৩০. অপলা পৌঁছল সন্ধ্যা মিলাবার পর

অপলা পৌঁছল সন্ধ্যা মিলাবার পর।

ট্রেন থেকে নেমেই সে একটি নিঃশ্বাস গোপন করল। আকাশ মেঘে কালো হয়ে আছে, ঘন ঘন বিজলি চমকাচ্ছে। অল্প কিছু লোক নেমেছে ট্রেন থেকে, তারা মুহূর্তের মধ্যে উধাও। ফাকা স্টেশন। চারদিক নিশুতি রাতের মত নীরব। অপলা ট্রগরের হাত ধরে বলল, ভয় লাগছে টগর?

না। কিসের শব্দ হচ্ছে খালা? কি জানি, ঝিঝি পোকা বোধ হয়। তোর ভয় লাগছে না তো?

না।

ভয়ের কিছু নেই। তোদের দাদার বাড়ি এখানে সবাই চিনে। বললেই হবে, মোক্তার বাড়ি। স্টেশন থেকে কোয়ার্টার মাইল।

কোয়ার্টার মাইল কী?

কোয়ার্টার মাইল হচ্ছে খুব কাছে। তোর ভয় লাগছে না তো?

না।

বৃষ্টি নামার আগে আগেই পৌঁছে যাব। আর না হয় বৃষ্টিতে অল্প ভিজব। কি বলিস মজাই হবে।

টগর উত্তর দিল না। তার মোটেই ভয় লাগছে না। বেশ মজাই লাগছে। বৃষ্টি নামলে আরো মজা হয়। শুধু ঝিঝি পোকার ডাকটা শুনতে কেমন লাগছে। এই পোকাগুলি মানুষকে কাড়য়ায় কিনা কে জানে। এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হচ্ছে, কিন্তু সে জানে জিজ্ঞেস করলে ঠিক উত্তর পাওয়া যাবে না। অপলা বলবে, না না কামড়ায় না। টগর লক্ষ্য করল খালামণি কেমন অসহায় ভঙ্গিতে সুটকেস হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সে বোধ হয় কাউকে জিজ্ঞেস করতে চান কোনদিকে যেতে হবে। কিন্তু কাকে জিজ্ঞেস করবে বুঝতে পারছে না।

খালামণি চল।

দাঁড়া একটু, এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? ঐ লোকটা আসছে। ওকে জিজ্ঞেস করব। ও বোধ হয় সেন্টশন মাস্টার।

কি ভাবে বুঝলে?

অপলা উত্তর দিল না। লোকটির দিকে এগিয়ে গেল।

স্টেশন মাস্টার অবাক হয়ে বললেন, কোথায় যাবেন? মোক্তার বাড়ি? ফয়সল সাহেবের বাড়ি? সে তো অনেকটা দূর।

কত দূর?

মাইল খানেকটা তো হবেই। গ্রামের মাইল শহরের মাইলের মত না, হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা হয়ে যাবে। তবু মাইল শেষ হবে না। পুরুষ মানুষ কেউ নেই আপনাদের সাথে?

জি না।

মোক্তার সাহেবের বাড়িতে তো কেউ থাকে না, সেখানে কার কাছে যাবেন?

অপলার বুক ধক করে উঠল। ট্রেনে উঠার পর থেকে এ রকম একটা আশঙ্কা তার হচ্ছিল গিয়ে দেখবে বাড়ি তালাবদ্ধ। দুলাভাই চলে গেছেন ঢাকা কিংবা অন্য কোথাও। বাড়ি দেখাশোনার জন্যে যারা ছিল তারাও নেই। মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেছে কিংবা অন্য কোনো গ্রামে যাত্ৰা দেখতে গেছে। ঢাকা ফিরে আসার কোনো ট্রেন নেই তারা রাত কাটাচ্ছে স্টেশনে। এমন সময় দুষ্ট কিছু লোকজন তাদের ঘিরে ধরল। তাদের মধ্যে একটি লোক খুব লম্বা তার সরু সরু হাত লোমে ভর্তি। সে খপ করে অপলার হাত ধরে বলল…

দুশ্চিন্তাগুলি এত স্পষ্ট হয় কেন কে জানে? ট্রেনে ওঠার পর থেকে তার আশপাশের সবাইকে অপলার দুষ্ট লোক বলে মনে হচ্ছিল। একজন টগরকে বাদাম কিনে দিল, অপলার সঙ্গে খুব খাতির জমানোর চেষ্টা করল। অপলার দৃঢ় ধারণা হল, লোকটার কোনো একটা মতলব আছে। সেই ধারণা ঠিক হয়নি, লোকটি ময়মনসিংহ স্টেশনে নেমে গেছে এবং নেমে যাবার আগে অপলাকে বলেছে …. যদি দেখেন পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হয়েছে তাহলে স্টেশন মাস্টারকে বলবেন পৌঁছে দিতে। অন্য কাউকে বলবেন না। আজকাল গ্রামেও টাউট শ্রেণীর একদল মানুষ তৈরি হয়েছে।

স্টেশন মাস্টার যথেষ্ট করলেন। একজন কুলী জোগাড় করলেন। হারিকেন এবং ছাতার ব্যবস্থা করলেন। এবং বার বার বললেন, মেয়ে মানুষের এতটা সাহস থাকা উচিত না। ছোট, একটা বাচ্চাকে নিয়ে একা একা রওনা হওয়া। কি সর্বনাশের কথা। দিনকালও ভাল না। যখন তখন ঝড়টির হচ্ছে।

পথে নেমে টগরের খুব আনন্দ হল। কত অদ্ভুত সব দৃশ্য চারদিকে। এবং সবই অচেনা। কতরকম শব্দ উঠছে,–আর সারাক্ষণই কেমন মজার একটা শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। একটা বাঁশ ঝাড়ের কাছে এসে সে থমকে দাঁড়াল।

ঐ সব কি জোনাকি খালামণি?

হ্যাঁ।

ওরা কি করছে?

খেলা করছে বোধ হয়।

এখানে এত জোনাকি কিন্তু শহরে জোনাকি নেই কেন?

জানি না কেন। তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস করবে, চল টগর দাঁড়িয়ে থাকবে না। দেরি হচ্ছে বৃষ্টি নামবে।

বেশিক্ষণ দাঁড়াব না। অল্প একটু দাঁড়াব।

বৃষ্টি নামবে তো।

নামুক।

টগর কিছুক্ষণ পরপরই দাঁড়িয়ে পড়েছে। তাকে আর নাড়ানো যাচ্ছে নাক। আপলা তাকে কোলে তুলতে চেষ্টা করল সে কোলে উঠবে না। সমস্তটা পথ হেঁটে হেঁটে যাবে।

কিসের শব্দ হচ্ছে খালামণি?

ঘণ্টা। ঘণ্টার শব্দ হচ্ছে।

ঘণ্টার শব্দ হচ্ছে কেন?

হিন্দুরা পূজা করছে। ওরা ঘণ্টা বাজিয়ে পূজা করে।

ওরা ঘণ্টা বাজিয়ে পূজা করে কেন?

জানি না কেন। ওদের জিজ্ঞেস কর।

টগর ভেবে পেল না। এত সুন্দর সব দৃশ্য, এত সুন্দর সব শব্দ কিন্তু খালামণির ভাল লাগছে না। কেন। একটা জায়গায় দেখা গেল লক্ষ লক্ষ ব্যাঙ ডাকছে। প্রথমে একটা ব্যাঙ মোটা গলায় কয়েকবার ডাকে তার পরপর অন্য ব্যাঙগুলি লাফালাফি করে ডাকতে ডাকতে হঠাৎ চুপ করে যায়। এ রকম করে কেন ওরা?

খালামণি!

না। আর একটি কথাও না। তুমি আমার কোলে আস টগর। এখনো অনেক দূর।

ব্যাঙরা সবাই একসঙ্গে কথা বলে কেন?

জানি না কেন। চুপ করে থাক তো এখন বৃষ্টি হলে কি অবস্থা হয় দেখবে।

বাড়ির কাছাকাছি আসতে সত্যি সত্যি বৃষ্টি নামল। প্রথমে ছোট ছোট ফোঁটা তারপরই মুষল বর্ষণ। সেই সঙ্গে ঠাণ্ডা বাতাস। ছাতা মেলতেই সেটা উল্টে গেল। টগর বলল, ছাতা উল্টে গোল কেন খালামণি?

এবার কিন্তু চড় খাবি টগর।

সঙ্গের কুলি জিজ্ঞেস করল আশপাশের কোনো বাড়িতে গিয়ে দাঁড়াবে কি না। অপলা রাজি হল না। তারা বাড়িতে পৌঁছল। কাকভেজা হয়ে। অপলার শাড়ি কাদায় মাখামাখি। সে দুবার কাদায় পা পিছলে পড়েছে। স্যান্ডেলের ফিতা গিয়েছে খুলে। রাগে-দুঃখে তার কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে। কিন্তু টগরের আনন্দের সীমা নেই। তার পাঁচ বছরের ক্ষুদ্র জীবনে এত আনন্দের ভ্রমণ সে এর আগে আর করেনি। এবং কে জানে ভবিষ্যতেও হয়ত আর করবে না। তীব ও তীক্ষ্ণ আনন্দের মুহূর্ত একজন মানুষের জীবনে বার বার আসে না।

ওসমান সাহেব বাড়িতেই ছিলেন। হৈচৈ শুনে হারিকেন হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। তার মুখ ভর্তি দাড়ি-গোফ। দেখতে কেমন সন্ন্যাসী সন্ন্যাসী লাগছে; তিনি শিশুদের গলায় চোঁচালেন, আরো কারা এসেছে। কাউকেই তো চিনতে পারছি না। এই ছোট ছেলেটা কে? চেনা চেনা লাগছে। কেন? টগর ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। তিনি, তাকে কোলে তুলতেই সে মুখ লুকালো তার বুকে। তার কেন জানি বড় লজ্জা লাগছে। কাউকে এখন আর মুখ দেখাতে ইচ্ছা করছে না। অপলা বলল, দুলাভাই, আপনার জামাকাপড় তো সব কাদায় মাখামাখি করে দিল।

দিক। তুমি কেমন আছ অপলা?

ভাল আছি। আপনি দাড়ি-গোঁফ রেখে এমন রবীন্দ্রনাথে সেজেছেন কেন?

ব্লেড পাওয়া যায় না। ব্লেডের অভাবেই এই কাণ্ড।

আপনাকে দাড়ি-গোফে কিন্তু ভালই লাগছে।

ওসমান শব্দ করে হেসে উঠলেন। ভরাট গলায় হাসি।

টগরও হাসতে শুরু করল। সে যেন এই রসিকতাটা বুঝতে পেরেছে। ওসমান সাহেব বললেন, আজ তোমরা আসবে এটা কিন্তু আজি জানতাম।

বাজে কথা বলবেন না দুলাভাই।

বাজে কথা না। তোমাদের জন্য রান্না করতে বলেছি। ফুলির মাকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবে।

জানতেন তাহলে স্টেশনে থাকলেন না কেন?

সেটা অবৈজ্ঞানিক কাণ্ড হত। অবৈজ্ঞানিক কিছু তো আমি করতে পারি না। মনের কোনো খেয়ালকে খানিক প্রশ্রয় দেয়া যায় বেশি প্রশ্রয় দেয়া যায় না।

কি করে বুঝলেন আজ আমরা আসব?

তা জানি না। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনে হল। টেলিপ্যাথি বোধ হয়। দু’জন আসবে সেটা বুঝিনি। আমার মনে হচ্ছিল তোমরা তিনজনই আসবে।

অপলা থেমে থেমে বলল, আপাও আসত ছুটি পায়নি। তাই। বলেই আপলার মনে হল দুলাভাই যেন অন্য এক রকম ভঙ্গিতে হাসলেন। শিশুদের মিথ্যা কথা প্রশ্রয় দেবার মত ভঙ্গিতে হাসা। মিথ্যাটি না বললেই হত।

দুলাভাই, আমরা আসায় আপনি কী খুশি হয়েছেন?

হ্যাঁ।

আপনার নির্জন তপস্যায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করলাম তাই না?

তপস্যা-টপস্যা কিছু না। মহাপুরুষরা তপস্যা করেন। আমি অতি সাধারণ একজন মানুষ। যাও, গোসল কর কাপড় বদলাও। চা করতে বলেছি। ফুলির মা বাথরুমে পানি তুলে দেবে।

আপনাদের নাকি পাকা ঘাট দেয়া চমৎকার পুকুর আছে। বৃষ্টির মধ্যে সেই পুকুর সাঁতার কাটতে নাকি দারুণ মজা।

কার কাছে শুনলে?

আপার কাছে। আপা বলে দিয়েছে।

ওসমান সাহেব একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। অপলা সুন্দর একটি স্মৃতি মনে করিযে দিয়েছে। বিয়ের পর পর রানুকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন। শ্রাবণ মাসের এক দুপুরে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল সেই বৃষ্টিতে দুজনে পুকুরে নেমেছিলেন। রানু কিছুতেই নামতে চাচ্ছিল না। তিনি প্রায় জোর করে তাকে রাজি করিয়েছিলেন। তার পর সে আর উঠে আসতে চায় না। যত বার তিনি বলে, রানু চল; উঠা যাক। রানু ততবারই বলে, আর একটু, আর একটু।

সুখের উপকরণ চারদিকে ছাড়ানো থাকে। আমরা প্রায় সময়ই তা বুঝতে পারি না! হঠাৎ এক সময় তার দেখা পাই এবং অভিভূত হয়ে পড়ি।

অপলা পুকুরে গোসল করতে যাবে বলে ঠিক করল। ফুলির মা। আপত্তি করবার চেষ্টা করছে। ভর সন্ধ্যায় খোলা চুলে পুকুরে নামা ঠিক না। কিন্তু তার আপত্তি গ্রাহ্য হয়নি। টগরও তার খালামণির সঙ্গে পুকুরে নামবে। সেও নাকি সাঁতার কাটবে।

ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে। ওসমান সাহেব ছাতা মাথায় দিয়ে একটি হারিকেন হাতে পুকুর ঘাটে এসেছেন। জলে নেমেছে টগর এবং অপলা। ফুলি পানিতে পা ডুবিয়ে পুকুর ঘাটে বসে আছে। ওসমান সাহেব বললেন, বেশি দূর যেও না অপলা।

আমাকে নিয়ে ভয় নেই দুলাভাই। আমি চমৎকার সাঁতার জানি। আপনি টগরকে উঠিয়ে নিয়ে চলে যান। ওর ঠাণ্ডা লাগবে।

তুমি না উঠলে ও উঠবে না।

আমি এখানে অনেকক্ষণ থাকব। বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত উঠবে না।

ওসমান সাহেব মৃদু হাসলেন। কিছু বললেন না। বিশেষ ঘটনা কি মানুষের জীবনে বারবার ফিরে আসে? ঠিক অপলার মত গলায়। রানুও তো একদিন এই কথাই বলেছিল। সেদিন তিনি অবশ্যি রানুর পাশে ছিলেন।

আজ ছাতা মাথায় একটি কড়ই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রকৃতি কি একই ঘটনা বিভিন্ন রকমভাবে মানুষের সামনে উপস্থিত করে? এ রকম একটি ঘটনা কি আবার তাঁর জীবনে ঘটবে? অসম্ভব নয়। একদিন হয়ত টগরের ভালবাসার একটি মেয়ে এ রকম বৃষ্টির রাতে পুকুরে নামবে এবং অবিকল রানুর মত গলায় বলবে–বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত আমি উঠব না, তিনি দূর থেকে শুনে ফেলবেন।

ওসমান সাহেব মৃদু স্বরে ডাকলেন, অপলা গ্রামে বসে বসে একটা মজার জিনিস লক্ষ্য করলাম। কি সেটা? গাছের যৌবন বার বার ফিরে আসে। কিন্তু মানুষের যৌবন মাত্র একবার। কথা শেষ হওয়া মাত্র জোর বৃষ্টি শুরু হল। টগর মহানন্দে হাততালি দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *