৩০. অম্বর গ্রাম ঘুরতে বেরিয়েছিল

৩০

অম্বর গ্রাম ঘুরতে বেরিয়েছিল। ভোর ভোর। কলকাতায় সাড়ে সাতটার আগে সে চোখ খোলে না, কিন্তু এই রানিগড়ে এলে কোন জাদুতে যে ঘুম ভেঙে যায়। স্রেফ আয়েশ করে আরও যে খানিকক্ষণ শুয়ে থাকবে, তার জো নেই। কেউ যেন তাকে ঘেঁটি ধরে তোলে বিছানা থেকে, ঠেলা মেরে পাঠিয়ে দেয় রাস্তায়। আশ্চর্য, কলকাতায় এমনটা ঘটলে দিনভর গা ম্যাজম্যাজ, অথচ রানিগড়ের প্রভাতী বাতাস পেয়ে দিব্যি টনকো হয়ে ওঠে শরীর। এই সময়টাতেই ঘাস-মাটি-খাল-বিল-মাঠ-পুকুর এমনকী গাছগাছালি থেকেও উঠে আসে বাচ্চাবেলার অপার্থিব গন্ধ। আলাদা কিসিমের একটা মৌতাত ছড়িয়ে যায় প্রাণে।

রানিগড় এগারো পাড়ার গ্রাম। মোটামুটি বড়ই। হাঁটতে হাঁটতে চরণদিঘি পেরিয়ে মহাবটতলা ছাড়িয়ে কখন যে গ্রামের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে অম্বর। এবার সরু হয়ে আসা মেঠোপথের দু’ধারে শুধুই ধানখেত। মাঝে মাঝে সবজি চাষও আছে কোথাও কোথাও। কচি ধানগাছের গাঢ় সবুজে তাকিয়ে থাকতে কী যে আরাম লাগে। রানিগড়ের মাঠেঘাটে এখন প্রবল শরৎ। সবুজের চালচিত্রে ধপধপে কাশফুল দুলছে হাওয়ায়, এ ছবিটা যেন আরও মায়াবী।

সূর্য অনেকটা উঠে গেছে। এবার ফিরতে হয়। অম্বর ঘুরল। আর নিসর্গ নয়, কেজো চিন্তাগুলো আসছে একে একে। যে কাজে এবার রানিগড় আসা, তা হয়েছে মোটামুটি। বাড়ির কোথায় কী কাজ হবে তার একটা অনুপুঙ্খ তালিকা বানাতে বলেছিল বড়কাকা। আগের এস্টিমেটটা ভাতারের দীনেশবাবুকে দিয়ে একবার যাচাই করিয়ে নেওয়ারও নির্দেশ ছিল। একতলা দোতলার বাথরুমদুটো আগাপাশতলা বদলাতে কেমন কী খরচা পড়তে পারে, সেটাও বড়কাকা জানতে চায়। কমোডের জন্যে ছাদে একটা ট্যাংক বসাতে হবে, সেই হিসেবও জুড়তে হল খরচের লিস্টে। সব মিলিয়ে দু’লাখ তিরিশ তো হয়ে গেল, দেখে বড়কাকা না চটে যায়।

আরও একটা দায়িত্ব ছিল অম্বরের। বাবা কাকারা কে কী দিতে পারবে, তা খোলসা করে জানা। এই কাজটা সবচেয়ে দুরূহ। বাবা তো শুনেই এমন একটা চোখে তাকাল, যেন গ্রিক কিংবা লাতিন শুনছে। তারপর আমতা আমতা করে যা বলল তার মর্মার্থ এই, গোটা পরিবারের হয়েই তো সে চাষবাস দেখে, সেই সব খরচ-খরচা সামলে, সংসার চালিয়ে, কীই বা নগদ থাকে তার হাতে! কথাটা অবশ্য একেবারে ভুল নয়। বীজ সার লেবারের ভাও লাফিয়ে লাফিয়ে চড়ছে। সেচের জল পয়সা দিয়ে কিনতে হয়। ইরাকে যুদ্ধ বেধে ডিজেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওই জল তো এখন তরল সোনা। ট্র্যাক্টর পাম্প কোনটারই বা ভাড়া এক জায়গায় দাঁড়িয়ে? বেচারা বাবা তো অসহায় বোধ করবেই। বাকি দু’জন তো দুই পদের। ছোটকাকার কানে যাওয়া মাত্র কেমন উদাস হয়ে গেল। তক্ষুনি তার দরকার পড়ল কাকে যেন ফোন করার। এবং মোবাইলে কথা বলতে বলতে ঘর ছেড়ে দ্রুত নিষ্ক্রমণ। আর মেজোকাকা? তিনি তো আরও সরেস। থুতনি ঝুলিয়ে ভাবল একটুক্ষণ। তারপর তুম্বো মুখে বলল, উমম, দেখছি। সেই দেখা এখনও ফুরোয়নি। অর্থাৎ ঝেড়ে কাশতে রাজি নয়। অম্বরের আর কী, সে বড়কাকাকে জানিয়ে দেবে। যা করার বড়কাকাই করুক। মিস্ত্রি লাগবে তো সেই ডিসেম্বরে, এখনও মাঝে অনেকটা সময় আছে।

কিন্তু অম্বরের নিজের কাজগুলো? তন্ময়কে কবিতা দেওয়া ছাড়া অন্তত দু’খানা ভাল প্রবন্ধ এনে দেবে বলছিল, একটাও পারেনি। রজত দাশগুপ্তর বাড়িতেও হানা দিয়েছিল, তিনি এমন হাতজোড় করে বিদেয় করলেন, অম্বর তো পালাতে পারলে বাঁচে। সোমনাথ পাইন হুগলির পুরনো মন্দিরের ওপর একটা বড় লেখা দেবেন বলে কথাও দিলেন, শেষমুহূর্তে কেসটা ঝুল খেয়ে গেল। হুগলিরই এক পত্রিকা নাকি লেখাটা কেড়ে নিয়ে গেছে! যত্তো সব ঢপ! ওই কাগজের নাম বেশি তো, তাই ওখানেই চালান করেছেন লেখাটা। এই সব বুদ্ধিজীবীগুলো এমন দু’নম্বরি হয়, বাপস! খুব কাঁউকাঁউ করছে শিবেন, কিন্তু অম্বর তো নাচার।

আর শেষ কাজটা? মূলত যে উদ্দেশ্যে এবার রানিগড়ে আসা? নিজের মুখোমুখি হওয়া, আর সেই সঙ্গে একটা কিছু সিদ্ধান্তগ্রহণ? সব কিছু জেনেশুনেও আঁচলকে অনিশ্চিত ভাগ্যের হাতে ছেড়ে রাখবে, নাকি নিজের মতো করে একটা চেষ্টা চালাবে? যাতে আঁচলের ভাল হয়। বিবেক বড় জ্বালাচ্ছিল কলকাতায়, রানিগড়ের নিরালাটুকু বড্ড জরুরি ছিল অম্বরের। কিন্তু দু’দিন ধরে ভেবে যা সে স্থির করল, সেটাই বা কতটা বাস্তবসম্মত? উলটো বিপত্তি ঘটবে না তো?

মুসলমান পাড়ার মুখে এসে অম্বরের চিন্তা থমকে গেল। অদূরে জহিরুল। পরনে পাজামা টি-শার্ট, সামনের চুল উঠে গিয়ে খানিকটা বয়স্ক লাগে ছোটবেলার সহপাঠীকে। মাথা ভালই ছিল জহিরুলের, তবে কলেজ পাশ করেছে গড়িয়ে গড়িয়ে। কমার্স নিয়ে। ভাতারে কলেজে ঢুকে তেরঙায় ভিড়েছিল, ওতেই লেখাপড়া বরবাদ। এখন গুসকরায় কি একটা ছোটখাটো ব্যবসা করে।

অম্বরই হাঁক ছাড়ল, “কী রে, আছিস কেমন?”

“ভাল নয় রে। দোকানটা তো উঠেই গেল।”

“কীসের যেন দোকান দিয়েছিলি?”

“মোবাইল সারাইয়ের। মেকানিক রাখিনি, নিজেই করতাম, বেশ দু’-চার পয়সা আসছিল…”

“তা বন্ধ হয়ে গেল কেন?”

“লাল পার্টির জ্বালায়। এবার ঘাসফুলের হয়ে খেটেছিলাম যে। তখনই শাসিয়েছিল, ভোটের পর হিসেব হবে। ভেবেছিলাম আমরা জিতে গেলে গায়ে হাত দিতে সাহস পাবে না। কী কাণ্ড, হেরে গিয়ে গুলি ফোলানো আরও বেড়ে গেল। নিজেরা এল না বটে, কিন্তু ট্রেড লাইসেন্স নেই অজুহাত দেখিয়ে পুলিশ পাঠিয়ে তালা ঝুলিয়ে দিল দোকানে।”

“তোর ছিল ট্রেড লাইসেন্স?”

“ধুস, আমাদের বাজারে ক’টা দোকানের লাইসেন্স আছে রে? আমি তো তাও বলেছিলাম, নিয়ম থাকলে আমাকে কাগজ-ফাগজ করিয়ে দাও। শালারা কিছু শুনলই না। শুধু কি আমাকে? ভান্টু, ধীরাজ, সনৎ সব্বাইকে আউট করে দিয়েছে।

“ছি ছি কী অন্যায়। তুই বিয়েশাদি করেছিস, বাচ্চাকাচ্চা হয়েছে… তোর তো বোধহয় দুটো মেয়ে, তাই না?”

“হ্যাঁ, বড়টা পাঁচ, ছোটটার এখনও তিন হয়নি…”

“তা কী করবি এখন?”

“ওই ঘাসফুলই করব। পেটে কিল মেরে। দাঁড়া না, আর তো দেড়টা বছর… ইনশাল্লাহ যদি এ রাজ্যের গদিটা উলটোয়… ওদের পার্টি অফিসে আমি মোবাইলের শোরুম খুলব। আর এই তোকে আমি বলে রাখছি, যার যার গায়ে লালেদের সামান্য গন্ধ আছে, সেই সব ক’টা হারামজাদাকে যদি বাঁশপেটা করে না তাড়াই তো আমার নাম জহিরুল আলম নয়।”

“তুই তো হেব্বি খেপে আছিস? মারের বদলা মার দিলেই কি সমস্যা মিটবে? ওরা আবার সুযোগ পেলে…”

“ওই সব গাধীঁমার্কা ডায়ালগ ছাড় তো। তেরঙ্গা করার সময় আমিও ওরকম কপচেছি। ঝাড়ও খেয়েছি বিস্তর। লালেরা একটা দাওয়াই শুধু বোঝে। মারের পালটা মার। এমনি এমনি ঘাসফুলে এসেছি নাকি? সুদেমূলে সব উশুল করব না?” জহিরুলের চোখ দু’খানা জ্বলে উঠল যেন। গোমড়া গলায় বলল, “কিছু মনে করিস না অম্বর, তোর কাকারও কিন্তু কপালে দুঃখ আছে।”

অম্বর থতমত, “তুই ছোটকাকার কথা বলছিস। কাকা তো এসব নোংরামোতে থাকে না…”

“যতটা দেখান, উনি তত সাধু নন।” জহিরুলের স্বরে জমাট ক্ষোভ, “বিপদে পড়ে আমি তো প্রথমে ওঁর কাছেই গিয়েছিলাম। উনি আমায় হাঁকিয়ে দিলেন! সোজা বললেন, দ্যাখো বাপু ওদের এখন মাথা গরম হয়ে আছে, আমার কথায় কোনও কাজ হবে না। আর তুমিই বা ওই নোংরা পার্টিতে আছ কেন? থাকলে তার জন্য কিছু তো খেসারত দিতেই হবে।”

“ছোটকাকা এসব বলেছে?”

“নয়তো কি বানিয়ে বলছি? গিয়ে জিজ্ঞেস কর।” জহিরুল মাথা দোলাচ্ছে, “চাকা ঘুরছে, বুঝলি, চাকা ঘুরছে। সব জমা থাকছে, হিসেব হবে।”

“মাথা ঠান্ডা কর। নিজে পঞ্চায়েতে না দাঁড়িয়েও ছোটকাকা রানিগড়ের কত উন্নতি করেছে ভাব? ইলেকট্রিসিটি আনল, চরণদিঘির পাড় বাঁধাল, পাকা রাস্তা হল রানিগড়ে…”

জহিরুলের যেন পছন্দ হল না কথাটা। একটু ভ্রুকুটি করে বলল, “ছাড়। ওসব পরে ভাবব। …এখন ক’দিন আছিস তো বাড়িতে?”

“না রে, আজ ফিরতে হবে।” অম্বর মোবাইলে সময় দেখল, “চলি রে, কিছু গোছগাছ আছে।”

“পুজোয় আসছিস? ক’দিন তা হলে আড্ডা মারা যাবে।”

“দেখি। ইচ্ছে তো আছে, যদি পারি…”

জহিরুলের কাঁধে আলগা চাপড় দিয়ে এগোল অম্বর। আশ্বিনের মনোরম সকালে যাও বা সামান্য ফুরফুরে ভাব জেগেছিল, আবার কষটে গেছে মেজাজটা। কী যে হচ্ছে চারদিকে? জহিরুলের মতো আরও কত যে হাজার হাজার জ্বলন্ত আগুনের ফুলকি ছেয়ে ফেলছে রাজ্যটাকে! ছোটকাকারা কী করল এত দিন? শুধু গা শোঁকাশুকি আর দল বাড়ানো? কে কে বি পি এল কার্ড পেল, সরকারি ডোল কাদের হাতে পৌঁছেছে, অম্বর কি কিছুই দেখেনি? ঝান্ডা বও, মিছিলে চলো, তবেই না মিলবে খয়রাতি। এত সব তত্ত্ব জানা লোক একুটু বোঝে না, বিশজনকে বাড়তি অনুগ্রহ দেখালে আশিটা শত্রু তৈরি হয়? এতকাল তারা ভয়েভক্তিতে মুখ খুলতে পারেনি। এখন যদি একবার টের পায় ছোটকাকাদের পায়ের নীচের মাটি আলগা হয়ে গেছে, আর কি তাদের দিয়ে ভোটবাক্স ভরাতে পারবে?

শুধু কী তাই? ছোটবেলায় অম্বর দেখেছে, আর্থিক অবস্থার হেরফের থাকলেও রানিগড়ের মানুষদের মধ্যে একটা পরিবার-পরিবার ভাব ছিল। যে যেমনই হোক, সকলেই সকলের দাদা মামা কাকা জ্যাঠা জেঠি মাসি পিসি…। তেমন ধারা কি আছে আর? এখন কাকে আপন ভাবব তা তো ঠিক হয় পার্টির রং দেখে। যেন লাল তেরঙা ঘাসফুল হওয়া ছাড়া কারওর অন্য কোনও পরিচয় নেই। দু’বছর হোক কী দশ বছর, সরকার তো একসময়ে বদলাবেই। কিন্তু পুরনো সম্পর্কগুলো কি ফিরবে আগের মতো?

মহাবটতলায় এসে অম্বরের চলার গতি মন্থর হল সামান্য। উঁকি দিয়েছে সাধুবাবার আশ্রমটায়। নাহ, আজও দর্শন নেই, ঘরে আছেন বোধহয়। রানিগড়ে এলে একবার অন্তত মোলাকাত করে যায় মানুষটার সঙ্গে। মা বলছিল সাধুবাবার নাকি শরীরটা সুবিধের নয়, বড় একটা বেরোন-টেরোন না আজকাল। খুব স্বাভাবিক, বয়স তো কম হল না, জন্ম ইস্তক মানুষটাকে অম্বর দেখছে মহাবটতলায়। তখনই তো চুলদাড়ি পেকে সাদা। থাকতেন বটগাছের নীচে বাঁধানো বেদিটায়। গ্রামের লোকরাই চাঁদা তুলে বানিয়ে দিয়েছিল আশ্রমখানা। চারপাশে গাছপালা লাগিয়ে আশ্রমে বেশ তপোবন-তপোবন ভাব এসেছে। আশ্রম তো বটেই, বুড়ো মানুষটার সঙ্গও অম্বরের মন্দ লাগে না। একসময়ে তো দারুণ ভক্ত ছিল অম্বর। সাধুবাবা বিস্তর দেশ ঘুরেছেন। বিহার অসম ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশের জঙ্গল, হিমালয়, সবই তাঁর নখদর্পণে। রমতা যোগীর ভ্রমণবৃত্তান্ত শুনতে শুনতে বুঁদ হয়ে যেত অম্বর। ভারী ইচ্ছেও জেগেছিল ওই সাধুবাবার মতো ঝোলা কাঁধে বেরিয়ে পড়বে একদিন। আর বেরনো, কলকাতা অবধি গিয়েই না সে হাঁপিয়ে গেল!

অনেকদিন আগে অম্বরকে একটা ভারী মজার কথা বলেছিলেন সাধুবাবা। তার কপালে সাক্ষাৎ রাজযোগ। কিন্তু সেই কপালটি নাকি পাথরচাপা। যদি কোনও মতে ঠেলেঠুলে পাথরখানা সে সরাতে পারে, তার উন্নতি আর ঠেকায় কে! সুখও নাকি তখন উপচে পড়বে।

কথাটা কেন যে এখনই মনে পড়ল অম্বরের? আচমকাই? এর মধ্যে নিয়তির কি কোনও খেলা আছে? সেই প্রস্তরখণ্ডটি তো এখনও এক চুল হঠেনি। উলটে যার দিকে সে একটু নয়ন মেলে তাকিয়েছিল, তারও আজ বিশ্রী কপালপোড়া দশা। মাথায় তার চিন্তা ঘুরছে বলেই কি স্মৃতির পাতা দুলে উঠল?

বাখারির গেট ঠেলে অম্বর আশ্রমে ঢুকল। চটি খুলে উঠেছে সিমেন্টের দাওয়ায়। অল্প গলা তুলে ডাকল, “সাধুবাবা আছেন নাকি?”

খকখক কাশির শব্দ উড়ে এল। সঙ্গে ঘড়ঘড় স্বর, “কে ভাই?”

“কায়স্থপাড়ার অম্বর। আপনার খবর নিতে এলাম।”

আধো অন্ধকার ঘরটি থেকে লাঠি হাতে বেরিয়ে এলেন মানুষটা। দীর্ঘ দেহকাণ্ড বেশ কুঁজো এখন। তামাটে শরীরে জরার চিহ্ন রীতিমতো প্রকট। অম্বর ঢিপ করে প্রণাম করতেই অমলিন হেসে বললেন, “বেঁচে থাকো বাবা।”

“আপনি শুনলাম খুব ভুগছেন?”

“যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ ভোগান্তি। এ তো জগতের নিয়ম। …তা তুমি তো এখন কলকাতায়।”

“হ্যাঁ। কাকার বাড়িতে।”

“সেখানে নাকি রাজার হালে আছ?”

ব্যঙ্গের মতো শোনাল বাক্যটি। কে যে রটিয়েছে? পরক্ষণেই অম্বরের মনে হল ক্রীতদাসত্বটুকু ধর্তব্যের মধ্যে না আনলে কীই বা এমন মন্দ আছে সে? গায়ে গতরে তেমন খাটতে হচ্ছে না, দু’বেলা চর্বচোষ্য জুটছে, গাড়ি চেপে ঘুরছে, বিনোদনের সময়ও যে মিলছে না তা নয়… রাজারা এর চেয়ে কী এমন বাড়তি আরাম ভোগ করে?

তবু ফোঁস করে একটা শ্বাস ঝরল অম্বরের, “মনে তেমন শান্তি নেই সাধুবাবা।”

“নিজের শান্তি নিজেকেই খুঁজে নিতে হয় রে।”

“বুঝি। কিন্তু একদম মনে জোর পাই না। কী করলে জোর আসে বলতে পারেন?”

“এর কোনও ওষুধ টোটকা তো আমার জানা নেই বাপ। শুধু বলতে পারি, এর কোনও সিধে রাস্তা নেই। আর সেই জটিল পথ নিজেকেই খুঁজে নিতে হয়।”

এ তো অম্বরও জানে। আর সেই আবছায়া ঢাকা পথে সে তো নিজের মতো করেই হাঁটছে। খামোখা এই বৃদ্ধের কাছে এসে তার ধোঁয়াটে বাণী গেলার কী প্রয়োজন!

ফের একটা নমস্কার ঠুকে আশ্রম ছাড়ল অম্বর। পথে আর থামল না, পা চালিয়ে সোজা বাড়ি।

অম্বরদের ভদ্রাসনটি নেহাত ছোট নয়। দোতলা, ঘর আছে খানছয়েক, ওপরতলায় একটা লম্বা টানা বারান্দা, চিলেকোঠায় অধিষ্ঠান করছেন গৃহদেবতা রাধামাধব, পাঁচিল দেওয়া ছাদ… সব মিলিয়ে অম্বরদের বেশ সম্পন্নই বলা চলে। অম্বরের ঠাকুরদা ছিলেন বর্ধিষ্ণু চাষি-কাম-মহাজন, এ বাড়ি তাঁরই বানানো। অম্বরের একমাত্র পিসি থাকত বোকারোয়। পিসেমশাই ছিল স্টিল প্ল্যান্টের অফিসার, বছর চারেক আগে ভাইরাল ফিভারে মারা গেছে পিসি, পিসেমশাইও রিটায়ার করে এখন হায়দরাবাদ নিবাসী একমাত্র ছেলের সংসারে। কালেভদ্রে সামাজিক অনুষ্ঠান ছাড়া তাদের সঙ্গে আর দেখাসাক্ষাৎ হয় না অম্বরদের। তারা আঁচলের বিয়েতেও আসেনি। রানিগড়ের বাড়ির ভাগ নিয়ে বাবা বা ছেলের কণামাত্র মাথাব্যথা নেই, অম্বরের বাবা-কাকারাই ভোগদখল করছে নিশ্চিন্তে।

সিমেন্টের উঠোনের এক কোণে ধানের মরাই। অন্য দিকে টিনের চালা বসানো ভাঁড়ার-কাম রান্নাঘর। সাত সকালেই হেঁশেলে সাজো সাজো রব এখন। রাজা আর মিলি ভাতারে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ছে, বড় রাস্তায় গিয়ে বাস ধরবে ভাই বোন, নিজের গ্যাস জ্বালিয়ে তাদের খাওয়ার আয়োজন করছে কাবেরী। সঙ্গে সঙ্গে দু’জনের স্কুলের টিফিনও বানাচ্ছে মেজকাকি। পাশেই আর একটা গ্যাস-স্টোভে জলখাবারের প্রস্তুতি চালাচ্ছে মা। বাবা ছোটকাকা আর অম্বরের জন্য। ওইটুকু পাকশালায় দুই জায়ের আলাদা আলাদা হাঁড়ি যে কী বিটকেল দেখায়।

রাজা হুড়মুড়িয়ে নামছে। পরনে সাহেবি কেতার স্কুল ইউনিফর্ম। দৌড়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, “দাদা, বাবা তোমায় খুঁজছিল।”

অম্বর ভুরু কুঁচকোল, “কেন রে?”

পাক্কা শহুরে কায়দায় ঠোঁট উলটোল রাজা, “কী জানি। বলছিল তোমায় দেখলে পাঠিয়ে দিতে।”

হঠাৎ এত্তেলা? কোনও ফরমায়েশ নির্ঘাত। কলেজ স্ট্রিট পাড়া থেকে বই-টই আনতে হবে বোধহয়। একতলায় নিজের গলতাটিতে আর ঢুকল না অম্বর, সোজা উঠল ওপরে। দোতলার তিনটে ঘরের দু’খানাই মেজোকাকার দখলে। বাড়ির বাকিটা বাবা ছোটকাকার। বড়কাকার জন্যে আর আলাদা করে তেমন কিছু নেই।

পুবখোলা কোণের ঘরটায় বিছানায় বসে কীসব লেখাজোকা করছিল অতনু। অম্বর ঢুকল, “ডাকছিলে?”

“হ্যাঁ আয়।” অতনু চোখ তুলল, “তোর সঙ্গে কথা আছে।”

টুল টেনে বসল অম্বর। মুখখানা হাসি হাসি করে।

চোখ থেকে চশমা খুলে কাচ মুছছে অতনু। ফের পরে নিয়ে বলল, “কাল তুই বাড়ি সারাইয়ের ভাগাভাগির কথা তুলেছিলি না, ওটাই ভাবছিলাম… দ্যাখ, তোর বড়কাকা কলকাতায় থাকলেও এখনও তো আমরা যৌথ পরিবারের কাঠামোটা ভাঙিনি। একে অন্যের বিপদ আপদের কথা ভাবি, দায়ে অদায়ে পাশে দাঁড়াই। সংসারের খিটিমিটি এড়াতে হয়তো পৃথগন্ন হয়েছি, তবু তো এক ছাদের নীচে মিলেমিশেই বাস করছি। তাই না?”

মোটা বুদ্ধিতেও ইঙ্গিত বুঝে ফেলেছে অম্বর। কিন্তু ঘাড় নাড়তেই হল, “সে তো বটেই।”

“তাই বলছিলাম কী, তোর বাবার ওপর প্রেশার করাটা ঠিক হবে না। তোর ছোটকাকা তো নাঙা পার্টি, সেই বা দেবে কোত্থেকে। সুতরাং আমি আর তোর বড়কাকা মিলিয়ে কাজটা তুলব। মানে তুলতেই হবে আর কী।”

অম্বর চমকে গেল। কানে ঠিকঠাক শুনছে তো? গলায় খানিক উৎসাহ নিয়ে বলল, “নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। তোমরা দু’জনেই তো সলভেন্ট।”

“আমার খরচটা জানিস? রাজা-মিলির স্কুলে কত টিউশন ফি দিতে হয় ভাবতে পারিস? তার ওপর ওদের পিছনে টিচার লাগাতে হয়েছে। আমারই দেখা উচিত, কিন্তু অঙ্ক বিজ্ঞান, এসব আমি পেরে উঠি না। নেহাত কিছু ছাত্র পড়াই, তাই কোনও মতে ম্যানেজ করতে পারছি। এরপর তো হায়ার এডুকেশনটা যে কী করে চালাব… রাজা যদি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চান্স পায়…।” অতনু একটু থামল, “যাক গে। নিজের সমস্যার কথা আর সাতকাহন করে বলতে চাই না। স্কুলে গিয়ে আজ একটা পি এফ লোনের অ্যাপ্লিকেশন ঠুকে দিচ্ছি। তুই মেজদাকে গিয়ে বলিস, ও নিশ্চিন্ত থাকতে পারে। আমি হাজার পঁচিশ দিয়ে দেব। ঠিক আছে না?”

কী বলবে অম্বর? মাথা নেড়ে কেটে পড়া ছাড়া গত্যন্তর আছে কী? তবে মনে মনে তারিফ করল মেজোকাকার। বাবা আর ছোটকাকার অসহায়তায় চোখ ভিজিয়ে কেমন চমৎকার যৌথ পরিবারের চালটা খেলে দিল! যাক, পঁচিশ হাজার তো খসাচ্ছে, এইটুকু প্রাপ্তিই বা বড়কাকার পক্ষে মন্দ কী!

রুটি চচ্চড়ি খেয়ে ঘরে এসে একটুক্ষণ শুয়ে রইল অম্বর। আবার ফিরছে আঁচলের চিন্তা। অজস্র দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভিড় করছে মাথায়। ঘুণাক্ষরে কারওকে কিছু টের পেতে না দিয়ে একা একা এতটা সিরিয়াস পদক্ষেপ নেওয়া কি ঠিক হবে? কাকেই বা জানাবে? বড়কাকা? কাকিমা? অসম্ভব। ধাক্কাটা ওরা নিতেই পারবে না। অলিকেও বা টানবে কেন? একদিন কোন বন্ধুর ফোন পেয়েই তার যা প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, বাপস। অম্বর তাকে ভুজুং-ভাজুং দিয়ে শান্ত করেছে ঠিকই, কিন্তু নির্বাণের মুখোমুখি হতে তাকে কি সঙ্গী করা যায়? কক্ষনও না। মাথা ঠিক রাখতে পারবে না অলি, একটা অনর্থ ঘটে যাবে।

অতএব অম্বরকেই গিয়ে দাঁড়াতে হবে নির্বাণের সামনে। কিন্তু আজই…? পরশু মহালয়া, সামনের সপ্তাহে আঁচল আবার আসছে গড়িয়ায়, তখন যদি যায় নির্বাণের কাছে? খুব দেরি হয়ে যাবে কী? আরও একটু নয় ভেবেচিন্তে…।

অম্বর ভিতরে ভিতরে শিউরে উঠল। সে কী তবে পিছিয়ে আসতে চাইছে? এখন যেটুকু জোর আছে মনে, সাতদিন পর যদি তা না থাকে?

নাহ, আর কিন্তু যদি নয়। এখন শুধুই সুতরাং।

চটপট স্নান সেরে নিল অম্বর। ভাত খেতে ইচ্ছে করছিল না, তবু মায়ের চাপে দু’মুঠো গিলতেই হল যা হোক। বেরিয়ে পড়েছে ঝোলা কাঁধে। বিশ্বাস পাড়ার মাঠে জোর কদমে পুজো-প্যান্ডেল বানানোর কাজ চলছে, বন্ধুরা অনেকে সেখানে উপস্থিত, সেদিক পানে তাকালই না অম্বর, হনহনিয়ে বড়রাস্তায়। বাস ধরে সোজা বর্ধমান।

হাওড়ায় নেমে ট্যাক্সি ধরল অম্বর। নিজের পয়সায় ট্যাক্সিতে এত লম্বা পথ পাড়ি জীবনে এই প্রথম। তা এমন একটা উদ্ভট অভিযানও কি সে কদাচ করেছে? তার এই অকিঞ্চিত্কর জীবনে?

চারটে বাজার আগেই অম্বর পৌঁছে গেল নির্বাণের অফিসে। আবার দুক দুক করছে বুক। হাঁটু কাঁপছে। প্রায় জোর করে নিজেকে লিফটে ওঠাল অম্বর। অবশেষে পা রেখেছে নির্বাণের চেম্বারে।

অম্বরকে দেখামাত্র নির্বাণ শশব্যস্ত। হকচকিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে, “আরে আপনি?”

“এলাম।” অম্বর বসল চেয়ারে। এতক্ষণের টানটান স্নায়ু শিথিল হচ্ছে ক্রমশ। শান্ত ভাবেই বলল, “আপনার কাছেই।”

“ও। …একটু চা বলি?”

“আজ বাদ দিন।” অম্বর বড় করে শ্বাস নিল। সামান্য ঝুঁকে বলল, “একটা আবেদন নিয়ে এসেছিলাম।”

নির্বাণ ফ্যালফ্যাল চোখে তাকাল।

অম্বর গলা ঝাড়ল। নাহ্, দেরি নয়, এক্ষুনি উগরোতে হবে কথাটা। হৃৎপিণ্ডের লাবডুব অগ্রাহ্য করে বলল, “আপনি আঁচলের আর কোনও ক্ষতি করবেন না। এটাই আমার রিকোয়েস্ট।”

নির্বাণ যেন কেঁপে উঠল একটু। পরক্ষণে হাত উলটে বলল, “কেন? আমি কী করেছি?”

“আমি সব জানি নির্বাণবাবু। বাগুইআটির যে মেয়েটির সঙ্গে আপনার অ্যাফেয়ার চলছে, তাকেও আমি চিনি। কাইন্ডলি এবার ব্যাপারটা বন্ধ করুন।”

“কী যা তা বলছেন?” কোণঠাসা বেড়ালের মতো আচমকা ফুঁসে উঠল নির্বাণ, “আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“আমি আপনার শত্রু নই। আমার কথাটা শুনুন।” মনে মনে সাজিয়ে আসেনি অম্বর, তবু মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “মানুষ তো ভুলভ্রান্তি করেই, আবার শুধরেও নেয়। এখনও তো আপনার সময় যায়নি।”

নির্বাণ চোখ কুঁচকে দেখছে অম্বরকে। দৃষ্টি সরাল না অম্বর। অনুনয়ের স্বরে বলল, “আঁচল অত্যন্ত সরল মেয়ে। আপনাকে পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করে সে, আমি জানি। অ্যান্ড শি ইজ ক্যারিয়িং ইওর চাইল্ড। আপনি প্লিজ ওকে প্রতারণা করবেন না। ওর মতো নিষ্পাপ মেয়ে এই শক সহ্য করতে পারবে না।”

বলে আর এক মুহূর্ত বসল না অম্বর। সে সিঁড়ি ধরে নীচে নামল, না লিফটে, তাও আর স্মরণে নেই। গেটের কাছটায় এসে হাঁপাচ্ছে। হাপরের মতো টানছে শ্বাস, পরক্ষণেই ফাঁকা হচ্ছে বুক।

হঠাৎই ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল অম্বরের। এতদিনে আঁচলের জন্য সাহস করে কিছু বলতে পারল সেই আনন্দে? না আঁচলের জন্য অসহায়ের মতো কাকুতি মিনতি করতে হল, সেই বেদনায়? কেন যে হঠাৎ কান্না আসে মানুষের!

৩১

সপ্তমী থেকে লক্ষ্মীপুজো, এই কয়েকটা দিন শান্তনুর পরিপূর্ণ বিশ্রাম। কারখানা বন্ধ, লেবারদের ছুটি, শান্তনুরও। দিনগুলোয় পরিবারেই বুঁদ হয়ে থাকে শান্তনু, হইচই আমোদ-আহ্লাদের অক্সিজেনে তাজা করে নেয় মস্তিষ্ক।

এ বছর তো তার বাড়তি পুলক। পঞ্চমীর দিন আঁচল এসেছে গড়িয়ায়। গত বছরও মেয়েটা ছিল, হল্লাগুল্লাও হয়েছে প্রতিবারের মতো। কিন্তু এবার যেন ব্যাপারটা অন্য রকম। মেয়ের বিয়ে হওয়া আর না হওয়ার মধ্যে যে কী বিশাল ফারাক। তার ওপর মেয়ে মা হতে চলেছে, এই খুশিই বা শান্তনু রাখে কোথায়।

সেই ছন্দেই শুরু হয়েছিল অষ্টমীর সকালটা। জলখাবারের টেবিলে অলি আঁচল অম্বর সব্বাই হাজির। কিন্তু আয়োজন দেখে নাক কুঁচকোল শান্তনু। মুখ বেজার করে বলল, “কী ব্যাপার? আজ লুচি নেই কেন?”

“খারাপ কিছু তো দেওয়া হয়নি। চিকেন স্যান্ডউইচ তো তুমিও ভালবাস।” মানসী নির্বিকার, “তা ছাড়া রোজ রোজ লুচি খাওয়া ভাল নয়। বয়স হচ্ছে সে খেয়াল আছে?”

“জ্ঞান দিয়ো না তো। পুজোর চারদিন সকালে লুচি পরোটা হবে, এটা এ বাড়ির আইন।” শান্তনুর স্বরে ছদ্মকোপ, “নো ওয়ান ক্যান ব্রেক দিস ল। নট ইভন দ্য মালকিন।”

“তাই বুঝি?” মানসীর গলা আরও নিরীহ, “কিন্তু কাল সকালে লুচি খেয়ে আঁচলের খুব অম্বল হয়েছিল যে। এবং আজ ব্রেকফাস্টের মেনুটা যে আঁচলেরই সাজেশন।”

“ও। …তা এটা আগে বলবে তো। হুম্‌ম্‌, লুচি তো সত্যিই অস্বাস্থ্যকর। তেল চুপচুপ ময়দার ভাজাভুজির চেয়ে এই স্যান্ডউইচ খাওয়া ঢের ভাল। খামোখা কোলেস্টেরল বাড়ানোর কোনও মানে হয়?”

অলি আঁচল মানসী মুখ টিপে হাসছে। এমনকী অম্বরও। শান্তনু বাদশাহি মেজাজে স্যান্ডউইচে কামড় বসিয়ে বলল, “গ্র্যান্ড। নো মোর লুচি। এখন ক’দিন তা হলে এটাই চলুক।”

অলি এবার শব্দ করে হেসে উঠল। মানসীকে ঠেলছে, “কী বলেছিলাম, অ্যাঁ? আমার উইশটা দিদিভাইয়ের নাম করে চালিয়ে দাও, দিব্যি পাশ হয়ে যাবে। দেখবে, বাপি হয়তো এবাড়িতে লুচিই ব্যান করে দিল!”

মানসীও ঠাট্টা ছুড়ল, “সত্যি, তুমি পারোও বটে। আঁচলের নাম করলেই অমনি সাত খুন মাফ। আর আমাদের পছন্দ অপছন্দ সব ফালতু, তাই না?”

মা-মেয়ের যৌথ আক্রমণে মজাই লাগল শান্তনুর। হাসছে মিটিমিটি। তবে একটু বুঝি লজ্জাও পেল মনে মনে। সত্যি, আঁচলের ইচ্ছে-অনিচ্ছেগুলো কেন যে তাকে এত দুর্বল করে দেয়?

কিন্তু কী বা তার করার আছে? আঁচলের মতো মেয়েকে না ভালবেসে পারা যায়? তার ওপর একাগ্র চিত্তে আঁচলের বাবা হওয়ার সাধনা করতে করতে কখন যে তার স্নেহ-ভালবাসা থেকে কৃত্রিমতার মোড়ক ঝরে গেছে, তা কি শান্তনুও জানে? মেয়েকে নিয়ে একসময়ে দেবরাজের সঙ্গে তার একটা সূক্ষ্ম লড়াই ছিল, হয়তো এখনও যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেনি, কিন্তু সেই দ্বৈরথের হারজিত তো কবেই গৌণ হয়ে গেছে। শান্তনু তো এখন স্পষ্ট টের পায়, সে যেন একটু বেশিই ভালবেসে ফেলেছে মানসীর মেয়েকে। তা মানসী মন থেকে মানুক ছাই না মানুক। তুলনায় অলিই বরং অনেকটা এলেবেলে। সাধে কি অভিমান করে অলি? বাপিকে খোঁটা দেয়?

প্লেটে অল্প মাস্টার্ড সস ঢালল শান্তনু। আঙুলে মাখিয়ে ঠেকাল জিভে, উপভোগ করছে ঝাঁঝ। তাকাল আঁচলের পানে। মুগ্ধচোখে। মাথা নামিয়ে খাচ্ছে আঁচল। ধীরগতিতে, নিজস্ব লয়ে। বিয়ের সময়ে একটু যেন রোগা পাতলা ছিল, এখন বেশ ভরভরন্ত দেখায় মেয়েকে। আসন্ন মাতৃত্ব যেন তাকে আরও অপরূপা করে তুলেছে, আঁচলের দিক থেকে এখন দৃষ্টি ফেরানো দায়।

হাসতে হাসতে শান্তনু বলল, “কী রে আঁচল, তোরও কি তাই মত?”

আঁচল হালকা সুরে বলল, “ছাড়ো না বাপি। ওদের কথা ধরো কেন? তা ছাড়া…”

“কী তা ছাড়া?”

“যাকে নিয়ে ডিসপিউট, তার কি ওপিনিয়ন দেওয়া সাজে?”

“বেড়ে বলেছিস তো।” মাথা দুলিয়ে তারিফ করল শান্তনু। মানসীর দিকে ফিরে বলল, “তা এবার শুনি, আজ তোমরা কী করছ? আশা করি লাস্ট ইয়ারের মতো হোলনাইট প্যান্ডেল হপিং-এর প্ল্যান নেই?”

“প্রশ্নই আসে না। আঁচল পারবে নাকি ঘুরতে? ওই ভিড়ভাট্টা ঠেলে?” মানসী অলির দিকে চোখ ঘোরাল, “তোমার নিশ্চয়ই প্রোগ্রাম আছে?”

“থাকুক, না থাকুক, তোমাদের হাত ধরে বেরোব না, এটা নিশ্চিত।”

শান্তনু তামাশা জুড়ল, “হাত ধরার অন্য লোক জুটিয়ে ফেলেছিস বুঝি?”

“আমি দিদিভাই নই বাপি। সাত তাড়াতাড়ি হাত ধরার লোক জোটানোর আমার কোনও বাসনা নেই।”

“ও কী কথা অলি। তোর দিদিভাই কবে…”

“সরি, সরি। তোমরা দিদিভাইকে জুটিয়ে দিয়েছ। শ্রীমান নির্বাণকুমার। দিদিভাই তাকে এমনই জাদুতে বশ করেছে, পুজোর সময়েও সে দিদিভাইয়ের ছায়া মাড়ায় না।”

আঁচলই আলগা ধমক দিল, “আহ অলি, কী হচ্ছে কী? আমাকে নিয়ে চর্চা বন্ধ করবি?”

মানসীও প্রায় তেড়ে উঠল, “শুনছ তোমার ছোটমেয়ের বাক্যি! কলেজে গিয়ে যেন ধরাকে সরা জ্ঞান করছে, দিনকে দিন জিভ লম্বা হচ্ছে মেয়ের।”

“আদৌ জিভ না থাকার চেয়ে জিভ লম্বা হওয়া ঢের ভাল মা।”

“ফের, ফের তুই মুখে মুখে তর্ক করছিস?”

“তোমরা থামবে?” শান্তনু এবার দাবড়ে উঠল। ইদানীং মাঝেমাঝেই অলি এই ধরনের কথা বলে। কেন যে বলে, কে জানে? হয়তো শালিকে নির্বাণ আদৌ আমল দেয় না বলেই একধরনের ক্ষোভ আছে অলির। ছেলেটা পারতপক্ষে এ বাড়িতে পা রাখে না, এলেও কেমন জড়োসড়ো হয়ে থাকে, এ নিয়েও বিরাগ থাকাটা অসম্ভব নয়। কিন্তু ভাষায় একটা মাত্রাজ্ঞান থাকবে তো! আঁচল সামনে বসে, তাও ভ্রূক্ষেপ নেই….! তবে পুজোর সকালে এই নিয়ে তুলকালাম করাটাও তো বুদ্ধিমানের লক্ষণ নয়। পরিবেশ লঘু করতে শান্তনু এবার অম্বরকে ধরেছে। স্বরে হালকাভাব এনে বলল, “তা হ্যাঁ রে অম্বর, পুজোয় এবারে রানিগড়ে গেলি না যে বড়?”

এতক্ষণ টুঁ শব্দটি করেনি অম্বর। সামান্য নড়ে-চড়ে উঠল, “এমনিই।”

“কিন্তু তোর প্রাণের বন্ধুরা যে ওখানে তোর বিহনে কাঁদছে রে!”

“গেলে হয়তো এখানে কেউ হাপুস নয়নে কাঁদত!” দু’ মিনিট আগের বকুনি ভুলে অলি আবার সরব। মিচকে হেসে বলল, “তাই না অম্বরদা।”

শান্তনুর চোখ বড় বড়, “সে কী রে অম্বর, তুইও ডুবেডুবে জল খাচ্ছিস নাকি?”

অম্বর গা মোচড়াচ্ছে, “ধ্যাৎ, অলির কথা তুমি কেন ধরো?”

“অ। আমি বুঝি বাজে বকছি। …তা হলে কাল সারাদিন তুমি ছিলে কোথায়? পরশুও তো দিনভর তোমার টিকি ছিল না। সকাল দশটায় বেরিয়ে ফিরলে সেই রাত দশটা বাজিয়ে।” অলি ভুরু নাচাল, “পুরো দিন ধরে কার সেবা করছিলে গো?”

“বারে, আমাদের পত্রিকা বেরোল না? পরশু সকাল থেকে বাইন্ডিংখানায় বসে। অবিরাম তাড়া লাগিয়ে সেই সন্ধেবেলায় চল্লিশটা কপি মিলল। কাল স্টলে স্টলে বিলি করা হল, যারা লিখেছে তাদের কপিগুলো দিয়ে এলাম…”

“এত কাজ একা একা করলে? সঙ্গে তোমার কেউ ছিল না অম্বরদা?”

এবার আঁচলের প্রশ্ন। ভঙ্গিটা নেহাতই সরল, কিন্তু মোটেই সাদামাঠা নয়। তার পলকা রসিকতায় কেমন যেন ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে অম্বর। মুখে জবাব ফুটছে না।

অলি প্রায় হাততালি দিয়ে উঠল, “দ্যাখো দিদিভাই, অম্বরদা কেমন ব্লাশ করছে, হিহি… নির্ঘাত কোনও কেস খেয়েছে… হিহি হিহি…”

কলিংবেল বাজছে। হাসির লহরী থামিয়ে অলিই উঠে গেল। ঘুরে এসে বলল, “তোমার সেই কনট্রাক্টর ভদ্রলোক। রমানাথ না কী যেন নাম।”

“রমাপতি। …ওঁকে ভিতরে এনে বসা। বল, আমি আসছি।”

ফের গেছে অলি। মানসী জিজ্ঞেস করল, “সত্যিই তা হলে তুমি দোতলাটায় হাত দিচ্ছ?”

“আর কদ্দিন ফেলে রাখব বলো? ভেবেছিলাম আঁচলের বিয়ের আগেই কাজটা শেষ করে ফেলব… তা এমন তাড়াহুড়োয় হল বিয়েটা…”

অলি আবার ঘুরে এসেছে। কৌতূহলী গলায় বলল, “এবার পুরোটা শেষ হয়ে যাবে…”

“করতেই হবে। শান্তনু মৃদু হেসে একবার আঁচলকে দেখে নিয়ে বলল, ফ্যামিলি তো বাড়ছে। এরপর তো আর তোরা দুই বোনে একঘরে গুঁতোগুঁতি করে থাকতে পারবি না। তারপর তোর বিয়ে হলে আরও আত্মীয় কুটুম্ব বাড়বে, এ ছাড়াও এসোজন বোসোজন আছে…”

“তারপর ধরো অম্বরদারও তো একটু বেটার অ্যাকোমোডেশন লাগতে পারে। যদি বিয়ে করে বসে…”

শান্তনু চোখ নাচাল, “কী রে, তোর সেরকম মতলব আছে নাকি?”

“আছে মানে?” অলি কলকল করে উঠল, “অম্বরদার তো ভীষণ ইচ্ছে বিয়ে করার। শুধু তোমার জন্য নাকি…”

অম্বর কাতরভাবে বলল, “অলি, কেন আমাকে নিয়ে ফাজলামি করছ?”

“অ্যাই, তুমি আমায় বলোনি এ বাড়িতে বউ এনে তুললে বড়কাকা খুব রাগ করবে?”

অম্বর হাউমাউ করে কী যেন বলতে চাইল। স্বর ফুটল না। হাত উলটে আচমকা উঠে গেল চেয়ার ছেড়ে।

মানসীর গলায় তরল বকুনি, “আহ অলি, কী যে করিস না… কেন বেচারার পিছনে লাগিস? শান্তিতে চা-টা পর্যন্ত খেতে পারল না।”

অলি পাত্তাই দিল না। হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছে ঘরে। তবে মানসীর স্বর যেন সামান্য অচেনা ঠেকল শান্তনুর। অম্বরের প্রতি মানসীর যে প্রবল বিরাগ ছিল, সেটা যেন কমে এসেছে। হয়তো এটাই স্বাভাবিক। একসঙ্গে থাকতে থাকতে এরকমই হয়। তা ছাড়া অম্বরের সহবতজ্ঞান আছে, বড়কাকিকে এত নানাবিধ সার্ভিস দেয়, এসবও তো মনোভাব বদলাতে সাহায্য করে।

নাহ, অম্বরকে নিয়ে এবার একটু আলাদা করে ভাবতে হয়। অলি হয়তো ঠাট্টাতামাশা করেছে, তবে অম্বর তো সত্যি আর কচি খোকাটি নেই। আজ বাদে কাল ও যদি সংসার পাততেই চায়, তার আগে ওকে একটু থিতু করা দরকার। ব্যবসায় আর একটু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দিতে হবে অম্বরকে। একটু ফাঁকিবাজির প্রবণতা আছে ঠিকই, তবে আজকালকার দিনে এমন বিশ্বস্ত অল পার্পাস সহকারীও তো পাওয়া কঠিন।

চা শেষ করে রমাপতিকে নিয়ে দোতলায় এল শান্তনু। অম্বরকেও ডেকে নিল ঘর থেকে। রমাপতিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাল সে ঠিক কী চায়। তিনখানা ঘরের দেওয়াল তোলা, মেঝে বানানো, সেখানে কী ধরনের টাইলস বসবে, জানলা দরজা কেমন হবে, তিনতলা ওঠার সিঁড়ি বানানো, ছাদে পাঁচিল দেওয়া, সবই ধরে ধরে বোঝাচ্ছে রমাপতিকে। মন দিয়ে শুনছে রমাপতি। ঘাড় নাড়ছে খুটখুট।

হঠাৎ অম্বর বলে উঠল, “কাজগুলো শেষ করতে মোটামুটি কদ্দিন লাগবে?”

রমাপতি ভুরু কুঁচকে হিসেব করল। বলল, “ফিনিশিংয়ের ব্যাপার তো, সময় একটু বেশিই লেগে যাবে। অন্তত চার-পাঁচমাস তো বটেই।”

“তা হলে তো অসুবিধে হবে বড়কাকা। আঁচল এসে থাকবে, তার কানের কাছে মিস্ত্রিমজুর ঘটাংঘট…”

হুম, এটা তো শান্তনু ভাবেনি। ডাক্তার আঁচলকে ডেট দিয়েছে থার্ড ফেব্রুয়ারি। তার মানে মোটামুটি ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে আঁচল গড়িয়ায়। সুতরাং তার আগে কমিয়ে ফেলতে হবে মিস্ত্রিমজুরের উৎপাত।

শান্তনু রমাপতিকে বলল, “দেওয়াল মেঝে সিঁড়ি ছাদ… চারটে আপনি কত তাড়াতাড়ি করতে পারবেন?”

“তা অন্তত দু’মাস।”

“আর একটু কমানো যায় না? তার জন্যে যদি বেশি লেবার লাগে…”

“চেষ্টা করতে পারি। তবে বুঝছেন কিনা…। আজকাল লেবারদেরও তো লেজ মোটা হয়েছে…। যেই বুঝবে কাজ ফিনিশের তাড়া আছে, অমনি তাদের বায়নাক্কাও…”

“বুঝেছি। তা পয়সা বেশি লাগুক ক্ষতি নেই। কিন্তু ডিসেম্বরের গোড়াতে আমি সিভিল ওয়র্ক কমপ্লিট চাই।”

“আর উড ওয়ার্কগুলো…? দেওয়াল ওয়ার্ড্রোব, প্যানেলিং…”

“ওগুলোও হবে। তবে বাড়িতে নয়। আপনার মিস্ত্রিদের বলুন, মাপ নিয়ে গিয়ে ওয়র্কশপে বানাবে।”

“হুম। তা হলে আর কী, লক্ষ্মীপুজোর পরদিন থেকে লোক লাগিয়ে দিই।”

“তার আগে এস্টিমেটটা তো প্রয়োজন। কবে পাব? একাদশীর দিন?”

“হ্যাঁ। মোটামুটি রেডিই আছে। আরেকটু ঘষে মেজে…”

রমাপতিকে বিদায় দিয়ে ছাদে ঘুরছিল শান্তনু। কী ভেবে ঢুকেছে অম্বরের ঘরে। ওমনি ভক করে চাপা তামাকের গন্ধ। সামান্য বিরক্ত স্বরে শান্তনু বলল, “জানলা খুলিস না কেন?”

তাড়াতাড়ি পাল্লা হাট করে অম্বরের গলায় কৈফিয়তের সুর, “বললাম না, ক’দিন ধরে পত্রিকা নিয়ে খুব ছোটাছুটি যাচ্ছে… উঠেই বেরিয়ে যাই, ফিরে বিছানায় ধপাস… খেয়াল থাকে না।”

“অ। তা কী বের করলি দেখি।”

টেবিলের ডাঁই থেকে একটা চটিমতো বই টানল অম্বর। বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “সাবধানে। এখনও বাঁধাই কাঁচা আছে। সবে বেরোল।”

হাতে নিয়ে দেখল শান্তনু। মলাটের ছবিটা বেশ। এক রুক্ষ ডালে দুটো পাতা বেরিয়েছে। পত্রিকার নামটিও ভারী কায়দা করে লেখা। মহুরী। শান্তনু কপাল কুঁচকে বলল, “মহুরী মানে কী?”

“বাঁশি।”

“তা বাঁশি রাখলেই পারতিস। এমন প্যাঁচ মারা নামের কী প্রয়োজন?”

“বাঁশি শব্দটা বড্ড বেশি সরাসরি। একমাত্রিক। মহুরীর মধ্যে একটা ঢেউ খেলানো ডাইমেনশন আছে।”

“বুঝলাম না।” শান্তনু হাসল, পাতা উলটে দেখছে সূচিপত্র। হঠাৎ দৃষ্টি আটকেছে প্রচ্ছদশিল্পীর নামে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “দেবরাজ সিংহরায় তোদের কভার এঁকেছেন?”

“হুঁ… মানে… কেমন হয়েছে?”

“বিখ্যাত পেন্টারের আঁকা… ভাল তো হবেই।” শান্তনু একটু চুপ থেকে বলল, “তুই পেলি কোত্থেকে? আঁচল জোগাড় করে দিয়েছে বুঝি?”

“না। আমিই এনেছি।”

“ও। তোর সঙ্গে চেনা আছে নাকি?”

“ওই আর কী। হঠাৎই ঘটনাচক্রে… বনানীপিসি একদিন আলাপ করিয়ে দিয়েছিল।”

আগে বলিসনি তো? বলতে গিয়েও গিলে নিল শান্তনু। কাকিমার প্রাক্তন স্বামীর সঙ্গে কোনও সূত্রে তার পরিচয় হল, ওমনি অম্বর লাফাতে লাফাতে এসে তাকে খবরটা জানাবে, এমনটা বোধহয় আশা করা ঠিক নয়।

তবু কেন যেন খচখচ করছে। মানসী কি জানে? মাঝে যখন বনানী বর্তমান এবং বনানী যে পরিমাণ কথুকি, মানসীর অবিদিত থাকার কথা নয়। কই, মানসীও তো শান্তনুকে কিছু বলেনি? উল্লেখ করার মতো কোনও ঘটনা ভাবেনি বলেই কি…?

আহ, কী যে সব আজেবাজে চিন্তা! নিজের ওপরই বেজায় বিরক্ত হল শান্তনু। মনের কোথায় যে এই সব ঈর্ষার কীটগুলো ঘাপটি মেরে থাকে? কেন যে এই সব তুচ্ছ ব্যাপারগুলো নিয়ে এখনও সে মাথা ঘামায়?

শান্তনুর আকস্মিক ভাবান্তর বুঝি অম্বরেরও নজর এড়ায়নি। সে আমতা আমতা করে বলল, “আসলে কী হয়েছে… পত্রিকার ডিসিশনটা তো অনেক লেটে নিয়েছি, কভার করার জন্য কাকে রিকোয়েস্ট করব ভেবে না পেয়ে ওঁকে অ্যাপ্রোচ করলাম, উনিও এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন…”

“ভালই তো হয়েছে। তোদের ম্যাগাজিনের গ্ল্যামার কত বাড়ল বল তো?” ভাইপোর পিঠে আলগা চাপড় দিল শান্তনু। চলে যেতে গিয়েও কী ভেবে দাঁড়াল, “আঁচলকে দেখিয়েছিস পত্রিকা?”

“না। আজ দেব।”

“তাড়ার কী আছে। যখন সল্টলেক ফিরবে, তখনই না হয়…। শান্তনু গলা নামাল, “আঁচলের ঘরে থাকলে তোর বড়কাকির হাতে পড়তে পারে… তার হয়তো। …বুঝেছিস তো কী বলতে চাইছি?”

প্রত্যুত্তরের অপেক্ষায় না থেকে শান্তনু নেমে এল। সোজা গিয়ে ঢুকেছে মেয়েদের কক্ষে। মেতে উঠেছে নেহাতই অকাজের গল্প-আড্ডায়। মানসীও এসে জমে গেল। আঁচলের শাশুড়ির কথা বলা, হাবভাব নকল করে দেখাচ্ছে অলি, হাসিতে ফেটে পড়ছে শান্তনু-মানসী। দোতলা উঠে গেলে অলি আঁচল কে কোন ঘর পাবে, অম্বরকে নীচে পাঠিয়ে দেওয়া হবে কি না, এসব নিয়েও জল্পনা চলল খানিক।

কথায় কথায় শান্তনু বলল, “আজ দুপুরে কী খ্যাটন?”

মানসী বলল, “অষ্টমীতে অনেক বাড়িতেই খিচুড়ি খায়। কিন্তু তোমরা তো ওসব মানো না। মাংস-ভাতই হচ্ছে। ভেটকিমাছের ফিলে তো গড়াই আছে, চাইলে ভেজে দেব।”

“উঁহু। ওটা কাল হোক। সঙ্গে পোলাও আর চিংড়ির মালাইকারি। ভাবছি নির্বাণকে কাল দুপুরে খেতে বলি।”

মানসী সংশয়ের সুরে বলল, “সে কি আসবে?”

শান্তনু প্রত্যয়ের সঙ্গে বলল, “কেন আসবে না? ডেকে দেখেছ তাকে? জামাইষষ্ঠীর দিন আসেনি?”

অলি ফোড়ন কাটল, “ঠিক ঠিক। এসে কী চমৎকার হুঁকোমুখো সেজে বসে রইল, ঘনঘন ঘড়ি দেখল… মায়ের ফিফটিন কোর্স মেন্যু শুধু খুঁটে গেল…। আর দিদিভাইকে নিয়ে গাড়িতে যখন উঠল, মনে হল কয়েদি জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে।”

মানসী চোখ পাকাল, “বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছিস কেন? বেচারা বড় লাজুক স্বভাবের। সহজে মিশতে পারে না।”

“দ্যাখো গে যাও, যেখানে পারার, সেখানে ঠিক পারে।”

“সে হয়তো বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে।” শান্তনু বলল, “যাই হোক, আমরা আমাদের ডিউটি করবই। …তুই কী বলিস আঁচল? ফোন করি নির্বাণকে?”

আঁচল উদাসীন স্বরে বলল, “যা ভাল বোঝো।”

উঠে গিয়ে মোবাইল ফোন নিয়ে এল শান্তনু। টিপল নির্বাণের নম্বর। যাহ, সুইচড অফ। বেলা এগারোটা বাজে, এখনও ঘুমোচ্ছে নাকি?”

অগত্যা ল্যান্ডলাইনই ভরসা। বাজছে ফোন। বেজেই চলেছে। অবশেষে এক বামাকণ্ঠ, “কে বলছেন?”

“গড়িয়া থেকে। আঁচলের বাপি।”

“ও কাকাবাবু আপনি? আমাদের বউমণি কেমন আছে?”

“ভাল। তোমরা সবাই ঠিক আছ তো?”

“হ্যাঁ কাকাবাবু।”

“নির্বাণকে একটু ডেকে দেবে?”

“ওমা, বান্টিদা তো সকালবেলাই বেরিয়ে গেছে।”

“ও কখন ফিরবে কিছু জানো?”

“তা তো বলে যায়নি। মাকে ডেকে দেব? উনি হয়তো…”

“উনি ব্যস্ত নন তো?”

“ওই একটু…। কারা সব এসেছে, মিটিং চলছে।”

“থাক তবে। পরে ফোন করবখন।”

মোবাইল অফ করে শান্তনু হাত উলটোল, “তোর বরকে তো ধরা গেল না রে। কী করি বল তো আঁচল?”

“বাদ দাও না বাপি। না ডাকলেই বা কী।”

“তা বললে চলে? শান্তনু পলক ভাবল, “এক কাজ কর। সারাদিনে কখনও না কখনও তো তোকে ফোন করবেই, তখন না হয় নেমন্তন্নটা করে দিস।”

আঁচলের রা নেই। অলি ঠোঁট বেঁকাচ্ছে। মানসী যেন খানিক হতাশ মুখে ঘর ছাড়ল। শান্তনু কথা ঘুরিয়ে অন্য প্রসঙ্গে গেল। এলোমেলো খানিক গল্পগাছা করে, স্নান খাওয়া সেরে জোর একখানা ঘুম লাগিয়েছে।

রাত্তিরে নির্বাণ প্রসঙ্গ উঠল আবার। খাওয়াদাওয়ার পর। শান্তনুই তুলল। আঁচল শুয়ে পড়েছে, অম্বর নিজের ঘরে, অলি তখনও বন্ধুদের সঙ্গে পুজো পরিক্রমা সেরে ফেরেনি। টিভি চালিয়ে নানান জায়গার প্রতিমা দেখছিল মানসী। শান্তনু এসে বসেছে পাশে। আচমকাই বলল, “ব্যাপারটা কিন্তু ভাবা দরকার, বুঝলে।”

মানসী ঘাড় ঘোরাল, “কী?”

“এই যে, তোমার জামাই। এখনও কিন্তু তার মোবাইল বন্ধ।”

“তো?”

“আঁচলের সঙ্গে নিশ্চয়ই ফোনাফুনি হয়নি। তা হলে আঁচল বলত। আমার কিন্তু এটা নর্ম্যাল ঠেকছে না।”

“অ্যাবনর্ম্যালেরই বা কী আছে? হয়তো সে তার মতো করে এনজয় করছে। মানসী অল্প ঝেঁঝে উঠল, “আমার তো অবাক লাগছে তোমার কাণ্ডকারখানা দেখে।”

“আমি কী করলাম।”

“মেয়ের বিয়েতে এত খরচা হল। বললে হাত একদম ফাঁকা হয়ে গেছে। ফ্যাক্টরিতে গোলমাল, নতুন ব্যবসা শুরু করতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছ, তার মধ্যে হঠাৎ দোতলা ওঠানোর জন্যে খেপে উঠলে কেন?”

“আরে, কারবারে তো চড়াই উৎরাই থাকেই, তা বলে কি অনন্তকাল বাড়ির কাজ ফেলে রাখা যায়?”

“টাকা আসবে কোত্থেকে? লটারি পেলে নাকি?”

“প্রায়। ফরিদাবাদ আর কানপুরের অর্ডারদুটোর পেমেন্ট এসেছে। ফরিদাবাদের পার্টি কাজের কোয়ালিটিতে হেভি প্লিজড। চুক্তি করেছে আগামী তিন বছর তারা শুধু আমার কাছ থেকেই মাল নেবে। যদি আমি তাদের পনেরো পারসেন্ট ডিসকাউন্ট দিই। দরাদরি চলছে। বারো পারসেন্টে রাজি হয়ে যাবে। তাতেও ফেলে ছড়িয়ে দু’কোটি টাকার অর্ডার বাঁধা।”

“কিন্তু সে তো অনিশ্চিত। তার ওপর ভরসা করে আট দশ লাখ খরচা করে ফেলবে? এরপর তোমার রানিগড়েও তো টাকা ঢালা আছে।”

আরে, সেই জন্যই তো শান্তনু আগে এ বাড়ির কাজ ধরতে চায়। যাতে মানসীর কাছে কখনও শুনতে না হয় গড়িয়ার বাড়ি আধাখ্যাঁচড়া রেখে সে রানিগড়ে পয়সা ওড়াচ্ছে। আবার এ বাড়ির কাজে হাত দিলে রানিগড়কে অবহেলা করা চলবে না। নয়তো দাদা ভাইরা বলবে বড় স্বার্থপর হয়ে গেছে শান্তনু।

নিজেরটি ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। এ যেন কাঁটার ওপর দিয়ে হাঁটা। এবং এরই নাম সংসার। সব্বাইকে খুশি রাখতে চাওয়ার যে কী জ্বালা।

মুখে অবশ্য শান্তনু বলল, “ছাড়ো তো। জীবন মানে তো পদে পদে অনিশ্চয়তা। আজ যেখানে পৌঁছেছি, ঝুঁকি না নিলে কি পারতাম? বরং ভাবো, আঁচল তার বাচ্চা নিয়ে নতুন ঘরে এসে উঠেছে। ছবিটা চিন্তা করলেই মন তর হয়ে যাবে।”

মানসী, কে জানে কেন, আর কিছু বলল না। টিভি বন্ধ করে উঠে দাঁড়িয়েছে। ছোট্ট একটা হাই তুলে চলে যাচ্ছে শোওয়ার ঘরে।

মিনিটখানেক স্থির বসে থেকে শান্তনু সোফা ছাড়ল। প্রায় অভ্যাস মতোই একবার উঁকি দিল মেয়েদের কামরায়। বিছানায় চোখ পড়তেই চমকে উঠেছে। আঁচল তো নেই! বাথরুমে নাকি? উঁহু, মেয়ে তো চেয়ারে, মুখখানা টেবিলে গোঁজা। রাতবাতির আলোতেও স্পষ্ট বোঝা যায়, কেঁপে কেঁপে উঠছে আঁচল।

হঠাৎই আঁচল মুখ তুলেছে। পাছে তাকে দেখে ফেলে, ছিটকে সরে এল শান্তনু। ঘরে এসেও হাঁপাচ্ছে।

পাড়ার প্যান্ডেলে তখন ঢাক বাজছিল। একটানা।

আওয়াজটা বুকে লাগছিল শান্তনুর। যেন কেউ গজাল ঠুকছে পাঁজরে।

৩২

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে এসে থামল গাড়ি। পিছনের দরজা খুলে সসম্ভ্রমে দাঁড়িয়েছে ড্রাইভার। নামল বিদিশা, চার ধাপ সিঁড়ি টপকে ঢুকেছে প্রকাণ্ড বিল্ডিংটার অভ্যন্তরে। চওড়া করিডরের অর্ধেকটা জুড়ে একখানা ছড়ানো-ছেটানো বইয়ের দোকান। বিক্রি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র, নানান বিষয়ের সহায়িকা, আরও কিছু টুকিটাকি পাঠ্যবই। এমনটা থাকার কথা নয়। দেখতেও ভারী বিশ্রী লাগে। তবে শিক্ষাকর্মী ইউনিয়নের পক্ষ থেকে চালাচ্ছে, এবং ইউনিয়নটি বিদিশার দলের। সব চেয়ে বড় কথা, ইউনিয়নের নেতাটির স্থানীয় রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রভাব। সুতরাং দেখেও বিদিশাকে না দেখার ভান করতে হয়। এর জন্যে মনে মনে যুক্তিও সাজিয়ে নিয়েছে বিদিশা। ছাত্রদের সুবিধের জন্যেই তো এই কেনাবেচার আয়োজন, এটুকু মেনে নিলে কী-ই বা এমন ক্ষুণ্ণ হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্রতা?

লিফট ধরে বিদিশা দোতলায় উঠল। উপাচার্য বিদিশা চৌধুরীর পিছু পিছু চলেছে ড্রাইভার। একহাতে ম্যাডামের ব্রিফকেস, অন্য হাতে ল্যাপটপ। দু’খানাই সমর্পিত হল পিয়োনের হাতে। নিজস্ব বিশাল কক্ষে প্রবেশ করে পুরু গদিওয়ালা রাজকীয় ঘুরনোচেয়ারে বসল বিদিশা। এবার শুরু হবে তার কর্মময় দিন।

লক্ষ্মীপুজোর পর সবে পরশু খুলেছে বিশ্ববিদ্যালয়। পুরোদমে ক্লাস শুরু হয়নি, এক্ষুনি পরীক্ষা-টরিক্ষাও নেই, তবে প্রশাসনিক কাজ তো আছে অন্তহীন। দু’খানা জেলার বিয়াল্লিশটা কলেজের ওপর খবরদারি করা, সে কী কম দায়িত্ব! নেহাত কলেজগুলো ভাইফোঁটা অবধি বন্ধ, নইলে তাদের সমস্যা মেটাতেই তো পাগল পাগল দশা হয়। তবে হ্যাঁ, বিদিশা তাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, তার এক কলমের খোঁচায় কলেজগুলোর অনেক আবদার নাকচ হয়ে যেতে পারে, এই ভাবনাটাই যেন অপার্থিব সুখ বয়ে আনে। দলের নির্বাচনী বিপর্যয়ের দুঃস্বপ্ন ছাপিয়ে নিজের বেঁচে থাকাটাই তখন ভারী সার্থক মনে হয় বিদিশার।

তবে শরীরটা এখন একটু জিরেন চাইছে। কম তো নয়, বাড়ি থেকে অনেকটা পথ, প্রায় দেড়ঘণ্টার ধাক্কা। আর রাস্তাঘাটের যা হাল! কী যে করছে সরকার, একটা ইলেকশনে হেরেই কেমন জবুথবু মেরে গেছে। পারিজাতদা বলছে বটে, আগামী এক বছরের মধ্যে সব আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে, কিন্তু কাজকর্মের ছিরি দেখে ঠিক প্রতীতি জন্মাচ্ছে না। মাত্র পঞ্চাশ-ষাট কিলোমিটার পেরোতে গা হাত পায়ে যা ব্যথা, বাপস!

মধ্যবয়সি পিয়োনটি এখনও দাঁড়িয়ে। নির্দেশের অপেক্ষায়। বিদিশা ভারিক্কি গলায় বলল, “জিতেন, এসিটা চালিয়ে দাও তো।”

“হালকা? না চড়া?”

“একটু চড়াই চলুক। পরে কমিয়ে দিয়ো। আর হ্যাঁ, এখনই কারওকে পাঠিও না। আমি বেল দেব, তারপর।

কর্তব্য সম্পাদন করে বেরিয়ে গেছে জিতেন। চেয়ার ছেড়ে বিদিশা বাথরুম ঘুরে এল। উপাচার্যের কক্ষটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হোটেলের স্যুইট। আলাদা বিশ্রামের জায়গা, ছোট অ্যান্টিরুম, আধুনিক টয়লেট, সবই মজুত।

ইজিচেয়ারে শরীর ছেড়ে দিয়ে একটুক্ষণ বসে রইল বিদিশা। চোখ বুজে ছকে নিল কী কী করবে এখন। তারপর স্বস্থানে ফিরে ডাক পাঠিয়েছে রেজিস্ট্রারকে।

প্রৌঢ় বিকাশ চক্রবর্তী হন্তদন্ত পায়ে ছুটে এসেছে। সে চেয়ারে বসামাত্র বিদিশার প্রশ্ন, “ইউ জি সি থেকে ন্যাকের ডেলিগেটরা কবে আসছেন, নিশ্চয়ই আপনার স্মরণে আছে?”

“শিওর। ডিসেম্বরের একুশ বাইশ তেইশ।”

“আজ অক্টোবরের চব্বিশ। মানে আর দু’মাসও বাকি নেই। তাই তো?”

“হ্যাঁ। আমরা তো এগোচ্ছি।”

“আপটুডেট প্রগ্রেসের একটা সিনপসিস বানানোর কথা ছিল না? সেটা মেলও করে দিতে বলেছিলাম…”

“আসলে হয়েছে কী ম্যাডাম… সব ক’টা ডিপার্টমেন্ট থেকে এখনও তো ফিডব্যাক জমা পড়েনি… তাই ক্লিয়ার পিকচারও পাওয়া যাচ্ছে না…”

“কারা কারা দেয়নি এখনও?”

“সায়েন্স মোটামুটি পেয়েছি। একমাত্র জুলজি এখনও…। কমার্সও এসেছে। একমাত্র হিউম্যানিটিজই…”

“তার জন্য আপনি কী করেছেন?”

“আমি তো অবিরাম রিমাইন্ডার দিয়ে যাচ্ছি। কালও ফিলসফির ডক্টর ঘোষালকে ফোন করেছিলাম।”

“ব্যস, তাতেই দায়িত্ব শেষ? আপনি ইউনিভার্সিটির ন্যাক কমিটির কোঅর্ডিনেটার, যেভাবে হোক এগুলো জোগাড় করা তো আপনার কাজ। তারপর এই হিউজ ডাটা কম্পাইল করা, সেগুলো অ্যানালিসিস…”

“হয়ে যাবে ম্যাডাম। একটু উইনডো ড্রেসিং করতে হবে।”

“কিছু ডাটা শেষ পর্যন্ত হয়তো মিলবে না, সেগুলো বানাতে হবে, তাই তো?”

বিকাশ হেসে ফেলল, “সবই তো জানেন। একটা-দুটো ফ্যাকাল্টি ছাড়া কেউই তো প্রপার রেকর্ড মেনটেন করে না। আর আমরাও স্যারদের ওপর হম্বিতম্বি করতে পারি না।”

“হুম।”

বিদিশার ভুরুতে পাতলা ভাঁজ। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সে হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে, কী সীমাহীন অব্যবস্থা চলছে এখানে। কোন বিভাগে ক’জন গবেষক, গত পাঁচ বছরে ক’টা পিএইচ ডি হয়েছে, কতজন অধ্যাপক কত পেপার পাবলিশ করেছে, কে ক’খানা বই লিখেছে, এইসব সরল তথ্যগুলোও এখানে মেলা দুষ্কর। কোনও সংখ্যাগত গোলমাল যদি ইউ জি সির নজরে পড়ে, চরম কেলেঙ্কারি হবে। এদিকে ন্যাকের কমিটিও তৈরি হয়েছে দলের পছন্দমতো। সেখানে অকর্মাদেরই ভিড়। ন্যাকের কাজের অজুহাতে তারা অনেকে ছ’মাস আগে থেকে ক্লাস নেওয়া বন্ধ করে বসে আছে। অথচ তার এই আউটপুট। আর এই কাজের অভিজ্ঞতাকে বাড়তি পুঁজি হিসেবে দেখিয়ে এরাই প্রফেসরশিপ বাগাবে। সাধে কী শিক্ষাকর্মীরা এদের নিয়ে টকঝাল ফুট কাটে!

বিদিশা চিন্তিত মুখে বলল, “ঠিক আছে, করুন যেভাবে পারেন। তবে ফিনান্স, পরীক্ষা আর লাইব্রেরি, এই তিনটেকে ঝটপট রেডি করুন। যদি বলেন তো ছোট ছোট কয়েকটা কমিটি গড়ে দিই।”

“তা হলে তো আবার ইসি মিটিং ডাকতে হবে।”

“কেন? আমি করতে পারি না?”

“হ্যাঁ পারেন। তবে কিনা…।” বিদিশার চোখে চোখ রাখল বিকাশ, “বেশ, করে দিন। ভিসির তো স্পেশাল পাওয়ার আছে।”

কথাটা শুনে তৃপ্তির চোরা শিহরন। বিদিশা ঠোঁট টিপে বলল, “একটু ভেবে নিই। আপনিও কয়েকটা নাম সাজেস্ট করুন।”

ঘাড় নেড়ে বিকাশ উঠতে যাচ্ছিল, ঘরে জিতেন। বলল, “ম্যাডাম, সুখেন্দু স্যার আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।”

নামটি শোনামাত্র ক্ষণপূর্বের প্রসন্নতা উধাও। প্রফেসর সুখেন্দু মৈত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। দেশে বিদেশে পণ্ডিত জগতে রীতিমতো এক সাড়া জাগানো নাম। স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে দুর্দান্ত রেজ়াল্ট, ছাব্বিশ বছর বয়সে পিএইচ ডি, চৌত্রিশে ডি এসসি…। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সবচেয়ে মজবুত খুঁটি। স্তম্ভও বলা যায়। তবে বড্ড ঠোঁটকাটা। একসময়ে নাকি নকশাল করত, এখন কোনও দলেটলে নেই। শুধু পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে আন্দোলন চালায়।

সুখেন্দুর সঙ্গে কথা বলতে একটু ভয় ভয় করে বিদিশার। বিকাশকে বলল, “আপনি আর একটু বসে যান।”

ঢুকেছে সুখেন্দু। বিদিশা সহজ সুরে বলল, “আসুন প্রফেসর সাহেব। হঠাৎ আমার কাছে?”

সুখেন্দু হাসি হাসি মুখে বলল, “ভালই হয়েছে। আপনাদের দু’জনকেই পেয়ে গেলাম।”

বিকাশ অপ্রতিভ স্বরে বলল, “আমার সঙ্গে কী হল?”

“আপনিই তো মশাই মেন কালপ্রিট।” কথাটা ছুড়ে দিয়ে সুখেন্দু স্মিত মুখে বিদিশাকে বলল, “রহস্যটা কী বলুন তো? গত জুলাইতে বোর্ড অফ স্টাডিজ়ের মিটিং করে ফিজিক্সের নতুন সিলেবাস তৈরি হল, নেক্সট সেশন থেকে চালু হওয়ার কথা। অথচ এখনও তো তার কোনও লক্ষণ দেখছি না।”

বিদিশার আগে বিকাশই জবাব দিল, “আমরা তো কলেজে কলেজে পাঠিয়েছিলাম। টু সিক ওপিনিয়ন ফর মডিফিকেশন।”

“জানি। সেগুলো জমা পড়ে গেছে, তাও জানি। সেই অনুযায়ী গত একুশে অগস্টের মিটিংয়ে কিছু অদল-বদল করা হয়েছে। এই অফিসে জমা পড়েছে অন অগস্ট টোয়েন্টি থার্ড। কিন্তু সেই নতুন সিলেবাস এখনও তো ইসিতে প্লেস হল না। কারণটা কী জানতে পারি?”

“হবে হবে। তাড়া তো নেই, নতুন সেশনের ঢের দেরি।”

“স্ট্রেঞ্জ! টিচারদের প্রিপেয়ার হতে হবে না? নতুন প্র্যাকটিক্যাল সেট করতে সময় লাগবে না কলেজের?” সুখেন্দু সামান্য ঝুঁকল, “নাকি আপনারা চান না আদৌ সিলেবাস চেঞ্জ হোক? কারণ আমার কাছে খবর আছে, সাতটা কলেজ সিলেবাস বদলে আপত্তি জানিয়েছে।”

“একেবারে ভুল বলেননি।” বিদিশা সোজা হয়ে বসল, “আমার কাছে কমপ্লেন এসেছে, নতুন সিলেবাস নাকি যথেষ্ট হাই ব্রাও। গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে বেশ কঠিন।”

“আজব কথা বলছেন তো! গ্রামের অজুহাতে সাবস্ট্যান্ডার্ড সিলেবাস পড়ে ছেলেমেয়েরা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাবে কী করে? রেজাল্টের দৌলতে যদি এখানে সুযোগ পেল তো ভাল, নইলে অন্য কোনও জায়গায় তো তাদের ঠাঁই হবে না।”

ব্যস, বেধে গেল তর্ক। ক্রমশ চড়ছে সুখেন্দুর গলা। বিদিশা আর বিকাশের প্রতিটি যুক্তি খানখান করে দিচ্ছে। টানা চল্লিশ মিনিট ঘরে ঝড় বইয়ে সুখেন্দু যখন ঘর ছাড়ল, বিদিশার কানমাথা গরম। বিকাশও নিশ্চুপ।

খানিক পরে বিকাশ বলল, “সুখেন্দুবাবু বেশি ছাত্রদরদি সাজতে চান। কী দুঃসাহস, আপনার অথরিটিকে পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ করছেন।”

বিদিশা ফ্যাকাশে হাসল, “ছাড়ুন। ও আমি বুঝে নেব।”

চলে গেল বিকাশ। একতাড়া চিঠি জমে আছে টেবিলে, একের পর এক চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিল বিদিশা। দরকারিগুলো রাখল আলাদা করে। মাঝে ফিনান্স অফিসার এল। পরীক্ষার নিয়ামকও। তাদের সঙ্গে জরুরি আলাপ সারল। এবার ফাইলপত্র সই করার পালা। পড়ে পড়ে। দেখেশুনে। জেনেবুঝে।

মন বসছিল না বিদিশার। সুখেন্দুর তর্জনী নাচানো এমন বিশ্রীভাবে দুলছে চোখের সামনে। এই তো প্রথম নয়, আগেও অন্তত দু’দিন…। এত স্পর্ধা, বলে কিনা উপাচার্যের চেয়ার তাকে সাজে না! আর তাও বলল কিনা বিকাশের সামনে! এই বিকাশ ছিল নর্থ বেঙ্গলের একটা কলেজে কেমিস্ট্রি ল্যাবের ডেমনস্ট্রেটার, পার্টির কৃপায় সে এখন এই উচ্চাসনে। যতই মুখে করুণ ভাব ফোটাক, ওই বিকাশও নিশ্চয়ই হাসছে বিদিশার অপমানে।

ধামাধরাদের বোধহয় এটাই নিয়ম। কেউ কারও সমব্যথী হয় না। একজনের দুর্দশায় অন্যে বুঝি মজাই লোটে। অন্তত বিদিশার তো তাই মনে হচ্ছিল। যত ভাবছিল, তত তপ্ত হচ্ছে মাথা। হঠাৎই ঠেলে সরিয়ে দিল ফাইল। মোবাইল হাতে নিয়েছে। ঘাঁটছে নম্বর। না, পারিজাতকে নয়, আর একটু ওপরে যেতে হবে। সরাসরি রাজ্য সম্পাদকের সঙ্গে কথা বললে কেমন হয়? মানুষটা ধীরস্থির, শিক্ষাদফতরের অনেক বিষয় সে নিজেই দেখাশোনা করে।

জয়ন্ত দাশগুপ্তর ব্যক্তিগত নম্বরটা টিপল বিদিশা। ওপারে গুরুগম্ভীর গলা পেয়ে তাড়াতাড়ি পরিচয় দিল নিজের। জয়ন্তর শান্ত প্রতিক্রিয়া, “ও, কমরেড চৌধুরী? যদি আপনাকে মিনিট পাঁচেক পরে কল করি…?”

“আপনি কেন? আমিই করব আবার।”

“না। আমি করব। ছাড়ছি এখন।”

বিদিশা বুঝে গেল, এ অনুরোধ নয়, নির্দেশ। নিশ্চয়ই ঘরে কেউ আছে, যার সামনে কথা বলতে চায় না।

ফোনের প্রতীক্ষায় কান খাড়া রেখে বিদিশা ফের মন দিল কাজে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা দল গিয়েছিল অল ইন্ডিয়া স্পোর্টস মিটে, তাদের বেলাগাম খরচখরচা নিয়ে একটা তদন্ত বসিয়েছিল কর্মসমিতি, তারই রিপোর্ট পড়ছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। প্রতিনিধি দলের প্রধান মিলন হালদার দলেরই লোক, সে ফাঁসছে কিনা ভাল করে বোঝা দরকার।

ফোন বাজছে। ঝটিতি মোবাইল তুলে মনিটরে দৃষ্টি রাখতেই মেজাজ কষটে। পল্টুদা। ওফ, আবার নিশ্চয়ই কোনও আবদার। নীলুর পোস্টিংয়ে তো সে খানিকটা সুবিধে করে দিয়েছে, আর কী চায়? সত্যি মানুষের চাহিদা যেন মেটে না কিছুতেই। না মেটালেও উপায় নেই, তা হলেই তুমি হয়ে যাবে খারাপ লোক। সাধে কী পার্টি ডুবতে বসেছে? ওই কাছের লোকদের দেখতে গিয়েই না…।

বিদিশা কুট করে লাইন কেটে দিল। পল্টুদার ঘ্যানঘ্যানানি, ওফ। কথা শুরু করলে আর থামতে চায় না। তার মাঝে যদি জয়ন্তর ডাক এসে ফিরে যায়! রাজ্য সম্পাদক বলে কথা, সে নিশ্চয়ই বারবার ফোন করবে না।

বিদিশা রিপোর্টে চোখ রাখল আবার। ভুরুর ভাঁজ বাড়ছে ক্রমশ। ভাল মতোই জড়িয়ে গেছে মিলন। প্রায় আটানব্বই হাজার টাকার গরমিল, অর্ধেক ভাউচার মিসিং…। কর্মসমিতির পরের বৈঠকে রিপোর্টটি ফেললেই তুমুল শোরগোল হবে। সাসপেনশনের দাবি ওঠাও বিচিত্র নয়। সংখ্যাধিক্যের জোরে চিত্কার নস্যাৎ করা যায় বটে, কিন্তু মিডিয়ায় খবর লিক হলেই সাড়ে সর্বনাশ! যা হল্লা চলছে এখন, এর থেকেই না একটা নতুন আন্দোলন চাগিয়ে ওঠে। অতএব ফাইলটি আপাতত হিমঘরে শুইয়ে রাখাই শ্রেয়। এখন কিছুদিন টালবাহানা চলুক, তারপর না হয়…।

আবার ক্রিং-ক্রিং। না, পল্টুদা নয়, এবার জয়ন্তই। কোনও কুশল প্রশ্ন নয়, মন্দ্র কণ্ঠে বলল, “হ্যাঁ কমরেড, শোনা যাক কী সমস্যা।”

“প্রফেসর সুখেন্দু মৈত্রর নাম নিশ্চয়ই আপনি শুনেছেন?”

“ফিজ়িক্সের তো? বলুন না, কী হয়েছে।”

“তাঁকে তো কনট্রোল করা যাচ্ছে না। নতুন সিলেবাস চালু করা নিয়ে আজ কিছু মতবিরোধ হয়েছিল… কিন্তু উনি যে ভাষায় আমায় অ্যাটাক করলেন…। এমনকী এও বললেন, আমার প্রতিটি অ্যাকশন নাকি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, কলেজগুলোর কিছু পেটোয়া অধ্যাপকদের নিয়ে নাকি দলবাজি চালাচ্ছি, তাদের প্রাইভেট পড়ানোর ব্যাপারে নাকি মদত দিচ্ছি…”

“বুঝেছি। …তা আপনি কী চান?”

“টু টিচ হিম আ লেসন। যাতে বাকি অধ্যাপকরা এই চেয়ারটাকে অন্তত সমঝে বুঝে চলে।” বিদিশা তিলেক ভাবল, “ওঁকে কি ইনসাবডিনেশনের চার্জে ফেলা যায় না? রেজিস্ট্রার সাহেব প্রেজেন্ট ছিলেন, তিনি আমার হয়ে টেস্টিফাই করবেন…”

“আপনি কি জানেন প্রফেসর মৈত্র কতটা পপুলার? পার্টির পক্ষ থেকে প্রতিটি অধ্যাপককে কড়া ডিকটাম দেওয়া সত্ত্বেও পরপর দু’বার উনি আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সমিতির সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। আমাদের প্রতিনিধিকে হারিয়ে। ওঁর বিরুদ্ধে এখন প্রতিটি স্টেপই প্রতিহিংসা বলে গণ্য হবে।”

“তা হলে আমি মুখ বুজে মেনে নেব? এরপর তো যে কোনও অধ্যাপকই আমার চেম্বারে এসে গলা বাজিয়ে যাবে।”

“বি ট্যাক্টফুল কমরেড। অন্য রাস্তা ভাবুন। প্রফেসর মৈত্রের রিটায়ারমেন্ট তো সামনেই? তাই না?”

“হতে পারে।”

“হতে পারে নয়। হচ্ছে। আগামী মার্চে হি উইল বি সিক্সটি। এসব খবর-টবরগুলো না রাখলে বিশ্ববিদ্যালয় চালাবেন কী করে?” জয়ন্তর গলায় আলগা ধমকের সুর, “শুনুন কমরেড, ষাটের পরে তো ফর্মাল এক্সটেনশনের একটা ব্যাপার আছে। পঁয়ষট্টি পর্যন্ত। ধাপে ধাপে। প্রফেসর মৈত্রকে ওটা দেবেন না।”

“তা কী করে সম্ভব? ওঁর সার্ভিস রেকর্ড এত ব্রিলিয়ান্ট…”

“তো? আপনাদের কনভেনশনটা কী, অ্যাঁ? এক্সটেনশনের চিঠি তৈরি করে অধ্যাপকদের কাছ থেকে একটা আবেদনপত্র নেওয়া হয়, তারপর কর্মসমিতিতে পাশ করানো তো নেহাতই ফর্মালিটি। এ ক্ষেত্রে কোনওটাই করবেন না। ষাট পূর্ণ হলে চাকরি ছেদের নোটিসটা ধরিয়ে দেবেন।”

“সর্বনাশ! কর্মসমিতিতে যদি চেঁচামেচি হয়?”

“বলবেন, উনি তো কোনও আবেদন করেননি, তাই এক্সটেনশন দেওয়া গেল না। দেখুন, প্রফেসার মৈত্রকে আমরা যতদূর চিনি, বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে না বললে উনি কোনও প্রেয়ার জমাই দেবেন না। ব্যস, আপনার দায়ও খতম।”

“ব্যাপারটা খুব দৃষ্টিকটু দেখাবে না? সবাই এক্সটেনশন পান, উনিই বঞ্চিত হচ্ছেন…”

“কমরেড, ওই চেয়ারে যদি থাকতে হয়, চোখকান বুজে রাখতে শিখুন। ও হ্যাঁ, আর একটা কথা। আগামী জুনে আপনাদের জিওগ্রাফি ফ্যাকাল্টির একজনের টার্ম শেষ হবে। পার্টির একজন শ্যামপুর কলেজে আছে, সে ওই পোস্টে অ্যাপ্লাই করবে। ডিটেলটা পরে পেয়ে যাবেন।”

জয়ন্ত দাশগুপ্তর ছেলে শ্যামপুর কলেজে পড়ায় না? প্রেসিডেন্সির ছাত্রনেতা ছিল… শ্রীমন্ত… তার কথাই বলছে নাকি?”

বিদিশা মৃদু স্বরে বলল, “নো প্রবলেম।”

“তবে ছাড়ি কমরেড?”

ফোন রেখে মনে মনে জয়ন্তর একটু তারিফ করল বিদিশা। সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না… কী চমৎকার প্ল্যান। খুঁটিনাটি খরবও রাখে বটে। তবে ভিতরের জ্বালাটা যেন কমছে না বিদিশার। সুখেন্দুকে তেমন কোনও কড়া শাস্তি দেওয়া গেল কী? বিদিশা যে ওজরই দেখাক, লোকটা তো সেই চাকরি শেষে শহিদের মর্যাদা পাবেই, তা হলে এত প্যাঁচ কষার কী মানে হয়? ডেকে একদিন জোর ধাতানি দিলে কী এমন ক্ষতি হত? আসলে পার্টি বোধহয় এখন আর কোনও বড়সড় বিতর্কে জড়াতে চায় না। ক্ষমতা বজায় রাখতে গেলে কোনও ধুকপুকুনিকে মনের কোণে ঠাঁই দিতে নেই, এই আপ্তবাক্য পার্টি বুঝি ভুলে যাচ্ছে। এসব দুর্বলতাই না আরও জলদি জলদি দলের পতন ডেকে আনে।

পাঁচ মিনিটও যায়নি, আবার ফোন। মনিটরে ফের পল্টুদা। উফ, নেই-আঁকড়া দাদাটিকে নিয়ে আর পারা যায় না। বিদিশা গোমড়া গলায় বলল, “কী ব্যাপার? বারবার রিং করছ কেন?”

“তুই ব্যস্ত নাকি? তাইলে নয় পরে…”

“আহ, বলো কী বলবে। বোর কোরো না।”

“কবে আইতাছস আমাগো বাড়ি?”

“যাব বলেছি নাকি?”

“তা নয়। বছরে একবারই তো তর দর্শন মেলে। বিজয়ার পর। তর মামি বড় আশা কইরা থাকে, মানুষটা কবে আছে কবে নাই… বউমারে লইয়া একবার আয় না।”

“আচ্ছা আচ্ছা, ফুরসত মিললে যাবখন।”

“শুন, যে জন্য তরে ফোন করা…। নীলুরে লইয়া তো ফের মুশকিলে পড়লাম।”

“কী হল আবার? ঝাড়গ্রামের বদলে তাকে তো মেদিনীপুর দেওয়া হয়েছে।”

“যাতায়াত ওর পুষায় না। আবার ওইহানে থাকলে তার একা একা লাগে।”

“ওর একটা বিয়ে দিয়ে দাও।”

“আরে, সেই কথাই তো কই। মাইয়া তার পছন্দই আছে। এই অঘ্রানেই তারে বিয়া কইরা মেদিনীপুর লইয়া যাইতে চায়।”

“বাহ, এ তো খুশির খবর।”

“তুই এতে খুশি দ্যাখোস বোনটি? আমার সর্বনাশটা বুঝস না? যাও দু’-চার পয়সা ঠ্যাকাইতেছিল আর কি তা পামু?”

“তা কী করা যাবে। তোমার কপাল।”

“আমার শেষ মিনতি শোন বোনটি। অরে কাছেপিঠে কোথাও আইনা দে। যাতে বউ লইয়া ঘরে থাকে। আমরাও তো বুড়াবুড়ি হইসি, আমাগো দ্যাহনের জন্যও তো লোক লাগে, না কী?”

যুক্তিটা একেবারে ফ্যালনার নয়। নীলু সঙ্গে থাকলে পল্টুদার সব দিক দিয়েই খানিক সাশ্রয় হয় বটে। আলতোভাবে বিদিশা বলল, “আচ্ছা দেখবখন। তবে কোনও কথা দিতে পারছি না।”

“ব্যস ব্যস, ওইটুকুই যথেষ্ট। তুই কত বড় মানুষ এখন, তুই চাইলে কী না হয়।” পল্টুর স্বর গদগদ, “তা আমাগো বউমার কী খবর? হ্যায় আছে কেমন?”

পল্টুকে তাড়াতাড়ি ছাঁটতে বিদিশা সংক্ষেপে জবাব দিল, “ভাল।”

“আহা কী টুকটুকে লক্ষ্মীমন্ত বউ। এবার একটা ফুটফুটে পোলাপান আইলে তর সংসার বুঝি পরিপূর্ণ হয়।”

আঁচলের যে বাচ্চা হবে, তা কী জানে পল্টুদা। যাক গে, যেচে ওই প্রসঙ্গ তোলার তার কোনও বাসনা নেই। আবার সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল, “হুঁ।”

“আর একখান কথা ছিল রে বোনটি। তুই আমার এত উপকার করছস, তরে না কইয়াও পারি না, কইতে সাহসও হয় না… কীভাবে নিবি, না নিবি…”

পল্টুর বিনয়ের আধিক্যে খটকা লেগেছে বিদিশার। জিজ্ঞেস করল, “কায়দা না মেরে বলো তো কী হয়েছে?”

“মনে কিছু করিস না কিন্তু। আমাগো বান্টির চালচলন আমার ভাল ঠেকে না।”

“কেন? কী করেছে বান্টি?”

“আমার বড়পুত্তুর তো এখন বাগুইআটিতে থাকে, হ্যায় নাকি মাঝেমধ্যেই বান্টিরে দ্যাখতে পায়। শিবমন্দিরের গলির এক মাইয়ারে লইয়া বান্টি নাকি খুবই ঘুরাফেরা করে। এই তো, পূজাতেও বান্টি নাকি তারে লইয়া…। লালুই আমারে কইল, পিসিরে সাবধান কইরা দাও। ফেমিলিটা ভাল নয়। ছেমড়ির দাদা নাকি ছিল মস্তান, পুলিশের গুলি খাইয়্যা মরসে। বাবাটা সারাক্ষণ নেশায় চুর থাকে। …বান্টি আমাগো সাদা মনের ছেলে, হয়তো সরলভাবেই মেশে। কিন্তু এইসব মাইয়ারা… বুঝিসই তো… ছেলেদের ফাঁন্দে ফেইলা…”

আরও কত কী বলে চলেছে পল্টু, কিছু কানে ঢুকছিল না বিদিশার। অফ করে দিয়েছে ফোন। রগের শিরা লাফাচ্ছে দপদপ। এখনও সেই ডাকিনীর খপ্পরে আটকে আছে বান্টি? আঁচলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার পরও?

এতক্ষণে যেন ছবিটা স্পষ্ট হচ্ছিল বিদিশার কাছে। বান্টির সন্ধেবেলা বাড়িতে না থাকা, বউয়ের কাছাকাছি না ঘেঁষা, সবেরই যেন অর্থ মিলছে। আঁচল কি জানে? মনে হয় না। জানলে নিশ্চয়ই থাকত না শ্বশুরবাড়িতে। তবে মেয়েদের স্বাভাবিক ইন্দ্রিয়বলে বুঝি কিছু আন্দাজ করেছে। তাই না মেয়েটার মুখে কখনও হাসি নেই। বজ্জাত ছেলে মেয়েটাকে গর্ভবতী করে দিয়ে আবার নেমে পড়েছে পুরনো খেলায়। ছি ছি, কী সর্বনাশটাই না ঘটল আঁচলের!

তার চেয়েও বড় কথা, এ তো বিদিশার চূড়ান্ত পরাজয়। বিদিশার সমস্ত পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করে দিল ছেলে? বিদিশা নিজেই বা কী? এতদিকে তার চোখ, অথচ ছেলের অসভ্যতাটা সে খেয়াল করেনি?

ঝটাকসে মোবাইল তুলল বিদিশা, চেনা নম্বর টিপছে। ওপারে গলা বাজতেই হুংকার, “তোমার আক্কেলটা কী মণিদা, অ্যাঁ? কতবার করে তোমায় বলেছিলাম বান্টির ওপর নজর রাখতে? কী করেছ এতদিন?”

“কেন? বান্টি কী করল?”

“চুপ। একদম চুপ। তোমার মতো কেন্নোপোকার ওপর বিশ্বাস রাখাটাই ভুল হয়েছে। আমার এত বড় ক্ষতি করলে? তুমি কি আমার ওপর প্রতিশোধ নিলে মণিদা? এইভাবে? তোমার মনে এই ছিল?”

বলেই বিদিশা ঝাং কেটে দিল ফোন। দু’ আঙুলে রগ টিপে বসে আছে। উপাচার্যের গদি, বিলাসবহুল কক্ষ, এসির নরম ঠান্ডা সব যেন একযোগে ঠাট্টা ছেটাচ্ছে সর্বাঙ্গে। আগুনের হলকা বইছে বুকে, জ্বলে যাচ্ছে শরীর।

না, বিদিশা ছেলের কাছে হার মানবে না। কিছুতেই না। ওই আঁচলেই সে বাঁধবে বান্টিকে। বাঁধবেই।

৩৩

নাটকের নাম বেওয়াফাই। অক্ষর থিয়েটারের দ্বিতীয় সারির প্রান্তে বসে দেখছিল দেবরাজ। বেশ আগ্রহ নিয়ে। সাধারণত পুনমের নাটক সে চার-পাঁচটা শোয়ের আগে দেখে না, এবার প্রথম রজনীতেই আসতে হয়েছে। পুনমের ঝুলোঝুলিতে। এখন মনে হচ্ছে এসে ভুল করেনি, যা চুটিয়ে অভিনয় করছে পুনম। আজই না দেখলে পুনমের এমন চমৎকার নটী রূপের অনেকটাই বুঝি তার অজানা রয়ে যেত।

যবনিকা পতনের পর বাইরের পার্কিং লটে এসে দাঁড়াল দেবরাজ। মুখের রং চং মুছবে, মেমসাহেবের ধরাচুড়ো ছাড়বে, পুনমের এখন বেরোতে খানিকটা সময় তো লাগবেই। গাড়িতে হেলান দিয়ে দেবরাজ একটা সিগারেট ধরাল। মাথায় নাটকটাই পাক খাচ্ছে এখনও। একটা মেয়ে কী অবলীয়ায় মিথ্যে বলে চলেছে বারবার। বরকেও ঠকাচ্ছে, প্রেমিককেও। অথচ সে কারওকেই প্রতারণা করছে না, এ যেন স্রেফ এক খেলা। সত্যিই কী এরকম হয়? মেয়েরা না সম্পর্ককে অনেক বেশি মূল্য দেয়? অবশ্য নাটকটা রূপকধর্মীও হতে পারে। পিন্টার তো রাজনৈতিক নাটকই লেখে, সম্ভবত মেয়েটার চরিত্রের মাধ্যমে অন্য কিছু একটা বলতে চেয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের ফাঁকা বুলি। কিংবা বুদ্ধিজীবীকুলের ভণ্ডামি। ওহ, কলকাতায় যা দেখছে আজকাল। আদর্শ আর ঝুটো রাজনৈতিক ক্ষমতা, দুটোর মাঝে যা দোল খাচ্ছে শিল্পী কবি সমেত সংস্কৃতি জগতের তাবড়-তাবড় রথী-মহীরথীরা! যে অসীম আর্ট কলেজে পড়ার সময়ে শিল্পীর স্বাধীনতা নিয়ে গলা ফাটাত, সে এখন ঘাসফুল পার্টির কৃপায় দিব্যি কলা অ্যাকাডেমির বিশেষ উপদেষ্টা। সাদামাঠা মোবাইল নয়, একেবারে ব্ল্যাকবেরি পকেটে রাখছে। এখন নাকি বুঝেছে যন্ত্রটি তত অপ্রয়োজনীয় নয়। আবার বড় গলা করে বলে, বিবেককে বাঁধা দিইনি রে, শুধুমাত্র শিল্পীদের স্বার্থে একটু বেশি সক্রিয় হয়েছি, এই যা। নাটকে এম্মা নামের মেয়েটাও এই ধরনের কী যুক্তি দিচ্ছিল না?

হন্তদন্ত পায়ে আসছে পুনম। পরনে জিনস, ঢোলা টিশার্ট, কাঁধে পেটমোটা ব্যাগ। দূর থেকেই গলা ওঠাল, “জলদি করো, জলদি করো, বহোৎ ভুখ লগা হ্যায়।”

ড্রাইভিং সিটে আসীন হয়ে হাত বাড়িয়ে দরজা খুলে দিল দেবরাজ। পুনম বসামাত্র স্টার্ট দিয়েছে গাড়িতে। আলগাভাবে বলল, “এত তাড়াতাড়ি বেরোলে যে? তোমাদের আজ প্রেসমিট ছিল না?”

“চলছে। ম্যায় ভাগ আয়ি।”

“কেন?”

“এত তারিফ চলছে আমার, বাপস। কান ঝাঁ ঝাঁ করছিল।”

“স্ট্রেঞ্জ! প্রশংসা শোনার জন্যে তো অ্যাকটর অ্যাকট্রেসরা মুখিয়ে থাকে।”

পুনম কিছু বলল না। পাতলা হেসে তাকিয়েছে বাইরে। রাত সাড়ে ন’টা বাজে। বিকেল সন্ধের চরম ব্যস্ততা নেই, তবে কনট প্লেস এখনও ঝিমোয়নি। গাড়ি চলছে অজস্র, ঝলমল করছে হোটেল রেস্তোরাঁ, কার্তিকের মিহি ঠান্ডা মেখে কেজো দিল্লি এখন ভারী মোহময়।

বাঁয়ে চওড়া রাস্তায় ঢুকে দেবরাজ জিজ্ঞেস করল, “কোথায় খাবে? একটু গেলে একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁ…”

“না না, বাড়িতেই খাব।”

“আজ তো রান্না নেই। তোমার বাই আসেনি।”

“কুছ লে লো না। রোটি-সবজি… সাথমে যদি মাটন চিকেন খাও…”

কোনও ঝঞ্ঝাটে গেল না দেবরাজ। বাবা খড়ক সিং মার্গের এক ধাবা থেকে শুধু রুটি-তড়কা নিল বেশি করে। পুনমের পছন্দের খানা। পড়ে থাকলে কালও খাবে।

এবার নিশ্চিন্তে বাড়ি। ঢলঢলে ক্লাচে চাপ দিয়ে দেবরাজ গাড়ির গিয়ার বদলাল। পুনমের প্রশ্ন কানে এল, “কেমন লাগল আমাদের প্লে?”

“ভাল। বেশ ভাল। তবে পলিটিকাল অ্যালিগরিটা খুব স্পষ্ট নয়।”

“ধুস, ওরকম কিছু নেই। এ তো একেবারে রিয়েল লাইফ ড্রামা। পিন্টারের লাইফে প্রায় এমনটাই ঘটেছিল। ওঁর ওয়াইফ ওঁরই এক বন্ধুর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল। পিন্টারকে জানানোর পরও সেই আশিকি সে ছাড়েনি। এবং আশিকের কাছে ভান করত যেন পিন্টার কিছু জানে না। পরে অবশ্য সেই বউয়ের সঙ্গে পিন্টারের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।”

“ও। এদিকে আমি কত কী ভেবে ফেললাম। দেশ-কাল-সমাজ তথ্য রাজনৈতিক পরিস্থিতি…।” বলতে বলতে দেবরাজ হা-হা হাসছে। পুনমের কাঁধে হালকা চাপড় মেরে বলল, “তুমি কিন্তু ফাটিয়ে দিয়েছ। ইটস এ পারফেক্ট পোরট্রেয়াল অফ বেওয়াফাই।”

পুনম নিচু স্বরে বলল, “বলছ?”

“শিওর। …তা তুমি হঠাৎ লিড রোল করলে যে বড়? ইউজুয়ালি তুমি তো সাইড ক্যারেক্টারই করো।”

“নাটকটা যখন গ্রুপে পড়া হচ্ছিল, তখনই টের পেয়েছিলাম এম্মা ক্যারেক্টারের জন্যে আমি সব থেকে স্যুটেবল। শুধু মগজ নয়, আমি হৃদয় দিয়ে চরিত্রটা ফোটাতে পারব। ডিরেক্টরকে বললাম কথাটা। সবার সামনেই। অখিলের মনে ডাউট ছিল, তবে সে আমার রিকোয়েস্টটা ঠেলতে পারেনি। তারপর রিহার্সাল শুরু হতে আর কোনও সমস্যা হল না।”

“কেন তোমার ওইরকম মনে হয়েছিল? তুমি নিশ্চয়ই অমন মিথ্যেবাদী নও? হাউ ক্যান ইউ রিড এম্মাজ মাইন্ড?”

“আর ইউ শিওর, আমি এম্মা নই?”

দেবরাজ সামান্য চমকেছে। তাকাল পুনমের দিকে।

দেবরাজের স্টিয়ারিং ধরা হাতে হাত রাখল পুনম। চাপ দিল মৃদু। তার ঠোঁটের কোণে চিলতে হাসি, যা বুঝি মোনালিসার চেয়েও দুর্বোধ্য। যমুনা ব্রিজে উঠছে গাড়ি, সামনে ফিকে ফিকে কুয়াশা। নর্দমার মতো বহমান শীর্ণ যমুনার বুকেও যেন ধোঁয়াটে আস্তরণ। দূরের অট্টালিকার সারি যেন আবছায়ায় ঢাকা।

বুঝি সেই আবছায়ার খানিকটা সেঁধিয়ে গিয়েছিল গাড়ির অন্দরে। দেবরাজ বা পুনম, কেউই আর কথা বলছিল না। আবাসনের চৌহদ্দিতে ঢুকে পুনমকে নামিয়ে দিল দেবরাজ। গাড়ি গ্যারেজ করে যখন ফ্ল্যাটে ঢুকল, পুনম খাবার সাজিয়ে ফেলেছে।

পোশাক বদলে হাত ধুয়ে খেতে বসে গেছে দেবরাজ। পেঁয়াজ আর কাঁচালঙ্কা নিয়ে। রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে পুনমকে বলল, “হঠাৎ সাইলেন্ট হয়ে গেলে কেন?”

“এমনি। নিজেকে তৈরি করছি।”

“কীসের জন্য?”

উত্তর না দিয়ে পুনমের পালটা প্রশ্ন, “আচ্ছা, আমি কি কখনও আমাদের গ্রুপের শো দেখার জন্য তোমাকে ফোর্স করি?”

“নেভার। আমি নিজেই যাই। আমার সময়মতো।”

“এবার কিন্তু আমি জোর করেছিলাম। …অবাক হওনি?”

“একটু একটু। তারপর ভাবলাম, পরশু কলকাতা যাচ্ছি, ফেরাটাও তো অনিশ্চিত, কবে নাটকটা দেখা হয় না হয়… প্লাস এইবার নাকি তুমি একটা স্পেশাল চরিত্রে…”

“ঠিকই ধরেছ। তবে আর একটা ব্যাপারও ছিল। আই হ্যাড সামথিং টু সে। মনে হচ্ছিল, দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি চাইছিলাম তার আগে তুমি নাটকটা দ্যাখো। তা হলে বক্তব্যটা কনভে করতে আমার সুবিধে হবে।”

দেবরাজ খাওয়া থামিয়ে চোখ তুলল, “কী হেঁয়ালি করছ বলো তো?”

“তোমাকে আমি কিছু মিথ্যে বলেছি রাজ। কিছু ফ্যাক্ট চেপেও গেছি। লতা ওয়াজ নট রং। অবধেশের সঙ্গে সত্যিই আমার অ্যাফেয়ার আছে।”

ধাক্কা একটা খেল বটে দেবরাজ, তবে প্রবল নয়। শুধু বলল, “তাই?”

“হ্যাঁ। এবং এটা অনেকদিনের ঘটনা। আমাদের রিলেশন অন্তত দশ বছরের। চাকরিতে জয়েন করার সময় থেকেই। তোমাকে আমি আরও যা বলিনি… বিমলের সঙ্গে আমার যে ডিভোর্স হয়েছিল, তার কারণ ছিল অবধেশ। মেহরৌলির এক হোটেলে বিমল আমাদের হাতেনাতে পাকড়াও করেছিল। কিন্তু ডিভোর্সের পরও আমি অবধেশের লাইফে এনট্রি পাইনি। কারণ অবধেশ তখন শুধু বিবাহিতই নয়, অবধেশের বউ মীনাক্ষী তার বরকে চোখে হারায় এবং সেই মেয়েকে ছেড়ে আসা অবধেশের পক্ষে অসম্ভব। তাকে লুকিয়েই আমাদের সম্পর্কটা… এখনও…”

“ও। কিন্তু আমাকে লুকনোর তো কোনও দরকার ছিল না? তুমি তো জানোই, নারীসঙ্গের ব্যাপারে আমিও মোটেই ধোয়া তুলসীপাতা নই? তোমার কাছে সেসব গল্প আমি গোপনও করিনি। হয়তো তুমি শুনতে চাওনি, বিরক্ত হয়েছ, স্টিল…”

“হুম। আমারও তো খুব অবাক লাগে। কেন যে বলতে পারিনি?”

“তার চেয়েও বড় কথা, আমার সঙ্গে তুমি থাকতে এলে কেন? একাই তো কোথাও স্টে করতে পারতে।”

“অসুবিধে ছিল রাজ। তোমার সঙ্গে আছি বলে মীনাক্ষী আমাকে নিয়ে অবধেশকে সন্দেহ করে না। আর এই রহস্যই বোধহয় আমার আর অবধেশের সম্পর্কটা এতদিন জিইয়ে রেখেছে।”

“ও।” দেবরাজের গলায় অল্প ঝাঁঝ ফুটল, “তুমি তা হলে শুধুই আমাকে ব্যবহার করেছ।”

“কাম অন রাজ, আমি তো তোমাকে পছন্দ করি। এক ঔরৎ এক মর্দকো জিতনি পসন্দ কর সকতি হ্যায়, উতনি হি। তোমার পাওয়ায় কখনও কোনও ঘাটতি পড়েছে? তুমিই বলো? কান্ট ইউ শেয়ার ইয়োর ওম্যান?”

একটু যেন নাড়া খেল দেবরাজ। এই কথাই কি সে একদিন বলেনি মানসীকে? আজ কানে লাগে কেন? সে না দাবি করে, তার মনে কোনও অসূয়া-ফসুয়া নেই? তবে কি তার মধ্যেও একটা গড়পড়তা পুরুষ ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে কোথাও? লিভ টুগেদারের পলকা সুতোকে সে কি অধিকারবোধের শিকল হিসেবে ভাবে সংগোপনে?

পুনম ভুরু কুঁচকে দেবরাজকে দেখছে। মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করল, “আমার ওপর খুব রাগ হচ্ছে?”

দেবরাজ ছোট একটা শ্বাস ফেলল। দু’দিকে মাথা নেড়ে বলল, “নাহ।”

“নিজেকে চিটেড মনে হচ্ছে?”

“আমার কি কারওকে প্রতারক ভাবা সাজে পুনম?”

“এরপরও কি তুমি আমার সঙ্গে থাকতে পারবে?”

“এম্মার হাজব্যান্ড তো পেরেছিল দেখলাম।” দেবরাজ হাসল, “আর আমি তো তাও নই।”

“তবু… আমাদের কি আর একসঙ্গে থাকা উচিত হবে?”

কেন যেন এই মুহূর্তে আবার মানসীকে মনে পড়ল দেবরাজের। তুমুল ঝগড়া করে মানসী যেদিন চলে গেল, ঠিক তার আগেও ঘরে শুয়ে কাঁদছিল। এমনকী মেয়ে কোলে, বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে যখন ট্যাক্সিতে চাপল, তখনও বারবার ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছিল। শুধু দেবরাজ নয়, ফেলে যাওয়া গোটা সংসারটাকেই যেন দেখছিল মানসী।

সেই দৃশ্যের সঙ্গে আজকের পরিস্থিতির কোনও সাদৃশ্য নেই, তবু কেন যে উঁকি দিল ছবিটা? সেই মেঘলা বিকেলটা যে আদৌ স্মরণে আছে, তাই তো দেবরাজ জানত না।

নিজেকে শক্ত করল দেবরাজ। স্পষ্ট স্বরে বলল, “তোমার উচিত-অনুচিত ঠিক করার আমি কে পুনম? আমার আবাহনও নেই, বিসর্জনও নেই। সিদ্ধান্ত তোমাকেই নিতে হবে।”

নিঃশব্দে আহার শেষ করল পুনম, ক্ষণেক অপেক্ষা করল দেবরাজের জন্যে। তারপর দু’জনের প্লেট নিয়ে চলে গেছে রান্নাঘরে। দেবরাজ ব্যালকনিতে গিয়ে সিগারেট ধরাল। ছেঁড়া ছেঁড়া চিন্তা ভাসছে মেঘের মতো। পুনম কি চলে যেতে চায়? দেবরাজ কি কোনওভাবে তার পিছুটান হয়ে দাঁড়িয়েছে? তাই যদি হয়, তা হলে তো এবার ক্রমশ তেতো হতে থাকবে সম্পর্ক। আশ্চর্য, দেবরাজ নিজেও কি খানিকটা দোদুল্যমানতা দেখাল না?

যাক গে, জীবন যেদিকে গড়াতে চায়, সেদিকেই গড়াক। যা তার হাতে নেই, তা নিয়ে কেন টেনশনে ভুগবে দেবরাজ? পুনম থাকাতে একটাই সুবিধে, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছিল ফ্ল্যাটটার। এবার থেকে নিজেকেই…

শুতে যাওয়ার আগে দেবরাজ নিয়মমতো ঢুকল স্টুডিয়োয়। তার এবারের দিল্লিবাস বৃথা যায়নি। তিনখানা ছবি শেষ করেছে। কে জানে কেন কলকাতাই এসে যাচ্ছে ছবিতে। জীর্ণ শহরটা অন্য ধরনের নিসর্গ হয়ে উঠছে যেন। প্রাচীন ভাঙাচোরা বাড়ি থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে বটগাছের পাতা, নদীর ওপারে বন্ধ মিলের চিমনি মরা নারকেলগাছের মতো দাঁড়িয়ে আছে সার সার…। আরও অন্তত দু’খানা ছবি আঁকা দরকার। মার্চে ইন্ডিয়ান আর্ট গ্যালারিতে অশোক মনজিত উত্সবদের সঙ্গে যৌথ প্রদর্শনী, সেখানে ছ’খানা ছবি দেওয়ার কথা। মনে হচ্ছে এবার কলকাতা গিয়েও তুলি ধরতে হবে। ওখানকার স্টুডিয়োর ভারী ছন্নছাড়া দশা, আজেবাজে আসবাবে বোঝাই। গিয়েই বলতে হবে দিলীপকে, যেন সাফসুতরো করে ফেলে ঝটপট।

চিন্তায় ছেদ পড়ল। পুনম ডাকছে, “রাজ, আমার লাইটারটা তুমি নিয়েছ?”

দেবরাজ চেঁচাল, “কই, না তো।”

“তা হলে গেল কোথায়? …তোমারটাই দিয়ে যাও প্লিজ।”

দেবরাজ হেলেদুলে বেডরুমে এল। তার হাত থেকে লাইটার নিয়ে সিগারেট ধরাচ্ছে পুনম। বিছানার দিকে এগোচ্ছিল দেবরাজ, হঠাৎ তার দৃষ্টি আটকেছে পুনমের রাতপোশাকে।

ফিনফিনে নাইটি। নীচে একটা সুতো পর্যন্ত নেই। পুনমের পূর্ণ দেহবল্লরী ভয়ংকর ভাবে দৃশ্যমান।

ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে পুনম কাছে এল। মিটিমিটি হেসে বলল, “চোখ বড় বড় করে কী গিলছ, অ্যাঁ?”

“হঠাৎ এই সাজ?”

“অড লাগছে? উতার দুঁ ক্যায়া?”

দেবরাজকে চমক হেনে পুনম পলকে নিরাবরণ। একদম কাছে এসে হঠাৎ জড়িয়ে ধরেছে দেবরাজকে। সিগারেট হাতেই ঠোঁটে মিশিয়ে দিচ্ছে ঠোঁট। চুম্বনে যে কী জাদু, মুহূর্তে টনকো হয়ে উঠল দেবরাজের শরীর। সিগারেট কেড়ে নিয়ে নিভিয়ে দিল অ্যাশট্রেতে। বলিষ্ঠ দু’হাতে নিষ্পেষিত করছে পুনমের ভারী স্তন। বসে পড়ল হাঁটু গেড়ে। মুখ রেখেছে পুনমের যোনিতে। উন্মত্তের মতো জিভ ঘষছে পুনমের পেটে কোমরে নাভিতে। পুনমও সাঁড়াশি হয়ে দেবরাজকে আঁকড়ে ধরল, আঁচড় টানছে তার পিঠে, মত্ত বাঘিনির মতো পিষছে পুরুষালি দেহ। দেবরাজকে নিয়ে সে গড়িয়ে পড়ল বিছানায়। মথিত হচ্ছে সশব্দে। আদিম সুখের জান্তব শীত্কারে কেঁপে কেঁপে উঠছে ফ্ল্যাটের বাতাস।

মৈথুন শেষ। দেবরাজের বাহুর বেড়ে শুয়ে পুনম। রণক্লান্ত যোদ্ধার মতো পড়ে আছে দেবরাজ। চোখ বুজে।

কানের ধারে পুনমের ফিসফিস, “মোটেই এখনও বুড়ো হওনি রাজ।”

দেবরাজ বিড়বিড় করল, “কবে আমায় কমজোরি দেখলে?”

“তা নয়। তবে এমন দাপাদাপি তো রোজ করতে হয় না…”

“তুমিই বা এমন মোহিনী রূপ ধারণ করো কই?” পুনমকে ছেড়ে দেবরাজ কনুইয়ে ভর রেখে আধশোওয়া। অন্য হাত খেলা করছে পুনমের স্তনবৃন্তে। চল্লিশ পেরোনো পুনম কেঁপে উঠছে মৃদু মৃদু। আচমকা একটা প্রশ্ন ধেয়ে এল দেবরাজের মনে। জিজ্ঞেস করে ফেলল, “কেসটা কী বলো তো? এটা কি বন্ধুত্বের নবীকরণ? নাকি বিদায়ী নৈশভোজ?”

একটু কি চমকাল পুনম? তেমনটাই যেন মনে হল দেবরাজের। পরক্ষণে অবশ্য দেবরাজের হাতখানা নিয়ে ঠোঁটে ঠেকিয়েছে পুনম। আঙুলে চুমু খেয়ে বলল, “এখন ওসব ভাবনা থাক রাজ। তুমি না এই মুহূর্তের জন্য বাঁচো?”

ঘরের আলো নিভে গেল। কখন যে ঘুমিয়েও পড়েছে নারীপুরুষ! পরদিন সকালে পুনম একেবার স্বাভাবিক। ঠেলে ঠেলে তুলল দেবরাজকে। তাকে টেবিলে ব্রেকফাস্ট দিয়ে ঝটপট রান্নাবান্না সারছে। অবধেশের দৌলতেই সম্ভবত চাকরিটা সে খোওয়ায়নি, অফিস বেরিয়ে গেল নিখুঁত টাইমে।

টোস্ট চিবোতে চিবোতে দিনটাকে ছকে নিচ্ছিল দেবরাজ। কাল বিকেলে কলকাতা যাওয়া, তার আগে দরকারি কাজ সারতে হবে কয়েকটা। গাড়ির ক্লাচটা গণ্ডগোল করছে, কৃপালের ওয়র্কশপে দেখানো দরকার। কৃপালের বিশাল গ্যারেজ, ওখানেই এখন রাখা থাকবে গাড়িটা। পুনম তো গাড়ি ব্যবহারই করে না, এখানে পড়ে থাকলে ও গাড়ির আরও যে কত সমস্যা তৈরি হবে! আজ তো আশিসের সঙ্গেও মোলাকাত করার কথা। আর্টিস্টস গিল্ড আর দিল্লি ট্যুরিজ়মে একটা গাঁটছড়া বাঁধার পরিকল্পনা চলছে, ওই নিয়ে একটু আলোচনা করা প্রয়োজন।

তবে সবার আগে চিরন্তন। দিল্লিতে একটা সোলো এগ্জিবিশন করা চিরন্তনের বহুকালের ইচ্ছে, তার একটা ব্যবস্থা মোটামুটি পাকা করে ফেলেছে দেবরাজ। ঋণশোধ নয়, শুধু সামান্য একটু প্রত্যুপকার, এখানকার শিল্পসংগ্রাহকদের সঙ্গে চিরন্তনের কাজগুলোকে একটু ভাল করে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। এটুকু করতে পারলে দেবরাজও যে মনে একটু তৃপ্তি পায়। হাউজ খাসের অম্বর আর্ট গ্যালারির মোহন থাপার যথেষ্ট আগ্রহ দেখিয়েছে, চুক্তিপত্রের একটা খসড়াও দেবে আজ। ওই সব কাগজপত্র হাতে নেওয়ার আগে চিরন্তনকে তো জানানো উচিত। মানুষ হিসেবে চিরন্তন অনেক সাচ্চা, অসীমের মতো ভড়ং নেই। তবে আত্মাভিমান আছে খুব। চুক্তির কিছু কিছু ধারা ওর পছন্দ নাও হতে পারে।

চা খেয়ে মোবাইলটা আনল দেবরাজ। এখনও সুইচড অফ। কাল নাটক দেখতে ঢুকে সেই যে ঘুম পাড়িয়েছিল, আর জাগানো হয়নি।

ফোন অন করতেই ভূকম্পন। খান দশেক মিসড কল! দু’খানা মেসেজ! সব ক’টাই বনানীর নম্বর থেকে!

তড়িঘড়ি মোবাইলের বোতাম টিপেছে দেবরাজ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ওপ্রান্তে বনানীর ভার গলা, “এতক্ষণে তোর সময় হল ছোড়দা?”

“কাজের কথা বল।” দেবরাজ অনুযোগটা এড়িয়ে গেল। উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, “দাদা ঠিক আছে তো?”

“ভাল থাকলে কি তোকে বারবার জ্বালাই? রাত একটা-দু’টোয় ফোন করি?” বনানীর গলা ধরা ধরা শোনাল, “বড়দাকে বোধহয় আর রাখা গেল না রে।”

তার মানে আছে এখনও! দেবরাজ ঈষৎ উত্তেজিতভাবে বলল, “আরে, কী হয়েছে বলবি তো?”

“নেক্সট কেমোর ডেট এগিয়ে আসছে… তাই নিয়ে দাদা ভীষণ অস্থির হয়ে পড়েছিল। সারাক্ষণ বউদিকে বলছিল, আমাকে আর পুইয়ে পুইয়ে মেরো না।”

“সে তো আগেই শুনেছি। নতুন করে কী হল?”

“কাল বিকেল থেকে হঠাৎ প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট। খবর পেয়ে তক্ষুনি দৌড়েছি পাইকপাড়ায়। গিয়ে দেখি ভয়ংকর দশা। হিক্কা তুলছে। কী করব, না করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। বউদি বলছে, আর টানাটানি কোরো না। শেষ সময়ে ও বাড়িতেই থাকুক। কিন্তু বড়দাকে ওই ভাবে ফেলে রেখেছি জানলে তুই রাগ করবি… ওদিকে তোকেও কিছুতেই ধরতে পারছি না… শেষে মরিয়া হয়ে আমিই অ্যাম্বুলেন্স ডেকে রাত ন’টা নাগাদ রাজারহাটের ওই হসপিটালেই ভরতি করলাম। অবস্থা দেখে ওরা আর কোনও ঝুঁকি নেয়নি, সঙ্গে-সঙ্গে ঢুকিয়ে দিয়েছে ভেন্টিলেটারে।

“ও। তা এখন কেমন?”

“একটু আগে ফোন করেছিলাম। বলল, ফিজিকাল প্যারামিটারসের তেমন কোনও উন্নতি হয়নি।” বনানী কাঁদো কাঁদো, “এখন বোধহয় শুধু সময়ের অপেক্ষা। …রাতে কাল পাইকপাড়ায় ছিলাম। বউদিকে নিয়ে এখন বেরোচ্ছি। …দেখি আছে, কি নেই।”

“আমার তো সেই কালকের টিকিট। পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে।”

“জানি তো। প্লেনের ওই টিকিট বদলে আজ আসা মানে তো অনেক গচ্চা। আর হুটোপাটি করে এসেই বা কী হবে? যে থাকার নয়, সে তো…”

“আহ, থাম।” মুহূর্তে ইতিকর্তব্য স্থির করল দেবরাজ, “আমি আজই আসছি। এক্ষুনি।”

যেন পাশের ফ্ল্যাটে আগুন নেভাতে যাচ্ছে, এমন ভঙ্গিতেই দৌড়ল দেবরাজ। ঝটাঝট ব্যাগ গোছাল, দশ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে ট্যাক্সি ধরেছে। এয়ারপোর্টে এসে প্রস্থানের বোর্ড দেখে টিকিট কেটে সওয়ার হল বিমানে। প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার পেরিয়ে কলকাতায় যখন নামল, হেমন্তের দুপুর তখনও ফুরোয়নি।

লাগেজ প্রায় কিছুই নেই, সঙ্গে শুধু একখানা ট্রলিব্যাগ। হাতল ধরে টানতে টানতে লাউঞ্জ পেরোচ্ছিল দেবরাজ, তখনই পিছন থেকে বামাকণ্ঠ। তাকেই ডাকছে না?

দেবরাজ ঘাড় ঘোরাল। খানিক দূর থেকে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে গাঢ় সবুজ শাড়ি পরা একটা মেয়ে! আরে না, মেয়ে কোথায়, এ তো মহিলা! চন্দ্রিমা না! দেবরাজ যখন তাকে ছেড়ে ফ্রান্সে গিয়েছিল, কোনও জাদুতে যেন সেখানেই আটকে রেখেছে বয়সটা।

চন্দ্রিমা ব্যাগ সুটকেস বোঝাই ট্রলিসমেত এগিয়ে এল। একরাশ উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে বলল, “উফ, কতদিন পরে যে আমাদের দেখা হল! প্রায় বিশ বছর, তাই না? নাকি আরও বেশি?”

অত হিসেব করার এখন সময় নেই দেবরাজের। একটু ব্যস্তভাবেই বলল, “ওরকমই কিছু হবে। তা আছ কেমন?”

“ভালই তো।” বলেই পাশে দেখাল চন্দ্রিমা, “মিট মাই হাজব্যান্ড। বিজয় পোদ্দার।”

দেবরাজ লক্ষই করেনি, চন্দ্রিমার পাশে হুইলচেয়ারে এক বৃদ্ধ মানুষ। গাল-টাল ভাঙা লোকটার বয়স সত্তর পঁচাত্তর তো হবে। তবে চেহারা বেশভূষা দেখে অর্থশালী বলেই মনে হয়। হাতজোড় করে নমস্কার জানাতেই ফের চন্দ্রিমা বলে উঠেছে, “আর ইনি হচ্ছেন গ্রেট পেইন্টার দেবরাজ সিংহরায়। তোমাকে বলেছিলাম না, একসময়ে আমার খুব আঁকার ঝোঁক হয়েছিল… উনিই তখন আমায় শেখাতেন।”

কী নির্জলা মিথ্যে। একেবারেই বদলায়নি চন্দ্রিমা! দেবরাজ যেন এবার একটু বিরক্ত হল। ঘড়ি দেখছে।

চন্দ্রিমার ভ্রূক্ষেপ নেই, বলে চলেছে, “বিজয় এন্টারটেনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত। ওর প্রোডাকশন হাউসের নাম নিশ্চয়ই শুনেছ? নটরাজ মুভিজ?”

সিনেমা জগতের খবর বড় একটা রাখে না দেবরাজ। বাংলা ছবির তো নয়ই। তবে বুঝল, আন্দাজটা ভুল নয়, বেশ বড় ঘাটেই নৌকো ভিড়িয়েছে সেই কথুকি বোদা মেয়েটা। বুঝি সেই কারণেই ঠোঁট ফাঁক করল সামান্য।

আবার চন্দ্রিমাই বলল, “আমি কিন্তু অ্যাকটিং লাইনে নেই। একটা বিউটি পার্লার খুলেছি। নিজেই চালাই।”

দেবরাজ নিস্পৃহ সুরে বলল, “তাই বুঝি?”

“মোটামুটি ভালই চলছে, বুঝলে। ফিল্‌ম লাইনের কাস্টমারে ছেয়ে থাকে আমার পার্লার।” চন্দ্রিমার গলায় গর্ব, “এদিকে বিজয়ের হার্টে রিসেন্টলি একটা গোলমাল ধরা পড়েছে। থরো চেক-আপের জন্যে ওকে চেন্নাই নিয়ে যেতে হল। এখন কত দিক যে আমাকে একা হাতে সামাল দিতে হয়!”

এবারেও আগ্রহ দেখাল না দেবরাজ। সংক্ষিপ্ত ধ্বনি ফোটাল, “ও।”

“তুমি নাকি এখন দিল্লিতে থাকো? চন্দ্রিমার কৌতূহল অদম্য, “ওখানেই সেটল করেছ?”

“হ্যাঁ।”

“আমার ছেলেও তো দিল্লিতে। ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়ছে। এ বছর ফাইনাল দেবে। আকাশকে দেখতে আমি তো এখন মাঝে মাঝেই দিল্লি যাই।”

“তাই নাকি?” আবার ঘড়ি দেখল দেবরাজ। অভদ্রতা না করেই বলল, “এখন একটু তাড়ায় আছি চন্দ্রিমা। আমার এক ক্লোজ রিলেটিভ খুব অসুস্থ…”

“ও। সরি সরি। তোমায় আটকাব না। …তোমার নাম্বারটা পেতে পারি?” বলে বিজয়ের দিকে তাকাল চন্দ্রিমা, “তুমি তো আর্টিস্টদের কমপ্যানি খুব ভালবাস… ওঁকে একদিন ডাকি, জমিয়ে গল্প করা যাবে?”

অগত্যা দিতেই হয় নম্বর। তারপর আর পিছন পানে না তাকিয়ে লম্বা লম্বা পায়ে সোজা প্রিপেড ট্যাক্সির বুথে। গাড়িতে ওঠার পর দেবরাজের হঠাৎ খেয়াল হল, পুনমকে কিছুই বলে আসা হয়নি। এখন ফোন করবে? কী যেন ভেবে মেসেজ পাঠিয়ে দিল একটা। তারপরই মগজে আঁচল। সে যে কলকাতায় এল, এখনই জানাবে কি মেয়েকে? থাক গে। দাদার অসুখ-বিসুখ, মৃত্যুসম্ভাবনা নিয়ে আঁচলকে এখন বিব্রত করায় বনানীর ঘোর আপত্তি… তা ছাড়া গিয়ে এখন কী দেখবে তার ঠিক নেই… সুতরাং তাড়াহুড়ো না করাই বোধহয় ভাল।

হাসপাতালে ঢুকতেই সামনে তন্ময়। দেবরাজ প্রশ্ন করার আগে তন্ময় বলে উঠল, ‘এসে গেছেন? বড়দা বুঝি আপনাকে দেখার জন্যই টিকে আছেন এখনও।”

“ঘাবড়াচ্ছ কেন? যমরাজের সঙ্গে ফাইট এখনও বাকি আছে, বুঝলে।”

তেমন জোর ফুটল কি গলায়? উঁহু, স্বর বুঝি কেঁপেই গেল দেবরাজের।

.

[সুচিত্রা ভট্টাচার্যর ‘এই মোহমায়া’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল ‘সানন্দা’ পত্রিকায়। আর শারদীয় দেশ ১৪২২-এর জন্য লেখা শুরু করেছিলেন ‘কাঁটা বেঁধা পায়ে’ উপন্যাসটি। কিন্তু তাঁর আকস্মিক প্রয়াণে দুটি উপন্যাসই অসম্পূর্ণ রয়ে গেল।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *