কৃষ্ণনগর কম দূরের পথ নয়। স্থলপথে যেতে অন্তত দু-দিন লেগে যাবে। তাছাড়া ঠ্যাঙাড়ে দস্যুদের উপদ্রবের আশঙ্কা আছে, রাত্রে পথ চলা দুষ্কর। নদীপথে কিছু অল্প সময় লাগতে পারে, কিন্তু বিধুশেখর নিজে নৌকোয় চড়তে ভয় পান। তাঁর কোষ্ঠিতে জলে ডোবা ফাঁড়ার উল্লেখ আছে।
বিধুশেখর তাঁর নিজের দুজন কর্মচারী এবং দিবাকরকে অগ্রিম রওনা করিয়ে দিলেন দ্রুতগামী ছিপ নৌকোয়, তারপর তিনি যাত্রা করলেন কয়েকজন পাইকবরকন্দাজসহ দুখানি জুড়িগাড়িতে। দুঃসংবাদ শুনে গঙ্গানারায়ণও তাঁর সঙ্গে আসতে চেয়েছিল, বিধুশেখর বলেছেন, তার প্রয়োজন নেই, গঙ্গানারায়ণ কলকাতায় থেকে দুই পরিবারের দেখাশুনে করুক।
রুগণা পত্নীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার কাজটি সহজ হয়নি। সৌদামিনী এখন একেবারে অবুঝের মতন হয়ে গেছেন, প্রতিদিন সকালে স্বামী সন্দর্শন না হলে তিনি আকুলি বিকুলি করেন। সুতরাং তাঁকে না জানিয়ে বিধুশেখর যেতে পারেন না। আবার সুহাসিনীর অসুখের কথা জানালেও সৌদামিনী এমন অস্থির হয়ে উঠবেন যে তখন তাঁকে বাঁচানোই শক্ত হবে। বিধুশেখর কলকাতা ছেড়ে যান কচিৎ কদাচিৎ, মোকদ্দমার কারণে দু একবার বর্ধমান গিয়েছেন। শুধু, সুতরাং হঠাৎ তাঁর বাইরে যাবার কারণটি সৌদামিনীকে বোঝাবেনই বা কী করে। সেই জন্য বিধুশেখরকে কিছু মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়েছিল, তিনি সৌদামিনীকে বোঝালেন যে কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ি থেকে তাঁর ডাক এসেছে একটি গুরুতর মামলায় তাঁর কাছ থেকে আইনের পরামর্শের জন্য। তিনি যেতে সম্মত হয়েছেন তার কারণ একযাত্রায় দুটি উদ্দেশ্য সাধিত হবে। তাঁর জামাই কৃষ্ণনগরে তাঁদের বাড়িখানির ব্যবস্থা কতদূর কী করলো তাও দেখে আসা যাবে। তিনি নিজে উপস্থিত হলে কাজ ত্বরান্বিত হবে নিশ্চিত, তাহলে তিনি মেয়ে জামাইকে সঙ্গে নিয়েও ফিরতে পারেন।
সৌদামিনী এই কথায় প্ৰবোধ মেনে বলেছিলেন, বাড়ির কাজ শেষ হোক বা না হোক, আপনি সুহাসিনীকে সঙ্গে নিয়েই আসবেন। আমি আর কতদিন আচি কি না আচি, শেষবারের মতন তার মুখখানি যেন দেকে যেতে পারি।
বিধুশেখরের কাপড়-চোপড় গুছিয়ে দিয়েছিল তাঁর বড় মেয়ে নারায়ণী। কয়েক বছর আগে সেও কপাল পুড়িয়ে ফিরে এসেছে বাপের বাড়িতে।
নারায়ণী মৃদু স্বরে বলেছিল, বাবা, আমি কি আপনার সঙ্গে যাবো?
বিধুশেখর বলেছিলেন, না মা, তুই গেলে এ দিকে সব সামলাবে কে? তোর ওপরেই তো এখন সব ভার।
—তবু আমাদের কেউ একজন গেলে ভালো হতো। সুহাসিনী পোয়াতী।
–অ্যাঁ?
রাগে বিধুশেখরের মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে হয়েছিল। সুহাসিনী যে অন্তঃসত্ত্বা, সে কথা কেউ তাঁকে আগে বলেনি কেন? তাহলে কি তিনি সুহাসিনীকে কৃষ্ণনগরে পাঠাতেন? এ বাড়িতে কেউ তাঁকে কোনো কথা বলে না, সবাই শুধু ভয় পায়।
বিবাহ দেবার পর সুহাসিনীকে তিনি একদিনের জন্যও শ্বশুরালয়ে যেতে দেননি। এইজন্যই তিনি এবার অনেক দেখেশুনে গরীব ঘর থেকে একটি সচ্চরিত্র ছেলেকে জামাই করেছেন এবং বিবাহের আগেই শর্ত করে নিয়েছিলেন যে তাকে ঘরজামাই হতে হবে। সবই ঠিকঠাক চলছিল, তারপর মেয়ে নিজেই কৃষ্ণনগর বেড়াতে যাবার জন্য আবদার করলো। বিধুশেখর তখন ভেবেছিলেন, যাক ঘুরে আসুক, কৃষ্ণনগর স্বাস্থ্যকর জায়গা। তখন কেউ তাঁকে একবার বলতে পারেনি যে সুহাসিনী গর্ভবতী!
গাড়ি ছুটে চলেছে ঝমোঝমিয়ে, বিধুশেখর ভেতরে বসে আছেন সোজা হয়ে চোখ বুজে। যেন ধ্যানমগ্ন। বিধুশেখরের অন্তরে একটিই চিন্তা, সুহাসিনীকে দেখতে পাবেন তো কৃষ্ণনগরে পৌঁছে! বাহকের হাতে যে পত্র এসেছে তাতে সুহাসিনীর কী অসুখ তা লেখা নেই। এখন শীতের সময়, ওলাওঠার প্রকোপ এই সময় কম থাকে। ঐ রোগটিকেই ভয় সবচেয়ে বেশী, একদিনও সময় দেয় না। তবে আর কোন রোগ হতে পারে? রোগ নিশ্চয়ই সাঙ্ঘাতিক রকমের কিছু নইলে এমনভাবে জরুরী বার্তা আসবে কেন!
বিধুশেখরের সন্তান ভাগ্য বড় মন্দ। পুত্র তো জন্মালোই না, পাঁচটি কন্যার মধ্যে দুটি মারা গেছে, আর দুটি বিধবা। বড় মেয়ে নারায়ণীরও কোনো পুত্ৰ সন্তান হয়নি, সে বিধবা হয়েছে তিনটি কন্যা সন্তান নিয়ে। বিধুশেখর প্রকাশ্যে স্নেহ-মমতা দেখান না, কিন্তু কনিষ্ঠা কন্যা সুহাসিনীর ওপর মনে মনে তিনি তাঁর সমস্ত স্নেহ উজাড় করে দিয়েছিলেন। কত আশা করেছিলেন সুহাসিনীর স্বামী দুর্গাপ্ৰসাদকে সব কিছু শিখিয়ে পড়িয়ে তাঁর বিষয় সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করে যাবেন। সুহাসিনীই যদি না বাঁচে, তাহলে আর দুর্গাপ্ৰসাদের কোনো মূল্য নেই তাঁর কাছে! তাহলে সব কিছু নবীনকুমারই পাবে।
দেশসুদ্ধ লোক জানে এবং চিরকাল জানবে যে নবীনকুমার রামকমল সিংহের সন্তান। সেটাই তো সত্য। অর্জন চিরকাল নিজেকে পাণ্ডব বলেছে। সে কি কখনো ইন্দ্ৰপুত্র বলে নিজের পরিচয় দিয়েছে? বিধুশেখর ব্ৰাহ্মণ এবং ব্ৰাহ্মণ মাত্রই দেবতার অংশ নিয়ে জন্মায়। কত নারী সন্তানের আশায় দেবতার কাছে বর মাগে। বিম্ববতীর একটি পুত্ৰ সন্তানের জন্য বড় সাধ ছিল, বিধুশেখর সেই সাধাটুকু পূর্ণ করে দিয়েছেন। এতে কুল রক্ষা হয়েছে, তাঁর বন্ধু রামকমল সিংহ তৃপ্তির সঙ্গে শেষ নিশ্বাস ফেলেছেন, এর চেয়ে বড় পুণ্যকর্ম আর কী হতে পারে। নিছক ভোগ লালসার দৃষ্টিতে বিম্ববতীকে কখনো দেখেননি বিধুশেখর, শুধুমাত্ৰ সন্তান জন্মের প্রয়োজনেই তিনি সহবাস করেছেন বিম্ববতীর সঙ্গে এবং নবীনকুমারের জন্মের পর আর একবারও তিনি বিম্ববতীকে শয্যাসঙ্গিনী হবার জন্য আহ্বান জানাননি। এখন বিম্ববতী বিধবা, আর তো সে প্রশ্নই ওঠে না।
কৃষ্ণনগর যাত্রার প্রাক্কালে নিজ স্ত্রী সৌদামিনীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসেছেন বিধুশেখর, কিন্তু বিম্ববতীর সঙ্গে একবার দেখাও করে আসতে পারেননি। বিম্ববতী লোকমুখে সংবাদ পাবেন যে বিধুশেখর শহরে নেই। তাতে কী বিম্ববতীর ক্ষীণতম অভিমানও হবে না?
গাড়ি হঠাৎ থেমে যেতেই বিধুশেখর বাইরে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, থামলি কেন? ব্যাটার শীগগির চল!
ওপর থেকে একজন পাইক বললো, হুজুর কোম্পানীর ফৌজ আসছে!
বিধুশেখর বিউগিলের শব্দ শুনতে পেলেন।
কোম্পানীর সিপাইরা মার্চ করে আসছে, এখন পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াতে হবে। বিধুশেখরের গাড়ি নেমে গেল একটা মাঠের মধ্যে। বিধুশেখর দেখলেন প্রায় সহস্ৰাধিক পদাতিক ও অশ্বারোহী, এরা চলে না। যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। অনেকখানি সময় নষ্ট হলো।
সামনে মাত্র দশ বারো জন গোরা সৈন্য, বাকি সবই দেশী সেপাই। বিখ্যাত বেঙ্গল রেজিমেণ্ট। কলকাতা থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত সবাই এই বেঙ্গল রেজিমেণ্টের নামে ভয়ে কাঁপে। দেশে এখন যুদ্ধবিগ্রহ নেই, সর্বত্রই শান্ত অবস্থা তবু কোম্পানির সৈন্যবাহিনী মাঝে মাঝেই পথ পরিক্রম করে। শান্তি বজায় রাখার জন্য মাঝে মাঝে শক্তি সামথ্যের প্রদর্শন করা বৃটিশ জাতির রণকৌশলের একটি অঙ্গ। রেজিমেণ্টে অবশ্য বাঙালী নেই, সিপাহীরা সকলেই পশ্চিমী ব্ৰাহ্মণ ও ক্ষত্ৰিয় জাতীয়। বাঙালী জাতি যুদ্ধবিদ্যা ভুলে গেছে। কলকাতায় রাজধানী স্থাপন করার পর, সেই রাজধানীকে সুরক্ষিত করার জন্য ইংরেজরা বাঙালীদের হাত থেকে তলোয়ার-বন্দুক কেড়ে নিয়ে তার বদলে কলম ধরিয়ে দিয়েছে।
বিধুশেখর মুগ্ধভাবে তাকিয়ে রইলেন সৈন্যবাহিনীর দিকে। কী সুন্দর সুশৃঙ্খলভাবে চলেছে সিপাহীরা। ইংরেজ জাতির শিক্ষার কী গুণ, দশ-বারোজন মাত্ৰ গোরা সৈন্যের হুকুমে সহস্ৰ সহস্ৰ দেশী সৈন্য নীরবে মাথা নীচু করে চলে। বিধুশেখর তাঁর ঠাকুদার মুখে গল্প শুনেছেন যে সেকালে নবাবী ফৌজকে আসতে দেখলেই গ্রামে-জনপদে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়তো। বিনা প্ররোচনায় লুণ্ঠন, নারী ধর্ষণ ও হত্যা ছিল নবাবী ফৌজের ব্যসন। সে অত্যাচারের প্রতিকারের জন্য কোথাও নালিশ জানাবারও উপায় ছিল না। তাই নবাবী ফৌজকে আসতে দেখলেই সবাই বনে জঙ্গলে পালিয়ে গিয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঈশ্বরকে ডাকতো। সেই তুলনায় ইংরেজ জাতি কত ভদ্র, সভ্য। কোম্পানির ফৌজ কখনো অকারণে লুঠপট করে না। বরং কোম্পানির ফৌজ যে পথ দিয়ে যায়, সে অঞ্চলে আর বহুদিন তস্যু-তস্করের উপদ্ৰব থাকে না।
ফৌজী কলম ছেড়ে একজন গোরা অশ্বারোহী ছুটে এলো বিধুশেখরের গাড়ির দিকে। জুড়ি ঘোড়া গুটি গায়ে এক বা চাবুক কবিয়ে সে জিজ্ঞেস করলে, সাইস, ভিতরে কে আছে? জেনানা না মর্দানা?
বিধুশেখর মুখ বাড়িয়ে বললেন, আই অ্যাম স্যার।
গোরা সৈনিকটি বয়েসে অতি তরুণ, দুপুরের রৌদ্রে মুখখানি টকটকে লাল। সে আবার শূন্যে চাবুকের শব্দ করে বললো, তুমি কোন মহারাজা আছো? কম্পানির ফৌজ যাইতেছে, নামিয়া দাঁড়াও নাই কেন?
গোরা সৈনিকের দুর্বোধ্য ভাষণ বিধুশেখর ঠিক বুঝতে পারলেন না। তবু দ্রুত নেমে এসে একটি সেলাম ঠুকলেন।
গোরা সৈনিক জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে?
বিধুশেখর বললেন, বিধুশেখর মুখুজ্যে স্যার, লা ইয়ার, স্যার; প্র্যাকটিস ইন সিভিল কোর্ট স্যার!
—উষ্ণীব খোলো, কুক্কুরীর সন্তান!
বিধুশেখর পুরোপুরি আইনজীবীর বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে বেরিয়েছিলেন। চোগা চাপকন ও মাথায় পাগড়ি। তিনি দেখলেন যে অন্য গাড়ির পাইক বীরকন্দাজরা আগেই গাড়ি থেকে নেমে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্ৰ পায়ের কাছে রেখে হেঁট মস্তকে দাঁড়িয়ে আছে। বিধুশেখর বাইরে বেরোন কম, আগে কখনো কোম্পানির ফৌজের সামনে পড়েননি, তাই এ সব নিয়ম কেতা জানেন না।
তিনি তাড়াতাড়ি পাগড়ি খুলে সাহেবটিকে আবার সেলাম জানালেন।
অশ্বারোহী সঙ্গে সঙ্গে পেছন ফিরে ধুলো উড়িয়ে আবার ছুটে গেল। কী অপূর্ব দার্ঢ্যময় তেজীয়ান তার ভঙ্গি, যেন চোখের নিমেষে সে আবার ফিরে গিয়ে মিশে গেল মূল বাহিনীর সঙ্গে।
যতক্ষণ ওদের দেখা যায় ততক্ষণ বিধুশেখর এক হাতে পাগড়ি নিয়ে অন্য হাতে সেলামের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলেন। এ জন্য তিনি ক্রুদ্ধ বা বিরক্ত বোধ করলেন না। ইংরেজ এদেশে শান্তি ও ন্যায় নীতি প্রতিষ্ঠা করেছে। তার বিনিময়ে এইটুকু সম্ভ্রম তো তারা দাবি করতেই পারে। রাজার জাতি হিসেবে শক্তিমান ইংরেজের প্রতি বিধুশেখরের রীতিমতন শ্রদ্ধাই আছে, কিন্তু তারা যখন ম্লেচ্ছ শিক্ষা প্রবর্তন কিংবা এ দেশের ধর্মের উপর হস্তক্ষেপ করে, সেগুলিই শুধু বিধুশেখর সহ্য করতে পারেন না।
কোম্পানির ফৌজের জন্য দেড় ঘণ্টা সময় অতিবাহিত করার পর বিধুশেখর আবার যাত্রা শুরু করলেন। এরপর আর কোন বিঘ্ন ঘটলো না। পথে একস্থানে রাত্রিবাস করে কৃষ্ণনগর পৌঁছেলেন পরদিন দ্বিপ্রহরে।
নিজেদের বাড়িতে এসে বিধুশেখরের প্রায় মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ার মতন অবস্থা হলো। তাঁর কন্যা সুহাসিনী তখনো বেঁচে আছে বটে। কিন্তু একেবারে যেন শেষ অবস্থা এবং তার স্বামী দুর্গাপ্রসাদও সমানভাবে পীড়িত। তাদের দুজনেরই কালাজ্বর হয়েছে।
দিবাকররা আগেই পৌঁছে গিয়ে চিকিৎসাপত্রের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করেছে বটে, কিন্তু আশা খুব কম। কালাজ্বর যেন সাক্ষাৎ কালান্তক যম, একবার ছলে আর নিস্তার নেই। যশোর বা খুলনার দিকে হাজার হাজার লোক এই ব্যাধিতে মারা যাচ্ছে, এখন সেই রোগ কৃষ্ণনগরেও এসে উপস্থিত হয়েছে। ইতিমধ্যেই কালাজ্বরের কালগ্ৰাসে পতিত হয়েছে বেশ কয়েকজন।
বিধুশেখর যেন উন্মত্তবৎ হয়ে উঠলেন। এ জীবনে তিনি মৃত্যু কম দেখেননি। মৃত্যু তো জীবের অমোঘ ভবিতব্য, যার যখন যাবার কথা যেতেই হবে। কিন্তু বিধুশেখর যেন কিছুতেই তাঁর প্ৰিয়তমা কনিষ্ঠা কন্যা আর তার স্বামীর বিয়োগ যন্ত্রণা সইতে পারবেন না। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়ের সঙ্গে তাঁর পূর্ব থেকেই পরিচয় ছিল, সেই দেওয়ানজীকে ধরে রাজবাড়ির চিকিৎসককে তিনি আনাবার ব্যবস্থা করলেন। এখানকার একজন পাদ্রীর সুচিকিৎসক হিসেবে সুনাম আছে, তাঁকেও নিয়ে এলেন কাকুতি মিনতি করে। এমনকি এক মৌলভি হেকিমী চিকিৎসককেও নিয়ে আসা হলো। পালা করে দেখতে লাগলেন তাঁরা তিনজনে। কেউই সুনির্দিষ্ট ভরসা দিতে পারছেন না। তবু যেন চলতে লাগলো যমে মানুষের লড়াই।
বিধুশেখর আহার নিদ্ৰা ত্যাগ করলেন। পাশাপাশি দুই শয্যায় শুয়ে আছে সুহাসিনী ও দুর্গাপ্রসাদ। তাদের শিয়রের কাছে আসন নিলেন বিধুশেখর। মাঝে মাঝেই তিনি একবার সুহাসিনী একবার দুর্গপ্ৰসাদের মুখের কাছে মুখ কুঁকিয়ে এনে উদ্গ্ৰীবিভাবে চেয়ে থাকেন, যদি কেউ কোনো কথা বলে। কিন্তু দুজনেরই বাকরোধ হয়ে গেছে।
সেই রাত কেটে গেল, পরের দিনেও একই অবস্থা। দুজনেরই যেন মৃত্যুর রঙ মাখা পাণ্ডুর মুখ, সামান্য নাড়ীর স্পন্দনে শুধু তাদের জীবনের স্পন্দন টের পাওয়া যায়। কবিরাজী, ইংরাজী ও হেকিমী এই তিন প্রকার ওষুধের তীব্র ঝাঁঝেই সম্ভবত তাদের প্রাণপাখি খাঁচা ছেড়ে বেরুতে পারছে না। তবে আর একটা রাত কাটবে কী না সন্দেহ।
সেই রাতে, রোগীদের ঘরে একা একা ঠায় বসে থেকে এক সময় বুঝি বিধুশেখরের তন্দ্ৰা এসে গেল। তিনি নিজেও সেটা বুঝতে পারলেন না। তাঁর ধারণা, তিনি তখনো জেগে আছেন।
বিধুশেখর দেখলেন, হঠাৎ সমস্ত ঘর এক দিব্য আলোয় ভরে গেল, এক স্বর্গীয় সৌরভে আমোদিত হলো সেই বন্ধ ঘরের বার্তাস। তারপর আস্তে আস্তে ফুটে উঠলেন এক জ্যোতির্ময় পুরুষ।
বিধুশেখর মনে করলেন, এই বুঝি যমরাজ। স্বয়ং এসেছেন তাঁর কন্যা জামাতাকে নিয়ে যেতে।
তিনি হাতজোড় করে বললেন, প্ৰভু, দয়া করুন, যদি সারা জীবনে কিছু সৎ কর্ম করে থাকি, তবে তার বিনিময়ে এই দুজনের প্রাণ ভিক্ষা দিন।
তখন সেই মূর্তি বললেন, বিধু, চেয়ে দ্যাখো।
বিধুশেখর ভালো করে দেখে তাঁর ভ্ৰম বুঝলেন। ইনি তো যমরাজ নন, ইনি তো স্বয়ং জনাৰ্দন, চার হাতে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম, মুখে মায়া-রহস্য-কৌতুক মেশা হাসি। ঠিক বিধুশেখরের গৃহদেবতার বেশে ইনি এসেছেন। তখন অপূর্ব এক পুলকে বিধুশেখরের শরীর রোমাঞ্চিত হলো। তাঁর জীবন আজ ধন্য। জগৎপতি জনাৰ্দন তাঁকে দেখা দিয়েছেন, আজ এই সঙ্কটের রাত্রে, তবে তো আর ভয় নেই। বিধুশেখর আচ্ছন্নের মতন মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্ৰণাম করলেন। পুনবার মাথা তুলতে তাঁর ভয় হলো। যদি সেই মূর্তি আর দেখতে না পান।
তবু, মুখ তুলে দেখলেন। সেই মূর্তি সেই রকমই স্ফরিত হাস্যে তাঁর দিকে চেয়ে আছেন।
বিধুশেখর বললেন, হে গিরিধারী, মধুকৈটভহারি, দয়াল, দীনবন্ধু, আমায় ভিক্ষা দিন!
জ্যোতির্ময় পুরুষ বললেন, আমি তো দিতেই এসেছি।
বিধুশেখর বললেন, আমার প্রাণসম কন্যা, আমার জামাতা—
যে হাতে পদ্ম ধরা, সেই হাতের একটি আঙুল দেখিয়ে সেই জ্যোতির্ময় পুরুষ বললেন, একজন! বিধুশেখর বুঝতে পারলেন না। হতবুদ্ধির মতন তাকিয়ে রইলেন।
সেই জ্যোতির্ময় পুরুষ আবার বললেন, যে কোনো একজন। তুমি বেছে নাও, আমি যে কোনো একজনের প্রাণভিক্ষা দেবো!
বিধুশেখরের সবঙ্গে কেঁপে উঠলো। তিনি কোনো কথাই আর বলতে পারলেন না। যে কোনো একজন? তিনি কার প্রাণভিক্ষা চাইবেন? সুহাসিনীর? কিন্তু দুর্গাপ্ৰসাদ?
বিধুশেখর দেখলেন সেই জ্যোতির্ময় পুরুষের দেহটি যেন দীপশিখার মতন একটু একটু কাঁপছে। হয়তো এখুনি আবার মিলিয়ে যাবেন।
বিধুশেখর ক্ৰন্দন মিশ্রিত ব্যাকুল গলায় বললেন, প্ৰভু, আমার পুত্র নেই, এই জামাতাই আমার পুত্রের স্থান নিয়েছে, আর সুহাসিনী আমার দুই নয়নের মণি, তাকে ছেড়ে আমি-তার গর্ভধারিণীও আর বাঁচবেন না—
জ্যোতির্ময় পুরুষের মূর্তিটি আরও বেশী কাঁপছে। সত্যিই বুঝি মিলিয়ে যাবার আর দেরী নেই। জলদগম্ভীর স্বরে তিনি বললেন, একজন!
মুহূর্তে মনস্থির করে ফেললেন বিধুশেখর। সুহাসিনীর মাত্র তের বৎসর বয়েস, দুর্গাপ্রসাদ মারা গেলে তার সামনে পড়ে থাকবে দীর্ঘ বৈধব্য জীবন। কন্যাদের বৈধব্য দশা দেখে দেখে আর বিধুশেখর সহ্য করতে পারছেন না, বিধবা অবস্থায় সুহাসিনী যদি ভ্ৰষ্টা হয়, যদি কুলে কালি দেয়, তাহলে ইহকাল পরকাল সব যাবে। দুর্গাপ্রসাদ পুরুষ মানুষ, পত্নী বিয়োগের দুঃখ সে সামলে উঠতে পারবে, সে বুদ্ধিমান, কৃতবিদ্য, এক জীবনে তার আরও অনেক কিছু পাবার থাকবে। কিন্তু সুহাসিনীর যে কিছুই থাকবে না।
বিধুশেখর বললেন, দুর্গাপ্রসাদ—
জ্যোতির্ময় পুরুষ সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেলেন। সেই দিব্য আলো ও দিব্য সৌরভও অন্তহিঁত হলো। প্রদীপের মৃদু আলোক ও ধোঁয়ায় মাখা ঘরখানি আগেকার চেহারা ফিরে পেল আবার।
বিধুশেখর যেন এই অন্তর্ধান সহ্য করতে পারলেন না। আর একবার দর্শন পাবার বাসনায় ছুটে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। প্ৰভু প্ৰভু বলে চিৎকার করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পড়ে গেলেন হুড়মুড়িয়ে।
নীচতলায় দিবাকর ও অন্য লোকজনরা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলো শব্দ শুনে। তারা দেখলো, বিধুশেখর বাহ্যজ্ঞানহীন। তাঁকে ধরাধরি করে এনে শুইয়ে দেওয়া হলো একটি খাটে। একজন ছুটে গেল রাজবৈদ্যকে ডেকে আনতে। অন্যরা বিধুশেখরের মাথায় জল ঢালতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পর বিধুশেখরের চৈতন্য হলো কিন্তু কোনো কথা বলতে পারলেন না। শুধু মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ শব্দ বার করতে লাগলেন। সবাই মনে করলো, বিধুশেখরকে ওলায় ধরেছে। ঘুমের মধ্যে অনেক সময় এরকম হয়।
বিধুশেখরকে জোর করে তুলে বসিয়ে দুজনে দুদিকে চেপে রইলো আর দিবাকর ওঁর কানে রাম নাম শোনাতে লাগলো।
এক সময় বিধুশেখর পুরোপুরি জ্ঞান ফিরে পেলেন। স্বাভাবিক স্বরে বললেন, আমায় ধরে আছিস কেন? ছেড়ে দে!
তারপরই হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে দিবাকরকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ওরে, আমি কী দেকলুম! আমি কী দেকলুম!
কঠোর ব্যক্তিত্ব ও আত্মমযাদাসম্পন্ন বিধুশেখরকে এইভাবে কাঁদতে কেউ কখনো দেখেনি। সুহাসিনীর ঠিক আগের বোনটিরও তো মৃত্যু হয়েছে বিধুশেখরের সামনেই, তখনো তো এমন দুর্বল হয়ে পড়েননি তিনি।
রাজবৈদ্য যখন এলেন, তখনই বিধুশেখর আপনমনে অশুপুত কণ্ঠে বারবার বলে যাচ্ছেন, আমি কী দেকলুম! আমি কী দেকলুম!
রাজবৈদ্য ওপরে এসে পরীক্ষা করে বুঝলেন, সুহাসিনী ও দুর্গাপ্ৰসাদের অবস্থা একই রকম আছে। দুজনেরই এখনো নাড়ীর স্পন্দন পাওয়া যায়। তাহলে বিধুশেখর হঠাৎ এত কান্নাকাটি করছেন কেন?
দেবতাদের কী অপূর্ব লীলা! মানুষকে যে তাঁরা কত রকম পরীক্ষায় ফেলেই দেখতে চান, তার আর কোনো ইয়ত্তা নেই।
পরদিন সকালেই দুর্গাপ্ৰসাদ মারা গেল এবং সুহাসিনী ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলো। দুদিনের মধ্যেই সুহাসিনীর মৃত্যু আশঙ্কা কেটে গেল একেবারে। সে যে ইতিমধ্যে বিধবা হয়ে গেছে তা সে জানতেও পারেনি।
বিধুশেখর একেবারে বিমূঢ় হয়ে পড়লেন। এ কী হলো? তিনি তো দুর্গাপ্ৰসাদেরই জীবন ভিক্ষা চেয়েছিলেন। তবে কি সেটা তাঁর মনের কথা ছিল না? সর্বজ্ঞ ভগবান কি তাঁর মনের কথা বুঝেই বিপরীত বর দিয়ে গেলেন? কিন্তু গর্ভবতী অবস্থায় বিধবা হয়ে সুহাসিনী দীর্ঘ বিড়ম্বিত জীবন নিয়ে কী করবে? বালবিধবার পক্ষে মৃত্যুই যে আশীর্বাদ।
সুহাসিনী তখনও শয্যাশ্রিতা, উঠে দাঁড়াবার মতন পায়ের জোর পায়নি, সেই অবস্থাতেই তার হাতের শাঁখা ভেঙে, সিথের সিঁদুর মুছে দেওয়া হলো। কৃষ্ণনগরের স্থানীয় কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি পরামর্শ দিয়েছিলেন, আর কয়েকটা দিন যাক, রুগণা মেয়েটিকে এখনই এমন নিদারুণ শোক সংবাদ জানাবার দরকার নেই।
কিন্তু বিধুশেখর এমন অনাচার হতে দিতে পারেন না। স্বামীর শবদেহ দাহ করা হয়ে গেছে। তার পরেও কোনো হিন্দু রমণী শাঁখা সিঁদুর পরে থাকতে পারে না। সেকালের মুনি-ঋষিরা মুখ ছিলেন না। তাঁরা যা নির্দেশ দিয়ে গেছেন, অনেক ভেবেচিন্তেই দিয়েছেন। একজনের পাপে সমগ্র সমাজ ছারেখারে যেতে পারে। ঠাকুর যখন পরীক্ষায় ফেলেছেন, তখন সব কিছু জেনেই বিধুশেখরকে সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার চেষ্টা করতে হবে। সত্যিকারের পুরুষকার যদি থাকে, তাহলে নিয়তির মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে, কোনো কিছুতেই ভয় পেলে চলবে না। বিধুশেখর ভয় পান না।
গলায় জোর নেই, তাই সুহাসিনী ড়ুকরে কাঁদতে পারলো না। ওষ্ঠ দংশন করে সে চোখের জলে বালিশ ভেজাতে লাগলো। মাত্র তের বৎসর বয়েস হলেও বৈধব্য যন্ত্রণা কী বস্তু, তা সে জানে। সে তার দিদি বিন্দুবাসিনীকে দেখেছে।
কন্যাকে নিয়ে আড়াই মাস কাল কৃষ্ণনগরেই থেকে গেলেন বিধুশেখর। চিকিৎসকের নির্দেশ মতন তখনও সুহাসিনীকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া চলে না। অনেক প্রয়োজনীয় কাজ থাকা সত্ত্বেও বিধুশেখর ফিরতে পারলেন না। কন্যাকে কার ভরসায় রেখে যাবেন? কলকাতার সঙ্গে সংবাদ আদান-প্ৰদান চলে নিয়মিত। তাঁর পত্নী সৌদামিনী এখন একটু সুস্থই আছেন। দুর্গাপ্ৰসাদের মৃত্যু সংবাদ তাঁকে জানানো হয়নি।
তারপর এক রাত্ৰে সুহাসিনীর প্রসব বেদনা উঠলো। এবং যথা সময়ে সে জন্ম দিল একটি পুত্রসন্তানের। পুত্ৰ! প্রায় পঞ্চাশ বৎসর পর বিধুশেখরের বংশে এই প্রথম পুত্ৰ সন্তান এলো। আর এই পুত্রটি গর্ভে থাকা অবস্থায় বিধুশেখর তাঁর কন্যার মৃত্যু কামনা করেছিলেন।
সেকথা চিন্তা করেই বিধুশেখর শিহরিত হলেন।