ত্রিশ
ত্রিভুবনের ইঙ্গিতে জিপ ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে গেল। সামনে দাঁড়ানো পুলিশের সকলের হাতে আধুনিক অস্ত্র। ত্রিভুবনের বুকের ভেতরে ড্রাম বাজছিল। হায়দার বলেছে তার সঙ্গে পুলিশের একটা অংশের ব্যবস্থা হয়েছে। এই লোকগুলো সেই অংশের মধ্যে পড়ে কি না কে জানে। পায়ের কাছে ধরা রিভলভারটি কাঁপছিল তার। ধরা পড়ার আগে এটাকে ব্যবহার করবে না।
একজন পুলিশ অফিসার চিৎকার করে বলল হেডলাইট নেভাতে। ড্রাইভার চটপট সেটা নিভিয়ে দিলে লোকটা এগিয়ে এল অস্ত্র হাতে। ড্রাইভারের পাশে দাঁড়িয়ে হুকুম করল, ‘কারফিউ পাশ আছে?’ ড্রাইভার তড়িঘড়ি সেটা বের করে দিল।
লোকটা জিপের ভেতরের আলোয় সেটাকে দেখার চেষ্টা করল। তারপর কাগজটা ফিরিয়ে না দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় যাচ্ছ?’
ত্রিভুবন জবাব দিল ‘শিবগঞ্জ।’
‘কেন?’
‘আমাদের এক আত্মীয় মারা গিয়েছে।’
‘নেমে এসো। সার্চ করব।’
‘অফিসার, আমাদের খুব দেরি হয়ে যাবে। ম্যাডাম রাগ করবেন।’
‘ম্যাডাম?’
‘ওঁর হুকুমেই যাচ্ছি।’
লোকটা কারফিউ পাশ ড্রাইভারকে ফিরিয়ে দিয়ে অন্যান্যদের ইশারা করল পথ করে দিতে। জিপ আর দাঁড়াল না। ওদের পেরিয়ে আসামাত্র স্বজন জিজ্ঞাসা করল, ‘ম্যাডাম কে?’
‘কেন? আপনাদের কি দরকার?’
‘পুলিশের কাছে মন্ত্রের মতো কাজ হল ওঁর নাম বলায়।’
‘আপনারা কিছু শোনেননি। চুপচাপ বসে থাকুন।’ রুমালে মুখ মুছল ত্রিভুবন। এখন বাড়িঘর চারপাশে নেই। প্রায় মাঠের মধ্যে দিয়ে গাড়ি ছুটছে। ব্যাপারটা ত্রিভুবনকেও কম বিস্মিত করেনি। হায়দার বলেছিল, ‘পুলিশ যদি তোমাকে বেকায়দায় ফেলতে চায় তাহলে ম্যাডামের দোহাই দেবে। তাতে কাজ না হলে বুঝবে অস্ত্র ব্যবহার করতে হবে।’ সে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘ম্যাডাম কেন? তিনি এর মধ্যে আসছেন কেন?’
‘আমি জানি না। কিছু কিছু ব্যাপার আছে যা জানতে না চাওয়াই ভাল।’
ত্রিভুবন তখন মাথা ঘামায়নি। মাথা ঘামানোর মতো অবকাশও ছিল না। অব্যাহতি পাওয়ার পর মনে হচ্ছে জল অনেক দূর গড়িয়েছে। তাদের এই আন্দোলনের সঙ্গে দেশ এবং বিদেশের অর্থবান কিছু মানুষ জড়িয়ে আছেন। লেডি প্রধান যদি তাদের আশ্রয় না দিতেন তাহলে আকাশলালের ওপর অপারেশন করা সম্ভব হত না। কিন্তু ওই ম্যাডাম যে তাদের সঙ্গে আছেন এ কথা প্রথমসারির নেতা হয়েও সে জানত না। ম্যাডাম হচ্ছেন স্বৈরাচারী সরকারের একজন প্রতিনিধি। বোর্ডে ওঁর ইনফ্লুয়েন্স খুব। ভার্গিস ওঠে বসে ওঁর কথায়। এমন মহিলা কি করে ওদের সঙ্গে থাকবেন? গুলিয়ে যাচ্ছিল সব ত্রিভুবনের কাছে।
এখন রাত সুনসান। আকাশে যেন তারার বাজার বসে গেছে। এই তিনজনকে সীমান্ত পার করে দিলে তার মুক্তি। তারপর সে চলে যাবে গ্রামে। এই জিপ নিয়ে অবশ্য গ্রামে যাওয়া যাবে না। কিন্তু গ্রামে গিয়ে করবেই বা কি? হঠাৎ আর একটা ভাবনা মাথায় এল। ম্যাডামের সঙ্গে কি আকাশলালের কোনও গোপন সম্পর্ক আছে। এতকাল পুলিশের হাত থেকে ম্যাডামই কি ওদের বাঁচিয়ে রেখেছিল? হায়দার সব জানত? এই সন্দেহ সত্যি হলে বিপ্লবের বড় বড় স্তম্ভগুলো তো ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। বিপ্লব ব্যাপারটাই বানানো হয়ে যাবে। রিভলভার আঁকড়ে ধরল সে। আকাশলাল কি তাকে ব্যবহার করেছে? বিপ্লবের নামে তাদের নিঃস্ব করে নিজের আখের গুছিয়ে নিতে অপারেশন করিয়েছে? ত্রিভুবন জানে এই প্রশ্নের উত্তর সময় ছাড়া কেউ দিতে পারবে না। হেনার মুখ মনে পড়ল। মেয়েটা তাকে ভালবাসে। তাকে ভালবাসে বলেই বিপ্লবের অংশীদার হয়েছে ও। হেনা এখন তার জন্যে গ্রামে অপেক্ষা করছে? ঠিক জানা নেই। ক’দিন কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি। হঠাৎ নিজেকে কিরকম প্রতারিত বলে মনে হচ্ছিল তার।
‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’ বৃদ্ধ ডাক্তারের গলা ভেসে এল।
‘জাহান্নামে।’ ত্রিভুবন বিকৃত মুখে উত্তর দিল। তার মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। স্বজনের গলা পাওয়া গেল, ‘আপনি এভাবে কথা বলতে পারেন না।’
‘কিভাবে কথা বলব তা আপনার কাছে শিখতে হবে নাকি?’
‘এই সময় পৃথা বলে উঠল, ‘আশ্চর্য অকৃতজ্ঞ তো!’
‘ইউ শাট আপ। চুপ করে বসুন।’ চিৎকার করে উঠল ত্রিভবন। হঠাৎই সে নিজেকে ধরে রাখতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল সবাই তার ভালমানুষির সুযোগ দিচ্ছে।
পৃথা বলল, ‘চমৎকার। আপনাদের জন্যে আমরা দেশ ছেড়ে এখানে এসে বন্দির জীবন যাপন করলাম। আমাদের কাজে লাগিয়ে এমন ব্যবহার তো আপনারা করবেনই।’
‘ম্যাডাম। আপনারা আমার জন্যে কিছু করেননি। যার জন্যে করেছেন সে ভ্যানে চেপে অন্য দিকে রওনা হয়ে গিয়েছে। আমার মাথা ঠিক নেই, এখন কথা বলবেন না।’ ত্রিভুবনের গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যে স্বজন ইশারায় পৃথাকে কথা বলতে নিষেধ করল। কিন্তু বৃদ্ধ ডাক্তার সেটা বুঝলেন না। তিনি বললেন, ‘আমাকে নামিয়ে দিন।’
‘নামবেন মানে? এখানে নেমে কোথায় যাবেন?’
‘যেখানেই যাই, নিজে যাব। আমাকে আপনাদের আর কোনও দরকার নেই।’
‘আছে। এখানে আপনাকে দেখতে পেলেই পুলিশ ধরবে। তারা আপনার পেট থেকে সব কথা টেনে বের করবে। আমরা সেটা চাই না।’
‘উঃ, আমি পাগল হয়ে যাব।’ বৃদ্ধ চিৎকার করে উঠলেন, ‘আমি কত দিন ধরে এদের কাছে বন্দি হয়ে আছি তা জানেন? আমার পরিবারের কাউকেই আমি দেখতে পাইনি। ওরা নিশ্চয়ই ভেবেছে আমি মরে গেছি। শুধু লোভে পড়ে আমি রাজি হয়েছিলাম। আকাশ আমাকে বলেছিল অপারেশনটা করতে পারলে পৃথিবীর সবাই আমার নাম জানবে। নোবেল প্রাইজ পাব আমি। ওঃ, কী ভুল কী ভুল!’
হঠাৎ ত্রিভুবন ঘুরে বসল, ‘এই বুড়ো, চুপ করবি কিনা বল!’
‘না করব না। চিৎকার করে সবাইকে বলব তোমরা আমাকে বন্দি করে রেখেছ।’
ত্রিভুবন স্বজনের দিকে তাকাল, ‘ওকে সামলান। এই চিৎকার কারও কানে গেলে আর বর্ডার পার হতে পারব না আমরা। পুলিশের চোখে আমরা সবাই এখন অপরাধী। এটা ওকে বোঝান। নইলে আমি কিছু করলে আপনারা দোষ দেবেন না।’
স্বজন বৃদ্ধের হাত ধরল, ‘ডক্টর। একটু শান্ত হন। বর্ডার পেরিয়ে গেলেই আপনি যেখানে ইচ্ছে সেখানে যেতে পারবেন।’
‘না পারব না। দে উইল নট অ্যালাউ মি। আমি ওদের গোপন খবর জেনে গেছি।’ বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন, ‘ওরা আমাকে ছেড়ে দিতে পারে না।’
গোপন খবর? স্বজন শক্ত হল। সে আকাশলালের মুখ অপারেশন করে পাল্টে দিয়েছে। এই ব্যাপারটা তার চেয়ে ভাল কেউ জানে না। পৃথিবীতে একমাত্র সে-ই আকাশলালকে দেখে আইডেন্টিফাই করতে পারবে। যদি নতুন জীবনে আকাশলাল নতুন মানুষ হিসেবে কাজ করতে যায় তাহলে তার মতো সাক্ষীকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইবে না। তার মানে বৃদ্ধের মতো তারাও নিরাপদ নয়।
স্বজন চাপা গলায় বলল, ‘বর্ডার আর কত দূর?’
ত্রিভুবন ড্রাইভারের দিকে তাকাল। ড্রাইভার বলল, “আর মাইল পাঁচেক।’
‘বর্ডার পার হবেন কি করে? সেখানে চেকপোস্ট আছে।’
‘সেটা আমার চিন্তা। আপনারা নিচু হয়ে বসে থাকবেন।’
এই সময় একটা মোটর বাইকের আওয়াজ পাওয়া গেল। রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে মোটর বাইকটা সামনের দিক থেকে আসছে। এখন ওরা পাহাড়ি জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে। রাস্তায় ঘন ঘন বাঁক। তাই মোটর বাইকটাকে দেখা যাচ্ছে না।
ত্রিভুবন বলল, ‘ভগবানের দোহাই, আপনারা চুপ করে থাকুন। বাইকে পুলিশ থাকবেই। আমি ওর সঙ্গে কথা বলব।’
একটা বাঁক ঘুরতেই দূরে বাইকটাকে দেখা গেল। আলোয় সিগন্যাল দিচ্ছে থেমে যাওয়ার জন্যে। ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, ‘কি করব?’
‘একা মনে হচ্ছে?’
‘হ্যাঁ। পেট্রল বাইক।‘
‘তাহলে কাছে গিয়ে স্পিড বাড়াও। বাইকটাকে স্ম্যাশ করার চেষ্টা করো।’
হেডলাইটের আলোয় পুলিশ অফিসারকে দেখা গেল। বাইক থেকে নেমে স্টেনগান উচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইশারা করছে জিপ থামাতে। জিপের গতি শ্লথ হল। কিন্তু কাছাকাছি পৌঁছে হঠাৎ পিকআপ বাড়িয়ে দিল ড্রাইভার। আর সেই সঙ্গে রাস্তার একপাশে চলে এল যেখানে বাইকটা রয়েছে। চিৎকার করে সার্জেন্ট লাফিয়ে পড়তে চাইল একপাশে। জিপ গতি বাড়িয়েও বাড়াতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল তার চাকা আটকে যাচ্ছে মাটিতে। ড্রাইভার ভয়ার্ত গলায় বলে উঠল, ‘বাইকটা ভেতরে ঢুকে গেছে।’ সে জিপ থামাতে বাধ্য হল।
চকিতে জিপ থেকে নেমে গুলি ছুঁড়তে লাগল ত্রিভুবন। রাস্তার পাশে শুয়ে থাকা অফিসারের শরীর আর নড়ল না। ত্রিভুবন চিৎকার করল, ‘বাইকটাকে বের কর, জলদি।’
ড্রাইভার ততক্ষণে নীচে নেমে দেখছে। ভেঙেচুরে তুবড়ে বাইকের অনেকটাই সামনের বাঁদিকের চাকার ফাঁকে ঢুকে গেছে। দু’হাত দিয়ে টেনে-হিঁচড়েও সেটাকে বের করতে পারল না লোকটা। বলল, ‘স্যার, আপনাদের হাত লাগাতে হবে।’।
ত্রিভুবন হুকুম করল, ‘নেমে আসুন, নেমে আসুন। না না আপনি নন, আপনি আসুন, হাত লাগান।’ বৃদ্ধকে থামিয়ে সে স্বজনকে হুকুম করল।
অতএব স্বজন নামল। চার ধার অন্ধকার, শুধু জিপের আলো জ্বলছে। তিনজনে কিছুক্ষণ চেষ্টার পর বাইকটাকে সরিয়ে আনতে পারল। জিপে উঠে বসল স্বজন। ত্রিভুবন উঠতে গিয়েও থেমে গেল, ‘স্টেনগানটা নিয়ে আসি। কাজ দেবে।’
মৃত অফিসারের কাছে চলে গেল সে। স্বজন দেখল অন্ধকারে অস্ত্রটাকে খুঁজে পাচ্ছে না ত্রিভুবন। দেখতে দেখতে ঢালুর দিকে নেমে যাচ্ছে। পা দিয়ে খুঁজছে সে। হঠাৎ তার নজরে এল নিজের আসনের ওপর রিভলভারটা রেখে গিয়েছে ত্রিভুবন। চট করে হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়ে সে ড্রাইভারের মাথায় অস্ত্রটা ঠেকাল, ‘স্পিড় নাও। জলদি। নইলে গুলি করব।’
‘কিন্তু— ।’
‘আর একটা কথা বললে তোমার অবস্থা ওই অফিসারের মতো হবে।’ রিভলভার দিয়ে ঠেলল সে ড্রাইভারের মাথাটাকে। সঙ্গে সঙ্গে গিয়ার পাল্টে অ্যাকসিলারেটারে চাপ দিল লোকটা। গাড়ি গতি নিতেই ত্রিভুবনের চিৎকার ভেসে এল, ‘এই, আরে, কি হচ্ছে? এই!’ রিভলভারের নল সরাল না স্বজন। চাপা গলায় বলল, ‘আরও জোরে’ এবং তখনই স্টেনগানের আওয়াজ ভেসে এল। অস্ত্রটাকে খুঁজে পেয়েছে ত্রিভুবন। কিন্তু জিপ ততক্ষণে আর একটা বাঁকের আড়ালে চলে এসেছে।
সোজা চালাও, থামবে না।’ হুকুম করল স্বজন।
‘থ্যাঙ্ক ইউ ব্রাদার।’ বৃদ্ধ বিড় বিড় করে উঠলেন।
এতক্ষণ পৃথা স্বজনের সঙ্গে লেপ্টে ছিল। এবার প্রশ্ন করল ‘আমরা বর্ডার পার হব কি করে?’
‘যেভাবে যাচ্ছিলাম।’
‘ওরা তো গুলি চালাবে।’
‘রিস্ক নিতে হবে।’
কয়েক মিনিটের মধ্যে স্বজনের হাত টনটন করতে লাগল। রিভলভারটা ধরে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ছিল। কিন্তু সে জানে সুযোগ পেলেই কাজে লাগাবে ড্রাইভার। হঠাৎ দূৱে আলো জ্বলছে দেখা গেল। ড্রাইভার বলল, ‘চেকপোস্ট এসে গেছে। কি করব?’
‘স্পিড তোল।’ স্বজন বলল।
‘না।’ বৃদ্ধ বলে উঠলেন, ‘গাড়িটা থামাও। আমি নীচে নেমে ওদের সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করব। সেই সুযোগে তোমরা বেরিয়ে যেতে পার।’
‘আপনি?’
‘আমার জন্যে চিন্তা করার দরকার নেই।’
‘ওরা আপনাকে মেরে ফেলবে।’
‘নাও পারে। আমি ঝুঁকি নেব। এ ছাড়া কোনও উপায় নেই।’
দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে চেকপোস্টের সামনে দুটো ড্রাম রাখা আছে। গোটা পাঁচেক পুলিশ অস্ত্র হাতে অপেক্ষা করছে। স্পিড তুলে বেরিয়ে যেতে গেলে ড্রামের গায়ে ধাক্কা খেতে হবে।
জিপের গতি কমতেই রিভলভার সরিয়ে নিল স্বজন। পায়ের নীচে ফেলে দিল। দুই ড্রামের মাঝখানে জিপের মুখ রেখে দাঁড় করাতেই বৃদ্ধ ডাক্তার নেমে পড়লেন। ততক্ষণে তাদের চারপাশে অস্ত্রধারীদের কৌতূহলী মুখ। বৃদ্ধ ডাক্তারকে বলতে শোনা গেল, ‘অফিসার-ইন-চার্জ কে? আমি তার সঙ্গে কথা বলব।’
‘আপনি কে?’
‘আমি একজন ডাক্তার। আমাকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।’
‘কোথায়?’
‘না আর কোনও কথা নয়। ঠিক লোকের সঙ্গে কথা বলব আমি।’
এবারে পাশের বাড়ির বারান্দা থেকে একজনের গলা ভেসে এল, ‘ওকে নিয়ে এসো।’
দু’জন লোক ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে এগোল। একজন জিপের পাশে দাঁড়িয়ে টর্চ জ্বেলে বলে উঠল, ‘আরে! মেয়েমানুষ আছে জিপে।’ যে বলেছিল, তার হাত থেকে টর্চ নিয়ে আর একজন পৃথার মুখে আলো ফেলল। পৃথা প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল, স্বজন ওর হাতে চাপ দিয়ে নিষেধ করল।
বারান্দায় উঠে বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি অফিসার?’
‘লোকে তাই বলে। আপনি কে?’
‘আমি একজন ডাক্তার। উগ্রপন্থীরা আমাকে জোর করে আটকে রেখেছিল। এইমাত্র আপনাদের একজন অফিসার পাহাড়ে ওদের ধরতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। সেই সুযোগে আমরা পালিয়ে এসেছি।’
‘প্রাণ হারিয়েছেন?’ চিৎকার করে উঠল লোকটা, ‘মোটরবাইকে ছিল?’
‘হ্যাঁ।’
সঙ্গে সঙ্গে সাড়া পড়ে গেল। একটা ভ্যান পুলিশ বোঝাই করে ছুটে গেল পাহাড়ের দিকে। অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার সঙ্গে জিপে কে কে আছে?’
‘ওরাও ডাক্তার। আমি একটু কমিশনার ভার্গিসের সঙ্গে কথা বলতে পারি?’
‘নিশ্চয়ই। ওদের ডেকে নিয়ে ভেতরে আসুন।’
বৃদ্ধ এগিয়ে এলেন জিপের কাছে। সেখানে দু’জন সেপাই দাঁড়িয়ে আছে অস্ত্র হাতে। নিচু গলায় বললেন তিনি, ‘আপনারা কি করবেন?’
‘নামলে ওরা সব জেনে যাবে। আপনি উঠে পড়ুন। পিকআপ নিন ড্রাইভার।’ স্বজন চাপা গলায় হুকুম করতেই জিপ ছিটকে এগিয়ে গেল আর বৃদ্ধ উঠতে গিয়ে গড়িয়ে পড়লেন সেপাইদের সামনে। ড্রাম দুটো দু’দিকে ছিটকে গেল। সেপাইরা ড্রামের আঘাত সামলাতে লাফিয়ে সরে পড়তেই জিপ ধাক্কা মারল বাঁশের বেড়ায়। চৌচির হয়ে গেল সেটা। বন্দুকের আওয়াজ শুরু হতেই জিপ এগিয়ে গেল অনেকটা। এখন পেছন থেকে অবিরত গুলি আসছে। মাথা নিচু করে বসে ছিল ওরা। হঠাৎ ড্রাইভার চিৎকার করে ব্রেক কষল। লাফিয়ে উঠে স্থির হয়ে গেল জিপটা। কাতর গলায় ড্রাইভার বলল, ‘আমার হাতে গুলি লেগেছে।’
‘সরে ঘাও, সরে যাও পাশে।’ স্বজন ওকে কোনও মতে সরিয়ে স্টিয়ারিঙে এসে বসল জিপের গায়ে গুলি লাগল আর একটা। অন্ধকার বলে অসুবিধে হচ্ছে ওদের। বেড়া ভাঙার সময় জিপের হেডলাইটগুলো গিয়েছে। স্বজন অন্ধকারেই জিপ ছোটাল। যে ভ্যানটা চেকপোস্টে ছিল সেটা একটু আগে বিপরীত দিকে রওনা হওয়ায় কেউ ওদের পিছ ধাওয়া করতে পারছে না। মাইল কয়েক পাহাড়ি রাস্তায় আসার পরে উত্তেজনা কমে এল স্বজনের। পৃথা পেছনে চুপ করে বসে আছে। স্বজন জিপ থামিয়ে ড্রাইভারের দিকে তাকাল, ‘কেমন আছ তুমি?’
লোকটা সাড়া দিল না। ওর কাঁধে হাত দিয়ে ঝাঁকাল সে। এবং সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারল। মুখ ফিরিয়ে সে পৃথাকে বলল, ‘লোকটা মরে গেছে।’
নিস্তেজ গলায় পৃথা বলল, ‘বোধহয় ওর গায়ে আবার গুলি লেগেছে।’
একটুও দ্বিধা না করে নেমে পড়ল স্বজন। টেনে হিঁচড়ে লোকটাকে জিপ থেকে নামিয়ে রাস্তার এক ধারে শুইয়ে দিল। ফিরে এসে স্টিয়ারিঙে বসে সে পৃথাকে বলল, ‘সামনে এসে বোসো। এখন আমরা বিপদমুক্ত।’
পৃথার গলার স্বর তখনও ক্লান্ত, ‘না।’
‘কেন?’
‘ওখানে আমি বসতে পারব না।’
স্বজন মাথা নাড়ল। তারপর স্পিড নিল। হেডলাইট ছাড়া জিপ বেশি জোরে চালানো সম্ভব নয়, অন্তত এই পাহাড়ি রাস্তাতে তো নয়ই। তা ছাড়া ইদানীং মারুতি চালিয়ে অভ্যস্ত সে। প্রতি মুহূর্তে সতর্ক থাকতে হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত একেবারে কমিয়ে দিল গতি। তারা সীমান্ত পেরিয়ে এসেছে। যা কিছু কড়াকড়ি ওপারে ঢোকার বা ওপার থেকে বের হবার মুখে। ভারতীয় সীমান্তে কোনও পাহারাদার নেই। ভারত তার এই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নাগরিকদের সম্পর্কে কোনও বাধানিষেধ রাখেনি। তাই এখন ওরা রয়েছে সীমান্তের এপারে। আবার কিছুটা এগোলেই মাইল কয়েক ভারতের থাকবে না। মিলেমিশে অদ্ভুত ব্যবস্থা। এসব জায়গায় দুই দেশের মানুষ অবাধে যাতায়াত করে। স্বজন দেখতে পেল দূরের পাহাড়ি বাঁকে আগুন জ্বলছে। এই রকম নির্জন জায়গায় কেউ এত রাত্রে আগুন জ্বালায় কি? আশেপাশে কোনও ঘরবাড়ি নেই। দু’পাশে এখন অনেক উঁচু পাহাড়, রাস্তাটা নেমে যাচ্ছে ওদের মধ্যে দিয়ে। এখানে এসে এত রাত্রে আগুন জ্বালবে কে?
বাঁক ঘুরে সে আগুনের কাছাকাছি চলে এল। রাস্তার পাশে কাঠ জ্বেলে এই আগুন তৈরি করা হয়েছে, কোনও মানুষ তার আশেপাশে নেই। পেছন থেকে পৃথার গলা ভেসে এল, ‘অদ্ভুত ব্যাপার, না? এভাবে আগুন জ্বেলেছে, দাবানল না লেগে যায়।’
‘কাছাকাছি গাছ নেই।’ গাড়ির ব্রেক চাপল স্বজন।
এই সময় ছায়ামূর্তি দেখা গেল। সম্ভবত জিপটিকে ভাল করে দেখেই সে আত্মপ্রকাশ করেছে। স্বজনের খেয়াল হল রিভলভারটা পেছনের সিটের তলায় রেখে এসেছে। সে চাপা গলায় বলল, ‘রিভলভারটা দাও।’
‘কোথায় আছে?’ পৃথার গলায় ভয়।
‘পায়ের নীচেটা দ্যাখো।’
ততক্ষণে ছায়ামূর্তি স্পষ্ট হয়েছে। স্বজন অবাক হয়ে দেখল আগন্তুক একজন নারী। আগুনের আভায় তাকে প্রচণ্ড রহস্যময়ী বলে মনে হছে। নারীর হাতে কোনও অস্ত্র নেই। ধীরে ধীরে এগিয়ে এল সে জিপের কাছে। অদ্ভুতভাবে স্বজনকে দেখল, ‘আপনি একা?
‘না। আমার স্ত্রী আছেন সঙ্গে।’ জবাবটা বেরিয়ে এল আপনাআপনি, কিন্তু তখনই খেয়াল হল এই নারী তাকে চেনে নাকি? স্বজন অবাক।
‘ত্রিভুবন কোথায়?’
চেকপোস্ট থেকে পুলিশভর্তি ভ্যানের ছুটে যাওয়ার দৃশ্যটি মনে এল। স্বজন বলল, ‘উনি নেমে যেতে বাধ্য হয়েছেন।’
‘কোথায়?’
‘সীমান্তের অনেক আগে।’
‘আপনার সঙ্গে আরও দু’জনের থাকার কথা। বৃদ্ধ ডাক্তার এবং ড্রাইভার।’
‘আপনি কে?’ এবার প্রশ্ন না করে পারল না স্বজন।
‘আমাকে আপনি চিনবেন না।’ নারী বলল, ওরা কোথায়?’
‘মারা গিয়েছেন। চেকপোস্ট পার হতে গিয়ে সংঘর্ষ হয়।’
‘ত্রিভুবনও কি তাই?’
‘না। উনি বেঁচে ছিলেন। অন্তত শেষবার দেখার সময় ছিলেন।’
‘তারপর?’
‘আমরা জানি না। জিপ নিয়ে আমরা চলে এসেছিলাম।’
‘কিন্তু আপনাদের জিপেই তো তার থাকার কথা।’
‘হ্যাঁ, তাই ছিলেনও। কিন্তু মোটরবাইকে চেপে এক পুলিশ অফিসার আমাদের চেজ করতে তিনি জিপ থেকে নেমে পড়েন। অফিসার মারা যায়, আমরা চলে আসি।’
‘ওকে না নিয়েই?’
স্বজনের মনে হল এই নারী ত্রিভুবনের সঙ্গিনী। শুধু ওর দলের লোক নয় তার চেয়ে বেশ কিছু। সে বলল, ‘ওকে নিয়ে এলে আমরা কেউই সীমান্ত পার হতে পারতাম না। বরং এই অবস্থায় উনি একা এদিকে চলে আসতে পারেন।’
নারী যেন বুঝতে পারছিল না তার কি করা উচিত। স্বজন জিজ্ঞাসা করল, ‘আমরা কি যেতে পারি?’
‘নিশ্চয়ই। এই আগুন তাহলে জ্বালিয়ে রাখার দরকার নেই। আপনারা চলে যান।’ নারী ধীরে-ধীরে পাহাড়ের আড়ালে চলে গেল।
পৃথা বলল, ‘মেয়েটার জন্যে কষ্ট হচ্ছে।’
স্বজন বলল, ‘হুঁ।’
পৃথা বলল, ‘তুমি বুঝবে না।’
‘তার মানে?’
‘মেয়েরা কখন এভাবে অপেক্ষা করে থাকে তা মেয়েরাই জানে।’
স্বজন জিপ চালু করল। হাতে স্টেনগান থাকলেও ত্রিভুবনের পক্ষে একা এক ভ্যান পুলিশের সঙ্গে লড়াই করা অসম্ভব। হয়তো ও কয়েকজনকে মেরে তবে মরবে। কিন্তু এসব অনুমান করে লাভ নেই। পাহাড় থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নেমে যাওয়া দরকার।