৩০. টেবিলের উপরে টিফিন কেরিয়ার

টেবিলের উপরে টিফিন কেরিয়ার থাকার কথা।

টিফিন কেরিয়ার নেই। আতাহার ঘড়ি দেখল। বারোটা বাজতে এগারো মিনিট। এত রাতে নিশ্চয়ই টিফিন কেরিয়ার নিয়ে কেউ আসবে না। খাবার পাঠাতে কি ভুলে গেছে। ভুলে যাওয়াটা অস্বাভাবিক না। ধরে নেয়া যেতে পারে আতাহারের বড় মামার বাড়িতে দৈনন্দিন কাজের একটা অলিখিত তালিকা আছে। টিফিন কেরিয়ারে করে আতাহারকে খাবার পাঠানোর কাজটা তালিকায় একেবারে শেষের দিকে। যার উপর দায়িত্ব সে সম্ভবত জ্বরে পড়েছে। কিংবা ছুটি নিয়ে দেশের বাড়িতে গেছে।

বেছে বেছে আজকের দিনেই ক্ষিধেয় আতাহারের নাড়িভূড়ি উল্টে আসছে। দোকানপাট এখনো কিছু কিছু খোলা। গোটা দুই কলা কয়েকটা বিসকিট এবং এক কাপ চা খেয়ে এলে হয়। সেটাও সম্ভব না। পকেটে কিছু নেই।

আজ নিয়ে তিন দিন সে শূন্য পকেট নিয়ে ঘুরছে। একটা লাভ হয়েছে সিগারেট খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। আজ সারা দিনে মাত্ৰ দুটা সিগারেট খাওয়া হয়েছে। তৃতীয় সিগারেটটা পাঞ্জাবির পকেটে আছে। রাতের খাবার পর আয়েশ করে বিছানায় শুয়ে ধরাবে এমন পরিকল্পনা ছিল। পরিকল্পনার দ্বিতীয় অংশ আয়েশ করে সিগারেট ধরানোটা করা যাবে। প্রথম অংশ খাওয়া দাওয়া বাদ দিতে হবে।

কোন একটা দোকানে গিয়ে দরদাম করে দুটা কলা কিনে সেখানেই তাৎক্ষণিকভাবে ছিলে খেয়ে ফেলা যায়। কলা খাওয়া হয়ে যাবার পরে পকেটে হাত দিয়ে আঁৎকে উঠে বলতে হবে–সর্বনাশ মানিব্যাগ গন। এই সব কাজ মজিদ ভাল পারত। তার অভিনয় প্রতিভা ছিল তুলনাহীন। তার কাব্য প্রতিভাও তুলনাহীন। সে এখন কবিতার জগৎ থেকে নির্বাসিত। তার বিয়ের কার্ড এসেছে। কার্ডের সঙ্গে ছোট চিরকুট–

দোস্ত,
কার্ড দেখে বুঝতে পারছিস বিয়ে করছি। খবৰ্দার বিয়েতে আসবি না। হাত জোড় করছি। সাজ্জাদও যেন না আসে। ওকে আমি বিয়ের কার্ডও পাঠাইনি। কবিতার জগৎ থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছি, রক্তমাংসের কবিতা আমার কাছে অনেক আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে। প্রতিজ্ঞা করেছি দুই দেবীর আরাধনা করব না। পুরানো লেখাও সব ছিড়ে ফেলেছি। দোস্ত খবৰ্দার তোরা বিয়েতে আসবি না।
ইতি মজিদ

মজিদের বিয়ের কার্ডটা সুন্দর। সাধু ভাষায় লেখা ভাব গম্ভীর নিমন্ত্রণ পত্র।

আল্লাহ পাকের অসীম মেহেরবানীতে–আগামী ৮ই পৌষ ২৯শে রজব রোজ শুক্রবার বাদ জুমা এজিন কাবিনের দিন ধার্য্য হইয়াছে…

আতাহার বিছানায় শুয়ে পড়ল। ক্ষিধে ক্ৰমেই বাড়ছে। ক্ষুধার্ত অবস্থায় শুয়ে থাকলে ক্ষিধে কম লাগে কারা যেন কথা? মজিদের। ক্ষুধা বিষয়ে মজিদের অনেকগুলি আবিষ্কার আছে। ক্ষুধা নষ্ট করা বিষয়ক র। তার মধ্যে আছে–

১। প্রচণ্ড ক্ষুধায় গলায় আঙ্গুল দিয়ে বমি করার চেষ্টা চালাতে হবে। সামান্য বমি হলে সারাদিনের জন্য ক্ষিধে নষ্ট হবে।

২। প্রচুর লবণ দিয়ে আধ ছটাক বাদাম খেতে হবে। এর মধ্যে কয়েকটা অবশ্যই খোসা শুদ্ধ।

৩। প্রচুর পরিমাণ চা এবং প্রচুর পরিমাণে জৰ্দাসহ পান খেলেও ক্ষিধে নষ্ট হবে। তবে এই পদ্ধতি বিপদজনক, এতে মুখের ভেতরের চামড়া পুড়ে যায়।

প্রতিটি পদ্ধতি মজিদের পরীক্ষিত। এখন মনে হচ্ছে এ জীবনে তাকে আর ক্ষিধে নষ্ট করার কোন পরীক্ষা করতে হবে না। তার ক্ষিধে পেলেই সবুজ চুড়ি পরা স্নিগ্ধ দুটা হাত তাকে ভাত বেড়ে দেবে। গোল গোল চাকা করা বেগুন গরম গরম ভেজে তার উপর এক চামচ গাওয়া ঘি ঢেলে দেবে। মজিদ। তখন হয়ত রহস্য করে বলবে, ও বউ, আমার ডান হাতে কি যেন হয়েছে। হাত নাড়াতে পারছি না। কি সমস্যায় পড়লাম বল দেখি। বউ মুখ টিপে হাসতে হাসতে বলবে, তুমি বড় যন্ত্রণা করা। আচ্ছা যাও হা কর, খাইয়ে। কে কোন ফাকে দেখে কি সব ছড়াবে।

ছড়াক যার যা ইচ্ছা–আমি তব মালঞ্চের হব মালাকার।

মানে কি?

মানে হল আমি তোমার দাসানুদাস।

হয়েছে দাস হতে হবে না। কপি কপি করে গিলবেনাতো। ভালমত চিবিয়ে খাও।

ভাত খাবার ফাঁকে আচার হিসাবে ছোট্ট একটা চুমু কি খেতে পারি?

ফাজলামী করবেনাতো। তোমার এইসব ফাজলামী অসহ্য লাগে।

 

আতাহার পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেট বের করে সবধানে টেবিলের উপর রাখল। তার জীবনের শেষ সঞ্চয় নষ্ট যেন না হয়।

পরিমল বাবু বললেন, ভাই একটা রিকোয়েস্ট–ঘরের ভিতর সিগারেট খাবেন না। দয়া করে বাইরে গিয়ে খাবেন।

জ্বি আচ্ছা। আজ। আপনার কাশি এখনো শুরু হয়নি, ব্যাপারটা কি?

পরিমল বাবু দুঃখিত চোখে তাকালেন। আতাহার বলল, কাশি শুরু না হওয়ায় সব কেমন এলোমেলো লাগছে। নাটক শুরু হয়ে গেছে। অথচ আবহ সংগীত নেই।

ভাই রসিকতা করবেন না। মানুষের যন্ত্রণা, রোগ ব্যাধি নিয়ে রসিকতা করতে নেই। ভগবান বিরক্ত হন। আজ। আপনার খাওয়া দিয়ে যায় নি?

মনে হয় ভুলে গেছে। বাঙ্গালী বড়ই বিস্মৃতি পরায়ণ জাতি। এরা সব কিছু দ্রুত ভুলে যায়।

আপনার ক্ষিধে লাগেনি?

লেগেছে। তবে ক্ষুধা জয়ের কিছু মন্ত্র আমার জানা আছে। আমার বন্ধু মজিদ এই বিষয়ে বিস্তর গবেষণা করেছে। মন্ত্রগুলির সেই হচ্ছে জনক। তার মন্ত্র ব্যবহার করে আপাতত সুখে নিদ্রা যাব।

আমার টিনের কৌটায় মুড়ি আছে, খাবেন?

জ্বি-না।

খাবেন না কেন?

মুড়ি খেতে ইচ্ছা করছে না বলে খাব না।

কি খেতে ইচ্ছা করছে?

চিকন চালের গরম গরম ভাত। খুব শক্তও না, আবার নরমও না। ধোয়া উড়ছে এমন গরম। পাতের পাশে চাক চাক করে কাটা বেগুন ভাজা। বেগুন ভাজার উপর গরম ঘি এক চামচ ঢেলে দেয়া হয়েছে। ভাত এবং বেগুনের গন্ধের সঙ্গে মিশেছে, ঘিয়ের গন্ধ। পাতের পাশে গাঢ় সবুজ রঙের একটা কাচা মরিচ।

পরিমল বাবু বিছানায় শুয়ে ছিলেন। উঠে বসলেন, মুগ্ধ গলায় বললেন, আপনার কথা শুনেতো আমার নিজেরই আবার ক্ষিধে লেগে গেছে। বেগুন ভাজা দিয়ে ভাত সত্যি সত্যি খাবেন? কাছেই আমার এক আত্মীয় থাকেন। তাঁকে বললে রোধে দেবেন।

উনার কাছে কি বেগুন আছে?

বেগুন হাতীরপুলের কাচা বাজার থেকে কিনে নিয়ে যাব। হাতীরপুলের কাচা বাজারে সারা রাত শাক-সবিজ পাওয়া যায়।

না থাক।

থাকবে কেন, চলুন। আপনার খুব ক্ষিধে লেগেছে। আপনাকে দেখে মায়া লাগছে। এই জন্য বলছি।

আতাহার হাসি মুখে বলল, আমাকে দেখে যদি মায়া লাগে তাহলে দয়া করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটা সিগারেট খাবার অনুমতি দিন।

আচ্ছা খান। সিগারেট খান।

আতাহার সিগারেট ধরাল। বালিশের কাছে এয়ার মেইল স্টিকার লাগানো মনিকার চিঠি। প্রায় এক সপ্তাহ হল এই চিঠি খাম বন্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। খাম খোলা হয়নি। চিঠিও পড়া হয়নি। মনিকার চিঠি পড়তে ইচ্ছা করে না। চিঠিতে কি লেখা থাকবে জানা কথা। একগাদা হ্যাঁচোর-প্যাচোর। হ্যাচোর-প্যাচোর পড়ে কি হবে? আনন্দময় কোন চিঠি থাকলে পড়া যেত। মনিকা আনন্দের কিছু লিখতে পারে না। আতাহার নিজের অজান্তেই চিঠির খাম খুলল—

প্রিয় আতাহার,
তোদের ব্যাপারটা কি আমাকে বলবি? কি হচ্ছে না হচ্ছে আমাকে কিছুটা জানাবি না? আমিতো তোর বোন। বাবা-মা তো আমাকে মেঘনা নদীর জল থেকে তুলে আনেন নি।

মায়ের কবর কোথায় হল? জানাজায় কত লোক হয়েছিল কিছুই আমাকে জানাবি না? প্রতি দিন তোদের কথা ভাবি–এই তার প্রতিদান। তোদের কথা এত বেশি ভাবি বলেই দিন রাত তোর দুলাভাইয়ের বাক্যবান সহ্য করতে হয়।

যাই হোক এখন তোকে একটা সুসংবাদ দিচ্ছি। তোর এবং ফরহাদের ইমিগ্রেশন হয়েছে। তোদের নিজেদের তো কোন গরজ নেই দুকপি ছবি পাঠানোর কথা বললে পাঠাবি না। তিনবার চারবার মনে করিয়ে চিঠি দিতে হবে। বার্থ সার্টিফিকেটের মত সামান্য সার্টিফিকেট জোগার করতে তোদের লাগে তিন মাস। আল্লাহর অসীম মেহেরবানী এখানে একজন ভাল লইয়ার পেয়েছিলাম। উনি প্রচুর ডলার নিয়েছেন, কিন্তু কাজ ভাল করেছেন।

তোরা প্রথম কিছুদিন এসে আমার এখানেই থাকবি তারপর নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরা করে নিবি। লোকে যে বলে আমেরিকায় পথে-ঘাটে ডলার উড়ে বেড়ায় ধরতে জানলেই হল, কথাটা মিথ্যে না। সাউথ ইন্ডিয়ান এক ভদ্রলোক আমেরিকায় এসে এক অফিসে জেনিটারের চাকরি নিলেন। মেঝে ঝাড় দেন। কমোড পরিস্কার করেন। পাঁচ বছরের মাথায় ভদ্রলোক মিলিওনীয়ার হয়েছেন। তাঁর বেশ কয়েকটা ফার্স্ট ফুডের দোকান আছে। নাম হল কাপ্লাস ইটারি। ভদ্রলোকের নাম হরিকল্প। তার স্ত্রীর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। ভদ্রমহিলা অতি মিশুক। তিনি তাঁর স্বামীকে বলে একটা ব্যবস্থা করে দেবেন। বাকি আল্লাহ পাকের ইচ্ছা।

এক হাজার ডলারের একটা ব্যাংক ড্রাফট পাঠালাম। তোদের এখানে ডলার এখন কত করে? চল্লিশ করে না? যদি চল্লিশ করে হয় তাহলে প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা পাবি। এই টাকাটা তোদের দুই ভাইকে আমি ধার হিসেবে দিচ্ছি। আমেরিকা এসে শোধ করবি। এবং টাকার ব্যাপারটা যেন কোন ক্রমেই তোর দুলাভাই না জানে। টাকাটা দিয়ে তোরা ভালমত জামা কাপড় বানিয়ে আনবি। টিকিট আমি পিটিএ করে পাঠাব। ভাল কথা, আমার জন্যে ভাল কাসুন্দ আনতে পারবি? কদিন ধরে হঠাৎ কাসুন্দি দিয়ে মাছ ভাজা খেতে ইচ্ছা করছে। এখানে শ্যাডা নামের এক ধরনের মাছ পাওয়া যায়। আমাদের ইলিশ মাছের মত, তবে স্বাদ কম। তোদের খাওয়াব। আমরা এখন আর ডিফারেন্স ধরতে পারি না। তোরা নিশ্চয়ই পারবি।

ভাল কথা, মা-বাবা এই দুজনের কবরই আমি বঁধাতে চাই। কালো গ্রানাইট পাথরে বাধাতে কত খরচ পড়বে আমাকে জানাবি। কবে দেশে আসব, তাতো জানি না। এলে যেন মার কবরের একটা চিহ্ন দেখতে পাই।

ইতি তোর
মনিকা আপু

এক হাজার ডলারের ব্যাংক ড্রাফটাটা আতাহার ঘুরিয় ফিরিয়ে দেখল। সামান্য একটা কাগজ। যে কাগজে নগদ মূল্যে অনেক খানি সুখ কেনা যায়।

পরিমল বাবুর কাশি শুরু হয়েছে। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। আমেরিকায় গেলে ক্যাসেটে পরিমল বাবুর কাশি রেকর্ড করে নিয়ে যেতে হবে। ঘুমুবার আগে কাশি না শুনলে ঘুম হবে না।

খক খ্যক খকর খক। খুখু খু— খকর খকর খকর–হ হ হ খক খক খক। কাশি চলছেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *