অধ্যায় ৩০
সন্ধ্যার পর রেবার সাথে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে কিন্তু চুম্বন হয় নি। এমন নয় যে, রেবা আপত্তি করেছে, কিংবা সুযোগ পায় নি। তারা দেখা করেছিলো বেইলি রোডের একটি লাউঞ্জে । কিন্তু রেবার সাথে প্রায় দুই ঘণ্টা থাকার পরও চুমু খাওয়ার কোনো ইচ্ছে জাগে নি। মাথার মধ্যে শুধু তুর্যের নতুন পরিচয়টা ঘুরপাক খাচ্ছিলো।
বাড়ি ফিরে এসে সোজা বিছানায় চলে যায়। জুতোটা কোনোরকম খুলে সটান শুয়ে পড়ে। অন্ধকার ঘর, একদম একা। চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকে। টানা তিন ঘণ্টা। মাথার মধ্যে একটাই ভাবনা ঘুরতে থাকে শুধু।
তুর্য হোমমিনিস্টারের ছেলে!
ঠিক আছে। সেন্ট অগাস্টিনের মতো স্কুলে এরকম ভিআইপিদের সন্তানরাই পড়াশোনা করে। খবর নিলে দেখা যাবে আরো অনেক মন্ত্রী, শিল্পপতি আর ক্ষমতাবানদের ছেলেমেয়ে ওখানে পড়াশোনা করছে। কিন্তু সেন্ট অগাস্টিনের প্রিন্সিপ্যাল অরুণদা কেন এ কথাটা তার কাছ থেকে লুকালো?
পুরো ঘটনাটা একে একে সাজিয়ে নিয়ে ভেবে গেলো সে।
সেন্ট অগাস্টিনের এক জুনিয়র ক্লার্ক হাসান স্কুলের টয়লেটে খুন হয়েছে। তার ঘাড় মটকে দেয়া হয়েছে বেশ দক্ষতার সাথে । কাজটা অবশ্যই একজন পেশাদার লোকের।
হাসান খুন হবার একটু আগে স্কুলের সুকঠিন নিরাপত্তা ভেদ করে বাস্কেটবলের কোচ সেজে ঢুকে পড়ে দু’জন। লোক দুটো যে পরিচয় ব্যবহার করেছে সেটা একদম ভুয়া। কেন ঐদিন ভুয়া পরিচয় দিয়ে দু’জন লোক ঢুকবে স্কুল কম্পাউন্ডে?
উত্তরটা খুব সহজ : হাসানকে খুন করতে ।
এটা সত্যি ধরে নিলে আরেকটা প্রশ্ন জাগে । ভুয়া পরিচয়ে যারা ঢুকেছে তাদের মধ্যে কোচ পরিচয় দেয়া লোকটি কথা বলেছে তুর্য নামের এক ছেলের সাথে। জেফরি আজ বিকেলে জানতে পেরেছে, সেই ছেলেটি বর্তমান হোমমিনিস্টারের একমাত্র সন্তান। দিপ্রোর কাছ থেকে সে আরো জেনে নিয়েছে, তুর্যকে নাকি ঐ ভুয়া কোচ অ্যাঞ্জেলসস টিমে সাইন করিয়েছে। কথাটা তুর্য নিজে বলেছে তাদেরকে।
দিপ্রো নামের ছেলেটার সাথে ভাব জমিয়ে কিছু জিনিস জানতে পেরেছে জেফরি । প্রথমত, তুর্য তাদের বন্ধু হলেও ছেলেটার সাথে বাকিদের সম্পর্ক ইদানিং মোটেও ভালো যাচ্ছে না। হোমমিনিস্টার বাবার ক্ষমতার দম্ভে মাটিতে তার পা পড়ে না।
দিপ্রোর কাছ থেকে তুর্যের মোবাইল নাম্বারটা কৌশলে নিয়ে নিয়েছে সে।
এদিকে তুর্য কয়েক দিন ধরে স্কুলেও আসে না। ঠিক করে বললে, হাসান খুন হবার পর থেকেই স্কুলে আসছে না।
কেন?
তুর্যকে পাওয়া গেলে জবাবটা জানা যাবে। কিন্তু ছেলেটার মোবাইল ফোন বন্ধ। সমস্যা নেই। হোমিসাইডে গিয়ে আগামীকাল এটার ব্যবচ্ছেদ করবে । জামান থাকলে কোনো সমস্যা ছিলো না, এই কাজটা খুব সহজেই করতে পারতো সে।
যেভাবেই হোক তুর্যের নাগাল তাকে পেতেই হবে। কারণ হাসান খুন হবার আগে ভুয়া কোচ হিসেবে যে দু’জন লোক সেন্ট অগাস্টিনে ঢুকেছিলো তাদের সাথে শুধুমাত্র তুর্যেরই কথা হয়েছে।
তবে হাসানের খুনের সাথে মিলনের সংশ্লিষ্টতা কোনোভাবেই মেলাতে পারছে না। সন্দেহ নেই মিলন একজন পেশাদার সন্ত্রাসী, ভয়ঙ্কর এক লোক, কিন্তু সে কি নিছক হাসানের প্রতিবেশি? নাকি হাসানের হত্যাকাণ্ডে তার গভীর কোনো যোগাযোগ আছে?
এমনও তো হতে পারে, ঘটনাচক্রে জেফরি মিলনের ডেরায় চলে গেছিলো? পুরো ব্যাপারটাই ভুল বোঝাবুঝি!
হতে পারে।
ঠিক তখনই আধোঘুমের ভাবটা কেটে গেলে বিছানা থেকে উঠে জামাকাপড় পাল্টে হাত-মুখ ধুয়ে নিলো সে। হাসানের ডায়রিটা হাতে নিয়ে চলে গেলো বেলকনির বারান্দায় । ওখানে একটা রকিংচেয়ার আছে। সেটাতে বসে ডায়রিটা পড়তে শুরু করলো সে।
জামান সুস্থ থাকলে এই ডায়রিটা তাকেই পড়তে দিতো। ছেলেটার পড়ার অভ্যেস আছে । দুএকদিনেই এটা পড়ে শেষ করে ফেলতো সে। কিন্তু জেফরির পড়ার অভ্যেস অনেক কম। বই খুললেই চোখে ঘুম চলে আসে। তার এই ব্যাপারটা ফাদার জেফরি হোবার্টও খেয়াল করেছিলেন। মৃত্যুর আগে ফাদারের দেয়া উপদেশগুলোর মধ্যে একটা ছিলো এই পড়া নিয়ে।
খুব চমৎকারভাবে বলেছিলেন ফাদার : এ দুনিয়াতে নাকি দু’ধরণের মানুষ আছে। একদল বই পড়ে আর অন্যদল বই লেখে! এর মাঝামাঝি কেউ নেই।
তাহলে তার মতো যারা বই পড়ে না তারা কোনো মানুষই না?
মনে মনে হেসে ফেললো জেফরি । ফাদার খুব একটা বাড়িয়ে বলেন নি । আসলেই পড়াশোনার অভ্যেসটা থাকা দরকার। এর কোনো বিকল্প নেই।
রাত বারোটা থেকে ডায়রি পড়তে শুরু করলো সে। চোখে ঘুম চলে এলে মুখে পানির ঝাঁপটা মেরে এলো দুএকবার । মাঝরাতে ক্লান্তি এসে ভর করলে নিজে নিজে পানি গরম করে টি-ব্যাগ দিয়ে এক কাপ চাও খেলো, কিন্তু পড়ায় কোনো বিরতি দিলো না ।
ফজরের আজানের ঠিক আগে, ডায়রির একটা জায়গায় এসে তার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেলো। যা আশা করেছিলো তারচেয়েও অনেক বেশি কিছু আছে এই ডায়রিতে।
পুরো এক পৃষ্ঠাও হবে না, বড়জোর তিন প্যারার একটি লেখা । সেই লেখায় হাসান এমন এক ঘটনার কথা উল্লেখ করে গেছে যে, জেফরি বরফের মতো জমে রইলো কিছুক্ষণ। বার বার লেখাটা পড়লো সে, যদিও সেটা করার কোনো দরকারই নেই। হাসান বেশ সহজ সরল ভাষায় একটা ঘটনা বর্ণনা করে গেছে, অনেকটা ক্ষোভের সাথে । বিস্তারিত কিছুই লেখে নি। কিন্তু এটুকুই যথেষ্ট। তার কারণ এই ঘটনায় তুর্য নামের হোমমিনিস্টারের একমাত্র সন্তানের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
ডায়রির পাতার উপর তারিখটা দেখলো জেফরি। মাত্র সাড়ে তিন মাস আগের ঘটনা।
আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন মাস আগে সেন্ট অগাস্টিনের জুনিয়র ক্লার্ক হাসান আর হোমমিনিস্টারের আদরের দুলাল তুর্যের সম্পর্ক মোটেও ভালো ছিলো না। তাদের মধ্যে একটা জঘন্য ব্যাপার ঘটে গেছিলো সেই সময়।
ঘটনা তাহলে এই! রকিংচেয়ারে দোল খেতে খেতে ভাবলো জেফরি বেগ।
অধ্যায় ৩১
জামান হাসপাতাল থেকে রিলিজ পেয়ে বাসায় চলে গেছে। ধারণার চেয়েও দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছে সে। তারপরও কমপক্ষে এক সপ্তাহ বেডরেস্টে থাকার জন্য হোমিসাইড থেকে তাকে ছুটি দেয়া হয়েছে জেফরির সুপারিশে। জামান অবশ্য তিন-চার দিন পরই কাজে যোগ দিতে চেয়েছিলো কিন্তু জেফরি সায় দেয় নি।
জামান সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত রমিজ লস্কর তার সহকারী হিসেবে কাজ করবে।
হাসানের ডায়রিতে যে ঘটনার কথা সে জেনেছে সেটা মহাপরিচালক ফারুক সাহেবকে বলে নি। ব্যাপারটা আপাতত গোপনই রাখবে, যতোদিন না শক্ত কোনো প্রমাণ তার হাতে আসে। ভালো করেই জানে, তার বস হোমমিনিস্টারের ছেলের কথা শুনলেই ঘাবড়ে যাবে। এ নিয়ে কোনো রকম তদন্ত করতে দেবে না।
জেফরি আরো সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অরুণ রোজারিওকেও তুর্যের ব্যাপারে কিছু বলবে না। সময় হলে সব প্রকাশ করবে ।
রমিজ লস্করকে দুটো কাজ দিয়েছে জেফরি : মিলনের প্রথম স্ত্রী আম্বিয়া খাতুনের গ্রামের বাড়িতে খোঁজ নেয়া এবং তুর্যের মোবাইল ফোনটার কললিস্ট চেক করা। অবশ্য লস্করকে সে বলে নি ফোন নাম্বারটা হোমমিনিস্টারের ছেলে তুর্যের।
কাজের অগ্রগতি কততদূর হলো জানার জন্য সকাল সকাল অফিসে এসেই রমিজকে ডেকে পাঠালো সে।
সালাম দিয়ে রমিজ লস্কর জেফরির সামনের চেয়ারে বসে পড়লো । তার হাতে একটা ফাইল । সরাসরি কাজের কথায় চলে এলো লস্কর।
‘স্যার, প্রথমে আসি আম্বিয়া খাতুনের ব্যাপারে। সিরাজদিখান থানার ওসি তার নিকট আত্মীয়দের জিজ্ঞাসাবাদ করে কিছু তথ্য জানতে পেরেছে।”
“বলতে থাকো।”
“আম্বিয়া খাতুনের বেশিরভাগ রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়স্বজন থাকে ঢাকার গেন্ডারিয়ায়। গ্রামের বাড়িতে এক চাচাতো ভাই আর এক ফুফাতো বোন ছাড়া কেউ থাকে না। তাদের সাথে আম্বিয়ার তেমন যোগাযোগ নেই। এটা তারা বলেছে সিরাজদিখান থানার ওসিকে। তবে আমার মনে হয় ওরা মিথ্যে বলেছে।”
“হুম, সেটাই স্বাভাবিক,” বললো জেফরি বেগ ।
“চাচাতো ভাই জানিয়েছে আম্বিয়ার স্বামীর নাম ইসহাক আলী…” রমিজ একটু থেমে কেশে নিলো। “তবে লোকটার ডাক নাম মিলন। এ নামেই সবাই তাকে চেনে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি । “মিলন সম্পর্কে কতোটুকু জানা গেছে?”
“বলছি স্যার, পাতা ওল্টালো রমিজ। “মিলনের গ্রামের বাড়িও বিক্রমপুরে…শ্রীনগর থানায় । এক সময় জুডো-কারাতে শেখাতো। এলাকার লোকজন জানে সে ব্ল্যাকবেল্টধারী।”
বিস্মিত হলো জেফরি । “আচ্ছা!”
“দীর্ঘদিন সিনেমায় কাজ করেছে।”
“সিনেমায়?”
“জি, স্যার। ওর একটা ফাইটিংগ্রুপ ছিলো, গ্রুপটার নাম অবশ্য জানা যায় নি । অনেকদিন থেকেই নাকি সিনেমায় কাজ করছে না। বর্তমানে সে কি করে, কোথায় থাকে তার কিছুই জানে না আম্বিয়া খাতুনের চাচাতো ভাই।”
“মিলনের দ্বিতীয় স্ত্রী সম্পর্কে কিছু জানে না তারা?” প্রশ্ন করলো জেফরি ।
“বগুড়ার মেয়ে…এর বেশি কিছু জানা যায় নি, স্যার।”
“ও…ঠিক আছে, বলো, আর কি জানা গেছে।”
“স্যার, আম্বিয়া খাতুনের চাচাতো ভাই আর কিছু জানাতে না পারলেও স্থানীয় এক ইউপি মেম্বার ওসি সাহেবকে জানিয়েছে, মিলন দীর্ঘদিন থেকে জেলে আছে।”
রিভলভিং চেয়ারের দোল খাওয়া থামিয়ে দিলো জেফরি । “তাই নাকি?”
“জি, স্যার । তবে এটার সত্যতা জানা যায় নি। এ ব্যাপারে আম্বিয়া খাতুনের চাচাতো ভাইকে জিজ্ঞেস করা হলে লোকটা জানায়, কয়েক মাস আগে কোরবানির ঈদের সময় মিলন তার বউকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে এসেছিলো । তিন-চারটা গরু কোরবানি দিয়েছে। গ্রামের অনেক লোক এটা জানে।”
“ও,” একটু সামনের দিকে ঝুঁকে এলো জেফরি । “তাহলে মেম্বারের তথ্যটা সঠিক নয়…”
“তাই মনে হচ্ছে, স্যার।”
“আর কিছু?”
“আম্বিয়ার চাচাতো ভাই জানিয়েছে, মিলনের এক ছোটো ভাই আছে, সে থাকে পুরনো ঢাকার গেন্ডারিয়ায়। তার নাম দোলন।”
“গুড ।”
“এই স্যার, এর বেশি জানা যায় নি।” রমিজ লস্কর আরেকটা পৃষ্ঠা উল্টিয়ে জেফরির দিকে তাকালো । “আর যে ফোন নাম্বারটা দিয়েছিলেন সেটার কল লিস্ট চেক করেছি।”
“হুম, বলো কি পেলে।”
“আদনান খুরশিদ তুর্য নামে সিমটা রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। গত চার পাঁচদিন ধরে ফোনটা বন্ধ আছে, স্যার।”
জেফরি চেয়ে রইলো রমিজের দিকে । “সেটা আমি জানি।”
রমিজ একটা এ-ফোর সাইজের কাগজ বাড়িয়ে দিলো জেফরির দিকে। “বন্ধ হবার চব্বিশ ঘণ্টা আগে যেসব ইনকামিং আর আউটগোয়িং কল করা হয়েছে এখানে তার সবগুলোর লিস্ট আছে।”
কাগজটা হাতে তুলে নিলো জেফরি ।
ফাইলটা বন্ধ করলো রমিজ লস্কর। “আমি কি এ ব্যাপারে ফারদার ইনভেস্টিগেশন করবো, স্যার?”
জেফরি একটু ভেবে নিলো। কয়েক মুহূর্ত পর বললো, “রমিজ, আমি তোমাকে অন্য একটা কাজ দেবো । কিন্তু তার আগে তোমাকে কথা দিতে হবে, ব্যাপারটা কারো সাথে শেয়ার করতে পারবে না।”
“আপনি বললে অবশ্যই করবো না, স্যার, রমিজ দৃঢ়ভাবে বললো।
“এমন কি ফারুক স্যারকেও বলতে পারবে না।”
জেফরির মুখ থেকে এ কথা শোনার পর রমিজ লস্কর কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো তার বসের দিকে। “ঠিক আছে, স্যার। কাউকেই বলবো না,” অবশেষে বললো সে।
“গুড।”
“কাজটা কি, স্যার?” কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলো রমিজ।
“যে ফোন নাম্বারটার কললিস্ট দিলে সেটা সেন্ট অগাস্টিনের এক ছাত্রের । আমি তার বর্তমান অবস্থান খুঁজে বের করতে চাই।”
রমিজ লস্কর হতাশ হলো। একটা স্কুলছাত্রকে খুঁজে বের করার জন্য তাকে বলা হচ্ছে? তাও আবার পুরো ব্যাপারটা গোপন রাখতে অনুরোধ করছে তার বস । আজব ব্যাপার!
“এর আর এমন কি…”
রমিজ লস্করের দিকে চেয়ে রইলো জেফরি বেগ । “কিন্তু কাজটা যতো সহজ ভাবছো ততোটা সহজ না।”
“ছেলেটা কি হাসান সাহেবের খুনের সাথে জড়িত? এখন আত্মগোপন করে আছে?”
“আমি সেরকমই ধারনা করছি।”
“ওকে স্যার, নো প্রবলেম।”
“কিন্তু প্রবলেম একটা আছে, রমিজ।”
“কিসের প্রবলেম?” অবাক হলো রমিজ লস্কর।
“ছেলেটার বাবা খুবই ক্ষমতাবান, রমিজের দিকে স্থিরচোখে চেয়ে বললো জেফরি।
“আই ডোন্ট কেয়ার, রমিজ বেশ দৃঢ়তার সাথে বললো কথাটা।
“তুর্য। আদনান খুরশিদ তুর্য,” আস্তে করে বললো জেফরি ।
রমিজ লস্কর কিছু বুঝতে পারলো না। এই নামটা তো একটু আগে সে নিজেই তার বসকে জানিয়েছে । “জি, স্যার। ছেলেটা কোন ক্লাসে পড়ে?”
“ক্লাস টেন।”
“ওকে। আমি আজ থেকেই কাজ শুরু করে দিচ্ছি।”
“রমিজ?”
“জি, স্যার?”
“ছেলেটার বাবা কে জানো?”
“কে?”
“আমাদের হোমমিনিস্টার । মাহমুদ খুরশিদ!”
রমিজ লস্করের মনে হলো জেফরি বেগ তার সাথে ঠাট্টা করছে। কিন্তু সে ভালো করেই জানে কাজের সময় তার বস্ কোনো রকম ঠাট্টা-তামাশা করে না। “হোমমিনিস্টারের ছেলে?!” বিস্মিত রমিজ লস্কর বলে উঠলো ।
মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি বেগ।
“কী বলছেন, স্যার!”
অধ্যায় ৩২
বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল বরাবরের মতো একটু দেরি করে সেন্ট অগাস্টিন থেকে বের হয়ে এলো। মেইনগেটের বাইরে এসে এদিক ওদিক তাকালো ভদ্রলোক। ইদানিং রিক্সায় করে বাড়ি ফেরে না। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় অর্ধেক পথ চলে আসে, তারপর রাস্তার পাশে কোনো চায়ের দোকানে বসে এক কাপ চা খেয়ে রিক্সা নিয়ে নেয়, নয়তো আবার হাটা শুরু করে।
সেন্ট অগাস্টিন থেকে তার বাড়ির দূরত্ব খুব বেশি হলে তিন-চার মাইল। এটা তার কাছে কোনো দূরত্বই না। ছোটোবেলায় বাড়ি থেকে দশ মাইল পায়ে হেঁটে রোজ রোজ স্কুলে যেতো। আজকালকার ছেলেপুলেরা এ কথা হয়তো বিশ্বাসই করতে চাইবে না। আর সেন্ট অগাস্টিনের বড়লোকের ছেলেমেয়েরা এটাকে নির্ঘাত গাঁজাখুড়ি গল্প মনে করবে।
ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে লাগলো বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল। স্কুল থেকে বেশ খানিকটা দূরে আসার পর তার কেন জানি মনে হলো কেউ তাকে অনুসরণ করছে। পেছনে ফিরে তাকালো। না। কেউ নেই। ফুটপাতটা একেবারেই নিরিবিলি। রাস্তায় অবশ্য কিছু গাড়িঘোড়া চলছে।
হাঁটতে হাঁটতে একটা নিরিবিলি জায়গায় চলে এলো সে। তার বাম দিকে রাস্তার উপর একটা রিক্সা, অনেকটা তার পাশাপাশি চলছে। ব্যাপারটা খেয়াল করতেই বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল সেদিকে তাকালো।
রিক্সার যাত্রিকে দেখে রীতিমতো ভিমড়ি খেলো সন্ন্যাল বাবু। বরফের মতো জমে গেলো যেনো । রিক্সাটাও থেমে গেলো তার পাশে।
“কেমন আছেন, মি: সন্ন্যাল?”
জেফরি বেগের প্রশ্নটা শুনে থ বনে গেলো বাবু । কিছু বলার আগেই রিক্সা থেকে নেমে এলো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর।
“আপনি?” আড়ষ্ট ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে কথাটা বের হয়ে গেলো।
“অবাক হয়েছেন?” জেফরি এসে বিশ্বজিৎ সন্ন্যালের হাতটা ধরে করমর্দন করলো ।
“না, মানে…” বাবু আর কিছু বলতে পারলো না।
“বাসায় যাচ্ছেন নিশ্চয়?”
“হ্যাঁ।” বিশ্বজিৎ সন্ন্যালের চোখেমুখে অজ্ঞাত ভীতি জেঁকে বসেছে।
“চলুন, এক কাপ চা খাওয়া যাক,” জেফরি প্রস্তাব দিলো।
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো বাবু।
“আপনার বাসায় তো কেউ নেই। ওখানে গিয়ে কি করবেন?…তারচেয়ে বরং চা খেয়ে গল্প করা যাক, কী বলেন?”
জেফরির কথার মধ্যে অন্য রকম কিছুর গন্ধ আছে, বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল বুঝতে পারছে সেটা। এই ইনভেস্টিগেটরকে না বলা মানে সন্দেহের বেড়াজালে নিজেকে জড়িয়ে ফেলা।
“চলুন,” কথাটা বলেই বাবুর হাত ধরে রিক্সার দিকে টেনে নিয়ে গেলো জেফরি । “রিক্সায় উঠুন। সামনের কোনো ভালো রেস্টুরেন্টে বসে চা খেতে খেতে গল্প করা যাবে।”
একান্ত অনিচ্ছায় বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল উঠে পড়লো রিক্সায় ।
.
জেফরি আর বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল বসে আছে একটা রেস্টুরেন্টে। তাদের সামনে দু’কাপ চা। একটু আগে তারা এখানে এসে পৌঁছেছে। রিক্সায় যতোক্ষণ ছিলো বাবু কোনো কথা বলে নি । জেফরিও আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যায় নি। যা বলার চা খেতে খেতে ধীরেসুস্থে বলবে ।
জেফরি চায়ে চুমুক দিলেও বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল কাপটা ধরেও দেখছে না ।
“কি হলো?…চা নেন,” তাড়া দিলো জেফরি বেগ।
বাবু চেয়ে রইলো ইনভেস্টিগেটরের দিকে। “আপনি কি আমার কাছে থেকে কিছু জানতে চান?” অনেকটা ভয়ে ভয়ে বললো বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল।
“আপনার এরকম মনে হচ্ছে কেন?” চায়ে চুমুক দিয়ে বললো জেফরি।
“না, মানে…” বাবু আর বলতে পারলো না।
চওড়া হাসি দিলো জেফরি । “শুনুন বাবু, আমরা প্রফেশনাল ইনভেস্টিগেটর। আমাদের কাছ থেকে কেউ কিছু লুকালে কোনো লাভ হয় না । একটু দেরি হয়, বাড়তি কষ্ট করতে হয়, কিন্তু যা জানার তা আমরা ঠিকই জানবো ।”
“আপনি আমাকে এসব কথা বলছেন কেন?” কিছুটা অবাক হয়ে বললো বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল।
“কারণ আমি চাই না, এ মুহূর্ত থেকে আপনি কোনো কিছু গোপন করার চেষ্টা করেন।” চায়ে চুমুক দিয়ে মুচকি হাসলো জেফরি ।
“আ-আমি…”
হাত তুলে থামিয়ে দিলো সে । “আপনার চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
বাবু অনিচ্ছা সত্ত্বেও চায়ের কাপটা তুলে নিলো তবে চুমুক দিলো না ।
“আমি কিন্তু আপনার কাছে কোনো কিছু গোপন করি নি…”।
“একদিক থেকে বলতে গেলে আপনার কথাটা সত্যি।”
বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। কিছু বলতে গিয়েও বললো না।
“আপনি আসলেই কিছু গোপন করেন নি, কোনো কিছু লুকান নি।”
“তাহলে যে বললেন?”
“দোষটা আসলে আমার ।”
“আপনার দোষ মানে?”
“কারণ হোমমিনিস্টারের ছেলে তুর্য আর হাসানের মধ্যে যে ঝামেলাটা হয়েছিলো সে ব্যাপারে আমি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেসই করি নি। আর যেহেতু জিজ্ঞেস করি নি, আপনিও আমাকে কিছু বলেন নি।” কথাটা বলেই জেফরি হেসে ফেললো। সে লক্ষ্য করলো বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল প্রচণ্ড নাড়া খেয়েছে। “অবশ্য তখন আমি এই ঘটনাটা জানতামও না।”
ঢোক গিললো বাবু। পুরোপুরি নার্ভাস হয়ে গেছে। উদভ্রান্তের মতো আশেপাশে তাকালো । কী বলবে বুঝতে পারছে না।
“নিশ্চয় এখন আর বলবেন না, আপনি কিছু জানেন না?”
বিশ্বজিৎ সন্ন্যালের শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হয়ে গেলো।
“শুনুন, মি: সন্ন্যাল। এখন থেকে আপনি মিথ্যে বললে বিরাট সমস্যায় পড়ে যাবেন।” কথাটা বলেই বিশ্বজিৎ সন্ন্যালের চায়ের কাপের দিকে তাকালো সে। “মনে হচ্ছে চা খাবার রুচি হারিয়ে ফেলেছেন।”
“দেখুন, আমি একজন সামান্য ক্লার্ক-”।
“প্লিজ,” কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বললো জেফরি । “এরকম অক্ষমতার কথা বলবেন না। এরকম কথা শুনতে শুনতে আমার কান পচে গেছে।”
“আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন আমার অবস্থাটা?” আকুতি জানিয়ে বললো বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল।
“অবশ্যই বুঝতে পারছি,” কথাটা বলে বাবুর হাতের উপর একটা হাত রাখলো সে। “আর সেজন্যেই স্কুলে গিয়ে সবার সামনে আপনাকে এবং আমার ঐ বিগ ব্রাদারকে নাস্তানাবুদ করি নি।”
“আপনি একজন রেসপনসিবল মানুষ, আপনি আমাদের অবস্থাটা বুঝবেন। হোমমিনিস্টারের ছেলের বিরুদ্ধে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ কিছু বলতে পারে না।”
“অবশ্যই পারে না। আপনাদের অবস্থা আমার চেয়ে ভালো আর কে বুঝবে।”
“তাহলে আমাদেরকে এসব ঝামেলায় জড়ানো কি ঠিক হচ্ছে?”
“আপনি কি করে ভাবলেন, আমি আপনাদেরকে ঝামেলায় জড়াবো?” জেফরি তার চায়ের কাপটা শেষ করে ফেললো। “আমাকে দেখে কি কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষ বলে মনে হয়?”
বাবু অবাক হয়ে চেয়ে রইলো, কিছু বললো না ।
“না, মি: সন্ন্যাল । আমি ভালো করেই জানি, হোমমিনিস্টারের ছেলের বিরুদ্ধে এভাবে সরাসরি অভিযোগ আনা যাবে না।”
“তাহলে আমার কাছ থেকে এসব জানতে চাচ্ছেন কেন?”
“বলতে পারেন, তথ্যটা যাচাই করে দেখতে চাচ্ছি। কারণ যা জেনেছি তা যদি সত্যি হয় তাহলে এই ঘটনায় আরো অনেকেই ফেঁসে যাবে। তার মধ্যে আপনিও আছেন।”
বাবুর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। “আপনাকে এসব কে বলেছে? আর আমি কেন ফেঁসে যাবো? আমি তো কিছু করি নি।”
‘কার কাছ থেকে জেনেছি সেটা পরে বলছি,” জেফরি বললো। “তার আগে বলুন, তুর্যের সাথে হাসানের ঘটনাটা আপনি কতোটুকু জানেন? আর আপনি নিজে কতোটুকু জড়িত ছিলেন তাতে?”।
বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল ঢোক গিলে চেয়ে রইলো জেফরি বেগের দিকে।
অধ্যায় ৩৩
রমিজ লস্কর প্রথমে ভিমড়ি খেলেও জেফরির কথামতো কাজে নেমে পড়েছে। হোমমিনিস্টারের ছেলেই হোক আর প্রেসিডেন্টের নাতি, তার কি? ঝড়ঝাঁপটার সবটাই যাবে তার বসের উপর দিয়ে।
জেফরি বেগ তাকে আশ্বস্ত করেছে, তার কোনো সমস্যা হবে না। সে জানে, ইনভেস্টিগেটর বেগ যখন কথা দিয়েছে নিশ্চিন্তে থাকতে পারে। এই লোক তার অধস্তনদের কোনো সমস্যায় ফেলবে না। দরকার হলে এক কথায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে। ডিপার্টমেন্টের সবাই এটা জানে। তাদের মতো রুটিরুজির চিন্তায় সারাক্ষণ জড়োসরো হয়ে থাকে না জেফরি বেগ।
এখন সে বসে আছে হোমিসাইডের কমিউনিকেশন রুমে। হোমমিনিস্টারের ছেলে তুর্যের ফোনকলের লিস্ট তার কাছে। সেই লিস্ট থেকে বের করতে হবে তুর্যের ঘনিষ্ঠ কোনো বন্ধু-বান্ধবকে।
তার বস্ অবশ্য বলে দিয়েছে, ভালো হয় তুর্যের প্রাইভেট টিউটরকে পেলে। ছেলেটা নিশ্চয় একাধিক টিউটরের কাছে পড়ে। প্রাইভেট টিউটর মিনিস্টারের বাড়িতে যায়। সুতরাং তুর্য কোথায় আছে সেটা জানা যাবে তার মাধ্যমে।
রমিজ এবার অন্যভাবে কাজটা করলো। তুর্যের নাম্বারে যেসব ইনকামিং এসএমএস এসেছে সেগুলো ঐ ফোন কোম্পানি থেকে একটু আগে জোগার করেছে সে।
মাত্র নয়টি এসএমএস। কিন্তু এরমধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে ।
একটা এসএমএস বাদে সবগুলোই রিটা নামের এক মেয়ের কাছ থেকে এসেছে।
তবে ওই একটা এসএমএস করা হয়েছে ‘ম্যাথ টিচার’ নামে সেভ করা নাম্বার থেকে। রমিজ লস্করের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। তার স জানতে পেলে খুশিই হবে।
এসএমএস’টা ওপেন করে পড়লো সে :
আমার আধ ঘণ্টা লেট হবে । ওকে?
এসএমএস’টা করা হয়েছে গত বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ছটায়, অর্থাৎ হাসানের খুন হবার আগের দিন ।
তুর্যের ম্যাথ টিচার!
রমিজ লস্কর মুচকি হাসলো। কাজ শুরু করার মতো একজনকে পেয়ে গেছে সে।
.
হোমমিনিস্টারের বখে যাওয়া ছেলে তুর্য। বাবা হোমমিনিস্টার হবার পর তার আচার আচরণে বিরাট পরিবর্তন আসে। কাউকে তোয়াক্কা না করার প্রবণতা দেখা যায়। ক্লাস টেনে পড়া এক ছেলে, বয়স বড়জোর পনেরো, অথচ এই বয়সেই বদমায়েশিতে হাত পাকিয়ে ফেলেছে।
আজ থেকে সাড়ে তিন মাস আগে সেন্ট অগাস্টিনে একটি নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে।
সবেমাত্র ক্লাস টেনে ওঠা আদনান খুরশিদ তুর্য তারই এক ক্লাসমেট সিমরানকে নিয়ে সেন্ট অগাস্টিনের ছয় তলার উপর নিরিবিলি এক কক্ষে গোপন কাজকারবারে ব্যস্ত ছিলো। ছয় তলার উপর সেই ফ্লোরটার কন্ট্রাকশন সবেমাত্র শেষ হয়েছে, তখনও সেটা ব্যবহার উপযোগী হয়ে ওঠে নি। ওখানকার একটা রুম স্টোররুম হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করেছে স্কুলকর্তৃপক্ষ।
তুর্য আর সিমরান সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে যায় সেই স্টোররুমে। তুর্য কিভাবে দরজার তালা খুলতে পেরেছিলো সেটা একটা রহস্য। যাইহোক, অল্পবয়সী দুটো ছেলেমেয়ে ফাঁকা একটি কক্ষে ঢুকে অ্যাডভেঞ্চারে মত্ত হয়ে পড়ে। তারা শুধু যৌনকর্মেই লিপ্ত ছিলো না, পুরো ঘটনাটি ভিডিও করছিলো মোবাইলফোনের ক্যামেরায় ।
সিমরানও এক ধনী পরিবারের বখে যাওয়া মেয়ে । ক্যামেরায় যে সঙ্গমের দৃশ্য ধারণ করা হচ্ছে সে ব্যাপারে পুরোপুরি জ্ঞাত ছিলো সে। তাদের কাছে ব্যাপারটা নিছক অ্যাডভেঞ্চার ছাড়া আর কিছুই ছিলো না।
কিন্তু বিপত্তি বাধায় হাসান।
সত্যি বলতে, নিরীহ গোবেচারা হাসান ঘটনাচক্রে এসে পড়ে সেখানে। কী একটা কাজে বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল হাসানকে ছয় তলার উপরে স্টোররুমে পাঠিয়েছিলো ।
হাসান স্টোররুমে ঢোকার আগেই লক্ষ্য করে ফ্লোরে ঢোকার যে কলাপসিবল গেট আছে সেটার তালা খোলা। অবাক হয় সে । এটার চাবি তো বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল আর তার কাছে আছে । স্টোররুমের কাছে আসতেই অদ্ভুত গোঙানির শব্দ শুনতে পায় সে।
উত্তেজনার চোটে কিংবা বেখেয়ালের কারণে দরজা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলো মিনিস্টারের ছেলে । হাসান দরজা ধাক্কা দিতেই সেটা খুলে যায় । ভেতরে ঢুকে যে দৃশ্যটা সে দেখতে পায় সেটা তার কল্পনাতেও ছিলো না।
স্কুলের দুটো অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে যৌনক্রিয়ায় মগ্ন!
হাসানকে ঘরে ঢুকতে দেখে তুর্য আর সিমরানও ভড়কে যায়। কিন্তু তাদের কিছুই করার ছিলো না। বুঝতে পারে জুনিয়র ক্লার্কের কাছে ধরা পড়ে গেছে তারা।
বিস্মত হাসান আরো লক্ষ্য করে পাশে একটা টেবিলের উপর মোবাইলফোন সেটআপ করা। সেটাতে পুরো দৃশ্যটা রেকর্ড করা হচ্ছে।
অচিন্তনীয় একটি ঘটনা।
তুর্য আর সিমরান দ্রুত জামাকাপড় পরে নিলেও ততোক্ষণে মোবাইলফোনটা কেড়ে নিয়ে নেয় হাসান। শুরু হয় হাসানের সাথে তুর্যের বাকবিতন্ডা । হাসানকে কঠিনভাবে শাসায় মিনিস্টারের ছেলে। মোবাইলফোনটা ফেরত দিয়ে দিতে বলে। শুধু তা-ই নয়, পুরো ঘটনাটি যেনো কাউকে না বলে সেজন্যে হুমকি পর্যন্ত দেয়। হাসান অবশ্য জানতো না তুর্য নামের বখে যাওয়া ছেলেটি নতুন হোমমিনিস্টারের একমাত্র সন্তান।
তুর্যের হুমকি-ধামকিতে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে যায় হাসান। এক পর্যায়ে কষে চড় মারে তাকে। হাসানের হাত থেকে মোবাইলফোনটা কেড়ে নিতে গেলে তুর্যের সাথে তার ধস্তাধস্তি পর্যন্ত হয়। কিন্তু শারিরীকভাবে হাসানের সাথে পেরে ওঠে না পনেরো বছরের তুর্য। ধস্তাধস্তির সময় সিমরান ছয় তলা থেকে দ্রুত সটকে পড়লেও তাতে কোনো লাভ হয় না। হাসানের কাছে অকাট্য প্রমাণ রয়ে যায়-তুর্যের মোবাইলফোনে ধারণ করা তাদের অপকর্মের ভিডিও।
হাসান তুর্যকে জাপটে ধরে নীচে নিয়ে আসতে গেলে ছেলেটা কোনো রকমে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে চলে যায় ।
হাসান সোজা চলে আসে বিশ্বজিৎ সন্ন্যালের কাছে। সব ঘটনা জানায় তাকে। সন্ন্যাল বাবু সব শুনে যারপরনাই বিস্মিত আর মর্মাহত হয়। তবে হাসানের মতো বাবুও জানতো না তুর্যের পরিচয়। হাজার হোক, তারা তো শিক্ষক নয়, সামান্য ক্লার্ক । ছাত্রছাত্রিদের সাথে খুব কমই তাদের দেখাসাক্ষাত হয়।
বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল সব শুনে তৎক্ষণাত হাসানকে সঙ্গে নিয়ে চলে আসে প্রিন্সিপ্যাল অরুণ রোজারিওর রুমে। রাগে ক্ষিপ্ত হাসান আর বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল সব খুলে বলে সেন্ট অগাস্টিনের প্রিন্সিপ্যালকে। ঘটনা শুনে রীতিমতো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন তিনি, কিন্তু মোবাইলফোনে ধারণ করা পর্নো ভিডিওটা দেখে চুপসে যান ।
অরুণ রোজারিও বুঝতে পারেন, হাসান আর বিশ্বজিৎ বাবু কার সম্পর্কে কথা বলছে। তিনি তাদেরকে জানান, তুর্য হোমমিনিস্টারের একমাত্র সন্তান। কথাটা শুনে হাসান আর বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল ভড়কে যায়।
ততোক্ষণে পানি অনেক দূর গড়িয়েছে। তুর্য চলে গেছে স্কুল থেকে । অরুণ রোজারিও বুঝতে পারছিলেন না তার কী করা উচিত। হোমমিনিস্টারকে ব্যাপারটা জানাবেন কিনা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না । হাসানের কাছ থেকে মোবাইলফোনটা নিয়ে নিজের কাছে রেখে দেন তিনি। বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল আর হাসানকে বলে দেন এ ঘটনা যেনো অন্য কেউ না জানতে পারে। ব্যাপারটা তিনি দেখবেন ।
কিন্তু অরুণ রোজারিও কিছু দেখার আগেই পরদিন আরেকটা বাজে ঘটনা ঘটে যায়।
স্কুল ছুটির পর বিশ্বজিৎ সন্ন্যালের রুমে ঢুকে হাসানকে পিস্তল দিয়ে ভয় দেখায় তুর্য। পিস্তলটা ছিলো তার বাবা হোমমিনিস্টারের লাইসেন্স করা। বাবার অগোচরে আলমিরা থেকে সেটা নিয়ে স্কুলে চলে আসে সে। তুর্য তার মোবাইলফোন ফেরত চায় হাসানের কাছে। ঐ সময় সন্ন্যাল বাবু ছিলো টয়লেটে। দারুণ ভয় পেয়ে যায় হাসান। তুর্যের মারমুখি আচরণে একদম অসহায় হয়ে পড়ে সে। ছেলেটাকে জানায়, তার মোবাইলফোন প্রিন্সিপ্যালের কাছে দিয়ে দিয়েছে। এ কথা শুনে তুর্য রেগেমেগে হাসানকে গুলি করতে উদ্যত হয় কিন্তু টয়লেট থেকে বের হয়ে সন্ন্যাল বাবু পেছন থেকে তাকে জাপটে ধরে ফেলে। অল্পের জন্য রক্ষা পায় জুনিয়র ক্লার্ক।
হাসান আর বিশ্বজিৎ বাবু মিলে পিস্তলসহ তুর্যকে ধরে নিয়ে আসে প্রিন্সিপ্যালের রুমে। অরুণ রোজারিও পুরো ব্যাপারটা শুনে যারপরনাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে হোমমিনিস্টারকে ফোন করেন, কিন্তু ফোনটা ধরে মিনিস্টারের পিএস। সব শুনে পিএস ছুটে আসে সেন্ট অগাস্টিনে ।
হাসান, বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল আর প্রিন্সিপ্যাল অরুণ রোজারিও অবাক হয়ে দেখতে পায়, তুর্যের বিচার তো দূরের কথা, উল্টো তাদেরকে শাসাচ্ছে পিএস আলী আহমেদ। ফোনটা ফেরত দিতে বলে, সেইসাথে পুরো ঘটনা চেপে যেতে বলে তাদেরকে । এই ঘটনা যদি জানাজানি হয় তাহলে তাদের কারোর জন্যই ভালো হবে না বলেও হুমকি দেয়া হয় ।
অরুণ রোজারিও অসহায়ের মতো আত্মসমর্পন করেন। এদেশের হোমমিনিস্টার কতোটা ক্ষমতা রাখে সেটা তিনি ভালো করেই জানতেন । তুর্যের মোবাইলফোন আর হোমমিনিস্টারের লাইসেন্স করা পিস্তলটা পিএসের কাছে ফেরত দিয়ে দেন তিনি।
ক্ষমতার সামনে অসহায় অরুণ রোজারিও রাগে অপমানে হতবাক হয়ে পড়েন। তারই স্কুলের এক পুচকে ছেলে এতো বড় অপরাধ করার পরও তিনি কিছু করতে পারলেন না শুধুমাত্র এই কারণে যে, ছেলেটার বাপ হোমমিনিস্টার!
তার অধীনস্ত কর্মচারি হাসান আর সন্ন্যাল বাবুর সামনে দারুণ অপমানিত বোধ করেন প্রিন্সিপ্যাল। শেষে সন্ন্যাল বাবু আর হাসানকে বলে দেন, পুরো বিষয়টা যেনো কাউকে কোনোদিন না বলে । বললে তারা সবাই ভীষণ বিপদে পড়ে যাবে।
কিন্তু কারো কাছে মুখ খোলার আগেই তারা আবারো বিপদে পড়ে যায় ।
এ ঘটনার দুদিন পরই স্কুলে ছুটে আসে তুর্যের বডিগার্ড আর পিএস আলী আহমেদ। তাদের আচরণ ছিলো বেশ মারমুখি । পারলে অরুণ রোজারিওকে স্কুলেই মেরে ফেলে । প্রথমে সেন্ট অগাস্টিনের প্রিন্সিপ্যাল কিছুই বুঝতে পারেন নি। পরে যখন তাকে বলা হলো, তুর্যের ভিডিওটা ইন্টারনেটে আপলোড করা হয়েছে, সেটা এখন লক্ষ লক্ষ মানুষ দেখছে তখন তিনি ঘাবড়ে যান।
এটা কি করে সম্ভব? মোবাইলফোনটা তিনি বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন সত্যি, কিন্তু পরদিনই তো ফেরত দিয়ে দিয়েছেন পিএসের কাছে। ভিডিওটা তিনি যে দেখেন নি তা নয়, দুএকবার সেই জঘন্য পর্নোগ্রাফিটা দেখলেও ফোনটা তিনি ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলেন। তুর্যের ফোনটা তার কাছে মাত্র একরাতের জন্য ছিলো-এই সময়ের মধ্যে ভিডিওটা কে কপি করলো, আর কে-ই বা আপলোড করে দিলো ইন্টারনেটে?
অরুণ রোজারিও দৃঢ়তার সাথে অস্বীকার করলেও পিএসের মারমুখি আচরণের সামনে ভড়কে যান। মুখ ফসকে বলে ফেলেন, কাজটা খুব সম্ভবত হাসান করে থাকতে পারে। কেননা, সে-ই হাতেনাতে। তুর্যকে ধরেছিলো । অরুণ রোজারিওর হাতে দেবার আগে তার কাছেই ছিলো মোবাইলফোনটা।
প্রিন্সিপ্যালের রুমে ডেকে এনে হাসানকে কঠিন জেরা করে পিএস আলী আহমেদ। কিন্তু দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করে হাসান। সে জানায়, ফোনটা হাতে পাবার পরই সন্ন্যাল বাবুকে নিয়ে প্রিন্সিপ্যালের রুমে চলে আসে। তারপর থেকে ফোনটা অরুণ রোজারিওর কাছেই ছিলো ।
অনেক হুমকি-ধামকি আর ভয় ভীতি দেখানোর পরও যখন কোনো লাভ হলো না তখন পিএস আলী আহমেদ স্কুল কম্পাউন্ড থেকে চলে যায়, যাবার আগে শীতলকণ্ঠে বলে যায়, এরজন্য তাদেরকে পস্তাতে হবে।
নিরীহ হাসান খুব ভয় পেয়ে গেছিলো এ ঘটনায়। তার মাথায় ঢোকে না, দেশের হোমমিনিস্টার, যার উপর সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব ন্যস্ত, তারই স্কুল পড়ুয়া ছেলে এতোবড় অন্যায় করার পরও উল্টো তাদেরকে হুমকি দেয়া হচ্ছে!
হাসানের দৃঢ় বিশ্বাস, ইন্টারনেটে ভিডিও আপলোড করার কথাটা ডাহা মিথ্যা। তাদের মুখ বন্ধ রাখার জন্য এই অপবাদ দেয়া হয়েছে।
অবশ্য প্রিন্সিপ্যাল অরুণ রোজারিও এটা মনে করেন নি। ঐদিন বাসায় ফেরার আগেই তার মনে সন্দেহ হতে থাকে, খুব সম্ভবত তার ছোটো ভাই টিংকু তুর্যের মোবাইল থেকে ভিডিওটা আপলোড করে থাকতে পারে। কারণ মোবাইলফোনটা রেখেছিলেন স্টাডিরুমের ড্রয়ারে । সেই রুমটাই এখন ব্যবহার করে তার ছোটো ভাই টিংকু-যে কিনা বছরখানেক আগে ঢাকার একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য তার বাসায় এসে উঠেছে। তার এই ভাইটি সারাক্ষণ ইন্টারনেট নিয়ে ডুবে থাকে।
অরুণ রোজারিও নিজের ছোটো ভাইকে সন্দেহ করলেও এ নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করেন নি। পুরো ব্যাপারটা চেপে যান ।
ওদিকে সন্ন্যাল বাবু হাসানকে বার বার বলে দেয়, এ ঘটনার কথা যেনো অন্য কেউ না জানে। হয়তো কিছুদিন পর মিনিস্টারের ছেলে আর তার পরিবার ব্যাপারটা ভুলে যাবে ।
সত্যি বলতে কি, তা-ই হয়েছিলো। এরপর আর কিছু হয় নি। হোমমিনিস্টার তার ক্ষমতাবলে ইন্টারনেট থেকে তুর্যের পর্নো ভিডিওটা রিমুভ করতে সক্ষম হন। কয়েক সপ্তাহ পর পুরো ব্যাপারটাই বিস্মৃত হয়ে যায়।
.
বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল মাথা নীচু করে বসে আছে। একটু আগে পুরো ঘটনাটা খুলে বলেছে ভদ্রলোক।
জেফরি বেগ এই ঘটনার খুব কমই জানতো, কারণ নিহত হাসান তার ডায়রিতে বিস্তারিত কিছু লেখে নি। শুধু তুর্য নামের ছেলেটা জঘন্য অপরাধ করার পরও পার পেয়ে যাবার কথা লেখা আছে। আরো আছে, তুর্য ছেলেটা যেকোনো সময় তার ক্ষতি করতে পারার আশংকা ।
এখন পুরো ঘটনা জানার পর বুঝতে পারছে হাসানের খুনের রহস্যটা । সব কিছুর পেছনে আছে ঐ বখে যাওয়া ছেলে, হোমমিনিস্টারের আদরের দুলাল তুর্য ।
“আমার ধারণা ঐ দিন আপনি আরো কিছু দেখেছিলেন, তাই না?”
বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল জেফরির দিকে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত।
“আপনি আরো কিছু জানেন, মি: সন্ন্যাল। আমার কাছে সব বলুন। আমার সাথে কো-অপারেট করলে আপনার কোনো সমস্যা হবে না।”
একটা টোপ দিলো জেফরি । তার ধারণা হাসান যেদিন খুন হয় সেদিন আরো কিছু ঘটনা ঘটেছে যা অরুণ রোজারিও আর সন্ন্যাল বাবুসহ সেন্ট অগাস্টিনের অনেকেই গোপন করে যাচ্ছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল মাথা নেড়ে সায় দিলো।
“তুর্যের বডিগার্ড লোকটা…”।
চমকে উঠলো জেফরি বেগ। “হ্যাঁ, বডিগার্ড লোকটা কি?”
“হাসান যেদিন খুন হয় সেদিন আমি ওকে টয়লেট থেকে বের হতে দেখেছি!”
“কি!”
অধ্যায় ৩৪
পর দিন নিজের অফিসে বসে আছে জেফরি বেগ । তার সামনে বসে আছে রমিজ লস্কর । একটু আগে জেফরি তাকে জানিয়েছে গতকাল বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল তুর্যের বডিগার্ড সম্পর্কে কি বলেছে ।
সেন্ট অগাস্টিনের জুনিয়র ক্লার্ক হাসানের রহস্যময় হত্যাকাণ্ডটি এখন উন্মোচিত হয়ে গেছে বলা যায়।
বডিগার্ড লোকটি বৃহস্পতিবার শেষ বিকেলে সেন্ট অগাস্টিনে ঢুকেছিলো । সন্ন্যাল বাবু নিজের অফিসরুমের জানালা দিয়ে দেখেছে লোকটা টয়লেট থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে অস্বাভাবিকতা খেয়াল করেছিলো বাবু। কেমন জানি নাভার্স আর তাড়াহুড়ার ভাব ছিলো। তুর্যের বডিগার্ড হিসেবে লোকটা প্রায়ই স্কুলে ঢুকতো সুতরাং পরদিন টয়লেটের ভেতরে হাসানের লাশটা পাওয়ার আগ পর্যন্ত এ ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামান নি ভদ্রলোক।
সাড়ে তিনমাস আগে তুর্যের সাথে হাসানের ঝামেলাটার কথা ভালো করেই জানে সন্ন্যাল বাবু । তুর্যের পর্নো ভিডিওটা যখন ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে তখন মিনিস্টারের পিএস প্রিন্সিপ্যাল আর হাসানকে শাসিয়ে গিয়েছিলো।
“স্যার, তাহলে তো ঘটনা একদম পরিস্কার,” সব শোনার পর বললো রমিজ লস্কর।
“হুম,” মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি বেগ ।
“এজন্যেই তুর্যকে আড়াল করে রেখেছেন মিনিস্টার।”
“আমার মনে হয় ছেলেটা তার নিজের বাড়িতেই আছে,” জেফরি বেগ বললো।
“হতে পারে, স্যার।”
“একজন মিনিস্টারের বাড়ির চেয়ে নিরাপদ জায়গা আর হয় না। কারো সাধ্য নেই ওখানে ঢুকে খোঁজ নেয়া। হাতেগোনা নিজস্ব কিছু লোকজন ছাড়া কেউ ঢুকতেও পারে না।”
“তাহলে তো তুর্যের নাগাল পাওয়া খুব কঠিন হয়ে যাবে । আমরা তো ইচ্ছে করলেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবো না,” বললো রমিজ।
“কাজটা যে খুব কঠিন সেটা আমিও জানি কিন্তু অসম্ভব নয়।”
রমিজ লস্কর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।
“পুলিশি তদন্তে যে কাউকে জিজ্ঞাসবাদ করা যায়। আইন আমাদের সে ক্ষমতা দিয়েছে। এ কাজে কেউ বাধা দিলে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে পারমিশন নিয়েও কাজটা অনায়াসে করা সম্ভব।
“আপনি কি সেটাই করবেন, স্যার?” রমিজ লস্করের চোখেমুখে ভয়।
“না। আপাতত এরকম কিছু করার ইচ্ছে আমার নেই।”
“তাহলে আপনি এখন কি করতে চাচ্ছেন?”
“মিলনকে ট্র্যাকডাউন করার পাশাপাশি তুর্যের মোবাইল ফোনটাও মনিটর করতে থাকো। আমি নিশ্চিত, ফোনটা সে ব্যবহার করবেই,” বললো জেফরি বেগ।
“জি, স্যার,” মাথা নেড়ে সায় দিলো রমিজ লস্কর। একটু চুপ থেকে বললো, “স্যার, আমরা যদি তুর্যের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো প্রমাণ পেয়ে যাই তখন কী হবে?”
জেফরি জানে এরকম কিছু হলে আসলেই একটা সংকটে পড়ে যাবে। এ দেশের পলিটিশিয়ানরা যতোই জোর গলায় গণতন্ত্র আর আইনের শাসনের কথা বলুক না কেন, আদতে সবই ফাঁপা বুলি । যতো বড় অন্যায়ই করুক না কেন, ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের কিছুই করা যায় না। এদিক থেকে দেখলে জেফরির সমস্যা আরো প্রকট-তাদেরকে মোকাবেলা করতে হবে খোদ হোমমিনিস্টারকে। নিজের একমাত্র ছেলেকে রক্ষা করার জন্য তিনি সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করবেন সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। ইতিমধ্যেই তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু করে দিয়েছেন।
তাই বলে জেফরি পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলবে না । এই কেসটার শেষ দেখতে চায় সে । আগেভাগে আশংকা করে থেমে যাবার কোনো মানেই হয় না।
“কী হবে না হবে সেটা ভাবার দরকার নেই। আমরা আমাদের কাজ করে যাবো,” কয়েক মুহূর্ত পর বললো জেফরি বেগ। “এখন আমাদের উচিত শুধুমাত্র কেসটা নিয়ে ভাবা । শক্ত প্রমাণ পাবার পর এসব নিয়ে ভাবা যাবে।”
“কিন্তু সতর্ক থাকা উচিত না, স্যার?” রমিজ লস্কর বললো। “হাজার হলেও হোমমিনিস্টারের ছেলের ব্যাপার। তারা যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে আমরা অনেক কিছু জেনে গেছি তাহলে কিন্তু আমাদেরও সমস্যা হবে।”
উদ্বিগ্ন রমিজ লস্করের দিকে চেয়ে রইলো জেফরি । “ঠিক আছে। এখন থেকে যা যা জানতে পারবে সেগুলো কারো সাথে শেয়ার কোরো না। এমনকি ফারুক স্যারের সাথেও না।”
রমিজ চুপ করে থাকলো। কথাটা সত্যি। তার বস জেফরি বেগ এই কেসটার অগ্রগতি নিয়ে কারা সাথে কোনোরকম আলোচনা করছে না। অথচ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তাদের হাতে চলে এসেছে ।
“এই কেসে একটা বিরাট খটকা এখনও রয়ে গেছে,” বললো জেফরি ।
“সেটা কি, স্যার?”
“মিলন। সন্ত্রাসী মিলনের কানেকশানটা এখনও পরিস্কার নয়। তাছাড়া বাস্কেটবলের কোচ সেজে যারা গেছিলো তাদের মধ্যে মিলন ছিলো কিনা সে ব্যাপারে কিন্তু আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারি নি।”
রমিজ লস্কর আবারো মাথা নেড়ে সায় দিলো।
“আমি আর্টিস্টের সাথে সিটিং দেবো, মিলনের একটা পোট্রেইট তৈরি করতে হবে। সেই ছবি দেখে যদি সেন্ট অগাস্টিনের ফিজিক্যাল ট্রেইনার চিহ্নিত করতে পারে তাহলে বুঝতে পারবো মিলনই ঐদিন কোচ সেজে স্কুলে গেছিলো।”
“আমার মনে হয় ফারদার ইনভেস্টিগেশন করার আগে এটাই করা উচিত, স্যার,” বললো রমিজ লস্কর।
জেফরির স্মৃতিতে মিলনের ছবিটা বেশ স্পষ্ট। প্রায় নিখুঁত বিবরণ দিতে পারবে। মনে মনে ঠিক করলো, আজই আর্টিস্টের সাথে সিটিং দেবে ।
মিলন খুবই স্মার্ট আর ভয়ঙ্কর এক সন্ত্রাসী। মাথা ঠাণ্ডা রেখে তাদের মতো দু দু’জন ইনভেস্টিগেটরকে মোকাবেলা করেছে। এরকম কাজ যার তার পক্ষে করা সম্ভব নয় । খুব কম সন্ত্রাসীই এটা পারবে ।
কথাটা ভাবতেই অন্য একজনের কথা মনে পড়ে গেলো তার। বাবল!
বাস্টার্ড নামেই যে বেশি পরিচিত।
অধ্যায় ৩৫
হাসপাতালের নির্জন করিডোর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে উমা । পড়ন্ত বিকেল। একটু পর তার ডিউটি শেষ হবে। হাত ঘড়িতে সময় দেখলো। আর মাত্র দশ মিনিট, তারপরই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। কিন্তু তার মধ্যে কোনো তাড়া নেই। অনেকটা ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে । সুদীর্ঘ করিডোরটা যেনো আরেকটু প্রলম্বিত হয়, মনে মনে এই আশা করছে সে ।
মুচকি হেসে ফেললো। একেবারে অবুঝের মতো ভাবছে। যা আশা করছে তা হবার নয়। অন্তত আজকে।
গত সপ্তাহে ঠিক এরকম সময়ে ঠিক এই করিডোর দিয়েই হেঁটে যাচ্ছিলো সে । প্রায় ফাঁকা করিডোরটা দিয়ে যেতে যেতে সিঁড়ির ঠিক আগে, যেখানটা একটু অন্ধকারাচ্ছন্ন, সেখানে আসতেই দেখতে পায় এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় সানক্যাপ। গায়ে চামড়ার জ্যাকেট।
উমা প্রথমে বুঝতে পারে নি। তার মাথায় ছিলো অন্য একটা চিন্তা । তার মা-বাবা একটা ছেলে ঠিক করেছে বিয়ের জন্য। খুব চাপাচাপি করছে। মানসিকভাবে উমা সুস্থির ছিলো না। বাবা-মাকে কী করে বাবলুর কথা বলবে। তাদের সম্পর্কটা জোড়া না লাগতেই যে বিচ্ছেদের আবর্তে পড়ে গেছে। জেল থেকে বের হয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে বাবলু। উমার সাথে অবশ্য মাঝেমধ্যে ফোনে যোগাযোগ হয়, কিন্তু তাদের সম্পর্কের ভবিষ্যত একদম অনিশ্চিত। বাবলু কবে দেশে ফিরবে, ফিরলেও মামলা-মোকদ্দমাগুলোর কি হবে, কিছুই জানতো না।
মনে মনে বাবলুকে কাছে পেতে ইচ্ছে করছিলো তার। এরকম সময় বাবলু তার পাশে থাকলে খুব ভালো হতো। তার সাথে এ নিয়ে কথা বলা যেতো।
সিঁড়ির কাছে আসতেই উমার নজরে পড়ে ক্যাপ পরা একজনের দিকে। আচমকা ভুত দেখার মতো থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। যা ভাবছিলো, কামনা করছিলো তা-ই ঘটে গেছে!
এটা কি বাস্তব নাকি দিবাস্বপ্ন?
না। কোনো দিবাস্বপ্ন ছিলো না সেটা।
“বাবলু?!” অস্ফুটস্বরে বলে উঠেছিলো সে। তার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেছিলো।
মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখে চশমা । মাথায় সানক্যাপ । কিন্তু বাবলুকে চিনতে বেগ পেতে হয় নি। তার দেবদূতের মতো চোখ জোড়া কোনোভাবেই ভুলবার নয়।
ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে উমা। বাবলু মিটিমিটি হাসতে থাকে । জ্যাকেটের পকেটে দু’হাত ঢুকিয়ে আস্তে আস্তে চলে আসে তার কাছে।
“কেমন আছো?”
উমার মনে হয়েছিলো জাপটে ধরবে বাবলুকে, কিন্তু নিজেকে বহুকষ্টে সংবরণ করে।
তারা দুজন হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে চলে যায় কাছের একটি পার্কে । একটা বেঞ্চে হাত ধরাধরি করে বসে থাকে অনেকক্ষণ ।
বাবলু জানায়, সে পরশু চলে যাবে। উঠেছে এক হোটেলে। উমার একটু সন্দেহ হয়-বাবলু কি শুধু তার সাথে দেখা করার জন্যই দেশে ফিরে এসেছে? নাকি অন্য কোনো কাজে? যে কাজে সে জীবনের দীর্ঘ একটা সময় নিজেকে জড়িত রেখেছিলো?
বাবলুর হাত ধরে ছলছল চোখে জিজ্ঞেস করেছিলো উমা, সে কি সত্যি তাকে দেখার জন্য এসেছে? তার মাথায় হাত রেখে বলতে বলে। বাবলু হেসে উমার মাথায় হাত রেখে বলে, সে শুধুমাত্র তার সাথে দেখা করার জন্যই এসেছে। তারপরও উমা তাকে দিয়ে আবারো প্রতীজ্ঞা করায়, এ জীবনে আর কখনও খুনখারাবির মতো কাজ করবে না। বাবলু অবলীলায় বলে, সে এ কাজ আর করবে না। কখনওই না। সে শুধু ভালোবাসা পেতে চায় । উমার সাথে থাকতে চায়।
খুশিতে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিলো উমা।
সন্ধ্যা হয়ে এলে তাকে রিক্সায় করে বাসায় পৌঁছে দিতে চায় বাবলু, কিন্তু উমা রাজি হয় না। তারা হাঁটতে হাঁটতেই রওনা হয়, কারণ উমারা এখন রামপুরায় থাকে না, থাকে পিজি হাসপাতালের খুব কাছে সেগুন বাগিচায় । রিক্সা নিলে হুট করে বাসায় চলে আসবে, তারচেয়ে ভালো হেঁটে গেলে। অন্তত বাড়তি কিছুটা সময় তো পাওয়া যাবে।
বাড়িতে ঢোকার আগে ঠিক করে আগামীকাল তারা সারাটা দিন একসঙ্গে কাটাবে। উমা ছুটি নিয়ে নেবে হাসপাতাল থেকে ।
উমার বেশ মনে পড়ে, ঐদিন ভালো লাগার অনুভূতি আর উত্তেজনার চোটে সারা রাত ঘুমোতেই পারে নি।
পরদিন তারা দেখা করে হোটেল র্যাডিসনে বাবলুর সুইটে। সমস্ত সংস্কার আর নিয়মনীতি তুচ্ছ করে তারা পাগলের মতো মিলিত হয়। ভালোবাসার তীব্রতার কাছে নিজেদেরকে সমর্পণ করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একসাথেই থাকে। তাদের দুজনের কাছে সেইদিনটি ছিলো স্বপ্নের মতো।
বাবলুকে ভেতরে নেবার সময় উমার মধ্যে যে তীব্র আবেগের সূচনা হয়েছিলো সে কথা কখনও ভুলতে পারবে না। কেঁপে কেঁপে উঠছিলো উমা । সারা শরীর যেনো সুখের খনি হয়ে উঠেছিলো। প্রতিটি রোমকূপ সুখের সুতীব্র প্রস্রবন ছড়িয়ে দিয়েছে।
“তুমি আমাকে খুন করেছে, বাবলু!” আবেগে থরো থরো উমা বলেছিলো তার ভালোবাসার মানুষটিকে।”
“আমি তোমাকে সব সময় খুন করতে চাই…এভাবে!” বাবলু বলেছিলো একইরকম তীব্র আবেগ নিয়ে ।
“আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি!” উমা কম্পিত কণ্ঠে বলে ওঠে।
শক্ত করে জড়িয়ে ধরে উমার কানে কানে বাবলু বলে, “আবার বলো।”
“কি ব্যাপার, এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
কথাটা শুনে সম্বিত ফিরে পেলো উমা। তার সঙ্গে কাজ করে এক নার্স, অবাক চোখে চেয়ে আছে তার দিকে। খেয়ালই করে নি, কখন যে দাঁড়িয়ে পড়েছে করিডোরের সেই জায়গাটাতে যেখানে গত সপ্তাহে বাবলুর সাথে দেখা হয়েছিলো।
“না, দিদি, এমনি…” নিজেকে সামলে নিয়ে বললো উমা।
ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো রুনুদি হিসেবে পরিচিত সিনিয়র নার্সটি। “কি হয়েছে?”
“কিছু না, দিদি,” কথাটা বলেই তড়িঘড়ি হাঁটতে শুরু করলো আবার ।
হাঁটতে হাঁটতে ভাবলো, আবার কবে বাবলু এমনি করে চলে আসবে তার সাথে দেখা করার জন্য?
অধ্যায় ৩৬
অরুণ রোজারিও মাথা নীচু করে চোখ বন্ধ করে রেখেছেন। তার বুকের কাছে দু’হাত ভাঁজ করা । মানসিকভাবে মুষড়ে পড়েছেন বলা যায়।
একটু আগে বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল তার কাছে এসে বলে গেছে, গতকাল সন্ধ্যার দিকে জেফরির সাথে তার সাক্ষাতের ঘটনাটি। জেফরি যদিও বাবুকে বলেছিলো তাদের এই সাক্ষাতের কথা কাউকে না বলার জন্য কিন্তু বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল তা করে নি। সে আর নতুন কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায় না । তাছাড়া ঐ ইনভেস্টিগেটরকে বিশ্বাস করার চেয়ে নিজের চাকরিদাতাকে বিশ্বাস করা অনেক ভালো।
সন্ন্যাল বাবুর কথা শেষ করার পরই অরুণ রোজারিও চুপ মেরে যান। জেফরি এসব কিভাবে জেনে গেলো-তার মাথায় ঢুকছে না।
বাবু কিছুক্ষণ বসে থেকে চুপচাপ চলে গেছে। তাদের প্রিন্সিপ্যাল এই কথাটা শুনে এভাবে ভেঙে পড়বে তা তার জানা ছিলো না ।
অরুণ রোজারিও এরকম আশংকাই করেছিলেন । হয়তো তুর্যের ব্যাপারে সব জেনে গেছে জেফরি । কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো তার এই ছোটোভাই তাকে কিছুই বলছে না। যদি বলতো তাহলে নিজের অবস্থান পরিস্কার করার একটা সুযোগ পেতেন তিনি। এখন কী করবেন বুঝতে পারছেন না।
জেফরিকে সব বলে দেবেন? কিন্তু আগ বাড়িয়ে বললে উল্টো যদি তাকেই সন্দেহ করতে শুরু করে সে? তাছাড়া সব কথা বলা কি সম্ভব?
না। আগ বাড়িয়ে কিছু বলার দরকার নেই। যেহেতু এখনও সব কথা বলার মতো সময় আসে নি তাই ঠিক করলেন আরেকটু সময় নেবেন। দেখবেন জেফরি এ ব্যাপারে কিছু জানতে চায় কিনা। অবশ্য তার মনে হচ্ছে, জেফরি কিছুই জানতে চাইবে না। এটাই হলো ভয়ের কথা। সব কিছু জানার পরও এই না জানতে চাওয়ার একটাই মানে-জেফরি আর তাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কিংবা কে জানে, তাকেও হয়তো সন্দেহ করতে শুরু করে দিয়েছে।
এখন যদি জেফরিকে সব খুলেও বলেন বিপদে পড়বেন। কারণ আরেক দিকে আছে হোমমিনিস্টার। প্রথম থেকে তিনি সব জানার পরও জেফরিকে কিছু বলেন নি। চেপে গেছেন সুকৌশলে । বিভ্রান্ত করেছেন তার এই ছোটো ভাইটিকে । আর এটা তিনি করেছেন মিনিস্টারের নির্দেশে। এখন জেফরি যদি তার কাছ থেকে সব জানতেও চায় তিনি কি সব বলে দিতে পারবেন?
তার অবস্থা হয়েছে সঙ্গিন। দুদিক থেকেই তিনি বিপদের মধ্যে আছেন অথচ এই ব্যাপারটায় তার কোনো সংশ্লিষ্টতাই নেই।
“হ্যালো অরুণদা।”
কণ্ঠটা চিনতে ভুল হলো না তার। মুখ তুলে চেয়ে দেখলেন দরজার কাছে। জেফরি দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে।
বহু কষ্টে হাসার চেষ্টা করলেন কিন্তু আজ যেনো তার মধ্য থেকে হাসি নামক জিনিসটা একেবারেই উধাও হয়ে গেছে। “আসো আসো…বসো।” শুধু এটুকুই বলতে পারলেন।
“আপনার কিছু হয়েছে?” বসতে বসতে বললো জেফরি বেগ।
‘না। এই একটু মাথা ব্যাথা…মাইগ্রেনের পুরনো সমস্যা…” অরুণ রোজারিও অবাক হলেন, আজকাল তিনি বেশ দক্ষতার সাথেই ঝটপট মিথ্যে বলতে পারছেন। শুধু অভিব্যক্তি লুকিয়ে ফেলতে পারলেই বেঁচে যেতেন।
“এই ব্যাথাটা আমারও আছে, তবে অতোটা তীব্র না…খুব খারাপ ব্যাথা,” কথাটা বলেই ডেস্কের উপর একটা বড় ইনভেলপ রাখলো জেফরি বেগ।
“এটা কি?” এনভেলপটার দিকে ইঙ্গিত করে জানতে চাইলেন অরুণ রোজারিও।
“একটা স্কেচ। হোমিসাইডের আর্টিস্ট এঁকেছে। সম্ভবত যে লোকটা কোচ সেজে আপনার স্কুলে ঢুকেছিলো তার ছবি ।”
“তার ছবি?” অবাক হলেন প্রিন্সিপ্যাল। “তার ছবি কিভাবে আঁকলো?”
জেফরির মনে পড়লো মিলনের সাথে তাদের মোকাবেলার কথাটা অরুণ রোজারিওকে বলা হয় নি। “আপনাকে বলতে ভুলে গেছি, একজন সন্দেহভাজনকে চিহ্নিত করতে পেরেছি আমরা।”
“তাই নাকি?” অনেকটা আপন মনে বললেন প্রিন্সিপ্যাল।
“আপনার ঐ ফিজিক্যাল ট্রেইনারকে একটু ডাকুন,” বললো জেফরি ।
“কেন?”
“উনাকে ছবিটা দেখাবো। ছবি দেখে উনি চিনতে পারলে দারুণ ব্যাপার হবে।”
অরুণ রোজারিও চুপচাপ ইন্টারকমটা তুলে কাজি হাবিবকে আসতে বললেন তার অফিসে।
“চা খাবে?” জানতে চাইলেন জেফরির অরুণদা।
“হ্যাঁ, তা খাওয়া যায়।”
তিনি বেল টিপে চায়ের অর্ডার দিয়ে দিলেন ।
কিছুক্ষণ পর চা চলে এলো, সেইসাথে কাজি হাবিবও। ভদ্রলোক জেফরিকে দেখে কেমন জানি কুকড়ে গেলো । কুশল বিনিময় করে তার সাথে হাত মিলিয়ে চুপচাপ বসে পড়লো চেয়ারে।
ডেস্ক থেকে এনভেলপটা হাতে তুলে নিলো জেফলি । “মি: হাবিব, দেখুন তো ছবিটা…চিনতে পারেন কিনা?” হাতে আঁকা স্কেচটা বের করে নিলো জেফরি । সে ভালো করেই জানে তাদের আর্টিস্ট যে ছবিটা এঁকেছে সেটা মিলনের আসল চেহারার অনেকটাই কাছাকাছি।
কাজি হাবিব ছবিটা হাতে নিয়ে বিস্ময়ে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। “মাইগড!”
কথাটা শুনে অরুণ রোজারিও সোজা হয়ে বসলেন চেয়ারে। তার চোখেমুখেও বিস্ময় উপচে পড়ছে।
“এটাই তো সেই লোকটা!” জেফরিকে বললো কাজি হাবিব।
“আমি জানতাম,” কথাটা বলেই হেসে ফেললো জেফরি বেগ । “এই লোকটাই অ্যাঞ্জেলস টিমের কোচ সেজে স্কুলে এসেছিলো।”
অরুণ রোজারিও হাত বাড়িয়ে ছবিটা নিয়ে নিলেন কাজি হাবিবের কাছ থেকে। গোল গোল চোখে তিনি চেয়ে থাকলেন সেটার দিকে।
“আপনি নিশ্চিত তো, মি: হাবিব?” বললেন তিনি।
“জি, স্যার । এই লোকটাই এসেছিলো,” দৃঢ়ভাবে বললো ফিজিক্যাল ট্রেইনার ।
“অরুণদা, মি: হাবিব চিনতে ভুল করেন নি, আমি নিশ্চিত।”
“কে এই লোকটা?” এটা বলার কোনো ইচ্ছেই ছিলো না অরুণ রোজারিওর কিন্তু মুখ ফসকে বের হয়ে গেলো।
“এর নাম ইসহাক আলী,” কথাটা বলে বাঁকা হাসি হাসলো জেফরি । “সবাই অবশ্য মিলন নামেই তাকে চেনে। সম্ভবত একজন পেশাদার খুনি!”
অরুণ রোজারিও চেয়ে রইলেন তার স্কুলের ছোটো ভায়ের দিকে । এতসব কিভাবে জানতে পারলো জেফরি! না জানি আরো কতো কিছু জানে । অথচ তাকে কিছু জিজ্ঞেস করছে না। তার সাথে কি এক ধরণের খেলা খেলছে সে?
হায় ঈশর!
অধ্যায় ৩৭
হোমিসাইডের অফিসে বসে আছে জেফরি বেগ আর রমিজ লস্কর । ডেস্কের উপর পড়ে আছে মিলনের স্কেচটা। তারা এখন জানে এই মিলনই অ্যাঞ্জেলস টিমের কোচ সেজে সেন্ট অগাস্টিনে গিয়েছিলো। তারপর তুর্য নামের ছেলেটার সাথে তার কথা হয়। তুর্য এসে তার সঙ্গিদের জানায় তাকে অ্যাঞ্জেলস টিম সাইন করিয়েছে। কথাটা শুনে তার অন্য সঙ্গিরা অবাক হয়েছিলো, কেননা তুর্যের চেয়েও ভালো প্লেয়ার ছিলো সেখানে, তাদেরকে বাদ দিয়ে তুর্য কেন? পুরোটাই কি হত্যা পরিকল্পনার অংশ?
এরপরই, বিকেলের শেষদিকে বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল নিজের অফিসঘরের জানালা দিয়ে দেখতে পায় তুর্যের বডিগার্ড টয়লেট থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। লোকটার আচরণ মোটেও স্বাভাবিক ছিলো না ।
পরদিন স্কুলের টয়লেট থেকে পাওয়া যায় হাসানের লাশ। ফরেনসিক পরীক্ষায় জানা গেছে খুনটা সংঘটিত হয়েছে আগের দিন বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে ছ’টার মধ্যে। অর্থাৎ মিলন স্কুলে ঢোকার পর ।
প্রথমে মিলন ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে স্কুলে ঢোকে, তুর্যের সাথে কথা বলে, তারপরই স্কুলে ঢোকে তুর্যের বডিগার্ড। পুরো বিষয়টা এখন পরিস্কার-অন্তত জেফরি বেগের কাছে-হাসানের হত্যাকাণ্ডের সাথে হোমমিনিস্টারের ছেলে এবং তার বডিগার্ড জড়িত। তাদের সহায়তায় কাজটা করেছে মিলন নামের ভয়ঙ্কর এক সন্ত্রাসী। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, হাসানের উল্টোদিকের ফ্ল্যাটেই থাকতো সেই খুনি।
নিঃসন্দেহে তুর্য, হাসান আর মিলন এক অদ্ভুত নেক্সাস ।
জেফরির বুঝতে বাকি রইলো না, হাসানের হত্যাকাণ্ডটি দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার ফসল । তাকে জানতে হবে মিলন কবে বাড়িটা ভাড়া নিয়েছিলো। সেটা কি হাসানের আগে নাকি পরে? যদি পরে হয়ে থাকে তাহলে খাপে খাপে মিলে যাবে। আগে হয়ে থাকলে আরেকটা গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়বে।
“এই লোকটাকে খুঁজতে হবে,” ছবিটার দিকে ইঙ্গিত করে রমিজ লস্করকে বললো জেফরি বেগ । “আমি নিশ্চিত, সে ঢাকা শহরেই আছে । তার দু দু’জন স্ত্রী…একজনের ব্যাপারে আমরা কিছুটা জানি।”
রমিজ মাথা নেড়ে সায় দিলো । বুদ্ধিমানের মতো কথা বলেছে তার বস। হোমমিনিস্টারকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার চেয়ে এটাই বেশি নিরাপদ।
“আমার মনে হয় তুর্যের পেছনে ছোটার চেয়ে এদের পেছনে ছুটলেই বেশি ভালো হবে…বিশেষ করে মিলনকে ধরতে পারলে সবকিছু পরিস্কার হয়ে যাবে।”
আবারো মাথা নেড়ে সায় দিলো রমিজ । মিলন নামের খুনিটাকে ধরা সম্ভব হলে তাদের অনেক সুবিধা হবে । খুনির স্বীকারোক্তিতে উঠে আসবে সব কিছু। তাতে মিনিস্টারের ছেলে জড়িত থাকলেও তাদের কোনো দায় থাকবে না।
“তাহলে আমি এখন কি করবো, স্যার?” রমিজ জানতে চাইলো ।
“জি, স্যার, আমারও একই প্রশ্ন।” কথাটা শুনে জেফরি আর রমিজ তাকালো দরজার দিকে । জামান দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে হাসি।
“জামান, তুমি?” অবাক হলো জেফরি ।
রমিজের পাশে একটা চেয়ারে বসে পড়লো সে। একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটে এখনও। তবে তাকে দেখে সুস্থই মনে হচ্ছে। “বাড়িতে বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না, স্যার । একদম বোরিং হয়ে গেছি…”
“তোমার ছুটি তো এখনও শেষ হয় নি,” বললো জেফরি, তার মুখেও হাসি । সহকারীকে দেখে তার ভালো লাগছে ।
“ছুটি ক্যান্সেল করে দিন । আমি কাল থেকেই জয়েন করতে চাই।”
“কিন্তু তুমি তো পুরোপুরি সুস্থ নও।”
“পায়ের অবস্থা কেমন, জামান?” জানতে চাইলো রমিজ লস্কর।
“একদম ঠিক আছি, লস্কর ভাই। কোনো সমস্যা নেই।”
“ব্যান্ডেজ লাগানো আছে না?” বললো জেফরি ।
“টেপব্যান্ডেজ, স্যার। ঘা শুকিয়ে যাচ্ছে। হাটাচলা করতে পারি…”
“ঠিক আছে, কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ হবার আগে কাজে জয়েন করার কী দরকার?”
“হ্যাঁ, আরো কয়টা দিন রেস্ট নেন,” বললো রমিজ।
“স্যার, বাড়িতে বসে থাকতে ভালো লাগে না। আমি কাল থেকেই অফিসে জয়েন করতে চাই।” জোর দিয়ে বললো জামান। “দৌড়াদৌড়ির কাজ করবো না। শুধু ডেস্ক জব।”
জেফরি চুপ করে থাকলো। রমিজ তাকালো তার দিকে । “তাহলে জয়েন করাই ভালো, কী বলেন, স্যার?”
“ওকে।” ছোট্ট করে বললো জেফরি । “চা খাবে?”
জামানের মুখে হাসি ফুটে উঠলো । “খাবো, স্যার।”
ইন্টারকমটা তুলে তিন কাপ চায়ের অর্ডার দিলে কিছুক্ষণ পরই চা চলে এলো। জমে উঠলো তাদের আলোচনা।
“তাহলে মিলনই সেচ সেজে স্কুলে গেছিলো?” ডেস্কের উপর রাখা ছবিটার দিকে ইঙ্গিত করে বললো জামান। চা আসার আগে এ পর্যন্ত যা যা জানতে পেরেছে তা সংক্ষেপে বলে দিয়েছে জেফরি বেগ ।
“হুম। অগাস্টিনের ফিজিক্যাল ট্রেইনার নিশ্চিত করেছে,” বললো জামানের বস্ ।
“স্যার, আপনার ঐ বড় ভাই অরুণ রোজারিও সবই জানেন। ভদ্রলোককে প্রথম থেকেই আমার সন্দেহ হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো কিছু একটা লুকাচ্ছেন…” বললো জামান।
“অনেক কিছুই লুকিয়েছেন। এখনও অনেক কিছু লুকাচ্ছেন, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।” একটু চুপ থেকে আবার বললো, “কিন্তু আমার মনে হচ্ছে উনি যদি কিছু লুকিয়ে থাকেন সেটা নিশ্চয় হোমমিনিস্টারের কারণেই করেছেন।”
“তাহলে কি মিনিস্টার নিজেও এ কাজে জড়িত?” জামান বললো তার বসকে ।
“আমার মনে হয় না মিনিস্টার এ কাজে জড়িত,” জেফরি কিছু বলার আগেই রমিজ লস্কর বললো।
“এ দেশের পলিটিশিয়ানদের কোনো বিশ্বাস নেই,” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো জেফরি বেগ। “মনে রেখো, তুর্যের বডিগার্ড লোকটার কথা। আমাদের অনুমাণ সেও এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত। তবে মিনিস্টার সরাসরি জাড়তি কিনা বুঝতে পারছি না। হয়তো উনি প্রথম দিকে জড়িত ছিলেন না, পরে ঘটনা জানতে পেরে সামাল দেবার চেষ্টা করছেন।”
জেফরি বেগের এ কথায় মাথা নেড়ে সায় দিলো তার সহকারী দু’জন।
“রমিজ, তুমি আম্বিয়া খাতুনের ব্যাপারে খোঁজ নেবে।”
“জি, স্যার।” একটু থেমে আবার বললো রমিজ, “মিলনের এক ছোটো ভাই পুরনো ঢাকার গেন্ডারিয়ায় থাকে। তার ব্যাপারে কি করবেন?”
“আমি নিজে সেটা দেখবো।”
জেফরি যেখানে মানুষ হয়েছে সেই সেন্ট গ্রেগোরি স্কুলের খুব কাছেই জায়গাটা। তারচেয়েও বড় কথা তার বন্ধু ম্যাকির বাড়ি সেখান থেকে খুব কাছে। তাছাড়া মিলন শুধু ম্যাকির পরিচয়টাই ব্যবহার করে নি, তার নামটাও ব্যবহার করেছে। এর মানে, ম্যাকিকে সে চেনে । সুতরাং এই ব্যাপারটা জেফরি নিজেই খোঁজ নিতে পারবে।
“স্যার, আমি কি করবো?” জামান জানতে চাইলো।
“রমিজ যে কাজটা করছিলো সেটা করতে পারো…তুর্যের টেলিফোনটা মনিটর করা।”
“আপনার জন্য ভালোই হবে, পিওর ডেস্ক জব, পাশ থেকে বললো রমিজ লস্কর । “অবশ্য বিরক্তিকর কাজ। ফোনটা বন্ধ আছে, কবে খুলবে কে জানে।”
“ওকে, নো প্রবলেম,” জামান কাঁধ তুলে বললো।
“হোমমিনিস্টারের ফোনটা ট্র্যাক-ডাউন করলে অবশ্য দ্রুত ফলাফল পাওয়া যেতো, কিন্তু সেটা তো করা যাবে না,” বললো রমিজ লস্কর।
জেফরি ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো তার দিকে। “আমরা কিন্তু সেটা করতে পারি…” বললো সে। তার চোখেমুখে অন্যরকম এক অভিব্যক্তি।
“জি স্যার!”
কথাটা একসাথে বলে উঠলো জামান আর রমিজ। তাদের চোখেমুখে বিস্ময় । বিশ্বাসই করতে পারছে না তাদের বস্ কী বলছে! হোমমিনিস্টারের
ফোন ট্যাপিং! পাগল!
“আমরা হোমমিনিস্টারের ফোন ট্যাপ করবো?!” ঢোক গিলে বললো রমিজ।
“এটা করার অনুমতি কি আমাদের আছে, স্যার?” জামানও যারপরনাই বিস্মিত । সত্যি বলতে, ভড়কে গেছে সে।
“না । তা নেই,” আস্তে করে বললো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর।
“তাহলে?” রমিজ লস্কর আবারো ঢোক গিললো ।
“কিন্তু অন্য একটা উপায়ে কাজটা আমরা করতে পারি!”
জেফরির কথাটা শুনে জামান আর রমিজ একে অন্যের দিকে তাকালো।
বেআইনীভাবে হোমমিনিস্টারের ফোন ট্যাপিং করা! মাথা খারাপ?!
“ভাবছো আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে?” জেফরি যেনো তার দু’জন অধস্তনের মনের কথা পড়তে পেরেছে। রমিজ আর জামান অবাক হয়ে তাকালো তার দিকে। দু’পাশে মাথা দোলালো সে। “না । আমার মাথা ঠিকই আছে। এটা করা সম্ভব।”
অসম্ভব! রমিজ আর জামান মনে মনে বললো।
অধ্যায় ৩৮
ম্যাকি বসে আছে দরবার নামক রেস্তোরাঁয়। যথারীতি চা খাচ্ছে, অপেক্ষা করছে পুরনো বন্ধু জেফরির জন্য। ঘণ্টাখানেক আগে জেফরি তাকে ফোন করে জানিয়েছে জরুরি একটা কাজে আসছে। ম্যাকি অবশ্য জানতে চেয়েছিলো কাজটা কি, কিন্তু তার বন্ধু এরচেয়ে বেশি কিছু বলে নি। বলেছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছে।
রেস্তোরাঁ থেকেই ম্যাকি দেখতে পেলো জেফরির রিক্সাটা এসে থেমেছে বাইরে । জেফরির হাতে একটা বড়সড় এনভেলপ।
“ব্যাপারটা কি, দোস্ত?” জেফরিকে পাশে বসার জন্য ইশারা করে বললো ম্যাকি । “আমি তো টেনশনে পইড়া গেছি।”
মুচকি হাসলো সে, এনভেলপটা টেবিলে রেখে বসে পড়লো। “আমি আসবো এটা আবার টেনশনের কি আছে?”
“আরে তুমি কি আর আগের তুমি আছো, পুলিশের লোক হইয়া গেছে । নিশ্চয় কোনো খুনখারাবির কেস, ঠিক কইছি না?”
মুচকি হাসলো জেফরি বেগ। “তা ঠিক। খুনখারাবি ছাড়া তো আমি কোনো কেস ইনভেস্টিগেশন করি না।”
“আবার টেনশনে ফালায়া দিলা,” কথাটা বলেই ভয় পাওয়ার কপট অভিনয় করলো ম্যাকি । তারপরই হাক দিলো, “আবে ওই মুইনা, এক কাপ চা দে। চিনি কম।”
“তোমার টিমের খবর কি?” জেফরি জানতে চাইলো ।
“কোনো ব্রেকিংনিউজ নাই । সব আগের মতোই আছে। প্রবলেমস আর রিমেইন দ্য সেম…” হেসে ফেললো ম্যাকি। তারপর দ্রুত সিরিয়াস হয়ে উঠলো। এটাই তার বৈশিষ্ট। “আমার টিমের নাম কইয়া যে হালারপো সেন্ট অগাস্টিনে গেছিলো হের পাত্তা লাগাইতে পারছো?”
“হুম।”
“কও কি!” একটু থেমে আবার বললো সে, “আমি ওরে চিনি?”
“আমার মনে হয় ওর ছবি দেখলে তুমি চিনতে পারবে,” বললো জেফরি ।
“ছবি?” ম্যাকি আবারো অবাক হলো । “ওই হালার ছবিও জোগার কইরা ফালাইছো? তুমি তো বহুত কামের আছো!”
মুচকি হাসলো জেফরি বেগ। ঠিক তখনই চা চলে এলো। “লোকটা ভুয়া হলেও অ্যাঞ্জেলস টিমের সত্যিকারের কোচের নাম ব্যবহার করেছে।”
“হালারপুতে করছেটা কি?” একটু রেগে বললো ম্যাকি।
“খুব স্মার্ট লোক, কিন্তু এই কাজটা করেই ভুল করে ফেলেছে,” চায়ে চুমুক দিয়ে বললো সে।
“আলবত ভুল করছে,” নিজের কাপে চুমুক দিলো জেফরির স্কুল বন্ধু । “হালারপুতেরে পাইলে ওর পাছা দিয়া আমি বাস্কেটবল ঢুকামু।”
হেসে ফেললো জেফরি । “তোমার নাম ব্যবহার করার অর্থটা কি বুঝতে পারছো?”
ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো ম্যাকি। “কি?”
“লোকটা তোমাকে চেনে। খুব সম্ভবত এই এলাকারই কেউ হবে হয়তো।”
“কও কি!” ম্যাকির চোখমুখ সিরিয়াস হয়ে উঠলো।
“তুমি বলেছো কয়েক মাস ধরে অ্যাঞ্জেলস টিমের কোচের দায়িত্ব পালন করছো, এ কথাটা খুব কম লোকেরই জানার কথা, তাই না?”
“একদম ঠিক কইছো।”
“তাহলেই বোঝো।”
“ওই হালার নামটা কি?” চায়ে চুমুক দিয়ে বললো ম্যাকি।
টেবিল থেকে এনভেলপটা হাতে তুলে নিলো সে। “তার নাম মিলন।”
“মিলন?! আরে, আমার পরিচিত কতো মিলন আছে জানো? বাইট্টা মিলন, মুরগি মিলন, গিট্ট মিলন, ধলা মিলন, কালা মিলন-” হঠাৎ চুপ মেরে গেলো ম্যাকি।
জেফরি এনভেলপ থেকে মিলনের ছবিটা বের করে তুলে ধরেছে তার সামনে।
“হায় হায়, মুখ দিয়ে অস্ফুট শব্দ বের হলো ম্যাকির। “এইটা তো মনে হইতাছে…” কথাটা বলে জেফরির হাত থেকে ছবিটা নিয়ে নিলো সে।
“চিনতে পেরেছো?” জানতে চাইলো জেফরি। সে নিশ্চিত তার বন্ধু চিনতে পেরেছে।
“কেরাতি মিলন!”
.
হোমিসাইডের কমিউনিকেশন্স রুমে বসে আছে জামান আর রমিজ লস্কর । তাদের বস্ জেফরি বেগ যখন হোমমিনিস্টারের ফোন ট্যাপ করার কথা বলেছিলো তখন বেশ ঘাবড়ে গেছিলো তারা ।
পাগল না হলে কেউ এমন কথা বলে
কিন্তু না, তাদের বস, যাকে হোমিসাইডের সবাই আড়ালে আবডালে জেফবিআই বলে ডাকে, সে মোটেও পাগল নয়। তার মাথাটা বরাবরের মতোই প্রখর আর ঠাণ্ডা। সেই মাথা থেকে উদ্ভট আইডিয়া খুব কমই বের হয়।
রমিজ আর জামানের অবস্থা দেখে জেফরি বেগ খুব মজা পেয়েছিলো। তবে তাদেরকে বেশিক্ষণ টেনশনে রাখে নি । হোমমিনিস্টারের ফোন ট্যাপ করার অন্য উপায়টা বলতেই রমিজ আর জামান হাফ ছেড়ে বাঁচে।
এখন সেই অন্য উপায়েই কাজটা করছে তারা। এটা একদম আইনসম্মত আর নিরাপদ।
জামান আর রমিজ প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে একটা ফোন ট্যাপ করার কাজে ব্যস্ত আছে। তাদের হাতে বড় বড় দুই মগ ভর্তি কফি।
এই কাজটা হলো মাছ ধরার মতো। ছিপ ফেলে ধৈর্য ধরে বসে থাকতে হবে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেও মাছ টোপ গিলতে পারে আবার কয়েক ঘণ্টাও লেগে যেতে পারে। এমনও হতে পারে সারাটা দিন একটা মাছও বঁড়শি গিললো না। সুতরাং এক দিক থেকে এটা যথেষ্ট বিরক্তিকর কাজও বটে। তবে জামান আর রমিজ লস্কর দু’জনেই এ কাজে দক্ষ । তাদের ধৈর্য পরীক্ষা অনেক আগেই হয়ে গেছে ।
কয়েক মিনিট ধরে রমিজ লস্করের কাছে নিজের গুলি খাওয়ার কাহিনীটা বিস্তারিত বলে গেলো জামান। কিভাবে মিলনকে চিহ্নিত করতে পারলো জেফরি, কিভাবে পালালো সে, তার পিছু ধাওয়া করতে করতে গলির মোড়ে এসে গুলি খাওয়া, সব বললো।
জেফরি কেন মিলনকে হাতে পেয়েও গুলি করতে পারলো না সে কথা বলার আগেই একটা বিপ হলো।
রমিজ আর জামান দু’জনেই তাকালো মনিটরের দিকে।
যে নাম্বারটা তারা ট্যাপিং করছে সেটাতে একটা ইনকামিং কল এসেছে । বিগত দু’ঘণ্টায় আরো পাঁচ-ছয়টি কল এলেও সেগুলো ছিলো মাকাল ফল। তারা অবশ্য এটাকে সংক্ষেপে বলে ‘মাফ’।
এবারেরটা কি হয় দেখার জন্য বাটন চেপে কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে নিলো রমিজ। জামান অবশ্য কফিতে চুমুক দিচ্ছে, ইয়ারফোনটা খুলে রেখেছে সে। তার ধারণা, এটা আরেকটা ‘মাফ’।
রমিজ লস্কর মনোযোগের সাথে কিছুক্ষণ শুনে গেলো, তারপর দ্রুত ইয়ারফোন তুলে নেবার ইশারা করলো জামানকে।
বড়শিতে মাছ ধরা পড়েছে! ইয়ারফোনটা কানে লাগাতে লাগাতে ভাবলো জামান ।
প্রায় তিন মিনিট ধরে তারা শুনে গেলো ফোনালাপটি। কলটা শেষ হলে দু’জনেই একে অন্যের দিকে তাকালো বিস্ময় নিয়ে। তাদের বস জেফরি বেগ একদম সঠিক লোককে বেছে নিয়েছে। তবে জামান নিশ্চিত, তার বসও জানে না এই লোক কতোটা গভীরভাবে হাসানের খুনের সাথে জড়িত!
“ইনকামিং কলটার আইডেন্টিফিকেশন কনফার্ম করা দরকার, রমিজ লস্কর কম্পিউটারে কিছু টাইপ করতে বললো, যদিও এরইমধ্যে সে কাজ শুরু করে দিয়েছে ।
জামান চুপ মেরে রইলো।
অরুণ রোজারিওর ফোনে একটু আগে যে ইনকামিং কলটা এসেছিলো সেটার পরিচয় জানতে মাত্র চার-পাঁচ মিনিট লাগলো রমিজ লস্করের ।
হোমমিনিস্টার!
রমিজ আর জামান হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো একে অন্যের দিকে ।
অধ্যায় ৩৯
“কেরাতি মিলন!” কথাটা আপন মনে বললো জেফরি।
একটু আগে ম্যাকি জানিয়েছে, কেরাতি মিলন নামটা এসেছে ‘কারাতে থেকে। কয়েক বছর আগে এই কেরাতি মিলন থাকতো ম্যাকিদের পাশের বাড়িতে। এলাকার ছেলেপেলেদেরকে কারাতে শেখাতো সে। তবে কয়েক বছর ধরে আর পুরনো ঢাকায় থাকে না। ম্যাকি শুনেছে, মিলন ফিল্ম লাইনেও কাজ করেছে। মার্শাল আর্টে বেশ দক্ষ এই লোকটা নাকি ব্ল্যাকবেল্টধারী। জেফরি জানে কথাটা সত্যি। তার গ্রামের বাড়ি থেকেও এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
“ওই মিলন কিন্তু খুব ডেঞ্জারাস মাল, দোস্ত,” ম্যাকি বললো। কথাটা বলে সিগারেটে টান দিলো সে। “টপ টেরর শাহাদাঁতের ডাইন হাত আছিলো।”
“তাই নাকি,” বললো জেফরি বেগ ।
একটু আগে ম্যাকি তাকে জানিয়েছে মিলনের সাথে তার বেশ ভালো খাতিরই ছিলো। সেটা অবশ্য অনেক আগের কথা। গত মাসে লক্ষ্মীবাজারে তার সাথে দেখা হলে চা-সিগারেট খেতে খেতে একটু আড্ডাবাজিও করেছে দু’জন। তখনই নানা কথা বলতে বলতে ম্যাকি তাকে জানিয়েছিলো অ্যাঞ্জেলস টিমের কোচ হবার কথা।
“শোনো, আমি আরেকটা কাজে তোমার কাছে এসেছি,” বললো জেফরি ।
“আরেকটা কাম?” ধোয়া ছেড়ে বললো ম্যাকি।
“হুম…” কিন্তু কিছু বলার আগেই তার মোবাইলফোনটা বেজে উঠলো। পকেট থেকে বের করে ডিসপ্লের দিকে তাকালো সে।
জামান!
রমিজ আর জামানকে সেন্ট অগাস্টিনের প্রিন্সিপ্যাল অরুণ রোজারিওর ফোন ট্যাপিং করার কাজ দিয়ে সে এখানে চলে এসেছিলো । কিন্তু এতো দ্রুত রেজাল্ট পাওয়া যাবে ভাবে নি ।
কলটা রিসিভ করলো জেফরি। ম্যাকি অবাক হয়ে চেয়ে আছে তার দিকে ।
“হ্যাঁ, বলো?”
ওপাশ থেকে জামানের কথা শুনতেই তার চোখমুখের অভিব্যক্তি পাল্টে গেলো। তবে খুব বেশি অবাক হয় নি। এরকম কিছুই প্রত্যাশা করেছিলো সে। কলটা শেষ করার আগে শুধু বললো : “ঠিক আছে…ওই নাম্বারটাও ট্যাপ করো…হুম…কোনো সমস্যা নেই…করো…”
ম্যাকি চুপচাপ বন্ধুকে দেখে গেছে এতোক্ষণ। ফোনটা রাখতেই জেফরিকে সে বললো, “কিছু হইছে নাকি?”
বন্ধুর দিকে তাকালো সে। “না । অন্য একটা কেস।”
“ও,” সিগারেটে আবারো জোরে টান দিলো ম্যাকি । “আরেকটা কামের কথা না কইলা?”
“হুম।” পকেটে মোবাইল ফোনটা রেখে দিলো জেফরি। “মিলনের এক ছোটো ভাই গেন্ডারিয়ায় থাকে…তাকে খুঁজে বের করতে হবে।”
“দোলন?” জানতে চাইলো ম্যাকি।
“তুমি তাকে চেনো?”
“চিনি তো…”
“গুড,” বললো জেফরি বেগ। “ওকে কিভাবে পাওয়া যাবে?”
“ঠিক কুন বাড়িতে থাকে তা তো জানি না, খালি জানি গেন্ডারিয়ায় থাকে।”
“গেন্ডারিয়ায় গিয়ে খোঁজ নিলে জানা যাবে না?”
জেফরির কথায় একটু ভাবলো ম্যাকি। “যাইবো না কেন?…মাগার ফকির-মিসকিনের মতো বাড়ি বাড়ি গিয়া খোঁজ করবা নাকি?”
“তাহলে কিভাবে তাকে খুঁজে বের করা যায়?”
“খাড়াও, আমি দেখতাছি,” কথাটা বলেই মোবাইল ফোনটা বের করলো। “আমাগো এলাকায় এক নয়া রংবাজ পয়দা অইছে…হালায় বিজাইত্যা অইলেও আমারে খুব মানে…” একটা নাম্বার বের করে ডায়াল করলো ম্যাকি। “লুইচ্চা মাসুম…ডেঞ্জারাস পোলা…” কানে ফোনটা চেপে বলে গেলো সে। “দেহি, ওই দোলনের ঠিকানা দিবার পারে কিনা।”
জেফরি কিছু বললো না। মনে হলো ওপাশ থেকে কলটা রিসিভ করা হয়েছে।
“ওয়ালাইকুম…হ, ভালা আছি…তুমি কিমুন আছো?…আচ্ছা…হুনো, আছো কই?…ও…আমি দরবারে আছি…একটু আইবার পারবা?…হ…এহন আইলে ভালা হয়,” জেফরির দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো সে । “হ…জরুরি…জলদি আহো।”
ফোনটা রেখে হাসি দিলো ম্যাকি। “আইতাছে…সামনেই আছে,” তারপর রহস্য করে হেসে বললো, “তুমি হইলা আমার দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই, বুঝছো? থাকো ওয়ারিতে…নতুন বাড়ি করতাছে…মিলনের ভাই দোলন তোমার কাছ থেইকা চান্দা চাইছে,” কথাটা বলেই চোখ টিপে হেসে ফেললো ম্যাকি।
মুচকি হাসলো জেফরি বেগ। “ঠিক আছে, চাচাতো ভাই।”
হা-হা-হা করে হাসলো অ্যাঞ্জেলসস টিমের আসল কোচ। “মুখটারে বেজার কইরা রাখো…দশ লাখ টাকা চান্দা চাইছে…এক্কেবারের পেরেসানের মইদ্যে পইড়া গেছো…ওকে?”
“ওকে।”
কিছুক্ষণ পরই হ্যাংলামতো দেখতে এক ছেলে এসে ম্যাকিকে সালাম দিলো । এ হলো লুইচ্চা মাসুম। সব সন্ত্রাসীকে দেখে চেনা যায় না, তবে লুইচ্চা মাসুমকে দেখলেই মনে হয় এই ছেলেটা অপরাধী কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। চোখমুখ, বেশভূষা সবই খারাপ।
ছেলেটাকে ম্যাকি তার পাশে বসতে দিয়ে জেফরিকে বললো, “এই হলো মাসুম । আমার খুব ঘনিষ্ঠ ছোটো ভাই।”
জেফরি হাত বাড়িয়ে দিলে মাসুম লজ্জিত হয়ে হাত মেলালো ।
“আমার চাচাতো ভাই, আমেরিকায় আছিলো,” ম্যাকি বলে চললো তার বানোয়াট কথাবার্তা। গত মাসে দ্যাশে আইছে। এহন খুব ফাপড়ে পইড়া গেছে।”
কৌতূহলী চোখে জেফরির দিকে তাকালো মাসুম।
“ওয়ারিতে বাড়ি বানাইবার কাম শুরু করছে, বুঝছো…ওইটা নিয়াই ঝামেলা।”
কোনো কিছু না শুনেই মাসুম এমনভাবে মাথা নাড়লো যেনো সব বুঝে ফেলেছে। “ওয়ারির কুন জায়গায়?”
“লারমিনি স্ট্রিটে…” ম্যাকি ঝটপট জবাব দিলো ।
“কতো নম্বর বাড়ি, ভাই?” প্রশ্নটা করলো ম্যাকিকে কিন্তু চেয়ে রইলো জেফরির দিকে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সে।
“চৌদ্দ নম্বর।”
জেফরি অবাক হলো, কতত অবলীলায় ম্যাকি মিথ্যে বলে যাচ্ছে। প্রতিভা আছে বটে ।
চোখ কুচকে জেফরির দিকে চেয়ে আছে মাসুম । “ভাইজানরে কই যেন দ্যাখছি?”
প্রমাদ গুনলো জেফরি । এই বদখতটা আসমানজমিনের পাঠক না তো?
“ওয়ারিতে দ্যাখছো মনে হয়, ম্যাকি বললো ।
“অইবার পারে।” এখনও চেয়ে আছে মাসুম ।
“হুনো, আমার এই ভাই তো পেরেসানির মইেদ্যে পইড়া গেছে, ম্যাকি বললো মাসুমকে। “ওর কাছ থেইকা চান্দা চাইছে…দশ লাখ!”
“কে চাইছে?”
“দোলন।”
“দোলন!” অবাক হলো মাসুম। “কুন দোলন?”
“ওই যে কেরাতি মিলন আছিলো না, ওর ছোটো ভাই।”
“অ্যাঁ!” বিস্মিত হলো মাসুম। “দোলন ভাই চাইছে?…কন কি?”
“হ, আমিও তো বুঝবার পারতাছি না, মাসুম…”
“কিন্তু হের তো চান্দা চাইবার কথা না, ভাই।”
“ক্যান?” ম্যাকি বুঝতে পারছে না সে সঠিক জায়গায় ঢিল মেরেছে কিনা।
“তিন বছর ধইরা দোলন ভাই এই লাইন ছাইড়া দিছে…গত বছর তো হজ্বও কইরা আইলো। না, ভাই, দোলন ভাই না। ঠিক কইরা কন, কুন দোলন চাইছে?”
ম্যাকি তাকালো জেফরির দিকে। “তোমারে তো দোলন নামই কইছে,?”
“হুম,” মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি ।
“মিলনের ভাই দোলন কইছে?”
মাসুমের কথায় আবারো মাথা নেড়ে সায় দিলো সে।
“বেলাফ মারছে, ভাই।”
“কও কি?” ম্যাকি অবাক হবার অভিনয় করলো।
“ঈমানে কইতাছি, বেলাফ দিছে। কুনো পাইনা রংবাজের কাম এইটা।” তারপর হলুদ দাঁত বের করে হেসে ফেললো। “চিন্তা কইরেন না, বড় ভাই,” কথাটা বললো জেফরিকে। আবার যদি ফোন করে কইবেন, নাকটিরপো, দশ লাখ ট্যাকা তোর গোয়া দিয়া ভইরা দিমু…”
জেফরি আর জামান একে অন্যের দিকে তাকালো । কথাটা শুনে খুব হাসি এলেও জোর করে আঁটকে রাখলো জেফরি ।
“কিন্তু ওইটা যদি আসলেই দোলন হইয়া থাকে, তাইলে?” ম্যাকি বললো মাসুমকে।
“কইলাম তো ভাই, ওইটা দোলন ভাই না। বিশ্বাস না অইলে আপনে নিজে দোলন ভায়ের লগে দেহা কইরা জাইন্যা নিয়েন…”
মাসুমের এ কথাটা শুনে জেফরি আর জামান আবারো একে অন্যের দিকে তাকালো। এতোক্ষণ পর আসল কথায় চলে এসেছে মাসুম।
“কিন্তু আমি তো জানি না দোলন কই থাকে,” বললো ম্যাকি ।
“অসুবিধা নাই, আমি আপনেরে হের ঠিকানা দিতাছি।”
“হ, ঠিকানাটা দাও। আমি নিজে গিয়া দোলনের লগে দেহা করুম।” ম্যাকি তাড়া দিয়ে বললো কথাটা।
“গেন্ডারিয়ার সাধনার গল্লি আছে না…ওই গল্লিতে ঢুইকা হাতের ডাইন দিকে একটা লন্ড্রির দোকান দেখবেন। দোকানটার লগে একটা পাঁচতলার বিল্ডিং আছে না…ওইটার চাইর তলায় থাকে।”
মাসুমের কথা শুনে ম্যাকি মাথা নেড়ে সায় দিলো। “চা খাইবা নি?”
“আরে না, টাইম নাই,” কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ালো মাসুম। “আমি তাইলে যাই ।” এবার জেফরির দিকে তাকালো সে। “কুনো টেনশন কইরেন না, বড় ভাই। আমি শিউর, বেলাফ মারছে।”
হাত বাড়িয়ে দিলো জেফরি । “থ্যাঙ্ক ইউ, ভাই।”
জেফরির সাথে করমর্দন করে ম্যাকিকে সালাম দিয়ে চলে গেলো মাসুম।
“কি বুঝলা?” ম্যাকি বললো জেফরিকে।
“তার আগে বলো, ওয়ারির লারমিনি স্ট্রিট, চৌদ্দ নাম্বার বাড়ি, এতো কিছু চট করে কিভাবে বললে?”
হা-হা-হা করে হেসে ফেললো ম্যাকি। “আরে, বুঝলা না?”
মাথা দোলালো জেফরি ।
“অমর্ত্য সেন।”
“কি?!”
“আমাগো স্কুলের ফেমাস স্টুডেন্ট…একোনমিক্সে নোবেল পাইছে…”
জেফরি কিছুই বুঝতে পারছে না। নোবেল লরিয়েট প্রফেসর অমত্য সেন তাদের স্কুল সেন্ট গ্রেগোরির ছাত্র ছিলো সেটা অনেকেই জানে কিন্তু চৌদ্দ লারমিনি স্ট্রিটের সাথে তার কী সম্পর্ক?
“হের বাপ-দাদার বাড়ি আছিলো চৌদ্দ নম্বর লারমিনি স্ট্রিটে…এইটা তো এহন জেনারেল নলেজের সাবজেক্ট হইয়া গেছে…ওইটাই আমি ইউজ করছি!” খিক খিক করে হাসতে লাগলো ম্যাকি।
ওহ!