ট্রেনে চেপে খুলনা, তারপর স্টিমার। বাদলটা এমন বোকারাম, ট্রেনে উঠেই ঘুমিয়ে পড়ল, কিছুই দেখতে পেল না। ওর দিদি সান্ত্বনা ওকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কত বার জাগানোর চেষ্টা করল, কিন্তু ছেলের হুশ নেই। স্টিমারে উঠে অবশ্য সে জেগে রইল আগাগোড়া।
খুব কম বয়সে বাদল এই পথ দিয়েই এসেছিল কলকাতায় কিন্তু সে সময়কার কথা তার বিশেষ কিছুই মনে নেই। এখন তার যা বয়স, তা সবকিছু দেখেই অবাক হবার মতন। শব্দ, বর্ণ, ঘ্রাণ এই সবকিছুরই মূল্য আছে। মনের মধ্যে কোনও শূন্যতাবোধ নেই–এখন নিজেকে পূর্ণ করার সময়। এক একটা দৃশ্য বুকের মধ্যে গাঢ় ছাপ ফেলে দিয়ে যায় কত ছোটখাটো জিনিস মুগ্ধতার বাহন হয়ে আসে।
এই নদীর নাম পদ্মা, এর কাছে এলেই মনটা গম্ভীর হয়ে যায়। অধিকাংশ জায়গাতেই ওপার দেখা যায় না। কোথাও মাঝখানে বিরাট চড়া পড়ে আছে, তবু এই নদী দু চোখ ভরিয়ে দেয়। পালতোলা নৌকো ঠিক যেন ছবির মতন, অর্থাৎ সুন্দর ছবির মতন আস্তে আস্তে দূরে মিলিয়ে যায় আবার অন্যরা আসে।
এক জায়গায় চড়ার ওপর একটা কুমির তার ছানাপোনা নিয়ে রোদ পোয়াচ্ছে–তাই দেখে বাদল দারুণ উত্তেজিত। তক্ষুনি ছুটে গিয়ে দিদিকে গিয়ে বলতেই সেও এল দেখতে। কিন্তু কুমিরগুলো এর মধ্যেই জলে নেমে পড়েছে। সান্ত্বনা কিছুতেই বিশ্বাস করে না। বাদল ইদানীং বানিয়ে বানিয়ে অনেক কথা বলে, সুতরাং বিশ্বাস না করা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সত্যি কথা শুনেও কেউ বিশ্বাস না করলে খুব মনখারাপ হয়ে যায়। বাদল সান্ত্বনার সঙ্গে ঝগড়া শুরু করে দিল।
স্টিমারে বেশ ভিড়। মানুষজনের ফাঁক দিয়ে গলে গলে বাদল এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছে। বাবা-মায়ের নিষেধ সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বাদল একা একা নীচে নেমে যায়, ইঞ্জিনঘরের কাছে উঁকিঝুঁকি মারে–এমনকী ফার্স্ট ক্লাসের কেবিনের কাছেও অবাধ গতি।
সেখানেই বাদল দেখতে পেল হৈমন্তীকে। রেলিং ধরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে এক দীর্ঘকায় নারীমূর্তি। চুলগুলো ভোলা, শাড়ির আঁচলখানা উড়ছে পতাকার মতন। দূর থেকে প্রথম দেখে বাদল ঠিক বিশ্বাস করতে পারল না। এ-পাশ থেকে একবার ও-পাশ থেকে আর এক বার দেখল। হৈমন্তী কাকিমা রেণুদের বাড়ি থেকে একদিন কোথায় চলে গিয়েছিলেন, তারপর আর তার খবর কেউ জানে না। বড়রা ওদের কাছে বলতেন, হৈমন্তী হারিয়ে গেছে। বাদল আর বিষ্ণু দারুণ ভালোবাসত হৈমন্তী কাকিমাকে, ওরা প্রতিজ্ঞা করেছিল, বড় হয়ে ওরা তাকে খুঁজে বার করবে।
সেই হৈমন্তী কাকিমা, এখানে এই স্টিমারে জলজ্যান্ত দাঁড়িয়ে আছেন? বাদল এক ছুট্টে কাছে গিয়ে ডাকল, হৈমন্তী কাকিমা?
হৈমন্তী ঘুরে দাঁড়ালেন। প্রথমটায় চিনতে পারলেন না। ভুরু কুঁচকে একটুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ও তুই? তুই এখানে কী করছিস?
বাবা-মার সঙ্গে মামাবাড়িতে যাচ্ছি।
কত বড় হয়ে গেছিস। চিনতেই পারছিলুম না, তোর নাম কী যেন।
হৈমন্তী কাকিমা তাকে এত ভালোবাসতেন, আর তিনি এখন ওর নামটাই ভুলে গেছেন–এতে বাদলের মনে একটা আঘাত লাগল।
হৈমন্তী বললেন, দাঁড়া, বলিস না, আমি মনে করছি। মনে পড়েছে। তোর নাম তো সূর্য।
সে তো আমার দাদার নাম।
হ্যাঁ তাই তো। তোর নাম তা হলে বাদল। বেশ নাম তোদের দুই ভাইয়ের। সূর্য আর বাদল! রোদ্দুর আর বৃষ্টি।
আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
আমি ঢাকা যাচ্ছি। তোর মামার বাড়ি কোথায়?
মনিকডাঙা।
সে আবার কোথায়?
হৈমন্তী বিশেষ বদলাননি এই ক’ বছরে। বড় বড় দুটি চোখে শিশুর সারল্য। এই রমণীর স্বামী এঁকে অনাদর করে অপর নারীর কাছে বদ্ধ হয়েছিলেন। হৈমন্তীর নিয়তি। ছিল সারা জীবন সেই বনেদি বাড়ির অন্দরমহলে বন্দি থেকে সবকিছু সহ্য করা। হৈমন্তী
তা মানেননি, বেরিয়ে পড়েছেন বাইরে। হৈমন্তীর কপালে এখনও সিঁদুর।– হৈমন্তী রেণু কিংবা বিষ্ণু বা ও-বাড়ির কারওর কথা জিজ্ঞেস করলেন না। বাদলকে দেখে তিনি খুশিই হয়েছেন বোঝা যায়। বাদলের কাঁধে হাত দিয়ে বন্ধুর মতন গল্প করতে লাগলেন। নদীর হু-হুঁ করা জোলো হাওয়ায় হৈমন্তীর সুন্দর মুখশ্রী আরও অপরূপ। দেখায়। তাঁর বাহুর ডৌল, ভরাট বুক, চিবুকের রেখা–এ-সবকিছুর মধ্যেই একটা মাদকতা আছে। এগারো বছরের ছেলেকেও সেই মাদকতা হাতছানি দেয়। বাদলের মনে হল, হৈমন্তী কাকিমার গায়ে কী সুন্দর গন্ধ। হৈমন্তী কাকিমার চেয়ে চমৎকার পৃথিবীতে আর কেউ নেই।
হৈমন্তী বললেন, আয়, একটা জিনিস খাবি?
হৈমন্তী বাদলকে নিয়ে গেলেন কেবিনের মধ্যে। সেখানে টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে চেয়ারে বসে একজন লোক একটা বই পড়ছেন। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। বাদলকে দেখে তিনি কোনও কথা বললেন না, শুধু হৈমন্তীর দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচালেন।
হৈমন্তী বললেন, এ হল বাদল। আমার দ্যাওরের ছেলে বিষ্ণু? তার বন্ধু।
লোকটি চশমাটা টিপে ধরে কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, খোকা, তোমার সঙ্গে তোমার মা-বাবা আছেন?
হ্যাঁ।
তিনি এবার হৈমন্তীকে বললেন, তুমি দেখা করবে?
করতে পারি।
লোকটি হৈমন্তীকে ইংরেজিতে খানিকক্ষণ কী যে বললেন, বাদল বুঝতে পারল না। হৈমন্তী উত্তরে বললেন, আমার কিছু যায় আসে না।
লোকটি এবার হেসে বললেন, তুমি যেখানে যাও, তোমার ঠিক একটা করে বাচ্চা ছেলে বন্ধু জুটে যায়।
বাচ্চারাই একমাত্র আমাকে ভালোবাসে। আর কেউ ভালোবাসে না।
লোকটি আবার বইতে চোখ ফেরালেন। সেই দিকে চোখ রেখেই বললেন, আমিও তো বাচ্চা। ভেতরে ভেতরে বাচ্চাই রয়ে গেছি।
ওরা কথা বলছিলেন হাসিমুখেই। কিন্তু বাদলের মনে হয়, এ সব দুঃখের কথা। বড়রা প্রায়ই এ রকম দুঃখের কথা বলে।
লোকটিকে বাদলের মোটামুটি পছন্দই হল। ছোট ছেলেরা অচেনা লোক দেখলেই তাকে পছন্দ-অপছন্দ করার ব্যাপারটা তৎক্ষণাৎ ঠিক করে নেয়। কারওর সঙ্গে তারা কথা বলা পছন্দ করে। কারওর সঙ্গে কথা বলতেই চায় না। বাদল নিজে থেকেই লোকটিকে জিজ্ঞেস করল, এই ইস্টিমার আর কতক্ষণ চলবে?
লোকটি বলল, কেন খোকা, তোমার খারাপ লাগছে? তা হলে তো তুমি কোনও দিন নাবিক হতে পারবে না?
না, আমার খুব ভালো লাগছে। বাবা বলেছেন, আমাদের সাড়ে দশটার সময় নামতে হবে।
তা হলে আর তোমাদের বেশি দেরি নেই।
হৈমন্তী কাগজের বাক্স থেকে অনেকগুলো ছোট ছোট কেক বার করে বাদলকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই কোনটা কোনটা নিবি?
কোনও কেকের ওপর প্রজাপতি, কোনওটার ওপর ফুল বা মাছ আঁকা, নানা রঙের। বাদল লজ্জা পেয়ে বলল, যে-কোনও একটা–তুমি তুলে দাও।
লোকটি বলল, পুরো বাক্সটাই ওকে দিয়ে দাও না। তুমি তো খাচ্ছ না।
হৈমন্তী তার থেকে একটা বার করে বাক্সটা সুতো দিয়ে বেঁধে বললেন, একটা এখন খেয়ে নে, বাক্সটা নিয়ে যাবি।
বাদল পুরো বাক্স কিছুতেই নেবে না, লজ্জায় তার কান লাল হয়ে যাচ্ছে। হৈমন্তী শেষ পর্যন্ত এক ধমক দিয়ে বাক্সটা জোর করে তার হাতে গুঁজে দিলেন। তারপর বললেন, আয়, আমরা বাইরে গিয়েই দাঁড়াই। সুরঞ্জন, তুমি আসবে?
তোমরা যাও। আমি বইটা ছাড়তে পারছি না।
কেকের তলার কাগজটা জলে ফেলে দিলে সেটা ভাসতে ভাসতে অনেক দূর যায়। একটা নৌকো থেকে একজন লোক খুব চেঁচিয়ে কী যেন বলছে–কিছুই বোঝা যাচ্ছে না তার কথা–শুধু শোনা যাচ্ছে, এ-এ এ শব্দ। একটা মাছরাঙা পাখি ঝুপ করে জলে পড়েই আবার উঠে গেল।
কিছুক্ষণ বাদে স্টিমারের গতি কমে এল। কোথাও থামবে। হৈমন্তী বললেন, এবার মা’র কাছে যা। নইলে চিন্তা করবেন। তোরা আবার কবে ফিরে যাবি?
তা তো জানি না।
আমরা ফিরব এক মাস বাদেই। ফেরার সময় আবার এই স্টিমারে তোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে বেশ হয়, নারে?
তুমি কলকাতায় কোথায় থাকো? তুমি তো হারিয়ে গিয়েছিলে।
দূর পাগল! হারিয়ে যাব কেন? আমি এখন এলাহাবাদে থাকি।
চিররঞ্জন আর হিমানী রীতিমতো ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন বাদলের জন্য। সান্ত্বনা আর চিররঞ্জন দু’ দিকে খুঁজে এসেছেন এর মধ্যে। মূর্তিমানকে ফিরতে দেখে চিররঞ্জন এক ধমক দিলেন।
হিমানী বললেন, তোর হাতে ওটা কী?
কেক। হৈমন্তী কাকিমা দিলেন।
তিনি আবার কিনি?
বাদলের মা বিষ্ণুদের বাড়িতে কয়েক বার গেছেন বটে, তবে রেণুর মা ও বিষ্ণুর মায়ের সঙ্গেই তার বেশি পরিচয়। হৈমন্তীকে তিনি দু’-এক বার দেখেও থাকতে পারেন। কিন্তু কোনও কেলেঙ্কারির ঘটনাই মেয়েদের অজানা থাকে না। হৈমন্তীর গৃহত্যাগের ঘটনা তিনি সবিস্তারেই জানেন। সেই হৈমন্তীর সঙ্গেই বাদলের দেখা হয়েছে বুঝতে পেরে তিনি একই সঙ্গে দারুণ কৌতূহলী এবং ক্রুদ্ধ হলেন। কুলটা রমণীর বর্তমান অবস্থাটা একবার চোখে দেখার কৌতূহল–এবং ওর সঙ্গে বাদল কথা বলেছে বলে রাগ।
চিররঞ্জন বার বার জিজ্ঞাসা করছেন, কে, কে? কিন্তু হিমানী পুরোপুরি সব বলতে পারছেন না। মেয়ে বড় হয়েছে, মেয়ের সামনে এসব কথা বলা যায় না। সুতরাং তিনি আরও বেশি রেগে উঠে বললেন, তুই নিতে গেলি কেন?
আমাকে জোর করে দিয়েছেন। জোর করে কেউ দেয়? তোকে বলেছি না, কেউ কোনও জিনিস দিলে নিবি না? হ্যাংলা ছেলে হয়েছ একটা।
সত্যি আমি নিতে চাইনি। জোর করে—
যা ফেলে দিয়ে আয়।
বাদলের কেঁদে ফেলার অবস্থা। যে-কেকটা খেয়েছে, তার স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে–এত ভালো। সে ভেবেছিল, দিদিকে দেখিয়ে কৃতিত্ব নেবে। কিন্তু হিমানী না ফেলিয়ে ছাড়লেন না কিছুতেই বাদলকে হুকুম করলেন বাক্স সুন্ধু জলে ফেলে দিতে। চিররঞ্জন পর্যন্ত সামান্য আপত্তি তুলে বললেন, একেবারে ফেলে দেবার দরকার কী। এক পাশে থাক না–গরিব দুঃখীরা খাবে। হিমানী তাতেও রাজি নন। ভ্ৰষ্টা রমণীর দেওয়া জিনিস জলে ফেলে না দেওয়া পর্যন্ত তাঁর শান্তি নেই।
স্টিমার থেকে নামবার সময় বাদল একবার মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। হৈমন্তী তখনও রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সেই হাওয়ার মধ্যে। বাদল মুখ ফিরিয়ে নিল সঙ্গে সঙ্গে। লজ্জায় তার শরীর অবশ হয়ে যাবার মতন অবস্থা। হৈমন্তী কাকিমা কি বুঝতে পেরেছেন? আর কোনও দিন সে হৈমন্তী কাকিমার কাছে মুখ দেখাতে পারবে না।