৩০. আনন্দে যা চান অন্যকে দিয়ে তাই করার পথ

ত্রিংশ পরিচ্ছেদ
আনন্দে যা চান অন্যকে দিয়ে তাই করার পথ

১৯১৫ সালে আমেরিকা প্রায় স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। কারণ এক বছর ধরে ইউরোপের দেশগুলো মানুষের ইতিহাসে যা হয়নি সেইভাবে পরস্পর হত্যার রক্তাক্ত তাণ্ডবে মেতে ওঠে। স্বপ্নেও এ ঘটনা কেউ ভাবেনি। শান্তি কি আর আনা যাবে? কেউ তা জানতো না। কিন্তু উড্রো উইলসন একবার চেষ্টা করে দেখবেন ভাবলেন। তিনি ঠিক করলেন ইউরোপের যুদ্ধোন্মাদ সব মানুষের কাছে তার ব্যক্তিগত শান্তির দূত পাঠাবেন।

সেক্রেটারি অব স্টেট উইলিয়াম জেনিংস ব্রায়ান, যিনি শান্তির প্রবক্তা ছিলেন, ব্রায়ানের যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। তিনি দেখলেন মানুষের সেবায় বিরাট একটা কাজ করে নিজেকে অমর করে তোলা যাবে। কিন্তু উইলসন অন্য একজনকে কাছে ডাকলেন তিনি হলেন তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু কর্ণেল হাউস। কর্ণেল হাউসকেই দায়িত্ব দেয়া হলো ব্রায়ানকে অসন্তুষ্ট না করে অপ্রিয় সংবাদটা তাঁকে জানাবার জন্য।

কর্ণেল হাউস তাঁর ডায়েরীতে লিখেছিলেন, ‘ব্রায়ান দৃশ্যতই হতাশ হয়েছিলেন যখন তিনি শুনলেন শান্তির দূত হিসেবে আমি ইউরোপে যাবো, তিনি ভেবেছিলেন কাজটা তিনি করবেন …।‘

‘আমি উত্তর দিলাম যে প্রেসিডেন্ট মনে করছেন কারও পক্ষে সরকারীভাবে যাওয়াটা সমীচীন হবে না, আর তিনি গেলে লোকের কৌতূহল জাগবে এবং লোকে ভাববে তিনি কেন গেলেন …।

ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন? হাউস যা বললেন তার অর্থহলো ব্রায়ান বিরাট ব্যক্তি, তার পক্ষে কাজটা যোগ্য হবে না–আর ব্রায়ান তাতে খুশি হলেন।

কর্ণেল হাউস দুনিয়ার হালচাল সম্পর্কে অভিজ্ঞ মানুষ তাই তিনি মানবিক সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ নিয়মই মেনে চলেছিলেন : ‘অপরকে দিয়ে যা করাতে চান সেটা তাকে খুশি হয়ে করতে দিন।

উড্রো উইলসন, উইলিয়াম গিবন ম্যাকাডুকে তার ক্যাবিনেটের সদস্য হওয়ার সময়েও এই নীতি মেনে চলেছিলেন। এটাই ছিল কাউকে তিনি যা দিতে পারতেন সেই সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান। অথচ উইলসন এমনভাবেই কাজটা করলেন যাতে অন্যজন দ্বিগুণভাবে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবেন। ম্যাকাডুর নিজের কথাতেই ব্যাপারটা শুনুন : তিনি (উইলসন বললেন যে তিনি খুবই খুশি হবেন আমি যদি তার মন্ত্রিসভায় অর্থদপ্তরের সেক্রেটারির পদ গ্রহণ করি। সব ব্যাপার চমৎকারভাবে উপস্থাপিত করার সুন্দর দক্ষতা তাঁর ছিল। তিনি এমনভাবে কথাটা উপস্থাপন করতেন মনে হতো তিনি কাজটা করলে যেন তাঁকে অনুগ্রহ করা হচ্ছে।’

দুর্ভাগ্যবশত উইলসন সব সময়েই এই কৌশল কাজে লাগান নি। তা যদি করতেন, তাহলে ইতিহাস হয়তো অন্যরকম হতো। যেমন, উইলসন আমেরিকাকে লীগ অব নেশনসে নেবার ব্যাপারে সেনেট আর রিপাবলিকান দলকে খুশী করতে পারেন নি। উইলসন ইলিহুরুট বা হিউজেস বা হেনরি ক্যাবট লজকে বা অন্য কোন রিপাবলিকানকে তার সঙ্গে শান্তির সভায় নিয়ে যাননি। বদলে তিনি নিয়ে যান তাঁরই দলের অখ্যাত লোকদের। তিনি রিপাবলিকান সদস্যদের পাত্তা না দিয়ে এটা স্বীকার করতে রাজিও হন না যে লীগ তৈরির কাজে তাঁর মত তাদেরও দান আছে, তাদের কোন ভাবেই অংশদানে তিনি রাজি হন না। আর এইরকম মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার ভুল কাজের ফলে উইলসন নিজের কর্মজীবন নষ্ট করেন, স্বাস্থ্যের ক্ষতি করেন, জীবনসীমা কমিয়ে আনেন, আমেরিকাকে লীগের বাইরে থাকতে বাধ্য করেন আর বিশ্ব ইতিহাসের ধারাও বদলে দেন।

বিখ্যাত প্রকাশন প্রতিষ্ঠান ডবলিউ পেজ এই নীতি অনুসরণ করতেন। অপরকে আপনার ইচ্ছামত কাজে উদ্বুদ্ধ করুন। প্রতিষ্ঠানটি এতই দক্ষ ছিল যে ও হেনরি জানিয়ে ছিলেন, ডবলিউ পেজ তার কোন গল্প প্রকাশে অনিচ্ছা এমনভাবে প্রকাশ করতেন এবং তাতে এমন মহত্ব আর প্রশংসা থাকতো যে অন্য প্রকাশক গল্পটি প্রকাশনার জন্য গ্রহণ করলে তিনি এতে বেশি আনন্দ লাভ করতেন। কিন্তু ডবলিউ পেজ প্রত্যাখ্যান করলে তিনি সব চাইতে বেশী খুশী হতেন।

.

আমি একজন লোককে জানি যিনি বক্তৃতা দানের বহু আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করতেন। এসব আমন্ত্রণ আসত এমন সব বন্ধুদের কাছ থেকে যাদের কাছে তিনি কৃতজ্ঞ। অথচ তিনি তা এমন কৌশলে প্রত্যাখ্যান করতেন যে তাঁরা প্রত্যাখ্যানে দুঃখ পেতেন না। তিনি কি করে এটা করতেন? শুধু তিনি দারুণ ব্যস্ত একথা বা অন্য কোন কারণ দেখিয়ে নয়। না, বরং আমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি আর একজন বক্তার নাম প্রস্তাব করতেন। আসলে তিনি অন্যকে আঘাত দিতেন না। বরং আর একজনের নাম করে সুযোগ দিতেন। আর এতে কাজ হতো চমৎকার। অন্য ব্যক্তি অসন্তুষ্ট হওয়ার সুযোগ পেতেন না।

জে. এ ওয়ান্ট প্রতিষ্ঠানের একজন মেকানিকের মনোভাব বদলের ব্যাপারে উদগ্রীব হন। প্রতিষ্ঠানটি ছিল বিখ্যাত মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান। মেকানিকের কাজ ছিল সারাদিন রাতে কাজ করা টাইপ রাইটার আর অন্যান্য মেশিন কর্মক্ষম রাখা। সে বারবার অভিযোগ করত কাজের সময় বড় বেশি, কাজও প্রচুর, তার একজন সহকারী চাই।

জে. এ. ওয়ান্ট তাকে সহকারী না দিয়েই তাকে সুখী করেন। কিভাবে? এই মেকানিকের ব্যবহারের জন্য একটা ব্যক্তিগত অফিস দেওয়া হয়। তার নাম দরজার উপর সেঁটে দেওয়া হয় এইভাবে ম্যানেজার, সার্ভিস ডিপার্টমেন্ট।

সে আর সামান্য মিস্ত্রী রইলো না, যাকে রাম, শ্যাম, যদুরা হুকুম করতে পারে। এখন সে একজন ম্যানেজার। সে পেল সম্মান, শ্রেষ্ঠত্ববোধ। এরপর থেকে সে বেশ আনন্দেই অভিযোগ ছাড়া কাজ করে চলেছিল।

ছেলেমানুষী ভাবছেন এটাকে? হয়তো ভাই। কিন্তু সবাই নেপোলিয়নকেও একথা বলেছিল তিনি যখন লিজিয়ন অব অনার সৃষ্টি করে সেটা তার সৈন্যদলের মধ্যে ১৫০০ জনকে পদক বানিয়ে বিতরণ করেন আর ১৮ জন সেনাপতিকে ‘ফ্রান্সের বীর’ আখ্যা দেন এবং সৈন্যবাহিনীকে ঘোষণা করেন গ্র্যাণ্ড আর্মি বলে। এই যুদ্ধে ওস্তাদ সেনাদের তিনি খেলনা দিচ্ছেন বলে নেপোলিয়ানের সমালোচনা করা হতে থাকে। জবাবে নেপোলিয়ন বলেন, মানুষ খেলনার দাস।

নেপোলিয়ন যে কৌশল নিয়েছিলেন সেটা আপনার ব্যাপারেও কাজে লাগাতে পারে। আমার একজন বান্ধবী মিসেস জেন্ট, যার নাম আগেও উল্লেখ করেছি, নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলেন। ছেলেরা দৌড়োড়ৌড়ি করে তাঁর বাড়ির বাগান নষ্ট করছিল। তিনি সমালোচনা, বকাবকি, অনেক কিছু করলেও তাতে কাজ হলো না। এরপর তিনি ছেলের দলের সবচেয়ে দুষ্টু নেতাকে একটা পদবী দিয়ে তাকে তার ‘গোয়েন্দা’ হিসেবে কাজে লাগালেন এইসব বন্ধ করতে। এতেই সমস্যার সমাধান হলো। সেই ‘গোয়েন্দা বাগানে আগুন জ্বালিয়ে একটা লোহার শিক গরম করে ভয় দেখাতে লাগল, যে বাগানে পা দেবে তাকে ছ্যাঁকা লাগানো হবে।

এই হলো মানুষের চরিত্র। অতএব অপরকে অসন্তুষ্ট না করে যদি স্বমতে আনতে চান ৯ নম্বর নিয়ম হল :

‘অপরকে দিয়ে যা করাতে চান তা তাকে খুশি মনে করতে দিন।‘

.

অল্প কথায়

অপরের অসন্তোষ না জাগিয়ে তাকে পরিবর্তনের নটি উপায়।

১: প্রশংসা আর আন্তরিক তারিফ দিয়ে শুরু করুন।

২: অপরের ভুল ঘুরিয়ে দেখান।

৩ : অন্যকে সমালোচনার আগে নিজের ভুলের কথা বলুন।

৪ : সরাসরি আদেশ না দিয়ে প্রশ্ন করুন।

৫: অপরকে মুখ রক্ষা করতে দিন।

৬ : সামান্য উন্নতিতেই প্রশংসা করুন আর প্রত্যেকটা উন্নতিতেও প্রশংসা করুন এবং সেটা আন্তরিক ভাবেই করুন।

৭ : অন্যকে প্রশংসা করুন তাতে সে ভালো হবার চেষ্টা করবে।

৮ : প্রশংসা করুন, ত্রুটি সংশোধন যে কঠিন নয় সেটা বুঝিয়ে দিন।

৯ : অপরকে খুশি মনে আপনার কাজ করতে দিন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *