৩০. বাংলা

৩০. বাংলা

মাঝে মাঝে মনে হয় আমার চেয়ে বেশি বাংলাকে কেউ ভালোবাসে না। বাংলাকে ভালোবেসে আমি ইউরোপ-আমেরিকা ত্যাগ করেছিলাম। এমন নয় যে ইউরোপ-আমেরিকায় আমি নিতান্তই এক নোবডি ছিলাম। তখন আমার বই ছাপাচ্ছে ইউরোপ আমেরিকার বড় বড় প্রকাশনী। তখন আমার দু’কথা শোনার জন্য লোকে টিকিট কেটে সেমিনারে যায়। তখন আমি খবরের কাগজের প্রথম পাতায়। তখন আমি নিরাপত্তা প্রহরী বেষ্টিত। এমন সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমাকে যেহেতু বাংলাদেশে ফিরতে দেওয়া হচ্ছে না, আমি পশ্চিম বঙ্গে বাস করবো। আমার সিদ্ধান্ত হয়তো ভুল ছিল, সিদ্ধান্তে আবেগ ছিল শতকরা নিরানব্বই ভাগ, আর যুক্তি ছিল এক ভাগ—সে আমি জানি। কিন্তু যে করেই হোক, আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করেছি। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একখানা ফেলোশিপ পেয়েছিলাম, সেটি শেষ করেই, ইউরোপ-আমেরিকাকে গুডবাই বলে আমি কলকাতায় বাস করতে শুরু করেছি। তখন, আশ্চর্য, যে বাঙালিরা আমার মাঝে মাঝে এসে কলকাতায় সপ্তাহ দু’সপ্তাহ থাকায় উচ্ছ্বসিত ছিল, তাদের অনেকে আর উচ্ছ্বসিত নয়। আমি তখন আর আকর্ষণীয় কিছু নই। আমি তখন তাদের মতোই গড়িয়াহাটে বাজার করা, তাদের মতোই কলেজ স্ট্রিটে হাঁটা, বা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়া পাশের বাড়ির কেউ। আমি তো পাশের বাড়ির কেউই হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে এড়িয়ে চলা তো চাইনি, আমাকে একঘরে করা তো চাইনি। বাংলাকে ভালোবেসে কলকাতায় এসে বাস করাটা অনেকের কাছে বোকামো মনে হয়েছে। ঘরবাড়ি ছিল প্যারিসে, প্যারিস থেকে হার্ভার্ডে গিয়ে ফেলোশিপ করছি, এ শুনে আমার কাছে আসতে যাদের আনন্দ হত, তাদের অনেকের আনন্দই দেখেছি নিভে গেছে যখন আমি তাদের মতো কেউ হয়ে গেলাম। আমার জনপ্রিয়তা রাতারাতি কমে গেল। তাই বলে বাংলা এবং বাংলা ভাষা থেকে আমার ভালোবাসা কিন্তু উবে যায়নি। আমি আরও আঁকড়ে রইলাম বাংলাকে। বাংলা থেকে নষ্ট রাজনীতি আমাকে চিরবিদেয় দিয়ে দেওয়ার পরও।

লক্ষ করেছি ব্যক্তি নয়, তার ব্যক্তিত্ব নয়, তার ভাবনাচিন্তা নয়, সে কোথায় বাস করে, তার ওপর তাকে শ্রদ্ধা করাটা নির্ভর করে। ইউরোপ আমেরিকার কথা বাদ দিচ্ছি। কলকাতার যে বাঙালি ব্যাঙ্গালোরে বা বোম্বেয় বাস করে, তাদের মূল্যটা বেশি। আবার ওদিকে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গঞ্জে যারা বাস করে, তাদের কাছে বড় শহরে অর্থাৎ কলকাতায় বাস করা মানুষের মূল্য বেশি। এ শুধু পশ্চিমবঙ্গের কাহিনী নয়, বাংলাদেশেরও একই কাহিনী। বাংলাদেশের প্রায় সবাই দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার জন্য অস্থির। আমেরিকাকে উঠতে বসতে গালি দিলেও আমেরিকায় বাস করার সুযোগ পেলে বাঙালি হাতে স্বর্গ পায়। বাংলা বাদ দিয়ে কেউ অন্য ভাষায় কথা বলতে পারলে তাকে বিদ্যান এবং বুদ্ধিমান বলে মনে করা হয়। তাই বলি, বাংলাকে খুব কম বাঙালিই ভালোবাসে। আমি না হয় বোকাই ছিলাম, বোকাই আছি। দুঃখ এ কারণে একফোঁটা নেই। ভারতবর্ষে বাস করাটা বিশাল এক চ্যালেঞ্জ। পায়ের তলায় মাটি বলতে কিছু নেই। তারপরও বাংলা যে দেশের অনেক ভাষার একটি, সে দেশকে দেশ বলে মনে হয় বলে বাস করি। এও হয়তো বোকামো। ওই যে বললাম বোকাই ছিলাম, বোকাই আছি, এতে দুঃখ নেই।

৩ ১. দলিত সাহিত্য

একবার ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের রেস্তোরাঁয় বসে খাচ্ছি। হঠাৎ একদল নারী পুরুষ আমাকে দেখে ছুটে এলেন, কী, আমার সঙ্গে ফটো তুলবেন। নিজেরাই বললেন তাঁরা দলিত সাহিত্যিক। সাহিত্য অ্যাকাডেমিতে দলিত সাহিত্যের ওপর একটি অনুষ্ঠান ছিল, কিছু দলিত সাহিত্যিক পুরস্কার পেয়েছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম দলিত সাহিত্য মানে কী? আপনারা দলিতদের নিয়ে লেখেন, নাকি আপনারা দলিত? ওঁরা বললেন, ওঁরা দলিত। মনে হচ্ছিল, দলিত বলে ওঁদের আনন্দ হচ্ছে, কারণ দলিত বলেই সাহিত্য অ্যাকাডেমিতে আমন্ত্রিত হওয়ার, পুরস্কার পাওয়ার সুযোগ ওঁরা পেয়েছেন। ওঁরা নিজেদের টেবিলে ফিরে যাওয়ার পর আমি ভাবতে বসলাম দলিত সাহিত্য, দলিত সাহিত্যিক এ কেমন জিনিস, দলিতদের মূলস্রোতের সাহিত্য থেকে আলাদা করে দেওয়া হচ্ছে। এককালে বাংলার কিছু মুসলমান ‘মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা’ প্রকাশ করতেন। সেটিও ছিল চরম বিদঘুটে। সাহিত্য অ্যাকাডেমির পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে ভারতবর্ষের সব ভাষা, এমনকি অসংখ্য ছোট ছোট প্রায়-মৃত ভাষার সাহিত্যিকদের পুরস্কৃত করা হয়, সেটি, আমি মনে করি, ভাষাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ভালো উদ্যোগ। কিন্তু দলিত সাহিত্যিকদের আলাদা করলে ব্রাহ্মণ সাহিত্যিক, কায়স্থ সাহিত্যিক, বৈদ্য সাহিত্যিকদেরও আলাদা করতে হয়! শুনেছি দলিতরা দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমির দাবি করছেন। অথবা দলিতদের ভোট পাওয়ার জন্য দলিতদের সাহিত্য অ্যাকাডেমি গড়ে দিতে চাইছেন ধুরন্ধর রাজনীতিক। দলিত অ্যাকাডেমি যদি গড়ে তোলা পলিটিক্যালি কারেক্ট, তবে বিভিন্ন গোষ্ঠীর জন্য আলাদা অ্যাকাডেমি গড়ে তোলাও পলিটিক্যালি কারেক্ট। কারণ বিভিন্ন গোষ্ঠীও তাঁদের বঞ্চনার কিছু না কিছু কাহিনী সামনে আনতে পারেন। এ কথা ঠিক দলিতদের শিক্ষা থেকে দীর্ঘকাল বঞ্চিত করা হয়েছে, সাহিত্য রচনায় তাঁরা হয়তো পিছিয়ে আছেন, কিন্তু তাঁদের সাহিত্যকে দলিত সাহিত্য বলে যেন উপেক্ষা না করা হয়, সেটি দেখার দায়িত্ব সাহিত্য অ্যাকাডেমির। আলাদা অ্যাকাডেমি হলেই যে সাহিত্যের মান বাড়বে তা তো নয়। আলাদা অ্যাকাডেমি গড়ার পেছনে যত না সাহিত্যিক কারণ, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক কারণ।

সাহিত্যের বিচার সাহিত্য দিয়েই হওয়া উচিত। সাহিত্যকে দলিত সাহিত্য, মুসলিম সাহিত্য, শূদ্র সাহিত্য, বা উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত সাহিত্যে, নারী এবং পুরুষ সাহিত্যে ভাগ করলে শুধু সাহিত্যিকদের অপমান নয়, সাহিত্যেরও অপমান। ভাগের কোনও শেষ নেই। বড় গোষ্ঠী থেকে ছোট গোষ্ঠী, ছোট থেকে ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর—ভাগ হতেই থাকবে। তার চেয়ে সব বিভেদকে দূরে সরিয়ে এক হয়ে যাওয়া ভালো। সাহিত্য শিল্পের ক্ষেত্রেই তো বিভেদের কোনও স্থান নেই। জাতপ্রথা নিষিদ্ধ হলেও এই প্রথা মানার লোকের অভাব নেই সমাজে। সমাজকে সুস্থ সুন্দর করার দায়িত্ব তো কিছুটা সাহিত্যিকেরও। জাতপ্রথার ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষকে যুগ যুগ ধরে সাহিত্যিকরাই সচেতন করেছেন। সাহিত্যিকদের একটিই পরিচয়, তাঁরা সাহিত্যিক। দলিতদের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা নিয়েই বলছি এভাবে সাহিত্যকে গোষ্ঠীভুক্ত করা অনুচিত। সাহিত্য হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান, তথাকথিত ছোটজাত বড়জাত, মুসলমান, নাস্তিক, ধনী গরিব, কালো সাদা বাদামি, নারী পুরুষ যে-ই লিখুন না কেন, যে ভাষাতেই লিখুন না কেন, তাকে ‘সাহিত্য’ হিসেবে দেখতে হবে। নামদেও ধাসাল, অরুণ কুম্বলে, মীনা কান্দাসামি, উর্মিলা পাওয়ার, বাবুরাও বাগুলদের আমরা ‘দলিত লেখক’ বলি না, আমরা তাঁদের ‘লেখক’ বলি। মেয়েদের লেখা সাহিত্যকেও মূলস্রোতের সাহিত্য থেকে পৃথক করার পুরুষতান্ত্রিক ষড়যন্ত্র আমরা দেখেছি। ভার্জিনিয়া উলফ, টনি মরিসন, মার্গারেট এটউড, এলিস ওয়াকার এঁদের আমরা ‘লেখক’ বলি, ‘মহিলা লেখক’ বলি না।

৩২. মৌলবাদী

বাংলাদেশের মৌলবাদীরা দুই ধরনের। এক ধরনের মৌলবাদী মাদ্রাসায় পড়েছে, পাঁচ বেলা মসজিদে যায়, কপালে নামাজের কালো দাগ তাদের, তারা ৩০টা রোজা রাখে, গোঁফ কামায় দাড়ি রাখে, মাথায় টুপি পরে, টাকনুর ওপর পাজামা পরে। মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, ওয়াজের হুজুর, মাদক পাচারকারী ইত্যাদি নানা পেশায় তারা জড়িত। তারা তাদের পুত্রদের মাদ্রাসায় পাঠায়, কন্যাদের বোরখা পরায়, অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেয়।

আরেক ধরনের মৌলবাদী সার্ট প্যান্ট জুতো মোজা পরে, দেশ বিদেশ ঘোরে, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। বড় বড় ব্যবসা বা চাকরি করে, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক স্থপতি মন্ত্রী কী নয় তারা!

এই দুই ধরনের মৌলবাদীর বেশভূষা, লাইফস্টাইল আলাদা হলেও তাদের বিশ্বাস এক। তারা বিশ্বাস করে ইসলাম জগতের শ্রেষ্ঠ ধর্ম। বিশ্বাস করে ইহুদি খ্রিস্টান হিন্দু বৌদ্ধ সক্কলে ইসলামকে ধবংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বিশ্বাস করে মুসলমান মেয়েদের হিজাব বোরখা পরা উচিত, যদি ইস্কুল কলেজে যেতেই হয়, অফিস আদালতে যেতেই হয়, হিজাব বোরখা পরেই যাবে, এমন কী ডাক্তারি মোক্তারি যদি করতেই হয়, হিজাব বোরখা পরেই করবে, হিজাব বোরখা পরেই ক্রিকেট খেলবে, সাঁতার কাটবে, এভারেস্টে উঠবে।

প্রগতিশীল বলে বাংলাদেশে যারা ছিল, তাদের অধিকাংশের মৃত্যু হয়েছে, অবশিষ্টরা মৌলবাদে কনভার্ট করে গেছে।

৩৩. ইলিশ

দুর্গাপূজা উপলক্ষে বাংলাদেশ ১৪৭৫ টন ইলিশ পাঠাচ্ছে পশ্চিমবাংলায়। জেসচার অব গুডউইল! জানতে চাইছি, আমরা যারা কলকাতার বাইরে বাস করতে বাধ্য হচ্ছি, তারা কি পদ্মার ইলিশের স্বাদ পাবো এ বছর? কত যে গুজরাটের ইলিশকে পদ্মার ইলিশ ভেবে খেয়েছি, আর ওয়াক করেছি! তা বাংলাদেশের সরকার, এত যে সেক্যুলার সেক্যুলার একখানা ভাব দেখাচ্ছ বছর বছর দেশের বাইরের দুর্গাপূজায় ইলিশ পাঠিয়ে, দেশের দুর্গা মূর্তিগুলো যে বছর বছর ভাঙচুর হয়, সেটি ঠেকানার চেষ্টা করো কি? সংবিধান থেকে রাষ্ট্র ধর্মটি বাদ না দিলে কিন্তু সত্যিকার সেক্যুলার হওয়ার কোনও পথই খোলা নেই। জেনেও না জানার ভান আর কতদিন?

৩৪. মুসলিম উম্মাহ

মুসলিম ব্রাদারহুড, মুসলিম উম্মাহ তো ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন মুসলমানের শত্তুর ইজরাইলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফেললো। জর্দান আর মিশর তো আগেই মিলিয়েছে। সৌদি আরবের সঙ্গে ইজরাইলের মাখামাখি অনেকদিনের। রইলো বাকি কোন দেশ? তুরস্ক আর ইরান এখনও শত্রুপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। আসলে ধর্মের মিল দিয়ে কিছু দিন সম্পর্ক ধরে রাখা যায়, বেশিদিন যায় না। রাজনীতি অর্থনীতি সমাজের রীতিনীতি গণতন্ত্র মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে মতের মিলই আসল। সব না হলেও কিছুটা মিলে গেলে কে কোন দেবতার পায়ে নিভৃতে মাথা ঠেকালো তা কেউ দেখে না। ধর্মীয় বন্ধুত্ব অর্থনৈতিক বন্ধুত্বের কাছে হার মেনে যায়। মুসলিম-পাকিস্তানের সঙ্গে অমুসলিম-চীনের বন্ধুত্ব অটুট যদিও চীন উইঘুর মুসলিমদের অত্যাচার করছে। রাজনীতি আর অর্থনীতির সামনে ধর্ম যদি এতই জবুথবু, তবে ধর্ম কেন টিকে আছে আজও? টিকে আছে ধর্মকে রাজনীতির একটা অংশ করা হয়েছে বলেই। রাজনীতির শরীর থেকে ধর্মকে ঝেড়ে ফেললে ধর্মের অস্তিত্ব অচিরে বিলীন হতে বাধ্য।

৩৫. সমাজ নষ্ট হয় বুদ্ধিজীবীরা নষ্ট হলে

বোরখার সমালোচনা করেছি সাতের দশকে, ঘরে বাইরে আন্দোলন করেছি। বোরখার বিরুদ্ধে আটের দশক থেকে লিখছি। ২০১০ সালে বোরখা নিয়ে আমার একটি লেখার কারণে মুসলমান মৌলবাদীরা দাঙ্গা বাঁধিয়েছে কর্ণাটকে। আগুনে পুড়িয়েছে বাস ট্রাক দোকানপাট, ভাঙচুর করেছে পত্রিকা অফিস, দু’জনের মৃত্যুও হয়েছে। বোরখার নিন্দে করলে কী ভয়ানক কাণ্ড ঘটে যেতে পারে, তা প্রত্যক্ষ করেছি। বোরখা সম্পর্কে আমার অগুনতি রচনা পড়ে কারও কারও চক্ষু খুলেছে। কিন্তু সে তো হাতে গোনা। অগুনতি মেয়ে আজকাল বোরখায় শরীর মুড়িয়েছে। আজ আমি বোরখা নিয়ে মন্তব্য করার বদলে প্রশ্ন করতে চাই বাংলাদেশের মেয়েরা কেন বোরখা পরছে, দোষ কার? বাংলাদেশে হাট মাঠ ঘাট দখল করে নিয়েছে ধর্ম ব্যবসায়ীরা, দোষ কার? বাংলাদেশের ইস্কুল কলেজ অফিস আদালত দখল করে নিয়েছে কূপমণ্ডূক ধার্মিকেরা, দোষ কার? বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল, প্রচারমাধ্যম, সংগঠন সংস্থা দখল করে নিয়েছে মৌলবাদীরা, দোষ কার? দোষ কী ধর্মের? ধর্ম একটা আইডিওলজি। আইডিওলজির কোনও দোষ নেই, একে না মানলেই এ মরে যায়। সরকারের দোষ? সরকার পালের হাওয়া যেদিকে, সেদিকেই নাও ভাসায়। সরকারেরও দোষ ততটা নয়। দোষ তাহলে কার? দোষ বুদ্ধিজীবীদের। কারণ বুদ্ধিজীবীরা জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন। ছেড়ে দিয়েছে বলেই হাট মাঠ ঘাট দখল করেছে সমাজের শত্রুরা। যেখানে বুদ্ধিজীবী এবং শিল্পী সাহিত্যিকদের নাটক থিয়েটার নৃত্য আবৃত্তি সংগীত পালাগান করার কথা, মুক্তবুদ্ধি আর মানবাধিকার বিষয়ে যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করার কথা, মানুষকে সভ্য শিক্ষিত সচেতন করার কথা, সেখানে আজ ধর্ম ব্যবসায়ীরা নারী-বিরোধী ওয়াজ শুনিয়ে মানুষের মগজ ধোলাই করে। বুদ্ধিজীবীদের যেখানে ইস্কুল কলেজ অফিস আদালতকে ধর্ম থেকে দূরে রাখার কথা, সেখানে ধর্ম ব্যবসায়ীরা মসজিদ মাদ্রাসা খুলে ছেলেমেয়েদের মগজ ধোলাই করে। কী করেছেন বুদ্ধিজীবীরা এতকাল? কী আর করেছেন? ক্ষমতাসীনদের পেছনে দৌড়েছেন, এই পুরস্কার ওই সুবিধে বাগিয়েছেন আর আখের গুছিয়েছেন। সমাজ উচ্ছন্নে গেলে তাঁদের কিচ্ছু যায় আসেনা। এই যে দল সংগঠনগুলো নিরবধি ধর্মের নাম জপছে, কেন? বুদ্ধিজীবীরা মুখ বুজে থেকে এই সর্বনাশটি হতে দিয়েছেন।

আমি আগেও বলেছি, আজও বলছি, মৌলবাদীরা ধর্মের ব্যবসা করে আসছে, করবে। এটাই তাদের পেশা। রাজনীতিকরাও স্বার্থান্ধ। সরকার তো নিতান্তই চোর গুণ্ডার সমষ্টি। এরা নষ্টই, এরা নষ্ট হলে সমাজ নষ্ট হয় না। কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা নষ্ট হলে সমাজ নষ্ট হয়। বাংলাদেশের সমাজ আজ নষ্ট সমাজ। সম্পূর্ণই বুদ্ধিজীবীদের কারণে।

৩৬. অক্ষয়ের মূত্রপান

বলিউড তারকা অক্ষয় কুমার সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। খুব ফিট যাকে বলে। অক্ষয় কুমার জানিয়েছেন তিনি প্রতিদিন গোমূত্র পান করেন। আয়ুর্বেদ শাস্ত্র থেকেই প্রেরণা পেয়েছেন, জানিয়েছেন। আয়ুর্বেদ ১০০০ বছর আগের প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি। আয়ুর্বেদে গোমূত্রের উপকারিতার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে গরু যখন মাঠে খায়, তখন স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী নানারকম লতা পাতা খায়। সেগুলো কিছুটা তো প্রস্রাবে পাওয়া যায়ই। গর্ভবতী গাভীর প্রস্রাবেও হরমোন এবং খনিজ দুই-ই পাওয়া যায়। মিনারেল বা খনিজ পদার্থ মানুষের শরীরে থাকা দরকার, সে কারণেই গোমূত্র পান করলেই শরীরে খনিজের অভাব দূর হয়, পুষ্টি যা দরকার, তাও গোমূত্রেই মেলে। আয়ুর্বেদ বলছে, সকালে খালি পেটে গোমূত্র পান করলে বিভিন্ন অসুখ সেরে যায়, এর মধ্যে আছে কুষ্ঠ রোগ, ডায়বেটিস, টিউমার, যক্ষা, পেটের অসুখ বিসুখ, ক্যান্সার। আয়ুর্বেদ আরও দাবি করছে গোমূত্র যদি কালো নুন, দই এবং ঘি’র সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া হয়, তাহলে জ্বর সারে। রক্তশূন্যতা সারানোর ওষুধ ত্রিফলা, গোমূত্র আর গরুর দুধ। আয়ুর্বেদ আরও বলছে, যে, গোমূত্র শরীরের ভেতরের সব টক্সিন বের করে দেয়, সুতরাং কোনও ক্রনিক অসুখের ঝুঁকি থাকে না। তাছাড়া গোমূত্র দিয়ে সাবান আর শ্যাম্পুও তৈরি করা যায়। এসব আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের দাবি।

কিন্তু বিজ্ঞান কী বলছে? বলছে আয়ুর্বেদের দাবিগুলোর কোনও প্রমাণ মেলেনি। বলছে গোমূত্রে সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্রিয়েটিনিন, ফসফরাস, এপিথেলিয়াল সেল পাওয়া যায়, কিন্তু গোমূত্র মানুষের অসুখ বিসুখ সারায় না। খনিজ থাকার ফলে গোমূত্র মাটির জন্য উপকারী হতে পারে, কিন্তু মানুষের জন্য নয়।

অক্ষয় কুমারের গোমূত্রে বিশ্বাস। তাঁর ভক্তকুল ইতিমধ্যে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে অক্ষয়ের সুস্বাস্থ্যের কারণ গোমূত্র। আসলে তাঁর সুস্বাস্থ্যের পেছনে আছে তাঁর ভালো জিন, ভালো এক্সারসাইজ, ভালো ডায়েট। কিন্তু ক্রেডিট যাচ্ছে গোমূত্রে। কিছু লোক উটের প্রস্রাবও পান করে, তাদের বিশ্বাস ওই প্রস্রাব তাদের রোগ সারাবে। এ আমরা দেখে অভ্যস্ত যে, ডাক্তার রোগ সারাবার পর সব ক্রেডিট মানুষ দেয় ঈশ্বর, ভগবান, আল্লাহকে। খুব সম্ভবত ঈশ্বর, ভগবান, আল্লাহর অস্তিত্ব নেই, কারণ তাদের অস্তিত্বের আজও কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

মানুষ সর্বগুণে গুণান্বিত নয়। কারও একদিকে বুদ্ধি খেলে, আরেকদিকে খেলে না। যেদিকে বিশ্বাস আছে, সেদিকে সাধারণত বুদ্ধির ছিটেফোঁটা দেখতে পাওয়া যায় না। তারপরও যুক্তিবুদ্ধিহীনবিশ্বাস জিনিসটা আদিকাল থেকেই আছে। হয়তো আরও বহু শতাব্দী থাকবে।

৩৭. ধর্ম

সব ধর্মের জন্মই অদ্ভুত। সব নবীকে গপ্প ফাঁদতে হয়েছে। মুসাকে বলতে হয়েছে উনি নদী ভাগ করে পথ বানিয়েছেন মিশর থেকে হিব্রু ক্রীতদাসদের ইজরাইলে নিয়ে আসার জন্য। পাহাড়ের ওপর তাঁর হাতে পাথর দিয়ে গেছেন ঈশ্বর, সেই পাথরে লেখা ১০ খানা আদেশনামা। ইহুদি যুবক যীশুকে জেরুজালেমের রাস্তায় আমি নবী আমি ঈশ্বর বলে চেঁচাতে হয়েছে,বহুঈশ্বরবাদী রোমানদের মন্দির ভাঙার চেষ্টা করলে সন্ত্রাসী হিসেবে তাঁকে শাস্তি দেওয়া হল, কাঠের ওপর পেরেক মেরে মৃত্যু হওয়া অবধি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল শরীর, এভাবেই অপরাধীদের তখন শাস্তি দিত রোমানরা। সব পাগলেরই শিষ্য জোটে, যীশুরও জুটেছিল কিছু, শিষ্যরাই বানিয়ে বানিয়ে নানারকম অলৌকিক ভূতের গপ্প ব’লে ব’লে আর যাদু দেখিয়ে দেখিয়ে, মানুষকে দলে টেনেছে। মরে যাওয়ার ৩ দিন পর নাকি যীশু কবর থেকে উঠে আকাশে চলে গেছেন এরকম কত গপ্প। আর মুহম্মদকে বলতে হয়েছে উনিই ‘শেষ নবী’, ওঁর বুক পেট চিরে ভেতরে যা কিছু ছিল ধুয়ে শুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে, ওঁর কানে নানা কিছু নিয়ে ফিসফিস করে বলার জন্য দো জাহানের মালিক স্বর্গ থেকে মর্ত্যে দূত পাঠাতেন। মুহম্মদও একদিন ডানাওয়ালা ঘোড়ায় চড়ে সাত আসমানে বসা সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে দেখা করে এসেছেন।

মাঝে মাঝে মনে হয় কী হত যদি রোমের সম্রাট কন্সটেন্টিন খ্রিস্টান না হতেন আর সাম্রাজ্যের সবাইকে ভয় দেখিয়ে রক্ত ঝরিয়ে জবরদস্তি খ্রিস্টান না বানাতেন!! কী হত যদি দেশে দেশে মানুষকে ধর্মান্তরিত না করতেন মুহম্মদের শিষ্যরা? তাহলে তিন ধর্মই মধ্যপ্রাচ্যের লোকাল ধর্ম হিসেবেই রয়ে যেত। আর দুনিয়ার মানুষ বিচিত্র সব বহুঈশ্বরবাদ নিয়ে আগে যেমন ছিল, তেমনই থেকে যেত। কী ফারাক একেশ্বরে আর বহুঈশ্বরে? দুটোতেই মিথ্যে গল্পের ছড়াছড়ি। দুটোই মানুষকে ভয় দেখায়, লোভ দেখায়।

কুসংস্কার থেকে, মিথ্যে থেকে যারাই দূরে সরাতে পারে নিজেকে, তারাই বুদ্ধিমান। ধর্ম কখনও পালটায় না, যেখানে আছে সেখানে থাকে। মানুষ পালটায়। বিবর্তন ঘটে মানুষের। আধুনিক হয় মানুষ।

৩৮. মসজিদ

বাংলাদেশের এক মসজিদের ভেতর শীতাতপনিয়ন্ত্রক যন্ত্রে বিস্ফোরণ ঘটেছে। মূলত গ্যাস পাইপলাইনের ওপর নির্মিত মসজিদটির ভেতর পাইপ ফেটে গ্যাস ঢুকে বিস্ফোরণটি ঘটায়। এর ফলে ২৩ জন মরেছে, প্রচুর আহত হয়েছে। বড় দুঃখজনক সংবাদ। কিন্তু প্রশ্ন হল, গ্যাস পাইপলাইনের ওপর কেন মসজিদ বানানো হল? এই ভয়ংকর অপরাধটি করতে কেউ কি অনুমতি দিয়েছে? অনুমান করছি কেউ দেয়নি অনুমতি। মুশকিল হল, অবৈধ কার্যকলাপের জন্য আল্লাহর অনুমতি ছাড়া মোল্লা মুফতিগুলো আর কারো অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না।

দ্বিতীয় প্রশ্ন, মসজিদে এসি কেন থাকে? শুনেছি রাজদরবারের মতো দেখতে একেকটা মসজিদ, ঝাড়বাতিও হয়তো ঝোলে। একাধিক শীতাতপনিয়ন্ত্রক যন্ত্র মসজিদে। মুসলমানরা শুনেছি শেষ নবীর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। তাঁর মতো জোব্বা পরেন, দাড়ি রাখেন, দাড়িতে মেহেদি লাগান, চোখে সুর্মা পরেন, নিমের দাঁতন দিয়ে মেসওয়াক করেন, একাধিক বিয়ে করেন। শেষ নবী কি তাঁর গরম-দেশে এসির আরামে নামাজ পড়তেন? নিশ্চয়ই না। তখনও তো ইহুদি- ক্রিশ্চানরা এসি আবিষ্কার করেনি। নবীর উম্মতদের এখন এসি ছাড়া, গাড়ি ছাড়া, টেলিভিশন ছাড়া, কম্পিউটার ছাড়া, মোবাইল ফোন ছাড়া চলে না। অথচ শেষ নবীর একখানা কম্বল ছিল সম্বল। পদাঙ্ক অনুসরণ করো তো ঠিকঠাক অনুসরণ করো। ইহুদি-খ্রিস্টানদের আবিষ্কৃত জিনিসপত্রের ওপর লোভ সংবরণ করো। ১৪০০ বছর আগের আইন এবং রীতিনীতি রিচুয়াল মেনে চলতে পারো তাহলে তখনকার সাদাসিধে জীবন কেন মেনে চলতে পারো না? শেষ নবী তো বারবারই বাহুল্য বর্জন করতে বলেছেন। তাঁর উপদেশ মেনে না চললে কেমন উম্মত!

অনেক মসজিদ অবৈধ ভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। ব্যস্ত রাজপথের ওপর, অন্যের জমির ওপর, গ্যাস পাইপলাইনের ওপর। পাইপ ফেটে গ্যাস বেরিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানোর আশঙ্কা আছে জানার পরও মসজিদ বানানো বন্ধ হয়নি। জনগণ বাধা দিতে ভয় পায়, কারণ ধার্মিকরা আজকাল সন্ত্রাসীতে রূপ নিয়েছে। সরকারও বাধা দেয় না, সম্ভবত সরকারও ভয় পায় অথবা ধার্মিক সাজার ভান করে। অনেক মসজিদেরই বিদ্যুৎ বিল মেটানো হয় না কোনওকালেই। অনেক মসজিদই অবৈধ কাজকর্মের আখড়া। খুন ধর্ষণ মাদক ব্যবসা কী না হয় মসজিদে! মসজিদ বলেই এর ভেতরে ঘটা সাত খুন মাফ।

আগুন যদি আজ আশেপাশের দোকানপাটে বাড়িঘরে লাগতো, কিন্তু মসজিদে না লাগতো, তাহলে বলা হত মসজিদে আগুন লাগেনি, কারণ আল্লাহ মসজিদকে রক্ষা করেছেন। আর এখন আশেপাশের দোকানপাটে বাড়িঘরে আগুন লাগেনি, লেগেছে শুধু মসজিদে। তাহলে কী বলা যাবে? আল্লাহ সবাইকে রক্ষা করেছেন, শুধু মসজিদকে করেননি। আল্লাহ সদা সর্বদা মসজিদ রক্ষা করবেন, এরকম ভাবা ঠিক নয়।

যে মসজিদ অবৈধ জমির ওপর, যে মসজিদের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করা হয় না, যে মসজিদের ভেতর আইনবিরোধী কর্মকাণ্ড চলে, সেইসব মসজিদ বন্ধ করে দেওয়া হোক। এই সরকার কোনও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী রাখেনি,ক্ষমতা হারানোর ভয় নেই, সমালোচক নিন্দুকদের মুখও সেলাই করে দিয়েছে, তাহলে যারা অপরাধী, সন্ত্রাসী, যারা দেশের সর্বনাশ করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এত দ্বিধা কেন? এর একটিই উত্তর হতে পারে, সরকারও হয়তো ওই মৌলবাদী ধর্ম ব্যবসায়ীদের মতোই, দেশের সর্বনাশ চায়।

৩৯. খবর আছিল

দুনিয়ার বেশিরভাগ মুসলমান আরবি বোঝে না। তারা কোরান মুখস্থ করে অর্থ না বুইঝা। অর্থ না বোঝাডা যে কত ভালো। বুঝলে খবর আছিল। সব আইসিসে নাম লেখাইত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *