৩০ এপ্রিল শেষ দিন
সকালবেলা জেনারেলরা বার্লিনের ভিন্ন ভিন্ন অংশের খবর নিয়ে মন্ত্রণাসভায় এলেন। অবস্থা আগের চেয়ে সামান্য একটু ভালো, কিন্তু হরেদরে সেই পুরনো কাহিনীজনরা যদি অসীম বিক্রমে কোনও এক অংশে একটুখানি এগোয় তবে কশা আর পাঁচটা দুর্বল জায়গায় তারও বেশি এগিয়ে আসে।
হিটলার আগের রাত্রে যে শেষ টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন তার উত্তর আসেনি, আর বরমান হিটলারের অনুমতিতে বিনানুমতিতে গণ্ডায় গণ্ডায় যেসব টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন তারও কোনও উত্তর নেই।
দুপুরবেলার মন্ত্রণাসভা হিটলারের জীবনের শেষ সভা। এবং সে-সভায় যে খবর সব এল সে-রকম দুঃসংবাদ তিনি জীবনে আর কখনও শোনেননি (এবং শুনতেও হবে না)। রাষ্ট্রভবন থেকে উত্তরে বেরোবার পথে খোল। তার ভাইডেনডামার ব্রিজের কাছে রুশরা এসে গেছে (এই পোলের উপর দিয়েই বমান এবং কয়েকজন পরের দিন বার্লিন থেকে বেরুনোর চেষ্টা করেছিলেন। অর্থাৎ উত্তরের পথও বন্ধ হল। এবং রাষ্ট্রভবনের এক কোণ যে ফস ব্রিটে এসে ঠেকেছে তার অন্য প্রান্তে টানেলের কিছুটা রুশরা দখল করে ফেলেছে। নির্লিপ্ত নিরাসক্ত চিত্তে হিটলার সঞ্জয়-বার্তা শুনে গেলেন।
দুটোর সময় হিটলার লাঞ্চ খেতে বসলেন। এফা আসেননি।
তিনি যে মানসিক চঞ্চলতা ও উত্তেজনায় কাতর হয়ে পড়েছিলেন সেকথা লিঙে বলেছেন। ট্রেভার রোপার ঐতিহাসিক। মানুষের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ নিয়ে তার কারবার কম– বিশেষ করে এফা যখন ইতিহাসে কোনও অংশ নেননি, তখন তিনি যে তাকে কিঞ্চিৎ অবহেলা করবেন সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু লিঙে ভ্যালে। তিনি তাঁর বিবৃতিতে যে এফার জন্য একটু বেশি স্থান দিয়েছেন সেটা কিছু বিস্ময়জনক নয়। লিঙে বলেছেন, ওই শেষের দিনেও তিনি লিঙেকে অনুরোধ করেন, হিটলারকে বুঙ্কার ত্যাগ করার জন্য চেষ্টা দিতে। এস্থলে অন্য আরেকটি ব্যাপারে ট্রেলার রোপারের সঙ্গে লিঙের কাহিনী মেলে না। ট্রেভার রোপারের মতে গ্যোবেল আগাগোড়া হিটলারকে বার্লিন ত্যাগ না করতেই উপদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু লিঙের বিবরণী থেকে জানা যায়, গোড়ার দিকে না হোক, অন্তত শেষের দিকে তিনি পর্যন্ত লিঙেকে এফারই মতো অনুরোধ জানান, লিঙে যেন হিটলারকে বার্লিন ত্যাগ করার কথা বোঝান। লিঙে নিশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, তিনি ফুরারের মন্ত্রী ও নিত্যালাপী হয়েও যে কর্ম সমাধান করতে পারেননি, সামান্য লিঙে সেটা করবেন কী প্রকারে?
লাঞ্চের পর হিটলার যখন বিশ্রাম করছেন তখন ফ্রাউ (মিসেস) গ্যোবেল লিঙের হাতে একখানা চিরকুট দেন হিটলারের জন্য। শেষবারের মতো একবার দেখা করে যেতে। হিটলার প্রথমটায় কুঞ্চিত করে পরে সেদিক পানে চললেন। সিঁড়িতে গ্যোবেলসের সঙ্গে দেখা। তিনি হিটলারকে মত পরিবর্তন করতে বললেন। হিটলার অনিচ্ছা জানিয়ে আন বুঙ্কারে ফিরে এলেন।
এ ঘটনার উল্লেখ আর কেউ করেননি, কারণ লিঙে ভিন্ন আর সবাই ওপারে। ইতোমধ্যে হিটলারের অন্তরতম অন্তরঙ্গ জনা পনেরো বুঙ্কারের করিডরে দাঁড়িয়ে আছেন। হিটলার ও ফ্রাই হিটলার (এফা) তাদের সঙ্গে নীরবে একে একে করমর্দন করলেন। এই শেষ বিদায়। ফ্রাউ গ্যোবে উপস্থিত ছিলেন না। সন্তান কটির আসন্ন মৃত্যুর কথা ভেবে তিনি ভেঙে পড়েছিলেন।
বুঙ্কারে সৈন্যসামন্ত এবং তজ্জনিত রূঢ় কঠোর বাতাবরণের ভিতর এসব সুন্দর মধুর বাচ্চাদের দেখাত যেন অন্য কোনও জগতের কোনও বেহেশতের ফিরিশতা দেবদূতের মতো। তারা এর থেকে ওঘরে ছুটোছুটি করত। এক বুঙ্কার থেকে অন্য বুঙ্কারে যেতে হলে যেখানে দেশের প্রধান সেনাপতি কাইটেলকেও পাস দেখাতে হত সেখানেও তাদের অবাধ গতি। যে কদিন পাইলট নারী হানা রাইটশ বুঙ্কারে ছিলেন তারা তার কাছ থেকে কোরাস্ গান শিখেছে। তাদের কী ভয় ওই তো কাকা অ্যাডলফ রয়েছেন। তিনি ঈশ্বরের মতো (ঈশ্বর জাতীয় কুসংস্কার গ্যোবেলস্ দম্পতি হয়তো বাচ্চাদের জন্য ব্যান করে দিয়েছিলেন? সর্বশক্তিমান এই তো তারা জনের প্রথম দিন থেকে জানে। কাকা হিটলারের অনুকরণে তাদের প্রত্যেকের নাম, এইচ অক্ষর দিয়ে আরম্ভ।
শেষ বিদায় নেবার পর একমাত্র তারাই করিডরে রইলেন যারা হিটলারের শেষকৃত্য সমাধা করবেন, অন্যদের বিদায় দেওয়া হল।
হিটলার ও এফা তার পর তাদের খাস কামরাতে ঢুকে দরজা বন্ধ করতেই,-লিঙে তার বৃতিতে বলেছেন তিনি হঠাৎ কী এক অজানা ভয়ে করিডর দিয়ে ছুটে পালালেন। অল্পক্ষণের ভিতরই কিন্তু তার মাথা ঠাণ্ডা হল। তিনি ধীর পদক্ষেপে ফিরে এলেন।
এর পরের ঘটনা দিয়ে, আমরা এ-প্রবন্ধ আরম্ভ করেছি। মাত্র একটি গুলি ছোঁড়ার শব্দ শোনা গেল, এবং লিঙে বলছেন পোড়া বারুদের কটু গন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে ভেসে এল।
খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে লিঙে, গ্যুনশে, বরমান, গ্যোবেলস ইত্যাদি ঘরে ঢুকলেন এবং যা দেখতে পেলেন তা পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে।
মৃতদেহ দুটি পোড়াবার জন্য দশ লিটার পেট্রল অনছে সেদিন সকালেই হিটলার তার অ্যাডজুটান্ট গনশেকে আদেশ দিয়েছিলেন। গুনশে হিটলারের ড্রাইভার কেস্পকাকে সে আদেশ জানালে তিনি বলেন, অতখানি পেট্রল জোগাড় করা সম্ভব হবে না (রুমানিয়া রাশান হাতে চলে যাওয়ার পর বার্লিন আর কোনও পেট্রল পায়নি)। অবশেষে পেতে হবেই হবে আদেশ এলে কেম্পকা অতি কষ্টে ১৮০ লিটার পেট্রল টিনে করে বুঙ্কারের বাইরে বাগানে পাঠিয়েছিলেন। শেষ রেস্ত খতম না হওয়া পর্যন্ত হিটলার যে জুয়োখলা বন্ধ করেননি, সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
সকাল থেকেই অন্যান্য বুঙ্কার থেকে হিটলার-বুঙ্কারে আসার সব-কটা পথ তালা মেরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল যাতে করে অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং প্রয়োজনীয় জন ভিন্ন অন্য কেউ ঘুণাক্ষরেও কিছু টের না পায়।
হিটলারের আপন সৈন্যবাহিনী এসএস, সৈন্য ও লিঙে হিটলারের দেহ কষলে জড়িয়ে নিলেন- রক্তমাখা মাখা-মুখ ঢাকবার জন্য। পরিচিত কালো পাতলুন পরা পা দুখানা দেখে করিডরে আর সবাই অনায়াসে ইনি যে হিটলার সেকথা বুঝতে পারলেন। চার দফে সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে এরা পঞ্চাশ ফুট উপরে খোলা বাগানে বেরুলেন। ইতোমধ্যে বরমান এফার দেই তুলে নিলেন। তিনি বিষ খেয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন বলে তার দেহে কোনও রক্তের দাগ ছিল না, এবং দেহটিকে ঢাকবার প্রয়োজন হয়নি। বাগানে এনে তার দেহ হিটলারের দেহের পাশে শোয়ানো হল।
কিন্তু ইতোমধ্যে একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেল। মাটির উপরে বুঙ্কারে যে প্রহরা মিনার ছিল সেখান থেকে প্রহরারত মানুফে নিচে সন্দেহজনক দ্রুত চলাফেরা; দরজা খোলাবন্ধ কার শব্দ শুনতে পেল। প্রহরীর কর্তব্য অনুযায়ী অনুসন্ধান করতে নিচে এসে বুঙ্কারের সামনে সে খেল ধাক্কা শবযাত্রার সঙ্গে। এফাকে সে পরিষ্কার চিনতে পারল এবং কম্বলে ঢাকা শরীর থেকে কালো পাতলুন পরা দুখানা পা ঝুলছে দেখতে পেল। সঙ্গে বরমান, জেনারেল কুড (পূর্বের সেই পাড় মাভাল), দানব সাইজের অ্যাডজুটান্ট গুশে, ভ্যালে লিঙে। গুশে হুঙ্কার দিয়ে মাসূল্টেকে সরে যেতে বলল। অদর্শনীয় চিত্তাকর্ষক ব্যাপার দেখা হয়ে গেল মাফেক্টের।
বরমান সম্প্রদায় সব আটঘাট বেঁধে ভেবেছিলেন সাবধানের মার নেই।
সপ্রমাণ হল মারেরও সাবধান নেই।
অনুষ্ঠান আবার চলল।
বুঙ্কারের দরজার উপর পর্চ ছিল। দরজা থেকে কয়েক হাত দূরে দুটি লাশ মাটিতে বইয়ে তার উপর পেট্রল ঢালা হল। এমন সময় রাশান কামানের বোমা এসে পড়তে লাগল বলে শবযাত্রীরা পর্চের তলায় আশ্রয় নিলেন। ট্রেভর রোপারের মতে গুশে একখানা ন্যাকড়াতে পেট্রল ভিজিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে সেটা লাশদের উপর ছুঁড়ে ফেললেন। লিঙে বললেন, তিনি খবরে কাগজে আগুন ধরিয়ে ছুঁড়ে মারেন। সঙ্গে সঙ্গে আগুন জ্বলে উঠে লাশ দুটো ঢেকে ফেলল। পর্চে দাঁড়িয়ে শবযাত্রী দল হিটলারকে শেষ মিলিটারি সেলুট দিলেন। তার পর তারা বুঙ্কারের ভিতরে ফিরে গেলেন।
কারনাও নামক আরেকজন সাধারণ প্রহরীরও এসব গোপন অনুষ্ঠান দেখবার কথা নয়। বুঙ্কারের ভেতরকার দরজা তালাবন্ধ দেখে সে-ও বাগানের দিক দিয়ে ঘুরে আসার চেষ্টা করে মোড় নিতেই আশ্চর্য হল। হঠাৎ সামনে দেখে দুটি মৃতদেহ পাশাপাশি শুয়ে। সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো দপ করে জ্বলে উঠল–বুঙ্কার মিনারের পর্চে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল বলে সে দেখতে পায়নি, ওখান থেকেই জ্বলন্ত ন্যাকড়া, কাগজ ছুঁড়ে লাশে আগুন ধরানো হয়েছে। খানিক পর আগুন একটু কমে যেতে সে পরিষ্কার চিনতে পারল ভগ্ন-মুণ্ড হিটলারের দেহ। প্রহরী কানাও কিন্তু সেখানে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারল না। পরে সে বলে, বীভৎসতম দৃশ্য। গুশের মতো বিরাট-দেহ দানব তাবৎ জৰ্মনিতেই কম ছিল। অল্পেতে বিচলিত হবার পাত্র নয়। সে পর্যন্ত বলে, হিটলারের দেহ-দাহ-দর্শন আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা।
প্রহরা পুলিশের এক তৃতীয় ব্যক্তি এই ঐতিহাসিক দৃশ্য দেখবার জন্য বুঙ্কারের পর্চে গিয়ে দাঁড়ান কিন্তু মনুষ্যদেহ-বসা পোড়ার দারুণ উৎকট দুর্গন্ধ তাঁকে সেখান থেকে পালাতে বাধ্য করে।
মিনারের ঘুলঘুলি দিয়ে মানুফেক্ট ও কানাও দেখতে পান, কিছুক্ষণ পরে পরে এনএস-এর লোক বুঙ্কার থেকে বেরিয়ে চিতাতে আরও পেট্রল ঢেলে দিচ্ছে। তার পর দুজনাতে নিচে নেমে এসে দেখেন, লাশগুলোর পায়ের দিকটা পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে এবং হিটলারের হাঁটুর হাড় দেখা যাচ্ছে। একঘন্টা পরে তারা ফের এসে দেখেন আগুন তখনও জ্বলছে, কিন্তু তেজ কম।
হিটলার আত্মহত্যা করেন অপরাহ সাড়ে তিনটেয় লিঙের হিসাবে তিনটে পঞ্চাশে। খুব সম্ভব বিকেল চারটে থেকে সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে ছটা অবধি ট্রেল ঢালা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্ট্রেল ফুরিয়ে যাবার পরও দেখা যায়, দেহদুটো পুড়ে ছাই হওয়া দূরে থাক, মাসচাম পুড়ে গিয়ে কালো হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও হিটলারকে যারা কাছের থেকে দেখেছেন তারা তখনও তাকে চিনতে পারবেন।
শবদাহকারীগণ পড়লেন বিপদে। হিটলার এ পরিস্থিতির সম্ভাবনা মনশ্চক্ষে দেখেননি এবং সে অনুযায়ী কোনও নির্দেশও দিয়ে যাননি। লিঙে তাঁর বিবৃতিতে হক কথা বলেছেন : পেট্রল দিয়ে মানব-দেহ পোড়ানো তো সহজ কর্ম নয়, হিটলার কেরোসিনের ব্যবস্থা করে গেলেন না কেন? লাশ পোড়ানোর অভিজ্ঞতা ভারতের বাইরে কম লোকেরই আছে। এটা যে কত কঠিন কর্ম সেটা ফেসব নাৎসি গ্যাস-চেম্বারের লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরে পরে বিরাট বিরাট চুল্লিতে এদের লাশ পোড়ান, তাঁরা ননবের্গের মোকদ্দমায় জবানবন্দির সময় এ কথার উল্লেখ করেছেন। এঁদের কর্তা বলেন, হাজারখানেক মানুষ গ্যাস দিয়ে মারতে আমাদের বারো মিনিটেরও বেশি সময় লাগত না, কিন্তু সেগুলো পুড়িয়ে ভস্মীভূত করা ছিল অতিশয় কঠিন ব্যাপার। আমাদের চুল্লিগুলো দিনের পর দিন চব্বিশ ঘণ্টা চালু রেখেও এদের নিশ্চিহ্ন করতে পারতুম না। বিস্তর হাড় চুল্লির তলায় পড়ে থাকত। অন্য এক সাক্ষী বলেন, সর্বাপেক্ষা মারাত্মক ছিল চুল্লির ধুয়ো। মানুষের পুড়ে-যাওয়া ছাই চিমনি দিয়ে বেরিয়ে বাতাসে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে আমাদের নাকে-কানে পোশাক-আশাকে সর্বত্র ঢুকে পড়ত। পাশের এবং দূরের গায়ের লোকগুলো পর্যন্ত বুঝে যায় যে আমরা কোন ব্যবসাতে লিপ্ত আছি।
হিটলারের অনুচরবর্গ ভাবলেন, তার প্রধান বাসনা ছিল তার দেহ যেন শক্তহস্তে বর্বর তামাশার বস্তু না হয়; অতএব তাকে যদি খুব গোপনে গোর দেওয়া হয়, তবে ইহুদি ও রুশরা ভার স্বল্পদ দেহ খুঁজে পাবে না। সন্ধ্যা মিলিয়ে যাওয়ার পর পুলিশকর্তা রাটেনহুবার গার্ডদের বুঙ্কারে ঢুকে সেখানকার সার্জেন্টকে বলল, হিটলার দম্পতির লাল গোর দেবার জন্য তিনজন বিশ্বস্ত লোন্দ্রে প্রয়োজন। তাদের নিয়ে যেন তিনি আসেন। এঁদের শপথ করানো হল, তারা সবকিছু গোপন রাখবেন। নইলে তাদের গুলি করে মারা হবে।
এদের একজনের নাম মেঙে হাউজ ও অন্যজন গ্ল্যান্সার। দ্বিতীয়জন বার্লিনের রাস্তায় যুদ্ধে মারা যান, এবং প্রথমজন রুশহস্তে বন্দি হয়ে রুশদেশে দশ বছর কাটিয়ে পশ্চিম জর্মনিতে ফিরে আসেন। তিনি বলেন, হিটলারের শরীর সম্পূর্ণ পুড়ে যাওয়া দূরে থাক, তাঁকে তখনও চেনা যাচ্ছিল।
বাগানে চিতার কাছে বোমা পড়ে একটা গর্ত হয়েছিল। মেডে হাউজ ও গ্লান্সার সেটাকে একটা ডবল গোরের সাইজে তিন ফুট গভীর করে খুঁড়লেন। তলায় তক্তা পেতে তার উপর লাশ দুটি রেখে উপরে মাটি চাপা দেয়া হল।
লিঙে ও রাটেনহুবার রুশদেশে দশ বত্সর বন্দিদশায় কাটিয়ে ফিরে এসে বলেন, তারা ঠিক গোরের সম্মুখে উপস্থিত ছিলেন না বটে তবে বাগানের একটা বোমাতে বানানো গর্তে যে উভয়ের কবর দেওয়া হয় সেটা সত্য। রাটেনবার তার সঙ্গে যোগ দিয়ে বলেন, শেষ মিলিটারি সম্মান দেবার জন্য তার কাছে একখানা স্বস্তিক (হাকেয়ে— হুট ক্রস) পতাকা চাওয়া হয়, কিন্তু তিনি জোগাড় করতে পারেননি।
মধ্যরাত্রে প্রহরী মানসূফেল্ট প্রহরায় ফিরে এসে আবার মিনারে চড়ল। রাশান বোমা তখনও চতুর্দিকে পড়ছিল ও বিমানবাহিনী আকাশে হাউই ফাটাচ্ছিল। তারই আলোকে সে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল, লাশদুটো নেই, এবং বোমাতে খোঁড়া এবড়ো-খেবড়ো গর্তটা পরিপাটি লম্বমান চতুষ্কোণ গোরের আকারে নির্মিত হয়েছে। তার মনে কোনও সন্দেহ রইল না, এটা মানুষের হাতের দক্ষ কাজ; আকাশ বা কামান থেকে বোমা পড়ার ফলে এরকম সুবিন্যস্ত নমুনা তৈরি হতে পারে না।
ওদিকে তার সহকর্মী কারও রাষ্ট্রভবনের কাছে সঙ্গীদের নিয়ে প্রহরার রোদে বেরিয়েছিল। এদের একজন তাকে বলল, ভাবতে দুঃখ হয়, অফিসারদের একজনও ফুরারের দেহ কোথায় রইল না-রইল সে-সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন। আমি তার দেহ কোথায় আছে জানি বলে গর্ব অনুভব করি। (লোকটি হয় মেঙেরস হাউজন, নয় গ্লানৎসার)।
কিন্তু যে-ই হোক, লোকটির বাক্যটি ন’সিকে খাঁটি। হিটলারের মৃত্যুর পর থেকে বাকি সব ব্যবস্থা অত্যন্ত অবহেলা ও দরদহীনভাবে করা হয়। এমনিতে জর্মনরা অত্যন্ত পাকা কাজ করতে অভ্যস্ত। তা হলে এমনটা হল কেন? খুব সম্ভবত লোকে যে বলে হিটলার তার সাঙ্গোপালকে (এমনকি বহু বিদেশিকেও) মন্ত্রমুগ্ধ, প্রায় মেয়েরাইজ করে রাখতেন সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা নয়। সেই ভানুমতীর ভোজবাজির সঙ্গে সঙ্গে যখন ম্যাজিসিয়ান হিটলার-ভানুমতীও অন্তর্ধান করলেন তখন তারা হঠাৎ সচেতন হল, তাদের বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে। অন্ধ হোক সত্য বিশ্বাস হোক, এতদিন শুরুর পর তারা তাদের ভবিষ্যৎ ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু এখন ঈ ফর হিমসেল অ্যান্ড ডেভিল টেক দি হাইভমোস্ট– চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা, আর শয়তান নিক যেটা সক্কলের পিছনে, যেটা অগা কাঁচা। বরমান অবশ্য তখন নেতৃত্ব গ্রহণ করেন, কিন্তু বুঙ্কারের অন্যতম অধিবাসী– সে বেচারি লাটবেলাট কিছুই না, এমনকি সামান্য আগডোম বাঘডোমের ডোম সেপাইও নয়, সে নগণ্য দরজি, ইউনিফর্ম বানায়, বিপুক করে– সে বলে, নেতৃত্ব কখনও এক কানাকড়িও ছিল না, লোকগুলো হেথাহোথা ছুটোছুটি করছিল মুকাটা মুরগির মতো। কিন্তু সেটা তার পরের অধ্যায়ের কাহিনী- সেটা আমি লিখতে যাচ্ছিনে।
আমি শুধু হিটলারের গোর দেওয়ার পরের একটি ঘটনা উল্লেখ করব। আনাড়ি হাতে হিটলার-এফার শবদেহ পোড়ানোর অপটু প্রচেষ্টা যথেষ্ট বীভৎস, এটা বীভৎস ও নিষ্ঠুর।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি, সেই রাত্রেই বুস্কারবাসীর পক্ষ থেকে রুশদের সঙ্গে সন্ধির প্রস্তাব নিষ্কল হয়। শেষ নিলতার খবর আসে পরদিন, ১ মে, দুপুরের দিকে।
এবং পূর্বেই বলেছি, গ্যোবেল স্থির করেন যে তিনি সপরিবার আত্মহত্যা করবেন। এখন সে সময় এসেছে। তিনি সকলের সঙ্গ ত্যাগ করে সপরিবার আপন বুঙ্কারে চলে গেলেন। কোনও কোনও বন্ধু সেখানে তার কাছ থেকে শেষ বিদায় নিয়ে নিলেন।
লিঙে বলেন– ট্রেভার রোপার এ-বাবদে স্বল্পভাষী– গ্যোবেলস্ হিটলারের সার্জন ডাক্তার সুমফেগারকে ডেকে পাঠালেন। তিনি ভিতরে ঢুকতেই গ্যোবেলস্ দম্পতি বেরিয়ে এলেন। ভিতরে কী হল কেউ সঠিক জানে না।
কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার সিঁড়ির কাছে বেরিয়ে এসে ফ্রাউ গ্যোবেলুসের দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়লেন–অর্থ, হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে ফ্রাউ গ্যোবেলস্ অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন।
ভিতরে কী হয়েছিল, কেউ জানে না, জানবেও না। কারণ ডাক্তার ও গ্যোবেল পরিবারের কেউই বেঁচে নেই। জনশ্রুতি, ডাক্তার যখন ঘরে ঢুকলেন তখন বাচ্চারা কফি খাচ্ছে। তাদের সঙ্গে তার হৃদ্যতা ছিল; তিনি বললেন, কফি খাওয়া শেষ হলেই তোমাদের সবাইকে নানা রঙের লজেফুস দেব। নতুন ধরনের লজেন্স। বাচ্চারা সাত-তাড়াতাড়ি তাদের কফি, কোকো, দুধ শেষ করল। তিনি বিষে-ব্রা লজেন্স দিলেন। নিজে অন্য ধরনের একটা নিলেন। সব্বাইকে একসঙ্গে মুখে পুরতে হবে। ব্যস হয়ে গেল।…অন্যেরা বলেন, ইনজেকশন দেন, এবং সবচেয়ে বড় মেয়েটি নাকি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নেবে না বলে ধস্তাধস্তি করেছিল। এসব জনশ্রুতির মূলে কী ছিল যে পাষণ্ড এরকম হীন কাজ করতে পারে সে হয়তো বুঙ্কারে তার পরিচিতদের ভিন্ন জনকে স্নি কথা বলেছিল। যে এসব করতে পারে তার পক্ষে বলাটা আর এমন কী কঠিন কর্ম? কিংবা হয়তো তার এসিসটেন্ট ব্যাপারটা বুঝে গিয়েছিল এবং জনশ্রুতিগুলোর মধ্যে একটা হয়তো তার।
এবং আরেকটা কথা বুঙ্কারের প্রায় সবাই জানতেন। একাধিক রমণী গ্যোবেলুদের সব কটি সন্তান একসঙ্গে বা ভাগ-বাটোয়ারা করে, ছদ্মনামে বা আপন নামে পালাতে প্রস্তুত ছিলেন। বল্ট বলেছেন, গ্যোবেলস শেষটায় তার আপন প্রোপাগান্ডার ফঁদে বন্দি। তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, বার্লিন অজেয়। তার পর শেষ মুহূর্তে যখন বার্লিনের হাজার হাজার অসহায় শিশু রোগে ক্ষুধায় মরছে, তখন তিনি প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী আপন সন্তানদের নিরাপদ স্থলে পাঠান কী করে? আমি বলি, পাঠালে কী হত? দু-চারটা লোক ঠাট্টা ব্যঙ্গ করত। কিন্তু ছ-ছটি নিষ্পাপ শিশুর জীবন বড়, না দুটো হৃদয়হীনের তিনটে মস্করা!
পূর্বেই বলেছি, শিশুগুলোর সবকটারই নাম ছিল হিটলারের আদ্যক্ষর এইচ দিয়ে। তারা তার সঙ্গেই গেল।
বেঁচে গেল শুধু একজন। গ্যোবেলুসের স্ত্রী তাঁর প্রথম স্বামীর সঙ্গে লগচ্ছেদ (ডিভোর্স) করে গ্যোবেলুকে বিয়ে করেন। সে-পক্ষের একটি সন্তান ছিল। নাম কোয়ান্ট। গ্যোবেল তাকে খুব স্নেহ করতেন। সে তখন বার্লিন থেকে দূরে। গ্যোবে তার জন্য একখানি সুন্দর চিঠি রেখে যান।
অতঃপর গ্যোবেলস তার অ্যাডজুটান্ট শ্যুগেরমানকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, এটাই সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিশ্বাসঘাতকতা; সব-কটা জেনারেল ফুরারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমাদের সবকিছু লোপ হয়ে গেল। আমি সপরিবার আত্মহত্যা করব। তুমি আমার দেহ পোড়াবার ভার নিতে পার? শ্যুগেরমান স্বীকৃত হলেন ও পেট্রলের জন্য লোক পাঠালেন কিন্তু অল্প পরিমাণেই পাওয়া গেল। প্রায় সাড়ে আটটার সময় গ্যোবেল তার স্ত্রীসহ বুঙ্কারের করিডর দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে চললেন। পথে শ্যুগেরমান ও ড্রাইভারকে পেট্রলসহ দেখতে পেলেন কিন্তু কোনও কথা বললেন না। বাগানে বেরিয়ে তিনি তার অর্ডারলিকে আদেশ দিয়ে স্বামী-স্ত্রী দুজনা তার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়ালেন। অর্ডারলি দুজনার ঘাড়ের উপর দুটি গুলি মারল। গেরমান শব্দ শোনার পর উপরে বাগানে গিয়ে মাটির উপর দুই মৃতদেহ পেলেন। পূর্বাদেশ অনুযায়ী তাদের চার টিন পেট্রল আঠারো গ্যালন– তাদের উপর ঢেলে চলে গেলেন। ওইটুকু পেট্রলে তাদের শরীরের চামড়া আর পোশাক পুড়েছিল মাত্র। মৃতদেহগুলো বিনষ্ট করার বা গোর দেবার কোনও চেষ্টাই করা হয়নি। রাশানরা পরের দিন সেগুলো বুঙ্কার আক্রমণ করার সময় পায় ও তাদের শনাক্ত করতে কোনও অসুবিধা হয়নি। গ্যোবেলসের ঝলসে যাওয়া শরীরের ফোটোগ্রাফ কাগজে বেরোয়। ভাঙা গাল চওড়া কপাল–চিনতে আমার পর্যন্ত কোনও অসুবিধা হয়নি।