৩. ইসলাম-পূর্ব একেশ্বরবাদীগণ
মুসলিম লেখকগণ প্রফেট মোহাম্মদের পূর্বে আরবের যুগকে অন্ধকার বা অজ্ঞতার যুগ বলে উল্লেখ করেছেন শুধু প্রফেটের আশীর্বাদ ও সংস্কারকে উচ্চ আদর্শ তুলে ধরার জন্য।
কিন্তু আসলে ইসলাম আবির্ভাবের পূর্বে আরবে শক্তিশালী ধর্মীয় প্রভাব এমনকি একেশ্বরবাদ সারা পেনিনসুলাতে আরববাসীদের আলোকিত করেছিল। ইসলাম আবির্ভাবের পর, বলা যেতে পারে, আরো একটি স্টেজের আগমন হয় যা বহু কাল ধরে ধর্মীয়-সামাজিক জীবনে উন্নয়ন এনৈছে, বিশেষ করে পশ্চিম এশিয়ায় ও মধ্যপ্রাচ্যে এবং এটা এখনও চলছে।
কোরানে একাধিকবার বলা হয়েছে প্রফেট মোহাম্মদের পূর্বে আরবে কোনো প্রফেটের উদয় হয়নি। (৩২:২; ৩৬ : ৫) তবুও এতে বলা হয় কতকগুলো প্রফেট আগে পাঠানো হয়েছিল আরব গোত্রের কাছে একেশ্বরবাদ প্রচার করতে ও তাদের সমাজ সংস্কার করতে। এই সব প্রফেট একক ঈশ্বরের বাণী বহন করে এনেছিলেন এবং মূর্তিপূজার বিরুদ্ধবাদী ছিলেন এবং সেই সব দেশের লোকদের তাদের পুরানো প্রথাকে পরিহার করতে উৎসাহিত করেছিলেন। কিন্তু পরিবর্তে এই সব প্রফেট নির্যাতিত হন।
এরকম একজন প্রফেট ছিলেন (শোয়েব) ইনি মিদিয়ান গোত্রের কাছে যান (৭:৮৩)। মিদিয়ান ছিল উত্তর-আরবে। তিনি তাদের পুরানো প্রথা ছেড়ে আল্লাহর পথে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু মিদিয়ানবাসীরা শোয়েবের কথা মানেনি, ফলে তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় ভূমিকম্প দ্বারা। মিদিয়ান অধিবাসীরা বাইবেলে মিদিয়ানাইন বলে কথিত। (যাত্রা পুস্তক ২:১৫) এবং শোয়েব মুসার শ্বশুর জেখরো (Jethro) ছিলেন বলে তফসিরকারগণ মনে করেন। অন্য আর একজন প্রফেট ছিলেন হুদ। ওমান ও হাদ্রামাতের মধ্যে আদ গোত্রের নিকট প্রেরণ করা হয় (৭:৬৩)। এখানকার অধিবাসীগণ তার কথা শোনে নাই, এজন্য তাদের দুর্ভিক্ষ দিয়ে ধ্বংস করা হয়। কেউ কেউ ইহুদি ও আরবদের পূর্বপুরুষ এবারের (Ebar) সাথে মিল খুঁজে পান। অন্যেরা বলে আদি ছিলেন ইসমাইলের পুত্র হাদার (Hadar) (আদি পুস্তক ২৫:১৫)। হাদ্রামাতে হুদের মাজার আছে; যেখানে লোকজন এসে জিয়ারত করে থাকে, শিনি চড়ায়।
আদ গোত্রের পুরানো শাসকদের মধ্যে একজন ছিলেন অধার্মিক সাদ্দাদ। ইনি ইরাম নগরী নির্মাণ করতে আদেশ দেন (৮৯:৬)। এই নগরে বড় বড় মার্বেল পাথরের পিলার জুড়ে তিনি এখানে প্রতিদ্বন্দ্বী স্বর্গ গড়তে চেয়েছিলেন। যখন নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয় সম্রাট সাদ্দাদ ও আমাত্যবর্গ সেই নগরী দেখতে যান, কিন্তু দীর্ঘকাল যাত্রার সময় ধূলিঝড়ে তারা মরুর বালিতে ঢাকা পড়ে যান। আর স্বর্গ দেখা হয় না। লোককাহিনী হিসাবে ইরাম নগরী এখন নাকি অনেকের কাছে দৃশ্যমান মরু বালিতে কিন্তু লোকচক্ষুর অগোচরে। কেউ ইরামবাসীদের সাথে আরামিয়েনদের তুলনা করে থাকে এবং সাদ্দাদকে করে থাকে সিরিয়ান সম্রাট প্রথম বেনহাদাদের সাথে (১ কিং ১৫:১৮-২০)।
তৃতীয় প্রফেট হচ্ছেন সালিহ (৭:৭১) পশ্চিম আরাবিয়ায় সামুদ গোত্রের কাছে ধর্ম প্রচারে গিয়েছিলেন। এদের কথা উল্লেখ আছে ৭১৫ খ্রিঃপূর্বাব্দে দ্বিতীয় সারগনের সময়ে উৎকীর্ণ এক শিলালিপিতে। এরা এসিরিয়া রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। কোনো কোনো পণ্ডিত ব্যক্তি বলেছেন যে আরিফাক্সাদ (Arphaxad)-এর পুত্র সালাহর সাথে সালেহ মিল খুঁজে পাওয়া যায় (আদি পুস্তক ১০:২৪) এবং অন্যেরা বলেন জোকতানের পুত্র শেলেফ (Sheleph)-এর সাথে মিল আছে।
কোরেশরা যেমন প্রথম দিকে প্রফেট মোহাম্মদকে অস্বীকার করেছিল কোরানে তেমনি উল্লেখ আছে সামুদবাসীরা সালেহকে অস্বীকার করে। তারা বলেছিল সে আমাদের মতোই মানুষ, সে কোনো ওহি আনতে পারে না। একজন প্রতারক মাত্র (৫৪:২৫), একজন ভূতগ্রস্ত মানুষ (২৬:১৫৩)। এর জন্য তারা তাদের পূর্বপুরুষের ধর্ম পরিত্যাগ করতে পারে না। (১১৪৬৫) সামুদবাসীরাও ভয়ঙ্কর এক ভূমিকম্পে এই নগরীসহ ধ্বংস হয়ে যায়।
সামুদ অঞ্চলটি ছিল হিজর সামুদায় প্লিনি (Thamedaei of pliny)। বাইবেলে দেদানের নামে এই নগরীর রাজধানীর নাম দেদান ছিল (Gen. ২৫:২৩)। এই রাজধানী অবস্থিত ছিল মদিনা ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী উত্তর হেজাজে। হিজরের অন্য একটা নাম ছিল মাদাই সালিহ-অর্থ সালিহর শহর। হিজর কোরানের একটি সূরার (Chapter) নাম।
পরবর্তীতে সামুদ অঞ্চল লিহিয়ানরা শাসন করেছে প্রায় ১৫৩ বছর ধরে লোহিত সাগরের পশ্চিম দিক ঘিরে। এদের প্রধান শহর ছিল এলওলা (Elola), তাইমা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে আশি মাইল দূরে। লিহিয়ান শাসকদের মধ্যে একজন নারীসহ আট জন ছিল। এদের মধ্যে একজনের নাম তুলমে, এতে মনে হয় এরা টলেমিদের সময়কার লোক (Irvine in wiseman, 1973, P. 299)। এলওলা প্রধান শহরের চারদিক ঘিরে হেলেনিক স্টাইলে পাথরের খোদাই করা চেম্বার ছিল। হেলেনিক কাঠামোর উপাসনালয়ও ছিল; আর ছিল দক্ষিণ আরাবি লিপিতে পাথরে উৎকীর্ণ লিখন। এইসব উৎকীর্ণ লিপির প্রকৃতি ছিল একেশ্বরবাদী- এর থেকে মনে হয় এখানে হিব্রুদের প্রভাব ছিল।
৩.১ হানিফ
প্রাক-ইসলামী যুগে একেশ্বরবাদীকে সাধারণত হানিফ বলা হতো। হানিফ শব্দটি সিরিয়ান ক্রিশ্চান থেকে ধার করা। এর অর্থ হচ্ছে সেই সব মানুষ যারা পৌত্তলিকতা পরিত্যাগ করে এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী। ইসলামের প্রাথমিক যুগে হানিফ শব্দকে ঘিরে চার ধর্ম আবর্তিত; যেমন জোরাস্ত্রিয়ান, ইহুদি, খ্রিস্টান ও সাবিয়েন। এরা সকলেই বিশেষভাবে কোরানে স্বীকৃতি পেয়েছে (২২ : ১৭) [সাবিয়ান অবশ্য সাবার অধিবাসী সাবিয়েনদের থেকে পৃথক ধরা হয়।]
সাবিয়ান শব্দটি শিথিলভাবে ব্যবহৃত হয় কয়েক গ্রুপের লোকজনদের জন্য যারা সেথ, ইনোক (ইদ্রিস) বা নোয়াহ ধর্ম পালন করত; পশ্চিম ইরাকের জ্ঞেয়বাদী (Gnostic) জুদো-খ্রিস্টান ব্যাপ্টাইজড গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠী এখনও এই অঞ্চলে টিকে আছে মান্দায়েন নামে এবং যারা তাদের বিশ্বাস ত্যাগ করে অন্য ধর্মে চলে গেছে যেমন প্রফেট মোহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীরা যাদের প্যাগন সমসাময়িক গোত্ররা সাবিয়ান বলত। (Hughes, 1799P557)
সাধারণভাবে সাবিয়ান শব্দটি প্রযোজ্য হতো প্রাচীন আরমাইকভাষী উত্তর মেসোপটেমিয়ার হারবানবাসীদের জন্য। বাইবেলে এই শহরের নাম প্রায়ই উল্লেখিত হয়েছে (আদিপুস্তক-১১ : ৩১)। হারবানবাসীরা নক্ষত্র পূজা করত ও এঞ্জেলদের শ্রদ্ধা-মান্য করত। সেলুসিডদের সময় এই সাবিয়েনরা হেলোনস্টিক প্রভাবে ছিল- হারবান চার্চ ফাদারদের কাছে হেলেনোপলিস বলে পরিচিত ছিল। এরা বিজ্ঞান বিষয়ক নিয়ে লেখাপড়া করত। অনেক যুগ ধরে এরা ইসলামের অধীনে ছিল এবং ইসলামী সভ্যতায় এদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। একজন বিশপের অধীনে হাররানে একটি খ্রিস্টান (মনোফিসাইট) কমিউনিটি ছিল।
ইহুদি বা খ্রিস্টান প্রভাবে আরব গোত্রে পঞ্চম শতাব্দিতে দেখা দিতে শুরু করে ‘হানিফ’ সম্প্রদায় এবং এরা স্থানীয় সংস্কারক ছিলেন। হানিফ এবং তাদের অনুসারীরা নিয়মসিদ্ধ সম্প্রদায় ছিল এবং এরা যা বিশ্বাস করত তাই শিক্ষা দিত। এদের মূল কর্মস্থল ছিল হেজাজ ও মক্কার শহর এলাকা। ইয়েথরেব (মদিনা) ও তায়েকও এদের কেন্দ্রস্থল ছিল এবং প্রফেটের সময় পর্যন্ত এই হানিফ সম্প্রদায় তাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল।
গাজার এক খ্রিস্টান ঐতিহাসিক সজোমেনাস (Sozomenus) মৃত ৪৪৩ লিখেছিলেন যে কিছু আরব ইসমাইলাইট যারা আব্রাহামের বংশধর বলে দাবি করত – চেষ্টা করত তাদের ধর্মে প্যাগন দুর্নীতি মুছে ফেলতে। তারা খোলাখুলিভাবে গোত্রের মানুষদের পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে সমালোচনা করত এবং চেষ্টা করত সংস্কার করতে যাতে আব্রাহামের ধর্ম (মিল্লাত ইব্রাহিম)কে পুনরুদ্ধার করা যায়।
সত্যের সন্ধানে হানিফরা আল্লাহর একত্বের ঘোষণা করত (তৌহিদ)। তারা ঈশ্বরকে আর-রহমান (দয়ালু) উপাধি দিয়েছিল, আর দিয়েছিল আর-রব (প্রভু) এবং আল গফুর (ক্ষমাশীল)। তারা রোজ কিয়ামত ও পুনরুত্থানে বিশ্বাস করত এবং সাধু ব্যক্তিকে স্বর্গবাসের কথা বলত; তারা দুষ্টদের দোযখ আজাবের কথা বলে মানুষদের সাবধান করত।
ইবন ইসহাকের মতে, হানিফরা বিশ্বাস করত যে তাদের সহযোগী আরবরা আব্রাহামের ধর্ম থেকে সরে গেছে এবং বলতে গেলে তাদের এখন কোনো ধৰ্মই নেই। তারা বহুবাদিতার বিরুদ্ধে, আল্লাত ও উজ্জার পূজার বিরুদ্ধে এবং কালো পাথরের পূজার বিরুদ্ধে মতবাদ প্রচার করত। তারা বলত পাথরের চারদিক ঘিরে তোমরা করছো কি? হে লোক সকল, আল্লাহর বা ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হও, বিশ্বাস আনো; পাথরের ওপর বিশ্বাস করে পূজো করে কোনো ফল হবে না। তারা অন্যান্য প্যাগন রীতিনীতির নিন্দাবাদ করত। যেমন জীবন্ত বালিকা শিশুদের জীবন্ত গোর দেয়া এবং তাদের এই প্রচারের কারণে এই জঘন্য প্রথা আস্তে আস্তে কমে আসছিল। তারা মানুষের দায়িত্ব সম্বন্ধে প্রচার করত। সত্য ধর্ম সম্বন্ধে ওকালতি করত। আর স্বচ্ছ নৈতিক জীবনযাপনের পক্ষে বলত। দুস্থদের প্রতি অনুদান, রোগীদের সেবা, দরিদ্রের সাহায্য করা, অনাথদের কল্যাণ, বিধবাদের নিরাপত্তা এবং অভাবীদের দুঃখ মোচন, দাস-দাসী ক্রয় এবং তাদের মুক্তি দেয়া হানিফদের প্রধান কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
খ্রিস্টান সাধুদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে হানিফরা নির্ধারিত সময়ে নিয়মিত প্ৰাৰ্থনা করত। কেউ কেউ তাদের মাথা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখত (দিথার), আরাধনায় সাহায্য করত এবং ঐশী বাণীতে আগ্রহী ছিল। এছাড়া ইহুদিদের তিসরি মাসে দশ দিন উপবাস পালন, খ্রিস্টান সাধুদের লেন্টের সময় শৃংখলা পালন ইত্যাদি দেখে তারা নিজেদের মধ্যেও আত্মশুদ্ধির চেষ্টা করত।
প্রত্যেক বছর পবিত্র রমজান মাসে তারা জাগতিক কাজকর্ম থেকে নিজেদের সরিয়ে সারা মাস আত্মশুদ্ধি করত, একে বলা হতো ‘তাহানুথ’। তারা মদ্যপান, যৌনকর্ম থেকে বিরত থাকত, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত প্রতিদিন উপবাস করত। ইবনে হিশাম ও অন্যান্য পণ্ডিত ব্যক্তিরা তাহানুথ শব্দ থেকে হানিফদের মতো সুশৃংখল জীবনযাত্রা নির্বাহের পদ্ধতি খুঁজে পান।
রমজান মাসে মক্কার হানিফরা শহরের চারদিকে পাহাড়ে ও গিরিগুহায় চলে যেত এবং নির্জনে মরুর অঞ্চলের নিস্তব্ধতার মাঝে নিজে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে স্বর্গীয় নৈকট্য লাভের চেষ্টা করত। এদের মধ্যে এই পদ্ধতি অনুসরণ করতেন প্রফেট মোহাম্মদের দাদা আবদুল মোত্তালেব। (মৃ. ৫৭৮ খ্রিঃ)। তার জীবনীকার আল জুহুরী (মৃ. ৭৪২) বলেন- আবদুল মোত্তালেব হেরা পর্বতের গুহায় উপবাস অবস্থায় নির্জনে আরাধনা করতেন। আবদুল মোত্তালেব যে হানিফ ছিলেন, আল জুহুরীর বক্তব্য থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়।
এটা স্পষ্ট যে প্রফেট মোহাম্মদের আবির্ভাবের অনেক পূর্ব থেকেই ইসলামের মৌলিক ধারণা মক্কার বাতাসে উড়ে বেড়াত এবং মক্কাবাসীদের প্রভাবিতও করেছিল। ওয়েলহসেন বলেন- প্রফেট মোহাম্মদের পূর্বে আরবে হানিফ সম্প্রদায় আরবে ইসলামের বর্তিকা প্রজ্বলিত করেছিল। স্প্রেঙ্গারের মতে Islam is the fruit of the, Hanif tradition- হানিফ ট্রাডিশনের ফলস্বরূপই ইসলাম, যার মূলাধার প্রফেট মোহাম্মদের সময় পর্যন্ত সারা আরবে বিস্তৃতি লাভ করেছে।
মুসলিম ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেছেন প্রথমে প্রফেট মোহাম্মদের সঙ্গী ছিলেন ১২ জন এবং তারা সকলেই হানিফ, এছাড়া আরো অনুসারী ছিলেন যারা হানিফ। তাদের মধ্যে ছিলেন ওসমান ইবন হোয়াইরিথ; তিনি ছিলেন আসাদ গোত্রের; জায়েদ ইবন আমর যার সঙ্গে মোহাম্মদের পরিচয় হয় ৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে; ওয়ারাকা যিনি সব সময়ে মোহাম্মদকে উৎসাহ দান করেছেন। ইয়াদ গোত্রের কসবিন সায়দা, ওবাইদুল্লাহ ইবন জাহান, তায়েফের উমাইয়া এবং আবু আমির- এরা দু’জনেই প্রফেটের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। আউস গোত্রের আবু কায়েস, প্রফেটের মদিনায় হিজরতের পর, ইনি হজরতের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী রূপে খাড়া হন এবং মৃত্যু পর্যন্ত এই অবস্থানে ছিলেন। কেউ কেউ বলেন ইনি পরে মুসলিম হন।
এই হানিফদের মধ্যে চার জন প্রফেটের আত্মীয়তা লাভ করেছেন, ওসমান ইবন হোয়াইরিথ, জাবেদ ইবন আমর, ওয়ারাকা এবং ওবাইদুল্লাহ এবং অনেকেই খ্রিস্টান ছিলেন। যেমন— ওসমান বিন হোয়াইরিথ, ওয়াক্কাস ইবনে মায়দা, ওবায়দুল্লাহ এবং সম্ভবত আবু আমির।
প্রফেট মোহাম্মদ নিজেই আব্রাহামকে হানিফ বলেছেন, কারণ তিনিই সর্বপ্রথম একেশ্বরবাদ প্রবর্তন করেন (২১:৫২)। কোরানে মুসলিমদের ইব্রাহিমের ধর্ম পালন করতে বলা হয়েছে (৩:৮৯)। তিনি ইহুদি ছিলেন না খ্রিস্টানও ছিলেন না (৩:৬০) ছিলেন হানিফ (১৬:১২১)।
এক সময়ে সব মুসলিমের জন্য হানিফ শব্দ ব্যবহর করা হয়েছে, কিন্তু যেহেতু প্রফেটের অনুসারীদের জন্য নির্দিষ্টভাবে এর প্রয়োগ ছিল না, এই শব্দের ব্যবহার পরবর্তীতে মুসলিম আরবে ইতিহাসভুক্ত হয়েছে।
৩.২ ইসলাম-পূর্ব ইহুদি
আরাবিয়ান ট্রাডিশন মতে মুসার সময় থেকে ইহুদিরা উত্তর আরবে বসতি করেছিল। তারপর অনেক ইহুদি নেবুচ্ছেদনজর, সেলুসিড ও রোমানদের নির্যাতন ও অত্যাচার এড়ানোর জন্য আরবে আশ্রয় নিয়েছে।
ঐতিহাসিকভাবে ইহুদিরা প্রফেট মোহাম্মদের জন্মের তিন শতাব্দি পূর্বে আরবে প্রবেশ করেছিল। ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমান টাইটাস-এর সময় জেরুজালেম মন্দির ধ্বংস হবার পর ইহুদিরা উত্তর আরবের লোকজনদের সাথে বসবাস করার জন্য এসেছিল। এর পরে কয়েক শতাব্দি ধরে ইহুদি গোষ্ঠী সারা আরব পেনিনসুলায় ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি দক্ষিণে হিমিয়ারে বসতি গেড়ে বসে এবং কিছু লোকজনকে ইহুদি ধর্মে দীক্ষিত করে।
৩১৫ খ্রিস্টাব্দে আবিসিনিয়ানরা হিমিয়ার দখল করলে হিমিয়ারইট শাসক (তুবা) ও তার পরিবারবর্গ ইথরেবে (মদিনায়) আশ্রয় গ্রহণ করে। তখন মদিনায় ইহুদি সম্প্রদায়ের বিরাট বসতি। হিমিয়ারে আবিসিনিয়ার দখল বেশি দিন ছিল না এবং ৩৭৫ খ্রিস্টাব্দে মালিক কারিব বলে এক আরব ইহুদি এবং তুব্বার আত্মীয়, হিমিয়ার থেকে বিদেশীদের তাড়িয়ে সে আরব বংশ পুনরুদ্ধার করে।
তার উত্তরাধিকারী ও পুত্র আসাদ আবু কারিব (মৃ. ৪১৫) ইথরেবে গিয়ে ইহুদি ধর্মে দীক্ষা নেয় এবং ফিরে এসে হিমিয়ারে ইহুদি ধর্মকে রাজধর্ম বলে ঘোষণা দেয়। (ফিলবি, ১৯৪৭, পৃঃ ১১৭)। আসাদ আবু কারিব এরপর উত্তর দিকে অভিযান চালিয়ে ইথরেব আক্রমণ করে প্যাগনদের উৎখাত করে ইথরের শহরকে ইহুদি শহরে পরিণত করার পরিকল্পনা নেয়। কিন্তু কোরাইজা গোত্রের দু’জন রাব্বি তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে এ পরিকল্পনা পরিত্যাগ করতে বলে।
যখন আসাদ এর পরিবর্তে মক্কা নগরী আক্রমণ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করে তখনও এই দু’জন রাব্বি এই অভিযানের বিরুদ্ধে পরামর্শ দেয়, কারণ দেখিয়ে বলে এই নগরী প্রাচীন পবিত্র নগরী, একে ধ্বংস করা উচিত হবে না। রাজা আসাদ তখন মক্কা নগরীতে উপস্থিত হয়ে ইয়েমেনি বস্ত্র দিয়ে কাবাঘরকে আচ্ছাদিত করে এবং এই সময় থেকে কাবাকে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখার প্রথা চালু হয়; একে কিয়া বা গিলাফ বলা হয়। (Esin 1963, পৃষ্ঠা ৫১)
ইহুদি ও খ্রিস্টান দক্ষিণ আরবে একসাথে ৫২৪ খ্রিঃ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করেছে যখন হিমিয়ারের আর এক ইহুদি রাজা আসাদ আবু কবিরের বংশধরধু-নুবাস আক্রমণ করে। এই প্রতিবেশী রাজ্য খ্রিস্টান পরিপূর্ণ। ফিমিউন নামে একজন এখানে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং বেশ উন্নতিও করেছিল। ধু-নুবাস নাজরান আক্রমণ করে খ্রিস্টানদের ওপর অত্যাচার শুরু করে এখনকার রাজা হারিথকে হত্যাও করে। আর যারা ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করতে অস্বীকার করে তাদের জ্বলন্ত কুণ্ডে নিক্ষেপ করে।
মনে হয় এ ঘটনা সম্বন্ধে কোরানের প্রাথমিক সূরায় উল্লেখ আছে। সেখানে বলা হয়েছে উহারা তাহাদিগকে নির্যাতন করিয়াছিল শুধু এই কারণে যে তাহারা বিশ্বাস করিত আল্লাহতে- ধ্বংস হইয়াছিল কুণ্ডের অধিপতিরা ইন্ধনপূর্ণ যে কুণ্ডে অগ্নি ছিল (৮৫ : ৪, ৫, ৮)। এতে বোঝা যায় যে কোরান খ্রিস্টানদের সত্যিকারের বিশ্বাসী বলে গণ্য করেছে, পরে অন্য ব্যাখ্যাকারীরা মনে করেন যে এখানে নবুচ্ছেদনজর যে তিনজন ইহুদিকে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করেছিল সেই কথা এখানে বলা হয়েছে (Dan. ৩ : ২০)।
ধু-নুবাসের অত্যাচারের ফলে যে মানুষটি প্রাণে বেঁচে যায় তার নাম দাউস ধুথালাবান; সে বাইজানটাইন সম্রাট ১ম জবাস্টিনের দরবারে পালিয়ে যায় এবং একটি অর্ধদগ্ধ গসপেল দেখিয়ে এর প্রতিশোধ নিতে বলে। সম্রাটের অনুরোধে ৫২৫ খ্রিস্টাব্দে আবিসিনিয়ার রাজার সৈন্যবাহিনী ধুনুয়াসকে আক্রমণ করে পরাজিত করে (পরে তারই প্রজাদের দ্বারা নিহত হয়)। বিজয়ী আবিসিনিয়ার রাজা সুমিয়াফাকে গভর্নর করে দেশে ফিরে আসেন। সুমিয়াফা পরে তার প্রতিদ্বন্দ্বী আবরাহা কর্তৃক গদিচ্যুত হয়।
৩.৩ ইসলাম-পূর্ব খ্রিস্টান
নিউ টেস্টামেন্টে বর্ণিত (Acts ২ : ১১) যে ইহুদি এক পর্বের দিনে (পেন্টিকস্ট) জেরুজালেমের উপস্থিত লোকজনদের মধ্যে কিছু আরাবিয়ান ছিল তারা প্রফেট বর্ণিত সু-সমাচার শুনছিল। সেন্ট পল লিখেছেন (গলসীয় ১ : ১৭) এই ঘটনার পর তিনি আরবে যান, কিন্তু সেখানে গিয়ে কি ঘটল তার বর্ণনা দেননি। সেন্ট পল সিনাই অঞ্চলে পেট্রাতে গিয়েছিলেন।
আরবে বহু পূর্ব থেকে কিছু ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান ছিল এবং তাদের মধ্যে কিছু নামকরা লোকও ছিল। বিজ্ঞে মোনাইমাস (মৃ. ১৮০) এবং সাধু ভেলেরিয়াস (২৫০ খ্রিঃ) অরিজেনের শিষ্য ছিলেন এবং ভেলেরিয়ান গোষ্ঠীয় প্রতিষ্ঠান। এই দুইজন আরব খ্রিস্টানদের মাঝে বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন এবং খ্রিস্টান চার্চে অবদানও রেখেছিলেন। সেন্ট সাইমন স্টাই লাইটস্ (মৃ. ৪৯৯) একজন আরব ছিলেন এবং তিনি গসপেলও প্রচার করেন।
মিশনারি ও সাধু-সন্ন্যাসীরা মধ্যপ্রাচ্যে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার করেছে এবং অনেকেই সেখানে পাকাপাকিভাবে ব্যবসা শুরু করে। (যেখানেই তারা বসতি করছে, সেখানেই চার্চ নির্মাণ করে মঠ তৈরি করেছে, বিধর্মীদের ধর্মান্তর করেছে, শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নতি সাধন করেছে এবং যে অঞ্চল তারা দখল করেছে সেখানে নিজেদের প্রভাব- প্রতিপত্তি বিস্তার করেছে। মিশনারি ছাড়া খ্রিস্টান ব্যবসাদার ও কারিগররা আস্তে আস্তে আরবের বড় বড় শহরে ছড়িয়ে পড়ে। তারা ছিল শান্তিকামী, পরিশ্রমী এ ধর্মের প্রতি নিবেদিত।
সিরিয়া, প্যালেস্টাইন ও মেসোপটেমিয়ায় প্রধান শহরে অনেক আরব বিশপের বাস ছিল এবং অনেক বিশপ তাদের আরবি নাম রেখেছিলেন। প্রফেট মোহাম্মদের জন্মের তিন শতাব্দি পূর্বে খ্রিস্ট ধর্ম আরব পেনিনসুলার রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছিল এবং ব্যাপকভাবে এর প্রসার ঘটেছিল। উত্তরে চার্চগুলো বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের মিশনারিরা প্রতিষ্ঠা করেছিল, দক্ষিণে হাদ্রামাত ও ওমানে চার্চ করেছিল ইন্ডিয়ান মিশনারিজ, ইয়েমেনে ও হিজাজে করেছিল আবিসিনিয়ার মিশনারিরা। ৬ষ্ঠ শতাব্দির মাঝামাঝি আরাবিয়া খ্রিস্টানদের, বলতে গেলে, কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়।
ইসলামের আবির্ভাবের এক শতাব্দি পূর্বে যিশু ও তার অনুসারীদের সম্বন্ধে ট্র্যাডিশন মধ্যপ্রাচ্য ও আরবে বহুল প্রচারিত ছিল। সিরিয়া ও প্যালেস্টাইনে খ্রিস্টানরা তাদের বিভিন্ন রকমের গসপেল, এমনকি গসপেলের বাইরের পুস্তকেও, যিশুখ্রিস্ট সম্বন্ধে বিভিন্ন কাহিনী তৈরি করে প্রচার করেছে। এই অঞ্চলের সাধারণ ভাষা ছিল সিরিয়াক (খ্রিস্টান আরামামাইক) এবং এই ভাষাতে তাদের বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে।
আলেক্সান্দ্রিয়া, রোম, কনস্ট্যান্টিনোপল এবং অন্যান্য স্থানে খ্রিস্টান ধর্মীয় বিভেদ ও মতবাদ সম্বন্ধে আরবের খ্রিস্টানরা অবহিত ছিল। সত্য বলতে কি, সিরিয়ান-খ্রিস্টান এর মধ্যে যে ভেদ বা দলাদলি তাকে ‘শিয়া’ (ফ্যাকশন) বলা হতো, এই শিয়া আরবি শব্দে ঢুকে দল বা গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। তবে মোটামুটিভাবে আরবে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে এই ধর্মীয় দলাদলি বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারেনি।
পূর্ব দেশীয় চার্চে খ্রিস্টানরা ছিল মনোফিসাইট (সিরিয়ান, কপটিক, আবেসিনিয়ান), ডিফাইসাইট (নেস্টোরিয়ান), এন্টি-মনোফিসাইট (মেলসাইট) আরিয়ান, নস্টিক (জ্ঞেয়) এবং মনিকিয়েন।
মনিকিয়েন গোষ্ঠী ছিল দ্বিত্ববাদী। এর প্রতিষ্ঠাতা একবাটানার মনি (মৃ. ২৭৬)। এর মিশনারি মধ্য এশিয়াতে বিস্তৃত ছিল- যে মনিকিয়েনিজম্ ৭৬২ সালে উইঘুর তুর্কিতে রাষ্ট্রধর্মে পরিণত হয়- পরে পূর্ব দিকে তিব্বতে প্রসার ঘটে (হফ ম্যান ১৯৬১ পৃঃ ৫২) এবং পশ্চিম দিকে নর্থ আফ্রিকা পর্যন্ত- এখানে সেন্ট অগাস্টিন এই ধর্মে দীক্ষা নেন। সেন্ট অগাস্টিন মারা যান ৪৩০ খ্রিঃ।
হিরা ও মেসোপটেমিয়াতে মনিকিয়েন কেন্দ্র ছিল এবং খোদ মক্কাতে এই মতবাদের ধারণা অজানা ছিল না। মনি দাবি করতেন যে তিনি যিশু প্রতিশ্রুত প্যারাক্লিট ছিলেন অর্থাৎ এডভোকেট বা আইনি উপদেষ্টা। তিনি আরও দাবি করতেন- তিনি শেষ ও ফাইনাল প্রফেট। এই প্রফেটের ধারায় বা সিলসিয়ায় (in prophetic succession) এবং তিনি ঐশীবাণী প্রাপ্ত। তিনি এমনও বলেন যে যিশু ক্রুশবিদ্ধ হননি, তার পরিবর্তে অন্য একজন হয়েছে। এই সব কথা বা বাক্য, অনেকের মতে, প্রফেট মোহাম্মদকে প্রভাবিত করেছে।
মনিকিয়েনদের ‘সিদ্দিক’ সত্যবাদী বলা হতো। প্রফেট মোহাম্মদ এই পদবি আবুবকরকে দিয়েছিলেন এবং কোরানেও একথা আছে (১৯৪৫৭) এনক বা ইদ্রিসকে উল্লেখ করে। মনিকিয়েনিদের মুসলিম খলিফারা বেশি হারে চাকরি দিয়েছে। কারণ এদের নিষ্ঠা, সততা, কর্তব্যের প্রতি একনিষ্ঠতা, নক্ষত্র বিষয়ে তাদের জ্ঞান, গণিতবিদ্যায় ও চিকিৎসাবিদ্যায় তাদের পারদর্শিতা এবং শিল্পকলায় তাদের দক্ষতা মুসলিমদের মুগ্ধ করত।
নেস্টোনিয়াস দ্বারা প্রতিষ্ঠিত খ্রিস্টান উপদল পারস্যতে প্রসার লাভ করে। নিস্টোনিয়াস মারা যান ৪৫১ খ্রিঃ। এরা যিশুখ্রিস্টের দ্বিত্ব প্রকৃতিতে বিশ্বাসী ছিল বলে কনস্ট্যান্টিনোপলের ধর্মগুরুরা তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, ফলে বাইজানটিয়ান থেকে তারা পারস্যে পালিয়ে যায়। খ্রিস্টের দ্বিত্ব প্রকৃতি সম্বন্ধে এদের ধারণা যে যিশুর মানুষ এবং স্বর্গীয় (divine) উভয় প্রকৃতি ছিল। পারস্য এদের স্বাগতম জানায় কারণ বাইজানটিয়াম এদের প্রতিদ্বন্দ্বী; তাই সাসানিয়ান সম্রাটের দ্বারা তারা উৎসাহিত হয়েছে। ৫৩১ খ্রিস্টাব্দে জান্দিশাপুরে নেস্টোরিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। দক্ষিণ- পশ্চিম পারস্যে জান্দিশাহপুরে এই বিশ্ববিদ্যালয় আদর্শ হিসাবে উমাইয়া খলিফারা অনুসরণ করেন।
নেস্টোরিয়ানরা তাদের ধর্মীয় মতবাদকে বহু দূর-দূরান্তে পৌঁছে দিয়েছিল এবং স্টেসিফোন (Ctesiphon) থেকে বেজিং-এর বাণিজ্য পথ তাদের পীঠস্থানে চিহ্নিত হয়েছিল। তারা ইন্ডিয়া ও সিংহলে ধর্মীয় স্কুল ও শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিল, এছাড়া কুর্দিস্তান, পারস্য, বেক্টেরিয়া, পার্থিয়া, সগদিয়ানা, স্কাইথিয়া, তুর্কিস্তান ও মঙ্গোলিয়া উপজাতি ভূমিতে তাদের ধর্ম ও শিল্পকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। তারা চীন ও জাপানে মিশনারিও পাঠিয়েছিল। (Rice, 1964, P. 12)। ৬৩৫ খ্রিস্টাব্দে নেস্টোরিয়ানের একটি মিশন চীনের রাজধানীতে পৌঁছলে চীন সম্রাটের বিজ্ঞপ্তিতে তা ঘোষিত হয়েছিল। (Diringer, 1977.9.286)।
৩.৪ সন্ন্যাসী
অনেক নিবেদিত খ্রিস্টান সাধু মধ্যপ্রাচ্যে দরিদ্র ও রুগ্ন ব্যক্তিদের সেবা ও কল্যাণময় কর্ম করেছেন, দান-ধ্যানও করেছেন। মধ্য আরবের খ্রিস্টান তামিম গোত্রের সাসা নামে এক মহান ব্যক্তি শিশুকন্যা ক্রয় করে তাদের জ্যান্ত কবর দেয়া থেকে বাঁচাত এবং পালনও করত। তার নাতি ফারাজদাক উমাইয়াদের সময়ে একজন বিখ্যাত কবি ছিলেন। তিনি গর্ব করে বলতেন তিনি তারই বংশধর যিনি বহু শিশুকন্যাকে কবরের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন।
গোঁড়া ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাসী খ্রিস্টানগণ শহুরে জীবন পরিত্যাগ করে মঠে সন্ন্যাস জীবনযাপন করত ঈশ্বরের আরাধনায়। মিশর, এশিয়া মাইনর, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, মেসোপটেমিয়া ও আরাবিয়া মরুভূমিতে এসব সন্ন্যাসীর পবিত্র স্থানের নিদর্শন পাওয়া যেত, এদের মধ্যে অনেকগুলোর নাম প্যাগন ও মুসলিম কাহিনীতে লিপিবদ্ধ আছে। পরবর্তীতে এই সব মঠের অনেকই মুসলিমরা তাদের ব্যবহারের জন্য বাসস্থানে রূপান্তর করে।
খ্রিস্টান মঠের জন্য আরবরা সিরিয়াক শব্দ ‘দাইর’ ব্যবহার করত এবং আরবের বেশিরভাগ মানুষ এই মঠ ও সন্ন্যাসীদের নিবেদিতপ্রাণের কথা জানত। তারা এ-ও জানত যে খ্রিস্টান সাধুরা নির্জনে একাকী বসে আরাধনা করে, এমনকি পর্বত গুহাতেও তারা নির্জনে উপাসনা করে। আর কবিরা এই নির্জন মরু উপাসনা সেন (কুঠরি) ও খ্রিস্টান সাধু সম্বন্ধে ও তাদের রাতভর উপাসনা সম্বন্ধে তারা বলেছে— রাতের নির্জনতায় শুধু আকাশের তারকারাজি তাদের এই আরাধনা ও উপাসনার সাক্ষী ছিল।
মরুভূমিতে ক্যারাডান যাত্রা পথে অন্ধকারে এই সাধু-সন্ন্যাসীদের কুটির থেকে অনেক দূর পর্যন্ত আলো দেখা যেত, এতে ভ্রমণকারীরা সাহস পেত এবং অনেক ক্ষেত্রে তারা আশ্রয় ও খাদ্যবস্তু পেত অতিথিরূপে। প্রাক-ইসলামী এক কবি লিখেছেন- এদের প্রকৃতি অন্য মানুষের মতো নয়, স্বার্থপর নয় তারা, সৎ ও নিঃস্বার্থ ছিল এবং তাদের পাওয়ার কিছু ছিল না দুনিয়াদারি থেকে।
এই সব সাধু-সন্ন্যাসীর আরাধনার পদ্ধতির সাথে আরবদের পরিচয় ছিল। প্রার্থনার সময় সাধুরা তাদের মাথা ঢেকে রাখত না, কারণ এটা ছিল ইহুদিদের প্রথা এবং এই প্রথা মস্তককে অসম্মান করার প্রথা (১ করিন্থ ১১ : ৪)। কিন্তু যদি কেউ আরাধনা করার ইচ্ছা করত, তখন শরীরে চাদর জড়িয়ে নিত, একখণ্ড কাপড় দিয়ে মাথা ঢেকে দিত, যাতে বাইরের কোনো দৃশ্য আরাধনায় বাধা সৃষ্টি না করতে পারে।
এই সাধুদের দিনে পাঁচবার প্রার্থনার সময় এবং সময় সময় ভারি রাত্রি পর্যন্তও প্রার্থনা করত, এই বিশ্বাসে যে ঘুমানোর চেয়ে প্রার্থনা ভালো। (Archer, 1924 67) প্রার্থনার সাথে বিভিন্ন রকম দেহভঙ্গিমা (Postures) ছিল। যেমন- দাঁড়িয়ে, দুই হাত জোড় করে বেঁধে, ঝুঁকে দাঁড়ানো (Bowingdown) এবং গোড়ালির ওপর বসা। সময় সময় সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত (Prostration)। মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে আরবে যে প্রার্থনার প্রথাকে ‘সেজদা’ বলা হয়। সেজদা শব্দটি সিরিয়াক। সিরিয়ান খ্রিস্টানদের মধ্যে প্রণিপাত বা প্রসট্রেশনের জন্য যে কপালে দাগ পড়ে তাকে খ্রিস্টান সন্ন্যাসীরা অতিরিক্ত ভগবত ব্যক্তি প্রতীক (Piety) বলে মনে করত। (Andrae 1960 P. 89)। কোরানেও এ ধরনের কপালের দাগ সম্বন্ধে প্রার্থনাকারীকে (নামাজিদের) বলেছে (৪৮:২৯)।
এই গভীর প্রণিপাত করা হয় হাঁটু ভেঙ্গে বসার সময়। এই সময় বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয় যাতে পেছন দিকটা বেশি ওপরে না উঠে যায়। এই প্রার্থনা পদ্ধতিকে ইহুদিরা বিদ্রূপ করত, কারণ এটা প্রাচীন ক্যানানাইটদের প্রথা এবং অনেক চার্চ পুরোহিত এ প্রথা নিরুৎসাহ করেছে। এই প্রথা ধীরে ধীরে খ্রিস্টানরা পরিত্যাগ করেছে, যদিও কোনো সময় তীর্থযাত্রায় তারা ব্যবহার করে।
ম্যাকডোনেল্ড, আর্চার ও অন্য পণ্ডিতদের মতে, ইসলাম আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য খ্রিস্টানদের এই প্রার্থনা পদ্ধতি গ্রহণ করেছে, বিশেষ অতিরিক্ত রাত্রিকালীন প্রার্থনা। প্রফেট মোহাম্মদের প্রাথমিক প্রচারকালে তিনি বহু খ্রিস্টান সাধু-সন্ন্যাসীদের সাথে দেখা করেছেন, আলাপ-আলোচনাও করেছেন। তিনি তাদের জীবনযাত্রার সাথে পরিচিতও ছিলেন এবং তাঁদের রাত্রীকালীন প্রার্থনা সম্বন্ধে বিশেষ করে অনেক নম্র ব্যবহারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েছেন (৫ : ৮৫)। আহলে কেতাব হিসাবে যখন তাদের কথা বলতেন, আল্লাহর প্রতি তাদের ভক্তি ও একাগ্রতা, ন্যায়বিচার ও ভালো কাজের কথা উল্লেখ করেছেন, (৩ : ১০৯ – ১০)।
যদিও প্রফেট মোহাম্মদ সন্ন্যাস জীবন অনুমোদন করেননি, তিনি বিশ্বাস করতেন খ্রিস্টানরা নিজেরাই এর আবিষ্কারক (৫৭ : ২৭)। তবু তিনি সত্যের সন্ধানে খ্রিস্টান সাধুদের এই সুশৃংখল জীবনযাত্রায় প্রভাবিত হয়েছেন। তার সময়ে অন্যান্য সত্যানুসন্ধানীর মতো তিনি খ্রিস্টান সন্ন্যাসীদের কিছু পদ্ধতি যেমন প্রার্থনার সময় মাথা ঢাকা, দিনে কয়েকবার প্রার্থনা করা এবং প্রার্থনাকালে গভীর প্রণিপাত (সেজদা) গ্রহণ করেছেন। মুসলিম ফরমুলা (তসবিব) ভোরের আজানের সময় মোয়াজ্জিন নামাজিদের ডাকে ‘প্রার্থনা ঘুমের চেয়ে ভালো] এটা মরুবাসী সাধু-মঙ্কদের প্রথাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
৩.৫ খ্রিস্টান গোত্র
ব্যক্তি ও ক্ষুদ্র দল ছাড়াও অনেক বড় বড় খ্রিস্টান সম্প্রদায় ছিল যারা আরব গোত্র সম্প্রদায় অথবা একটা বৃহৎ খ্রিস্টান জনগোষ্ঠী। আরবের প্যাগন প্রতিবেশীর মতো, খ্রিস্টান গোত্ররা প্রায় স্থান বদল করত; তাই বিশাল এলাকা জুড়ে তারা দল বা গোত্র হিসাবে ছড়িয়ে থাকত, তাই তাদের গোত্রে গোত্রে সম্পর্ক লোকজন ও মুভমেন্ট সম্বন্ধে একটা সম্যক চিত্র, লোকসংখ্যার হিসাব রেকর্ড করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
এই সব গোত্র দেখা গেছে বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে সিরিয়া থেকে দক্ষিণ আরব পর্যন্ত এবং ভূমধ্যসাগর এলাকা থেকে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত। এদের অনেক প্রশাসক সাহিত্য, শিল্প ও কাব্যের গুণগ্রাহী ছিলেন। আরবি লিপি ও ভাষায় খ্রিস্টান সম্পদায়ের যথেষ্ট অবদান ছিল এবং শিল্প ও প্রসারে তাদের ভূমিকা ছিল অনবদ্য।
সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, মেসোপটেমিয়া ও আরব পেনিনসুলা বিভিন্ন গোত্র ও কল্যাণের মধ্যে ইতিহাসে অনেকের উল্লেখযোগ্য স্থান আছে, ইসলামের পূর্বে ও পরেও। ৩০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এমনি কয়েকটি খ্রিস্টান গোত্রের চিত্র তুলে ধরা হলো :
সিরিয়া এবং উত্তর-পশ্চিম আরবের রাজ্যগুলো গ্রেট কোদা কনফেডারেশনের শাখা দলের দখলে ছিল এবং তাদের প্রধান ছিল নুমান ইবন আমর ইবন মালিক (মৃ. ২৭০)। সম্ভবত প্রখ্যাত তানুখ প্রশাসক ছিলেন রানী মাবিয়া (মৃ. ৩৭৫), যার পক্ষে খ্রিস্টান স্বার্থ প্রচার করে গেছেন বিশপ ও সন্ন্যাসী মোজেস এবং এই বিশপের শাসনাধীনে (Diocese) ছিল অনেক যাযাবর গোত্র। রানী মাবিয়ার সময়েই এই বিশপের প্রভাব ছিল বেশি যার ফলে এর প্রচারকার্যের জন্য সিরিয়ার প্রায় আরব গো খ্রিস্টানিটিতে দীক্ষা নেয়।
তানুখ গোত্রের সাথে সম্পর্কযুক্ত বহরা গোত্র যাযাবর প্রায় ছিল যারা পালমিরা ও দামেস্কের মধ্যে চলাফেরা করত। দক্ষিণ দামেস্কের এলাকা ইটুরিয়া (Ituraea) সালিহ গোত্রের দখলে ছিল। প্রায় ৩৬৫ খ্রিস্টাব্দে সালিহ গোত্র খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে। কোঙ্গা কানফেডারেশনের আর একটি শাখা উধারা (Uddara) আধুনিক আম্মানের পূর্ব ভূমি দখল করেছিল, একটা আরবি প্রেম-কাব্যের নামও দিয়েছিল। এই সব গোত্র এবং অন্য খ্রিস্টান গোত্রের নিজস্ব বিশপ ও পুরোহিত ছিল।
প্যালেস্টাইন উপরিভাগে একটু উত্তর দিকে যে গোত্র ছিল তা ছিল বিশাল আজদ কনফেডারেশনভুক্ত। এরা নিজেদের দেবতার মূর্তি আইম (Ayim)কে সাথে নিয়ে আসে। এই গোত্র খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দিতে দক্ষিণ থেকে এদিকে উঠে আসে এবং পূর্ব দিকে ওমান এবং উত্তর দিক দিয়ে মধ্য আরব পর্যন্ত ছাড়িয়ে যায়। এই গোত্রকে ঘাসান বলা হতো- ২৫০ খ্রিস্টাব্দে এরা ট্রান্সজর্ডনে বসতি স্থাপন করে। ‘Day of Halima’ নামে এক বিখ্যাত যুদ্ধে তারা সিরিয়ান আরবদের পরাজিত করে তাদের রাজ্য দখল করে নেয়।
ঘাসানের রাজপরিবার মনোফিসাইট খ্রিস্টানিটি গ্রহণ করে এবং প্যালেস্টাইনের কিছু অংশ ও সিরিয়ান মরুভূমির পশ্চিম দিক শাসন করে। তাদের রাজধানী ছিল দামেস্কের কাছে এবং দ্বিতীয় রাজধানী ছিল বসরায়। রাজত্বকাল ২৯২-৬৪০ খ্রিস্টাব্দ। এককালে এই অঞ্চল ছিল নাবাতাইনদের কেন্দ্র। ঘাসানিরা অনেক চার্চ ও মঠ নির্মাণ করে এবং এই বংশের শেষ রাজার কাল পর্যন্ত খ্রিস্টানিটি বজায় ছিল। হেলেনিস্টিক সভ্যতার প্রভাবে এদের সভ্যতাও চরমে পৌঁছেছিল।
ইসলামের আবির্ভাবের পর ঘাসান গোত্র শিল্প বিস্তারের ক্ষেত্রে আরবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুসলিম ঐতিহাসিকরা যেমন বলেছেন প্রফেট মোহাম্মদের পূর্বে জাহেলিয়া যুগে তারাই ছিল শিক্ষা-দীক্ষা ক্ষেত্রে সামন্ত গোত্র (Lord of the day of ignorarce) এবং ইসলামের যুগে নক্ষত্র স্বরূপ।
ঘাসানিরা প্যালেস্টাইনের মিত্র ছিল এবং প্রায় পারস্য সাহায্যপুষ্ট হিরা রাজ্যের লাবমিদ রাজাদের সাথে আরব গোত্রের ওপর কর্তৃত্ব দখলের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ত। ৫২৯ খ্রিস্টাব্দে বাইজানটাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ান ঘাসান প্রশাসক তৃতীয় হারিথ ইবন জাবালাকে ‘ফাইলার্ক’ (Phylark) পদবিতে ভূষিত করেন। এই পদবি মাত্র সম্রাটের নিচের পদবি এবং খুউব উচ্চস্তরের।
ঘাসানির সর্বশেষ প্রিন্স দ্বিতীয় জাবালা (মৃ. ৬৩৭) বাইজান্টাইন রাজদরবারে আশ্রয় পান। সেখানে তার যথেষ্ট সম্মান ছিল। এ ছাড়া বাইজানটাইনে মুসলিম রাজ্য থেকে অনেকে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। এদের মধ্যে তাঈ গোত্রের জাবইবন সারদাস অন্যতম। ৭১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে, কোরেশি গোত্রের মখজুম আল-ওয়াবিসি, মুসলিম ধর্মে অনীহা প্রকাশ করে বাইজানটাইনে চলে গিয়ে খ্রিস্টান হয়েছিলেন, পরে বিবাহ করেন ও সেখানেই মারা যান। আরব গোত্রের অনেকেই এমনিভাবে দেশত্যাগ করে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজেছে। সামোনাস নামে একজন সেরাসিন সম্রাট ৬ষ্ঠ লিওর (মৃ. ৯১২) বন্ধুরূপে বাইজাইন্টাইনে গিয়ে খ্রিস্টান মঠে সন্ন্যাস জীবনযাপন করেন।
ঘাসান এলাকার দক্ষিণে কোদা কনফেডারেশনের বালি গোত্র মধ্য প্যালেস্টাইনে গ্যালিলিতে কিছু এলাকা দখল করে নেয়। আমিলা ও জুদহাম গোত্রের মতো বালি গোত্রের প্রায় সকলেই খ্রিস্টান ছিল এবং এই তিন গোত্র মিলে মুতার যুদ্ধে প্রফেট মোহাম্মদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছে। কয়েকজন পণ্ডিত মানুষ বলেছেন আমিলা মূলত আরামাইন গোত্র-সম্ভূত; আবার অনেকে তাদের যোগসূত্র খুঁজে পান ওল্ড টেস্টামেন্টের আমালেকাইটসদের সাথে (গণনা : ১৩ : ২৯); অন্যরা বিশ্বাস করে, অরা জোকতানের পুত্র আবিমায়েলের বংশধর (আদিপুস্তক ১০ : ১৮); তারপরেও অন্য একদল বিশ্বাস করে তারা জুরহাম গোত্রের সাথে সম্পর্ক যুক্ত।
প্রভাবশালী জুদহাম গোত্র (আমর ইবন আদি বলেও পরিচিত) কোদা কনফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত এবং মনে হয় এই কোদা গোত্রও জুরহামের সাথে সম্পর্কযুক্ত তবে এতে মতভেদ আছে। হেজাজ থেকে বিতাড়িত হবার পর, তারা হিজরের আশপাশে বসতি করে এবং লোহিত সাগরের পশ্চিম উপকূল হয়ে সিনাইয়ের দক্ষিণ অংশ পর্যন্ত জুড়ে বসে। এদের রাজধানী ছিল আইলা (আকাবা)। প্রায় ৩৫০ খ্রিস্টাব্দে নাবাতাইনদের প্রভাবে, জুদহামরা খ্রিস্টান হয়ে যায়। সিনাইয়ের আশপাশ এলাকায় অনেক চার্চ ভবন গড়ে ওঠে। পঞ্চম শতাব্দির মধ্যভাগে এই সব চার্চের নেতাদের মধ্যে ছিলেন বিশপ আবদুল্লাহ (Abdellas) এবং হারিথা (Aretas)। সিরিয়ান মরুভূমে অগ্রগামী গোত্র ছিল কালব যারা কাহতান আরবদের সুপ্রিম প্রতিনিধি— যেমন, আদনান (উত্তর) আরব ছিল খ্রিস্টান কাইস (Kayis)। এরাও কোদ কনফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরা উত্তর দিকে সরে যায় এবং দুমাতে রাজধানী গড়ে তোলে। প্যাগনদের সময়ে দুমা আরব রানীদের বা উচ্চ মহিলা পুরোহিতদের কেন্দ্রস্থান ছিল। এদের প্রধান দেব-দেবীদের মধ্যে ছিল আতার (ইসতার) দাঈ, আবিরিল্লু ও নূহাই।
দুমাতে কাল্ব গোত্র খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে। নামকরা সদস্যদের মধ্যে এই গোত্রে ছিল জায়েদ ইবন হারিথ প্রফেট মোহাম্মদের পালক পুত্র। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে অক্টোবর মাসে প্রফেট মোহাম্মদ দুমাতে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে এক সশস্ত্র বাহিনী পাঠান। এই কালব গোত্র পরে উমাইয়া খলিফাদের প্রধান সাহায্যকারী রূপে আবির্ভূত হয় এবং খলিফা মাবিয়া এই গোত্রের একটি রমণীকে বিবাহ করেন যে মহিলা ১ম ইয়াজিদের মাতা ছিলেন। নাম মায়মুনা।
বানু কলির দক্ষিণ রাজ্যে ছিল বানু তাঈ, এরাও কাহতান বংশজাত। যদিও এরা প্রধানত ভবঘুরে তবু প্রাচীন শহর তাইমার আশপাশে বসতি করে। কথিত যে, ইসমাইল পুত্র তেমা এই তাইমা শহর পত্তন করেন। (আদিপুস্তক ২৫; ১৫)। প্রাচীন মিশর ও মেসোপটেমিয়ার মরু বাণিজ্য পথে তাইমা উন্নয়নশীল ওয়েসিস রূপে লোহিত সাগর ও পারস্য উপসাগরের মধ্যে প্রসিদ্ধি পায় এবং হেজাজ থেকে সিরিয়া পর্যন্ত বাণিজ্যপথ নিয়ন্ত্রণ করে। এখানে অ-আরব বিশাল জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল, সাথে ছিল কিছু ইহুদি স্থাপনা।
বানু তাঈ, বলা হয়ে থাকে, পৌত্তলিকার মাঝেই তাদের জীবন নির্বাহ করেছে, খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত না হওয়া পর্যন্ত। এই গোত্রের সদস্যদের মধ্যে একজন হাতেম তাঈ (৫৯০ খ্রিঃ) প্রফেট মোহাম্মদের পূর্বে বেঁচে ছিলেন। তার আতিথেয়তা কিংবদন্তি স্বরূপ ছিল। প্রফেট মোহাম্মদ এই গোত্রের উচ্চ প্রশংসা করতেন। এই পরিবারের লোকজনেরা আরবে বহুল পরিচিত ছিল এবং কেউ অতিথি সৎকারে সমাজে প্রতিষ্ঠা পেলে তাকে হাতেম তাঈ-এর সাথে তুলনা করা হতো। ইসলামের পূর্ণ আবির্ভাবের পর এই গোত্রের সকলেই ধর্মান্তরিত হয়।
তাঈ গোত্রের একটি শাখা বাআন গোত্র সাহিত্য ক্ষেত্রে উৎকর্ষতা লাভ করে এবং তারা লিখন পদ্ধতির নতুন সংস্কার করে। আরব ধর্মলিপির নবআবিষ্কারের জন্য খ্যাত ছিলেন তিন জন বাআন পণ্ডিত।
উত্তর হেজাজে প্যাগন গোত্রদের মধ্যে এক খ্রিস্টান সম্প্রদায় ছিল। প্রধানত তারা ছিল জুদহাম ও তাঈ গোত্রভুক্ত। এরা বসতি স্থাপন করে এলওলা ওয়েসিস-এর পর্বত গাত্রে। এক সময় এই অঞ্চল ছামুদ ও লিহিয়ান গোত্রদের দখলে ছিল। তাঈ গোত্র থেকে আর একটি দল ওয়াদি আল কোরাতে কুটির স্থাপন করে, একে বলা হতো ‘গ্রাম্য উপত্যকা’। এই ভ্যালি মদিনার উত্তরে ও খাইবারের পশ্চিমে অবস্থিত ছিল। এই ভ্যালিতে ইহুদিদেরও কিছু স্থাপনা ছিল।
মদিনা ওয়েসিসের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গানিম বলে খ্রিস্টান গোত্র বাস করত। এরা ছিল আজদ কনফেডারেশনের একটা অংশ, যারা (নন-খ্রিস্টান) আউস ও খাজরাজের আত্মীয় ছিল। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে তাদের উপাসনার গৃহগুলো প্রফেট মোহাম্মদের আদেশে জ্বালিয়ে দেয়া হয়।
খোদ মদিনাতে খ্রিস্টানদের একটি ক্ষুদ্র সম্প্রদায় ছিল; কিন্তু প্রধান স্থাপনা ছিল ইহুদিদের এবং মদিনার সমাজে জুদাইজমদের শক্তিশালী সম্পর্ক বিরাজ করত। (Muir, 1912, P. 116)। ইহুদিদের এই শক্তিশালী সামাজিক অবস্থা প্রফেট মোহাম্মদের পূর্বে ও পরেও ছিল।
হেজাজ ও নেজদের বিস্তীর্ণ এলাকাতে আসাদ বলে খ্রিস্টান গোত্র ছিল, এরা নন- খ্রিস্টান কোরেশদের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিল (Trimingham, 1979, P 263)। আসাদ গোত্রের উল্লেখযোগ্য সদস্যদের মধ্যে সংস্কারক ছিলেন তোলাইহা, প্রফেট মোহাম্মদের প্রথম স্ত্রী খোদেজা; খোদেজার কাজিন ওয়ারাকা এবং ওসমান ইবনে হুয়ারিথ।
ইবনে হিশাম ও অন্যরা বলেন যে, ওসমান ইবনে হুয়াইরিথ মক্কার এক নেতা এবং খোদেজার কাজিন, কাবাঘরের পৌত্তলিকতায় বিতৃষ্ণ হয়ে বাইজানটাইন দরবারে চলে যান। সেখানে তার সমাদর হয় এবং পরে তিনি খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেন। প্রায় ৬০৫ খ্রিস্টাব্দে, প্রফেট মোহাম্মদের মিশনের কিছু পূর্বে ওসমান মক্কায় ফিরে আসেন এবং রাজকীয় সাহায্যের বলে মক্কা নগরীর শাসনভার গ্রহণ করে প্যাগন ধর্ম সংস্কারের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এতে প্রতিষ্ঠিত মক্কার শাসকবর্গ জোর প্রতিরোধ জানালে ওসমান সিরিয়ায় পালিয়ে যান। কিন্তু দু’বছর পরে মক্কাবাসীরা ওসমানকে হত্যা করতে সমর্থ হয়। পরে মুসলিম ট্রাডিশনে তাকে হানিফ বলা হয়েছে। কতকগুলো বিক্ষিপ্ত গোত্র, প্রায়ই যাযাবর টাইপ, উত্তর মেসোপটেমিয়ার জেজিরা দখল করে নেয়। ঐ সময় সিরিয়ায় ও আশপাশ অঞ্চলে যেসব ছোট-বড় গোত্র ছিল, তারা সবাই খ্রিস্টান ছিল (Kennedy, 1986, P. 20) ।
এই সব গোত্রের প্রধান ছিল তাঘালিব (বানু হুদ বলেও পরিচিত)। এরা নেজদ থেকে মধ্য এশিয়ায় আগমন করে। ৪৫০ খ্রিস্টাব্দে এদের প্রথম ব্যাচ এসে ইউফ্রেটিসে বসবাস শুরু করে এবং কিছু দিনের মধ্যেই খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হয়। নজদের বাকি তাঘলিব গোত্র বক্র গোত্রের সাথে চল্লিশ বছর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং শেষ হয় ৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে। এই যুদ্ধ আরবের প্রাচীন কাব্যে ‘বাসাসের যুদ্ধ’ বলে বিখ্যাত। যুদ্ধের পর বাকি তাঘলিব গোত্রে যারা ছিল, তারা নেজদ থেকে উত্তরে চলে যায় তাদের পূর্ব গোত্রের সাথে যোগ দিতে।
তাঘলিবদের পরাজিত করেন খলিফা ওমর, কিন্তু তারা জিজিয়া কর দিতে অস্বীকার করে এই যুক্তিতে যে, তারা আরব- সুতরাং তাদের রেয়াত দিতে হবে। তাই তাদের মুসলিম হিসাবে কর দিতে বলা হয়, নন-মুসলিম বলে নয়। ঐতিহাসিক ইয়াহিয়া বিন জারির (মৃত ১০৭৯) বলেন যে, তাঘলিবরা তার সময় পর্যন্ত খ্রিস্টান থেকে যায়, এমনকি প্রফেটের মৃত্যুর তিনশো বছরের অধিক পর্যন্ত।
দক্ষিণের তাঘলিব গোত্র ছিল আইলিদ গোত্র (বা আইলিদ ইবন নাজির)। এরা মূলত ইয়ামামা থেকে আগত এবং দাবি করে যে প্রফেট মোহাম্মদের পূর্বপুরুষ আদনানের পুত্র মাআদের বংশধর। উত্তর দিকে মাইগ্রেশনের সময় তাদের পূর্বপুরুষ আইলিদ বা ইলিয়াদ, মক্কাতে একটি পবিত্র টাওয়ার (মিনার) প্রতিষ্ঠা করে, সম্ভবত মেসোপটেমিয়ার স্টাইলে জিগুরাতের মতো। কথিত আছে যে, তারা কাবা নামে একটি চৌকো ঘর, কুফা ও বসরার মধ্যে সিন্দাদে তৈরি করে (Faris, 1952 P. 39)। শেষে এই তাঘলিব গোত্র ইউফ্রেটিস ভ্যালিতে বসবাস শুরু করে দেয় এবং আনবার নামে এক রাজধানী শহরও গড়ে তোলে যা পার্থিয়ানদের জন্য বেশ গুরুত্ব লাভ করেছিল। ৪২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আনবার খ্রিস্টানদের জন্য দুর্গ স্বরূপ হয়। পরে শিক্ষা-দীক্ষায় ও এক নতুন ধরনের লিখন পদ্ধতিতে এরা বিখ্যাত হয়ে ওঠে
লাখমিদ গোত্র দক্ষিণ আরবের কাহতান গোত্রের শাখা ছিল, কিন্তু উত্তরের আদিনার গোত্রের সাথে তাদের শক্ত সম্পর্ক ছিল। এরা রাজত্ব করেছে ২৬৮ খ্রিঃ থেকে ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, রাজ্যসীমা ছিল সিরিয়া ও মেসোপটেমিয়ার মধ্যে, রাজধানী ছিল হিরা। হিরা শব্দ সিরিয়াক হারতা (Herta) থেকে, অর্থ ক্যাম্প। হিরা নগরী ইউফ্রেটিসের নিম্নাঞ্চলে অবস্থিত ছিল। হেরা নগরীর আশপাশ অঞ্চল পবিত্র বলে গণ্য হতো, কেননা লোকে বিশ্বাস করত এই অঞ্চলে আদম ও নূহের সমাধি ক্ষেত্র আছে।
সিরিয়ার বিশাল অঞ্চল নিয়ে ঘাসানরা যেমন বাইজানটাইনদের সুনজরে ছিল তেমনি ইরাকের বিশাল অঞ্চল দখল করে লাখামিদরা ছিল পার্সিয়ান সাসানিদদের মিত্র। ৩২৫ খ্রিঃ পারস্যের দ্বিতীয় শাহপুর লাখমিদ রাজ্য ইমরুল কায়েসকে ‘সব আরবের রাজা’ উপাধি দিয়েছিলেন। এই উপাধি ৩২৮ খ্রিস্টাব্দে নাসারার প্রতিলিপিতে উৎকীর্ণ করা হয়েছিল, যে উৎকীর্ণ প্রতিলিপি আরবি ভাষায় সবচেয়ে প্রাচীন (রডিনসন ১৯৭৬, পৃঃ ২৭)।
লাখামিদরা সাংস্কৃতিকভাবে চরম উৎকর্ষতা লাভ করেছিল এবং ৪১০ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের প্রথম ইয়াজদ গার্ড হিরার শাসক ১ম নুমানের কাছে আপন পুত্র বাহরাম গুরকে শিক্ষা-দীক্ষার জন্য দেন। এই বাহরাম গুর পরবর্তীকালে কিংবদন্তি শিকারি হয়েছিলেন। ১ম নুমান তার রাজত্বের শেষে সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়েছিলেন।
৫১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে হিরা নেস্টোরিয়ান বিশপ্রিকের কেন্দ্রস্থল ছিল, কিন্তু সব লাখমিদ রাজারা খ্রিস্টান ছিল না। এদের মধ্যে দু’জন ওজ্জা দেবীর ভক্ত ছিল। কিন্তু তারা খ্রিস্টান পরিবারে বিয়েশাদি করেন এবং তাদের প্রজারা প্রায় সকলেই খ্রিস্টান ছিল।
হিরার তৃতীয় মুনধিরের স্ত্রী হিন্দ একটি খ্রিস্টান মঠ প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার প্রস্তরফলকে লেখা হয়েছিল যে তিনি রাজার কন্যা, রাজার মাতা কিন্তু খ্রাইস্টের দাসী। তৃতীয় মুনধীর মারা যান ৫৫৪ খ্রিঃ। এই মঠটি ইসলামের ইতিহাসে অনেক দিন পর্যন্ত স্মরণীয় ছিল।
হিরার নুমান বংশের কথা আরব ঐতিহাসিকরা ঘনঘন উল্লেখ করেছেন এবং এদের রাজদরবারে সব সময়েই কবি ও বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা গুলজার থাকত। পারস্যের রাজপরিবারের মতো আরব প্রধানগণ তাদের পুত্র-সন্তানদের হিরার খ্রিস্টান স্কুলে শিক্ষার জন্য পাঠাত, কারণ সেই সময় হিরার বিদ্যাপীঠের সুনাম ছিল।
আরবি ভাষা, আরবি লিপি ও আরবি কবিতা, ইসলাম-পূর্ব যুগে হিরার খ্রিস্টান রাষ্ট্রের কাছে ঋণী ছিল, কারণ সে সবের উৎকর্ষতা এখানেই হয়েছিল।
৬ষ্ঠ শতাব্দির মধ্যভাগ থেকে পারস্যের সাসানিয়ান রাজারা হিরাকে করদরাজ্য হিসাবে গণ্য করতে আরম্ভ করে, ফলে হিরার রাজারা তাদের দেশীয় আরব প্রধানদের আনুগত্য লাভের চেষ্টা করে। চতুর্থ নুমান (মৃ. ৬০২), যে খ্রিস্টান রাজার যশকথা আরবি কবিতায় উল্লেখ আছে। পারস্য সম্রাটের সন্দেহভাজন হন তার আরবপ্রীতির কারণে, বিশেষ করে খ্রিস্টান বকর গোত্রের সাথে তার সখ্যর জন্য। এই জন্য তিনি পারস্য সম্রাট দ্বিতীয় খসরু পারভেজ কর্তৃক উৎখাত হয়ে প্রাণ হারান, আর এর সাথেই লাখমিদ বংশের অবলুপ্তি ঘটে।
এই হিরা রাজ্যের পতনের পর তিন বছরের মধ্যে আরবের বকর গোত্র পারস্যের প্রভাব হিরা রাজ্য থেকে উৎখাত করে দেয়। পারস্যের এই পরাজয় পারস্য সাম্রাজ্যের ওপর আরব বিজয় সহজ করে দেয়। ইসলামী রাজ্যের কয়েক শতাব্দি ধরে হিরার আশপাশে জনসংখ্যার অনেকেই খ্রিস্টান ধর্ম পালন করতে থাকে। এই হিরা শহরের মধ্য থেকেই শিয়াদের নাজাফ শহর গড়ে ওঠে যা শিয়াদের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য শহর বলে গণ্য।
হিরার কিছু উত্তর দিকে একটি উন্নয়নশীল খ্রিস্টান সম্প্রদায় গড়ে ওঠে যাদের বলা হতো ইবাদ-আল-মসিহ। খ্রিস্টের দাস। এরা পরবর্তীতে ‘ইবাদ’ গোত্রে পরিণত হয়। এক সময় তারা নিকটে ওজ্জা দেবীর পীঠস্থান দখল করে নেয় (কথিত আছে এখানে নরবলি ও পশুবলি হতো)। এর উপরে ইবাদ গোত্র একটি চার্চ নির্মাণ করে। ৫৬০ খ্রিস্টাব্দের দিকে ইউফ্রেটিস নদীর ধারে তারা তাদের রাজধানী আকুলা প্রতিষ্ঠা করে এবং একজন বিশপও নিযুক্ত হন।
হিরা শহর যেমন মুসলিম শহর নাজাফের কেন্দ্রবিন্দু ছিল, তেমনি আকুলা ছিল কুফা শহরের (Trimingham, 1979 P. 171)। কুফা শহর বুদ্ধিজীবী, আইনজ্ঞ ব্যক্তি এবং বিদ্যাপীঠের জন্য বিখ্যাত ছিল। ৬৩৫ খ্রিস্টাব্দে নাজরান থেকে বিতাড়িত বহু খ্রিস্টান কুফাতে আশ্রয় নেয়। ৬৬০ খ্রিস্টাব্দে চতুর্থ খলিফা কুফা চার্চ ধ্বংস করেন এবং কুফাতে তার রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। এই অঞ্চলে খ্রিস্টানদের প্রভাব যে কী পরিমাণ ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় আরব ঐতিহাসিক হিসাব আল কালবি-র ৮২০) গ্রন্থ The Churches and Monastaris of Hira and the Genoalogis of the Ibadis থেকে। মূলত গ্রন্থটি এখন পাওয়া যায় না, তবে ঐতিহাসিকদের লিখিত গ্রন্থে এর ঘন ঘন উল্লেখ পাওয়া যায়।
বানু ইবাদের দক্ষিণে ছিল ইজ্ল (Ijl), যারা হিরা ও বসরার মধ্যে বসতি স্থাপন করে। আরও দক্ষিণ দিকে এই খ্রিস্টান গোত্রের বেশ কয়েকটি বসতি গড়ে উঠেছিল।
টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস ডেল্টার কাছে আরবের প্রধান এক শহর চারক্স অবস্থিত ছিল, পারস্য উপসাগরের কাছে এর রাজধানী শহর। এই এলাকা পূর্বে গ্রিক আলেকজান্ডারদের দখলে ছিল, পরে ছিল পার্থিয়েনদের দখলে। চতুর্থ শতাব্দিতে (খ্রিঃ) হিরা শহরের আরবরা ওবুলার পূর্বে একটি ছোট খ্রিস্টান মঠ তৈরি করে। খেজুর বৃক্ষ কুঞ্জের মধ্যে এই মঠটি মরুর রুক্ষ আবহাওয়ার মধ্যে মনোরম স্থান ছিল।
এখানে ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানরা বসরা নগরী প্রতিষ্ঠা করে। এই শহর ছিল নাবিক সিন্দাবাদের। পরে এই শহর কুফা নামে মুসলিম ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। বসরার পণ্ডিত ব্যক্তিরা উৎকৃষ্টভাবে কোরান পাঠ ও ব্যাখ্যা করতে পারত এবং আরবি ভাষার চরম উৎকর্ষ সাধন করে। সাহিত্য, ধর্ম ও রাজনীতিতে বসরা ও কুফা মুসলিম বিশ্বে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। ওয়াট লিখেছেন যে, আব্বাসীদের প্রাথমিক যুগে বসরাতে গ্রিক দর্শনসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তির কর্মকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল।
দক্ষিণ-পশ্চিম ইরাকে রাবিয়া ও নামিরের আদনান গোত্ররা বাস করত এবং আরও দক্ষিণে খ্রিস্টান মুদার সম্প্রদায় তাদের গির্জাসহ শান্তিতে বসবাস করেছে। মুদার সম্প্রদায়ের একটি শাখা ছিল অখ্রিস্টান কিনানা দল। এই কিনানা দলে ছিল কোরেশ গোত্র। রাবিয়া ও মুদারের মধ্যে ঘনঘন সংঘর্ষ লেগেই থাকত, বিশেষ করে যখন তারা ইসলামে দীক্ষা নেয়। উভয় গোত্রই উমাইয়া যুগে মুসলিম রাজ্য প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
আরব ও পারস্য উপসাগরের উপকূলে বাহরাইনে (সুমেরিয়ান লিপিতে এর নাম ছিল দিলমুন) খ্রিস্টান মিশনারিদের কেন্দ্রভূমি ছিল। প্রাথমিক ইসলামী যুগে বাহরাইনের উপকূল অঞ্চল বর্তমান বাহরাইন দ্বীপের চেয়ে আকারে বড় ছিল। এখানে দুটি নদী (বাহরাইন) মিশে দক্ষিণ ইরাকে শাত-ইল-আরব-এর রূপ ধারণ করেছে (O’ Leary, 1927. P. 10) এবং হাসা (প্রাচীন নাম গেরহা) কুয়েত ও কাতার পেনিনসুলা উপকূল ধরে বয়ে চলেছে। এই অঞ্চলে প্রধান খ্রিস্টান গোত্র হলো বকর (বা বকর ইবন ওয়াইল), যিনি ৫০২ খ্রিস্টাব্দে সিরিয়ার বর্ডারের আতঙ্ক ছিলেন। পরে অবশ্য বাইজানটাইন সম্রাট প্রথম এনাসতাশিয়াস এদের সঙ্গে সন্ধি করে বশে আনতে সক্ষম হন। এরা পরে ৬০৫ খ্রিঃ কুফার কাছে ধূ-কারে পারসিয়ানদের যুদ্ধে পরাস্ত করে। এই যুদ্ধের কীর্তিগাথা আরব কবিরা তাদের কবিতায় লিখে গেছেন।
বকর সম্প্রদায়ের সাথে জড়িত আরও একটি গোত্র ছিল কাইস বা আবদুল কাইস। প্রথমে নাজরানের বাসিন্দা পরে কাতার ও বাহরাইনের আশপাশে স্থায়ী বাসিন্দা হন। ৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে সেখানকার চার্চগুলো তদারক করবার জন্য একটা বিশপের অফিস প্রতিষ্ঠা করা হয়। কাইস গোত্রের উত্তর-পশ্চিম দিকে বাহরাইনে ছিল খ্রিস্টান আইউব গোত্র।
তৃতীয় শতাব্দির মাঝামাঝি আজদ কনফেডারেশনের আর একটি খ্রিস্টান গোত্র মাজুন ওমান (মাস্কট) অঞ্চলের দিকে সরে যায়। প্রাচীনকালে এখান থেকে তামা সরবরাহ করা হতো। অল্প সময়ের মধ্যে এই অঞ্চলে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বেশ বাড়- বাড়ন্ত হয় এবং ওমানে প্রায় ৪২৪টি বিশপ অফিস গড়ে ওঠে। মুসলমানরা যখন ওমান শহর দখল করে তখন তারা খ্রিস্টান গোত্র মাজুন নিজ ধর্ম পালন করার অনুমতি দেয় এই শর্তে যে তারা তাদের অর্ধেক জমি ও সম্পদ মুসলমানদের সমর্পণ করবে। মাজুন খ্রিস্টানদের অনেকেই এই শর্তে নিজ ধর্ম পালন করতে থাকে।
ওমানের উত্তর বর্ডারের প্রান্তে দোফার (Dhofar) রাষ্ট্রে বড় একটা খ্রিস্টান সম্প্রদায় ছিল এবং বন্দর শহর মোশচাতে একজন বিশপ ছিলেন। খ্রিস্টান নেজদ ও ইয়ামামা গোত্র নেস্টোনিয়ান মিশনারি দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এদের মধ্যে তামিম গোত্র ও আইয়ুব গোত্র পশ্চিম আরবের বিশাল অংশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এরাই মক্কাতে কোরেশ গোত্রের অবস্থানকে পোক্ত করতে যথেষ্ট সহায়তা করেছে, কিন্তু প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ অব্দে মক্কার অন্য গোত্র তাদের বিরুদ্ধে অপবাদ দেয় এই বলে যে তারা কাবার সম্পদ চুরি করেছিল সেই সময়ে। বহু শতাব্দির পর মক্কার কোরেশ গোত্র খ্রিস্টান তামিম গোত্রের সাহায্যের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং তাদের অনেক সদস্যকে ধর্মীয় ও বিচারকার্যে নিয়োজিত করে।
বহু পূর্ব থেকেই তামিম গোত্র ওকাজে বাৎসরিক কবিতা উৎসবের পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই দায়িত্ব তারা খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করার পরেও পালন করেছে এবং বিচারকার্যও পরিচালনা করেছে। তামিম গোত্রের দুইজন বিখ্যাত কবি জারির ও ফারাজদাক উভয়েই খ্রিস্টান ছিল।
তামিম গোত্রের মহিলাদের সৌন্দর্য ও সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতার জন্য কোরেশ গোত্রের মর্যাদাশীল ব্যক্তিরা তামিম গোত্রের মহিলাদের বিবাহ করতে পছন্দ করত। বিখ্যাত মহিলা সংস্কারক সাজাজ এই তামিম গোত্রের; এর অবশ্য সমাজে নিন্দাবাদও ছিল তার ব্যতিক্রমধর্মী চরিত্রের জন্য; কিন্তু নিজ গোত্রের সদস্যদের সাপোর্ট যথেষ্ট পেয়েছেন। প্রফেট মোহাম্মদের প্রচারকালে তামিম গোত্রের কিছু সদস্য অনিচ্ছাভাবে ইসলাম গ্রহণ করে কিন্তু প্রফেটের মৃত্যুর পর তারা আবার নিজ ধর্মে ফিরে আসে। পরে জবরদস্তিতে মুসলিম হয়।
তামিম গোত্রের মধ্যে আরো একটি গোত্র ছিল নাজিয়া। এরাও খ্রিস্টান ছিল কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। খলিফা আলীর বিরুদ্ধে খারিজী বিদ্রোহীদের মধ্যে এরাও ছিল। অনেকেই খ্রিস্ট ধর্মে ফিরে আসে এবং আলীর সৈন্যদের দ্বারা ধৃত হলে তারা তাদের ধর্ম সম্বন্ধে গর্ব করে (Trimingham, 1979 P. 279)।
আরবের উত্তর প্রান্তে বকর গোত্রের একটি প্রভাবশালী শাখা হানিফা বসবাস করত (Muir, 1912. P. 457); এরা খ্রিস্টান ছিল এবং ইয়ামামাতে ছড়িয়ে ছিল। এখানকার একজন খ্রিস্টান শাসক হাওদা ইবন আলীর কাছে প্রফেট মোহাম্মদ ইসলাম গ্রহণ করার জন্য পত্র দেন। হাওদার উত্তরাধিকারী ছিল মুসাইলামা। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর এই গোত্র ও ইয়ামামা গোত্রের অনেক সদস্য কোরানের ক্বারী ছিল।
নেদের দক্ষিণে ছিল নাজরান অঞ্চল। এর রাজধানীও ছিল নাজরান। নাজরান দক্ষিণ আরাবিয়া ও হেজাজের মধ্যে ক্যারাভান সংযোগ ছিল। ভূমধ্যসাগর ও পারস্য উপসাগর ছেড়ে পূর্ব দিকে এই ক্যারাভান বাণিজ্য করত।
পারস্যে জন্মগ্রহণকারী আরব ঐতিহাসিক তাবারি (মৃ. ৯২৩) পুরনো ইতিহাস উল্লেখ করে বলেন যে, এক সিরীয় সাধু ফিমিউন (ফেমিয়ন? ইফেমিউস?) রাজমিস্ত্রি রূপে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তিনি বেদুইন দ্বারা ধৃত হন এবং নাজরানে দাস হিসাবে বিক্রি করে দেয়; এটা হবে প্রায় ৪৬০ খ্রিস্টাব্দে। এখানে তিনি অনেক আরবকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করেন এবং নাজরানে প্রথম চার্চ নির্মাণ করেন।
নাজরান শহরে একটা বাৎসরিক মেলা হতো, এটা দক্ষিণ আরবের মক্কার সন্নিকটে ওকাজ মেলার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। নাজরান মেলায় বিধর্মী আরবদের নিকট অনেক খ্রিস্টান সাধু ধর্ম প্রচার করত। এদের প্রচেষ্টার ফলে বলতে গেলে নাজরানের সব লোকসংখ্যা পঞ্চম শতাব্দির শেষে খ্রিস্টান হয়ে যায়। (Glubb. 1979 P. 51)। ৫২৪ খ্রিস্টাব্দে ধু-নুয়াস, হিমিয়ারের ইহুদি শাসক নাজরান আক্রমণ করলে যোগাযোগ শুরু হয় এবং খ্রিস্টানদের ওপর অত্যাচার চলতে থাকে। পরের বছর (৫২৫) বাইজানটাইনের মিত্র আবিসিনিয়ানরা ধু-নুয়াসকে পরাজিত করে বিতাড়িত করে।
ঐতিহাসিক ইবনে হিশাম নাজরান সম্বন্ধে বলেছেন যে, তাদের রাজার ধর্ম ছিল অর্থাৎ বাইজানটাইন সম্রাটের ধর্ম। নাজরানে একটি খুব বড় উৎকৃষ্ট ক্যাথিড্রাল ছিল মার্বেল ও মোজাইক চর্চিত এবং এই ক্যাথিড্রাল বাইজানটাইন সম্রাটের অনুদান (O’ Leary 1927. P. 144)। নাজরানের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের চামড়া ও বস্ত্রশিল্প ছিল এবং সেখান থেকে বিখ্যাত ইয়েমেনি পোশাক তৈরি হতো। সম্ভবত সেসময় নাজরান আরবের লোকজন সম্পদশালী ছিল।
সেই সময় সমসাময়িক আরব রাষ্ট্রের মধ্যে নাজরানে একটি উন্নত রাজনৈতিক সমাজ-জীবন ছিল। একজন সৈয়দ মহান নেতার দ্বারা নাজরান শাসিত হতো এবং তিনি পররাষ্ট্র, বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিলেন। তার ডেপুটি হিসাবে একজন আকিব অভ্যন্তরীণ বিষয় দেখাশোনা করতেন। আর একজন বিশপ ছিলেন যিনি চার্চ ও ধর্ম বিষয় তদারক করতেন (এর পর সৈয়দ শব্দটি প্রযোজ্য হয়েছে প্রফেট মোহাম্মদের বংশধরদের জন্য)
নাজরানের সম্ভ্রান্ত পরিবারের দেখাশোনা করত দাইয়ান পরিবার এবং এই পরিবারের অনুদান ছিল চার্চের জন্য একটি বিরাট অঙ্ক। আরব কবিরা এই পরিবারকে আরবে সবচেয়ে সম্ভ্রান্তশীল পরিবার বলে উল্লেখ করেছে।
নাজরানে দুটি মহান গোত্র ছিল এবং প্রত্যেক গোত্রে খ্রিস্টানদের সংখ্যা বেশি। একটি ছিল হারিথ গোত্র যারা আরবে উত্তর-পশ্চিমে স্থায়ী বাসিন্দা ছিল, এই গোত্র নাজরানে একটি ‘কাবা’ ভবন নির্মাণের দায়িত্বে ছিল। এই ভবনে অত্যাচারিত ব্যক্তিরা আশ্রয় গ্রহণ করত। এখানে আরব খ্রিস্টানরা তীর্থের জন্য জড়ো হতো। এটা ছিল তীর্থভূমি। অন্য মহান গোত্রটি ছিল কিন্দা গোত্র যারা দক্ষিণ ও মধ্য আরবে ছড়িয়ে- ছিটিয়ে বাস করত। এদের মধ্যে অনেকে প্যালেস্টাইন ও সিরিয়াতে আশ্রয় নিয়েছিল এবং সেখানে মাআদ ও আদনান গোত্রের সাথে সখ্য স্থাপন করে। কিন্দা গোত্ৰ শাসন করতেন একটি খ্রিস্টান বংশ, এই বংশ কবি ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের সমাদর করেছে। তাদের উৎসাহ জুগিয়েছে। ইসলামিক দার্শনিক ইয়াকুব আল কিন্দি (মৃ. ৮৬৮) এবং আবদুল মসিহ আল-কিন্দি এই কিন্দা রাজবংশের সন্তান। ইয়াকুব আল কিন্দি পশ্চিম দেশে আল কিন্দুস বলে পরিচিত।
খলিফা ওমর নাজরান খ্রিস্টানদের জোর করে মুসলমান না করা পর্যন্ত তারা খ্রিস্টান ছিল; তারপর নাজরানের অনেক খ্রিস্টানকে কুফাতে নির্বাসনে পাঠানো হয়। দক্ষিণে আরব পেনিনসুলার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত (ইয়েমেন, হিমিয়ার, হাদ্রামাত) খ্রিস্টানদের প্রভাব ঐসব অঞ্চলে নাজরান ও আবিসিনিয়া থেকে পড়েছিল।
ফিলসটরগাস (মৃ. ৪৩৯) তার চার্চ হিস্ট্রিতে বর্ণনা করেছেন যে ৩৪২ খ্রিস্টাব্দে বাইজানটাইন সম্রাট কনস্ট্যান্টিয়াস ইন্ডিয়াতে একজন বিশপের অধীনে এম্বেসি পাঠিয়েছিলেন। এই এম্বেসির সাথে অনেক মূল্যবান গিফ্ট এবং দুশো কাপ্পাডোশিয়া ঘোড়াও পাঠান এই উদ্দেশ্যে যে, হিমিয়ারাইট রাজা তার রাজ্যে চার্চ নির্মাণ করার অনুমতি দিবেন। অনুমতি পাওয়া গিয়েছিল এবং একটি চার্চ আদাননে (এডেন) আর একটি হোরমুজে নির্মাণ করা হয়েছিল। সবচেয়ে বড় চার্চ নির্মিত হয় সানার দক্ষিণে জাফরে। এই চার্চ নির্মাণে বাইজানটাইন সম্রাট মার্বেল ও মোজাইক প্ৰদান করেছিলেন।
আনুমানিক ৩৪৫ খ্রিস্টাব্দে আবিসিনিয়ার নেগাস দক্ষিণ আরাবিয়ার প্রদেশগুলোতে কিছু নিয়ন্ত্রণ আদায় করে নেন এবং আকসুম, হিমিয়ার, সাবা ও রাইদানের রাজা উপাধি গ্রহণ করেন এবং ঐসব প্রদেশে খ্রিস্টান ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম করার প্রচেষ্টা চালান। এই প্রথম আধিপত্য (৩৪৫-৭৫) শেষ হয় যখন একজন আরব নেতা আবিসিয়ানদের ঐ সব প্রদেশ থেকে উচ্ছেদ করেন। এই আরব নেতা পরে সেখানে ইহুদি রাষ্ট্র স্থাপন করেন।
হিমিয়ারে এরপর আর একবার স্বল্পকালের জন্য খ্রিস্টান শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় যখন আব্দ কেলাল নামে এক আরব খ্রিস্টান সে স্থান অধিকার করে অল্পকালের জন্য (৪৫৫-৬০) সাবাতে রাজ্য স্থাপন করেন। কিন্তু এ বিষয়ে ইতিহাস কতটুকু সত্য তা এখনো নির্ণীত হয়নি। তবে ঐসব এলাকায় পঞ্চম শতাব্দির শেষ পর্যন্ত যে খ্রিস্টানদের আধিপত্য ছিল, সে সম্বন্ধে সন্দেহ নেই।
৫২৫ খ্রিস্টাব্দে ধু-নুয়াসের মৃত্যুর পর আবিসিনিয়ার গভর্নর সুমিয়াফা নেসাসের কর্তৃত্ব স্বীকার করে সানা থেকে দক্ষিণ দিক শাসন করতে থাকে আকসুমাইট কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে। সুমিয়াফা কমপক্ষে চারটি দক্ষিণ-আরবীয় প্রতিলিপি থেকে পরিচিত যার মধ্যে একটি দয়াময় (আল-রহমান) ঈশ্বর ও তৎপুত্র খ্রিস্টের নামে উৎসর্গীকৃত। (Philby, 1947 P. 121)। এরপর ৫৫০ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টান মিশনারিরা হিমিয়ার থেকে নুবিয়ান রাষ্ট্রে ভ্রমণ করে, যার রাজধানী ছিল সোবা (Soba) বর্তমান খার্তুমের কাছে এবং সেখানে খ্রিস্টানিটি প্রতিষ্ঠা করে। ৫৮০ সালে ঐ রাষ্ট্রে খ্রিস্ট ধর্ম রাজধর্ম রূপে পরিগ্রহ করে (Trimingham, 1979, P. 302)]
৫৩০ খ্রিস্টাব্দে আব্রাহা নামে এক সিরীয়-আরব সুমিয়াফাকে স্থানচ্যুত করে সানারাজ্য দখল করে স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেন এবং নেগাসের ভাইসরয় হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেন। মারিব ড্যাম (dam)কে পুনর্নির্মাণের জন্য তিনি উদ্যোগ নেন। দক্ষিণ আরবীয় প্রতিলিপিতে তার নাম উল্লেখ আছে। এর মধ্য দিয়ে তিনি প্রসিদ্ধিও লাভ করেন।
আব্রাহাকে বহু দেশের শাসনকর্তা অভিনন্দন জানাতে তার রাজ্যে দূত পাঠান। এদের মধ্যে আবিসিনিয়ার নেগাসের দূতও ছিল। অন্যান্য দেশের মধ্যে বাইজানটাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ন, পারস্যের প্রথম খসরু, খ্রিস্টান আরব রাজা হিরার তৃতীয় মুনধির, ঘাসান রাজ্যের শাসনকর্তা তৃতীয় হারিস ইবন জাবালা (Philly, 1947, P. 192)।
সানাতে আব্রাহা ক্যালিস নামে এক বিরাট চার্চ নির্মাণ করেন। ক্যালিস শব্দ গ্রিক ‘ecelesia’ অর্থাৎ চার্চ থেকে আগত। ঐ যুগে এই চার্চকে বিস্ময়কর বলে অভিহিত করা হতো। তার ইচ্ছা ছিল এই চার্চকে কেন্দ্র করে তীর্থস্থান গড়ে তুলতে, হেজাজের কাবার মতো। তার এই ইচ্ছাকে নস্যাৎ করতে মক্কা থেকে একটি দল সানাতে আসে এবং গু-গোবর দিয়ে এই পবিত্র স্থানকে কলুষিত করে। অন্য একটা কাহিনী মতে, তারা আব্রাহার একজন মিত্রকে হত্যা করে। এই অপকর্মের প্রতিশোধ নিতে আব্ৰাহা ৫৫০ খ্রিস্টাব্দে এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কাতে অভিযানে যাত্রা করেন। আব্রাহার বাহিনীর মধ্যে হস্তিবাহিনীর উপস্থিতি মক্কাবাসীদের বিস্ময়ের উদ্রেক করে, কারণ এই বিশাল জন্তুর সাথে তাদের পূর্ব পরিচয় ছিল না। আব্রাহা যে পথ দিয়ে আক্রমণ চালান সে পথকে ‘হস্তি-পথ’ বলা হয়। পথে আব্রাহা মক্কার আবদুল মোত্তালেবের (প্রফেটের দাদা) দুশো উট আটক করেন; তখন আবদুল মোত্তালেব মক্কার প্রভাবশালী ব্যক্তি।
আব্দুল মোত্তালেব আব্রাহার সাথে মিটিং করতে প্রস্তাব করলে, আব্রাহা বলে পাঠান যে তিনি যুদ্ধ করতে আসেননি। আব্দুল মোত্তালেব বলে পাঠান- আমরা যুদ্ধ চাই না, কারণ যুদ্ধে আমাদের বিশেষ দক্ষতা নেই। আমি আমার উটগুলো ফেরত চাই। আব্রাহা বিস্মিত হয়ে বলেন— আপনি শুধু আপনার উটের কথা বললেন, কিন্তু যে মন্দিরে আপনি পূজা করেন এবং আপনার পূর্বপুরুষরা করেছেন সে সম্বন্ধে কিছু বললেন না। আমি ঐ মন্দির ঘর ধ্বংস করতে এসেছি। আব্দুল মোত্তালেব জবাবে বলেন, উটগুলো আমার, কিন্তু মন্দির আমার নয়। যার মন্দির তিনিই এটি রক্ষা করবেন। আমার উটগুলো শুধু ফেরত দেন। (Nicholson, 1969 P. 67)।
আব্দুল মোত্তালেবকে তার উটগুলো ফেরত দেয়া হয়। এরপর আব্দুল মোত্তালেব মক্কাবাসীদের নিরাপত্তার জন্য বক্তব্য রাখেন ও আব্রাহাকে তার উদ্দেশ্য ত্যাগ করে ফিরে যেতে বলেন।
ইত্যবসরে হলো কি যে, আব্রাহার সেনাদলে গুটি বসন্ত দেখা দিল, ফলে আব্রাহা ফিরে যেতে বাধ্য হন তার উদ্দেশ্য পরিত্যাগ করে। আরবিতে গুটি বসন্তের অর্থ ক্ষুদ্র পাথর, কারণ বসন্তের গোটা বেশ শক্ত হয় রোগীর দেহে। তাই ঘটনাকে কোরানে বলা হয়েছে (সূরা ১০৫) যে, পক্ষীরা দলে দলে আক্রমণকারীদের পাথর ছুড়ে মেরেছে। পরবর্তীতে ট্রাডিশনে বলা হয়েছে যে, প্রফেট মোহাম্মদ ঐ হাতির বছরে (year of the elephant) (আম-আল ফিল) জন্মগ্রহণ করেন যখন আব্রাহা মক্কা আক্রমণ করেন। এই ট্রাডিশনে প্রফেটের জন্মের সাথে আব্রাহার ব্যর্থতার একটা যোগসূত্র টানার প্রচেষ্টা। সত্য ঐতিহাসিক ঘটনা হচ্ছে, আব্রাহার অভিযানের প্রায় দু’দশক পরে প্রফেটের জন্ম। আল-জুহুরির (মৃ. ৭৪২) মতে আব্রাহার ঘটনার আঠারো বছর পর প্রফেটের জন্ম; আর ইবন আল-কালবির (মৃ. ৮২০) মতে, তেইশ বছর পর অর্থাৎ ‘year of the elephant’-এর তেইশ বছর পর।
অভিযান থেকে প্রত্যাবর্তনের পরই আব্রাহার মৃত্যু হয় এবং তার পরবর্তী দু’জন উত্তরাধিকারী স্বৈরশাসনের কারণে সাইফ ইবন ধু-ইয়াজান নামে এক স্থানীয় হিমিয়ার নেতা হিরার দরবারে আপিল করেন। এই আপিলের জন্য তিনি পারস্যের সাহায্য লাভ করেন।
পারস্য থেকে সমুদ্রপথে এক অভিযানের ফলে ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে পারস্য আবিসিনিয়াদের বিতাড়িত করে এবং হিমিয়ার পারস্যের একটি প্রদেশে পরিণত হয় এবং এই অবস্থা পঞ্চাশ বছর ধরে চলে। এরপর পারসিয়ানরা স্থানীয় প্রকাশক নিযুক্ত করে যিনি সানাতে নিযুক্ত পারস্য গভর্নরের অধীনে কাজ করতে থাকেন।
সানার সর্বশেষ গভর্নর ছিলেন বাধান যিনি সাসানিয়ান সম্রাট দ্বিতীয় খসরু পারভেজের রাজত্বকালে সানা শাসন করেছেন; পরে ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে এই রাজ্য মুসলিমদের দখলে আসে। দু’বছর পর হিমিয়ারাইটসদের জোর করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা হয়।