একদিন দুপুরের রোদ ঠেলিয়া বিলের পার দিয়া মোড়লকে ফিরিয়া আসিতে দেখা গেল।
মোড়লের মুখের দিকে তাকানো যায় না। পর্বতপ্রমাণ কাঠিন্য আসিয়া আশ্রয় করিয়াছে। ভয়ংকর একটা-কিছু যে ঘটিতে যাইতেছে তাহাতে কাহারো দ্বিমত রহিল না।
এইরূপ সময়ে একদিন মোড়লের বাড়িতে কিশোরের ডাক পড়িল।
কিশোর ছিল অন্যরকম চিন্তায় বিভোর। সে রাতদিন কেবল ভাবিয়া চলিয়াচিলঃ কোনো-একটা অলৌকিক উপায়ে ঐ মেয়েটির সহিত তাহার বিবাহের আয়োজন হইতে পারে কিনা। তাহা না হইলে কিশোরের বাঁচিয়া থাকিয়া লাভ কি? কে তাহার পক্ষ হইতে উহাদের কাছে কথাটা তুলিবে।
মোড়লের কাছে খুলিয়া বলা যাইত। কিন্তু তার মনের যা অবস্থা।
এমন সময় মোড়লের ডাকে কিশোর ভয়ে ভয়ে তাঁহার কাছে গিয়া দাঁড়াইল। মোড়লের কথা বলিবার সময় নাই। হাতে ইসারা করিয়া মুখে শুধু বলিল, ‘আমার স্তিরাচারে ডাকছে।’
এখানে কাজ এত আগাইয়া রহিয়াছে, অথচ কিশোর ইহার কিছুই জানে না। সে মোড়ল-গিন্নির পায়ের ধূলা লইয়া দাঁড়াইতেই, গিন্নি তাহাকে একটা ঘরের ভিতরে লইয়া গেল। সেখানে নূতন একটা শাড়ি পরিয়া, পানের রসে ঠোঁট রাঙা করিয়া, এবং গালে-মুখে তেলের ছোপ লইয়া সেই মেয়েটা বারবার লাজে রাঙা হইয়া উঠিতেছে।
মোড়ল গিন্নির হাতে দুইটি ফুলের মালা। একটি কিশোরের হাতে তুলিয়া দিয়া বলিল, ‘শাস্ত্র মতে বিয়া কইর দেশে গিয়া। অখন মালাবদল কইরা রাখ।’
মালাবদল হইয়া গেল, মোড়ল-গিন্নি হঠাৎ ঘরের বাহির হইয়া শিকল তুলিয়া দিল।
মেয়েটি ভয় পাইয়াছিল। দরজা বন্ধ, অন্ধকার ঘর। কারো মুখ কেউ দেখিতে পায় না। অবশেষে কিশোর তাহার ভয় দূর করিল।
পরে মোড়লগিন্নি শিকল খুলিয়া বন্দীকে মুক্তি দিয়া বাহির করিয়া দিল; আর বন্দিনীকে ভগিনীস্নেহে স্নান করাইয়া দিয়া রান্নাঘরে নিয়া বসাইল। কিশোরকে বলিল দিল, ‘দেখ জাল্লা উতলা হইয়া পাখির মত পাখ বাড়াইও না, রইয়া-সইয়া আগমন কইর।’
পরের দিন মেয়ের মা দেখিতে আসিল। মোড়ল-গিন্নিকে বলিল, ‘মালাবদল হইয়া গেছে ত?’
‘হ, হইয়া গেছে।’
‘আর দেখাসাক্ষাৎ করাইও না মা। অমঙ্গল হয়। দেশে গিয়া আগে শাস্ত্রমতে বিয়া হোক। কপালের কি গরদিস মা। জামাই পাইয়া মাইয়া আমার পর হইয়া গেল। আমার ত তাতে কোন অনাহলাদ নাই। অখন ঘরের মানুষেরে নিয়া কথা। সে-মানুষে না জানি কি করে।’
সকল কথা শুনিয়া সুবল আনন্দে লাফাইয়া উঠিয়া বলে, ‘দাদা, তা অইলে বাসন্তীরে তুমি ইখানেই পাইয়া গেলা। অখন দেশের বাসন্তীরে কার হাতে তুইল্যা দিবা কও।’
‘তোর হাতে দিয়া দিলাম।’
সুবলের মনে একটা আশার রেশ গুন্ গুন্ করিয়া উঠে।