৩০. পুলিশের হাঙ্গামায় বাকের

পুলিশের হাঙ্গামায় বাকের এর আগেও দুবার পড়েছে। প্রথমবার ভয় ভয় করছিল। জিপে করে থানায় যাবার সময় তার বুক কঁপিছিল এবং প্রচণ্ড রকম পিপাসা বোধ হচ্ছিল। থানায় পৌঁছে অবশ্যি ভয়টা কেটে গেল। ওসি সাহেব চমৎকার ব্যবহার করলেন। এমন ভাবে কথাবার্তা বলতে লাগলেন যেন বাকের তার দীর্ঘদিনের চেনা মানুষ। চা-সিগারেট খাওয়ালেন। ঘণ্টা দু’এক পর বললেন, আচ্ছা ভাই যান।

কেনই বা তাকে এনেছিল কেনই বা ছেড়ে দিয়েছিল তা বাকের জানতে পারেনি। জানার চেষ্টাও করেনি। ইয়াদ অবিশ্য খুব ছোটাছুটি করেছে। নানান জায়গায় টেলিফোন করেছে। সেই সব টেলিফোনের একটি ভূমিকাও হয়ত আছে। থানার সেকেন্ড অফিসার বাকেরকে নামিয়ে দিতে জিপ নিয়ে এলেন। লোকটির বয়স অল্প। বয়সের তুলনায় চেহারা বেশ কঠিন। কথা বলে খ্যাসখ্যাসে গলায়। কিন্তু লোকটিকে বাকেরের পছন্দ হয়েছিল। সে জিপে আসতে আসতে বলল, সব সময় মাস্তানরা কি করে জানেন? ক্ষমতায় যে দল থাকে তার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। তাদের টিকে থাকার স্বার্থেই তারা তা করে। ক্ষমতাসীন দলের ওদের দরকার। ওদেরও সরকারি সাপোর্ট দরকার। মাঝখান থেকে আমরা বসে বসে কলা চুষি।

বাকের বলল, সরকারি দলের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।

সেকেন্ড অফিসার সেই কথার তেমন কোন গুরুত্ব দিল না।

বিরসমুখে সিগারেট টানতে লাগল। সস্তা সিগারেট। গন্ধে মাথা ধরে গেল বাকেরের। পুলিশের অফিসারও যে সস্তা সিগারেট খায় তা বাকেরের জানা ছিল না। সে সেপাইদের হাতেও ফাইভ ফাইভের প্যাকেট দেখেছে।

দ্বিতীয়বার পুলিশ হাঙ্গামা হল মইনুদ্দীন বেপারী নামের এক লোকের জন্যে। সে বাকের এবং ইয়াদের নামে কেইস করে দিল। দোকানের ক্ষতিসাধন ও লুণ্ঠন। অভিযোগও গুরুতর। মইনুদ্দীনের কোমরে জোর ছিল। তার এক খালাতো ভাই প্রতিমন্ত্রী। কাজেই পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেল বাকের এবং ইয়াদকে। সেবার পাঁচ ঘণ্টার মতো থাকতে হল থানায়। এই পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে কে বা কারা যেন মইনুদ্দীন বেপারীর দোকানে আগুন লাগিয়ে দিল। পাঁচ ছ লাখ টাকার জিনিস নিমিষে উধাও। দিনদুপুরে তিনটা বোমা ফাটল মইনুদ্দীন সাহেবের বাড়ির সামনে।

বাকের ছাড়া পেয়ে আসামাত্র মইনুদ্দীন সাহেব কাঁদো কাঁদো মুখে দেখা করতে এলেন। জড়িত গলায় বললেন–একটা মিস আন্ডারস্টেনডিং হয়ে গেছে। অন্যের পরামর্শে পড়ে এই ব্যাপার। এখন আপনি যদি জিনিসটা ক্ষমার চোখে না দেখেন তাহলে তো মুশকিল। আপনি আমার ছোট ভাইয়ের মতো। বড় ভাই যদি না বুঝে একটা কাজ করে…

জিপে করে পুলিশের কাছে যাওয়াটাই এক সময় একটি আনন্দের ব্যাপার ছিল। লোকজন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। নেতা নেতা একটি ভাব হচ্ছে মনে।

কিন্তু আজ সে রকম মনে হচ্ছে না। বাকেরের মনে হল এবারের ব্যাপারটা অন্যরকম। কারণ থানার ওসি এক পর্যায়ে তাকে বলল, এইবার আপনার তেল কমাব।

একটা থানার ওসি তার সঙ্গে এই ভাবে কথা বলবে কেন? রহস্যটা কোথায়? এই লোকই তো আগের দুবার তাকে ভাই বলেছে। চা এবং গরম ডালপুরী এনে খাইয়েছে। ফেরত পাঠিয়েছে পুলিশের জিপে।

আজ সে তিন ঘণ্টা যাবত কাঠের একটা বেঞ্চিতে বসে আছে। ওসির ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে তাকে চিনতেই পারছে না। একটা লোককে ধরে নিয়ে এসেছে। এ নিয়ে কারোর কোনো মাথাব্যাথা নেই। ওসি সাহেব বিয়ে বাড়ির এক লম্বা-চওড়া গল্প ফেদেছেন। সবাই আগ্রহ করে গল্প শুনছে। সেতাবগঞ্জে বরযাত্রী যাবে ভুলে গিয়ে উঠেছে নবীগঞ্জে। সেখানেও এক মেয়ের বিয়ে। সাজানো বাড়ি দেখে সবাই গিয়ে বর নিয়ে উঠল। মাইকে গান-টান বাজছে। কনে পরীয়রে মধ্যে কানাঘুষা হচ্ছে। সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। অচেনা বর, অচেনা লোকজন। দীর্ঘ গল্প। শেষই হতে চায় না। যারা শুনছে তারা হেসে গড়িয়ে পড়ছে। উৎসাহ পেয়ে ওসি সাহেব রসাল জায়গাগুলি দ্বিতীয়বার করে বলতে লাগলেন। বাকেরের মনে হল এই গল্প শেষ হবা মাত্র দ্বিতীয় একটি গল্প শুরু হবে। সে শুকনো মুখে বলল, এক গ্লাস পানি খাব।

ওসি সাহেব বললেন, পানি খেলেই পেচ্ছাব পেয়ে যাবে। চুপচাপ বসে থাকেন। ঠাণ্ডার দিনের এত কিসের পানি খাওয়া-খাওয়ি?

এতেই হাসির স্রোত বয়ে গেল! বাকেরের বিস্ময়ের সীমা রইল না। দুপুর একটা পর্যন্ত বাকের একই জায়গায় বসে রইল। একটা সময। ওসি সাহেব বললেন, ওকে হাজতে ঢুকিয়ে দিন।

বাকের বলল, কী ব্যাপার আমাকে বলুন?

ওসি সাহেব বললেন, সময় হলে সবই শুনবেন। সময় হয় নাই। এখনো বাকি আছে।

এই কথাতেও একটি হাসির স্রোত বইল! এ থানার ওসি সাহেব যে একজন রসিক ব্যক্তি সে পচিয় বাকের এর আগে পায়নি। বিভিন্ন পরিবেশে মানুষের বিভিন্ন পরিচয় পাওয়া যায়।

হাজতে ছোট্ট ঘরটায় নজন হাজতি। এর মধ্যে একজন অসুস্থ। সে বিকট শব্দে বমি করছে। বমির চাপে চোখ উল্টে আসছে। কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। সবার চোখের দৃষ্টিতে এক ধরনের উদাস ভাব।

দরজার পাশে সেন্ট্রি পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। চোখে-মুখে রাজ্যের নির্লিপ্ততা! বমি করার ব্যাপারটি সে দেখছে কিন্তু সে দৃশ্য তার মনে কোনো ছাপ ফেলছে না। বাকের বলল, ভাই এসব পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করুন। লোকটাকে একটা ডাক্তার দেখান!

পুলিশটি কোনো শব্দ করল না। বাকের দ্বিতীয়বার বলল, কি ব্যাপার ভাই? কিছু করুন।

সন্ধ্যাবেলা জমাদার আসবে তখন পরিষ্কার হবে।

লোকটাকে এক গ্রাস পানি এনে দিন।

পুলিশটি বড় একটি টিনের মাগে এক মগ পানি এনে দিল।

বাকেরের ধারণা ছিল সন্ধ্যার আগেই অনেকে আসবে তার কাছে।

তার ভাই হয়ত আসবে না। কিন্তু লোক পাঠাবো। সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকতে হবে কষ্ট করে।

ঘরে বমির কুৎসিত গন্ধ। সবাই নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বসে আছে। টাক মাথার গোঁফ ওয়ালা একটি লোক বলল, বড় ভাই আপনার কাছে সিগারেট আছে?

বাকের বলল, না।

টাকা তো আছে। সেন্ট্রিকে দেন সিগারেট এনে দিবে। ওকে পাঁচটা টাকা দিতে হবে। আমার কাছে দেন ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

বাকের একটা কুড়ি টাকার নোট বের করে দিল। টাক মাথার লোকটি বলল, আরো পাঁচটা টাকা দেন তাহলে ভাল কম্বল পাবেন। নয়, এমন কম্বল দিবে ঘুমাতে পারবেন না।

আপনি কতদিন ধরে আছেন এখানে?

তের মাস।

তের মাস? বলেন কি?

এতদিন খাজতে রাখার কোনো নিয়ম নিযাই। কোর্টে নিতে হয়। জামিন দিতে হয়, জামিন না। হলে জোলখানায় হাজত আছে। কিন্তু–

কিন্তু কি?

না কিছু না।

দুইটা খুন করেছি। টাকা খেয়ে করেছি। যাদের টাকা খেয়ে করেছি। তারাই ধরিয়ে দিয়েছে। বড় ভাই, গোটা দশেক টাকা ধার দিতে পারেন? আমার ছেলে টাকা নিয়ে এলেই পেয়ে যাবেন।

আপনার নাম কি?

আমার নাম কবীর উদ্দিন। বাড়ি হচ্ছে গিয়ে মুন্সিগঞ্জ। মুন্সিগঞ্জ গিয়েছেন কখনো?

না।

ভালই করেছেন না গিয়ে। যাওয়ার মতো জায়গা না। আমি নিজেই যাই না।

বাকের মানিব্যাগ খুলে দশটি টাকা দিল। ব্যাগে আরো ত্ৰিশ টাকার মত আছে। তার জন্য যথেষ্ট। সন্ধ্যার আগেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

সন্ধ্যার আগে কোন ব্যবস্থা হল না। কেউ এল না বাকেরের কাছে। অসুস্থ লোকটি বিকট শব্দে বমি করতে লাগল। মাঝরাতে। বাকের ভেবেছিল এখানেই মরে পড়ে থাকবে। তা অবশ্যি হল না। ওসি সাহেব এসে তাকে হাসপাতালে পাঠালেন। হাজতঘরে কোনো বাতি নেই। বাতির দরকারও নেই। বারান্দার আলো এসে পড়ছে। এতেই দেখা যাচ্ছে। তবু ওসি সাহেব কি মনে করে যেন পাঁচ ব্যাটারির টর্চলাইট সবার মুখের ওপর কিছুক্ষণ করে ধরতে লাগলেন। বাকেরের মুখের ওপর তাও অনেকক্ষণ ধরা রইল।

এটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে হাসান সাহেব বাকেরের গ্রেফতার হবার খবর পেলেন দেড় দিন পর। তাও পত্রিকার মাধ্যমে। ছবি ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। কোন খবরই তিনি দুবার পড়েন না। এটিও পড়লেন না। যদিও তার মন বলতে লাগল এ খবরটা আবার পড়া উচিত। এবং কিছু করলেন না। এগারটা বাজার আগেই বাসায় চলে এলেন। অফিসে তার কিছুই করার ছিল না।

সেলিনা অসময়ে তাকে ফিরতে দেখে মোটেই অবাক হলেন না। যেন তিনি জানতেন হাসান সাহেব অসময়ে ফিরবেন। এবং এ জন্যেই যেন সেজোগুজে অপেক্ষা করছিলেন। সেলিনা বললেন, তুমি কি আট ঘণ্টার নোটিসে চিটাগাং যেতে পারবে?

কেন?

পারবে কিনা আগে বল।

না পারার তো কোনো কারণ দেখি না।

তানিয়ার বিয়ে। এখন আবার বলে বোস না যে তুমি তানিয়াকে চেন নয়। চেন তো?

হ্যাঁ চিনি। তোমার খালাতো বোন।

না হয়নি। আমার ফুফাতো বোন। হঠাৎ বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমাকে টেলিফোনে বলল। আমি বলে দিয়েছি যে ভাবেই হোক তোমাকে নিয়ে আমি কাল সকালে চিটাগাং উপস্থিত হব।

হাসান সাহেব কিছু বললেন না। সেলিনা বললেন, কথা বলছি না কেন?

কি বলব?

যেতে পারবে কিনা? বিয়েটা সেরে সেই রাতেই না হয় ফিরে আসব। রাত দশটায় ট্রেন আছে। আমি টিকিট কাটতে পাঠিয়েছি। অনেক দিন ট্রেনে চড়া হয় না? তোমার ট্রেনে চড়তে ইচ্ছা করে না?

করে।

তুমি যে প্রায়টা একটা করিতা বলতে কামরায় গাড়ি ভরা ঘুম। রজনী নিঝুম।

হা বলতাম।

রাতের ট্রেনে জাস্ট আমরা দু’জন। ইন্টারেস্টিং হবে না? আমার তো মনে হয় খুব ফান হবে।

হবে হয় তো।

আমি তোমার সুটকেস গুছিয়ে রেখেছি।

কাজ তো তাহলে অনেক দূর এগিয়ে রেখেছ।

হ্যাঁ তা রেখেছি।

ট্রেন ছাড়ল রাত দশটায়। হাসান সাহেবের বেশ ভালই লাগছে। কামরায় গাড়ি ভরা ঘুম রজনী নিঝুম। কবিতাটি বাববার মাথায় ঘুরছে। দু’জন মাত্র প্রাণী এ কামরায়। তাদের কেউ ঘুমুচ্ছে না। তবু এই কবিতার চরণটিই মাথায় আটকে গেল কেন? সেলিনা কি সব যেন বলছে। কিছুই মাথায় ঢুকছে না। কিন্তু শুনতে ভাল লাগছে। সেলিনার গলার স্বর চমৎকার।

এ্যাই তুমি কথা বলছি না কেন?

শুনছি। দুজনে কথা বললে কে শুনবে?

বাকেরের ব্যাপারটা নিয়ে কিছু করেছ?

হাসান সাহেব বললেন, তুমি জানতে?

জানব না কেন?

কবে জানলে?

যেদিন ধরে নিয়ে গেল সেদিনই। তুমি অফিসে চলে গেলে। একটা ছেলে এসে আমাকে বলল।

আমাকে তো কিছু বলছিন। আমি জানলাম খবরের কাগজ পড়ে।

সেলিনা চুপ করে রইলেন। হাসান সাহেব শান্ত স্বরে বললেন, আমাকে জানানো উচিত ছিল।

আমার জানাতে ইচ্ছা করেনি।

হাসান সাহেব। আবার চুপ করে গেলেন। ট্রেন চলছে দ্রুতগতিতে। ঝিকঝিক শব্দ হচ্ছে। ছোটবেলায় এই শব্দে কত রকম গান মিশে যেত। এখন যাচ্ছে না। শুধু রজনী নিঝুম কথাটা এসে মিশেছে।

সেলিনা বললেন, ঘুমিয়ে পড়েছ?

না।

বাকেরকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। ওর বন্ধু-বন্ধাবরা ওকে ছাড়িয়ে আনবে।

আমি বাকেরকে নিয়ে ভাবছি না।

কি ভাবিছ তাহলে?

নিজের কথা ভাবছি।

 

কোর্টে বাকেরের জামিন হল না। তার বিরুদ্ধে চারশত আটচল্লিশ এবং উনিশ অবলিকের এফ ধারায় দু’টি অতিযোগ। এই দু’টি অভিযোগই জামিনযোগ্য নয়। কোর্টে থেকে পুলিশ রিমান্ডে উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকে আরো জিজ্ঞাসাবাদ করা। তার সহয়োগী অপরাধীদের সম্পর্কে তথ্যাদি নেয়া। কিন্তু কাৰ্যক্ষেত্রে সে রকম কিছু হল না। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার ব্যাপারার পুলিশের কোন রকম আগ্রহ দেখা গোল না। এরমধ্যে ইয়াদ এল তাকে দেখতে। সুন্ট-টুট পরা ভদ্রলোক। চুলের স্টাইল বদলে ফেলেছে কিংবা কিছু একটা করেছে। তাকে চেনা যাচ্ছে না। সে চোখ কপালে তুলে বলল, অবস্থা কি?

অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছিস।

হেভি পিটন দিয়েছে মনে হয়। মুখ ফোলা।

মারধর করেনি। মশার কামড়ে মুখ ফুলেছে।

মশারি দেয় না।

বাকের উত্তর দিল না তার প্রচণ্ড ইচ্ছা করছে গারদের ফ্যাক দিয়ে হাত বের করে প্রচণ্ড একটি চড় কষিয়ে দিতে। সে দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বলল, হারামজাদা।

আমি খবর পেয়েছি। পরশু বুঝলি। খবর শুনে আমার মাথায় থান্ডার এসে পড়ল। বিনামেঘে বজাঘাত। আমি ভাবলাম ব্যাপারটা কি! কোন ঝামেলায় জড়ালি। নে সিগারেট নে।

বাকের সিগারেট নিল। টাক মাথার কবীর উদ্দিন বলল, স্যার আমারে একটা দেন। আমি বাকের সাহেবের খোঁজখবর করছি।

ইয়াদ সিগারেটের প্যাকেট বাকেরের দিকে এগিয়ে দিল। রাজা মহারাজাদের মতো ভঙ্গি করে বলল, রেখে দে তোর কাছে। আর শোন কোনরকম চিন্তা করবি না। আমি আমার শ্বশুর। সাহেবকে বলছি। সে কানেকশনওয়ালা আদমি। দুই তিনটা টেলিফোন করলেই দেখষি জামিন হয়ে গেছে। তোর ভাই কিছু করছে?

জানি না। বোধ হয় কিছু করছে না। শুনলাম তার চাকরি নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। কি সমস্যা?

তা জানি না। বাংলাদেশে কি সমস্যার শেষ আছে নাকি? হা হা হা।

বাকের পেট কাঁপিয়ে হাসতে লাগল। এর মধ্যে তার একটা নাদুস নুদুস ভুড়িও হয়েছে। দেখলেই হাত বুলাতে ইচ্ছা করে।

বাকের।

বল।

আমার একটা নিউজ আছে। শ্ৰীলংকা যাচ্ছি।

তাই নাকি?

হুঁ, আমার এক মামাশ্বশুর ম্যানেজ করে দিলেন। ব্যবসার ব্যাপার। ওখান থেকে নারকেল তেল আনব।

ভাল।

আমার বউও সঙ্গে যেতে চাচ্ছে বুঝলি। দিনরাত ঘ্যান ঘ্যান করছে।

নিয়ে যা।

মেয়েছেলে কোথাও সঙ্গে নিতে আছে? ঐ যে কি যেন বলে–পথে নারী বিবর্জিতা। আমিও চেষ্টা করছি। কিছু লাভ হবে না। এঁটেল মাটির মতো লেগে গেছে।

বাকের চুপ করে রইল। ইয়াদ তার সিগারেট শেষ করে উঠে থু করে একদলা থুথু ফেলল। চোখ মুখ কুঁচকে বলল, বড় গাধা জায়গা, বমি এসে যাচ্ছে। তুই কোন চিন্তা করিস না। চিকোবশ ঘণ্টার মধ্যে ছুটিয়ে নিয়ে যাব। কাউকে কোন খবর টাবর দিতে হবে?

না। তুই যাচ্ছিস?

হুঁ।

কবীর উদ্দীন বলল, স্যার আপনি বাকের সাহেবকে কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে যান। উনার হাতে একটা পয়সা নাই।

ইয়াদ আশ্চর্য হয়ে মানিব্যাগ বের করল। দুইটি একশ টাকার নেট এবং কিছু খুচরা ছিল। একশ টাকার দু’টি নোটিই এগিয়ে দিল। বাকের টাকা নেবার ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখাল না। হাত বাড়াল কবীর উদ্দীন। মুখ তৰ্তি হাসি দিয়ে বলল, যাবার আগে ওসি সাহেবকে একটু স্যার বলবেন আমাদের দেখাশোনার জন্যে। একটা এক্সট্রা কম্বল পেলে স্যার খুব ভাল হয়।

সাত দিনের পুলিশ রিমান্ডের সময়সীমা শেষ। কিন্তু পুলিশ আরো সাত দিনের সময় চাইল। কোর্ট সময় মঞ্জর করল। বাকের পুরনো হাজতঘরে ফিরে এল। কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে এল না। প্রথম সাতদিন পার করতে যতটা খারাপ লাগছিল। দ্বিতীয় সাতদিনে ততটা খারাপ লাগল না। কারণ কবীর উদ্দীন কী ভাবে যেন গাজার ব্যবস্থা করে ফেলেছে। গাজাটা বেশ ভাল জিনিস। টানার জন্যে কলকে লাগে না। সিগারেটের তামাক ফেলে দিয়ে তার ভেতর গাজা ভরে চমৎকার টানা যায়। ভালই লাগে।

প্রথম খানিকক্ষণ মন খুব কোমল হয়ে যায়। কাঁদতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছা করে খুব ভাল ভাল কাজ করতে। মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর করে দিতে। সেই কোমল ভাবটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। খানিকক্ষণের মধ্যেই জগৎ-সংসার সম্পর্কে একটি বৈরাগ্য এসে পড়ে। এই বৈরাগ্যের ভাব সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী হয়। সবচে বড় কথা রাতের ঘুমটা ভাল হয়। এক ঘুমে রাত কাভার। ঢং ঢেং করে এরা যে ঘণ্টা পিটে সেই শব্দও কানো যায় না।

অন্যান্য হাজতিদের সম্পর্কে প্রথমদিকে তাক খানিকটা বিতৃষ্ণার ভাব ছিল। এখন সেটা নেই। সবার সঙ্গেই তার এখন ভাল সম্পর্ক। মতিলাল নামে একজন হাজতি ছাড়া পেয়ে চলে যাবার দিন বাকেরের বুক হুঁ-হু করতে লাগল। আর মতিলাল হারামজাদাও এমন গরু, ছাড়া পেয়েছিস বগল বাজাতে বাজাতে চলে যা, তা না। সবাইকে জড়িয়ে ধরে আকাশ-পাতাল কান্না। এই ভাবে কাঁদলে অন্যদের চোখে পানি আসবেই। বাকেরের গাল ভার হয়ে গেল। চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। বহু চেষ্টায় গলার স্বর কর্কশ করে সে বলল, কী এত দেরি করছেন? বাড়ি চলে যান। আর এত কাঁদছেন কেন? মেয়েছেলে নাকি? চোখ মুছেন রে ভাই!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *