৩০ আগস্ট, সোমবার ১৯৭১
ভোর হয়ে আসছে। ওরা এখনো ফেরে নি। ক্যাপ্টেন কাইয়ুম বলেছিল আধঘন্টা পৌঁনে একঘন্টা পরে ফিরবে। আমিও সে বিশ্বাসে ঘর-বার করে পাঁচ ঘন্টা কাটিয়ে দিলাম? ওরা তো সোজাসুজি ধরে নিয়ে যেতে পারত কিছু না বলে। ক্যাপ্টেন কাইয়ুম মিথ্যে কথা বলল তাহলে?
ক্যাপ্টেন কাইয়ুম গাড়িতে উঠার আগে ওর ফোন নম্বরটা জিগ্যেস করেছিলাম। কেন জিগ্যেস করেছিলাম? তাহলে কি অবচেতন মনে আমারও সন্দেহ ছিল যে ওরা অত তাড়াতাড়ি ফিরবে না?
ঘড়িতে ছটা বাজল। জুবলীর বাসায় ফোন করলাম। জুবলীর ভাইয়ের ছেলে হাফিজ আমাদের বাসা থেকে গ্রেপ্তার হয়েছে–তাকে খবরটা আগে জানানো দরকার। একটা আশার কথা, জুবলীর বড় ভাই ফরিদ এখন ঢাকার ডি.সি। উনি হয়তো এ ব্যাপারে কোনো সাহায্য করতে পারবেন।
তারপর ফোন করলাম মঞ্জুরকে, মিকিকে।
আধঘন্টার মধ্যে জুবলী, মাসুমা আমাদের বাসায় এসে গেল। ওদের দেখে এতক্ষণে এই প্রথম আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম। ওরা আমাকে গভীর মমতায় জড়িয়ে ধরে চুপ করে রইল। সান্ত্বনার ভাষা কারো মুখে নেই। ওরাও তো সমান দুঃখে দুঃখী। একজনের স্বামী, অন্যজনের ভাই বর্বর পাকবাহিনীর বন্দিশালায়।
একটু পরে নিজেকে সামলে বাবার ঘরে গেলাম ওঁকে উঠিয়ে মুখ-হাত ধুইয়ে হলে ইজিচেয়ারে বসাতে। জুবলী, মাসুমা রান্নাঘরে গেল বারেককে নিয়ে কিছু চা-নাশতার ব্যবস্থা করতে।
বাবাকে তুলতেই উনি বিস্মিত স্বরে বলে উঠলেন, মাগো, তুমি কেন? মাসুমা কই?
আমি প্রাণপণে গলা স্বাভাবিক রেখে বললাম, ওরা চারজনেই ভোরবেলা উঠে সাভার গেছে। আজ ওখানে হাটবার কিনা, সস্তায় কিছু বাজার করে আনবে।
বাবা আর কিছু বললেন না।
ওঁকে চা-নাশতা খাইয়ে নিচে গিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলাম। শুধু এক কাপ চা ছাড়া আর কিছু খেতে পারলাম না, মাসুমা, জুবলীর পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও।
হঠাৎ গেটের কাছে গাড়ির শব্দ হল। দৌড়ে পোর্চে বেরোলাম। একটা সাদা গাড়ি। শরীফরা ফিরে আসছে। আমাকে দৌড়ে গেটের কাছে যেতে দেখেই কিনা জানি না গাড়িটা ঘঁাচ করে গলিতেই থেমে গেল। সঙ্গে সঙ্গে নিরাশায় মন ভরে গেল। গাড়িতে মাত্র একজন আরোহী –সে-ই চালাচ্ছে। গাড়িটাও টয়োটা, আমাদের হিলম্যান মিংকস্ নয়। দরজা খুলে চালক নামতেই দেখলাম স্বপন! তার গায়ে টটকে লাল একটা জামা, চুল উস্কখুস্ক, চোখ লাল, মুখে উদভ্রান্ত ভাব। সে কিছু বলার আগেই আমি দৌড়ে তার কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম, শিগগির পালাও স্বপন। রুমী ধরা পড়েছে। কাল রাতে আর্মি এসে বাড়িসুদ্ধ সবাইকে নিয়ে গেছে। শিগগির চলে যাও এখান থেকে। এভাবে গাড়িতে একা ঘুরো না। কোথাও লুকিয়ে থাক।
স্বপনের মুখ দিয়ে একটাও কথা বেরোল না। সে তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে বসতেই আমি একপাশে সরে দাঁড়ালাম। সে গেটে গাড়ি ঢুকিয়ে ব্যাক করে বেরিয়ে চলে গেল। আমি শূন্য মন নিয়ে ঘরে এসে বসলাম। দশ মিনিট যেতে না যেতেই দরজায় খুব আস্তে ঠুকঠুক নক। আমি লাফ দিয়ে উঠে দরজা খুলতেই দেখি দুটি ছেলে দাঁড়িয়ে-শুকনো মুখ, চোখের চাউনিতে চাপা ভয়। ওরা ঘরে ঢুকলে বললাম, তুমি শাহাদত চৌধুরীর ছোট ভাই ফতে না? আর তুমি জিয়া। তোমরা কেন এসেছ? শিগগির পালাও। কাল রাতে রুমীকে নিয়ে গেছে, ঐ সঙ্গে বাড়ির সবাইকে।
ফতে অস্পষ্ট স্বরে বলল, আমাদের বাড়িও রেইড হয়েছে। আর্মি আমার সেজো দুলাভাইকে ধরে নিয়ে গেছে।
আর কাউকে নিয়েছে?
না, আমি কাল বিকেলেই খবর পেয়েছিলাম, সামাদকে ধরেছে। আমি আমার ছোট দুই বোনকে নিয়ে হাটখোলার বাড়ি থেকে অন্যখানে চলে গেছিলাম, সেজো দুলাভাই কদিন আগেই গ্রাম থেকে ঢাকা এসেছিলেন। তাই উনি আব্বা-মার সঙ্গে বাড়িতেই ছিলেন।
তোমরা আর দাঁড়ায়ো না। তাড়াতাড়ি চলে যাও।
ফতে আফসোস আর দুঃখভরা স্বরে বলল, আমি এ বাড়ি চিনতাম না। কাল রাতে আন্দাজে এ গলি সে গলি অনেক খুঁজেছি–যদি রুমীকে খবরটা দিতে পারি–আজ সকালে জিয়াকে পেয়ে–জিয়া এ বাসা চেনে–তা কোন লাভ হল না–
কথা অসমাপ্ত রেখেই ফতে আর তার পাশে পাশে মাথা নিচু করে জিয়া বেরিয়ে গেল।
পড়শীরা একে একে আসতে শুরু করেছেন। তারা সবাই রাতে জেগে উঠে নিজ নিজ ঘরের মাঝখানে কাঠ হয়ে দাড়িয়েছিলেন, কিন্তু কেউ দরজা খুলতে সাহস পান নি। সানু, মঞ্জ, খুকুর হেফাজতে আমাকে রেখে মাসুমা, জুবলী পরে আবার আসবে বলে বিদায় নিল।
আটটার সময় থেকে আর্মি এক্সচেঞ্জে ফোন করতে লাগলাম ক্যাপ্টেন কাইয়ুমকে চেয়ে। কিন্তু কোন হদিস করতে পারলাম না। একবার বলে উনি এখনো আসেন নি। আরেকবার শুনি এই একসটেনসান ওনার নয়। অন্য একসটেনশান নম্বর দেয়–সেখানে চাই, তারা আবার অন্য একটা নম্বর দেয়।
নটার সময় মঞ্জুর, মিকি বাসায় এলেন। বাঁকা ঢাকায় নেই, চাটগাঁয়। মঞ্জুর মিকি সব শুনে বললেন, অফিসে গিয়ে খোঁজখবর করি। দেখি কি করা যায়।
সাড়ে নটার সময় দরজায় কলিং বেল বাজল। দৌড়ে গিয়ে খুলে দেখি, হাফিজ। একা।
হাফিজকে টেনে ঘরের ভেতর এনে বুকে জড়িয়ে ধরলাম, হাফিজ! তুই এসেছিস বাবা। তুই একা কেন? তোর খালু কই? রুমী, জামী, মাসুম?
হাফিজের পরনে লুঙ্গি আর সাদা পাঞ্জাবি দলামোচড়া, ধুলোময়লা মাখা। চোখে মুখে গভীর যন্ত্রণার ছাপ। সে এমনিতেই খুব আস্তে কথা বলে, এখন গলার স্বর প্রায় শোনাই গেল না, জানি না।
ওর উদ্ভ্রান্ত চেহারা দেখে ওকে আগে বসালাম। প্রথমে ও পানি খেল দুই গ্লাস। তারপর ওকে চা এনে দিলাম এককাপ। ও একটু সুস্থির হয়ে বলল–ওদেরকে প্রথমে মেইন রোড়ে নিয়ে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে সামনে একটা জীপের হেডলাইট জ্বালিয়ে সবাইকে সনাক্ত করে। তারপর রুমীকে আলাদা করে নিয়ে ওদের জীপে ওঠায়। হাফিজ, মাসুম, জামীকে শরীফের গাড়িতে উঠতে বলে। শরীফকে বলে তাদের জীপটাকে ফলো করতে। কয়েকজন পুলিশও রাইফেল হাতে শরীফের গাড়িতে ওঠে। মেইন রোডে ঐ জীপটা ছাড়াও আরো কয়েকটা জীপ ও লরি দাঁড়িয়েছিল। ওরা জীপ ফলো করে এয়ারপোর্টের উল্টোদিকে এম.পি.এ. হোস্টেলে যায়। সেখানে ওদের সবাইকে নিয়ে একটা ঘরে রাখে। সেখানে সারারাত ধরে ওদের সবার ওপর খুব মারধর করা হয়েছে।
বলতে বলতে হাফিজের ঠোট কেঁপে গেল। আমি বললাম, ঠিক আছে, এখন আর বলতে হবে না। তুই হাত-মুখ ধুয়ে নাশতা খেয়ে একটু বিশ্রাম কর। তোর চাচাকে ফোন করি।
হাফিজের খুব ইচ্ছে নয় চাচাকে ফোন করার। এই চাচার সঙ্গে ওদের বিশেষ সম্পর্ক নেই। ও বলল, জেবিসকে জানালেই হবে।
জুবলীকে ফোন করে বললাম, হাফিজকে ছেড়ে দিয়েছে। হাফিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার চাচা ফরিদকে ফোন করে জানালাম সমস্ত ব্যাপারটা। এই বিপদে আত্মীয়ের ওপর অভিমান রাখতে নেই।
মিকি, মঞ্জরকেও ফোন করে হাফিজের কাছ থেকে পাওয়া খবরগুলো জানালাম।
হাফিজ ওপরের ঘরে বিছানায় শুয়ে খানিক বিশ্রাম করে জুবলীদের বাসায় চলে গেল।
আমি খানিক পরপরই আর্মি এক্সচেঞ্জে ফোন করে চলেছি। সেই বিহারি সুবেদার তার নাম বলেছিল সফিন গুল। কাইয়ুম নেই বললে গুলকে দিতে বলি। তাকেও পাওয়া যায় না।
ওপরে বাবা খুব অস্থির হয়ে উঠেছেন–শরীফরা এখনো ফিরছে না কেন?
আতাভাইকে ফোন করেছি, বাদশাদের এবং অন্য আত্মীয়দের খবর দিতে। ভাবছি আতাভাই বা ইলা-বাদশারা এলে তারপর বাবাকে আসল কথাটা বলতে হবে।
সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। এখনো পর্যন্ত শরীফদের কোন খবর নেই। মঞ্জুর-মিকি ওরা সারাদিন এই ব্যাপার নিয়েই দৌড়োদৌড়ি করছে। কিন্তু এখনো কোন হদিস লাগাতে পারে নি।
আমি সারাদিনে ক্যাপ্টেন কাইয়ুম বা সুবেদার সফিন গুল কাউকেই ফোনে ধরতে পারি নি। ভাবছি ব্যাপারটা কি? ওরা মিছে নাম বলে যায় নিত?
সারাদিন ধরে বাসায় লোকজন আসছে –আতাভাইরা, ইলা-বাদশারা, কলিম, হুদা, নজলু, মা, লালু, আতিক, বুলু। পেছনের রাস্তার বজলুর রহমান সাহেবের স্ত্রী, কাসেম সাহেব, সাত্তার সাহেব। এ রাস্তার সব পড়শী, মাসুমা, জুবলী আবার বিকেলে মিনি ভাই, রেবা, লুলু, চাম্মু। আমার হঠাৎ মনে হল, আচ্ছা, এদের প্রাণে কি ভয়ডর নেই? এরা যে এত আসছে? মেইন রোডের মুখে নিশ্চয় সাদা পোশাকে আই.বির লোক নজর রাখছে। এদের তো বিপদ হতে পারে।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় হঠাৎ কপাল খুলে গেল, ফোনে সুবেদার সফিন গুলকে পেয়ে গেলাম। সফিন গুল খুবই বিনয়ের সঙ্গে জানাল ইন্টারোগেশানে কুছু দেরি হোচ্ছে, আপুনি কুছু ফিকির কোরবেন না। উনারা ইন্টাররোগেশান শেষ হোলেই বাড়ি চলে যাবেন।
আমি বললাম, ওরা কেমন আছে? কি এত ইন্টারোগেশান? আমি কি আমার স্বামী কিংবা ছেলে কারো সঙ্গে কথা বলতে পারি।
সফিন গুল একটু দ্বিধা করে বলল, ঠিক আছে। ডাকছি কোথা বোলেন।
একটু পরে জামীর গলা শুনতে পেলাম মা–আমি জামী–
আমি একেবারে উচ্ছসিত ব্যাকুল হয়ে উঠলাম, জামী, কি ব্যাপার তোদের এখনো ছাড়ে নি কেন? কেমন আছিস তোরা?
জামী থেমে থেমে বলল, ছাড়বে। ভালো আছি।
রুমী কেমন আছে? তোর আব্ব? মাসুম?
জামী সেই রকম ছাড়া ছাড়া ভাবে বলল, ভালো।–এখন ছাড়ি।
জামী–-জামী, তোরা খেয়েছিস কিছু?
না।
বলিস কি? এখনো কিছু খেতে দেয় নি? দে তো সুবেদার সাহেবকে ফোনটা
ফোনে সুবেদারের সাড়া পেয়ে আমি বললাম, এখনো পর্যন্ত ওদের কিছু খেতে দেন নি? কাল রাত বারোটায় নিয়ে গেছেন এখন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা–এতক্ষণ পর্যন্ত ওরা
খেয়ে রয়েছে? আপনার দোহাই সুবেদার সাহেব, ওদের কিছু খেতে দিন। না হয় ওদের কাছ থেকেই টাকা নিয়ে কিছু কিনে এনে দিন।
সুবেদার ঠিক হ্যায়, ঠিক হ্যায়, আভি দেতা হ্যায় বলে ফোন রেখে দিল। আমি খানিকক্ষণ থম ধরে বসে বসে ফুললাম। তারপর হঠাৎ কান্নায় মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়লাম।