পথিকৃৎ প্রকাশক
আমাদের সাহিত্যসমাজে এ রকম একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশের প্রকাশনা জগৎ বলে তেমন কিছু ছিল না। বিশেষ করে, ১৯৪৭ এর আগে তো কিছুই ছিল না। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। ১৯৫০ থেকে ‘৭১ পর্যন্ত দুই দশকে বাংলাদেশে একটি ভালো প্রকাশনা জগৎ গড়ে ওঠে। শুধু তা-ই নয়, বর্তমান। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে মুদ্রণ ও প্রকাশনার সূচনা দেড় শ বছর আগে ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। তবে সেই প্রকাশনা জগৎ কলকাতার মতো সমৃদ্ধ ছিল না। কলকাতার পুস্তক প্রকাশনার বয়স আরও ৫০ বছর বেশি। তা ছাড়া যেহেতু কলকাতা ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী, তাই সরকারি প্রয়োজনে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতায় আধুনিক মুদ্রণ ও প্রকাশনাশিল্প বিকশিত হয় উনিশ শতকের মাঝামাঝি নাগাদ। পূর্ববঙ্গের ঢাকা নগরী কলকাতার থেকে কয়েক শতাব্দী পুরোনো হওয়া সত্ত্বেও ছিল অবহেলিত এবং সরকারি আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত। দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রপত্রিকা সব কলকাতা থেকেই প্রকাশিত হতো বড় বড় ছাপাখানা থেকে। গুরুত্বপূর্ণ বইপত্রও বের হতে থাকে আধুনিক প্রেস থেকে। সেসব বইপত্রের ছাপা-বাঁধাই ছিল আন্তর্জাতিক মানসম্মত। বাস্তব কারণেই ঢাকার প্রথম ৫০-৬০ বছরের প্রকাশনার মান উন্নত ছিল না।
পঞ্চাশের দশকে আমাদের নিকট ও দূরসম্পর্কের আত্মীয়স্বজনের অন্তত জনা পনেরোর ছাপাখানা, বাঁধাইখানা ও প্রকাশনা ব্যবসা ছিল। পঞ্চাশের দশকের প্রথম। দিকে আমি আমার বাবার সঙ্গে চকবাজার, ইসলামপুর, জিন্দাবাহার, তাঁতীবাজার, পাটুয়াটুলী, বাংলাবাজার, পাতলাখান লেন থেকে ফরাশগঞ্জ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রেসে গিয়েছি। ছোট ট্রেডল মেশিন হোক বা ফ্লাট মেশিন হোক, কাগজ ছাপা হতে দেখতে আমার খুব ভালো লাগত। সেখানে অনেক ট্রেডল মেশিন মেশিনম্যান পা দিয়ে চালাতেন। ফ্লাট মেশিন স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলত, তবে কাগজটা মেশিনম্যান হাতে ধরিয়ে দিতেন। মনোমেশিন ও লাইনো সম্ভবত এখন উঠে গেছে। ওগুলোতে অপারেটর টাইপ করলে মেশিনেই কম্পোজ হয়ে যেত। অফসেট মুদ্রণযন্ত্র অনেক পরে এসেছে।
উনিশ শতকের শেষ ৪০ বছরে ঢাকায় অন্তত ৪০টি ছাপাখানা ছিল। ওইসব ছাপাখানার প্রায় সব কটিই ছিল ছোট, একসঙ্গে ডিমাই আকারের দুই বা চার পৃষ্ঠা ছাপা হতো। পরে একটু বড় প্রেসে একসঙ্গে ডিমাই বা ক্রাউন আকারের আট পৃষ্ঠা পর্যন্ত ছাপা সম্ভব হতো। এক শ সোয়া শ বছর আগের মুদ্রিত বই দেখে এ ধারণা পাওয়া যায়।
যারা বলেন ঢাকায় আগে কিছুই ছিল না, যা হয়েছে সবই একাত্তরের পরে, তাঁদের অবগতির জন্য দেড় শ বছর আগের কয়েকটি ছাপাখানার নাম উল্লেখ করছি। সেকালের ছাপাখানার মালিকেরা ছিলেন একালের চেয়ে অনেক বেশি বাঙালি জাতীয়তাবাদী। তাঁদের ছাপাখানাগুলোর নাম থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
কয়েকটি ছাপাখানার নাম : বাঙ্গালা যন্ত্র, আদর্শ যন্ত্র, সুলভ যন্ত্র, শীতল যন্ত্র, ভারত যন্ত্র, আৰ্য্য যন্ত্র, মোহাম্মদী যন্ত্র, সাঈদী যন্ত্র, গিরিশ যন্ত্র, আজিজিয়া যন্ত্র, গোপীনাথ যন্ত্র, গেন্ডারিয়া যন্ত্র, ইসলামিয়া যন্ত্র, ইস্ট বেঙ্গল যন্ত্র, নূতন যন্ত্র, সুদর্শন যন্ত্র, ওরিয়েন্টাল প্রেস, ভারত সুহৃদ (প্রেস ও প্রকাশনা), আশুতোষ যন্ত্র প্রভৃতি। সেকালে প্রেস না লিখে বলা হতো যন্ত্র।
ঢাকার প্রথম ছাপাখানা স্থাপিত হয় ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে। ১৮৬০ সালে স্থাপিত হয় বাঙ্গালা যন্ত্র। এই ছাপাখানা থেকে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার ও কবি প্রাবন্ধিক হরিশ্চন্দ্র মিত্রের কবিতা, প্রবন্ধ ও নাটকের অনেকগুলো বই মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। উনিশ শতকের শেষ দিকে ঢাকার প্রধান কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার, দীনবন্ধু মিত্র, হরিশ্চন্দ্র মিত্র, কালীপ্রসন্ন ঘোষ ছিলেন অগ্রগণ্য। বড় প্রকাশকের মধ্যে স্টুডেন্ট লাইব্রেরি, মওলা বক্স, ওয়াহেদ বক্স প্রভৃতির নাম করা যায়। কালীপ্রসন্ন ঘঘাটের ‘অঞ্জলি’ (১৮৯২) কাব্যের প্রকাশক ছিলেন ওয়াহেদ বক্স। তার কয়েকটি প্রবন্ধ গ্রন্থও ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়।
উনিশ শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকে ঢাকা থেকে অনেকগুলো ‘উপন্যাস প্রকাশিত হয়, যদি সেগুলোকে আদৌ উপন্যাস বলা যায়। আদিনাথ ঘোষের হেমলতা উপন্যাস বাঙ্গালা যন্ত্র থেকে ১৮৮৪-তে প্রকাশিত হয়। আর্জুমান্দ আলীর প্রেম দর্পণ-এর প্রকাশক ছিলেন গোপীনাথ বসাক, প্রকাশিত হয় ১৮৯১ সালে। হারাণচন্দ্র ঘোষের উপন্যাস সরলা (১৮৭৬) প্রকাশ করেন মওলা বক্স। প্রকাশক সরলা এবং আরও কয়েকটি বইয়ের পেছনে বিজ্ঞাপনে বলেছিলেন : ‘এই সকল পুস্তক ঢাকা পাটুয়াটুলী আমার নিকট তত্ত্ব করিলে প্রাপ্ত হইবেন। ক্রেতাগণ নগদ মূল্যে অধিক পুস্তক ক্রয় করিলে যথেষ্ট কমিশন দেয়া হইবে।’ দেখা যায়, দেড় শ বছর আগেও বেশি টাকার বই কিনলে বেশি পরিমাণ কমিশন দেওয়া হতো।
১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম একটি আলাদা প্রদেশ হলে ঢাকার প্রকাশনাশিল্প বিস্তৃত হয়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর মুদ্রণ ও প্রকাশনা বিকশিত হতে থাকে। শতাব্দীর প্রথম দিকেই বাংলাবাজার বইয়ের দোকানে ভরে যায়। যদিও তাতে পাঠ্যপুস্তকই বেশি। কলকাতায় যা ছিল কলেজ স্ট্রিট, ঢাকায় তা-ই যেন বাংলাবাজার। কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, ময়মনসিংহ, রংপুর প্রভৃতি জেলা শহরেও প্রকাশনী সংস্থা ছিল ‘৪৭-এর আগে।
১৯৪৭-এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বছর দুইয়ের মধ্যেই ঢাকায় একটি বড় প্রাণবন্ত প্রকাশনাজগৎ গড়ে ওঠে। কলকাতা থেকে বহু মুসলমান ছাপাখানার মালিক ও বই প্রকাশক ঢাকায় এসে নতুন করে নতুন রাষ্ট্রে ব্যবসা শুরু করেন। কয়েকটি বড় আধুনিক প্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। পাঠ্যপুস্তক ও সৃজনশীল বইয়ের প্রকাশনায়ও আসে নতুন গতি।
উপনিবেশ-পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিশীল প্রকাশনা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু। এটি ওয়ালীউল্লাহদের পারিবারিক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কমরেড পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হয়। যার ঠিকানা ছিল ৬২, সুভাষ এভেন্যু, ঢাকা। এটি ছাপা হয়েছিল সে সময়ের সবচেয়ে আধুনিক ছাপাখানা নবাবপুরের নারায়ণ মেশিন প্রেস থেকে। তখন ঢাকায় ব্লক তৈরির ভালো কারখানা ছিল না বলে কলকাতা থেকে প্রচ্ছদের ব্লক করে আনা হয়েছিল। ১৯৪৮-এর শেষ দিকে লালসালু প্রকাশিত হয়। তখন ওয়ালীউল্লাহ ঢাকা বেতার কেন্দ্রের বার্তা বিভাগের সম্পাদক ছিলেন। তাঁর অগ্রজ সৈয়দ নসরুল্লাহ আমাকে বলেছেন, লালসালু প্রকাশের পর পরই ওয়ালীউল্লাহ করাচি বেতার কেন্দ্রে বদলি হয়ে গেলে তাঁদের কমরেড পাবলিশার্স বন্ধ করে দেওয়া হয়।
কলকাতায় পূর্ব বাংলার মুসলমানদের কিছু প্রকাশনী সংস্থা ছিল। তাদের মধ্যে আইনুল হক খান ও মোহাম্মদ নাসির আলীর নওরোজ পাবলিশিং হাউস সৃজনশীল বই প্রকাশে উদ্যোগী ছিল। তারা ঢাকায় এসে প্রতিষ্ঠা করেন নওরোজ কিতাবিস্তান। মূল অফিস ও বিক্রয়কেন্দ্র ছিল বাংলাবাজারে। পরে নিউমার্কেটে শাখা খোলা হয়। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বইয়ের পরিবেশক ছিল নওরোজ কিতাবিস্তান। নওয়োজ পঞ্চাশের দশকে জসীমউদ্দীনের নির্বাচিত কবিতার সংকলন সুচয়নী, কাজী আবদুল অদুদের নদীবক্ষে, আবু ইসহাকের সূর্য দীঘল বাড়ী, আবুল ফজলের জীবন পথের যাত্রী, আবুল কালাম শামসুদ্দীনের ত্রিস্রোতা, অজিত কুমার ঘোষের বঙ্গ সাহিত্যে হাস্যরসের ধারা প্রভৃতি প্রকাশ করে।
আরেকটি মানসম্মত প্রকাশনা সংস্থা ছিল রুহুল আমীন নিজামীর স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স। সেখান থেকে বেরোত বাংলা সাহিত্যের প্রধান লেখকদের বই। ইস্ট বেঙ্গল পাবলিশার্সের কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটকের বইগুলোও ছিল মানসম্মত। মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের ভাষা ও সাহিত্য, রণেশ দাশগুপ্তের উপন্যাসের শিল্পরূপ, শাহেদ আলীর কৃষ্ণপক্ষ, কাজী আবুল হোসেনের বনজ্যোত্স, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের বাবলা প্রভৃতি ইস্ট বেঙ্গল থেকে প্রকাশিত হয়।
অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন তাঁর নিজের বই প্রকাশের জন্য করেছিলেন হাসি প্রকাশনালয় শান্তিনগরে, লেখক কাজী আফসার উদ্দিন আহমদ করেছিলেন মৃত্তিকা সাহিত্য সদন নয়াপল্টনে, বোরহান উদ্দীন আহমদ ইস্ট বেঙ্গল বুক সিন্ডিকেট পাটুয়াটুলীতে। কবি আহসান হাবীব করেছিলেন কাঠেরপুল লেনে কথা বিতান।
সেকালের ঢাকার বড় বড় প্রকাশনীর মধ্যে ছিল প্রেসিডেন্ট লাইব্রেরি, আদিল ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ইসলামিয়া লাইব্রেরি, ওসমানীয়া বুক ডিপো, কোহিনূর লাইব্রেরি, প্যারাডাইস লাইব্রেরি, আহমদ পাবলিশিং হাউস, লিয়াকত পাবলিশিং কোম্পানি, সরোজ লাইব্রেরি, পাকিস্তান বুক কর্পোরেশন, সোবহানিয়া লাইব্রেরি কপোতাক্ষী, শ্রাবণী, স্টুডেন্ট ওয়েজ, মোহাম্মদী বুক হাউস, আইডিয়াল পাবলিকেশন্স, মখদুমী অ্যান্ড আহসানউল্লাহ লাইব্রেরি প্রভৃতি। গুলিস্তানে ছিল অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। সেখান থেকে ইংরেজি ও বাংলা ভালো ভালো বই প্রকাশিত হতো। কবি মঈনুদ্দীনের যুগস্রষ্টা নজরুল, ইব্রাহীম খাঁর ইস্তাম্বুল যাত্রীর পত্র প্রভৃতি অক্সফোর্ড থেকে বের হয়।
যেগুলোর নাম আমি স্মৃতি থেকে উল্লেখ করলাম, তার বাইরে বাংলাবাজার ও নিউমার্কেটে আরও সৃজনশীল প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান ছিল। পাঠ্যবইয়ের প্রকাশনী ছিল বহু– ঢাকা ও অন্য জেলা শহরে। সুতরাং, নিঃসন্দেহে বলা যায়, ষাটের দশকে তো বটেই পঞ্চাশের দশকেই বাংলাদেশে একটি প্রাণবন্ত প্রকাশনী জগৎ গড়ে ওঠে। তারাই আমাদের আজকের আধুনিক প্রকাশনীর অগ্রপথিক। তাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।