৩০. প্লতিনস
প্লতিনস (২০৪-২৭০ খ্রিষ্টাব্দ) ছিলেন নবপ্নাতনবাদের প্রবর্তক এবং প্রাচীনকালের মহান দার্শনিকদের শেষ প্রতিনিধি। রোমক ইতিহাসের সবচাইতে বিপদসঙ্কুল যুগ এবং তার জীবন সহ-অস্তিত্বশীল। তার জন্মের কিছুদিন আগে সৈন্যবাহিনী নিজেদের ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন হয় এবং আর্থিক পুরস্কারের বিনিময়ে সম্রাট নির্বাচনের রীহিণ করে এবং আবার সাম্রাজ্য বিক্রি করার সুযোগের জন্য পরবর্তীকালে সম্রাটদের হত্যা করে। এগুলোই সর্বাগ্রে করণীয় কর্ম হওয়ার ফলে সৈন্যবাহিনী সীমান্তরক্ষায় সম্পূর্ণ অপটু হয়ে পড়ে এবং উত্তর দিক থেকে জার্মানদেরও পূর্বদিক থেকে পারসিকদের শক্তিশালী অভিযানে বাধা দিতে অপারগ হয়। যুদ্ধ ও মহামারীর ফলে সাম্রাজ্যের জনসংখ্যা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস পায়, অন্যদিকে করের বর্ধিত হার ও সম্পদ হ্রাসের ফলে যে সমস্ত প্রদেশ শত্রুরা আক্রমণ করেনি সেই সমস্ত প্রদেশের আর্থিক সর্বনাশ হয়। যে নগরগুলো ছিল সংস্কৃতির ধারক ও বাহক বিশেষ করে সেই নগরগুলোই পেল কঠিন আঘাত, কর সংগ্রাহকদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিরাট সংখ্যক অবস্থাপন্ন নাগরিকরা পালিয়ে যেতে থাকেন। প্লতিনসের মৃত্যুর পর শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং দিঅক্ৰেতিয়ান এবং কনস্তান্তিনের সক্রিয় প্রচেষ্টার ফলে সাম্রাজ্য সাময়িকভাবে রক্ষা পায়।
এই সমস্ত ঘটনা সম্পর্কে প্লতিনসের লেখায় কোনো উল্লেখ নেই। বাস্তব জগতের ধ্বংস ও দুঃখের দৃশ্য থেকে পেছন ফিরে তিনি উত্তম ও সৌন্দর্যের চিরন্তন জগৎ সম্পর্কে চিন্তা করেছেন। এ ব্যাপারে তখনকার দিনের সর্বাপেক্ষা ঐকান্তিক মানুষদের সঙ্গে তাঁর ঐকতান ছিল। খ্রিস্টান ও পৌত্তলিক নির্বিশেষে কেউই ব্যবহারিক জগতে কোনো আশা দেখতে পাননি এবং তাঁদের কাছে শুধুমাত্র পরলোকই আনুগত্যের উপযুক্ত বলে মনে হতো। খ্রিস্টানদের কাছে পরলোক ছিল স্বর্গরাজ্য, সে রাজ্য ভোগ করা যাবে মৃত্যুর পর। প্লাতনীয়দের কাছে সেটা ছিল কল্পনের চিরন্তন জগৎ, সেটাই বাস্তব জগৎ–সে জগৎ, অলীক প্রকাশ্য জগৎ নয়। খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ববিদরা এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয় করেছিলেন এবং তিনসের দর্শনের অনেক অংশকে মূর্ত করেছিলেন। খ্রিস্টীয় ধর্ম তিনসের কাছে কী ঋণে ঋণী ডিন ইঙ্গে প্লতিনসের উপর তাঁর অমূল্য পুস্তকে তা সঠিক দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন। তিনি বলেন, খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বের কাঠামোর অপরিহার্য অংশ প্লাতনবাদ, এই ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে অন্য কোনো দর্শন-আমি নির্ভয়ে বলছি- বিনা দ্বন্দ্বে কাজ করতে পারে না। তিনি বলেছেন, খ্রিস্টীয় মতবাদকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো না করে সে মতবাদ থেকে প্লাতনবাদকে বিচ্ছিন্ন করা একেবারেই অসম্ভব। তিনি দেখিয়েছেন-সেন্ট অগস্তিন বলেছেন সমস্ত দার্শনিক তন্তুই সবচাইতে শুদ্ধ ও উজ্জ্বল এবং প্লতিনস সম্পর্কে বলেছেন-তিনি এমন একজন মানুষ যার ভিতরে প্লাতন আবার জীবন ধারণ করেছেন এবং তিনি যদি আর কিছুকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকতেন তাহলে তিনি কয়েকটি শব্দ কিংবা ভাবপ্রকাশকে শব্দসমষ্টি পরিবর্তন করে খ্রিস্টান হয়ে যেতেন। ডিন ইঙ্গে-র কথা অনুসারে সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাস বাস্তব আরিস্ততেলেসের চাইতে প্লতিনসের নিকটতর।
সুতরাং মধ্যযুগের খ্রিস্টধর্ম ও ক্যাথলিক ধর্মতত্ত্ব নির্মাণের প্রভাবরূপে প্রতিনস ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে বলবার সময় এর যে সমস্ত বিরাট পরিবর্তন হয়েছে ঐতিহাসিককে সেগুলো সযত্নে শনাক্ত করতে হবে এবং এমনকি একটি যুগেও যে তার নানা রূপ হতে পারে, শনাক্ত করতে হবে সে তথ্যও। সিনপটিক গপেল (Synoptic Gospel)-মার্ক, ম্যাথু ও লুক লিখিত সুসমাচার) ভিত্তিক খ্রিস্টধর্মে প্রায় কোনো অধিবিদ্যা নেই বললেই চলে। এই দিক দিয়ে আধুনিক আমেরিকার খ্রিস্টধর্ম অনেকটা আদিম খ্রিস্টধর্মের মতো। সাধারণ মানুষের চিন্তন ও বোধে প্লাতনবাদ আমেরিকাতে অপরিচিত এবং যখন পার্থিব সবকিছুই হতাশাজনক ছিল তখন যে অলৌকিক আশা সান্ত্বনার প্রলেপ দিত তাতে ব্যাপৃত থাকার চেয়ে অধিকাংশ আমেরিকান খ্রিস্টানই এই পৃথিবীতে কর্তব্য নিয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত এবং ব্যস্ত দৈনন্দিন জগতের সামাজিক অগ্রগতি নিয়ে। আমি ধর্মীয় গোঁড়ামি পরিবর্তনের কথা বলছি না কিন্তু বলছি গুরুত্ব ও আকর্ষণের পার্থক্য বিষয়ে। একজন আধুনিক খ্রিস্টান এই পার্থক্যের বিশালত্ব যদি বুঝতে না পারেন তাহলে তিনি অতীতের খ্রিস্টধর্ম বুঝতে পারবেন না। যেহেতু আমাদের অধ্যয়ন ইতিহাস নিয়ে সেহেতু আমরা ব্যস্ত অতীত শতাব্দীগুলোর কার্যকর বিশ্বাসসমূহ নিয়ে এবং এগুলো সম্পর্কে প্লাতন ও প্লতিনসের প্রভাব বিষয়ে ডিন ইঙ্গে যা বলেছেন তার সঙ্গে অনৈক্য হওয়া অসম্ভব। প্লতিনস কিন্তু শুধুমাত্র ঐতিহাসিকভাবেই গুরুত্বপূর্ণ নন। তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধরনের তত্ত্বের প্রতীক এবং এ বিষয়ে তিনি যে কোনো দার্শনিকের চাইতে ভালো। নানা বিভিন্ন কারণে একটি দার্শনিক তন্ত্রকে গুরুত্বপূর্ণ বলা যেতে পারে। প্রথম ও স্পষ্টতম রূপে প্রতীয়মান কারণ হলো আমরা ভাবি এ তন্ত্র সত্যি হতে পারে। বর্তমান যুগের খুব বেশি দর্শনশাস্ত্রের ছাত্র প্লতিনস সম্পর্কে এরকম ভাববেন না। ডিন ইঙ্গে এ ব্যাপারে একটি দুর্লভ ব্যতিক্রম। কিন্তু অধিবিদ্যার যে গুণ সম্ভব সেটা শুধুমাত্র সত্যই নয়। এর সৌন্দর্য থাকতে পারে এবং প্লতিনসের ভিতরে নিশ্চিতভাবে তা আছে। কতগুলো অংশ আছে সেগুলো দান্তে র প্যারাডাইস (Paradise)-এর শেষ সর্গগুলোকে মনে করিয়ে দেয়, সাহিত্যে আর অন্য কিছুই মনে করায় না। প্রায়শই তাঁর মহিমাময় চিরন্তন বিশ্বের বিবরণ :
আমাদের সূক্ষ্ম কারুকাজের কল্পনায় উপস্থিত করি
শুদ্ধ মিলের সেই অচঞ্চল সুর।
হ্যাঁ, সে সুর বাজে নীলকান্তমণি রঙের সিংহাসনের সম্মুখে
বাজছে তার উদ্দেশ্যে-যিনি সেই সিংহাসনে আসীন।
তাছাড়া, একটি দর্শন গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, কারণ সেটা একটা বিশেষ মেজাজ কিংবা এক বিষয়ে অবস্থান মানুষ যা বিশ্বাস করে তা সুন্দরভাবে প্রকাশ করে। জটিলতাহীন আনন্দ এবং দুঃখ, দর্শনের বিষয়বস্তু নয় বরং সেগুলো সরলতার কবিতা কিংবা সংগীতের বিষয়বস্তু হতে পারে। আনন্দ ও দুঃখের সঙ্গে মহাবিশ্ব সম্পর্কিত চিন্তন শুধুমাত্র জন্ম দিতে পারে অধিবিদ্যক তত্ত্বগুলোর। একজন মানুষ আনন্দপূর্ণ দুঃখবাদী হতে পারে কিংবা হতে পারে বিষাদগ্রস্ত আশাবাদী। মনে হয় স্যামুয়েল বাটলার (Samuel Butler) প্রথমটির উদাহরণ হতে পারেন। প্রতিনস দ্বিতীয়টির একটি প্রশংসনীয় দৃষ্টান্ত। তাঁর জীবনকালে সুখের অভাবই প্রত্যক্ষ এবং জরুরি অথচ সুখ যদি বা প্রাপ্তিসাধ্য হয় তাহলে সে সুখ খুঁজতে হবে এমন বস্তু থেকে যা অনুভূতির জগৎ থেকে বহুদূরে। সেই সুখের ভিতরে সবসময়ই কষ্টকর প্রচেষ্টার একটা উপাদান থাকে, এ আনন্দ শিশুর সহজ আনন্দ থেকে অনেক আলাদা। এবং যেহেতু এ আনন্দ দৈনন্দিন জগৎ থেকে আহরিত নয় কিন্তু আহরিত চিন্তন ও কল্পন থেকে, তাই এই সুখ দাবি করে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জীবনকে ঘৃণা কিংবা অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা। সুতরাং যারা সহজাত সুখে সুখী তারা সেই ধরনের অধিবিদ্যক আশাবাদ আবিষ্কার করে না, যে আশাবাদ এক অতীন্দ্রিয় জগতের বাস্তবতায় বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল। মানুষের ভিতর যারা পার্থিব অর্থে ছিলেন অসুখী কিন্তু যারা তত্ত্বের জগতে উচ্চতর সুখ খুঁজে পেতে দৃঢ়সংকল্প-তাঁদের ভিতর প্লতিনসের স্থান খুবই উচ্চে।
তাছাড়া তাঁর শুদ্ধ বৌদ্ধিক গুণকে কোনোক্রমে অবজ্ঞা করা যায় না। অনেক ক্ষেত্রে তিনি প্লাতনের শিক্ষণকে শোধন করেছেন, যে ধরনের তত্ত্ব তিনি প্রচার করেছেন তাকে যতদূর সম্ভব সঙ্গতিপূর্ণভাবে বিকশিত করেছেন। অন্য অনেকে এই কর্মে তাঁর সহযোগী ছিলেন। বস্তুবাদের বিরুদ্ধে তাঁর যুক্তিগুলো উত্তম এবং দেহ ও আত্মার সম্পর্ক সম্বন্ধে তাঁর কল্পনের পুরোটাই প্লাতন কিংবা আরিস্ততেলেসের চাইতে স্পষ্ট।
স্পিনোজার মতো তাঁর এক ধরনের নৈতিক শুদ্ধতা এবং মহত্ত্ব আছে, যা মনে গভীর ছাপ ফেলে। তিনি সবসময়ই আন্তরিক, কখনোই তীক্ষ্ণভাষী কিংবা দোষদর্শী নন, নিয়ত চেষ্টা করেছেন-যা গুরুত্বপূর্ণ বলে বিশ্বাস করেন সে কথা যতটা সম্ভব সরলভাবে পাঠককে বলতে। তাত্ত্বিক দার্শনিক হিসেবে তাঁর সম্পর্কে যাই ভাবা যাক না কেন, মানুষ হিসেবে তাকে ভালো না বাসা অসম্ভব।
প্লতিনসের জীবনচরিত্র তাঁর বন্ধু ও শিষ্য পফুরি-র লেখা থেকে যতটুকু জানা সম্ভব ততটুকুই জানা আছে, পর্চুরি ছিলেন সেমীয় (Semite-বাইবেলোক্ত সেম থেকে উৎপন্ন ইহুদি, আরব ও সিরীয়দের বলা হয়-অনুবাদক), তার আসল নাম ছিল মালখস (Malchus)। যাই হোক, এই কাহিনিতে অনেক অলৌকিক উপাদান আছে, ফলে বইটির বিশ্বাসযোগ্য অংশে সম্পূর্ণ আস্থা স্থাপন করা মুশকিল।
প্লতিনসের মতে স্থান-কালে তাঁর রূপ গুরুত্বহীন এবং তিনি ইতিহাসে তার অস্তিত্বের কালে ঘটে যাওয়া আকস্মিক ঘটনাগুলো সম্পর্কে কিছু বলতে নারাজ ছিলেন। তবে তিনি বলেছিলেন তাঁর জন্ম মিশরে ও তরুণ বয়সে যে তিনি আলেকজান্দ্রিয়াতে লেখাপড়া করেছেন-এ তথ্য সুবিদিত। সেখানে তিনি ছিলেন ঊনচল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত ও সেখানে তাঁর শিক্ষক ছিলেন অ্যামোনিয়স সাক্কাস (Ammonius Saccas), একে প্রায়শই নবপ্নাতনবাদের প্রতিষ্ঠাতা মনে করা হয়। তারপর তিনি পারসিকদের বিরুদ্ধে সম্রাট তৃতীয় গর্ডিয়ান (Gordain III)-এর অভিযানে যোগদান করেন, জনশ্রুতি অনুযায়ী-তাঁর উদ্দেশ্য ছিল পূর্বদেশের ধর্মগুলো বিষয়ে অধ্যয়ন করা। সম্রাট তখনও ছিলেন তরুণ ও তাঁকে সৈন্যবাহিনী হত্যা করে-এটাই ছিল তখনকার দিনের রীতি। এই ঘটনা ঘটে ২৪৪ খ্রিস্টাব্দে মেসোপটেমিয়ার যুদ্ধের সময়। তখন প্লতিনস তাঁর প্রাচ্য পরিকল্পনা ত্যাগ করে রোমে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন, সেখানে অল্পদিনের ভিতরেই শিক্ষকতা আরম্ভ করেন। তাঁর শ্রোতাদের ভিতরে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন এবং তিনি সম্রাট গ্যাল্লিয়েনস (Gallienus)-এর আনুকূল্য লাভ করেন। একসময় তিনি কাম্পানিয়াতে (Campania) প্লাতনের রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা করেন এবং এই উদ্দেশ্যে প্লাতনোপলিস (Platonopolis) নামে একটি নতুন নগর নির্মাণের পরিকল্পনাও করেন। সম্রাট প্রথমে এই পরিকল্পনার অনুকূল ছিলেন কিন্তু শেষে তার অনুমতি প্রত্যাহার করেন। রোমের অত নিকটে একটা নতুন নগরের স্থান হওয়া সম্ভব-এরকম ব্যাপার অদ্ভুত মনে হতে পারে কিন্তু সম্ভবত ততদিনে ঐ অঞ্চল এখনকার মতো ম্যালেরিয়াপ্রবণ হয়ে পড়ে, আগে তা ছিল না। উনপঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি কিছুই লেখেননি কিন্তু তারপর তিনি প্রচুর লিখেছেন। তাঁর লেখাগুলোর সম্পাদনা ও বিন্যাস করেছিলেন পর্টুরি, তিনি ছিলেন প্লতিনসের চাইতেও বেশি পুথাগোরীয় এবং প্রতিনসকে বিশ্বস্তভাবে অনুসরণ করলে যতটা হতো নব্য প্লতনবাদী গোষ্ঠীকে তার চাইতেও বেশি অতিপ্রাকৃত মতবাদী করে তোলেন।
প্লাতনের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ছিল প্রতিনসের, প্লাতনকে সাধারণত উল্লেখ করেছেন তিনি (He) বলে। সাধারণভাবে আশীর্বাদধন্য প্রাচীনদের সম্মান করেছেন কিন্তু পরমাণুবাদীদের নয়। স্টোইক এবং এপিকুরীয়রা তখনও সক্রিয় হওয়ায় তাঁদের বিরোধিতা করা হয়েছে। স্টোইকদের বস্তুবাদের বিরোধিতা করা হয়েছে মাত্র, এপিকুরীয়দের বিরোধিতা করা হয়েছে তাদের দর্শনের প্রতিটি অংশের জন্য। যা মনে হয়, আরিস্ততেলেস তার চাইতে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন, এই ভুল বোঝার কারণ তাঁর কাছে প্রাপ্ত ঋণ অনেক সময়ই অস্বীকৃত থেকে গেছে। বহু ক্ষেত্রেই পার্মেনিদেসের প্রভাব অনুভব করা যায়।
প্লতিনসের প্লাতন বাস্তব প্লাতনের মতো জীবন্ত নন। ধারণাতত্ত্ব, ফয়েদ এবং রিপাবলিক-এর ষষ্ঠ খত্রে অতীন্দ্রিয়বাদী মতবাদগুলো ও সিম্পোসিয়াম (Symposium)-এ প্রেম সম্পর্কিত আলোচনা-এগুলোই প্লাতনের প্রায় সম্পূর্ণ পরিচয়-এনিয়াদস্ (Enneads-তিনসের বইগুলোর এই নাম)-এ যেরকম দেখা যায়। রাজনীতিতে আকর্ষণ, বিভিন্ন সদ্গুণের সংজ্ঞা অনুসন্ধান, গণিতশাস্ত্রে আনন্দ, ব্যক্তি সম্পর্কে নাটকীয় ও সহৃদয় স্নেহশীলতা এবং সবার উপরের প্লাতনের ক্রীড়াকৌতুক-এগুলো প্লতিনস-এ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। কার্লাইল (Carlyle) বলেছেন, জেরুজালেমে ইহুদিদের সঙ্গে (অর্থাৎ চিন্তনের সঙ্গে) প্রাতন খুব সহজ হতেন। এর বিপরীতে প্রতিস সবসময়ই তার শ্রেষ্ঠ আচরণ করেন।
প্লতিনসের অধিবিদ্যা শুরু হয় পবিত্র ত্রয়ী দিয়েঃ অদ্বিতীয় (One), প্রাণ (Spirit) এবং আত্মা (Soul)। খ্রিস্টীয় ত্রয়ীর ব্যক্তিদের মতো এই তিনটি সমরূপ নয়। সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছে অদ্বিতীয়, তারপর অবস্থান প্রাণের এবং তারপর আত্মার।১৫২
অদ্বিতীয় একটু অস্পষ্ট। একে কখনো বলা হয় ঈশ্বর, কখনো উত্তম; এ অতিক্রম করে অস্তিত্বকে, এটাই অদ্বিতীয়ের প্রথম অনুবর্তী। অবশ্যই আমরা এর উপর কোন বিধেয় আরোপ করব না কিন্তু শুধু বলব এটা অস্তিমান। (একথা স্মরণ করিয়ে দেয় পার্মেনিদেসকে)। ঈশ্বরকে সর্ব বলা ভুল হবে, কারণ, ঈশ্বর সর্বকে অতিক্রম করেন। সমস্ত বস্তুতেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে। কিছু অস্তিত্ব ছাড়াই অদ্বিতীয়ের অস্তিত্ব থাকতে পারেঃ যেমন কোথাও এর অস্তিত্ব নেই তেমন কোনো স্থানেই এর অনস্তিত্বও নেই। যদিও অদ্বিতীয়কে অনেক সময় উত্তম বলা হয়, আমাদের এও বলা হয়েছে যে, অদ্বিতীয় উত্তম এবং সুন্দর-উভয়ের পূর্ববর্তী। অনেক সময় অদ্বিতীয়কে আরিস্ততেলেসের ঈশ্বরের মতো বলে মনে হয়। আমাদের বলা হয়েছে, ঈশ্বর থেকে আহরিত কিছুতে তাঁর প্রয়োজন নেই এবং তিনি সৃষ্ট জগৎকে আগ্রহ করেন। অদ্বিতীয়ের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা যায় না এবং এ বিষয়ে নীরবতায় যে সত্য আছে কোনো বাক্যেই সে সত্য নেই।
এবার আসছি দ্বিতীয় ব্যক্তির আলোচনায়, প্রতিনস এর নাম দিয়েছেন নু (nous)। নু শব্দের অর্থ বোঝা যায় এরকম একটি ইংরাজি শব্দ খুঁজে বার করা সবসময়ই কঠিন (এ অসুবিধে বাংলা ভাষাতেও আছে-অনুবাদক)। প্রামাণিক ইংরাজি অভিযানে অনুবাদ করা হয় মন কিন্তু তা সঠিক অর্থ বোঝায় না, বিশেষ করে যখন শব্দটি ধর্মীয় দর্শনে ব্যবহার করা হয় তখন তো নয়ই। আমরা যদি বলতাম প্লতিনস আত্মার উপরে মনকে স্থান দিয়েছেন তাহলে সম্পূর্ণ ভুল একটা ধারণা থেকে যেত। প্লতিনসের অনুবাদক ম্যাককেনা (Mckenna) বৌদ্ধিক নীতি কথাটি ব্যবহার করেছেন কিন্তু কথাটা বিশ্রী এবং ধর্মীয় ভক্তির উপযুক্ত কোনো বস্তুর ইঙ্গিত দেয় না। ডিন ইঙ্গে প্রাণ, শব্দটি ব্যবহার করেছেন, এটাই বোধহয় প্রাপ্তিসাধ্য শব্দগুলোর ভিতরে শ্রেষ্ঠ। কিন্তু এই শব্দটি বৌদ্ধিক উপাদান বাদ দিয়ে যায়, পুথাগরসের পরবর্তী সমস্ত গ্রিক ধর্মীয় দর্শনশাস্ত্রে এই উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গণিতশাস্ত্র, ধারণার জগৎ এবং অনুভূতি বহির্ভূত জিনিস সম্পৰ্কীয় সমস্ত চিন্তনেই পুথাগরস, প্লাতন ও প্লতিনসের জন্য ঐশ্বরিক কিছু আছে, সেগুলো নু-এর ক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত কিংবা অন্ততপক্ষে নিকটতম-যা আমাদের কল্পনে সম্ভব। প্লাতনের ধর্মের এই বৌদ্ধিক উপাদানই খ্রিস্টানদের, বিশেষ করে সেন্ট জন-এর গসপেল রচয়িতাকে খ্রিস্ট এবং লোগোস-কে অভিন্ন মনে করিয়েছিল। এক্ষেত্রে লোগোস-এর অনুবাদ হওয়া উচিত যুক্তি, এর ফলে নু-এর অনুবাদে যুক্তি কথাটা ব্যবহারে আমাদের বাধা দেয়। ডিন ইঙ্গে-কে আমি অনুসরণ করে প্রাণ শব্দটি ব্যবহার করব কিন্তু এই শর্তে যে, নু অর্থে শব্দটির একটি বৌদ্ধিক অর্থ থাকতে হবে, যে অর্থটি প্রাণ শব্দটির সাধারণ প্রচলনে অনুপস্থিত। কিন্তু প্রায়ই নু শব্দটি আমি অনুবাদ না করেই ব্যবহার করব।
বলা হয়েছে নু হলো অদ্বিতীয়ের প্রতিমূর্তি, এর উৎপাদনের কারণ অদ্বিতীয়ের আত্মঅন্বেষায় দর্শন (vision) হয়-এই দেখাটাই নু। এটা এক কঠিন কল্পন। প্লতিনস বলেছেন, অংশহীন একটি সত্তার পক্ষে নিজেকে জানা সম্ভব। এক্ষেত্রে দ্রষ্টা ও দৃষ্ট অভিন্ন। প্লাতনের মতো, ঈশ্বর কল্পিত হয়েছেন সূর্যের উপমায়, আলোকদাতা ও আলোকিত বস্তু অভিন্ন। এই উপমা অনুসরণ করে নু-কে আলোক বলে বিচার করা যেতে পারে, এই আলোকের সাহায্যে অদ্বিতীয় নিজেকে দর্শন করে। আমাদের পক্ষে ঐশ্বরিক মন জানা সম্ভব, স্বেচ্ছার (self-wil) বশে সেটা আমরা ভুলে যাই। ঐশ্বরিক মন জানতে হলে আমাদের অবশ্যই অধ্যয়ন করতে হবে নিজের আত্মাকে, যখন সে আত্মা সর্বাপেক্ষা দেবতুল্যঃ আমাদের দেহকে অবশ্যই সরিয়ে রাখতে হবে এবং আত্মার সেই অংশকে সরিয়ে রাখতে হবে যেটা দেহকে গড়েছিল, তাছাড়া সরাতে হবে জ্ঞানেন্দ্রিয়, কামনা, আবেগ এবং ঐ জাতীয় নিরর্থক সমস্ত জিনিস। তারপর যা অবশিষ্ট থাকে সেটাই ঐশ্বরিক বুদ্ধির প্রতিমূর্তি।
যারা ঐশ্বরিকভাবে আবিষ্ট ও উৎসাহিত তাঁদের অন্তত এই জ্ঞান আছে যে, তাঁরা নিজেদের ভিতরে বৃহত্তর কিছু ধরে রেখেছেন, যদিও তাঁরা বলতে পারেন না সেটা কী। যে আন্দোলন তাঁদের চঞ্চল করে ও তাদের থেকে যে বাক্য নির্গত হয় তা থেকে তাঁরা বুঝতে পারেন সেই শক্তি-যা তাঁদের চালিত করে, তাঁরা নিজেরা চালক ননঃ তেমনি আমাদের নু যখন বিশুদ্ধ তখন আমরা দাঁড়াই সেই মহত্তমের দিকে, আমরা জানতে পারি অন্তরের ঐশ্বরিক মনকে যা সত্তা ও অন্য সবকিছু দান করেঃ কিন্তু আমরা সেই অপরকেও জানি, জানি যে সে এসব কিছুই নয়, জানি যে যাকে আমরা সত্তা বলে জানি সে তার চাইতে মহত্তর একটি তত্ত্বপূর্ণতর ও বৃহত্তর। মন, যুক্তি এবং আবেগের উধ্বে; এই শব্দগুলো সে দান করে, সেগুলো যেন আমাদের বিভ্রান্ত না করে।
সেইজন্য যখন আমরা ঐশ্বরিকভাবে আবিষ্ট ও উদ্বুদ্ধ তখন শুধুমাত্র নু-কেই দেখতে পাই না, দেখতে পাই অদ্বিতীয়কেও। যখন এইভাবে আমরা ঈশ্বরের সংস্পর্শে আসি তখন যুক্তিতে কিংবা বাক্যে সে দর্শন প্রকাশ করতে পারি না, সেটা আসে পরে। স্পর্শের মুহূর্তে দৃঢ় ঘোষণা করার মতো তার কোনো ক্ষমতাই থাকে না, থাকে না অবকাশ, দর্শন সম্বন্ধে যুক্তি আসে পরবর্তীকালে। আত্মার উপর সহসা আলোকপাত হলে আমরা হয়তো জানতে পারি আমাদের দর্শন হয়েছে। এই আলোকপাত হয় সেই মহত্তম থেকে, সেই আলোকই মহত্তম। আমরা ঐ উপস্থিতিতে বিশ্বাস করতে পারি যখন একটি বিশেষ লোকের আবাহনে সেই অন্য ঈশ্বরটির মতো তিনি আলোক নিয়ে উপস্থিত হন, সেই আলোকই ঐ আগমনের প্রমাণ। এভাবে অনালোকিত আত্মা সেই দর্শনরহিত হয়ে থাকে, আলোকিত হলে সে আকাক্ষিতের অধিকারী হয়। এবং এটাই আত্মার সামনে উপস্থিত সত্য উদ্দেশ্য-আলোককে গ্রহণ করা, মহত্তমকে দিয়ে মহত্তমকে দর্শন করা এবং অন্য কোনো তত্ত্বের আলোকে দর্শন না করা-সেই মহত্তমকে দেখা, যে মহত্তম বীক্ষণের মাধ্যম। কারণ, আত্মাকে যা আলোকিত করে তাকে দেখবার জন্যই আত্মা আলোকিত হয় ঠিক যেমন সূর্যের নিজের আলোকেই আমরা সূর্যকে দেখি।
কিন্তু কী করে সম্ভব এ কাজ করা?
ছিন্ন করো সব কিছু।
ভাবাবিষ্ট হওয়ার অভিজ্ঞতা (নিজের দেহের বাইরে গিয়ে দাঁড়ানো) প্লতিনসের বারবার হয়েছেঃ
বহুবার একরম হয়েছেঃ দেহ থেকে উত্থিত হয়ে নিজের ভিতর আবিষ্ট হওয়া, সমস্ত বস্তু থেকে বহির্গত হওয়া এবং আত্মকেন্দ্রিক হওয়া, অবাক করা সৌন্দর্য দেখা, তারপর পূর্বের চেয়েও অধিক করে উচ্চতম বিন্যাসের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের সম্পর্কে আশ্বস্ত হওয়া, মহত্তম জীবনযাপন, ঈশ্বরের সঙ্গে একান্ত হওয়া, সেই ক্রিয়া করে তার ভিতরেই অবস্থিত হওয়া, বৌদ্ধিক দিক দিয়ে যারা মহত্তমের নিচে তাদের সবার উপরে থাকা, তবুও সেই নিম্নগতির মুহূর্ত আসে উপলব্ধি থেকে যুক্তিতে এবং ঈশ্বরে সেই স্বল্পস্থায়ী পরবাসের পরে, নিজেকে আমি প্রশ্ন করি কী করে ঘটে আমার এখনকার নিম্নগতি, কী করে প্রবেশ করল আত্মা আমার দেহে- যে আত্মা দেহের ভিতরে থাকলেও দেখিয়েছে সে সেই উচ্চ সত্তা হতে পারে।
এবার আসছি আত্মায়- সে ত্রয়ীর তৃতীয় ও নিম্নতম সদস্য। যদিও আত্মা নু-এর চাইতে হীন তবুও সে সমস্ত জীবের স্রষ্টা। সেই সৃষ্টি করেছে সুর্য, চন্দ্র এবং নক্ষত্ররাজি এবং সম্পূর্ণ দৃশ্যমান জগৎ। সেই ঐশ্বরিক বুদ্ধির সন্তান। আত্মা দ্বৈতঃ একটি অন্তরাত্মা, সে নু-এর সঙ্গে গভীরভাবে নিবদ্ধ এবং অপর আত্মাটি বহির্জগম্মুখী। শেষোক্তটি জড়িত এক নিম্নগতির সঙ্গে, যে গতিতে আত্মা সৃষ্টি করে তার প্রতিমূর্তি সেই প্রতিমূর্তি প্রকৃতি ও অনুভূতিময় জগৎ। স্টোইকরা প্রকৃতি ও ঈশ্বরকে এক মনে। করতেন কিন্তু প্লতিনস মনে করেন প্রকৃতি নিম্নতম বলয়, এর উদ্ভব আত্মা থেকে-উদ্ভব হয় যখন আত্মা ভুলে যায় ঊর্ধ্বে নু-এর দিকে দৃষ্টিপাত করতে। এই মত আধ্যাত্মিক রহসব্যবাদের ইঙ্গিত দিতে পারে অর্থাৎ দৃশ্যমান জগৎ মন্দ কিন্তু প্লতিনস এই দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নেননি। দৃশ্যমান জগৎ সুন্দর এবং এই জগৎ আশীর্বাদ পূত প্রাণীর বাসভূমি, এ জগৎ শুধুমাত্র বৌদ্ধিক জগৎ থেকে কম উত্তম। আধ্যাত্মিক রহস্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ে একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় বিতর্কমূলক আলোচনায়, যার বিষয় ছিল যে, মহাবিশ্ব এবং তার সৃষ্টিকর্তা মন্দ, তিনি আধ্যাত্মিক রহস্যবাদী মতবাদের খানিকটা মেনে নিয়েছিলেন যেমন, বস্তু সম্পর্কে ঘৃণা। সেই ঘৃণার কারণ হতে পারেন প্লাতন কিন্তু তিনি মনে করেন অন্য যে অংশগুলো প্লাতনের কাছ থেকে পাওয়া নয় সেগুলো অসত্য।
অধ্যাত্মিক রহস্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁর আপত্তি দুরকম। একদিকে, তিনি বলছেন, আত্মা বাস্তব জগৎ সৃষ্টি করে ঈশ্বরের স্মৃতি থেকে এবং তার কারণ এই নয় যে, সে পতিত। তাঁর মতে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ যতটা ভালো হওয়া সম্ভব ততটাই ভালো। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুগুলোর সৌন্দর্য সম্পর্কে তাঁর বোধ তীব্র :
যার বৌদ্ধিক জগতের ঐকতান সম্পর্কে সত্যকারের বোধ আছে এবং সুর বিষয়ে কোনো আকর্ষণ আছে সে কি ঐকতানের উত্তরে বোধযোগ্য শব্দ না করে পারবে? কোনো জ্যামিতিবিদ কিংবা পাটিগণিতবিদ দৃশ্যমান বস্তুগুলোতে দৃষ্ট প্রতিসাম্য, অনুরূপতা এবং বিন্যাসের নীতি দেখে আনন্দিত না হয়ে পারবেন? এমনকি ছবিগুলোর ব্যাপার বিচার করুন : যারা ইন্দ্রিয়ানুভূতির সাহায্যে চিত্রশিল্পকর্মের সৃষ্টি দর্শন করে তারা শুধুমাত্র একটি বস্তুকে একটি মাত্র উপায়ে দর্শন করে না। তারা দৃষ্টিপথে প্রদর্শিত বস্তুগুলোর ভিতরে কল্পনে যা থাকে তার উপস্থিতি চিনতে পেরে গভীরভাবে আলোড়িত হয় এবং এভাবে তারা সত্য স্মরণ করার আহ্বান পায়- যে অভিজ্ঞতা থেকে প্রেম উদ্ভুত হয় সেই একই অভিজ্ঞতা। যদি একটি মুখে সৌন্দর্যের অতি উস্কৃষ্ট প্রতিচ্ছবি দর্শনে মন দ্রুত চলে যায় অন্য বলয়ে, তাহলে নিশ্চয়ই অনুভূতিময় জগতে সৌন্দর্যের প্রাচুর্য কেউই দেখে না-দেখে না ঐ বিরাট সুবিন্যাস, যে গঠন সুদূরের তারকাগুলোও প্রদর্শন করে, কেউ এমন জড়বুদ্ধি, এমন স্থানু হতে পারে না, যে এগুলো দেখে তার স্মৃতি জেগে উঠে না এবং সেই মহত্ত্ব থেকে উদ্ভূত এই সমস্ত মহানের চিন্তায় যে সশ্রদ্ধ বিস্ময়ে মুগ্ধ হয় না। এভাবে সাড়া না দেওয়ার একটিমাত্র কারণই থাকতে পারে-এ বিশ্বের গভীরতা সম্পর্কে কিংবা অন্য বিশ্বের দৃশ্য সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই
আধ্যাত্মিক রহস্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাগ করার আর একটি কারণ আছে। আধ্যাত্মিক রহস্যবাদীদের মতে সূর্য, চন্দ্র এবং তারকাদের সঙ্গে ঐশ্বরিক কিছু জড়িত নেই। একটি মন্দ সত্তা এগুলো সৃষ্টি করেছে। বোধগম্য সমস্ত বস্তুর মধ্যে একমাত্র মানুষের আত্মারই কোনো উত্তমত্ব আছে। কিন্তু প্লতিনসের স্থির বিশ্বাস মহাকাশের বস্তুপিণ্ডগুলো দেবতুল্য জীবদের দেহ, মানুষের তুলনায় সেই জীবদের শ্রেষ্ঠত্ব অমেয়। আধ্যাত্মিক রহস্যবাদীদের মতে, তাঁদের নিজস্ব আত্মা, দীনতম দীন মানুষের আত্মা ঘোষণা করে মৃত্যুহীনকে, ঐশ্বরিককে। কিন্তু সমগ্র মহাবিশ্ব এবং মহাবিশ্বের অন্তর্ভুক্ত তারকাগুলোর সঙ্গে অমর তত্ত্বের (Immortal Principle) কোনো যোগাযোগ হয়নি অথচ এগুলো তাদের নিজেদের আত্মার তুলনায় শুদ্ধতর ও সুন্দরতর (II, ৯, ৫)। প্লতিনসের দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থনে তিমাএউস-এর প্রামাণিক রচনা রয়েছে এবং কিছু খ্রিষ্টান ফাদার এটা গ্রহণ করেছিলেন, যেমন অরিগেন (Origen)। এ মত কল্পনার দিক থেকে আকর্ষণীয়, মহাবিশ্বের বস্তুপিণ্ডগুলো সম্পর্কে স্বাভাবিক যে ভাব উদ্ভূত হয় এ মত তারই প্রকাশ এবং এ মত ভৌত ব্রহ্মাণ্ডে মানুষের একাকিত্ববোধ হ্রাস করে।
প্লতিনসের রহস্যবাদে কোনো বিষণ্ণতা কিংবা সৌন্দর্যবিরোধী কিছু নেই। কিন্তু বহু শতাব্দী পর্যন্ত তিনি ছিলেন শেষ ধর্মীয় শিক্ষক যার সম্পর্কে এ কথা বলা যায়। সৌন্দর্য এবং তার সঙ্গে জড়িত সমস্ত আনন্দকে ভাবা হতো শয়তানের। পৌত্তলিক এবং খ্রিষ্টান-উভয়েই শ্রীহীনতা ও মালিন্যকে মহিমান্বিত মনে করতেন। স্বধর্মত্যাগী জুলিয়ান (Julian) তাঁর সমসাময়িক গোঁড়া সন্ন্যাসীদের মতো দাড়ির জনাকীর্ণতা (উকুন-অনুবাদক) নিয়ে গর্ব করতেন। তিনসের এ সমস্ত ব্যাপারে কিছুই নেই।
আত্মা সৃষ্টি করে পদার্থ এবং পদার্থের স্বাধীন বাস্তবতা নেই। প্রতিটি আত্মারই নিজস্ব কাল আছে, যে কাল উপস্থিত হলে আত্মাটি অবতরণ করে এবং তার উপযুক্ত দেহে প্রবেশ করে। তার উদ্দেশ্য যুক্তি নয় তবে যৌন ইচ্ছার সঙ্গে অনেক বেশি তুলনীয় একটা কিছু। আত্মা যখন দেহ পরিত্যাগ করে পাপী আত্মা হলে তাকে অবশ্যই অন্য দেহে প্রবেশ করতে হবে, কারণ, ন্যায্যতার প্রয়োজনে তার শাস্তি পাওয়া দরকার। এই জীবনে যদি তুমি তোমার মাকে হত্যা করে থাক তাহলে পরজন্মে তোমাকে মেয়ে হয়ে জন্মাতে হবে এবং পুত্রের দ্বারা নিহত হবে (III ২, ১৩) পাপকে শাস্তি দিতেই হবে। কিন্তু শাস্তিটা ঘটে স্বাভাবিকভাবে, ঘটে পাপীর ভুলের অস্থির তাড়না থেকে।
আমাদের মৃত্যুর পর আমরা কি এই জীবনের কথা মনে রাখি? উত্তরটা নিখুঁত যুক্তিপূর্ণ কিন্তু অধিকাংশ আধুনিক ধর্মতাত্ত্বিকরা যা বলবেন তা নয়। স্মৃতি জড়িত আমাদের জীবনের সঙ্গে কালে কিন্তু সর্বোত্তম ও সর্বাপেক্ষা সত্য জীবন মরণের ওপারে। সেইজন্য আত্মা চিরন্তন জীবনের দিকে যত অগ্রসর হয় তার স্মৃতি ততই কমতে থাকে। বন্ধু, সন্তান এবং স্ত্রীকে ক্রমশ বিস্মৃত হয়, শেষ পর্যন্ত এ জগতের কিছুই আর মনে থাকে না কিন্তু তখন আত্মা শুধুমাত্র বৌদ্ধিক জগৎ নিয়ে চিন্তা করে। ব্যক্তিত্বের কোনো স্মৃতি থাকে না, ধ্যানের দৃষ্টিতে সে নিজের সম্পর্কে অনবগত। আত্মা নু-এর সঙ্গে একাত্ম হবে কিন্তু নিজে ধ্বংস হয়ে নয় : নু এবং একক আত্মা হবে যুগপৎ দুটি এবং একটি (Iv, ৪, ২)।
চতুর্থ এনিয়াদ আত্মা সম্পর্কে, সেখানে একটি অংশে অর্থাৎ সপ্তম ধর্মীয় পুস্তিকাতে (tractate) অমরত্ব নিয়ে আলোচনা আছে।
দেহ হলো মিশ্রিত বস্তু, স্পষ্টতই অমর নয়। যদি সেটা আমাদের অংশ হয় তাহলে আমরাও সম্পূর্ণ অমর নই। কিন্তু দেহের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক কী? আরিস্ততেলেস (তাঁর সম্পর্কে খোলাখুলি উল্লেখ নেই) বলেছেন, আত্মা দেহের আকার কিন্তু তিনস এই দৃষ্টিভঙ্গি বাতিল করে দিয়েছেন এই যুক্তিতে যে, আত্মা দেহের আকার হলে বৌদ্ধিক কর্ম অসম্ভব হতো। স্টোইকদের চিন্তনে আত্মা পার্থিব কিন্তু আত্মার ঐক্য প্রমাণ করে এটা অসম্ভব। তাছাড়া, যেহেতু বস্তু অক্রিয় সেহেতু সে নিজেকে সৃষ্টি করতে পারে না, আত্মা সৃষ্টি না করলে বস্তুর অস্তিত্ব থাকত না এবং আত্মা না থাকলে বস্তু চোখের পলকে অদৃশ্য হতো। আত্মা বস্তুও নয়, বাস্তব বস্তুপিণ্ডের আকারও নয় কিন্তু সার এবং এই সার চিরন্তন। প্লাতনের যুক্তিতে অন্তর্নিহিত আছে এই দৃষ্টিভঙ্গি আত্মা অমর, কারণ, ধারণাগুলো চিরন্তন কিন্তু শুধুমাত্র প্রতিনসের ক্ষেত্রে এ তত্ত্ব স্পষ্টভাষিত হয়।
বৌদ্ধিক জগতের দূরত্ব থেকে আত্মা কী করে দেহে প্রবেশ করে? উত্তর-ক্ষুধার মাধ্যমে। কিন্তু ক্ষুধা যদিও কখনো কখনো নীচ প্রবৃত্তি, অনেক সময় এ প্রবৃত্তি তুলনায় মহান হতে পারে। সর্বশ্রেষ্ঠ অবস্থায় আত্মার বৌদ্ধিক তত্ত্বে (নু) দেখা নক্সা অনুসারে শৃঙ্খলা সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা হতে পারে। অর্থাৎ আত্মা সারের অন্তরের জগৎ নিয়ে চিন্তা করে এবং এমনকিছু সৃষ্টি করতে ইচ্ছা করে যা যতটা সম্ভব তার নিজেরই মতো, যা অন্তদৃষ্টির বদলে বহিদৃষ্টিতে দেখা যায়-(আমরা বলতে পারি) অনেকটা একজন স্বরলিপি লেখকের মতো যদি প্রথমে তার সুর কল্পনা করেন এবং তারপর ঐকতানে সেই সুর বাজানো শুনতে চান।
কিন্তু আত্মার এই সৃজনের আকাঙ্ক্ষার দুর্ভাগ্যজনক ফল রয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত আত্মাটি সারের বিশুদ্ধ জগতে বাস করে ততক্ষণ পর্যন্ত সে ঐ জগত্বসী অন্যান্য আত্মার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না, কিন্তু যখনই সে দেহের সঙ্গে যুক্ত হয় তখনই তার দায়িত্ব হয় নিজের চাইতে নিম্নতর বস্তুকে শাসন করা এবং এই দায়িত্বের জন্য সে অন্য আত্মাগুলোর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সে আত্মাগুলোর অন্য দেহ থেকে। কয়েকটি মুহূর্তে কয়েকজন মানুষ ছাড়া আত্মাটি দেহের সঙ্গে শৃঙ্খলিত হয়। দেহ সত্যকে অস্পষ্ট করে কিন্তু সেখানে সবকিছু স্পষ্ট ও পৃথকভাবে থাকে (IV,৯, ৫)।
প্লাতনের মতবাদের মতো এই মতবাদের অসুবিধা-সৃষ্টি করাটাই ভুল হয়েছিল এই দৃষ্টিভঙ্গিকে এড়ানোর অসুবিধা। তার সর্বোত্তম অবস্থায় আত্মা নু অর্থাৎ সারের জগতে তৃপ্ত। আত্মা যদি সবসময় সর্বোত্তম অবস্থায় থাকত তাহলে সে সৃষ্টি করত না, শুধুমাত্র ধ্যান করত। মনে হয় সৃষ্টিকর্মকে ক্ষমা করা উচিত, তার কারণ, সৃষ্ট জগৎ প্রধানত যৌক্তিকভাবে যা সম্ভব তার ভিতরে সর্বোত্তম কিন্তু এটা চিরন্তন বিশ্বের একটা অনুকরণ এবং সেইজন্য অনুকরণের পক্ষে যতটা সম্ভব ততটা সৌন্দর্য এতে আছে। সবচাইতে নির্দিষ্ট নিশ্চিত বক্তব্য আছে আধ্যাত্মিক রহস্যবাদী সম্পর্কিত ধর্মীয় পুস্তিকাতে (Tractate) (II, ৯, ৮) :
আত্মা কেন ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছিল এ প্রশ্ন করা আত্মার অস্তিত্বের কারণ আর সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির কারণ জিজ্ঞাসা করার তুল্য। তাছাড়া, এ প্রশ্নের ভিতর নিহিত আছে চিরন্তনের আরম্ভের ইঙ্গিত এবং এটি একটি পরিবর্তনশীল সত্তার ক্রিয়া হিসেবে সৃষ্টির বিবরণ দেয়- যে সত্তা কর্ম থেকে কর্মান্তরে বিচরণ করে।
যারা এরকম চিন্তা করে তারা যদি সংশোধিত হতে চায় তাহলে তাদের অবশ্যই শিক্ষা দেওয়া উচিত অতিপ্রাকৃতদের চরিত্র সম্পর্কে এবং রাজসিক শক্তিগুলোর নিন্দা করা তাদের বন্ধ করাতে হবে, যেখানে সসম্মান সঙ্কোচ থাকা উচিত সেখানে নিন্দাবাদ তাদের মুখে এত সহজে আসে।
এমনকি মহাবিশ্ব পরিচালনার ব্যাপারেও এরকম আক্রমণের কোনো ভিত্তি নেই, কারণ, এতে বৌদ্ধিকের মহত্ত্ব স্পষ্ট প্রমাণিত হয়।
এ সমগ্রতা যা জীবনরূপে প্রকাশ পেয়েছে তা কোনো অবয়বহীন গঠন নয় (এর অন্তর্গত সেই হীনতর আকারগুলোর মতো নয় যেগুলো তাদের প্রচুর জীবনীশক্তির ফলে দিবারাত্রি জন্মগ্রহণ করে), ব্রহ্মাণ্ড একটি সংগঠিত জীবন, কার্যকর, জটিল, সর্বব্যাপী অতল প্রজ্ঞা প্রকাশ করছে। তাহলে কী করে কেউ অস্বীকার করতে পারে যে, এটা বৌদ্ধিক দেবতাদের সুন্দরভাবে গঠিত একটি স্পষ্ট প্রতিমূর্তি? সন্দেহ নেই এটা আসল নয়, একটা অনুভূতি কিন্তু এর চরিত্রই ঐরকম। এটা যুগপৎ প্রতীক এবং বাস্তব হতে পারে না। কিন্তু একে অক্ষম অনুকৃতি বললে মিথ্যে বলা হবে, ভৌত বিন্যাসের একটি সুন্দর প্রতিরূপের যা অন্তর্ভুক্ত হতে পারত তার কিছুই বাদ দেওয়া হয়নি।
এই পুনরুৎপাদন থাকা আবশ্যিক (যদিও বিচক্ষণতা ও পরিকল্পনার সাহায্যে নয়) কারণ, বৌদ্ধিক মানুষই শেষ কথা নয় কিন্তু তাদের অবশ্যই থাকতে হবে দুরকম কাজ-একটি অন্তর্মুখী, অপরটি বহির্মুখী। তাহলে ঈশ্বরের পরবর্তী কিছু একটা নিশ্চয়ই থাকতে হবে, কারণ, একমাত্র যে বস্তুর সঙ্গে সমস্ত শক্তি শেষ হয় শুধুমাত্র সেই বস্তু নিজের কিছু অংশকে নিয়ে প্রেরণ করতে অক্ষম।
আধ্যাত্মিক রহস্যবাদীদের প্রতি তিনসের নীতির ভিত্তিতে এটাই বোধহয় সম্ভাব্য শ্রেষ্ঠ উত্তর। সামান্য পৃথক বাগ্বিধিতে এই সমস্যাটি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন খ্রিষ্টান ধর্মতত্ত্ববিদরা। সৃষ্টির আগে সৃষ্টিকর্তার কিছু অভাব ছিল-এই ঈশ্বরদ্বেষপুর্ণ সিদ্ধান্ত অনুমোদন না করে খ্রিষ্টান ধর্মতত্ত্ববিদদের পক্ষে সৃষ্টির কারণ বর্ণনা করা ছিল কঠিন। বাস্তবিক, তাদের অসুবিধা ছিল প্রতিনসের চাইতে বেশি, কারণ, তিনি বলতে পারতেন মনের চরিত্র এমন যে, সেখানে সৃষ্টিকর্তার ছিল অবশ্যম্ভাবী, খ্রিষ্টানদের মতে বিশ্ব সৃষ্টির কারণ ঈশ্বরের স্বাধীন ইচ্ছার অবাধ প্রকাশ।
এক বিশেষ ধরনের বিমূর্ত সৌন্দর্যবোধ সম্পর্কে প্রতিনসের অত্যন্ত সুস্পষ্ট ধারণা, ছিল। বুদ্ধি যে অদ্বিতীয় এবং আত্মার মধ্যবর্তী-এই বিবরণ দিতে দিতে সহসা তিনি এক রচনাংশে দুর্লভ বাগ্মিতায় ফেটে পড়েনঃ
মহত্তম তার প্রগতিতে কখনোই আত্মাহীন বাহন দ্বারা সম্মুখে বাহিত হতে পারে না, এমনকি প্রত্যক্ষভাবে আত্মার দ্বারাও নয়ঃ কোনো অবর্ণনীয় সৌন্দর্য এর অগ্রগামী হবে। মহান রাজার প্রগতি যাত্রায় প্রথম আসে ক্ষুদ্র অনুচররা, তারপর আসে পদাধিকার অনুসারে উচ্চ থেকে উচ্চতর পদাধিকারীরা রাজার আরও নিকটবর্তী রাজসিকরা। তারপর তাঁর নিজের সম্মানিত সঙ্গীরা আসেন, এই সমস্ত জাঁকজমকের শেষে সহসা আবির্ভূত হন মহান সম্রাট নিজে এবং সবাই (যদি তারা আবির্ভাবের পূর্ববর্তী দৃশ্য দেখে পরিতৃপ্ত হয়ে চলে না গিয়ে থাকে, তাহলে) আভূমি প্রণত হয় ও স্বাগত জানায়। (v.৫.৩)।
বৌদ্ধিক সৌন্দর্য সম্পর্কে একটি ধর্মীয় পুস্তিকা (Tractate) আছে, তাতেও একইরকম অনুভূতি দেখা যায় (V, ৮)।
নিশ্চিতভাবে সমস্ত দেবতারাই মহিমান্বিত এবং সৌন্দর্যমণ্ডিত-সে সৌন্দর্য বাক্যের অতীত। কেন তারা এমনতর? বুদ্ধি এবং বিশেষ করে তাদের ভিতর ক্রিয়াশীল বুদ্ধি (ঐশ্বরিক সূর্য ও তারকারাজি) যা তাদের দৃশ্যমান করে।
সহজ আরামে থাকা রয়েছে সেখানে এবং এইসব ঐশ্বরিক সত্তার কাছে যথার্থ হলো মাতা এবং ধাত্রী, অস্তিত্ব এবং প্রতিপালন। যা পদ্ধতিগত নয় কিন্তু প্রকৃত সত্তা-তা তারা দেখতে পান এবং সবের ভিতরে দেখতে পান নিজেদের, কারণ, সবই স্বচ্ছ, কিছুই আলোকহীন নয়, কিছুই প্রতিবন্ধক নয়। প্রতিটি সত্তাই প্রতিটি অন্য সত্তার কাছে স্পষ্ট-প্রস্থে ও গভীরতায়। আলোকের ভিতর দিয়ে আলোক গমন করে। এবং তাদের প্রত্যেকের ভিতরে সর্ব রয়েছে ও একই কালে সে অন্য প্রত্যেকের ভিতরে সর্বকে দেখতে পায়, সুতরাং সর্বত্রই সর্ব রয়েছে এবং সর্বই সর্ব এবং প্রতিটি সর্ব এবং মহিমা অনন্ত। তাদের প্রত্যেকেই মহান, ক্ষুদ্র মহান। সেখানে সব তারকা এবং প্রতিটি তারকাই আবার সমস্ত তারকা এবং সূর্য। যদিও অস্তিত্বের কোনো একটা রূপ প্রত্যেকটির ভিতর প্রধান তবু প্রত্যেকের ভিতরই প্রত্যেকের ছায়া পড়ে।
পৃথিবী অনুকৃতি হওয়ায় তার অসম্পূর্ণতা আছে, তাছাড়া আছে পাপ থেকে উদ্ভূত আরও সত্যকার মন্দ, খ্রিষ্টানরা ও প্লতিনস উভয়েই এ তথ্য মানতেন। পাপ স্বাধীন ইচ্ছার ফল, নিয়তিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিনস স্বাধীন ইচ্ছা সমর্থন করতেন, বিশেষ করে জ্যোতিষীদের বিরুদ্ধে। জ্যোতিষশাস্ত্রের সত্যতা সম্পূর্ণ অস্বীকার করার সাহস তাঁর নেই কিন্তু তিনি একটা সীমা স্থির করতে চান, তার ফলে যা অবশিষ্ট থাকবে তার সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকবে স্বাধীন ইচ্ছার। জাদুবিদ্যা সম্পর্কেও তিনি একই কাজ করেছেন। তিনি বলেন, ঋষিরা জাদুকরের ক্ষমতার বাইরে। পফুরি বলেছেন, একজন প্রতিদ্বন্দ্বী দার্শনিক প্লতিনসের উপর জাদুবিদ্যার মন্দ প্রভাব প্রয়োগ করতে চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাঁর পবিত্রতা ও প্রজ্ঞার ফলে জাদুবিদ্যাটি প্রতিদ্বন্দ্বীর অভিমুখেই প্রতিক্ষিপ্ত হয় এবং সমস্ত অনুগামীরা ও পর্ফুরি, তিনসের চাইতে বেশি কুসংস্কারগ্রস্ত। তাঁর ভিতরে কুসংস্কার ছিল সে যুগে যতটা অল্প সম্ভব ততটাই।
প্লতিনস যে মতবাদ শিক্ষা দিতেন তার ভালোমন্দ এবার বিচার করা যাক এবং যতদিন পর্যন্ত খ্রিষ্টীয় ধর্মতত্ত্ব সুসংবদ্ধ ও বৌদ্ধিক ছিল ততদিন পর্যন্ত সে তত্ত্ব প্রধানত এই মতবাদ গ্রহণ করেছিল।
প্রথমত ও প্রধানত রয়েছে তিনস যাকে আদর্শ ও আশার নিরাপদ আশ্রয় বলে মনে করতেন তার গঠন, তাছাড়া আরও জড়িত ছিল বৌদ্ধিক এবং নৈতিক প্রচেষ্টা। তৃতীয় শতাব্দী ও তার পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে বর্বর আক্রমণে পাশ্চাত্য সভ্যতা প্রায় ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছিল। এটা সৌভাগ্য যে, যখন ধর্মতত্ত্বই একমাত্র জীবিত মানসিক কর্ম, তখন গৃহীত তন্ত্রটি শুধুই কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিল না কিন্তু নিজের মধ্যে বাঁচিয়ে রেখেছিল- কখনো হয়তো খুব গভীরে বিলীন অবস্থায় এমন সব মতবাদকে যার মধ্যে ধৃত ছিল গ্রিক বৌদ্ধিক কর্মের বহুলাংশ এবং স্টোইক ও নব্য প্লাতনবাদীদের মধ্যে বহুল প্রচলিত নৈতিক নিষ্ঠা। এর ফলে স্কলাস্টিক (মধ্যযুগীয় খ্রিষ্টীয় পাণ্ডিত্য) দর্শনের উত্থান সম্ভব হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে রেনেসাঁ-র সঙ্গে সম্ভব হয়েছিল প্লাতন এবং অন্যান্য প্রাচীনদের পুস্তকাদির পুনর্গঠন থেকে আহরিত উদ্দীপনা।
অপরদিকে, প্লতিনসের দর্শনের ত্রুটি ছিল মানুষকে বাইরে দৃষ্টিপাত করতে উৎসাহ না দিয়ে অন্তরে দৃষ্টিপাত করতে উৎসাহ দেওয়াঃ আমরা যখন অন্তরে দৃষ্টিপাত করি তখন দেখি নু- যা ঐশ্বরিক কিন্তু যখন বাইরে দৃষ্টিপাত করি তখন দেখি ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য জগতের অসম্পূর্ণতা। এই জাতীয় ব্যক্তিনিষ্ঠার জন্ম হয়েছিল ক্রমে ক্রমে। এই মতবাদগুলো পাওয়া যাবে প্রতাগরস, সাতেস এবং প্লাতনের মতবাদে, তাছাড়া পাওয়া যাবে স্টোইক ও এপিকুরীয়দের মতবাদে। কিন্তু এটা প্রথমে ছিল শুধুমাত্র মতবাদ বিষয়ক, মানসিকতা জাত নয়। বহুদিন পর্যন্ত এই মতবাদ বৈজ্ঞানিক কৌতূহলকে হত্যা করতে পারেনি। আমরা দেখেছি কি প্রায় ১০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পসিনিয়স স্পেন ও আফ্রিকার আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে জোয়ার-ভাটা পর্যবেক্ষণ করতে গিয়েছিলেন। যাইহোক ধীরে ধীরে ব্যক্তিনিষ্ঠা মানুষের মনোভাব ও মতবাদকে আক্রমণ করল। বিজ্ঞানচর্চা বন্ধ হয়ে গেল এবং একমাত্র সদগুণকেই গুরুত্বপূর্ণ মসনে করা হলো। প্লাতনের কল্পনে সদ্গুণ ছিল যতদূর মানসিক কৃতিত্ব তকালে সম্ভব তার সঙ্গে জড়িত কিন্তু পরবর্তী শতাব্দীগুলোর চিন্তনে বর্ধমানহারে সদগুণের সঙ্গে শুধুমাত্র জড়িত ছিল সদ্গুণান্বিত ইচ্ছা-জড়িত ছিল না ভৌত জগৎকে জানার ইচ্ছা কিংবা মানবিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়নের ইচ্ছা। নৈতিক মতবাদের দিক থেকে খ্রিষ্টধর্মও এই দোষ থেকে মুক্ত ছিল না, যদিও কার্যক্ষেত্রে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের গুরুত্বে বিশ্বাস নৈতিক কর্মের জন্য একটা উদ্দেশ্য দিয়েছিল-সে কর্ম আর শুধুমাত্র নিজের সত্তাকে নিখুঁত করাতেই আবদ্ধ ছিল না।
প্লতিনস একই সঙ্গে অন্ত এবং আদি- গ্রিক সাপেক্ষ যা অন্ত এবং খ্রিষ্টীয় জগৎ সাপেক্ষ তা আদি। বহু শতাব্দীর নৈরাশ্যে ক্লান্ত ছিল প্রাচীন জগৎ, হতাশায় শ্রান্ত, সে জগতের কাছে তাঁর মতবাদ হয়তো গ্রহণীয় ছিল/কিন্তু উদ্দীপক ছিল না। অপরিশীলিত বর্বর জগতে শক্তির অতিপ্রাচুর্যকে সংযত করা ও নিয়ন্ত্রিত করার প্রয়োজন ছিল কিন্তু উদ্দীপিত করা নয়। তাঁর শিক্ষণের যতটুকু প্রবেশ করতে পেরেছিল তাতে উপকার হয়েছিল, কারণ, যে দোষের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হতো সেটা আলস্য নয়, সেটা পাশবিকতা। তাঁর দর্শনের যা বেঁচেছিল রোমের অন্তিম যুগের খ্রিষ্টান দার্শনিকরা তাকে পরবর্তী যুগে প্রেরণ করার দায়িত্ব পালন করেছিলেন।