৩০. ঘুম আসতে রাত্রি তৃতীয় প্রহর পার

ঘুম আসতে রাত্রি তৃতীয় প্রহর পার হয়ে গিয়েছিল। রাত্রি দেড়টার সময় ইনজেকশন দিয়ে। প্রদ্যোত বাড়ি গিয়েছিল, তারপর ছেলেটির নাড়ি দেখে মশায় বাড়ি ফিরেছিলেন। বিছানায় শুয়ে অনেক কথা মনে পড়েছে; ঘুম আসতে তিনটে পার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ঘুম ভাঙল সকালেই। ছেলেটির জন্য উৎকণ্ঠা নাই। সে তিনি রাত্রেই বুঝে এসেছেন। সংকটের ক্ষণ আসতে আসতে, আসতে পায় নি, গতিকে মোড় ফিরিয়েছে ওষুধ। তবু ঘুম ভাঙল। জ্বর কমেছে, ওই ফুলোটা কীভাবে কমে, কতটা কমেছে দেখতে হবে। রাত্রে ভাল দেখা যায় নি। প্রদ্যোত ডাক্তারকে অভিনন্দন জানাতে হবে, অকুণ্ঠ অভিনন্দন। সে ঘড়ির কাঁটার মত আসবে, ইনজেকশন দেবে।

আতর-বউ তার আগেই উঠেছেন। নিচে একদফা তেজ বিকিরণ শেষ করেছেন। ভোরবেলা কালীতলায় জল দিতে গিয়ে মতি কর্মকারের মাকে দেখেছেন। কালীতলার পাশেই মতির বাড়ি; মতির মা কোঠাঘরের জানালা খুলে কালীমন্দিরের দিকে তাকিয়ে কাতরস্বরে যন্ত্রণা উপশমের জন্য প্রার্থনা জানাচ্ছিল। মতির মায়ের প্লাস্টার-করা পায়ের যন্ত্রণা কাল কোনো কারণে বেড়েছে। সম্ভবত বর্ধমান থেকে এখানে আসার পথে কোনো কিছু অনিয়ম ঘটে থাকবে। মতির মাকে দেখে আতর-বউ তারই উপর বর্ষণ করেছেন তাঁর রাত্রির অবরুদ্ধ ক্ৰোধ।

মানুষের এত বাবার সাধ? এত ভয়? মরণে এত দুঃখ! চিরন্তন প্রশ্নগুলি তিরস্কারের সঙ্গে মতির মায়ের কাছে উথাপিত করেছেন। বাড়ি ফিরেই স্বামীকে নিচে নামতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন—এত সকালে উঠলে? শুয়েছ তো রাত্রি দুটোর পর।

-ঘুম ভেঙে গেল। ছেলেটার খবর নি—কেমন আছে?

–ওখানেও কি কিছু হেঁকে বসে আছ নাকি?

গভীর স্বরে মশায় ডেকে উঠলেন–নারায়ণ নারায়ণ!

–আর তোমার নারায়ণ নারায়ণ! নিজের সন্তানের মৃত্যুকালে ওষুধ দিতে বললে যে দুধ। গঙ্গাজল দিতে বলে, তাকে কিছু বিশ্বাস নাই। কিন্তু সেকাল এককাল ছিল। একাল হলে আর এই ডাক্তারের মত ডাক্তার হলে বনু মরত না। মতির মাকে দেখে এলাম। কোঠার জানালা খুলে কালীমাকে প্রণাম করছে।

মশায় ক্ষুব্ধ হলেন না। একটু হাসলেন। কী বলবেন আতর-বউকে? জীবনের দুরারোগ্য অথচ অক্ষম ব্যাধির মত! মৃত্যুর শান্তি কোনোদিন দিতে পারবে না, শুধু ব্যাধির জ্বালা-যন্ত্রণায় কষ্ট দেবে।

স্বামীর মুখে হাসি দেখে আতর-বউও হাসলেন। হেসে বললেন– রতনবাবুর ছেলেকে দেখে কী বলে এসেছ? ছি-ছিছি! ওরকম করে বোলো না, বলতে নাই। বয়স হয়েছে। এখন ভ্রম হবে। সেটা বুঝতে হয়। কাল তখন অনেক রাত, তুমি অহি সরকারদের বাড়িতে। রতনবাবুর লোক এসে চারটি টাকা আর চিঠি দিয়ে গিয়েছে। আমি ব্যস্ত হলাম। কী জানি, এখুনি হয়ত যেতে হবে। বিনয় তখনও বসে ছিল—তাকে ডেকে পড়লাম। সে বললে—মশায়কে যেতে বারণ করেছে। ডাক্তারেরা সবাই বলছে—ভাল আছে। এক মশায় বলেছেন, মুখে কিছু। বলেন নি, ইশারায় বলেছেন—ভাল নয়। তা বিপিনবাবুর ইচ্ছে এই নাও চিঠি। রাত্রে দিই। নি। কী জানি, মানুষের মন তো!

চিঠি আর চারটি টাকা নামিয়ে দিলেন। মশায় টাকাটা ছুঁলেন না। চিঠিখানাই তুলে নিলেন। হ্যাঁ, তাই লিখেছে রতনবাবু। ক্ষমাও চেয়েছে তার কাছে। লিখেছে—তোমার ইঙ্গিত যে ধ্রুব সত্য তাহা আমি জানি। এবং সে সত্যকে সহ্য করিবার জন্য নিজেকে প্রস্তুতও করিতেছি। কিন্তু বিপিন তাহা পারিল না। প্রদ্যোতবাবু প্রভৃতি ডাক্তারেরা অন্য মতই পোষণ করেন। সকলেরই মত বিপিন ভাল আছে। এবং কলিকাতা হইতে বড় ডাক্তার চ্যাটার্জি মহাশয়কে আনিবার কথা বলিয়াছে। বিপিনেরও তাই ইচ্ছা। সুতরাং…।

যাক, মুক্তি! একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন মশায়। কিন্তু মুক্তিই বা কোথায়? বিপিন তো। তাঁকে সে যেতে বারণ করেছে, তিনি যাবেন না, কিন্তু সে পিঙ্গলকেশী তো ফিরবে না। বিপিনের জন্য দুঃখে মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল।

—মশায়! উঠেছেন? মশায়?

ভারী গলা, দীর্ঘায়িত উচ্চারণ; এ রানা পাঠক। ওকে আজ আসতে বলেছিলেন কাল।

—মশায়!

রানা অধীর হয়ে উঠেছে মনে হচ্ছে।

 

—কাল রাত্রে রক্ত একটু বেশি উঠেছে মশায়।

–এ অবস্থায় তোমার হেঁটে আসা উচিত হয় নি, বাবা।

–কী করব? আপনি যে আসতে বলেছিলেন আজ।

একটু চুপ করে থেকে মশায় বললেন– কিন্তু আমি কী করব বাবা, এ রোগে?

–পরমায়ু থাকলে বাঁচাবেন, না থাকলে সময়ে বলে দেবেন, কালী কালী বলে তৈরি হয়ে যাব আর যতটা পারবেন কষ্টের লাঘব করবেন। আর কী করবেন?

—মশায়!

–রানা!

–দেখুন আমার হাত। কী ভাবছেন আপনি?

