ডায়েরি লেখা পারুলের আবাল্যের অভ্যাস।
ওই অভ্যাসের জন্যে অমলবাবু নামের ভদ্রলোকটি ক্ষেপে যেতেন। তার ধারণা ছিল আমাকেও দেখতে দেওয়া হয় না এমন কিছু লেখা স্ত্রীর পক্ষে অত্যন্ত গর্হিত! কিন্তু পারুল এমন অদ্ভুত আশ্চর্য ভাবে ধিক্কার দিয়েছিল যে, জোর করে চেয়ে নিয়ে পড়া সম্ভব হতো না।
অমলবাবু বলেছিলেন, কী লেখা হয় ওতে যে মাঝরাত্তিরে উঠে লিখতে ইচ্ছে করে? ওটা তো তোমার পদ্যর খাতা নয়?
পারুল হেসে গড়িয়ে পড়েছিল, ওমা, তুমি আমার পদ্যর খাতাটা চিনে রেখেছো? আমার সম্পর্কে তোমার এতো লক্ষ্য?
লক্ষ্যের কিছু অভাব দেখেছো? বলেছিলেন অমলবাবু।
পারুল হাসি থামিয়ে বলেছিল, তা বটে! লক্ষ্যের অভাব? নাঃ, বরং একটু অভাব থাকলে মন্দ হতো না!
অমলবাবু গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলেছিলেন, হুঁ, তা এ খাতাটা কিসের?
দেখছেই তো, ডায়েরির।
ডায়েরি! গেরস্থর ঘরের মেয়েছেলের ডায়েরি লেখবার কি আছে?
কিছুই নেই। পাগলামি মাত্র!
কই দেখি কী নিয়ে পাগলামি! বলেছিলেন অমলবাবু হাতটা বাড়িয়ে!
সেই সময় পারুল বেদম হেসে উঠেছিল, এমা, দেখবে কি বলে! পরের চিঠি পড়ো পড়ো, তাই বলে অন্যের ডায়েরী দেখবে? নাঃ, তুমি বাপু বড়ো বেশী গাঁইয়া! আমার সামনে যা বললে, আর কারুর সামনে বোলো না। এটাকে এই তোমার সভ্যতার ওপর ছেড়ে দিয়ে যেখানে সেখানে ফেলে রাখছি, দেখো-টেখো না যেন।
এমন গোপন জিনিস যে স্বামীকেও দেখানো চলে না?
দেখানো কো চলবে না? পারুল কৌতুকে চোখ নাচিয়ে বলেছিল, আমি তোমায় ভয় করি নাকি; তাই তুমি পাছে আমার গোপন কথা জেনে ফেলে বলে ভয় পাবো? অপরের ডায়েরি দেখাটাই অসভ্যতা। সভ্য সমাজের কতকগুলো আইন আছে, মানো তো?
মানি না একথা বলতে পারেননি অমলবাবু, তাই বেজার মুখে বলেছিলেন, ওসব হচ্ছে বিলিতিয়ানা কথা! বাঙালী-বাড়িতে আবার এই সব!
পারুল সঙ্গে সঙ্গে মুখটা খুব অমায়িক করে বলেছিল, ওমা তাই তো! বাঙালীদের সে সভ্যতা-ভব্যতার ধার ধারতে হয় না তাতে মনে ছিলো না। তবে তো দেখছি খাতাটাকে গভীর গোপনে লুকিয়ে রাখতে হবে।
বলেছিল কিন্তু তা রাখেনি।
ভাড়ার ঘরের তাকে ফেলে রেখেছিল।
অথবা সেটাই অমলবাবুর পক্ষে দূর্গম-দুস্তুর ঠাই বলেই ওই চালাকিটা খেলেছিল। ভাড়ার ঘরে চাবি দেওয়ার কড়া নির্দেশ অমলবাবুরই। চাকর-বাকরকে তার দারুণ সন্দেহ।
পারুল যখন বলেছিল, সর্বদা চাবি দিয়ে রাখবো, ভাঁড়ারে এমন কি আছে? টাকা না গহনা, নাকি শাল-দোশাল-? দুটো চাল ডাল তেল নুন বৈ তো নয়। তখন অমলবাবু পারুলকে ন্যাকা আখ্যা দিয়েছিলেন।
অতএব পারুল একনিষ্ঠ চিত্তে ভাঁড়ারে চাবি লাগায় এবং সে চাবি কোথায় যে রাখে কে জানে! আঁচলে চাবি বাঁধার যে একটা চিরন্তন রীতি আছে বাঙালী মেয়েদের, সেটা আবার পারুলের হয়ে ওঠে না। আঁচলে চাবি বাধার অভ্যাস তার এতাবৎকাল নেই!
পারুল যখন তাড়ারে থাকে, কাজকর্ম করে, তখন কিছু আর সামনে থেকে খুন করে টেনে নেওয়া যায় না। আর পারুল যখন বাড়িছাড়া হয়ে কোথাও যায়, চাবিটা খুঁজে পাওয়া যায় না।
অবিশ্যি কোথায় আর যেত পারুল, হয়তো পাশের বাড়ির কনক মাসিমার কাছে। মফঃস্বলে যে রকম পাড়া-বেড়ানোর প্রথা, পারুল তেমন বেড়াতে পারতো না অমলের ভয়ে। নয়, নিজের বিতৃষ্ণায়? ওটা ওর নিজের রুচিতেই ছিল না।
সময়ের যত মূল্যবান আর কি আছে? সেই সময়টাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে মানুষ! বই খাতা কিছুও যদি না থাকে, নিজের মনটা নেই? তাকে নিয়েই কাটিয়ে দেওয়া যায় না বাড়তি পেয়ে যাওয়া সময়টুকু?
শুধু কনক মাসিমার সঙ্গে রুচির কিছু মিল ছিল বলেই মাঝে মাঝে যেত।
তবু ওরই ফাঁকে একদিন একটা পাতায় চোখ বুলিয়ে ফেলেছিলেন অমলবাবু, ছুতো করে ভাড়ার ঘরে ঢুকে তাকের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে, বৌয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে অন্যমনস্কের ভাবে খাতাটার পাতা উল্টে।
কিন্তু দেখে লাভ হয়নি কিছু, একখানা পৃষ্ঠার পুরো পাতাটার নীচে মাত্র একটি লাইন, মানুষ নামের জীবটা কী হাস্যকর! বিধাতার সৃষ্টির গলদ!
পরের পৃষ্ঠায় সেইভাবে লেখা, অথবা জাতটা নিজের যথার্থ পরিচয় ভুলে মেরে দিয়ে নিজেকে হাস্যকর করে বসে আছে। বিধাতার সৃষ্টিতে গলদ ছিল না।
আর একটা পৃষ্ঠায় লেখা, আজকের মধ্যরাত্রির আকাশটা কী অপূর্ব! চাঁদ না-থাকা আকাশ কী অসম্ভব সুন্দর।
এই জিনিস লিখে মানুষ সময় নষ্ট করে? আবার সেটা অন্যকে দেখানো চলে না? রাবিশ।
পারুল এখনো মাঝে মাঝে ডায়েরি লেখে।
এখনো তেমনি ছিরিছাদের অভাব। আর ভঙ্গীটাও তেমনিই।
যেন মুখোমুখি বসে কারো সঙ্গে কথা বলছে।
আজ লিখছিল, মনের মধ্যে বেশ একটু অহঙ্কার জন্মে গিয়েছিল, তোমাদের নীতিনিয়মের ওই সব বহুবিধ দায়ের বোঝা আমি আর বয়ে মরি না।..অহঙ্কার ছিল, হাল ছেড়ে আজ বসে আছি আমি ছুটিনে কাহারো পিছুতে মন নাহি মোর কিছুতেই, নাই কিছুতে। সে অহঙ্কারটা ভাঙতে বসেছে।…অহঙ্কার ছিল, যার বেড়ি তারে ভাঙা বেড়িগুলি ফিরায়ে বহুদিন পরে মাথা তুলে আজ উঠেছি।
কিন্তু এখন যেন টের পাচ্ছি সব বেড়ি ভাঙা সহজ নয়। সমাজের দায়, সংসারের দায়, চক্ষুলজ্জার দায়, মমতার দায়, সব কিছু ত্যাগ করলেও একটা দায় কিছুতেই ত্যাগ করা যায় না। সেটা হচ্ছে মানবিকতার দায়।…ওই যে ছেলেটা টেবিলে মাথা ঝুঁকিয়ে একমনে স্কুলের পড়া তৈরী করছে, ওর মনের মধ্যে কী ঝড় তুফান উঠছে তার চিন্তায় আমার মনে প্রবল তুফান উঠছে। স্থির থাকা দায় হচ্ছে।
আচ্ছা, এটা কি স্নেহের দায়?
ছেলেটার মায়ায় পড়ে গেছি বলেই?
পাগল। ওসবের ধার পারু বামনী ধারে না। আজ যদি ওর মা-বাপের শুভমতি হয়, কাল আর ভাবি না–আজকের দিনটা থাকুক আমার কাছে ছেলেটা।…যদিও আমার প্রতিবেশিনীরা এখন মহোৎসাহে বেড়াতে আসতে শুরু করেছেন, এবং এই কথাটি বলতে পেয়ে আনন্দের সাগরে ভাসছেন, এইবারে দিদি আমাদের জব্দ হয়েছেন। এখন রাজা ভরতের দশা হলো! হরিণছানাটির জন্যে সব দরকার হচ্ছে। সব আহরণ করতে হচ্ছে।
আবার আর এক দল হিতৈষীও যারা সখেদে বলেন, দেখছেন তো দিদি যুগের ধর্ম! মা বাপ ওই দামাল বয়েসের ছেলেকে বুড়ো ঠাকুমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্দি হয়ে বসে আছে! একটা ছেলের কী কম হ্যাঁপা? আহা, আবার ওঁর জন্যে মাছ-মাংসের পত্তন করতে হচ্ছে। তবে এও বলি দিদিজাপনার আবার বেশী মায়া! কেন, দুধ ঘি ছানা মাখনে কি পুষ্টি নেই? তাই আপনি ওই ক্ষুদে ছেলেটার জন্যে এতকাল পরে ওই সব ছুঁয়ে মরছেন! আর মাছটা যদিও বা করলেন, মাংস, ডিম, এততা কেন?…তাছাড়া যতই করে মরুন, শেষ অবধি কি ওই ছেলে আপন হবে? হবে না দিদি, এই আমি আপনাকে স্ট্যাম্পো কাগজে লিখে দিতে পারি, কার্যকালে ঠিকই আমে-দুধে মিশে যাবে, আঁটি আঁস্তাকুঁড়ে রবে! নিজেই মারবেন মায়ায়!
শুনে শুনে খুবই হাসি পায়, বুঝলে?
মায়া নামক বস্তুটার সংজ্ঞা কী তাই ভাবতে চেষ্টা করা। অভিধানে আছে বিভ্রান্তি,… অলীক, যেটা যা নয় তাই দেখা, দৃষ্টিভ্রম-আবার এও আছে-মমতা স্নেহ। কোনটা সঠিক মনে হয় তোমার?
কাকে যে সম্বোধন করে লিখছে কে জানে! লিখছিল, হঠাৎ নাতিটা পড়তে পড়তে উঠে এলো। বিনা ভূমিকায়, বলল, বাবাকে লিখে দাও আমায় বোর্ডিঙে ভর্তি করে দিতে।
পারুল প্রায় চমকে উঠল। তবু সামলে নিয়ে বললো, কেন হে মহারাজ, হঠাৎ এই আদেশ কেন?
এখানে আমার ভাল লাগছে না।
সে তো না লাগাই স্বাভাবিক। কিন্তু বোর্ডিঙে গেলেই ভাল লাগবে মনে হয়?
লাগাতে চেষ্টা করবো।
তা এখানেই সেই চেষ্টাটা করে দেখো না।
না।
উদ্ধত উত্তর দিল ছেলেটা।
তবে তো লিখতেই হয় বাবাকে। তা তুই নিজেই লেখ না।
রাজা, পারুল যাকে মহারাজ বলে, তেমনি উদ্ধতভাবে বলে, না, তুমি লিখে দাও।
বাঃ! তোর বাবা, তুই লিখবি না কেন?
বলছি তো, না!
ছেলেটার সুকুমার শিশুমুখে একটা অনমনীয় কাঠিন্য।
পারুলও একটু কাঠিন্য দেখায়।
বলে, কিন্তু আমি কেন লিখতে যাব, বল? তোর এখানে অসুবিধে হচ্ছে তুই সেটা জানাবি-
রাজা লাল-লাল মুখে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলে, আমি বলেছি এখানে অসুবিধে হচ্ছে?
ওমা, তা না হলে হঠাৎ বোর্ডিঙে ভর্তি করার কথা উঠবে কেন? আমি তো সাত দিন সাত রাত বসে ভাবলেও এটা মাথায় আনতে পারতাম না। আমি হঠাৎ এমন কথা লিখলে বাবা ভাববে আমিই তোকে ভাগাতে চেষ্টা করছি।
কক্ষনো ভাববেন না। বাবা তোমায় চেনেন না বুঝি?
চেনেন বুঝি! পারুল সকৌতুকে বলে, আমি তো জানতাম আমায় কেউ চেনে না।
রাজা ক্রুদ্ধ গলায় বলে, তোমার কথার মানে বোঝা যায় না।
পারুল এবার শান্ত গলায় বলে, আচ্ছা রাজা, তোকে যদি আমি বাবাকে লুকিয়ে তোর মার কাছে রেখে আসি?
রাজা হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে বলে, তোমরা সবাই মিলে আমায় এত জ্বালাতন করছো কেন? শুধু বোকার মত কথা!
না, কেঁদে ফেলে না, শুধু মুখটা আগুনের মত হয়ে ওঠে।
পারুল কি এই ছোট্ট ছেলেটাকে ভয় করবে?
হয়তো ভিতরে ভিতরে ভয়ই আসে পারুলের। তবু সাবধানে হালকা গলায় বলে, বুড়োদের দশাই ওই, বুঝলি? সবাইকে জ্বালাতন করে মারে, আর বোকার মত কথা বলে। তা যাকগে, সত্যিই বলছি শোন, আমি ঠিক করেছি তোর বাবাকে না বলে-টলে চুপিচুপি তোকে নিয়ে–
ব্যাপারটা যেন খুব কৌতুকের এইভাবে বলে পারুল, তোকে নিয়ে সোজা তোর মায়ের কাছে। ব্যাস, বাবা যখন এসে বলবে, কই মা, রাজা কই? আমি তখন বেশ বোকাটি সেজে বলব, কি জানি বাপু, সে যে সুটকেস-ফুটকেস নিয়ে কোথায় কেটে পড়লো একদিন।
রাজা এই ছেলে-ভুলনো কথায় দারুণ চটে যায়, অসহিষ্ণু গলায় বলে ওঠে, বেশ তোমায় লিখতে হবে না, আমিই বাবাকে লিখে দিচ্ছি, বোর্ডিঙে ভর্তি করে দিয়ে যেতে।
পারুল গম্ভীর হয়।
শান্ত গলায় বলে, দেখ রাজা, তোর বাবার খামখেয়ালীর জন্যে সবাই মিলে কষ্ট পাবি কেন? মার জন্যে তোর কত মন কেমন করছে–
কথার মাঝখানে রাজা বলে ওঠে, ছাই করছে!
করছে রে করছে। আচ্ছা বেশ, না হয় নয়, কিন্তু বোনটির? বোনটি তো তোকে দেখতে পেয়ে–
তোমরা আমায় একটু শান্তি দেবে? বলে ঘর ছেড়ে চলে যায় রাজা।
পারুল চুপ করে বসে থাকে সেই দিকে তাকিয়ে। আর ডাকাডাকি করে না ওকে। সাহস হয় না।
একটু পরে নিজেই ফিরে আসে ছেলেটা, একটুকরো কাগজে কলাইন লিখে পারুলের সামনে ফেলে দিয়ে বলে, এই নাও। তোমার চিঠির সঙ্গে পাঠিয়ে দিও।
পারুল অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সেই লাইন-দুটোর ওপর।
আমায় বোর্ডিঙে ভর্তি করে দেবে। তোমার যা খরচ হবে, আমি বড় হয়ে শোধ করে দেব।
সেই রাত্রে পারুল তার সেই ছিরিছাঁদহীন খাতাটায় লিখে রাখে, একটা খামখেয়ালী পুরুষ পরিণাম-চিন্তাহীন একটা খেয়ালের বশে একটা মেয়ের স্বামী সংসার সন্তান সব কেড়ে নিয়েছে, ভেবেছিলাম অন্ততঃ সন্তানটাকে ফেরত দেবে তাকে, দেখছি আর উপায় নেই। আর ফেরত দেওয়া যাবে না।
হ্যাঁ, পুরুষটাকেই দোষ দিলো পারুল, নিজের ছেলে হলেও। হয়তো পুরুষকেই বিচক্ষণ হতে হবে এই সহজাত ধারণায়।