৩য় সর্গ

তৃতীয় সর্গ

এ্যাপোকনিগম একদিন স্বর্গলোকে উচ্চকণ্ঠে সতর্ককরে মর্তমানবদের, শয়তানরূপী ড্রাগন তাদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করতে আসবে। কিন্তু হায়, ব্যর্থ হলো সে কণ্ঠস্বর।

ধিক মর্ত্যলোকের অধিবাসীদের। একবার মানবজাতির আদি পিতা-মাতাকে সতর্ক করে দেওয়া হয় এক গোপন শত্রুর আগমন সম্পর্কে। তখন সেই শত্রুর মারাত্মক ফাঁদ এড়িয়ে পালিয়ে যান তারা।

এখন সেই শয়তান ঈশ্বরের অনুগৃহীত মানবজাতির উপর ক্রোধে প্রজ্জ্বলিত চিত্ত হয়ে মানবকুলের আদি পিতা-মাতাকে প্রলোভিত ও স্বর্গচ্যুত করার জন্য এল নরক, থেকে স্বর্গলোকে। এইভাবে ঈশ্বর ও দেবতাদের সঙ্গে প্রথম যুদ্ধে যে হীন পরাজয় স্বীকার করে স্বর্গচ্যুত হয়ে দুর নরকপ্রদেশে গিয়ে তাদের আশ্রয় নিতে হয়, দুর্বলচিত্ত মানুষের উপর সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে চায় শয়তানরাজ।

কিন্তু কৌশলে সে স্বর্গারোহণের ও মানবকুলের আদি পিতা-মাতার সন্ধানলাভে সমর্থ হলেও তার এই কঠিন প্রচেষ্টায় কোন আনন্দের উল্লাস ছিল না, ছিল না কোন গর্বোদ্ধত ভাব। তার বিক্ষুব্ধ বুকের মধ্যে যেন এক জ্বলন্ত এঞ্জিন তার অগ্রপ্রসারী চিত্তকে পিছন থেকে টানছিল। সে স্বভাবত নির্ভীক হলেও এক অজানা শঙ্কা আর সংশয় তার বিপন্ন বিব্রত চিন্তাকে নিপীড়িত করছিল। নরক থেকে স্বর্গে আরোহণ করলেও কোন উত্তরণ ঘটেনি তার চিত্তে। তার অন্তরের অন্তঃস্থলে সে যেন নরকপ্রদেশের কুটিল অন্ধকাররাশিকেই বহন করে এনেছিল। তাই স্বর্গের শান্ত সুন্দর পরিবেশেও এক অশান্ত কু-অভিসন্ধিরূপ নরকাগ্নি জ্বলছিল তার অন্তরে।

সহসা বিবেক তার লুপ্ত সংশয় ও হতাশাকে জাগ্রত করে তুলল। সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতির পীড়ন শুধু হলো তার মনে। সে অতীতে কি ছিল, এখন কি হয়েছে এবং তার এই চেষ্টিত কার্যের যে কুফল হতে পারে, এই সব বিষয় চিন্তিত করে তুলল তাকে। কখনো আনন্দোজ্জ্বল মনোরম স্বর্গোদ্যানের পানে, কখনো ঊর্ধ্বে বিরাজিত স্বর্গলোকের পানে, কখনো মধ্য আকাশে দেদীপ্যমান ও পর্যাপ্ত কিরণমালায় অতিভাস্বর সূর্যের পানে সে তার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।

তারপর সে এক গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আপন মনে বলতে লাগল, যে সূর্য, যে তুমি সর্বোচ্চ গৌরবের মুকুটে ভূষিত হয়ে এই নূতন জগতের দেবতারূপে স্বরাজ্যে অধিষ্ঠিত হয়ে আছ এবং যে তোমার চক্ষু হতে বিচ্ছুরিত প্রোজ্জ্বল দৃষ্টিদ্যুতির সামনে নক্ষত্রেরাও লজ্জায় মাথা নত করে, সেই তোমাকে বন্ধুভাবে সম্বোধন করতে পারলাম না।

হে সূর্য, তোমার সে আলোকমালা আমার অতীতকে স্মৃতিপথে জাগ্রত করে তুলছে। সেই আলোকমালাকে আমি কত ঘৃণা করি। অতীতে একদিন আমি কি গৌরবময় আসনেই না অধিষ্ঠিত ছিলাম এবং অহঙ্কার ও ভ্রান্ত উচ্চাভিলাষের বশবর্তী হয়ে আমি স্বর্গরাজ্যের অতুলনীয় অধীশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হয়ে সেই গৌরবের আসন হতে বিচ্যুত হয়ে সুদুর নরকপ্রদেশে কিভাবে নিক্ষিপ্ত হই–আজ এই সব কথা মনে পড়ছে আমার। সেই স্মৃতির জ্বালাময়ী পীড়নে অনুক্ষণ আপীড়িত হচ্ছি আমি।

আমার পক্ষ থেকে এই ধরনের প্রতিদানে কোনরূপে যোগ্য ছিলেন না তিনি। তিনিই আমাকে সৃষ্টি করে খ্যাতির সুউচ্চ সু-উজ্জ্বল শিখরদেশে প্রতিষ্ঠিত করেন আমাকে। তিনি আসলে কোন ভর্ৎসনা বা কোনরূপ দুর্ব্যবহার করেননি আমার সঙ্গে। তার শাসন এমন কিছু কঠোর বা দুঃসহ ছিল না কারো পক্ষে, বরং তা প্রশংসা ও ধন্যবাদেরই যোগ্য ছিল সর্বাংশে।

কিন্তু হায়, তার সকল মঙ্গলময় কার্য মন্দ মনে হয় আমার এবং আমার মধ্যে জাগায় শুধু হিংসা আর বিদ্বেষ। বস্তুত তিনি আমাকে এত উচ্চে স্থান দেন যে . আমি তার প্রতি কোন বশ্যতা বা আনুগত্যকে ঘৃণার চোখে দেখতে থাকি। ভাবি আর এক ধাপ উপরে উঠলেই আমি সম্মান ও গৌরবের উচ্চতম স্তরে উন্নীত হব। এইভাবে তার প্রতি আমার অন্তহীন কৃতজ্ঞতার প্রভূত ঋণের কথা ভুলে যাই আমি। সে কৃতজ্ঞতার ঋণ দুঃসহ বোঝাভার বলে মনে হয়। কিন্তু ভুলে যাই কৃতজ্ঞতার ঋণ এমনই এক ঋণ যে সে ঋণের স্বীকৃতি উপকারীর সব উপকারের ঋণ পরিশোধ করে দেয়। কিন্তু আমি তখন সে ঋণ স্বীকার না করে সম্পূর্ণরূপে ভুলে গিয়েছিলাম, তার কাছে আমি কত কি পেয়েছি। তার কাছে কত দিক দিয়ে উপকৃত আমি।

হায়! তখন তার অমোঘ বিধানে যদি আমি কোন হীনতর দেবদূত হয়ে জন্মাতাম, তাহলে আমি হয়ত সুখে স্বর্গসুখ ভোগ করতাম আজও। তাহলে অসংযত উদ্দাম আমার ছলনা এমন ভ্রান্ত উচ্চাভিলাষের সৃষ্টি করত না।

আবার এমনও হতে পারে, ঈশ্বর ছাড়া কোন বৃহৎ শক্তি আমি ক্ষুদ্র হলেও আমাকে আকর্ষণ করে উচ্চাকাঙ্ক্ষার ছলনাজাল বিস্তার করে টেনে নিয়ে যায় আমাকে অনিবার্য বেগে। কিন্তু আমার মধ্যেও যদি স্বাধীন ইচ্ছা ও অনুরূপ শক্তি থাকত আমার অন্তরে ও বাইরে তাহলে আমি তার সকল প্রলোভনকে প্রতিহত করতে পারতাম, ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারতাম তার সকল ছলনাজালকে।

তাহলে কাকে আমি দোষ দেব? কাকে অভিযুক্ত করব আমার এই অবস্থার জন্য? ঈশ্বরের সংস্কারযুক্ত ভালবাসা সকলের উপরেই সমানভাবে পতিত হয়েছিল। কিন্তু আমার কাছে অভিশপ্ত ও ঘৃণার বস্তু হয়ে উঠেছিল সে ভালবাসা।

কিন্তু আমি ঠিক অভিশপ্ত নই। কারণ তখন আমার মধ্যে ছিল স্বাধীন ইচ্ছা। সেই স্বাধীন ইচ্ছার বলেই আমি স্বাধীনভাবে এমন পথ বেছে নিই যার জন্য আজ আক্ষেপ ও অনুশোচনা করতে হচ্ছে আমায়। আমি এখন কোন পথে যাব? অন্তহীন ক্রোধ ও প্রতিহিংসার পথে, না অন্তহীন হতাশার পথে? সত্যিই আমি বড়ই হতভাগ্য। আমি এখন যে পথে চলেছি তা অন্তহীন নরকের পথ। আমিই এক জীবন্ত নরক।

বর্তমানে নরকের যে গভীরতম প্রদেশে যন্ত্রণাদায়ক জীবন যাপন করি তার থেকেও গভীর এক গহুর তার ভয়ঙ্কর মুখব্যাদান করে গ্রাস করতে আসে আমায়। তার তুলনায় বর্তমানে নরক স্বর্গ বলতে হবে।

হে আমার অন্তরাত্মা, অবশেষে এতদিনে তুমি তোমার ভুল বুঝতে পেরেছ। কিন্তু এখন অনুতাপের মাধ্যমে কি কোন উপায় নেই আমার পাপস্খলনের? কোন ক্ষমা বা মার্জনা নেই আমার জন্য? উন্মুক্ত আছে শুধু আত্মসমর্পণের পথ? আত্মসমর্পণ ছাড়া কি অন্য কোন পথ নেই?

অথচ এই আত্মসমর্পণেই আমার যত কিছু আপত্তি। এই শব্দটাই আমার কাছে এক চরমতম ঘৃণার বস্তু। এই আত্মসমর্পণের কথাটা নরকে আমার অধীনস্থ প্রজাদের কাছে আমাকে এক অনপনেয় লজ্জা আর অপমানের পাত্র করে তুলবে।

আমি শুধু তাদের যত সব আপাত উজ্জ্বল প্রতিশ্রুতি দিয়ে বশীভূত করে রেখেছি, কিন্তু তাদের আত্মসমর্পণ করতে শেখাইনি। আমি যেন মিথ্যা আত্ম-অহঙ্কারের দ্বারা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকেও আমার বশীভূত করতে পারব এমনি একটা ভাব দেখিয়েছি তাদের।

হায়, তারা জানে না কত ব্যর্থ আমার সেই অহংকার। জানে না, সে অহঙ্কারের জন্য কতখানি মূল্য আমায় দিতে হয়েছে। কি ভীষণ আত্মদহনে দগ্ধ হচ্ছে আমার অন্তর। যতই তারা আমাকে নরকের রত্নখচিত সিংহাসনে বসিয়ে হাতে শাসনদণ্ড তুলে দিয়ে সম্মানের সুউচ্চ স্তরে তুলে দেয় ততই আমি নীচে তলিয়ে যাই। আমি শুধু দুঃখেই মহান, অতৃপ্ত অপূর্ণ উচ্চাভিলাষেই আমার যা কিছু আনন্দ।

যদি আমি আমার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আত্মসমর্পণ করি তাহলে কি পূর্বের সেই গৌরবময় অবস্থা ফিরে পাব? তার সেই উন্নত অবস্থায় পুনরধিষ্ঠিত হওয়ার পর আমি যদি আমার আত্মসমর্পণ প্রত্যাহার করে নিই? অবস্থার দ্বারা প্রপীড়িত হয়ে বাধ্য হয়ে কপট আত্মসমর্পণকালে যে শপথ করব পরে তা যদি তুলে নিই? ঘৃণার ক্ষত যেখানে অন্তরের গভীরে অনুপ্রবিষ্ট হয় সেখানে কোন প্রকৃত পুনর্মিলন সম্ভব হতে পারে না।

এই পুনর্মিলন সম্ভব নয় বলেই আমার পরিণাম আরও খারাপ হতে বাধ্য। আমার পতন হয়ে উঠবে আরও শোচনীয়। শুধু তার আগে আমি একটু বেশি মূল্য দিয়ে একটুখানি বিরাম নিতে চাই, যদিও এই বিরাম বা শান্তি নিতান্ত সাময়িক।

আমার শাস্তিদাতা সর্বশক্তিমান ঈশ্বর তা জানেন। আমি পূর্ণ শান্তি বা পুনর্মিলন প্রার্থনা করিনি তার কাছে আর তিনিও তা দান করতে চাননি আমাকে।

এখন আর কোন আশা নেই। কারণ তিনি আমাদের বিতাড়িত করে আমাদের পরিবর্তে তাঁর নূতন আনন্দের মানবজাতিকে সৃষ্টি করে একটি জগৎ তাদের দান করেছেন।

সুতরাং হে আশা বিদায়, আশার সঙ্গে সঙ্গে সব শঙ্কা ও অনুশোচনাকেও বিদায়। আমার জীবনে মঙ্গলের আর কোন সম্ভাবনা নেই। হে অশুভ, তুমি আমার পক্ষে শুভ হও। তোমার সেই অশুভ শক্তির বলেই আমি স্বর্গের সুবিশাল সাম্রাজ্যের অর্ধাংশ জয় করে তাতে রাজত্ব করতে পারি।

শয়তানরাজ যখন আপন মনে কথাগুলি বলে যাচ্ছিল তখন প্রতি মুহূর্তে ক্রোধ, প্রতিহিংসা, হতাশা প্রভৃতি আবেগানুভূতির প্রভাবে বিবর্ণ ও ম্লান হয়ে উঠছিল।

তার মুখমণ্ডল স্নান করে দিচ্ছিল তার দেবদূতের ছদ্মরূপ। এই অবস্থায় তাকে যদি কোন স্বর্গীয় দেবদূত নিরীক্ষণ করত তাহলে তার মুখ দেখে তার শয়তানসুলভ কু-অভিসন্ধির কথা বুঝতে পারত।

এটা সে নিজেও বুঝতে পারল। তাই সে তার বহিরঙ্গের এক কৃত্রিম শান্তির আবরণে তার অন্তরের তুমুল আলোড়ন আর গভীর প্রতিহিংসাকে ঢেকে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করে যেতে লাগল। কারণ প্রতিশোধ বাসনাকে চরিতার্থ করার জন্য সে ছিল দৃঢ়সংকল্প। শয়তান হয়ে সাধুর ছদ্মবেশে ছলনার এই মিথ্যাচারণ তার জীবনে এই প্রথম।

কিন্তু শত চেষ্টা করেও ইউরিয়েলের চোখকে সে ফাঁকি দিতে পারল না। যে পথে সে এসেছিল ইউরিয়েলের সন্ধানী দৃষ্টি সে পথে তাকে সর্বক্ষণ অনুসরণ করে। তারপর এমিরিয়ার পর্বতে ইউরিয়েল তার বিকৃত মূর্তিটি দেখতে পেয়ে যায়। সে মূর্তিটি এক সুখী দেবদূতের মূর্তি নয়। তার উন্মাদের মত ভয়ঙ্কর হাবভাব লক্ষ্য করেছিল ইউরিয়েল।

কিন্তু শয়তান ভাবছিল, সে সম্পূর্ণ একা একা সকলের অলক্ষ্যে চলেছে তার গন্তব্যস্থল অভিমুখে। অবশেষে সে স্বর্গোদ্যান ইডেনের প্রান্তে এসে উপনীত হলো। এখান থেকে স্বর্গলোক অতি নিকটে। খাড়াই পাহাড়ের মত মাথা উঁচু করে উঠে যাওয়া স্বর্গলোক ছিল ঘন সবুজ বনে সমাচ্ছন্ন। তাতে প্রবেশ করার কোন পথ নেই। পাইন, দেবদারু, ফার প্রভৃতি বড় বড় গাছের ছায়ায় আচ্ছন্ন সেই বিশাল বনপ্রদেশের উপর থেকে স্বর্গের সুউচ্চ প্রাচীর উঠে গেছে। সে প্রাচীরের রং এনামেলের মত ধূসর। তার উপর সূর্যের কিরণ ছড়িয়ে পড়ায় অপূর্ব হয়ে উঠেছিল সে বনপ্রকৃতির দৃশ্য।

শয়তানরাজ যতই এগিয়ে চলেছিল সেদিকে ততই নির্মল বাতাস যেন তাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য ছুটে আসছিল তার দিকে। তার মন থেকে একমাত্র হতাশা ছাড়া সব বিপদ দূর করে বসন্তের আনন্দ জাগাচ্ছিল সে মনে। সন্ধ্যার মেঘমালায় মণ্ডিত আকাশে রামধনু দেখা গেলে পৃথিবীতে যে শোভা হয় সে শোভার থেকে সুন্দরতর হয়ে উঠেছিল সেই সবুজ বনপ্রকৃতির দৃশ্য। ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসা বাতাসের পাখনায় ছিল অসংখ্য বনফুলের গন্ধ। সে গন্ধে মাতোয়ারা বাতাসেরা যেন ফিসফিস করে কথা বলছিল নিজেদের মধ্যে।

উত্তমাশা অন্তরীপ ও মোজাম্বিকের ওপারে দক্ষিণ-পশ্চিম আরবের উপকূল থেকে ছুটে আসা গন্ধবহ উত্তর-পূর্ব সমুদ্রবায়ু যেমন সমুদ্রনাবিকদের অভ্যর্থনা জানায়, তেমনি শয়তানরাজকেও যেন অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল স্বর্গোদ্যান থেকে প্রবাহিত সুবাসিত বাতাস। এ্যাসমোদিয়াস নামে এক অশুভ প্রেতাত্মা তোবিতের পুত্রের স্ত্রীর প্রতি মোহাসক্ত হয়ে পড়লে মাছপোড়ার যে গন্ধ দিয়ে তাকে মিডিয়া থেকে মিশরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, স্বর্গোদ্যানের বাতাস সে গন্ধের মত উৎকট নয়, অনেক মনোরম ও আনন্দদায়ক।

শয়তানরাজ এবার সেই অরণ্যসমাচ্ছন্ন খাড়াই পাহাড়ে উঠে যেতে লাগল। মন তার বিষাদগ্রস্ত থাকায় গতি ছিল তার মন্থর। কিছুদূর উপরে ওঠার পর কঠিন অরণ্যে পথ হয়ে উঠল অদৃশ্য ও দুর্গম। কোন মানুষ বা পশুর পক্ষে সেখানে প্রবেশ করা সম্ভব নয়।

একদিকে একটামাত্র প্রবেশদ্বার আছে। পূর্বদিকে সেই প্রবেশদ্বারটি দেখতে পেয়ে তা দিয়ে প্রবেশ করতে ঘৃণাবোধ করল শয়তানরাজ। সে তখন আপন শয়তানসুলভ শক্তিবলে সেই অরণ্যসমাচ্ছন্ন পাহাড় ও স্বর্গপ্রাচীর এক উল্লম্ফনে অতিক্রম করে ওপারে স্বর্গলোকের মধ্যে গিয়ে পড়ল। কোন ক্ষুধিত নেকড়ে যেমন সন্ধ্যায় বেড়াবেষ্টিত ভূমির মধ্যে সমবেত মেষপালের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে লাফ দিয়ে বেড়া ডিঙিয়ে যায়, অথবা যেমন কোন দুঃসাহসী চোর কোন ধনীর বাড়িতে টাকা চুরির জন্য জানালা দিয়ে উঠে রুদ্ধদ্বার ঘরের ভিতর জোর করে ঢোকে তেমনি শয়তানরূপী এই বিরাট চোর বাতাস শূন্যপথে উড়ে গিয়ে প্রাচীরবেষ্টিত দেবলোকে প্রবেশ করল। সে লোভী তস্করের মত স্বর্গমধ্যস্থিত জীবনবৃক্ষের শাখায় উঠে বসে রইল।

কিন্তু সেই বৃক্ষের উপর বসেও সে তার জীবনপ্রদায়িনী শক্তির কথা কিছুমাত্র চিন্তা করল না, শুধু জীবিতদের কিভাবে মৃত্যু ঘটানো যায় সেই কথাই চিন্তা করতে লাগল। অমৃতের উৎস কোথায় আছে এই স্বর্গলোকে এবং সে উৎস কিভাবে নিবারিত ও নিষ্ক্রিয় করা যায় শয়তান শুধু সেই কথাই ভাবতে লাগল।

সে উৎসের সন্ধান শুধু পরমেশ্বর একাই জানেন, সে উৎসের সকল রহস্য শুধু আছে তারই অধিকারে। শয়তান শুধু যা কিছু শুভ ও ভাল তাকে অশুভ ও মন্দে পরিণত করতে পারে।

শয়তানরাজ দেখল তার নীচে স্বর্গোদ্যান আর সবুজ ঐশ্বর্যে পূর্বদিক প্রসারিত। পুর্বে ইভেন নগরীকে বলা হত তেনাসার। এ শহরে আছে গ্রীসের রাজাদের দ্বারা নির্মিত বিরাট এক রাজপ্রাসাদ। পরে ঈশ্বর এইখানে এক উর্বর বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড বেছে নিয়ে তার উপর গড়ে তোলেন এক মনোরম উদ্যান। সে উদ্যানে রোপণ করেন বিভিন্ন জাতীয় বড় বড় গাছ। সেই সব গাছের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু হচ্ছে জীবনবৃক্ষ। সে বৃক্ষে সোনার অমৃত ফল ফলত।

এই জীবনবৃক্ষের পাশেই ছিল. জ্ঞানবৃক্ষ। মানুষের এই জ্ঞানবৃক্ষই মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায় একদিন। এই উদ্যানের দক্ষিণ দিকে একটি বড় নদী বয়ে গেছে। সে নদীর সামনে কতকগুলি পাহাড় তার পথরোধ করে দাঁড়িয়ে থাকলেও নদী তার গতি পরিবর্তন করেনি। সে সেই পাহাড়গুলির তলদেশ ভেদ করে প্রবাহিত হয়েছে।

অনুন্নত যে পাহাড়টিকে ভিত্তি করে স্বর্গের উদ্যানটি রচিত হয়েছে সেই পাহাড়ের উপর আছে একটি স্বচ্ছসলিলা ঝর্ণা যার জলধারা উদ্যানটিকে বিধৌত করে খাড়াই পাহাড়ের গা বেয়ে নীচে পড়েছে। তারপর চারটি শ্রোতোধারায় বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন দিকে বিধৌত করে বিভিন্ন দিকে চলে গেছে।

স্বর্গোদ্যানের বিশাল সীমানার মধ্যে তৃণাচ্ছন্ন উপত্যকার উপর মেষপাল চড়ছিল। মুক্তোর মত স্বচ্ছ জলের ঝর্ণার ধারে ছিল কত ফুল ও ফলের গাছ। সেই উদ্যানের মনোরম দৃশ্যাবলী দেখতে লাগল শয়তানরাজ। তার নিজের মনে কোন আনন্দ না থাকলেও আনন্দময় পরিবেশ দেখতে দেখতে অভিভূত হয়ে গেল সে।

এমন সময় সেই উদ্যানের এক জায়গায় দুটি দেবোপম নগ্ন দানবমূর্তি দেখতে পেল শয়তানরাজ। ঈশ্বরের অনুগৃহীত সৃষ্টি হিসাবে তাদের দেহাবয়বদুটি স্রষ্টার গৌরবকে যেন ঘোষণা করছিল নীরব ভাষায়। তাদের আয়ত চোখের প্রশস্ত উজ্জ্বল দৃষ্টির মধ্যে প্রতিফলিত হচ্ছিল ঐশ্বরিক দ্যুতি। সত্য, প্রজ্ঞা, কঠোর শুচিতা ও পবিত্রতার মূর্ত প্রতীক ছিল যেন তারা। কিন্তু শুচিতার কঠোরতা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে ছিল সন্তানসুলভ স্বাধীনতা। তারা যেন ছিল নিজেরাই নিজেদের প্রভু।

জাতি হিসাবে মৃর্তিদুটি মানব হলেও আকৃতি ও প্রকৃতির দিক থেকে তারা সমান ছিল না। প্রকৃতির দিক থেকে একটি মূর্তির মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছিল সাহসিকতা এবং তেজস্বিতা। আর একজনের মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছিল মেদুরতা, নম্রতা, কমনীয়তা এবং মোহপ্রসারী সৌন্দর্যের সুষমা।

একটি মূর্তি ছিল আকারে কিছু বড় এবং তার সম্মুখভাগ ও প্রশান্ত উজ্জ্বল চক্ষুদুটিতে ছিল পূর্ণ প্রভুত্বের ছাপ। তার ঘনকৃষ্ণ কেশপাশ তার স্কন্ধদেশ পর্যন্ত ছিল লম্বিত। কিন্তু আর একজনের কুঞ্চিত কেশপাশ ছিল তার ক্ষীণ কটিদেশ পর্যন্ত লম্বিত ও আলুলায়িত। তার মধ্যে ছিল এক সলজ্জ অধীনতা, বিনম্র অহংবোধ। তাকে মনে হচ্ছিল সে যেন কারো অধীন, কিন্তু সে কোন কঠোর শাসন বা রূঢ় প্রভুত্বের বস্তু নয়। তাকে মৃদু অনুশাসনের দ্বারা পরিচালিত করতে হবে।

তার মধ্যে কতকগুলি রহস্যময় দিক ছিল যেগুলি অসংবৃত অবস্থাতেই দেখা যাচ্ছিল। সে ছিল প্রকৃতির সৃষ্টি, যেন প্রকৃতির জীবন্ত কারুকর্ম। তার মধ্যে ছিল যেন এক পাপজনিত লজ্জাবোধ আর অসম্মানজনক সম্মানবোধ।

এই মূর্তিটিই হলো নারীমূর্তি, মানবজাতির আদিমাতা।

হে নারী, তোমার আপাত পবিত্র কপট ভাবের দ্বারা কিভাবে তুমি বিব্রত করে তোল পুরুষদের, কিভাবে তুমি মানুষের জীবন থেকে সব দুঃখ, নীরবতা ও নিষ্কলঙ্ক নির্দোষিতাকে নির্বাসিত করে দিয়েছ চিরতরে?

সেই আদি মানব ও মানবীর মূর্তিদুটি নগ্ন অবস্থায় হাত ধরাধরি করে ধীরে ধীরে গাছে ঘেরা একটি ঝর্ণার ধারে ঈশ্বর ও দেবদূতদের দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল। তাদের মনে কোন কুচিন্তা বা পাপবোধ ছিল না। সেই থেকে পৃথিবীতে যত আলিঙ্গনাবদ্ধ প্রেমিকযুগল দেখা গেছে তারা ছিল তাদের সবার থেকে সুন্দর।

আদিপিতা আদম ছিল পরবর্তী কালের সমস্ত মানব সন্তানদের থেকে সুন্দর পুরুষ আর আদিমাতা ঈভ ছিল তার সব কন্যাদের চেয়ে সুন্দরী। ঝর্ণার ধারে এক খণ্ড সবুজ তৃণভূমির উপর তারা দুজনে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কথা বলতে লাগল। শুধু উদ্যানের কিছু কাজ ছাড়া অন্য কোন শ্রমের কাজ তাদের করতে হত না।

বনের ফল আর ঝর্ণার জল খেয়ে ক্ষুধাতৃষ্ণা নিবারণ করত তারা। ক্ষুধা পেলে রসাল ফলের ভারে আনত গাছের শাখাগুলি থেকে ফল পেড়ে খেত তারা। তৃষ্ণা পেলে কানায় কানায় ভরা নদী-ঝর্ণার উপর পাশ থেকে ঝুঁকে জলপান করত। এক এক সময় তারা রসাল কচিকচি ভঁটা চিবোত। বিবাহিত যুবক-যুবতীর মত তারা নির্জনে যৌবনসুলভ নেশায় মত্ত হয়ে উঠত মাঝে মাঝে। তাদের মুখের উপর ফুটে উঠত প্রেমমদির হাসি। তাদের চারপাশে বনের পশুরা এমন কি বাঘ, সিংহ, চিতা, ভল্লুক প্রভৃতি হিংস্র জন্তুরাও তাদের সকল হিংস্রতা ভুলে গিয়ে শান্তভাবে সেবা করত তাদের। হাতিরা তাদের শুড় ঘুরিয়ে আনন্দদান করত। সাপেরাও তৃণশয্যার উপর শান্তভাবে শুয়ে ছিল, তাদের অনেক ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছিল।

ক্রমে অস্তগমননান্মুখ সূর্য আকাশ থেকে ধীরে ধীরে নেমে এসে পশ্চিমের সমুদ্রের দ্বীপাবলীর উপর ঢলে পড়ল। নক্ষত্রেরা ধীরে ধীরে উদিত হতে লাগল সান্ধ্য আকাশে।

শয়তানরাজ প্রথম থেকে সমানে সঁড়িয়ে এই সব কিছু দেখে যেতে লাগল। বিষাদগ্রস্ত মনে তার স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ করে চারদিকের এই সব দৃশ্যাবলী দেখতে। দেখতে অবশেষে কিছু কথা না বলে থাকতে পারল না।

সে বলল, হে নরক, আমি বিষাদঘন চিত্তে কি সব দেখছি? একদা যা ছিল আমাদের সুখের আবাস সেখানে যারা দেবদূত নয় এমন সব শত শত প্রাণীরা কত সুখে বসবাস করছে। তারা উজ্জ্বলতা বা দিব্য দ্যুতির দিক থেকে কিছুটা নিকৃষ্ট হলেও যে স্রষ্টা তাদের সৃষ্টি করেন সে স্রষ্টার কিছুটা দ্যুতি ও সুষমা ঝরে পড়েছিল তাদের দেহ থেকে। দৈব সাদৃশ্যের একটা অংশ মূর্ত তাদের মধ্যে।

হে প্রেমিকযুগল, তোমরা জান না, তোমাদের এই অবস্থার পরিবর্তন কত নিকটে। অত্যাসন্ন সেই ভাগ্যপরিবর্তনে তোমাদের জীবনের সকল সুখ সকল আনন্দ নিঃশেষে অন্তহিত হয়ে যাবে কোথায় চিরতরে। দুঃখের সীমাহীন গভীরে নিক্ষিপ্ত হবে তোমরা। বর্তমানে যে সুখের যে আনন্দের আস্বাদ লাভ করছ তোমরা, সে দুঃখ হবে এই সুখের থেকে অনেক গুণ বেশি।

তোমরা এখন যে সুখে সুখী সে সুখ তো চিরস্থায়ী নয়। যে স্বর্গলোকের সীমানার মধ্যে বাস করছ তোমরা সে সীমানা তো সুরক্ষিত নয়। যে প্রাচীর দ্বারা এই স্বর্গসীমা বেষ্টিত তা দুর্বল এবং তার প্রতিরক্ষাগত শক্তি এমনই অপ্রচুর ও অসার্থক যে তা আমার মত এক বহিঃশত্রুকে নিবারিত করতে পারল না। অবাধে এ লোকে প্রবেশ করলাম আমি।

কিন্তু স্বর্গের শত্রু হলেও তোমাদের উপর কোন জাতক্রোধ নেই আমার। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমি শত্রু নই তোমাদের। আমি কারো কাছে কোন করুণা বা মমতা না পেলেও আমি এখানে আসি অদৃশ্য অবস্থায়। তোমাদের অলক্ষ্যে অগোচরে তোমাদের করুণামিশ্রিত দৃষ্টিতে না দেখে পারছি না। তোমাদের সঙ্গে মিত্রতাই আমার কাম্য। আমি চাই তোমাদের সঙ্গে এমন এক মিত্ৰতাসূত্রে আবদ্ধ হতে যাতে তোমাদের সঙ্গে মিলেমিশে আমি বাস করতে পারি অথবা তোমরা আমার সঙ্গে বাস করতে পার এখন থেকে।

আমার বাসস্থান হয়ত তোমাদের মনঃপুত না হতে পারে, কারণ তা এই স্বর্গলোকের মত সুন্দর নয়। তবু সেই বাসভূমি সেই পরম স্রষ্টারই এক সৃষ্টি এবং সেই হিসাবে তোমাদের তা মেনে নেওয়া উচিত। তিনিই আমাকে তা দান করেছেন এবং আমি তোমাদের দান করছি।

তোমরা সেখানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নরকপ্রদেশ উন্মুক্ত করে দেবে তার বিস্তৃত দ্বারপথ। সেখানকার রাজারা এগিয়ে আসবে তোমাদের অভ্যর্থনা করতে। সেই নরকপ্রদেশই আমার বাসভূমি। কিন্তু সে স্থান এখানকার মত সংকীর্ণ নয়। তোমার অসংখ্য সন্তানদের স্থানসংকুলানের কোন অভাব হবে না। তারা অনায়াসে বাস করতে পারবে সেখানে।

সে স্থান যদি তোমাদের ভাল না লাগে তাহলে কোন উপায় নেই। তাহলে তোমরা আমার প্রতি কোন অন্যায় না করলেও যিনি আমার উপর অন্যায় করেছেন, যিনি আমাকে তোমাদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণের পথে টেনে নিয়েছেন তাকে ধন্যবাদ দিও। যদিও তোমাদের নিস্পৃহতা ও নির্দোষিতায় আমি বিগলিত হয়ে পড়ছি, তথাপি সাধারণের স্বার্থ ও সম্মানের খাতিরে রাজ্যলাভের আকাঙ্ক্ষায় আমি এই নতুন জগৎ অধিকার করে আমার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চাই আর তার জন্যই আমি বাধ্য হয়ে এমন এক জঘন্য কাজ করতে এসেছি যা আমি নিজেই ঘৃণা করি।

এই সব কথাগুলি আপন মনে বলল শয়তান। সকল অত্যাচারীই তাদের অন্যায় কর্মের স্বপক্ষে যে যে যুক্তি দেখায়, যে প্রয়োজনীয়তার কথার উল্লেখ করে শয়তানও তা করল। তারপর সে যে গাছের উপর একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখছিল সেই গাছ হতে নীচে অবতরণ করে এক চতুষ্পদ জন্তুর রূপ ধারণ করে সেই সব জন্তুদের মাঝে মিশে গেল। কারণ এখান থেকে এইভাবেই তার শিকারের বস্তুর উপর লক্ষ্য রাখা সম্ভব হবে। এখান থেকে তাদের কথাবার্তা বা কাজকর্ম দেখতে পাবে। কখনো বাঘ বা কখনো সিংহ হয়ে সে অগ্নিদৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে সামনে।

মাঝে মাঝে তার দৃষ্টিটাকে এদিকে সেদিকে স্থানান্তরিত করতে লাগল শয়তান। তার মনে হতে লাগল যে কোন মুহূর্তে এই দুটি শিকারকে দুটি থাবার মধ্যে ধরে ফেলতে পারবে।

এরপর দেখা গেল আদি মানব আদম আদি মানবী ঈভকে কি বলতে লাগল আর শয়তান তা শুনতে লাগল কান খাড়া করে।

আদম ঈভকে বলতে লাগল, হে আমার সকল আনন্দের অংশীদার, যে শক্তি আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং যে বিস্তৃত জগতে আমরা বাস করছি সেই শক্তি ও জগৎ যেন চিরমঙ্গলময় হয় আমাদের পক্ষে। পরম মঙ্গলময় ঈশ্বর আমাদের প্রতি। অপার করুণাবশত আমাদের পথের ধূলি থেকে তুলে এনে এই সর্বসুখকর স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি আপন ইচ্ছা বা প্রয়োজনমত সব কিছুই সৃষ্টি করতে পারেন।

সেই ঈশ্বর আমাদের জন্য এত কিছু করলেও তিনি আমাদের কোন সেবাই চান না। তিনি আমাদের কাছে চান শুধু একটিমাত্র আনুগত্য। এই বিশাল বিস্তীর্ণ উদ্যানে যত সব উপাদেয় সুস্বাদু ফলের গাছ আছে তার মধ্যে শুধু জ্ঞানবৃক্ষের ফল যেন কখনো আমরা ভক্ষণ না করি। জীবনবৃক্ষের পাশে রোপিত জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেলে তা মৃত্যুসম হয়ে উঠবে আমাদের পক্ষে।

বুদ্ধিমান ঈশ্বর নিজে ঘোষণা করেছেন এই জ্ঞানবৃক্ষের ফলভক্ষণ আমাদের মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠবে। এই জগৎ ও জগতের জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে যত জীব বাস করে সেই সব জীবের উপর প্রভুত্ব ও শাসনক্ষমতা আমাদের দান করে তার বিনিময়ে শুধু এই আনুগত্যই চান। সুতরাং এই নিষেধাজ্ঞাটি যেন খুব আমরা কঠিন না ভাবি।

আমরা যখন অন্য সব কিছু বস্তুই স্বাধীনভাবে উপভোগ করতে পারি, অসংখ্য আনন্দের উপকরণ ইচ্ছামত বেছে নিতে পারি তখন এই একটিমাত্র নিষেধাজ্ঞা মেনে চলা এমন কিছু দুঃসাধ্য কর্ম নয় আমাদের কাছে। আমাদের শুধু একটিমাত্র কর্তব্যকর্ম সাধন করতে হয়। সে কর্ম হলো এই যে, এই সব চারাগাছগুলি অতিরিক্ত বেড়ে গেলে তা হেঁটে দিতে হয় এবং এই ফুলগাছগুলির সেবাযত্ন করতে হয়। এই কাজগুলি করার পর আমরা দুজনে একসঙ্গে ঈশ্বরের গৌরবগান করব। তাছাড়া এ কাজ শ্রমসাধ্য হলেও তোমার সঙ্গে করি বলে মোটেই কষ্ট হয় না।

আদমের কথা শেষ হলে ঈভ তার উত্তরে বলল, যার জন্য আমার এই জীবন সৃষ্ট হয়েছে, যার অঙ্গ থেকে অর্ধাঙ্গিনীরূপে সৃষ্ট হয়েছে আমার দেহ, সেই তুমিই আমার মস্তিষ্ক, তুমিই আমার পথপ্রদর্শক ও পরিচালক! তুমি যা বলেছ তা ঠিক এবং ন্যায়সঙ্গত। ঈশ্বরের কাছে কত বিষয়ে কত ঋণী আমরা। প্রতিদিনই তাঁকে ধন্যবাদ দেওয়া এবং তার প্রশংসা বা গৌরবগান গাওয়া উচিত।

এদিক দিয়ে দেখতে গেলে আমার দায়িত্ব আরও বেশি, কারণ আমি তোমার থেকে আরো বেশি সুখ ও সৌভাগ্য ভোগ করি। তোমাকে পেয়ে সব দিক দিয়ে নির্বিঘ্ন ও নিষ্কন্টক হয়ে উঠেছি আমি। অবশ্য তুমি আমার মত সাথী আর কোথাও খুঁজে পাবে না।

সেই দিনটির কথা প্রায়ই মনে পড়ে আমার আজও। সেদিন ঘুম থেকে জেগে উঠেই দেখি একটি গাছের তলায় ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ফুলের উপর শুয়ে আছি আমি। তখন আমি বিপুল বিস্ময়ের সঙ্গে ভাবতে লাগলাম, আমি কে এবং কোথায় আছি। সেখান থেকে উঠে আমি কিছুটা এগিয়ে গেলাম। সহসা আমার অদূরে একটি গুহার মুখে জলের কলকল শব্দ শুনে সেদিকে তাকিয়ে দেখি একটি পার্বত্য গুহা থেকে : একটি জলের ধারা সশব্দে বেরিয়ে এসে সমতলের উপর ছড়িয়ে পড়ছে। তারপর সেই জলধারা একটি হ্রদের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকছে। সেই হ্রদের জল স্বচ্ছ নীল– আকাশের মতই এমন স্বচ্ছ ছিল যে তাতে সবকিছু প্রতিবিম্ব দেখা যায়।

কৌতূহলবশত আমি সেই হ্রদের সবুজ তটভূমিতে নিজেকে শায়িত করে হ্রদের নির্মল জলের দিকে তাকালাম। আমার মনে হল হ্রদ নয়, যেন আর এক আকাশ। সহসা সেই স্বচ্ছ জলের ওপরে একটি মূর্তি ঘাড় বেঁকিয়ে আমাকে দেখছে। আমি তাকে দেখে পিছিয়ে গেলে সেও পিছিয়ে গেল। কিন্তু থাকতে না পেরে আমি ফিরে গিয়ে তার দিকে সপ্রেম ও সহানুভূতির দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখলাম তার উপর। তাকে একান্তভাবে পাবার জন্য সাধনা করতে লাগলাম। এমন সময় একটি অদৃশ্য কণ্ঠস্বর সতর্ক করে দিল আমায়, হে সুন্দরী, ওখানে যা দেখছ তা তোমারই ছায়া। তোমার সঙ্গেই তা যাওয়া-আসা বা ওঠা-বসা করে। আমাকে অনুসরণ করো। আমি তোমাকে এমন জায়গায় নিয়ে যাব যেখানে তুমি শুধু তোমার ছায়া বা দেহের প্রতিরূপটিকেই দেখবে না, সেখানে তুমি যার প্রতিমূর্তি তাকে তুমি সশরীরে দেখতে পাবে, তাকে তুমি আলিঙ্গন করতে পারবে। চিরদিন তার সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে যুক্ত থেকে উপভোগ করে যেতে পারবে তুমি। তুমি তার বহু সন্তান গর্ভে ধারণ করবে এবং মানবজাতির আদি মাতা হিসাবে অভিহিত হবে।

সেই কণ্ঠস্বর আরও বলল, তুমি আমাকে দেখতে পাবে না। অদৃশ্য অবস্থায় আমি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব তোমাকে। তুমি শুধু নীরবে নির্বিচারে অনুসরণ করে যাবে আমায়।

আমি সেই কণ্ঠস্বরের কথামত তাকে অনুসরণ করে যেতে লাগলাম। তোমাকে দেখতে পেলাম। সুন্দর, দীর্ঘ দেহ। কিন্তু আমার মনে হলো জনবিস্মিত সেই মূর্তির থেকে কম নমনীয়, কম নম্র। আমি তাই পিছন ফিরে চলে যেতে শুরু করলাম। তুমি তখন চিৎকার করে আমায় বললে, ফিরে এস সুন্দরী ঈভ, কার ভয়ে তুমি পালাচ্ছ এমন করে? তুমি জান না, যার কাছ থেকে পালিয়ে যাচ্ছ তুমি তারই অংশ। তোমার দেহাবয়ব গড়ে তোলার জন্য আমি আমার নিজের দেহের অংশ থেকে অস্থি, মজ্জা, ও মাংস দান করি। তুমি আমার অন্তরের নিকটতমা, আমার জীবনের জীবন। তুমি আমার পাশে পাশে সব সময় থাকবে, তুমিই হবে আমার প্রিয়তমা, অন্তরতমা, আমার সকল শান্তি ও সান্ত্বনার উৎসস্থল। তুমি আমার আত্মার অর্ধাংশ, আমার অর্ধাঙ্গিনী। তুমি তোমার শান্ত হাত দিয়ে আমাকে ধরেছিলে। আমি আত্মসমর্পণ করেছিলাম তোমার কাছে। তখন থেকে দেখতে পাচ্ছি, সৌন্দর্য কিভাবে পুরুষোচিত জ্ঞান ও মহিমার দ্বারা পূর্ণতা লাভ করে এবং সেই সৌন্দর্যই প্রকৃত সৌন্দর্য।

এই কথা বললেন আমাদের আদি মাতা। তাঁর চোখে-মুখে ছিল নির্মম দাম্পত্য প্রেমের মদির আকর্ষণ, নীরব আত্মসমর্পণের ভাব। তিনি তখন অর্ধ-আলিঙ্গনের ভঙ্গিতে আমাদের আদি পিতার উপর হেলে পড়লেন। আলুলায়িত সোনালী কেশপাশে। আচ্ছন্ন তাঁর স্ফীত বক্ষ আদি পিতার বক্ষের উপর স্থাপন করলেন তিনি।

আদি পিতা তখন আদি মাতার দেহসৌন্দর্য ও ননত মাধুর্য দর্শনে বিশেষ প্রীত হয়ে প্রসন্নতার হাসি হাসলেন, ঠিক দেবরাজ জুপিটার যেমন একদিন জুনোর পানে তাকিয়ে হেসেছিলেন এবং পবিত্র চুম্বনের দ্বারা তাঁর ওষ্ঠাধরকে আপীড়িত করেন। জুপিটারের সে হাসিতে মেঘ হতে বসন্ত ফুল ঝরে পড়ে।

তা দেখে শয়তান ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে সরে দাঁড়াল। কঠিন ঈর্ষান্বিত দৃষ্টি দিয়ে নিরীক্ষণ করতে লাগল তাদের। তারপর আপন মনে বলতে লাগল, এ দৃশ্য ঘৃণ্য এবং পীড়াদায়ক। মনোরম স্বর্গোদ্যানে এই দুটি মানব-মানবী পরস্পর আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় এক পরম স্বর্গীয় সুখ উপভোগ করছে, অথচ আমি নরকে নিক্ষিপ্ত। যে নরকে কোন প্রেম নেই, আনন্দ নেই, আছে শুধু অতৃপ্ত কামনার ভয়ঙ্কর পীড়ন, সেই নরকের অন্ধকারে প্রজ্জ্বলিত নরকাগ্নির জ্বালাময়ী উত্তাপের সঙ্গে অতৃপ্ত কামনার বেদনা আর ব্যাকুলতা ভোগ করে যেতে হয় আমাদের।

এখন আমি ওদের মুখ থেকে যা শুনেছি তা ভুললে চলবে না। এই স্বর্গলোকে বা স্বর্গোদ্যানে যা কিছু আছে তা তারা সব উপভোগ করতে পারে না। এই উদ্যানে জ্ঞানবৃক্ষ নামে একটি মারাত্মক গাছ আছে যার ফল নিষিদ্ধ তাদের কাছে। এ গাছের ফলের আস্বাদন থেকে বঞ্চিত তারা। তার মানে তাদের প্রভু ঈশ্বর এক অযৌক্তিক সংশয়ের দ্বারা আচ্ছন্ন। কিন্তু তাদের প্রভু ঈর্ষান্বিত কেন তাদের প্রতি? জ্ঞানলাভ করা কি পাপ? সে জ্ঞানলাভের পরিণাম কি মৃত্যু? তবে কি তারা অজ্ঞ রয়ে গেছে আজও? জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত হয়ে অজ্ঞতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকাটা কি সুখী অবস্থা? সেটা কি তাদের আনুগত্য আর বিশ্বাসের অভ্রান্ত প্রমাণ বা পরিচায়ক?

হ্যাঁ, এটাই হবে তাদের ধ্বংসের সৌধ নির্মাণের ভিত্তি। এই অজ্ঞতাই হবে তাদের ধ্বংসের কারণ। আমি তাদের মনে জ্ঞানের বাসনা সঞ্চারিত করে তাদের উত্তেজিত করে তুলব। আমি তাদের এমনভাবে উত্তেজিত করে তুলব যাতে তারা ঈশ্বরের ঈর্ষাজনিত আদেশ প্রত্যাখ্যান করে। তাদের আমি বুঝিয়ে দেব, ঈশ্বরের এ আদেশ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তারা যাতে চিরকাল ঈশ্বরের অধীন হয়ে থাকে, ঈশ্বরের সমান মর্যাদার আসনে কখনো উন্নীত হতে না পারে, তারই জন্য ঈশ্বর জ্ঞানবৃক্ষের ফল ভক্ষণ করতে নিষেধ করেছেন তাদের।

তারপর নিষিদ্ধ জ্ঞান লাভ করে ঈশ্বরের সমকক্ষ হবার অভিলাষে যেমন জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাবে অমনি অনিবার্য হয়ে উঠবে তাদের মৃত্যু। এর থেকে ভাল তাদের ধ্বংসের উপায় আর কি থাকতে পারে?

কিন্তু তার আগে এই উদ্যানের চারিদিক আমাকে একবার ঘুরে দেখতে হবে। এর প্রতিটা কোণ ভাল করে দেখতে হবে আমায়। ঘটনাক্রমে এই উদ্যানে কোথাও কোন গাছের তলায় অথবা কোনও ঝর্ণার ধারে কোন ভ্রাম্যমাণ দেবদূতের দেখা পেয়ে যেতে পারি। তাহলে তার কাছ থেকে জ্ঞাতব্য বিষয় জানা যাবে।

হে প্রেমিকযুগল, যতক্ষণ পর বেঁচে থাক। ক্ষণস্থায়ী আনন্দ প্রাণভরে উপভোগ করে যাও আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত। কারণ এক সুদীর্ঘকালীন দুঃখ অপেক্ষা করে আছে তোমাদের জন্য।

এই বলে ঘৃণাভরে দর্পিত পদক্ষেপে এগিয়ে চলল সে। যেতে যেতে সুচতুরভাবে নিরীক্ষণ করতে লাগল চারিদিক। ধীরে ধীরে বন, প্রান্তর, পাহাড়, উপত্যকার উপর দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল সে। যেতে যেতে দেখল একসময় চুড়ান্ত দ্রাঘিমারেখায় যেখানে আকাশ মর্ত্যের মহাসমুদ্রে মিলিত সেইখানে সূর্য অস্তাচলে গেল। স্বর্গের পূর্বদ্বারে শেষ সূর্যরশ্মিগুলি ঝরে পড়তে লাগল। সেই পূর্বদ্বারে ছিল তূপাকৃত মমরপ্রস্তরের এক অভ্রভেদী পাহাড়। মেঘলোক পর্যন্ত বিস্তৃত সেই পাহাড়ের মর্ত্যভূমি থেকে ওঠার একটিমাত্র পথ ও প্রবেশদ্বার আছে। বাকি সবটাই হচ্ছে এবড়ো-খেবড়ো পাথরে ভরা খাড়াই পাহাড় উপরে উঠে গেছে। তাতে ওঠা অসম্ভব কারো পক্ষে।

সেই পাহাড়ের উপর এক জায়গায় প্রহরাকার্যে নিযুক্ত দেবদূতদের মধ্যে প্রধান গ্যাব্রিয়েল আসন্ন রাত্রির প্রতীক্ষায় বসেছিল। স্বর্গের যুবকরা বিনা অস্ত্রে খেলা দেখাচ্ছিল তাকে। কিন্তু নিকটে ঢাল, বর্ম, শিরস্ত্রাণ, বর্শা প্রভৃতি স্বর্ণ ও হীরকখচিত অস্ত্রাদি ঝুলিয়ে রাখা ছিল।

এমন সময় গ্যাব্রিয়েলের সামনে আকাশমণ্ডলে ব্যাপ্ত ঘনায়মান সান্ধ্যছায়ার মধ্য দিয়ে সূর্যের একটি আলোকরেখার মত কক্ষচ্যুত উল্কার বেগে ইউরিয়েল এসে দাঁড়াল সহসা। শরৎকালের রাত্রিতে নক্ষত্রবিচ্ছুরিত বাম্পাগ্নি যেমন সমুদ্রনাবিকদের আসন্ন ঝড় সম্বন্ধে সতর্ক করে দেয়, ইউরিয়েল মেনি গ্যাব্রিয়েলকে সতর্ক করে দিয়ে বলল, শোন গ্যাব্রিয়েল, তোমার উপর এক নূতন কাজের ভার দেওয়া হয়েছে। সদাজাগ্রত ও সদাসতর্ক অবস্থায় কড়া নজর রাখতে হবে, কোন দুষ্ট আত্মা যেন এই চির আনন্দময় লোকে প্রবেশ করতে না পারে। আজই বেলা দ্বিপ্রহরে আমাদের এলাকায় একটি আত্মা এসেছিল। তাকে খুবই কৌতূহলী ও তৎপর দেখাচ্ছিল।

দেবদূতের মত দেখতে সেই আত্মা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সৃষ্টিকার্য সম্বন্ধে আরও অনেক কিছু জানতে চাইছিল, বিশেষ করে ঈশ্বরের সর্বশেষ প্রতিরূপ মানবজাতি সম্বন্ধে। আমি তখন মানবজাতির আদি পিতা-মাতার বাসভূমিতে যাবার পথ বলে দিই। সে সঙ্গে সঙ্গে আকাশপথে সেই দিকে উড়ে যায়। আমি তার উড়ে চলার কক্ষপথে তাকিয়ে লক্ষ্য করতে থাকি। তাকে প্রথমে দেবদুতের মত দেখালেও ইডেনের উত্তরদিকে যে পর্বত আছে তার উপর সে অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গে তার আকৃতি-প্রকৃতি ও চোখের দৃষ্টি সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়ে একেবারে স্বর্গীয় দেবদূতদের বিপরীত হয়ে যায়। তার উদ্দেশ্য কু-অভিসন্ধিমূলক আর আচরণ ও হাবভাব রহস্যময় মনে হয়।

আমি আমার দৃষ্টি দিয়ে তখনো তার অনুসরণ করতে থাকি। কিন্তু গাছের আড়ালে আমার দৃষ্টিপথের বাইরে চলে যায় সে। আমার মনে হয় সে হচ্ছে স্বর্গ হতে নির্বাসিত শয়তানদের একজন। নরকপ্রদেশ থেকে উঠে এসে স্বর্গলোকের মধ্যে প্রতিহিংসাবশত নতুন কোন বিপদ বাধাতে চায়। তোমার কাজ হবে তাকে খুঁজে বের করা এবং তার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা।

একথা শুনে দেবসেনা গ্যাব্রিয়েল উত্তর করল, ইউরিয়েল, অত্যুজ্জ্বল সৌরমণ্ডলের মধ্যে বসে থেকে দৃষ্টি প্রসারিত করে তুমি যে দূরের বস্তুকে দেখতে পাবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। এই দ্বারপথে যে প্রহরা রয়েছে সে প্রহরা এড়িয়ে কেউ আসতে পারবে না। একমাত্র স্বর্গের পরিচিত কেউ ছাড়া এখানে আসে না। কিন্তু স্বর্গের দেবদূত ছাড়া বাইরের জগতের কেউ যদি পার্থিব বাধা ডিঙিয়ে স্বর্গোদ্যানের ভিতরে প্রবেশ করে, যদি সে স্বর্গের কোন দৈবশক্তি না হয় তাহলে তুমি যার কথা বললে সে এই স্বর্গলোকের মধ্যে যে রূপেই প্রবেশ করুক বা ঘুরে বেড়াক, আগামীকাল প্রত্যুষেই আমি তার বিষয়ে জানতে পারব।

গ্যাব্রিয়েলের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি পেয়ে ইউরিয়েল তার সৌরমণ্ডলের মাঝে চলে গেল। সূর্য তখন আকাশের পূর্বপ্রান্তে ঢলে পড়েছে সারাদিনের কাজ শেষ করে। পশ্চিম প্রান্তে মেঘগুলিকে নীলচে ও সোনালী রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে কে যেন।

এবার ধীরে ধীরে নেমে এল নিস্তব্ধ নিঝুম সন্ধ্যা। গোধূলির ধূসর-গম্ভীর আবরণে সব কিছু আচ্ছন্ন হয়ে গেল একেবারে। এক অখণ্ড নীরবতা বিরাজ করতে লাগল চারিদিকে। পশুরা তাদের তৃণশয্যায় শয়ন করল, পাখিরা চলে গেল তাদের আপন আপন বাসায়। একমাত্র নাইটিঙ্গেল সারারাত জেগে জেগে এক প্রেমমধুর গান গেয়ে চলল একটানা। সে গানের সুরে পুলকের জোয়ার জাগল সেই নৈশ নীরবতার বুকে।

সহসা জীবন্ত মুক্তাসন্নিভ এক আভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল সমগ্র আকাশমণ্ডল। সন্ধ্যাতারার পিতা যে হেসপারায়াস নক্ষত্রগুলিকে পরিচালিত করে নিয়ে আসছিল, আকাশে সে হেসপারায়াস উজ্জ্বল হয়ে উঠলে অবগুণ্ঠিত চন্দ্ররাণী উদিত হয়ে তার রজতশুভ্র আলোর আবরণগুলি ছড়িয়ে দিলেন অন্ধকারের উপর।

আদি মানবপিতা আদম তখন ঈভকে বললেন, হে আমার জীবনসঙ্গী, এখন রাত্রিকাল সমাগত। এই কাল সকল জীবেরই বিশ্রামলাভের সময়। চল আমরাও বিশ্রামলাভ করিগে। কারণ শ্রম এবং বিশ্রাম, দিন এবং রাত্রি এক অবিচ্ছিন্ন পারম্পর্যে ঈশ্বরই সৃষ্টি করেছেন। নিদ্রায় শিশিরবিন্দুগুলি নিদ্রার বোঝাভার নিয়ে ঝরে পড়ছে আমাদের চোখের পাতার উপর। অন্যান্য প্রাণীরা কর্মহীন অবস্থায় ঘুরে বেড়ায় বলে তাদের বিশ্রামের প্রয়োজন কম কিন্তু মানুষকে প্রতিদিন দৈহিক বা মানসিক কর্মে ব্যাপৃত থাকতে হয় এবং তাতেই তার গৌরব। তার সকল পথে সকল কাজেই ঈশ্বরকে ভক্তি করে চলে মানুষ। কারণ তার কর্মাকর্মের ভাল-মন্দ দিকগুলি ঈশ্বর বিচার করে দেখেন এবং সেইমত ফলদান করেন। কিন্তু অন্যান্য জীবদের কর্মকর্ম সম্বন্ধে উদাসীন থাকেন তিনি।

আগামীকাল প্রভাতে পূর্বদিকে আলো ফুটে ওঠার আগে ঘুম থেকে উঠতে হবে আমাদের। তারপর কাজে মন দিতে হবে। ঐ ফুলগাছগুলির গোড়া থেকে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। তারপর দুপুরে বিভিন্ন গাছের যে সব শাখাপ্রশাখাগুলি অতিরিক্ত বেড়ে গাছের গোড়ায় দেওয়া সারগুলি খেয়ে ফেলে সেই শাখাপ্রশাখাগুলিকে হেঁটে ফেলতে হবে। কিন্তু এ কাজে আরও লোকের দরকার। শুধু আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়। যে সব ফুলের কুঁড়িগুলি গাছ থেকে ঝরে তলায় ছড়িয়ে পড়ে আছে সেগুলোকে পরিষ্কার করতে হবে। যাই হোক, এখন আমরা কিছুই করতে পারব না, কারণ এখন রাত্রিকাল, শুধু বিশ্রামের সময়।

রূপলাবণ্যবতী ঈভ তখন বলল, হে আমার প্রভু ও পরিপালক, তুমি আমাকে যা করার নির্দেশ দেবে, আমি বিনা প্রতিবাদে তাই করব। ঈশ্বরের বিধানই হলো এই। তোমার কাছে ঈশ্বরই আইন, আর আমার আইন তুমি। অধিক না জানতে চাওয়াটাই নারীদের পক্ষে সুখের, এবং প্রশংসার যোগ্য।

তোমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি সময়ের কথা, ঋতু ও ঋতু পরিবর্তনের কথা সব ভুলে যাই। কী সুন্দর ও শান্ত এই প্রভাতকাল। পাখিদের সুমধুর সঙ্গীতে মধুময় হয়ে উঠেছে এই সকাল। সকালের মনোহর সূর্য এই মনোরম উদ্যানভূমিতে ওষধি, বৃক্ষপত্রে, ফুলে-ফলে পতিত শিশিরবিন্দুর উপর তার পূর্বাচলের আলোক বিকীরণ শিশিরসিক্ত বস্তুগুলিতে সূর্যকিরণ পড়ায় তা চকচক করছে মুক্তার মত। বৃষ্টির পর এই উর্বর ভূমি সুগন্ধি হয়ে ওঠে।

তারপর যখন শান্ত স্তব্ধ সন্ধ্যা নেমে আসে এবং তারপর আসে রাত্রি তখন পাখিগুলি ঘুমিয়ে পড়ে এবং চাঁদ ওঠে। তখন নক্ষত্ররাজি মুক্তার মত আকাশে কিরণ দিতে থাকে। কিন্তু শান্ত সকাল, পাখিদের গান, সূর্যকিরণোজ্জ্বল বৃক্ষরাজি ও ফুল-ফল, মুক্তাসন্নিত শিশিরবিন্দু, বর্ষণোত্তর মাটির সৌরভ, অথবা শান্ত সন্ধ্যা, নিস্তব্ধ রাত্রি, চন্দ্রের আকাশ পরিক্রমা, উজ্জ্বল নক্ষত্র তুমি বিনা আনন্দ দান করতে পারে না। কিন্তু স্বর্গ ও মর্ত্যের সকল জীবই যখন তাদের চক্ষু মুদিত করে ঘুমিয়ে আছে তখন সারারাত ধরে এই চন্দ্র ও এই সব নক্ষত্ররাজি কি কারণে কিরণ দান করে চলেছে?

তখন আমাদের আদিপিতা বললেন, হে ঈশ্বরদুহিতা মানবী, অনন্তগুণসম্পন্না ঈভ, এই সব নৈশ জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর কাজই হল পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে উদয়-অস্তের মাধ্যমে আপন আপন কর্তব্য পালন করা। রাত্রিকালে যদি এরা কিরণ না দেয়, যদি পরিপূর্ণ অন্ধকারের উপর রাত্রির সনাতন অধিকার ফিরে না পায় তাহলে প্রকৃতি ও জীবজগতের সকল প্রাণের আগুন নির্বাপিত হয়ে যাবে। চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজি তাদের উজ্জ্বলকিরণের দ্বারা রাত্রিকালে প্রকৃতি ও জীবজগতের সবকিছুকে শুধু আলোকিত করে তোলে না, সেই উত্তপ্ত ও নানাবিধ প্রভাবের দ্বারা তাদের উত্তপ্ত ও অনুপ্রাণিত করে।

রাত্রিকালে মর্ত্যজাত যে সব বস্তুরাজি চন্দ্র ও নক্ষত্রমণ্ডল হতে জ্যোতির যে একটি অংশ পায় তারা সূর্যের পর্যাপ্ত ও পূর্ণায়ত কিরণলাভের জন্য ব্যগ্র হয়ে ওঠে।

যদিও রাত্রি গম্ভীর হলে চন্দ্র ও নক্ষত্রলোক দেখার জন্য কোন মানব জাগ্রত থাকে না, তথাপি সে আলোক বৃথা যায় না। স্বর্গলোকে কখনো নৈশ দর্শক বা চন্দ্রালোক বা নক্ষত্রালোক উপভোগের অভাব হয় না। ঈশ্বর চান তাঁর গৌরবগান বা প্রশংসা। রাত্রিকালে সারা পৃথিবী জুড়ে লক্ষ লক্ষ অদৃশ্য দেবদূত চন্দ্র ও নক্ষত্রমণ্ডলের আলোকমালা উপভোগ করে বেড়ায়। আমরা জাগ্রত বা নিদ্রিত কোন অবস্থাতেই দেখতে পাই না তাদের।

এইসব অদৃশ্য দেবদূতেরা সারা দিন-রাত ঈশ্বরের সৃষ্টিকার্য দেখে তার প্রশংসা করে এবং ঈশ্বরের গুণগান করে। কতবার আমরা গভীর নিশীথে খাড়াই পাহাড়ের উপর অথবা গভীর অরণ্যমাঝে কত দৈব কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হতে শুনেছি। এই কণ্ঠস্বর এক জায়গায় কোথাও ধ্বনিত হলে অন্য এক জায়গায় অন্য এক কণ্ঠস্বর যেন তার প্রত্যুত্তর দেয় এই সব কণ্ঠস্বরগুলি তাদের মহান স্রষ্টা পরমেশ্বরের গৌরবগান করে বেড়ায়। যখন তারা দলে দলে পাহারা দেয়, যখন তারা নৈশপ্রহরায় নিযুক্ত হয়ে রাত্রিকালে ঘুরে ঘুরে বেড়ায় তখন তারা বাদ্যযন্ত্র সহযোগে ঈশ্বরের নামকীর্তন করে। তাদের সেই ভিন্ন ভিন্ন দলগত সঙ্গীতের সুরধারাগুলি এক ঐকতানে মিলিত হয়ে রাত্রির অখণ্ড বিশুদ্ধতাকে খণ্ড খণ্ড করে আমাদের সকল চিন্তাকে ঊর্ধ্বাভিমুখী ও ঈশ্বরাভিমুখী করে তোলে।

এইভাবে কথা বলতে বলতে হাত ধরাধরি করে তাদের পরম আনন্দঘন কুঞ্জমাঝে চলে গেল তারা। পরমস্রষ্টা মানুষের আনন্দ বিধানের জন্য লড়েল ও মাটেল গাছের লতাপাতার ছাদবিশিষ্ট এই কুঞ্জবন নির্মাণ করে দেন। সে কুঞ্জবনের চারিদিকে ছিল সুগন্ধি সুন্দর ফুলে ভরা গাছের বেড়া। সে কুঞ্জের মেঝের উপর ছিল দামী পাথরের পরিবর্তে আইরিস, গোলাপ, যুঁই, ভায়োলেট প্রভৃতি বিভিন্ন রঙের সুগন্ধি ফুলের মেদুর আস্তরণ। কোন পশু-পাখি বা কীটপতঙ্গ মানুষের ভয়ে প্রবেশ করতে পারে না সে কুঞ্জবনে। এর থেকে বেশি নিভৃত নির্জন বা বেশি ছায়াচ্ছন্ন কুঞ্জবনে বনদেবতা প্যান, সিলভানাস বা কোন পরী কখনো ঘুমোয়নি বা বাস করেনি।

ফুল, মালা ও সুগন্ধি ওষধিতে পরিপূর্ণ এই বিস্তৃত কুঞ্জবনের মাঝেই একদিন আদম ও ঈরে প্রথম বাসরশয্যা স্থাপিত হয়। স্বর্গের দেবদূতেরা সেদিন বিবাহের দেবতা হাইমেনের গান গেয়ে নগ্ন সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ ঈভকে বিবাহের নববধূ হিসাবে আদি মানব আদমের হাতে তুলে দেয়। ঈভ ছিল প্যান্ডোরার থেকে বেশি সুন্দরী এবং দেবতারা তাকে বিবিধ অপার্থিব উপহারে ভূষিত করেন। এমনি করে একদিন প্যান্ডোরাকে তার উপহারের বাক্সটাই অগ্নিদেবতা প্রমিথিউসের ভাই এপিমেথিউসকে ছলনার দ্বারা মুগ্ধ করার জন্য এনে দেয়। প্যান্ডোরার সেই উপহারের বাক্স খোলার সঙ্গে সঙ্গে অভিশাপ নেমে আসে মানবজগতের উপর।

আদি মানবপিতা আদম ও আদিমাতা ঈভ সেই বিস্তৃত কুঞ্জমাঝে প্রবেশ করে দুজনেই পঁড়িয়ে রইল। তারপর তারা যে ঈশ্বর যে পরমশ্রষ্টা স্বর্গ-মর্ত্য, জ্যোতির্ময় চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজি সৃষ্টি করেছেন সেই ঈশ্বরের বন্দনাগান করতে লাগল। তারা স্তবের মাধ্যমে বলতে লাগল, হে পরমেশ্বর, হে সর্বশক্তিমান, তুমিই এই রাত্রি ও দিন

সৃষ্টি করেছ। সারাদিন আমরা আমাদের নির্দিষ্ট কর্মগুলি যথাযথভাবে পরস্পরের সাহায্যে সম্পন্ন করে আমাদের এই দাম্পত্যশয্যায় বিশ্রামলাভের জন্য এসেছি।

আমাদের এই দাম্পত্য সুখ তোমারই অনুগ্রহে লব্ধ। কিন্তু এই মনোরম স্থান এতই বড় যে অনেক লোক এখানে স্বচ্ছন্দে বাস করতে পারে। আমাদের দুজন থাকার পরও অনেক জায়গা খালি পড়ে থাকে এখানে।

আমাদের দুজনের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি লাভ করেছিলে যে আমাদের এই দুজনের মিলন থেকে এমন এক জাতির উদ্ভব হবে যারা সমগ্র মত্যভূমি পরিপূরিত করে থাকবে এবং যারা আমাদের মত জাগ্রত অথবা নিদ্রাকালে ঈশ্বরের অনন্ত মহানুভবতার জন্য গৌরবগান করবে।

এইভাবে তার নৈশ প্রার্থনা শেষ করলেন আদিপিতা আদম এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্মগুলি করলেন। তারপর চারদিকে অকিয়ে দেখলেন কেউ কোথাও নেই। তখন সেই কুঞ্জের ভিতরকার দিকের একটি ঘরে পাশাপাশি দুজনে শুয়ে পড়লেন মুখোমুখি। আদম বা ঈভ কেউ কারও দিকে পিছন ফিরে পাশ ফিরলেন না।

প্রেমের যে রহস্য ভণ্ড প্রেমিকরা ধরতে পারে না, দাম্পত্য প্রেমের যে পবিত্রতা ও শুচিতা তারা রক্ষা করতে পারে না, আমাদের আদি পিতা-মাতা ঈশ্বর নির্দেশিত পথে চলে সেই পবিত্র দাম্পত্য প্রেমের প্রতি ছিলেন একান্তভাবে বিশ্বস্ত ও মনেপ্রাণে শুচিশুদ্ধ।

ঈশ্বর চান এই দাম্পত্য প্রেম হবে সন্তানবৃদ্ধির উৎস। তিনি চান সুসন্তানদের সংখ্যাবৃদ্ধি। শুধু যারা ঈশ্বর ও মানবজাতির শত্ৰু, যারা ঈশ্বরদ্রোহী, দেবদ্রোহী ও মানবদ্রোহী, সেই দেববৈরী ও মানববৈরী ধ্বংসকারীরাই ঈশ্বরের কাছে সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত।

হে রহস্যময় ঐশ্বরিক বিধান দ্বারা বিধৃত দাম্পত্য প্রেম, তুমিই মানব-সন্তান বৃদ্ধির একমাত্র উৎস, স্বর্গ ও মর্ত্যের সকল জীবের তুমিই একমাত্র প্রকৃত উৎপাদনকারী। তোমারই দ্বারা ব্যভিচারী ও অবৈধ কামনা-বাসনাগুলি মানবজাতির মন থেকে বিতাড়িত ও বিদূরিত হয়ে পশুদের জগতে চলে যায়। তুমিই সকল প্রেমের মধ্যে যুক্তিবোধ, সততা, বিশ্বস্ততা, ন্যায়পরায়ণতা, পবিত্রতা প্রভৃতি সদ্গুণগুলি প্রবর্তন করো। তোমারই

সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। তোমার উপর কোন পাপদোষ আরোপ করে বা কোন অন্যায়ে অভিযুক্ত করে তোমাকে এই পবিত্রতম স্থানের অনুপযুক্ত হিসাবে পরিগণিত করতে পারি না আমি। তুমি সকল পারিবারিক সম্পর্কের মাধুর্যের স্থায়ী উৎস।

হে দাম্পত্য প্রেম, তোমার শয্যা চিরনিষ্কলুষ ও চিরপবিত্র। সাধু ব্যক্তিরা ও ধার্মিক পিতারা এই শয্যায় শয়ন করেই সৎপুত্রদের জন্মদান করে থাকেন।

এই পবিত্র দাম্পত্য প্রেম কখনো সুবর্ণ বাণ নিক্ষেপ করে, কোথাও তার স্থিরোজ্জ্বল প্রদীপটি জ্বালিয়ে দেয়। কখনো বা নীল পাখা মেলে কল্পনার আকাশে উড়ে চলে। এই দাম্পত্য প্রেমের শুচিতা ও বিশ্বস্ততা কখনো অর্থলোলুপ ব্যভিচারিণী রমণীদের কৃত্রিম হাসিতে অথবা চটুল নৃত্যগীত ও তরল আমোদ-প্রমোদে প্রমত্তচিত্ত অভিজাত সমাজের নর-নারীদের মধ্যে পাওয়া যায় না। অথবা কোন ক্ষুধার্ত প্রেমিকা তার গর্বিত প্রেমিকের কাছে যে গান গায় সেই গানের প্রাণহীন সুরের মধ্যেও প্রেমের কোন শুচিতা আশা করা যায় না।

এই পবিত্র দাম্পত্য প্রেমে চিরবিশ্বস্ত আমাদের আদি পিতামাতা আদম ও ঈভ পরস্পর নগ্ন ও আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় সেই নিভৃত কুঞ্জবনের মধ্যে তৃণশয্যায় শয়ন করে নাইটিঙ্গেল পাখির গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লেন। কুঞ্জগৃহের কুসুমাস্তীর্ণ চন্দ্রাতপ হতে গোলাপ ঝরে পড়তে লাগল।

হে দম্পতিযুগল, তোমরা সুখে নিদ্রা যাও। তোমরা যে পরম সুখে সুখী তার থেকে বেশি সুখ আর চেও না। তোমরা যা জান তার থেকে আর বেশি কিছু জানতে চেও না।

রাত্রির প্রহর তখন অতীতপ্রায়। চন্দ্র সবেমাত্র আকাশস্থ তার যাত্রাপথ অর্ধাংশ। পরিক্রমা করেছে। এমন সময় নৈশ প্রহরায় নিযুক্ত চেরাবিম জাতীয় দেবদুতেরা যুদ্ধের বেশে এসে নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়াল।

গ্যাব্রিয়েল তার পাশের আর এক দেবদূতকে বলল, শোন উজ্জীয়েল, তোমাদের দলের অর্ধেক সংখ্যক দেবদূত দক্ষিণ প্রান্তে প্রহরা দিক। আর একদল উত্তর দিকে প্রহরা দিতে থাক। আমাদের দল থাকবে পশ্চিম দিকে।

সঙ্গে সঙ্গে দেবদূতরা বাণ, বর্শা প্রভৃতি অস্ত্র হাতে এক একটি অগ্নিশিখার মত চলে গেল। এরপর ইথুরিয়েল ও জেফন নামে দুজন বলিষ্ঠ দেবদূতকে ডাকল গ্যাব্রিয়েল।

তাদের উপর এক কার্যভার দিয়ে বলল, ইথুরিয়েল ও জেফন, তোমরা তোমাদের পাখায় ভর দিয়ে উড়ে সারা উদ্যানটা খুঁজে দেখ। কোন জায়গা বাদ রাখবে না। বিশেষ করে যেখানে দুজন মানব-মানবী নিশ্চিন্ত নিদ্রায় অভিভূত হয়ে আছে। আজ বিকালে সূর্যের অস্তগমনকালে নরকের কোনও এক শয়তান নরকের কারাগার থেকে অসদুদ্দেশ্যে পালিয়ে এখানে উঠে এসেছে। সে কোথায় লুকিয়ে আছে খুঁজে বার করো। তাকে ধরে নিয়ে এস এখানে।

এই বলে গ্যাব্রিয়েল তার জ্যোতির্ময় মূর্তিতে চন্দ্রের উজ্জ্বলতাকে ম্লান করে তার নিজের কাজে চলে গেল। অন্য দুজন দেবদূত শয়তানের সন্ধানে কুঞ্জবনের দিকে চলে গেল। কুঞ্জবনে তারা গিয়ে দেখল সেই পলাতক শয়তান এক সাপের রূপ ধরে ঈভের কানে কানে কি বলছে। এইভাবে শয়তান এক হীন অপকৌশলের দ্বারা ঈভের কল্পনাকে নাড়া দিয়ে তার মধ্যে যত সব ভ্রান্ত আশা ও স্বপ্ন সঞ্চারিত করার চেষ্টা করছে। এক অবৈধ ও নীতিবিগর্হিত অভিলাষের বিষ তার কানের মধ্যে ঢেলে তার জৈব সত্তার মধ্যে প্রবাহিত বিশুদ্ধ রক্তের ধারাকে কলুষিত করে দিচ্ছে। এইভাবে ঈভের মধ্যে ঘুমের ঘোরে জাগল কতকগুলি বিক্ষুব্ধ চিন্তা। জাগল ব্যর্থ আশা, ব্যর্থ লক্ষ্য, অসঙ্গত কামনা-বাসনা আর এক মিথ্যা আহঙ্কার আর আত্মম্ভরিতার ঊর্ধ্বচাপ।

ইথুরিয়েল তখন তার বর্শা দিয়ে শয়তানকে মৃদুভাবে স্পর্শ করল। কোন মিথ্যা বা মিথ্যাবাদী স্বর্গের রোষকশায়িত স্পর্শ সহ্য করতে পারে না।

শয়তান বিস্ময়ে চমকিত হয়ে উঠে দাঁড়াল ব্যস্ত হয়ে। নাইগ্রীস পাউডারের স্থূপে কোন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ পড়লে বারুদের স্পর্শে যেমন আগুন জ্বলে ওঠে, তেমনি শয়তান ক্রোধে জ্বলে উঠে তার আসল মূর্তি পরিগ্রহ করে দেবদূত দুজনের সামনে এগিয়ে গেল। দেবদূতদ্বয়ও অকস্মাৎ নরকের শয়তানরাজকে স্বর্গলোকের উদ্যানে দেখে বেশকিছুটা বিস্মিত না হয়ে পারল না।

তবু তারা কোনরূপ ভয় না পেয়ে অবিচলিতচিত্তে শয়তানরাজকে বলতে লাগল, নরকে নির্বাসিত কোন বিদ্রোহী আত্মা, তুমি নরকের কারাগার ভেঙে এখানে পালিয়ে এসে ছদ্মরূপ ধারণ করে প্রাচীর লঙ্ঘনকারী তস্করের মত এখানে সুখনিদ্রায় অভিভূত দুজনের মাথার কাছে বসে কি করছিলে?

শয়তানরাজ তখন ঘৃণাভরে বলল, আমাকে তোমরা জান না? চিনতে পারছ না আমায়? একদিন তোমরা যেখানে উঠতে পারতে না সেই সুউচ্চ গৌরবের আসনে আমি যখন সমাসীন থাকতাম তখন তোমরা আমার সঙ্গে কথা বলতে বা আমার কাছে যেতে সাহস পেতে না। আর আজ কিনা বলছ আমাকে তোমরা চেনই না। আর চিনতে যদি পেরেই থাক তবে বৃথা জিজ্ঞাসা করে কি লাভ?

দেবদূত জেফন তখন ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যুত্তর দিল, হে বিদ্রোহী আত্মা! তুমি যেন ভেবো না, একদিন স্বর্গবাসকালে যে উজ্জ্বল মূর্তিতে অক্ষুণ্ণ গৌরবে প্রতিষ্ঠিত ছিলে, আজও তোমার সেই মূর্তি আছে। তখন তোমার মধ্যে যে ন্যায়পরায়ণতা, সততা ও পবিত্রতা ছিল এখন তা নেই। আজ তুমি সে স্বর্গলোক হতে নির্বাসিত। আজ তোমার পাপ, নারকীয় অন্ধকারের কুটিলতা মূর্ত তোমার মধ্যে। যাই হোক, এখন চল, যিনি আমাকে এই স্থানের প্রতিরক্ষা ও পবিত্রতা রক্ষার কাজে নিযুক্ত করেছেন, যিনি আমাদের এখানে তোমার সন্ধানে পাঠিয়েছেন, তুমি তার কাছে গিয়ে তোমার আসার কারণ ও যাবতীয় বিবরণ দান করবে।

চেরাব জাতীয় সেই দেবদূত এই কথা বলল। তার এই তীব্র ভর্ৎসনা তার যৌবনসমৃদ্ধ চোখমুখকে এক বিশেষ দ্যুতির দ্বারা উজ্জ্বল করে তুলল আরও। অপ্রতিরোধ্য করে তুলল তার ভর্ৎসনার আবেদনটিকে। লজ্জারুণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইল শয়তানরাজ। সে বুঝতে পারল সততা ও সাধুতার তেজ কত ভয়ানক। দেখল স্বর্গীয় গুণাবলী তার দেহে কত সুন্দরভাবে প্রকটিত। হারানো গৌরবের কথা ভেবে দুঃখে জর্জরিত হয়ে উঠল সে। এক তীব্র অনুশোচনা জাগল তার মধ্যে। তার এই গৌরবহীন হতশ্লান অবস্থায় তার অলক্ষ্যে অজান্তে দেবদূতরা তাকে দেখে ফেলায় লজ্জাভিভূত না হয়ে পারল না সে। তবু সে দমল না কিছুমাত্র। তবু হার মানল না দেবদূতদের কাছে।

সে বলল, লড়াই যদি করতে হয় তাহলে সামনে সামনে করাই ভাল। যে তোমাদের পাঠিয়েছে আমার যা কিছু বাদ-প্রতিবাদ হবে তার সঙ্গে, প্রেরিত তোমাদের সঙ্গে নয়। তাতে হয় অধিকতর গৌরব অর্জন করব অথবা অধিকতর ক্ষতিকে বরণ করে নেব।

জেফন তখন বলল, যদি তুমি আমাদের সঙ্গে যাও তাহলে আমাদের এই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য বিচারের সম্মুখীন হতে হবে না। আর যদি না যাও তাহলে তুমি যত বড়ই দুবৃত্ত হও তোমার সঙ্গে আমাদের অবশ্যই যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে হবে।

আর কোন কথা বলল না শয়তানরাজ। রাগের আবেগে এমনই অভিভূত হয়ে পড়েছিল যে কোন বাক্যস্ফুর্তি হলো না তার মুখে। বল্লাবিদমিত দর্পিত অশ্বের মত সে উদ্ধতভাবে এগিয়ে চলতে লাগল দেবদূতদ্বয়ের সঙ্গে।

শয়তান বুঝতে পারল, এ অবস্থায় বলপ্রয়োগের চেষ্টা অথবা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা বৃথা। ঊর্ধ্বলোকের ঐশ্বরিক শান্তির ভয় অবদমিত করল তার অন্তরের ক্ষোভকে। এ ছাড়া অন্য কোন ভয় তার ছিল না।

ক্রমে তারা পশ্চিম প্রান্তে এসে উপনীত হলো। প্রহরারত দেবদূত বাহিনী তাদের দেখতে পেয়ে ঘিরে দাঁড়াল। তাদের কর্তব্যকর্ম সম্বন্ধে নির্দেশের অপেক্ষা করতে লাগল।

তখন তাদের প্রধান গ্যাব্রিয়েল তাদের বলল, বন্ধুগণ, আমি এই পথে কাদের। পদশব্দ শুনে চকিত হয়ে দেখি ইথুরিয়ের ও জেফনের সঙ্গে তৃতীয় এক ব্যক্তি আসছে। সে ব্যক্তির মধ্যে কোন স্বর্গীয় দ্যুতি নেই, তার ভয়ঙ্কর আচরণ থেকে বোঝা যাচ্ছে। সে নরকপ্রদেশের উদ্ধত রাজা! তার চোখের দৃষ্টির মধ্যে প্রকটিত ঔদ্ধত্যের ভাব থেকে বেশ বোঝা যাচ্ছে বিনা যুদ্ধে যাবে না সে এখান থেকে। সুতরাং প্রস্তুত হয়ে দাঁড়াও।

গ্যাব্রিয়েলের কথা শেষ হতে না হতেই ইথুরিয়েল ও জেফন শয়তানকে ধরে এনে বলল কাকে তারা এবং কিজন্য ধরে এনেছে এখানে, কিভাবে তারা দেখতে পায় তাকে এবং কিভাবে সে এক সাপের রূপ ধারণ করে ঘুমন্ত ঈভের কানে কানে কি বলছিল।

গ্যাব্রিয়েল তখন কঠোর ভাষায় শয়তানরাজকে বলতে লাগল, হে শয়তানরাজ, কেন তুমি নরকপ্রদেশের নির্ধারিত সীমানা লঙঘন করে এখানে প্রহরারত দেবদূতদের বিব্রত করতে এসেছ? স্বর্গলোকের সীমানার মধ্যে তোমার এই অবৈধ ও উদ্ধত প্রবেশ সম্পর্কে তোমার কাছ থেকে জবাবদিহি চাইবার অধিকার এবং ক্ষমতা আমাদের আছে। ঈশ্বরের বিধানে এখানে যারা সুখনিদ্রায় অভিভূত আছে তাদের নিদ্রাভঙ্গের কাজে ব্যাপৃত দেখেছে তোমাকে প্রহরীরা। তোমার এই ন্যায়নীতি লঙ্ঘনের কাজকে যে কেউ সমর্থন করবে না এখানে তা কি জান না তুমি?

একথা শুনে ঘৃণায় তার ভ্রুযুগল কুঞ্চিত করে শয়তান বলল, গ্যাব্রিয়েল, স্বর্গে তোমাকে জ্ঞানী বলে সবাই শ্রদ্ধা করে। আমিও এতদিন তাই করতাম। কিন্তু তোমার এই প্রশ্ন সংশয়ান্বিত করে তুলেছে আজ আমার সেই ধারণাকে। এমন কেউ কি কোথাও আছে যে অন্তহীন সীমা-পরিসীমাহীন যন্ত্রণা ও বেদনাকে ভালবাসে? আর যদি তুমি আমার এই অবস্থার মধ্যে পড়তে তাহলে তুমিও আমার মত সব ন্যায়-নীতি লঙঘন করে সেই যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তিলাভের আশায় এমন এক দূরবর্তী স্থানের সন্ধান করতে যেখানে সমস্ত পীড়ন ও যন্ত্রণা পরিণত হবে আরাম আর স্বাচ্ছন্দ্যে। যেখানে সমস্ত দুঃসহ দুঃখক্লেশ পরিণত হয়ে উঠবে এক নিবিড়তম সুখানুভূতিতে। জানবে আমিও সেই সুখের সন্ধানেই এসেছি এখানে। তোমার মধ্যে আছে শুধু ভাল-মন্দের এক অন্ধবোধ, নেই কোন যুক্তিবোধ। কোন মন্দ বা অশুভ অবস্থার মধ্যে, কোন দুঃখকষ্টের মধ্যে জীবনে পড়নি তুমি।

বল, তুমি কি আমাদের এই অসহনীয় কারাবাস সম্বন্ধে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে? পারবে না। বরং সেই নরকের লৌহদ্বারগুলিকে আরও দৃঢ়ভাবে রুদ্ধ করতে বলবে, যদি তিনি সেখানে আমাদের অবস্থানকে দীর্ঘায়িত করতে চান। এরা আমাকে যেখানে এবং যা করতে দেখেছে তা সত্য। তোমার প্রশ্নের উত্তরে আমি শুধু এই কথাই বলতে চাই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমি কোন ক্ষতি করেছি বা করতে চেয়েছি।

শয়তানের কথা শেষ হলে যোদ্ধাবেশে গ্যাব্রিয়েল মুখে কিছুটা হাসি ফুটিয়ে ঘৃণার সঙ্গে বলল, যে স্বর্গচ্যুত সে কিনা জ্ঞানীর মত বিচার করছে। যে নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য নরকে নিক্ষিপ্ত ও নির্বাসিত হয় সে সেই নরকের কারাগার থেকে কোন্ সাহসে পালিয়ে এসেছে এখানে তাকে তা জিজ্ঞাসা করায় আমাদের জ্ঞানের বিচার করছে। তার নির্বাসনদণ্ড অমান্য করে বিনা ছাড়পত্রে নরক থেকে ও নাকি যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে আসাটাকে ও জ্ঞানের পরিচায়ক হিসাবে প্রচার করছে। এইভাবে ও বিধিনির্ধারিত শাস্তিকে পরিহার করে এসেছে জোর করে।

হে দুঃসাহসী বীর, ঠিক আছে, বিচার করে যাও আমাদের। তারপর দেখবে তোমার এই পালিয়ে আসার জন্য দণ্ডদাতার রোষ সাতগুণ হয়ে উঠছে। তোমার নরকবাসের যন্ত্রণা যত তীব্ৰই হোক তাঁর রোষের সমান হতে পারবে না তা কখনো। তাঁর রোষকশায়িত দণ্ড আবার তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে নরকে।

কিন্তু তুমি একা কেন? তোমার নরকবাসী সঙ্গীরা কি নরকের কারাগার ভেঙে পালিয়ে আসেনি? তাদের কাছে কি নরকযন্ত্রণা কম অনুভূত হয়? তাই কি তারা পালিয়ে আসেনি? অথবা তাদের থেকে তোমার সহ্যশক্তি কম? হে সাহসী শয়তানরাজ, যদি তুমি তোমার এই পালিয়ে আসার কারণ তোমার সেই নির্বাসিত অনুচরদের বলতে তাহলে তারা তোমাকে একা আসতে দিত না এখানে। তারাও সকলে নরকযন্ত্রণা হতে মুক্তিলাভের আশায় পালিয়ে আসত এখানে।

তখন শয়তানরাজ আরও কঠোরভাবে কুটি করে বলল, হে অপমানকারী দেবদূত, আমার সহ্যশক্তি কারো থেকে কম নয়, যন্ত্রণার ভয়ে ভীত বা কাতরও নই আমি। তুমি জান আমার শক্তি কতখানি। তুমি দেখেছ একদিন যুদ্ধের মাঝে কেমন ভয়ঙ্কর ও অবিচলভাবে দাঁড়িয়ে সাহায্য করেছিলাম তোমাকে। যে বজ্রগর্জন শুনে ও বজ্রাগ্নি দেখে ভয় পেয়ে সবাই পালিয়ে যায় আমি তাতে ভয় পাইনি। কোন বর্শাফলক ভীত করতে পারেনি আমাকে। আমি ছিলাম নির্ভীক এবং দুর্জয়। তুমি সেকথা জেনেও জানার ভান করছ।

আমি কিন্তু আজও তেমনি নির্ভীক আছি। তাই আমি নতুন কোন আশ্রয়ের সন্ধানে কোন অনুচরকে না পাঠিয়ে নিজে অজানার পথে শূন্যে ঝাঁপ দিই। নিজে কোন বিপদের ঝুঁকি না নিয়ে বসে থেকে আমার অধীনস্থ কারো উপর বিপদের বোঝা চাপিয়ে দিইনি। তাহলে দেখছ, নেতা হিসাবে আমি কতখানি বিশ্বস্ত।

ঈশ্বরের সৃষ্ট এই নতুন জগতে আমাদের নতুন বাসভূমি গড়ে তুলতে চাই আমি। আমার বিপর্যস্ত শক্তিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চাই এই পৃথিবীতে। তারই সন্ধানে এসেছি আমি। এই মর্ত্যভূমি অথবা স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝখানে কোন শূন্যলোকে কোন বাসভূমি গড়ে তোলা যায় কিনা তাও দেখব আমি। কিন্তু এ জগতের দখলাধিকার বিনা যুদ্ধে পাব না আমি। তবে তোমাদের কাজ তো শুধু ঈশ্বরের সিংহাসনের চারপাশে দাঁড়িয়ে ঈশ্বরের স্তোত্ৰগান করা। ঈশ্বরের জয়গান গাওয়াই হলো তোমাদের কাজ। যুদ্ধ করা তো তোমাদের কাজ নয়।

তা শুনে দেবদূতসেনা গ্যাব্রিয়েল বলল, কি করে একটা কথা বলে পরমুহূর্তেই তা অস্বীকার করো তুমি? প্রথমে তুমি বললে দুঃসহ নরকযন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরেই পালিয়ে এসেছ তুমি, আবার পরমুহূর্তেই বললে সব বিপদের ঝুঁকি নিয়ে এক বিশ্বস্ত নেতা হিসাবে নতুন বাসভূমির সন্ধানে এখানে এসেছ এবং কোন যন্ত্রণার ভয়ে ভীত বা নত নও তুমি। কোন নেতার মুখে কখনো এ কথা শোভা পায় না। কোন নেতা এমন কথা বলে না। মিথ্যাবাদীরাই এমন কথা বলে।

শয়তান, তুমি আর যাই বল, ‘বিশ্বস্ততার কথা তুলে বিশ্বস্ততা’ নামক শব্দকে কলুষিত করো না। তুমি বিশ্বস্ত কার কাছে? মোর বিদ্রোহী অনুচরবৃন্দের কাছে। একদল শয়তান যাদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত শুধু শয়তানিতে ভরা, তাদের কাছে তোমার সমস্ত শৃংখলাবোধ ও বিশ্বস্ততা সীমাবদ্ধ। যিনি পরম ঈশ্বর, সর্বস্বীকৃত সর্ববন্দিত পরম শক্তি তাঁর প্রতি তোমার সমস্ত সামরিক আনুগত্য ও বিশ্বস্ততা নস্যাৎ করে তুমি সেই ধর্মভ্রষ্ট, নীতিভ্রষ্ট শয়তাদের কাছে শুধু বিশ্বস্ত? এক সুচতুর ভণ্ডরূপে তুমি আজ মুক্তির দূত হতে চাইছ, অথচ তুমিই একদিন স্বর্গের রাজার কাছে ক্রীতদাসের মত তাঁর প্রতি অনুরক্ত ছিলে এবং তাঁর পদলেহন করতে। তবে কি সেই স্বর্গাধিপতিকে সিংহাসনচ্যুত করে নিজে স্বর্গে রাজত্ব করার জন্যই তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলে?

সে যাই হোক, এখন আমার কথা শোন, দূর হয়ে যাও এখান থেকে। যেখান থেকে পালিয়ে এসেছ সেখানেই উড়ে চলে যাও। এই মুহূর্তে যদি তুমি এখান থেকে চলে না যাও, যদি তোমাকে স্বর্গের এই পবিত্র সীমানার মধ্যে দেখতে পাই তাহলে তোমাকে শৃংখলে আবদ্ধ করে টানতে টানতে আমি নরকের কারাগারে দিয়ে আসব। সে কারাগারের দ্বার এমন কঠোরভাবে রুদ্ধ করে আসব যে আর তুমি কোনদিন সে দ্বার ভেঙে কোথাও পালাতে পারবে না।

এইভাবে শয়তানরাজকে ভীতি প্রদর্শন করল গ্যাব্রিয়েল। কিন্তু শয়তান তাতে কর্ণপাত করল না। সে আরও ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, হে চেরাব নামে সীমান্তরক্ষী যদিও দেবদূত, যদিও তুমি আমাকে তোমার বন্দী ভেবে শৃংখলাবদ্ধ করার ভয় দেখাচ্ছ। কিন্তু তাহলে জেনে রেখো, তার থেকেও ভারী আমার লৌহকঠিন বাহুর চাপ সহ্য করতে হবে তোমায়, যদিও স্বর্গের রাজা তোমার পাখার উপর চড়ে গমনাগমন করেন এবং যদিও অন্যান্য দেবদূতদের সঙ্গে তোমাকে স্বর্গের নক্ষত্রখচিত পথের উপর দিয়ে স্বর্গরাজ্যের রথচক্র টেনে নিয়ে যেতে হয়।

শয়তান যখন এইসব বলছিল তখন দেবদূত সেনারা তাদের অস্ত্র শানিয়ে ও বর্শা উঁচিয়ে শয়তানের দিকে এগিয়ে এল। তাদের সামনে নির্ভীক অবস্থায় মনের সমস্ত শক্তি সংহত করে আটনাস পর্বতের মত দাঁড়িয়ে রইল শয়তানরাজ। তার হাতেও ছিল বর্শা এবং বাণ।

সে সময় উভয়পক্ষে যদি যুদ্ধ হত তাহলে হয়ত ধ্বংসের তাণ্ডব নেমে আসত সমগ্র স্বর্গলোকে। সব কিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যেত।

এমন সময় ঈশ্বর একটি দাঁড়িপাল্লা নিয়ে শয়তানের ভাগ্য নির্ধারণ করার জন্য দুদিকে নিক্তি ঝুলিয়ে দাঁড়িপাল্লা ধরে বসলেন। দুটি নিক্তির একটিতে ছিল শয়তানের ভাগ্য আর ভবিষ্যৎ আর একটিতে ছিল স্বর্গের ভাগ্য।

এখন দেখা গেল শয়তানের ভাগ্যের নিক্তিটি হাল্কা হয়ে উঠে গেল অনেকটা।

গ্যাব্রিয়েল ঊর্ধ্বে তাকিয়ে তা দেখে শয়তানকে বলল, শয়তান, আমি জানি তোমার শক্তি কতখানি এবং তুমিও জান আমার শক্তি কতদূর। সুতরাং আর অস্ত্র নিয়ে আস্ফালন করে লাভ কি? কারণ আমাদের সকল শক্তিই ঈশ্বরের অধীন। তিনি ইচ্ছা করলে আমাদের সকল শক্তির উচ্ছ্বাসকে স্তব্ধ করে দিতে পারেন মুহূর্তে। যদি একবার প্রমাণ চাও তাহলে ঊর্ধ্বে তাকিয়ে দেখ। দেখ ঈশ্বরের দ্বারা বিধৃত দাঁড়িপাল্লায় তোমার ভাগ্যের দিকটি কত হাল্কা, কতখানি তা উপরে উঠে গেছে। তুমি বাধা দিতে চেষ্টা করলেও আসলে তোমার প্রভুত্বশক্তি কত কম।

শয়তানরাজ তা দেখেই নিজের অবস্থার কথা বুঝতে পেরে সেই মুহূর্তেই ক্ষোভের সঙ্গে বিড়বিড় করে কি বলতে বলতে পালিয়ে গেল স্বর্গলোক থেকে। তার সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্হিত হলো রাত্রির অন্ধকার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *