প্রেমের প্রাদুর্ভাব ও প্রতিকার
প্ৰস্তাবনা
ভালোবাসা নামক রোগে আক্রান্ত হয়েন নাই, এমন ব্যক্তি ত্ৰিভুবনে আছেন। কিনা, তাহা লইয়া বিতর্ক থাকিলেও থাকিতে পারে; কিন্তু ইহা যে সুমরু হইতে কুমেরু পর্যন্ত সমস্ত বিশ্বের আকাশে, বাতাসে, অন্তরীক্ষে ইথার তরঙ্গের মতো বিচরণ করিয়া বেড়াইতেছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। মহাশূন্যেও বিচরণ করিতেছে কিনা, তাহার সাক্ষাৎ প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। তবে অসম্ভব নহে। ইহার ফাদ সর্বত্র পাতা আছে–কে কোথায় ধরা পড়ে, কেহই জানে না। সৌভাগ্যক্রমে শিশু এবং বৃদ্ধ — যাহাদের রোগ প্রতিরোধক শক্তি সীমিত, তাহারা সাধারণত এই রোগে আক্রান্ত হয় না। তবে ভীমরতি নামক উপব্যাধি থাকিলে বৃদ্ধরও এই পীড়ার শিকার হইতে পারেন। এবং বার্ধক্যে এই রোগ দেখা দিলে বেশি বয়সের হাম রোগের আক্রমণের মতো–তাহা নিদারুণ হইয়া থাকে। মোট কথা, এই ভয়ানক ব্যায়রাম বিশ্বের আনাচে-কানাচে মহামারীর আকারে ছড়াইয়া পড়িয়াছে, বিবেকবান ব্যক্তিমাত্রেই তাহা স্বীকার করিবেন। ধনী-দরিদ্র, রাজা-প্ৰজা, সিনেটর-প্রেসিডেন্ট, ক্রেতা-বিক্রেতা, মেথরমুচি–কেহই ইহার আকস্মিক হামলা হইতে রেহাই পাইয়াছেন বলিয়া শুনি নাই। পাইলে নিশ্চয় গিনিস বুক অব রেকর্ডসে তাহার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকিত।
একটি-দুটি দৃষ্টান্ত দিলে বিষয়টা আরও হৃদয়গ্রাহ্য হইতে পারে। দীর্ঘ কাল আগে নহে; মার্কিন মুলুকের রাষ্ট্রপতি কিল্টন মহাশয় এই রোগে আক্রান্ত হইয়াছিলেন। প্রেমের অমৃত তুলিবার জন্য পুরুষরা যেসব অস্ত্ৰ ব্যবহার করে, তিনি তাহার অধিক–দুর্মুল্য সিগার পর্যন্ত ব্যবহার করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও তিনি লেজে-গোবরে হইয়াছিলেন। ব্রিটেনের এক রাজাও এই রোগাক্রান্ত হইয়া বাদশাহী ছাড়িয়া আজীবন এক বিধবার পদসেবা করিয়াছিলেন। বস্তুত, এই রোগের প্রকোপে এতদ্ররূপ পদস্থলনের ঘটনা প্ৰায়শ শ্রুতিগোচর হয়।
অবাক হইতে হয় যে, এই রোগের ফলে অনেকের সাড়ে সর্বনাশ হওয়া সত্ত্বেও লোকেরা ইহাকে ভালো বাসা অর্থাৎ ভালো অনুভব করা বলিয়া থাকে। রবীন্দ্রনাথ নামক একজন বাঙ্গালি কবি তাঁহার তরুণ বয়সে এই কথাটির মৃদু প্রতিবাদ করিয়া বলিয়াছিলেন যে, ভালোবাসা এমন যন্ত্রণাদায়ক, তাহা সত্ত্বেও লোকে কেন ইহাকে ভালোবাসা বলে! কিন্তু তাঁহার এই প্রতিবাদ আন্তরিক ছিলো বলিয়া বিশ্বাস হয় না। কারণ পরবর্তী কালে তিনি আবার “ভালোবাসা ভালোবাসা” বলিয়া গলা ফাটাইয়া এন্তার গান করিয়াছিলেন। অনেকে বলেন যে, প্রেমের পীড়ায় পিষ্ট হইয়া দারুণ ক্লের হইলেও ভিতরে ভিতরে হৃদয়ে ইহা এক প্রকার সুখের সুড়সুড়ি দিয়া থাকে। সেই কারণে বুদ্ধিমান ব্যক্তিরাও জানিয়া-শুনিয়াও এই বিষ পান করিবার ব্যাপারে প্রবল আপত্তি করেন না। বিষপান করিয়া তাহা লইয়া আবার ইনাইয়া-বিনায়াই গান করেন।
সমস্যার তীব্রতা ও ব্যাপ্তি
মোদ্দা কথা, সমস্যাটি ব্যাপক এবং ভয়াবহ। তাবৎ বিশ্ব এই ব্যাধির খপ্পরে পড়িয়া আকুলি-ব্যাকুলি করিতেছে। অনেকে মাথায় হাত দিয়া হাহাকার করিতেছে। মলিন বিষন্ন মুখে ফ্যা ফ্যা করিয়া আকাশের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকাইয়া কি যেন খুজিতেছে। নৈশকালে শয্যায় ছটফট করিতেছে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও এই রোগের কোনো কার্যকর চিকিৎসা অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হইয়াছে বলিয়া শুনি নাই। বসন্ত, ওলাউঠা, ধনুষ্টঙ্কার, এমন কি কোনো কোনো কৰ্কট রোগেরও টিকা আবিষ্কৃত হইয়াছে। কিন্তু প্ৰেমরোগ ঠেকাইয়া রাখিবার কোনো টিকা অদ্যাবধি উদ্ভাবিত হয়। নাই। মনে হয়, বৈজ্ঞানিকদের সেই রূপ টিকা আবিষ্কার করিবার সত্যিকার সদিচ্ছাও নাই। তাজ্জব হইতে হয় এই ভাবিয়া যে, কুকুর-বিড়ালের মতো ইত্যর প্রাণীর রোগ নিরাময়ের জন্য গবেষণার এক শেষ হয়, অথবা শত শত কোটি মুদ্রা ব্যয়ে পুরুষত্বহীনতার ঔষধ আবিষ্কার করিবার নিমিত্ত গবেষণা হইতেছে। কিন্তু যে-প্রেম রোগে আক্রান্ত হইয়া পুরুষত্বহীনতার বিষয়ে বীর পুরুষরা বিশেষ সচেতেন হইয়া উঠেন, খোদ সেই রোগ হইতে যাহাতে আত্মরক্ষা করিতে পারে, তাহা লইয়া কোনো গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা হয় না।
এমন কি, এই রোগের হেতু কি এবং ইহা কিভাবে বিস্তার লাভ করে তাহা লইয়াও এ যাবৎ সর্বজনস্বীকৃত কোনো মতবাদ বা থিওরি প্রচলিত নাই। ভূত তাড়াইবার, পরীক্ষা পাশের, শত্রুর ক্ষতি করিবার তাবিজ এবং মাদুলিধর্মব্যবসায়ীদের দক্ষিণা দিলে সহজেই পাওয়া যায়। কিন্তু প্ৰেমরোগ আরোগ্য করিবার মতো কোনো তাবিজ অথবা মাদুলি পাওয়া যায় না। যেগুলি পাওয়া যায়, তাহা রীতিসমত উপায়ে গ্রহণ করিলেও কাহারও রোগমুক্তি হইয়াছে বলিয়া প্ৰত্যক্ষ সাক্ষ্য অথবা নির্ভরযোগ্য কোনো প্ৰমাণ পাওয়া যায় না।
এই নিদারুণ ব্যাধির অভিজ্ঞতা হইতে গৃহীদের তো কথাই নাই, মুনীঋষি এবং মহাপুরুষরাও–কেহই রেহাই পান নাই। কোনো কোনো মহাপুরুষের উপর ইহার প্রভাব বরং অধিক বলিয়া ধারণা হয়। বরঞ্চ ইহার কুফল হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করিয়া তাহারা ভালোবাসা হইতে যোজন যোজন দূরে থাকিবার উপদেশ দিয়াছেন। তাঁহারা বলিয়াছেন যে, শারীরিক প্রয়োজন হইলে সারিয়া ফেলো। অর্থাৎ পুত্রার্থে সন্তান জন্মদান প্রক্রিয়া বাঞ্ছনীয়। (আধুনিক নারীবাদীরা রাগ করিবেন না; কিন্তু মনু মহাশ পুত্রার্থেই লিখিয়াছেন, কন্যার্থে লেখেন নাই–আমার অপরাধ লইবেন না।) তাহারা এই কথাও বলিয়াছেন যে, বিবাহ না-করিলে পাতক হইতে হইবে। যাহারা সন্তান উৎপাদনের বিষয়ে আগ্রহ প্ৰদৰ্শন করেন না, বিধানদাতাদের মতে, তাহারা অতিশয় নিন্দনীয়। কেবল মনু মহাশয় নহেন, বস্তুত সকল ধর্মপ্রবর্তকই এইরূপ দৈহিক প্রক্রিয়ার বহির্ভূত কোনো মানসিক বিকারের–অর্থাৎ প্রেমের— অকুণ্ঠ নিন্দা জ্ঞাপন করিয়াছেন। অধিক ফসল উৎপাদনের জন্য যেমন অধিক জমির প্রয়োজন, তেমনি অধিক সংখ্যক সন্তান জন্মদানের জন্যে অনেকগুলি গৰ্ভ সংগ্ৰহ করিবার ব্যাপারেও ধর্ম উদারভাবে অনুমতি দিয়াছে। কিন্তু প্ৰেম? তওবা! সাফ দিলের উপর এসব হইল। শয়তানের আছর। (কোনো কোনো ধর্মে বিবাহের সর্বোচ্চ সংখ্যা বঁধিয়া দেওয়া হইয়াছে। আবার, কোনো কোনো ধর্ম এতো উদার যে, সংখ্যা নির্ধারিত করিয়া বিবাহের মতো মহৎ প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা হানি করে নাই। বরং কোনো কোনো ধর্মে অর্থ এবং দৈহিক সামর্থ্য থাকিলে যতগুলি ইচ্ছা ক্রীতদাসী সংগ্ৰহ করিয়াও বিনোদনের ব্যবস্থা জোরদার করিবার অনুমতি দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু প্ৰেমরোগ হইতে সর্বদা দূরে থাকার কথা শাস্ত্রে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে কথিত হইয়াছে।)
অনেকের ধারণা, পুরুষরাই এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়েন। কিন্তু তাহারা কোন আক্কেলে এই উক্তি করেন, বোঝা যায় না। কারণ, কলিকালে নারীরাও এই রোগে আক্রান্ত হইয়া প্রায়শ বিশেষ কাবু হয়েন বলিয়া শোনা যায়। এমন কি, তাহাদের মধ্যে যাহারা এই রোগের প্রকোপে হিতাহিত জ্ঞান হারাইয়া ফেলেন, তাহারা আর কিছু না-পাইলে তাঁহাদের বস্ত্ৰ বৈদ্যুতিক পাখার সঙ্গে কণ্ঠে প্যাঁচাইয়া আত্মহত্যা পর্যন্ত করিয়া থাকেন। কিন্তু শাস্ত্রাদেশ মানিয়া নারীরা গৃহপালিত জন্তুদের মতো গৃহাভ্যন্তরে বন্দী থাকিলে এই অনাহূত ঝামেলা হইতে অনায়াসে আত্মরক্ষা করিতে পারিতেন। (অসূৰ্যাম্পশ্যাদের এই সব উৎপাত ছিলো না। কিন্তু সেই সুখের সত্যযুগ বহু কাল বিগত হইয়াছে।) মোট কথা, ধর্মে লিঙ্গভেদের প্রতি প্রবল জোর দেওয়া হইলেও এই রোগ লিঙ্গভেদ করে না। এই রোগ সার্বজনিক।
রোগ লক্ষণ
এই ব্যাধি হইলে মনের মধ্যে হা-হুতাশ আরম্ভ হয়। বিশেষ একজনের প্রতি অতীব আকর্ষণ ও মনোযোগ দেখা দেয়। তাহার নয়নের সহিত একবার নয়ন মিলাইতে, তাহার সহিত অর্থহীন বাক্যালাপ করিতে, তাহার মনোযোগ লাভ করিতে হৃদয় অত্যন্ত আকুল হইয়া উঠে। তাহা ছাড়া, তাহার স্পর্শ লাভ করিবার জন্য (এমন কি তাহার সঙ্গে দেহ-মন অভিন্ন করিবার জন্য) হৃদয় আই-ঢাই করিতে থাকে। (জনৈক বৈষ্ণব কবি লজ্জা-শরমের মাথা খাইয়া এই ইচ্ছাকে প্রতি অঙ্গ লাগি প্ৰতি অঙ্গের ক্ৰন্দন বলিয়া বৰ্ণনা করিয়াছেন। কথাটা অসঙ্গত নহে। ইচ্ছাটা কতকটা ঐ রকমই হয় বটে। কিন্তু তিনি মধ্যযুগে যাহা অমন অসংকোচে বলিতে পারিয়াছেন, তথাকথিত আধুনিক রুচিবশত আমি তাহা বলা হইতে নিবৃত্ত থাকিলাম।) এই বিশেষজনটি দৃষ্টির আড়ালে গমন করিলেই হৃদয়ের অভ্যন্তরে হাহাকার আরম্ভ হয়। ইহার যথার্থ নাম বিরহ। অতিশয় কঠিন রোগ। এতই কঠিন যে, ইহার শেষ দশা হইল মৃত্যু। কিন্তু সে কথা এখানে থাকুক।
যাহার প্রতি এই অদ্ভুত এবং অহেতুক আকর্ষণ সৃষ্টি হয়, তাহার কোনো মন্দ দিক এই সময়ে দৃষ্টিতে আইসে না। পঙ্গু-পায়ে তাহার খোড়াইয়া চলাকেও এই সময়ে ভারতনাট্যমের মতো মনোহর মনে হইতে পারে। তাহার ত্বকের বর্ণ কৃষ্ণ হইলেও অতঃপর সেই রঙকেই বিশ্বের সর্বোত্তম রঙ বলিয়া ধারণা জন্মে। ধূসর মেঘ, ঘোলাটে জল, সবুজ পাতা— সব কিছুকেই তখন সেই রঙ বলিয়া ভ্ৰম হয়।
এই রোগাক্রান্ত ব্যক্তির আচার-আচরণ এবং প্রত্যাহিক ব্যবহার এই সময়ে আমূল বদলাইয়া যায়। এই চন্দ্ৰে-পাওয়া ব্যক্তিরা এই সময়ে এমন এক-একটা অদ্ভুত কাজ করিয়া বসেন যাহা অন্য সময়ে কখনোই করিবার কথা ভাবিতেন না। অথবা নিদেন পক্ষে সেই কর্মকে হাস্যকর মনে হইত। বস্তুত, এই আচরণকে পাগলামি বলিলে অত্যধিক বলা হয় না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হইতেছে, এই পাগলামি যে করে, তাহার নিজের নিকট ইহাকে খুবই স্বাভাবিক বলিয়া মনে হয়।
জনপ্রিয় ধারণা হইল যে, ইহা হৃদয়ঘটিত রোগ। কিন্তু হৃদরোগবিশেষজ্ঞরা ইহাকে আদৌ হৃদরোগ বলিয়া স্বীকার করেন না। কেন করেন না, তাহারা ভালো বুঝেন। সাধারণত এই রোগে আক্রান্ত হইলে অনেকে তাঁহাদের হৃদয়ে একটা কেমন কেমন চিনচিনে বেদনা অনুভব করেন। ফলে কখনো কখনো বুক চাপিয়া ধরেন। হৃদয়ে হামলা হইলে অর্থাৎ হার্ট অ্যাটাক হইলে যেমন কেহ চাপিয়া ধরে–তেমন। এতদ্ব্যতীত, এই রোগ হইলে মধ্যে মধ্যে হৃৎপিণ্ডের গতি বাড়িয়া যায়। ইহাকে হৃদরোগের ভাষায় ট্যাকি কার্ডিয়া বলা হয়। শ্বাস-প্ৰশ্বাস। ঘন ঘন হইতে থাকে। আর প্রায়শ নিজের অনিচ্ছায় এবং অজ্ঞাতে ফোস ফোস করিয়া দীর্ঘনিশ্বাস পড়িয়া থাকে। এই সব লক্ষণ হইতে সাধারণ মানুষের ধারণা হইতেই পারে যে, ইহার সহিত হৃদরোগের অন্তরঙ্গ যোগাযোগ রহিয়াছে। কিন্তু আগেই বলিয়াছি, হৃদরোগবিশেষজ্ঞরা এই কথা স্বীকার করেন না।
অনেকে বলেন, ইহা মনের রোগ। হৃদরোগ-বিশেষজ্ঞদের ইহাতে কোনো আপত্তি নাই। তবে হৃদরোগ হইলে অস্ত্ৰোপচার করিয়া তাহার চিকিৎসা করা যায়। মুশকিল হইল, মনটা শরীরের কোন স্থানে অবস্থিত, বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি সত্ত্বেও তাহা কেহই জানে না। সুতরাং চিকিৎসকগণ প্ৰেমরোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের দেহের সেই স্থানে খোচাইয়া কোনো পদাৰ্থ বাহির করিয়া বায়ল্পি করিয়া পরীক্ষা করিবেন, তাহার উপায় নাই। তাহা না-হইলে জীন-প্ৰযুক্তি অথবা ঐ ধরনের কোনো অত্যাধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি দিয়া হয়তো ইহার কথঞ্চিৎ প্রতিকার সম্ভব হইত। হৃৎপিণ্ডের অবস্থান এবং তাহার পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যাদি ডাক্তারগণ ভালো করিয়া জানেন। সেই হেতু কাটাকুটি করিয়া তাহারা ব্যৰ্থ অথবা আশিংক বিগলিত হৃৎপিণ্ডকে মেরামত করিতে পারেন। কিন্তু মনের অবস্থান না-জানায় শৈল্যচিকিৎসার দ্বারা প্ৰেমরোগ ভালো করিবার কোনো পন্থা অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই।
অনেকে মনে করিয়া থাকেন যে, হৃদয়ের নয়, এই রোগ প্রকৃত পক্ষে মস্তিষ্কের। কারণ, মানুষ মস্তিষ্কের সাহায্যেই প্রেমিক/প্রেমিকার ধ্যান করিয়া থাকে। এই ব্যাধিকে অতএব অনেকে মস্তিষ্ক বিকার বলিয়া সাব্যস্ত করিয়াছেন। তাহার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, এই রোগাক্রান্ত ব্যক্তিরা কমবেশি পাগল। ইলেক্টিক শক দিয়া পাগলামির চিকিৎসা অনেক সময় সাফল্যের সঙ্গে হইয়া থাকে। কিন্তু প্ৰেমরোগ হইয়াছে চিকিৎসকগণ এই রূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হইলে সেই পাগলকে ইলেক্টিক শক দিবার বিধান দেন না। বরং অভিভাবকরা প্ৰচণ্ড ধমক দিলে অথবা প্রেমিক/প্রেমিকা বিশ্বাসঘাতকতা করিলে এই বিকার প্রশমিত হয়।
অনেকে বলেন, এই রোগ এক প্রকারের জুর। শরীরের কোনো স্থানে কোনো বিকার ঘটিলে, সংক্ৰামক রোগ হইলে অথবা ভাইরাসের আক্রমণ হইলে যেমন দেহের উত্তাপ বৃদ্ধি পায়, প্রেম রোগে আক্রান্ত হইলে তেমনি মনের উত্তাপ বাড়িয়া যায়। মুশকিল হইলো: জুর হইলে তাপ-কাঠি দিয়া উত্তাপের পরিমাপ করা যায়। কিন্তু প্ৰেমজুর হইলে তাহা মাপিবার মতো কোনো থার্মোমিটার অদ্যাবধি বাজারে ছাড়া পায় নাই। আবিকৃত হইয়াছে বলিয়াও শোনা যায় নাই। তাহা ছাড়া, সাধারণ জুর প্যারাসিটামলে দ্রুত কমিয়া যায়, কিন্তু প্ৰেমজুরের তেমন কোনো বটিকা নাই। রোগাক্রান্তের মস্তকে ঘটি ঘটি জল ঢালিলেও এই জুরের উপশম হয় না। অবশ্য কেহ। কেহ বলিয়া থাকেন যে, মাথা মুড়াইয়া ঘোল ঢালিয়া গাধার পৃষ্ঠে চড়াইলে ক্ষেত্র বিশেষে কিছু উপকার জন্মে। কিন্তু ইহা পরীক্ষিত সত্য নহে।
মোট কথা, মর্মঘাতী এবং ক্রমবর্ধমান প্ৰেমরোগের সফল অথবা ব্যর্থ— কোনো রকম চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয় নাই। অতএব, এই ব্যাধির ব্যাপারে ঔষধের কোম্পানিগুলির কি অধিকতর সচেষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয় নহে? এই পীড়ার জুতসই একটি বটিকা–এমন কি, তিক্ত স্বাদের কোনো তরল মিকশ্চার বাহির হইলেও তাহা যে লোকে লাইন লাগাইয়া কিনিবেন, সে বিষয়ে সন্দেহের তেমন অবকাশ আছে বলিয়া সমাজসচেতন কোনো ব্যক্তিই মনে করিবেন না। কারণ, প্রেমে পড়িলে তাহাকে বেশ কষ্টকর অভিজ্ঞতা বলিয়া মনে হয়। অনেক সময়ে রীতিমতো হৃদয়বিদারক বলিয়াও মনে হইতে পারে। অতএব এই রোগের ঔষধ যতোই তিক্ত হউক, যতোই দুর্মুল্য হউক, যতোই দুর্লভ হউক, লোকে তাহা সংগ্ৰহ করিতে চেষ্টার ক্রুটি রাখিবে না। কিন্তু গলদ একেবারে গোড়ায়। বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, ভেজস কোম্পানিগুলি এই রূপ একটি ঔষধ আবিষ্কারের নিমিত্ত উদ্যোগী হইবার কোনো লক্ষণ দেখাইতেছে না। আমার বিবেচনায় সকলে মিলিয়া এখন মাননীয় গবর্নমেন্টের দরবারে দরখাস্ত দিবার প্রয়োজন দেখা দিয়াছে। কিন্তু একমাত্র আমার বিবেচনার উপর নির্ভর করিতে না-পারিলে এই বিষয় বিবেচনা করিবার নিমিত্তে অবিলম্বে একটি সর্বদলীয় নাগরিক কমিটি গঠন করা হউক।–এই বিষয়ে স্বদেশ হিতৈষীগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি।
(বিশেষ দ্রষ্টব্য: কোন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় গভর্ণমেন্ট বাহাদুর প্রেমের প্রতিকারের নিমিত্ত অৰ্থ বরাদ্দ করিবেন, তাহা কবে বাস্তবায়িত হইবে এবং সাংসদ মহোদয় ও তাঁহাদের তাবেদারগণ ঐ অর্থের কতোটা অনৰ্থ করিবেন এবং তাহার ফলে প্ৰেম-ব্যাধির সম্ভাব্য ঔষধ কতোটা কার্যকর হইবে, তাহার কোনো নিশ্চয়তা নাই। ইতিমধ্যে এই রোগে আক্রান্ত লোকের সংখ্যা বাড়িয়াই চলিতেছে। তাহাদের কি বলিয়া সাত্ত্বনা দেওয়া হইবে? ভাবিয়া আমি কোনো কুলকিনারা দেখিতেছি না। কি করিব? কি বলিব? ইতিবাচক একমাত্ৰ যাহা মনে পড়িতেছে, তা অতি প্রাচীন কালের এক বিখ্যাত কবির উক্তি। ইহা একটি প্রাকৃত ভাষার গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে। এই কবির উক্তিই একমাত্র ভরসা। প্ৰেমরোগ থেকে আরোগ্য লাভ করিবার পর নিজের অভিজ্ঞতা দিয়া এই কবি বলিয়াছেন যে, প্ৰেম চলিয়া যায়।
পিশুনজনের জল্পনায়, হায়, প্রেম চলে যায়,
প্ৰণয়ের কোমল কুসুম যায় ঝরে
অতিদর্শনের বন্যা এসে
প্রেমের প্রবীণ বৃক্ষ তাকেও উপড়ায়—
এমন কি, একেবারে অকারণে প্ৰণয়ের মহীরুহ কুপোকাত হয়।)
(প্ৰথম আলো, ২০০৭)