এককড়ির মন্দিরের চূড়ার ত্ৰিশূলে গলাছিলা বিকটদৰ্শন এক শকুন এসে বসেছে। সে আকাশের দিকে গলা লম্বা করছে, আবার গুটিয়ে আনছে। পাখা মেলে দিচ্ছে এবং বন্ধ করছে। তার চকচকে ক্রুদ্ধ লাল চোখ দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে।
মন্দির চূড়ায় শকুন বসা বিরাট অলক্ষণ। মহাবিপদের অগ্রিম ইশারা। শকুন তাড়াবার চেষ্টা করা হচ্ছে। ঢ়িল ছোড়া হচ্ছে। গুলতিতে করে মার্বেল ছোড়া হচ্ছে। শকুন নির্বিকার। এইসব কর্মকাণ্ড সে মোটেই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে না। কিছুক্ষণ খোল করতাল বাজানো হলো। শব্দে অতিষ্ঠ হয়ে সে উড়ে গেল ঠিকই, আবার এসে বসল। এই দফায় দেখা গেল তার ঠোঁটে মাংস। কিসের মাংস কে জানে! মরা গরুর মাংস হলে সর্বনাশ। মন্দির অশুদ্ধ হয়ে যাবে। মন্দির শুদ্ধি বিরাট আয়োজনের ব্যাপার।
এককড়ির উপদেশে বাঁশের আগায় খড় বেঁধে সেই খড়ে আগুন লাগিয়ে চেষ্টা শুরু হয়েছে। পশুপাখি আগুন ভয় পায়। এই শকুনটা যত হারামিই হোক আগুন দেখে অবশ্যই পালাবে। এককড়ি বললেন, আধঘণ্টা সময়, এর মধ্যে শকুন দূর করবা। প্রয়োজনে একজন কেউ মন্দিরের মাথায় উঠ। এতগুলি মানুষ একটা শকুন দূর করতে পার না, এটা কেমন কথা!
এককড়ি তার আড়তে কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে থাকল। মন অস্থির লাগছে। শকুন দূর না হওয়া পর্যন্ত অস্থিরতা কাটবে না। তাঁর ব্যক্তিগত মন্দিরে শকুন বসেছে, বিপদ যা হবার তার হবে। বিপদের কিছু সম্ভাবনা তিনি দেখতে পাচ্ছেন। চালের দাম কমতে শুরু করেছে। কিছুদিনের মধ্যে বোরো ফসল উঠবে। এইবার ফসল ভালো হয়েছে। ইংরেজ সরকার ঘোষণা দিয়েছে, যুদ্ধ শেষ হবার পরপরই ভারতকে স্বাধীন করে দেয়া হবে। এটা আরেক যন্ত্রণা। ইংরেজ রাজার জাত। তারা যেভাবে রাজত্ব করেছে সেভাবে কে পারবে? হিন্দু-মুসলমান কাটাকাটি করেই তো মরে যাবে।
এককড়ি শকুনের খবর নিল। শকুন এখনো যায় নাই। ঠিক হয়েছে। একজন মন্দিরের চূড়ায় অলঙ্গা দিয়ে চেষ্টা করবে। অলঙ্গা সুপারিকাঠের বর্শা। বর্শাধারী স্নান করে শুদ্ধ হয়ে নিচ্ছে। এককড়ি উঠে দাঁড়ালেন। ধনু শেখের সঙ্গে ব্যবসা বিষয়ে পরামর্শ করবেন। গুদামে রাখা চাল পার করতে ধনু শেখের সাহায্য লাগবে। একজন ব্যবসায়ী আরেকজনকে সাহায্য করে। এটাই নিয়ম। সেখানে হিন্দু-মুসলমান থাকে না। এককড়ি ছোট্ট ভুল করে ফেলেছেন। সব চাল আগেই বিক্রি করে দেয়া উচিত ছিল। তবে সময় এখনো আছে।
ধনু শেখ যত্ন করে এককড়িকে বসিয়েছেন। পান-তামাক দেয়া হয়েছে। একজন গেছে মিষ্টি আনতে। মুসলমানের ঘরে দুগ্ধজাত খাদ্য ছাড়া অন্য খাদ্য গ্রহণ করা যায় না। দুধ এবং দুগ্ধজাত দ্রব্য সব অবস্থায় পবিত্র। ধনু শেখ বললেন, মসজিদটা ঠিক করে দিলা না? এক মাসের উপর হয়ে গেল জুম্মার নামাজ বন্ধ।
এককড়ি বিস্মিত হয়ে বলল, আমি কেন মসজিদ ঠিক করে দেব? এটা কেমন কথা?
ধনু শেখ তামাক টানতে টানতে বললেন, থানার দারোগা সাহেব তদন্তে পেয়েছেন— তুমি মসজিদ পোড়ানোর সাথে জড়িত। অনেকে সাক্ষী দিয়েছে। অনেকে আমার কাছে এসেও বলেছে। তোমার নিজের লোকই আমাকে বলে গেছে।
আমার নিজের লোক আপনাকে বলেছে? সে কে? তার নামটা বলেন।
শ্ৰীনাথ বলেছে। টিকেট বাবুর চাকরির জন্যে আমার কাছে এসেছিল। তখন বলল। আমি যদিও তার কথার একটা বর্ণ বিশ্বাস করি নাই।
এককড়ি হতভম্ব হয়ে গেল। কী ভয়ংকর কথা। ধনু শেখ বললেন, শ্ৰীনাথকে ডেকে জিজ্ঞাস করা। তবে সে কিছু স্বীকার পাবে বলে মনে হয় না। তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে, এ ধরনের কথা যেন আর না বলে। মন্দ কথা লোকজন সহজে বিশ্বাস করে।
রাগে এককড়ির শরীর জুলে যাচ্ছে। শ্ৰীনাথের বিষয়ে এক্ষুনি ব্যবস্থা নিতে হবে। সে উঠে দাঁড়াল। ধনু শেখ বললেন, বসে, মিষ্টি আনতে গেছে। দুষ্ট লোকের কথায় এত অস্থির হলে চলে না। এককড়ি বসল। চাল বিক্রির বিষয়টা আলাপ করতে হবে। নৌকা করে এত চাল নেয়া যাবে না। ধনু শেখের লঞ্চের সাহায্য লাগবে।
এককড়ি বলল, আপনার কাছে একটা বিষয়ে সাহায্যের জন্যে এসেছি। সামান্য কিছু চাল কিনে রেখেছিলাম। বোরো ফসল উঠার আগে বিক্রি করে দিব। আপনার লঞ্চে করে চাল নিয়ে যাব। কলিকাতা। কোনো সমস্যা আছে?
ধনু শেখ বললেন, কোনো সমস্যা নাই। তবে লোকজনের চোখের সামনে চালের বস্তা লঞ্চে তোলা ঠিক হবে না। নিশিরাতে তুলতে হবে।
অবশ্যই।
ধনু শেখ বললেন, চাল পঁচে যায় নাই তো?
এককড়ি বিস্মিত হয়ে বলল, চাল পচবে কী জন্যে?
লুকায়া রাখা চাল। আলো বাতাস পায় নাই। অনেকের এরকম হয়েছে। সিউরাম নামের এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীর এক হাজার বস্তা চাল পঁচে গোবর হয়ে গেছে। সে এখন ন্যাংটা হয়ে পথে পথে ঘুরতেছে।
আপনাকে বলেছে কে?
কাগজে পড়লাম। ঢাকা প্ৰকাশে ছাপা হয়েছে।
আমার চাল ঠিক আছে।
তুমি সাবধানী মানুষ। তোমার সমস্যা হবার কথা না। যাই হোক, চাল কখন পাচার করতে চাও বলে। আমার লঞ্চ তৈয়ার থাকবে।
‘পাচার’ বলতেছেন কেন? আমি সৎভাবে চাল নিয়া যাব। বিক্রি করব। আমার মধ্যে দুই নম্বরি নাই।
ঠিক আছে। ঠিক আছে। কথার কথা বলেছি।
এককড়ি বাড়ি ফিরেই গুদামের চাল পরীক্ষা করল। তাঁকে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়তে হলো। দুটা গুদামের চাল টিনের। টিনের ফুটা দিয়ে বৃষ্টির পানি ঢুকেছে। চাল পঁচে গেজে উঠেছে। তালাবন্ধ গুদাম কেউ খুলে নাই। এতবড় সর্বনাশ যে হয়ে গেছে তা বোঝা যায় নাই।
একজন এসে এককড়িকে জানাল যে, শকুন দূর হয়েছে। ত্ৰিশূলে আবার যেন এসে না বসে তার জন্যে বড়ই গাছের ডাল ভেঙে ত্রিশূলকে ঘিরে বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। বড়ই কাটার জন্যে শকুন বসতে পারবে না।
বিপদ একা আসে না। সঙ্গী সাখী নিয়ে আসে। এককড়ি সন্ধ্যাবেলায় খবর পেল, কোলকাতায় তার দোকানটা লুট হয়েছে। এইখানেই শেষ না, তার নতুন খবরপাঠক দেবুকে টাকা ব্যাংকে জমা দিতে নেত্রকোনা পাঠানো হয়েছিল। সে টাকা জমা না দিয়ে উধাও হয়ে গেল।
এককড়ি সারারাত মন্দিরে বসে রইল। তার মধ্যে সে-রাতেই পাগলামির কিছু লক্ষণ প্রকাশিত হলো। তার কাছে মনে হলো, ঠাকুর তাকে পছন্দ করেছেন এবং তার সঙ্গে কথা বলা শুরু করেছেন। ঠাকুরের সঙ্গে তার নিম্নরূপ কথাবার্তা হলো
ঠাকুর : কিরে মন বেশি খারাপ?
এককড়ি; আমি ধনেপ্ৰাণে গেছি ঠাকুর।
ঠাকুর : ধনে গেছিস ঠিক আছে। প্ৰাণ তো আছে।
এককড়ি : ধন বিনা প্ৰাণ দিয়ে কী করব ঠাকুর?
ঠাকুর : ধনের ব্যবস্থা করছি। আমি আছি না? গুপ্তধনের ব্যবস্থা হবে। এক কলসি মোহর হবে না?
এককড়ি : হবে। কবে পাব?
ঠাকুর : লাবুসের বাড়িতে যা। শিউলি গাছের আশেপাশে মাটিতে পোতা গুপ্তধন। খুঁড়ে বের কর।
এককড়ি : এখনি যাব?
ঠাকুর : তোর ইচ্ছা। তবে এত তাড়াহুড়া কী? আয় গল্প করি।
এককড়ি মাটি কাটার দু’জন কমলা এবং কোদাল নিয়ে ভোরবেলায় লাবুসের বাড়িতে উপস্থিত। গম্ভীর গলায় বললেন, তোমার সঙ্গে একটা আলোচনা আছে।
লাবুস বলল, বলুন কী আলোচনা?
এককড়ি বললেন, আমার যে মহাসর্বনাশ হয়েছে এই খবর কি পেয়েছ?
কিছুটা শুনেছি। আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে পাগল হয়ে গ্রামে বন্দরে ঘুরত। আমি বলেই এখনো ঠিক আছি। যাই হোক, মূল কথা এটা না। আমি একটা হাঁড়িতে কিছু সোনার মোহর ভরে তোমার ওই শিউলি গাছের গোড়ায় পুঁতে রেখেছিলাম।
ওইখানে কেন?
গোপন করার জন্যেই অন্যের জায়গায় রেখেছি। হরিচরণ বাবু এই বিষয়ে জানতেন। আমার এখন মহাবিপদ। মোহরগুলি নিতে এসেছি। দুটা মোহর তোমাকে আমি দিয়ে যাব।
লাবুস বলল, আমাকে কিছু দিতে হবে না। আপনার জিনিস আপনি নিয়ে যান।
ঠিক কোথায় পুতেছি এখন মনে নাই। অমাবশ্যার রাতে পুতেছি। দিক খেয়াল নাই। বিস্তর খোঁড়াখুঁড়ি করতে হবে।
করুন।
লাবুস, তুমি বিশিষ্ট ভদ্রলোক। তুমি না চাইলেও আমি তোমাকে দুটা মোহর দিব। লাঙ্গরখানার কাজে লাগবে।
লাবুস বলল, লঙ্গরখানা তো উঠায়ে দিয়েছি।
এককড়ি বললেন, দেশে আবার অভাব আসবে, তখন নতুন লঙ্গরখানা চালু করবা। অর্থের সব সময়ই প্রয়োজন। তাহলে খোড়া শুরু করি?
করুন।
এককড়ি মহাউৎসাহে কাজ শুরু করলেন। রাতের দুশ্চিন্তার কিছুমাত্র এখন তাঁর চোখে-মুখে নাই। তাকে আনন্দিত এবং উৎফুল্ল লাগছে। তিনি পাটি বিছিয়ে বসেছেন। হাদিস উদ্দিন তার জন্যে বাজার থেকে ব্ৰাহ্মণের হুঙ্কা এনে দিয়েছে। এককড়ি হাদিস উদ্দিনের কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট। তিনি ঠিক করে রেখেছেন, গুপ্তধন পাবার পরপরই হাদিস উদ্দিনকেও খুশি করবেন। তাকে সোনার মোহর দেয়ার কিছু নাই! টাকা-পয়সা কিছু দিয়ে দিবেন। তিনি হাদিস উদ্দিনকে গলা নিচু করে বলে দিয়েছেন, তুমি কামলা দু’জনের দিকে নজর রাখবা। কঠিন নজর। এরা যেন কিছু পাচার করতে না পারে।
ভাঙা হাঁড়ি, মাটির ঢাকনি জাতীয় জিনিস উঠে আসছে। আসল জিনিস এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। তবে অস্থির হবার কিছু নাই। ধৈর্য ধরতে হবে।
খোঁড়াখুঁড়ি দেখার জন্যে অনেকেই জড়ো হয়েছে। গুপ্তধন খোঁজা হচ্ছে এই খবর ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যাপারটায় এককড়ি খুবই বিরক্ত। তিনি ধমকাধমকিও করেছেন- লাভ হচ্ছে না।
রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি এবং খোড়াখুঁড়ির উত্তেজনায় দুপুরের দিকে এককড়ির ঝিমুনির মতো হলো। এই ঝিমুনির মধ্যেই তিনি ঠাকুরকে স্বপ্নে দেখলেন। ঠাকুরকে লজ্জিত এবং দুঃখিত দেখাচ্ছিল।
এককড়ি! ছোট্ট ভুল হয়েছে রে।
কী ভুল?
জায়গা ভুল। গুপ্তধন পোতা আছে। পুরনো কালীবাড়িতে, এখানে না।
কালীবাড়ির কোন জায়গায়?
যেখানে বলি দেয়া হয় ঠিক তার নিচে। হাঁড়িকাঠির নিচে। বেশি খুঁড়তে হবে। না। ছয় সাত হাত।
মোহর কয়টা আছে জানেন?
না। তবে বাদশাহি মোহর।
কোন বাদশাহ? বাদশাহ জাহাঙ্গীর?
হুঁ। বাদশাহ জাহাঙ্গীর। আসল গিনি সোনার মোহর।
হাঁড়িটা কত বড় সেটা বলেন।
হাঁড়ি না। কলসি। মাঝারি সাইজের কলসি।
এককড়ি হুড়মুড় করে উঠে বসলেন। তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
জিনিসটা কোথায় পুতেছিলাম ভুলে গেছি, এখন মনে পড়েছে। চলে যাচ্ছি, তবে তুমি নিশ্চিত থাক— তোমাকে একটা মোহর দিব। তোমার জায়গায় হলে দুটাই দিতাম।
লাবুস বলল, আমার মনে হচ্ছে। আপনার শরীরটা খারাপ। আপনি গোসল করে খাওয়াদাওয়া করুন। বিশ্রাম করুন।
জিনিসটা বাড়িতে নিয়া তারপর স্নান করে খাওয়াদাওয়া করব। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়কার মোহর। এখন দর হবে তিনশ’ টাকার উপর। হবে না?
জানি না, হতে পারে।
আচ্ছা আমি যাই। আমি কাজ শেষ করে কমলা দুটাকে পাঠায়ে দিব। এরা গর্ত বন্ধ করে দিয়ে যাবে।
এককড়ি হস্তদন্ত হয়ে চলে গেলেন। নষ্ট করার মতো সময় তার হাতে নাই। কালীবাড়ির হাঁড়িকাঠের নিচটা খুঁড়ে সাত-আট ফুট গর্ত করা হয়েছে। ভাঙা ইট এবং ভাঙা কলসি ছাড়া কিছু পাওয়া যায় নি। সন্ধ্যাবেলা প্রবল জ্বর নিয়ে এককড়ি ফিরলেন। তাঁর দৃষ্টি এলোমেলো। চোখ রক্তবর্ণ। হাঁপানির টান উঠেছে। বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। তারপরেও ফুসফুস ভরাতে পারছেন না।
জ্বর এসেছে মাওলানা ইদরিসেরও। বেশ ভালো জ্বর। তাঁর শরীর ভালো যাচ্ছে না। প্রায়ই জ্বরজারি হচ্ছে। শরীর ভেঙে পড়েছে বলে তিনি অল্পতেই কাহিল হয়ে পড়েছেন। এই কাহিল অবস্থাতেও তাকে ছবি আঁকতে বসতে হয়েছে। মীরা মানছে না।
কাকের ছবি হলে কোনো সমস্যা ছিল না। দুটা টান দিয়েই তিনি কাক আঁকতে পারেন। মীরা বলছে কাক আঁকলে হবে না, মীরাকে আঁকতে হবে। মানুষের ছবি আঁকা গুনাহর কাজ। আল্লাহপাক অপছন্দ করবেন। বাম কাঁধে বসে থাকা ফেরেশতা বদি লিখবো। কিন্তু তিনি মীরাকে মানাতে পারছেন না। সে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে বসে আছে।
মীরা শান্তভঙ্গিতে কোলে হাত রেখে বসে আছে। ইদরিস মীরার সামনে বসেছেন। ছবি আঁকার কাগজ মেঝেতে বিছানো। কাক আঁকা আর মানুষ আঁকা তো এক না। শুরু করবেন। কোথেকে? চোখ থেকে শুরু করবেন। প্ৰথমে বাম চোখ। হিসাব করে ডান চোখ। তারপর ঠোঁট।
মাওলানা কয়লা হাতে নিয়ে বললেন, বিসমিল্লাহ। বলেই মনটা খারাপ হলো, একটা নিষিদ্ধ কাজ তিনি বিসমিল্লাহ বলে শুরু করতে যাচ্ছেন! ভুলের উপর ভুল।
মীরা বলল, বাবা, শুরু কর।
ইদরিস তার কন্যার বা চোখের মণির কালো অংশ এঁকে ফেললেন। এই চোখ চকচক করছে। চকচকে ভাবটা আনতে হবে। চোখের মণির কালো এখান থেকে একরকম লাগছে না। কোথাও বেশি কোথাও কম। চোখের মণি ঠিক করতে করতেই ডান চোখের মণির জায়গাটা একটা বিন্দু এঁকে ঠিক করলেন। তারপর ঠোঁটের জায়গাটা ঠিক করা হলো। এখন তাঁর মূল কাজ হচ্ছে, একটা চোখ আঁকতে আঁকতে মুখের অবয়বের জায়গাগুলি ঠিক করা।
মাওলানা আশ্চর্য এক ঘোরের মধ্যে চলে গেছেন। তার সামনে এখন মীরা ছাড়া কিছু নেই। মীরা কয়েকবার ডাকল, বাবা! বাবা! মাওলানা জবাব দিলেন r
ঠোঁট আঁকা হয়েছে। ঠোঁট হয়েছে হাসি হাসি। এটা তো ঠিক না, মীরার ঠোঁটে কান্নাভাব প্রবল। হাসিকে কান্নায় নিয়ে আসতে হলে কী করতে হয় তা তিনি জানেন না। কিন্তু তিনি যে জানেন না এটাও ঠিক না। তাঁর মাথার ভেতরে কেউ একজন বসে আছে। সে জানে। সে অবশ্যই জানে।
আঁকা শেষ করে মাওলানা ছবিটির দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলেন। আহারে, কী সুন্দর হয়েছে ছবিটা! একটা অবাক শিশু অভিমানে ঠোঁট বঁকিয়ে বসে আছে। তার চোখে পানি নেই, কিন্তু চোখ দেখে মনে হচ্ছে সে এক্ষুনি কাঁদবে।
মীরা বলল, বাবা, কাঁদছ কেন? ছবিটা তো সুন্দর।
এই জন্যেই কাঁদছি রে মা।
মাওলানা অজু করে নামাজ পড়তে বসলেন। ‘তাওবা ওস্তাগাঁফেরুল্লাহ’ বলে আল্লাহপাকের কাছে অন্যায়। এই কাজের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। একটা অবোধ শিশুর মনতুষ্টির জন্যে এত বড় একটা অন্যায় কাজ তাকে করতে হয়েছে।
হাদিস উদ্দিন মীরার ছবি নিয়ে গেল লাবুসের কাছে। লাবুস, হতভম্ব হয়ে বলল, একী!
হাদিস উদ্দিন বলল, মওলানা সাব এঁকেছেন।
লাবুস বলল, কী অবিশ্বাস্য কথা!
হাদিস উদ্দিন বলল, আমি ভাবছিলাম উনি কাউয়া ছাড়া কিছুই আঁকতে পারেন না। এখন দেখলেন অবস্থা!
লাবুস বলল, আমি এত সুন্দর এত জীবন্ত ছবি কোনোদিন দেখি নাই। দেখে কি মনে হয় জানো? ডাকলে মীরা উত্তর দিবে।
লাবুস সত্যি সত্যি ছবির দিকে তাকিয়ে ডাকল, মীরা। মীরা। এই পুষ্পরানি।
ধনু শেখ ডেকে পাঠিয়েছেন মাওলানা ইদরিসকে। তিনি জুম্মাঘর তৈরি করে দিয়েছেন। জুম্মাঘরের দায়িত্ব মাওলানাকে দিতে চাচ্ছেন। ইমাম করিমকে দায়িত্ব দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সে এখন জুটেছে এককড়ির সঙ্গে। কোদাল নিয়ে সে এককড়ির সঙ্গে আছে। এককড়ি কোনো জায়গা দেখিয়ে দেয়া মাত্র কোদান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
ধনু শেখ বললেন, মাওলানা, আপনার খবর কী?
জি জনাব। আমার খবর ভালো।
লোকে আপনাকে ডাকে কাউয়া মাওলানা। শুনলাম। আপনার এখন একমাত্র কাজ কাউয়া আঁকা। ঘটনা কী?
ইদরিস জবাব দিলেন না। ধনু শেখ বললেন, কাউয়া কেন আঁকেন?
জনাব, মেয়েটারে খুশি করার জন্যে আঁকি।
কাউয়া একটা বদপাখি। ময়লা খায়। দেখতে অসুন্দর। তার ডাক অসুন্দরকা কা কা। তারে আঁকার দরকার কী? দুনিয়াতে সুন্দর পাখির কি অভাব আছে? ময়ুর আছে, টিয়া আছে, কাকাতুয়া আছে। আছে কিনা বলেন?
জি জনাব আছে।
হাঁস মুরগিও তো সুন্দর। এদের মাংসও খাওয়া যায়। হাঁস মুরগিও তো আঁকতে পারেন।
ইদরিস চুপ করে আছেন। ধনু শেখের নির্দেশে সদরুল মাওলানার সামনে কাজল এবং পেনসিল রাখল। ধনু শেখ বললেন, দেখি একটা কাউয়া আঁকেন। সবাই আপনার কাউয়া আঁকা দেখেছে, আমি দেখি নাই। তাড়াতাড়ি আঁকেন। আমার হাতে সময় নাই।
মাওলানা আঁকলেন। ধনু শেখ বললেন, খারাপ না। দেখি এখন একটা মুরগি আঁকেন।
মাওলানা আঁকলেন।
মুরগির সাথে কয়েকটা বাচ্চা দিয়ে দেন। মায়ের পিছনে পিছনে বাচ্চা ঘুরছে।
মাওলানা আদেশ পালন করলেন।
ধনু শেখ বললেন, কার ভেতরে কী গুণ থাকে। কেউ জানে না। আপনার ভিতরে যে এই গুণ ছিল কে ভেবেছে। যাই হোক, জুম্মাঘরের ইমামতি শুরু করেন। আইজ থাইকা শুরু। আছর ওয়াক্তে আজান দিয়া শুরু করেন।
মাওলানা বললেন, আমি বিরাট পাপী মানুষ। একজন পাপী মানুষ মসজিদের ইমাম হইতে পারে না। আমি প্রতিদিন পাপ করি। অবস্থা এমন হয়েছে যে পাপ ছাড়া থাকতে পারি না। আজকেও পাপ করেছি।
কী পাপ করেছেন?
ছবি এঁকেছি।
এটা কি পাপ?
জি জনাব পাপ।
তাওবা করেন। তওবা করলেই তো পাপ শেষ। পাপ করবেন, তারপর আল্লাহপাকের কাছে তওবা করে পাপমুক্ত হবেন, আবার পাপ করবেন।
মাওলানা বললেন, এটা আল্লাহপাককে ফাঁকি দেওয়া। এই কাজ আমি করব না।
মসজিদের ইমামতি তাহলে করবেন না?
জি-না জনাব।
আপনি তো বেয়াদবও আছেন। আমার মুখের উপর ‘না’ বলা বিরাট বেয়াদবি।
আল্লাহপাকের কোনো হুকুমে না বলা বেয়াদবি এবং মহাগুনাহর কাজ। আপনাকে না বলা বেয়াদবি না। তারপরেও না’ বলায় যদি মনে কষ্ট পেয়ে থাকেন। আমি ক্ষমা চাই। মানুষের মনে কষ্ট দেয়া নিষেধ আছে।
ধনু শেখ বললেন, আপনি আমার সামনে থেকে যান। কাউয়াদের কাছে যান। তাদেরকে নিয়া কা কা করেন।
ইদরিস বের হয়ে এলেন। আসরের নামাজের পর বড়গাঙের পাড়ে বসলেন। হাতে কাগজ এবং পেনসিল। আজ তিনি গাছের ছবি আঁকবেন। গাছের ছবি আকাতে কোনো পাপ নেই। গাছ তো আর জীবজন্তু না। সন্ধ্যা নাগাদ ছবি শেষ হলো। প্রাণ, স্বাস্থ্যু এবং সৌন্দর্যে ঝলমলে একটা লেবুগাছ। লেবু। ফলে আছে। লেবু ফুল ফুটে আছে। ছবির দিকে তাকালে লেবু ফুলের গন্ধ নাকে লাগে।
মাওলানা বাড়ির দিকে রওনা হয়েছেন। গাঙের পাড়েই মাগরেবের নামাজ শেষ করেছেন। নামাজে পুরোপুরি মন দিতে পারেন নি। দৃষ্টি চলে যাচ্ছিল আকাশের দিকে। সন্ধ্যার আকাশের কী সুন্দর রঙ। পেনসিল দিয়ে এই রঙ আনা যাবে না। রঙ তিনি পাবেন কোথায়? কাঁচাহিলুদের রস থেকে হলুদ রঙ পাওয়া যাবে। সেগুন গাছের কাঁচিপাতা বাটা থেকে লাল রঙ। নীল পাবেন কোথায়? সাদা কাপড়ে যে ‘নীল’ দেয়া হয় সেই নীল কি ব্যবহার করা যায়? আকাশে আছে সাদা মেঘের স্তুপ; সাদা রঙ হিসেবে চকখড়ি কেমন হবে?
মাওলানা সাহেব, আদাব।
ইদরিস চমকে তাকালেন। তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁটছিলেন বলেই হঠাৎ মনে হয়েছে আকাশ থেকে কেউ একজন বলেছে, আদাব।
আদাব বলেছেন এককড়ি। তিনি উবু হয়ে সড়কে বসে আছেন। সড়কের পাশেই গর্ত করা হচ্ছে গর্ত করছে ইমাম করিম। ঠাকুর স্বপ্নে এককড়কে দেখা দিয়ে বলছেন, ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা বরাবর গর্ত করে যেতে। রাস্তার পাশেই আছে। ঠিক কোথায় তা বলা যাচ্ছে না।
ইদারস বললেন, ভালো আছেন?
এককড়ি বললেন, সামান্য পেরেশানির মধ্যে আছি। তবে আজ পেরেশানির অবসান হবে। কলসি পাওয়া যাবে। আজ দিন শুভ। শুক্লা পঞ্চমী।
ইমাম করিম ঝাপঝাপ কোদালের কোপ দিচ্ছে। তার সারা গা দিয়ে ঘাম পড়ছে।
টং করে শব্দ হলো। এককড়ি চেচিয়ে উঠলেন, আস্তে আস্তে। কলসি যেন না ভাঙে।
কলসি না। ইটের টুকরায় কোদালের কোপ পড়েছে এককড়ি তাতে হতাশ হলেন না। হতাশ নামের মানবিক বিষয়টি পাগলদের মধ্যে অনুপস্থিত। তারা বাস করে সম্পূর্ণ হতাশামুক্ত জগতে।
ইমাম করিম বলল, মাওলানা ঘরে যান। আমাদের কাজের অসুবিধা হইতেছে। দাঁড়ায়া দেখার কিছু নাই। জিনিস যখন পাব সবেই জানবেন। আমাদের মধ্যে লুকাছাপা কিছু নাই।
মাওলানা বাড়ির দিকে রওনা হলেন। তাঁর মন বিষণ্ণ। তিনি খবর পেয়েছেন করিমের পাগলামি অনেক বেড়েছে! এখন সে রেগে গেলেই কোদাল নিয়ে তাড়া করে। দূরের কোনো শহর বন্দ্রে ছেড়ে দিয়ে আসা আসা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সবার ধারণা করিমের মাথার যে অবস্থা দূরে ছেড়ে দিয়ে এলে সে পথ চিনে আসতে পারবে না।
অঞ্চলে একজন পাগল থাকা ভালো। এতে অঞ্চলের ‘বরকত’ হয়। কিন্তু বিপদজনক পাগল থাকা ভালো না। এরা কখন কী করবে। তার ঠিক নেই। ইমাম করিম বিপদজনক পাগলের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। কে বিপদজনক পাগল কে না। তা ঠিক করে অঞ্চলের শিশুরা। তারা যখন কোনো পাগল দেখামাত্র বিপুল উৎসাহে তার দিকে ঢ়িল ছুড়তে শুরু করে তখন ধরেই নিতে হবে সে বিপদজনক পাগল।
বান্ধবপুরের শিশুরা ইমাম করিমকে দেখামাত্র ঢিল ছুড়ছে। এককড়িকে কিছু বলছে না।
সন্ধ্যার পরও খোঁড়াখুঁড়ি চলতে লাগল। এককড়ি আরো দু’জন কমলা নিয়ে এসেছে। রাতচুক্তি কামলা। সারারাত কাজ করবে। সূর্য ওঠার পর মজুরি নিয়ে বিদায় হবে। একটা হ্যাজাক লাইট জোগাড় করা হয়েছে। হ্যাজাকের আলোয় ঝলমল করছে চারদিক। কেমন উৎসব উৎসব ভাব।
রঙিলা বাড়ি থেকে পালকি যাচ্ছে ধনু শেখের বাড়িতে। চার বেহারার পালকি। সঙ্গে একজন চরণদার। পালকিতে শরিফা। অনেকদিন পর আজ তার ডাক পড়েছে।
পালকি হ্যাজাক বাতির কাছে আসতেই শরিফা বলল, থামেন।
পালকি থামল।
শরিফা চরণদারকে বলল, ইমাম করিম সাহেবরে একটু কাছে আসতে বলেন। আমি তারে দুইটা কথা বলতে চাই।
এককড়ি বললেন, পালকিতে কে যায়?
চরণদার বলল, রঙিলা বাড়ির কইন্যা যায়।
খাড়াইলা কেন? কাজের মধ্যে ঝামেলা। চইল্যা যাও।
চরণদার বলল, সামান্য কাজ আছে। কাজ শেষ হলে চলে যাব।
সে করিমের কাছে গেল। করিম কোনো আপত্তি ছাড়াই পালকির পাশে এসে দাঁড়াল।
শরিফা বলল, ভালো আছেন?
করিম বলল, ভালো আছি।
শরিফা বলল, আপনি আমারে দেখতে পাইতেছেন না। আমি দেখতেছি। আপনার শরীর ভালো না। লোকে বলে আপনার না-কি মাথাও নষ্ট হয়েছে।
হুঁ।
আপনি কি আমাকে চিনেছেন?
হুঁ।
বলেন, আমি কে?
তুমি শরিফ।
এখন আমি শরিফা না। আমি রঙিলা বাড়ির নটি। আমার নাম–ফুলকুমারী। নাম সুন্দর না?
হুঁ।
এককড়ি ধমক দিল, কাজকাম ফালায়া কী শুরু করলা?
করিম কোদাল হাতে নেমে গেল। শরিফার পালকিও চলতে শুরু করল। বেহারারা হুম হাম শব্দ করছে। তারা নিঃশব্দ হলে শরিফার কান্নার শব্দ শুনতে পেল।
ধনু শেখের শরীর খারাপ করেছে। মাথায় যন্ত্রণা, বমি বমি ভাব। শরীরে চুলকানিও হয়েছে। কিছুক্ষণ চুলকালেই জায়গাটা ফুলে। লাল হয়ে যাচ্ছে। সতীশ কবিরাজ সন্ধ্যাবেলা এসে দেখে গেছে। তার কথামতো চুন এবং নিমপাতা বাটা লাগানো হচ্ছে। বমিভাব কাটানোর জন্যে গন্ধভাদালির বড়া খেয়েছেন। এতে বমিভাব আরো বেড়েছে। বমি হয়ে গেলে শরীর ভালো লাগবে- এই ভেবে গলায় আঙুল দিয়ে বমির চেষ্টাও করেছেন। বমি হয় নি। মনে হচ্ছে একগাদা খাবার গলার কাছে আটকে আছে।
শরীরের এই অবস্থায় কোনো কিছুই ভালো লাগে না। শরিফাকে তিনি বললেন, যাও চলে যাও। ভাগো।
শরিফা বলল, কোথায় যাব?
যেখান থেকে আসছ সেখানে যাবে। আমার শরীর ভালো না।
শরীরে কী হয়েছে?
চুলকানি হয়েছে।
শরিফা আগ্রহ নিয়ে বলল, দেখি?
ধনু শেখ বললেন, কী দেখবা? তুমি কি ডাক্তার কবিরাজ?
শরিফা বলল, আপনার কুষ্ঠরোগ হয়েছে কি-না এইটা দেখব। আপনার কুষ্ঠরোগ হওনের কথা।
ধনু শেখ থমথমে গলায় বললেন, কী বললা?
শরিফা স্বাভাবিক গলায় বলল, আমি অন্তর থেকে অনেকবার বলেছি আপনার যেন কুষ্ঠ হয়। অন্তর থেকে যে যা চায় তাই হয়।
ধনু শেখ বললেন, তুমি তো অন্তর থেকে তোমার স্বামীর কাছে ফিরে যেতে চেয়েছিলে। যেতে পেরেছ?
শরিফা বলল, অন্তর থেকে তখন চাই নাই। এখন চাই।
তোমার ধারণা ইমাম করিম তোমার মতো এক নটিকে বিবাহ করে সংসার শুরু করবে?
হুঁ।
ধনু শেখ বললেন, সে ইচ্ছা করলেও তো পারবে না। আমি তোমারে এখনো তালাক দেই নাই।
শরিফা বলল, আমি এখনো আপনার স্ত্রী?
অবশ্যই।
তাহলে আমি আর রঙিলাবাড়িতে যাব না। এইখানেই থাকব। আপনার লোকজনদের বলেন গরম পানি করতে, আমি সিনান করব।
ধনু শেখ বললেন, তুমি এক্ষণ বিদায় হবা।
শরিফা বলল, অবশ্যই না। আমি আপনার স্ত্রী।
বলতে বলতে শরিফা শব্দ করে হাসল। ধনু শেখ বললেন, হাসো কেন?
শরিফা বলল, আমি আপনার স্ত্রী। থাকি রঙিলাবাড়িতে। একদিন মনে করেন আপনার মেয়েজামাই আমোদ ফুর্তি করতে রঙিলাবাড়িতে উপস্থিত। তার আবার মনে ধরল আমারে… হি হি হি।
ধনু শেখ বললেন, চুপ কর মাগি!
শরিফা বলল, ভালো বুদ্ধি দেই শুনেন। আমারে তালাক দিয়া নিজের ইজ্জত রক্ষা করেন।
ধনু শেখ বললেন, তালাক তালাক তালাক। এখন তুই বিদায় হ। শরিফা বলল, আজ আর যাব না।
তোরে লাত্থায়া বিদায় করব।
শরিফা বলল, এইটা পারবেন না। একটা মোটে ঠ্যাং। এক ঠ্যাং-এ লাথালাথি করা যায় না। আচ্ছা শুনেন, আপনার পায়ের পাতা কি চুলকায়? কুষ্ঠরোগের আরেক লক্ষণ পায়ের পাতা চুলকানি।
রাত অনেক হয়েছে। তারপরেও ঘুম থেকে তুলে সতীশ কবিরাজকে আনা হয়েছে ধনু শেখের কাছে।
ধনু শেখ বললেন, ঠিকমতো বলো। আমার কি কুষ্ঠ হয়েছে?
সতীশ কবিরাজ বললেন, কুষ্ঠ কেন হবে?
ধনু শেখ বললেন, কেন হবে, কেন হবে না এই বিবেচনা পরে। আগে দেখ হয়েছে কি-না।
না।
ধনু শেখ বিরক্ত গলায় বললেন, না দেইখাই বললা— না। আগে দেখ।
সতীশ কবিরাজ বললেন, কুষ্ঠ যে জায়গায় হবে সেই জায়গা অসাড় হয়ে যাবে। সূচ ফুটালে ব্যথা লাগবে না।
সুচ ফুটায়া দেখ। তার প্রয়োজন নাই।
ধনু শেখ বিরক্ত মুখে বললেন, প্রয়োজন আছে কি নাই সেই বাহাস পরে করবা, আগে সুচ ফুটাও।
সতীশ কবিরাজ সূচ ফুটালেন। ধনু শেখ ব্যথায় বিকট চিৎকার দিলেন। সতীশ কবিরাজ বললেন, নিশ্চিন্ত মনে ঘুমান। আপনার যকৃত দুষ্ট হয়েছে। যকৃত দুষ্ট হলে চুলকানি হয়। সকালে ওষুধ দিব। অনুপান দিয়ে দিব। নিয়মিত খাবেন। ওষুধ যে কদিন খাবেন সেই কদিন মদ্যপান করবেন না।
আজ তো খেতে পারব? ওষুধ তো শুরু হয় নাই।
সতীশ কবিরাজ বললেন, নিয়ম রক্ষার জন্যে সামান্য চলতে পারে। তবে না খাওয়াই উত্তম।
ধনু শেখ বললেন, উত্তমের আমি গুষ্ঠি কিলাই।
প্রচুর মদ্যপান করে তিনি ঘুমুতে গেলেন। বিকট স্বপ্ন দেখে তাঁর ঘুম ভাঙল। স্বপ্নে তিনি একজন কুষ্ঠরোগী। ভিক্ষা করছেন কোলকাতা রেলস্টেশনে। তাঁর শরীরের মাংস গলে গলে পড়ছে। মাছি চারদিকে ভিনভন্ন করছে। তাঁর গা থেকে খসে পড়া মাংস একটা মোটা তাজা কুকুর খাপ খপ করে খাচ্ছে। কুকুরটা এবার সরাসরি গা থেকে মাংস ছিড়ে নিতে এগিয়ে এলো। ভয়ঙ্কর দাঁত নিয়ে সে এগিয়ে আসছে। দাঁতের ফাঁক দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ছে। ‘বাঁচাও বঁচাও’ বলে তিনি চিৎকার করছেন। সবাই তার চিৎকার শুনছে, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছে না। বরং তারা মজা পাচ্ছে।
ধনু শেখের চিৎকার শুনে শরিফা ঘরে ঢুকল। সে রঙিলাবাড়িতে ফিরে যায় নি। পাশের কামরায় পাটি পেতে শুয়েছিল। শরিফা বলল, আপনার কী হয়েছে? বোবায় ধরেছে?
ধনু শেখ বললেন, বোঝায় ধরে নাই। কুত্তায় ধরেছে।
শরিফা বলল, মেয়েরে খবর দিয়া নিয়া আসেন। যে অসুখ আপনি বাধায়েছেন। আপনার ভালো সেবা দরকার।
চুপ। সতীশ কবিরাজ দেখে গেছে। সে বলেছে কিছু হয় নাই।
কলিকাতা শহরে যান। বড় ডাক্তার দেখান।
চুপ বললাম। চুপ।
আমি পাশের ঘরেই আছি। আবার যদি কুত্তায় ধরে ডাক দিয়েন।
ধনু শেখ ঘুমুতে গেলেন না। ভোর হওয়া পর্যন্ত জেগে বসে রইলেন। নিজে আরো একবার সুচের পরীক্ষাটা করলেন। সূচ ফুটালেন এবং প্রচণ্ড ব্যথায় চিৎকার করে উঠলেন। না, অবশ্যই তার কুষ্ঠরোগ হয় নি। তারপরেও কোলকাতার বড় ডাক্তারকে দেখাতে তো অসুবিধা নাই। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, দু’একদিনের মধ্যে কোলকাতা যাবেন। প্রয়োজনে ডাক্তার বিধানচন্দ্রের কাছে যাবেন।
ডাক্তারের নাম কার্তিক বসু। ক্যাম্মেল হাসপাতালের চর্মরোগের অধ্যাপক। তিনি ধনু শেখকে যত্ন করে দেখলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, এলাৰ্জিাঘটিত ব্যাধি।
ধনু শেখ বললেন, কুষ্ঠ না তো? আমার তো মনে হচ্ছে কুষ্ঠ।
কাৰ্তিক বসু বললেন, আপনার মনে হলে তো হবে না। আমার মনে হতে হবে।
সুঁচ ফুটানোর পরীক্ষা করবেন না?
সুঁচ ফুটানোর কী পরীক্ষা?
সুচ ফুটালে ব্যথা পাই কি না।
আপনি আগে যে ডাক্তারকে দেখিয়েছেন তার কাছেই যান। আমার যা বলার বলে দিয়েছি।
ধনু শেখ বললেন, এলাৰ্জি হয়েছে বলেছেন, ঠিক আছে মানলাম। এলাৰ্জির চিকিৎসা করুন।
এলাৰ্জির কোনো চিকিৎসা নেই।
তার মানে কী? এটা কী বললেন?
পৃথিবীর অনেক ব্যাধি আছে যার চিকিৎসা নেই। অবাক হবার কিছু নেই।
ধনু শেখ বললেন, আমি আপনার সব কথাই মানলাম। বুঝলাম যে আমার কুষ্ঠ হয় নাই। তারপরেও আমি যদি কুষ্ঠরোগের ওষুধ খাই তাতে অসুবিধা আছে? আমাকে কুষ্ঠরোগের ওষুধ দিন।
কাৰ্তিক বসু উঠে পড়লেন। এই রোগীর পেছনে সময় নষ্ট করার অর্থ হয় না।
ধনু শেখের চুলকানি অসুখ খুবই বাড়ল। বরফ ঘষলে কম থাকে। বরফ ঘষা বন্ধ করলেই অসহ্য চুলকানি। তিনি একজন লোক রেখেছিলেন, যার একমাত্র কাজ চিরুনি দিয়ে তার গায়ে আঁচড়ানো। মাঝে মাঝে বরফ ঘষা।
তাঁর রাতের ঘুম একেবারেই কমে গেল। চোখে ঘুম আসামাত্ৰাই বিকট দুঃস্বপ্ন। এর মধ্যে একটা দুঃস্বপ্ন ভয়ঙ্কর। যেন তার একটা পায়ে দড়ি বেঁধে লঞ্চঘাটের কাছে লম্বা বকুল গাছের ডালে বুলিয়ে রাখা হয়েছে। তাঁর গা থেকে মাংস গলে গলে পড়ছে। বিকট দুৰ্গন্ধ। লঞ্চ থেকে যাত্রীরা মুখে রুমাল চাপা দিয়ে নামছে এবং সবাই তার গায়ে থুথু দিচ্ছে।
ধনু শেখ স্বপ্নটা যখন দেখছেন তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের দিকে। হিটলারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইটালির সর্বেসর্ব বেনিতো মুসোলিনীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে এবং তার বান্ধবীকে গুলি করে হত্যার পর পায়ে দড়ি বেঁধে লরেটা স্কয়ারে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়, যাতে ইটালির মানুষ এদের গায়ে থুথু দিতে পারে। *
————-
* অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলি– ১৯৩০ সনের দিকে ইউরোপ ভ্রমণের সময় বেনিতো মুসোলিনীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেখা হয়। মুসোলিনীর লেখা উপন্যাস ‘দ্য কার্ডিনালস মিসট্রেস’ (ইংরেজি অনুবাদ) পড়েও খুশি হন। মুসোলিনীর আতিথেয়তা এবং ভদ্রতায় রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হন। মুসোলিনী বিশ্বভারতীর জন্য অর্থ সাহায্যও করেন। রবীন্দ্রনাথ ঘোষণা করেন, মুসোলিনী একজন অসাধারণ রাষ্ট্রনায়ক এবং আঁর অতি পছন্দের। বড় মানুষদের ভুলগুলিও সাধারণত বড় হয়ে থাকে।