মশায় বললেন–ভাবছি, তুমি প্ৰদ্যোত ডাক্তারদের দেখিয়ে–

বাধা দিয়ে রানা বললে—আজ্ঞে না। ও লোকটির নাম আমার কাছে করবেন না। ওর নাম না, চারুবাবুর নামও না। ওদের দুজনের কাছে আমি গিয়েছিলাম। সব কথা আপনাকে বলি নি। শুধু বলেছিলাম, ওরা লম্বা ফর্দ দিয়েছে। কিন্তু আরও আছে। আমি বলেছিলাম—এক্স-রে-টে–যা বলছেন—কমসমে করিয়ে দেন। বামুন বলে গরিব বলে ক্ষ্যামাঘেন্না করে নিন। তা হাসপাতালের ডাক্তার বললেবামুটামুন আমি মানি না। আর গরিব বলেই বা তোমাকে দয়া করব কেন? তুমি অসচ্চরিত্র লোক, একটা স্ত্রীলোক থেকে অসুখ ধরিয়েছ। চারুবাবু বললে–তোমাদের ঘরে মাকালী রয়েছে গো, অনেক পয়সা পাও তোমরা। তারপর হেসে বললে–মা-কালীর কাছে পড় না হে। মা-কালী সারাতে পারবে না? …ওদের কাছে আমি যাব না।

বিষণ্ণ হাসি ফুটে উঠল মশায়ের মুখে। রানার অন্তরের ক্ষোভটুকু তিনি অনুভব করতে পারলেন। রানাদের জাত আলাদা। এ কথা ওরাই বলতে পারে।

রানা বলে গেল—আপনাকে বলেছি, একটি মেয়েলোক থেকে আমার মত অসুরের দেহে রোগটা ঢুকে গেল। কলকাতার এক হতভাগিনী মেয়ে। কলকাতার দাঙ্গার সময় গুণ্ডারা তাকে লুট করে। তারপর এখান ওখান করে তার লাঞ্ছনার আর বাকি রাখে নি। কোথা সেই বেহার পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে আবার কলকাতা–কলকাতায় আমাদের গায়ের ওপাশে গঙ্গারামপুরের মুসলমান গুণ্ডা রহমত ওকে পায়, সে তাকে বোরখা পরিয়ে নিয়ে আসে এখানে। নদীর ঘাটে নৌকোর উপর উঠিয়েছিল। আমি লগি ধরেছিলাম। আমার গলায় পৈতা। এই দেহ। তার ওপর লগিতে ঠেলা দিয়ে হক মারলামজয় কালী! সব হরি হরি বল! নৌকোতে সবই প্রায় হিন্দু। সবাই হরিবোল বলে উঠল। মেয়েটা তখন সাহস পেয়ে বোরখা ফেলে দিয়ে চিৎকার করে উঠল—আমাকে বাঁচাও, আমি হিন্দুর মেয়ে। ওরা আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। রহমত ছুরি বার করেছিল কিন্তু আমার হাতের লগি তখন উঠেছে। মেরে উঠলাম হাঁক! রানা পাঠককে রহমত জানে। বেটা ঝপ করে নদীতে লাফিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে তার সঙ্গীটা। মেয়েটাকে নিয়ে গেলাম বাড়ি। মুসলমানেরা এল। বললে—দিয়ে দাও, নইলে ভাল হবে না। আমি বললাম মন্দকে ভয় করে না রানা, তা তোরা জানিস। পারিস নিয়ে যাস সেই মেয়ে। বাড়ি ফিরতে চাইলে না। থেকে গেল। তাপরেতে ঘি আর আগুন; জানতাম না মেয়েটার এ রোগ আছে। মেয়েটাও জানত না ঠিক। ক্রমে জানা গেল। কিন্তু তখন ওকে ছাড়া আমার সাধ্যর বাইরে। চরিত্রহীন বলছে বলুক, আমি ওকে বিয়ে একরকম করেছি। ভালবেসেছি মেয়েটাকে। ভালবাসতে গিয়ে রোগ ধরেছে, তার রোগ নিয়েছি, তাতে আমার লজ্জা নাই। সে যে যা বলবে বলুক। মরেও আমার সুখ। আর চারুবাবু বলে কালীর কথা। কালীর কাছে রোগ সারে কি না জানি না। তবে মায়ের ইচ্ছে হলে সারে। কিন্তু কালীর কাছে রোগ সারিয়ে দাও-এ বলতে আমি শিখি নাই মশায়। কালীর কাছে চাই—কালকে যেন ভয় না করি। তাকেই বলে মোক্ষ। কালীর কাছে চাই কালীর কোল! আপনি আমাকে ঘেন্না করবেন না, মাকালী নিয়েও তামাশা করবেন না আমি জানি। তাই আপনার কাছে আরও আসা।

তা তিনি করবেন না। করেন না। তাঁর বাবা বলতেন—রোগীকে রোগ নিয়ে কখনও কটু কথা বোলো না। কখনও শ্লেষ কোরো না। পাপ-পুণ্যের সংসারে মানুষ পুণ্যই করতে চায়, কিন্তু পারে না। শাসন কোবরা, ধমক দিয়ো, প্রয়োজন হলে ভয়ও দেখিয়ো। কিন্তু মর্মান্তিক কথা বোলো না, আর রোগী শরণাপন্ন হলে ফিরিয়ে দিয়ো না।

গুরু রঙলাল বলতেন মানুষ বড় অসহায়, জীবন। রাগ কোরো না কখনও। ঘৃণাও না।

গুরু রঙলাল অনেক ক্ষেত্রে রোগীর গালে চড় মেরেছেন। ভূপী বোসকে মেরেছিলেন। এক। শৌখিন তান্ত্রিক লিভারের কঠিন অসুখ নিয়ে এসেছিল তার কাছে। তিনি মদ খেতে নিষেধ করেছিলেন। সোজা কথা ছিল তাঁর। বলেছিলেন মদ খেলে বাঁচবে না। মদ ছাড়তে হবে। রোগী বলেছিল—কিন্তু আমার সাধনভজন? রঙলাল ডাক্তার বলেছিলেন–বিনা মদে কাসার পাত্রে নারকেল জল-টল দিয়ে করবে। পাঁঠা বলির বদলে মাষকলাই ছড়িয়েও তো হয় হে। লোকটা জিভ কেটে বলেছিল—বাপ রে! তা হলে আর মা দেখাই দেবেন না! ও আমার মায়ের আদেশ! মা আমাকে দেখা দিয়ে বলেছেন ডাক্তারবাবু। রঙলাল ডাক্তার খপ করে তার চুলের মুঠো ধরে বলেছিলেন কী বললি? মা তোক দেখা দিয়ে এই কথা বলেছেন? মিথ্যেবাদী! মা মদ খায়? খেতে বলে? যে মদে লিভার পচে–সেই মদ?

জীবনমশায় জানতেন—এ রোগী বাঁচবে না। প্রবল রিপুপ্রভাবে সে অসহায়। বাঁচেও নি সে।

মানুষ অসহায়, বড় অসহায়! প্রবৃত্তির তাড়নায় সে মর্মান্তিক কলঙ্ক-কাহিনী রচনা করে চলে। আজ রচনা করে—কাল অনুশোচনা করে, নিজেকেই নিজে অভিসম্পাত দেয়। মনে মনে ভাবে আকাশে সূর্য নিভে যাক; কাজ নাই, আলোতে কাজ নাই। অন্ধকারে ঢাকা থাক সব। বহু দেখেছেন তিনি। উপার্জনক্ষম পুত্রের মৃত্যুশয্যায় পিতাকে উইল তৈরি করিয়ে নিতে দেখেছেন বধূকে বঞ্চিত করে। আরও কঠিন পাপ করতেও দেখেছেন। ভাই-ভাগ্নে এদের কথা তিনি ধরেন না। পুত্রকেও ক্ষমা করেন তিনি। স্ত্রীর মৃত্যুশয্যায় স্বামীর ব্যভিচারে লিপ্ত থাকার ইতিহাস অনেক। স্বামীর মৃত্যুশয্যায় স্ত্রীও ব্যভিচার করে, ভ্ৰষ্টা স্ত্রী। ভ্ৰষ্টা নয় এমন অনেককে গোপনে মাছ চুরি করে খেতে দেখেছেন এই কঠিন লগ্নে। শুধু মা, মায়ের পুণ্য অক্ষয়।

মানুষ বড় অসহায়!

মশায় একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। রানা ডাকলে—মশায়!

–একটু বসে জিরিয়ে নাও বাবা। কথা বোলো না। অনেকটা হেঁটেও এসেছ। একটু পরে দেখব। বোসা। আমি এদের এই ছেলেটাকে দেখে আসি।

অতসীর ছেলে আজ ভাল আছে। জ্বর কম, ফুলোটাও কমেছে। ফুলোর উপরের রক্তাভার গাঢ়তাও কম হয়েছে। পরিধি কমে নি, কিন্তু বাড়ে নি, থমকে দাঁড়িয়েছে। কাল সকালে জ্বর ছিল একশো দুইয়ের কাছাকাছি, আজ সকালে জ্বর একশো একের নিচে। চৈতন্যের উপর আচ্ছন্নতার যে একটি আবরণ পড়েছিল, সেটি কেটে এসেছে; কুটকুট করে দু-চারটি কথা বলছে। ঠিক সাতটার সময় প্রদ্যোত ডাক্তারের বাইসিকেলের ঘণ্টা বেজে উঠল। ভোর পাঁচটার ট্রেনে সদর শহর থেকে অরুণেন্দ্র ব্লাড রিপোর্ট পাঠিয়েছে। কঠিন রোগ, মারাত্মক সংক্ৰমণ হয়েছিল—অরুণেন্দ্র রিপোর্টে লিখেছে উইথ এ টেন্ডেন্সি টু ইরিসিপ্লাস। চিকিৎসা তার নির্ভুল হয়েছে। রিপোর্টের জন্য কী উৎকণ্ঠাতেই কাল দিনরাত্রি সে কাটিয়েছে। পৃথিবীতে অমৃতই শুধু ওষুধ নয়, বিষও ওষুধ। কাল দিনরাত্রে এমনি ওষুধ অনেকটাই সে দিয়েছে। বৃদ্ধ মশায় অবশ্য তাকে বলেছিলেন কিন্তু তার উপর পূর্ণ ভরসা করতে সে পারে নি। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাতেই কত ক্ষেত্রে কত ভ্ৰম হয়, কত ক্ষেত্রে প্রথম দু-তিনবার পর্যন্ত রোগ ধরা পড়ে না। এ তো মানুষের অনুভব অনুমান। কাল বিকেলে তার যখন সন্দেহ হয়েছিল মাস বলে এবং যখন ওই বৃদ্ধ বলেছিলেন মাস নয়; কঠিন বিষজর্জর রক্ত দূষিত করেছে, ঝড়ের মত বাড়ছে এবং বাড়বে—তখন তার খানিকটা রাগ হয়েছিল। বৃদ্ধ যদি বলত এ মৃত্যুরোগ তবে প্রদ্যোত হয়ত রাগে নিজেকে হারিয়ে ফেলত। মৃত্যুরোগ-নিৰ্ণয়-শক্তির একটা সুপিরিয়রিটি-কমপ্লেক্স বৃদ্ধের মাথা খারাপ করে দিয়েছে।

দাঁতু ঘোষাল ভাল আছে। বিপিনবাবু ভাল আছেন। মতির মা বর্ধমান থেকে ফিরে এসেছে। কাল। বুড়ির পায়ের যন্ত্রণা কাল রাত্রে বেড়েছে একটু। এই এখুনি এখানে আসার পথে, মতি মুখ-শুকনো করে দাঁড়িয়ে ছিল; বলেছে—ডাক্তারবাবু মায়ের পায়ের যন্ত্রণা যে বেড়ে গেল কাল রাত্রি থেকে! তা হলে?

প্রদ্যোতের বুঝতে বাকি থাকে নিমতি যা বলতে চাইছে অথচ মুখে উচ্চারণ করতে পারছে না, সে কথাটা কী? একবার মনে হয়েছিল বলে, তা হলে মশায় যা বলেছিল তাই কর। খোল করতাল বাজিয়ে নিয়ে যাও গঙ্গাতীরে। কিন্তু আত্মসংবরণ করেছে। বলেছে আসবার সময় দেখব। কিছু নয়, ট্রেনে আসবার সময় পা নিয়ে নড়াচড়া হয়েছে, সেইজন্য বেদনা হয়ে থাকবে।

 

প্রদ্যোতকে সাদর সম্ভাষণ মশায়ই জানালেন—আসুন। রোগী আপনার দিব্যি কথা বলছে। ভাল আছে।

কপালে হাত ঠেকিয়ে নীরবে প্রতি-নমস্কার জানিয়ে রোগীর বিছানার পাশে বসল।

মশায় বললেন–আমি দেখেছি—

মধ্যপথে বাধা দিয়ে প্রদ্যোত বললে–আমি দেখি।

–বিপদ কেটে গিয়েছে।

–না। বলেই প্রদ্যোত প্রশ্ন করলেন–রাত্রে প্রস্রাব কেমন হয়েছে বলুন তো?

বৃদ্ধ বুঝতে পারছেন না, ওষুধের প্রতিক্রিয়া আছে। প্রস্রাব বন্ধ হতে পারে। পেটে ফাঁপ দেখা দিতে পারে।

প্রস্রাব কমই হয়েছে। রাত্রি বারটা থেকে সকাল পর্যন্ত একবার। পেটে ফাপ রয়েছে একটু। রোগী বেশ কয়েকবার জলের মত তরল মলত্যাগও করেছে, পেটের দোষ হয়েছে। প্রদ্যোত ডাক্তার গভীর মনোযোগর সঙ্গে দেখে তারপর ইনজেকশনের সিরিঞ্জ বের করলে।

 

ইনজেকশন শেষ করে প্রদ্যোত উঠল। কই? মশাই কই?

–নাই। চলে গিয়েছেন। অহি সরকার বললে, ওঁর আরোগ্য-নিকেতন থেকে ডাকতে এসেছিল।

প্রদ্যোত একটু দাঁড়িয়ে ভেবে নিল। সে কি কোনো রূঢ় কথা বলেছে? না। বলে নি।

অহি বললে—উনি বলে গেলেন আমাকে ডেকে, বিপদ কেটে গিয়েছে। আপনার খুব প্রশংসা করে গেলেন। বললেন, খুব যুঝেছে। খুব সাহস। খুব ধীর।

প্রদ্যোত বললে, প্রস্রাবের উপর নজর রাখবেন। একটু দেরিতেই হবে। তবু লক্ষ্য রাখবেন। আর পেটে ফাপ একটু রয়েছে ওই ফাঁপটা দেখবেন। বাড়ছে মনে হলেই আমাকে খবর দেবেন। আর একটা কথা, মশায় নাড়ি দেখছেন বার বার, এটা ঠিক হচ্ছে না। আপনারাও চঞ্চল হতে পারেন। আমারও একটু কেমন মনে হয়। বেরিয়ে এল সে।

সাড়ে আটটা বাজছে। হাসপাতালে কত কাজ, কত কাজ! কম্পাউন্ডার হরিহর এখানকার লোক, বয়স হয়েছে। লোকটি আশ্চৰ্য শিথিল-চরিত্র। হবে-হচ্ছে করেই চলা স্বভাব। দু-দশ মিনিটে কী আসে যায়? নার্সরাও সুবিধে পায়।

মঞ্জুকে বলে এসেছে। সে অবশ্য দেখবে। নিয়মিতভাবে সে এসব দেখে। এদিক দিয়ে সে ভাগ্যবান। মঞ্জু তাঁর কর্মের বোঝার ভার মাথায় তুলে নিয়েছে। রোজ সকালে একবার নিজে সে রোগীদের খোঁজ নিয়ে আসে, মিষ্ট কথায় সান্ত্বনা দিয়ে আসে। হাসপাতালটির পরিচ্ছন্নতার দিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার। নিজের বাড়ি থেকে মধ্যে মধ্যে পথ্য তৈরি করে দিয়ে আসে। মেয়েদের সম্পর্কে বলতে গেলে মঞ্জুর জন্যই সে নিশ্চিন্ত। রোগিণীদের ও দিদি। ষাট বছরের রোগিণীও দিদি বলে।

এই দাঁতু ঘোষালটা তো মঞ্জুকে পেয়ে বসেছে। হাসপাতালের ভাতের সঙ্গে মঞ্জুর পাঠানো তরকারি ভিন্ন চিৎকার করবে। মঞ্জুকে রাজ্যের ভূত-প্রেতের গল্প বলে ভাব জমিয়েছে দাঁতু ঘোষাল। লোটা অত্যন্ত পাজি। হাসপাতালে থেকেও কী করে যে ও গাঁজা খায়-গাঁজা পায়–বুঝতে পারে না প্রদ্যোত। ওকে তাড়িয়েই দিত সে। কিন্তু মশায়ের নিদানটার জন্যই রেখেছে। দেখবে সে।

আরোগ্য-নিকেতনের সামনে দিয়ে যাবার পথে নজরে পড়ল-মশায় কার হাত দেখছেন। ঘাড়টি ঈষৎ ঝুঁকে পড়েছে। বোধ করি চোখ বন্ধ করে রয়েছেন। প্রদ্যোত হাসলে। সে শুনেছে, বিনয় মশায়কে তার দোকানে বসবার জন্য ধরেছে। অন্তত কিছুকালের জন্য। যতদিন সে কোনো পাস-করা ডাক্তারকে এনে বসাতে না পারে!

 

রানার হাতই দেখছিলেন মশায়। ভুজঙ্গগতি। কুটিল সর্পিল ভঙ্গি। এ সাপ রাজগোরই বটে, দেহ-বিবরের মধ্যে বাসা বেঁধেছে; তার বিষ-নিশ্বাসে সারাটা দেহ অহরহই জ্বরজর্জর। গায়ের গন্ধ থেকেও বুঝতে পারছেন। সাপের গায়ের গন্ধ চেনে যে প্রবীণ বিষবৈদ্য, গর্তের বাইরে বসেও তার গায়ের গন্ধ পায়। সে গন্ধ তিনিও পাচ্ছেন। ধীরে ধীরে এবার চোখ খুলে চাইলেন। রানার মুখের দিকে তাকালেন। চোখের চারিপাশে কালো ছায়া পড়েছে; চোখ দুটি ক্লান্তিতে কৃষ্ণপক্ষের চন্দ্রের মত বিষণ্ণ, তার চারিপাশে রাহুর উদ্যত গ্রাসের মত গাঢ় কৃষ্ণমণ্ডল। রানার হাতখানি ছেড়ে দিয়ে বিষণ্ণ হেসে বললেন–রোগ তাই বটে বাবা।

রানা হেসেই বললেসে তো আমি জানি গো! নিজে তো গোড়া থেকেই বলছি। তা কী বুঝছেন? বাঁচব? ভাল হবে? না? একটু হেসে বললে—যদি মরি তো কতদিনে মরব? বলুন। আপনি, অসঙ্কোচে বলুন। রানা ভয় করে না।

মশায় চুপ করে রইলেন। ভাবছিলেন নূতন ওষুধ উঠেছে স্ট্রেপ্টোমাইসিন, তার কথা। সে নাকি অব্যৰ্থ।

রানা আবার বললে–বলুন গো! আপনি মশায়, আপনি ভয় করছেন কেন গো!

মশায় বাইরের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলেন। তিনি হঠাৎ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন– আজও কিছু বলব না বাবা। তুমি কাল বিকেলে আসবে—এখানে নয়, বিনয়ের দোকানে। ওখানেই আমাকে পাবে। কিন্তু হেঁটে এমন করে এসো না, গরুর গাড়ি করে আসবে। হাঁটাহাটি পরিশ্রম এসব এখন স্থগিত রাখ। আর সেই মেয়েটির সংস্রব একেবারে পরিত্যাগ করতে হবে। বুঝেছ?

রানা খুশি হয়ে উঠল। বললে—আজ্ঞে হ্যাঁ। যা বললেন– আমি তাই করব। কাল আমি গাড়ি করে বিনয়ের দোকানেই আসব। আর একটা কথা আছে আমার, রাখতে হবে।

–কী, বল? হাসলেন মশায়।

–সে মেয়েটার ব্যামো আমার চেয়েও বেশি। বাঁচবে না। তবে রোগ তো একই। তাকেও আমার সঙ্গে দেখুন না কেন? আপনি বিশ্বাস করুন, আদি। তাকে ছোব না। কিন্তু তাকে যখন আশ্রয় দিয়েছি—আর ধরুন—তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি। একটা দায় তো আমার আছে। তাকে আজ তাড়িয়ে দেওয়াটা কি আমার পাপ হবে না? সে হতভাগী আবার কোথায় কার ঘরে যাবে, বিষ ছড়াবে!

—এনো। তাকেও এনো। দেখব।

রানা চলে গেল। মশায় বিনয়কে বললেন–এই জন্যেই রানাকে আমি এত ভালবাসি।

বিনয় হেসে বললে—আমাকেও বাসেন। আমার দোকানে বসতে রাজি হয়ে আমার কী মুখটা যে রেখেছেন আপনি—সে কী বলব?

ইন্দির এসে দাঁড়াল। একখানা ফর্দ হাতে দিলে। বললে—একবারে মাসকাবারি হিসেব করে জিনিস নিয়ে এলাম। এই ফর্দ।

মোয় হাসলেন, বললেন–উত্তম। গিনিকে দাও গে, রেখে দেবে। না হয় ফেলে দেবে। কমিশনে কুলোয় ভাল, না হলে বিনয়কে তালগাছ দিলেই হবে।

বিনয়ের দোকানে বিকেলবেলা বসতে তিনি রাজি হয়েছেন। অহি সরকারের বাড়ি থেকে এসে রানার পাশে বিনয়কে বসে থাকতে দেখেই বলছেন—এসেছিস? আচ্ছা তাই হল, বসব তোর দোকানে। ইন্দির চলে যেতেই সেতাবের দিকে তাকিয়ে মশায় বললেন–বলছিলাম না, সংসারচক্র! এই দেখ বিনয়চন্দ্র মাসকাবারি জিনিস পাঠিয়ে দিয়েছে।

সেতাব বসে ছিল ঘরের কোণে। সামনে দাবার ছকটি বিছিয়ে দুদিকেই খুঁটি সাজিয়ে নিবিষ্ট মনে খেলে যাচ্ছিল।

এতক্ষণে মুখ তুলে সেতাব বললে—তালগাছ বেচতে গিনি রাজি হয়েছে?

জীবন মশায়ের লাইকার পুকুরে পঁচিশটা তালগাছ আছে। সোজা এবং সুদীর্ঘ আর বহু পুরনো। এ অঞ্চলে গাছ কটির খ্যাতি বহুবিস্তৃত এবং সর্বজনস্বীকৃত। এমন পাকা সোজা তালগাছ। একালে সুদুৰ্লভ। ওই গাছ কটি আতর-বউয়ের সম্পত্তি, তার বক্ষপঞ্জর বললেও অত্যুক্তি হয়। না। যুদ্ধের আগেই এসব গাছের দাম ছিল তিরিশ টাকা। এখন আশি-নব্বই টাকা লোকে হাসিমুখে দিতে চায়। কিন্তু আতর-বউ তা দেবেন না। ছন্নমতি লক্ষ্মীছাড়া ভাগ্যহীন স্বামীর উপর তাঁর আস্থা নাই। পঁচিশটির দশটি নিজের এবং দশটি স্বামীর পারলৌকিক ক্রিয়ার জন্য রেখেছেন। পাঁচটি রেখেছেন আপকালের জন্য।

জীবনমশায় হেসে বলেন-কুড়িটি হল ভবসাগর পারের ভেলা। আর পাঁচটি হল শেষ বয়সে খানা-খল পার হওয়ার নড়ি। তা বিনয় বলেকয়ে ওই পাঁচটি নড়ির থেকে একটা দিতে রাজি করেছে। বলেছে, টাকাটা পোস্টাপিসে জমা রেখে দেব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *