৩.১ ভিত কাটা চলছে

দিকশূল

ভিত কাটা চলছে। একদল কামিন ভাঙছে ইট। লরি এসে মাল নামাচ্ছে। সবাই ভিড় করছে আশেপাশে। কী হবে? কারখানা ! রুটি বিস্কুটের কারখানা।

মেঘনাদ তখন চলেছে ইদ্রিসের সঙ্গে। স্টেশন থেকে তিন ক্রোশ রাস্তা হেঁটে এসে উঠল তন্দুর মিস্তিরি গোলামিঞার বাড়ি। গোলামিঞা, বড়মিঞা নামে খ্যাত। ভাইপোর নাম খাঁদন আলী। খুড়ো ভাইপো তন্দুর মিস্তিরি। সন্ধ্যাবেলা গিয়ে শুনল, বাড়ি নেই, কলকাতায় আছে। ঠিকানা নিল। রাজাবাজারের এক বস্তিতে আছে।

স্টেশনে ফিরতে ফিরতে রাত হল। সেখান থেকে পাণ্ডুয়ায় ফিরে এল ট্রেনে, ইদ্রিসের বাড়িতে।

অনেক রাত হয়েছে, উনুনে কাঠ জ্বালিয়ে বসে আছে ইদ্রিসের বিবি আর ব্যাটার বিবিরা। ব্যাটারাও বসে আছে, মেহমানের সঙ্গে কথাবার্তা বলবে, খাতির যত্ন করবে। পাড়ার আরও কয়েকজন এসেছে, সকলেই মুসলমান আর সকলেই রুটি বিস্কুটের কাজের কারিগর। র‍্যাশনিং আর পারমিটের যুগে এখন সকলেই বেকার হয়ে পড়েছে। ময়দা নেই দেশে, কারখানাগুলি উঠে গেছে একে একে। নিজেদের টিমটাম ব্যবসাও তুলে দিতে হয়েছে ময়দার অভাবে। এখন সকলেই খেতে মজুরি করে। এদের মধ্যে ইদ্রিসের অবস্থা একটু ভাল ।

মেঘনাদের বার বার লালমিঞার কথা মনে পড়ল। তারপর যখন শুনল, তার জন্য নতুন হাঁড়ি রয়েছে, নিজের হাতে রান্না করে খেতে হবে, তখন সে অবাক হল। বলল, নিজেরটা ফুটিয়ে খেতে পারি, সেটা তেমন কিছু নয়। কিন্তু আমি তো মুসলমানের বিচার কোনও দিন করিনি। করব কী করে। আমার সে সাহস কই।

কিন্তু ইদ্রিসও সাহস করতে পারছে না। পাশেই এক হিন্দুবাড়ি ছিল। সেখান থেকেই রান্না হয়ে এল।

মেঘনাদ ইদ্রিসের ছেলেদের সঙ্গে কথা বলে নিল। পনেরো দিন বাদে এক ছেলে চলে যাবে মেঘনাদের কাছে কাজ করতে। এখান থেকেই, পাড়ার আরও দু জনকে মেঘনাদ কাজে নিল। বলল, নতুন শুরু করতে যাচ্ছি। কারবারটা জমুক। তেমন দিন এলে আমি অনেককেই নিয়ে যাব।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাণ্ডুয়ার সমস্ত কারিগরদের একটি কথা বলে সে নিরাশ করে গেল। লে গেল, ভবিষ্যতে আমি যন্ত্র দিয়ে কারখানা করব, এই আমার বড় আশা।

পরদিন একটি বেলা অপেক্ষা করতে হল ইদ্রিসের জন্য। কাজ মিটিয়ে কলকাতায় পৌঁছুল বিকালে। বড়মিঞা আর খাঁদনকে পাওয়া গেল। দু জনেই আসাম যাবে পরদিন। পথ খরচা আর বায়নার টাকা পেয়ে গেছে।

মেঘনাদ দুশ্চিন্তায় মাথায় হাত দিল। বলল, ক-দিন লাগবে সেখানে?

গোলামিঞা বলল, তা আজ্ঞে বলা যায় না। দূরে গেলে, যার যা কাজ আছে, সবই করিয়ে নেয়। বারে বারে কলকাতা থেকে পথখরচাও লাগে, আমাদেরও কষ্ট হয়।

মেঘনাদ বলল, সে সব জানিনে। আমারটা তা হলে করে দিয়ে যেতে হবে মিঞাসাহেব।

গোলামিঞা বলল, বাবু, এইটা আমার ব্যবসা। কথার খেলাপ করা ভাল না।

ইদ্রিস বলল, বড়মিঞা, অবস্থাটা একটু বুঝেন। পরের খিদমতগারিতে মিছা বললে, খোদা গোস্তাকি নেয় না। আপনি আসাম চলে গেলে, বাবুর বড় দুভোর্গ হবে। একজনের জন্য তো না। আসামের শহরে শহরে হয়তো ঘুরে বেড়াতে হবে আপনাকে। তা আপনি যান, দু-চার দিন বাদে যান, বাবুরটা করে দিয়ে যান। আসামে একটা চিঠি দিয়ে দেন।

খুড়ো ভাইপো চোখাচোখি করে চুপ করে রইল খানিকক্ষণ। আরও কিছু কথাবার্তার পর রাজি হল তারা। মেঘনাদ একশো টাকা বায়না দিল। পরদিনই যাওয়া স্থির। পথখরচাও দিয়ে গেল।

তারা যখন বেরুল, কলকাতার রাস্তায় বাতি জ্বলছে। হাওড়া থেকে আসবার সময় কলকাতা দেখার সুযোগ পায়নি মেঘনাদ। ইদ্রিসের পেছনে পেছনে সে কলকাতার রাস্তা দেখতে দেখতে চলল।

শিয়ালদহের কাছে এসে মেঘনাদ বলল, আর একটু দেখে যাই কলকাতাটা। কলকাতা দেখতে দেখতে মেঘনাদের মনে হল, সে কত ছোট, কত কিঞ্চিৎ। পৃথিবী কী বিশাল, এ সংসারের সরঞ্জাম। ঐশ্বর্য কী বিরাট ! এই প্রথম সে অনুভব করল, বিনয় কেন সব কিছুই বড় করে করতে চেয়েছে। যারা এই বিশাল, পরিপূর্ণ জগতে ঘোরাঘুরি করছে আজন্ম, তারা ছোট করে কিছু ভাবতে পারবে কেন। মেঘনাদ নিজেও পারত না। ধলেশ্বরী পারের সিরাজদিঘার সঙ্গে এর কত তফাত। আকাশ পাতাল ফারাক বললেও ব্যবধান বোঝানো যায় না।

এই বিচিত্র ঐশ্বর্য পরিপূর্ণ সংসারের সমকক্ষ হতে হবে। সিরাজদিঘা ব্যাপ্তিলাভ করবে কলকাতায়, তবেই তো মেঘনাদের নতুন জীবন সার্থক।

ট্রেনে ফিরতে গিয়ে এক কাণ্ড ঘটে গেল।

হঠাৎ একটি ছেলে ট্রেনের কামরায় উঠে গান ধরে দিল। তারপরেই পেটে চাঁটি। মেঘনাদ ফিরে দেখল চালিস। মেঘনাদকে সে দেখতে পায়নি। নানান অঙ্গভঙ্গি করে তোক হাসাচ্ছে, রাগাচ্ছে। তারপরেই চালিস ঝুমির ঝুরির ব্যাখ্যা করতে আরম্ভ করল।…বাবুর বড় বিস্কুটের কারবার। বাবুর বউয়ের নাম ঝুমি। বড় মনোমোহিনী সোহাগী বউ, জানেন? বাবু বিস্কুটের নাম দিলেন ঝুমির ঝুরি।..

মেঘনাদের বুকের মধ্যে ধ্বকধ্বক করছে। সে চালিস আর সমস্ত যাত্রীর মুখ দেখছে। তার মনে হচ্ছে, সব লোক তাকিয়ে আছে তার দিকে।

চালিস ততক্ষণে গান ধরেছে,

যে খাবে ঝুমির ঝুরি
সে পাবে, ঝুমি এক কুড়ি।

কে একজন বলল, এক কুড়ি সোহাগী বউ ঝুমি?

: হ্যাঁ। 

: তবে নিয়ে আয় শালা তোর ঝুমির ঝুরি। এক কুড়ি ঝুমিই যদি পাওয়া যায়

চালিস বলল, গানটা আর এটুস আছে। বলে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে গাইল,

তখন, ঝুমি চিবিয়ে খাবে কুড়মুড়ি।

হাসির রোল পড়ে গেল। সবাই বলল, কিন্তু, বিস্কুট কোথায় রে তোর ছোঁড়া?

মেঘনাদ হাসিতে কৌতূহলে, অদ্ভুত উত্তেজিত। কী বলে শোনার জন্য উৎকর্ণ হল সে। চালিস বলল, হবে বাবুরা, পাবেন শিগগিরই। বাবুর কারখানা উঠছে, ঝুমির ঝুরি এল বলে। এখন আমাকে এট্টা পয়সা দেন।

আবার হাসি।

ইদ্রিসও হাসছিল। হঠাৎ বলল, বাবু, নামতে হবে। ইস্টিশন এসে গেছে।

মেঘনাদ তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে উঠে, চালিসের কাছে এসে খপ করে তার হাত ধরল।

: কে মশাই? বলে তাকিয়েই চালিসের চোখ ছানাবড়া। হাতে আর এক বিন্দু শক্তি নেই।

মেঘনাদ বলল, আয়।

সুড়সুড় করে নেমে এল চালিস। মেঘনাদ বলল, বদমাইশ ! মুখের ভাত ফেলে পালিয়েছিলি যে বড়?

চালিস চুপ। মেঘনাদ তাকে ধরেই হাঁটতে আরম্ভ করল। খুব গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করল, বদরুদ্দিনের খবর জানিস?

চালিস বলল, বদরুদ্দিন মারা গেছে।

অ্যাাঁ? কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল সে। তারপর বলল, সিরাজদিঘা গেছলি নাকি এর মধ্যে?

: একবার, গত মাসে ঘুরে এসেছি। আর যাই না।

: কেন?

: মা, ভাই, সবাই মরে গেছে। আর কী করতে যাব।

মেঘনাদ উৎসুক হয়ে উঠল। চালিস আবার বলল, লক্ষ্মণ সায়েরা এসেছে এদিকে, কাপড়ের দোকান করেছে। সব রিফিউজি কিনা!

মেঘনাদ বলল, আচ্ছা, সিরাজদিঘার মেঘনাদ সার কর্মচারী বিপিনের খবর জানিস?

চালিস মেঘনাদের মুখের দিকে একবার তাকাল। দেখে নিল রাগ আছে কিনা বাবুর মুখে। বলল, তার বড় ব্যারাম শুনলাম। বাজারে এট্টা মেয়েমানুষের ঘরে পড়ে থাকে। শুনলাম, বাঁচবার আশা নেই। বাবু

: বল।

: সা কত্তা, আপনার কারখানার টিন, চালা কিছু নাই। সব চোরেরা খুলে নিয়ে গেছে। তণ্ডুল ভেঙে যাচ্ছে। তার মধ্যে এখন শিয়াল কুকুরের বাস। গদিঘরের চাল বেড়াও কাটা।

মেঘনাদের হাতের মধ্যে চালিসের হাতটা প্রায় গুঁড়িয়ে যাওয়ার দাখিল। অসহ্য যন্ত্রণায় ও উত্তেজনায়, তার সারা দেহের মধ্যে কিছু একটা পাক দিয়ে উঠতে লাগল।

তার চোখের সামনে ভেসে উঠল, সেই শ্মশানের চিহ্ন। ছেড়ে-আসা কুল কোনওদিন থাকে না। এক কূল ভাঙে, আর এক কূল গড়ে। ভেঙে পড়ছে এক কুল। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে তার চিহ্নও থাকবে না। এই নতুন কুল-ই ভবিষ্যতের সব আশা ভরসা। মনের মধ্যে একটি ক্ষীণ আশা ছিল, এখানে মার খেলে, আবার সাহস করে ছুটে যাবে একদিন সেখানে। আজ তাও ধূলিসাৎ হয়ে গেল। তা-ই বিপিনদার কোনও চিঠি নেই। উত্থানশক্তি রহিত, অসহায়, শুধু দেখছে সব চেয়ে চেয়ে।

: কী অসুখ?

চালিস বলল, গায়ে ঘা। সবাই বলল, বাঁচবে না।

বাঁচবে না। লীলার কথা মনে পড়ে গেল। সত্য হল তার কথা-ই। তারপর মেঘনাদ শুনল চালিসের কথা। বাড়ি তাদের কাদিশাল। সিরাজদিঘা থেকে বেশি দূরে নয়।

মেঘনাদ বলল, আমার কারখানায় কাজ করবি?

চালিস বলল, যদি দেন—

: দিতে তো চাই। পালিয়ে যাবি না তো।

: কত্তা। তখন এট্টা মিছে কথা বলে ফেলেছিলাম—

মেঘনাদ বলল, থাকবি ইদ্রিসের কাছে এখন। খাবি আমার কাছে। কারখানা তৈরি হয়ে গেলে। সেইখানে থাকবি। কী কাজ জানিস?

: ছিট মালে ছাপ কাটতে পারি।

ইদ্রিসের যাতায়াত ঘোরাঘুরি, সব পয়সাই মেঘনাদ দিয়েছে। তবু বলল, ইদ্রিস তোমার মজুরি কামাই হয়েছে দোকানে। সেটা তুমি আমার কাছ থেকে নেও।

কিন্তু ইদ্রিস কিছুতেই টাকা নিল না।

বাড়ি ফিরে এসে সিরাজদিঘার কথা বলল সে লীলাকে। লীলা নিস্পৃহ নির্বিকারভাবে ঠোঁট উলটে রইল। তবু চোখের তারায় তারায় অদ্ভুত হাসির ধার

নকুড় তাড়াতাড়ি জানাল, গোলার মালিককে সে সব টাকা দিয়ে দিয়েছে। সিরাজদিঘার কথা শুনে সে আক্ষেপ করল। প্রাণহীন আক্ষেপ। সুকুমারীরও সেই রকম। তারা দু জনেই যেন কীসের ঘোরে নিমগ্ন।

শুধু তিলি বলল, বোনাই, যা আছে ওখানে সব বিক্রি করে দেও।

মেঘনাদ বলল, বিক্রি করার কিছু নেই তুমি। ভিটেটা আছে, এদ্দিনে তারও চাল বেড়া হয়তো খুলে নিয়ে গেছে কেউ। বেচে আর আমি কী পাব। থাক সে সব।

মেঘনাদের মুখে ব্যথার ছায়া দেখে, ও বিষয়ে আর কিছু বলল না তিলি। বলল, তবে, এখানেও তো তুমি শুরু করেছ। ভগবান করুন, এখানে যদি তোমার ভাল চলে, তবে আবার সব হবে।

হবে ঠুমি? বলে সে উৎসুক হাসি নিয়ে তাকাল। বলল, তুমি, আমার কথা তুমি ভাবো, না?

জানি না, এ বাড়িতে কী হয়েছে, আমার বড় একলা একলা লাগে। বিজয়ও আমার উপর খুশি নয়। বোধ হয়। বিশ্বাস করো তুমি, আমি কিন্তু বুঝি, তুমি বোনাইকে মনে রাখো।

তিলি অদ্ভুত হাসি-ত্রস্ত মুখে, অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল, না, না, মোটেও নয়। আমি কারও জন্য ভাবিনে, একটুও না।

বলতে বলতে অন্ধকার হল মুখ। বলল, বোনাই, তোমার কাছে একটি কথা বলব।

বিস্মিত মেঘনাদ বলল, বলল।

তিলি নিজেকে চাপতে পারল না। চোখে জল এসে পড়ল। বলল, বোনাই তুমি দিদিকে একটু ভালবাসো, একটু। তোমাদের এমন কেন, আমি বুঝিনে।

রাত হয়েছে। ঢাকা বারান্দায় উনুনের কাছেই খেতে বসেছে মেঘনাদ। ঘাই প্রায় ঘুমোচ্ছে।

মেঘনাদের সারা মুখে ব্যাকুল যন্ত্রণা। বলল, তুমি, কেন বলছ এ কথা, আমি বুঝি না। কী করে। তোমাকে বোঝাব ! আমি মুখ মানুষ। কিন্তু জীবনে কোনওদিন কোনও মেয়েমানুষের কাছে। যাইনি। তোমার দিদির ভালবাসা পাব, এই আশায় আমি ঘুরছি। কিন্তু কী পাপ করেছি জানি না, তোমরা দোষো আমাকে। তবে বুঝি আমি ভালবাসা জানি না। তুমি ঠাকরুন, তবে তুমি আমাকে একটু ভালবাসা শিখিয়ে দেও।

 হেসে ফেলল তিলি। আর হু হু করে জল এসে পড়ল চোখে। এই হাসি কান্নার মধ্যেও কেমন একটু চাপা চাপা ভয়, ব্ৰস্ত উৎকণ্ঠা। বলল, ওমা ! না, না, আমি ও বস্তুর কিছু বুঝিনে। তোমাকে। শেখাব কি।

সে আর তাকাতে পারল না মেঘনাদের দিকে। মেঘনাদ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে গম্ভীর গলায় বলল, তবে তোমার দিদির বিষয়ে আমার আর কিছু করার নেই। তুমি অন্য কিছু চেয়ো বরং আমার কাছে।

বলে সে উঠল। তিলি আবার বলল, একটি জিনিস চাইব তোমার কাছে এক দিন, আজ নয়।

: কী?

: সে কথা আজ বলতে পারব না।

তন্দুর মিস্তিরি খুড়ো ভাইপোর চোখ গোল হয়ে গেল সব দেখে শুনে। তখনও, কারখানা ঘরের মেঝে তৈরি হয়নি । তন্দুর করবে কোথায়। মেঘনাদ বিনা কাজে মজুরি দিয়ে বসিয়ে রাখল চারদিন। তারপর তন্দুর আরম্ভ হল। তন্দুরের মেঝে তৈরি হয় বালি আর নুন দিয়ে। নীচে ইট, তারপরে বালি, নুন, তারপরে আবার একপাটি করে ইট। তার উপরে, কাদা মাটির গাঁথনি দিয়ে উঠল। তন্দুরের খিলেন। সিমেন্ট বালির গাঁথনিতে, উত্তাপের ভারসাম্য বজায় থাকে না। উত্তাপের এদিক ওদিক হলে, তন্দুরের সমস্ত মাল নষ্ট হয়ে যাবে। কেরামতি জানে তারা খুড়ো ভাইপো। তন্দুরের খিলেন ওঠে ইট দিয়ে, কিন্তু ঘুরতে ঘুরতে, অনেকটা মসজিদের গম্বুজের মতো হয়। মাথার কাছে গিয়ে ইট কাদাতেই এমন চাবি এঁটে দেয়, সব কিছু ভর করে থাকে সেখানে। ওইটি খুলে গেলে সব ঝুরঝুর করে পড়ে যাবে। সামনের দিকে তন্দুরের মেঝের সঙ্গে খোলা রইল শুধু হাতখানেক লম্বাচওড়া একটি মুখ। অন্ধকার গহ্বর। প্রকাণ্ড ঢাকা উনুনের মুখের মতো। যেন বিশাল রাক্ষসটা হাঁ করে রয়েছে। চিমনি উঠল সঙ্গে সঙ্গেই।

রাজমিস্তিরিদের খাটুনি হল একটু। অ্যাসবেস্টাসের চাল তুলতে হল সন্তর্পণে, কাঁচা তন্দুরের উপর পড়লে ভেঙে যাবে।

সমস্ত জায়গাটির চেহারা বদলে যেতে লাগল। মুক্তর পোড়ো জমিতে আজ ইট কাঠ চুনের ছড়াছড়ি, লরি, গরুর গাড়ির ভিড়।

মেঘনাদ আছে সর্বক্ষণ। নাওয়া খাওয়ার সময় নেই। বিজয়ের মন যত ভারই থাক সে রোজ আসে কারখানা থেকে ফিরেই।

নকুড় আসে লাঠি ঠুকঠুক করে। চোখে বোধ হয় আর একটু ছানি পড়েছে। শরীর শুকোচ্ছে, ওদিকে চোখও ঘোলা হয়ে উঠছে আরও। বড় অন্যমনস্ক। কী যেন তার হারিয়ে গেছে।

বিনয়ও ছোটাছুটি কম করছে না। তাকে দেখলেই, সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। সে এলেই মনে হয়, মেঘনাদ কেউ নয়, সে-ই আসল মালিক।

তিলি, সুকুমারী, ষোড়শী সবাই দেখে গেছে। আসেনি শুধু লীলা। আসেনি, আসবে না। বলেছে, ও দেখে আমি কী করব। আমার চিতায় কেউ মঠ তুলছে না।

দুই বোনে কথা কাটাকাটি করেছে। মেঘনাদ জানে সব। ভাববার অবকাশ পায়নি। সময় নেই। এক মুহূর্ত। সময় নেই, তবু তারই ফাঁকে ফাঁকে বুকটা টনটন করে।

সাতদিনের মাথায় যখন তন্দুর শেষ হল, তখন একদিন ইদ্রিস বলল সসঙ্কোচে, বাবু, আপনার মিশিন কারখানার তো দেরি আছে।

: তা আছে। কেন বলো তো মিঞা।

: বলছিলাম, এক তন্দুরেই গেদো আর ছিটের কাজ করতে অসুবিধা হবে না।

সামনে ছিল বিনয়। সে বলে উঠল, ঠিক বলেছ, আর একটা তন্দুরের দরকার। যেমন করেই হোক, বিনয় এ কাজকর্মের কথা কিছু জানত। গেদো মাল হল রুটির ময়দা। ছিট হল বিস্কুট। এক তন্দুরে দুটি কাজ একসঙ্গে হবে না। বিস্কুট রুটির উত্তাপের তারতম্য আছে।

বিনয় আবার বলল, কাজের চাপ বাড়লেই, তখন আর একটা তন্দুরের জন্য মিস্তিরিদের পেছনে ছোটাছুটি করতে হবে, কাজটি হয়ে থাকা ভাল।

তা ভাল। কিন্তু মেঘনাদ অন্য কথা ভাবছিল। ভাবছিল, আর একটি তন্দুর মানে আর একটি ঘর তৈরি করতে হবে। কিন্তু ভাববার সময় নেই। তার নিজের সময় নেই, তন্দুর মিস্তিরিরও সময় নেই, তা ছাড়া ইদ্রিস বিনয়, দু জনেই যখন বলছে, হয়ে যাক।

বিনয় বলল, এতে কি ভাববার কিছু আছে মেঘনাদবাবু।

মেঘনাদ বলল, না। কিন্তু বিনয়বাবু, পারমিট পাব তো।

বিনয়ের টানা টানা চোখে ছেলেমানুষের মতো উচ্ছ্বসিত হাসি ফুটে উঠল। বলল, সে কথা আপনি ভাবছেন কেন। মরবার আগেও দিয়ে যাব।

নতুন তন্দুরের হুকুমের আগেই, নতুন ঘরের হুকুম হল।

কারখানা মূর্তি ধরছে একটু একটু করে। মেঘনাদ দূর থেকে দেখছে লুকিয়ে লুকিয়ে। হাসছে আপন মনে।

.

সাত দিন বাদে চিঠি এল রাজীবের। প্রথমে উধম সিং অনুপস্থিত ছিল। জমিরুদ্দিনের কাছে দু দিন গিয়ে দেখা করা যায়নি। উধম সিং ফিরে এসেছে। কার চিঠি দেওয়া যায়? উধমের না জমিরুদ্দিনের।

চিঠিখানা পড়তে পড়তে বিনয় অন্য কথা ভাবল। পার্টির চব্বিশ পরগনার কতারা তার সহায়। সুখেন্দু রায় মজুমদার এখন ক্ষমতায় বসে আছেন। এ অঞ্চল থেকেই দাঁড়িয়েছেন তিনি। তিনি রাজীবকে অপছন্দ করেন। ইউনিয়নগুলিতে রাজীবের কর্তৃত্ব পছন্দ করছেন না। রাজীবের যদি আর সাত দিন দিল্লি থেকে ফিরতে দেরি হয়, অন্তত দুটি বড় বড় ইউনিয়নে জরুরি সভা করে, নতুন। নির্বাচন করে ফেলা যায়। কারণ? কারণ আর কিছুই নয়। চিপ র‍্যাশনের ব্যাপারে, কয়েকজন নেতার কার্যকলাপ সুবিধার মনে হচ্ছে না। ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হওয়া প্রয়োজন যাতে সংগ্রাম করতে পারে শ্রমিকেরা। রাজীব হল এক নম্বর লোক, যে সংগ্রাম করতে চায় না।

রাজীবের চিঠির জবাব দেওয়ার আগে, ইউনিয়নের কয়েকজনকে চিঠি লিখল সে। জরুরি সভা, বিনয় চৌধুরীর বাড়িতে।

মনে মনে ঠিক করে নিল, যদি সভা কার্যকরী হয়, তবে সমস্ত ইউনিটের সেক্রেটারির নামটা হওয়া চাই বিনয় চৌধুরীর।

রাজীবকে এখন কার্যকরী সমিতি থেকেও বাদ দিতে হবে। সে বড় মালিক ঘেঁষা। তারপর? তারপর একান্ন সালের নির্বাচন। অবশ্য তার দেরি আছে।

রাজীবকে লিখল, উধমের সঙ্গে আলাপ করো, কয়েকদিন চিঠি দিয়ো না। চিঠি দাও জমিরুদ্দিনকে।

জমিরুদ্দিনের চিঠিটা লিখেছে সে একজন গম্ভীর এডুকেশনিস্ট, কালচারিস্টের মতো।

তার চাকর গোপালের চিঠিও এসেছে। পাঁচ দিন পর, সুলতাকে নিয়ে ফিরছে সে। অথচ বিনয়ের চোখেমুখে যেন আগুন লেগেছে। তার বিষণ্ণ চোখ জ্বলছে নিরালায়। সেই জ্বলুনির মধ্যে একটি চাপা চাপা লুব্ধ উল্লাস।

সে পুড়ছে, জ্বলছে, কিন্তু কী মহানন্দ সেই জ্বালা পোড়ায়। লীলা দেহে, মনে, হাসিতে, কথায়, ব্যবহারে এক সর্বনাশা আগুন। যার শিকড় আছে তার মৃত্যু আছে। যার পেছন আছে, তাকে পেছন ফিরতে হয়। যার আছে সম্মুখ তাকে অগ্রসর হতে হয়। লীলার কিছুই নেই সে সব। সে বাতাসবাহিনী দাবানল। যেন মনে হয় বিনয়ের উপযুক্ত সঙ্গিনী।

কিন্তু মহানন্দের মধ্যে মাঝে মাঝে হঠাৎ মনটা কুঁকড়ে ওঠে। এই বাতাসবাহিনী দাবানলের মধ্যে। আছে বন্যতীব্রতা, কিন্তু বড় ভুল। বিনয়ের ভিতরের কালচারিস্ট প্রেতাত্মাটার সম্মানে লাগে। লীলার ধার আছে, কিন্তু সেটা গ্রাম্য অজ চাষির কাটারির ধার। ধারটা অবাচীন। যদিও সে । অভিমান তার ভেঙে গেছে মুক্তর বেলাতেই, তবু মনে হয়। একটু যেন লাগে তার আত্মাভিমানে।

প্রায় প্রতিদিন আসছে লীলা। কী দুর্জয় সাহস। তবু, এরই মধ্যে এক নতুন লোভে লোলায়মান হয়ে উঠেছে বিনয়ের চোখ। নিজেকে সে চাপছে, ঢাকছে। ঠিক এমনি হয়েছিল মুক্তর জমিটার সময়। শেষ পর্যন্ত বিনয় মুক্তর প্রেমের মর্যাদা রাখতে পারল না। জমিটা গ্রাস করে ফেলল। তেমনি এক নতুন দিক দেখা দিয়েছে লীলার মধ্যে। তেমনি, কিন্তু বিনয় যেন ভাল ছেলের মতো বিষয়টি মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে।

মনের মধ্যে কোথায় তার একটি বিচিত্র স্ব-বিরোধ আছে। তার সেই বিরোধের জোর বড় কম। এত কম যে, সে তার বাল্য জীবনের তাদের সেই মস্ত বড় বাড়িটার পরিবেশ কখনও কাটিয়ে উঠতে পারে না। বাবা বনাম জ্যাঠার সেই অদ্ভুত ছিচকেমিটা বংশানুগত কীটের মতো ঘুরছে তারও রক্তের মধ্যে। এক ইঞ্চি পাঁচিল জিতে নেওয়া কিংবা, সম্পত্তির মধ্যে শজনে গাছের দুটি ডাল হেরে যাওয়া। অথচ এই লোকগুলিই পূর্বপুরুষের কী অদ্ভুত গৌরব করত, আর বলত, ঠিক তেমনটি আবার হতে হবে এই বংশকে। পণ্ডিত হতে হবে প্রত্যেকটি ছেলেকে।

অবাক বিনয় আত্মভোলা হয়ে দেখত আর শুনত সেই সব ব্যাপার। জানত না তার আত্মভোলা অবচেতন কাঁচা মনের শিরায় শিরায় কেমন করে তা চারিয়ে গেছে।

সেই এক ইঞ্চি পাঁচিল আর শজনে গাছের দুটি ডাল আজকে পালটে গেছে। তার রূপটি হয়েছে অন্যরকম। হয়তো একদিন বিনয় মিনিস্টার হবে। এই বাসনাটি তার রক্তের মধ্যে কেঁচোর মতো বুকে হেঁটে বেড়াচ্ছে। সেই দিন এই মুক্ত কী ভাববে! ডা. সীতানাথের স্ত্রী সুধাকে সে কিছুই ফাঁকি দেয়নি। কিন্তু লীলা কী চোখে দেখবে ! স্ব-বিরোধ তার এইটুকুই। অনেক পাপ করে একদিন সে এমন একটি পর্যায়ে উঠবে, যে দিন সে পাপের উর্ধ্বে চলে যাবে। সে দিন সে এ জগতে ফিরে আসবে না, তাকাবে না, মনেও করবে না একবার। সে দিন সে ভাল কাজ করতে চাইবে, মহৎ হবে, উন্নত হবে। মন্দের সমস্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ভাল হবে সে।

তবু, তাদের সেই বাড়িটার ছিচকে প্রেতটা পায়ে পায়ে ঘুরছে তার। দেরি করা যায় না আর। লীলার কাছে আরও কিছু পাওয়ার আছে তার। হয়তো ওইটুকুই আসল পাওনা। পাঁচ দিন পরেই। ঘুরে আসছে সুলতা। তাতে ভয় নেই, সুযোগেরও অভাব হবে না। কিন্তু সুলতার চোখের সেই নিঃশব্দ ঘৃণার গুপ্তি বিধবে বার বার। অসুবিধা হবে নিশ্চিন্তে কাজ গোছাবার।

.

পাঁচ দিন গেল না। তিন দিন পরেই, সন্ধ্যাবেলা ফিরে এল চাকর গোপাল। গোপাল একলা, সুলতা আসেনি।

লীলার সঙ্গে বিনয় তখন উপরে।

বিনয় বলছে, তার বিষণ্ণ ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে, ঝুমি তোমার কি ভয় করে না একটু?

লীলার চোখেমুখেও আগুন। নতুন প্রেমের মাধুর্যে, প্রাণজুড়ানো শীতল ঢল নামেনি তার শরীরে। ঈষৎ কৃশ, আরও তীব্র হয়েছে তার নাগিনী তনু।

বলছে, কীসের ভয়, কাকে ভয়?

: বাবা, মা, ভাই, বোন।

: তারা আমার জীবনের কে?

: তোমার স্বামী !

: স্বামী কাকে বলে, আমি জানিনে। আমার ভয়ও নেই।

: আমাকে ভয় করো না তুমি ঝুমি?

ভয় কেন করব? এক মুহূর্ত থেমে বলছে লীলা, বিনচৌ এমন করে তাকায়, আমার মন মানে । কেন তাকায়, সে-ই জানে। ফাঁকি দিয়ে সরে যেতে মন চাইল না। বিনচৌ যদি কিছু পায় এমন করে চেয়ে, নিয়ে নিক। কী ধরে রাখব, কেন ধরে রাখব, কীসের জন্য, কার জন্য। ভাবি এই বুঝি ভালবাসা। বিনচৌও তো তাই বলে।

বলে খিলখিল করে তীক্ষ্ণস্বরে হেসে উঠছে লীলা। বলছে, পুরুষের ভালবাসা ! বিনচৌও পুরুষ। কেটে যেতে পারে বিনচৌ-এর ভালবাসা। জানি, জানি। ভয় কীসের। সেদিন বিনচৌ পালিয়ে বেড়াবে আমার কাছ থেকে।

বিনয় ঢুলুঢুলু চোখে করুণ গলায় বলছে, রাগ করছ ঝুমি।

লীলা হাসতে হাসতে ঝিকিমিকি করে উঠছে একটি তীক্ষ্ণ পাতলা ফলার মতো।

বিনয়ের বুকের কাছে দাঁড়িয়ে বলছে, না, বিনচৌ ভয়ের কথা বলছে তাই। যদি বাঁচতে না পারি, মরে যাব। ভয় কীসের।

এমন সময় গোপাল এল। নীচে ঠাকুর বলল গোপালকে, এসেছিস? শালা আবার একটা মেয়েমানুষ এসেছে কোত্থেকে। ওই যে লোকটা কারখানা করছে, তার বউ। বউমা কোথায়?

গোপাল বলল, আগে বল, বাবু কোথায়।

: উপরে। যাসনি, দরজার কাছে গিয়ে ডাক।

গোপাল এসে ডাকতেই চমকে উঠল বিনয়। ছুটে এল দরজায়। পেছনে লীলা। গোপাল শুধু একখানি চিঠি দিল। বিনয় আশ্চর্য শান্ত গলায় বলল, নীচে যা।

লীলা বলল, কীসের চিঠি?

বিনয় নিস্পৃহ গলায় বলল, কারখানার।

লীলা গোপালকে চেনে না। বিনয় চিঠিটি পড়ল, ইংরেজিতে লেখা

: ছেলেদের বোলপুর পৌঁছে দিলাম। তোমার চাকরকেও পাঠিয়ে দিলাম। আমি যাচ্ছি দিল্লিতে, আমার বাবার কাছে। অনেকদিন বাবাকে দেখিনি। সুলতা।

লীলা বলল, বিনচৌ-এর মুখ ভার হচ্ছে যে !

চিন্তিত সুরে বলল বিনয়, একটু বিপদে পড়েছি ঝুমি। তোমাকে বলব দু এক দিন বাদে।

লীলা চলে গেল একটু পরে। বিনয় ডাকল গোপালকে। গোপাল এল। দরজা বন্ধ করল বিনয়। একটি লিকলিকে বেত হাতে নিয়ে এসে দাঁড়াল সামনে। বলল, প্রত্যেকটি সত্যি কথা বলে যা।

গোপাল ভীত চোখে তাকিয়ে বলে গেল সব। সে কিছুই জানত না। সুলতার সঙ্গে সে বোলপুরে এসেছে। বোলপুরে পৌঁছে দিয়ে উনি হঠাৎ বললেন, গোপাল এই চিঠিটা তোমার বাবুকে দিয়ো । আমি আমার বাবার কাছে যাচ্ছি। তখন একটা গাড়ি দাঁড়িয়েছিল স্টেশনে। উনি সেটাতে চেপে বসলেন।

: তুই চেঁচালি না কেন?

: কী করে চেঁচাব?

: উনি পালিয়ে যাচ্ছেন বলে ।

: অনেক লোক ছিল। আমি চাকর মানুষ

বেতটা ফেলে দিয়ে সরে গেল বিনয় । মিথ্যে বলছে না গোপাল। তারই চালে ভুল হয়েছে। অনেকদিন বাদে নগেন্দ্রনাথের দিল্লির ঘরে, সেই রং-মাখা ঠোঁট দুটি ভেসে উঠল চোখের সামনে। যেন লাল ঠোঁট টিয়েটা ছাড়া পেয়ে পাখা ফুলিয়ে শিস দিচ্ছে। বিদ্রূপ করে হাসছে আপন মনে।

পরমুহূর্তে দেখল, নগেন্দ্রনাথের কোলের উপর পড়ে সুলতা কাঁদছে।

কাঁদছে সুলতা। হঠাৎ মনটা ছটফট করে উঠল। ভূতগ্রস্তের মতো। ফিরে বলল গোপালকে, চলে যা।

.

দ্বিতীয় তন্দুর হয়ে গেছে। কিন্তু কোনও ঘরটিই পুরো ওঠেনি। আর একটি তন্দুরের জন্য, মেঝে তৈরি করতেই রাজমিস্তিরিদের কয়েকদিন গেল। যদি বৃষ্টি আসে, বিপদ হবে। ধ্বসে যাবে তন্দুর। তবে, আকাশে মেঘের কোনও ভার নেই, শীতের শুষ্কতায় জমাট নীল হয়ে গেছে।

মেঘনাদ চেয়ে চেয়ে দেখছে। এর সঙ্গে সিরাজদিঘার কোনও মিল নেই। কেমন যেন একটু সাহেবি সাহেবি, শহুরে মতো দেখাচ্ছে। নতুন, একেবারে নতুন বাতাস নিয়ে আসবে সব কিছু তার জীবনে।

তার সমস্ত সঞ্চয়, জলের ধারায় বেরিয়ে যাচ্ছে হু হু করে। তাতে কোনও আপসোস নেই মেঘনাদের। এ যে তার ভারে ভারে টেনে আনা, জমানো জলাশয়। নালী কেটে ভাসিয়ে দিয়েছে তাকে, অনাবৃষ্টির খর জ্যৈষ্ঠ মাঠে। যে মাঠে মূর্তি ধরবে তার স্বপ্ন।

তবু নীল আকাশে বিদ্যুৎ চমকায় মাঝে মাঝে । রাজীব ফেরেনি এখনও দিল্লি থেকে। কী পুড়বে তন্দুরে, যদি ময়দা না পাওয়া যায় ! অবশ্য, বিনয় বলছে, আসবে দু এক দিনের মধ্যে।

আরও আছে এক রক্তক্ষয়ী বেদনা, চিরদিন আমরণ থাকবে সেই ব্যথা। লীলা আসেনি, দেখেনি।

বিজয় সময় পেলেই কাছে কাছে থাকে। কিন্তু তারও মনে দুশ্চিন্তা। ইউনিয়নের কমিটির জরুরি সভায়, নতুন নির্বাচন হয়ে গেছে। কিছুই বুঝতে পারছে না সে। রাজীবদাকে সেক্রেটারি রাখা হয়নি আর। বিনচৌ হঠাৎ ভীষণ কোম্পানি-বিদ্বেষী হয়ে উঠেছে। দরকার হলে, চটকল মজুরের হয়ে সে দিল্লি কাঁপিয়ে দেবে বলেছে। সেক্রেটারি হয়েছে সে।

ইদ্রিসের ছেলে নুরুল, পাণ্ডুয়ার আরও দু জন, রহিম আর পাঁচু এসে পড়ল। ১৭০

কিছু কিছু হিসাবরক্ষকের কাজ করছে নকুড়। কম্পিত হাতে কলম ধরে পাকা হিসেবির মতো আঁক কষছে। কলমের টান কী ! খাঁটি সওদাগরি বিন্যাস সেই লেখায়। তবু কী যেন হারিয়ে যাওয়ার সেই ভাবটি যায়নি এখনও।

ষোলো দিন পর রাজীব এল। বিনয়ের সঙ্গে দেখা করে বলল, ব্যবস্থা হয়ে গেছে। উধম সিং-ই সব ব্যবস্থা করেছে। তবে জমিরুদ্দিনকেও ডিনার পার্টি দেওয়া হয়েছে। বাবা! কী মদ খেতে পারেন জমিরুদ্দিন সাহেব। আর মেয়েদের ব্যাপারেও বড় নির্লজ্জ।

বাড়ি থেকে সন্ধ্যাবেলাই বেরিয়ে এল রাজীব। দিল্লি যাওয়ার দিন সন্ধ্যাবেলার কথাটি ভুলতে পারছে না কিছুতেই। সাহস করে বিজয়দের বাড়িতেই এল। হয়তো তিলি সব কথা সবাইকে বলেছে। দুনাম রটে গেছে সর্বত্র।

কিন্তু সেরকম কিছুই দেখতে পেল না সে। তেমনি একটু অদ্ভুত শ্লেষ ফিকে হাসি তিলির ঠোঁটে। কিন্তু চোখের দৃষ্টি একটু তীক্ষ্ণ।

তাকে দেখে বিজয় বলল, এই যে রাজীবদা, ইউনিয়নে গেছলেন নাকি?

রাজীব বলল, না। এই তো ঘণ্টা দুয়েক আগে এসেছি।

বিজয় নির্বিকার গলায়, ঈষৎ বিদ্রূপ মিশিয়ে বলল, ইউনিয়নে নতুন কমিটি হয়ে গেল। আপনি আর সেক্রেটারি নেই।

রাজীবের ফরসা মুখ রক্তহীন শবের মতো হয়ে উঠল। হঠাৎ কোনও কথা জোগাল না তার মুখে। বিজয় বলে গেল, বিনচৌ সেক্রেটারি হয়েছে। আপনি বড় মালিকঘেঁষা, বলেছে আপনার বন্ধুরা। বিনচৌ মজুরদের বলেছে, সে দিল্লি ইস্তক কাঁপিয়ে দেবে।

রাজীবের মনে হচ্ছিল, তার হাত পা ঝিমঝিম করছে। পড়ে যাবে এখুনি। যে ভয় সে করেছিল, তা-ই হয়েছে। দলের সমস্ত ইউনিটটাই তা হলে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আর মজুর সভ্যরা, ওরা তো গড্ডালিকাপ্রবাহ। চোখের বাইরে তো মনেরও বাইরে। একবার অদর্শন হলেই ভুলে যায়। এর নাম চটকল এলাকা। তার চোখের সামনে বিনয় আর সুখেন্দু রায় মজুমদারের মুখ দুটি ভাসতে লাগল। রাজনীতি ! এর নাম রাজনীতি ! তার এতদিনের আশা ভরসা, এতদিনের পলে পলে তৈরি তার ভবিষ্যৎ, সমস্ত ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।

অবশ্য নিয়ম শৃঙ্খলার অভাব অভিযোগ, সবই সে করবে এই নতুন নির্বাচনের বিরুদ্ধে। তবু সুখেন্দু মজুমদার রয়েছে শাসন ক্ষমতায়।

তার ইচ্ছে হল, চিৎকার করে ওঠে, গলা ফাটিয়ে, সকলের সব পাপ ঘোষণা করে দেয়। কিন্তু সাহস হল না। এমনকী বিনয়ের বিরুদ্ধে বিজয়কেও সে কিছু বলতে পারল না। তা হলে, সে নিজেও ভাসবে না, ডুববে।

বিজয় বলল, রাজীবদা, আপনাকে মজুররা পুরোপুরি বিশ্বাস হয়তো করত না। কিন্তু বিনচৌকে কেউ একটুও বিশ্বাস করে না।

: তবে বিনচৌ সেক্রেটারি হল কী করে?

আজ রাজীবও বিনচৌ বলছে। বিজয় বলল, মজুরদের তো আপনি জানেন। কমিটির হিন্দুস্থানি মজুর মেম্বাররা সবাই বিনচৌকে ভোট দিয়েছে। নিজেরা দেয়নি, দিইয়েছে। তবে, আমরা ইউনিয়নের ভরসায় আর থাকব না। দরকার হলে আমরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে কমিটি করে নেব।

রাজীবের ইচ্ছে করল, একটি চড় কষিয়ে দেয় বিজয়ের গালে। কিন্তু নিজেকে শান্ত করে রাখল সে। তার এখন থেমে থাকা ছাড়া উপায় নেই।

মনটা তার হঠাৎ তিলির দিকে ঝুঁকে পড়ল আরও। জীবনে এত বড় আঘাত সে আর কখনও পায়নি। তার সারা মুখে একটি অদ্ভুত অসহায় ব্যথা, ক্লিন্নতা। তিলি তার মুখের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হল। বলল, কী, চা খাবেন?

রাজীব দেখল, কোনও মালিন্য, কলঙ্ক, রাগ বা ঘৃণা নেই তিলির মুখে। কাছাকাছি কেউ নেই। রাজীব বলল, ঠুমি, তুমি আমাকে ভুল বোঝোনি তো?

তিলির ইচ্ছে হল বলে, আপনিই ভুল করে একটা কাণ্ড করেছিলেন। এতে আর ভুল বোঝাবুঝির কী আছে।

কিন্তু সে তেমনই হেসে বলল, না। চা খাবেন?

অবাক হয়ে রাজীব শুধু বলল, হ্যাঁ খাব।

.

দেড় মাস হয়ে গেল। কারখানা প্রায় শেষ হল। কোনও রকম এনকোয়ারি হয়নি। পারমিট এসে পড়েছে। বিনয়ের কাছে রয়েছে। এখানকার র‍্যাশনিং অফিসার কিংবা লোকাল ডিলারের সঙ্গে কোনও কথা হয়নি মেঘনাদের। 

বোর্ড অফ মেশিন ইনডাস্ট্রির অফিসারও আসেনি মেঘনাদের যন্ত্র দেখতে, পরীক্ষা করতে। সব কিছু দেখছে, করছে বিনয়। বিনয় বলেছে, আপনাকে ও সব কিছু ভাবতে হবে না। আপনি কারখানা দেখুন। যেদিন বলবেন, ময়দা চিনি আপনার ঘরে পৌঁছবে।

রাজমিস্তিরির সঙ্গে কথা বলল মেঘনাদ। মিস্তিরি বলল চারদিকে পাঁচিল দেওয়ার দরকার। নইলে বড় খোলামেলা থাকবে।

মেঘনাদ বলল, পাঁচিল দেও মিস্তিরি। কিন্তু এবার আমি আগুন দেব তন্দুরে।

মিস্তিরি বলল, দিন, ও ঘরে আর তো আমার কোনও কাজ নেই। আমার কাজ এখন আপনার মালখানা আর অফিসঘর।

অফিসঘর? মেঘনাদ হেসে ফেলল। যাকে বলে গদিঘর, তাকেই বলে অফিসঘর। লোকজন আসবে, বসবে, পাইকাররা দরাদরি করবে, হিসাবকিতাব হবে। বিনয় বলেছে, টেবিল চেয়ার পাতা। হবে সেই ঘরে। একজন লেখাপড়া জানা ম্যানেজার রাখতে হবে।

ম্যানেজার! যত ভাবে, তত মেঘনাদের গোঁফের ফাঁকে ফাঁকে হাসির লুকোচুরি। একটি লোককে নিয়ে এসেছিল বিনয়। নাম হরিহর। একটু খুঁড়িয়ে চলে। বয়স চল্লিশের ঘরে। চোখ দুটো কেমন যেন শেয়ালের মতো। এদিকে রোগা, কিন্তু মোটা মোটা ঠোঁটের কোণে একটা বিশ্রী হাসি। কিছু ইংরেজি লেখাপড়া জানে। মেঘনাদকে এসে বলেছিল, নমস্কার স্যার।

মেঘনাদের মনে হচ্ছিল, লোকটা যেন তার সঙ্গে ইয়ার্কি করছে। তার ভাল লাগেনি। কিন্তু বিনয় নিয়ে এসেছে। তবে বেশি নয় মাত্র পঁয়ত্রিশ টাকা মাইনের ম্যানেজার ! বিনয় বলেছে, লোকটি কাজেকর্মে খুব ভাল, ব্যবসাও বোঝে। মাস দুয়েক রেখে যদি মাইনে টানা না যায়, বিদায় করে দিতে কতক্ষণ।

হরিহর আসছে রোজ। এখন থেকেই তার দেখাশোনার কাজ আরম্ভ হয়ে গেছে। কিন্তু হিসেবটা আছে নকুড়ের হাতেই।

আরও অনেক লোক আসছে রোজ। কারখানার কারিগর মিস্তিরির কাজের জন্য আসছে অনেকে। ইদ্রিসের ছেলে নুরুলই একজন পাকা মিস্তিরি । মেঘনাদ নিজে রয়েছে। মিস্তিরির দরকার নেই তার এখন।

তন্দুরে আগুন দিল মেঘনাদ। এ আগুন দিয়ে, রুটি বিস্কুট সেঁকা হবে না। মাটি আর ইটের সাধারণ উত্তাপ থেকে, প্রথম আগুন দিয়ে তন্দুরের তাপমাত্রা বজায় রাখতে হবে। দেশীয় মিস্তিরিরা উত্তাপের মাপ জানে না। তাদের জ্ঞান থার্মোমিটার ছাড়া গায়ে হাত দিয়ে জ্বর দেখার মতো। কিন্তু নির্ভুল হয় কাজের সময়। তন্দুর ঠিক তাই। সর্বক্ষণের সাধারণ তাপ নেমে গেলে মানুষের মতো তন্দুরও শেষ হয়ে যায়। আবার তাকে সাধারণ তাপে ফিরিয়ে আনতে হয়। তারপর রুটি বিস্কুট সেঁকার জন্য নতুন করে আগুন দিতে হয় রোজ। থেমে থাকা চলবে না। এ সব ঝামেলা নেই ইলেকট্রিক হিটারে।

তন্দুরের সাধারণ উত্তাপ তুলতেই আগুন লাগে সব চেয়ে বেশি। তন্দুরে প্রাণ সঞ্চারিত হয় প্রথম আগুনেই।

এক শো মন কাঠ এসেছে। দুটো তন্দুরে প্রায় প্রথম আগুনে আশি মন কাঠ লাগবে।

মেঘনাদ নিজে টিণ্ডাল হয়ে বিকেলবেলা আগুন দিল। নুরুল, পাঁচুমিঞা, চালিস, সবাই আছে সঙ্গে। ইদ্রিস কাজ ছাড়েনি হোটেলের।

আর চারদিকে হেঁকে ডেকে হুমকে লেংচে লেংচে ফিরছে হরিহর। কখনও চালিসকে ধমকাচ্ছে, নুরুলকে বকছে। তাড়া দিচ্ছে রাজমিস্তিরিদের।

নকুড় দেখছে সব চুপচাপ। হিসেবটা ঠিকই আছে। কিন্তু মাথায় আর অঙ্ক নেই। একবারের জায়গায় দশবার গুনতে হচ্ছে। হরিহর তাকে এসে বলছে, কী ! অসুবিধে হচ্ছে? আমাকে দিন না, হিসেব করে দিচ্ছি।

নকুড় অপলক ছানিপড়া চোখে চেয়ে থাকে। যেন বোবা। তার উপরে রুগ্ন দেখাচ্ছে ভীষণ। হরিহর মনে মনে বলে, ব্যাটা বুড়োর ভীমরতি হয়েছে। বোধ হয় মরবে। ভালই হয়।

বিজয় এসে বোনাইকে দেখে অবাক। পোড়া কাঠের কালি লেগেছে গায়ে। কাপড় এঁটেছে কোমরে। ধোঁয়ায় রং পালটে গেছে সর্বাঙ্গের।

আর দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে তন্দুরে। বাইরে থেকে দেখা যায় না। লোলায়মান জিহ্বার মতো লেলিহান শিখা বেরিয়ে আসছে ছোট হাঁ মুখ দিয়ে।

বিজয়ের সঙ্গে তন্দুরঘরের বাইরে উঠোনে এসে দাঁড়াল মেঘনাদ। আগুনে পুড়ে মুখটা লাল টকটকে দেখাচ্ছে। বিজয় বলল, একেবারে বয়লার মিস্তিরি হয়ে গেছে যে বোনাই।

মেঘনাদের চোখে অসহ্য উদ্দীপনা। সজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে উঠেছে পাঁশুটে গোঁফ। কারখানার চিমনির ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, বিজয়, ঠিক ওই ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকটরির মতো দেখাচ্ছে, না?

হাসি পেল বিজয়ের। কোথায় ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকটরি, তার বয়লার, আর কোথায় রুটি বিস্কুটের কারখানার তন্দুরের চিমনি। বোনাইয়ের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু বোনাইয়ের মুখটি দেখে তার খুব ভাল লাগছে। বলল, পেরায় তাই।

মেঘনাদ আবার বলল, মেশিন বসলেই অন্যরকম হয়ে যাবে। একটা শব্দ হবে, না? ঘররর, ঘিচ ঘিচ, সোঁ সোঁ ! হা হা হা। বছর পাঁচেকের মধ্যেই হবে আশা করি।

বিজয় অবাক হয়ে হেসে উঠল। সেই মন্দিরের কথা বলছে বোনাই। কারখানার আনন্দেও মানুষ এমন করে! করে নিশ্চয়ই। মুনাফা আসবে একদিন মুঠো মুঠো, টাকার আনন্দে মানুষ সবই করে। কিন্তু বোনাইকে এত বোকা লাগছে, রাগ করতে পারছে না বিজয়।

কালো ধোঁয়ারাশি কুণ্ডলী পাকিয়ে ধীরে ধীরে সরছে দক্ষিণে, উত্তরে বাতাস। শীত পড়েছে। মেঘনাদের চোখের সামনে থেকে ভেসে ভেসে উঠছে সিরাজদিঘার ছবি। সেই কারখানার সেই ধোঁয়া, ধলেশ্বরীর বুকে ছায়া ফেলে উড়ছে।

একটু একটু অন্ধকার হয়েছে। হ্যারিকেন জ্বলছে। ইলেকট্রিক কানেকশন নেওয়া হবে কয়েকদিন পরে। প্রায় শূন্য হয়ে এসেছে মেঘনাদের থলি। এখনও ময়দা, চিনি, মজুর, সকলের জন্য কিছু কিছু রাখতে হচ্ছে। নইলে কারখানা চলবে কী করে। এখনও মাসখানেক বাজার পরখ করতে হবে।

হঠাৎ হরিহর খেঁকিয়ে উঠল, এই ব্যাটাচ্ছেলেরা এখানে দাঁড়িয়ে কে রে। অ্যাাঁ? যা, কাজে যা।

মেঘনাদ বিরক্ত হয়ে ফিরে তাকাল। হরিহর চিনতে পেরে তাড়াতাড়ি, কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, ও, আপনি স্যার। ভেরি সরি ! একদম রিকগনাইজ করতে পারিনি।

ঠোঁটে তার সেই নোংরা ইয়ার্কি মারা হাসি। যেন ঠাট্টা করছে। তার কথার অর্ধেক বুঝতে পারল না মেঘনাদ। কথা বলতেও প্রবৃত্তি হল না। বিরক্ত কুঞ্চিত চোখে শুধু তাকিয়ে রইল।

হরিহর সরে গেল। বিজয় বলল, ল্যাংচা হরে তোমার ম্যানেজার হয়েছে তো?

মেঘনাদ বলল, বিনয়বাবু এনে দিয়েছেন।

বিনয়বাবু! বিজয়ের মাথার মধ্যে আগুন জ্বলতে লাগল। এর মধ্যেই আবার চিপ র‍্যাশন তুলে দেওয়ার নোটিশ আসছে। শোনা যাচ্ছে, বিনচৌ চিপ র‍্যাশনের বিপক্ষে। সে বলল, বোনাই, তোমাকে বাড়িতে যেতে বলল তুমি। ওবেলা নাকি খাওনি?

: এইবার যাব।

: তুমি যাও, আমি একটু ইউনিয়নে যাচ্ছি।

সে চলে গেল। বিনয় এল। হেসে বলল, বাঃ কারখানা চালু হয়ে গেছে দেখছি।

মেঘনাদ উৎফুল্ল হয়ে উঠল। মনে মনে সে বিনয়ের কথাই ভাবছিল। বিনয়বাবু, কালকে বিকালে আমার মাল চাই

:কালকেই আরম্ভ করবেন?

: হ্যাঁ, আর দেরি নয়। সব দিক সামলাতে হবে তো।

: বেশ। আচ্ছা, আপনি কি ষাট মন ময়দাই আনাবেন এখন?

মেঘনাদের মস্ত মুখে, গোঁফের ফাঁকে লজ্জা ও খুশির হাসি। বলল, না, এত মাল এনে কী করব, বলেন। পাঁচ সাত মন মালেই আমার কাজ চলবে কাল। চাহিদা বুঝে আমাকে কাজ করতে হবে। কিন্তু, মাল কম নিলে, পারমিটের কোনও ক্ষতি হবে না তো।

: কিছুমাত্র না। সে সব ভার আমার।

কী করবেন বাকি মালটা। এখন কয়েক সপ্তাহ তো পুরো মাল আনানো যাবে না।

: র‍্যাশনের দোকানওয়ালারা কিনে নিয়ে আপনাকে দু হাতে আশীর্বাদ করবে।

বলে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেসে উঠল বিনয়। বিষণ্ণ চোখ দুটিতে মাতালের নেশাচ্ছন্নতা। এই ব্যাপারটি মেঘনাদ বুঝল। বুঝল, সমস্ত ময়দাটা যাবে চোরাবাজারে। যদি চল্লিশ মনও যায়। সেখানে, তা হলেও চোরাকারবারিরা গড়পড়তা আটশো টাকা সপ্তাহে সপ্তাহে রোজগার করবে। একেবারে মাগনা।

টাকার টান, বড় টান। বিনয় নিজেই কারবার করবে কিনা মেঘনাদ জিজ্ঞেস করতে পারল না। তারও মনটা চনমন করে উঠল একবার। পরমুহূর্তেই ছি ছি করে উঠল সে। মনে পড়ল। লালমিঞার কথা। চোরাকারবারে অনায়াস টাকার বন্যায় অনেকবার ভাসতে গিয়ে ফিরে এসেছে সে। আজ আবার। কেন, সামনে রয়েছে তার নতুন কারখানা। সে কেন যাবে এই পথে।

বিনয় বলল, কিন্তু আপনার বেকারির একটা নামটাম দিন।

মেঘনাদ হাসল। বলল, নাম আর কী দেব বলেন। বিস্কুটের নামটা অবশ্য দেব।

: কেন, আপনার বেকারির একটা নাম থাকা দরকার। একটা হ্যান্ডবিল ছেড়ে দেওয়া যাক পাঁচ সাত টাকা খরচ করে।

মেঘনাদ বললে, বলেন তো কী নাম দেওয়া যায়।

বিনয় টানা টানা গম্ভীর চোখে চেয়েছিল চিমনির দিকে। বলল, লীলা বেকারি নাম দিন না।

লীলা বেকারি ! লীলা। লীলা নয় ঝুমি। মেঘনাদ জানে, বিনয়ের সঙ্গে লীলার বড় ভাব। তার চেয়ে লীলার কথা বিনয় বেশি বলে। তার নিজের মনে আসেনি, বিনয় বলছে লীলার নামে বেকারি করতে। প্রায় সন্ধ্যাতেই তিলিকে জিজ্ঞেস করলে শুনতে পায় লীলা বিনয়ের বাড়ি বেড়াতে গেছে। নিরভিমান শিক্ষিত উদার বিনয়, অশিক্ষিত মহিলার সঙ্গে আলাপে উন্নাসিকতা নেই।

লীলার মধ্যেও এক গুরুতর পরিবর্তন দেখছে মেঘনাদ। সে আজও আসেনি কারখানায়। তার তীব্রতা আরও বেড়েছে, বিদ্রূপ বিদ্বেষের ভার আরও শাণিত। শত কাজের মাঝেও আশ্চর্যরকমভাবে লীলার কথা মনে পড়ে যায়। তিলির সঙ্গে লীলার কথা বন্ধ হয়ে গেছে। কী হয়েছে, মেঘনাদ কিছুই জানে না।

শুধু বুকের মধ্যে পোকা খায় কুরে কুরে। কিন্তু এত বড় বুক, এত কাজের মানুষ, বাইরে থেকে তার কিছু চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। আর তিলি যেন তাকে কী বলতে চায়। কাছে আসে অদ্ভুতভাবে, অভিমানভরা ছলছল চোখে চায় আর সরে যায়। ওই মেয়েটির জন্যও তার বুকে এক বিচিত্র করুণ বাষ্প জমে উঠছে। কাছে থেকে স্নেহ করতে, আদর করতে ইচ্ছা করে।

আর বিনয় লীলার কথা বলে এমনভাবে, যেন মেঘনাদের চেয়েও লীলা তার কাছাকাছি বেশি। সে বলল বিনয়কে, বেশ তো, লীলার নামেই হোক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *