অধ্যায় ৩০
ডক্টরের বাড়ি থেকে নিজের ঘরে ফিরে এসে দেখতে পায় তার রুমমেট বন্ধু। নেই। হয়তো জরুরি কোনো কাজে আটকে গেছে। মনে মনে খুশি হয়েছিলো সে। হাত-মুখ ধুয়ে জামা পাল্টে বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিশ্চিন্তে ভাবতে পারবে তদন্তটা কিভাবে এগিয়ে নেয়া যায়।
কিন্তু জামা-কাপড় ছেড়ে হাতমুখ ধুতে যাবার আগেই তার ফোনটা বেজে ওঠে। ডিসপ্লে দেখেই মেজাজ কিছুটা বদলে যায়। এই ফোনটা না ধরে পারতো না। আবার ফোনটা রিসিভ করতেও তার কেমন অস্বস্তি লাগে সব সময়।
পাঁচবার রিং হবার পর অবশেষে ফোনটা রিসিভ করে সে। অপর প্রান্ত থেকে তার মা বরাবরের মতোই অনুযোগের সুরে জানান, অনেকদিন হলো চারু দেখা করতে আসে না। ফোনও দেয় না।
মায়ের এমন অভিযোগ পুরোপুরিই সত্য, আর বেশ পুরনো গল্পও বলা চলে। বাবা মারা যাবার পর থেকেই মায়ের সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকে তার। এমন নয় যে, বাবার মৃত্যুর জন্য সে তার মাকে দায়ি করে। তবে বাবার মৃত্যুর পর বছর পার না হতেই তার মামারা একাট্টা হয়ে মায়ের বিয়ে দিয়ে দেয়। ছোট্ট চারু তখন সেটা মেনে নিতে পারেনি। তার মায়ের নতুন স্বামি মানুষ হিসেবে যে খারাপ ছিলো তা-ও নয়। তারপরও কেমন একটা অনুভূতি হতো তার। লোকটার কাছ থেকে সব সময় দূরে দূরে থাকতো। ক্লাস এইটে ওঠার পর তাকে যখন ঢাকার এক স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয় তখন হাফ ছেড়ে বেঁচেছিলো।
সেই থেকে চারুর একা একা পথ চলা। প্রথমে স্কুলের হোস্টেলে, কলেজের ছাত্রবাসে, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের হল হয়ে ওঠে তার বাড়ি। যতো বড় হতে থাকে ততোই দূরত্ব বাড়িয়ে তুলতে গুরু করে মায়ের সাথে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পর মায়ের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নেয়াও বন্ধ করে দেয়। কারণ, টাকাগুলো তার মায়ের স্বামি দেয়। বেশ কয়েকটা প্রাইভেট টিউশনি করে নিজেই নিজের খরচ মেটাতে শুরু করে।
যাই হোক, তার মা তাকে বলেছেন, ঢাকায় তার বড় মামার বাড়িতে এসেছেন কয়েক দিনের জন্য, চারু যেন তার সাথে দেখা করে যায়।
ঠিক আছে, এক সময় এসে দেখা করে যাবে-এমন আশ্বাস দিয়ে মায়ের সাথে ফোনালাপটি শেষ করে সে। তারপর দ্রুত হাত-মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। নিবিষ্টমনে ভাবতে শুরু করে মিসকাতের খুনের ঘটনাটা নিয়ে। সে জানে, সমস্যাটা খুবই কঠিন। মিসকাতের খুনের তদন্ত করার কোনো আইনগত বৈধতা তার বা ডক্টরের নেই। ফলে সিএনজি ড্রাইভার চাঁন মিয়ার ব্যাপারে কিছু করতে গেলে তাকে কঠিন বাধা পেরোতে হবে। সঙ্গে যতো পেশাদার সিকিউরিটিই থাকুক না কেন, লোকটাকে বাধ্য করতে পারবে না কোনোভাবেই। তার উপর অমন ক্ষ্যাপাটে একজনের সাথে দ্বিতীয়বার দেখা করতে যাওয়াটাই ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু তদন্তের স্বার্থে তাকে হয়তো একাধিকবার চাঁন মিয়ার সাথে কথা বলতে হবে। শুধু কথা বললেই হবে না, লোকটাকে বাধ্য করতে হবে প্রশ্নের জবাব দিতে।
এছাড়াও, আরো কিছু শক্ত প্রমাণ জোগাড় করতে হবে চাঁন মিয়ার বিরুদ্ধে। এজন্যে কোথায় যেতে হবে, কি করতে হবে তার সবকিছু আগে থেকে ঠিক করে নিতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে বুজরুকি আর ভণ্ডদের মুখোশ উন্মোচন করে আসছে। এ কাজে তার দক্ষতা গোয়েন্দাদের মতোই। নিজের উপর আস্থা আছে তার। আর সেটাকে অহংকারের তকমা লাগিয়ে হেয় করার কিছু নেই।
অনেকক্ষণ এক নাগারে ভেবে যাবার পর দুটো বিষয় তার মাথায় উদয় হলো। এ দুটো কাজই তাকে প্রথমে করতে হবে। সিদ্ধান্ত নিলো, গতকাল সকালেই বেরিয়ে পড়বে, আর চাইলেও সঙ্গে করে মায়াকে নিয়ে যাওয়া যাবে না এ কাজে।
.
চারু আহসান পরদিন সকালে নাস্তা করেই সোজা চলে গেলো ডিবি অফিসে। মুর্তজাকে তার অফিসেই পাওয়া গেলো। একটা ফাইল খুলে গভীর মনোযোগের সাথে কী যেন পড়ছে। চারুকে ঢুকতে দেখে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালো ভদ্রলোক।
“চা, না কফি?” চেয়ারে বসার পরই জিজ্ঞেস করলো ডিবি অফিসার।
“একটু আগেই খেয়ে এসেছি…তবে আপনার জন্যে নিতে পারেন।”
“আমিও একটু আগে খাইছি,” হাতের ফাইলটা ডেস্কের উপরে রেখে দিলো অফিসার।
“আচ্ছা, মিসকাতের মা…ঐ এমপি কি এখন আর প্রেসার দেন না আপনাদেরকে?”
বাঁকাহাসি হাসলো মুর্তজা। “তা তো দেয়ই। ফাপড়-টাপড় মারে, আমাগো যোগ্যতা নিয়া দুই-চাইরটা কথা শুনায়া দেয়।” একটু থেমে আবার বলল সে, “হোমমিনিস্টারের লগে ঐ মহিলার ভালো খাতির। মিনিস্টারও মাজেমইদ্যে ঠ্যালা মারে।”
“তাহলে তো আপনাদের জন্য এটা একটা গলার কাঁটা হয়ে গেছে।”
চারুর কথায় সায় দিলো ডিবি অফিসার। “হুম। কিন্তু কিছু করার নাই। আমরা তো চেষ্টা করতাছি, কোনো কূলকিনারা করবার পারতাছি না।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু।
“আপনেও তো এইটা নিয়া কাজ করতাছেন…কিছু বাইর-টাইর করতে পারলেন?” জানতে চাইলো মুর্তজা।
জাঁদরেল ডিবি অফিসাররা যেখানে সামান্যতম অগ্রগতিও অর্জন করতে পারেনি সেখানে চারু যে কিছু করতে পারবে না সেটা ধরেই নিয়েছে এই লোক।
“আমি তো আপনাদের মতো আইনের লোক না, অনেক লিমিটেশনের মধ্যে কাজ করতে হয় আমাকে। দরকারি অনেক কিছু চাইলেও করতেও পারি না সব সময়।”
ডিবি অফিসার দাঁত বের করে হাসলো। যেন নিজের ব্যর্থতার অজুহাত দাঁড় করাচ্ছে চারু।
“হুম। আমাগোও কিন্তু অনেক লিমিটশনের মইদ্যে কাজ করতে হয়।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো যুক্তিবাদি। “তারপরও, আপনারা যা করতে পারেন আমি সেটা পারি না।”
দাঁত বের করে হাসলো অফিসার। “আপনেও তাইলে জ্যামে আটকা পড়ছেন।”
মনে মনে হাসলো চারু। “হুম। তবে একজন সাসপেক্ট পেয়েছি। মনে হচ্ছে এই লোকটার ব্যাপারে একটু নজর দিলে ভালো কিছু বের হতে পারে।”
মুৰ্তৰ্জা নিজের চেয়ারে নড়েচড়ে বসলো, মুহূর্তে বদলে গেলো তার ভাবভঙ্গি। মুখ থেকে উধাও হয়ে গেলো হাসি। “সাসপেক্ট পাইছেন! কে?”
লোকটার বিস্মিত ভঙ্গি দেখে বেশ মজা পেলো চারু। উপযুক্ত একটা টোপ দিয়েছে। এই টোপ না গিলে উপায় নেই।
“যে সিএনজি ড্রাইভার বাইকার বাবুকে হাসপাতালে নিয়ে গেছিলো
ডিবি অফিসার অবিশ্বাসে বলে উঠলো, “সিএনজি ড্রাইভার? মোবাইল আর কাপড়চোপর নিয়া পালাইছিলো যে ব্যাটা?”
“হুম।”
“ও ক্যান খুন করবো এমপির ছেলেরে?”
“কেন খুন করবে সেটা আগে বলি,” একটু থেমে আবার বলল সে, “আজ থেকে দুই বছর আগে মিসকাত এক সিএনজি ড্রাইভারের ছেলেকে অ্যাকসিডেন্ট করেছিলো…ছেলেটা মামলা করেছিলো মিসকাতের বিরুদ্ধে কিন্তু সুবিধা করতে পারেনি। ঐ ঘটনায় ছেলেটা পঙ্গু হয়ে যায়। মিসকাতের মা টাকা সেধেছিলেন মামলা তুলে নেবার জন্য, কিন্তু ছেলেটা রাজি হয়নি। মামালায়ও সুবিধা করতে পারেনি।”
সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো মুতর্জা।
“ছেলেটী পঙ্গু হবার পর থেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলো। এক পর্যায়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করে।”
“বলেন কি?”
“কুড়িল বস্তিতে থাকতো ছেলেটা। বস্তির পাশ দিয়ে যে রেললাইন চলে গেছে সেখানেই ঘটে এই ঘটনা। আমার ধারণা, এরপরই ছেলেটার বাবা ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে মিসকাতের উপরে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ডিবি অফিসার। “আচ্ছা।”
“একমাত্র ছেলে, বউ নেই, আর কোন সন্তান নেই, বুঝতে পারছেন?”
কপালে ভাঁজ পড়লো মুর্তজার। “এই কারণে আপনে তারে সাসপেক্ট মনে করতাছেন?”
“না, একটু গুছিয়ে নিলো চারু আহসান। “দুটো কারণে আমি লোকটাকে সন্দেহের তালিকায় রাখছি।”
“কি রকম?” মুর্তজার আগ্রহ তুঙ্গে উঠে গেলো।
“প্রথমত, আমি জানতে পেরেছি হ্যালোউইন পার্টিতে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন একটা সিএনজিতে করেই গেছিলো। আর এ কথা তো জানেনই, বাইকার বাবুকে অ্যাকসিডেন্টের পর একটা সিএনজিই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।”
মুর্তজার কপালে ভাঁজ পড়লো। “খুনি সিএনজিতে কইরা গেছিলো, আপনে কেমনে জানলেন?”
চারু জানতো এ প্রশ্নটা করবেই ডিবি অফিসার। “গাজীপুরে গিয়ে এক টঙ দোকানির কাছ থেকে এটা জেনেছি। লোকটা বলেছে খুন হবার আগে একটা সিএনজিতে করে এক লোক এসেছিলো। এরপরই খুন হয় মিসকাত।”
মুর্তজা যেন অপমানিত বোধ করলো কথাটা শুনে। পেশাদার গোয়েন্দা হয়ে তারা এটা জানতে পারেনি, অথচ সাধারণ একজন মানুষ জেনে গেলো!
“সম্ভবত বাবু অ্যাকসিডেন্ট করার পর লোকটা সিএনজি নিয়ে ওখান দিয়ে যাবার সময় ঘটনাচক্রে সেটা দেখতে পায়। মানবিক কারণে ছেলেটাকে সিএনজিতে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যায় সে। হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর আবিষ্কার করে এই বাবু ছেলেটাই মিসকাতের বন্ধু। এটা জানার
পরই সে ফোন আর ব্যাগটা নিয়ে কেটে পড়ে।”
“এইটা কিভাবে সে জানবার পারবো?” মুতর্জতার চোখেমুখে সন্দেহ।
“কোনটার কথা বলছেন?”
“এই যে, বাবুর ফ্রেন্ড হয় মিসকাত।”
“ওহ,” বুঝতে পেরে বলল চারু। “পার্টিতে যেতে দেরি করছে বলে বাবুকে ফোন করেছিলো মিসকাত। সম্ভবত সেই ফোনকলটা রিসিভ করে সিএনজি ড্রাইভার।”
“কিন্তু কল দেইখা সিএনজি ড্রাইভার কেমনে বুঝলো এইটা মিসকাত? কলার আইডিতে নাম দেইখা?”
“আমার তা মনে হয় না। শুধু নাম দেখে চেনার কথা নয়।”
“তাইলে?”
“সেটা খতিয়ে দেখার জন্যই আমি মিসকাতের ফোনে আপনারা কি পেয়েছিলেন সেটা একটু দেখতে চাইছিলাম।”
“মিসকাতের ফোন?”
“জি। আপনারা কি সেই ফোনটার কললগ চেক করে দেখেছিলেন?”
“হ, দেখছি তো।”
“কি পেয়েছেন ওখানে, সেটা কি রেকর্ড করা আছে?”
“হুম, আছে। দাঁড়ান, চেয়ার ঘুরে পাশে রাখা ফাইল কেবিনেট থেকে একটা ম্যানিলা ফোল্ডার বের করে আনলো মুতর্জা। কিছু এ-ফোর সাইজের প্রিন্টেড কাগজ ঘেঁটে একটা কাগজে চোখ আটকে গেলো তার। “এই যে, দেখেন,” চারুর দিকে কাগজটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল ডিবি অফিসার।
কাগজের লেখাগুলোর দিকে মনোযোগ দিলো যুক্তিবাদি।
হ্যালোউইন পার্টির সময় মিসকাতের কললগের প্রায় সবটাই আছে প্রিন্টেড কপিতে। ৭:০৫, ৭:৩২, ৭:৫৫ তে মোট তিনবার বাবুর নাম্বারে কল করেছে সে। বাকি কলগুলো নিয়ে সে মাথা ঘামালো না।
“হাসপাতালের রিপোর্ট অনুযায়ি বাবুকে কখন ইমার্জেন্সিতে আনা হয়?”
চারুর প্রশ্নটা শুনে একটু ভেবে জবাব দিলো ডিবি অফিসার। “সাতটার পর পরই নিয়া আসছিলো…এগজ্যাক্ট টাইম মনে হয় সোয়া-সাতটা হইব।”
“তাহলে হাসপাতালে নিয়ে আসার পর বাবুকে দু-বার কল করেছিলো মিসকাত।”
“হুম। কিন্তু মিসকাতের কল কইলাম রিসিভ করে নাই,” জানালো মুতর্জা।
“হুম,” মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু “মিসকাতের ফোনের মেসেজ বক্সটা চেক করে দেখেছিলেন?”
“দেখছিলাম…ওইটাতে কিছু পাই নাই। খালি ফোন কোম্পানির হাবিজাবি অফারের মেসেজ দিয়া ভর্তি।”
“মিসকাত কি হোয়াটসআপ, মেসেঞ্জার, ভাইবার ব্যবহার করতো?”
চারুর এই প্রশ্ন শুনে কাচুমাচু খেলো ডিবি অফিসার। “এইটা তো চেক করি নাই।”
তদন্তকারি অফিসারের এমন গাফিলতির কারণে মনে মনে রেগে গেলেও মুখে কিছু বলল না। “আমার মনে হয় ফোনটা আবার চেক করে দেখলে ভালো হতো।”
মুতর্জার চোখেমুখে বিব্রত হবার ভঙ্গি। একে তো তদন্তকারি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে একটুও অগ্রগতি করতে পারেনি, তার উপরে চারুর মতো অপেশাদার লোক একজন সাসপেক্ট পর্যন্ত আবিষ্কার করে ফেলেছে, এখন আবার তার তদন্তের ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দিচ্ছে। ভেতরে ভেতরে একটু অসন্তুষ্ট হলেও মুখে সেটা প্রকাশ করলো না। হাজার হলেও শেষ পর্যন্ত তদন্তের ফলাফল তার ঘরেই যাবে।
“এটা কি করা যাবে?”
চারুর প্রশ্ন শুনে সম্বিত ফিরে তাকালো ডিবি অফিসার। “কুনটার কথা কইতাছেন?”
“মিসকাতের ফোনটা…ওটা কি আবার চেক করা যাবে? আপনি তো তদন্তকারি অফিসার, আপনি চাইলে সেটা করতেই পারেন।”
“হুমম…তা তো পারি।” এতদিন মিসকাতের মায়ের মুখোমুখি হতে চায়নি সে। ঐ এমপি এমনভাবে কথা বলে যেন, তারা সবাই ঘোড়ার ঘাস কাটে। বসে বসে জনগণের টাকার শ্রাদ্ধ করা ছাড়া আর কিছু করে না। মহিলা ভীষণ অসন্তুষ্ট তাদের উপরে। তবে এবার মনে হয় দেখা করলে এমপিসাহেবাকে সন্তুষ্ট করতে পারবে সে। চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো, “আপনে দুই-দিন পর আসেন, দেখি কি করা যায়।”
“থ্যাঙ্কস, ভাই।” একটু থেমে চারু আবার বলল, “আপনি তদন্ত কর্মকর্তা, আপনি খুব সহজেই সিএনজি ড্রাইভারের ব্যাপারে তদন্ত করতে পারেন। আমার মনে হয় ওই লোকটার দিকে মনোযোগ দিলেই এই কেসটার সমাধান করতে পারবেন।”
“হুম…ঠিক কইছেন। ব্যাপারটা আমি দেখমু।”
“তাছাড়া আপনাদের এক্সপার্টরা ভিক্টিমের ইনজুরি দেখে খুনি সম্পর্কে যে ধারণা করেছে তার সাথেও সিএনজি ড্রাইভারের মিল পাওয়া গেছে।”
কথাটা শুনে আৎকে উঠলো মুর্তজা। আরেকবার নড়েচড়ে বসলো সে। “কি রকম?”
“কুড়িল বস্তিতে গিয়ে আমি সিএনজি ড্রাইভারকে দেখেছি,” চারু বলল। তবে সবটা বলার কোনো ইচ্ছে তার নেই। “ঐ লোকটার উচ্চতা পাঁচফুট তিন-চার ইঞ্চিই হবে। আর সম্ভাব্য খুনির মতো সে-ও বাঁ-হাতি।”
“বলেন কি!” ডিবি অফিসার সত্যি সত্যি তাজ্জব বনে গেলো।
“আমি তো চাইলেও আপনাদের মতো করে তদন্ত করতে পারবো না। আপাতত এটুকুই বের করতে পেরেছি, বাকিটা আপনি করেন।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ডিবি অফিসার।
“আপনি ঐ সিএনজি ড্রাইভারকে অ্যারেস্ট করুন। ওকে ইন্টোরোগেট করতে পারলে মূল্যবান তথ্য পেয়ে যাবেন মনে হচ্ছে।”
মাথা নেড়ে আবারো সায় দিলো মুর্তজা। এ ব্যাপারে তার মনেও কোনো সন্দেহ নেই। লোকটাকে বাগে নিতে পারলে এমন প্যাদানি দেবে, বাপের নামও ভুলে যাবে। তোতাপাখির মতো পই পই করে সব বলে দিতে বাধ্য হবে তখন।
“আরো কিছু শক্ত প্রমাণ জোগাড় করতে পারলেই এই কেসের সুরাহা করা সম্ভব হবে।
“হুম। ব্যাপারটা আমি দেখতাছি,” বলল ডিবির তদন্তকারি কর্মকর্তা। “যা করার আগে সবই আমি করুম। চিন্তা কইরেন না।”
দারুণ স্বস্তি পেলো চারু আহসান। সে এটাই চেয়েছিলো।
.
অধ্যায় ৩১
রিডিংগ্রাসের উপর দিয়ে তাকালেন জহুরা সোবহান।
বিশাল ড্রইংরুমের একটা দেয়াল জুড়ে আছে বেশ কিছু সম্মাননা, সার্টিফিকেট আর ছবির ফ্রেম। ওগুলোর একটাতে নিবদ্ধ হলো তার চোখ।
তার ছেলে মিসকাত প্রিয় কুকুরটা জড়িয়ে ধরে হাসিমুখে চেয়ে আছে। ছবিটার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। আজ প্রায় বছরখানেক হলো ছেলেটা নেই। তার বুক খালি করে দিয়ে চলে গেছে সে।
আসলে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। আর সেটা করা হয়েছে। খুবই বিভৎসভাবে। এত বিত্ত-বৈভব আর প্রতিপত্তি থাকা সত্ত্বেও এমন জঘন্য কাজ কে করতে পারলো সেটাও জানতে পারেননি আজো। অপদার্থ পুলিশ আর ডিবির লোকজন সামান্য ইঙ্গিতও দিতে পারেনি এ ব্যাপারে। সম্ভাব্য খুনি কে হতে পারে সেটাও তারা আন্দাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতের পত্রিকাটার দিকে চোখ ফেরালেন। তাদের দলের ছাত্র সংগঠনের বিবদমান দুটো গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলি হয়েছে গতকাল রাতে, ঠিক মিসকাতের মতো দেখতে একটা ছেলে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। ঘটনার রিপোর্টিংয়ের পাশাপাশি ছেলেটার যন্ত্রণাকাতর মুখের একটি ছবিও দেয়া আছে পত্রিকায়।
“ম্যাডাম, আপনার সাথে একজন দেখা করতে আসছে।”
কাজের ছেলেটার কথায় পত্রিকা থেকে মুখ তুলে তাকালে তিনি। “কে?”
ছেলেটা সামনে এসে একটা কার্ড বাড়িয়ে দিলো তার দিকে।
কার্ডটা দেখলেন জহুরা সোবহান। খুব সম্ভবত এই অপদার্থটি সকালে তাকে ফোন করে পায়নি, তাই সরাসরি বাড়িতে চলে এসেছে।
আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলেন তিনি। পত্রিকা পড়তে আর ভালো লাগছে না। অপদার্থটা কী বলতে এসেছে সেটা জানা যাক। যদি বরাবরের মতো সান্ত্বনার বাণী আওড়াতে আসে তাহলে এই লোক ভুল করবে। অনেক শুনেছেন, আর না। লোকটাকে বান্দারবানের পাহাড়ে কিংবা খাগড়াছরিতে বদলি করানোর জন্য উঠেপড়ে লাগবেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রির সাথে তার যে রকম সুসম্পর্ক তাতে করে এ কাজটা করা খুব কঠিন কিছুও হবে না।
“স্লামালেকুম, ম্যাডাম,” সম্ভ্রমের সাথে সালাম দিয়ে ঘরে ঢুকলো ডিবির মুর্তজা।
“এত সকালে…ঘটনা কি?”
“আমি ফোন দিছিলাম…ফোন বন্ধ আছিলো,” বলল সে।
“ঐ ফোনটা এত সকালে অন করি না,” জবাব দিলেন এমপি। তার তিনটা ফোনের একটা এত সকালে খোলা রাখেন না। আর এই ফোনটার নাম্বারই সবার কাছে দেন। “বসুন,” অফিসারকে বললেন তিনি।
ড্রইংরুমের একটা সোফায় বসে পড়লো মুর্তজা। “আপনি কি মিসকাতের কেসটার ব্যাপারে এসেছেন?”
“জি, ম্যাডাম।”
ভুরু কুচকে তাকালেন মিসকাতের মা। “এক চুলও তোতা এগোতে পারেননি, বার বার আমার কাছে এসে কী লাভ? সান্তনা দিতে এসেছেন?”
“জি, না। কী যে বলেন…” কাচুমাচু খেয়ে বলল তদন্তকারি কর্মকর্তা। এই কেসটা হাতে পাবার পর থেকে বেশ কয়েকবার এরকম কথা শুনেছে এমপির কাছ থেকে।
“যখনই জানতে চাই, বলেন তদন্ত করছেন। খুব জলদিই নাকি রেজাল্ট পাওয়া যাবে। এই ভাঙা রেকর্ড আর কতো বাজাবেন?”
“এইবার মনে হয় আপনারে সুখবর দিতে পারবো।”
স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন মিসকাতের মা। “তাই নাকি!”
“জি।”
“তদন্তে কি গুরুত্বপূর্ণ কিছু পেয়েছেন?”
বিগলিত হাসি দিলো মুর্তজা। “সেইরকমই মনে হইতাছে।”
“কি পেয়েছেন, বলুন?” বোঝাই যাচ্ছে সময় নষ্ট করার মতো মেজাজে নেই তিনি। “একটু পর আমাকে বেরোতে হবে। আপনাকে খুব বেশি সময় দিতে পারবো না।”
“অনেকদিন ধইরা তদন্ত করার পর একজন সাসপেক্ট পাইছি, ম্যাডাম,” মুর্তজা বলল।
মিসকাতের মা সোজা হয়ে বসলেন। মনে হলো চমকে গেছেন। “কী!” চোখ থেকে রিডিং গ্লাসটা খুলে ফেললেন তিনি। “সাসপেক্ট পেয়েছেন? কে সে?!”
মুর্তজা জানতো কথাটা শোনার পর এমপি এমন প্রতিক্রিয়া দেখাবেন। “না, মানে…এখনও পুরাপুরি শিওর না। তয় কিছু জিনিস আবার চেক কইরা দেখতে চাইতাছি। সেইজন্যই মিসকাতের ফোনটা একটু দরকার। ওইটা দেখতে হইবো আবার।”
“আরে, সাসপেক্ট কে, সেটা বলেন আগে!” অধৈর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন এমপি। “কোন্ হারামজাদা এ কাজ করেছে? মিসকাতের কোন্ বন্ধু?”
“বন্ধুদের কেউ না, ম্যাডাম। সাসপেক্ট একজন সিএনজি ড্রাইভার।”
“কি!” জহুরা সোবহান আৎকে উঠলেন কথাটা শুনে। “সিএনজি ড্রাইভার?!”
“জি, ম্যাডাম।”
“আপনি আমার সাথে ফাজলামি করছেন?” রেগেমেগে বললেন মিসকাতের মা। “একজন সিএনজি ড্রাইভার কেন আমার ছেলেকে…” কথাটা শেষ করার আগেই নিজে থেকেই থেমে গেলেন তিনি। “কে? আপনি কার কথা বলছেন?”
“ম্যাডাম, এই সিএনজি ড্রাইভারের ছেলে মিসকাতের বিরুদ্ধে মামলা করছিলো কয়েক বছর আগে।”
মিসকাতের মা বিস্ফারিত দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকলেন। তথ্যটা যেন তাকে বজ্রাহত করেছে।
“অ্যাকসিডেন্টের মামলা…” মুর্তজা বলল। “কুড়িল বস্তিতে হইছিলো অ্যাকসিডেন্টটা।”
“এ খবর আপনি জানলেন কিভাবে?” সন্দেহের সুরে জানতে চাইলেন এমপি।
“ইয়ে মানে,” মুর্তজা একটু ভেবে নিলো। “কেসটা তদন্ত করবার গিয়া জানবার পারছি।”
একটু উদাস হয়ে গেলেন মিসকাতের মা। “কিন্তু এর সাথে মিসকাতের খুনের কি সম্পর্ক? ওই কেসটা তো ওরা হেরে গেছে…কবেই সব চুকেবুকে গেছে।”
“আসলে ম্যাডাম, আপনে হয়তো জানেন না, মামলায় হারনের পর ঐ পোলাটা সুসাইড করছে।”
কপালে ভাঁজ পড়লো এমপির। তবে খুব বেশি অবাক হলেন না। “তাই নাকি?”
“জি, ম্যাডাম।”
“এ কারণে আপনি ধরে নিলেন মিসকাতকে ওই সিএনজি ড্রাইভার খুন করতে পারে?”।
“না, ম্যাডাম। আরো ব্যাপার আছে।”
“কি ব্যাপার? আমাকে সব খুলে বলুন।”
একটু ঢোক গিলে নিলো ডিবি অফিসার। চারু আহসানের কৃতিত্বটা পুরোপুরি নিজের করে নিয়ে বলতে শুরু করলো সে, “আমরা জানবার পারছি, বাবু অ্যাকসিডেন্ট করবার পর এক সিএনজিওয়ালাই তারে হাসপাতালে নিয়া গেছিলো, ঐ সিএনজিওয়ালাই বাবুর ব্যাগ আর মোবাইল নিয়া ফুটছিলো। ব্যাগে যে কস্টিউম আর মুখোশ ছিলো ওইটা পইরা খুনি একটা সিএনজি নিয়া গেছিলো গাজীপুরে।” এক নাগাড়ে বলে একটু ঢোক গিলে নিলো সে। এমপির দিকে তাকালো। পাথরের মতো স্থির হয়ে আছেন তিনি। “আমাগো ফরেনসিক এক্সপার্টরা এর আগেই আন্দাজ করছিলো খুনির হাইট পাঁচফুট তিন-চাইর হইবো…আর সে বাউয়া…মানে বামহাতি। সিএনজি ড্রাইভারের হাইটও সেইম, ম্যাডাম। ঐ লোকও বামহাতি। মিসকাতরে ওই-ই খুন করছে। আমি শিওর।”
মিসকাতের মা আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলেন। ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে আছেন তিনি। অন্য এক চিন্তায় ডুবে গেছেন যেন।
“কিন্তু ওই লোক কিভাবে জানতে পারলো ওরা ওইদিন গাজীপুরে পার্টি করছিলো?” অবশেষে মোক্ষম প্রশ্নটাই করলেন জহুরা সোবহান।
“আমার মনে হয় মিসকাত ঐদিন বাবুরে ফোন দিছিলো…মেসেজও দিবার পারে।”
“দিতেই পারে, তাতে কি?”
“সেইখান থেইকাই লোকটা জানবার পারছে গাজীপুরে একটা পার্টি হইতাছে।”
“বুঝলাম না, একটা ফোনকল থেকে কিভাবে….” মিসকাতের মা থেমে গেলেন, কথাটা আর শেষ করলেন না।
“আজকাইলকার ফোন, ম্যাডাম…কলার আইডির সাথে ছবিও ওঠে। ডিসপ্লেতে।”
জহুরা সোবহান যেন জবাবটা পেয়ে গেলেন। আনমনেই মাথা নেড়ে সায় দিলেন তিনি। “হুম…বুঝেছি।”
“এরজন্যই ফোনটা আবার দেখবার চাইতাছি কনফার্ম হওনের লাইগা।”
একটু ভেবে মিসকাতের মা উঠে দাঁড়ালেন। “আপনি একটু বসুন…আমি আসছি।”
ডিবি অফিসারকে একা রেখে তিনি চলে গেলেন পাশের ঘরে।
কয়েক মিনিট পর চা আর বিস্কিট নিয়ে ঘরে ঢুকলো এক কাজের মেয়ে। মুর্তজা কেবল সময় কাটানোর জন্য চায়ের কাপটা তুলে নিলো। সে জানে, রাজনীতিবিদদের বাড়ির চা কেমন হয়। কাঙ্গালিভোজের খাবার, যাকাতের কাপড় আর রাজনীতিবিদদের বাড়ির চা-এর অবস্থা একই রকম হয়ে থাকে। চাকরিজীবনে অনেক রাজনীতিকের বাড়িতে গেছে, খুব কমই ভালোমানের দুধ চা খেয়েছে সে।
কিন্তু যেমনটা ভেবেছিলো তেমন না। তাকে দুধ চা দেয়া হয়েছে। আস্তে করে সেই চায়ে চুমুক দিলো ডিবি অফিসার। চা-টা বেশ ভালো।
কয়েক মুহূর্ত পর চা যখন মাঝপথে তখনই ঘরে ঢুকলেন এমপি। চায়ের কাপ রেখে উঠে দাঁড়ালো মর্তুজা। এমপি তাকে বসার জন্য ইশারা করলেন। মিসকাতের মায়ের হাতে ছোট্ট একটা শপিংব্যাগ। সেটা বাড়িয়ে দিলেন অফিসারের দিকে।
“এটার মধ্যে মিসকাতের ফোন আর চার্জারটা আছে।”
মুর্তজা কোনো কথা না বলে ব্যাগটা হাতে নিয়ে নিলো।
“ভেতরে একটা এনভেলপও আছে…ওটা আপনার বখশিস।”
একটু লজ্জিত হবার ভান করলো অফিসার।
“আপনারা এখন ওর ব্যাপারে কি করবেন?”
“ওরে অ্যারেস্ট করুম, ম্যাডাম। এমন প্যাদানি দিমু, সব কইয়া দিবো।”
ভুরু কুচকে তাকালেন এমপি। “লোকটাকে পাবেন কোথায়?”
“এহনও কুড়িল বস্তিতেই থাকে।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আমাকে আপগ্রেড জানাবেন।”
নিঃশেব্দ সালাম ঠুকলো মুর্তজা। “আমি তাইলে, আসি, ম্যাডাম।”
ব্যাগটা নিয়ে চুপচাপ ঘর থেকে বের হয়ে গেলো ডিবি অফিসার। বাইরে এসে সবার আগে এনভেলপটা খুলে দেখলো। সবগুলোই একহাজার টাকার নতুন চকচকে নোট।
সব মিলিয়ে পঞ্চাশটা।
.
অধ্যায় ৩২
“কথা কস্ না ক্যান?”
চাঁন মিয়া অন্ধকার ঝুপড়ি ঘরে খাটের উপরে বসে আছে। এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার সামনে বসে থাকা ছেলের দিকে। মাথা নিচু করে বোবা হয়ে আছে তার আদরের ধন সুরুজ। ছেলেটা অনেকদিন থেকেই এমন আচরণ করছে, অথচ আগে এই ছেলের মুখে কথা ফুটতো। তার কথার জ্বালায় অতীষ্ঠ হয়ে চাঁন মিয়া অনেক সময় বলে উঠতো, “বাজান রে, আমারে একটু রেস্ট নিবার দে…গাড়ি চালায়া আইছি…মাথা ধরছে খুব।”
মাথা ব্যথার কথাটা আমলে না নিয়ে তার ছেলে নানান কথা বলতো বাপকে। দেশ-বিদেশের সব খবর তার মাথায়। এই বস্তির একমাত্র পত্রিকা পড়ুয়া ছেলে ছিলো তার সুরুজ। এখানকার অনেকের ঘরেই সস্তা চায়নিজ টিভি রয়েছে, কিন্তু কেউ কখনও ভুলেও বিবিসি আর সিএনএন দেখতে না–তার সুরুজ বাদে।
ছোটবেলা থেকেই তার ছেলেটা পড়াশোনায় ভালো। কোনো মাস্টার রাখতে হয়নি। কোনোদিন কোচিংও করেনি। নিজে নিজে পড়াশোনা করেছে। কলেজে ওঠার আগেই টিউশনি করে পড়াশোনার খরচ মেটাতে, বাপের বোঝা কমানোর চেষ্টা করতো। বাপকে সে বলতো, বিরাট বড় অফিসার হবে। তাদের বাপ-ব্যাটার কোনো দুঃখ থাকবে না। সে হেসে বলতো, নিজের কথা কখনও ভাবে না, তার সুরুজ বড় মানুষ হলেই নিশ্চিন্তে মরতে পারবে।
ছেলেটাকে নিয়ে যে বিশাল স্বপ্ন দেখেছিলো সেটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। সেই ছেলে এখন বলতে গেলে বোবা।
একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে চাঁন মিয়া বলল, “বাজান, আঙ্গোর পিছন ফেউ লাগছে।”
ছেলেটা মাথা তুলে তাকালেও কিছু বলল না। ছেলেটা পুরোপুরি পাল্টে গেছে। এখন দশটা কথার জবাবেও একটা কথা বলে না।
“তয় চিন্তার কিছু নাই। তুই কইলাম এট্টুও ডরাইস না।”
সুরুজ আবারো মাথা তুলে বাপকে দেখে মাথা নামিয়ে ফেলল।
“আমাগো ধরন এত সোজা না,” কথাটা বলেই চাঁন মিয়া নিঃশব্দ হাসতে লাগলো। তার ছেলে অবশ্য মুখ তুলে দেখলো না বাপের সেই হাসি।
“এরপর যদি আবার আহে…এক্কেরে কোপ দিয়া দিমু দুইটার ঘাড়ে!”
এ কথার পরও ছেলে নির্বিকার রইলো।
চাঁন মিয়া কিছু বলতে যাবে তার আগেই ঝুপড়ি ঘরের কাঠের দরজায় টোকা পড়লো বেশ জোরে জোরে। সতর্ক হয়ে উঠলো সুরুজের বাপ। ভয়ার্ত চোখে তাকালো দরজার দিকে। যে বা যারা দরজার ওপাশে আছে তাদের ধৈর্য কম।
“তুই চুপ কইরা বয়া থাক…আমি আইতাছি। যাইস না কইলাম।”
সুরুজ কিছু বলল না। যথারীতি চুপচাপ। দুনিয়ার কোনো কিছুতে সে আর উদ্বিগ্ন বোধ করে না।
চাঁন মিয়া খাটের নিচ থেকে একটা দা তুলে নিলো হাতে। এই দা-টা দিয়েই কয়েকদিন আগে সন্দেহজনক দু-জন মানুষ এসেছিলো তার কাছে। ঐ দু-জনই বোধহয় আবার এসেছে।
দা-টা বামহাতে শক্ত করে ধরে পেছনে আড়াল করে রাখলো, ডানহাত দিয়ে দরজা খুলে দিতেই দেখতে পেলো তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তিন যুবক। এদের কাউকে সে জীবনেও দেখেনি।
“কারে চাই?”
“তুই-ই চাঁন মিয়া?” সবার সামনে যে যুবক দাঁড়িয়ে আছে সে জিজ্ঞেস করলো।
“হ। কি চাই?” খনখন করে উঠলো তার কণ্ঠ।
“গলা নামায়া কথা ক…” পেছনে থাকা আরেক যুবক রেগেমেগে বলে উঠলো। “ঘর থিকা বাইর হ…তর লগে কথা আছে।”
চাঁন মিয়া বুঝতে না পেরে ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো যুবকদের দিকে। “কি কথা? কি চাস আমার কাছে? তরা কারা?” প্রায় চিৎকার করে বলল সে।
“শূয়ারেরবাচ্চা!” সামনের যুবকটি ডানহাত দিয়ে খপ করে চাঁন মিয়ার গলা টিপে ধরলো। লাথি মেরে ভিজিয়ে রাখা কপাটটা খুলে হ্যাঁচকা টানে দরজার বাইরে নিয়ে এলো চাঁনমিয়াকে। “এত কথা কস্ ক্যান! গলা নামায়া কথা ক!…এমপির পোলারে” কথাটা শেষ করতে পারলো না। তার বদলে বুকফাঁটা আর্তনাদ করে উঠলো : “আ-আ-আ!”
চিৎকারটা ছড়িয়ে পড়লো চারপাশে।
চাঁন মিয়া বিদ্যুৎগতিতে ডানহাত দিয়ে তার গলা চেপে ধরা হাতটার কব্জি ধরেই পেছনে লুকিয়ে রাখা দা-টা দিয়ে এক কোপ বসিয়ে দিয়েছে সেই যুবকের উদ্যত বাহুর উপরে। মুহূর্তে হাতটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে খণ্ডিত হাতটা ছুঁড়ে মারলো বাকি দুই যুবকের দিকে। তারা ভড়কে গেলেও একটু সরে গিয়ে উড়ে আসা কর্তিত হাত থেকে নিজেদেরকে বাঁচাতে পারলো।
এই সুযোগে চাঁন মিয়া চট করে ঢুকে পড়লো ঘরের ভেতরে। দ্রুত বন্ধ করে দিলো ঘরের দরজা।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হলেও খুব দ্রুত কোমর থেকে পিস্তল বের করে ফেলল দুই যুবক।
কর্তিত হাতের যুবক মাটিতে বসে পড়ে চিৎকার করছে। বিশ্বাসই করতে পারছে না তার সাথে কী হয়ে গেছে একটু আগে। অবিশ্বাসে চেয়ে আছে কাটা হাতটার দিকে। গল গল করে রক্ত পড়ছে সেখান থেকে।
তাকে পাশ কাটিয়ে তার সঙ্গি দু-জন দৌড়ে এসে চাঁন মিয়ার বন্ধ দরজায় লাথি মারলো সজোরে। খ্যাচ করে দরজাটা আর্তনাদ করে উঠলো। উদভ্রান্তের মতো আরো কয়েকটা লাথি মারতেই দরজাটা খুলে গেলো।
অন্ধকার ঘরে হুরমুর করে ঢুকে পড়লো না তারা, সতর্কতার সাথে পিস্তল উঁচিয়ে ভালো করে ঘরের ভেতরটা দেখে নিলো একবার।
কেউ নেই!
তারা যখন বুঝতে পারলো তখন একটু দেরি হয়ে গেছে। চাঁন মিয়ার ঝুপড়ি ঘরের পেছন দিককার টিনের দেয়াল একটু ফাঁক হয়ে আছে।
যুবক দু-জন রেগেমেগে ঘরের পেছন দিকে ছুটে গেলো পিস্তল উঁচিয়ে। দৌড়াতে দৌড়াতে খিস্তি ছোটাতে লাগলো তারা।
ঘরের পেছন দিকে যখন চলে এলো দেখতে পেলো দা হাতে চাঁন মিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে যাচ্ছে রেললাইনের দিকে।
পেছন থেকে গুলি করবে কি করবে না, এই দ্বন্দ্বে ভুগলো দু-জন। শেষ পর্যন্ত তারা গুলি না করে দৌড়াতে লাগলো চাঁন মিয়ার পেছন পেছন।
রেললাইনের কাছে আসতেই দেখতে পেলো হুইসেল বাজিয়ে ছুটে আসছে একটা ট্রেন।
চাঁন মিয়ার সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। নিজের জীবনের পরোয়া না করে ধাবমান ট্রেনের সামনে দিয়েই রেললাইনটা এক দৌড়ে পার হয়ে গেলো। আরেকটু হলেই ট্রেনের নিচে কাটা পড়তে সে।
দুই যুবকের পক্ষে অবশ্য রেললাইন পার হওয়া সম্ভব হলো না। অতিক্রম করতে থাকা ট্রেনের সামনে থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হলো তারা। দম ফুরিয়ে হাফাতে লাগলো। অপেক্ষা করতে লাগলো ট্রেনটা চলে যাওয়ার, কিন্তু ভালো করেই জানে, নিষ্ফল এই অপেক্ষা।
ট্রেন চলে যাবার পর রেললাইনের ওপারে চাঁন মিয়ার টিকিটাও দেখতে পেলো না।
দুই যুবক পেছনে ফিরে তাকালো এবার।
তাদের সঙ্গি মাটিতে পড়ে থাকা কর্তিত হাতটার পাশে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর চিৎকার করে যাচ্ছে বুকের সমস্ত বাতাস বের করে।
.
অধ্যায় ৩৩
দু-দিন পর র্যাশনালিস্ট সোসাইটি থেকে কাজ সেরে লাঞ্চ টাইমের আগেই ডিবি অফিসে চলে গেলো চারু। যাবার আগে অবশ্য ফোন করে জেনে নিয়েছে সে এখন অফিসেই আছে।
মুর্তজাকে দেখে মনে হলো মনমরা। সম্ভবত মিসকাতের ফোন থেকে তেমন কিছু পায়নি।
চারুর সাথে সামান্য কুশল বিনিময় করার পরই অফিসার একটা কাগজ বাড়িয়ে দিলো, তাতে মিসকাতের ফোনের সমস্ত বিবরণ টাইপ করা আছে।
“আপনে তো বাইরের লোক,..ওর ফোনটা আপনেরে দেওয়া যাইবো না,” বলল মুর্তজা। “তয় সমস্যার কিছু নাই। এই কাগজে কললিস্টের সবকিছু টাইপ করা আছে।”
“থ্যাঙ্কস,” বলেই কাগজটা হাতে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়ে গেলো চারু আহসান।
যেনটা ধারণা করেছিলো, বেশিরভাগ স্মার্টফোন ব্যবহারকারিদের মতোই মিসকাতও হোয়াটসআপ, ভাইবার, মেসেঞ্জার ব্যবহার করতো। সবগুলো ঘেঁটে দেখা গেছে বাবুকে হ্যালোউইন পার্টির দিন হোয়াটসআপ থেকেও দু-বার ফোন করেছিলো মিসকাত। মেসেঞ্জারে মেসেজও দিয়েছে। একটা। সেই মেসেজে মিসকাত তার বন্ধুকে তাড়া দিয়েছে গাজীপুরে চলে আসার জন্য :
সে কেন ফোন ধরছে না? তার কি কোনো সমস্যা হয়েছে? সে যেন তাড়াতাড়ি কলব্যাক করে। তার জন্য পার্টি দেরি করে শুরু করতে হচ্ছে। আর বেশি দেরি হলে তারা শুরু করে দেবে।
এ থেকে খুব সহজেই সিএনজি ড্রাইভার জেনে নিতে পেরেছে আজ গাজীপুরে একটা পার্টি হচ্ছে।
কিন্তু গাজীপুরের বাড়ির ঠিকানা চাঁন মিয়া কিভাবে জানতে পারলো সেই প্রশ্নের জবাব এখনও অজানাই রয়ে গেছে। কারণ মিসকাতের মেসেজের কোথাও ঠিকানা দেয়া নেই। তার কোনো দরকারও ছিলো না। কারণ জায়গাটা যে বাইকার বাবু আগে থেকেই চিনতো সেটা স্বীকারও করেছে চারুর কাছে। সম্ভবত হ্যালোউইন পার্টির আগেও গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ওখানে গিয়েছিলো। ওরকম নির্জন আর নিরাপদ একটি বাড়ি অল্পবয়সি ছেলেছোকরাদের জন্য রীতিমতো স্বর্গতুল্য ডেটিংস্পট।
যাই হোক, আপাতত গাজীপুরের বাড়ির ঠিকানা জানার বিষয়টা অমীমাংসিত থাকলেও চারু খুব আশাবাদি, অচিরেই এ প্রশ্নের জবাব সে দিতে পারবে।
“ফোন ঘাঁইটা পুরা শিওর আমি, ঐ ব্যাটাই কামটা করছে,” বলল অফিসার।
“তাহলে এখনই চাঁন মিয়াকে অ্যারেস্ট করে ইন্টেরোগেট করুন। আমার ধারনা গুরুত্বপূর্ণ কিছু পেয়ে যাবেন। দেরি করা ঠিক হবে না।”
চারুর কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ডিবি অফিসার। “অলরেডি দেরি হইয়া গেছে।”
চমকে উঠলো চারু। “দেরি হয়ে গেছে মানে?”
আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মুর্তজা। “আমি ফোর্স নিয়া কুড়িল বস্তিতে গেছিলাম কাইল রাইতে। চাঁন মিয়ারে পাই নাই। সে ফুটছে।”
“বলেন কি!” বিস্মিত হলো চারু। “ক-দিন আগেই আমি ওকে ওখানে পেয়েছি…কী এমন ঘটলো যে, বস্তি থেকে হাওয়া হয়ে গেলো লোকটা?”
একটু চুপ করে থেকে বলল মুর্তজা, “আমি যাওনের আগেই চাঁন মিয়া এক গুণ্ডার হাত কাইটা পলাইছে!”
“কি?!” অবাক হলো যুক্তিবাদি।
“কাইল রাইতে তিন গুন্ডা আইছিলো চাঁন মিয়ারে ধরবার লাইগা, চাঁন মিয়া তখন দা দিয়া ওগোর একজনের হাত কাইটা পলাইছে।”
“বলেন কি! কারা এসেছিলো? কেন এসেছিলো? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“ডিটেইল কইতে পারুম না। বস্তির লোকজন কইলো, চাঁন মিয়ার কাছে তিন-চারটা গুণ্ডাটাইপের লোক আসছিলো নাকি। তখনই লোকটা একজনূরে কোপ মাইরা পলাইছে। মনে হয় না আর বস্তিতে ফিরা আসবো।”
“শিট!” চারুর মুখ দিয়ে বের হয়ে গেলো কথাটা। কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো অফিসারের দিকে। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেলো প্রথম সাক্ষাতে এই অফিসার কি বলেছিলো তাকে মিসকাতের মা তার ছেলের হত্যাকারির বিচারের অপেক্ষায় বসে থাকবে না!
“সত্যি করে বলুন তো, আপনি কি মিসকাতের মাকে চাঁন মিয়ার কথাটা বলছিলেন?”
চারুর প্রশ্নে বিব্রত হবার ভঙ্গি করলো মুর্তজা। “হুম…কইছিলাম তো।”
“ওহ্,” বুঝতে পারলো সে। “তাহলে ঐ এমপিই গুণ্ডাগুলোকে পাঠিয়েছে।”
“এমপি পাঠাইছে!” প্রশ্ন করলো না, অনেকটা আপন মনে বলে উঠলো অফিসার। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো সে। সম্ভবত তার মনেও এই প্রশ্নটা উঁকিঝুঁকি মারছিলো।
“আমার আগেই এটা মনে রাখা দরকার ছিলো। আপনিই বলেছিলেন, মিসকাতের মা তার ছেলের হত্যাকারি সম্পর্কে জানতে পারলে বিচারের জন্য বসে থাকবেন না।”
একটু কাচুমাচু খেলো মুর্তজা।
শিট! তিক্ততায় ভরে উঠলো চারুর মন। বুঝতে পারছে, এই রহস্যের সমাধান করাটা তার জন্য আরো কঠিন হয়ে গেলো এখন।
.
অধ্যায় ৩৪
চাঁন মিয়ার ঝুপড়ি ঘরের সামনে এসে চারপাশে একটু তাকিয়ে দেখলো ট্যাপা।
ফেন্সিডিলের বোতলটা লুঙ্গির গিটে আটকে রেখেছে, সেটা আস্তে করে বের করে ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। দরজায় তালা মারা। আর এটা চাঁন মিয়া মারেনি। এক গুণ্ডার হাত কেটে ফেলার পর সেই যে পালিয়েছে আর ফিরে আসেনি লোকটা। সহসা ফিরে আসার সম্ভাবনাও নেই। ট্যাপা জানে, তালাটা মেরেছে মর্জিনার মা। চাঁন মিয়ার অনুপস্থিতিতে তার ঘরটা নিরাপদ রাখার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে এই বুড়ি। শুধু তা-ই না, শকুনের মতো পাহারা দিচ্ছে নিজের ঘরের সামনে বসে। এ কারণে সে একটু বেশি সতর্ক।
চাঁন মিয়া একজনের হাত কেটে পালিয়ে যাবার পর এখানে ডিবির লোকজন এসেছিলো কিন্তু স্থানিয় থানা এ ব্যাপারে কিছুই জানতো না। ওসিসাবকে সে নিজে জানালেও কথাটা খুব একটা আমলে নেয়া হয়নি।
ফেন্সিডিলের বোতলটা নিয়ে ট্যাপা চলে গেলো চাঁন মিয়ার ঘরের পেছন দিকে। ওখানে একটা নাম না-জানা গাছের চারপাশে ঝোঁপঝাঁড়ের মতো কিছু আছে। বস্তির অনেকে পেশাব করার কাজে হরদম ব্যবহার করে। চাঁন মিয়া ঘরে থাকলে ভুলেও এ কাজ করে না।
ট্যাপা অবশ্য পেশাব করার জন্য ওখানে গেলো না, কিংবা হাতে যে বোতলটা আছে সেটা খাওয়াও তার উদ্দেশ্য নয়। সে আসলে অন্য একটা কাজ করতে এসেছে। আজ রাত ন-টার পর দু-বার ঢুঁ মেরে গেছে এখানে, কিন্তু সুবিধা করতে পারেনি। চাঁন মিয়ার ঘরের উল্টো দিকে থাকে থাকে মর্জিনার মা। বুড়ির চোখ দূরবীনের মতো। যতোক্ষণ জেগে থাকে ঘরের বাইরে বসে বিড়ি ফোঁকে। তার কারণে ট্যাপা সুবিধা করতে পারেনি।
ভুলটা অবশ্য তারই। তালা খোলার জন্স পায়তারা করেছিলো সে। মর্জিনার মা না থাকলে খুব সহজেই রিক্সার স্পোকের ছোট্ট একটি অংশ দিয়ে চায়নিজ তালাটা খুলে ফেলতে পারতো কিন্তু এ কাজ মর্জিনার মায়ের সামনে ভুলেও করা যাবে না। বাজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠবে বুড়ি। এমনিতেই ট্যাপার ব্যাপারে তার ধারণা ভালো নয়। পাঁচ-ছয় বছর আগে ট্যাপা যখন ছিঁচকে চোর ছিলো তখন বুড়ির ঘরে চুরি করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছিলো। সেই থেকে বুড়ি তাকে দেখলেই ভুরু কুচকে চেয়ে থাকে। যেন দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা চুরি করার ধান্দায় ঘুর ঘুর করে সে।
বুড়ির বোঝা উচিত, সে এখন লোকাল থানার ইনফর্মার। চুরিচামারির মতো কাজ করে না।
নিজের কথায় নিজেই হেসে ফেলল ট্যাপা। অভ্যাস এমন জিনিস সহজে ছাড়া যায় না। চাঁন মিয়া তার ঘর ফেলে পালাবে আর ট্যাপার মতো পুরনো চোর হাত গুটিয়ে বসে থাকবে তা কি হয়?
যাই হোক, দুই ঘন্টা পর তার বুদ্ধি খোলে। খামোখাই তালা খোলার ধান্দা করেছে। চাঁন মিয়ার ঘরে ঢোকার সহজ রাস্তাটার কথা ভুলেই গিয়েছিলো। অবশেষে তার মনে পড়ে। কেউ একজন দেখেছে, চাঁন মিয়া গুণ্ডাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য নাকি তার ঘরের পেছন দিক দিয়ে বের হয়ে দৌড়ে পালিয়েছে। সম্ভবত ঝোঁপের পাশে একটা টিন সামান্য আলগা আছে।
কোনো কারণ ছাড়া সেই ঝোঁপের ভেতরে ঢুকলেও মর্জিনার মায়ের শ্যেনদৃষ্টিতে পড়তে হবে, তাই সঙ্গে ক র ফেন্সিডিলের বোতলটা নিয়ে এসেছে। এর ভেতরে আসলে পানি ছাড়া কিছু নেই। ট্যাপা এসব কাশির সিরাপ খেয়ে নেশা করে না, তার লাগে গাঁজা। দিনে দশ-বারোটা হলেই চলে যায়।
তো ফেন্সিডিলের বোতলটা মর্জিনার মাকে ঠিকই বিভ্রান্ত করতে পারলো। বুড়ি যখন দেখলো ট্যাপা বোতল নিয়ে চোরের মতো চাঁন মিয়ার। ঘরের পেছন দিকে ঝোঁপের আড়ালে যাচ্ছে তখন মুক বাঁকিয়ে বিড়ি ফুঁকতে লাগলো। তার ভাব এমনই, খা হারামজাদা! এইসব খায়া মর।
ঝোঁপের আড়ালে গিয়ে বোতলটা ফেলে দিলো ট্যাপা। দুটো টিনের সংযোগ খুঁজে পেতে কোনো সমস্যাই হলো না। জয়েন্ট ছুটে গেছে বলে টিনদুটো আলগা হয়ে আছে।
তাহলে এটাই চাঁন মিয়ার গোপন দরজা!
দু-হাতে ধরে জোরে টান দিতেই ফাঁক হয়ে গেলো। সেই ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়লো চাঁন মিয়ার অন্ধকার ঘরে। কোমর থেকে সস্তা মোবাইলফোনটা বের করে আলো জ্বালালো ট্যাপা।
ঘরের সবকিছু এলোমেলো অবস্থায় আছে। বোটকা গন্ধ নাকে এলো। কতোদিন ধরে এ ঘর পরিস্কার করা হয় না কে জানে।
ঘরের প্রতিটি কোণ খুঁজে দেখলো সে। মানুষজন কোথায় মূল্যবান জিনিসপত্র, টাকা-পয়সা লুকিয়ে রাখে সে ব্যাপারে তার ভালো ধারণা আছে।
দশ-পনেরো মিনিট খোঁজাখুঁজি করার পরও যখন কিছু পেলো না তখন একটু হতাশই হলো। চাঁন মিয়া কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়াই ঘর ফেলে পালিয়েছে, সুতরাং তার যা কিছু আছে সব জায়গামতোই থাকার কথা।
অনেকক্ষণ পর কিছু না পেয়ে ব্যর্থ ট্যাপা বুঝতে পারলো খাটের নিচটা দেখা হয়নি। উপুড় হয়ে খাটের নিচে মোবাইলফোনের আলো ফেলল। হাবিজাবি জিনিসে ভর্তি। সিএনজির কিছু অকেজো আর পুরনো যন্ত্রাংশও আছে। দুটো বাতিল টায়ারও দেখতে পেলো। তার ধারণা এইসব হাবিজাবি জিনিসের মধ্যেই চাঁন মিয়া তার সম্পদ লুকিয়ে রেখেছে। লোকটা খুবই চালাক। বুদ্ধিসুদ্ধি ভালো। সে নিশ্চয় গোপন জায়গায় মূল্যবান জিনিসপত্র লুকিয়ে রাখবে না। এমন মামুলি জায়গায় রাখবে, কারোর মনেই হবে না এখানে মূল্যবান কিছু থাকতে পারে-তাকে চুরিচামারিতে হাতেখড়ি দিয়েছিলো যে মজনু ওস্তাদ এটা তার কথা।
খাটের নিচ থেকে একে একে জিনিসগুলো সরিয়ে দেখতে চাইলো ট্যাপা। একটা টায়ার বের করে আনলো। আরেকটা টেনে বের করতে যাবে অমনি খুট করে একটা শব্দ কানে গেলো তার। বরফের মতো জমে গেলো সে। দরজার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো আওয়াজটা ওখানু থেকেই আসছে। সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলফোনটার আলো নিভিয়ে দিলো। Ow
বাইরে থেকে দরজার তালা খুলছে কেউ!
চাঁন মিয়া?
অসম্ভব!
মর্জিনার মা?
ট্যাপার বুক ধরফর করে উঠলো। কী করবে সেটা ভাবতে বেশি সময় নিলো না। সোজা খাটের নিচে ঢুকে পড়লো। যে টায়ারটা বাইরে বের করে রেখেছিলো সেটা আবারো খাটের নিচে টেনে রাখলো সে।
দরজাটা খুলে গেলো আস্তে করে। বাইরে থেকে স্বল্প আলো এসে ঢুকলো ঘরে। খাটের নিচ থেকে ট্যাপা দেখতে পেলো একজন মানুষের পা দেখা যাচ্ছে। পা-টা মর্জিনার মায়ের নয়। কোনো পুরুষ মানুষের।
পা টেনে টেনে লোকটা খাটের কাছে চলে এলো। দোয়া-কালাম পড়তে শুরু করে দিলো ট্যাপা। এই জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো চুরি করতে গিয়ে বোধহয় ধরা খাবে আজ।
ঘরটা আলোকিত হয়ে উঠলো। সম্ভবত লোকটা তার মোবাইলফোনের টর্চ জ্বালিয়েছে। ট্যাপার বুক কেঁপে উঠলো। ঘরে যে-ই ঢুকে থাকুক সে চাঁন মিয়া নয়।
চোরের উপরে বাটপারি? তার মতোই কেউ এসেছে তাহলে?
দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করলো সে। তারপর তাকে পুরোপুরি ভড়কে দিয়ে আলোটা খাটের নিচে ফেলা হলো। একদম তার মুখ বরাবর।
ট্যাপা যদি চাঁন মিয়ার মুখটা দেখতে পেতো তাহলে এতোটা ভড়কে যেত না।
হায় আল্লাহ!
প্রচণ্ড ভয়ে হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেলো তার। বোবায় ধরার মতো অবস্থা হলো। হাত-পা অসাড় হয়ে গেলো মুহূর্তে। কিন্তু বহুদিনের পোড়খাওয়া লোক সে। অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে বড় হয়েছে। শরীরের সমস্ত শক্তি আর সাহস জড়ো করে গগনবিদারি চিৎকার দিতে দিতে খাটের অন্যপাশ দিয়ে দ্রুত হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়ে এলো।
দরজাটা খোলাই আছে, কোনো কিছু না ভেবে সেই দরজার দিকে ছুটে গেলো, পেছনে ফিরেও তাকালো না।
ঘর থেকে পড়িমরি করে বের হতেই পড়ে গেলো মর্জিনার মায়ের সামনে। অবশিষ্ট কিছু পচা দাঁত বের করে উন্মাদগ্রস্তের মতো হাসছে বুড়িটা!
প্রাণপণে দৌড়াতে দৌড়াতে ট্যাপার শুধু একটা কথাই মনে হলো, এ জীবনে এতটা ভয় কখনও পায়নি।
.
অধ্যায় ৩৪
ডক্টর আজফার হুসেন গম্ভির মুখে বসে আছেন। আজ সকালেই তিনি সিলেট থেকে ফিরে এসেছেন, তাকে একটুও ক্লান্ত দেখাচ্ছে না। ভ্রমণের কোনো ছাপ নেই তার চোখেমুখে। সংক্ষিপ্ত প্লেন জার্নির কারণেই এমনটা হয়েছে।
ডক্টরের সামনে বসে আছে চারু আহসান আর মায়া।
“এটা নিশ্চিত, ঐ এমপি…মিসকাতের মা-ই গুণ্ডাগুলোকে পাঠিয়েছে, আস্তে করে বলল চারু। একটু আগে গুণ্ডাদের একজনের হাত কেটে চাঁন মিয়ার পালানো থেকে শুরু করে মিসকাতের ফোনে যে-সব প্রমাণ পেয়েছে সবটাই খুলে বলেছে মায়া আর ডক্টরকে।
মাথা নেড়ে সায় দিলেন ডক্টর। “ইট ডাজ মেক সেন্স।”
“আপনি আমি…আমরা চাঁন মিয়াকে সাসপেক্ট মনে করলে কি হবে,” বাঁকাহাসি হেসে বলল চারু আহসান, “মিসকাতের মা কিন্তু একদম নিশ্চিত হয়ে গেছে কাজটা ঐ লোকই করেছে।”
“হুম…তা না হলে তো গুণ্ডা পাঠতো না।”
“কিন্তু চাঁন মিয়া এখন কোথায় গেছে সেটা কেউ জানে না।”
“মনে হয় না খুব সহজে বস্তিতে ফিরে আসবে লোকটা,” অনেকক্ষণ পর মুখ খুললো মায়া।
“কে জানে, আর ফিরে আসবে কিনা,” দীর্ঘশ্বাসের সাথে বলে উঠলো চারু।
“গুণ্ডাগুলো লোকটার নাগাল পেলে বাঁচিয়ে রাখবে না ওকে,” যোগ করলেন আজফার হুসেন। তাদের একজনের হাত কেটে ফেলেছে। সাংঘাতিক ব্যাপার।”
চারুও জানে কথাটা সত্যি। ওরকম ভয়ঙ্কর মানুষজন হন্যে হয়ে খুঁজছে চাঁন মিয়াকে। একে তো এমপির দেয়া অ্যাসাইনমেন্টে ব্যর্থ হয়েছে, তার উপরে নিজেদের এক সঙ্গির হাত কাটা গেছে এই ঘটনায়, লোকগুলো এখন দিনরাত একটা কাজই করে যাচ্ছে-চাঁন মিয়ার হদিস বের করা। কে জানে, এরইমধ্যে তাকে বাগে পেয়ে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়েছে কিনা।
চারু অবশ্য ইনফর্মার ট্যাপাকে পাঁচশ টাকা দিয়ে বলে দিয়েছে, চাঁন মিয়া বস্তিতে ফিলে এলেই যেন তাকে জানায় সে। ট্যাপার ধারণা, চাঁন মিয়া আর ঢাকায় নেই। তবে কোথায় যেতে পারে সেটাও সে জানে না। দেশের বাড়িতে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে, তবে ট্যাপা যতোটুকু জানে, নদীভাঙনের শিকার হয়ে বহু আগেই চাঁন মিয়াদের গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে। দেশের বাড়ি বলতে কিছু নেই।
আত্মীয়স্বজন?
না। দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে চাঁন মিয়া কুড়িল বস্তিতে থাকলে কখনও কোনো আত্মীয়স্বজনের দেখা পায়নি তারা। এমন কারোর কথাও শোনেনি।
“চাঁন মিয়াকে যদি এমপির লোকজন মেরে গুম করে ফেলে তাহলে তো এই কেসের কোনো সুরাহা করা যাবে না।”
চারুর দিকে তাকিয়ে রইলেন ডক্টর। “যাদের কেস তারাই যদি এভাবে সুরাহা করে ফেলে তাহলে আমাদের কী করার আছে! আমরা তো এই কেসের কোনো পক্ষ নই।”
চারু আহসান বুঝতে পারলো ডক্টরের কথাটার মমার্থ। এই কেসের সত্যিকারের পক্ষ আসলে তিনটি-মিসকাতের মা, চাঁন মিয়া আর তদন্তকারি অফিসার। মিসকাতের মা যদি চাঁন মিয়াকে তার লোকজন দিয়ে খুন করে ফেলে তাহলে এই কেসের তদন্তকারি কর্মকর্তা হিসেবে মুর্তজার কিছুই করার থাকবে না।”
মনে মনে চারু একটা জিনিসই চাইলো, চাঁন মিয়া যেন বেঁচে থাকে। পরক্ষণেই তার মনে হলো সে ভীষণ স্বার্থপর। আসলে চাঁন মিয়ার জীবন নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয়, সে চিন্তিত তার অ্যাসাইনমেন্টটা নিয়ে। হ্যালোউইন নাইটের খুনের রহস্য সমাধান করার জন্যই সে চাইছে চাঁন মিয়া নামের এক গরীব-দুঃখি মানুষটা যেন বেঁচে থাকে, যাতে করে সে প্রমাণ করতে পারে মিসকাতের খুনটা সে-ই করেছে।
নিজেকে খুব ছোট মনে হলো চারু আহসানের। ধিক্কার দিলো মনে মনে।
এই চাঁন মিয়া যদি এমপির গুণ্ডাদের হাতে মারা গিয়ে থাকে তাহলে তার দায় কিছুটা চারুর উপরেও বর্তায়।”অথচ এ নিয়ে তার মধ্যে অপরাধবোধ যতোটা না হচ্ছে তার চেয়ে বেশি চিন্তিত সে চাঁন মিয়া যেন বেঁচে থাকে তার উদ্দেশ্য পূরণের জন্য।
চারু বুঝতে পারলো, সে-ও ক্যারিয়ারিস্ট হয়ে গেছে। তার যুক্তিবাদি সমিতির কর্মকাণ্ডটাই তার ক্যারিয়ার। আর সে ঠিক কপোরেট এক্সিকিউটিভ আর সরকারি আমলাদের মতোই ক্যারিয়ার নিয়ে মদমত্ত এখন। কোনোকিছুই তার কাছে মুখ্য নয়-শুধু নিজের কাজ আর লক্ষ্য ছাড়া।
“কি ভাবছো?”
সম্বিত ফিরে পেয়ে চারু দেখতে পেলো ডক্টর তার দিকে ভুরু কুচকে চেয়ে আছেন। “না। কিছু না।”
“যাই হোক, ইউ ডিড অ্যা গুড জব।”
এ কথায় চারু মোটেও সন্তষ্ট হতে পারলো না। কোনো অ্যাসাইনমেন্টের সমাধান না-হওয়া পর্যন্ত নিজেকে সফল ভাবার লোক সে নয়।
“মিসকাতের ফোন থেকে যেটা তুমি বের করেছে তাতে করে বোঝাই যাচ্ছে, বাবুকে যখন সে কল করেছিলো তখন ফোনটা ছিলো চাঁন মিয়ার কাছে। সেই থেকে লোকটা বুঝে যায় মিসকাত হচ্ছে বাবুর বন্ধু।” একটু থেমে আবার বললেন ডক্টর, “ডিসপ্লে-তে মিসকাতের ছবি ভেসে উঠেছিলো। বুঝতে কোনো অসুবিধা হবার কথা নয়।”
“হুম, তা ঠিক,” মায়া বলল, “কিন্তু চাঁন মিয়া গাজীপুরের বাড়ির ঠিকানাটা জানলে কি করে?”
ডক্টর আজফারও সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন চারুর দিকে।
কাঁধ তুলল যুক্তিবাদি। “মিসকাতের ফোন ঘেঁটে এমন কিছু পাইনি যা থেকে বুঝতে পারবো চাঁন মিয়া গাজীপুরের ঠিকানা জেনে নিতে পারে। তবে…” একটু থামলো চারু। “বাবুর ফোনে এরকম কিছু ছিলো না সেটা কিন্তু আমরা নিশ্চিত হতে পারবো না। ওর ফোনটা সিএনজি ড্রাইভারের কাছেই ছিলো, ওটা আর রিকভারি করা যায়নি। সম্ভবত খুন করার পর ফোনটা ফেলে দেয়া হয়েছে।”
“বাবু কিছু বলতে পারেনি?”
মায়ার প্রশ্নে মাথা নেড়ে জবাব দিলো চারু আহসান। ও বলেছে, ওর ফোনে গাজীপুরের ঠিকানা সেভ করা ছিলো না, জায়গাটা সে চেনে। এর আগেও গেছিলো সেখানে।”
“ও,” ছোট্ট করে বলল মায়া।
“এ ব্যাপারে তোমার হাইপোথিসিস কি? জানতে চাইলেন ডক্টর।
কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো চারু। তদন্তের কাজে সবচাইতে সৃজনশীল অংশ হলো হাইপোথিসিসগুলো। বাকিটা ক্ষুরধার যুক্তি আর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ। র্যাশনালিস্ট সোসাইটির অনেকের মতো চারু নিজেও জানে যুক্তি আর হাইপোথিসিস হলো তার সবচাইতে শক্তিশালি দিক। তবে পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তীক্ষ্ণ কিনা সে-ব্যাপারে অতোটা নিশ্চিত নয়। এ মুহূর্তে কিছু একটা তার মাথায় উঁকি দিচ্ছে কিন্তু সেটা কি বুঝতে পারছে না।
অবশেষে একটা কথা মনে পড়ে গেলো তার। গাজীপুরে মিসকাতের দাদার বাড়ির বাইরে টঙ দোকানি তাকে বলেছিলো ওই বাড়িতে কখনও সিএনজি আসতে দেখেনি সে। মিসকাত খুন হবার আগে কেয়ারটেকার শামসু মিয়া জরুরি কাজে ঢাকায় গেলে একটা সিএনজিতে করে ফিরে এসেছিলো।
“উমম…চাঁন মিয়া সিএনজি চালায়…হতে পারে কাকতালিয়ভাবে সে মিসকাতদের গাজীপুরের বাড়িতে কোনো প্যাসেঞ্জার নামাতে গিয়েছিলো ঘটনার আগে?” নতুন একটা হাইপোথিসিস উপস্থাপন করলো।
ডক্টরের ভুরু কপালে উঠে গেলেও পুরোপুরি নির্বিকার রইলো মায়া।
“অনেক সম্ভাবনা থাকতে পারে…আমি শুধু একটা উদাহরণ দিলাম। বলছি না, এটাই হয়েছে।”
“হুম,” বললেন ডক্টর। “একটু কাকতালিয় শোনালেও খারাপ বলোনি। এমনটা তো হতেই পারে।”
“কিন্তু এখন এসব যাচাই বাছাই করা যাবে না।”
চারুর দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন আজফার হুসেন।
“চাঁন মিয়াকে পাওয়া না গেলে এই তদন্ত এখানেই শেষ।”
মুচকি হাসলেন ডক্টর। “সেটা পুলিশের জন্য…আমাদের জন্য নয়।”
মায়া কিছু বুঝতে না পেরে চেয়ে রইলো। চারুও যে বুঝতে পেরেছে তা নয়।
“পুলিশকে সাক্ষি-প্রমাণ জোগাড় করতে হয় আদালতে প্রমাণ করার জন্য। কিন্তু আমি তোমাদেরকে যে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছি তাতে কেবল এটা প্রমাণ করতে পারলেই হবে, কাজটা কে করেছে…কিভাবে করেছে।”
“তার মানে দুর্বল প্রমাণ হলেও চলবে?” চারু অবাক হয়ে জানতে চাইলো।
“দুর্বল বলবো না,” সহাস্যে বললেন ডক্টর আজফার, “আমি বলবো গ্রহণযোগ্য প্রমাণ। আর সেটা আমাদের নিজেদের কাছে গ্রহণযোগ্য হলেই হবে।” ডক্টর এবার গভীর করে নিঃশাস নিলেন। “মাইডিয়ার চারু…তুমি হয়তো ভুলে গেছো এই অ্যাসাইনমেন্টটা আমি তোমাদেরকে দিয়েছি। এটা আমাদের তিনজনের ব্যাপার। আমরা তো আদালত নই, বিচারকও নই। কেবলই কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ।
“তাহলে আপনাদের কাণ্ডজ্ঞান কি বলছে? আমি এ পর্যন্ত যা করেছি তাতে করে কি মনে হচ্ছে আপনাদের?”
ডক্টর আজফার ইঙ্গিতপূর্ণভাবে মায়ার দিকে তাকালেন, যেন এই প্রশ্নের জবাবটা তারই আগে দেয়া উচিত।
মায়া একটু ভেবে বলল, “কাণ্ডজ্ঞান বলছে, কাজটা চাঁন মিয়াই করেছে।”
“আর যুক্তিবুদ্ধির বাইরে কি বলছে?” বাঁকাভাবে জিজ্ঞেস করলো চারু।
মায়া স্থিরচোখে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। “কিন্তু আমার অনুভূতি বলছে, চাঁন মিয়া একা এ কাজ করেনি।”
ভুরু কুচকে গেলো চারু আহসানের। “ওর সাথে আরেকজন আছে…” আস্তে করে বলল মায়া।
“হুম…চাঁন মিয়ার সাথে অবশ্যই একজন আছে সহযোগি আছে। গাজীপুরে হ্যালোউইন পার্টিতে যে গেছিলো সে যদি চাঁন মিয়া হয়ে থাকে তাহলে তার সিএনজিতে আরেকজন ছিলো…ড্রাইভার হিসেবে।”
মায়া কিছু বলতে যাবে অমনি চারুর মোবাইলফোনটা বেজে উঠলো। কলার আইডি দেখে অবাক হলো সে।
ট্যাপা!
সঙ্গে সঙ্গে কলটা রিসিভ করলো সে। তার ধারনা চাঁন মিয়ার হদিস জানা গেছে। “হ্যা…বলো, কি খবর?”
“ছার! চাঁন মিয়ার পোলা সুরুজ বাঁইচ্যা আছে। আমি নিজের চক্ষে দেখছি!”
“কি” চারু অবিশ্বাসে বলে উঠলো।
.
অধ্যায় ৩৫
সুরুজ বেঁচে আছে!
ট্যাপার সাথে দীর্ঘ ফোনালাপের পর যা জানতে পেরেছে সেটা ডক্টর আর মায়াকে জানিয়েছে চারু। তার মাথায় শুধু এ প্রশ্নটাই ঘুরপাক খাচ্ছে।
“ঐ ইনফর্মারের কথা কতোটা বিশ্বাসযোগ্য?” ডক্টর আজফার হুসেন অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর জানতে চাইলেন।
কাঁধ তুলল চারু। “তা জানি না। তবে আমি ভাবছি অন্য কথা।”
“কি?”
“সুরুজের মৃত্যুর ব্যাপারে এখনও ধোঁয়াশা রয়ে গেছে কিন্তু। সুরুজের বেঁচে থাকার সম্ভাবনাটা একদম উড়িয়ে দেয়া যায় না।”
ভুরু কপালে তুললেন ডক্টর। “কি রকম?”
“যে লাশটা কবর দেয়া হয়েছে তার মাথা ছিলো না। বস্তির মতো জায়গায় বাবা যখন দাবি করবে এ লাশ তার ছেলের তখন কে যাবে এটা নিয়ে সন্দেহ করতে?”
“হুম, গম্ভির হয়ে বললেন আজফার হুসেন। “তুমি বলতে চাইছে আইডেন্টিফিকেশন ছাড়াই সবাই ধরে নিয়েছে লাশটা ঐ সিএনজি ড্রাইভারের ছেলের?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু। মায়ার দিকে চকিতে তাকালো। মেয়েটা উদাস হয়ে চেয়ে আছে বড় জানালাটার দিকে।
“সুতরাং ইনফর্মার লোকটার কথা একেবারে উড়িয়ে দেয়া ঠিক হবে। হয় সে সত্যি সত্যি সুরুজকে দেখেছে নয়তো দৃষ্টি বিভ্রমের শিকার হয়েছে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলেন ডক্টর। “তুমি তো এটা নিয়ে বেশ ভালোমতোই ইনকোয়্যারি করেছিলে…যা জানতে গেরেছিলে তাতে করে মোটামুটি নিশ্চিত ছিলে সুরুজ মারা গেছে।” এ।
“নিশ্চিত বলা যাবে না,” দ্বিমত পোষণ করলো চারু। “এখনও কিছু ফাঁক রয়ে গেছে। বাপ-ছেলে যদি প্ল্যান করে কাজটা করে থাকে তাহলে কারোর পক্ষে বোঝা সম্ভব না ট্রেনে কাটা পড়া লাশটা সুরুজের ছিলো না।”
ডক্টরের কপালে ভাঁজ পড়লো।
“সুরুজের কঙ্কালটা যদি পেতাম তাহলে নিশ্চিত হওয়া যেত। সেটা কিন্তু পাইনি।”
কয়েক মুহূর্ত গম্ভির হয়ে বসে রইলেন ডক্টর। তারপর তাকালেন মায়ার দিকে। “একটু আগে তুমি বললে সিএনজি ড্রাইভারের সাথে সব সময় আরেকজন থাকে…এটা কেন তোমার মনে হচ্ছে?”
হাফ ছাড়লো চারু। প্রশ্নটা আসলে তারই করার কথা ছিলো কিন্তু মায়াকে এ কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিলো না।
গভীর করে দম নিয়ে বলল সাবেক রেডিও-জকি, “চাঁন মিয়াকে যখন প্রথম দেখেছি তখনই এটা আমার মনে হয়েছিলো। নিছক একটা অনুভূতি…ব্যাখ্যা করতে পারবো না আমি।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডক্টর। তার বেলায়ও মায়া এ কথা বলেছিলো। চারুর দিকে তাকালেন তিনি। নির্বিকার থাকার চেষ্টা করলেও তার ঠোঁটে প্রচ্ছন্ন বাঁকাহাসি লেগে আছে।
মায়া আর কিছু বলল না। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে আছে সে। এখনও চেয়ে আছে জানালা দিয়ে বাইরে। দৃষ্টিতে তার শূণ্যতা।
মায়া কি সুরুজমিয়ার ছেলেকে ইঙ্গিত করছে? যদি সেটাই করে থাকে তাহলে তার ব্যাখ্যা আর যাই হোক অশরীরি কিছু হবে না।
ভুত-প্রেতের অনুষ্ঠান করতো মেয়েটা। আত্মা-প্রেতাত্মায় বিশ্বাস করে সে। তার পক্ষে এ কথা বলা সাজে। কিন্তু চারু হচ্ছে বিজ্ঞানমনস্ক একজন মানুষ। তার পক্ষে এভাবে প্রমাণ ছাড়া কথা বলা সম্ভব নয়।
যুক্তিবাদির দিকে তাকালেন ডক্টর। “তুমি কিন্তু বলেছিলে, ঐ সিএনজি ড্রাইভারকে নাকি তার ছেলের সাথে কথা বলতে শুনেছিলে। বস্তির অনেকেই জানে লোকটা তার মৃত ছেলের সঙ্গে কথা বলে। এখন আবার ইনফর্মার বলছে সে চোখে দেখেছে সুরুজকে। এটা তো খুবই রহস্যজনক ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে।”
মাথা দোলাল চারু। “শুনুন, চাঁন মিয়ার এখন যে মানসিক অবস্থা সেটার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে,” চারুর যুক্তিবাদি সত্তা স্বরূপে আবির্ভূত হয়ে বলতে শুরু করলো। “তার ক্ষ্যাপাটে আচরণের কারণ লোকটা ছেলের আত্মহত্যার পর থেকে মানসিকভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছিলো যে, কী বলবো…কিছুটা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।”
ডক্টর মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললেন, “সেটাই স্বাভাবিক।”
“নিজের ছেলের মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি সে। এরফলে তার মস্তিষ্ক। ছেলের কল্পিত অস্তিত্ব তৈরি করে নিয়েছে। সে মনে করে তার ছেলে জীবিত আছে। তার সাথে কথা বলে। হয়তো চোখের সামনে দেখেও।”
“হুম,” গম্ভির হয়ে বললেন ডক্টর। “এরকম ঘটনার নজির কিন্তু আছে।”
আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু।
“কিন্তু এসব আচরণকে এখনও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত কিছু বলে মনে করা হয় না।”
ডক্টরের কথায় সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো যুক্তিবাদি।
“এটাকে তারা প্যারা-নরমাল বলে অভিহিত করে থাকে।”
“প্যারানরমাল মানে কিন্তু অলৌকিক ব্যাপার-স্যাপার না,” তর্কের সুরে বলল চারু।
“কিন্তু এটাকে তুমি বিজ্ঞানও বলতে পারো না,” হেসে বললেন ডক্টর। যেন বন্ধুসুলভ তর্ক করতে চাচ্ছেন তিনি।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে চারু বলল, “হুম। সেটা আপনি বলতে পারেন। তবে আপনাকে মাথায় রাখতে হবে, প্যারা-নরমাল তাকেই বলে যেটার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সম্ভবত আছে…এক সময় হয়তো দেয়া যাবে। অনেক প্যারা-নরমাল অ্যাক্টিভিটির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কিন্তু পরবর্তিকালে দেয়া হয়েছে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলেন ডক্টর আজফার। “আই কুডেন্ট মোর অ্যাগ্রি উইদ ইউ।”
বিজয়ির হাসি ফুটে উঠলো চারুর ঠোঁটে।
“চাঁন মিয়ার মস্তিষ্ক বিকৃত হতে পারে,” বললেন ডক্টর, “চারু যেমনটা বলল, লোকটা হয়তো এক ধরণের ডিশনের মধ্যে আছে..তার ছেলে মারা যায়নি, এখনও বেঁচে আছে। সেই ছেলের সাথে সে কথা বলে। ছেলের কাল্পনিক অস্তিত্বটাকে চোখেও দেখে, কিন্তু…” একটু থেমে চারু আর মায়ার দিকে তাকালেন। দু-জনের অভিব্যক্তি দু-রকম। একজন সন্দেহের দৃষ্টিতে চেয়ে আছে, অন্যজন উদাস। “চাঁন মিয়ার সাথে যে আরেকজন সহযোগি আছে সেটা তো চাঁন মিয়ার নিজের সৃষ্টি করা কল্পিত কিছু নয়। বাস্তব কোনো চরিত্র। কারণ অন্যেরা এটা দেখেছে। সবাই কি ডিশনের স্বীকার? কিংবা তাদের মস্তিষ্ক এটা দেখিয়েছে?”
“এ প্রশ্নের জবাব পেতে হলে আপনাকে আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে, ডক্টর,” বলল যুক্তিবাদি। “তবে একটা কথা মনে রাখবেন, এখানে অশরীরি কিছু নেই। যা আছে তা হলো প্রতিশোধ আর হত্যাষড়যন্ত্র। এরজন্যে কিছু কৌশল অবলম্বন করেছে খুনি।”
মাথা নেড়ে সায় দিলেন আজফার হুসেন। “যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে একটা প্রশ্ন এসে যায়।”
চারু স্থিরচোখে চেয়ে রইলো ডক্টর হুসেনের দিকে।
“মিসকাতের খুন হবার বহু আগে থেকেই চাঁন মিয়া কিছু একটা করার পরিকল্পনা করছিলো?”
চারু আর মায়া কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো ডক্টরের দিকে।
“কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, সেই পরিকল্পনাটা কি ছিলো?” আজফার হুসেন বেশ নাটকিয় ভঙ্গিতে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন।
চারুর কপালে ভাঁজ পড়লো। “কি ছিলো মানে? মিসকাতকে খুন করা!”
“মিসকাতের মাকে নয় কেন?” ভুরু কপালে তুলে তাদের দুজনের দিকে তাকালেন ডক্টর।
মায়া নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। কয়েক মুহূর্ত ভেবে গেলো চারু। ডক্টরের প্রশ্নটা উড়িয়ে দেবার মতো নয়।
“একজন ক্ষমতাবান এমপি…নিজের ছেলের অপকর্ম ঢাকার জন্য যা যা করার দরকার করেছেন। তার উপরে ক্ষোভ থাকাটা কি স্বাভাবিক নয়?”
“আপনি বলতে চাচ্ছেন, চাঁন মিয়া বহু আগেই থেকেই মিসকাত আর তার মাকে খুন করার পরিকল্পনা করেছিলো?”
মাথা দোলালেন ডক্টর। “আমার মনে হয় না চাঁন মিয়া ঐ এমপিকে ছেড়ে দেবে।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললেন, “অন্তত এখন তো নয়-ই। বিশেষ করে যখন গুণ্ডা পাঠিয়ে চাঁন মিয়াকে খুন করার চেষ্টা করা হয়েছে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু। চাঁন মিয়া যদি মিসকাতকে ওভাবে খুন করতে পারে, তিন-তিনজন গুণ্ডাকে মোকাবেলা করে পালিয়ে যেতে পারে পারে, তাদের একজনের হাত কেটে ফেলতে পারে, তবে বুঝতেই হবে লোকটা প্রতিশোধের নেশায় শুধু উন্মত্তই নয়, প্রতিশোধ নেবার মতো ক্ষমতাও রাখে।
“আমরা কি মিসকাতের মাকে এটা জানিয়ে দেবো?” চারু জিজ্ঞেস করলো। এর আগে তার ছোট্ট একটা ভুলেই চাঁন মিয়ার জীবন বিপদে পড়ে গেছিলো। আর কোনো জীবন বিপদের মুখে পড়ক সেটা চায় না।
“হুম,” গম্ভির মুখে বললেন ডক্টর। “জানানো উচিত কিন্তু কিভাবে জানাবে উনাকে?”
“উনার সাথে দেখা করে সব খুলে বলবো?”
চারুর কথায় মাথা দোলালেন আজফার হুসেন। “মনে হয় না সেটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ভদ্রমহিলা তোমাদেরকে ভুল বুঝতে পারেন। কোথাকার কে এসে তার জীবন হুমকির মুখে আছে বলবে আর ভদ্রমহিলা সেটা বিশ্বাস করবেন?”
চারু আর মায়া চেয়ে রইলো ডক্টরের দিকে।
“তোমরা কারা? এই কেস কেন তদন্ত করছো? তোমাদের স্বার্থ কি? কোন উদ্দেশ্যে এসব বলছে-এমন প্রশ্ন করবেন উনি। মনে রেখো, রাজনীতি করা মানুষ অন্যের প্রতিটি কাজের পেছনে উদ্দেশ্য খোঁজে। এটাই তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। হতে পারে, তারা নিজেরা কোনরকম উদ্দেশ্য ছাড়া কাজ করে না বলেই এমনটা ভাবে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু। ডক্টরের কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু এমপিকে সতর্ক করে দেয়াটাও জরুরি। অন্যভাবে সেটা করা যায় কিনা ভেবে দেখা যেতে পারে।
চারুর মনের একটা অংশ বলছে, চাঁন মিয়ার পরবর্তি টার্গেট হবে মিসকাতের মা। যার হারানোর কিছু নেই তার পক্ষে মরিয়া হয়ে অমন কাজ করা অসম্ভব নয়। পলাতক চাঁন মিয়া হয়তো মরণ কামড় দেবার চেষ্টা করবে আর সেটা মিসকাতের মা ছাড়া অন্য কেউ হতে পারে না। কিন্তু তার মনের অন্য অংশটা যুক্তি দিয়ে বলতে চাচ্ছে, মিসকাতের মা একজন সিটিং এমপি, তাকে বাগে পাওয়াটা খুব কঠিন। চাঁন মিয়া আপাতত গুণ্ডাগুলোর হাত থেকে নিজের জীবন বাঁচাতেই ব্যস্ত থাকবে এমপির পেছনে লাগবে না।
ঠিক তখনই আরেকটা প্রশ্ন তার মাথায় উদয় হলো।
অ্যাঞ্জেল!
“আমার তো মনে অ্যাঞ্জেলকে নিয়েও ভাবা উচিত,” বলল চারু আহসান। “ও কিন্তু মিসকাতের কেসে মিথ্যে সাক্ষি দিয়েছিলো।”
ডক্টর মাথা নেড়ে সায় দিলেন। “এটা একদম উড়িয়ে দেয়া যায় না।”
এ মুহূর্তে মিসকাতের মায়ের চেয়ে অনেক সহজ হলো অ্যাঞ্জেলের ক্ষতি করা। সে হলো সফট টার্গেট। খুব একটা সতর্কভাবে চলাফেরা করে না।
“আমার মনে হয় অ্যাঞ্জেলকে সতর্ক করে দেয়া উচিত,” বলল যুক্তিবাদি।
মাথা নেড়ে সায় দিলেন ডক্টর। “হুম। আশংকাটা সত্যি হোক আর না হোক, ওই ছেলেকে সতর্ক করে দেয়াই ভালো হবে।”
এ নিয়ে চারুর মধ্যে কোনো দ্বিধা নেই। সে সিদ্ধান্ত নিলো আজকেই অ্যাঞ্জেলকে বলে দেবে, সে যেন একটু সতর্ক হয়ে চলাফেরা করে।
.
অধ্যায় ৩৬
কোথায় গেলো হারামিটা?
মিকাকে খুঁজে পাচ্ছে না অ্যাঞ্জেল। নিচের তলায়ও খুঁজে দেখেছে। দোতলাও সে নেই। বাকি রইলো ছাদ। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো তার। এ সময়ে ছাদে যেতে ইচ্ছে করছে না। চারতলার অ্যালোটি রইস হাওলাদার এখন ছাদে হাটাহাটি করছে। অবসরপ্রাপ্ত এই ব্রিগেডিয়ার ইদানিং তাকে উত্যক্ত করা শুরু করে দিয়েছে। দেখা হলেই গদগদ হয়ে কথা বলে। সে যে খুব উদার, খুবই ভোলা মনের আর সমকামি বিয়ে সমর্থন দিয়ে নিজের ফেসবুকের প্রোফাইল পিক ‘রেইনবো’ করে দিয়েছে। সেটা তো বলবেই, সবচেয়ে বিরক্তিকর হলো, এতদিন ধরে কেন তার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটা অ্যাকসেপ্ট করা হয়নি তা নিয়েও তাগাদা দেবে।
খচ্চরটা জানলে কি করে ‘আমি বনলতা’ আইডির মালিক সে?-অনেক ভেবেও এটা বের করতে পারেনি অ্যাঞ্জেল। এই অবসরপ্রাপ্ত লোকটির স্ত্রী বহু আগেই ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছে। সম্ভবত মহিলা বুঝে গেছিলেন তার স্বামির ভিন্ন রকম রুচির ব্যাপারটি। কোনো সন্তানসন্ততি নেই। দূর সম্পর্কের এক ভাগ্নেকে নিয়ে একলাই থাকে। ডাক্তারের পরামর্শে ইদানিং সকাল বিকাল দু-বেলা হাটাহাটি করে। সেটাও করে অ্যাপার্টমেন্টের ছাদে।
অ্যাঞ্জেল ঠিক করলো মিকাকে খোঁজার জন্য ছাদে যাবে না। হারামিটা আজ আসুক! কিছু খেতে দেবে না। দরজাও খুলবে না।
নিজের ঘরে এসে পিসির সামনে বসলো সে। আজ সকাল থেকেই তার মন খারাপ। তার কারণ আজ একটি বিশেষ দিন কিন্তু বিশেষ মানুষটা নেই! সেজন্যেই সকাল থেকে মনমরা হয়ে ছিলো, বাড়ির বাইরে আর যায়নি, মিকাকে নিয়েই কাটিয়ে দিয়েছে সারাটা দিন। বিকেলের দিকে একটু ঘুম দেবার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু ঘুম আর আসেনি।
আজ মিসকাতের জন্মদিন।
এক বছর আগেও এই দিনটা কতোই না অনিন্দে কাটতো অ্যাঞ্জেলের। রাত বারোটা বাজার পর পর সবার আগে মিসকাতকে উইশ করতো সে। মিসকাতের প্রেমিকা কখনও সবার আগে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে পারেনি। কিভাবে পারবে, অ্যাঞ্জেল তো এই দিনটায় রাত সাড়ে এগারোটার পর থেকেই মিসকাতের সাথে ফোনে কথা বলতে শুরু করে দিতে। সেই ফোনালাপ শেষ হতো বারোটার পরপরই।
এবার রাখি…তোর গার্লফ্রেন্ডদের লম্বা কিউ পড়ে যাবে না-হলে! বিচগুলো জ্বলেপুড়ে মরবে! তোকে নিয়ে ডাউট করবে।
মিসকাতকে বলতো সে। জন্মদিনটায় অনেক বন্ধুবান্ধবদের সাথে কাটালেও অ্যাঞ্জেল থাকতো সারাক্ষণ মিসকাতের সাথে। গার্লফ্রেন্ডের সাথে ডেটিংয়ের সময়েও তাকে বাদ রাখতো না। একই গাড়িতে করে তারা তিনজন ঘুরে বেড়াতো। মিসকাত আর অমি যখন চুমোচুমি করতে অ্যাঞ্জেল তখন অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতো।
শর্ট ফিল্ম, প্লিজ! ফুললেন্থের নয় কিন্তু!
মিসকাতকে কনুই দিয়ে গুতো মেরে বলতো সে। মিসকাত তার গার্লফ্রেন্ডকে চুমু খেতে খেতেই অ্যাঞ্জেলের জননেন্দ্রিয়তে একটা থাবা বসিয়ে দিতো। ভীষণ দুষ্ট ছিলো মিসকিটা।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো অ্যাঞ্জেলের ভেতর থেকে। জ্ঞান-বুদ্ধি হবার পর থেকে সে দেখেছে তার বাব-মা, পরিবার, আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে বন্ধুবান্ধব সবাই তাকে নিয়ে বিব্রত। সবাই অন্য চোখে দেখতে তাকে। যেন তার জন্মটাই পাপ। কিন্তু এদের মধ্যে মিসকিটা ছিলো ব্যতিক্রম। সেই ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় ওর সাথে পরিচয়, এরপর স্কুলের দুষ্টু ছেলেদের বুলিং থেকে শুরু করে সব ধরণের অনাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শুরু করে মিসকাত। অ্যাঞ্জেলের এই সাতাশ বছরের জীবনে সত্যিকারের বন্ধু ছিলো ও। সব জায়গায় ওকে সঙ্গে করে নিতো। কখনও ওকে নিয়ে বিব্রত হতো না কোথাও। অ্যাঞ্জেলও একমাত্র মিসকির কাছে সব দুঃখযন্ত্রণার কথা খুলে বলতো। মিসকাতও এমন কোনো বিষয় নেই যা অ্যাঞ্জেলের সাথে শেয়ার না করতো।
তার সেই বন্ধুও চলে গেলো অকালে।
সময় কাটানোর জন্য ফেসবুকে লগ-ইন করতে যাবে অমনি তার ফোনটা বেজে উঠলো। ডিসপ্লের দিকে তাকিয়ে সমস্ত বিরক্তি নিমেষে দূর হয়ে গেলো তার। চারু তাকে ফোন দিয়েছে! সে
এই ছেলেটাকে তার অসম্ভব ভালো লাগে। ওর মধ্যে সাহস আর স্মার্টনেস আছে। বিশেষ করে একটা ভুরু উঁচু করে যখন তাকায় তখন অ্যাঞ্জেলের কী যে ভালো লাগে! কথাও বলে দারুণ গুছিয়ে। কণ্ঠটা ভরাট। বাচনভঙ্গি বেশ প্রমিত। আজকালকার ছেলেপেলেদের মতো ‘খাইসি-গেসি’ বলে না। অ্যাঞ্জেল তার লেখালেখিরও ফ্যান। কী ক্ষুরধার যুক্তি রে বাবা! কতো কিছু জানে!
পরমুহূর্তেই যে-ই না মনে পড়ে গেলো, মিসকাতের কেসের ব্যাপারে কিছু জানার জন্য ফোন দিয়ে থাকতে পারে, অমনি অ্যাঞ্জেলের স্বল্পস্থায়ি খুশিটা মিইয়ে গেলো। এই ছেলের একটাই সমস্যা : যখনই কথা হবে শুধু অপ্রিয় সেই বিষয়টা নিয়ে জানতে চাইবে।
“হ্যালো…রাইটার কেমন আছে?” কলটা রিসিভ করে বলল সে।
“ভালো। তুমি?” অপরপ্রান্ত থেকে চারু বলল।
“এই তো…ভালো।” বিষণ্ণ কণ্ঠে জানালো অ্যাঞ্জেল।
“তোমার শরীর কি খারাপ?”
“না।” অবাক হলো সে। তার কণ্ঠ শুনে বুঝে গেছে তার মনের অবস্থা! “আসলে মনটা খারাপ। তেমন কিছু না।” একটু থেমে আবার বলল সে, “আপনার কি খবর?”
“এই তো, আছি। তোমাকে একটা জরুরি দরকারে ফোন দিয়েছি।”
“বলুন, কি দরকার?”
“তুমি তো মিসকাতের কেসটায় সাক্ষি দিয়েছিলে, তাই না?”
চারু আহসানের এমন প্রশ্নে যারপরনাই বিরক্ত হলো সে। তার ধারনাই ঠিক, ছেলেটা মিসকাতের কেসের ব্যাপারেই ফোন দিয়েছে। “হুম। আপনাকে তো আগেই বলেছি।”
“ঐ ছেলেটার বাবা…সিএনজি ড্রাইভার…তার কথা তোমার মনে আছে?”
উফ! মনে মনে বিরক্ত হলেও মুখে কিছু বলল না। “হুম…মনে আছে। কেন, কি হয়েছে?”
“পুলিশ এখন সন্দেহ করছে, ঐ সিএনজি ড্রাইভারই মিসকাতকে খুন করেছে।”
“হোয়াট!” চমকে উঠলো সে।
“পুলিশ আমাকে সেরকমই বলল।” চারু যে নিজে তদন্ত করে এটা বের করেছে সেটা জানালো না।
“মাই গড! বলেন কি?”
“হ্যাঁ। আমার মনে হয়, তোমার একটু সাবধানে চলাফেরা করা উচিত।” মিসকাতের মা যে গুন্ডা পাঠিয়ে লোকটাকে মারতে চেয়েছিলেন সেটাও চেপে গেলো।
“আ-আমাকে…ক-কি করবে?” ভয়ে তোতলালো অ্যাঞ্জেল।
“শোনো, এ নিয়ে অতো ভয় পাবার কিছু নেই, অভয় দিলো চারু। “লোকটা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে গেছে। ওর ছেলে…মিসকাত যাকে অ্যাকসিডেন্ট করেছিলো, সে বছরখানেক আগে আত্মহত্যা করেছে।”
“বলেন কি!”
“ছেলেটা সুইসাইড করার পর থেকেই লোকটার মাথা বিগড়ে গেছে।” একটু থেমে আবার বলল, “এরকম লোকজন কখন কি করে বসে ঠিক
নেই।”
অ্যাঞ্জেল নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো।
“তাই বলছিলাম, একটু সাবধানে থেকো। চোখকান খোলা রেখো।”
আনমনেই মাথা নেড়ে সায় দিলো সে।
“বুঝতে পেরেছো, অ্যাঞ্জেল?” তাড়া দিয়ে বলল চারু।
“হুম। বুঝতে পেরছি।”
“তবে ভয় পেয়ো না। লোকটাকে পুলিশ খুঁজছে। মনে হয় খুব জলদিই ধরা পড়ে যাবে।”
“পুলিশ কি শিওর, ঐ লোকটাই মিসকাতকে খুন করেছে?” ফোনের অপর প্রান্তে থাকা চারু আহসান একটু চুপ মেরে রইলো।
“মানে…ইট ডাজেন্ট মেক এনি সেন্স! হাউ কাম? ওরকম একজন লোক কি করে…”
“তোমার সাথে দেখা হলে সব খুলে বলবো। এখন প্যানিৰ্ড না হয়ে শুধু একটু সতর্ক থেকো। ঠিক আছে?”
“হুম। বুঝতে পেরেছি।”
“আর ভুলেও সিএনজি অটোরিক্সায় যাতায়াত কোরো না। ওকে?”
“ওকে।”
“পরশু বিকেলে আমরা মিট করছি। তখন সব খুলে বলবো।”
“থ্যাঙ্কস অ্যা লট।”
আস্তে করে কলটা কেটে দিয়ে উদাস হয়ে গেলো অ্যাঞ্জেল। ঐ ছেলেটার বাপ মানকিভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে… ছেলের মৃত্যুর জন্য মিসকাতের উপরে প্রতিশোধ নিয়েছে?
তার পেছনেও লাগতে পারে?
পায়ের কাছে কিছু একটা নড়ে উঠতেই চমকে উঠলো সে। “আউ!” চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
“মিউ।”
হাফ ছেড়ে বাঁচলো অ্যাঞ্জেল। মিকা কখন তার পায়ের কাছে এসে ঘুর ঘুর করছে খেয়ালই করেনি।
নাদুসনুদুস বেড়ালটাকে কোলে তুলে নিলো সে। আদুরে কণ্ঠে বলল, “কোথায় ছিলি হারামি? তোকে খুঁজে খুঁজে আমি হয়রান! খালি তিনতলায় যাওয়া হয়…না?”
মিকা মুখ ঘষতে লাগলো অ্যাঞ্জেলের বুকে।
“ঐ বান্টিদের নতুন বেড়ালটার সাথে আজকাল খুব লাইন মারছিস বুঝি।”
মিকার কোনো ভাবান্তর নেই।
“নটি বয়।” বেড়ালটা নিয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো সে। “বেশি বাড়াবাড়ি করলে তোকে না একদম ইয়ে করে দেবো।”
মিকা মিয়াও করে উঠলো। যেন কথাটার প্রতিবাদ করেছে।
“ইয়ে মানে, খাসি করে দেবো। ঠিক আছে? তারপর দেখবো বান্টিদের বেড়ালটা তোকে পাত্তা দেয় কিনা।”
হুমকিটা আমলেই নিলো না মিকা, সে তার মালিকের বুকে মুখ ঘষেই চলছে।
এমন সময় অ্যাঞ্জেলের চোখ গেলো জানালার বাইরে, নিচের রাস্তার দিকে। তাদের অ্যাপার্টমেন্টের বাইরের রাস্তায় একটা সিএনজি দাঁড়িয়ে আছে।
অন্য কোনো সময় হলে এটা নিয়ে কিছুই ভাবতো না। কিন্তু আজ, এ মুহূর্তে সিএনজিটা দেখে তার বুক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো।
.
অধ্যায় ৩৭
বাইক নিয়ে ছুটে চলেছে চারু।
কোথায় যাবে জানলেও কী করবে সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই তার। তারপরও ঘর থেকে বের হয়ে গেছে ফোনটা পাবার পর পরই। এই প্রথম কোনো কিছু না ভেবে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
একটু আগে অ্যাঞ্জেলকে ফোন করে সতর্ক করে দেবার পর পরই তার কাছ থেকে আবার কল পায়। মিসকাতের এই বন্ধুটি ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। বেচারা নরম মনের মানুষ, সামান্য ঘটনায় ভড়কে যায়। চারুর কাছ থেকে সতর্কবাণী পাবার পর পর যে দৃশ্য দেখেছে সেটা তাকে পুরোপুরি ভড়কে দিয়েছে।
অ্যাঞ্জেলকে এজন্যে মোটেও দোষারোপ করা যায় না। তার ভীতিটার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে।
একটা সিএনজি দাঁড়িয়ে আছে ওর বাড়ির সামনে!
ভীত অ্যাঞ্জেলকে নিজের ঘরে থাকার পরামর্শ দিয়েই চারু বেরিয়ে পড়েছে। অ্যাঞ্জেলের বাড়ির সামনে গিয়ে যদি দেখে সিএনজিটা দাঁড়িয়ে আছে, আর তাতে বসে আছে চাঁন মিয়া, তাহলে কী করবে। কি করা উচিত হবে তার?
এই একটা ভাবনাই বার বার মাথার মধ্যে উঁকি মারছে। এই প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবে আর কয়েক মিনিট পরই।
বাইকের গতি আরো বাড়িয়ে দিলো সে। রাত দশটার পর, গুলশান বারিধারা এলাকাটি এত ব্যস্ত থাকে না। খুব দ্রুতগতিতে বাইক ছুটিয়ে ঢুকে পড়লো বারিধারায়। অ্যাঞ্জেলের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনটি খুঁজে পেতে বেশি সময় লাগলো না তার। এলাকাটি সে ভালো করেই চেনে। দুই বছর আগে ন্যাশনালিস্ট সোসাইটির বর্তমান অফিসটি ভাড়া করার আগে এক প্রবীণ সদস্যের বদান্যতায় বারিধারায় তার নিজ বাড়ির নিচতলায় কিছুদিন অফিস করেছে তারা। সেই সময়গুলোতে চারুকে প্রতিদিন বারিধারায় এসে অফিস করতে হয়েছে।
বারিধারার তিন নম্বর সড়কে ঢুকতেই এক-দেড়শ গজ দূরে রাস্তার বামদিকে সবুজ রঙের সিএনজি অটোরিক্সাটা চোখে পড়লো, সঙ্গে সঙ্গে তার হৃদস্পন্দনের গতি গেলে বেড়ে। বাইকটার গতি কমিয়ে সিএনজি থেকে একটু দূরে থামালো সে।
তার থেকে মাত্র বিশগজ দূরে আছে অটোরিক্সাটা। নিজের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে চারু। হেলমেটের ভেতর থেকে চেয়ে রইলো গাড়িটার দিকে। হেলেমেটের ফেস-শিন্ডটা উপর তুলে দিয়ে ভালো করে তাকালো এবার।
সিএনজির ভেতরে কেউ আছে। প্যাসেঞ্জার সিটে বসে আছে। পেছন দিকের স্বচ্ছ প্লাস্টিকের উইন্ডোটা দিয়ে দেখা যাচ্ছে।
ড্রাইভার নয়, অন্য কেউ!
চাঁন মিয়া আর কে হতে পারে?
বাইকের ইঞ্জিন এখনও বন্ধ করেনি, আস্তে করে আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলো সে। প্রায় নিঃশব্দে সিএনজিটার পেছনে চলে এলো। গভীর করে দম নিয়ে রাস্তার উল্টোদিকে ২২ নাম্বার বাড়ির দিকে তাকালো চারু। ছয়তলার এই অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের তিনতলায় থাকে অ্যাঞ্জেল। সম্ভবত জানালার পেছন থেকে তাকে দেখছে।
চারু তার বাইকটার ইঞ্জিন বন্ধ করে স্ট্যান্ডের উপর দাঁড় করিয়ে হেলমেটটা খুলে বাইকের হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে দিয়ে এক পা সামনে এগোবে অমনি বেজে উঠলো তার সেলফোনটা। বিরক্ত হয়ে তাকালো রাস্তার ডানদিকের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের তিনতলার দিকে। সে নিশ্চিত অ্যাঞ্জেলই ফোনটা দিয়েছে।
পকেট থেকে ফোন বের না করে ভবনের দিকে হাত তুলে তাকে আশ্বস্ত করার ইশারা করলো। যদিও সে জানে না কোন জানালার পেছনে অ্যাঞ্জেল দাঁড়িয়ে আছে।
হঠাৎ একটা শব্দে চমকে তাকালো সে।
সিএনজিটার ইঞ্জিন স্টার্ট দিচ্ছে।
চারু কোনো কিছু না বুঝেই দৌড় দিলো। সিএনজিটা এগিয়ে যেতে শুরু করতেই একহাতে গ্রিলের দরজা ধরে ফেলার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। গাড়িটার সাথে সাথে দৌড়ানোর চেষ্টা করলো এবার। যিলের ফাঁক দিয়ে ভেতরে কে আছে দেখার আগেই সিএনজিটা দ্রুত গতিতে সামনের দিকে ছুটে গেলো।
কয়েক মুহূর্ত কিংকতব্যবিমূঢ় হয়ে থাকলো চারু, তারপর ধাতস্থ হতেই ছুটে গেলো নিজের বাইকের কাছে। হেলমেটটা ঝটপট পরে বাইক স্টার্ট দিয়েই ছুটলো সিএনজিটার পেছনে। এখনও দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়নি, তবে এক-দেড়শ’ গছ পেছনে আছে সে।
একটা চৌরাস্তার মোড়ের কাছে আসতেই দেখতে পেলো গাড়িটা বামদিকে মোড় নেবার জন্য গতি কমিয়ে দিয়েছে। এই সুযোগে বাইকের গতি আরো বাড়িয়ে দিলো সে, কয়েক মুহূর্ত পরই সিএনজিটার পাশে চলে এলো।
কিন্তু দরজার গ্রিল দিয়ে যাকে দেখতে পেলো সে নিতান্তই হালফ্যাশনের এক তরুণ। কানে ইয়ারফোন গুঁজে দিয়ে কারো সাথে মোবাইলফোনে কথা বলছে। চারুর দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো ছেলেটা।
একটু সামনে এগিয়ে সিএনজি ড্রাইভারকে দেখার চেষ্টা করলো এবার। গাট্টাগোট্টা, দাড়ি-টুপি পরা মাঝবয়সি এক লোক।
আতঙ্কিত ড্রাইভার চারুর দিকে এমনভাবে তাকালো যেন ছিনতাইকারির পাল্লায় পড়েছে।
অবস্থা বেগতিক দেখে বাইকের গতি কমিয়ে দিলো সে। সিএনজিটা অপসৃত হতেই হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
আরেকটুর জন্য ভুলবোঝাবুঝির শিকার হতে যাচ্ছিলো। অ্যাঞ্জেলের উপর ভীষণ ক্ষেপে গেলো, কিন্তু সেই ক্ষোভ মেটালো বাইকের অয়েল ট্যাঙ্কে জোরে জোরে চাপড় মেরে। হঠাৎ পেছন থেকে তার কাঁধে একটা হাত পড়তেই চমকে উঠলো সে।
“আমি!”
হাফ ছেড়ে বাঁচলো চারু আহসান। অ্যাঞ্জেল। উপর থেকে সে সবই দেখেছে, তারপর চারুকে ওভাবে ছুটে যেতে দেখে নিচে নেমে এসেছে।
“ওটা কে ছিলো?” ভয়ার্ত কণ্ঠে জানতে চাইলো অ্যাঞ্জেল।
মাথা দোলাল চারু। “আর যাই হোক চাঁন মিয়া ছিলো না। তুমি খামোখাই ভয় পেয়েছে।”
“ওহ..থ্যাঙ্কস গড!”
যৌক্তিক কারণে ছেলেটার উপর রাগতে পারছে না, বরং নিজের উপরেই রাগ হচ্ছে তার। এভাবে অ্যাঞ্জেলের ফোন পেয়ে ছুটে আসা উচিত হয়নি।
“আমি তোমাকে বলেছিলাম একটু সাবধানে থাকতে…তার মানে এই না, সিএনজি দেখলেই ভয় পেতে হবে।”
অ্যাঞ্জেল মন খারাপ করার অভিব্যক্ত দিলো। “ভয় কি সাধে পেয়েছি! ভয় পাবার অনেক কারণ আছে।”
“একটা সিএনজি তোমার বাড়ির সামনে থেমে ছিলো…এই তো? নাকি আরো কিছু হয়েছে?”
মাথা দোলাল মিসকাতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। “আপনি বুঝবেন না আমি কেন এতটা ভয় পেয়েছিলাম।”
হতাশ হলো চারু। “সবটা খুলে না বললে বুঝবো কী করে?”
অ্যাঞ্জেলের মধ্যে একটু দ্বিধা দেখা দিলো।
ভুরু কুচকে তাকালো যুক্তিবাদি। “আরো কিছু হয়েছে নাকি?”
অ্যাঞ্জেলের চোখদুটো ছল ছল করে উঠলো। “আপনার কাছে আমি কিছু কথা লুকিয়েছিলাম। এটা করা ঠিক হয়নি। সব বলে দেয়া উচিত ছিলো।”
ভুরু কুচকে জানতে চাইলে চারু, “কিসের কথা বলছো তুমি? বলো?”
গভীর করে নিঃশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলো ও, “কোথাও একটু বসে বলি? আমার না দম বন্ধ হয়ে আসছে। একটুও ভালো লাগছে না।”
আক্ষেপে মাথা দোলাল যুক্তিবাদি। “কোথায় বসতে চাও?”
“লেকের পাশে?”
“ঠিক আছে…চলো।”
চারুকে অবাক করে দিয়ে অ্যাঞ্জেল তার বাইকের পেছনে উঠে বসলো। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে পড়লো যুক্তিবাদি।
সুন্দর করে চারুর কোমর জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ঠোঁট এনে সে বলল, “কী হলো…যান!”
বাধ্য হয়ে বাইকের পেছনে অ্যাঞ্জেলকে বসিয়ে বারিধারার লেকের পাশে যেতে হলো চারুকে। লেকের পাশে নির্জন একটা জায়গায় বাইকটা থামিয়ে তারা দু-জন বসে পড়লো ঘাসের উপরে।
“এবার বলো, আমার কাছ থেকে কি লুকিয়েছো তুমি?”
একটু চুপ থেকে অ্যাঞ্জেল বলল, “আমরা আসলে জানতাম ঐ ছেলেটা আত্মহত্যা করেছে।”
“কি!” চারু যেন আকাশ থেকে পড়লো।
মাথা নেড়ে দৃঢ়ভাবে জানালো, “মিসকাতজোর আমি…আমরা জানতাম এটা।”
.
অধ্যায় ৩৮
চাঁন মিয়ার ছেলের আত্মহত্যার কথাটা মিসকাতের মা জানতেন।
তিনি এটা কিভাবে জেনেছিলেন সেটা অবশ্য মিসকাত জানতে পারেনি। তবে সে আন্দাজ করতে পেরেছিলো তার মা সম্ভবত ঐ বস্তির নেতাগোছের একজনের মাধ্যমে এটা জেনেছিলেন।
এমপিসাহেবার নিজের রাজনৈতিক দলের কুড়িল বস্তির একটি শাখা আছে। পুলিশের পাশাপাশি ওখানকার এক নেতাকে দিয়ে তিনি চাঁন মিয়া আর তার ছেলেকে চাপ দিয়েছিলেন মামলা তুলে নেবার জন্য।
সুরুজ আত্মহত্যা করার পর একদিন এমপির সাথে দেখা করতে এলে ঐ নেতাগোছের লোকটি এ কথা জানিয়েছিলো। তবে মিসকাতের মা কথাটা ছেলেকে না বললেও স্বামির সাথে এ নিয়ে কথা বলেছিলেন।
যাই হোক, একদিন মিসকাত গাড়ি নিয়ে বের হবে, এমন সময় তার ভোলাভালা বাবা আশরাফ সোহান হঠাৎ ক্ষেপে গেছিলেন ছেলের উপরে। মিসকাত যেন দরকারের বাইরে অন্য কোনো কাজে গাড়ি ব্যবহার না করে।
এ কথা শুনে মিসকাত অবাক হয়েছিলো। তার বাবা কখনও কোনো ব্যাপারে বাধা দেন না। হঠাৎ কী এমন হলো যে বাবা এসব কথা বলছেন!
এ নিয়ে বাবার সাথে তর্ক করতে গেলে রাগের মাথায় আশরাফসাহেব বলে দেন, যে ছেলেটাকে সে অ্যাকসিডেন্ট করে পঙ্গু করে ফেলেছিলো সে কয়েকদিন আগে আত্মহত্যা করেছে। ছেলেটার এমন পরিণতির জন্য মিসকাতের অনুতপ্ত হয়া উচিত।
কথাটা শুনে মিসকাত চুপ মেরে গেছিলো। তার নিজের কাছেও খারাপ লেগেছিলো, তবে তার মা এসে বাবাকে উল্টো বলেছিলেন, এসব কথা ছেলেকে বলার কী দরকার ছিলো?
সত্যি বলতে, সুরুজের আত্মহত্যার কথাটা শোনার পর মিসকাত একটু ‘আপসেট’ই হয়েছিলো। কথাটা সে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু অ্যাঞ্জেলের সাথে ঐদিনই ‘শেয়ার’ করে।
এ কথা শুনে নরম মনের অ্যাঞ্জেলের মন ভীষণ খারাপ হয়েছিলো। এ ঘটনার জন্য একটু হলেও নিজেকে দায়ি মনে করতে শুরু করে সে। কারণ মিসকাতের হয়ে মিথ্যে সাক্ষি দিয়েছিলো আদালতে।
তো, সুরুজের আত্মহত্যার খবর শোনার দু-দিন পর এক পূর্ণিমা রাতে একটা ঘটনা ঘটে। মিসকাত তার গার্লফ্রেন্ড অমির সাথে ফোনে কথা বলছিলো। রাতভর ফেসবুকে চ্যাট আর ফোন করে ভোরের আগে ঘুমানোর অভ্যেস ছিলো তার। পূর্ণিমা রাতে তার গার্লফ্রেন্ড তাকে বলে, আজ সারাটা রাত তারা ব্যালকনিতে বসে বসে জ্যোৎস্না দেখবে আর ফোনে কথা বলবে।
কথামতো মিসকাত তার ঘরের ব্যালকনিতে বসে অমির সাথে ফোনে কথা বলতে থাকে। মিসকাতের ঘরটা রাস্তার পাশে, ব্যালকনি থেকে নিচের রাস্তা দেখা যায়। রাত ২টার পর সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে, পথঘাট ফাঁকা হয়ে গেছে তখনই নিচের রাস্তায় হঠাৎ করে তার চোখ যায়। একটা দৃশ্য দেখে পুরোপুরি ভড়কে যায় মিসকাত।
সে দেখতে পায় রাস্তার উল্টোদিকে একজন দাঁড়িয়ে আছে। একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার ব্যালকনির দিকে।
মিসকাতের কাছে পুরো ব্যাপরটাই অবিশ্বাস্য আর ভৌতিক বলে মনে হয়। কারণ যে ছেলেটাকে দেখছে সে কয়েকদিন আগেই আত্মহত্যা করেছে।
.
“মিসকাত সুরুজকে দেখেছে!”
অ্যাঞ্জেলের কাছ থেকে গল্পটা শুনে অবিশ্বাসে বলে উঠলো চারু।
মাথা নেড়ে সায় দিলো মিসকাতের বন্ধু। “মিসকি আমাকে সেরকমই বলেছে। খুব ভয় পেয়ে গেছিলো। সারা রাত আর ঘুমাতে পারেনি।”
মাথা দোলাল যুক্তিবাদি। “এটা ওর মনের ভয় থেকে হয়েছে। এক ধরণের দৃষ্টিবিভ্রম। তার অপরাধি মন এটা তাকে দেখিয়েছে।”
কাঁধ তুলল অ্যাঞ্জেল। “হুম। আমিও ওকে এ কথা বলেছিলাম কিন্তু মিসকি কোনোভাবেই এটা মেনে নিতে পারেনি। ও জোর দিয়ে বলেছিলো, যা দেখেছে সেটা একদম সত্যি।”
চারু কী বলবে ভেবে পেলো না।
“মিসকি এতটাই ভয় পেয়ে গেছিলো যে, অনেকদিন রাতের বেলায় একা ঘুমাতে পারেনি। হয় ওর বাড়ির কাজের ছেলেটাকে সাথে রাখতো নয়তো কখনও কখনও আমাকে বলতো ওর সাথে থেকে যেতে।”
“মিসকাত এ কথা তার মা-বাবাকে বলেনি?”
মাথা দোলাল অ্যাঞ্জেল। “না। ও শুধু আমাকে বলেছে এ কথা। ইউ নো…আমাকে ও সব কথা বলতো। স-অ-অ-ব!”
এ কথা অ্যাঞ্জেল সব সময়ই জোর দিয়ে বলে। মিসকাতের সাথে আসলেই তার নিবিড় সম্পর্ক ছিলো।
“এ কারণেই আমিও সিএনজিটা দেখে খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম…ইউ নো?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু আহসান। “হুম। বুঝতে পেরেছি।”
“সরি…রাইটার!” কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল ‘আমি বনলতা’ আইডির মালিক। “এসব কথা আপনাকে আগেই বলা উচিত ছিলো।”
“ইটস ওকে।”
খপ করে চারুর একটা বাহু ধরে ফেলল সে। “থ্যাঙ্কস অ্যা লট! ইউ আর সো সুইট।”
ধরনী…দ্বিধা হও! মনে মনে প্রমাদ গুণলো চারু আহসান। আশেপাশে তাকালো কেউ দেখছে কিনা।
কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তবে পুরোপুরি নিশ্চিতও হতে পারলো না।
রাতের এ সময়ে কমন-জেন্ডার একজন তার বাহুলগ্ন হয়ে আছে! যারা দেখবে তারা কী ভাববে চারু জানে। তার গা গুলিয়ে উঠলো।
“চলো,” চট করে উঠে দাঁড়ালো সে। “অনেক রাত হয়েছে…বাসায় যেতে হবে। তুমিও বাসায় যাও।”
অ্যাঞ্জেলের চেহারা দেখে মনে হলো আশাহত হয়েছে সে।
.
অধ্যায় ৩৯
বারিধারা থেকে ফিরে এসে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে চারু।
আজকের ঘটনাটা নিয়ে ভাবছে সে। অ্যাঞ্জেল খুব ভড়কে গেছিলো। ছেলেটাকে অবশ্য দোষ দেয়া যায় না। নরম মনের একজন মানুষ সে। তার উপরে মিসকাত যখন বেঁচে ছিলো তখন তাকে বলেছিলো মৃত সুরুজকে নাকি সে দেখেছে তার বাড়ির নিচে। এসব কারণে নিজের বাড়ির নিচে একটা সিএনজি দেখে স্বাভাবিকভাবেই ভয় পেয়ে যায় সে।
তবে চারুর ভাবনায় এখন অন্য একটা চিন্তা। মৃত একজনকে বার বার কেন দেখা যাবে? মিসকাতেরটা না-হয় অপরাধবোধ থেকে সৃষ্ট মানসিক চাপ আর দৃষ্টিবিভ্রম বলে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, কিন্তু ট্যাপার মতো ধুরন্ধর ইনফর্মার কেন দেখবে সুরুজকে? এর ব্যাখ্যা কি?
তারচেয়েও বড় কথা চাঁন মিয়ার সাথে সব সময় একজনকে দেখা যাচ্ছে। মায়া যেটার ইঙ্গিত করেছে সেই অশরীরি তত্ত্ব না-হয় বাদ দেয়া গেলো, কিন্তু একজন সহযোগির উপস্থিতিটাকে অস্বীকার করা যাচ্ছে না।
বাইকার বাবু অ্যাকসিডেন্ট করার পর তাকে যে সিএনজিটা তুলে নেয় সেখানেও একজন প্যাসেঞ্জার ছিলো। গাজীপুরে যে সিএনজিতে করে খুনি গেছিলো সেটারও ছিলো ড্রাইভার। চাঁন মিয়া যদি খুনটা করে থাকে তাহলে অন্য কেউ কেন থাকবে তার সাথে? সে তো নিজেই সিএনজি চালাতে পারে। তারপরও একজন সহযোগি যে ছিলো সেটা মোটামুটি নিশ্চিত। সিএনজি থেকে কেউ নেমে যাবার পর গাড়িটা ঘুরিয়ে পার্ক করে রাখা হয়। এ কাজটা কে করলো?
চারু জানে পুরো ঘটনার মধ্যে কিছু ফাঁক রয়ে গেছে। গভীর ভাবনায় ডুবে সেইসব নিয়েই ভেবে গেলো। অবশেষে বুঝতে পারলো, চাঁন মিয়াই যে গাজীপুরে গেছিলো সিএনজি নিয়ে সেটা প্রমাণ করতে পারলেই সব জটিল হিসেবের সমীকরণ মিলে যাবে। পাজলের বাকি টুকরোগুলো তখন মিলে যাবে আপনাআপনিই।
কিন্তু এ কাজটা কিভাবে করা যাবে?
দুচোখ বন্ধ করে গভীর নিঃশাস নিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো সে। প্রাচীন ভারতের যোগিদের এই টেকনিকটা আসলেই কার্যকরি। চিন্তাভাবনা স্থিত করতে, গভীর ধ্যান করতে এর জুরি নেই। এ জীবনে বহুবার সে এমন গোলকধাঁধাতুল্য রহস্যের সমাধান করেছে। কূলকিনারা করতে না পারলে বার বার চেষ্টা করে দেখেছে, হাল ছেড়ে দেয়নি কখনও।
অনেকক্ষণ ভেবে যাবার পর আশার আলো দেখতে পেলো সে।
একেবারে শুরু থেকে শুরু করতে হয়।
এই অপ্তবাক্যটি মিসকাত হত্যারহস্যের তদন্তের সময় ভুলে গছিলো। সে-কারণে শুরুটা ভুলভাবে করেছে। সে ধরেই নিয়েছিলো এই রহস্যের শুরু হয়েছে গাজীপুর থেকে-আসলে ওটার শুরু হয়েছে বাইকার বাবুর অ্যাকসিডেন্ট এবং তাকে সিএনজিতে করে মেডিকেলে নিয়ে যাবার পর থেকে।
আক্ষেপে নিজেকে ভর্ৎসনা করলো চারু। তবে সে জানে, খুব বেশি দেরিও হয়ে যায়নি।
চাঁন মিয়ার সিএনজিটা যদি মেডিকেলের ইমার্জেন্সিতে বাবুকে নিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে তার নিশ্চয় সাক্ষিও আছে। যদিও ডিবি-পুলিশ সিসিক্যাম নেই বলে হাল ছেড়ে দিয়েছে, কিন্তু চারু জানে ওখানে সব সময় আরো অনেক মানুষজন থাকে, আর তাদের মধ্যে নিশ্চয় কেউ না কেউ দেখেছে।
একটা সম্ভাবনার কথা ভাবতেই বেশ আশাবাদি হয়ে উঠলো চারু। ঠিক করলো কাল সকালে প্রথম কাজ হবে সেটা খতিয়ে দেখা।
আরেকটা বিষয় নিয়েও ভেবে দেখলো। মিসকাতের মাকে কিভাবে সতর্ক করে দেয়া যায়। তার কাছে মনে হচ্ছে, এমপিকে আসুলে ডিবি অফিসারের মাধম্যেই সাবধান করে দিলো ভালো হয়। মহিলা এ নিয়ে কোনো সন্দেহ করবে না তাহলে। আর বিষয়টাও গুরুত্বসহকারে নেবে।
“ঘুমাচ্ছো নাকি?”
চারুর ধ্যান ভাঙালো কথাটা শুনে। চোখ খুলে দেখলো তার রুমমেট বন্ধু আশফাঁক দাঁড়িয়ে আছে। “না…একটু চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম।
“ও,” আশফাঁক শুধু এটাই বলল।
“বসো, বিছানায় উঠে বসলো চারু।
“না। বসার দরকার নেই। একটা কথা বলতে এসেছিলাম।”
“বলো।”
“সামনের সপ্তাহে ফ্রি থেকো।”
“কেন? ব্যাচেলর পার্টি দেবে নাকি?”
“হুম। বলতে পারো ঐ রকমই…আমার অফিসের কিছু কলিগও থাকবে, আর তুমি। বেশি মানুষজনকে বলিনি।”
চারু মনে মনে হেসে ফেলল। তার এই বন্ধু ইচ্ছে করলেও বেশি মানুষকে বলতে পারবে না। কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে চারু ছাড়া আর কারো সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি। গড়ে না ওঠার কারণ আশফাঁকের অন্তর্মুখি চরিত্র নাকি ক্লাসমেটদের করা তার নামের বিকৃতি ‘অ্যাজফাক,’ চারু জানে না।
অন্যের ব্যাপারে খুব বেশি কৌতূহল নেই আশফাঁকের। একেবারে বিশুদ্ধ কর্পোরেট এক্সিকিউটিভের চরিত্র সযতনে গড়ে তুলেছে ছাত্রজীবন থেকেই। বেশিরভাগ পুরুষমানুষই হাতেগোনা তিনটি স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে ওঠে-গাড়ি, বাড়ি, নারী। তার রুমমেটের অবস্থাও তাই। জীবনে তিনটি স্থূল লক্ষ্য নিয়ে সে এগিয়ে চলেছে কপোরেট অফিসের চাকরি পাবার মধ্য দিয়ে। নারী আর গাড়ি করায়ত্ত করে ফেলেছে এরইমধ্যে। বাকি আছে বাড়ি। চারুর ধারণা, অচিরেই সে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে। শুনেছে, তার শশুড় নাকি তিনটি বাড়ির বালিক, অথচ এক ছেলে আর এক মেয়ের জনক। সুতরাং একমাত্র মেয়ে একটা বাড়ি পাবেই পাবে।
“কোথায় করবে…মানে, কোথায় কি খাওয়াবে?” হালকাচালে জানতে চাইলো চারু।
“এখনও ঠিক করিনি। এক কলিগকে দায়িত্ব দিয়েছি, ও আগের দিন ঠিক করে জানিয়ে দেবে। ওয়াইন আর হুইস্কি থাকছে কিন্তু।”
ভুরু কপালে তুলল চারু। “দারুণ!”
“রাত আটটার পর, ঠিক আছে?”
“হুমম।”
রুমমেট চলে যেতে উদ্যত হবে, কী মনে করে যেন ঘুরে দাঁড়ালো। “ভালো কথা, তুমি নাকি বেশ ভালো একটা চাকরি পেয়েছো? কোন ফার্মে? পোস্ট কি? কিছুই তো শেয়ার করলে না।”
হেসে ফেলল চারু। “কোনো ফার্ম না। পোস্ট…উমমম…পোস্ট টোস্টও নেই।”
“বলো কী!” অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো আশফাঁক। “ফাজলামো করো নাকি আমার সাথে!”
“আরে না, সত্যি বললাম। অদ্ভুত চাকরি। তুমি ওসব বুঝবে না।”
কাঁধ তুলল রুমমেট। “পোস্ট-পজিশন না থাকলে প্রমোশন আর ইনক্রিমেন্ট কিভাবে হবে? ফিউচার কি এরকম চাকরির?”
হাসতে হাসতে মাথা দোলাল চারু। “বললাম না, অদ্ভুত চাকরি। এসব নিয়ে ভেবো না। আমি আমার মতো ভালোই আছি।”
“হুমম, “ কিছু না বুঝেই বলল তার বন্ধু। “বেতন-টেন ঠিকমতো দেয় তো?”
“তা দেয়,” আস্তে করে বলল সে।
“দিলেই ভালো,” কথাটা বলে কয়েক মুহূর্ত চুপ মেরে রইলো।
মনে মনে প্রমাদ গুণলো চারু। সে জানে, এরপর কতো বেতন পায় সেটাও জিজ্ঞেস করবে নির্ঘাত। এসব নিয়ে কথা বলতে তার একদম ভালো লাগে না। এসব কথা যারা বলে বেড়ায় আর যারা এসব জানতে চায়-দুই প্রজাতিকেই তার ভীষণ করুণা হয়।
“বাড়িওয়ালা বলল, আমি চলে যাবার পরও এই ফ্ল্যাটটা ছাড়ছো না,..ভাড়াটারা দিতে পারবে তো?”
সরাসরি বেতনের কথা না বলে একটু ঘুরিয়ে বলায় চারু তার বন্ধুর ডিপ্লোমেটিক সেন্সের প্রশংসা না করে পারলো না।
“সমস্যা হবে না। তুমি এ নিয়ে ভেবো না তো,” কথাটা বলেই প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করলো, “তোমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান কবে করছো?”
“সম্ভবত ডিসেম্বরে।”
“তাহলে তো খুব বেশি দেরি নেই। নভেম্বর তো এসেই গেছে।”
“হুম। বিয়েতে কিন্তু থাকতেই হবে। কোনো অজুহাত দেখানো যাবে না।”
“অবশ্যই। তোমার বিয়েতে আমি যাবো না…কী বলো!”
মাপা হাসি দিলো রুমমেট। “ওকে, যাই…ঘুমাবো। খুব সকালে আবার উঠতে হবে। কালকে ঢাকার বাইরে যাবো অফিসের কাজে। গুড নাইট।”।
“গুড নাইট।”
বন্ধু চলে যাবার পর মনে মনে হেসে ফেলল চারু আহসান। কারণ এই প্রথম বিয়ে নিয়ে একটা ভাবনা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে। সে-ও একদিন বিয়ে করবে আর সবার মতো?
যদিও জ্ঞান হবার পর থেকে কখনও, সজ্ঞানে কিংবা অবচেতনে বিয়ে নামক বন্ধনের কথা সে ভাবেনি। আর সেজন্যেই বােধহয় কোনাে সম্পর্কেও জড়ায়নি কখনও। ইঙ্গিত পেয়েছে, ইশারাও পেয়েছে, কখনও কখনও সে নিজেও খানিকটা ঝুঁকে পড়েছে কারাের প্রতি, মনের গহীনে একটা ইচ্ছে জেগে উঠেছে, কিন্তু সম্পর্কের বন্ধনে জড়িয়ে পড়েনি।
মাথা থেকে বিয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে দুচোখ বন্ধ করে ঘুমানাের চেষ্টা করলাে এবার। কাল সকালে নতুন করে শুরু করতে হবে। যেখান থেকে শুরু সেখানে যেতে হবে তাকে।