৩০. দ্য পেনসিভ
অফিসের দরজা খুলে গেল। হ্যালো পটার তুমি এখানে দাঁড়িয়ে? এস এস বাইরে কেন, ভেতরে এস, মুডি ওকে দেখে বললেন।
হ্যারি ঘরের ভেতর গেল। এর আগে হ্যারি মাত্র একবার ডাম্বলডোরের অফিস ঘরে এসেছিল। অতি চমৎকার গোলাকৃতি ঘর। দেওয়ালে ডাম্বলডোরের আগে যারা হেডমাস্টার হেডমিসট্রেস ছিলেন তাদের ফটো লাইন করে টাঙানো রয়েছে। সকলের চোখ দেখে মনে হয় ঘুমাচ্ছেন। নিশ্বাসের তালে তালে তাদের বুক উঠানামা করছে।
কর্নেলিয়স ফাজ ডাম্বলডোরের ডেস্কের পাশে দাঁড়িয়ে, গায়ে পিনস্ট্রাইপড আলখেল্লা (ক্লোক)। হাতে লেবু রংয়ের বোলার হ্যাট।
হ্যারি, একটু এগিয়ে এসে আমুদে আমুদে মুখ করে বললেন, কেমন আছ?
খুব ভাল, হ্যারি মিথ্যে বলল।
আমরা, যেদিন রাতের বেলায় ক্রাউচ মাঠে এসেছিলেন সে বিষয়ে আলোচনা করছিলাম, ফাজ বললেন। তুমি তাকে দেখেছিলে, তাই না?
হ্যারি বলল, হ্যাঁ। ও ভাবল, বাইরে থেকে তাদের কথা কিছু শোনেনি ভান করা ঠিক হবে না। বলল, আমি সেদিন মাদাম ম্যাক্সিমকে কোথাও দেখিনি। অবশ্য যদি উনি লুকিয়ে না থাকেন।
ডাম্বলডোর হাসলেন। অবশ্য ফাজ তার হাসি দেখতে পেলেন না। চোখ দেখে মনে হয় খুব মজা পেয়েছেন।
হা… ঠিক আছে, ফাজ বললেন। ফাজকে খুব বিপাকে পড়েছেন দেখে মনে হয়। আমরা এখন মাঠেতে একটু হেঁটে আসব। হ্যারি, তুমি যদি কিছু মনে না কর, তাহলে তুমি তোমার ক্লাসে যাও।
হ্যারি ডাম্বলডোরকে সচকিতে দেখে বলল, আপনার সঙ্গে আমি কিছু কথা বলতে এসেছিলাম প্রফেসর। ডাম্বলডোর ওকে খুঁটিয়ে দেখলেন।
বেশ তো আমরা না ফিরে আসা পর্যন্ত তুমি এখানে অপেক্ষা কর। আমাদের মাঠের ব্যাপারটা দেখে আসতে খুব বেশি সময় নেবে না বলে মনে হয়। ডাম্বলডোর বললেন।
ওরা ঘরের দরজাটা বন্ধ করে চলে গেলেন। মিনিটখানেক পরে হ্যারি মুডির কাঠের পায়ের খটখট শব্দ শুনতে পেল। নিচের করিডলরে সেই শব্দ একটু একটু করে বিলীন হয়ে গেল।
হ্যালো ফকেস। ফকেস ডাম্বলডোরের অতি প্রিয় ফনিক্স পাখি। (রূপকথার পাখি। এরা নিজে নিজে পুড়ে মরে ভস্ম হতে নরদেহ ধারণ করে পুনরুজ্জীবিত হত।) ফকেস অনেক রাজহংসীর মতো বড় আকারের। ওর গায়ে লাল টকটকে পোশাক, পালকগুলো সোনার। হ্যারির হ্যালো শুনে সোনার দাড়ে বসা ফকেস পুচ্ছ নাচাতে নাচাতে চোখ পিটপিট করল।
হ্যারি ডাম্বলডোরের ডেস্কের সামনে একটা চেয়ার টেনে বসল। বেশ খানিকটা সময় হোগার্ট স্কুলের অতীত দিনের হেডমাস্টার হেডমিস্ট্রেসের ফটোর দিকে তাকিয়ে রইল। ওরা সবাই ফ্রেমে আবদ্ধ হয়ে ঝিমুচ্ছেন। ও বসে বসে অরণ্যের ঘটনা ভাবতে লাগল। মাঝে মধ্যে কপালের কাটা দাগে হাত বুলোতে লাগল। এখন আর ব্যথা নেই।
এখন ওর মনে কোন অস্থিরতা নেই, ডাম্বলডোরের অফিসে না থাকারই কথা, একটু পর তো ও ডাম্বলডোরকে ওর স্বপ্নের কথা বলবে। হ্যারি ডেস্কের পেছনে দেয়ালের দিকে তাকাল, দেখল একটা তাকে জোড়াতালি দেয়া জীর্ণ সর্টিং হ্যাটটা দাঁড় করান রয়েছে তার পাশেই একটা গ্লাসকেস, তাতে রয়েছে অপূর্ব একটা রূপার সোর্ড। সোর্ডের খাপে লালপাথর সেট করা। টুপিটা দেখেও চিনতে পারলো। দ্বিতীয় বর্ষের সময় ওই সর্টিং হ্যাটটা টেনে বের করেছিল। এই সোর্ড-এর মালিক গডরিক গ্রিফিন্ডরের, ওর হাউজের প্রতিষ্ঠাতা। ও যখন লড়াই করতে করতে প্রায় আশা ছেড়েছিল তখন ওই সোর্ডটা ওর অনেক সাহায্যে এসেছিল। তাকিয়ে থাকতে থাকতে ও দেখতে পেল বেশ খানিকটা রূপালী আলোর রেখা সেই গ্লাসকেসের ওপর পড়ে নাচছে আর ঝিকমিক করছে। আলোটা কোথা থেকে আসছে দেখার জন্য এধার–ওধার তাকাল। দেখল ওর পেছনে একটা কাল রংয়ের আলমারির ভেতরে রাখা একটা রূপালী জিনিস থেকে রূপালী আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। আলমারির পাল্লাটা ভাল করে বন্ধ নয়। হ্যারি ওটা বন্ধ করবে না করবেনা ভেবে এদিকে তাকাল.. তারপর আলমারিটার কাছে গিয়ে পাল্লাটা সম্পূর্ণ খুলে দিল।
ও দেখল আলমারির ভেতরে রয়েছে একটা পাথরের গামলা। গামলার কানায় অদ্ভুত অদ্ভুত প্রতীক আর অক্ষর খোদাই করা রয়েছে। হা গামলা থেকেই তো আলোটা বিকরিত হচ্ছে। আলোটা গ্যাসের না জলীয় ঠিক বুঝতে পারলো না। উজ্জ্বল সেই আলোটা স্থির নয়, ঘুরছে। অনবরত গতিপথ বদলাচ্ছে। গামলার ভেতরে চারপাশে জল। বাতাস লেগে টলটল করছে, তারপরই অনেকটা মেঘের মতো খণ্ড খণ্ড, ঘূর্ণির মতো ঘুরছে। ওর দেখতে দেখতে মনে হল আলো একটু একটু করে তরল পদার্থে পরিণত হচ্ছে, অথবা বাতাস কঠিন পদার্থ হয়ে যাচ্ছে। কেন হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না হ্যারি।
ওর দুহাত অদ্ভুত সেই জলীয় পদার্থ স্পর্শ করতে চাইল। কিন্তু দীর্ঘ চার বছর জাদু রাজ্যে থেকে এইটুকু অভিজ্ঞতা হয়েছে, কোনও অজানা জিনিস স্পর্শ করা মুখের কাজ। হ্যারি রোবের পকেট থেকে জাদুদণ্ড বের করে চারদিকে তাকাল, গামলার রূপালী পদার্থের ওপর ভাগটা ঘূর্ণির মতো বনবন করে ঘুরতে লাগল।
হ্যারি তারপর আলমারির ভেতরে মুখটা ঢোকাল। ততক্ষণ রূপালী পদার্থটা অনেক স্বচ্ছ হয়ে গেছে, দেখে মনে হয় একটা কাঁচ। কাঁচের কাছে মুখ নিয়ে দেখতে পেলো নিচে রয়েছে প্রকাণ্ড এক অন্ধকার ঘর। অনেকটা কারাগৃহের মতো। ঘরের ছাদে একটা গোল গর্ত। সেই জানালার মতো গোল বড় ছিদ্র দিয়ে অন্ধকার ঘরের ভেতরটা দেখতে পেল। ঘরটা পাতালগৃহের মতো।
ঘরে মিটমিট করে আলো জ্বলছে। একটা দরজা বন্ধ। ঘরে কোনও জানালা নেই। ঘরের দেয়ালে গোঁজা রয়েছে মশাল! ও মুখটা স্বচ্ছ কাঁচ থেকে প্রায় দুইঞ্চি ফারাক রাখল। দেখল সেই পাতাল ঘরের দেয়ালের লম্বা লম্বা কাঠের বেঞ্চে লাইন করে বসে রয়েছে বিভিন্ন বয়সের জাদুকর–জাদুকরী। ঘরের ঠিক মাঝখানে পাতা রয়েছে একটি চেয়ার। চেয়ারের হাতলের দুধারে মোটা মোটা লোহার শিকল। চেয়ারে কেউ বসলে যেন তাকে বাঁধা হবে।
কিন্তু যে ঘরটা ও দেখছে সেটা কোথায়? নিশ্চয়ই হোগার্টে নয়, ক্যাসেলে আজ পর্যন্ত ওইরকম ঘর চোখে পড়েনি। তাছাড়া গামলার তলায় যাদের দেখছে সবাই তো বয়স্ক, কিন্তু হ্যারি যতদূর জানে হোগার্ট স্কুলে এত সংখ্যক শিক্ষক নেই। ও ভাবল-এমনও তো হতে পারে ওরা কারও জন্য অপেক্ষা করছে। হ্যারি ওদের মাথায় চোঙ্গা মতো টুপি ছাড়া মুখ দেখতে পাচ্ছে না। ওরা সকলেই একদিকে তাকিয়ে রয়েছে। কিন্তু কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছে না। গামলাটা গোল, তার তলায় যে ঘরটা দেখছে সে চতুষ্কোন! হ্যারি বুঝতে পারছে না কিসের জন্য ওরা ওখানে বসে রয়েছে। ভাল করে দেখার জন্য মুখটা আরও নামিয়ে নিল।
ওর নাকের আগাটা সেই অদ্ভুত পদার্থে ঠেকল যার ভেতর দিয়ে ও দেখছিল।
ডাম্বলডোরের অফিস ঘরটা হঠাৎ সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল, হ্যারি সামনের দিকে ছিটকে পড়তেই, গামলার ভেতরেও সেই অদ্ভুত পদার্থে মুখ থুবড়ে পড়ল।
ভাগ্য ভাল ওর মাথাটা বেসিনের তলায় পাথরে লাগেনি। ও একটা প্রচণ্ড শীতল ও কাল পদার্থের মধ্যে পড়ে গেল, অনেকটা যেন কাল ঘূর্ণির আবর্তে।
তারপরই দেখল সেই ঘরটার এককোণে ও একটা বেঞ্চে বসে রয়েছে। ও যে গোল গর্তের ভেতর দিয়ে অন্ধকার ঘরে পড়ে গেছে সেটার দিকে তাকাল। কিন্তু গর্তের বদলে দেখল সেখানে একটা কাল পাথর।
ঘন ঘন নিশ্বাস নিতে নিতে হ্যারি এধার ওধার তাকাল। ঘরের মধ্যে যেসব জাদুকর–জাদুকরী (সংখ্যায় প্রায় ২০০০ হবে) ওর দিকে তাকাঁচ্ছে না। আশ্চর্য! চৌদ্দ বছরের একটি ছেলে সিলিং থেকে নিচে পড়ে গেল, কেউ লক্ষ্য করল না। হ্যারির বেঞ্চে, ওর পাশে যে বসেছিল তার দিকে ফিরে হ্যারি নিস্তব্ধ ঘরে অসম্ভব জোরে চিৎকার করে উঠল। ও দেখল ডাম্বলডোর ওর পাশে বসে রয়েছেন।
প্রফেসর, হ্যারি চাপাস্বরে বলল–আমি অতি দুঃখিত, আমি ইচ্ছে করে এখানে আসিনি। আমি আপনার ঘরের ক্যাবিনেটের গামলা দেখছিলাম… আমি… আমরা এখন কোথায়?
কিন্তু ডাম্বলডোর একটুও নড়লেন না বা কথা বললেন না। এমন ভাব দেখালেন যেন হ্যারির উপস্থিতি টের পাননি। অন্যসব জাদুকরের মতই তিনি ঘরের এক কোণে তাকিয়ে রইলেন, সেখানে ও দেখতে পেল একটা দরজা।
হ্যারি হতবুদ্ধি হয়ে ডাম্বলডোরের দিকে তাকাল, তারপর নির্বাক ভিড়ের দিকে, তারপর আবার ডাম্বলডোরের দিকে।
এর আগেও হ্যারি একবার এমন পরিস্থিতিতে পড়েছিল। এমন একটা জায়গায় সেখানে কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছেন বা তার কথা শুনতে পাচ্ছে না। এবারও একটা সম্মোহিত ডায়রির পাতা থেকে পড়ে গেছে। যদি ও কোন ভুল না করে থাকে, তাহলে আবার সেইরকম কিছু একটা ঘটেছে।
হ্যারি ওর ডান হাতটা তুলে ইতস্তত করে ডাম্বলডোরের মুখের সামনে তরঙ্গায়িত করল। ডাম্বলডোর চোখের পাতা বন্ধ করলেন না। হ্যারির দিকে তাকান তো দূরের কথা, এক ইঞ্চিও নড়লেন না। হ্যাঁ, হ্যারি বুঝতে পারলো… ভাবলো, ডাম্বলডোর কোন মতেই ওকে অবহেলা করতে পারেন না। তিনি চিন্তায় ডুবে আছেন এবং এই ডাম্বলডোর স্বাভাবিক ডাম্বলডোর নয়। হ্যাঁ তাহলেও বেশিদিনের কথা নয়, যে ডাম্বলডোর ওর পাশে বসে রয়েছেন এখন তার চুল রূপালী হয়ে গেছে, কিন্তু জায়গাটা কোথায়? জাদুকররা কার জন্য অপেক্ষা করছে। হ্যারি ঘরের ভেতরটা আবার ভাল করে দেখল। ওপর থেকে দেখে ঘরটাকে মাটির তলায় মনে হয়েছিল, এখন সে সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নেই। ঘরটা ঠিক ঘর নয়… অন্ধকার পাতালপুরী। ঘর নিরানন্দ ও ভীষণ দর্শন ঘরের দেয়ালে কোন ছবি নেই, কোন সাজগোছ নেই; শুধু লাগালাগি সারিবদ্ধ বেঞ্চি, এমনভাবে রাখা যে সেখানে বসে ঘরের মাঝখানে রাখা শিকলবাঁধা হাতলওয়ালা চেয়ারটাকে কোনও বাধাছড়া পরিষ্কার দেখতে পায় সকলে।
হ্যারির ঘরটা সম্বন্ধে কোনরকম সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে (সেখানে ডাম্বলডোর ওর পাশে স্থানুর মতো বসে রয়েছেন) ও পদশব্দ শুনতে পেল। পাতালপুরীর ঘরের এক কোণের বন্ধ দরজা খুলে গেল, তিনজন ঢুকল, একজন আর সাথে দুজন ডিমন্টের (কারাগৃহের রক্ষী)।
হ্যারির শরীরের ভেতরটা বরফশীতল হয়ে গেল। ডিমেন্টররা দীর্ঘদেহী, মুখে কাপড় ঢাকা। ওরা লোকটিকে নিয়ে ধীর পদক্ষেপে ঘরের মধ্যে রাখা শৃঙ্খল লাগান আর্ম চেয়ারের কাছে গেল। সেই লোকটার দুটো হাত দুজন ডিমেন্টর ধরে রেখেছে। ওদের হাতগুলো লাল, দেখে মনে হয় পচে গেছে। যাকে ওরা ধরে রয়েছে দেখে মনে হয় জ্ঞান হারাতে বেশি সময় নেই। হ্যারি জানে ডিমেন্টররা ওকে ছুঁতে সাহস করবে না, ওরা যতই শক্তিশালী হোক না কেন।
হ্যারি চেয়ারে বসা লোকটির দিকে তাকাল, বসা লোকটি, কারকারফ!
ডাম্বলডোরের মতো বৃদ্ধ নয়। সতেজ যুবকের মতো। মাথার চুল আর ছাগলদাড়ি, কাল ও চকচকে। এখন তার গায়ে সেই সুন্দর ফারকোট নেই। গায়ে পাতলা জীর্ণ ময়লা রোবস (আলখেল্লা) গায়ে শিকল বাধা। তিনি চেয়ারে বসে অনবরত কাঁপছেন। হ্যারি দেখল হঠাৎ সেই শিকলগুলো উজ্জ্বল সোনার আকার ধারণ করল।
হ্যারির বাঁ-ধার থেকে কে যেন সজোরে বলল, ইগর কারকারফ! হ্যারি কথাটা কেবল দেখার জন্য পাশ ফিরল। দেখল ক্রাউচ ওর পাশের বেঞ্চের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ক্রাউচ বেশ চটপটে, চুল কাল, মুখে বলিরেখা নেই। দৃষ্টি সতর্ক!
মন্ত্রণালয়কে সাক্ষ্য ও তথ্য দেবার জন্য আজকাবান থেকে আনা হয়েছে মি. কারাকারফকে। আপনি বলেছেন, আপনার কাছে অনেক তথ্য ও গোপন খবর আছে দেবার। এবার বলুন…
কারাকারফ সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করলেন; কিন্তু আষ্টেপৃষ্ঠে শিকল এটে থাকার জন্য পারলেন না।
আছে স্যার, অনেক বলার আছে, কারকারফ ভীত হয়ে বললেন।
হ্যারি কারকারফের গলায় তোষামোদের সুর শুনতে পেল।
কারকারফ বললেন, আমি মন্ত্রণালয়কে সাহায্য করতে চাই, আমি জানি মন্ত্রণালয় ডার্কলর্ডের প্রত্যেকটি অনুচরদের ধরতে চায়, আমি আমার সাধ্য অনুযায়ী সাহায্য করতে চাই।
দর্শকদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হল। কোন কোন জাদুকর জাদুকরী গভীর মনোযোগ দিয়ে শৃঙ্খলিত কারকারফকে দেখতে লাগল। তাদের মুখে অবিশ্বাসের ছাপ! হ্যারি ডাম্বলডোরের দিক থেকে এক অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো, নোংরা…!
লোকটি ম্যাড–আই–মুডি। একটু ভিন্ন দেখাচ্ছে তাকে। চোখে ম্যাজিক্যাল আই নেই। স্বাভাবিক দুটি চোখ। সেই দুই চোখে তব্র ঘৃণার দৃষ্টিতে কারকারফের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। মুখে বিতৃষ্ণার ছাপ।
মুডি ফিস ফিস করে ডাম্বলডোরকে বললেন, ক্রাউচের সঙ্গে গোপন সমঝোতা করেছে। ওকে ধরতে আমার পাক্কা ছয় মাস সময় লেগেছে। আরও কিছু নাম দিতে পারলে ক্রাউচ ওকে তাড়াতাড়ি মুক্তি দেবে।
যতই চেষ্টা করুক বাঁচার, আমি ওকে সোজা ডিমেন্টরদের হাতে তুলে দেবই দেব।
ডাম্বলডোর তার নাক দিয়ে ঘরঘর শব্দ করলেন।
ওহো আমি একদম ভুলে গেছি, আপনি ডিমেন্টরদের নাম শুনতে চান না। মুডি কাষ্ঠহাসি হাসলেন।
না, ডাম্বলডোর শান্তভাবে বললেন–খুব ভাল করেই জানেন সে কথা। আমার বিশ্বাস মন্ত্রণালয় খুব অবিবেচকের মতো কাজ করছে ওদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে।
কিন্তু, ওর মতো নোংরা স্বভাবের লোক…। মুডি সাধারণভাবে বললেন।
মি, ক্রাউচ বললেন, আপনি বলছেন প্রমাণস্বরূপ আপনার কাছে অনেক নাম আছে কারকারফ, শোনা যাক তাদের নাম।
কারকারফ তড়িঘড়ি করে বললেন; কিন্তু আপনাকে বুঝতে হবে যে হিহু মাস্ট নট বি নেমড়, সবসময় তার কাজ গোপন রাখেন–আমি বলতে চাই ওর সমর্থকরা, আমি দুঃখের সঙ্গে বলছি, আমিও তার মধ্যে একজন। আমি এখন অতীতের কার্যকলাপের জন্য খুবই দুঃখিত…ও।
মুডি বললেন, বলতে থাকুন।
আমরা কখনই আমাদের দলের প্রতিটি লোকের নাম জানি না।… একমাত্র তিনিই জানেন।
খুবই চালাকের মতো এগিয়ে যাওয়া–তাই না… যেমন আপনার মতো কিছু লোক কারকারফ, তাদের সকলকে দলভুক্ত করতে বাধা দিয়েছেন।
মি. ক্রাউচ বললেন, তা সত্ত্বেও আপনি বলছেন আপনার কাছে আমাদের দেবার জন্য কিছু নাম আছে?
কারকারফ বললেন, হ্যাঁ আমি ঠিক বলেছি। তারা সবাই অতি সক্রিয় অনুগামী… সব আমার নিজের চোখে দেখা… তারা লর্ডের কথা শুনছে। আমি সম্পূর্ণভাবে তাকে ছেড়ে এসেছি ও অভিযুক্ত করার জন্য এই তথ্য দিচ্ছি। আমি… আমি তার সঙ্গে থাকার জন্য তীব্রভাবে অনুশোচনা করছি… এত বেশি যে সহ্য করতে পারছি না।
মি. ক্রাউচ বললেন, তাহলে নামগুলো?
কারকারফ একটা বড় শ্বাস নিয়ে বললেন, অ্যান্টনিন ডলোহোভ। আমি তাকে অসংখ্য মাগলদের অত্যাচার করতে দেখেছি… এবং যারা ডার্ক লর্ডের বিরুদ্ধে তাদেরও…।
মুডি বিরবির করে বললেন, তাকেও সাহায্য করেছেন।
ক্রাউচ বললেন, আমরা তাকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করেছি। আপনাকে ধরার অল্প কিছু পরেই।
কারকারফ বড় বড় চোখে বললেন, সত্যি? আ–আমি শুনে সত্যি আনন্দিত হলাম।
ক্রাউচ বললেন, আর কেউ?
ও হ্যাঁ, রোজিয়ার… ইভান রোজিয়ার।
ক্রাউচ বললেন, রোজিয়ার তো বেঁচে নেই। ও ধরা পড়ার চাইতে লড়াই করতে চেয়েছিল। এনকাউন্টারে তার মৃত্যু হয়।
কারকারফ বললেন, রোজিয়ারই যথেষ্ট, কথা বলার সময় কারকারফ ভীত হলেন। হ্যারির বুঝতে বাকি রইলো না, তার দেওয়া খবর মন্ত্রণালয়ে বিশেষ কোনও কাজে লাগবে না।… যেদিকে ডিমেন্টররা দাঁড়িয়েছিল কারকারফ সেদিকে তাকালেন। ডিমেন্টররা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে এক চুলও না নড়ে… অপেক্ষা করছে।
ক্রাউচ বললেন, আর কেউ?
কারকারফ বললেন, ট্রেভার্স… ম্যাককিনিনসকে হত্যা করতে সাহায্য করেছিল। ও ইম্পেরিয়স কার্সের একজন দক্ষ। অসংখ্য লোককে বীভৎস কাণ্ড করাতে সাহায্য করেছে। রুকউড, একজন গুপ্তচর ও হি–হুঁকে বহু প্রয়োজনীয় তথ্য মিনিস্ট্রির ভেতর থেকে পাচার করেছে।
ক্রাউচ বললেন, কী বললেন, রুকউড! সামনে বসা এক জাদুকরীকে ইশারা করলেন। মেয়েটি একটি পার্চমেন্ট কাগজে কিছু ফট ফট করে লিখল, অগাস্টাস রুকউড… রহস্য বিভাগ।
কারকারফ বললেন, এই ব্যক্তিটি আমি জানি মন্ত্রণালয়ে ভাল পদে অধিষ্ঠিত জাদুকরদের নিয়ে মন্ত্রণালয়ের ভেতরে ও বাইরে বিরাট এক জাল সৃষ্টি করেছিল। উদ্দেশ্য গোপন তথ্য সংগ্রহ।
ক্রাউচ বললেন, ট্রেভার্স ও মালসিবার, ঠিক আছে। খুব ভাল কথা কারকারফ, যদি আপনার বক্তব্য শেষ হয়ে থাকে… আপনাকে আজকাবানে ফিরে যেতে হবে… তারপর আমাদের সিদ্ধান্ত…।
–না, এখনও শেষ হয়নি, কারকারফ দারুণ হতাশ ও ক্রুব্ধ হয়ে বললেন।
মশালের আলোতে হ্যারি দেখল কারকারফ দরদর করে ঘামছেন। ওর কাল চুল আর দাড়ির সঙ্গে গায়ের সাদা চামড়া দারুণ এক বৈষম্য।
–স্নেইপ, কারকারফ চিৎকার করে বললেন, সেভেরাস স্নেইপ!
ক্রাউচ কঠিন স্বরে বললেন, স্নেইপকে এই কাউন্সিল মুক্ত করেছেন, তাছাড়া ডাম্বলডোর তার জামিন হয়েছেন।
কারকারফ চিৎকার করে বললেন, না। চেয়ার ছেড়ে উঠতে চেষ্টা করলেন। শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার জন্য পারলেন না। বললেন, সেভেরাস স্নেইপ একজন
ডেথইটার ছিল, আমার বক্তব্যে মিথ্যা নেই।
ডাম্বলডোর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন, এই ব্যাপারে আমার আগেই সাক্ষ্য দেয়া হয়ে গেছে। একথা মিথ্যা নয় যে, স্নেইপ অতীতে একজন ডেথইটার ছিলেন। লর্ড ভোল্টেমর্টের পতনের আগেই আমাদের সঙ্গে তিনি যোগ দিয়েছেন… শুধু তাই নয়, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের হয়ে গুপ্তচরেরও কাজ করেছেন। আমি যেমন ডেথইটার নই, তেমনি স্নেইপও নয়।
হ্যারি পেছন ফিরে মুডিকে দেখল। ম্যাড–আই–মুডির চোখেমুখে অবিশ্বাসের ছাপ!
–ঠিক আছে কারকারফ, ক্রাউচ গম্ভীর হয়ে বললেন। আপনি আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন। আমি আপনার কেস পুনরায় বিবেচনা করব। এখন আপনাকে আজকাবানে ফিরে যেতে হবে।
মি. ক্রাউচের কণ্ঠস্বর একটু একটু করে ম্লান হয়ে গেল। পাতালপুরীটা যেন ধোঁয়াটে ছিল, সেটাও মিলিয়ে যেতে লাগল, এক এক করে সবকিছুই। তারই মধ্যে হ্যারি নিজেকে দেখতে পাচ্ছে, ও ছাড়া সবকিছুই ঘূর্ণাবর্তের মতো অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে।
তারপরে আবার অন্ধকার হিমশীতল পাতালপুরী উদ্ভাসিত হয়ে গেল। হ্যারি দেখল এখন ও অন্য একটা বেঞ্চে বসে রয়েছে। সেই বেঞ্চটা আগের অন্যান্য বেঞ্চের চাইতে উঁচু। ওর বাঁ–ধারে বসে আছেন মি. ক্রাউচ। আগের মতো গম্ভীর নেই, স্বাভাবিক পরিবেশ। দেয়ালের ধারে বসে থাকা জাদুকর–জাদুকরীরা নিজেদের মধ্যে আলাপ–আলোচনা করছে… এমন এক ভাব ওরা যেন কোনও খেলাধুলা দেখতে এসেছে। হ্যারির অদূরে বসে থাকা এক জাদুকরীকে চোখে পড়ল। ওর মাথায় ছোট ছোট সোনালী চুল, পরণে ম্যাগনেটা রোবস। একটা গাঢ় সবুজ রংয়ের পালক দাঁতে কামড়াচ্ছে। মেয়েটি সন্দেহ নেই রিটা স্কীটার। ওর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে অন্যধারে তাকাল। এবারও ডাম্বলডোর ওর পাশে বসে রয়েছেন। পরণে অন্য রোবস। ক্রাউচকে অতিশয় ক্লান্ত, বেশি মাত্রায় রোগা দেখাচ্ছে। হ্যারির মনে পড়ে গেল অন্য একদিন, অন্য এক পরিস্থিতি, এক ভিন্ন বিচারালয়। অভিযুক্তরাও ভিন্ন।
কোণের দিকে দরজাটা খুলে যেতেই লুডো বেগম্যান ঘরে ঢুকলেন।
সম্পূর্ণ এক ভিন্ন বেগম্যান। আগের মতো ছোট–খাট নয়, কিডিচ খেলোয়াড়দের মতই লম্বা–চওড়া পেশিবহুল চেহারা নাকটা থ্যাবড়া নয়। শিকল লাগানো চেয়ারে বসার সময় বেগম্যান ঘাবড়ে গেছেন মনে হল। কারকারফের মতো কেউ তাকে শিকল দিয়ে বাঁধলো না। বেগম্যান দর্শক আর দুএকজন জাদুকর–জাদুকরীদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লেন ও মৃদু হাসলেন।
–লাডো বেগম্যান, ডেথইটারসদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগের জবাব দেবার জন্য কাউন্সিল অব ম্যাজিক্যাল লর সামনে আপনাকে আনা হয়েছে; ক্রাউচ বললেন, আপনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণাদি আমরা বিচার করেছি ও এখন আমাদের রায়দানের মুখে পৌঁছেছি। আপনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তা খণ্ডিত করার জন্য যদি আপনার আরও কিছু বক্তব্য থাকে তা রায়দানের পূর্বে বলতে পারেন।
হ্যারি নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না লুডো বেগম্যান একজন ডেথইটার? একমাত্র, বেগম্যান অদ্ভুতভাবে হেসে বললেন, জানি আমি মহামূর্খ।
এই কথা শুনে সামনে বসা দুএকজন জাদুকর হো হো করে হেসে উঠল। ক্রাউচ মনে হল তাদের জোরে হাসাটা পছন্দ করলেন না। ক্রাউচ বেগম্যানের দিকে অতি কঠোর ও কুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
তুমি ভুলেও একটি সত্যি কথা বলনি খোকা। কে যেন ডাম্বলডোরকে হ্যারির পেছন থেকে শুকনো কণ্ঠে বলল। হ্যারি পেছনে তাকিয়ে দেখল ম্যাড আই মুডি। যথাস্থানে ঠিক বসে আছেন।
ক্রাউচ বললেন, লাড্ডা বেগম্যান, ভোল্টেমর্টের সমর্থনকারীদের কাছে তথ্য আদান–প্রদানের সময় আপনাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এই জঘন্য অপরাধের জন্য আপনাকে আমি আজকাবানে কারারুদ্ধ করে রাখার জন্য আমার মত দিচ্ছি। কমপক্ষে
কিন্তু রায় শোনার পর সামনের বেঞ্চে বসে থাকা জাদুকর জাদুকরীরা দাঁড়িয়ে পড়ে, মাথা নেড়ে, এমনকি ঘুষি তুলে প্রতিবাদ জানাল। বেগম্যান কলকল ধ্বনির ভেতর বললেন, আমি আগেও বলেছি এখনও বলছি ওই তথ্য পাচার সম্বন্ধে আমার কোনও সুস্পষ্ট ধারণা নেই। ওর নীল চোখ বিস্ফোরিত হল।–কণা মাত্র না। বৃদ্ধ ক্লকউড আমার পিতার বন্ধু। আমার কখনও কোনদিন সন্দেহ হয়নি যে তিনি ইউ নো হুর লোক, আমি ভেবেছিলাম, আমাদের কাজের জন্য তথ্য সংগ্রহ করছি। রুকউড বলেছিলেন, আমাকে মিনিস্ট্রিতে একটা চাকরি করে দেবেন… আপনারা জানেন আমার কিডিচ খেলার পর্ব শেষ হলে আমি মনে করি, বা আমার মনে হয়েছিল আমি একটি ছোটখাট কাজও পাবো না।… পাওয়া সহজ নয়।
আবার ভিড়ের মধ্য থেকে চাপা হাসির রোল।
পাতালঘরের ডানদিকে তাকিয়ে ক্রাউচ তীক্ষ্মস্বরে বললেন, দোষী কি নির্দোশ এর জন্য ভোট গ্রহণ প্রয়োজন। সেসব জুরি কারাবাসের পক্ষে তারা দয়া করে হাত তুলবেন।
হ্যারি ডান ধরে তাকাল। একজনও হাত তুললেন না। অনেক জাদুকর, দর্শকরা হর্ষে, উল্লাসে হাততালি দিতে লাগল। তাদের মধ্যে এক জাদুকর উঠে দাঁড়ালেন।
ক্রাউচ খেঁকিয়ে বললেন, কিছু বলার আছে?
আমরা মি. বেগম্যানকে তার ইংল্যান্ড দলের হয়ে গত শনিবার তুর্কীর বিরুদ্ধে অসামান্য কিডিচ খেলার জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি, জাদুকর এক নিশ্বাসে কথাটা বলে গেলেন।
মি. ক্রাউচ অসম্ভব রাগে ফেটে পড়লেন। সারা পাতালঘর বেগম্যানকে হই হই করে অভিনন্দন দিতে লাগল। বেগম্যান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন… মাথানত করে স্মিত হাসলেন।
বেগম্যান ঘর ছেড়ে চলে গেলে মি. ক্রাউচ ডাম্বলডোরের কাছে এসে থুতু ফেলে বললেন, জঘন্য… রুকউড তাহলে ওকে অবশ্যই চাকরি জোগাড় করে দেবে, যেদিন লাডো বেগম্যান আমাদের মন্ত্রণালয়ের কাজে যোগ দেবে সেদিনটি মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষ দুঃখের দিন হবে সন্দেহ নেই।
পাতালঘরে নেমে এসেছে নীরবতা–শুধু এক রোগা ডিগডিগে শুকনো চেহারার জাদুকরী ক্রাউচের পাশে বসে খুব আস্তে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। মুখে তার রুমাল চাপা… হাত কাঁপছে। হ্যারি মি. ক্রাউচের দিকে তাকাল, তার মুখ শুকনো… আগের চেয়ে বৃদ্ধ… ওর কপালের শিরাগুলো ফুলে উঠে দপদপ করছে।
পাতালঘরের কোণের দিকে দরজা আবার খুলে গেল। ক্রাউচ বললেন, ওদের ভেতরে নিয়ে এস। নিস্তব্ধ পাতালঘর গমগম করে উঠল, প্রতিধ্বনিত হল তার আদেশ।
ডিমেন্টররা চারজনকে ধরে বেঁধে ঘরে ঢুকল। হ্যারি দেখল ঘরের সকলে একইসঙ্গে ক্রাউচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে কানে কানে কিছু বলাবলি করছে।
ডিমেন্টররা চারজনকে পাশাপাশি চারটে শিকল দেয়া চেয়ারে বসাল। চারজনের মধ্যে একজন মোটা লোক ক্রাউচের দিকে উদাসিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। একজন রোগা ও ভীত লোক, ও ঘরের সকলের দিকে তাকাল…। একজন মহিলা, মাথায় তার ঘন চকচকে কাল চুল, চোখে বোরখা আবৃত… শিকল লাগানো চেয়ারে এমন এক ভঙ্গি করে বসল যেন চেয়ারটা সিংহাসন। আর একটি ষোল সতের বছরের ছেলে দেখেই মনে হয় ভীষণ ভয় পেয়েছে, মাঝে মধ্যে শিউরে উঠছে ও কাঁপছে। ওর মাথায় খড় রংয়ের ছোট ছোট পাতলা চুল। গায়ের চামড়া ধবধবে। যে রোগা মহিলা ক্রাউচের পাশে বসেছিলেন তিনি চেয়ারে বসে কখনও সামনে, কখনও পেছনে দোলা খাচ্ছেন। মাঝে মধ্যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। চোখের জল রুমাল দিয়ে মুছছেন।
ক্রাউচ চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন, চেয়ারে বসিয়ে রাখা চারজনের দিকে তাকালেন। মুখে প্রবল ঘৃণার ছাপ।
তোমাদের কাউন্সিল অব ম্যাজিক্যাল ল-এর সামনে হাজির করা হয়েছে, পরিষ্কার কণ্ঠে মি. ক্রাউচ বললেন। তোমাদের ঘৃণ্য জঘন্য অপরাধের শাস্তির কথা শোনাবার জন্য।
সেই খড় রংয়ের চুলের ছেলেটি বলল, বাবা, অনুগ্রহ করে উনাকে থামাও, আমি অপরাধ করিনি।
আদালতে এই রকম কথা আমরা আগেও অনেক শুনেছি, ক্রাউচ চীৎকার করে বললেন ছেলের করুণ কথা ওর তীব্র গলার স্বরে চাপা পড়ে গেল।–তোমাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ–তথ্যাদি দিয়ে অভিযোগ শোনা হয়েছে। তোমরা চারজন কর্তব্যরত অররকে ধরার জন্য অপরাধ করেছ। ফ্রাংক লংবটমকে কুসিয়াস কার্স প্রয়োগ করেছ। নিশ্চিত ধারণা যে তোমরা নির্বাসিত হি–হুঁ… যার নাম উচ্চারণ করা অবশ্যই ঠিক নয়, তার বর্তমান ডেরার খবর রাখ।
–, বাবা, আমি কিছু করিনি, কিছু জানি না… আমাকে দয়া করে ডিমন্টরদের হাতে তুলে দেবেন না। শপথ করে বলেছি আমি জানি না, ছেলেটি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল।
ক্রাউচ আরও বললেন, তুমি ও তোমরা ফ্রাঙ্ক লংটমের স্ত্রীর ওপর নিষিদ্ধ ক্রসিয়স কার্স প্রয়োগ করেছিলে, যখন তিনি তোমাদের কোন খবর দিতে রাজি হননি। তোমরা হি হু, যার নাম উচ্চারণ করা ঠিক হবে না তাকে, পুনরায় পুরনো শক্তিতে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা করেছ। এবং তার অতীতের হিংসাত্মক কার্যকলাপ পুনরায় চালু করার মদদ দিচ্ছ।… এখন আমি মাননীয় জুরিদেব রায় প্রার্থনা করছি।
ছেলেটি আর্তনাদ করে উঠল–মা।
ক্রাউচের পাশে বসে থাকা শীর্ণ মহিলা আগের মতো সামনে–পেছনে দুলতে দুলতে ফোপাতে লাগলেন।–না, না না বাবাকে নিষেধ কর আমি সেই কাজ করিনি, আমি কোনও দলে ছিলাম না!
ক্রাউচ বললেন, যারা শাস্তির পক্ষে তারা দয়া করে হাত তুলুন। আমার মতে এই জঘন্য অপরাধের একমাত্র উপযুক্ত শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
ডানদিকে বসা জাদুকর–জাদুকরী সকলে একযোগে হাত তুলল। দেয়াল লাগোয়া যারা বসেছিল তারা আনন্দে–উচ্ছাসে ফেটে পড়ল। তাদের চোখে প্রতিহিংসা–বর্বর আনন্দোচিত জয়ের হাসি, মুখরিত হয়ে উঠল প্রায় অন্ধকার কারাকক্ষ… পাতালপুরী।
ছেলেটি আকুলভাবে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, আমায় আজকাবান জেলে পাঠিও না বাবা, আমি কোন অপরাধ করিনি।
ডিমেন্টটররা তাদের পেছনে এসে দাঁড়াল আজকাবানে নিয়ে যাবার জন্য। ওরা চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল। মহিলা অপরাধী ক্রাউচকে বলল, শোন ডার্কলর্ড আবার ফিরে আসছেন, ক্রাউচ! আমরা আজকাবানে থেকে তার পুনঃ আবির্ভাবের অপেক্ষা করব। উনি অবশ্যই আমাদের যথাযযাগ্যভাবে পুরস্কার দেবেন… আমরাই তার বিশ্বস্ত অনুচর! আমরাই শুধু তাকে খুঁজেছি! সাবধান ক্রাউচ।
কিন্তু ছেলেটা প্রবল শক্তিতে হাত–পা ছুঁড়ে ডিমেন্টরদের বাধা দিতে লাগল ওরাও তাদের প্রবল শক্তি দিয়ে ছেলেটিকে ধরে রাখল। চারজনের কঠোর শাস্তি শুনে পাতালঘরে উপস্থিত সবাই নাচানাচি করতে লাগল।
ছেলেটি ডিমন্টরদের সঙ্গে যেতে যেতে বলল, আমি আপনার ছেলে… আপনার ছেলে… বিনা দোষে এমন শাস্তি দেবেন না।
ক্রাউচ জোরে জোরে বললেন, নানা তুমি আমার ছেলে নও, আমার কোনও ছেলে নেই।
শীর্ণ মহিলা শাস্তি শোনার পর যে চেতনা হারিয়েছেন তা ক্রাউচ ভ্রুক্ষেপই করলেন না।
ডিমেন্টররা ওকে নিয়ে যাও, ক্রাউচ বললেন, বলার সময় মুখ থেকে থুতু ছিটকে বেরোল।
ডাম্বলডোর বললেন, এবার আমাদের অফিসে ফিরে যেতে হবে হ্যারি।
হ্যারি চমকে উঠে পাশে তাকিয়ে দেখল, ডাম্বলডোর দেখছেন, ডিমেন্টররা ক্রাউচের ছেলেকে টেনে–হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে।
–চল, ডাম্বলডোর বললেন। হ্যারির কনুইতে হাত ছোঁয়ালেন। হ্যারির মনে হল ও বাতাসে ভাসছে… চোখের সামনে থেকে পাতালপুরী একটু একটু করে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।… চতুর্দিক অন্ধকার। মনে হল ও খুব আস্তে আস্তে ডিগবাজি খাচ্ছে… তারপরই দেখল ডাম্বলডোরের রৌদ্রজ্জ্বল অফিসে ও বসে রয়েছে। আলমারিতে রাখা পাথরের বেসিনটা ঘরের তীব্র আলোতে ঝকমক করছে। ডাম্বলডোর ওর পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
হ্যারি তোতলাতে তোতলাতে বলল, আলমারির একটা পাল্লা ভোলা ছিল। ওটা বন্ধ করা আমার উচিতও হয়নি।
জানি, ডাম্বলডোর বললেন। তারপর গামলাটা তুলে ডেস্কের কাছে নিয়ে গিয়ে চকচকে টেবিল টপের ওপর রেখে দিলেন। তারপর হ্যারিকে ওর সামনে বসতে ইঙ্গিত করলেন।
হ্যারি গামলার দিকে তাকিয়ে বসল। বেসিনের ভেতরের পদার্থ আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। রূপার মতো সাদা… অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছে, ছোট ছোট ঘূর্ণি সৃষ্টি করছে।
হ্যারি আমতা আমতা করে বলল, ওগুলো কী?
এইগুলো? একে বলা হয় বিষণ্ণতা, ডাম্বলডোর বললেন। আমি মাঝে মধ্যে দেখি, আমি আশা করছি আমার মনোভাব বুঝতে পারছ… আমার অনেক ভাবনা ও স্মৃতি মস্তিষ্কের মধ্যে বোঝাই হয়ে রয়েছে। যখন কোনও চিন্তা মাথার মধ্য থেকে বের করে দিতে চাই, আমি বিষণ্ণতা ব্যবহার করি। তখন বিষণ্ণতা চিন্তাকে গামলার মধ্যে ফেলে দেয়, সময় পেলে সেটা পরীক্ষা করি। যখন তারা একটা আকার ধারণ করে তখন ধরনটা খুঁজে বের করতে সুবিধা হয়, বুঝতে পারলে?
তাহলে ওই পদার্থ আপনার চিন্তা কমিয়ে রাখে? হ্যারি কথাটা বলে তরল পদার্থের দিকে তাকাল।
দেখবে কেমন করে করি? ডাম্বলডোর তার আলখেল্লা থেকে জাদুদণ্ড বের করে পাকা চুলে ছোঁয়ালেন। ছোঁয়াতেই কিছু চুল তাতে লেগে রইল। তারপরই হ্যারি দেখল মাথার ভেতর থেকে রূপালী কিছু পদার্থ বেসিনের জলীয় পদার্থের সঙ্গে মিশে গেল। বুঝলে, আমার বিষণ্ণ ওই বেসিনের তরল পদার্থের সঙ্গে মিশল। এবার কাছে এসে দেখ।
হ্যারি গামলার মুখ নামিয়ে তরল পদার্থের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। দেখল ওর মুখ পাত্রের ভেতর সাতরাচ্ছে।
ডাম্বলডোর তারপর দণ্ডটা পাত্রের চারপাশে ঘোরালেন। তারপর ভেসে উঠল স্নেইপ, কারকারফের মুখ।
ডাম্বলডোর তার অর্ধচন্দ্র চশমার কাঁচ দিয়ে হ্যারিকে দেখলেন। বললেন, এটা সংযোগ করা, এই সংযোগ করতে কারও সাহায্যের দরকার হয় না।
হ্যারি দেখল, পাত্রে বারবার স্নেইপের মুখ ভেসে উঠেছে।
–বুঝলে আমার অফিসে যখন প্রফেসর ফাজ এসেছিলেন, তখন আমি পেনসিভ ব্যবহার করেছিলাম। চলে গেলে ভুলবশত: ঠিকমত পাল্লাটা ভাল করে বন্ধ করিনি, স্বাভাবিকভাবে সেই জন্য তোমার দৃষ্টি ওদিকে পড়েছিল।
হ্যারি বলল, আমি দুঃখিত প্রফেসর।
ডাম্বলডোর শুধু মাথা নাড়লেন।
কৌতূহল অন্যায় বা পাপ নয়। ডাম্বলডোর বললেন, তবে আমাদের সবসময় সতর্কতার সঙ্গে কৌতূহল মেটাতে হবে। তারপর ম্যাজিক দণ্ড দিয়ে তার চিন্তা তরল পদার্থকে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন, হঠাৎ একটি বছর ষোল বয়সের মেয়ে গামলার ভেতর ঘুরতে লাগল। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়াল। মেয়েটি হ্যারি ও ডাম্বলডোরকে দেখলই না। ও বলল, স্নেইপ আমাকে সম্মোহন করেছিল প্রফেসর ডাম্বলডোর, আমি কিছু করিনি, শুধু ওকে টিজ করছিলাম। বলেছিলাম, তুমি ফ্লোরেন্সকে চুম্বন করেছ, আমি দেখে ফেলেছি… গত বৃহস্পতিবার গ্রীন হাউজের পেছনে…।
ডাম্বলডোর বিষণ্ণ দৃষ্টিতে মেয়েটিকে দেখে বললেন, কিন্তু কেন বান্ধা, তুমি কেন ওর পেছনে পেছনে গিয়েছিলে।
মেয়েটি আর ঘুরছে না, স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বার্থা? হ্যারি অস্ফুট স্বরে ওরদিকে তাকিয়ে বলল…। ইনি কী বার্থা জোরকিনস?
ডাম্বলডোর বললেন, হ্যা…। আবার তার চিন্তা দেখার জন্য গামলার তরল পদার্থকে দণ্ড দিয়ে নাড়াতে লাগলেন। আবার সেটা রূপালী রং হয়ে গেল। হ্যাঁ ও বার্থা, আমাদের স্কুলের ছাত্রী ছিল।
পেনসিভে ডাম্বলডোরের মুখ তীব্রভাবে উদ্ভাসিত করল। হ্যারির দেখে মনে হল ডাম্বলডোর বড় বেশি বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। ডাম্বলডোরের বয়স বাড়ছে হ্যারি জানে… তাহলেও এত বৃদ্ধ হয়ে যাবেন ভাবতে পারেনি।
হ্যারি, কি যেন বলতে এসেছিলে তুমি? এক্ষুণি বলে ফেলো, আমাকে আবার চিন্তার ভেতরে ঢুকে যেতে হবে।
প্রফেসর কিছুক্ষণ আগে আমি ক্লাসে ছিলাম ভবিষ্যৎ কথন তারপর সেখানে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
বল, তারপর ঘুমে কি দেখলে।
লর্ড ভোল্ডেমর্ট। ওয়ার্মটেলকে নির্যাতন করছে। আপনি নিশ্চয়ই ওয়ার্মটেলের নাম শুনেছেন, চেনেনও তাকে।
হাঁ, অবশ্যই তারপর কী দেখলে বল।
ভোল্ডেমর্ট প্যাঁচার কাছ থেকে বার্তা পেয়ে জেনেছেন, এমন একটা কিছু দোষ বা ভুল ওয়ার্মটেল করেছে সেটা মারাত্মক হলেও তিনি শুধরে নিয়েছেন। কে একজন মারাও গেছে। তারপর বললেন, ওয়ার্মটেল সাপের মুখ থেকে তোমাকে ফিরিয়ে আনলাম। ভোল্টেমর্টের চেয়ারের পাশে বিরাট এক সাপ ছিল। ওয়ার্মটেলকে বললেন এখন সাপ তোমার বদলে হ্যারিকে খাবে। তারপর ওয়ার্মটেলের ওপর কুসিয়াস কার্স প্রয়োগ করলেন… আমার কপালের কাটা দাগটা অসম্ভব জ্বালা আর ব্যথা করতে লাগল। তারপরই আমার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙার পরও আমার ব্যথা কমল না।
ডাম্বলডোর কেবল ওর দিকে তাকালেন।
এই স্বপ্ন দেখেছি, হ্যারি বলল।
আচ্ছা, ডাম্বলডোর বললেন। আচ্ছা এই বছর অন্য কোনও সময়ে তোমার কাটা দাগে ব্যথা হয়েছে? গরমকালে তুমি একবার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল ওইরকম একটা কিছু দেখে?
আপনি কি করে জানলেন প্রফেসর? হ্যারি একটু আশ্চর্য হয়ে বলল।
তুমি কী মনে কর সিরিয়সের সঙ্গে তোমার চিঠির আদান–প্রদান হয়, তার আমি কোনও খবর রাখি না? সিরিয়স হোগার্ট ছাড়ার পরও আমাকে ছাড়েনি, আমিও তাকে ছাড়িনি। তোমার সব খবরই আমি সিরিয়সের কাছ থেকে পাই। আমিই ওকে পাহাড়ের গুহায় লুকিয়ে থাকতে পরামর্শ দিয়েছিলাম। ওটাই ওর সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। তোমরা তো দেখে এসেছে?
ডাম্বলডোর চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরময় পায়চারি করতে লাগলেন। একটু পরপর কপালে দণ্ড ছোঁয়াতে লাগলেন। ছোঁয়াবার পর উজ্জ্বল রূপালী চিন্তা মাথা থেকে বেরিয়ে এসে পেনসিভের সঙ্গে মিশতে লাগল।
প্রফেসর? হ্যারি খুব ধীরে বলল।
ডাম্বলডোর পায়চারি থামিয়ে হ্যারির দিতে তাকালেন।
আমাকে ক্ষমা করবে, ডাম্বলডোর খুব আস্তে আস্তে বললেন। তারপর ডেস্কে বসলেন।
–কেন আমার কাটা দাগে ব্যথা লাগে, জ্বালা করে প্রফেসর?
ডাম্বলডোর গভীর দৃষ্টিতে হ্যারিকে দেখলেন। তারপর বললেন, তোমার ওই কাটা দাগ জ্বালা করে ব্যথা লাগে, যখন লর্ড ভোন্ডেমট তোমার খুব কাছে আসে, যখন তোমার কোনও ক্ষতি করার মতলব আঁটে। তোমার প্রতি ঘৃণার ভাব তার মনের ভেতর দানা বাঁধে।
কিন্তু কেন?
কারণ তুমি আরও এমন. এক কার্সের সঙ্গে সংযুক্ত যা কার্যকরী হয়নি; ডাম্বলডোর বললেন, কার্সটা সাধারণ নয়।
তাহলে, আপনি কী মনে করেন যে স্বপ্নটা দেখেছি সেটা সত্য হবে?
সম্ভবত, ডাম্বলডোর বললেন, আমি বলছি বিশ্বাস করার কারণ আছে। হ্যারি তুমি কী স্বপ্নে ভোল্ডেমর্টকে স্বচক্ষে দেখেছ?
না, হ্যারি বলল, শুধু চেয়ারের পেছনটা। কিন্তু দেখার তো কিছুই ছিলো না, ছিল কী? আমি বলতে চাই, তার কী দেহ আছে? কিন্তু বুঝতে পারছি না দেহ না থাকলে জাদুদণ্ড কেমন করে ধরেন? হ্যারি খুব ধীরে ও আস্তে বলল।
সত্যি তো? ডাম্বলডোর বিড়বিড় করলেন–সত্যি তো…।
দুজনেই অনেকটা সময় নীরব। ডাম্বলডোর সারা ঘরে পায়চারি করতে লাগলেন, আর মাঝে মধ্যে কপালে দণ্ড ঠেকিয়ে উজ্জ্বল রূপালী চিন্তা পেনসিভ ফেলতে লাগলেন।
হ্যারি শেষে বলল, আপনি কি মনে করেন ও আরও বেশি শক্তিশালী হচ্ছে প্রফেসর?
ভোল্ডেমর্ট? পেনসিভের দিকে তাকিয়ে হ্যারিকে দেখলেন। আমি একমাত্র আমার সন্দেহের কথা তোমাকে বলতে পারি।
হ্যারি, ডাম্বলডোরের দিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবার মনে হল উনি হঠাৎ আগের চেয়েও বেশি বৃদ্ধ ও কাহিল হয়ে পড়েছেন।
–ভোল্ডেমর্ট ক্ষমতা আয়ত্তে আনার পর শুধু শুনতে পাই নিরীহ মানুষের অন্ত ধানের কথা। ভোল্ডেমর্ট শেষ যেখানে ছিল সেখান থেকে বার্থা জোরকিনস কোনরকম চিহ্ন না রেখে উধাও হয়েছে। মি. ক্রাউচও তাই… আমাদের মাঠ থেকেই। তৃতীয় অন্তর্ধান এক মাগল। আমি দুঃখের সঙ্গে বলছি মিনিস্ট্রি সেই বিষয়টিতে একেবারেই কোনো গুরুত্ব দেয়নি। যেহেতু সে ছিল মাগল (যারা জাদুকর নয়)। ওর নাম ফ্রাঙ্ক ব্রাইস, যেখানে ভোল্ডেমর্টের পিতা জন্মেছেন, বড় হয়েছেন সেই গ্রামে তিনি থাকতেন। গত আগস্ট মাস থেকে তার আর দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। শোন, আমি মাগলদের সংবাদপত্র পড়ি, আমার মন্ত্রণালয়ের বন্ধুরা অবশ্য পড়েন না।
ডাম্বলডোর হ্যারির মুখের দিকে অতি গম্ভীরভাবে তাকালেন। এই রকমের অন্ত ধান কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, মনে হয়, এর সঙ্গে কোনো শক্তি যুক্ত আছে। মন্ত্রণালয় অবশ্য আমার সাথে একমত নয়–বোধহয় তুমি এ বিষয়ে শুনে থাকবে, মানে যখন তুমি আমার ঘরের বাইরে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে।
দুজনেই আবার নীরব। ডাম্বলডোর একের পর এক মাথার ভেতর থেকে চিন্তা বের করে নিচ্ছেন, হ্যারির মনে হল এইবার তার চলে যাওয়া উচিত, কিন্তু তার কৌতূহল ওকে চেপে বসিয়ে রাখল।
প্রফেসর? ও আবার বলল।
হ্যাঁ, বল হ্যারি, ডাম্বলডোর বললেন।
আমি যখন পেনসিভে, তখন আদালতে যা দেখেছি, সে সম্বন্ধে আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারি?
অবশ্যই, ডাম্বলডোর ভরি স্বরে বললেন। আমি অনেকবার আদালতে যোগদান করেছি, কিন্তু কিছু কিছু বিচার আমার মনে বারবার ফিরে আসে, বিশেষ করে এখন যা দেখেছ…
তুমি সেই বিচার চলাকালে আমাকে দেখেছ? একটায় ক্রাউচের ছেলের? ওরা নেভিলের বাবা-মায়ের প্রসঙ্গে কথা বলছিলেন? ডাম্বলডোর হ্যারির দিকে তী দৃষ্টিতে তাকালেন।
আরও বললেন, তুমি কি জান কেন নেভিল ওর বাবা-মার কাছে না থেকে গ্রান্ডমাদারের কাছে থেকে বড় হয়েছে?
হ্যারি জানে না, এমনভাবে মাথা নাড়ল। গত চার বছরে ওরা একই ক্লাসে পড়েও এই ব্যাপারটা একবারও মাথায় আসেনি।
হ্যাঁ, নেভিলের বাবা-মায়ের প্রসঙ্গ ওরা আদালতে তুলেছিল, ডাম্বলডোর বললেন। প্রফেসর মুডির মতো ওর বাবা ফ্র্যাঙ্ক একজন অরব ছিলেন। ভোমের্টের ক্ষমতাচ্যুতির পরেই তার বিষয়ে জানার জন্য তাকে ও তার স্ত্রীকে নির্যাতন করা হয়েছিল। হয়তোবা তুমি তা শুনে থাকবে।
ওরা তো মৃত? হ্যারি বলল।
না মৃত নয়। কথাটা এমন এক বিরক্তির সঙ্গে বললেন–হ্যারি আগে কখনও তাকে এমনভাবে কথা বলতে শোনেনি। ওরা পাগল হয়ে গেছেন। ম্যাজিক্যাল ম্যালাডিস অ্যান্ড ইনজুরিস সেন্ট মাংগোম, হাসপাতালে আছেন। আমার ধারণা নেভিল মাঝে মধ্যে ঠাকুমার সঙ্গে তাদের সঙ্গে দেখা করতে যায় ছুটিছাটার দিন। ওরা ছেলেকে দেখে চিনতে পারেন না।
হ্যারি দারুণ ভয়ে আক্রান্ত হয়ে বসে রইল। গত চার বছরে একবারও নেভিলের মুখ থেকে খবরটা শোনেনি, এমনকি জানবার চেষ্টাও করেনি।
ডাম্বলডোর বললেন, লংবটমরা অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। ভোল্ডেমর্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর পরই তাদের ওপর আক্রমণ হয়েছিল–অথচ সে সময় লোকেরা মনে করতো তারা নিরাপদে আছেন। তাদের ওপর এই বর্বরোচিত আঘাত মানুষজনের মনে দারুণ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিল মানুষ। এইরকম প্রতিক্রিয়া এর আগে আমি কখনো দেখিনি। মিনিস্ট্রি অবশ্য চাপের মুখে দুষ্কৃতিকারীদের ধরার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল… কিন্তু দুঃখের বিষয় তাদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে কিছু করা সম্ভব হয়নি।
হ্যারি বলল, মি. কাউচের ছেলে হয়ত জড়িত ছিল না।
ডাম্বলডোর বললেন, সে সম্বন্ধে আমার কোনও ধারণা নেই।
আরও দুটি প্রশ্ন করার জন্য হ্যারি ছটফট করছিল; কিন্তু সেগুলো তো জীবিত মানুষদের অপরাধ প্রসঙ্গে।
বলছিলাম ব্যাগম্যানের কথা।
আজ পর্যন্তও কোন ডার্ক কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত আছে এমন অভিযোগ আমি শুনিনি, ডাম্বলডোর কোনরকম উত্তেজিত না হয়ে স্বাভাবিকভাবে বললেন।
হ্যারি বলল, স্নেইপ ভোল্ডেমর্টকে আর সমর্থন করে না তার প্রমাণ কি প্রফেসর?
ডাম্বলডোর হ্যারির প্রশ্নসূচক দৃষ্টির দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বললেন, ব্যাপারটা আমার আর স্নেইপের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাক হ্যারি।
হ্যারি বুঝতে পারলো, ডাম্বলডোরের সঙ্গে ওর কথাবার্তা শেষ হয়েছে। এবার যেতে হবে। ডালডোরকে আগের মতো চিন্তিত দেখাচ্ছে না। শান্ত মুখ।
ডাম্বলডোর বললেন, হ্যারি।
হ্যারি তখন দরজার গোড়ায় পৌঁছে গেছে। শোন, তুমি কি নেভিলের মা বাবার সম্বন্ধে কারও কাছে কোন কথা বলবে না। প্রয়োজন হলে তখন ও নিজেই বলবে।
–আচ্ছা প্রফেসর, হ্যারি বলল।
–আর একটা কথা। হ্যারি পেছন ফিরে তাকাল, দেখল ডাম্বলডোর পেনসিভের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। গামলার তলা থেকে রূপালী আলো তার মুখে এসে পড়েছে, তাকে আরও বৃদ্ধ দেখাচ্ছে। ডাম্বলডোর হ্যারিকে এক মুহূর্ত দেখে বললেন, তোমার তৃতীয় টাস্ক ভালোভাবে হোক আমি তোমার শুভ কামনা করি।