৩০
গিরিশদার বাড়ি অনেকদিনই যায় না পৃথু। কিন্তু সাবীর মিঞার বাড়ি যায় না আরও বেশি দিন। ডিসেম্বর মাস পড়ে গেল। টুসু মিলির দুজনেরই পরীক্ষা হয়ে গেছে কিন্তু স্কুল বন্ধ হয়নি এখনও। বাতাসে বরফের ছুঁচ উড়ে বেড়াচ্ছে। গাছেরা মৌনী নির্বাক। বেশিদেরই পাতা ঝরে যাবে শীতের শেষে। তারপর বসন্ত অপগত হলে নাগা সন্ন্যাসীদের মতো নগ্ন হয়ে সার সার দলে দলে তারা একই জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেই মাথার উপর পত্রশূন্য, হাত তুলে কোনও অদৃশ্য অনামা দেবতার নামে জয়ধ্বনি দিতে দিতে কোন কোন দূরের তীর্থযাত্রায় যাবে।
জোরে ছুটে গেলেও অনেকসময় একপাও এগোনো যায় না। আবার এক জায়গায় অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেও ইচ্ছে করলে অনেক দূরে চলে যাওয়া যায় হয়তো।
জিম ক্যালান বলে এক স্কটিশ সাহেবকে জানত পৃথু। জনসন সাহেবের বন্ধু ছিলেন। একবার ওড়িশার কালাহাণ্ডির জঙ্গলে মানুষখেকো বাঘ মারতে গেছিলেন ওঁরা। পৃথুর বাবাই নিয়ে গেছিলেন। রাতে মাচায় বসেছিল পৃথু ক্যালান সাহেবকে নিয়ে। হৃষ্ট-পুষ্ট মানুষটি। কলকাতার ব্রিটিশ কনস্যুলেট-এ কী যেন কাজ করতেন। স্কচ হুইস্কি খেতেন। নীট। আমুদে লোক ছিলেন খুব। জীবনে এর আগে কখনও শিকার করেছিলেন যে কিছু, তা মনে হয়নি পৃথুর তাঁকে দেখে। মানুষ-খেকো দিয়েই অ্যাকাউন্ট ওপেন করবেন ভেবেছিলেন। যা, অনেক ভাগ্যবান আনাড়িই করেছেন বলে জানা আছে। বাঘের অপেক্ষায় শীতের কৃষ্ণপক্ষের তারাভরা রাতে মাচা মটমটিয়ে নড়ে-চড়ে বসে জিম বলেছিলেন :“হে, পৃটু, দিস প্লেস, আ গুড়ওয়ান ফর কনটেমপ্লেশান।”
শুধুমাত্র গাছেরাই জানে ‘কনটেমপ্লেশান’ কাকে বলে। মালোঁয়ার রাজধানী মাণ্ডুর বাওবাব গাছগুলি, কানহার সুপ্রাচীন শালেরা, ঠুঠা বাইগার হারিয়ে যাওয়া গ্রামের একলা শিমুল এরা সকলেই হাজার হাজার শ-শ বছর ধরে ধ্যানমগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে ভেবেই যাচ্ছে। মৌনতার ভাষা বড়ই বাঙময়।
আজ মুসলমানদের কী যেন একটা তেওহার ছিল। মসজিদ, মসজিদের গম্বুজ থেকে জবাকুসুম-রঙা আকাশে ভোরের আজান ছুটে গেছে সূর্যের বুকের অস্ফুট লালিমার দিকে। পায়রারা ডানা-ঝটপটিয়ে এই প্রাণবন্ত, ভোগবিলাসী, অনেক যুদ্ধ-জেতা এবং যুদ্ধ-হারার স্মৃতিতে সমানভাবে গর্বিত ধর্মাবলম্বীদের ধার্মিক উচ্ছ্বাস মুখে করে উড়ে গেছে স্বাধীন আকাশে। কারখানা বন্ধ নেই, কিন্তু অফিস বন্ধ আজ।
মুসলমানদের তেওহার উপলক্ষে ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে সাইকেল ক্রিংক্রিং করে সাবীর মিঞার বড় ছেলে নতুন পায়জামা কুর্তা এবং কাজকরা সাদা টুপি মাথায় দিয়ে এসে দাওয়াত দিয়ে গেছে পৃথকে। কত ঋণই যে জমে গেছে, জমে যাচ্ছে সাবীর মিঞার কাছে পৃভুর! এ জন্ম কেন, দশ জন্মে এই ঋণের বোঝা সইতে হবে তাকে। নিঃস্বার্থ প্রীতির ঋণ। সাধক মহম্মদের সার্থক ভক্ত এই খাঁটি মুসলমান ভদ্রলোকের প্রেমের ঋণ। সাবীর মিঞা ইংরিজি শেখেনি বলেই বোধহয়, ঠুঠা বাইগা বা দিগা পাঁড়ের মতো খাঁটি ভারতীয় রয়ে গেছে এখনও ভদ্রতায়, স্বভাবে, অতিথিপরায়ণতায়। ফার্সী, উর্দু, সংস্কৃত, ভোজপুরী এইসব ভাষার পুরাতন ঐতিহ্যবাহী, প্রকৃত ভারতীয় মানুষ যে এখনও অনেকেই বেঁচে আছেন, রয়ে গেছেন এই বিরাট, বৈচিত্র্যময়, স্বরাট দেশে তা পৃথুদের মতো মানুষদের পরম সৌভাগ্য!
যাবে পৃথু।
সাবীর মিঞা বাড়ির দাওয়াত-এর রকমসকমই আলাদা। সকাল দশটাতে খাওয়া শুরু হবে, শেষ হবে বিকেল চারটেয়। সঙ্গে গল্প হবে নানা রকম, শিকারের, গানবাজনার। পুরুষালি, নারীবিবর্জিত সঙ্গর নেশা আস্তে আস্তে চারিয়ে যাবে মোগলাই খানা আর সুরার সঙ্গে ধমনীতে। ভাবলেই, একধরনের চাপা উত্তেজনা বোধ করে পৃথু।
ওয়াজু মহম্মদ বলেছিল, আসবেন অনেকেই। গিরিশদা, ভুচু, লাড্ডু, শামীম, ঠুঠা বাইগা এমনকী দিগা পাঁড়েও। আধুনিক, ইংরিজি-শিক্ষিত তথাকথিত ভারতীয় আঁতেলদের কাছে অথবা কম্যুনিজম-এর প্রকৃত তাৎপর্য না-বোঝা কম্যুনিস্টদের কাছেও; ধর্ম ব্যাপারটা একটা ন্যাক্কারজনক প্রাচীনতম। কিন্তু যে প্রকৃত শিক্ষিত, এক ধর্ম নয়, অনেক ধর্মর সীমা পেরিয়ে গেছে যার উপলব্ধির গভীরতা; হয়ত সাবীর মিঞারই মতো; তিনিই জানেন যে, ধর্ম আর কুসংস্কার এক নয়।
অফিস যেদিন বন্ধ থাকে সেদিনকার ছুটিটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে পৃথু। যে কোনও নিয়মের মধ্যেই একধরনের ক্লান্তি জন্মায়। নিশ্চিন্ত স্থির জলের মধ্যের শ্যাওলার মতো। সে নিয়ম কাজেরই হোক, কি ছুটিরই হোক। এই কারণেই রবিবারের ছুটিটাকে আর ছুটি বলে মনে হয় না। খাণ্ডেলওয়াল সাহেবরা প্রতি রবিবারে পিকনিকে যান। সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ অবধি। নিয়ম। উধাম সিং চুরি করে তিতির মারতে যান। রুষা, প্রতি রবিবারে স্টীমবাথ নেয়, ওজন ঠিক রাখার জন্যে। ভুচু, পামেলার কাছে চার্চ-এ যায়। রথও দেখে, কলাও বেচে। শামীম মিঞাও মৌলভী গিয়াসুদ্দিনকে দু’ ঘণ্টা গালাগালি করে। নাস্তা খেতে খেতে। প্রতি রবিবার সকালে। রবিবারের নাস্তাটা একটু ভারী হয় বলে, মৌলভীকে গালাগালি না করলে নাকি নাস্তা হজমই হয় না ওর। তাই-ই বে-ইতোয়ারের যে-কোনও ছুটিই বেশক খুশি বয়ে আনে পৃথুর কাছে।
পৌঁছতে পৌঁছতে একটু দেরিই হয়ে গেল পৃথুর। হেঁটেই গেল। টি-বি হসপিটালের রুগিদের লাল গোলাপ আর চিজ দিতে যাবেন রুষাদের মহিলা-সমিতির মহিলারা। রুষারও অবশ্যই যেতে হবে। দারুণ দারুণ সিল্কের শাড়ি পরে মহার্ঘ সব “ফোরেন” সুগন্ধি মেখে, আইব্রো-প্লাক করা, ফেস-প্যাক-নেওয়া মহিলারা এক সকালে হঠাৎ-দেখা দিয়ে টি-বি রুগিদের ধন্য করতে গিয়ে তাদের বুকের অবস্থা আরও খারাপ করে দিয়ে চলে আসবেন।
বছর তিনেক আগে রুষাকে দেখে, দিগা পাঁড়ে একদিন অবাক হয়ে চেয়েছিল। রুষা হাউসকোট পরে কাজ করছিল। তখনও চান করেনি; ভুরু আঁকেনি; লনে এসেছিল পৃথুকে কিছু জরুরি কথা বলতে। ও চলে যেতেই দিগা আতঙ্কিত গলায় ফিসফিস করে পৃথুকে শুধিয়েছিল, “কাউয়ানে খা লিয়া ক্যা?”
পৃথু তাকে আশ্বস্ত করে বলেছিল, দিগার চিন্তার কোনওই কারণ নেই। কাকেরা সবরকম আবর্জনা যদিও খায়, তবু, সুন্দরী মেয়েদের ভ্রূ তাদের সুখাদ্যর তালিকাতে পড়ে না।
চান করে উঠে, শীতের রোদে হেঁটে যেতে ভালই লাগছিল। জর্দা দেওয়া পান খেতে খেতে। ইচ্ছে করেই সাইকেল রিক্সা নেয়নি। রুষা চলে যাবার পর টুসুর সঙ্গে একটু ব্যাডমিন্টন খেলেছিল কিচেন গার্ডেনে। অতি সাবধানে। পৃথুর হাতের একটি মোক্ষম “চাপ”-এ এগজিবিশানের জন্যে সযত্নে-ফলানো একটি টোম্যাটোর গাল তুবড়ে যাওয়ায় গত রবিবারে প্রায় প্রলয় ঘটেছিল। রুষা প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বলেছিল, কিচেন-গার্ডেনটা ব্যাডমিন্টন খেলার জায়গা নয়। গায়ে জোর থাকে, স্ম্যাশিং স্ম্যাশ করার ক্ষমতা থাকে তো ক্লাবের টুর্নামেন্টে নাম এন্ট্রি করে যারা খেলতে জানে তাদের সঙ্গে খেললেই পারো! ছোট ছেলের কাছে হিরো সাজার দরকার কী?
পৃথু মনে মনে বলেছিল, টোম্যাটো স্ম্যাশ করতে যাবেই বা কেন সে? ‘মেশড’ পোটেট্যোরা টোম্যাটোর কাছাকাছি থাকতে ভাল বাসলেও; পৃথু মোটেই ভালবাসে না।
ধূলি-ধূসরিত গলির মধ্যে সাবীর মিঞার অতি-সাধারণ বাড়ির সামনে ভুচুর জীপ, শামীমের মোটরসাইকেল, গিরিশদার গাড়ি, লাড্ডুর ঢাউস বড় গাড়িটা লাগানো আছে। অতিথিপরায়ণ লোকেরা সচরাচর নিজেরা বড়লোক হয় না। বড়লোক হবার উপায় থাকে না তাদের।
“আইয়ে, আইয়ে” করে সাবীর মিঞা বুকে জড়িয়ে ধরলেন পৃথুকে। লাড্ডুকে প্রত্যাশা করেনি পৃথু। দেখে খুশি হল। তবে দিগা আসেনি। লাড্ডু বলল, পাধারীয়ে, পাধারীয়ে দাদা।
লাড্ডুর গান শুনে সাবীর মিঞা তার বড় ভক্ত হয়ে উঠেছেন বোঝা গেল। সাবীর মিঞার মতো কিছু মানুষ দেখেছে এ জীবনে পৃথু, যাঁদের দেখে মন বলে ওঠে, গুণী হওয়া খুবই সোজা। গুণগ্রাহী যে হতে পারে সেই-ই হওয়ার মতো কিছু হল। সত্যিকারের গুণগ্রাহী। স্বার্থ, বা ধান্দাবাজির বা চামচাগিরির গুণগ্রাহিতা নয়।
গিরিশদা বললেন, কী হে? লং টাইম, নো সী?
ওরা সবাই বটি কাবাব খাচ্ছিল। একটি মস্ত খাসি কাটা হয়েছে। লাড়ুয়ার হাট থেকে তাকে মাস ছয়েক আগে কেনা হয়েছিল। ধবধবে সাদারঙা, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, বড়-বড় কানের, এবং বুদ্ধিমান চোখের এই খাসিটিকে অনেকদিনই দেখেছে পৃথু। এই খাসিটির সঙ্গে লানডান স্কুল অফ ইকনমিক্স-এর একজন অধ্যাপকের চেহারার দারুণ মিল খুঁজে পেত পৃথু; যতবারই দেখা হত গলায় দড়ি-বাঁধা খাসিটির সঙ্গে। পাঁঠা বা খাসি হলেই যে বোকা হয়, আর অনেক ডিগ্রিধারী অধ্যাপক হলেই যে চালাক হতে হবেই এমন কোনওই কথা নেই।
খাসিটার শরীরের বিভিন্ন অংশ দিয়ে বিভিন্ন পদ রান্না হচ্ছে আজ। মহল্লার অপেশাদারী নাটকে যেমন অভিনেতার চেয়ে প্রমটারের ভূমিকাই অনেক বেশি ইমপরট্যান্ট হয়, আজ সাবীর মিঞার চেয়েও নেপথ্যবাহিনী তাঁর দুই বিবি এবং অগুনতি মেয়েদের ভূমিকাও সেরকমই অনেক বেশি ইমপরট্যান্ট। সাবীর মিঞার পরনে চেক-চেক লুঙ্গি এবং জালি-গেঞ্জি, এবং তার উপরে ফিনফিনে আদ্দির কাজকরা পাঞ্জাবি। ভোপালের টাঙ্গাওয়ালারা গরমের দিনে যেমন পরেন, তেমন। শীত-টিত নেই মানুষটার। মাঝে মাঝে আণ্ডেকা রোসান হালুয়া খান।
সাবীর মিঞার ফিগারটাও অদ্ভুত। লম্বায় ছ’ ফিট। বুকের ছাতি আগে ছিল চুয়াল্লিশ এখন কমে চৌত্রিশ। পশ্চাদ্দেশের ঘেরও চৌত্রিশ। কোমর চব্বিশ। মিঞা না হয়ে বিবি হলে, যেকোনও মিস ইউনিভার্সের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে পারতেন স্যুইমিং কসট্যুম পরে। তবে, প্রাইজ হয়তো পাওয়া হয়ে উঠত না। কারণ সাবীর মিঞাকে যদি স্যুইমিং কসট্যুম পরা-অবস্থায় কেউ দেখত, তবে নিছক ‘শক’-এই তার মৃত্যু হত।
সাবীর মিঞার চোখ দুটি সম্বন্ধেও কিছু না বললে সব বলা হবে না। চোখই তো মানুষের মনের আয়না! রাতের জিপ গাড়ির হেডলাইটের মতোই তাঁর চোখ দুটি। স্বাভাবিক অবস্থাতে “ডিমারে” থাকত। উত্তেজিত, খুশি, রাগী বা বিস্মিত হলেই চোখ দুখানি “ডিপারে” উজ্জ্বল হয়ে জ্বলজ্বল করত। ডিমার-ডিপার ডিপার-ডিমার। যাঁরা এই দুচোখের খেলা না দেখেছেন তাঁদের এর লীলা বোঝানো আদৌ সম্ভব নয়। কিন্তু এমন মানুষটার গলায় স্বরটা ছিল টি-এইট-মডেল ফোর্ড গাড়ির পেট্রল-এঞ্জিনের আওয়াজের মতোই মিষ্টি। গানও গাইতেন চমৎকার। আর শের-শায়রীর নবাব ছিলেন তিনি। মীর্জা গালীব, জীগর মোরাদাবাদী, ফৈয়াজ এবং সাম্প্রতিক অতীতে এলাহাবাদের ফিরাক গোরখপুরীর শায়েরও ঘুরত তাঁর মুখে মুখে। ফিরাক যে আসলে হিন্দু এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, এবং নামটাও যে তার ছদ্মনাম এ কথাও পৃথু প্রথম শোনে সাবীর মিঞার কাছ থেকেই।
ফিরাকও এখন আর নেই।
শামীম হঠাৎ বলে উঠল, পৃথু ঢুকতেই, শাল্লে লাল্লুকো নীল্লা বনাকে ছোড় দিয়া দাদা। ইকসো পাঁচ বুখার। আঁখ বন্ধ। পোরসারভি বন্ধ। মরভি যানে শকতা। শালে বেইমান।
সকলে হাঁ-হাঁ করে উঠল।
ব্যাপারখানা কী? কেন এমন করলে শামীম? তুমি কি ঠিক জানো যে, ওই-ই বলে দিয়েছিল ফরেস্টার এবং পুলিশদের?
বিলকুল!
শামীম বলল, ধর্মেন্দ্র-স্টাইলে।
তা, মারলে কেন? অন্য ভাবে কি শিক্ষা দেওয়া যেত না?
পৃথু বলল। দুঃখিত গলায়।
নেহি দাদা। মগর, ইক নয়া স্টাইলসে শিখলায়া শালেকো।
নয়া স্টাইল?
সকলে সমস্বরে শুধোল।
ভুচু চোখ টিপল একবার শামীমের দিকে। এখানে লাড্ডু আছে। যে, বারাশিঙা মারার কিছুমাত্রই জানে না। ওর কাছে গোপন-কথা ফাঁস করার দরকারটা কী?
শামীম ভুচুর সিগন্যাল রেকগনাইজ করল। করেই, হঠাৎ লাড্ডুকে বলল, দেখ লাড্ডুওয়ালে, হিঁয়াকা কোঈ বাঁতে হুঁয়া হোনেসে বাহারমে তেরী লাড্ডুকা দুকানমে ম্যায় আগ লাগা দুঙ্গা। হুঁশিয়ার!
লাড্ডু বেচারি জম্পেস করে মুখ ভর্তি বটি-কাবাব নিয়ে বসেছিল। হঠাৎ ওর দোকানে আগুন লাগবে শুনে ও একই সঙ্গে কোঁৎ করে কাবাব গিলতে গিলতে হতভম্ব হয়ে বলতে গেল, “লেহ লটকা।” ব্যসস, যায় কোথায়? সঙ্গে সঙ্গে গলায় কাবাব আটকে গেল। তখন তাকে নিয়ে আর এক বিপত্তি! এ মাথায় চাঁটি মারে, তো ও গুলাব-জল মেশানো জল ঢালে তরমুজের মতো মুখ হাঁ-করিয়ে, বদনা থেকে। হইহই রইরই ব্যাপার।
অবস্থা; খবরের কাগজের ভাষায়, যখন “আয়ত্তাধীন”, তখন ব্যাপারটা জানা গেল শামীমের মুখে।
ও বলল, চটে যাবার ওর বিলক্ষণ “হক” ছিল। ও তো আসলে মারেনি লাল্লুকে। কোনওরকম হিংসা করেনি। গান্ধী মহাত্মার অহিংসার পথেই গেছে।
অহিংসার পথের হিংসার কথা শুনে, লাড্ডু আবারও বলল, লেহ লটকা।
পৃথু ধমক লাগাল শামীমকে। বলল, খুলেই বলো না। কী হেঁয়ালি করছ?
শামীম তখন যা বলল, তা শুনে সকলেরই চোখ কপালে।
লাল্লুদের গ্রাম আর দিগার কুঁড়ের মাঝের জঙ্গলে পাহাড়ে ভোপালের কাছের ভীমবৈঠকার গুহা আর রক-শেলটারের মতোই অনেক গুহা আর রক-শেলটার আছে। সেখানে মস্ত মস্ত ভীমরুলের চাক। মৌমাছির চাক। ভীমবৈঠকাতেও যেমন আছে। শামীম, লাল্লুকে হাটচান্দ্রায় ওর বাড়িতে নেমন্তন্ন করে পরোটা আর মোরগা-টোরগা খাইয়েছিল ভরপেট। তারপর তাকে খাতির করে হিম্বা ঈত্বর মাখিয়েছিল আদর করে।
রহিস মুসলমানেরা বাড়িতে দাওয়াত দিলে আগেই ঈত্বরদান এনে মেহমানদের গোঁফে, জুলফিতে; কারও বা বুকের চুলেও ঈত্বর ইস্তেমাল করে দেন। কষে হিম্বা ঈত্বর লাগিয়ে লাল্লুকে মোটর-সাইকেলের পেছনে বসিয়ে শামীম দিগার কুঁড়ের মাইলখানেক দূরে এমনই জায়গায় ছেড়ে দিয়ে এসেছিল যে ঠিক সেখান থেকেই জঙ্গলের সেই পাকদণ্ডী রাস্তাটা ওদের বস্তির দিকে গেছে। ওই পাকদণ্ডীটাই গেছিল একেবারে গুহা এবং রক-শেলটার-এর গা ঘেঁষে। শামীম জানত যে, আতরের তীব্র গন্ধ গায়ে মেখে ওইখানে পৌঁছলে আর দেখতে হবে না। হাজার হাজার মৌমাছি টাইফুনের মতো আছড়ে পড়বে লাল্লুর গায়ে। মৌমাছির কামড় যে একবার খেয়েছে সে জীবনে আর কখনও মৌমাছি নিয়ে কাব্য করবে না।
কবে ঘটেছে এ ঘটনা?
সাবীর মিঞা শুধোলেন।
পরশু। শামীম বলল।
কেমন আছে? খোঁজ নিয়েছ?
আররে! সেই খোঁজ নিয়েই তো এলাম! সোজা সেখান থেকেই আসছি।
ভেবেছিলাম, এতক্ষণে টেঁসেই গেছে। গিয়ে দেখি, বেঁচে গেল এ যাত্রা। মরেইনি যখন, তখন ইলাজ করাবার জন্যে দশটা টাকাও দিয়ে এলাম। পকেট এদিকে পুন্নোয়া-টাঁড় এর মতো ধু-ধু। এই টাকাটা তোমরা আমাকে দিয়ে দেবে। সাবীর মিঞারই দেওয়া উচিত। তাঁর নাতির ছুন্নৎ-এর শিকার করতে গিয়েই তো এত বিপত্তি।
পৃথু বলল, খুবই অন্যায় করেছ।
শামীম বলল, তুম কাবাব খাও দাদা। ঠিক-বেঠিককে মামলেমে আপনে মন ফাঁসো। শালার বউটা বড় কাঁদতে লাগল।
লাল্লুর বউ-এর কান্না দেখেই গলে গেলি বল।
গিরিশদা বললেন।
মেয়েছেলের কান্না দেখে যে গলে যায় সে শালা পুরুষ নয়।
আমার এক শালী এসেছিল লাহোর থেকে। তাকে গতবছর নিয়ে গেছিলাম মাণ্ডু, পাঁচমারী, ভীমবৈঠক সব দেখাতে। সেও ইত্বর মেখেছিল। গরমের দিন ছিল। ফিরদৌস মেখেছিল সে। শেষ বিকেলে গিয়ে পৌঁছেচি ট্যুওরিসট বাসে করে। ইয়া আল্লা! সে যাত্রায় শালীকে এনে বাঁচিয়ে ফিরিয়ে দিতে পেরেছি যে এইই ঢের। সাতদিন অসুস্থ ছিল। ভোপালে তাকে হামিদিয়া হাসপাতালে পর্যন্ত ভর্তি করতে হয়েছিল। তার কাছে থাকাতে আমাকেও কম কামড়ায়নি। সত্যিই। মৌচাক আর ভীমরুলের চাকের কাছে কখনও গন্ধ মেখে, বা ধুপকাঠি জ্বালিয়ে যেতে নেই।
শামীম বলল, ন্যাকামি করবেন না সাবীর সাহেব, যে শালারা শালীর কামড় খেয়েছে, তারাই জানে যে মৌমাছির কামড় তার তুলনায় কিছুই নয়।
ভুচু বলল, যে জায়গায় লাল্লু কামড় খেয়েছে, সে জায়গাটাতে বিস্তর ভাল্লুক আছে। বড় বাঘও আছে। ওই কামড় খেয়ে বাড়ি ফিরে গেল কী করে লাল্লু?
বাড়ি ফিরবে কী করে? অজ্ঞান অবস্থায় ওইখানেই পড়েছিল। পরদিন সকালে ফরেস্ট-গার্ড যাচ্ছিল সাগুয়ান প্ল্যান্টেশন-এ বাইসন আসছে কি না তার ভানজ দেখতে। সেই লাল্লুকে অজ্ঞান অবস্থায় আবিষ্কার করে। তারপর লাল্লুদের বস্তি থেকে লোকজন ডেকে এনে ওকে নিয়ে যাবার বন্দোবস্ত করে।
লাড্ডু বলল, শামীমকে। বহতই খতরনাগ আদমী হ্যায় ভাই তুঁ।
নিরুত্তাপ শামীম বলল, তোমার মতো অতটা নই। এক-এক তান মেরে কত মেয়েকে যে খুন করেছ সুরের ছুরিতে তা তুমিই জানো! তোমার মতো খতরনাগ আমিও নই!
গিরিশদা বললেন, প্রেমে আর যুদ্ধে অবশ্য কিছুই অন্যায় নয়।
তাছাড়া, অহিংসার পথেই তো হিংসা করেছে শামীম।
ভুচু বলল।
সকলেই হেসে উঠল। অহিংসার পথে হিংসা কথাটা বোধহয় এবার থেকে চালু হয়ে গেল।
সাবীর মিঞা বললেন, দ্যাখ শামীম, কাজটা তবু তুই ভাল করিসনি। ও যদি কখনও জানতে পায়?
খুদাহ নিজে পর্যন্ত জানতে পারবেন না আর লাল্লু বাইগা! ছাড়ো তো তুমি! এসব দিমাগের ব্যাপার অকল-এর বলেই, ডান হাতের তর্জনী দিয়ে নিজের বাঁ দিকের জুলপির উপর টোকা মারল দুটো।
তবুও অন্যায় করেছিস। কারণ, লাল্লু আমাদেরই একজন ছিল। নিজেদের মধ্যে কারও সঙ্গে সম্পর্ক যদি খারাপই হয়ে যায়, তবে তা সুন্দর ভাবে শেষ করা উচিত, তিক্ততার সঙ্গে নয়।
আজীব আদমী আপ। লাল্লুর বউ আমাকে বালুসাই খাওয়াল, মোগাঁও-এর হাট থেকে কিনে এনেছে বলল দু দিন আগে। কত্ত ভালবাসল আমাকে। সম্পর্ক শেষই বা কেন হবে আর তিক্ততাটাই বা দেখলেন কোথায়? উসব কেতাবি কথা শের-শায়েরী আমিও কম জানি না সাবীর সাহাব। বলেই; উঠে দাঁড়িয়ে চমৎকার সুললিত গলায় আবৃত্তি করল শামীম। মনে হল, ইতিমধ্যেই ভদকার ভূত চড়ে গেছে ওর মাথায়।
ত—আর-রুখ রোগ বন যায়ে
উসকো ভুল না হী বেহতর
ত-আল-লুক বোঝ বন যায়ে
—তো উসকো তোড়না হী আচ্ছা।
অফসানা আনজাম তক
লানা না হে মুসকিন
উসকো এক খবসুরৎ মোড়
দেকর ছোড়না হী আছা।
কেয়াবাৎ। কেয়াবাৎ। বহত খুউব। রব উঠল চারধার থেকে।
হারামজাদা, সুরতহহারাম শামীম, ব্রীড়ানস্র কিশোরীর মত মুখ করে মাথা হেঁট করে আদাব জানাল সকলকে। তারপরই বলল, আজকের মেনু কী সাবীর সাহেব?
সাবীর মিঞা বললেন, আমার ক্ষেতির চাল, ক্ষেতির চানাকা ডাল, গোবি, বায়গন, টোম্যাটো, পিঁয়াজ, হরা-মিরচা আর…
সকলেই হো হো করে হেসে উঠল।
এই ক্ষেতির রহস্য, সাবীর মিঞা আর তার বন্ধুরাই শুধু জানে।
মেন উইদাউট উইমেন-এর এই দোস্তির গোপন রহস্য এ। ক্ষেতি-ফেতি কোনও জন্মে ছিল না সাবীর মিঞার। তাঁর সুউর্বর কল্পনা দিয়ে বনক্ষেতি বলে এক খামার বানিয়েছিলেন তিনি। বিবিরা শিকারে যেতে দিতে চাইতেন না একেবারেই। বয়সও হয়েছে এবং শরীর ভাল যাচ্ছিল না মাস ছয়েক থেকে। একটা মাইল্ড অ্যাটাকও হয়ে গেছিল। রাত জাগতেও দিতেন না। তাই বনক্ষেতির উদ্ভব হয়েছিল। যখনই শিকারে যেতে হত তাঁকে, তখনই অন্দরমেহাল-এ বলতে হত বনক্ষেতিতে যাচ্ছি। জমি জমা তদারকি করতে, সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁ। বনক্ষেতি বলে একটা জঙ্গুলে গ্রাম ছিল ঠিকই বাইহার-এর পথে। সেখানে তিনদিক খোলা একটি মাটির ঘরও ছিল। পাশে একটা মস্ত তেঁতুল গাছ। একটু দূরে তালাও, তাতে নীল জল। বড় পদ্ম, ছোট ছোট কুমুদিনী আর শাপলার ভিড় সেখানে। নানারকম বুনো-হাঁস এসে জমা হত শীতকালে। বনক্ষেতিতে শিকার করা কিন্তু একেবারেই বারণ ছিল। নিজেদের বারণ। এ মাটির কুঁড়েতে সাবীর মিঞা নিজে হাতে পাথর-সাজানো উনুনে, খিচুড়ি, আলুকা-ভাত্তা এবং অন্যত্র—শিকার করা জানোয়ারের ও পাখির মাংস রান্না করতেন। তেঁতুলতলার খাটিয়াতে বসে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষার অনেক দিন ও রাত কেটেছে পৃথুদের। নারী-সঙ্গ বর্জিত, ফোটা-কার্তুজের গন্ধ-মাখা সেই সব পুরুষালি দিনের স্মৃতি মস্তিষ্কর কোষে কোষে জড়িয়ে থাকবে, যতদিন প্রাণ থাকে।
বনক্ষেতির মাশুল গুণতে হত সাবীর মিঞাকে। আর তার ফায়দা ওঠাত ভেড়ুয়া মাঝি। মুদির দোকানি। তাবৎ ভাল ভাল চাল, পুলাউ-এর জান, বাজারের শ্রেষ্ঠ ডাল ঘি এবং অন্যান্য জিনিস পৌঁছে যেত সাবীর মিঞার বাড়ি সেই দোকান থেকে। কুলির মাথায়। বস্তা করে। লাল্লু শেখ-এর দোকান থেকে আসত সবরকমের সেরা আনাজ। দুই বিবি মহা খুশি। ‘বনক্ষেতির’ জিনিসের স্বাদই আলাদা!
বলতেন তাঁরা।
খাসির কী কী পদ হয়েছে তাই-ই বলুন সাবীর সাহাব?
এবার ভুচু বলল।
বটি-কাবাব দেওয়া, দরাজ হাতে জাফরান-ঢালা মন-পসন্দ বিরিয়ানি পুলাউ তোমার জন্যে। গুলহার কাবাব তো খাচ্ছই। চাঁব। পায়। সঙ্গে তক্কর থাকবে। লাব্বা, রেজালা, কলিজা-ভাজা, ভডকার সঙ্গে। এবং কবুরাও।
কবুরা অর্থাৎ অণ্ডকোষ মুসলমান রান্নার এক বিশিষ্ট পদ।
মগজও তাইই। জঙ্গলের লোকেরা বলে, ভাল্লুকের “কবুরা” খেলে বৃদ্ধরও হারেম রাখার ক্ষমতা আসে। খাসির কবুরা খেলে কী হয়! তা কাউকে জিজ্ঞেস করা হয়নি আজ পর্যন্ত।
খানা চালু হয়ে যাবার পরই মাঝে মাঝে সাবীর মিঞা সকলকে হামদর্দ দাবাখানার এক এক বাটি “পাচনল” খাইয়ে দেবেন জোর করেই। খানা “পচবার” জন্যে অর্থাৎ, হজম করার জন্যে। সঙ্গে শিকারের গল্প চলবে।
বাহাদুরির গল্প নয়। হেরে-যাওয়ার গল্প সব। গুলি-ফসকানোর।
ধোঁকা-খাওয়ার, বোকা-বনার, ঠকে-যাওয়ার সব গল্প। নিজেদের কৃতিত্বর গল্প নিজেরা, নিজেদের মধ্যে সচরাচর ওরা করে না। জঙ্গলের নানাবিদ্যায় কৃতী না হলে এই বিশেষ সঙ্গে এসে মেশবার ছাড়পত্রই তো তাদের কারওই পাওয়ার কথা ছিল না। তাইই কৃতিত্বর গল্প বড় একটা হয় না এই মজলিসে। এখানে গান বাজনাও হয় না। তবে, গান বাজনার কথা হয়। লাড্ডুর মতো গুণীরা নিমন্ত্রিত হয়।
পৃথু এখানে, এই সঙ্গে থেকেও; যে সবসময়ই একাত্ম থাকে, তা ঠিক নয়। তার প্রধান কারণ, শিকার সে আজকাল করেই না। বহুদিন হলই করে না। তাইই এদের অনেক ঘটনা, গল্প, যে সব নিয়ে ওরা আলোচনা করে তার বেশিই ওর অজানা। তবু, জঙ্গলের বন্ধুদের সঙ্গও তো অনেকখানি। পরনিন্দা নয়, পরচর্চা নয়, ষড়যন্ত্র নয়, কাউকে টেনে নামানো বা ঠেলে ওঠানোর বদমতলবও নয়, নীচ বা ইতর কোনও আলোচনাই নয়, পৃথিবীতে যে হাসি ছাড়া, পুরুষালি বল-বীর্য ছাড়া, জীপের এঞ্জিনের আওয়াজ, জঙ্গলের নিস্তব্ধ শব্দময়তা অথবা বন্দুক বা রাইফেলের গুলির শব্দ ছাড়া আর অন্য কোনও শব্দ আদৌ আছে এ কথা একবারও মনে হয় না এখানে এলে। টাকা পয়সা, বাড়ি-গাড়ি, সুন্দরী-নারী, যশ, এ সব কোনও-কিছুরই ধার ধারে না এরা। এই রুক্ষ, আত্মিক সৌন্দর্যে সুন্দর, সদাহাস্যময় বিভিন্নবয়সী পুরুষদের প্রেমে পড়ে আছে ও। জঙ্গলের প্রেমে, জঙ্গলের এই জীবনের প্রেমে।
এখনও চুরি করে যে দু একটা পশু-পাখি এরা মারে, তা অন্যায় হলেও; দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অহর্নিশ যে পরিমাণ অন্যায় সংঘটিত হচ্ছে তার তুলনায় এ কিছুই নয়। আজ এদের চুরি করে শিকার কেন যে করতে হয়, তাও জানে না পৃথু। বনের আইন ইংরেজ আমলেও যা ছিল এবং যেমন করে তা পালিত হত, তেমন থাকলে আর পালিত হলে, আজও পারমিট নিয়েই ওরা শিকার করতে পারত। বুক ফুলিয়ে।
শুধু চোরা-শিকারিদেরই জেল হয় এই ভারতবর্ষে। ভোট-চোরারা বুক ফুলিয়ে রাজা-মহারাজা হয়ে সহজে ঘুরে বেড়ায় বীরদর্পে। মিথ্যাচারে, মিথ্যা-প্রচারে, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে কোটি কোটি সরল সহজ, নিরুপায় দেশবাসীকে ধোঁকা দিয়ে পাঁচ বছর পর পর ভোট-চুরি করাটা অন্য সব কিছু চুরির আগেই বন্ধ করা উচিত ছিল।
আইন যাঁরা বানান, যাঁরা দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা; তাঁদের প্রত্যেকেরই আগে সততা, আন্তরিকতা ও আইনানুগতার পরীক্ষায় আগে নিজেদের উত্তীর্ণ করে তারপরই দেশবাসীর বিভিন্ন অপরাধের বিচার করতে বসলে ভাল করতেন।
ভডকা এনেছিলেন গিরিশদা। “ইফ ইটস আ ড্রিঙ্ক, কনসাল্ট গিরিশ ঘোষ” এই বেদবাক্য সকলেই মেনে চলে। গিরিশদা গন্ধরাজ লেবু জোগাড় করেছেন বড় বড়। হয়তো তাঁর বাড়ির কামধেনু সেই ডীপ-ফ্রিজ-এর মধ্যেই রাখা ছিল তা। সঙ্গে ধানি-লঙ্কা। লেবু কেটে ও লঙ্কা চিরে গেলাসের মধ্যে ফেলে তাতে পাতিয়ালা সাইজের ভডকা ঢেলে দিচ্ছিলেন তিনি। ফল যা হচ্ছিল, তা বলার নয়। লিভার-এর মধ্যে কেউ যেন আলপিন ফুটিয়ে দিচ্ছিল। সাবীর সাহাবের শরীর ভাল নয়। বিবি আর ছেলেরা সাবীর সাহেবের মদ খাওয়া বা শরীরের উপর অত্যাচার করা একেবারেই পছন্দ করতেন না। ওঁর বাড়িতে ওসব থাকত না। এমনিতে তিনি এসব অখাদ্য-কুখাদ্য খান না আজকাল। তার সারেঙ্গীওয়ালাদের সঙ্গে পড়লে অবশ্য না করতেন না। বলতেন, হাসতে হাসতে, এদের কি করে বোঝাই যে জন্মেছি যখন, তখন মরতে তো হবেই।
ভেতর থেকে বিবিদের পরোয়ানা এল ছোট ছেলের মারফৎ।
সাবীর মিঞা গিরিশদার দিকে চেয়ে বললেন, কী করি?
গিরিশদা লোকাল গার্জেন বনে গিয়ে বললেন, খান। একশবার। আপনি সাহাব আমার চেয়ে বয়সে আর কতই বা বড় হবেন। যা ইচ্ছে করে, করবেন। বিবি-বাচ্চাদের প্রতি সব দায়িত্ব তো পালন করেছেন, আর কী?
সাবীর সাহেবের হেডলাইটের মতো চোখ দুটো ডিপারে জ্বলজ্বল করে উঠল। বললেন, সাহী বাত। আমি তো তাইই বুঝি। পঞ্চাশ বছর অবধি মানুষ যা কিছু করে তার সবই উচিত-কর্তব্য। পরের প্রতি কর্তব্য। আব্বা, আম্মা, বিবি, আওলাদ, সবকিছু এদেরই জন্যে। পঞ্চাশের পর সবকিছুই করা উচিত নিজেরই জন্যে। শুধুই নিজের জন্যে। যা কামাব, নিজের জন্যে খরচ করব; দোস্ত-বিরাদরদের দাওয়াত দেব। শরীরের উপর শাসন রাখব না। আমি মরে গেলে তো এই নমকহারাম দুনিয়া আমাকে বারো ঘণ্টাও মনে রাখবে না। আমি তো গাইয়ে নই, শায়ের লিখনেওয়ালা নই; অন্য লক্ষ লক্ষ মানুষেরই মতো একজন অতি সাধারণ মানুষ। অত পুতুপুতু করে বাঁচার সময় আমারও আর নেই ইয়ার। ওয়াক্ত ফুরিয়ে আসছে। ঝাড়লণ্ঠনের সবকটি বাতিই এখন জ্বালাবার সময় হয়েছে। পলতে উসকে দিয়ে, তেল ভরে নিয়ে; নতুন করে জ্বলব এবার। যাওয়ার আগের জ্বলা।
গিরিশদা বললেন, ভাই হে, নিশ্চয়ই মরবেন, আপনি মরবেন আমিও মরব। প্রত্যেক আওলাদ যখন প্যাদা হয় তখন সে তার নিজের মওত তো মুখে করেই নিয়ে আসে।
সাবীর মিঞা হাসলেন। ভডকার গ্লাসে চুমুক দিলেন একটা। খোলা দরজা দিয়ে, চবুতরার উপর দিয়ে ধূলিধূসরিত খোয়ার রাস্তা পেরিয়ে তাঁর চোখ দুখানির দৃষ্টি মসজিদের গম্বুজ আর খিলানের গায়ে লেগে থাকা শীতের ম্লান বিধুর রোদের সঙ্গে মাখামাখি হয়ে গেল।
হঠাৎই বুড়ো স্বগতোক্তির মতো বলে উঠলেন,
“গুস্তাকি, ম্যায় স্রিফ করেঙ্গে ইকবার
যব সব পায়দল চলেঙ্গে;
ম্যায় কান্ধেপর সওয়ার।”
অর্থাৎ জীবনে অপরাধ একবারই করব। সবাই যখন হেঁটে যাবে, আমার দোস্তরা, আমি তখন তাদের কাঁধে চড়ে যাব।
হঠাৎ ঘরের মধ্যে নিস্তব্ধতা নেমে এল। এত খুশির মধ্যে, এত খুশবুর মধ্যে, এত উমদা খানার মধ্যে, দোস্তদের মধ্যে বসে এই তেওহারের দিনে এমন কথা কেন?
শামীম বলল, আপনার গুস্তাকি কখনওই হয়নি কারও কাছে। হবেও না। আমরা সকলেই আপনার জানাজা বয়ে নিয়ে যাব, যদি আগে মরেন। আপাতত ঝুঠঠো ফজুল বাঁতে না করে আমাকে একটা ভডকা দিন। ডাবল করে।
বলেই বলল,
“না পীনা হারাম হ্যায়,
না পিলানা হারাম;
পীকে হোঁসমে আনা হারাম হ্যায়।”
সকলেই বহত খুউব। বহত খুউব করে উঠল।
আজ কেন যেন এখানে আসার কিছুক্ষণ পর থেকেই মনটা কেমন উচাটন হয়েছিল পৃথুর। দুটো ভডকা খেয়েছিল। গুলহার কাবাব, কলিজা-ভাজা; তবু ওদের সঙ্গে আজ যেন আনন্দে সামিল হতে পারছিল না। ওর এই স্বভাবকে কেউই বোঝে না। ও নিজেও যে পুরো বোঝে এমনও নয়। সকলেই ওকে ভুল বোঝে। এমনকী দোস্তরাও।
কুর্চির কথা মনে পড়ছে বার বার। কোনওদিন রুষার কথাও মনে পড়ে। কোনওদিন বা শেষ যে বাঘটাকে মেরেছিল হঁসসার জঙ্গলে বহুবছর আগে তার শান্ত ক্ষমাময় মুখটাকে। তখন অন্য কিছুতেই আর মনোনিবেশ করতে পারে না ও।
খাওয়া শেষ হতে হতে বিকেল চারটে বাজবে। আসল খানা তখনই জমবে।
ভুচুর কাছে ভুচুর জীপের চাবিটা চাইল।
বলল, আমি একটু ঘুরে আসছি ভুচু।
কোথায় যাবেন?
সকলেই হাঁ হাঁ করে উঠল।
এই, একটু ঘুরে আসছি।
গিরিশদা বললেন, আমার গাড়িও নিয়ে যেতে পারো ভায়া।
নাঃ। শীতের মধ্যে হুডখোলা জীপ চালাতেই ভাল লাগে। রোদ লাগে।
তবে আর একটা খেয়ে যাও। ওয়ান ফর দ্যা রোড।
গিরিশদা বললেন।
পৃথু কিছু বলার আগেই ভুচু বলল, এতদূর জীপ চালিয়ে যাবে আসবে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্যেও আমি ফিট করে দিচ্ছি।
এতদূর মানে? পৃথু শুধোল।
আমি জানি, কোথায় যাবে তুমি।
কোথায়?
পরে বলব।
সকলেই পৃথু আর ভুচুর মুখে তাকাল। এমন এমন সময়ে ভুচুকে পৃথুর টেনে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করে। মারামারি ও করে না; করেইনি বলতে গেলে। কিন্তু ওর রাগ যখন চাপে তখন মানুষ খুন করে ফেলাও আশ্চর্য নয় ওর পক্ষে। জিন। বাবার রক্ত। সবই মোছা যায়, রক্ত মোছা যায় না। কালো রক্ত, নীল রক্ত, লাল রক্ত কোনও রক্তই মোছা যায় না। অনেককেই প্রাণপণ চেষ্টা করতে দেখে চারদিকে; নিজের রক্তকে প্রাণপণে অস্বীকার করার। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা শুধু বিফলই নয়; হাস্যকরও বটে।
জীপটা চালিয়ে পৃথু চলে গেলে, সাবীর মিঞা চিন্তাম্বিত মুখে ভুচুর দিকে চেয়ে বললেন, গ্যয়ে কাঁহা পিরথুবাবু?
ভুচু বলল, আমি জানি না।
শামীম বলল, বিজলীর কাছে কি? সেদিন জলের ট্যাঙ্কির নিচে মাছ কিনতে গিয়ে দেখা হয়েছিল। পিরথুবাবুর কথা জিজ্ঞেস করছিল বিজলী বাইজী।
বলো কী?
অবাক হয়ে বললেন, গিরিশদা। পঞ্চাশের পরই মানুষের বনে এবং বাইজির কাছে যাওয়ার হক্ক হয়। পৃথুর হঠাৎ…অসময়ে…অবশ্য…
টিকিয়া-উড়ান চালিয়ে হাটচান্দ্রার শহর এলাকা পেরিয়ে এল পৃথু। রুষা বলেছিল, বাড়িতে থাকতে। মিলি-টুসুর সঙ্গে লাঞ্চ করতে, কারণ মহিলা সমিতির কমিটি মেম্বাররা সকলেই এস-ডি-ওর বাড়িতেই লাঞ্চ খেয়ে আসবেন। পৃথু জানে, যে ও কর্তব্য করল না। জীবনে, খুব কম কর্তব্যই ও করেছে। অস্বীকার করে না ও ওর অপারগতার কথা। তবু, মনের কোণে কাঁটা কাঁটা লাগে। ও বোঝে যে, ক্বচিৎ-কদাচিৎ ছাড়া মিলি-টুসুরও কোনও প্রয়োজন হয় না ওকে। বরং ও থাকলে, ওরা অস্বস্তিই বোধ করে। জোরে টেপ-ডেক বাজাতে পারে না। বন্ধুদের সঙ্গে ফ্রী হতে পারে না।
পরপর তিনটে ভডকা তাড়াতাড়ি খেয়েছে। মাথায় চড়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছে ও। জীপের স্টিয়ারিং শক্ত হাতে ধরে স্পীড বাড়াল। রাস্তাটা এখানে খারাপ। সামনেই নালার উপর একটা কজওয়ে। পৃথুর চোখের কোণদুটো জ্বালা জ্বালা করতে লাগল। অনেকদিন কাঁদে না পৃথু। অনেক অনেক বছর। কাঁদতে পারলে হালকা হত অনেক। চোখের জল কোথায় যে পালিয়ে গেছে। কান্নার বদলে বালি। দুঃখ হলে চোখ জ্বালা করে শুধু। দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল নীচের ঠোঁট। পান খেয়ে ফেটে গেছে ঠোঁটদুটো।
কজওয়েটা পেরিয়ে অ্যাকসিলারেটরে পুরো চাপ দিয়ে চড়াইটা উঠতে উঠতে ও জোরে চেঁচিয়ে উঠল; কুর্চি! কু-র্চি!
পথের দুধারের ঘন বন জীপের এঞ্জিনের শব্দ ওর গলার স্বরকে শুষে নিল। তারপর কুর্চি নামটাকে পাথুরে লাল-ধুলোয় ধূসরিত পথে জীপের টায়ারের নীচে গুঁড়িয়ে দিল। গুঁড়ো গুঁড়ো করে। শুকনো পাতার মতো।
রায়নার বাজারে পৌঁছেই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল ও। কত জোরে গাড়ি চালিয়েছে ও তা কে জানে? এত অল্প সময়ে কি করে এসে পৌঁছল এতটা পথ। বাজার পেরিয়ে কুর্চিদের বাড়ির নির্জন রাস্তাতে জীপটা ঢোকাল। তারপর কী মনে করে আবার ব্যাক করে গিয়ে পান কিনল। জর্দা! কাঁচা লঙ্কা আর গন্ধরাজ লেবু মেশা ভডকার সঙ্গে জর্দা মিশে যেতেই দুবার হেঁচকি উঠল ওর। তারপর আস্তে এঞ্জিন স্টার্ট করে কুর্চিদের বাড়ির দিকে এগোল।
মোড় ঘুরতেই দেখা গেল বাড়িটা। কদমগাছ দুটো। মস্ত।
একটা মহুয়াগাছের পাশে জীপটাকে দাঁড় করাল ও পথের একেবারে বাঁদিকে ঘেঁষে। এঞ্জিন বন্ধ করে দিল। ঘড়িতে তখন প্রায় একটা বাজে।
কী লাভ? কেন যাবে? যাবে, কার কাছে? সে তার কে? ছুটির দিনে মিঞা-বিবি শীতের দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে আতর মাখানো রজাই-এর নীচে জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে নিশ্চয়ই এখন। সে কেন এই সময় ওদের সুখকে বিঘ্নিত করতে যাবে? জীবনে কাউকেই ও ঠকায়নি আজ পর্যন্ত, জ্ঞাতসারে, কেনই বা ভাঁটুকে ঠকাতে যাবে?
একটা মন্থর হাওয়া ছেড়েছিল। পাথরে, টাঁড়ে, শুকনো পাতা ঝাঁট দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল সেই হাওয়া। কালি তিতির ডাকছিল টাঁড় থেকে বিষণ্ণতার প্রতীকের মতো। পথের ডানদিকে থোকা-থোকা কুঁচফল ফুটেছে। কুর্চি কি জানে যে, এখানে লাল-কালো উজ্জ্বল কুঁচ ফলের গাছ আছে অনেক? ওর বাড়ির এত কাছে? ভাঁটু তো এই পথ দিয়েই রোজ মোটর সাইকেল চালিয়ে যায়। ভাঁটু কি দেখে না?
সবাই সব দেখে না। সবাই, সব ভাগ্যিস দেখে না। কুঁচগাছ দেখতে পেলে তো ভাঁটু কুর্চিকেও দেখতে পেত।
কে যেন ওর মাথার মধ্যে বলে উঠল, কুর্চি, তোমাকে ভালবাসে পৃথু। যাও না তুমি। তুমি গেলে, খুশি হবে ও।
পৃথু হাসল। ভাগ্যিস সেই নির্জন দুপুরের বনপথে কেউ ছিল না। একা একা হাসতে দেখলে পাগল ভাবত ওকে। পাগল যে, সেও লোকের সামনে পাগলামি করতে চায় না। ভাবল, পরস্ত্রীদের ভালবাসা! ও গেলে, কুর্চি খুবই খুশি হবে হয়তো। বলবে, আসুন, আসুন। কী সৌভাগ্য আমার। বলবে, আজ দই-মাছ রেঁধেছিলাম, রুইয়ের কালিয়া। মুগের ডাল, রুই-এর মাথা দিয়ে। বাঁধাকপি, কড়াইশুটি আর আলু দিয়ে লাল করে। বসুন। বসুন। আমি এক্ষুনি গরম করে দিচ্ছি, ফ্রিজ থেকে বের করে। পাঁচ মিনিট।
যে ভালবাসা ফ্রিজে ঢুকে যায়, তা আর গরম হয় না কখনও।
খেতে পৃথু ভালই বাসে। তার উপর নিজে হাতে যদি রেঁধে খাওয়ায় কেউ। কিন্তু একজন পুরুষ একজন নারীকে ভাল যদি বাসে তেমন করে, তবে তার ভালবাসার জনের কাছ থেকে কখনও সখনও দই-মাছ বা তেল-কই ছাড়াও আরও কিছু খেতে ইচ্ছে করে। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে পৃথু, পুরুষের শরীর যেন শত্রুতেও না পায়। পুরুষের শরীরের মধ্যে যে কত জানোয়ারই ঘুমিয়ে থাকে। কুম্ভকর্ণের মতো শক্তিমান একটি সত্তা যদি হঠাৎ ঘুম ভেঙে ওঠে তখন বড়ই খিদে থাকে তার।
কুর্চিকে যেন দেখতে পেল পৃথু। বারান্দায় এসে একবার ঘুরে গেল। কে জানে? হয়তো ভুলই দেখল। গিয়ে কী লাভ? গিয়ে যদি বলতেই হয় কুর্চিকে যে, আমার খিদে পেয়েছে, খেতে দাও; সে তো ভিক্ষে চাওয়াই হল। নিজের ছেলেবেলায় নিজের বাড়ির কাজের লোক, রান্নার লোকদের কাছ থেকেও কিছু চায়নি কোনদিনও। চেয়ে খায়নি কখনও, একটি মাছ, বা একটুকরো মাংসও। মা যেদিন না থেকেছেন খাওয়ার কাছে, সেদিন যা দিয়েছে তারা তাইই খেয়ে উঠে গেছে। খিদে পেয়েছে কি পায়নি তাইই যে-মানুষ অন্যের মুখ দেখে বুঝতে না পারে; তার কাছে কি কিছু চেয়ে খাওয়া যায়?
ঘুম ঘুম পাচ্ছে পৃথুর। ঝরনার মতো ঝরাপাতা বয়ে যাচ্ছে দুপাশ দিয়ে। জীপটা যেন নৌকো এটা।
হঠাৎই মনে পড়ে যে, জীপে ওঠার সময় কি একটা দিয়েছিল ভুচু জীপের কাঁচমোছা হলুদ রঙা কাপড়ে মুড়ে, ড্যাশবোর্ডের পকেটে। ডান হাত দিয়ে খুলল প্যাকেটটা। একটা পাইন্টের বোতলে জল দিয়ে লেবু দিয়ে তৈরি করে দিয়েছে ভডকা।
খাবে? যখন আর খাওয়া উচিত নয় বোঝে; ঠিক তখনই আরও খেতে ইচ্ছে করে।
খাবে না তো কী করবে? আর কী করার আছে ওর? বোধ যখন বড় তীব্র হয়, ছুরির ফলার মতো, কুরে কুরে খায় ভিতরটা তখন তাকে ভোঁতা করার এই-ই তো সহজ পথ।
কুর্চির শোবার ঘরের বিছানায় লেপের মধ্যে ওম। আতরের গন্ধ। কুর্চির মাথার গন্ধ তেলের গন্ধে সব মাখামাখি হয়ে গেছে। মাথার কাছের খোলা জানালা দিয়ে একটু রোদ আর টাঁড়ের গায়ের দুপুরের গন্ধ এসে ঢুকছে বিরহী কালি-তিতিরের ডাকের সঙ্গে, কুর্চির ঘরে।
ভাঁটুর গায়ের গন্ধটা কেমন? নিশ্চয়ই বিচ্ছিরি! হবেই। হতে বাধ্য। ভাল্লুকের গায়ের গন্ধর মতো কি? নাকি, হায়নার গায়ের গন্ধর মতো?
কে জানে? এসব ভেবে লাভই বা কী? কুর্চি তার কে? কুর্চি তো ভাঁটুরই বিবাহিত স্ত্রী। বিবাহ! উদ্দালকের ছেলে শ্বেতকেতু প্রথম বিবাহ প্রথা চালু করেছিলেন না? থাক, সে সব কথা এখন নয়। পাইটের বোতলটা থেকে সোজা গলায় ঢালল পৃথু। দাঁত দুটো টকে আসছে। টক টক লাগছে গলা। সাড়, অসাড় হয়ে যাচ্ছ।
বেলা পড়ে আসছে। মেয়েদের ভালবাসারই মতো শীতের বেলা ঝুপ করে সরে যায়; মরে যায়। জানান না দিয়েই। হাওয়ায় হিম। কিন্তু ভডকা খাওয়ার জন্যে বুঝতে পারছে না।
হঠাৎ আবার স্টার্ট করল এঞ্জিন। ফারস্ট গীয়ারে দিয়ে, কুর্চির বাড়ির সামনে গেল। বাড়িটা পেরিয়ে গেল। হর্ন দিল একবার। ভাঁটু বেরিয়ে বারান্দায় এল। চুল উস্কোখুস্কো। মুখ ফোলা। ভুড়িটা তরমুজের মতো বেরিয়ে আছে। জীপটা ফেরাল পৃথু। ও বুঝল ওর হাত থেকে স্টিয়ারিং ফসকে যাচ্ছে। প্রচণ্ড নেশা হয়ে গেছে ওর। “না পীনা হারাম হ্যায়, না পীলানা হারাম, পীকে হোঁসমে আনা হারাম হ্যায়।” জীপটা ঘুরিয়ে যখন আবারও গেটের কাছে এল ও, তখন দেখল ভাঁটু নেই। ভিতরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। ফাঁকা। সব ফাঁকা। পৃথুর মধ্যেটাও ফাঁকা।
বোকার মতো কিছুক্ষণ চেয়ে রইল খোলা চোখে। এমন সময় বাগানের দিক থেকে দাঈকে আসতে দেখা গেল। তেলমাখা ভিজে চুল মাথার উপরে চুড়ো করে বেঁধেছে। মনে হচ্ছে, যেন কোনও বাঙালি বোষ্টমী। এ কী। দাঈ যে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। নিশ্চয়ই চিনতে পেরেছে। অথচ, যে চিনলে খুশি হত, সে জানতেও পেল না ওর আসার কথা।
সঙ্গে সঙ্গে এঞ্জিন স্টার্ট করল পৃথু। দুগ্ধপোষ্য শিশু নয় ও যে, দাঈয়ের দরকার আছে কোনও। না দাঈ। বাঈ! বাঈ!
এবার আবার ফিরে চলল হাটচান্দ্রার দিকেই। মসজিদের পাশের সেই বাড়িটির একটি ঘরের দিকে, যেখানে একদল পুরুষ বসে আছে ঘন হয়ে। যারা বনের বাঘেরই মতো পুরুষ। নারী সঙ্গ করেছে, নারীকে সন্তান দিয়েছে; কিন্তু নিজেদের নিজস্বতা, স্বাধীনতা কিছুই বাঁধা দেয়নি পৃথিবীর নারী জাতির কাছে। নারীকে ছাড়াই যে খুব সহজে বাঁচা যায়, তা সেই পুরুষরা নিজেরা নিজেদের জীবনে বেঁচে দেখিয়েছে। প্রমাণ করেছে।
কিন্তু বাঁচা কি সত্যিই যায়? বনের বাঘও কি পারে? শালা আদম। একবার তার চেহারাটা জানা থাকলে ফোর-সেভেনটি-ফাইভ ডাবল-ব্যারেল, রাইফেলের সক্ট-নোজেড বুলেট পুরে তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিত। পৃথিবীতে এত খাবার থাকতে কেউ জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেতে যায়?
আবারও জঙ্গলে এসে পড়ল জীপটা। ঠাণ্ডা লাগছে। একদল চিতল হরিণ লাফিয়ে রাস্তা পরোল। লাফিয়ে নয়; উড়েই। সেদিকে তাকিয়ে ছিল পৃথু। হঠাৎই দেখল বাঁকের মুখে একটা কয়লা-বোঝাই ট্রাক। এক চুলের জন্যে বেঁচে গেল ও। ট্রাকের পেছনে দাঁড়ানো কুলিরা অকথ্য গালাগালি করে উঠল পৃথুকে। জীপটা আস্তে করে পথের বাঁদিকে একটি বুড়ো পলাশের নীচে রাখল। স্টার্ট বন্ধ না করে পাইন্টের বোতলটা শেষ করল।
কে যেন বলল, মাথার মধ্যে থেকে, পৃথু তুমি মরে গেছিলে। এক চুলের জন্যে বেঁচে গেলে এই মাত্র।
আবার অ্যাকসিলারেটরে চাপ দিল ও। নিজে নিজেকে বলল, জীবন ও মৃতুর মধ্যে তফাৎ চিরদিনই তো এক চুলেরই। আমি তো মরতেই চাই। যে বেঁচে নেই, সে নতুন করে মরবে কী করে?
এবার জীপটা এরোপ্লেনের মতো চলছে। আঃ। কী হাওয়া। ঠাণ্ডা হওয়া। মা যেন হাত রাখলেন কপালে। বললেন, খোকন, এ কি তোর গাটা গরম গরম লাগছে? মা চলে যাওয়ার পর আজ অবধি কেউ কপালে হাত রাখেনি ওর। জ্বরের মধ্যেও না।
ছিঃ ছিঃ। ইডিপাস কমপ্লেক্স? স্বাভাবিক ব্যাপারের যত্বসব অস্বাভাবিক ব্যাখ্যা! মা ছেলেকে ভালবাসবে না তো কি রুষা ইদুরকারকে ভালবাসবে? কুর্চি, পৃথুকে? ফানী!
বাসে না। ভাল সে বাসে না। কুর্চি, একটুও ভালবাসে না পৃথুকে। ও শুধু কথার ভালবাসা, চোখের ভালবাসা, দই-মাছ আর তেল-কই-এর ভালবাসা; সুন্দর চিঠির ভালবাসা। শুধু ওইটুকু ভালবাসা নিয়ে একজন অভাবী পুরুষ বাঁচতে পারে না। দিগা পাঁড়ে যেন কী একটা দোঁহা বলে! দোঁহা? না মানসমুক্তাবলী?
জিয় বিনু দেহ, নদী বিনু বারী।
তৈসি অ নাথ পুরুষ বিনু নারী॥
প্রাণ বিনা দেহ, জল বিনা নদী যেমন; নারী বিনা পুরুষও তেমনই।
নারী তো আছে সব পুরুষেরই। সব নারীরই আছে পুরুষ। তবুও, এত কষ্ট কেন? কষ্ট কি পৃথুর আর রুষারই? না কি কষ্ট সকলেরই? বাঘবন্দীর ঘরে সকলেই কি সুখে আছে বেশ? বর-বর, বউ-বউ খেলা, ছেলে-মেয়ে, ছেলে-বউ, মেয়ে-জামাই, নাতি-নাতনি, নাতবউ-নাতজামাই। অবশেষে পুতিও। আবার পুতি-বউ, পুতনি-জামাই…চলেছে এইই আবহমান কাল ধরে। অভ্যেস। অভ্যেস। অন্ধ পুতুল খেলার অর্থহীন অভ্যেস।
গাঁ-আ-আ-আ করে ধেয়ে এল একটা বাস। নীল-রঙা-মালঞ্জখন্ড যাচ্ছে হাটচান্দ্রা থেকে। পথ ছেড়ে বাঁদিকের পাথুরে জমিতে নামিয়ে দিল কোনওক্রমে জীপের চাকা দুটো পৃথু,। খাদে পড়তে পড়তে বেঁচে গেল; সামান্যর জন্যে।
কে যেন মাথার মধ্য থেকে আবার বলে উঠল; পৃথু, তুমি এক্ষুনি মরে যাচ্ছিলে।
পৃথু হাসল, না-বলে বলল, যে মরতে চায়, মৃত্যু তাকে ছোঁয় না। যে বাঁচতে চায়; মৃত্যু বাঘের মতো তারই ঘাড়ে এসে পড়ে। আজও তো মরল না ও। মরলে একদিন এমনি করেই মরবে। নিজে নিজে। নিজের গাড়ি নিয়ে। অন্যের গাড়ি ভাঙবে না, অন্যের গায়ে আঁচড় লাগাবে না। গাড়ির স্টিয়ারিংএ বসে নিজে নিজে মরার অনেকই পথ আছে। গিরিশদার ভাষায়, মরলে গদ্দাম আওয়াজ করেই মরবে, ধুঁয়োর মতো উড়ে যাবে এক লহমায়, কুকুরের মতো কেঁই কেঁই করে কাঁদবে না মরার সময়। কারও কাছেই না। রুষা, মিলি, টুসু, এমনকী কুর্চির কাছেও না। একটা মানুষ ভিতরে ভিতরে যে কাঁদছে, তা যদি মায়েরই মতো কেউ সত্যি সত্যি কাঁদার আগে নাইই বুঝতে পারল তাহলে সেই মানুষদের কাছে নিজেকে ছোট করতে যাবেই বা কোন দুঃখে? বাইরের কান্না তো চোখই কাঁদে। পৃথুর এ কান্না যে, সে কান্না নয়। এ যে বুকের মধ্যে রক্তক্ষরণ। এই বোঝা কান্না বুকে করে যারা কাজ করে, কর্তব্য করে, হাসে, নেমন্তন্ন খায়, তাদের বড়ই কষ্ট! সত্যিই বড় কষ্ট। কজন আর সত্যি সত্যিই কেঁদে ভারী দমবন্ধ এই বোবা পাথরের ভার থেকে মুক্ত করতে পারে নিজেকে।
সাবীর মিঞার বাড়ির সামনে যখন এসে পাঁছল তখন বেলা প্রায় তিনটে। খানা জমে উঠেছে। পৃথুকে দেখে গিরিশদা বুঝতে পেরেছিলেন। বললেন, বোসো বোসো, ওই আরামকেদারাতে বোসো। তোমার এই অবস্থায় নিজে জীপ চালানো উচিত হয়নি।
বহত বুড়হা কাম। অ্যায়সা কভভী নেহী করনা চাইয়ে পৃথুবাবু।
সাবীর মিঞাও বকলেন।
পৃথু আরাম কেদারায় পুরো এলিয়ে দিতে চাইল না শরীর। এলিয়ে দিলে আর উঠতে পারবে না।
সাবীর মিঞা নিজে হাতে বড় দস্তরখান থেকে বের করে লাল শীল ফুল আঁকা এনামেলের রেকাবিতে করে বিরিয়ানী, তক্কর, একটু বাখরখানি রোটি, ভোপাল থেকে আনিয়েছে; এবং রেজালা তুলে দিলেন। বললেন, খান। এর পর ফিরণী দেব।
একটা জিনিস লক্ষ করেছে পৃথু ওর মুসলমান দোস্তদের খানাপিনাতে টক-এর কোনও পদ থাকেনা। সাবীর মিঞা একদিন বলেছিলেন, যদি মস্ত হয়ে বাঁচতে চান, জিন্দা দিল হয়ে হরওয়াক্ত মস্তিতে থাকতে চান তবে পেঁয়াজ, রসুন, লঙ্কা এইই খাবেন। পুরুষ মানুষদের টক খাওয়া মানা। হিন্দুদের যদিও মোটে একটি করেই বিবি। তবুও বেশি টক খেলে সে বিবিও পালিয়ে যাবে। বলতেন, বিবিকে টক খাওয়াবেন বেশি করে। নিজে একদম খাবেন না।
যত্ব সব। মনে মনে রাগ হচ্ছিল পৃথুর। কেন জানে না, ওর শরীরের মধ্যে হঠাৎ শয়ে শয়ে কাঁকড়া নড়াচড়া করতে আরম্ভ করেছে। সকাল থেকে। বেশি পেঁয়াজ রসুন লঙ্ক ভডকা এসব খেয়েই কি হল? সে তো খাচ্ছে ছোট্টবেলা থেকেই। তার বাবাও খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে পুরোপুরি মুসলমান ছিলেন। জীবনযাত্রার রইসীতেও অনেকখানি। পানের পিক ফেলার পিকদান থেকে শুরু করে, পার্সিয়ান গালচে। সুর্মা থেকে শুরু করে জড়িমোড়া আলবোলা, বাদ ছিল না কিছুই। পৃথুরও হারেম থাকা উচিত ছিল। এই চখা-চখির মতো বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীর মতো নির্জন চরের মধ্যের ঘরে দিগন্তের নদীর নীলাঞ্জনে চোখ ভরে খঞ্জনি বাজিয়ে দিন কাটানোর রক্ত নিয়ে সে জন্মায়নি।
হায় রক্ত! মানুষ নিজের রক্তকে ছাপিয়ে উঠতে কেন পারে না। কিসের শিক্ষা তাহলে তার? কিসের পারিপার্শ্বিকতার গর্ব? তার মায়ের রক্তের সমস্ত সুক্ষ্ম ব্যাপারগুলি, দয়া, গান, কবিতা, গভীরতা, ভালবাসা, অভিমান, সব মাঝে মাঝে চাপা পড়ে যায় তার বাবার রক্তের স্থূল দুর্মর ব্যাপারগুলোতে। মুখে বলল, নাঃ।
নাঃ। ফিরে এসে, অমন খানা মুখে দিয়েও শান্ত লাগছে না নিজেকে একটুও। আগুন নিভছে না। কী যে করবে বুঝে উঠতে পারছে না।
কী হল। পৃথু ভায়া? তোমার আজ হয়েছেটা কী?
বাঘ জেগেছে আজকে; বাঘিনী চাই।
মনে মনে বলল ও।
যে-সব কথা জীবনের শিকড় অবধি গিয়ে পৌঁছয় অথবা জীবনের শিকড় থেকেই যেসব কথা উঠে আসে, তা খুব অল্প লোককেই বলা যায়।
তাড়াতাড়ি খেয়ে নিতে চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। বমি বমি লাগতে লাগল ওর। উঠে বলল, আমি বাড়ি যাব। শরীর খারাপ লাগছে আমার।
সকলেই উদ্বিগ্ন হল। গিরিশদা বললেন, আমার গাড়ি নিয়ে যাও। ড্রাইভার আছে। যদি ডাক্তারের কাছে যেতে হয় বা ডাক্তার ডাকতে হয়, তাহলে গাড়ি রেখে দিয়ো তোমার যতক্ষণ খুশি। আমাকে ভুচু পৌঁছে দেবে।
কথা বলার মতো অবস্থা ছিল না তখন। হাত তুলে দেখাল ও, আচ্ছা। তারপর গিয়ে ড্রাইভারের পাশে বসল।
বাড়ির সামনে গাড়িটা নেই। রুষা কি ফেরেনি এখনও? আজ সে তার বিবাহিতা স্ত্রীর কাছে বিবাহের প্রধানতম শর্ত পালন করার কথা বলবে। “ইজ ম্যারেজ লিগালাইজড প্রস্টিট্যুশান?” রিয়্যালী? কোথায় যেন পড়েছিল কথাটা।
বেল টিপতেই রুষাই এসে খুলল।
কী হয়েছে তোমার? উদ্বিগ্ন গলায় বলল, রুষা।
মিলি, টুসু; গাড়ি কোথায়?
ওরা স্কুলের ফেট-এ গেছে।
মেরী, দুখী ওরা?
ন্যাকামি কোরো না। জানো না, এখন ওদের রেস্ট করার সময়। কেন? কী দরকার তোমার? কী চাই? খেয়ে এসেছ?
হুঁ।
কী চাই?
চাই, চলো, তোমার বেরুমে চলো।
ব্যঙ্গের হাসি ফুটে উঠল রুষার মুখে। আমার বেডরুম? হঠাৎ। কেন? আমার বেডরুমে তোমার কী চাই? তুমি তো বাঘ। বাঘেদের তো বেডরুম দরকার হয় না।
অত কথা বলার এবং শোনার সময় নেই এখন পুথুর। রুষার আগে আগেই ও রুষার বেডরুমে গিয়ে পৌঁছল। খাটে শুয়ে পড়ল। বেডশীট দিয়ে ঢাকা বিছানার উপর। জুতো খুলে রাখল গোল হালকা নীল কার্পেটে। রুষার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছিল তীক্ষ্ণ চোখে।
বলল, কী হয়েছে তোমার? কী চাই?
তোমাকে। রুষা। তোমাকে একটু চাই। এসো।
রুষা না এসে, জানালা দিয়ে বাগানে চেয়ে রইল। পেয়ারা বনে টিয়ারা মারামারি করছে। পেয়ারা ঠুকরে ফেলে দিচ্ছে নীচে। জোড়া বুলবুলি ডাকছে রঙ্গনের ঝাড় বসে। ভালবাসায় ঝাপটা ঝাপটি করছে। ঘুঘু দম্পতি ডাকছে সপ্রেম, গভীর স্বরে।
রুষা কাছে এল না দেখে পৃথু খাট থেকে কষ্ট করে উঠে রুষার কাছে গিয়ে নিজের স্ত্রীকে পরস্ত্রীর মতো ভয়ে ভয়ে জড়িয়ে ধরল।
এক ধাক্কা দিয়ে রুষা ওকে খাটে ফেলে দিল।
খাটের বাজুতে মাথা ঠুকে গেল পৃথুর। বলল, উঃ।
কী ভেবেছ তুমি আমাকে? স্বামীর পরিচয়টুকু ছাড়া, আমার কাছে তোমার আর কোনও দাম নেই। আমি কি তোমার ঝি? না রক্ষিতা? ন-মাসে ছ-মাসে তোমার যখন হঠাৎ ইচ্ছে হবে তখন…। না, আমি তেমন নই। ব্যাপারটা মনের ব্যাপার। শরীরের নয়।
ভাবল বলে, তাইই তো। আমি তো তাইই বলি। মন থেকে যে তোমাকে চাইতেই ইচ্ছে করে না আমার। তাইই তো চাই না। কিন্তু তবু…
মুখে কিছুই বলতে পারল না, বলল, উঃ।
লেগেছিল খুবই মাথায়।
আবার ও হাত বাড়িয়ে বলল, এসো, এসো; একটু এসো, প্লীজ…
রুষা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, কেন? আমার কাছে কেন? কুর্চির কাছে যাও। বাজারের প্রস্টিট্যুটের কাছে যাও। যেখানে খুশি যাও। আমি কী চাই, কখন চাই তা নিয়ে তোমার কোনওদিনই কোনও মাথাব্যথা ছিল? তোমার যখন নেই, আমারই বা থাকবে কেন? বেরিয়ে যাও তুমি এখান থেকে। গেট আউট।
তুমি তাড়িয়ে দিচ্ছ?
হ্যাঁ। তুমি গেলে আমি বাঁচি। আমার ছেলেমেয়ে বাঁচে। তোমার এই অদ্ভুত অসামাজিক অসুস্থ জীবনযাত্রা কোনও রেসপেকটেবল লোকের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। এখান থেকে যাও, তবে প্রতি মাসে টাকাটা ঠিক ঠিক দিতে হবে। মাইনের সব টাকা।
উঠে বসে পৃথু বলল, কেন? চলে যাব, তাহলেও…
কেন আবার কী? আমার বাড়ি এটা। আমার রাইট আছে তোমাকে তাড়িয়ে দেবার। তুমি কোম্পানির গেস্ট হাউসে গিয়ে থাকো। টাকা দেবে, কারণ ছেলে মেয়ে আছে। ছেলেমেয়ে হবার সময় মনে ছিল না? বিয়ে করেছিলাম আমি একজন রেসপেটেবল ফরেন-ট্রেইন্ড এঞ্জিনিয়ারকে। একজন ব্যালান্সড মানুষকে। ব্যর্থ কবি, বনের বাঘকে আমি বিয়ে করিনি। তোমার আসল—তুমি কে জানলে, কোনওদিনও বিয়েই করতাম না তোমাকে। আর কথা নয়। চলে যাও।
পৃথু বিড় বিড় করে উঠল। তারপর মাথা নিচু করে জুতোটা পরল বহু কষ্টে। নিজের স্ত্রীকে অনেকেই রেপ করে বলে শুনেছে পৃথু। তারা হয়তো অন্য মেয়েদেরও রেপ করতে পারে। পৃথু সে কথা ভাবতে পারে না। জোর করে? জোর করে জীবনে লজ্জা পাওয়া যায়, গ্লানি পাওয়া যায়; কোনও আনন্দই জোর করে কি পাওয়া যায়?
গিরিশদার গাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল। ড্রাইভার ওকে দেখেই এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিল। পৃথু বসে বলল, চলো।
কাঁহা, সাহাব?
কাঁহা? বলেই চুপ করে গেল পৃথু।
কোথায় যাবে? যাওয়ার জায়গা তো ওর কোথাওই নেই। বন্ধু বলতে যা বোঝায়, যাকে জীবনের সব কথা অকপটে বলা যায়; তেমন বন্ধুও তার একজনও নেই। দু একজন ছিল। ইদুরকারেরই মতো, তারাও তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। প্রিয়তম বন্ধুদের মুখোস খুলে গেলে, তাদের গভীর ঈর্ষাপরায়ণ শত্রু বলেই চিনেছে। তার জঙ্গলের বন্ধুরা রাইফেল-বন্দুক বোঝে, বাঘ মারার সাহসের কথা বোঝে, একজন মহিলার কাছে এমন করে হেরে যাবার মতো ভীরুতার কথা তাদের কাছে বলা যায় না। তাছাড়া, তাদের জঙ্গুলের বুদ্ধিতে তারা বুঝতেও চাইবে না যে দোষটা রুষার নয়, দোষটা পুরোপুরিই ওর। একজন মানুষ জীবনে যা-কিছুই পায় অথবা পায় না, তার কৃতিত্ব বা দায়িত্ব তার নিজেরই। অনুকম্পা চায় না, সমবেদনা চায় না সে কারও কাছেই; তাইই তো তার মুখ-ভরা হাসি সব সময়। নিজেকে তবু ছোট করলেও করতে পারে, তা বলে রুষাকে ছোট করবে কী করে? রুষা যে তার থেকে সবদিক দিয়েই ভাল। দোষ তো সবই পৃথুরই। মস্ত দোষ। ও সাধারণ হতে পারল না, অন্য দশজনের মতো হতে পারল না।
কাঁহা যাইয়েগা সাহাব?
চলো, সিধা চলো।
রুষা বলেছিল, “তোমার আসল-তুমিকে জানলে তোমাকে কখনও বিয়ে করতাম না।”
ভালই বলেছে। আসল-তুমি! আসল-আমি, আসল-তুমিকে কেইই বা চেনে জানে? এই আমি-তুমি তো প্রতিমুহূর্তেই বদলে যাচ্ছি। জন্তু জানোয়ার বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে শুধু আয়তনে বাড়ে, গায়ের জোরেই বাড়ে। কিন্তু মানুষ? এই বিচিত্র প্রাণীর মন বলে যে বস্তুটি আছে সেই মনের ঊর্ধ্বগতি অধোগতি, তার বিবর্তন, পরিবর্তন এমনভাবে ঘটে যে; তার মালিকের পর্যন্ত তা জানবার উপায় থাকে না।
কোথায় যাবে? শ্বশুরবাড়ি?
সব বিবাহিত মানুষেরই একটি করে শ্বশুরবাড়ি থাকে। সেখানে জামাই বা ভগ্নীপতি গেলে আদর-যত্ন, ভালবাসা ফ্রিজ খুলে সহজে বের করে দেওয়া হয়। ইনস্ট্যান্ট ভাললাগা; কফির মতো পৃথুর তাও নেই। রুষার যে দুজন কাজিন আছে তারা এখন কেউ-কেটা হয়ে অতীতকে ভুলে গেছে। জন্তু-জানোয়ারের মধ্যেও কিন্তু অতীতের স্মৃতি বেঁচে থাকে, বেঁচে থাকে কৃতজ্ঞতা বোধ। শুধু মানুষের মধ্যেই এসব তামাদি।
আভভি কাঁহা?
আবার শুধোল গিরিশদার ড্রাইভার। বাজারের মোড়ে এসে। অন্ধকার হয়ে এসেছে। পৃথুর মাথার মধ্যের অন্ধকারেরই মতন।
তোমার নামটা কী যেন ভাই?
শ্রীকৃষ্ণ। ড্রাইভার বলল।
মুখে বলল, বাঃ। বাঃ।
শ্রীকৃষ্ণকেই তো দরকার ছিল এই মুহূর্তে। সারথি! তুমি যেখানে হয় নিয়ে চলো। অর্জুন আর যুদ্ধ করবে না। তার পরমাত্মীয়দের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চায় না সে। তারা তাকে যতই মারুক, বকুক, ব্যথা দিক; তীর ছুঁড়ক বুকে।
মনে মনে বলল।
কাঁহা সাহাব? গাড়িটা মোড়ের মাথায় দাঁড় করিয়ে রেখে শ্রীকৃষ্ণ আবারও বলল।
শরাব কা দুকান। রঘু শাহকা দুকান। পানিকা ট্যাকিকি পাস।
আপ ঔরভি পীজিয়েগা সাহাব? আপকি তবিয়ত গড়বড়াগিয়া। ঔর নহী পীনে চাহিয়ে সাহাব।
বাত মত করো। রঘু শাহকা দুকান।
জলের ট্যাঙ্কির নীচের মাছওয়ালারা তখনও দু একজন বসে আছে। ছড়ানো-ছিটোনো বরফ-চাপা দেওয়া শাল সেগুনের পাতা। আঁশটে গন্ধ। গাড়িটা দাঁড়াল।
রূপাইয়া হ্যায় তুমহারা পাস?
পৃথু শুধোল।
কাহে সাহাব?
ভডকা লাও। বড়া বুত্তল এক। রূপাইয়া নেহি হোনেসে, হামারা নাম বোলো; অ্যাইসাহি দে দেগা।
ভডকা?
আররে ভুডকা নেহী, ভডকা।
সফেদ বড়কা? পানিকো মাফিক।
হাঁ। হাঁ। তুম তো সবহি জানতা।
নেহী সাহাব। উ তো গাড়িমেই পড়া হ্যায়। দো বুতল। বাবু লেতে আয়েথে ইকসট্রা। কম্মী হোনেসে…।
ওয়াহ। ওয়াহ। তব তো মজা আ গায়া। লাও। এক বুত্তল লাও।
গিলাস তো নেহি হ্যায় সাহাব সাথমে।
গিলাস সে কেয়্যা হোগা। জেহর কোঈ গিলাসমে পীতে হেঁ থোরী! বিশ কে আর গেলাসে করে খায় হে! আভভী যাও। পান লাও হামারা লিয়ে। ইকশ-বিশ। জর্দা ভি। চার পান।
জী সাহাব।
বলেই নেমে গেল শ্রীকৃষ্ণ।
বোতলটা খুলে ঢকঢক করে ঢেলে দিল মুখে। জ্বালা জ্বালা! কণ্ঠনালী, লিভার, কেউ যেন সুতীক্ষ্ম ছুরি দিয়ে কেটে দিল। খুবই কষ্ট। কিন্তু এ কষ্ট, এ খরাবী, কুর্চি আর রুষা দুজনেরই দেওয়া দুঃখের কাছে কিছুই নয়। হায়! তোমরা যদি কখনও জানতে, পৃথু তোমাদের কতখানি ভালবাসে। প্রত্যেকের ভালবাসার রকমই আলাদা হয়। আলাদা আলাদা পুরুষ তাদের আলাদা আলাদা ভালবাসা! তোমাদের কত বুদ্ধি। কিন্তু দুহাতে তোমাদের সব বুদ্ধি জড়ো করেও পৃথুকে তোমরা দুজনে কেউই বুঝতে পারলে না। পারলে না…
এবার কোথায় যাবে? রাত মোহানাতে গিয়ে বসে থাকবে একা যতক্ষণ না বেহুঁস হয়ে যায়? “পীকে হোঁসমে আনা হারাম হ্যায়!”
এমন সময় গাড়ির পাশে কে যেন এসে দাঁড়াল।
বলল, সাহাব!
কওন?
জলের ট্যাঙ্কির ছায়া পড়েছে এখানে। আধো-অন্ধকার। প্রথমে চিনতে পারল না লোকটিকে পৃথু। ম্যায় সারেঙ্গীওয়ালা। বিজ্লী বাঈজিকো ইয়াদ তো হ্যায় না?
বিজ্লী। হ্যাঁ হ্যাঁ বিজ্লী। জরুর। জরুর ইয়াদ হ্যায়।
চালিয়ে না হুজৌর। আজ তেওহারকা ওজেসে মেহমান কোঈ আনেওয়ালা ভি নেহী। আপ চালিয়ে। বড়ী খুশি হোগী বিজ্লী।
খুশি হবে? পৃথুকে দেখে খুশি হবার মতো এখনও আছে তাহলে কেউ? ঈ ক্যা খশনসীবী বাত।
পৃথু মনে বলল, গাড়িমে বৈঠো। চালুঙ্গা।
ড্রাইভার শ্রীকৃষ্ণ এসে পান দিল। জর্দার সঙ্গে নীট ভডকা মিশে গিয়ে প্রাণটা তক্ষুনি বেরিয়ে যাবে মনে হল পৃথুর।
সারেঙ্গীওয়ালাকে দেখে শ্রীকৃষ্ণর পছন্দ হল না।
পৃথু বলল, বাইজির সঙ্গে সারেঙ্গী বাজায় এ। দ্যাখোনি, সেই রাতে গিরিশদার বাড়িতে?
আপ কিদার যাইয়েগা সাহাব?
জাহান্নাম!
আপকি লায়েক আদমীকো হুঁয়া যানা নেহী চাহিয়ে।
হেসে উঠল পৃথু। হামরা লায়েক? হাম কওনসী বড়া আদমী হ্যায়?
আপ বহত মানী আদমী হ্যায় সাহাব। সোসাইটিমে আপকি কিতনা ঈজ্জৎ।
সোসাইটি! আবারও হেসে ফেলল পৃথু। সোসাইটির কাছ থেকে তার কিছুই চাইবার নেই। এই সোসাইটি? সোসাইটি, রুষাদের আর ইদুরকারদের জন্যে। ও চিরদিনই আনসোশ্যাল ছিল। এখন অ্যান্টি সোশ্যাল হয়ে যাচ্ছে। বাঈজির কাছে গিয়ে তার গান শুনে, শরীর ছেনে নিজেদের ভিতরের গভীর নিহিত পাপবোধকে ক্ষালন করতে তো যায় গুণ্ডা, বদমাস, আর বেহড়ের ডাকাতরাই। সমাজ যাদের জায়গা দেয়নি। যারা বাগী হয়ে গেছে; সমাজের উপর তীব্র অভিমানে যারা সমাজের উপর প্রতিশোধ নিতে যায় এসব জায়গায়। কেউ খুন করে বাগী হয় গোয়ালিয়রে, ভিন্দ-এ; মোরেনায়, চম্বলের বেহড়ে, আবার পৃথুর মতো বাগী হয় কেউ কেউ, বিনা রক্তপাতে খুন হয়ে গিয়ে।
চল শ্রীকৃষ্ণ। অর্জুন কী করবে জানে না। শ্রীকৃষ্ণ, তুমি জাহান্নমে নিয়ে গিয়ে মুক্ত করো তাকে।
বিজ্লী বোধহয় সাজগোজ করেনি আজকে। আজকে ওর রেস্ট-ডে। সারেঙ্গীওয়ালা মিনিট দশেক বসিয়ে রাখল ওকে ফরাসের উপর। তাকিয়া আছে, ছড়ানো ছেটানো। দেওয়াল-জোড়া আয়না। বাসি লাল গোলাপ। আতর আর ধুপের গন্ধ ঘরে। দেওয়ালে, বুক-খোলা একজন ফিল্মের নায়িকার ছবিওয়ালা ক্যালেন্ডার।
বড় ঘুম পাচ্ছিল পৃথুর। তাকিয়াতে হেলান দিলেই ঘুমিয়ে পড়বে। কিন্তু ঘুমোবে ঠিকই, তবে এখন নয়। ওর শরীরের মধ্যের কাঁকড়াগুলোকে ছেড়ে দেবে বিজ্লীর শরীরে। তখন শান্তি। গভীর শান্তি। বড় আরামের ঘুম ঘুমোবে তখন। ওর কোনও দোষ নেই। রুষা তো বলেইছে যেখানে খুশি যেতে ওকে। যা-খুশি করতে। নষ্ট হয়ে যেতে বলেছে ওকে। নষ্টই হয়ে যাবে ও।
বিজ্লী এসে আদাব করল। বলল, কার মুখ দেখে উঠেছিলাম আজ!
পৃথু বলল, ভডকা খাবে?
না।
আপনি এসেছেন। আপনিই তো আমার জওয়ানীর সবচেয়ে কিমতি শরাব। গান শুনবেন তো?
শোনাও।
তাড়াতাড়ি সারেঙ্গী বাঁধা হল। তবলচি ঘুমিয়ে ছিল তেওহারের দিনের ভারী খানা খেয়ে। তাকে ঘুম থেকে তুলে আনা হল। বিজলী গান ধরল। একটি ঠুঙরি। এই ঠুঙরিটি অনেকদিন আগে হীরাবাঈ বরোদাকারের গলায় শুনেছিল, ভোপালে, এক রইস আদমীর ঘরোয়া ম্যায়ফিলে। আজ ম্যায়ফিল নয়। শুধু পৃথুরই জন্যে বিজ্লী গাইছে। গান দিয়ে রূপ দিয়ে পৃথুকে বিদ্ধ করবে বলে। কিন্তু পৃথু আজ বিদ্ধ হতে আসেনি। বনের বাঘের জমিয়ে রাখা পাহাড়-প্রমাণ তীব্র কাম দিয়ে বিজ্লীকেই বিদ্ধ করবে বলে এসেছে। নিজেকে ভাবশূন্য করতে। নিঃশেষ হতে। অশেষের লীলায় মেতে উঠবে ও আজ ওর জংলি উদ্দামতায়। ফুরিয়ে দিয়ে আবার নতুন করে ভরে নেবে নিজেকে এই লীলাতে।
গাইছিল বিজ্লী। “মেরা সাঁইয়া বুলাঁওয়ে আঁধি রাতি, নদীয়া বৈরী বঁহি…”
শুনরে মালা হো তেরী ছেরী নইয়া লাগা দে পারে…”
আহা! কী গান। ভডকার শিশিটা প্রায় শেষ করে আনল পৃথু। ওর মাথার মধ্যে এখন বাস্তারের বাইসন হর্ন মারিয়াদের নাচের মাদল বাজছে। শিরায় শিরায় জংলি কুকুরের মতো রক্ত-পিপাসু রক্ত ছুটোছুটি করছে। বিজ্লীকে আজ নরম নধর কোনও বনহরিণীরই মতো নিঃশেষে খাবে ওরা। চেটে-পুটে, খুঁটে খুঁটে, কিছুমাত্র বাকি না রেখে।
গান থামলে, বিজ্লী অরেকটি গান ধরার জন্যে তৈরি হল। পৃথু হাত তুলে বারণ করল। বিজ্লী, সারেঙ্গীওয়ালা এবং তবলচি সবাইই অবাক হয়ে তাকাল পৃথুর দিকে।
পৃথু আঙুল তুলে ভিতরের দরজার দিকে দেখাল।
অবিশ্বাসে চোখ দুটি বড় বড় হয়ে উঠল বিজ্লীর। মাথা নিচু করে ফেলল। চোখের ইঙ্গিতে ওদের যেতে বলল। তারপর হাত ধরে টালমাটাল পৃথুকে নিয়ে গেল ভিতরের ঘরে। খাটে, ওকে শুইয়ে মাথার কাছে বসে কপালে হাত দিল। চুলে বিলি কেটে দিতে লাগল। নাকের রোমকূপে-কূপে কালো কালো বিন্দুর মতো ময়লা জমেছিল। নাক টিপে সেই ময়লা তুলে দিল। তারপর আতর মাখানো রুমাল এনে নাক পরিষ্কার করে মুছে দিল।
পৃথু হঠাৎ উঠে বসে বাঘ যেমন করে হরিণের মাংস ছেঁড়ে তেমন করে কামড়ে চুমু খেল। বিজ্লীকে।
যন্ত্রণায় বিজ্লী বলল, উঁ-উ-উ…জংলিপন।
হাঁ। ম্যায় জংলীই হুঁ বিজ্লী। বিলকুল জংলী।
পৃথু ওকে ছেড়ে দিয়ে বলল, তোমার আমার মধ্যে কোনও আড়াল চাই না আমি। ওঃ বিজ্লী। আমার কিন্তু পয়সা নেই। তুমি…
ওর ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে বিজ্লী বলল, এত্বদিনে এইই বুঝলে আমাকে! সব ব্যবসাদারই টাকা কামায়। কিন্তু তাদের প্রত্যেকেরই এমন এমন সম্পর্ক থাকে যেখানে তারা না নিয়ে কিছু দিতে পেরেই ধন্য হয়। তুমি আমার সেইই। পয়সা দিয়ে সকলেই আমার শরীরটাকে কিনতে পারে। মনটা কেনা-বেচার বাইরে। তুমি আমার মনের মানুষ।
কেন? কেন? কী করে? আমিই কেন?
কী জানি! ভালবাসা তো ব্যবসা নয়। দেনা-পাওনার ব্যাপার নয়। একজনের সঙ্গে অন্যজনের হঠাৎই হয়ে যায়। এর রহস্য খুদাহই জানে। আমি কী করে জানব বলো। আনপড় জেনানা।
এই ঘরের খাটের দু পাশেও দেওয়াল-জোড়া আয়না। এ সব মেয়েরা বোধহয় খুব সৎ হয় ভিতরে ভিতরে। লুকোবার কিছুমাত্র থাকলে, নিজেকে বার বার এমন করে দেওয়াল-জোড়া আয়নার সামনে অনাবৃত করে দেখা যায় না। দেখানো তো নয়ই।
সব আড়াল খুলে ফেলল বিজ্লী একে একে। পরতের পর পরত। মেয়েদের যত পরিধান, যত সাজ, সব বুঝি অবশেষে খুলে ফেলার জন্যে তাদের আবরণ পরিপ্লতি পায় নিরাবরণ হলেই।
আঃ। দু চোখ ভরে দেখল পৃথু। বেণীটিকে বাঁ কাঁধ দিয়ে নামিয়ে এনে বুকের পাশ দিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছে। বেণীর রুপোলি জরির বাঁধন আশ্চর্য এক সৌন্দর্য এনে দিল। শ্রাবণের আকাশে রুপোলি রেখার মতো।
আঃ। যেন ঝাঁ-ঝাঁ করা বসন্ত দুপুরের গভীর জঙ্গলের মাঝে একটি রক্তলাল ফুলাভারাবনত ঝাঁঝালো ছিপছিপে একলা পলাশ। পৃথু ওকে টেনে নিল বিছানাতে। মনে মনে বলল, পলাশ, তোমার ঝাঁঝ সব শুষে নেব আজ।
পৃথুর ডান বাহুতে মাথা দিয়ে শুয়ে ছিল বিজ্লী। কাৎ হয়ে। ঘরের বাতি নেবানো। ছোট্ট নীল আলোটা জ্বলছে। ঘুমিয়ে পড়েছে পৃথু। নিঃশেষিত বাঘ। হঠাৎ বিজ্লী অনুভব করল তার খোলা পিঠ পৃথুর চোখের জলে ভিজে গেছে। অদ্ভুত মানুষ একটা।
বিজ্লী উঠে পড়ে রজাইটা পৃথুর.গায়ে দিয়ে দিল। ঠাণ্ডা আছে। সব পুরুষই এক এক সময় শিশুর মতোই হয়ে যায় তাদের ভাবভঙ্গিতে। ঘুমের মধ্যে দেয়ালা করে তারা।
জানালার কাছে গিয়ে জানালাটা খুলে দিল বিজ্লী। মহল্লায় কারও ঘরে গান হচ্ছে। ভূপ রাগে গাইছে কেউ। বিলম্বিত তিনতালে : “সহেলারে, সহেলালারে আ মিল গায়ে…জনম জনমকো…
সহেলারে…
শীত করছিল পৃথুর। সে যেন নরম হাতে গলার আর কাঁধের কাছে লেপটা গুঁজে দিল ভাল করে। আবার আরামে ঘুমিয়ে পড়ল ও। পাশ ফিরে।
ঘুম যখন ভাঙল, দেখল, রোদ এসে পড়েছে ঘরের রঙিন টালি-মোড়া মেঝেতে। পায়রা ডাকছে, বকবকম ছোট মসজিদের মিনারের তলায় বসে রোদ পোয়াতে পোয়াতে। ওদের ঝাপটানো-ডানায় ছিটকে উঠে পায়রা-পায়রা গন্ধ ছড়িয়ে যাচ্ছে সকালের ওম-ধরা রোদে। কাছেই কোথাও গলায় ঘন্টা-বাঁধা একটা রামছাগল মাথা ঝাঁকাচ্ছে। টুং-টাং আওয়াজ আসছে তার। দুধ দুইছে বোধহয় কেউ। একটি রামছাগল কত দুধ দেয় কে জানে?
নানা অপ্রয়োজনীয় অপ্রাসঙ্গিক কথা মাথার মধ্যে ভিড় করে আসছে। হরজাই শব্দ ভেসে আসছে কানে, এলোমেলো। পথ দিয়ে মেয়ে-পুরুষ যাচ্ছে আসছে। তাদের জুতো ও চটি পরা পায়ের আওয়াজ পথ থেকে উঠে আসছে ঘরে। শিশির-ভেজা, ধুলো-মাখা, এখনও চুপচাপ পাড়া থেকে। সাইকেল রিকশা গেল একটা। ক্রিং ক্রিং করে ঘণ্টা বাজিয়ে। বোধহয় দুধের বালটি বসানো আছে রিকশাতে। ক্রিং ক্রিং এর সঙ্গে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ মিশে যাচ্ছে। পাশের বাড়ি থেকে কোনও বাতিকগ্রস্থ বুড়ো খুব জোরে গলা খাঁকারি দিয়ে মুখ ধুচ্ছে। খবরের কাগজওয়ালা হেঁকে যাচ্ছে ঊর্দুর কাগজ নিয়ে। আখবার! আখবার! পায়ে পায়ে ঝুম ঝুম করে মল-বাজিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে পাথুরে পথে কোনও মুসলমান কিশোরী। ওড়না-উড়িয়ে; বেণী-দুলিয়ে।
সাবীর মিঞা অনেকদিন আগে কিশোরীর অথবা কৈশোরের বর্ণনা দিয়ে একটি শায়ের বলেছিলেন। এই অচেনা গন্ধপুঞ্জ ও শব্দমঞ্জরীর মধ্যে অদেখা কিশোরীর দৌড়ে যাওয়ার শব্দেই হঠাৎ করে মনে উড়ে এল সেই শায়েরটি।
“আভভি লড়প্পনভি হ্যায়, শাবার ভি হ্যায়
হায়া কী পরদেমে ও সোঁখবে নকাব ভি হ্যায়।”
কৈশোর যেন দুটি ঘরের মাঝের পর্দাখানি। একটি ঘর শৈশবের, অন্য ঘর যৌবনের। হাওয়া লেগে পর্দাটি যেন একবার এ ঘর আর একবার ও ঘর করছে। এইই কৈশোর।
নানা শব্দ ও গন্ধর ছিটে, চেতনার চারদিকে তারা বাজির থেকে উৎক্ষিপ্ত কণার মত ছিটকে যাচ্ছে। শুয়ে শুয়ে দেখতে পাচ্ছে পৃথু ছোট্ট ঘরখানির উপরের ফলস-সীলিং। সীলিং-এর নীচে ভোপালী চাঁদোয়া নিপুণ হাতে সেলাই করে দেওয়া হয়েছে। রোদ এসে রঙীন মেঝেতে পড়ে প্রতিফলিত হচ্ছে রঙিন চাঁদোয়াতে। আবারও প্রতিফলিত হয়ে সমস্ত ঘরখানিকে এক বহুবর্ণ প্রজাপতির ডানার মতো তিরতিরে, কাঁপা আলোতে আভাসিত করে দিয়েছে। কে জানে? কোথায় শুয়ে আছে পৃথু? কার ঘর এটা? মস্তিষ্কর শ্লথ কোষগুলিও জড়াজড়ি করে সকালের কবোষ্ণ শীতের আশ্লেষে ঘুমিয়ে আছে এখনও আরামে। এমন সকালে কারই বা ইচ্ছে করে ঘোর ভেঙে, লেপ ছেড়ে উঠতে? কোথায় যে সে আছে, জায়গাটা বেহেস্ত না দোজখ তা জানার ইচ্ছেটুকুও যেন নেই ওর। মরে যাবার পূর্বমুহূর্তে, মানুষ তার অনেক গর্বের চেতনা চিরদিনের মতো লুপ্ত হয়ে যাবার আগে, যেমন এক অবচেতনের জগতে ভাসমান থাকে, তেমনই ভাসমান আছে এখন পৃথু।
আচমকা চোখ পড়ল ডানদিকের দেওয়ালের বড় আয়নাতে। আয়নার উল্টোদিকে পাশের ঘরে যাবার দরজা। সেই দরজায় দাঁড়ানো বিজ্লীর ছায়া পড়েছে আয়নায়। বিজ্লী!
বিজ্লীকে ও এমন সাজে দেখেনি আগে। নকল হিরে-পরা সুর্মটানা, জর্জেট, বা চুমকি-বসানো বাঁধনী শাড়ি অথবা সালোয়ার কামিজ অথবা ঘাঘরা-মোড়া বিজ্লী নয় এ। সবে চান করেছে। পিঠময় ভিজে চুল ছড়ানো। কোনও হাকিমি তেল মেখেছে মাথায়। আমলার তেলও হতে পারে। আমলকি-আমলকি গন্ধ বেরোচ্ছে। ছড়িয়ে গেছে গন্ধ; সারা ঘরে। ইত্বর এবং হাকিমি তেলের গন্ধ বড় তীব্র। মুসলমানরা তীব্র গন্ধ ভালবাসে। তীব্র ভাবে বাঁচতে জানে তারা। জীবনে এবং জীবনযাত্রায় হিন্দুদের সঙ্গে অনেকই তফাৎ মুসলমানদের। ওরা জীবনকে এবং হয়তো মরণকেও বড়ই ভালবাসে। পৃথু বোধহয় গতজন্মে মুসলমান ছিল। অথবা, পরের জন্মে মুসলমান হয়ে জন্মাবে। নইলে, তাদের অনেককিছুই তার এত ভাল লাগে কেন?
সাধারণ তাঁতের শাড়ি পরেছে বিজ্লী একটি। সাদা-কালো, চেক-চেক; ছোট-ছোট। মাহেশ্বরী মিলের শাড়ি। কালো টিপ পরেছে কপালে। সুর্মা অবশ্য লাগিয়েছে। মামুলি। ছোট হাতার কালো ব্লাউজ একটি। তার অনাবৃত পেটটির একফালি দেখা যাচ্ছে। হলুদ-বসন্ত পাখির মতো রঙ তার পেটের। মসৃণ রেশমি-কোমল, উজ্জ্বল হলুদ। দরজার চৌকাঠে ডান পা-টি রেখে বাঁ হাতটি দরজার পাল্লায় উঁচু করে ছুঁইয়ে উঁকি মেরে দেখছে, পৃথুর ঘুম ভাঙল কি না!
পৃথু মুখ ঘোরাল।
চায়ে লাঁউ! ঔর কুছ নাস্তা? মু-আঁ ধো নেহী লিজীয়েগা?
নেহী!
আঁ-মু নেহী ধোকেই নাস্তা? সাচমুচ অজীব আদমী হেঁ আপ!
সুবহি অ্যায়সেহি কহতে হ্যায়। ম্যায় অজীবই হুঁ। সাচমুচ। বিজ্লী প্রশ্রয়-ভরা তিরস্কারে দুটি উজ্জ্বল চোখ ভরে অনিমেষে তাকিয়েছিল পৃথুর দিকে।
পৃথু ভাবছিল। ও তো মানুষ নয়; জানোয়ার। জানোয়ারেরা কী দাঁত মাজে, মুখ-চোখ ধুয়ে খাবার খায়? দাড়িওয়ালা জোয়ান বাঘ কি কস্মিনকালেও দাড়ি কামায়? ওসব অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতা শুধুমাত্র মানুষেরই।
একটু পরই নীলরঙা এনামেলের বড় রেকাবিতে বসিয়ে সিঁদুর-রঙা এনামেলের কাপে ধুঁয়ো-ওঠা গরম চা আর আধখানা বাখরখানি রোটির সঙ্গে কলিজা-ভাজা নিয়ে এল বিজ্লী। খাটেরই একপাশে রেখে বলল, হালিম আমার, দারুণ বাওর্চি। খেয়ে দেখুন! উঠুন এবারে। উঠে বসে, খাটের বাজুতে বালিশ রেখে আরাম করে খান।
এক ঝটকাতে উঠেই গা থেকে লেপ সরিয়ে দিল পৃথু। কোনও কিছুই ধীরে-সুস্থে করা মানুষটির চরিত্রানুগ নয়। লেপটা সরিয়ে দিতেই শীত করল।
বিজ্লী সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে নিল। লেপটাকে, পৃথু আবার টেনে নিল গায়ে। সারা ঘর বিজ্লীর পিঠময় ছড়ানো চুলের হামর্দদ দাওয়াখানার আমলা তেলের গন্ধে ম’ ম’ করছিল।
আস্তে আবার পৃথুর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বিজ্লী বলল, খান। ঠাণ্ডা হয়ে গেল যে কলিজা-ভাজা। ভোপাল থেকে আনিয়েছিলাম বাখরখানি রোটি। খেয়ে দেখুন।
পৃথু কিছু বলার আগেই জানলা দিয়ে বাইরে চেয়ে আপনমনে বলল, আমার মনের সব শীত পালিয়েছে কাল রাতে। আর দেখুন! কী জাঁকিয়ে শীত এল আজ সকালে, হাটচান্দ্রাতে।
চায়ে চুমুক দিল পৃথু। আঃ! “দিল খুশ হয়ে গেল। টুসুর ভাষায়। টুসু! তার ছেলে! আওলাদ। কী করছে এখন ও কে জানে? কেন যে ওর কথা হঠাৎ মনে হল। কী করছে টুসু এখন?
চা-টা ভাল?
বিজ্লী বলল।
দারুণ!
তুমি খিচুড়ি রাঁধতে পারো? বিজ্লী?
বিজ্লী হেসে উঠল।
সেই হাসির শব্দে পৃথুর মনে হল, কোনও রাঙা-জবা গাছের ডালে বসে একজোড়া র্যাকেট-টেইলড ড্রঙ্গো প্রেম করতে করতে যেন প্রেমেরই ভার সইতে না পেরে গাছ থেকে হঠাৎ নীচে পড়ে গেল প্রেমোল্লাসে।
খিচড়ি, কওন না আওরৎ বনানে শকতি? দুনিয়াকি হর- আওরৎহি জানতি হোগী।
নিরুচ্চারে পৃথু বলল, তুমি কজন আওরৎকে জান?
কী কী খিচুড়ি রাঁধতে জানো তুমি?
সব খিচুড়ি।
না না। ভুনি খিচুড়ি রাঁধতে জানো? মুগের ডাল, কড়া করে ভেজে, মধ্যে ফুল-কপি বলে ফেলেই মনে মনে বলল, সরী! নো ফুলকপি। কপি অফ নো টাইপ। কড়াইশুঁটি, চিনেবাদাম, কিসমিস…বেশি করে গাওয়া ঘি, সঙ্গে শুকনো লঙ্কা ভাজা। কড়কড়ে করে।
বাঃ বাঃ। আপনি দেখছি বাওর্চির কাজও জানেন।
বলেই, বিজ্লী হাসতে লাগল।
পৃথুও হাসল। বলল, হাঁ সবহি কাম। বে-কামকা আদমীনে ভি আপনা কাম ছোড়কে সবহি কাম জানতে হেঁ থোরা-বহত।
বিজ্লী হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলল, আজ সারা দিন থাকবেন তো আমার কাছে?
নিরুচ্চারে বলল, সারাজীবন? থাকবেন?
মুখে বলল, কী ভাল যে লাগছে আমার! বলেই, বিজ্লী কাছে চলে এল। কাছে আসতেই ওর চুলের গন্ধে কী যে হয়ে গেল পৃথুর! মাথার মধ্যে হঠাৎ কী সব জ্বলে গেল। অচানক।
চা-টা সবে খাওয়া শেষ হয়েছিল। এক ঝটকায় হাত বাড়িয়ে ও টেনে আনল বিজ্লীকে ওর বুকের মধ্যে। আচমকা। একটু দেখা, একটু ছোঁয়া, কত কীই যে ঘটে যায়! মানুষ পুরুষের মতো ভঙ্গুর করে খুদাহ আর কোনও পুরুষ জীবকেই গড়েননি বোধহয়!
হঠাৎ-আকর্ষিত বিজ্লীর পায়ের ঠেলায় নাস্তা-ভরা রেকাবিটা পড়ে গেল মেঝেতে। আওয়াজ করে।
লেপের নিচ থেকে বিজ্লীর লজ্জামাখা অস্ফুট স্বর ভেসে এল একটু পর।
জংলি! আপনি হতে পারেন রহিস, কিন্তু আপনি জংলি! অজীব; জংলি!
জঙ্গল কি খারাপ?
ফিসফিস করে বলল পৃথু।
কিছু কিছু সময়, মুহূর্ত আসে সকলেরই জীবনে যখন কথা বলতে একেবারেই ইচ্ছে করে না। শরীর যখন অন্য শরীরের সঙ্গে উন্মাদনার সঙ্গে কথা বলে তখন মুখের ছুটি। হরজাই আলোয় রঙিন ঘরে, রজাই-এর তলার সুগন্ধি নিভৃতিতে একজন স্বল্প পরিচিত নারীর অঙ্গে অঙ্গে অঙ্গাঙ্গী হয়ে গিয়ে পরিচিতির শেষ ধাপে পৌঁছে গেল ও। এক নিমেষে। সারাজীবনের অনেক তেল-কই আর দই-মাছের পরিচয়কে পিছনে ফেলে এই পরিচয় মুহূর্তের মধ্যে পৃথুর অনেকই কাছাকাছি এনে দিল এ বিজাতীয় নারীকে। হয়তো, এই নারীর কাছে পৃথুকেও।
যুবতী বিজ্লী, পৃথুর বুকের ঘন কালো রোমে মুখ ডুবিয়ে যৌবনের গন্ধ নিচ্ছিল। চিকন হরিণী যেমন বর্ষাদিনের মেঘলা সকালে নদীপারের চাপ চাপ সবুজ কোমল কচি ঘাসে মুখ ডুবিয়ে গন্ধ নেয়; যেমন চিতল মাছও, বর্ষার চলকে-চলা নতুন জলে ঘাই মেরে মেরে।
মহল্লার একজন বাইজি রেওয়াজ করছিল। ভৈরবীতে, দূরের ঘরে বসে, শীতের শান্ত সকালের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সুর ভরে দিয়ে, যেন সুরের আলপনা দিচ্ছিল সে।
রাগ রাগিণীর তাৎপর্য সবসময় বোঝে না পৃথু। কানে যাইই যায় তাইই যে সবসময় মনে পৌঁছয়ই এমনও নয়। কিন্তু আজ সকালের দূরের অচেনা গায়িকার গলার সুরে ভরে যাচ্ছে ওর সমস্ত মস্তিষ্ক। সুরারই মতো সুরের তরলিমা চুঁইয়ে যাচ্ছে, ভিতরে আস্তে আস্তে। বিজ্লীর কোমরে হাত থেকে শুয়ে-থাকা পৃথুর মনে হল যে, দিন-মাড়িয়ে যায় ও রোজই সকাল থেকে রাত, কিন্তু বাঁচে না। বছরের পর বছর-মাড়ানো আর বেঁচে থাকায় অনেকই তফাৎ। ওর এই সামান্য শরীরটার মধ্যেও যে এতসব অসামান্য আনন্দের উৎস লুকোনো ছিল তা বিজ্লীর সান্নিধ্যে না গেলে বোধহয় জানতেও পেত না। জীবনের কতগুলো বছর কত অমুল্য বছর সবই নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আর ফেরানো যাবে না তাদের। এক পক্ষর দয়ায় নয়, অন্য পক্ষর ঘৃণায় নয়, দু পক্ষরই উদভ্রান্ত উদাসীনতাতেও নয়, দু পক্ষেরই তীব্র আসক্তি আর আবেশে ভর করে আসঙ্গর আনন্দঘন আশ্লেষে একে অন্যকে সম্পূর্ণ করে না পেলে যুগল শরীরের মন্দিরে ঘণ্টা বাজানো আর ধূপ জ্বালানোই হয় শুধু; পুজো হয় না। মানব মানবীর এই আশ্চর্য শরীরে, দহন আর প্রলেপ বোধহয় নিঃশর্তভাবেই নিহিত আছে। বিয়ের পর এতবার রুষার সঙ্গে সংসর্গ করেছে পৃথু কিন্তু বোধহয় কখনওই সম্পৃক্ত হয়নি। সমস্ত বিবাহিত নারী ও পুরুষও কী রুষা আর পৃথুরই মতো? সহবাসকেও তারা এক স্থূল দৈনন্দিন অভ্যেসে পর্যবসিত করেছে।
রুষার পেশা অধ্যাপনা। পৃথুর প্রযুক্তি। আর বিজ্লীর? শরীর আর গলা? আশ্চর্য! কতকিছুই শেখার আছে প্রত্যেকটি মানুষের কাছে।
গলির ঠিক বিপরীত দিকের বাড়ি থেকে একজন মধ্যবয়সী বাঈজি এবার ভাঙা-ভাঙা, যৌনতামাখা বাঈজিসুলভ গলায় হারমনিয়ম বাজিয়ে একটি ঠুংরী ধরল। রেওয়াজে তো রাগ-রাগিণীর সময়কাল মানা হয় না! তবলাতে যে ঠেকা দিচ্ছে তার হাতটি বড় মিষ্টি। অনেকটা কেরামতুল্লা খাঁ সাহেবের মতো। তবলা, সেই হাতের আদরে শৃঙ্গারমোহিত নারীর মতোই শিউরে শিউরে উঠছে যেন! আনন্দে। অস্ফুট সব গভীর সুখের শব্দ উঠছে।
বাঈজী গাইছে :
“কঙ্কর মেয়ে লাগ যাঁইহে না রে
কঙ্কর লাগলে কি, কচ্ছ ডর নাহি
গগ্গর মোরা ফুট যাঁইহে না রে
গগ্গর ফুটলে কী কচ্ছ ডর নাহি
চুন্দর মোরা ভিজ যাঁইহে না রে
চুন্দর ভিজলে কী কচ্ছ ডর নাহি
বালম মোরা হত যাঁইরো নারে…
কঙ্কর মোঁয়ে লাগি যাইহেঁ না রে…
খুবই চেনা চেনা লাগছিল ঠুংরীটি। খুবই চেনা, কিন্তু মনে করতে পারছে না কিছুতেই…। এখন অবশ্য কিছু মনে করতে ইচ্ছে করছে না। পায়রা ডাকছে বকম বকম। কার বাড়ির কাকাতুয়া বলছে আও সাহাব, গানেসে নাফরৎ নেহী না হ্যায়? বার বারই বলছে শেখানো বুলি। মনে পড়ে গেছে পৃথুর। রসুলনবাঈ-এর ঠুংরী ওটি। কঙ্কর মোঁয়ে লাগি যাঁইহে না রে…। কথা আর সুরের বৈচিত্র্যর জন্যে মনে গেঁথে ছিল। কোথায় এবং ঠিক কবে শুনেছিল গানটি তা এখনই মনে করতে পারছে না।
ম্যায় যাঁউ?
ফিসফিস করে বলল বিজ্লী।
নহী। গানা শুনাও।
ধেৎ। আভভী? না তানপুরা, না সারেঙ্গী, না তাবালিয়া…
কওনসী গান হোগী নাঙ্গা গল্লেমে?
এই তো সঠিক সময়! এখনই তো নাঙ্গা গলায় গাইবার সময়।
নাঙ্গা গল্লেমেই শুনাও।
গুন গুন করে, পৃথুর কানের কাছে মুখ নিয়ে গাইল, বিজ্লী, নাঙ্গা গলায়, পৃথুর জন্যে। আলসের পায়রারাও শুনতে পেল না সেই গান।
“রসকে ভরে তোরে নয়না, এরি সাঁবারিয়া।
আয়েযা সাঁবারিয়া…তোঁহে দরোমাঁ লাগালুঁ-রসকে ভরে তোরে নয়না…
মোরা জিয়া তড়পে তড়পে মোরা সাঁবারিয়া…”
যতদিন হল বিজ্লীর সঙ্গে পৃথুর আলাপ হয়েছে, বিজ্লী, চোখের ভাষায়, মুখে বলে এবং না-বলেও অনেকবারই বোঝাবার চেষ্টা করেছে পৃথুকে যে, সে ভালবাসে তাকে। বাঈজির কথা, বাঈজির চোখের চমক অনেক কিছুই ব্যক্ত করে। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলেও বিশ্বাস করেনি। পসারিণীর প্রেম তো বিশ্বাসের নয়। কিন্তু এই সকালের নিরাভরণ নিরাবরণ বিজ্লী এই গানটির মধ্যে দিয়ে নিজেকে এমনভাবে নিংড়ে দিল পৃথুর কাছে যে, বিদ্যুৎচমকের মতোই ও বুঝল এ মিথ্যা নয়; ভান নয় এ। এই ভালবাসা! বিজ্লী সত্যিই ভালবাসাটা মিথ্যা হলে গানটা এমন সত্যি হতে পারত না। বিজ্লী এই গানের মধ্যে দ্রবতমা হয়ে পৃথুকেও দ্রব করে দিল। হৃদয় চিপে দিল পৃথুর কানে কানে।
ঠিক আছে। ঠিক আছে গো মেয়ে। “দ্রব জীবন ঝরিয়ে ঝর ঝর নির্ঝর তব পায়ে।” পুজোর গান। প্রেমও তো পুজোই। পূজারী যারা; তারাই জানে।
কী জানি কেন, মন খারাপ হলে, মনের মন কী করবে তা না জানলে, মনে ঝড় উঠলে অথবা মন গভীরতায় প্রশান্ত হলেও সেই সাদা চুল সাদা-দাড়ি আলখাল্লা-পরা ঋষিতুল্য মানুষটির কথা মনে পড়ে যায় পৃথুর। আর কেবলই তাঁর গানই মনে পড়ে।
গান শেষ করে বিজ্লী বলল, চালিয়ে, উঠিয়ে, হাত মু ধো লিজিয়ে, বহুত দের তক শোয়া আপনে। ম্যায় আভভি আয়ি, নাস্তা গরম। ঔর চায়ে লেকর।
মেঝে থেকে রেকাবি ও ছড়িয়ে-পড়া খাবারগুলো তুলে নিয়ে চলে গেল বিজ্লী।
পৃথু উঠে পড়ে জামা কাপড় পড়ল। বাথরুমে যাবে একবার। খোলা জানালার কাছে এসে দাঁড়াল ও। মিষ্টি, উষ্ণ রোদ এসে পড়েছে সবুজ আর লাল কাজকরা টাইলের মেঝেতে। নীচের পথ দিয়ে এই মহল্লার জীবন বয়ে চলেছে। পথে এলে, বা পথের দিকে চাইলেই ওর রক্তে উন্মাদনা জাগে। চলমানের সঙ্গে সঙ্গে নিজেরও চলতে ইচ্ছে করে। কোথায় যাবে এবং আদৌ কোথাওই যাবে কি না; সেটা জানার ইচ্ছা পর্যন্ত থাকে না। শুধুই চলার মধ্যেও বোধহয় একধরনের আনন্দ আছে। যারা থেমে থাকে, স্থবিরতার শিকার হয়েছে যারা জীবনে, তারা হয়তো জানে না সে কথা।
কাল সন্ধেবেলাতে এখানে এসেছিল। কেন যে কুর্চি একবার দেখা দিল না, কেন যে, রুষা…। এইই বোধহয় হওয়ার ছিল। ভবিতব্য একেই বলে। মিলি ও টুসুর কথা খুবই মনে পড়ছে পৃথুর।
পৃথু কী নষ্ট হয়ে গেল?
বিজ্লী এসে ঘরের এক কোণায় তেপায়ার উপর খাবারের রেকাবি রাখল।
বাথরুমে যাননি এখনও?
যাচ্ছি।
শিগগিরি যান। চা দিয়ে আসছি।
বাথরুম থেকে ফিরে এসে খাটের উপরই বসল পৃথু রেকাবি হাতে। বিজ্লী, নীল আর সাদা ফুল ফুল কাজ করা পোর্সিলীনের একটা গ্লাসে, খুঁয়ো-ওঠা গরম চা নিয়ে ঘরে ঢুকল।
বলল, খান। আমি দেখি।
তুমি? খাবে না? কী খাবে?
খাব। সময় হয়নি।
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে ও বলল। আজ রাতে তুমি নিশ্চয়ই অন্য লোকের আদর খাবে?
জানি না। খুব বিষণ্ণ দেখাল বিজ্লীকে। খারাপ মেয়ে আমি। তবু আমি তো গানই শোনাই বেশি। বাজাই না। খুবই কম। ক্বচিৎ-কদাচিৎ।
তবু। যদি…।
কী করব? আমার এইই তো পেশা। ছেলেবেলা থেকেই গান আর শরীর। এছাড়া আমার যে কিছুই নেই। রোজগার করে খাওয়াবে কেউ, সুখে রাখবে তুলোর মধ্যে করে, এমন কপাল তো করে আসিনি। আমার তো আর স্বামী নেই!
স্বামী চাওনি, তুমি, তাইই নেই।
স্বামী নাইই বা থাকল। স্বাধীনতা তো আছে। সেটা কি কম?
খাওয়া থামিয়ে বিজ্লীর মুখের দিকে তাকাল পৃথু।
বলল, স্বামী চাও?
অন্য কথা বলুন।
আমাকে কি চাও? স্বামী হিসেবে?
আপনি একটি পাগল।
কেন?
এমনিই বললাম। পাগলকে আর কী বলব?
আমি এবার যাব বিজ্লী।
জানি। থাকতে যে আসেননি তা জানি।
তুমি আর কিছু বলবে না? তোমার টাকা আমি নিয়ে আসব পরে। ঠিক আসব দেখো।
আপনি…আপনাকে…খুব খারাপ আপনি, বাজে…।
জানি। অদ্ভুত বাজে লোক আমি একটা। ঠিক আছে?
আঃ! আবার কবে আসবেন?
দেখি।
যেদিন আসতে খুব ইচ্ছে করবে, সে দিনই আসবেন। আমি বলেছি বলেই আসতে হবে না। খুব দুঃখটুঃখ হলে আসবেন। খারাপ মেয়েদের কাছে ভদ্রলোক বড় মানুষরা তো শুধু তখনই আসেন।
কেন? খুশি হলে কি আসতে মানা করছ?
ঠিক তা নয়। খুশি বইবার মানুষ তো নিশ্চয়ই অনেকই আছে আপনার। আমি না হয় দুঃখই বইব। খুশি হয়েই। আসবেন।
একটু চুপ করে থেকে মুখ নিচু করে বলল, তবু তো আসবেন।
পৃথুর গলার কাছে কী যেন একটা দলা পাকিয়ে উঠল। সেই জিনিসটা বাখরখানি রোটি অথবা কলিজা-ভাজা নয়। অন্য কিছু। তার স্বাদ বড় তেতো।
পৃথু বলল, চলি বিজ্লী।
বিজ্লী জানলার পাশ থেকে তাড়াতাড়ি সরে এসে পৃথুর কাছে দাঁড়াল।
মেয়েটার গলার স্বরই শুধু নয়, সমস্ত ব্যক্তিত্বই যেন কাঁচ দিয়ে তৈরি। অথচ, সে ভাঙে শুধু নিজের ইচ্ছেতেই। ঝকঝকে দুটি চোখে বুদ্ধি ঠিকরোচ্ছে, হিরের গায়ের দ্যুতির মতো। এই সহজাত বুদ্ধি কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ই কাউকে কোনওদিন দিতে পারে না। কেউ কেউ তা নিয়েই জন্মায়। শরীর ছাড়াও, একজন পুরুষকে দেওয়ার মতো অনেক কিছুই আছে ওর। শুধু নিতে জানা চাই।
পৃথু মাথা ঝুঁকিয়ে ওর কপালে একটা চুমু খেল। বিজ্লী, পৃথুর বুকে ওর মুখ রেখে পৃথুকে জোরে জড়িয়ে ধরল একবার। মনে হল, কোনওদিনও ছাড়বে না আর।
একটুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল পৃথু। তারপর আলতো করে জড়ানো লতানো হাতদুটি দু হাত দিয়ে খুলে দিল।
আবার বলল, চলি বিজ্লী। ওর চোখে চেয়ে দেখল, চোখদুটি জলে ভরে গেছে।
পৃথুর গলার কাছে সেই অজানা জিনিসটা আবারও দলা পাকিয়ে উঠল। চলে যেতে গিয়েও, দাঁড়িয়ে পড়ল ও। বলল, শোনো : একটা কথা শোনো। আমার সামনে তুমি কখনও কাঁদবে না। আমি যাদের ভালবাসি, তারা আমার সামনে কাঁদুক তা আমি পছন্দ করি না। আমার খুব কষ্ট হয়।
বলেই, ও নেমে গেল সরু, দিনের বেলাতেও প্রায়-অন্ধকার, সিঁড়ি দিয়ে। পথে নামতেই কোথা থেকে সেই কাকাতুয়াটা বলে উঠল “আও সাহাব। গানেসে নফরৎ নেহী না হ্যায়?” নেড়ি কুকুরের একটি কাদা-মাখা বাচ্চা কঁকিয়ে কেঁদে উঠল, কাঁচা নর্দমা থেকে কেৎরে কেৎরে উঠে।
গলি থেকে বাইরে বেরিয়েই পৃথু অবাক হয়ে দেখল, শ্রীকৃষ্ণ বসে আছে, গিরিশদার গাড়িতে।
এ কী!
লজ্জা পেয়ে বলল, পৃথু।
তুমি কী সেই কাল থেকে এখানেই রয়েছ নাকি?
না। কাল রাত এগারোটায় বাড়ি গিয়ে বাবুকে রিপোর্ট দিয়ে আবার আজ সকাল ছ’টাতে এসেছি।
রিপোর্ট দিয়ে? কিসের রিপোর্ট?
আপনার রিপোর্ট। আপনাকে আমার বাবু আমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে বলেছেন।
পেছনের দরজা খুলে শ্রীকৃষ্ণ দাঁড়িয়ে ছিল। গাড়িতে উঠেই পৃথু বলল, কারখানা।
ঘর নেহী যাইয়েগা সাহাব? আপনা ঘর ভি নেহী?
আমার কোনও ঘর নেই। ভাবল, শ্রীকৃষ্ণকে বলে। তারপর ভাবল, কী লাভ! বাড়িতে বাড়ি নেই।
“বাড়ি ফিরে দেখি বাড়িতে বাড়ি নেই।
একটা বড় দরজা
কয়েকটা বখাটে জানালা।
নড়ে চড়ে জিগগেস করল।
কাকে চাই?
ভেবে দেখতে হবে কাকে চাই।
বাড়ি ফাঁকা, বাড়িতে বাড়ি নেই।
কাঠের চেয়ারে ভাড়াটের মত
অনাহত অতিথির মত
বুঝে ফেলি।
চোখে দ্বিধা, পায়ে ভর কম।
একা।
আমার বাড়িতে বাড়ি নেই।
বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের কবিতা
শ্রীকৃষ্ণ কী বুঝবে?
পৃথু দৃঢ় গলায় বলল, কারখানায় চলো শ্রীকৃষ্ণ। এক কথা আমি দুবার বলা পছন্দ করি না।
জী সাব।
বলল, শ্রীকৃষ্ণ। তারপর বিলাইতি টোলির মোড় থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে সবজি মণ্ডির ভিড় এড়িয়ে এগোল কারখানার দিকে।
ঠাণ্ডা জলে চান করে, নাস্তা করে বেশ ভাল লাগছিল পৃথর। কাল রাতের শরীরের কাঁকড়াগুলো সব শীতের চন্দ্রমল্লিকার মতো নানা নরম-রঙা সত্তায় ফুটে উঠেছে। এখন মন আলো করে। হালকা, ঝরঝরে লাগছে শরীর। দিগা পাঁড়ের মানস মুক্তাবলী ঠিকই বলে। নারী ছাড়া পুরুষের চলে না। গতি নেই কোনও।
কারখানার মধ্যে ঢুকে অফিস বিল্ডিং-এর সামনে ও নেমে গেল গাড়ি থেকে। শ্রীকৃষ্ণকে বলল, গিরিশদাকে বোলো যে, আমি যাব দেখা করতে ওঁর সঙ্গে। আজ না পারলে, কাল যাব।
জী সাব।
তোমার সঙ্গেও করব দেখা; পরে।
জী সাব।
হাসল শ্রীকৃষ্ণ।
গিরিশদার গাড়িটা চলে যেতেই অজাইব সিংহে আসতে দেখা গেল পৃথুর গাড়ি নিয়ে। অজাইব সিং গাড়ি থেকে নেমেই সেলাম করল। বলল, মেমসাব খাত ভেজিন।
ভুরু কুচকে খামটা নিয়ে ছিঁড়ল। চিঠিটা বের করল। রুষ লিখেছে, ইংরিজিতে। আই জাস্ট ক্যুডনট কেয়ার লেস। তুমি জাহান্নামে যেতে পারো। তবে, আজ অফিসের পর বাড়িতে এসো। টুসুর বেশ জ্বর হয়েছে। তোমার কথা বলছে। মিলি ও টুসুকে বলেছি যে, তুমি অফিসের কাজে হঠাৎ বাইরে গেছ। দু একদিনের মধ্যেই ফিরে আসবে। কালকের ব্যবহারের জন্যে আমি দুঃখিত। চিরদিনই মনে মনে তোমাকে যা বলতে চেয়েছি, বলব বলে ঠিক করে রেখেছি, মুখে বলেছি ঠিক তারই উল্টো কথা। কী করব! আমি এরকমই। আমি তোমাকে ভালবাসি, কিন্তু আমারই মতো করে। প্রত্যেকের ভালবাসারই রকম আলাদা। তুমি বোঝনি কখনও এ কথাটা।
রাতে কোথায় ছিলে?
লছমার সিংকে দিয়ে চীজ-বেক করিয়ে রাতে অজাইব সিংকে পাঠিয়ে ছিলাম কুর্চির বাড়ি। ওই ছুতো করে, তোমার খোঁজ করতে। সেখানেও যে তুমি যাওনি সে খবরও পেয়েছি। দাঈ নাকি কুর্চিকে বলেছে যে, দুপুরে জীপে করে ঠিক তোমারই মতো দেখতে কোনও একজন লোক ওদের বাড়ি গেছিল। কিন্তু নামেনি।
কিছুই বুঝলাম না। তোমার হেঁয়ালী তুমিই জানো।
রাতে তাহলে ছিলে কোথায় আপাতত এটুকুই জানিয়ো।
ট্রুলী ইয়োর্স, রুষা।
এই “ট্রুলী ইয়োর্স” কথাটা তামাদি হয়ে গেছে। পৃথিবীতে ট্ৰুলী পৃথুজ একজন মানুষও নেই। শুধু পৃথুরই কেন? কারওই নেই।
রুষার চিঠিরই উল্টোদিকে, ওর শেষ প্রশ্ন “রাতে কোথায় ছিলে?”-র উত্তরে লিখে দিল পৃথু, এক কথায়। “জাহান্নামেই!”
অজাইব সিং চিঠি নিয়ে সেলাম করে চলে গেল।
ইমম্যাটেরীয়াল ম্যানেজার শর্মা বলল, আজ দাড়ি নেহী বানায় তুমনে ঘোষ?
সত্যিই তো! খেয়াল হয়নি আগে।
পৃথু বলল, অশৌচ চলছে আমার।
অশৌচ?
হ্যাঁ। আমার জ্যাঠশ্বশুর মারা গেছেন।
কোথায় থাকতেন?
বিলাসপুর। জ্যাঠশ্বশুর এবং বিলাসপুর দুটোই বানিয়ে বলল, পৃথু।
ভেরী স্যাড। শুনকর, মনমে বহুৎই দুখ পৌঁছা!
রাজনৈতিক নেতাদের মতো থিয়েটার করে বলল শর্মা।
থ্যাঙ্ক উ্য।
পৃথু বলল।
টুসুর জ্বর! মিলি? মিলিটা কেমন আছে? কতদিন যে মেয়েটার সঙ্গে গল্প করেনি! চেহারাই দেখেনি কতদিন হয়ে গেল। খাওয়ার সময় দেখা হত আগে। ইদানীং তাও হয় না। সময়মত তো খায় না! হবে কী করে? অনেক পাপ। পাপ জমে যাচ্ছে অনেক। পরতের পর পরত। খারাপ, খুবই খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
তাড়াতাড়ি অফিসের ফাইলপত্র দেখে কারখানার ভিতরে যাবে ও। তারপর আজ বিকেল তিনটে-চারটে নাগাদ বেরিয়ে পড়বে। এখন কাজের চাপও কম। জানুয়ারী থেকে আরও কমবে।
অফিসের ফাইলে ডুবে গেল ও। যখন যা করে ও তখন তাইই করে। কাল রাতে ও ছিল বিজ্লীর পৃথু। আজ সকালে অফিসের পৃথু। বিকেলের কথা বিকেলই জানে।
ঠুঠা বাইগা একবার এল ইতি-উতি চেয়ে, সাবধানে ঘরে কেউ নেই, তা দেখে নিয়ে নিচু গলায় বলল, কাজটা তোমার ঠিক হচ্ছে না। এমন করে কেউ মদ খায়? মদকে তুমি খাবে। মদ তোমাকে খাবে কেন? ছিঃ! ছিঃ!
ব্যস্ত আছি ঠুঠা। নিজের চরকায় তেল দাও গিয়ে। আমি শিশু নই।
শক্ত গলায় বলল, পৃথু।
আমার কাছে শিশুই। আমার কোলে কাঁধে-চড়েই মানুষ হয়েছ। ভুলে যেয়ো না। যাতে তোমার ভাল হয়, তাইই করতে বলেছি। বলব, চিরদিন। তাতে তুমি রাগই করো, আর যাইই করো তোমার ওসব চোখ-রাঙানি অন্যদের জন্যে রেখো।’
পৃথু জবাব দিল না।
বলল, সত্যিই ব্যস্ত আছি ঠুঠা। পরে এ নিয়ে কথা বলব।
ঠুঠার উপর বাগ হচ্ছিল খুবই। কিন্তু আজ সকালের অনেক দাম দিয়ে কেনা খুশিটাকে নষ্ট করতে রাজি ছিল না ও একেবারেই।
গলা নামিয়ে বলল, পরে। পরে কথা হবে। যাও এখন।
জানালা দিয়ে কারখানার ভেতরের গেটটা দেখা যাছিল। একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। এখন ফুল নেই। তবে পাতা আছে অজস্র। কামিনরা যাচ্ছে আসছে। কোণার দিকে ফ্যাকটরির এক্সটেনশনের কাজ হচ্ছে। হঠাৎই পৃথুর চোখের দৃষ্টি তীক্ষ হয়ে উঠল। কামিনরা যাচ্ছে, আসছে। আঁটসাঁট তাঁদের শরীর। মাথায় করে ইঁট বইছে, চুন, বালি, পাথরকুচি। ওই শীতেও তাদের সস্তা ছিটের লাল হলুদ সবুজ ব্লাউজের নীচের বাহুমূল ঘামে ভিজে উঠেছে। আশ্চর্য! কী দারুণ। এই সব জীবন্ত ঘামঝড়ানো, আঁটসাঁট সব নারীশরীরগুলি। অসভ্যর মতো চোখে তাকাচ্ছে পৃথু তাদের দিকে। বিজ্লী তাকে আশ মিটিয়ে খাইয়ে হঠাৎই খিদে বাড়িয়ে দিয়েছে। তার মধ্যের অলক্ষ্যে-ঘুমোনো কোনও কামুক কুম্ভকর্ণর ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে। খুবই বিপদ এখন পৃথুর। পৃথু সত্যিই নষ্ট হয়ে যাবে। রুচি? যে রুচি নিয়ে তার এত গর্ব ছিল? কোথায় গেল তা? ছিঃ ছিঃ। পৃথু ঘোষ। ছিঃ ছিঃ।
কী করে জানল রুষা তা কে জানে, অজাইব সিং আবারও এসে হাজির হল গাড়ি নিয়ে তিনটের সময়। যাওয়ার সময় দুপুরের খাবার আনবে কি না জিজ্ঞেস করে গেছিল। পৃথু বলেছিল, ক্যানটিনে যা হয় খেয়ে নেবে।
বাড়ি যখন ফিরল : দেখল, রুষা পোর্টিকোতে দাঁড়িয়ে আছে। এ দৃশ্য একেবারে নতুন বলে মনে হল। কবে যে শেষ তার জন্যে অপেক্ষা করতে দেখেছে ওকে তা আজ মনে পড়ে না পৃথুর।
অজাইব সিং ব্যাপারটাকে দেখেও যেন দেখেনি এমন ভাব করে রইল। নেমে, দরজা খুলে দিল পৃথুর জন্যে।
টুসু কোথায়?
পৃথু বলল।
ঘরে।
রুষা জবাব দিল। পৃথুর সঙ্গে ভিতরে যেতে যেতে।
চা খাবে তো! সঙ্গে খাবে না কিছু? দুপুরে কী খেলে?
অবাক লাগছে পৃথুর। দুপুরে কী খেয়েছে এবং আদৌ কিছু খেয়েছে কি না তা নিয়ে রুষার কোনওদিনও মাথাব্যথা ছিল না।
অবাক লাগলেও একরকমের ভাললাগাও লাগছিল ওর। আদর্শ!
তুমি টুসুর কাছে যাও। আমি মেরীকে বলে তোমার খাওয়ার ঠিক করছি। ফ্রেঞ্চ-টোস্ট খাবে?
কিছু খাব না আমি। এক কাপ চা খাব শুধু।
ওঃ।
টুসু খাটে বসে মবি-ডিক পড়ছিল।
কেমন আছিস রে বেটা? কত জ্বর?
বেশি না। তুমি কোথায় গেছিলে বাবা? জবলপুরে? আমার জন্যে একটা ক্রিকেটের ব্যাট আনতে বলেছিলাম না? আজ থেকে তো স্কুল বন্ধ। তিনদিনের জন্যে।
কেন?
মাদারস ডে। টিচারস ডে। তারপর পরীক্ষার পর তো শীতের ছুটি আরম্ভ।
মিলি ঘরে এল। গোলাপীর উপর সাদা ফুলফুল প্রিন্টের একটি ফ্রক পরেছে। গোলাপি রঙ সোঁয়েটার ফুল-হাতা। কাঁধের উপর চুল ছড়িয়ে আছে। বব করে দিয়েছে রুষা। হাতে একটি ইংরিজি বই। পড়ছিল।
বলল, হাই বাবা।
হাই!
পৃথু বুঝল যে, রুষারই নির্দেশে মিলি এসেছে পৃথুর কাছে কর্তব্য করতে। শুধু কর্তব্যই।
যাচ্ছি বাবা।
বলে মিলি চলে গেল।
টুসু!
টুসু বই থেকে চোখ না তুলে বলল, কী বলছ?
তুই তাহলে ভালই আছিস?
হ্যাঁ-অ্যা-অ্যা।
কোনও কষ্ট নেই তো?
কিসের কষ্ট? আঃ যাওনা বাবা, দারুণ ইন্টারেস্টিং জায়গায় আছি এখন। ব্লু-হোয়েলটাকে, মানে মবি-ডিককে দেখা গেছে।
আচ্ছা। পড়ো তুমি। বলে, পৃথু ঘর ছেড়ে নিজের ঘরে এল। তারপর বাথরুমে গেল। জামাকাপড় ছেড়ে পায়জামা পাঞ্জাবি পরল।
রুষা ঘরে এল। পৃথু তার চেয়ারে বসে, টেবলের উপর পা তুলে দিয়ে শেয়াল-রঙা আলোয়ান গায়ে দিয়ে নস্যি নিচ্ছিল। অন্যদিন, অন্য সময় হলে অনেক কিছুই বলত রুষা। ঝগড়া করত। আজ চায়ের কাপটা, নিজে হাতে প্লাস্টিকের ট্রানসপারেন্ট ট্রে সুদ্ধ নামিয়ে রাখল টেবিলে। তারপর পৃথুর খাটের এক কোণায় বসল।
পৃথু চায়ের কাপটা তুলে নিল হাতে। চুমুক দিল। ও বুঝতে পারছিল যে, রুষা একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার মুখের দিকে। আজকে ঝগড়া করবে না ও। স্বামী-স্ত্রী যতদিন একে অন্যের সঙ্গে ঝগড়া করে ততদিন পর্যন্ত সম্পর্কটা থাকে। অথচ, আশ্চর্য! তখন ঝগড়াটাকেই সম্পর্কহীনতা বলে ভ্রম হয়। যদিন ঝগড়া করার মতো সম্পর্ক থাকে না, সেদিন সম্পর্ক বলতেও বোধহয় বাকি থাকে না কিছুই। এ কথাটা পৃথু আগে কখনও ভেবে দেখেনি। বোধহয় রুষাও ভাবেনি।
কিছু বলবে?
পৃথু বলল।
নাঃ। কী আর বলব! কাল জাহান্নামে গেছিলে তুমি? সেটা কোথায়?
কাল আমি একজন বাঈজির কাছে গেছিলাম।
খাট থেকে হঠাৎ উঠে পড়ে দরজা ভেজিয়ে দিল রুষা। বলল, আস্তে, আস্তে, মিলি টুসু বাড়ি আছে।
আমি যে খারাপ এটা ওদের কাছে আমি লুকোতে চাই না।
পৃথু বলল, চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে।
খারাপ ভালোর ওরা কী বোঝে? তুমি ওদের বাবা। তোমার পরিচয়েই ওদের পরিচয়। তুমি ওদের রক্ষণাবেক্ষণ করো এইটেই ওদের কাছে সব। ওদের মা তোমাকে সম্মান করে এটা ওরা জানে, তুমি না জানলেও। এর বেশি ওদের না জানাই ভাল।
দুজনেই অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল। জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে। শীতের বেলা পড়ে আসছে। ছায়ারা দ্রুত দীর্ঘতর হচ্ছে। খাণ্ডেলওয়াল সাহেবের কালো কুচকুচে যুবতী আয়া সাদা ধবধবে জোয়ান অ্যালসেশিয়ান কুকুরটাকে নিয়ে প্রকৃতির মধ্যে চলে গেল কনে-দেখা আলো মেখে।
রুষা হঠাৎ বলল, তুমি খুশি হয়েছ?
কিসে?
যার কাছে গেছিলে তার কাছে গিয়ে?
পৃথু তার দুটি চোখ রুষার চোখে রাখল। এমন থিয়েটার কোথায় শিখল রুষা তা কে জানে? কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ করল রুষার চোখে অভিনয় নেই। থতমত খেয়ে গেল পৃথু। জবাবে কী যে বলবে, বলা উচিত; ভেবে পেল না।
রুষা আবার বলল, যদি খুশি হয়ে থাকে, তাহলে যেয়ো মাঝে মাঝে।
পৃথু আবার তাকাল রুষার দিকে।
রুষ মুখ নামিয়ে নিল একবার। তারপর মুখ তুলে স্থির গলায় বলল, শুধু দেখো, যেন কেউ না জানে। ছেলেমেয়েরা না জানে। কুর্চির কাছে না গিয়ে তার কাছেই যেয়ো। কুর্চি তোমাকে দেবে না কিছুই। শুধু সর্বনাশ করবে তোমার। আমার এবং ছেময়েদেরও। তুমি অনেক বোঝো, সব বোঝে না। শরীরের ভালবাসার ভয় নেই; ভয় মনের ভালবাসায়।
অন্য কথা বল।
দুজনে আবারও অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল। তিতির ডাকছে পেছনের ঝাঁটি জঙ্গল থেকে। চামারটোলিতে রাতের প্রস্তুতি হিসেবে কে যেন চাঁটি মারছে মাদলে। মাথার মধ্যে ঘা পড়ছে। ক্লান্তি লাগছে বড়।
ওরা অনেক কিছু জানে, না?
হঠাৎ রুষা বলল।
মানে?
না। পড়েছি, শুনেছি…। এই প্রফেশনালাইজেশানের দিনে সবকিছুই পারফেকশনে পৌঁছেছে তো। অ্যামেচারদের দিন আর নেই। জীবনের কোনও ক্ষেত্রেই! বাঈজি-টাঈজিরা শরীরের ব্যাপারটা আমাদের চেয়ে ভাল বোঝে? না?
হেসে ফেলল পৃথু। অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে রুষাও হেসে ফেলল।
হাসলে, এখনও তোমার গালে টোল পড়ে। পৃথু বলল। অনেকদিন পর তোমার হাসি দেখলাম।
তোমারও।
তুমি, রুষা, কিন্তু সত্যিই শিক্ষিত। অন্য কোনও স্ত্রীই বোধহয় ব্যাপারটাকে এমন ফিলসফিকালী নিতে পারত না!
এটা শিক্ষা-অশিক্ষার ব্যাপার নয়। পারসপেকটিভের ব্যাপার। রিলেটিভ ব্যাপার। তোমাকে বোঝাতে পারব না।
একটু চুপ করে থেকে রুষা হেসে বলল, আসলে আমি ঠিক করেছি, তোমার কাছে কখনও হেরে যাব না। আমি জিতবই, দেখো। দেখি, তুমি কী করে হারাও আমাকে।
বলেই রুষা মুখ নিচু করে ফেলল। সেই প্রায়ান্ধকার শীতার্ত ঘরে পৃথু দেখল যে, জলে ভরে এল রুষার দু চোখ।
ও উঠে গিয়ে রুষাকে তুলল দু হাত ধরে। নিজের কাছে টানল। বলল, পাগলী। কী যে সব ঘটছে ঘটনা, একের পর এক মাথামুণ্ডু নেই কোনও কিছুরই। মাথার ঠিক থাকছে না।
পৃথু রুষার গালে গাল ছুঁইয়ে বলল, আমরা বেশ নতুন বর-বউ! হ্যাঁ। বেশ। আমাদের যেন ভীষণ প্রেম, হ্যাঁ?
ছাই।
বলেই, রুষা কান্না আর হাসির মাঝামাঝি একরকমের অনুভূতিতে ভেসে গিয়ে মাথা রাখল পৃথুর বুকে। এবং ঠিক তখনই একটা জীপের হর্ন কর্কশ আওয়াজ করে বেজে উঠল বাংলোর সামনে। কে যেন পৃথুর নাম ধরে ডাকল, পৃথুদা, পৃথুদা।
রুষা জানালার কাছে গিয়ে বলল, তোমার ভুচু।
তারপর বলল, একদিন আমি এদের সকলকে একসঙ্গে নেমন্তন্ন করে বিষ খাইয়ে মেরে দেব।
ভুচু, মনে হল জীপ থেকে নেমে দৌড়ে আসছে বাইরের দরজার দিকে।
পৃথু স্বগতোক্তির মতো বলল, খারাপ কিছু ঘটেছে। বলেই ড্রয়িংরুমের দিকে এগোল।
অজাইব সিং নিয়ে এল ভুচুকে।
পৃথুর পেছনেই রুষাকে দেখেই ভুচু বলল, নমস্কার বৌদি। পৃথুদার সঙ্গে একটা জরুরি কথা আছে। গোপনেই বলতে চাই।
রুষা অজাইব সিংকে ইশারায় বাইরে যেতে বলল। বলে, নিজেও ভিতরে চলে এল। রুষার বুক দুরদুর করছিল। কাল রাতের ঘটনার সঙ্গে জড়ানো কিছু নয়তো!
কী হল? পৃথু বলল।
গলা নামিয়ে ভুচু বলল, শামীমের বড় মেয়েটাকে, ঘণ্টাখানেক আগে কারা যেন কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে। বাড়ির সামনের টিউবওয়েলে দাঁড়িয়ে ছিল, খাওয়ার জল ভরার জন্যে।
বলো কী? ওদের গলিটাতে তো সবসময় লোক গিসগিস করে। অত লোকের সামনে থেকে?
হ্যাঁ। একটা জীপে করে এসেছিল। চারজন গুণ্ডামত লোক। ভোপালের নাম্বার প্লেট লাগানো।
নাম্বার প্লেট বদলে এসেছিল নিশ্চয়ই।
অপরূপ সুন্দরী মেয়ে। নাম, নুরজাহান। শামীম ভাই একেবারে জবাই-করা মুরগির মতো ছটফট করছে আর ডাক ছেড়ে কাঁদছে। কে বলবে ওকে দেখে যে, কথায় কথায় ও অন্য লোককে গুলির তোড়ে উড়িয়ে দেয়।
থানায় খবর দিয়েছ?
তা দিয়েছি। তবে বোঝেই তো! কোন দেশে বাস আমাদের! কলকাতার পুলিশের মতো ভদ্রলোক তো সবাই নয়।
আমাকে কী করতে বলো?
খোঁজ লাগাব। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। সাবীর মিঞা আর গিরিশদাকে দিয়ে একাজ হবে না। খতরা হতে পারে। তুমিও সংসারী লোক। তোমাকেও টানা উচিত নয়। কিন্তু মাথা কাজ করছে না আমার। আমার বন্দুকটা আর গুলির বেল্টটা নিয়ে নিয়েছি। তোমার…
মনে পড়ে গেল পৃথুর যে, গতসপ্তাহেই উধাম সিং যখন জবলপুরে গেছিলেন তখন অনন্ত বিশ্বাসের দোকান থেকে ওর পিস্তলটাকে আনিয়ে নিয়েছিল।
ভুচুকে বলল, এক সেকেন্ড দাঁড়াও।
ভিতরে গিয়ে পিস্তলটা আর দুটো ম্যাগাজিন নিয়ে নিল পৃথু। গুলির প্যাকেট নিল একটা পঞ্চাশটার। আই সি আই-এর গুলি নিল। ইটালিয়ান গুলি আর অর্ডন্যান্স কোম্পানীর গুলি আটকে যায় এই পিস্তলে।
রুষাকে নিজের ঘরে ডাকল। ডেকে সংক্ষেপে বলল। পিস্তলের কথা ওকে বলল না কিছুই। বন্ড-এর পাঁচব্যাটারির টর্চটা বের করে তাড়াতাড়ি ব্যাটারী ভরে নিল।
কোথায় যাচ্ছ? ফিরবে কখন?
কী করে বলব?
আজ লছমার সিংকে বলেছি ভাল করে ভুনি-খিচুড়ি রাঁধবে। তোমার পছন্দমত।
তুমি নিজে রাঁধবে না?
আমি পারি না। সকলে কী সব পারে? যা আমি পারি না তাইই চিরদিন বড় করে দেখলে তুমি, আর যা যা পারি সেগুলো দেখলেই না চোখ চেয়ে।
হবে! হবে। সময় যায়নি।
বলতে বলতে, দৌড়ে বেরিয়ে গেল পৃথু। দরজা দিয়ে বেরতে বেরতে বলল, দেরি হলে খাবার হট-কেস-এ রেখে শুয়ে পড়ো। কেউই যেন বসে না থাকে।
এগারোটা অবধি দেখব তবুও। তাড়াতাড়ি ফিরো। উদ্বিগ্ন গলায় রুষা বলল।
চেষ্টা করব।
ও জীপে গিয়ে বসতেই জীপ স্টার্ট করল ভুচু। কচুবন থেকে হঠাৎ বেরুনো দাঁতাল শুয়োরের মতো গোঁ-ভরে জীপটা ছুটিয়ে দিল ও। হেডলাইটের আলোয় রাস্তা পেরুনো একটা বন-বেড়ালের লালচে ভুতুড়ে চোখ জুলজুল করে জ্বলে উঠল।
কোনদিকে যাবে? আন্দাজে?
প্রথমে শামীমের বাড়ির দিকে যাব। ওখানে কোনও খোঁজ পেল কি না জেনে নিয়ে তারপর পাগলের মতোই ঘুরতে হবে চারদিকে। কিছু না করেও যে বসে থাকা যায় না।
কিছু করার না থাকলে মিছিমিছি পাগলের মতো ঘুরেই বা কী হবে? তার চেয়ে শামীমের বাড়িতে বসে মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবা দরকার।
চলো, দেখি কী করা যায়।
পৃথুর কপালটাই এরকম। বহুবছর পরে রুষা ওর খুব কাছে এসেছিল। ওর জীবন একটা প্রচণ্ড সম্ভাবনার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল থমকে গিয়ে। ঠিক সেই সময়েই এই ঘটনা। আশ্চর্য! ও রুষাকেই হারাতে চেয়েছিল। ভেবেছিল, নিজে না হেরে গিয়েও রুষাকে হারানো সহজ হবে। ও নিজে কখনওই হারাতে চায়নি। অথচ, রুষাও হারতে চায় না বলল।
বড়া মসজিদের কাছাকাছি আসতেই হেডলাইটের আলোয় দেখা গেল শামীমের নিত্য-নৈমিত্তিক বিদ্বেষ ও রসিকতার পাত্র গিয়াসুদ্দিন মৌলভী হন্তদন্ত হয়ে তার সাইকেল জোর ছুটিয়ে এদিকেই আসছে।
ভুচু বলল, এ শালা এই ঘটনার পেছনে নেই তো! বলেই, জোরে ব্রেক করল জীপটাকে, প্রায় মৌলভীর মুখোমুখিই। গিয়াসুদ্দিন প্রায় পড়ে যাচ্ছিল সাইকেল উল্টে। চেঁচিয়ে বলল, বেয়াকুফ! সুরতহারাম।
ভুচু মুখ বের করল পাশ থেকে।
বলল, খাল-খরিয়াত সব ঠিক্কে না মোলভী সাহাব?
আররে। পিরথুবাবু ভি হ্যায়? আপলোগোঁকো তাল্লাসমেই যা রহা থা। শুনা ত আপলোঁগোনে?
শুনেই তো আসছি।
জলদি জীপ ঘুমাকে হামারা ঘরকা পিছাওয়ালা রাস্তেমে বড়কা ইমলিকা পেঁড় কা নীচে যা কর রোক্কিয়ে। ম্যায় আভভি আয়া। তাল্লাস মিলা।
বলেই, মৌলভী সাইকেলে উঠল। জোরে প্যাডল করেই বলল, ছিপকর রহিয়েগা। কিসিকোভি মালুম নেহি হোনা হ্যায়।
ঠিক হ্যায়। আপ আইয়ে।
জীপ ঘুরোতে ঘুরোতে ভুচু বলল, হদিস মিলেছে মনে হচ্ছে। আমরা ঠিক সময় মতোই এসেছি। মেয়েটা কেমন আছে কে জানে? রুবাইয়াৎ শোনানোর জন্যে তো কোনও মেয়েকে কেউ কিডন্যাপ করে না।
পান খাব ভুচু। কাল দুপুরের পর থেকে পান খাইনি।
পৃথু বলল।
তোমাকে নিয়ে পারি না আর। এই নাও।
বলেই ড্যাশবোর্ডে হাত চালিয়ে শালপাতার দোনাতে মোড়া পান আর সিগারেটের প্যাকেটের রাংতাতে মোড়া জর্দা বের করে দিল ও।
পৃথু বলল, একেই তো বলে চেলা!
জীপটাকে মৌলভীর বাড়ির পিছনের জঙ্গুলে জায়গায় নিয়ে গিয়ে ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছের নীচে লাগিয়ে হেড-লাইট সাইড-লাইট সব নিবিয়ে দিল পৃথু। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই মৌলভী তার বন্দুকটা নিয়ে এসে জীপের পেছন দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে ঝপাং করে বসে পড়ল। বন্দুকের নলের সঙ্গে ঠোকাঠুকি হয়ে গেল জীপের মাথার লোহার রডের। মৌলভী একটা মস্ত কাজলদানি বের করে বলল, মুখে, নাকে, কপালে লাগিয়ে নিন। কেউ যেন চিনতে না পারে।
ভুচু বলল, দাঁড়ান। দাঁড়ান!
বলেই তাড়াতাড়ি নেমে গিয়ে জীপের নাম্বার প্লেটটা খুলে ফেলে পাদানীর কাছ থেকে গোয়ালিয়রের নাম্বার লেখা একটি নাম্বার প্লেট বের করে ওরিজিনাল নাম্বার প্লেটটা চেঞ্জ করে দিল।
সকলে মিলে কাজল মেখে কিম্ভুতকিমাকার হয়ে নেবার পর ভুচু এঞ্জিন স্টার্ট করে পেছনে মুখ ঘুরিয়ে শুধোল, কোনদিকে? চিলপির দিকের রাস্তায় ফরেস্ট ডিপার্ট-এর একটা অ্যাবানডানড ভাঙা বাংলো আছে। জানেন তো! যে বাংলোর পিছনে জঙ্গলে সেভেনটি-ওয়ান-এ সাবীর মিঞা বড় বাঘ মেরেছিল হাঁকোয়াতে?
হ্যাঁ।
সেখানে নিয়ে গেছে? নুরজাহানকে?
হ্যাঁ।
কে, মানে কারা?
ভগয়ান শেঠ-এর ব্যাটা লালটু আর তার ইয়াররা।
জীপে করে?
হ্যাঁ।
আপনার জীপের এঞ্জিন এবং আলো কিন্তু ভাঙা বাংলোর কিছুটা আগেই যে চড়াই আছে, সেখানেই বন্ধ করে দিয়ে জীপ অন্ধকারে গড়িয়ে নামাতে হবে। তারপর এক-ফার্লং মতো দূরে জীপটাকে জঙ্গলে লুকিয়ে রেখে পায়ে হেঁটে যেতে হবে আমাদের। খাতরা আছে। কিন্তু নুরজাহানের ইজ্জৎ! শামীম ভাইয়ের ইজ্জত। কোনওই উপায় নেই। আমরা কুরবানী হলে, হব। পুরুষের জান তো ভালকাজে কুরবানী হবার জন্যেই।
থানায় খবর দিলেন না কেন? ফোর্স নিয়ে আসত। আইন কি নিজেদের হাতে তুলে নেওয়া ভাল?
পৃথু বলল।
ফুঃ। থানা! থানা তো বড়লোকদের পকেটে। যেমন এখানে, তেমনই পাকিস্তানেও। যার উপায় আছে এবং সাহস আছে তার পক্ষে নিজের হাতে আইন তুলে না নিলে কোনও অন্যায়েরই মোকাবিলা হওয়া সম্ভব নয়। এদেশে, এখনও অন্তত নয়। মেয়ের ইজ্জৎ চলে যাবার পর শামীম কি দশ বছর ধরে আদালত আর উকিল করবে? সেখানেও তো যার পয়সার জোর সেই-ই জিতবে।
জোরে ছুটে-চলা জীপ থেকে মুখ বার করে পানের পিক ফেলে পৃথু বলল মনে মনে, তা ঠিক! বঙ্কিমবাবু সেই কবে লিখে গেছিলেন, “আইন! সে তো তামাশামাত্র! বড়লোকেরাই পয়সা খরচ করিয়া সে তামাশা দেখিতে পারে।”
বেশ লাগছে পৃথুর। কতদিন ব্যক্তিগত বিপদের মুখোমুখি হয়নি ও। শিকার ছেড়ে দিয়েছে বহু বছরই। ব্যক্তিগত বিপদের সামনাসামনি হলে বেশ চনমন করে ওঠে রক্ত। জানা যায় যে, এখনও মরে যায়নি পুরোপুরি, সংসার, রুজি-রোজগার আর একঘেয়েমির চাপে! ভাল লাগছে। খুবই ভাল লাগছে পৃথুর। জোরে ছুটে-চলা জীপে বসে রাতের ঠাণ্ডা হাওয়ায় চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মনে মনে ও বলল, থ্যাঙ্ক উ্য ভুচু!
মিনিট পনেরো প্রচণ্ড জোরে জীপ চালিয়ে সেই চড়াইটার কাছে গিয়ে জীপ পৌঁছল। বাংলোটার দিক থেকে চড়াই। এদিক থেকে গেলে উৎরাই। জীপের সব আলো আর-এঞ্জিন বন্ধ করে চোখকে অন্ধকারে সইয়ে নিল ভুচু। অন্যরাও এই উৎরাই নেমেই একটি কজওয়ে আছে। সেখানে স্টিয়ারিং একটু এদিক ওদিক হয়ে গেলেই জীপটা নালাতে পড়ে যাবে। ওরা তিনজনেই সামান্য সময় চুপ করে বসে থাকল চোখ বন্ধ করে। তারপর চোখ খুলতেই ঝাপসা ঝাপসা দেখা যেতে লাগল রাস্তা; গাছ-পালা। এখানে ঝাঁকড়া সব শালগাছা। এই জায়গাটা পেরুলেই আরও পরিষ্কার দেখা যাবে চারধার। চাঁদও উঠেছে একটু। আজ অষ্টমী-নবমী হবে।
জীপটা গড়িয়ে নামছে। সেকেন্ড গীয়ারে দিয়ে রেখেছে ভুচু। জীপের লোহার বডির শব্দ শোনা যাচ্ছে শুধু গুটুর-গুটুর। আর ক্যানভাসের পর্দার পৎ-পৎ। ওরা সকলে উৎকণ্ঠিত হয়ে বসে আছে। কজওয়েটাও পেরিয়ে গেল জীপটা আস্তে আস্তে। ওটা পেরিয়েই পথের পাশে একটা সমান জায়গা দেখে ভুচু ঝোপ-ঝাড় ভেঙে ঢুকিয়ে দিল বাঁদিকে জীপটাকে। তারপর নেমে পড়ল।
ফিসফিস করে বলল, পাস-ওয়ার্ড মাইকাল।
মাইকাল।
মাইকাল।
অন্ধকারে ফিসফিস করে বলল ওরা দুজন। পৃথু আর মৌলভী।
তারপর তিনজনে আলাদা হয়ে ছড়িয়ে গেল জঙ্গলের মধ্যে বনবাংলোর দিকে। কিছুটা যেতেই দেখা গেল বাংলোটাকে। শীতের অল্প চাঁদের কুয়াশাভরা রাতে পোড়ো বাংলোটাকে ভুতুড়ে দেখাচ্ছে। একটা দিক ভাঙা। বারান্দা, এবং চারটি থামের মধ্যে তিনটিই ভেঙে গেছে। মধ্যে থেকে টর্চ-এর আলো ফুটে বেরচ্ছে। এই পথে কোনও যানবাহন যায় না। চোরা-শিকারি আর ডাকাতরাই ব্যবহার করে রাতের বেলা। দিনের বেলা পাহাড়-জঙ্গলের ভিতরের গ্রামের মেয়ে-পুরুষ দল বেঁধে হেঁটে যায়।
হঠাৎই চোখে পড়ল একটা জীপ দাঁড়িয়ে আছে।
পৃথু দেখতে পেল, ভুচু বাঁ হাতে বন্দুকটাকে ধরে ডান হাত দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে জীপটার দিকে এগোতে লাগল। পেছনে পেছনে গিয়াসুদ্দিন তার ধবধবে সাদা পোশাকে। এই পোশাকের কারণেই মোরগ-মারা মৌলভী আজ ফওত হয়ে যাবে দুশমনদের হাতে। জীপের ডানদিকের পেছনের চাকার হাওয়া খুলে দিল ভুচু। ফুসসস—স-স শব্দ করে হাওয়া বেরুতেই কে একজন জীপ থেকে লাফিয়ে নামল। তার হাতে মস্ত একটা ছোরা। ওই স্বল্প আলোতেও চকচক করে উঠল সেটা। ভুচু লোকটার বুকের সঙ্গে বন্দুকটা এগিয়ে দিয়ে লোকটার একেবারে বুকে নলটা ঠেকিয়ে দিল। ঠিক সেই সময়ই মৌলভী কাণ্ডটা ঘটাল। হঠাৎ লোকটার পেছনে পৌঁছে অতর্কিতে তার মোটা শক্ত বাঁ হাত দিয়ে লোকটার গলাটা জড়িয়ে ধরে ডান হাত দিয়ে তার গলার কাছে কী যেন কী করল। আঁক—আঁ—আঁ—আর-র-র-র করে শব্দ হল একটু। তারপরই লোকটা কাটা-পাঁঠার মতো ছটফট করতে লাগল মাটিতে পড়ে গিয়ে। মৌলভীর সাদা কুর্তার বুকের কাছটা লাল রক্তর ফিনকিতে ভরে গিয়ে কালো দেখাল অস্পষ্ট আলোতে।
যেন এক্ষুনি একটি মোরগা জবাই করেছে সে, এমন ভাবেই মৌলভী জবাই-করা লোকটাকে ফেলে রেখে বাংলোর দিকে এগোল।
পৃথুর গা গুলিয়ে উঠল। রুষা ঠিকই বলে। ও একটা জংলিই। জংলি। খুনী। নইলে সে এসব লোকের সঙ্গে মেশে কেন? মৌলভী এক্ষুনি একটা লোককে ঠাণ্ডা-রক্তে খুন করল। এ লোকটা হয়তো ওদের মাইনে করা ড্রাইভারই। কে জানে? লোকটা হয়তো নুরজাহান সম্বন্ধে কিছুই জানে না। হয়তো ওরা নুরজাহানকে নিয়ে আসার পরেই ও জীপ চালিয়ে নিয়ে এসেছে ভগয়ান শেঠের ছেলেকে। কিন্তু মস্ত বড় ছোরাটা? ছোরা বের করল কেন সে?
বমি-বমি পাচ্ছিল পৃথুর। এই সব মানুষগুলোর সঙ্গে এই ঘোলা রাতে তার মতো মানুষ কী করছে? সমাজ তো তাকে অন্য এক নিরাপদ সম্মানের জায়গায় বসিয়ে রেখেছিলই।…তবু…
পৃথু বাংলোটার ডানদিকে চলে গেল। জীপ থেকে নেমেই দুটি ম্যাগাজিনই গুলিতে লোড করে নিয়েছিল। একটি জার্কিনের ডান পকেটে রেখে অন্য ম্যাগাজিনটি পিস্তলে লোড করে নিল। এবার কোমরের হোলস্টার থেকে টেনে বের করল পিস্তলটাকে। ডান হাতে ধরে এগোল। আশা করল, নিজেকে বাঁচাবার কারণ ছাড়া তাকে গুলি চালাতে হবে না।
রঘবীর! রঘবীর! বলে, ডাকতে ডাকতে একটা লোক বাংলোর বারান্দায় এসে দাঁড়াল। ওই স্বল্প আলোতেও দেখা যাচ্ছিল লোকটার চেহারাটা ছিপছিপে। সরু কোমর। লম্বা। গোঁফ আছে। বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না। এরা পালোয়ান নয়। কিন্তু ডাকাতদের চেহারা এরকমই হয়। শরীরে প্রচণ্ড শক্তি ধরে লোকটা।
লোকটা আবার ডাকল, রঘবীর। রামকা বটল লাও। শো গ্যয়া ক্যা হারামজাদা? রঘবীর নিশ্চয়ই ড্রাইভারটির নাম।
তার কাছ থেকে কোনওই উত্তর না পেয়ে সন্দিগ্ধ হয়ে লোকটা ভিতরে চলে গেল। ফিরে এল রাইফেল হাতে। তারপর নেমে এল বাংলো থেকে।
ভুচু ঝোপের মধ্যে পৃথুর শেয়ালে-রঙা আলোয়ান গায়ে মিশে গেছিল। লোকটা ওকে পেরিয়ে যেতেই বন্দুকের নল ঠেকিয়ে দিল ও আবারও তার পিঠে।
বলল, হ্যান্ডস আপ। জারা সে হিলনেসেই গোলিসে ভুঞ্জ দেগা।
লোকটি রাইফেল-ধরা হাতটা ওঠাতে ওঠাতেই পেছনে ঘাড় ঘোড়াচ্ছিল। হুঁশিয়ার, ধূর্ত, সাহসী লোকটা। কিন্তু মোটা, চলচ্ছক্তিহীন মৌলভী আবারও চিতাবাঘের মতোই ক্ষিপ্রতায় এক লাফে তার ঘাড়ে চড়ে এক মুহূর্তের মধ্যে তাকেও জবাই করল। আচমকা গলায় ছুরি খেয়েই রাইফেলের ট্রিগারটা টেনে দিল লোকটা। নিজেরই অজান্তে আকাশের দিকে গুলি গেল। গম গম গম করে উঠল নিস্তব্ধ-রাতের গহন জঙ্গল।
সঙ্গে সঙ্গে ভুচু আর মৌলভী ছিটকে গেল দুদিকে। পৃথু একা এগিয়ে যেতে লাগল দ্রুত বাংলোর পেছন দিকে। ওদের আসল কাজ নুরজাহানকে উদ্ধার করা। প্রথমেই খুনোখুনি শুরু করে দিল ওরা। মেয়েটাকে যদি প্রাণেই মেরে দেয়? ইমম্যাচিওরড, ট্রিগার-হ্যাপী লোক এই মৌলভী।
গুলির শব্দ হতেই ভিতর থেকে দুজন বন্দুকধারী লোক ছুটে এল। এবং বারান্দা থেকে নেমে লোকটি যেখানে পড়েছিল সেদিকে বন্দুক তাক করে সাবধানে এগিয়ে আসতে লাগল।
পৃথু শুনল, ছটফট করা লোকটা রক্ত কুলকুচি করা ঘড়ঘড়ে গলায় ডাকল, সিরকান্ত, সিরকান্ত।
জিন্দা হ্যায় আভভিতক। খতম কর দো উসকো। পাকাড় যানেসে…
দ্বিতীয় লোকটি বলল।
প্রথম লোকটি তার বন্দুকের নল তারই সঙ্গীর কপালে ঠেকিয়ে ট্রিগার টেনে দিল। আহত ডাকাত অন্য ডাকাতের কাছে সাংঘাতিক বিপদের। তাকে ফেলে রাখা যায় না আহত অবস্থায়।
গুলি হতেই গুলি-খাওয়া লোকটি পা দুটি টানটান করে ছড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। যে লোকটি গুলি করল, সে নিচু হয়ে ওর পড়ে যাওয়া রাইফেলটা তুলে নিতে যাবে যখন, ঠিক তখনই ভুচু চকিতে পর পর দুটি ব্যারেলই ফায়ার করল। হঠাৎ ওড়া তিতির কি বটের ফ্লাইং মারার মতো করে। টাঙ্গির কোপ-খাওয়া পলাশ গাছেরই মতো তারা ধপাস করে পড়ে গেল।
পৃথু এবার দৌড়ে গিয়ে পেছনের জানালা দিয়ে উঁকি মারল। দেখল, একটি ধবধবে ফর্সা, ছিপছিপে মাথা ভর্তি কালোচুলের মেয়ে শুয়ে আছে। পৃথুর দিকে মাথা। তার মুখের মধ্যে রুমাল গোঁজা। হাত দুটিকে দু দিকে টান টান করে বাঁধা জানালার শিকের সঙ্গে। সম্পূর্ণ অনাবৃতা। একটি চব্বিশ-পঁচিশ বছরের ছেলে মেয়েটির পাশে বসে উদ্বেগে বাইরে চেয়ে আছে। ঘরে আর অন্য কেউই নেই।
পৃথু ঘুরে গিয়ে একদৌড়ে ঢুকল ঘরে। ঢুকতেই ছেলেটি ধড়মড় করে উঠে বসে পৃথুকে দেখেই বলল, আমাকে মেরো না। আমি কিছু ক্ষতি করিনি মেয়েটার। এই ডাকুরা আমার কাছ থেকে পাঁচ হাজার করে টাকা নিল, এক একজন। নিয়ে মেয়েটাকেও ওরাই…
এমন সময় মৌলভী আর ভুচু ঘরে ঢুকল এসে দৌড়ে।
ভুচু, তোমার আলোয়ানটা দাও ওকে।
পৃথু বলল।
ভুচু লজ্জা পেয়ে অন্য দিকে চোখ করে আলোয়ানটা নুরজাহানের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে ওর হাতের বাঁধন খুলতে লাগল। মুখ থেকে রুমাল টেনে বের করল। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে গেল নুরজাহান, গোঁ গোঁ আওয়াজ করতে করতে। অজ্ঞান হবার আগে ওর চোখ দুটিতে আতঙ্ক, বিস্ময় এবং এক নিমেষের স্বস্তি জ্বল জ্বল করে উঠল। তার পরই নিভে গেল।
ভুচু বলল, ক্যা রে, ভগয়ান শেঠকা বেটা!
হামারা কুছ কসুর নেহী। ম্যায় মজা ভি নেহি লুটা, মেরী পয়সা ভি লোগ খা লিয়া।
কাঁহাকা ডাকু থা উ লোগ?
মোরেনাকা।
জীপকা নাম্বার প্লেট তো হিয়াঁকাই হ্যায়।
উ লোগ বদল লিয়া থা।
কিতনা রূপাইয়া দিয়াথা তুমনে?
এক এক কো পাঁচ পাঁচ হাজার!
পৃথু বলল। তাড়াতাড়ি চল, মেয়েটাকে নিয়ে। এখানে সময় নষ্ট করার সময় নেই।
হঠাৎ লালটু সিং অপলকে তাকাল পৃথুর দিকে। ওর গলার স্বরে চমকে গিয়ে। হঠাৎ হাত-জোড় করে পৃথুর পায়ে উপুড় হয়ে পড়ে বলল, ম্যানিজারবাবু! ঘোষ সাহাব। আপকো ম্যায় পহচান লিয়া। মেরী জান আপ বাঁচা দিজিয়ে ম্যানিজার সাহাব। মেরী পিতাজী আপকো আমীর বনা দেগা। জিন্দগী ভর আপকো নোকর বনকে রহেগা ম্যায়। ম্যায় কুছ কিয়া নেহী। ছোঁনে ভি নেহি দিয়া ছোকরী কো উ ডাকু লোগ।
ওরা তিনজনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল।
পৃথু বলল, ওকে বাইরে নিয়ে চলো তো ভুচু। আর মৌলভী, আপনি মেয়েটাকে কাঁধে করে নিয়ে আসুন।
হঠাৎ মৌলভী তার বন্দুকের ঠাণ্ডা, কালো, স্টিলের মৃত্যুবাহী নলটা লালটু সিং-এর বাঁদিকের জুলপির একটু উপরে কানের পাশে ঠেকিয়ে ট্রিগারটা টেনে দিল।
ছেলেটা হাত জোড় করেই ঢলে পড়ল ভাঙা বারান্দায়। পেচা আর চামচিকেরা একসঙ্গে হল্লাগুল্লা করে উঠল খুব জোরে চারধার থেকে।
পৃথু বলল, হতভম্ব হয়ে গিয়ে, ওকে মারার কি দরকার ছিল মৌলভী সাব? খুন করে কী আনন্দ পান আপনি?
বিরক্তি ফুটে উঠল ওর গলায়।
মৌলভী গিয়াসুদ্দিন ঠাণ্ডা চোখে তাকাল পৃথুর মুখে। বলল, ও যে আপনাকে চিনে ফেলেছিল। নিজেদের বাঁচতে হলে অন্যকে মারতেই হয়। এতো ছেলেখেলা নয়। আপনি কি সবই বোঝেন ঘোষসাহেব?
উত্তর দিল না পৃথু।
ভুচু তার জীপের ফলস নাম্বার প্লেটটা খুলে এনে ডাকাতদের জীপের পিছনে লাগিয়ে নিজের নাম্বার প্লেট আবার লাগিয়ে দিল। তারপর দৌড়ে সকলে মিলে ওদের জীপে ফিরে যেতেই ভুচু জোরে জীপ চালাল।
ভুচু! মৌলভি বলল, আমার বাড়ির কাছের তেঁতুলতলায়ই দাঁড়িয়ো। আমি আমার দুই বিবিকে, একটা বোরখা নিয়ে আসতে বলব। তারপর নুরজাহানকে বোরখা ঢেকে নিয়ে যাব আমার বাড়িতে। শামীম আর তার বউকে এখানে পাঠিয়ে দেবেন ভুচুবাবু।
ড্যাশবোর্ড খুলে ভুচু বলল, পান খাও পৃথুদা।
মৌলভীর বাড়ি থেকে তার বিবিরা এসে নুরজাহানকে কোনওক্রমে হাঁটিয়ে নিয়ে গেল বোরখা-ঢাকা দিয়ে।
ভুচু বলল, তুমি জীপটা নিয়ে তোমার বাড়ি চলে যাও পুত্থাদা। আমি সাইকেল রিক্সা করে শামীমকে খবর দিয়ে আবার সাইকেল-রিক্সা করেই তোমার বাড়ি আসছি। সেখান থেকে জীপ নিয়ে যাব। গারাজে গিয়ে দেখতে হবে রক্ত-টক্ত লাগল কি না কোথাও।
ঠিক আছে।
নিজের বাংলোর দিকে আস্তে আস্তে জীপ চালিয়ে যেতে যেতে পৃথু ভাবছিল মৌলভীর পাঞ্জাবিতে রক্ত ভরে আছে। ওকে কি দেখল কেউ? ওর হাতেও রক্ত। কত মানুষের হাতই রক্তমাখা। কোনও রক্ত দেখা যায়, কোনও রক্ত দেখা যায় না। ভগয়ান শেঠ আর লালটু সিংদের নিজেদের হাত কখনও রক্তাক্ত হয় না। যা কিছু করে তারা অন্যদের দিয়ে করায়। পৃথু একদিন লক্ষ করেছিল যে, ভগয়ান শেঠ নিজে হাতে টাকা খরচ পর্যন্ত করে না। খরচ করার জন্যেও কর্মচারী আছে। যারা বড় বড় শেঠ তারা নিজেরা রক্তরই মতো, টাকা দিয়েও নিজেদের হাত দূষিত করে না।
জীপটা পোর্টিকোতে ঢুকিয়ে জীপ থেকে নামতেই দেখল রুষা দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। চান করেছে। হলুদ আর কালো ডোরা কাটা ধনেখালি শাড়ি পরেছে একটা। হলুদ ব্লাউজ। চুলে হলুদ ক্রীসানথিমাম ফুল গুঁজেছে। দারুণ সুন্দর দেখাচ্ছে তার বউকে, বেনে-বউ পাখির মতো। বিজ্লীর চেয়ে অনেকই বেশি সুন্দরী রুষা। বিজ্লীর শরীরই আছে। রুষার সৌন্দর্যে মনের সৌন্দর্য, বুদ্ধিমত্তা, পরিশীলনের ছাপ পরিস্ফুট। সৌন্দর্য তো শুধু চোখ বুকে হয় না, মনের আলোয় আভাসিত না হলে সৌন্দর্য বীজের মতোই সুপ্ত থাকে, ফুল হয়ে ফুটে ওঠে না।
কী হল? পেলে খোঁজ?
বলতে গিয়েও পৃথু চুপ করে গেল। ভুচুই এসে বলুক যা বলার। মিথ্যে কথা ভাল করে বলতে পারে না পৃথু। চোখের পাতা কেঁপে যায়, মুখের ভাব পাল্টে যায়।
বলল, ভুচু সব জানে। মেয়েটিকে ওরা উদ্ধার করেছে।
কিছু করেনি তো মেয়েটিকে?
এতক্ষণ সময় বয়ে গেল। করে, কী আর নি?
কী করেছে?
মেয়েদের নিয়ে পুরুষরা যা করে এসেছে চিরদিন। তফাৎ এই-ই যে অনিচ্ছায় করেছে, জোর করে, যা সুন্দর তাকে কদর্যতা দিয়েছে। করার জন্যেই তো ধরে নিয়ে গেছিল।
কী জংলী! কী খারাপ!
সব পুরুষই জংলী। তাদের জংলামো সুপ্ত থাকে। এই সুপ্ততা অক্ষত রেখে যারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে, ভালত্বর তকমা তাদের জন্য। যারা পারে না তাদের গায়ে খারাপত্বর টিকিট লাগে।
উঃ। ঘাস্টলী ব্যাপার স্যাপার। হাটচান্দ্রা জায়গাটা খুবই আনসেফ হয়ে উঠছে দিনকে দিন।
সব জায়গাই সমান। বড় বড় শহর এর চেয়েও খারাপ। সে সব জায়গায় প্রতিদিনই এরকম কত ঘটনা ঘটছে। আমরা জানতে পারি না, তাই।
ভুচু আসছে?
হ্যাঁ।
ওকি খাবে এখানে?
খাবে?
অবাক হল পৃথু।
বলল, খেতে পারে, যদি তুমি খেতে বলল। ও তো নিজেই রান্না করে খায়।
তবে খাবে। খিচুড়ি তো বেশি করেই করেছে।
তুমি চান করবে না?
চান? রাতে তো করি না, তবে আজ…
গরম জল আছে গীজারে। চালিয়ে রেখেছি। চান করে নাও। নোংরা হয়ে থাকলে আমার…
রুষার মুখে তাকাল পৃথু। বেনে-বউ পাখিটি আজ বেড়ালের হাতে স্বেচ্ছায় ছিন্নভিন্ন হতে চায়। হোক। দিগা ঠিকই বলে। “বিধিহু ন নারী গতি জানী।”
ও যখন বাথরুমে তখন ভুচু এল। পায়জামা-পাঞ্জাবী পরে বেরিয়ে দেখল রুষার সঙ্গে ভুচু বসে আছে। রাম নিয়ে এসেছে ভুচু একটা। রুষাও নিয়েছে একটু।
ভুচু বলল, এসো দাদা।
রুষা বলল, ‘ড্রিংকস-এর সঙ্গে তোমাদের টিট-বিটস কি দেব কিছু না, একেবারেই খাবে?
ভুচু বলল, না না। খেয়ে নেব একেবারে। নাও পৃথুদা বড় করে একটা ঢেলে দিচ্ছি।
রুষা বলল, তারপর?
তারপর আর কি? দু দল ডাকাতে বোধহয় রেষারেষি ছিল। অন্য দল এদের মেরে দিয়ে গেল। নুরজাহানকে যে নিয়ে যায়নি সঙ্গে এই-ই ভাল।
ওই ডাকাতগুলো তাও ভাল বলতে হবে। নইলে কি আর মেয়েটাকে ছেড়ে দিত?
ভুচু একটা চুমুক দিয়ে বলল, ডাকাতদের মধ্যেও ভালমন্দ থাকে বইকি, ভাল মানুষদেরও যেমন থাকে। থাকগে মরুকগে ডাকাতরা, এই ঘটনার জন্যে আপনার সঙ্গে ভাল করে আলাপ হল এইটেই আমার লাভ। পৃথুদা তো সবসময়…
রুষা গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, কী? সবসময় আমার নিন্দা করে?
নিন্দা? কখখনো না। আপনার এতো বেশি প্রশংসা করে সকলের কাছেই যে আমার সন্দেহ হত যে আপনি সত্যি সত্যিই প্রশংসার যোগ্য কি৬ না আদৌ।
প্রশংসা করে? আমার? স্ট্রেঞ্জ!
কেন? স্ট্রেঞ্জ কেন? আপনার সঙ্গে মিশে এখন বুঝতে পারছি যে হাটচান্দ্রার সকলেই কেন আপনি বলতে পাগল। আমি গাড়ির মিস্ত্রি, আমার কথা ছাড়ুন। তবে ভাল লাগাতে যোগ্যতা লাগে নিশ্চয়ই, ভাল লাগতে লাগে না।
বাঃ। চমৎকার বলেছেন।
পৃথুর ভীষণ ভাল লাগছিল। এই ঘর, এই রকম স্ত্রী, তার অশিক্ষিত, জংলী, বুনো বন্ধুবান্ধবদের তার বাড়িতে এইরকম অবারিত দ্বারই তার স্বপ্ন ছিল। আজ তার স্বপ্ন সত্যি হল। কে করল, সত্যি? বিজলী। আশ্চর্য। বেচারি বিজলী।
খাওয়া দাওয়ার পর ভুচু চলে গেল জীপ নিয়ে। পৃথু বলল, এসো আমার ঘরে। রুষা খাটে এসে বসলে, দরজা বন্ধ করে ঘরের আলো নিভিয়ে দিল।
পাখি যখন নিজেই ছিন্নভিন্ন হতে ইচ্ছা করে তখন বেড়ালে আর পাখিতে খুব ভাব হয়ে যায়। ভাব ভাব কদমের ফুল।
প্রায় তিরিশ বছর আগে পড়েছিলাম,এখন আবার মোবাইল এ