ত্রিশ
মাধবীলতা অর্ককে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর অনিমেষ চুপচাপ বসেছিল চেয়ারে। এই বিশাল বাড়ির কোথাও কোন শব্দ নেই। এমন কি মাঝে মাঝে যে গোঙানিটা শোনা যাচ্ছিল সেটাও আপাতত স্তব্ধ। অনিমেষের হঠাৎ অস্বস্তি শুরু হল। এত নির্জনতা সহ্য করা যায় না। তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেনে দীর্ঘকাল থেকে নার্ভগুলো যাতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল তাতে এই ব্যতিক্রম সহ্য করা মুশকিল। অনিমেষ চোখ বন্ধ করল।
কোথায় যেন সুর কেটে গেছে। এই বাড়ি তৈরি হবার আগে থেকেই সে এখানে ছিল। শৈশব থেকে যৌবনের শুরু পর্যন্ত যেখানে কাটিয়েছে সেখানে এসে এই কয়েক মুহূর্তেই বুঝতে পারছে একটা বিরাট ফাঁক তৈরি হয়ে গেছে। পিসীমা তার সঙ্গে এমন নির্লিপ্ত ব্যবহার কোনদিন করেনি। পিসীমাকে আবেগহীন অবস্থায় সে কখনও দ্যাখেনি। এতগুলো বছরে পিসীমার চেহারার পরিবর্তন হয়েছে। বার্ধক্য ওঁর সারা শরীরে এমন ছাপ মেরেছে যে সেই পরিচিত চেহারাটাকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু মনেরও এমন পরিবর্তন হবে? এত সংযত, অনিমেষ এল অথচ তাঁর কোন বিকার নেই। যে পিসীমা তাকে অনিবাবা ছাড়া কথা বলতেন না তিনি ওরকম নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে পারলেন! আর ছোটমা! এ কোন ছোটমাকে দেখছে সে? মনে আছে, মহীতোষ যখন দ্বিতীয়বার বিবাহ করেছিলেন তখন তাঁর মধ্যে তো বটেই, ছোটমার মনেও এক ধরনের কুণ্ঠা কাজ করত। অনিমেষের সঙ্গে ব্যবহারেও ছোটমা সেই দুর্বলতা প্রকাশ করতেন। কিসে অনিমেষের ভাল লাগে তার সন্ধানে তৎপর থাকতেন সে সময়। কোনদিন মুখের ওপর কড়া কথা বলেননি। আর আজ এই মহিলাকে কঠোর, বুদ্ধিমতী এবং নিষ্ঠুর স্বভাবের মনে হল। সঙ্গে সঙ্গে আর একটা অপরাধবোধ অনিমেষের মনে মেঘের মত ধেয়ে এল। ছোটমা যখন মাধবীলতাকে আক্রমণ করছিলেন তখন বেচারা একটাও জবাব দেয়নি, কিন্তু সে কি করছিল? তার তো তুমুল প্রতিবাদ করা উচিত ছিল। নাকি এই বাড়িতে পা দেওয়ামাত্রই তারও একটা গোপন পরিবর্তন ঘটে গেছে, আচমকা সে নিজেকে এই বাড়ির মানুষ বলে ভাবতে আরম্ভ করেছে। সবই হয়তো ঠিক কিংবা পুরোটাই বেঠিক তবে সময় যে সম্পর্কের গায়ে অনেক ফুটো তৈরি করে দেয় এটা বোঝা গেল। অনিমেষ হঠাৎ সেই পুরোনো কালের অবেগটাকে বুকের মধ্যে আবিষ্কার করে চোখ বন্ধ করল।
কাছাকাছি কোথাও একটা ‘বউ কথা কও’ এমনভাবে ডেকে উঠল যে অনিমেষ চমকে উঠল। কতদিন বাদে সে পাখির ডাক শুনতে পেল। সে ঘরটার দিকে তাকাল। বোধ হয় তারা আসতে পারে ভেবেই এটাকে ভদ্রস্থ করা হয়েছে। কিন্তু তারা তো নাও আসতে পারত! তাহলে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে এঁরা নিশ্চয়ই আশা ছাড়েননি। এই ঘরে সে আগে কখনও থাকেনি। সে-সময় নতুন বাড়ির এপাশটা ভাড়াটেদের দখলে ছিল। হঠাৎ দাদুর জন্যে অনিমেষের মনে ঢেউ উঠল। এই বাড়ি দাদু যেন রক্ত দিয়ে তৈরি করেছিলেন!
কিন্তু অবাক কাণ্ড, এঁরা কি বাবাকে না জানিয়ে তাকে টেলিগ্রাম করেছিলেন? ছোটকাকার কাছে জানা গিয়েছিল বাবার স্ট্রোক হয়েছে এবং শয্যাশায়ী। একটু আগে যে শব্দ কানে এসেছে তাতে বোঝা যাচ্ছে তিনি কথাও বলতে পারেন না। অথচ সে এতদুর থেকে অনেক দিনের পরে এল কিন্তু ছোটমা মাঝখানে দেওয়াল দিয়ে রাখছেন। স্ট্রোকের রুগী যদি উত্তেজিত হয় তাহলে খারাপ কিছু হতে পারে, অনিমেষ এইভাবে সমস্ত ব্যাপারটাকে মেনে নিতে চাইছিল কিন্তু পারছিল না।
এই সময় অর্ক ফিরে এল। তারপর সুটকেস খুলে একটা পাজামা বের করে পাশের ঘরে যেতে যেতে বলল, ‘ওপাশের বারান্দায় তোমার জন্য জল দিয়েছি।’ তারপর একটু থেমে বলল, ‘দারুণ বাড়ি, না? বোঝা যায় তোমরা এককালে বেশ বড়লোক ছিলে।’
‘কোনকালেই ছিলাম না।’
‘যাঃ। বড়লোক না হলে এত বড় বাড়ি তৈরি করা যায়?’
‘যায়। একটা মানুষ তার সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে এই বাড়ি করে শেষ পর্যন্ত ভিখিরি হয়ে পড়েছিলেন। বাড়িটা করতেই তাঁর তৃপ্তি ছিল।’ অনিমেষ ধীরে ধীরে কথাগুলো বলল।
‘তোমার দাদু, না? ভদ্রলোক খুব বোকা ছিলেন, তাই না?’ পাজামার দড়ি বাঁধতে বাঁধতে ঘর থেকে বেরিয়ে এল অর্ক। আর সঙ্গে সঙ্গে উন্মত্তের মত চেঁচিয়ে উঠল অনিমেষ, ‘চুপ কর! বোকা ছিলেন। যাঁকে চেন না জানো না তাঁর সম্পর্কে এমন কথা বলতে লজ্জা করল না। ননসেন্স!’ অনিমেষের শরীরে আচমকা ক্রোধ জন্মেই ছড়িয়ে পড়ল।
হতভম্ব হয়ে গেল অর্ক, ‘কি আশ্চর্য! তুমি রেগে গেলে কেন?’
‘চমৎকার! একটা সৎ সরল মানুষকে তুই ব্যঙ্গ করবি আর আমি চুপ করে থাকব!’
‘আমি তো ব্যঙ্গ করিনি। তুমি বললে সব টাকা এই বাড়ির পেছনে শেষ করে দিয়েছেন উনি, এত বড় বাড়ি না করে কিছু টাকা রাখতে তো পারতেন। আমি তাই বোকামি বলেছি। আমি ভুল বলেছি?’
‘নিশ্চয়ই!’ অনিমেষের উত্তেজনাটা কমছিল না, ‘যে ব্যাপারটা বুঝিস না সে ব্যাপারে কখনও কথা বলবি না। তাছাড়া দাদুকে নিয়ে এসব কথা আমি শুনতে চাই না।’
অনিমেষ মুখ তুলে দেখল অর্কর ঠোঁটে অদ্ভুত ধরনের হাসি চলকে উঠেই মিলিয়ে গেল। সে বলল, ‘তোমাকে ধরব?’
‘না। আমি একাই যেতে পারব।’ জামাটাকে খুলে রাখল অনিমেষ। এক রাত্রেই গেঞ্জিটা ঘেমো গন্ধ ছাড়ছে। খালি গায়ে বেশ আরাম লাগছিল। ক্রাচ দুটোয় ভর দিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। তারপর অর্কর দিকে তাকিয়ে সোজা বড় ঘরে চলে এল। ঘরের মেঝে এত মোলায়েম যে ক্রাচ ফেলতে হচ্ছে সাবধানে। ভেতরের বারান্দায় চলে আসতে ওর জ্যাঠামশাই-এর কথা মনে পড়ল। ও তখন স্কুলে পড়ে। জ্যাঠামশাই বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলেন অনেকদিন। তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করতে চেয়েছিলেন দাদু। কেউ তাঁর কোন খোঁজ খবর করতে চায়নি। জ্যাঠামশাই-এর ব্যবহারই আত্মীয়স্বজনদের তাঁর সম্পর্কে নিস্পৃহ রেখেছিল। তবু সেই নিরুদ্দিষ্ট অবস্থাতেও জ্যাঠামশাই দাদুকে জ্বালাতেন। অনিমেষ ক্রমশ তাঁর চেহারা ভুলেই যাচ্ছিল। সেই জ্যাঠামশাই একদিন দাদুর অনুপস্থিতিতে এ বাড়িতে ফিরে এলেন। একা নয় পরিবার সমেত। তখন জেঠীমা যে আচরণ করেছিলেন, জ্যাঠামশাই নিজেকে বাড়ির লোক প্রমাণ করার জন্যে যে দুর্বল কথাবার্তা বলছিলেন তা আজ অনিমেষের মনে পড়ল। জ্যাঠামশাইয়ের পুরোনো বউকে সেদিন মেনে নিতে পারেননি হেমলতা। আজ তিনি কিভাবে মাধবীলতাকে মানতে পারেন? জ্যাঠামশাই-এর মত কোন অপরাধ সে করেনি কিন্তু এখন যেন মনে হচ্ছে ভূমিকার খুব বেশী পার্থক্য নেই। নেই তো, জ্যাঠামশাই তাঁর বৃদ্ধ বাবা এবং দিদির জন্যে কিছুই করেননি। তার বিরুদ্ধেও তো যে কেউ ওই এক অভিযোগ করতে পারে।
অর্ক লক্ষ্য করছিল ওই চিৎকারের পর বাবা কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছে। এতটা পথ হেঁটে এল কিন্তু ঠিক নিজের মধ্যে নেই। এমন কি বারান্দায় এসে বাগানের দিকে চেয়ে আছে। সে ডাকল, ‘বাবা, মুখ ধোবে না?’ অনিমেষ ফিরে এল চেতনায়। প্রচণ্ড আফসোস হচ্ছে। কি হল এখানে এসে? এইসব যন্ত্রণার মধ্যে জোর করে তাকে টেনে নিয়ে এল মাধবীলতা। এই বাড়ি এবং ওই মানুষগুলোর প্রতি সে কোন কর্তব্যই তো করতে পারবে না। মগে জল তুলে অর্ক ঢেলে দিচ্ছিল। অনিমেষ এক হাতে মুখ ধুয়ে নিল, গলায় বুকে জল দিল। তারপর গামছা কিংবা তোয়ালের জন্যে অর্কর দিকে তাকাল। অর্কর ততক্ষণে মনে পড়েছে। নতুন তোয়ালেটা সে ওপাশের বাথরুমে রেখে এসেছে। মা যদি এতক্ষণে ঢুকে পড়ে তাহলে ওটা—। সে বলল, ‘দাঁড়াও, দেখছি।’
সেই সময় ছোটমা যে পেছনের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন তা ওরা লক্ষ্য করেনি। অর্ক বারান্দা থেকে নামবার আগেই ছোটমা বললেন, ‘গামছা চাই? এইটে নাও।’ বারান্দার এক কোণে দড়িতে টাঙানো গামছা টেনে নিয়ে তিনি অনিমেষের হাতে দিলেন, ‘তোমার বাবা যেতে বললেন!’
‘বাবাকে বলেছেন?’
‘হ্যাঁ। তুমি এসেছ শুনে অদ্ভুত চোখে তাকালেন। তারপর চুপচাপ হয়ে গেলেন। শুধু বললেন, ‘ওকে ডেকে দাও। আমি বলেছি, হাত মুখ ধুয়ে আসছে।’
‘চলুন, যাচ্ছি।’ অনিমেষ গামছাটা ফিরিয়ে দিয়ে ক্রাচ ঠিক করে নিল।
‘দাঁড়াও। আমি বলিনি তুমি তোমার বউ আর ছেলেকে নিয়ে এসেছ।’
‘বলেননি?’
‘না। তোমার কাকা আমাদের সব ঘটনা বলেছে কিন্তু ও শুধু জানে তুমি বিয়ে করে কলকাতায় আছ। যদি বলার দরকার মনে কর তুমিই বলবে।’
অনিমেষ হাসল। তারপর ছোটমার পাশ কাটিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। চলার সময় ওর শরীরটা ওঠানামা করে ক্রাচের জন্য। অর্কর মনে হল বাবা বেশ শক্ত-মানুষের মত কথা বলছে। এই বাড়িতে এখন যে নাটকটা চলছে সেটাকে ধরতে পেরেছে। বাবাকে কি এখন দাদু খুব গালাগাল করবে? ছোটমাকে তার ভাল লাগছে না। কেমন কাঠ কাঠ কথাবার্তা। তারপরেই খেয়াল হল দাদু তো কথা বলতে পারেন না। ওই যে গোঙানিটা একটু আগে শোনা যাচ্ছিল সেটা তো দাদুর। তাহলে আর গালাগাল করবে কি করে? কৌতুহলী হয়ে সে অনিমেষের অনুসরণ করল।
মাঝখানের ঘরে এসে ছোটমা বললেন, ‘একটু দাঁড়াও, চা খেয়ে যেও।’
‘কেন?’
‘তোমার সঙ্গে আমার কয়েকটা কথা আছে।’
‘সেটা তো পরেও বলা যায়।’
‘যায়। আচ্ছা—।’ ছোটমা এগিয়ে গেলেন পাশের ঘরের দিকে। অনিমেষ একবার নিজের শরীরের দিকে তাকাল। খালি গায়ে অস্বস্তি হচ্ছিল, একটা কিছু পরার কথা চিন্তা করেই বাতিল করল। আজকাল দুই হাত এবং বুক আগের তুলনায় বেশী পেশীযুক্ত হয়ে গেছে, খারাপ লাগে।
ছোটমার পেছন পেছন ডাইনিং রুমে চলে এল অনিমেষ। দাদু খুব শখ করে এই ঘরটা তৈরি করেছিলেন। পাথরের টেবিল আর সিমেন্টের চেয়ার মাঝখানে, বেসিন আর তারের বিরাট জানলা যাতে হাওয়া আসতে পারে খাওয়ার সময়। অনিমেষ দেখল ডাইনিং টেবিলের ওপর নানানরকমের কৌটো বোঝাই করা রয়েছে। বোঝা যাচ্ছে ওটা ব্যবহার করা হয় না।
ডাইনিং রুমের পাশের ঘরের পর্দা সরিয়ে ছোটমা অনিমেষকে ইঙ্গিত করলেন। আর তখনই অনিমেষের শরীরটা কেমন ভারী হয়ে গেল। সে ধীরে ধীরে দরজায় গিয়ে দাঁড়াল । একটা বড় খাটে মহীতোষ শুয়ে আছেন। দরজায় দাঁড়ালে তাঁর মুখ দেখা যায় না কিন্তু শরীরের অনেকটাই চোখে পড়ে। ছোটমা চাপা গলায় বললেন, ‘উত্তেজিত হলে তর্ক করো না।’
অনিমেষ একটু অবাক হল। যে কথা বলতে পারে না সে তর্ক করবে কি করে? ছোটমা দরজা থেকে নড়লেন না। অনিমেষ ক্রাচের শব্দ তুলে ধীরে ধীরে খাটের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই অবাক হয়ে গেল । এ কে? তার বাবা, মহীতোষ? চোখ বন্ধ, মুখময় সাদাকালোয় মেশানো দাড়ি, চোখের তলা ফোলা, খুবই শীর্ণ শরীর কিন্তু পেটটা বেশ উঁচু। চিৎ হয়ে পড়ে আছেন। মাথার পাশে একটা ঘণ্টা, ডান দিকে। এই মানুষটিকে সে চেনে না, তার স্মৃতির সঙ্গে কোন মিল নেই। মহীতোষ একটুও নড়ছেন না, অনিমেষ যে ঘরে এসেছে তাও টের পাননি।
অনিমেষ নিঃশব্দে খাটের পাশে বসল। বসে দরজার দিকে তাকাল। ছোটমা নির্জীব চোখে চেয়ে আছেন সেখানে দাঁড়িয়ে। তাঁর পেছনে ডাইনিং রুমে অর্ক। অনিমেষ আবার তার বাবার দিকে তাকাল। পেটের খানিকটা ওপর থেকে পা অবধি চাদরে ঢাকা দেওয়া আছে। ওর মনে হল মহীতোষ বোধ হয় ঘুমাচ্ছেন। আর তখনি চোখ খুললেন মহীতোষ। একটা পানসে দৃষ্টি সরাসরি অনিমেষের মুখের ওপর পড়ল। প্রথমে কোন প্রতিক্রিয়া হল না, তারপর কপালে ভাঁজ পড়তেই দৃষ্টিটা পাল্টে গেল। মুখ খুলে গেল এবং একটা গোঙানি ছিটকে এল। একদম অস্পষ্ট নয়, অনিমেষের মনে হল মহীতোষ জিজ্ঞাসা করছেন, কে, কে? গোঙানিটা শুনেই বুকের ভেতরটা ধক করে উঠেছিল। অনিমেষ চট করে ডান হাত মহীতোষের পায়ের ওপর রাখল। মহীতোষের দুটো চোখ বিস্ফারিত, মুখ হাঁ হয়ে গিয়েছে। যেন খুব অবাক হয়ে গিয়েছেন তিনি। চোখ ঘুরিয়ে এবার কাউকে খুঁজতে চেষ্টা করলেন। গোঙানিটা আবার শুরু হতে ছোটমা দরজা ছেড়ে ওঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন। অনিমেষ দেখল ছোটমাকে দেখতে পেয়ে মহীতোষ যেন কিছুটা শান্ত হলেন। তারপর ওঁর ডান হাত সামান্য ওপরে উঠে অনিমেষের দিকে নির্দেশ করল। ছোটমার মুখে কোন স্পন্দন নেই, অনুত্তেজ উচ্চারণ, ‘অনিমেষ।’
হাতটা ধীরে ধীরে বিছানায় নেতিয়ে পড়ল। মহীতোষের দুটো চোখের দৃষ্টি স্থির, অনিমেষের মুখের দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকলেন। অনিমেষ আবার কেঁপে উঠল। কোন খুনের আসামী অথবা বিশ্বাসঘাতকের দিকে মানুষ কি এইভাবে তাকায়? একটুও ভালবাসা নেই, আগ্রহ নেই, এমন কি সামান্য করুণাও নেই! মহীতোষের মুখ একটু বেঁকে রয়েছে, বাঁ দিকটা প্রাণহীন কিন্তু চোখ বেশ সজাগ। উনি বাঁ চোখে দেখতে পাচ্ছেন কিনা বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু অনিমেষ ওই চাহনি সহ্য করতে পারছিল না। অথচ এখান থেকে উঠেও যাওয়া যায় না, বসে থাকাও কষ্টকর। আবার গোঙানি শোনা গেল, এবার যেন খুব কষ্ট করে গোঙানি থেকে শব্দগুলো আলাদা করতে পারলেন মহীতোষ, ‘তুমি এলে!’
ছোটমা মুখ ফিরিয়ে নিলেন। নিয়ে ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। অনিমেষ শেষ পর্যন্ত কথা বলতে পারল, ‘কেমন আছ, বাবা?’
আর তখনি মহীতোষের দু’ চোখের কোণে জলবিন্দু জেগে উঠল, উঠে বিস্ফারিত হওয়ায় গড়িয়ে পড়ল দুই গাল বেয়ে। অনিমেষ অসহায় চোখে কান্নাটাকে দেখল। এবং সে আবিষ্কার করল তার গলায় কোন শব্দ আসছে না, শরীর কাঁপিয়ে একটা কান্না বুকের মধ্যে পাক খাচ্ছে। এবং সেই মুহূর্তে সে জানলায় অর্ককে দেখতে পেল। দেখে প্রাণপণে আবেগটাকে প্রশমিত করার চেষ্টা করল। তারপর অন্য রকম গলায় বলল, ‘বাবা!’
মহীতোষ চোখ বন্ধ করলেন। জমে থাকা জল উপচে এল গালে। এইভাবে চোখের জল দেখতে পারা যায় না। অনিমেষের ইচ্ছে করছিল কাছে গিয়ে সেটা মুছিয়ে দেয়। কিন্তু খাটের এক পাশ থেকে উঠে অন্য পাশে যেতে তাকে যে পরিশ্রম করতে হবে সেটা ইচ্ছে নষ্ট হয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
মহীতোষ চোখ খুললেন, তারপর জড়ানো খুবই অস্পষ্ট গলায় কিছু বললেন। অনিমেষ এবার তার একবিন্দুও বুঝতে পারল না। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি বলছেন?’
মহীতোষ আবার উচ্চারণ করলেন কিন্তু এবার সেটা গোঙানি হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত তাঁর ডান হাত উঠল, উঠে অনিমেষের ক্রাচদুটো দেখাল।
অনিমেষ এবার মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ, আমি হাঁটতে পারি না।’
সেটা শোনামাত্র মহীতোষ অদ্ভুত ম্লান হাসলেন। তাঁর শরীর সামান্য কাঁপল। তিনি আবার কথা বলতে চেষ্টা করলেন। অনিমেষ কিছুই বুঝতে পারছিল না। মহীতোষও সেটা ধরতে পেরেছিলেন। তিনি হঠাৎ জোরে চিৎকার শুরু করে দিলেন। এই গোঙানিটাই অনিমেষরা ওপাশের ঘরে বসে প্রথম শুনতে পেয়েছিল। শব্দ করছেন আর মুখ ফিরিয়ে দরজার দিকে তাকাবার চেষ্টা করছেন। অনিমেষ ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে তড়িঘড়ি বলে উঠল, ‘আপনি শান্ত হন, ওরকম করবেন না। আপনার শরীর খারাপ হবে।’
এই গোঙানি অর্ককে দরজা থেকে ঘরের মধ্যে টেনে এনেছিল। সে অবাক হয়ে বৃদ্ধকে দেখছিল। আর একবার মুখ ফেরাতেই মহীতোষ অর্ককে দেখতে পেলেন। আচমকা তাঁর চিৎকার থেমে গেল। হতভম্বের মত তিনি অর্ককে দেখতে লাগলেন। অনিমেষ লক্ষ্য করল মহীতোষের শরীর স্থির হয়ে গিয়েছে। তাঁর চোখ অর্কর মুখের ওপর স্থির, একবার ফিরে এল অনিমেষের ওপর। অনিমেষ বলল, ‘আমার ছেলে।’
এইসময় ছোটমা হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলেন, ‘কি হয়েছে?’ খুব উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল তাঁকে। ঘরে ঢুকে অর্ককে দেখে তাঁর মুখ গম্ভীর হল।
ছোটমার উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্র মহীতোষ যেন পাল্টে গেলেন। আবার গোঙানির স্বরে কি একটা বলতে বলতে ডান হাত ছোটমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। ছোটমা সামান্য বিরক্ত-গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ, তাতে কি হয়েছে? তুমি তো জানো ওর ওপর পুলিস অত্যাচার করেছিল, সেই থেকে হাঁটতে পারে না। আর এ হল অনির ছেলে।’
অর্ক দেখল বৃদ্ধ তার দিকে আবার তাকাচ্ছেন। ওই গোঙানি কিংবা জড়ানো স্বরের অর্থ তারা বুঝতে পারেনি কিন্তু ছোটমার কাছে তা অস্পষ্ট নয়। সে কি প্রণাম করবে? শায়িত মানুষকে প্রণাম করা ঠিক হবে? মহীতোষ আবার কিছু বললেন। ছোটমা ঘাড় ঘুরিয়ে সেটার তর্জমা করে দিলেন, ‘তোমাকে কাছে ডাকছেন।’
অর্ক এগিয়ে গেল। মহীতোষের ডান পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি হাতের ইশারায় বসতে বললেন খাটের ওপর। অর্ক অনিমেষের দিকে একবার তাকিয়ে আলতো ভঙ্গীতে বিছানায় বসল । মহীতোষ আবার শব্দ করতেই ছোটমা বললেন, ‘তোমার নাম জিজ্ঞাসা করছেন।’
‘অর্ক।’
মহীতোষের চোখ ছোট হল, তিনি ছোটমার দিকে তাকালেন।
ছোটমা বললেন, ‘ও বলছে ওর নাম অর্ক।’
মহীতোষের ঠোঁটে এবার হাসি ফুটল। তাঁর ডান হাত এবার অর্কর হাতের ওপর উঠে এল। শীতল হাত। মহীতোষ আবার কিছু বলতে চাইলেন কিন্তু একমাত্র ‘গরীব’ শব্দটি ছাড়া ওরা অন্য কিছু বুঝতে পারল না।
অনিমেষ এবার ছোটমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওঁর চিকিৎসা ঠিক মত হচ্ছে?’
‘যেটুকু সম্ভব। ওষুধে আর কি হবে! পরে এসব কথা বলা যাবে।’ ছোটমা যেন প্রসঙ্গটা এই সময়ে আর বাড়াতে চাইছিলেন না।
ঠিক তখন হেমলতার গলা পাওয়া গেল। চিৎকার করে ছোটমাকে ডাকছেন। ছোটমা বললেন, ‘দেখা তো হয়ে গেল। এবার চল, বোধ হয় দিদি তোমাদের খেতে ডাকছেন।’
অনিমেষ বলল, ‘এদিকের বাথরুমটা ব্যবহার করা হয়?’
‘হ্যাঁ।’
খাট থেকে নেমে এল অনিমেষ। বগলে ক্রাচ দুটো গুঁজে হাঁটতে গিয়ে তার চোখ আবার মহীতোষের ওপর পড়ল। মহীতোষের চোখে সেই ছবিটা আবার ফিরে এসেছে। অনিমেষ মাথা নিচু করে বাইরে বেরিয়ে এল। ওপাশের বাথরুমে পৌঁছাতে কয়েকটা পা-মাত্র কিন্তু সেটাকেই দীর্ঘ মনে হচ্ছিল। ভেতরে ঢুকে অনিমেষ কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে রইল। এমন করে নিজেকে তার কখনও অপদার্থ মনে হয়নি। মহীতোষের দৃষ্টিটা যেন তার সমস্ত সত্তাকে ফালা ফালা করে দিয়েছে। কি করলে অনিমেষ? এতদিন ধরে তুমি কি করলে?
ছোটমা অর্ককে ডাকলেন, ‘চল।’
মহীতোষ মাথা ঘুরিয়ে স্ত্রীকে দেখে আবার কিছু বলতে চাইলেন, অর্ক তার কিছুই বুঝতে পারল না। একটু বিব্রতভঙ্গীতে ছোটমা বললেন, ‘এসেছে। দিদির কাছে আছে। একটু বাদেই আসবে, চা খেয়ে নিক।’
অর্ক এবার বুঝল। এই বৃদ্ধটিকে তার খারাপ লাগছিল না। শুধু কথা বুঝতে পারা যায় না, এই যা। বাবার বাবা। কতকাল পরে দুজনের দেখা হয়েছে কিন্তু উনি কোন কথাই বলতে পারলেন না। সে ছোটমার সঙ্গে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। হাঁটতে হাঁটতে ছোটমা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোন ক্লাশে পড় তুমি?’
অর্ক উত্তর দিতেই ফের প্রশ্ন, ‘কত বয়স তোমার?’
এবার জবাবটা শুনে ছোটমা বিস্মিত চোখে তাকালেন কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। অর্কর মনে হল ভদ্রমহিলা তাদের ঠিক মেনে নিতে পারছেন না। বারান্দার দিকে যেতে যেতে ছোটমা বললেন, ‘দ্যাখো তো, তোমার মা হাত মুখ ধুয়ে এসেছে কিনা! এলে রান্নাঘরে আসতে বলো।’
অর্ক ওদের জন্যে নির্দিষ্ট ঘরটিতে এসে দেখল কেউ নেই। বাড়িটা কেমন খাঁ খাঁ করছে। সে আবার বেরিয়ে এল। ভেতরের বারান্দায় পা দিয়ে দেখল ছোটমা রান্নার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বলছেন, ‘এ কি, এখনও বাথরুমে যাওনি?’
হেমলতার গলা পাওয়া গেল, ‘ওমা তাই তো, কথা বলতে বলতে খেয়ালই নেই। আমার আবার কথা বলতে আরম্ভ করলে হুঁশ থাকে না। এই জন্যে বাবা আমাকে কম কথা শোনাতো? চিরকাল তো এই বাড়িতে দাসীবৃত্তি করে গেলাম, যে পারে সেই কথা শোনায়। যাও যাও, বাথরুম থেকে ঘুরে এস।’
অর্ক দেখল মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে ওপাশের বাথরুমের দিকে চলে গেল। এইবার ছোটমার চাপা গলা কানে এল অর্কর, ‘আপনার স্বভাব গেল না।’
‘কেন? আমি আবার কি করলাম!’
‘চেনা নেই শোনা নেই যে আসছে তার কাছেই এমন সব কথা বলেন! আচ্ছা, আপনাকে কি এ বাড়ির দাসী করে রাখা হয়েছে? আপনি বলতে পারলেন?’
‘দাসী ছাড়া আর কি! মেয়েছেলে হয়ে জন্মানো মানেই তো দাসীবৃত্তি করা। হয় বাপের নয় ছেলের, স্বামী বা ভায়ের। কিন্তু এই মেয়েটা মনে হয় বেশ ভাল, অনির খুব পছন্দ আছে।’ হেমলতা স্বচ্ছন্দে বললেন।
‘এটুকু সময়ের মধ্যে বুঝে গেলেন মেয়েটা ভাল!’
‘তা ঠিক। মানুষের মনের মধ্যে কি আছে তা ওপর থেকে কি করে বুঝব! মুখ দেখে তো তাই মনে হল। তবে ওদের অবস্থাও ভাল না।’
‘কি করে বুঝলেন?’
‘গায়ে এক ফোঁটা সোনা নেই। নতুন বউ বাড়ি এল গয়না ছাড়া।’
‘নতুন বউ আবার কোথায়? অত বড় ছেলে যার।’
‘ওঃ, ছেলেটা কিন্তু অবিকল অনির মত হয়েছে। আমি তো প্রথমবার দেখে চমকে উঠেছিলাম। সেই স্কুল-পাশ করা অনি যেন এসে দাঁড়িয়েছে। আর আমাদের অনিকে কিন্তু আমি চিনতেই পারিনি। মনেই হয় না সেই অনি। আজ বাবা বেঁচে থাকলে—।’
‘আবার কাঁদতে শুরু করলেন?’
‘আর কি করব! এখন তো শুধু এই কান্নাটুকুই আছে!’
‘আপনি সরুন, আমি ভেজে দিচ্ছি।’
এইভাবে কথা শোনা উচিত নয়। অর্ক সরে আসতে গিয়ে দেখল হেমলতা রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন। অর্ক ইচ্ছে করেই বারান্দা থেকে বাগানে নামল। সে যেন কিছুই শুনতে পায়নি।
হেমলতা তাকে দেখে এগিয়ে এলেন, ‘দাদুর সঙ্গে দেখা হয়েছে?’
মাথা নাড়ল অর্ক। হ্যাঁ।
‘কথা বলতে পারে না। এক পাশ পড়ে গিয়েছে। যা বলে তা ওই ছোট বুঝতে পারে ভাল, আমিও সব পারি না। ছোট বউ কে বুঝতে পারছ? তোমার ছোটদিদিমা। বড়দিদিমা অনেক বছর আগেই স্বর্গে গিয়েছে, তার নাম ছিল মাধুরী। তোমার বাবা কোথায়?’
‘ভেতরে।’
‘তুমি তো বাবার দাদুকে দ্যাখোনি, এই বাড়ি উনি করেছেন। খুব রাগী লোক ছিলেন। তবে তোমার বাবাকে খুব ভালবাসতেন।’ হেমলতা হাসলেন।
এই সময় মাধবীলতা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল ভেজা জামাকাপড় নিয়ে। হেমলতা তাই দেখে বললেন, ‘এইখানে মেলে দে, এই তারে।’
অর্ক একটু অবাক হল। এর মধ্যেই মাকে ইনি তুই বলছেন? ওর খুব ভাল লাগল বৃদ্ধাকে। সে কি বলে ডাকবে? ঠাকুমা!
মাধবীলতা ঘোমটা বাঁচিয়ে কাপড় মেলে দিল। অর্ক দেখছিল, মাকে আজ একদম অন্যরকম দেখাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে হেমলতা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হ্যাঁরে, তোর এত বড় ছেলে কবে হল? কত বয়স ওর?’
মাধবীলতা আড়চোখে ছেলেকে দেখে বলল, ‘পনের পার হয়ে গেল।’
‘ও বাবা! এত বড়!’
এই সময় ছোটমা বেরিয়ে এলেন, ‘অর্ক, তোমার বাবাকে ডেকে নিয়ে এসো। জলখাবার খাবে।’
হেমলতা বললেন, ‘খোঁড়া মানুষ এখানে আসতে পারবে কি! ওরটা ঘরেই পাঠিয়ে দিলে হয়। যাও, বাবাকে বল, খাওয়ার ঘরে গিয়ে বসতে।’
অর্ক চলে গেলে মাধবীলতা বলল, ‘আমাকে দিন আমি নিয়ে যাচ্ছি।’ ছোটমা অর্কর চলে যাওয়া দেখছিলেন, ‘পনের ষোল বছর বলে একদম মনে হয় না। ওর জন্মসাল কবে?’
মাধবীলতা উত্তর দিল। তাতে পনের যে পেরিয়ে গেছে তা বোঝা গেল।
‘তখন তো অনি এম এ পড়ত। কি বলছ তুমি?’
‘না। তখন পড়া ছেড়ে দিয়েছিলো। আমার এম এ পরীক্ষা হয়ে গিয়েছিল।’ মাধবীলতার খুব সঙ্কোচ হচ্ছিল, সে জুড়ে দিল, ‘আমি তখন চাকরি করি, ও জেলে ছিল।’
হেমলতা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘জেলে থাকলে বিয়ে হল কখন?’
‘জেলে যাওয়ার আগে।’
‘তোমার বাবা বিয়ে দেননি নিশ্চয়ই।’ ছোটমা প্রশ্ন করলেন।
‘না।’
‘তোমরা নিজেরাই বিয়ে করেছিলে?’
মাধবীলতা মাথা নিচু করল।
‘সই করে বিয়ে করেছিলে তাহলে?’ ছোটমার গলায় কি সন্দেহ।
মাধবীলতা ক্রমশ জড় হয়ে পড়ছিল। কোন রকমে বলল, ‘না।’
‘তাহলে?’ ছোটমার গলার স্বর সিরসিরে।
এইবার হেমলতা চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ও বুঝেছি। কালীঘাটের বিয়ে। বাবার কাছে শুনেছি কালীঘাটে গেলে পুরুতরা ঠাকুরের সামনে বিয়ে দিয়ে দেয়।’
‘ওই বিয়ে তো আইনসিদ্ধ নয়।’ ছোটমার গলা এবার শক্ত।
‘তাই নাকি?’ হেমলতা যেন অবাক হয়ে গেলেন! ‘তাহলে কি হবে?’
ছোটমা বললেন, ‘ভেবে কি করবেন? কপালে যা লেখা আছে তাই মানতে হবে। আপনি কি কখনও ভাবতে পেরেছিলেন অনি খোঁড়া হবে?’ কথাটা শেষ করে রান্নার ঘরে ঢুকে গেলেন ছোটমা। মাধবীলতা পাথরের মত দাঁড়িয়েছিল। এই সময় দু হাতে দুটো থালায় খাবার নিয়ে ছোট মা বেরিয়ে আসতেই মাধবীলতার চেতনা ফিরল। সে এগিয়ে এল থালা দুটো নেওয়ার জন্যে। কিন্তু ছোটমা তার দিকে লক্ষ্য না করে সোজা বারান্দায় উঠে ঘরের দিকে এগোতে থাকলেন। মাধবীলতা থমকে গেল। ওর মনে হল ছোটমা যেন ইচ্ছে করেই খাবারের থালা তার হাতে দিলেন না।
খাওয়ার টেবিল থেকে জিনিসপত্র নামিয়ে অর্ক একা বসেছিল। ছোটমা সেখানে থালা দুটো রেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার বাবা কোথায়?’
‘ঘরে।’ অর্ক লুচিগুলোর দিকে তাকাল।
ছোটমা আবার বড় ঘরটা পেরিয়ে অনিমেষদের জন্যে নির্দিষ্ট ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন। অনিমেষ চুল আঁচড়াচ্ছিল। ছোটমা বললেন, ‘খাবার দিয়েছি।’
‘যাচ্ছি।’ অনিমেষ চিরুনি রাখল।
‘একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি, তোমাদের কি কালীঘাটে বিয়ে হয়েছিল?’
অনিমেষ অবাক হয়ে তাকাল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, ‘না তো!’