সায়েবডাঙা, কেউ বলে কুঠিডাঙা।
পাথুরে মাটির ঢলন একটা খানিকটা উঁচু খানিকটা নিচু, আবার খানিকটা উঁচু-লাল কাকরে ভরাঢেউ খেলানোর ভঙ্গিতে একটা ঢলন যেন নেমে এসেছে সাঁওতাল পরগনার পাহাড়ের দেশ থেকে। পশ্চিম থেকে পুবে চলে এসেছে একটা ব-দ্বীপের চেহারা নিয়ে। এই ঢলনের আশপাশে বাংলাদেশের মাটি। সেখানেই দেশের চাষের মাঠ, সেসব মাঠে নানা ফসল ফলে। হাঁসুলীর বকে—এই লাল মাটির একটা ফালি এসে শেষ হয়েছে হাঁসুলী বাঁকের উত্তরপশ্চিম মাথায়। এইখানে নীলকর সাহেবেরা তাদের কুঠি তুলেছিল। এই মাটিতে আট মাস ঘাস জন্মায় না, আষাঢ় থেকে আশ্বিন পর্যন্ত কঠিন রোগে চুল-উঠে-যাওয়া মানুষের মাথায় সদ্যগজানো রোগা চুলের মত পঙাশ-সবুজ রঙের ঘাস গজায়। উঁচু সায়েবডাঙায় ঢলন ক্রমশ নিচু হয়ে কোপাইয়ের চরের সঙ্গে মিশে এক হয়ে গিয়েছে। কোপাইয়ের বন্যার ভয়েও বটে, এবং বন-জঙ্গলে কাদা নাই—ঝকঝকে তকতকে বলেও বটে, সাহেবরা এইখানে কুঠি তুলেছিল। সাহেবদের আমলে এই ডাঙা ছিল রাজপুরী।
সুচাঁদ বলে-বাবারা বলত, অ্যাই বড় বড় ঘোড়া, এই ঝালর দেওয়া সওয়ারী অর্থাৎ পালকি। এই সব বাংলা-ঘর, ফুল বাগিচা, বাঁধানো খেলার জায়গা, কাঠ-কাঠরার আসবাব; সে ঐশ্বর্যের কথা এক মুখে বলা যায় না। এক দিকে কাছারি গমগম করত, বন্দুক নিয়ে পাহারা দিত পাইক আটপৌরেরা মাথায় পাগড়ি বেঁধে লাঠি নিয়ে বসে পাহারা দিত। জোড়হাত করে বসে। থাকত চাষী সজ্জনেরাভয়ে মুখ চুন। দু-দশজনাকে বেঁধে রাখত। কারুর শুধু হাতে দড়ি, কারুর বা হাত-পা দুই-ই বাধা। সায়েব লোক, রাঙা রাঙা মুখ, কটা কটা চোখ, গিরিমাটির মত চুল, পায়ে অ্যাই বুট জুতো—খটমট করে বেড়াত, পিঠে ‘প্যাটে’ জুতোসুদ্ধ লাথি বসিয়ে। দিত, মুখে কটমটে হিন্দি বাত মারডালো, লাগাও চাবুক, দেখলাও শালোলোগকো সায়েব লোকের প্যাচ। কখনও হুকুম হত—কয়েদ করো। কখনও হুকুম হত–ভাঙ দেও শাপলালোকের ধানকো জমি। লয়তো, কাটকে লেও শালোকে জমির ধান। সে তোমার বামুন নাই, কায়েত নাই, সদ্গোপ নাই—সব এক হাল। ‘আতে’ সারি সারি বাতি জ্বলত-টুং-টাং–কাঁ-কোঁ—ভ্যাঁ-পো ভাঁ-পো বাজনা বাজত, সায়েব মেম বিলিতি মদ খেত, হাত ধরাধরি করে নাচত, কয়েদখানায় মানুষ চেঁচালে হাকিড়ে উঠত বাঘের মত—মৎ চিল্লাও। বেশি ‘আত’ হলে সেপাইরা বন্দুকের রজ করত—দুম-দুম-দুম-দুম। হাক দিত-ও-হো-ই। তফাত যাও—তফাত যাওচোর বদমাশ হুঁশিয়ার! চোরই হোক আর সাধুই হোক এতে ওদিকে হাঁটলে অক্ষে থাকত না; দুম করে গুলি করে দিত।
সেই ডাঙা এখন ধুধু করছে। নীলকুঠির চিহ্নের মধ্যে আছে কেবল সাহেবদের লাগানো আমবাগান। তারই মধ্যে ভাঙা নীলের হ্রদগুলো, আর বাংলোর কিছু কিছু ভিত। সেগুলোর চারিপাশে ঘন ঝোপ-জঙ্গল গজিয়েছে। কাকুরে পাথুরে ডাঙার এই ঠাঁইটুকুতে সাহেবরা সার মাটি দিয়ে খুঁড়ে-খুসে জল ঢেলে অদ্ভুত উর্বর করে তুলেছিল। তখন ছিল বাগান, এখন জঙ্গল। বাকিটা চিরকালের সেই লাল মাটি ধু-ধু করছে।
সুচাঁদ ডাঙাটার ধারে দাঁড়িয়ে মধ্যে মধ্যে কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছে আক্ষেপ করে। চোখ দিয়ে তার সত্যই জল পড়ে। হাঁসুলীর বাঁকে বাঁশবাঁদির কাহারপাড়ায় মানুষদের প্রকৃতি আছে, চরিত্র নাই। অল্পেই ওরা হাসে, অল্পেই ওরা কাদে; নিজের দুঃখেও কদে, পরের দুঃখেও কদে। মহাবনে মহাগজ পতনের সংবাদ পেলে কৌতূহলবশত দেখতে যায় এবং এত বড় দেহটি অসাড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখে ভাবাবেগে অভিভূত হয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদে। তবে ওদের পুণ্য নাই। ওদের চোখের জলের স্পর্শে মৃত জীবন্ত হয়ে ওঠে না। সুচাঁদের মুখে সাহেবডাঙার গল্প শুনে সবাই চোখ মোছে, তবে সুচাঁদের মত এত কাদতে কেউ পারে না। সুচাঁদ সেই উপকথার শেষের যুগের মানুষ যে!
সুচাঁদ চোখ মুছে বলে—আঃ আঃ, রোপোকথায় সেই যে বলে, রাক্ষুসীর খাওয়া পুরী, এ তাই। খা-খাখা করছে।
সত্যই খখা করে। মানুষজন ওদিকে বড় কেউ আসে না। দাতালের আড্ডা, জঙ্গলে-ভরা ভাঙা নীলকুঠি। রাত্রে ওরাই দল বেঁধে বার হয়, ছুটে গিয়ে পড়ে নদীর ধারে, পঁতে মাটি চিরে নানান গাছের মূল তুলে খায়। ধানের সময় মাঠে গিয়ে পড়ে। মাঠে মাচান বেঁধে টিন বাজিয়ে কাহারেরা তাদের তাড়ায়। ছোট ছোট বাখারিতে শক্ত দড়ি-গাথা বড়শি বেঁধে মদের মেয়া ও কলার টোপ গেঁথে ছড়িয়ে দেয় মাঠময়, ধান খেতে এসে মুখে বড়শি গেঁথে পায়ে দড়ি আটকে দাঁড়িয়ে থাকে, সকালে কাহাররা ধরে মারে। বেশি উপদ্রব হলে দল বেঁধে গিয়ে মেরে আসে
ওদের।
সেই কুঠিডাঙায় কোদালের কোপ পড়ছে।
জল ঝড় হয়ে গিয়েছে দুদিন আগে। বৃষ্টি বেশ পর্যাপ্ত পরিমাণেই হয়েছে। চন্দনপুরের বড়বাবুরা সাঁওতাল মজুর লাগিয়েছেন প্রায় দেড়শো। এই লাল কাকুরে মাটির একটি বিশেষত্ব আছে। যে মাটি পাথরের মত শক্ত, কোদালে কাটে না, কোপ মারলে খানিকটা লাল ধুলো ওড়ে, চোখে মুখে মিহি বালি ছিটকে লাগে, সেই মাটি বৃষ্টিতে ভিজলে কয়েকদিন ধরে ভুরোর মত নরম হয়ে থাকে। মাটির এই অবস্থার নাম ‘বতর’। এখানকার মাটি কাটার সুযোগ এই বতরে। এ সুযোগ চলে গেলে মাটি কাটা আবার কঠিন হয়ে পড়বে। সাহেবডাঙার যে ঢালটা নেমেছে। কোপাইয়ের দিকে, সেই ঢালে চাষের জমি তৈরি হচ্ছে। ঢালের শেষ অংশটায় চন্ননপুরের বড়বাবুদের নিজের জমি তৈরি করছে সাঁওতালরা।
কাছাকাছি জাঙলের সদ্গোপ মহাশয়দের কয়েকজন সেলামি দিয়ে খাজনা-বন্দোবস্তিতে জায়গা নিয়েছে। তারা নিজেরা বসে আছে, খাটছে কিষান মাহিন্দার সঙ্গে দু-চারজন মজুর। বনওয়ারী সবচেয়ে খারাপ পাঁচ বিঘা জায়গা নিয়েছে। বিনা সেলামিতে জমি, নীরস তো হবেই। তা ছাড়া কাহারদের অদৃষ্টে এর চেয়ে ভাল জমি হবেই-বা কেন? সে নিজেই কোপাবে মাটি, সেই মাটি ঝুড়িতে তুলে মাথায় বয়ে আলবন্দি করে ফেলবে বনওয়ারীর বউ আর সুচাঁদ পিসি। সুচাঁদ পিসিকে বনওয়ারী মজুর দেবে অবশ্য। তিনপহর খাটবে, চোদ্দ পয়সা নগদ পাবে আর পাবে জলখাবার মুড়ি। আর কথা আছে বিকেলবেলা ঠাণ্ডার সময় ছুটির পর প্রহ্লাদ রতন পানু আরও জনকয়েক কোদাল নিয়ে এসে মাটি কেটে রেখে যাবে। পরের দিন সেই মাটি তুলে ফেলবার জন্য পাড়ার কয়েকজন মেয়েকে লাগাবে বনওয়ারী। বনওয়ারী হাঁটু গেড়ে বসে প্রণাম করলে—‘আচোটা মাটিকে’ অর্থাৎ ভূমিকে। মনে মনে বললে—তোমার অঙ্গে আঘাত করি নাই। মা, তোমার অঙ্গকে মার্জনা করছি। সেবা করছি তোমার। তুমি ফসল দিয়ে। আমার ঘরে অচনা। হয়ে থেকো। তারপর সে কোচড় থেকে খুলে সেখানে নামিয়ে দিলে—বাবাঠাকুরের পুজোর ফুল। জয় বাবা, তুমি অক্ষে কর। যেন পাথর না বার হয়। কোনো জন্তু জানোয়ার না বার হয়। হাতে তালি দিয়ে বললেকীট-পতঙ্গ, সাপ-খোপ সাবধান, তোমরা সরে যাও। আমি আজার কাছে জমি নিয়েছি, দেবতার কাছে আদেশ নিয়েছি—এ জমি আমি কাটব। সে কোপাতে লাগল। সদ্গোপ মহাশয়েরা নিজে কোয় তামাক খেয়ে মধ্যে মধ্যে কৃষাণ মাহিন্দারদের দিচ্ছেন। সাঁওতালরা ‘চুটা’ খাচ্ছে, বনওয়ারী দু পয়সার বিড়ি কিনে এনেছে, নিজে খানিকটা খেয়ে এটো। বিড়ি বউকে দিচ্ছে, সুচাঁদকে দিচ্ছে গোটা বিড়িই। পিসিও বটে, তা ছাড়া পুরো একটা বিড়ি না খেলে সুচাঁদের নেশা হবে না। কিন্তু সুচাঁদও বিড়ি খেতে চায় না, তামাকই তার সবচেয়ে প্রিয়। হঠাৎ সুচাঁদ হেদো মণ্ডলের কাছে গিয়ে বললে—কল্কেটা একবার দাও কেনে গো!
মণ্ডল বিনা বাক্যব্যয়েই কন্ধেটা নামিয়ে দিলেন। সুচাঁদ মণ্ডলের সামনেই উবু হয়ে, অবশ্য লজ্জা করে পিছন ফিরে বসে নারীত্বের ভূষণ বজায় রেখে তামাক খেতে লাগল। হঠাৎ এক সময় লজ্জা ভুলে সামনে ফিরে বললে—তুমি তো তবু কল্কে দিলে মোড়ল, পানার মুনিব হলে মারতে আসত আমাকে। অথচ আমার মেয়ের তরে যখন অঙ ধরেছিল, তখন আমার পায়ে ধরতে এসেছিল।
হেদো মণ্ডল ধমক দিয়ে চিৎকার করে বললেন—থা, এখানে বকবক করিস না। হেদো মণ্ডলের গলার আওয়াজ একেই খুব জোর, তার উপর সুচাঁদকে কালা জেনে চিৎকার করেই কথা বলায় সুচাঁদ স্পষ্ট শুনতে পেল কথাগুলি। এর জন্য সে হেদো মণ্ডলের উপর বরাবরই খুব সন্তুষ্ট।
–বকবক করব না?
–না।
কিছুক্ষণ হেদো মণ্ডলের মুখের দিকে চেয়ে রইল সুচাঁদ, তারপর বললে—সব শেয়ালের এক রা! তা বেশ। আবার সে তামাক খেতে লাগল। আবার বললে—তোমরা আর কোদাল ধরবা না, লয়?
হেদো মণ্ডল বলে উঠলেন—এ-হে-হে! এ মাগী তো বড় জ্বালালে দেখছি।
—কেনে? জ্বালালাম কি করে? বলি জ্বালালাম কি করে? তোমার বাবাকে দেখেছি নিজে। হাতে কোদাল ধরে ওই লম্বা বাকুড়ি কাটতে। হাঁস্ হাঁস্ করে সে কি কোদালের কোপ! তোমরাও
তো কাটতে গো মাটি নিজে হাতে। আমি তো ভূশণ্ডি কাক—আমার তো দেখতে বাকি নেই। কিছু।
কথাটা সত্য। কিছুকাল অর্থাৎ বিশ-পঁচিশ বৎসর আগেও এইসব মণ্ডল মহাশয়েরা পুরোপুরি চাষী ছিলেন। জমি কাটাইয়ের কাজ থেকে আরম্ভ করে চাষের কাজ পর্যন্ত কিষান মাহিন্দার এবং মজুরদের সঙ্গে নিজেরাও প্রত্যেক কাজটি করে যেতেন, তাতে অপমান বোধ করতেন না। এই বিশ-পঁচিশ বৎসরের মধ্যে এমন ওলটপালট হল যে, সদগোপ মহাশয়েরা এখন আধাবাবু হয়ে উঠেছেন। হেদো মণ্ডল নিজেও এ কথাটা ভাল করে বুঝতে পারেন, তাঁর শরীরে প্রচুর ক্ষমতা এখনও এবং চাষে কর্মে তার গভীর অনুরাগ। সকল কাজ পূর্বের মত করতে তার ইচ্ছাও হয়, কিন্তু পারেন না। পারেন না, নিজেদের জাতি জ্ঞাতির কাছে লজ্জা পেতে হবে বলে; আঃ হায় রে! কি যে ইংরজি বাবুগিরির ঢেউ এল দেশে! এই বলে মনে মনে আক্ষেপ করেন তিনি। বাড়ির দরজা বন্ধ করে তবুও তিনি অনেক কাজ করেন। কিন্তু সুষ্ঠাদের কাছে স্বীকার করতে পারেন না সে কথাটা। তিনি বিরক্ত হয়েই বললেন—বকিস না মেলা। তোরা যে মরা কুকুর বিড়েল ফেলা ছেড়েছি, আবার রব তুলছিস মরা গরু কাঁধে করে ফেলব না, বাড়ির নর্দমা পরিষ্কার করবি না বলছিস। বলি, তোরা এত বাবু হলি কি করে? তোরাও বাবু হচ্ছি, আমরাও বাবু হচ্ছি। না হলে আমাদের মর্যাদা থাকে কি করে?
সুচাঁদ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে বনওয়ারীকে। বললেওইওই মুচণ্ডুদ্দি, বুঝলে মণ্ডল ওই বনওয়ারীর মাতব্বরি এ সব। ওই ধুয়ে তুলেছিল মরা কুকুর বেড়াল ফেলব না। তাপরেতে সবাই মিলে গুজুর গুজুর করে ধুয়া ধরেছে—গরু ফেলতে হলে কাধে করে ফেলাব না, গাড়ি চাই; জল নিকেশী লালা ছাড়াব, কিন্তু এঁটোকাঁটা ময়লা মাটির পচা নৰ্দমাতে হাত দোব না। আমি বলি, বাপ পিতামোর আমল থেকে করে আসছি, করবি না কেনে? তা বনওয়ারী ঘাড় লেড়ে বলে—উহু, মুদ্দোফরাস মেথরের কাজ করবে কেনে?
হেদো মণ্ডল এবার ক্ষেপে উঠলেন—বনওয়ারীর দোষ? বলি, হঁ্যা রে মাগী, তোর নাতজামাই করালী যে সেদিন আমাকে বললে—বেটা-ফেটা বোলো না মশাই, সেও কি বনওয়ারীর দোষ নাকি?
সুচাঁদ গালে হাত দিলে—সেই মারে! তারপর বললেওকে আমি দু-চক্ষে দেখতে পারি। পাড়ার সব্বনাশ করবে দেখো তুমি, সৰ্ব্বনাশ করবে।
বনওয়ারীর কানে কথাগুলি সবই যাচ্ছিল। সুচাঁদ পিসি কালা, হেদো মণ্ডল চিৎকার করে কথা বলছে। সুতরাং সে কেন, এখানকার সকলেই শুনতে পাচ্ছে। সে অত্যন্ত অসহিষ্ণু হয়ে ডাকলে—বলি, তামুক খাবা আর কতক্ষণ?
সুচাঁদ ব্যস্তভাবে উঠল। বনওয়ারীকে খাতির সে করে না, কিন্তু আজ বনওয়ারী সুচাঁদের প্রায় মনিব-স্থানীয়, নগদ চোদ্দ পয়সা এবং জলখাবারের মুড়ি দেবে সে। উঠেও সে দাঁড়াল। কিন্তু হঠাৎ দুঃখের আবেগে কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছলে, তারপর হেদো মণ্ডলকে বললে—আমার ললাট দেখ কেনে মণ্ডল মশায়! এই বুড়ো বয়সে মজুরি খাটছি। ওই করালীকে বিয়ে করেছে। বলেই লাতিনের সাথে বসনের সাথে ভিনু হয়েছি আমি।
আবার সে বসল। গলা ফাটিয়ে মণ্ডলকে বললে আমি বলেছিলাম বসনকে, ওই হারামজাদী পাখীকে নয়ানের হাঁপানি ধরেছে, ভাল হয়েছে, নামের মরদ নামে থাকুক। পাখীর এখন উঠতি বয়স, কিছু ওজগার-টোজগার করে লে। তা’পরেতে খানিক-আধেক বয়েস হোক—এক কুড়ি, ড্যাড় কুড়ি হোক, তখন ‘ছাড়বিড় করে সাঙা দিব। না কি বল মণ্ডল? সুচাঁদ আবার কাঁদতে লাগল—আমার প্যাটের বিটী বসন, বসনের প্যাটের বিটী পাখী–
এবার বনওয়ার কাছে এসে দাঁড়াল। সুচাঁদ সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বললেচ বাবা, চ। এই দুটো পরানের বেথার কথা মণ্ডল মশাইকে বললাম। খুঁড়িয়ে চলতে আরম্ভ করলে সে নিজের কাজের জায়গার দিকে। বনওয়ারী মাটি-বোঝই ঝুড়িটা তার মাথার উপর তুলে দিতেই সুচাঁদ বনওয়ারীর মুখের দিকে তাকিয়ে কাতর অনুনয় করে বললে—আগ করেছিস, হাঁ? বনওয়ারী?
বনওয়ারী উত্তর না দিয়ে ঘুরে কোদালটা ধরে মাটিতে কোপ মারতে আরম্ভ করলে। মোটা বলিষ্ঠ হাতে রাগের মাথায় সে কুপিয়েই চলল। কিছুক্ষণ পর দাঁড়িয়ে কোমর ছাড়িয়ে নিলে। ধুলোমাখা হাতের আঙুল দিয়ে কপালের ঘাম টেনে চেঁছে ফেললে। দেড়শো সাঁওতালের টামনার কোপে বাবুদের কাজ এগিয়ে চলেছে কোপাইয়ের বানের মত। আর তার কাজ চলেছে রিমিঝিমি বর্ষার ধানের জমিতে গরুর খালে জল জমার মত। তা হোক। এমনি করেই চিরদিন কাজ চলে আসছে। বাবুদের কাজ চলবে দিনকয়েক—যতদিন ‘বতর’ থাকবে ততদিন, তার কাজ চলবে। বার মাস। রোজ বিকালে এসে সে খানিকটা করে কেটে যাবে। এবার মাত্র একখানা জমি তৈরি করবে সে। বাকি জমিটায় চাষ দিয়ে ভাদ্র মাসে কতকটা ‘তেপেথে’ অর্থাৎ তিন পক্ষীয় কলাই, কতকটা ঘেসোমুগ, কতকটা বরবটি ছিটিয়ে দেবে। তারপর আসছে মাঘে যে জলটা হবে, সেটা হলেই লাঙল চালিয়ে মই দিয়ে ঠেলে মাটি সরিয়ে আলবন্ধনের চেষ্টা করবে; তারপর কিছু মাটি কেটে সমান করবে; সঙ্গে সঙ্গে আলবন্ধনও শক্ত হবে। এভাবে জমি করায় সুবিধাও আছে, ধীরে ধীরে ঠেলে ঠেলে পাশের পতিতের মধ্যে চল না কেন এগিয়ে। নজর পড়বে না কারও। পাঁচ বিঘা জমি নিয়েছে বনওয়ারীওটাকে সাড়ে পাঁচ বিঘা তো করতেই হবে।
প্রথম ফসল উঠলে সে ফসলের ভোগ দিতে হবে বাবাঠাকুরের থানে, মুগসিদ্ধ বরবটি সিদ্ধ। আর এক বোতল পাকী মদ। কালারুদ্র পুরুত মশায়কে দিয়ে আসবে গোটা কলাই। বেরাম্যান পুরুতের মুখেই বাবা খেয়ে থাকেন। তারপর দিয়ে আসবে চন্ননপুরে বড়বাড়ি, নতুন মালিক বাড়ি। মুখুজ্জে-বাড়িতে ‘আজলক্ষ্মীর ভোগ লাগবে, ‘আজা’ মহাশয়ের বদনে উঠবে। আর দিতে হবে জাঙলের দু-পুরুষে মনিব ঘোষ-বাড়িতে। তা না দিলে হয়? এইসব দিয়ে থুয়ে যদি থাকে, তখন পাড়াতে একমুঠো করে দিতে হবে। তার পরে থাকে থাকবে না থাকে তাতেও বনওয়ারীর ‘দুষ্ক’ থাকবে না। চাষের দ্রব্য— ‘মা-পিথিমীর দান’, এ পাঁচজনকে দিয়েই খেতে হয়। বিশেষ করে প্রথম বছরের ফসল। দেবতা-ব্রাহ্মণরাজা মনিব-জ্ঞাত-গোষ্ঠী সবাইকে দিয়ে যদি থাকে তো নিজে খাবে, না থাকে হাত পা ধুয়ে হাসিমুখে ঘরে ঢুকবে। যা দেবে তা তোলা থাকবে আসছে বছর দুনো হয়ে ঘরে আসবে; যমপুরীর খাতাতেও জমা হয়ে থাকল। তোমার নামে।
মনের আনন্দে হুম-হাম করে কুপিয়ে চলল বনওয়ারী। বনওয়ারীর বউ ছুটে ছুটে বইছে। ঝুড়িভর্তি মাটি। সুচাঁদ পিসি খুঁড়িয়ে চলে এক ঝুড়ি ফেলে ফিরতে ফিরতে সে দু-তিন ঝুড়ি ফেলে আসছে। তার গরজের তুলনা কার সঙ্গে। এ জমি যে তার নিজের হবে।
ওঃ! সেরেছে রে! পাথর লেগেছে। কোদালের তলায় খং-খং করে শব্দ উঠছে। মাটি সরিয়ে দেখলে বনওয়ারী। হাতখানেক মাটির নিচেই রয়েছে-নুড়িপাথর।
মাথায় হাত দিয়ে বসল বনওয়ারী। নুড়িপাথর এমন-তেমন নয়, একটা মেঝের পাড়নের মত; ইয়া বড় বড় নুড়ি, আর আধ হাত তিন পো পুরু স্তরে জমে আছে। কোদাল দিয়ে টামনা দিয়ে কোপ মিরলে ধার ভেঙে যাবে, ভোঁতা হয়ে যাবে অস্ত্ৰ, কিন্তু তাতে তো পাথর উঠবে না।
সে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াল। টামনার বটের উপর হাত রেখে ভাবতে লাগল—উপায়?
বাবুদের সাঁওতাল মজুরেরাও পেয়েছে পাথরের স্তর। টামনা রেখে গাঁইতি ধরেছে। বাবু মহাশয়দের কারবারই আলাদা, আগে থেকেই ‘রনুমান’ অর্থাৎ অনুমান করে গাড়ি বোঝাই করে গাঁইতি এনেছে। হেদো মণ্ডল বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা। সেও ভাবছে, পাথর লাগলে মুশকিল হবে। হেদো মণ্ডল বললেন—লাগল তো? অর্থাৎ পাথর।
বনওয়ারী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ঘাড় নেড়ে জানালো–হ্যাঁ, লেগেছে।
–আমি জানতাম। হেদো মণ্ডল সঙ্গে সঙ্গে উঠলেন, চলে গেলেন বাবু মহাশয়দের চাষবাবুর কাছে। গুড়ু-গুজু ফুসুফুসু লাগিয়ে দিলেন। বনওয়ারী হেসে ঘাড় নাড়লে অর্থাৎ ‘ঢাকে ঢোলে বিয়ে তাতে কাশতে মানা।’ চাষবাবুকে কিছু দিয়ে গাঁইতি ভাড়া নেবেন। তার আর চুপিসারে কথা কিসের বাবা!
বনওয়ারীর স্ত্রী হতাশ হয়ে পাশে উবু হয়ে বসে পড়ল। সে তার মুখের দিকে চেয়ে বললে—কি হবে?
সুচাঁদ চোখ বড় বড় করে বললে—ছেড়ে দে, বুল্লি, বাবা ছেড়ে দে। পাথরের মধ্যে কোথা কোন্ দেবতা আছে, অসুরের কাড়ি আছে, তাতে চোট মেরে কাজ নাই—ছেড়ে দে।
সে তুলে নিলে একটা গোল নুড়ি। নুড়িটার কালো গায়ের মাঝখানে গোল সাদা দাগঠিক পৈতের মত। বললে—দেখ। তারপর তুলে দেখালে একটা টুকরো অসুরের কড়ি। ঠিক গাছের গুঁড়ির মত চেহারা, এগুলিকে সুচাঁদ বলে—আসুরের কাঁড়ি। অর্থাৎ অসুরের হাড় জমে পাথর হয়ে গিয়েছে। দেবতারা অসুর মেরেছিলেন, তাদেরই হাড়। এ সব কাহারদের পিতিপুরুষদের কথা। কিন্তু বনওয়ারীদের আমলে ওসব বিশ্বাস চলে গিয়েছে। সুচাঁদ পিসির মিথ্যে ভয়। জমি কাটছে। বনওয়ারী জীবন-ডোর; পাথরের গায়ে পৈতের মত দাগ হাজারে হাজারে দেখেছে। দেবতা কি হাজারে হাজারে ছড়িয়ে থাকে। পাথরে ওরকম দাগ থাকে। অসুরের কড়িও তাই। তবে ভাবনা একমাত্র এ পাথর কাটবে কি করে? গাঁইতি না হলে ‘রসম্ভব’ অর্থাৎ অসম্ভব। কিন্তু গাঁইতি কাহারেরা ধরে না। ঐ ঘঁচলো অস্ত্রটি কখনও তো ধরা হয় নাই, সাহেব লোকের ‘রামদানি’ অর্থাৎ আমদানি করা অস্ত্রটি যে শূলের মত। ওতে মা-বসুন্ধরার বুকে আঘাত করা কি উচিত। তার উপর পাবেই বা কোথা! বারু মহাশয়ের চাষ-বাবুকে ঘুষ দেবার মত টাকা তার কোথা?
হঠাৎ মনে পড়ল করালীর কথা। করালী পারে। চন্ননপুরের রেলকারখানায় গুদাম-বোঝই গাঁইতি। সে দিতে পারে। কিন্তু
হেদো মণ্ডল এসে বললেন—কি রে, হতভম্ব হয়ে গেলি যে! চোট মেরেই দেখ!
তা বটে। চোট মেরে দেখাটা দরকার, কতখানি পাথর আছে। মনে মনে প্রণাম করে সে চোট মারতে আরম্ভ করলে। খং খং খং। লোহা এবং পাথরে আঘাত লেগে শব্দ উঠতে লাগল। পাথরের স্তরটা আধ হাতের মত পুরু, নিচে মোলাম কালো মাটি। বাহবা, বাহবা! একেবারে উৎকৃষ্ট ধরনের মাটি। গাঁইতি ধরতেই হবে। না ধরে উপায় নাই। কুঁদোর মুখে বঁকা কাঠ সোজা, নেয়াইয়ের উপর হাতুড়ির নিচে লোহা জব্দ, গাঁইতির মুখে মাটি-পাথর জব্দ। সে দেখেছে চন্ননপুরের লাইনে—দূর থেকে দেখেছে অবশ্য পশ্চিমা মজুরের হাতে গাঁইতির ঘায়ে পাথর খান খান হয়ে যায়। তাদের চেয়ে কম জোরে কোপ মরে না কাহারেরা।
—আঃ! আরে বাপ রে বাপ রে বাপ রে!
টামনা ছেড়ে দিয়ে বনওয়ারী কপালখানা চেপে ধরলে। হঠাৎ একটা পাথর ভেঙে তার কুচি ছিটকে এসে তার কপালে লেগেছে। ওঃ, বঁটুলের মত বেগে, কিন্তু তার চেয়ে ভীষণ। বঁটুল গোল, তার ধার নাই, এটা ধারালো ভাঙা পাথর।
হাতের তালুতে আগুনের মত ‘তাই’ অর্থাৎ তাপ ঠেকছে কিসের। হুঁ, তা হলে নিয়েছে। ‘অক্ত’ নিয়েছেন মা-বসুমতী।
ছুটে এল বনওয়ারীর পরিবার। দেখি, দেখি! অক্ত পড়ছে যে গো! হেই মা! কি হবে! পিসি-অ পিসি!
হেদো মণ্ডলের হাতের কন্ধে দেখে সুচাঁদ আবার একদফা তৃষিত হয়ে উঠেছিল। সে শুনতেই পেলে না বনওয়ারীর পরিবারের কথা।
হেদো মণ্ডল দেখেছিলেন, তিনি উঠলেন না, শুধু বললেন–নিয়েছে নাকি?
বনওয়ারী হেসে বললো–হ্যাঁ।
হেদো বললেন–ও তো জানা কথাই। নেবেই। না নিয়ে ছাড়বে না। লাগিয়ে লে, মাটি লাগিয়ে লে।
বনওয়ারী এক মুঠো মাটি তুলে চেপে ধরলে কপালের ক্ষতস্থানে। এতক্ষণে সুচাঁদ দেখতে পেয়ে সামনে উবু হয়ে বসল।
হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা! মা-বসুমতী!
মা-বসুমতী যেমন দেন, তেমনিই নেন। আমন ধানে চালে ফসলে তোমাকে খাওয়াবেন, কিন্তু শেষকালে ‘দ্যাহখানি’ নেবেন, পুড়িয়ে দিলেও নিদেনপক্ষে ছাইমুঠোটি তাকে দিতে হবে। বেঁচে যতদিন আছ, নখ চুল এ দিতে হবে। মধ্যে-মাঝে দু-চার ফেঁটা ‘অক্ত’। ‘যে প্যাটে ছেলে ধরে সে প্যাট কি অল্পে ভরে? এত মানুষ এত পশু পাখি পেসব করেছেন মা, বুক চিরে ফসল দিচ্ছেন, তার তেষ্টা কি শুধু মেঘের জলে মেটে! মায়ের বুকে চোটাতে গেলে ‘অক্ত দিয়ে মায়ের পূজা দিতে হয়! না দাও, মা ঠিক তোমার দু-চার ফোটা রক্ত বার করে নেবেনই। নিয়েছেন মা তার পাওনাগণ্ডা। বনওয়ারী রক্তমাখা মাটি মুঠো করে জমির এক কোণে পুঁতে দিলে।
তবে এ লক্ষণ ভাল; রক্ত যখন নিয়েছেন মা, তখন দেবেন—তাকে দু হাত ভরে দেবেন।
ঝ-ঝম্ গম্-গম্! গমূ-গম্ ঝম্-ঝম্! পায়ের তলায় মাটি কাঁপছে, হাঁসুলী বাঁকের বাঁকে বাঁকে পঞ্চশব্দের বাজনার মত ধ্বনি তুলে দশটার গাড়ি চলেছে কোপাই পাগলীর বুকের ওপরের লোহার মালার পুল পার হয়ে।
মুখুজ্জেবাবুদের সাঁওতাল মজুরেরা গাঁইতি টামনা ঝুড়ি ফেলছে ঝপাঝপ। দশটায় এ বেলার। মত ছুটি।
হাঁসুলীর বাঁকে বোশেখ মাসে দ্বাদশ সূর্যের উদয়।
এখানে গ্রীষ্মের দিনে খাটুনির সময় সকাল ছটা থেকে দশটা। আবার ও-বেলায় তিনটে থেকে ছটা।
বনওয়ারীও কোদাল ঝুড়ি তুললে। ও-বেলার খাটুনি বনওয়ারী খাটবে না। বনওয়ারীর ও বেলার পালা আরম্ভ হবে সন্ধেবেলা থেকে। চাদনী রাত্রি আছে, ফুরফুর করে বাওর’ অর্থাৎ বাতাস বইবে, মদের নেশার আমেজটি লাগবে, পাড়াপ্রতিবেশী পাঁচজনকেও পাওয়া যাবে, তখন আবার কাজ আরম্ভ করবে বনওয়ারী। বাবুদের পয়সার খেলা, জাঙলের সদূগোপ মহাশয়দেরও কতকটা তাই, কতকটা দাপটের খেলাও বটে, জবরদস্তি কাজ আদায় করে নেয় তারা। বনওয়ারীর নিজের গতরের খাটুনি, আর পাড়াপ্রতিবেশীর ভালবাসা ছেদ্দার’ অর্থাৎ শ্ৰদ্ধায় কেটে দেওয়ার কাজ। বনওয়ারীর জমি রাত্রে কাটা হবে, জাঙলের মনিবেরা সকালে এসে দেখে বলবেন—এ শালোদের সঙ্গে পিরবার যো নেই।
জাঙলের কাছাকাছি এসে সুচাঁদ বললে বনওয়ারী, তা পয়সা কটা দিবি এখন?
বনওয়ারী কোমরের গেঁজেল থেকে একটি দুআনি বার করে তার হাতে দিয়ে বললে—এই এক বেলা খাটুনির দামই দিলাম তোমাকে। উ-বেলা আর আসতে হবে না।
—আসতে হবে না? কেনে?—বুকটা ধড়াস করে উঠল সুচাঁদের। সে বুঝতে পেরেছে, বনওয়ারী তাকে শুধু আজ ও-বেলার জন্যই নয়, বরাবরের জন্যই আর কাজে নেবে না।
বনওয়ারী বললে—তুমি বুড়ো মানুষ, তোমাকে নিয়ে কি খেটে পোষায়? না তোমারই আর খাটা পোষায়?
সুচাঁদ খানিকটা চুপ করে থেকে বললে—তা বেশ। দে, তাই দে। তোর ধর্ম তোর ঠাঁই! প্যাটের বিটীই যেকালে বৈমুখ, সেকালে আর পরের ভরসা কিসের? লইলে আমি এখনও যা খাটতে পারি, তা তোর পরিবারে পারে না।
বনওয়ারী আর কথা বললে না। সে স্ত্রীকে সঙ্গে করে চলে গেল গ্রামের দিকে। জলখাবারের সময় হয়েছে, জল খাবে। তার আগে গরুগুলিকে দুইতে হবে; তাদের মাঠে ছেড়ে দিতে হবে। অনেক কাজ। একটু দেরিই হয়ে গিয়েছে আজ। বনওয়ারীর গড়নটা খুব মোটা, তার উপর। জোয়ান বয়সের প্রথম থেকেই বাক বয়ে পালকি বয়ে বা কাটা ডান কাঁধের চেয়ে উঁচু হয়ে গিয়েছে। চলেও সে বেঁকে। ডান পাটা পড়ে জোরে জোরে। হনহন করে সে চলল। ভিজে
আলপথের ডান দিকের কিনারায় তার পায়ের ছাপ বসে যাচ্ছে। হঠাৎ একটা জায়গা ভস করে। বসে গেল। বনওয়ারী পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলে। বললে–হুঁ। সঙ্গে সঙ্গে হেঁট হয়ে ঝুঁকে পড়লে সে।
বউ বললে—কি?
–পিঁপড়ে।
অসংখ্য পিপড়ে গর্তটার ভিতরে বিজবিজ করছে। অধিকাংশের মুখে ডিম।
বউ বললে—আহা, দেখে চলতে হয়। ডিম নিয়ে কেমন আকুলি-বিকুলি করছে দেখ দিনি!
—তোর মাথায় বনওয়ারী এদিক-ওদিক চেয়ে মাঠের মধ্য দিয়ে একটা পিঁপড়ের সারি দেখিয়ে দিয়ে বললেওই দেখ। অনেকক্ষণ থেকে ওরা পালাতে লেগেছে এখান থেকে। তারপর আকাশের দিকে চেয়ে বললেজল ঝড় পেচণ্ড একটা হবে লাগছে।
–জলঝড় হবে?
—পেচণ্ড।
—পেচণ্ড?
হ্যাঁ। পিঁপড়েতে জানতে পারে। বর্ষায় দেখিস না, মেঝে থেকে দ্যালে বাস করে? দাঁড়া।
বলে সে এগিয়ে গেল কর্তার গানের দিকে। ওখানে বেলগাছের গোড়াগুলিতে বার মাস মানুষের হাত পড়ে না, পড়ে কালেকস্মিনে। এই নিরুপদ্রবতার জন্য বেলগাছ-শ্যাওড়াগাছের গোড়াগুলি পিপড়ের বাসায় ভর্তি। প্রচুর পরিমাণে বালিমাটির কণা তুলে ছোট স্থূপের আকারে উঁচু করে সাজিয়ে চমৎকার বাসা করে। কিন্তু বর্ষার আভাস পাওয়া মাত্র পিপড়েগুলি ডিম নিয়ে উঠে যায় গাছের উপরে; পুরনো গাছগুলির জীৰ্ণ গাঁঠে ছিদ্র করাই আছে, সেই ছিদ্রগুলি পরিষ্কার করে নিয়ে বাস করে। বৃষ্টি-অনাবৃষ্টির লক্ষণ জানতে হলে বনওয়ারী ওই গাছতলায় এসে। দাঁড়িয়ে দেখে, পিঁপড়েগুলি নিচে নেমে এসেছে, কি উপরে উঠেছে।
বেশি দূর যেতে হল না, কর্তার থানের মুখে এসেই তার নজরে পড়ল, কতকগুলো কাক। নেমেছে। বেলগাছের ডালে বসে আছে সড়ক-ফিঙের ঝাঁক। তারাও মাঝে মাঝে ঝাপিয়ে পড়ছে। কাকদের আশেপাশে লাফাতে লাফাতে ঠুকরে কিছু খেয়ে চলেছে। পিঁপড়ে খাচ্ছে, তাতে আর ভুল নাই। পিঁপড়েরা দল বেঁধে বেরিয়ে উপরে চলেছে। পক্ষীর আঁক নেমেছে, ওদের ভোজ লেগেছে। প্রচণ্ড জলঝড় একটা হবে, তাতে সন্দেহ নাই। পাড়ার লোককে সাবধান করতে হবে। এসব হুঁশ যদি কারও থাকে! বনওয়ারীর আক্ষেপ হল, বলেও কাহারদের সে জ্ঞান দিতে পারলে না।
বনওয়ারী বাড়ি ফিরল। বউ আগেই এসেছে। সে বললে—আচ্ছা বাজে কারণে তোমার মতি বটে বাপু! সাবি বেনোদা বসে আছে। ওদ উঠেছে—ওরা আর যাবে কখন?
বনওয়ারী বললে—চেঁচাস না, চেঁচাস না, বুল্লি মাগী, একদণ্ড দেরিতে সাবি বেনোদা ওদে ননির পুতুলের মতন গলে যাবে না। আমার কৰ্ম আমি বুঝি। দে, বাছুর ছেড়ে দে। কেঁড়েটা দে।
গাইগুলি চিৎকার করছিল বাছুরের জন্য, বনওয়ারী গিয়ে কপালে গলায় হাত বুলিয়ে বললে—হচ্ছে, হচ্ছে। মা সকল, ধৈৰ্য্য ধর একটুকুন। হাসতে লাগল সে।
গাই দুয়ে শেষ করে কেঁড়েটি নামিয়ে দিতেই সাবি বললে—গেরস্তরা বলছে বেজায় জল দিচ্ছিস দুধে। জল একটুকুন কমিয়ো কাকি।
সাবি বেনোদা দুজনে চন্ননপুরে যায় দুপুরবেলা, সুকৌশলে স্থূপীকৃত ঘুটে বড় বড় ঝুড়িতে সাজিয়ে নেয়, তার উপর রাখে দুধের ঘটি। চন্ননপুরের ভদ্রলোকের বাড়িতে দুধ রোজ দিয়ে আসে। চার পয়সা সের দুধ। বনওয়ারীর বাড়িতে দুধ হয় চার সের। সেই দুধে কোপাইয়ের বালি-খোড়া পরিষ্কার জল মিশিয়ে বনওয়ারীর বউ পাঁচ সের করে দেয়। দিন গেলে পাঁচ আনা পয়সা। তার মধ্যে দৈনিক পাঁচ পয়সা হিসাবে পায় সাবি আর বেনোদা।
বনওয়ারীর বউ বড় ভালমানুষ। সে ঘাড় নেড়ে বললেজল তো সেই এক মাপেই দিই মা। বেশি তো দিই না।
বনওয়ারী সাবির দিকে তাকিয়ে বললে—পথে ঝরনার জল মিশিয়ে তোরা আরও কতটা বাড়াস বল্ দি-নি?
বেনোদা বললেহেই মা গো! আমরা?
–হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমরা। তোমরা বড় স্যায়না হো—হাসতে লাগল বনওয়ারী।
বেনোদা এবং সাবিও হাসতে লাগল; এ কথার পর আর অস্বীকার করলে না তারা অভিযোগ। বনওয়ারী আবার বললে—একটুকুন কম বাড়িয়ে লিস, মানে মানে—আগে যতটা বাড়াতিস, তার চেয়ে বাড়ায় না। তা হলে বাবুরা রা কাড়বে না।
কথাটা সত্য, সাবি এবং বেনোদা—শুধু তারাই বা কেন—কাহারপাড়ার যেসব মেয়ে পরের দুধ নিয়ে চন্ননপুরে যোগান দিয়ে আসে, তারা সকলেই ওই কাজ করে। পথে দুধে খানিকটা জল ঢেলে দুধ বাড়িয়ে দৈনিক দুটো চারটে পয়সা উপরি উপার্জন করে।
বনওয়ারী স্ত্রীকে বললে—ডিমগুলান দিয়ে দে।
স্ত্রী বললে—মনিব-বাড়িতে দেবে বলছিলে যে?
—দে দে। এখন পয়সার টানা, জমি কাটতে নোকজনকে পয়সা লাগবে।
মনিব! মনে মনেই জল্পনা-কল্পনা করে বনওয়ারী, মনিব যে এখন কে হবেন কে জানছেন! চন্ননপুরে বড়বাবুর চরণ যদি পায়, তবে–
মৃদু হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। সেই হাসিমুখেই চলল সে করালীর বাড়ির দিকে। করালী নাই নিশ্চয়ই। পাখীকে বলে আসবে—করালীকে বলিস আমার গোটা কয়েক গাঁইতি চাই। একটু পাড়া ঘুরেই চলল সে, কার ঘরের চালের কেমন অবস্থা দেখে নিচ্ছিল। দু-চার দিনের মধ্যে জল একটু বেশি পরিমাণেই হবে; সামনে বৈশাখ মাসজল হলে ঝড় হতেই হবে।
‘পাথর’ অর্থাৎ শিলাবৃষ্টি হওয়া অসম্ভব নয়। সকলকে সতর্ক করে দিতে হবে।
কাহারপাড়ার ঘর। বানে ডোবে, ঝড়ে ওড়ে। দালান নয়, কোঠা নয়, ইট নাই, কাঠ নাই; মাটির দেওয়াল, বাঁশবাঁদির বাঁশ, হাঁসুলী বাঁকের নদীর ধারের সাবুইয়ের দড়ি আর মাঠের ধানের খড়—এই নিয়ে ঘর। কোঠাঘর করতে নাই—বাবাঠাকুরের বারণ আছে। তা ছাড়া কোঠায় শোবে বাবুরা, সদ্গোপ মহাশয়েরা। কাহারদের কি তাদের সঙ্গে সঙ্গ করতে হয়? না সাজে।
বনওয়ারীর ভুরু কুঁচকে উঠল। নাঃ, আর পারলে না সে। কাহারদের শিক্ষা হবে না এ জীবনে। তার হাড়ে আর কুলাবে না। সকলের চালই ফুরফুর করছে। কারুর চাল তেমন ভাল নয়। এখন কারুর হুশ নাই। এখন বেশ লাগছে। ‘আত্তিরে ঘরে শুয়ে চালের ফুটো দিয়ে চাদের আলো আসে, ‘দেবসে’ ‘ও’ আসে, বেশ লাগছে। গ্রাহ্য নাই। গ্রাহ্য হবে বর্ষার মেঘ ঘনিয়ে এলে সেই ঘোর লগনে। চালের অবস্থা একমাত্র তার ঘরেরই ভাল। এরই মধ্যে চালে সে নতুন খড় দিয়েছে। আচ্ছা বাহার খুলেছে! ওই আর একখানা ঘরের চালেও নতুন খড়। ওখানা তো করালীর ঘর। হ্যাঁ, করালীর ঘরই তো। বাহাদুর ছোকরা! সে এগিয়ে গেল এর ঘর ওর ঘর দেখতে দেখতে। করালীর ঘরের সামনে এসে সে থমকে দাঁড়াল সবিস্ময়ে। এ দিক দিয়ে তার পথ নয়। এ পথে সে বড় হাটে না। পাড়ার মাতব্বর সে, দরকার না হলে সে কারও বাড়ি যায় না। করালীর বাড়ি সে ওদের বিয়ের পরে আর আসে নাই।
হরি হরি হরি! বলিহারি বলিহারি! ঘরখানাকে নিকিয়ে চুকিয়ে রঙচঙ দিয়ে করেছে কি? মনের মানুষ নিয়ে ঘর বেঁধেছে কিনা ছোকরা! ঘরের সামনেটার উপরের দিকে ঘন লাল গিরিমাটি দিয়ে রাঙিয়েছে, নিচের দিকটায় দিয়েছে আলকাতরা। দরজায় দিয়েছে আলকাতরা। দরজার দুপাশে আবার লাল নীল সবুজ হরেক রকম রঙ দিয়ে এঁকেছে দুটো পদ্ম। বাঃ বাঃ!
বাড়িতে কেউ নেই। পাখী বোধহয় ঘাস কাটতে গিয়েছে। করালী তো সকালেই গিয়েছে। চন্ননপুর লাইনে খাটতে। নসুও গিয়েছে চন্ননপুরে মজুরদের সঙ্গে খাটতে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে
সে দেখলে। মনটা ভারি খুশি হয়ে উঠল তার।
–ক্যা গো? ক্যা দাঁড়িয়ে? এক বোঝা ঘাস মাথায় করে পাখী এসে বাড়ি ঢুকল। বোঝর ঘাসগুলি তার চোখের সামনে ঝুলে রয়েছে বলে মানুষটাকে সম্পূর্ণ দেখতে পাচ্ছে না সে।
–আমি রে পাখী। তোদর ঘর দেখতে এসেছি মা। বা-বাবা! এ যে ‘রিন্দভোবন’ করে ফেলালছে করালী!
বোঝা উঠানে ধপ করে ফেলে পাখী তাড়াতাড়ি ঘর পূলে একটা নতুন কাঠের চৌকো টুল বার করে দিলে—বস মামা।
বা-বাবা! এ যে টুল রে! বলিহারি বলিহারি! ভদ্রজনের কারবার করে ফেলাল করালী!
পাখী ঘর থেকে একটা নতুন হারিকেন, একখানা নতুন সস্তা দামের শতরঞ্জি, একটা রঙচঙে তালপাতার পাখা এনে সামনে নামিয়ে দিয়ে বললে—এই দেখ, মানা করলে শোনে না; আজেবাজে জিনিস কিনে টাকা-পয়সার ছেরাদ্দ করছে।
হা-হা করে হেসে বনওয়ারী বললেওরে বাবা, নতুন বিয়ের এই বটে। তার ওপরে বউ যদি মনে ধরে, তবে তো আর কথাই নাই। তা তোকে মনে ধরা তো ধরা—দুজনাতে মনের মানুষ।
পাখী মুখে আঁচলটা দিয়ে হাসতে লাগল আমার কথা শুনে।
বনওয়ারী উঠল, বললে—আসছিলাম তো বাড়িতেই। পথে পাড়াটাও ঘুরলাম, সব চাল দেখে এলাম। একটা পেচণ্ড ঝড়জল হবে লাগছে কিনা! তা তোদের ঘরে এসে দাঁড়ালাম, এমন ঝকমকে ঘরদোর দেখে দাঁড়াতে হল। যাই, এখন দেখিকার চালে খড় আছে কার চালে নাই। মাতব্বর হওয়ার অনেক ঝক্কি মা।
পাখী বললে—ঝক্কি নিলেই ঝক্কি, না নিলেই ক্যা কি করবে? ওই তো আটপৌরে-পাড়ার মাতব্বর অয়েছে পরম, সে ঝক্কি নেয়? এত সব খোঁজ করে? কার চালে খড় নাই, কার ঘরে খেতে নাই—দেখে বেড়ায়? কারও দোষ-গুণ বিচার করে? তুমি এই যে আমার ঘর করে দিলে, লইলে আমি চলে যেয়েছিলাম চন্ননপুরে ওর সঙ্গে। তা’পরেতে নিকনে কি ঘটত কে জানে? হয়ত আবারও কারুর সঙ্গে চলে যেতাম বিদ্যাশ বিভুয়ে। তোমার দয়াতেই আমার সব। তুমি ধার্মিক লোক, মা-লক্ষ্মীর দয়া অয়েছেন তোমার পরে। কত্তাঠাকুরতলায় ধূপ দাও, পিদিম দাও, তোমার ধরমবুদ্ধি হবে না তো হবে কার? পাখী হঠাৎ হেঁট হয়ে তার পায়ের ধুলে নিলে।
বনওয়ারীর বড় ভাল লাগল পাখীকে আজ। বড় ভাল মেয়ে পাখী। বসনের কন্যে, ‘অক্তে’ চৌধুরী মোয়দের ‘অক্তের মিশাল আছে, হবে না ভাল কথা! আনন্দে তৃপ্তিতে তার মন জুড়িয়ে গেল, হিয়েখানি যেন ভরে উঠল গরমকালে মা-কোপাইয়ের শেতল জলে-ভরা ‘আঙা মাটির কলসের মত। মনে মনে সে কত্তাঠাকুরকে প্রণাম করলে, বললে—বাবাঠাকুর, এসব তোমার দয়া। তুমি মাতব্বর করেছ, তুমিই দিয়েছ এমন মন, মতি। তুমি অক্ষে করবে কাহারদের ঘরবাড়ি ঝড়ঝাপটা থেকে। বনওয়ারী তোমার অনুগত দাস, তোমার হুকুমেই সে কাহারপাড়ার চাল দেখছে। লাঙল টানে গরু, তার কি বুদ্ধি আছে, না সে জানে কোন দিকে ঘুরতে হবে, ফিরতে হবে? পিছনে থাকে লাঙলের মুঠো ধরে চাষী, তাকে গরু দেখতে পায় না; কিন্তু হালের মুঠোর চাপের ইশারায় গরু ঠিক চলে। বনওয়ারী সেই গরু! বাবাঠাকুর, কত্তাবাবা, তুমি হলে সেই চাষী।
তা নইলে করালীর মতিগতি ফেরে! চন্ননপুরে কারখানায় পাকা মেঝের কোয়ার্টার ছেড়ে কাহারপাড়ার বাড়িতে রঙ ধরিয়ে ফিরে আসে! কথাবার্তা মিষ্টি হয়! না, করালী অনেকটা সোজা হয়েছে। এই তো সেদিন নিজে থেকে তেরপল দিয়ে এল গুড়ের শালে। কোনো রকমে ওকে ঘরবশ করে চন্ননপুর ছাড়িয়ে কাহারদের কুলকর্মের কাজে লাগাতে হবে; ধরমের পথ ধরিয়ে দিতে হবে। সে এক দিনে হবে না। কেমে-কেমে’ ‘ধেয়ো-ধেয়ো’ বাকা বাঁশকে যেমন তাতিয়ে চাপ দিয়ে সোজা করতে হয় তেমনই ভাবে। পাড়ার লোকে ক্ষেপে উঠেছিল করালীর বিরুদ্ধে। কিন্তু তার তো দশের মত হট করে মাথা গরম করলে চলে না! ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে হবে তাকে।
ঘোড়ার একটা দোষ হল, ‘লবাবী’ করা। অ্যাই টেরি, অ্যাই জামা, অ্যাই কাপড়, অ্যাই একটা ‘টরচ’ আলো, একটা বশি, যেন বাবুর বেটা বাবু বেড়াচ্ছে, কে বলবে কাহারদের ছেলে! মুখে লম্বা লম্বা কথা। লোকে এসব সহ্য করতে পারে না। তাও অনেক করেছে—অনেক। তবে। নাকি শোনা যাচ্ছে, ছোঁড়া আজকাল বেআইনি চোলাই মদের কারবার করছে চন্ননপুরে। কাহারপাড়াতেও আনছে। রাত্রে মজলিস করে এই মদ খায়। সাবধান করতে হবে। শাসন করতে হবে।
বনওয়ারীর মনের মধ্যে একটি সাধ হয়। করালীকে নিয়ে সাধ। সে জেনেছে, বেশ বুঝেছে, এই ছোঁড়া থেকে হয় সর্বনাশ হবে কাহারপাড়ার, নয় চরম মঙ্গল হবে। সর্বনাশের পথে যদি ঝোকে তবে কাহারপাড়ার অন্য সবাই থাকবে পেছনে—লাগতে লাগবে তার সঙ্গে। সে পথে করালী গেলে বনওয়ারী তাকে ক্ষমা করবে না। তাই তার ইচ্ছা তাকে কোলগত করে নেয়; তার পুত্র সন্তান নাই। ডান হাত থেকে বঞ্চিত করেছেন ভগবান। বনওয়ারীর ইচ্ছে, বিধাতা যা তাকে দেন নাই—নিজের কর্মফলের জন্যে—সে তা এই পিথিমীতে অর্জন করে।
পুণ্য তার আছে। বাবার চরণে মতি রেখেছে, নিত্য দুবেলা প্রণাম করে, বাবার থান আগলে রাখে। আঁধার পক্ষের পনের দিন সনজেতে পিদিম দেয়। জ্ঞানমত বুদ্ধিমত ন্যায্য বিচারই করে সে। নয়ানের বউ পাখীকে করালীকে দিয়ে অন্যায় একটু করেছে, নয়ানের মা চোখের জল ফেলেছে—তাকে শাপ-শাপান্ত করেছে। তা করুক, বনওয়ারী নিজের কর্তব্য করবে। নয়ানের একটি সাঙা দেবে সে, কনে এর মধ্যেই ঠিক করে ফেলেছে। মেয়েটির রীতকরণ একটুকুন চনমনে, কালোমুখী বদনাম একটু আছে তার বাপের গায়ের সমাজে। তা থাক, নয়ানের মায়ের ভবিষ্যৎ ভেবেই এমন মেয়ে সে ঠিক করেছে। নয়ান যদি সেরে না ওঠে, তবে ওই মেয়েই রোজকার করে নয়ানের মাকে খাওয়াবে।
লোকে না ভেবে কথা বলে। ভদ্রলোকে বেশি বলে। তারা বলে—ছোটলোকের জাতের ওই করণ। তারা হলেন টাকার মানুষ, জমির মালিক, রাজার জাত। তাদের কথাই আলাদা। কথাতেই আছে, ‘আজার মায়ের সাজার কথা’। নয়ান যদি তাদের জাতের হত তবে নয়ান মরে গেলেও থাকত তার টাকা, জমি, তাই থেকে নয়ানের মা একদিকে কাদত, একদিকে খেত। আর কাহারের জাত? না জমি, না টাকা, নয়ান মরে গেলে নয়ানের মায়ের সম্বল হবে গতর, গতর গেলে ভিক্ষে। তার চেয়ে এ মন্দের ভাল। পাপ পুণ্যি বনওয়ারী বুঝতে পারে না এমন নয়, সে বুঝতে পারে মেয়েলোকের সতীত্বের মূল্য। কিন্তু বিধির বিধান, উপরে আছেন সজাতেরা, তাদের ময়লা মাটি থুতু সবই আপনি এসে পড়ে তাদের গায়ে। সৎজাতের ময়লা সাফ করে মেথর। চরণসেবা করে হাড়ি ডোম বাউরি কাহার। শ্মশানে থাকে চণ্ডাল। বিধির বিধান এসব। কাহারদের মেয়েরা সতী হলে ভদ্রজনদের পাপ ধরবে কারা, রাখবে কোথা? কাজেই কাহার। জন্মের এ কর্ম স্বীকার যে করতেই হবে।
পাখী কিন্তু পাখির মতই কলকল করে চলেছিল ভোরবেলার পাখির মত। কত প্রশংসাই সে করে গেল। বাবার চরণে পেনাম জানিয়ে কাহারজনমের কথা ভাবছিল বনওয়ারী। হঠাৎ পাখীর কণ্ঠস্বর পরিবর্তনে সে একটু চমকে উঠল।
গলা খাটো করে পাখী বললে—জান মামা, ওই মিচকেপোড়া চিপেষষ্টী নিমতেলে পানা সেদিন বলছিল—দেখ কেনে মাতব্বরের ধরম, এই বছর না ফিরতে বেরিয়ে যাবে। ফেটে যাবে। পাপ করে বাবাঠাকুরের ঠাঁই হেঁয় কেউ তবে বাবা তাকে ক্ষমা করে না, তুমি নাকি? পাখী চুপ করলে।
–কি? আমি নাকি–? কি করেছি আমি?
–ক্যা জানে বাপু! আমার আগেকার শাউড়ি, আটপৌরে-পাড়ার কালোবউ এইসব পাঁচজনকে নিয়ে নানান কথা নানান কেচ্ছা করছিল বলে, সে নাকিনি দেখেছে।
বনওয়ারীর বুকটা হঠাৎ ফুলে উঠল রাগে। কানে শোনা কথা, মিথ্যে নয় তা হলে।
পাখী বলল—আটপৌরে-পাড়ায় ঘেটুগান কে বেঁধেছে জান? ওই পানা।
পানা?
হ্যাঁ। নসুদিদির তো ভাবীবীর অভাব নাই। ওই আটপৌরে-পাড়ার দলের কোন্ ছোঁড়া বলেছে।
—হুঁ। বনওয়ারী মাটির দিকে চেয়ে একটু ভেবে নিলে—আচ্ছা।
পাখী আবার বললে—সে তো এগে একেবারে কাই। বলে-মারব শালোকে। পানা নাকিনি থানায় কি সব লাগান-ভাজান করে এয়েছে ওর নামে। ও নাকি চন্ননপুরে চোলাই মদ বিক্কি করে, লুকিয়ে অ্যালের সিলিপাট বিক্কি করে। আমাদের বাড়িতে নাকি সনজেবেলায় ছেলেছোকরাদের আড্ডা বসে, নাচগানের ছাউনি দিয়ে ভেতরে ভেতরে নাকি চুরি-ডাকাতির সলাপরামশ্য হয়। চোরের দল গড়ে।
সর্বনাশ! বনওয়ারী চমকে উঠল। পানা, হারামজাদা পানী, ঘরভেদী পানা, কাহারপাড়ার পাপ পানা! পানাকে মাটিতে ফেলে তার বুকে চেপে বসা অতি সহজ কাজ। কাঠির মত চেহারা, পাখির মত নাক, ছুঁচোর মত লম্বাটে সরু মুখ পানার, কিন্তু হারামজাদা নিজের চোখে কিছু যেন দেখেছে বলেছে। কি দেখেছে?
হঠাৎ মনে পড়ে গেল বনওয়ারীর, পানার মনিব পাকু মণ্ডল মহাশয়ের কথা। পাকু মণ্ডল বলেছিলেন-পানা তাকে বাঁশঝাড় বিক্রি করেছে। পাকু মণ্ডলের সন্দেহ নাকি পানা এর মধ্যে কিছু গোলযোগ করেছে। বাঁশঝাড় দেখে তার মনে হয়েছে, ঝাড় একটা নয়, ঝাড় দুটো। চৌহদ্দিটা শুনতে বলেছেন একদিন বনওয়ারীকে। পাকু মণ্ডলের কাছে যেতে হবে তাকে। এক্ষুনি যাবে সে।
উঠে পড়ল বনওয়ারী। করালীর বাড়ি থেকে হনহন করে বেরিয়ে সেই দুপুর রৌদ্রেই চলল। সে পাকু মণ্ডলের কাছে।
পথে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। যাঃ, পাখীকে আসল কথাটাই বলা হল না; গাঁইতির জন্যে বলতে এসে পানার চতুরালির কথা শুনে মাথা ঘুরে গেল তার। ভুলে গেল আসল কথা।
দীর্ঘশ্বাস ফেললে সে। মাতব্বরির যত সুখ তত দুঃখ। চড়কের পাটা থাকে মানুষের মাথায়, সেই পাটায় গজাল পোতা থাকে, তার উপর শুতে হয় গাজনের প্রধান ভক্তকে। মাতব্বরিও তাই। মানুষের মাথার উপরে কাটারা পাটায় শোয়া। হে ভগবান! পানা তার সর্বনাশ করবে। এটা অবশ্য তার পাপ, তার অন্যায়। কিন্তু সে তো মানুষ। কালোবউ
হঠাৎ মাথায় যেন তার বিদ্যুতের মত খেলে গেলচড়কের পাটা! সামনে গাজন। বাবা কালারুদ্দের চড়কের পাটায় শুয়ে সে তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবে, লোকের সামনে প্রমাণ করবে তার কত পুণ্য।