২.৭ খড়ের বিছানার উপর শুয়ে

২.৭

খড়ের বিছানার উপর শুয়ে কয়েক ঘণ্টা ঘুমের আশায় এপাশ ওপাশ করতে লাগল অশান্ত নিকোলাস ব্যালান্টাইন। আর মাত্র তিন দিনের মাঝেই সুরাট থেকে ব্রিস্টলের উদ্দেশে যাত্রা করবে জুনো। জাহাজের কার্গো ভর্তি হয়ে আছে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে মোটাসোটা লাভ এনে দেবার আশায় ছাপানো সুতীর কাপড়, সিল্ক আর নীল দিয়ে। নিকোলাস নিজেও বিদেশ পাড়ি জমাবে। জুনোতে জায়গা পাবার জন্য ভালোই অর্থ দিতে হয়েছে লালমুখো ক্যাপ্টেনকে। কিন্তু উত্তমাশা অন্ত রীপা ঘুরে যে দেশে পৌঁছাতে চাইছে, যেটিকে সে আদৌ গৃহ বলে মনে করে না, সেই দীর্ঘ আর বিপদসংকুল ভ্রমণের যাত্রাপথ যে আনন্দময় হবে না তা বেশ বোঝা যাচ্ছে।

নিদ্রার আশা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াল নিকোলাস। আর মাত্র ঘণ্টাখানেকের মাঝেই দেখা দেবে প্রভাত, অথচ সরাইখানার নিচ তলার ছোট্ট কক্ষের কাদামাটি দিয়ে তৈরি ইটের দেয়াল থেকে এখনো গরম ভাপ বের হচ্ছে। নিকোলাসের প্রায় উলঙ্গ দেহ ভিজে গেছে ঘামে। বাইরের আঙিনাতে গিয়ে কুয়ো থেকে এক বালতি পানি তুলে নিজের গায়ে ঢেলে দিল। কুকুরের মত ভিজে গায়ে এগিয়ে গেল নিম গাছের ছায়ার নিচে বসতে। কাছেই একটা চারপেয়ে টুলের উপর বসে আছে– সম্ভবত নৈশ প্রহরী–ঘুমন্ত একজন মানুষ। যাক, অবশেষে শাহজাদী জাহানারাকে নিয়ে আর কোন চিন্তা রইল না। আগের দিন হাতে এসে পৌঁছানো সংক্ষিপ্ত চিঠিটা শান্তি এনে দিয়েছে মনের মাঝে, আগ্রা ছেড়ে পালিয়ে যাবার ব্যাপারে দূর হয়ে গেল সব অপরাধবোধ।

বেশ শক্ত ধাঁচের মেয়ে জাহানারা। শিখে নিতে হয়েছে এমনটা, ছোট্টবেলাতে জাহাঙ্গীরের হাত থেকে পালাতে হয়েছিল পরিবারসহ। একই সাথে মন খারাপ হয়ে গেল কল্পিত অপরাধের বোঝা তার উপর চাপানো হয়েছে শুনতে পেয়ে, যদি সুরাটের ব্যবসায়ীদের মাঝে ছড়ানো রটনাগুলো সত্যি হয়ে থাকে। কিন্তু সম্রাটের কনিষ্ঠ পুত্রেরা কি সত্যিই বিদ্রোহে জড়িয়েছে? বিশদভাবে কিছুই লেখা ছিল না জাহানারার চিঠিতে। কিন্তু ভাগ্যে যাই থাকুক না কেন আবারো দারা আর পিতার পাশে থাকতে পেরে নিজের স্বস্তি প্রকাশ করেছে শাহজাদী। এতে কি যাত্রাপথে তাকে শঙ্কিত না হবার জন্য প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে? সম্ভবত না। হতে পারে যে দারার ভাইয়েরা শুধুমাত্র আস্ফালন করছে। এই বিশাল দেশে, রাজকীয় ট্রাঙ্ক রোড আর বার্তা বাহকেরা ব্যতীত সংবাদ পৌঁছায় অতি ধীর গতিতে। প্রায় বিকৃতি লাভ করে পথিমধ্যে আর বোকার দলও অভাব নেই তা বিশ্বাস করার।

ভেতরে যাবার জন্য উঠে দাঁড়াল নিকোলাস কিন্তু শুনতে পেল কিছু একটা ভেঙে পড়ার শব্দ, অনুভব করল কেঁপে উঠল মাটি। এক কি দুই মিনিট পরে আবারো শুরু হল আওয়াজ, এবার আর বন্ধ হবার নাম নেই। এটা একমাত্র কামানের গোলাই হতে পারে। সুরাটে আক্রমণ চালানো হচ্ছে? শব্দের গতিপথ শুনে বোঝা গেল যে গ্রামের দিক থেকে শহরের উপর গোলা ছোঁড়া হচ্ছে। পাশের রাস্তা থেকে হতচকিত চিৎকার শোনা গেল। দৌড়ে নিজের কক্ষে গেল নিকোলাস। তাড়াহুড়ো করে শার্ট গায়ে দিয়ে, পায়ে জুতো গলিয়ে পাশের গলিতে গিয়ে দেখল ইতিমধ্যে বেশ লোকজন জড়ো হয়ে গেছে-ইংরেজ ব্যবসায়ীরা, কারো কারো পরনে রাতের পোশাক। কারো হাতে ধরা ক্যাশ বাক্স; ভারতীয় কেরানী আর দোকানদার। নিশ্চয় দুর্গের নিরাপত্তার ভেতর যেতে চাইছে সকলে। মোটা দেয়াল দিয়ে তৈরি চতুর্ভুজ দুর্গ প্রায় এক মাইলের চারভাগের এক ভাগ দূরত্বে সমুদ্রের কাছাকাছি উচ্চভূমির উপর অবস্থিত। দুর্গের ভূ-গর্ভস্থ ভল্টের গভীরে নিজেদের সম্পদ সঞ্চিত করে রেখেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। উৎকৃষ্ট দুর্গের পাহারার দায়িত্বে আছে ইংল্যান্ড থেকে পাঠানো কোম্পানি রেজিমেন্টের একদল সৈন্য। এর দেয়ালের নিচে পুরোপুরি সজ্জিত, কামানসহ প্রস্তুত হয়ে নোঙ্গরে ভাসছে বেশ কয়েকটি জাহাজ যেন যে কোন অনাহূত বিপদের মোকাবেলা করা যায়।

আর বিপদ, মনে হচ্ছে অবশেষে এসেই গেছে… মানুষের ভিড়ের মাঝে বহুকষ্টে দরজার কাছে নিজেকে ঠেলে দিয়ে কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে শহরের দেয়াল আর প্রভাতের ধূসর আলোয় ধোঁয়া আর ধুলা দেখতে পেল নিকোলাস। হঠাৎ করেই খানিকটা পরিচিত এক তরুণ ব্যবসায়ীর নজরে এলো। চামড়ায় মোড়ানো হিসেবের খাতা বুকের কাছে ধরে দৌড়ে আসছে তার দিকে। জন, কী হয়েছে? হট্টগোল ছাপিয়ে চিৎকার করে উঠল নিকোলাস।

শুনতে পেল না তরুণ ব্যবসায়ী, পেশীবহুল হাত বাড়িয়ে তাকে ধরে ফেলল নিকোলাস। আমি নিকোলাস, তুমি জানো কী হচ্ছে আসলে? ডাকাত পড়েছে? প্রশ্নটা করলেও নিকোলাস ভালো করেই জানে যে ডাকাতেরা শহরের বাইরে রসদবাহী রেলগাড়িতে আঘাত করতে পারলেও কামান কোথায় পাবে তাও এত বড় কামান?

কেউ কেউ বলছে যে শাহজাদা মুরাদ তুর্কী ভাড়াটে সৈন্য নিয়ে এসেছে সুরাট আক্রমণ করতে।

কিন্তু সে তো গুজরাটের শাসনকর্তা। কেন তাহলে গুজরাটের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী শহরের উপর অতর্কিত হানা দিয়েছে–এই শহরই তো তাকে সবচেয়ে বেশি কর দেয়? নিকোলাসের হাত ছেড়ে দৌড়ে পালাতে চাইছে তরুণ ব্যবসায়ী, বিবর্ণ চোখে তাকিয়ে আছে বিপদ থেকে দৌড়ে পালিয়ে দুর্গের কাছে একে অন্যের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে, ধাক্কা দিয়ে এগোতে থাকা ভিড়ের জনতার দিকে।

কারণ শাহজাদা কোম্পানির কাছে বিশাল অঙ্কের ঋণ চেয়েছিল; কিন্তু বোর্ডের ডিরেক্টরেরা প্রত্যাখান করেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠল তরুণ ব্যবসায়ী, বুঝতে পারল তাকে আরো জোর করে আঁকড়ে ধরেছে নিকোলাস।

তো এখন এভাবেই নিজের কার্য উদ্ধার করতে চাইছে…হাত ছেড়ে দিল নিকোলাস আর জনতার ভিড়ে হারিয়ে গেল লোকটা। যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল নিকোলাস। তার নিজেরও কি এখন দুর্গের আশ্রয়ে ঢাকা উচিত?

এখন তো আর সে কোন মোগল সেনাপ্রধান নয়, শুধুমাত্র একজন, বিদেশী যে কিনা গৃহে ফেরার সময় জড়িয়ে পড়েছে আরেকজনের সমস্যাঁতে। নিজেকে রক্ষা করাই তার প্রধান দায়িত্ব। সত্যিই তাই? যদি মুরাদ সত্যিই সুরাটের উপর আক্রমণ করে থাকে তাহলে অরাজকতা শুরু হয়েছে বলতে হবে। শাহজাহান কখনোই এমন কিছুর অনুমতি দেবেন না; তার মানে গুজবগুলো সত্য: সম্রাটের পুত্রেরা, অন্তত মুরাদ তো বটেই পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেছে।

দরজার কাছ থেকে সরে গিয়ে ভয়ার্ত মানুষগুলোকে পাশ কাটিয়ে আবারো সরাইখানার দিকে ফিরে চলল নিকোলাস; ইতিমধ্যেই সেখানকার সবাই পালিয়ে যেতে শুরু করেছে। ঘুমন্ত প্রহরী উধাও হয়ে গেছে, জীবনের চিহ্ন বলতে শুধুমাত্র বিছানার নিচে শুয়ে আছে লোম-ওঠা একটা কুকুর, সামনের পায়ের মাঝে মাথা গুঁজে ভয়ে কুইকুই করছে, অবিরাম চলছে গোলাবর্ষণ।

নিজের কক্ষে গিয়ে খড়ের তোষকের নিচে থেকে ব্যাগ দুটো তুলে নিল নিকোলাস। তেমন একটা ভারী নয়–হিন্দুস্তানে এতদিনের সেবাদানের ফসল–কিন্তু এ ভূমির কাছে এখনো ঋণী সে, জানে কোথায় যেতে হবে।

*

রাজকীয় সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত করার মত যথেষ্ট সময় নেই হাতে; কিন্তু বিলম্ব করাটা কোন উপায় নয়, আবারো উপদেষ্টামণ্ডলীর সভা ডেকে প্রস্তুতি নিতে বলবেন ভাবলেন শাহজাহান। তার মতে, উপদেষ্টারাও বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছে–সবাই পঞ্চাশের নিচে বলতে গেলে কেউই নেই। তিন সপ্তাহ আগে সংকট শুরু হবার পর প্রথমবারের মত দারার সামরিক অভিজ্ঞতা না থাকাটার জন্য অনুতাপ করলেন শাহজাহান। সবসময় নিজের পাশে, বিপদ আপদ থেকে মুক্তভাবে রাখতে চেয়েছেন জ্যেষ্ঠ পুত্রকে। কখনো ভাবেননি এতে করে অন্য পুত্রেরা নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে যা কোনদিন যুদ্ধ ক্ষেত্রে তাঁর এবং দারার বিরুদ্ধেই ব্যবহার করবে।

আমার বিশ্বস্ত সভাসদগণ, বার্তাবাহক আর দূত মারফত জানতে পেরেছি যে শাহসুজার বাহিনী এখনো গঙ্গা ধরে পশ্চিমে এগিয়ে চলেছে, ধীরে হলেও এগিয়ে আসছে। শুরু করলেন সম্রাট। যেসব ভূমি পার হয়ে আসছে, তাদেরকে ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছি যেন শাহ সুজার বাহিনীকে থামিয়ে দেয়ার জন্য সবরকম চেষ্টা করা হয় ও রসদ সংগ্রহ করতে বাধা দেয়া হয়। কিন্তু সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য সেনাবাহিনীই প্রয়োজন। তাই শাহ সুজার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী পাঠাচ্ছি আমি। আমার দৌহিত্র, দারাপুত্র সুলাইমান নেতৃত্বদান করবে, আম্বারের রাজা জয় সিং থাকবে পরামর্শদাতা। বাহিনীতে থাকবে বিশ হাজার অশ্বারোহী ও পাঁচ হাজার পদাতিক সৈন্য। গঙ্গার নিচে বরাবর গেলে আফগান জেনারেল দিলীর খান ও তার বাহিনী যোগ দেবে এ বাহিনীর সাথে।

শাহ সুজাকে কি জীবন্ত নিয়ে আসতে হবে? জানতে চাইল রাজা।

হ্যাঁ। পুত্রের রক্তপাত এড়িয়ে যেতে চাই। আমার অভিপ্রায় নিজের অপরাধ কবুল করার জন্য আমার সামনে নিয়ে আসা হবে তাকে।

আপনার অন্য দুই পুত্রের কোন সংবাদ, জাহাপনা? জিজ্ঞেস করে উঠল উজবেক খলিলুল্লাহ খান, যার ক্ষত-বিক্ষত মুখমণ্ডল বহন করছে উত্তরের অভিযানে আওরঙ্গজেবের পাশে থেকে নিজের দেশীয় ভাইদের বিরুদ্ধে শক্ত যুদ্ধ করার চিহ্ন।

মুরাদের বিরুদ্ধে পাওয়া তথ্যগুলো এখনো অস্পষ্ট। কোন কোন সংবাদে বলা হয়েছে যে নিজেকে গুজরাটের সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করেছে সে–মসজিদে তার নামে খুতবা পাঠ করা হচ্ছে আর মুদ্রায় নিজের শাসনামলের চিহ্ন খোদাইয়ের আদেশও নাকি দিয়েছে। এছাড়া অন্য সংবাদ বলছে নিজের রাজস্ব মন্ত্রীকে হত্যা করেছে–আলী নকি, যে কিনা সবসময় বিশ্বস্ত ছিল আমার প্রতি মুরাদের ষড়যন্ত্রমূলক কাজের সমালোচনা করার অপরাধে। সংবাদে শুনেছি মুরাদ নিজে নাকি তাকে তলোয়ার দিয়ে হত্যা করেছে। এছাড়াও গুজব আছে মুরাদ সুরাট আক্রমণ করে লুট করার পাঁয়তারা করছে; এরপর যুদ্ধের ব্যয় বহন করার মত অর্থ সংগ্রহ হয়ে গেলে নিজের রাজধানী আহমেদাবাদ থেকে রওনা দিবে দাক্ষিণাত্য থেকে আসা আওরঙ্গজেবের সাথে হাত মিলাতে। এরই মাঝে নিজের স্ত্রী আর ছেলে-মেয়েদেরকে চম্পনীর দুর্গে পাঠিয়ে দিয়েছে, তার মানে দীর্ঘ অভিযানের পরিকল্পনা আছে।

যদি সত্যিই শাহজাদা মুরাদ নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করে থাকে তাহলে তো আওরঙ্গজেবের সাথে যুদ্ধ করার কথা, যোগ দেবার নয়, তাই না? জানতে চাইল মারওয়ারের রাজা যশয়ন্ত সিং। আঙুল ঢুকিয়ে রেখেছে কোমরের কাছে স্বর্ণের চেইনের সাথে ঝুলানো ছুরির রত্নখচিত খাপের মাঝে।

আমার তা মনে হয় না। আমাদের দূতেরা উত্তরে আহমাদাবাদের দিকে যাবার সময় ধরে ফেলেছে আওরঙ্গজেবের এক বার্তাবাহককে। লোকটা আওরঙ্গজেবের সীল লাগান পত্র মুরাদের কাছে নিয়ে যাচ্ছিল। কি লেখা ছিল, আমি পড়ে শোনাচ্ছি! ইশরায় পরিচারককে ডেকে পত্রখানা তুলে নিলেন শাহজাহান।

‘সিংহাসন দখলের জন্য আমাদের পরিকল্পনা এগিয়ে চলেছে। ইসলাম আর মোগলদের উপর কলঙ্ক লেপন করা প্রতিমা পূজারী আর অবিশ্বাসীদেরকে একসাথে খতম করে এই পাপময় দেশে এক আল্লাহ তায়ালার নাম কায়েম করব। আমার প্রিয়তম ভাই, আমার সাথে এই মহতী কর্মে অংশ নিয়েছ তুমি আর তাই এই মর্মে প্রতিজ্ঞা করছি যে, যখন আমরা সফল হব–সফল হবই, কেননা আমাদের অভিপ্রায় সৎ–তোমার পুরস্কার হবে পাঞ্জাব, আফগানিস্তান, কাশ্মির আর সিন্দু প্রদেশ, যেখানে কারো কোন হস্তক্ষেপ ছাড়া আপন শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারবে তুমি। আল্লাহ আমার স্বাক্ষী রইলেন। যখন একসাথে দেখা হবে, যেমন আমরা ঠিক করে রেখেছি আগ্রায় পৌঁছানোর আগে শত্রুকে পদানত করা ও এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সফলভাবে সম্পাদনের জন্য বাকি আলোচনা সার হবে।‘

এমনো হতে পারে যে আমার হাতে পৌঁছে এ পত্র আমাকে ভুল পথে পরিচালনার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে এই চক্রান্ত করা হয়েছে। এরকম অসদোপায় অবলম্বন আওরঙ্গজেবের দ্বারা সম্ভব। কিন্তু আমার মনে হয়। এটা মিথ্যে নয়। মুরাদের বৃথা অহমিকা আর অন্তঃসারশূন্যতার সুবিধা নিচ্ছে আওরঙ্গজেব। সে জানে যে আগ্রা থেকে মুরাদের দূরত্ব কম। আর আমার সন্দেহ যৌথ বাহিনীর উপর আওরঙ্গজেব জোর দিচ্ছে যে তার আগে মুরাদ যেন এখানে পৌঁছে কোন ধরনের সামরিক ও রাজনৈতিক সুযোগ না নিতে পারে। শাহ সুজার প্রতি আওরঙ্গজেবের কী মনোভাব সেটা শুধুমাত্র অনুমান। কিন্তু একটা ব্যাপার নিশ্চিত যে মুরাদ বা আওরঙ্গজেব কাউকেই আগ্রাতে পৌঁছাতে দেয়া যাবে না। আর তাই রাজা যশয়ন্ত সিংয়ের নেতৃত্বে দক্ষিণে আরো একদল সেনাবাহিনী পাঠাতে চাই আমি, যেন তাদেরকে খুঁজে বের করে প্রতিহত করা যায়। একাকী বা যৌথ যেভাবেই তাদেরকে পাওয়া যাক না কেন। আল্লাহ্ আর ন্যায় আমাদের পাশে আছে–তাদের সাথে নয়।

চুপ করে বসে এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে ফেললেন শাহাজাহান। দারা জানে যে অবসন্ন হয়ে পড়েছেন তিনি। ক্রমাগত দুর্বলতা সত্ত্বেও রাতের বেশিভাগটাই জেগে বসে দারা। সুলাইমান, জয় সিং, যশয়ন্ত সিং আর অন্যান্য সেনাপ্রধানদের সাথে মানচিত্র দেখেছেন, রসদের ব্যাপারে কথা বলেছেন–যাত্রার জন্য কত সৈন্য প্রস্তুত আছে, পরবর্তী দল পাঠাতে কত সময় লাগবে, হাতে থাকা কামানের সংখ্যা কত, কতটি যুদ্ধতি আছে রাজকীয় হাতিশালে আর কতটাই বা দিতে পারবে রাজপুত মিত্রেরা। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেও অসুস্থ শয্যায় পড়ে থাকতেন শাহজাহান আর এখন কৃশকায় দুর্বল শরীরে যদিও কোন শক্তি অবশিষ্ট নেই, তাঁর ইস্পাত দৃঢ় মানসিকতা অন্যদের মাঝে আত্মবিশ্বাস সঞ্চার করছে। উপদেষ্টাদের চোখেমুখে তারই প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছে দারা। নিজের ভেতরেও তা বেশ অনুভব করতে পারছে।

উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলল শাহজাদা। দীর্ঘজীবী হোন আমার পিতা, ম্রাট, জিন্দাবাদ বাদশা শাহজাহান।

চারপাশে উপদেষ্টাদের উল্লসিত প্রতিধ্বনি শুনতে পেয়ে তার নিজের উৎসাহও হয়ে গেল দ্বিগুণ। যেমনটা পিতা বলেছেন, তাদের অভিপ্রায় সৎ।

*

আব্বাজান, রাজা জয় সিং এসেছেন। ঘুমের মাঝে দারার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন শাহজাহান। সুস্থ হয়ে যাবার পরেও মধ্যাহ্নের খাবারের পরে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন খানিকটা–যদিও আগের তুলনায় তেমন খেতেও পারেন না। শুধুমাত্র তন্দুরে সেকা খানিকটা মুরগি আর অল্প একটু জাফরানী ভাত। চোখ থেকে ঘুম তাড়িয়ে সোনালি রেশমের কাউচের উপর উঠে বসলেন শাহজাহান, এর উপরে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। দ্রুত মনোযোগ দিলেন বাস্তবে। গত কয়েক সপ্তাহে তেমন একটা সংবাদ পাননি সুলাইমানের সেনাবাহিনীর অগ্রগতি সম্পর্কে। কী সংবাদ এনেছে জয় সিং? কেন বা সে নিজে এলো?

আমি এখনো জানি না। এখনো তাকে দেখিনি। হারেমে নাদিরার সাথে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম এমন সময় একজন পরিচারক এসে জানালো রাজার আগমন সংবাদ। ভেবে দেখছি দুজনে একসাথে তার সংবাদ শুনলেই ভালো হবে। খবর পাঠিয়ে দিয়েছি যেন পনের মিনিটের মাঝে ব্যক্তিগত দর্শনার্থীদের কক্ষে এসে দেখা করেন আমাদের সাথে।

বস্তুত মাত্র দশ মিনিটের মাথাতেই পিতা-পুত্রের সামনে রাজার আগমন ঘোষণা করল এক কর্চি। রাজা প্রবেশ করতেই দেখা গেল সবসময়কার মতই ভাবে রুচিশীল পোশাকে হাজির হয়েছেন; যার জমকালো গোঁফ নিপুণভাবে বাঁকানো আর সুগন্ধি তেল চর্চিত, ঘিয়ে রঙা আলখাল্লায় একটিও দাগ নেই। পাশে একটি কক্ষে বসে প্রাণপণে ময়ূরের পাখা দিয়ে তৈরি বিশাল পাখা টানছে পরিচারকেরা। সম্রাটের মাথার উপরে কোন এক অতিকায় প্রজাপতির পাখার মত করে আগুপিছ হয়ে বাতাস ছড়াচ্ছে এই পাখা। তারপরেও গরম আর গুমোট হয়ে আছে। কক্ষ, অথচ জয় সিং একটুও ঘামছে না!

উদ্বিগ্ন হয়ে আর রাজার চেহারায় সংবাদের কোন প্রতিচ্ছায়া দেখতে না পেরে নিয়ম ভেঙে কথা বলে উঠল দারা। আপনার নিয়ে আসা সংবাদ কি ভালো না খারাপ, জয় সিং?

খানিকটা বিস্মিত হয়ে উত্তর দিল রাজা, মিশ্র, সম্মানীয়।

ঠিক আছে, দারা। বলে উঠলেন শাহজাহান। যেভাবে ঘটেছে সেভাবেই ঘটনাসমূহকে বর্ণনা করতে দাও জয় সিংকে, যেন আমি বিবেচনা করে দেখতে পারি।

আমি তাই করছি, জাহাপনা। সম্রাটকে কুর্নিশ করলো রাজা, শাহজাহানের শব্দগুলোতে স্পষ্ট বুঝতে পারল ভৎর্সনা করা হয়েছে অতি আগ্রহী পুত্রকে।

প্রথমে যমুনা তারপর গঙ্গা ধরে দ্রুত এগিয়েছিল আমাদের জাহাজ বহর। মাঝে মাঝে শুধু থামা হয়েছে ঘোড়াদের অনুশীলনের জন্য। আর আল্লাহবাদে থামা হয়েছিল আরো অস্ত্র ও রসদ নিয়ে দিলীর খানের যোগ দেয়ার জন্য। এক মাসেরও কম সময়ে পাঁচ শত মাইল অতিক্রম করেছিল বহর, এরপর স্থানীয় এক প্রজার নিয়ে আসা তথ্যানুসারে, যে কিনা নিজের নদীর কাছাকাছি দুর্গ থেকে দাঁড় বেয়ে এসেছে আমাদের সাথে যোগ দিতে আপনার দৌহিত্র বারানসীর কাছে যাত্রা স্থগিতের আদেশ দেয়। এক্ষেত্রে আমার এবং দিলীর খানের পরামর্শ মতই কাজ করেছে শাহজাদা সুলাইমান। কয়েকটা ভারী যন্ত্রপাতি পেছনে রেখে তৎক্ষণাৎ রওনা হয়ে যায় শাহ সুজা আর তার সৈন্যদের মোকাবেলা করতে। প্রজার দেয়া তথ্যানুযায়ী শাহ সুজা ও তার বাহিনী পশ্চিম দিকে বারো মাইল ভেতরে নদীর উত্তর অংশ ধরে এগোচ্ছে।

পরের দিন সন্ধ্যার পরে তাঁবুতে ফিরে আসলো আমাদের কয়েকজন চর। প্রধান সেনাবাহিনীর আগে গিয়ে চারপাশ ভালোভাবে তদারকি করে আসার সময় শিবিরে আগুনের আলো জ্বলতে দেখেছে। ঘোড়া থেকে নেমে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গিয়ে শাহ সুজার তাঁবু একেবারে নীরব দেখতে পায়; এমনকি একজন পাহারাদারও ছিল না। তাদের প্রতিবেদন শুনে যুদ্ধসভার মাধ্যমে মধ্যরাতের ঠিক পরপরই শাহ সুজার শিবিরে আক্রমণের ব্যাপারে একমত হয়ে যাই–আমরা সকলে, কেননা তখন আগত দিনের জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করবে শাহ সুজার সৈন্যরা। পরিবারের রক্তে রঞ্জিত না হতে চাওয়া আপনার আদেশের কথা স্মরণ করে, শাহজাদা সুলাইমান আমাদেরকে গুলি ছুঁড়তে নিষেধ করে দেয়। হত্যা না করেই শাহ সুজাকে খুঁজে বের করাটাই ছিল উদ্দেশ্য।

শাহ সুজার তাঁবুর কাছাকাছি এক মাইলের কম দূরত্বের মাঝে ছোট ছোট ঝোঁপের কাছে যাবার আগপর্যন্ত সবকিছু ভালোই চলছিল। হঠাৎ করেই যন্ত্রণাকাতর এক চিৎকারে কেঁপে ওঠে বাতাস আর আমাদের পথ প্রদর্শক দূত ছিটকে পড়ে ঘোড়া থেকে। তার ভয়ার্ত ঘোড়া আমাদের দিকে ছুটে আসতে শুরু করে। লাগাম মাটিতে লুটোচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য ভেবেছিলাম, দেখতে পাইনি এমন কোন পাহারাদার হয়ত চরের গায়ে গুলি করেছে। কিন্তু ঘোড়া কাছে আসতেই দেখা গেল জটার নিতম্বে রক্তাক্ত আঁচড়, আমাদের সারির মধ্য দিয়ে দৌড়ে চলে যেতে লাগল পেছনে বিশাল বড় একটা পুরুষ বাঘ। আমাদের ঘোড়াগুলোও বেসামাল হয়ে উঠল। বাঘটাই ছিল চরের চিৎকার আর ঘোড়র ক্ষতের কারণ–শত্রু আক্রমণ নয়। কিন্তু আমাদের সংখ্যা দেখে আবারো রাতের আঁধারে হারিয়ে গেল বাঘ। কিন্তু হট্টগোলের শব্দে জেগে গেল শাহ সুজার কয়েকজন প্রহরী। সতর্ক হয়ে চিৎকার শুরু করে দিল তারা।

তৎক্ষণাৎ ঘোড়া ছুটিয়ে তাঁবুর দিকে ছুটে গেলাম আমরা, হাতে বর্শা আর খোলা তলোয়ার। সবচেয়ে কাছের তাঁবুগুলো হয়ত আর একশ গজও দূরে নয়, এমন সময় ন্যাকড়া দিয়ে তৈরি কামানের গোলা উড়ে আসতে লাগল আর ঘোড়া থেকে পড়ে গেল একজন কর্চি। তাঁবুগুলোর কাছাকাছি পৌঁছে প্রথমেই তলোয়ার দিয়ে দড়ি কেটে দেয়া হল; ফলে তবু ছিঁড়ে নিচে চাপা পড়লো সৈন্যরা। বর্শা দিয়ে গেঁথে ফেলা হল আটকে পড়া সৈন্যদেরকে। রক্তে ভিজে গেল তাঁবুর কাপড়, আহত সৈন্যরা চিৎকার করে উঠল আত্মসমর্পনের জন্য। পনের মিনিটেরও কম সময়ে তাঁবুর ঠিক মাঝ বরাবর ঢুকে গেলাম আমরা। তখনি দেখতে পেলাম অশ্বারোহীদের বড়সড় একটি দল ঘোড়া ছুটিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল পূর্বের জঙ্গলে। চিৎকার করে শাহজাদা সুলাইমানকে জানালাম যে এদের মাঝে শাহ সুজাও নিশ্চয় আছে; কিন্তু তাদেরকে চলে যেতে দেবার কথার উত্তরে জানালো শাহজাদা… আমরা তাদেরকে পরে দেখে নেব। সেই মুহূর্তের জন্য জরুরি ছিল শাহ সুজার বাকি সৈন্যদের ব্যবস্থা করা। তাঁবুতে মূল্যবান সব জিনিস ছিল। এগুলোর মাঝে রাজকীয় যুদ্ধহাতিও ছিল যেগুলোকে কাজে লাগাবার সুযোগ পায়নি শাহ সুজা।

আমার পুত্র কি তাহলে পালিয়ে গেছে? যদি না হয়, তাহলে কী হল?

আমার বিশ্বাস শাহ সুজা পালিয়ে গেছে, জাহাপনা; কিন্তু আমি নিশ্চিতও নই। আর কোথাও শাহ সুজাকে ধরতে পারিনি আমরা-মৃত বা আহতদের মাঝেও ছিল না। শাহজাহানের চেহারা দেখে তাড়াতাড়ি বলে উঠল জয় সিং।

কিন্তু এসব তো ভালোই সংবাদ? তোমার দিকনির্দেশনায় শাহ সুজাকে পরাজিত করেছে সুলাইমান।

হ্যাঁ, জাহাপনা, কিন্তু তারপর যা ঘটল সেটা দুঃসংবাদ।

তোমার কথার অর্থ কি শাহ সুজার দল পুনরায় একত্রিত হয়ে আক্রমণ করেছে?

না, জাহাপনা, তা নয়–সহজ কথায় বলতে গেলে আপনার দৌহিত্র জেদ করেছে যেন শাহ সুজার পিছু ধাওয়া করি আমরা, যারা পূর্ব দিকে পাটনাতে পালিয়ে গেছে বলে জানতে পেরেছি। দিলীর খান আর আমি বহুবার বোঝাতে চেয়েছি যে শাহ সুজা ইতিমধ্যেই আপনার সিংহাসনের জন্য বিদ্রোহ শুরু করেছে আর জানামতে আওরঙ্গজেব আর মুরাদকেও এখনো পরাজিত করা সম্ভব হয়নি, তাই এটাই এখন সবচেয়ে বড় হুমকী। আমরা চেয়েছি সেনাবাহিনীকে, যেটি কিনা সৈন্যদের সেরা অংশ, পিছিয়ে এসে পশ্চিম দিকে নিয়ে যেতে, সেখানেই জরুরি বেশি। শাহজাদা সুলাইমান কিছুতেই একমত হয়নি। কিন্তু সেনাপ্রধান হিসেবে তার কথা মান্য করতেই হবে। আমি শুধু অনুমতি নিয়ে আগ্রাতে ফিরে এসেছি ব্যক্তিগত দেহরক্ষীদের নিয়ে, যেন আপনার কাছে প্রতিবেদন পেশ করতে পারি আর দিলীর খান রয়ে গেছে উপদেষ্টা হিসেবে।

সুলাইমান বাহিনীর আর কোন সংবাদ পেয়েছ তুমি?

হ্যাঁ, মাত্র গতকালই। দিলীর খানের কাছ থেকে দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে এসেছে, একজন কসিড। সে আর সুলাইমান, বারানসী থেকে বিশ মাইল পূর্ব দিকে আছে, বাংলার জঙ্গল আর জলাভূমির মাঝে পিছু ধাওয়া করছে প্রতিপক্ষের।

হতাশ হলেন শাহজাহান। ঠিক কথাই বলেছে জয় সিং : সংবাদ মিশ্র ধাঁচের। শাহ সুজা পালিয়ে গেছে কিন্তু সুলাইমান এমনভাব করছে যেন মরণপণ যুদ্ধে নয়, শিকার করতে গেছে। সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে যদি যশয়ন্ত সিং আওরঙ্গজেব আর মুরাদকে পরাজিত করতে পারে। কিন্তু তা না হলে সুলাইমানের সৈন্যদের প্রয়োজন পড়বে। তাই শাহ সুজার পিছু ধাওয়া করার বেপরোয়া অভিযান থামাতে হবে। এই মুহূর্তেই আদেশ পাঠিয়ে শাহজাদাকে আগ্রায় ডেকে আনবেন শাহজাহান।

*

বসন্তের রৌদ্রতাপ–উষ্ণ কিন্তু তেমন কড়া নয়–আরামদায়ক লাগল চেহারার উপর এসে পড়াতে। নিজের হালকা বাদামি তেজী ঘোড়াটির উপরে আবারো উঠে আনন্দিত হয়ে উঠলেন শাহজাহান। খুব বেশি সময় লাগল না, দৃষ্টির সামনে ভেসে উঠল সিকান্দ্রাতে অবস্থিত আকবরের বিশাল সমাধির লাল বেলেপাথরের তৈরি ফটকদ্বার। সম্প্রতি পাওয়া সংবাদটা আত্মস্থ করার জন্য সময় আর একাকিত্বের খোঁজে হঠাৎ করেই মন চাইল পিতামহের শেষ নিদ্রার জায়গাটিতে আসতে, যিনি তাঁকে শিখিয়েছেন একজন সম্রাটের দায়িত্ব। প্রিয় দৌহিত্রের এহেন সংকটময় মুহূর্তে আকবর বেঁচে থাকলে কী বলতেন? আকবর নিজে কখনো এমন বিপর্যয়ের মোকাবেলা করেননি। কারণ তিনি হয়ত আরো উৎকৃষ্ট শাসক ছিলেন, আরো অধ্যবসায়ী আর সাম্রাজ্যের মনোভাব বোঝার ক্ষেত্রে আরো তীক্ষ্ণবুদ্ধির অধিকারী….

সবুজ পাগড়ী পরিহিত প্রহরীর দল উঠে দাঁড়াতেই ঘোড়া থেকে নেমে পড়লেন শাহজাহান। হয় বয়সের ভারে নতুবা অসুস্থতার কারণে অথবা হয়ত উভয়ের কারণে যতটা ভেবেছিলেন তার চেয়ে বেশি ব্যাথা হয়ে গেছে শরীরের হাড়গোড় আর মাংসপেশী। কর্চির হাতে লাগাম ধরিয়ে দিয়ে দেহরক্ষীকে ইশারা করে আদেশ দিলেন বাইরে থাকতে। একাকী প্রবেশ করলেন ফটকদ্বার দিয়ে। বাগানে যেতেই বিস্মিত হয়ে কিচকিচ শুরু করে দিল একটা বানর, মাথা তুলে তাকিয়ে রইল গাছের নিচে চড়ে বেড়াতে থাকা তিনটি হরিণ। কিন্তু শাহজাহান সোজা তাকিয়ে রইলেন গাছের ছায়া দিয়ে ঢাকা বালি-পাথরের তৈরি পথের শেষ মাথায় পিতামহের সমাধির দিকে। সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে একটু বেশিই কঠিন এই সমাধি, কিন্তু এর দৃঢ়তা ফুটিয়ে তুলেছে আকবরের চেতনাকে। শারীরিক এবং মানসিক উভয় দিক থেকেই বড় মাপের শক্তিশালী মানুষ ছিলেন সম্রাট আকবর। সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত করে গভীর আর শক্ত করেছেন এর ভিত্তিকে, ঠিক যেমন তাঁর সমাধিকে ধরে রেখেছে এর খিলানগুলো।

ধীরে ধীরে পথের শেষ মাথায় গিয়ে বসলেন সমাধির দিকে মুখ করে থাকা দুটি মার্বেল পাথরের বেঞ্চিতে। এখানে এসেছিলেন নির্জনে বসে খানিকটা ভাবতে; কিন্তু ঘোড়া ছুটিয়ে আসার পরিশ্রমে আর সারাদিনের ঘটনায় হতবিহ্বল থাকার ফলে প্রায় সাথে সাথে বন্ধ হয়ে গেল চোখ জোড়া।

হঠাৎ করেই হতচকিত হয়ে জেগে গেলেন পাথুরে পথে পদশব্দ শুনতে পেয়ে। উঠে দাঁড়িয়ে ঘুরে তাকিয়ে দেখতে পেলেন দ্রুতপায়ে তার দিকে হেঁটে আসছে কেউ একজন কিন্তু গাছের ছায়া পড়ায় বোঝা যাচ্ছে না লোকটা কে। একাকী থাকতে চাওয়ার পরেও দেহরক্ষীরা কেন কাউকে ঢুকতে দিল? অবচেতনেই হাত চলে গেল কোমরবন্ধনীর সাথে ঝুলন্ত ছুরির কাছে। কে তুমি? কে তোমাকে অনুমতি দিয়েছে আমার একাকিত্বে অনুপ্রবেশ করতে? জানতে চাইলেন সম্রাট।

থেমে গেল আগন্তুক। সোনালী কেশ, দেখতে পেলেন শাহজাহান পূর্বের মত উজ্জ্বল বা ঘন নয়; কিন্তু তারপরেও ভুল হবার কোন কারণ নেই।

এগিয়ে এসো। নিকোলাস ব্যালান্টাইন কাছে এগিয়ে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন সম্রাট।

জাহাপনা, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা করুন। আপনার প্রহরীদের নেতা আমাকে চেনে। যখন আমি বলেছি যে আপনাকে দেয়ার জন্য জরুরি তথ্য নিয়ে এসেছি, আমাকে প্রবেশ করার অনুমতি দিয়েছে।

হাত একপাশে রেখে দিলেন শাহজাহান। আরো কাছে এগিয়ে আসার পর দেখতে পেলেন ইংরেজের কৃশকায় চেহারায় চোখের নিচে গভীর কালো দাগ। আমার কন্যা তোমার কাছে চিঠি লিখত, আমি জানি, আমি … অনুতপ্ত … ভুল বোঝাবোঝির জন্য তোমাকে আগ্রা ছেড়ে যেতে হল।

জাহাপনা, এই কারণে এত কষ্ট করে ঘোড়া ছুটিয়ে আপনাকে খুঁজতে আসিনি আমি। আমি এমন কিছু বলতে চাই, যা কোনভাবেই না–অপেক্ষা করা যাবে না। গলার স্বর কেঁপে গেল নিকোলাসের।

বলো।

ইংল্যান্ড যাত্রার উদ্দেশে সুরাটে অপেক্ষা করছিলাম। এমন সময় শহরে আক্রমণ শুরু করে আপনার পুত্র শাহজাদা মুরাদ। শহরের দেয়াল কামান দিয়ে খুঁড়িয়ে দিয়ে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজকোষ লুট করে নিয়ে গেছে…. সুরাট থেকে ফেরার সময় পথিমধ্যে কয়েকজনের কাছে শুনেছি মুরাদেরই একজন সেনাপতি নেতৃত্ব দিয়েছে এই ধ্বংসলীলায়। শাহজাদা নিজে দক্ষিণ দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে আরো বিশাল বাহিনী নিয়ে, শাহজাদা আওরঙ্গজেবের সাথে মিলিত হতে… বুঝতে পেরেছি যে সাথে সাথে এ সংবাদ আপনাকে জানানো প্রয়োজন। আমি… শাহজাহানের মুখে দুঃখের বিমর্ষ হাসি ফুটে উঠতে দেখে থেমে গেল নিকোলাস।

সাধুবাদ জানাই যে তুমি এসেছ, কিন্তু ইতিমধ্যেই সুরাটের উপর আক্রমণের সংবাদ পেয়েছি আমি। এমনকি ঘটনা ঘটার আগেই শুনেছি যে মুরাদ আক্রমণ আর রাজকোষ লুট করার পরিকল্পনা করছে; কিন্তু আমার হাতে পর্যাপ্ত সংখ্যক সৈন্য নেই যারা কিনা সময় মত পৌঁছতে পারবে… ।

আপনি জানেন ভেবে স্বস্তি পাচ্ছি, জাহাপনা। আমার ভয় ছিল যে দেরি না হয়ে যায়।

আর তোমার কী মনে হয় আমি কি পদক্ষেপ নিয়েছি?

সেনাবাহিনী পাঠিয়ে দেয়া যেন মুরাদ ও তার ভাই একত্রে মিলিত হতে না পারে?

ঠিক, তাই। বস্তুত, সুরাট সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোন খবর পাবার আগেই আমি তা করেছি। তোমাকে বিস্মিত দেখাচ্ছে, নিকোলাস। তুমি আমার বিদ্রোহী পুত্রদের দাবি বিশ্বাস করোনি যে শাসন করার পক্ষে বেশি অসুস্থ হয়ে গেছি আমি?

নিকোলাসের আহত অভিব্যক্তি দেখে গলার স্বর কোমল করলেন শাহজাহান–যাই হোক, মাতৃভূমির জন্য জাহাজ না ধরে এখানে আসার কোন প্রয়োজন ছিল না ইংরেজ লোকটার।

তুমি ভাবতেও পারবে না সবকিছু কত দ্রুত ঘটে গেছে। আমার সম্রাজ্ঞী মৃত্যুবরণ করার পর থেকে এতবড় অন্ধকার মুহূর্ত আর আসেনি আর এখন আগ্রায় ফিরে এসেছ তুমি। ভেবেছিলে আমাকে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ দিবে–এজন্য তোমাকে ধন্যবাদ। কিন্তু এখন আমি তোমাকে জানাচ্ছি… মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই জানতে পেরেছি, রাজা যশয়ন্ত সিংয়ের নেতৃত্বে যে শক্তিশালী বাহিনী পাঠিয়েছি তাদের সাথে আওরঙ্গজেব ও মুরাদের যৌথ বাহিনীর দেখা হয়েছে ধর্মতে। উজ্জয়নী থেকে খুব বেশি দূরে নয়। ভুল তথ্য সরবরাহ করা হয়েছিল যশয়ন্ত সিংকে–অথবা ইচ্ছেকৃতভাবে হয়ত ভুল পথে নিয়ে যাওয়া হয়েছে–

শত্রুর গোলন্দাজ বাহিনীর শক্তি সম্পর্কে না জেনেই সনুখ সমরের নির্দেশ দিয়ে বসে রাজা। খোলা ময়দানে তার রাজপুত অশ্বারোহীদেরকে নির্বিচারে হত্যা করেছে বিদ্রোহীদের কামান। কামানের গোলার সাথে সাথে বিদ্রোহী বাহিনীর অশ্বারোহী সৈন্যদেরকে এগোতে দেখে ভীত ও ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে আমাদের সৈন্যরা; অনেকেই যশয়ন্ত সিং সহ পালিয়ে যায় রাজস্তানী মরুভূমিতে।

আওরঙ্গজেব আর মুরাদ এখন কোথায় আছে?

নিশ্চিতভাবে জানি না আমি। যদি তাদের জায়গায় আমি হতাম তাহলে চম্বল নদীর দিকে এগোতাম, আগ্রা আর তাদের মাঝে সবশেষ বাধা। আর তাই স্বাভাবিকভাবে দক্ষিণ দিকে গোয়েন্দা পাঠিয়ে দিয়েছি যেন তারা পৌঁছানোর সাথে সাথে জানানো হয় আমাকে।

এরপর কী করবেন, জাহাপনা?

একটা মাত্র কাজই করতে পারি–বাকি সৈন্যদেরকে পাঠিয়ে তাদেরকে বাধা দেয়া। সাম্রাজ্য আর সম্মান রক্ষার্থে মাঠে নামতে হবে শাহজাদা দারাকে–আমার পিতামহের সমস্ত অর্জন হুমকির মুখে ঝুলছে এখন।

.

২.৮

আগ্রা থেকে চার মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে সমভূমি থেকে উঠে যাওয়া ছোট্ট একটা পাহাড়ের মাথায় নিজের বাদামি ঘোড়র উপর শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে নিকোলাস। সকালের স্নিগ্ধ আলোতে দিগন্তের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল তাজমহলের পরিচিত অবয়ব। তার কাছে গম্বুজটাকে মনে হয় যেন অশ্রুবিন্দু। সম্রাটের অনুরোধে আবারো ভাড়াটে সৈন্যদের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেছে নিকোলাস। প্রভাতের আলো ফোঁটারও আগে নিকোলাস আর তার পাঁচশ সৈন্যকে নিয়ে বের হয়ে এসেছে দারা–রোগ, ক্ষত আর হতাশা মিলে যদিও উত্তরের অভিযানের সময়কার চেয়ে সংখ্যায় অনেক কমে গেছে তারা–চম্বল নদীর দিকে নিজের সেনাবাহিনী নিয়ে রওনা দেয়ার আগে সর্বশেষ পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে এভাবে।

হাতে জ্বলন্ত মশাল নিয়ে খাড়া পথ বেয়ে সুউচ্চ ফটকদ্বার দিয়ে নেমে এসেছে তারা। এরপর কোনরকম সামরিক বাধা ছাড়াই পার হয়ে এসেছে সমভূমি। বুক ভরে হিন্দুস্তানের অদ্বিতীয় আর অসাধারণ ঘ্রাণ টেনে নিল নিকোলাস–মাটি থেকে উঠে আসা গন্ধের সাথে মিশে গেছে রাতে ফোঁটা ফুলের গন্ধ যেমন চম্পা, মশলা আর গোবর দিয়ে আগুন জ্বালানোর গন্ধ, জেগে উঠছে সকলে, তৈরি হচ্ছে নতুন দিনের জন্য। সৈন্যদের ঘোড়ার খুড়ের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না, মাঝে মাঝে ডেকে উঠছে একটা ময়ূর আর নিশাচর গ্রাম্য কুকুর।

যদিও আক্ষরিক অর্থেই শান্তি ভঙ্গ হতে যাচ্ছে এখন। দারা আর সৈন্যবাহিনী এগিয়ে চলেছে ভাইদ্বয় আওরঙ্গজেব আর মুরাদের সাথে সন্মুখ সমরে লড়তে। পারিবারিক বিভক্তি আর কদর্যতা নিয়ে ভেঙে পড়তে যাচ্ছে গৃহযুদ্ধ। হিন্দুস্তানে আসার পর নিজের জীবনের প্রথম দিকটাতেও এসব দিন দেখেছে নিকোলাস। যখন রক্তাক্ত পরিণতি আর ধ্বংসের কথা জেনেও সিংহাসনের জন্য লড়াই করেছিল শাহজাহান। পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের পশ্চিমে পারিবারিক এস্টেট থেকে পাঠানো বড় ভাইয়ের পত্রে জানতে পেরেছিল যে নিজের দেশেও শুরু হয়েছিল গৃহযুদ্ধ–রাজাকে হত্যা করার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় জনগণের সংসদ। আর এর গোঁড়া জননেতা অনুসরণকারীদের উপর আরোপ করেছে আওঙ্গজেব আর মোল্লাদের মত মৌলিক একটি বিশ্বাসের কঠোর আর সাদাসিধে নীতি; এমনকি থিয়েটার আর ১লা মে তারিখে পুষ্পশোভিত দণ্ডের চারপাশে ঘুরে ঘুরে নৃত্য করার মত নির্দোষ উৎসবকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

প্রায় অবচেতনেই কোমরের কাছে রাখা দুটি পিস্তলের একটির উপর হাত রাখল নিকোলাস। ভাইয়ের শেষ চিঠির সাথে এগুলোও এসে পৌঁছেছে শক্ত করে বেঁধে রাখা একটি প্যাকেটের মাঝে। এ ধরনের অস্ত্র হিন্দুস্তানে প্রায় বিরল বলা চলে। যাই হোক, সামনের যুদ্ধে হয়ত কাজে লাগবে এ দুটো। যদিও মনে হয় না যুদ্ধের মাঝে নতুন করে গুলি ভরে নেয়ার মত যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে। তাই প্রতিটি গুলি করতে হবে ভেবে-চিন্তে, জায়গা মত। যদিও অনুশীলনের সময় পনের গজের বেশি লাগাতে পারেনি সে।

কানে তালা লেগে যাবার মত বিস্ফোরণের শব্দে কেটে গেল নিকোলাসের চিন্তার সুতো। সৈন্যদের এগিয়ে আসার শব্দ ভেসে এলো সামনের দিকে লম্বা-গলার বাদ্যের আওয়াজের মাধ্যমে।

পাশাপাশি ত্রিশ জন সৈন্য আছে একেবারে সামনের সারিতে। সকলের পরনে মোগলদের সবুজ পাগড়ি আর টিউনিক। একই রকমের দেখতে কালো ঘোড়ার উপর চড়ে বসেছে সকলে। প্রথম দিকে দুই সারিতে বাদক দলের সাথে দামামা বাজিয়েরাও আছে। নিজেদের ঘোড়ার দুই পাশে ছোট ছোট দামামাগুলোকে বেঁধে নিয়ে একই তালে বাজাচ্ছে সবাই আর জন্তুগুলোও এতটাই প্রশিক্ষিত হয়ে গেছে যে শব্দের ঝংকারেও কোন ভাবোদয় বোঝা গেল না। বাদ্য দলের পরেই আছে ঋজুদেহী অশ্বারোহীর দল। শুধুমাত্র তারা বাদে প্রতি ছয় জনে একজন, ধারণা করল নিকোলাস হাতে ধরা সবুজ ব্যানারের কাঠের দন্ড।

বাতাসে উড়ছে মোগল নিশান। প্রস্থ অপেক্ষা বেশি দৈর্ঘ্যের সবুজ পতাকার সাথে হাতে উদ্যত বর্শা। তাদের পেছনে আবারও অশ্বারোহীদের সারি। এদের হাতের বর্শার মাথায় বেঁধে রাখা সবুজ দৈর্ঘ্য বেশি পতাকাগুলো আরোহীদের দুলে ওঠার তালে তালে সৃষ্টি করে সমুদ্রের তরঙ্গ অথবা মনে হচ্ছে যেন শরতের শস্যক্ষেতের উপর বয়ে যাচ্ছে বাতাস।

কয়েক মিনিট পরে সোনালি ধুলার মাঝ দিয়ে নিকোলাসের চোখে পড়ল যুদ্ধহাতিদের সারি। প্রতিটির উপরে বিশাল হাওদা আর লোহার পাতের দেহবর্ম। পাতগুলো এত ছোট যে হাতিগুলো স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারে না। নিকোলাসের মনে পড়ে গেল যে একবার শুনতে চেষ্টা করেছিল সংখ্যা, তিন হাজার পর্যন্ত গোনার পর অবশেষে ক্ষান্ত দেয়। যুদ্ধবর্মের মতই প্রতিটি হাতির শুঁড় বেঁধে রাখা হয়েছে একদিকে ধারালো বাঁকা তলোয়ার দিয়ে। শুড়গুলোকে রক্তলাল রং দিয়ে রাঙানো হয়েছে। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হাওদার মাঝ থেকে উঁকি দিচ্ছে গজনাল-এর ব্যারেল। এরকম চলন্ত যুদ্ধের জন্য অত্যন্ত যুতসই হোট কামান। হাতির দল একেবারে লড়াইয়ের মাঝখানে দ্রুত ঢুকে যেতে পারে এ কামানগুলো নিয়ে।

হাতিদের সারির একেবারে মাঝখানে আছে অপেক্ষাকৃত বড় জম্ভগুলো। এগুলোর শুড় লাল নয় সোনালি রঙে রাঙানো। একে অন্যের সাথে তালে তালে পা ফেলে চতুর্ভুজ আকৃতি নিয়ে এগিয়ে চলেছে। চারকোনার প্রতিটা কোণার হাওদা থেকে উড়ছে অশ্বারোহীদের চেয়েও বড় সবুজ ব্যানার। ছয় ফুট উঁচু আর সম্ভবত বিশ ফুট লম্বা ব্যানারগুলোতে সোনা দিয়ে অ্যামব্রয়ডারি করা হয়েছে সম্রাট আর দারা শুকোহর নাম। একেবারে মাঝখানে আছে সবচেয়ে বড় হাতি। সূর্যের আলোয় চকমক করছে সুউচ্চ হাওদার গায়ে লাগান মনি-মাণিক্য। ধীরে ধীরে হাতিটা কাছে এগিয়ে আসতেই পরিষ্কারভাবে দারার দেহাবয়ব দেখতে পেল নিকোলাস। প্রপিতামহ মহান আকবরের ন্যায় সোনার দেহবর্ম পরে বসে আছে হাওদার ঠিক মাঝখানে। পেছনে খোলা তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কালো দাঁড়িঅলা দুই দেহরক্ষী। পাশ দিয়ে যাবার সময় নিকোলাসের দিকে তাকিয়ে একটা হাত তুলল দারা। কিন্তু নিকোলাস নিশ্চিত হতে পারল না যে তাকে কি সত্যিই চিনতে পেরেছে দারা নাকি একজন ভালো জেনারেলের মত দায়িত্ব পালন করেছে শুধু পথের পাশে থাকা সৈন্যদেরকে অভিবাদন জানানো।

আধা ঘণ্টা পরে সেনাবাহিনীর কামান চলে গেল নিকোলাসের পাশ দিয়ে। তাকে আদেশ দেয়া হয়েছে যেন নিজের সৈন্যদেরকে নিয়ে পশ্চাদ্ভাগের সৈন্যদের সাথে যোগ দেয়। সকালের কুয়াশা কেটে যেতেই গরম পড়তে শুরু করেছে আর নাক-মুখও ভরে যেতে লাগল ধুলায়। যাইহোক, দ্রুত নিজের চামড়ার বোতল থেকে এক চুমুক পানি মুখে দিয়ে নীল কাপড়ে আবার চেহারা ঢেকে নেবার মাঝে জমকালো গোলন্দাজ বাহিনী দেখে না চমকে পারল না। সবচেয়ে বড় কামানটি এ মুহূর্তে পার হয়ে গেল তার পাশ দিয়ে। এত বড় পিতলের ব্যারেল, রহস্যময় পাখি আর সাপের ছবি খোদাই করা প্রায় বিশ ফুটের কাছাকাছি। আট চাকার দেহটা বইতে কতটা ষাঁড় লাগছে? গুনে দেখল একটা অস্ত্র টানতে ঘেমে নেয়ে উঠছে ত্রিশটা পশু, একটা থেকে আরেকটা পশুর মাঝে দৌড়ে তাড়া দিচ্ছে সাদা-কাপড় পরা, খালি পায়ের চালক। অবাধ্য পশুর গায়ে লম্বা চাবুকের আঘাত আর দড়ি ধরে টানার ফলে এত জোরে চিৎকার করে উঠছে বঁড়গুলো যে মাঝে মাঝে পুরো সৈন্য শোভাযাত্রার শব্দ ছাপিয়েও সে আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।

যুদ্ধহাতির চেয়েও কামান বাবর হিন্দুস্তানে এদের আগমন ঘটিয়েছেন তাও প্রায় দেড়শ বছর হয়ে গেল–যে কোন সেনাবাহিনীর প্রাণকেন্দ্র, অশ্বারোহী বা হাতির দলের আক্রমণ ঠেকানো ছাড়াও বিস্ফোরণের মাধ্যমে দেয়াল আর ফটকদ্বার ভেঙে, খুঁড়িয়ে দিতে পারে একটা শহরের শক্তি। বারুদের প্রস্তুতকারীরা বেশিরভাগই তুর্কি ভাড়াটে সৈন্য সবসময় আরো ভালো বারুদের মিশ্রণ তৈরি করছে যেন বেড়ে যায় কামানের দূরবর্তী আঘাত ক্ষমতা আর বিশ্বাসযোগ্যতা। শুধু যদি, ভাবলো নিকোলাস, কামারশালার কারিগর এই বিশাল অস্ত্রগুলোকে আরেকটা হালকা করে তৈরি করত তবে বহনে আর গোলা ছুঁড়তে আরো সহজ হত।

কামানের পরে এলো কাঠের গরুগাড়ি, কয়েকটিতে শক্ত করে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা ঢাকনা–বারুদ বোঝাই গাড়ি–আর কয়েকটিতে ভর্তি পাথর আর লোহা পুড়ে রাখা কামানের গোলা। এদের পেছনে, বেশিরভাগই ঘোড়ার পিঠে বসে আছে আবার কেউ কেউ পায়ে হেঁটে আসছে, বন্দুকধারীর লম্বা অস্ত্র আর বারুদ ভরার শলাকা ঝুলছে তাদের ঘোড়ার গায়ে থেকে বা নিজেদের পিঠ থেকে। একই সাথে আছে বারুদের শিঙা বা চামড়ার থলেতে ভরা বন্দুকের গুলি। এদের অস্ত্রগুলো বেশিরভাগই ম্যাচলক। হিন্দুস্তানী আবহাওয়ার জন্য বেশি কার্যকর। অন্যদিকে নতুন আবিষ্কৃত হওয়া ফ্লিন্টল ধুলা অথবা সঁাতাতে আবহাওয়ায় গুলি ছুঁড়তে ব্যর্থ হয়। বন্দুকধারীদের সাথে সাথে আসছে। নতুন গুলি তৈরির জন্য রাসায়নিক বহন করে নিয়ে আসা সৈন্যরা।

তীরন্দাজরা পাশ দিয়ে চলে যেতেই গরমে আরো বেশি ক্লান্ত আর উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল নিকোলাস। পূর্ববর্তী অভিযানের চেয়ে সংখ্যায় কম হলেও এদের জোড়া ধনুক আর পালক লাগান তীর এখনো বন্দুকের গুলির চেয়েও দ্রুত ছুটতে পারে, যদিও ততটা ভয়ংকর নয় আচরণে।

শেষের একেবারে আগে এলো পদাতিক বাহিনী। কারো পায়েই জুতা নেই বলতে গেলে। সূর্যের প্রখর গরম থেকে রক্ষা পেতে হালকা সুতি কাপড় আর সাধারণ পাগড়ি পরে আছে বেশির ভাগ। কয়েকজনের হাতে তলোয়ার। বেশিরভাগের হাতে সাধারণ বর্শা। কিন্তু কয়েকজন বহন করছে যন্ত্রপাতির মত অস্ত্র যেমন কাস্তে আর কোদাল, যা দিয়ে শস্য খেতে কাজ করতেই অভ্যস্ত তারা। কিন্তু বেশিরভাগ অভিজ্ঞ সৈন্য সুলাইমানের সাথে শাহ সুজার পিছনে চলে যাওয়ায় তাড়াহুড়ো করে এদেরকে শস্য খেত থেকে উঠিয়ে নিয়ে সেনাবাহিনীতে পাঠিয়ে দিয়েছে জমিদারেরা।

যুদ্ধে এরকম অদক্ষ পদাতিকের কোন ভূমিকা কখনো দেখেনি নিকোলাস। হয় দ্রুত আতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে যায় নয়ত প্রতিরোধ করতে গেলে সহজেই কচুকাটা হয় শত্রুর হাতে। সম্ভবত এদের প্রধান ভূমিকা হচ্ছে সংখ্যায় বেশি হয়ে সাধারণ জনগণ অথবা অনভিজ্ঞ সেনাবাহিনীকে ভয় পাইয়ে দেয়া। আরো আধ-ঘণ্টা কেটে গেল ইতিমধ্যেই বিশৃংখল হয়ে পড়া পদাতিক বাহিনীর এলোমেলো যাত্রা শেষ হতে। অতঃপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অশ্বারোহী পশ্চাদভাগের সৈন্যদের এগিয়ে আসতে দেখতে পেল নিকোলাস–হালকা হলুদ অথবা কমলা রঙের আলখাল্লা পরিহিত সূঁচালো-কানের মেওয়ারী ঘোড়র উপর বসে থাকা রাজপুত সৈন্য আর বিশাল সব ঘোড়ার উপর বসে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ভারী দেহের পাঞ্জাবী সৈন্যদের মিশ্র একটি দল।

আনন্দে নিজের লোকদের দিকে তাকিয়ে হাত ইশারা করল নিকোলাস। জুন মাসের তপ্ত সূর্যের নিচে সকলেই ঘামছে তার মত, শিরস্ত্রাণ বেয়ে শ্বেদকণিকা নামছে মুখের উপর, এরপর মেরুদণ্ড বেয়ে মিশে যাচ্ছে পৃষ্ঠদেশের উপর থাকা বর্মের মাঝে। কৃতজ্ঞচিত্তে ধন্যবাদ জানালো নিকোলাস যে রসদ বোঝাই বাহিনীর জন্য অপেক্ষা করতে হল না। কেননা হেলেদুলে এগোতে থাকে ভারী মালবাহী উট, খচ্চর আর হাড় জিরজিরে গাধার দল। আর এর সাথে আছে তাঁবুর পিছনে আসা বিচিত্র পেশার মানুষের মিছিল, দম বন্ধ করা ধুলার মাঝে চোখে পড়ল প্রায় আগ্রার ফটকের কাছে হুড়োহুড়ি করছে দলটা। এখনো সেনাবাহিনীর প্রয়োজনে আনন্দ-বিনোদনের ব্যবস্থা; রাধুনী, দড়িবাজ, দেহপসারিণী মেয়েরা আর সাপুড়ের দল তাঁবুর জীবনে শূন্যতা ভরিয়ে তোলার পাশাপাশি প্রশমিত করে দেয় যুদ্ধের উদ্বিগ্নতা। এই অভিযান যদি স্বল্প সময়ের জন্য হত আর দারা-ই হয়ে যেত বিজয়ী, আপন মনেই ভাবল নিকোলাস। ঘোড়র পেটে গুতো দিয়ে আগে বাড়ল সে আর তারই মত আরো একবার চলার সুযোগ পেয়ে আগ্রহী হয়ে উঠল বাদামি ঘোড়া ছোট্ট পাহাড় বেয়ে নেমে গিয়ে যোগ দিল দারার বিশাল সেনাবাহিনীর সাথে।

*

চম্বল নদীর তীর থেকে আস্তে করে মাছের খোঁজে উড়াল দিল দুটা সারস বক। চম্বলের চিকচিকে পানির মাঝে ছায়া পড়েছে এগুলোর বিশাল লাল মাথা আর ধূসর-শুভ্র পালকের। একটা মরা গাছের গুঁড়ির উপর বসে কৃতজ্ঞচিত্ত নিকোলাস তাকিয়ে দেখছে, আস্তে আস্তে বিদায় নিচ্ছে দুপুরের কড়া রোদ, পানি থেকে হাঁক ছাড়ল লম্বা, কৃশকায় ঘরিয়াল। এটাও বেরিয়েছে খাবারের খোঁজে।

ঘরিয়ালের মত কুমির আর কখনো দেখেনি নিকোলাস। স্থানীয় লোকেরা তাকে এই বলে নিশ্চয়তা দিয়েছে যে এটা ক্ষতি করে না কারো, শুধু মাত্র মাছ খায়। আবার একই সাথে এ বলেও সতর্ক করে দিয়েছে যে, মাংশাসী কুমিরদেরকেও প্রায় অগভীর পানিতে দেখা যায়। তাই যত গরমই পড়ুক না কেন বা যতই ইচ্ছে করুক না কেন, নদীতে সাঁতার কাটা যাবে না।

পেছনে শব্দ শুনে তাড়াতাড়ি ঘুরে তাকাল নিকোলাস। না কোন কুমির নয়–মাছ খেকো অথবা অন্য কোন জাতের তার দুই কি তিনজন সঙ্গী কর্মকর্তা হেঁটে যাচ্ছে দারার তাঁবুর দিকে, যে মিটিংয়ের ডাক সেও পেয়েছে। সময়ের কথা স্মরণ করে উঠে দাঁড়াল নিকোলাস, কাপড় ঝেড়ে হাঁটা ধরল তাঁবুর দিকে। যেতে যেতে অবাক হয়ে ভাবতে লাগল কী কারণে হতে পারে এই সভা। পাঁচ দিন ধরে গরম আর ধুলাময় ধীর গতির যাত্রা শেষে আজ সকালে চম্বলে পৌঁছেছে সেনাবাহিনী। অনুমান করল হয়ত নদী পার হয়ে আওরঙ্গজেব আর মুরাদের মুখোমুখি হবার ব্যাপারে কথা হবে সভাতে–চম্বল কি অগভীর আর আস্তে আস্তে বইছে যেন নিরাপদে পার হওয়া যায় নাকি নৌকা সেতু তৈরিতে আরো সময় লেগে যাবে।

মিটিংয়ে প্রবেশের পাঁচ মিনিট পরে শামিয়ানার নিচে নিচু ডিভানে বসে থাকা দারার চারপাশে জড়ো হওয়া ষাটজন সেনানায়কের দ্বিতীয় সারিতে দাঁড়িয়ে নিকোলাস বুঝতে পারলো সে ভুল ভেবেছে। ডিভানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভ্রমণকারীর মত চেহারার একজনের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে উঠল দারা, রবি কুমার মাত্রই ফিরে এসেছে চম্বলের তীর ধরে দক্ষিণে দুই দিনের পরিদর্শন শেষে। রবি, আমার কর্মকর্তাদের সুবিধার্তে সেখানে কী দেখেছ আরেকবার খুলে বল।

মাথা নাড়ল রবি কুমার। সন্ধ্যায় আওরঙ্গজেব আর মুরাদের সেনাবাহিনীকে বিশ মাইলের মত নদীর নিচের দিকে দেখেছি আমি। অগ্রবর্তী সৈন্যদের বেশির ভাগ ইতিমধ্যে পার হয়ে এসেছে; কিন্তু বাকি সৈন্যরা রান্নার জন্য আগুন জ্বালাতে ব্যস্ত। দেখে মনে হয়েছে অপর পাড়েই রাত কাটাবার পরিকল্পনা আছে।

গুপ্তচর রবি কুমারের প্রথম শব্দ শুনতে পেয়েই বিস্ময়ের ধ্বনি বেরিয়ে এসেছে উপস্থিত অফিসারদের মুখ থেকে। এবার কথা বলে উঠল লম্বা, সুন্দর করে ছাঁটা দাড়িঅলা একজন। গোয়ালিওরের কাছে ছোট্ট একটা অঞ্চলের শাসক রাজা রাম সিং রাঠোরকে চিনতে পারলো নিকোলাস। সাহস আর সামরিক পাণ্ডিত্য উভয় বিষয়েই সুখ্যাতি আছে রাজার। জানতে চাইলো, আমরা যতটা ভেবেছি তার চেয়েও দ্রুত এগিয়ে এসেছে তারা, মাননীয় শাহজাদা। সমস্ত যন্ত্রপাতি আছে তাদের সঙ্গে?

রবি কুমারকে উত্তর দেবার জন্য ইশারা করল দারা।

আমি খুব বেশিক্ষণ থাকি নি বা কাছাকাছি যেতে পারি নি। কিন্তু মনে হয় প্রথম দিককার রসদবাহী মালগাড়ি আছে তাদের সাথে। সবসময় অন্য গাড়িগুলোও আসছে একটা একটা করে। আর দিগন্তে ধুলার মেঘ দেখে মনে হয়েছে আরো সৈন্য আর রসদ আসার এখনো বাকি আছে। আমার অনুমান আগামীকাল পুরো দিন লেগে যাবে নদী পার হয়ে তীরের কাছে পুনরায় একত্রিত হতে।

ধন্যবাদ, রবি কুমার। বলে উঠল দারা। ফিরে তাকাল সেনাপ্রধানদের দিকে। আমরা তাবু ভেঙে দিয়ে নদী পারাপার শেষ করার আগে তাদেরকে ধরতে পারি না?

খানিকক্ষণ বিরতির পর আবারো কথা বলে উঠল রাজা রাম সিং রাঠোর, না, মাননীয় শাহজাদা। যদি সাথে ভারী অস্ত্র আর যুদ্ধহাতি নিতে চাই, আমার মনে হয় আমরা পারব না। এখন পর্যন্ত একদিনে মাত্র আট মাইলের মত চলতে পেরেছি আমরা। প্রাণীগুলোকে সর্বোচ্চ গতি দিয়ে এগোতে চাইলেও মনে হয় না দুই দিনের কমে সেনাবাহিনী সর্বশক্তি দিয়েও নদীর কাছে পৌঁছাতে পারবে। ততক্ষণে আওরঙ্গজেব আর মুরাদ আগ্রার দিকে যাত্রা শুরু করে দেবে আর তাদেরকে ধরা আমাদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।

আমিও এই ভয়টাই পাচ্ছি। বলে উঠল দারা। রবি আর অন্যান্য গুপ্তচরেরা ফিরে আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত সময়ে যতটা পেরেছি মানচিত্র দেখে কথা বলেছি চম্বলের তীরের থেকে আসা নিম্নপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে। শত্রুরা যদিও নদী পার হয়ে এসেছে, আমরা তাদের চেয়ে উত্তরে আর আগ্রার বেশি কাছাকাছি আছি। তাই তারা যতই দ্রুত এগোক না কেন আমার মনে হয় যদি ভোরের আগে তাঁবু ভেঙে দিয়ে এখন থেকে পশ্চিমে এগোতে শুরু করি, তাহলে তাদেরকে বাধা দেয়ার জন্য পথিমধ্যে সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছে যাবো আমরা। আপনাদের কী মনে হয়?

কোন ধরনের ভূমি পার হতে হবে আমাদেরকে? জিজ্ঞেস করে উঠল আরেকটা কণ্ঠ। বক্তাকে দেখতে পেল না নিকোলাস।

আমাকে বলা হয়েছে অল্প কিছু বাধা বিপত্তি ব্যতীত বেশির ভাগটাই সমভূমি। যদিও কয়েকটা জায়গায় গভীর বালি আছে, যার কারণে ভারী যন্ত্রপাতির গতি খানিকটা শ্লথ হয়ে যেতে পারে। তার পরেও আমাদের হাতে যথেষ্ট সময় থাকবে এগিয়ে যাবার জন্য।

আবারো কথা বলে উঠল প্রশ্নকর্তা। ধন্যবাদ, শাহজাদা। এক্ষেত্রে আর কোন সমস্যাই রইল না। সৈন্য আর জম্ভগুলো এত নিঃশোষিত হয়ে যায়নি যে সারা রাতের বিশ্রামের পরেও তরতাজা হয়ে উঠবে না। শব্দগুলো খানিকটা কুণ্ডলী পাকানো হলেও অর্থ বোঝা গেল পরিষ্কারভাবে। সমস্বরে চিৎকার করে একমত হল সকলে। পাগড়ি পরিহিত মাথা নাড়ল অন্য কর্মকর্তারা।

সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে তাহলে। বলে উঠল দারা। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের ভার আমি আপনাদের উপর ছেড়ে দিচ্ছি, আমার বিশ্বস্ত সেনাপ্রধানেরা। লক্ষ্য রাখবেন সৈন্যরা যেন খানিকটা বেশি খাবার পায়। খুশি হবে সকলে। তাদেরকে জানাবেন, আপনাদের মতই তাদেরকেও পুরস্কৃত করব আমি, যখন বিজয় হবে আমাদের। এর সাথে উঠে গেল দারা। আস্তে আস্তে হেঁটে চলে গেল তাঁবুর ভেতরে।

ঘুরে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার সূর্যালোকে নিজের তাঁবুর দিকে ফিরতে গিয়ে আপন মনে নিকোলাস না ভেবে পারল না যে, সেনাবাহিনীর জন্য খাবার আর পুরস্কারের ব্যাপারে যতটা উদার দারা, নিজের কর্মকর্তাদের উপর যতটা তার আত্মবিশ্বাস, তাহলে শাহজাদা নিজে কেন আরেকটা প্রধান ভূমিকা পালন করলো না। অন্তত নিজের সেনাপ্রধানদেরকে আরো একটু ভালোভাবে জানার সুযোগ পেত দারা। বিশেষ করে যেসব প্রজা রাজ্যের শাসক, যারা সেনাবাহিনী আগ্রা ছাড়ার ঠিক আগমুহূর্তে সম্রাটের নির্দেশে শহরে এসে পৌঁছেছে; কিন্তু শাহজাদার সাথে মিলিত হবার সুযোগ পায়নি। একজন নেতার প্রতি পূর্ণ বিশ্বস্ততা আদায়ের জন্য বিশেষ করে একজন সম্ভাব্য সম্রাট যে কিনা গৃহযুদ্ধ লড়ছে, অধঃস্তনের প্রয়োজন তাঁকে চেনা, জানা একই সাথে নিজের ভব্যিষত সম্পর্কেও আশাবাদী হয়ে উঠতে পারবে তাহলে নিম্নপদস্থরা। উত্তরের দুই অভিযানের নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নিকোলাস জানে যে আওরঙ্গজেব অথবা মুরাদ কেউই এমন সহজ আচরণ করেনি। কিন্তু দারার সহজাত চারিত্রিক মাধুর্যও তাদের ছিল না আর অভিযানগুলোও ভয়ংকর পরাজয়ের মাধ্যমে শেষ হয়েছে। ঈশ্বর চাইলে তাদেরকে আবারো একই ভাগ্য বরণ করতে হবে।

*

আস্তে করে ঘোড়র উপর থেকে বালুময় ভূমিতে পড়ে গেল ফরাসী লোকটা। দেখামাত্র নিজের ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে লোকটার কাছে চলে এলো নিকোলাস। নিশ্চিত যে অসহ্য গরমের কবলে পড়ল আরো এক ভুক্তভোগী। দুমড়ে মুচড়ে পড়ে থাকা সৈন্যের কাছে গিয়ে চিৎকার করে তাকে শুইয়ে দিল নিকোলাস। তারপর অন্য সহকর্মীদের সহায়তায় তাড়াতাড়ি খুলে ফেলল ভারী লোহার দেহবর্ম, তুলে নিল বুকের উপর থেকে এত তেতে আছে যে মনে হল হাতে ছ্যাকা লাগবে গরমে।

ফরাসী সৈন্যটার হাত দুটো কাঁপছে। চেহারা হয়ে গেছে লালচে বেগুনি আর ধূসর চোখ জোড়া মাথার মত ঘুরছে। নিকোলাস কোমরবন্ধনীর কাছ থেকে নিজের পানির বোতল নিয়ে চেষ্টা করল মানুষটার মুখে কয়েক ফোঁটা ঢালতে। অল্প একটুই কেবল গড়িয়ে পড়ল সৈন্যটার ফাটা ঠোঁট আর দাঁতের সারির ফাঁক গলে। বেশিরভাগটাই গড়িয়ে পড়ল চিবুক আর গলা বেয়ে।

কাশতে শুরু করতেই আরো একটু পানি ঢেলে দিল নিকোলাস। ঢুলি নিয়ে আসোপালকি–তাঁবুতে ফিরিয়ে নিতে হবে, কিন্তু তার আগে কপালে ভেজা কাপড় জড়িয়ে দাও। আদেশ দিল নিকোলাস। হয়ত বেঁচে যাবে লোকটা, তাই আশা করছে সে। শক্ত-সমর্থ যোদ্ধা এই ফরাসী লোকটা হিন্দুস্তানে এসেছে বোর্দুয়া থেকে ফরাসী এক বণিক দলের সাথে। এরপর দলটাকে ছেড়ে চলেও আসে, কারণটা পরিষ্কার করে না বললেও অন্যদের ধারণা হাঁসের ডিমের মত বড়সড় একটা হারানো রুবির হাত রয়েছে এতে। যদি বেঁচে যায় তাহলে অন্য অনেকের চেয়ে ভাগ্যবানই বলতে হবে তাকে।

পানির বোতল থেকে নিজেও খানিকটা চুমুক দিয়ে ভাবতে লাগল নিকোলাস। নিজের আরো তিনজন সৈন্য হারিয়েছে সে–দুজন ঘটনাস্থলেই মারা গেছে প্রতিবেশী পদাতিক সেনাদল থেকেও অসংখ্য প্রাণহীন দেহ সরিয়ে নিতে দেখেছে, তালপাতা আর মরা ডাল দিয়ে বানানো সাধারণ স্ট্রেচারের পাশ দিয়ে ঝুলছিল হাতগুলো।

ঠিক যেমনটা পরিকল্পনা করেছিল, তিনদিন ব্যাপী অত্যন্ত অবসাদময় যাত্রা শেষে দারার সেনাবাহিনী অবশেষে সফল হয়েছে আগ্রা মুখে আওরাঙ্গজেব আর মুরাদের বাহিনীর পথ রোধ করতে। নিচু পাহাড়ের উপর তাঁবু খাটানো হয়েছে–বলতে হয় ছোট্ট পাহাড়–এটি গ্রেট ট্রাঙ্ক রোডকে দুভাগে ভাগ করে দিয়েছে আগ্রা যাবার পথে শহর থেকে দশ মাইল দূরে জায়গাটা, যেটির নাম নিকোলাস শুনেছে সামুগড়।

যখন তারা উপলব্ধি করতে পারল যে উত্তর দিকে যাবার তাদের প্রাথমিক পরিকল্পনা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে, আওরঙ্গজেব আর মুরাদ ধুলার মেঘ ছড়িয়ে পশ্চিমে ঘুরে গেল দারার বিশাল সেনাবাহিনীর মুখোমুখি না হওয়ার জন্য। উত্তরে একটা দিকে সৈন্য নিয়ে ধাওয়া করল দারা, পিছু নিল ভাইদের ছায়ার আর মাঝে মাঝেই ঝটিকা দল পাঠিয়ে বন্দিদের ধরে নিয়ে এলো। পুরো প্রক্রিয়াতে তেমন কিছু শিখতে পারল না দারা আর তার কর্মকর্তারা। শুধু বুঝতে পারল যে শত্রুপক্ষ অনড়, ভীতও হবে না অথবা আত্মসমর্পণও করবে না।

এইভাবে সামুগড়ের সমভূমির চারপাশে আগু-পিছু করার পর ৭ জুন সকালবেলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হল দুই পক্ষের সেনাবাহিনী। উঁচু জায়গায় থাকার কল্যাণে প্রাথমিকভাবে খানিকটা সুবিধা পেল দারা। বাতাসবিহীন সকালবেলা ক্রমশ বেড়ে যেতে লাগল সূর্যের তেজ, তিন ভাইয়ের একজনও সাহস করল না এগিয়ে এসে কোন কিছুতে জড়িয়ে পড়তে। এমনকি নিকোলাসও অবাক হয়ে ভাবতে লাগল আলোচনার কোন সুযোগ হবে কিনা, যদিও সেটা পুরোপুরি আকাশ-কুসুম। গত পাঁচ ঘণ্টা ধরে যা ঘটে চলেছে তা হলো উভয় পক্ষের সৈন্যরাই হয় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে নয়তো ঘোড়ার পিঠে বসে আছে উত্তপ্ত রোদের মাঝে। সূর্য এখন ঠিক মাথার উপরে। ইতিমধ্যে মারা যাওয়া জম্ভগুলোর উপর উড়তে শুরু করে দিয়েছে শকুনের দল, চেয়ে আছে চোখ আর পেট থেকে ফুলে বেরিয়ে থাকা নীলচে অন্ত্রের দিকে, অনিচ্ছাকৃতভাবেও নিজের সম্ভাব্য গতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে সৈন্যদেরকে যখন যুদ্ধ আসলেই শুরু হবে।

চারপাশে তাকিয়ে নিকোলাসের চোখে পড়ল, কোন দিকের সেনাবাহিনীর মাঝেই কোন রকম নড়াচড়া নেই। শুধু কম বয়সী পানি বাহকেরা নিজেদের থলি আর বোতল নিয়ে সৈন্যদের মাঝে ঘুরছে তৃষ্ণার্তকে দেয়ার জন্য, যদিও যথেষ্ট নয়। পানি যথেষ্ট নেই–গরমে তাই থামানো যাচ্ছে না সৈন্যদের নিস্তেজ হয়ে পড়া।

পরবর্তী দুই ঘণ্টায় নিজের আরো দুজন লোককে হারাল নিকোলাস, একজন অল্প চুলঅলা স্কটিশ, নাম অ্যালেক্স গ্রাহাম মুরাদের সাথে উত্তরে প্রথম অভিযানের সময় থেকেই আছে নিকোলাসের সাথে, অনুনয় করে গেছে, যেন কোমরের থলেতে থাকা পাঁচটা রুপার মুদ্রা স্কটিশ হাইল্যান্ডে তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দেয় নিকোলাস। যদিও তাকে আশ্বাস দিয়েছে নিকোলাস; কিন্তু জানে যে কত অসম্ভব কাজ হবে এটা, এমনকি যদি সে বেঁচেও যায়, ব্রিটেনে তো হিন্দুস্তানের মতই গৃহযুদ্ধ চলছে।

গভীর চিন্তায় এই প্রশ্নটা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ করে বিপরীত দিকে সেনাবাহিনীর মাঝে চাঞ্চল্য দেখা গেল। অবশেষে আক্রমণ করতে আসছে তারা? চিৎকার করে নিজের লোকদেরকে প্রস্তুত হতে জানিয়ে দিল, খুশি হল যে যাক, অপেক্ষার পালা শেষ হবে–ভয়ংকর গরমে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে খারাপ আর কিছু নেই। কিন্তু কয়েক মিনিট পরেই বুঝতে পারল যে আজ আর কোন যুদ্ধ হবে না। নিজেদের তাঁবুর দিকে ফিরে চলেছে শত্রুপক্ষ, বর্তমান অবস্থান থেকে এক মাইল পেছনে শীঘি একজন কর্চির মাধ্যমে দারাও নির্দেশ পাঠালো পাহাড়ের উপর নিজেদের তাঁবুতে ফিরে যেতে। অন্তত আরো একটা দিন বেঁচে রইল তাহলে, ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে, নিজের লোকদের ইশারা করে যেতে যেতে ভাবল নিকোলাস।

.

২.৯

পরের দিন সকালবেলা ভোর হবারও আগে ঘুম থেকে জেগে উঠল নিকোলাস। সত্যি বলতে, রাতে তেমন ঘুমই হয়নি। গতকাল সন্ধ্যায় যুদ্ধ উপদেষ্টাদের সভায় সবাই একমত হয়েছে যে আরো একটা দিন প্রতিপক্ষের আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করার কোন মানে হয় না। তাদের উচিত সংখ্যার দিক থেকে বেশি হবার সুযোগ নেয়া প্রতিপক্ষের পঞ্চাশ হাজারের তুলনায় দারার সৈন্য সংখ্যা আশি হাজার। সকাল হবার সাথে সাথেই অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে আক্রমণ শুরু করতে হবে।

নিকোলাস আর তার ভাড়াটে সৈন্যের ক্ষেত্রে দারার আদেশ হল তার যুদ্ধ পরিচালনার তাঁবুর ঠিক পেছনেই সংরক্ষিত সৈন্য হিসেবে প্রস্তুত থাকা। যে কোন দুর্বল জায়গায় আঘাত হানার জন্য সদা তৎপর থাকা। এই কাজে নিজেদের সামরিক অভিজ্ঞতা আর তুমুল যুদ্ধের মাঝেও স্নায়ুর দৃঢ়তা বজায় রাখার ক্ষমতা কাজে লাগাতে হবে।

নিজের লোকদের মাঝে দ্রুত ঘুরে বেড়াতে লাগল নিকোলাস। এখনো ঘুমিয়ে আছে বা স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়েছে এরকম সৈন্যদেরকে ঝাকুনী দিয়ে জাগিয়ে দিল, উৎসাহের বাণী শোনালো প্রত্যেককে, তলোয়ারগুলোর ধার পরীক্ষা করে দেখল; কিন্তু সবাইকে বারবার সেটা স্মরণ করিয়ে দিল তা হচ্ছে নিজেদের সাথে যত বেশি সম্ভব পানি নিয়ে যাওয়া। এরপর সকালের নাস্তা নিয়ে উঠে গেল ছোট পাহাড়টার চূড়ায়, যেখানে তাঁবু গেড়েছে তার দল। জরিপ করে দেখতে লাগল বিপরীত পাশের শত্রুদের অবস্থা। শুকনো সমভূমির দুই পাশে একে অপরের দিকে মুখ করে খাটানোনা তাঁবুগুলোর মাঝে দূরত্ব দেড় মাইল। মাটির ভাঁড় থেকে লাচ্ছিতে চুমুক দিতে দিতে পানি আর দইয়ের মিশ্রণ। খেয়ে ফেলল বেশ কয়েকটা গোল পরোটা। তাওয়া থেকে গরম গরম নামানোর পর খেতে বেশ সুস্বাদু লাগে, ঠিক এখন যেমন লাগছে, সাথে মুরগির রানের হাড়;

দারার উজ্জ্বল লাল বর্ণের তাবু আর তার সেনাবাহিনীর সামনের সারি থেকে চোখ ঘুরে গেল শত্রুর তাঁবুর দিকে। দেখতে পেল আওরঙ্গজেব আর মুরাদের সৈন্যরাও ঘুম থেকে উঠে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এমনকি এতদূর থেকেও উৎসাহী দৃষ্টি মেলে দেখতে পেল, হাতির পিঠে হাওদা পেতে দেয়া হচ্ছে আর তাঁবুগুলোর সামনে অশ্বারোহী সৈন্যরা ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। হঠাৎ করেই–ভোর হয়েছে এখনো হয়ত এক ঘন্টাও হয়নি–শুনতে পেল সাদা ধোঁয়া ছড়িয়ে গর্জন করে উঠল বিপরীত পাশের ভারী তামার কামান, শত্রুর অবস্থানের মাঝামাঝি বড়সড় একটা তাঁবুর কাছ থেকে, যেটা নিকোলাস ধারণা করল আওরঙ্গজেব আর মুরাদের প্রধান সামরিক দপ্তর। তার মানে দারার মত তার ভ্রাতৃদ্বয়ও আর অপেক্ষা সহ্য করতে পারছে না।

সাথে সাথে উত্তর দিয়ে গর্জে উঠল দারার কামানগুলো। অনেকগুলো গোলাই কাছাকাছি পড়ল যেমন শত্রুরগুলো, শুকনো ভূমিতে পড়ে কোন ক্ষয়-ক্ষতি ঘটালো না কেবল কাঁকড় আর ধুলার বর্ষণ ছাড়া। যাই হোক, ক্রমশ বেড়ে যাওয়া ধুলার মাঝে দিয়ে নিকোলাস দেখতে পেল গর্জে উঠল আরেকটা শক্ত কামান, প্রচণ্ড বিস্ফোরণে মুহূর্তখানেকের জন্য শ্রবণশক্তি হারিয়ে গেল যেন। শব্দটা এসেছে তার পেছন দিক থেকে, বাম পাশে মনে পড়ে গেল সেখানে ছিল দারার বারুদ রসদবাহী গাড়িতে বহর, যুদ্ধ সভার উপদেষ্টারা ভেবেছিল শত্রুর কামানের গোলা ততদূর যাবে না। হয় আওরঙ্গজেবের কোন এক ভাগ্যবান কামান রেকর্ড ভঙ্গ করে গোলা ছুঁড়েছে, নয়ত দারার নিজের কোন এক বেখেয়াল গোলন্দাজ অস্ত্রের গাড়িতে গোলা ছুঁড়েছে। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা এই যে, ক্ষয়ক্ষতি যেন বেশি না হয়।

এই বিপর্যয়ের উত্তরেই যেন নিকোলাস দেখতে পেল দারার অশ্বারোহী বাহিনীর একদল সৈন্য প্রস্তুত হতে শুরু করেছে। বন্দুকধারী আর পদাতিক সৈন্যদের পাশ কাটিয়ে অতঃপর এগিয়ে যেতে লাগল দুই সেনাবাহিনীর মাঝখানের খোলা ময়দানে। সেই একই রাজপুত আর পাঞ্জাবী সৈন্যরা যারা আগ্রা ত্যাগ করার দিনে পশ্চাদভাগের বাহিনী গড়ে তুলেছে একত্রে। যুদ্ধে এসে এখন তারা প্রথম হবে। একটু পরেই টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে সোজা আওরঙ্গজেব আর মুরাদের কামানের দিকে ছুটে গেল দলটা। বাতাসে তাদের সবুজ ব্যানার উড়ছে পতপত করে, হাতে উদ্যত বর্শা আর কোনমতে নিজেদেরকে ঠেকিয়ে রেখেছে একজোট হয়ে দৌড়ানোর জন্য, নতুবা শত্রুর গুলির মধ্যে পরিণত হবে সহজ নিশানায়।

এমনকি এতদূর থেকেও রাজপুতদের রণহুঙ্কার শুনতে পেল নিকোলাস রাম! রাম! রাম! ছুটছে সকলে। শত্রুপক্ষ থেকে আধা মাইল দূরত্বে থাকতেই আবারো তাদের উপর গর্জে উঠল আওরঙ্গজেব আর মুরাদের কামান। সাথে সাথে পড়ে গেল একেবারে প্রথম ব্যানার বহনকারীর তামাটে ঘোড়াটা। মাথার উপর বনবন করে করে ঘুরতে ঘুরতে মাটিতে আছড়ে পড়ল আরোহীর প্রাণহীন নিথর দেহ। কিন্তু দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া দেহটার সাথে জড়িয়ে বাতাসে উড়তে লাগল ব্যানার। পড়ে গেল আরো ঘোড়া আর তাদের আরোহীরা। একই সাথে অন্যরা আবার পথ করে নিয়ে ছুটে চলল দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে। হয় আহত হল নতুবা আরোহীরা জখম হয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল। তারপরেও বাকি অশ্বারোহীরা একটুও না থেমে, শিরস্ত্রাণ পরা মাথা ঘোড়ার গলার সাথে লেপ্টে রেখে ছুটে চলল শত্রুর দিকে।

বন্দুকধারী সৈন্যরা আওরঙ্গজেব আর মুরাদের কামানের ফাঁকে ফাঁকে নিজেদের তেপায়াটুল আর লম্বা নলওয়ালা বন্দুক নিয়ে নিশানা ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কামানের গোলার সাথে যুক্ত হল বন্দুকের গুলি। তাদের প্রথম যৌথ আক্রমণেই খালি হয়ে গেল আরো কিছু ঘোড়র পিঠ, আরো অসংখ্য ঘোড়া হোঁচট খেয়ে পড়ল ধুলার মাঝে, গড়াতে গড়াতে ভেঙে গেল পা আর খুর। কিন্তু ততক্ষণে কামানের কাছে পৌঁছে গেল দারার অশ্বারোহী সৈন্যরা। বর্শা দিয়ে, তলোয়ার দিয়ে আঘাত করে কচুকাটা করতে লাগল গোলন্দাজ আর বন্দুকধারীদের। একটু পরেই অস্ত্র ফেলে পালিয়ে গেল বেশির ভাগ শত্রু বন্দুকধারীরা। আনন্দিত হয়ে উঠে নিকোলাস দেখতে পেল জিতে যাচ্ছে সম্রাটের সৈন্যরা। দারাও নিশ্চয় একই কথা ভাবছে। নিজের রক্তলাল তাবুর পাশে বিশাল যুদ্ধহাতির পিঠে হাওদার মাঝে দাঁড়িয়ে বিজয়ীর ভঙ্গিতে শাহজাদাকে মুষ্টিবদ্ধ হাত মাথার উপরে তুলতে দেখল নিকোলাস।

যাই হোক, এর এক কি দুই মিনিট পর আবার শত্রু কামানের পাশে যুদ্ধরত সৈন্যদের দিকে তাকাতেই দেখা গেল, আওরঙ্গজেব আর মুরাদের সেনাবাহিনীর বাম পাশ থেকে অশ্বারোহী সৈন্যদের বিশাল একটি অংশ টগবগিয়ে এগিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল দারার বাহিনীর উপর। কয়েক মিনিটের জন্য মনে হল সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাথর খণ্ডের উপর, এমনভাবে কামানের কাছে-দূরে চলতে লাগল যুদ্ধ। ধীরে ধীরে ফলাফল চলে গেল শত্রুবাহিনীর অনুকূলে আরো বেশি সংখ্যক সৈন্য এসে যোগ দিতে লাগল তাদের সাথে।

প্রায় বিশ মিনিট পরে দেখা গেল ঘুরে দাঁড়িয়ে ফিরে আসতে শুরু করেছে দারার ব্যানার। আর কোন সন্দেহই রইল না। দারার অশ্বারোহীরা, সংখ্যায় একেবারে কমে গিয়ে দ্রুতগতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে ফিরে আসতে চাইছে নিজেদের সারির দিকে। মুরাদ আর আওরঙ্গজেবের সৈন্যরা তাদের পিছু ধাওয়া না করলেও পড়ে যেতে লাগল আরোহী, বন্দুকের গুলি এসে ধাক্কা দিচ্ছে সবাইকে। কমলা পোশাকের এক রাজপুত সৈন্য পড়ে গিয়েও পা আটকে ফেলল পা-দানির সাথে। ঘোড়াটা তাকে বহুদূর টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এলো যতক্ষণ পর্যন্ত না ভেঙে গেল চামড়ার পা-দানি। নিথর হয়ে পড়ে যাবার আগে আরো বার কয়েক পাড়িয়ে গেল দেহটা। অন্যদিকে আবার আরেক জন সাহসী অশ্বারোহী শত্রুর গুলির মুখে আঁকাবাঁকা হয়ে নিজের ধূসর রঙের ঘোড়া ছুটিয়ে গিয়ে ছো করে তুলে নিয়ে এলো নিজের আহত সহযোদ্ধাকে। অন্যান্য ঘোড়াবিহীন সৈন্যরাও দৌড়ে, মাটি ঘষটে ঘষটে যেভাবে পারছে ফিরে আসতে চাইছে নিজেদের সারির দিকে, দেহবর্ম আর শিরস্ত্রাণ খুলে ফেলে দিয়েছে অনেকে, যেন চলতে গিয়ে ভারের কারণে গতি না থেমে যায়।

একটা আরোহীবিহীন আতঙ্কিত ঘোড়া–অনেকগুলোই আছে এমন মাটিতে ছুঁড়ে ফেলল এক সৈন্যকে, বেচারা পাশ দিয়ে যাবার সময় চেষ্টা করেছিল ঘোড়ার লাগাম ধরতে। বহুকষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে ডান পা টেনে টেনে ফিরে আসতে লাগল সৈন্যটা। শীঘ্রি বাকিরা যারা ঘোড়ার পিঠে ছিল, এসে পড়ল নিজেদের সঙ্গীদের ভেতরে, নিরাপত্তার মাঝে। একেবারে শেষে যারা এসেছে, তাদের মাঝে আছে একজন ব্যানার বাহক সৈন্য, তার আহত ঘোড়াটা প্রায় শখানেক গজ দৌড়ে এসে এখন ঢলে পড়ল আস্তে করে। স্থূলকায় পাঞ্জাবী সৈন্যটা ভারী ব্যানার হাতে নিয়েই দৌড়ে পার হয়ে এল বাকি পথটুকু। অন্য দিকে সহিসেরা দৌড়ে এসে ঘোড়া থেকে নামতে সাহায্য করল আহত সৈন্যদেরকে, মারাত্মকভাবে আহতদেরকে হাতে বানানো খাঁটিয়াতে যত্ন করে শুইয়ে দিয়ে নিয়ে যেতে লাগল হাকিমদের তাঁবুর দিকে।

এর আগে একদিন হাকিমদের একটা তাঁবুতে উঁকি মেরেছিল নিকোলাস, দেখতে পেয়েছিল লাল-অ্যাপ্রন পরিহিত চিকিৎসকেরা শান্ত মুখে সাজিয়ে রেখেছে নিজেদের ছুরি, কাঁচি আর অন্যান্য যন্ত্রপাতি, অন্যদিকে সাহায্যকারীরা আগুন জ্বেলে প্রস্তুত করে রেখেছে লোহার পাত। তাড়াতাড়ি অন্যপাশে চোখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল নিকোলাস, আহত হলে কী করা হবে তাকে নিয়ে সেটা আর ভাবতে চায়নি মন। এর পরিবর্তে গভীরভাবে ভেবে দেখতে চাইল, অশ্বারোহীদের উপর নিজেদের বিজয়ের সুযোগ নিয়ে কেন পিছু ধাওয়া করে এলো না আওরঙ্গজেব আর মুরাদ। এমন সময় এক কর্চি এসে জানালো নিজের তাঁবুতে যুদ্ধসভা ডেকেছে দারা।

কাছাকাছি থাকায় প্রথমেই পৌঁছে গেল নিকোলাস। শামিয়ানার নিচে ঢুকতেই দেখতে পেল স্বর্ণের দেহবর্ম পরে ভাইদের তাঁবুর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দারা, সেখানে শ্রমিকেরা অসহ্য গরম উপেক্ষা করেও যুদ্ধ করছে প্রথম আক্রমণে ধরাশায়ী হয়ে যাওয়া কামানগুলোকে ঠিকঠাক করতে। অন্যরা ষাড় দিয়ে টেনে আনা গাড়ি থেকে কামানের গোলা আর বারুদ নামিয়ে সাজিয়ে রাখছে গোলন্দাজদের কাছে। আরো একদল সৈন্যের হোট একটা দল ছুটে বেড়াচ্ছে আহত আর নিহত সৈন্যদের মাঝে। কয়েকজনকে বয়ে নিয়ে যেতে দেখতে পেল নিকোলাস, নিঃসন্দেহে নিজেদের সৈন্য। অন্য আরেকটা দল আহত ঘোড়াগুলোর গায়ে বিঁধিয়ে দিচ্ছে বর্শা। মনে হল জম্ভগুলোকে দুদর্শা থেকে মুক্তি দেবার শুরুভার কাঁধ থেকে নামিয়ে ছুটে গেল অন্য দেহগুলোর দিকে। ঝুঁকে পড়ে খুঁজে দেখল মূল্যবান কিছু পাওয়া যায় কিনা; এরপর বুকের মাঝে ঢুকিয়ে দিল বর্শার ফলা। একজন আহত সৈন্য কী ঘটছে দেখতে পেয়ে হঠাৎ করেই নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে দৌড়ে আসতে চাইল দারার সারির দিকে টলোমলো পায়ে। কিন্তু দেখতে পেল একজন হত্যাকারী। এক লাফে আহত সৈন্যের কাছে এসে সহজেই ধরে ফেলল, মাটিতে ফেলে আগ্রহের সাথে গেঁথে ফেলল নিজের বর্শা দিয়ে।

দারা, পরিষ্কারভাবে সেও দেখতে পেয়েছে পুরো ঘটনাটা। চিৎকার করে উঠল, কেমন করে তারা এত নিষ্ঠুর হচ্ছে?

মাননীয় শাহজাদা! এটা যুদ্ধ আর যুদ্ধ নির্মম হয়, বিশেষ করে গৃহযুদ্ধ। কিন্তু এর চেয়েও খারাপভাবে শক্তহস্তে সৈন্যদেরকে মারা যেতে দেখেছি আমি উত্তরে অভিযানে। উত্তর দিল নিকোলাস।

যুদ্ধের ব্যাপারে আপনার অভিজ্ঞতা আমার চেয়ে বেশি। সত্যি কথা বলতে আমার অভিজ্ঞতা একেবারে অল্প আর আমি অল্পই চাই। যত শীঘ্নি এই যুদ্ধ শেষ হয় ততই মঙ্গল।

এই ফাঁকে দারার বাকি সেনাপতিরা এসে জড়ো হল তার চারপাশে আর তাদেরকে স্বাভাবিক পদ্ধতি বা দরবারের ব্যঞ্জনাপূর্ণ স্বাগত না জানিয়েই শাহজাদা বলে উঠল, আমি দেখেছি কীভাবে আমাদের সাহসী লোকগুলোকে হত্যা করছে শত্রুরা, যারা অশ্বারোহীরা পিছু হটাতে আহত হয়ে পড়ে আছে সেখানে। আমি তাদেরকে আবারো এ সুযোগ দিতে চাই না। আমরা আর কখনো পিছু হটে আসবো না। আমাদের পরবর্তী আক্রমণ হবে হাতে থাকা সমস্ত সৈন্য নিয়ে একযোগে।

এটা বেশ সাহসী পদক্ষেপ, মাননীয় শাহজাদা; কিন্তু এটা কি ঠিক হবে? জানতে চাইল রাজা জয় সিং, একটা আক্রমণে সমস্ত বাহিনীকে ব্যবহার করা? অনিশ্চিত ভবিষ্যত বা কোন প্রতিরোধের জন্য কয়েক রেজিমেন্ট সৈন্যকে রিজার্ভ রাখা উচিত নয় কি?

সৈন্যদেরকে ধরে রাখলেই বরঞ্চ প্রতিরোধ বেশি আসবে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবার সুনিপুণভাবে আঘাত করে আজকের মাঝেই শেষ করতে হবে এ যুদ্ধ। আমাদের সৈন্যদের প্রস্তুত হতে কত সময় লাগবে?

এক ঘণ্টা, সম্ভবত, শাহজাদা। উত্তরে জানোলো রাজা। আর এবার, আমি পরামর্শ দেব আক্রমণের সফলতার জন্য শত্রুর সারিতে কামানের গোলা ছুঁড়ে সৈন্যদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়া সহ তাদের বাকি কামানগুলোকে অকেজো করে দেওয়ার জন্য।

প্রয়োজনীয় আদেশ দিয়ে দিন।

ভুলে যাবেন না, মাননীয় শাহজাদা, যখন আমরা নিজেদের প্রস্তুতি নিতে থাকবো, পেছন থেকে বলে উঠল একটা কণ্ঠ, আমাদের খেয়াল রাখতে হবে শত্রু সৈন্যরা জড়ো হয়ে আমাদের উপর চড়াও হবার কোন পাঁয়তারা করছে কিনা।

আরেকটা বুদ্ধিদীপ্ত মন্তব্য, ভেবে দেখল নিকোলাস। যুদ্ধের ক্ষেত্রে, ঠিক যেমন প্রতিযোগিতায় হয়, শুধুমাত্র নিজের পরিকল্পনা নিখুঁত করাটাই যথেষ্ট নয়, শত্রুর দিকেও তোমাকে লক্ষ্য রাখতে হবে আর উত্তর দেবার ব্যাপারেও সদা প্রস্তুত থাকতে হবে।

হ্যাঁ, অবশ্যই। আমরা আরো বেশ কিছু গুপ্তচর পাঠিয়ে দেব, যেন শত্রুপক্ষের যে কোন তৎপরতা তৎক্ষণাৎ জানা যায়। যাই হোক, আমার মনে হচ্ছে সংখ্যায় কম হবার কারণে আমার ভাইয়েরা আত্মরক্ষামূলক কৌশল অবলম্বন করেছে। আমি নই। আর সময় নষ্ট করা উচিত হবে না। আক্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিন, জয় সিং। আমার বিশ্বস্ত আর বিজ্ঞ উপদেষ্টামণ্ডলী, আমি আপনাদের সবার কাছে ঋণী। আর আমার পিতা, আমাদের সত্যিকার সম্রাটও একই কথাই বলবেন। সবাইকে সৌভাগ্যের শুভেচ্ছা আর আল্লাহ বিজয় দিয়ে আমাদেরকে আশীর্বাদ করুন। সভা শেষ করা হল।

আবারো বিস্মিত হয়ে নিকোলাস ভাবতে লাগল, শেষ মন্তব্যের মাধ্যমে দারার আন্তরিক বদান্যতা ভাব ফুটে উঠলেও কর্মকর্তারদের সাথে আরেকটু সময় না কাটানোর সিদ্ধান্তটা হয়ত ভালো হয়নি। কেননা, সেনাপতিদেরকে বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা, তার সহজ রণকৌশল সম্পর্কে আরো পরামর্শ নেয়া, নিদেনপক্ষে সকলকে উৎসাহী করে তোলার জন্য বিশেষভাবে বুঝিয়ে বলা প্রয়োজন ছিল যে এই বিজয় কেন সাম্রাজ্যের আর তাদের জন্য এতটা গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে দারাকে চেনার সুবাদে পরিবার, ব্যক্তিগত জীবন আর ঘনিষ্ঠ মিত্রদের সাথে দারার উষ্ণ আর মনোমুগ্ধকর আচরণ সম্পর্কে যথেষ্ঠ ওয়াকিবহাল নিকোলাস। এখন মনে হল সমর্থকদের সাথে এহেন আলোচনার ক্ষেত্রেও আরেকটু খোলামেলা, সহজ হতে পারত দারা। এখন পর্যন্ত দারার হাতে সৈন্যের যে সর্বাধিক সংখ্যা আছে, তাতে তার রণকৌশল সফল হওয়া উচিত আর আল্লাহ চাইলে, সন্ধ্যার মাঝে সে আর তার সৈন্যরা বিজয়ীর বেশে ঘোড়া ছুটাতে পারবে আগ্রার দিকে।

দেড় ঘণ্টা পরে, নিজের বাদামি ঘোড়ায় চড়ে দারার তাঁবুর পেছনে আবারো ছোট্ট পাহাড়টার মাথায় উঠে গেল নিকোলাস। পুরোদস্তুর রণ সাজে সজ্জিত হয়ে এবার ঘামতে লাগল বুক আর পিঠের বর্মের নিচে, ডান পাশে লম্বা তলোয়ার আর নীল কোমরবন্ধনীর সাথে আটকে আছে কাকৃতি-হাতলঅলা দুইটা পিস্তুল। ঢাকের বাজনা বেজে উঠতেই তাকিয়ে দেখতে পেল সামনের সারিতে প্রায় দেড় মাইল লম্বা লাইন ধরে একত্রে এগোতে শুরু করেছে দারার সৈন্যরা। ডান পাশে রাজা রাম সিং রাঠোরের রাজপুত সৈন্যরা আর বাম পাশে খলিল উল্লাহ খানের উজবেক সৈন্যগণ। একটু আগে দুই সেনাবাহিনীর মাঝে কামানের গোলা বিনিময়ের ফলে সৃষ্ঠ সাদা ধোয়ার মাঝ দিয়ে চলতে শুরু করল দলটা। একটু আগেই আশি মিনিট ধরে উভয় পক্ষ যথেষ্ট গোলাবারুদ খরচ করে ফেললেও কোন পক্ষই মনে হল না তেমন ক্ষত্রিস্থ হয়েছে। শুধুমাত্র স্পষ্ঠভাবে চোখে পড়ল একে অন্যের কাছ থেকে কয়েক ফুট দূরত্বে বিশাল ধূসর পাথরখণ্ডের মত পড়ে আছে দারা আর মুরাদের তিনটা হাতি। কামানগুলোকে আরো একটু এগিয়ে আনতে গিয়ে কুপোকাত হয়ে গেছে বিশাল জন্তু তিনটা।

একে একে আরো সৈন্য এসে এগোতে শুরু করল দারার বাহিনী থেকে। একটু পরে দারার নিজের বিশাল হাতিও এগোতে শুরু করতেই রত্নখচিত সুউচ্চ হাওদা থেকে সৈন্যদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ল শাহজাদা। তার হাতির আকার আর হাউদার নির্মাণগুণে সকল সৈন্যরা শাহজাদাকে দেখছে আর সে নিজেও অন্যদেরকে দেখতে পাচ্ছে যা ভিন্ন কোন উপায়ে সম্ভব হত না।

নিজ সৈন্যদেরকে নিয়ে যেখানে ছিল সেখানেই থাকার জন্য শাহজাদার আদেশ পালন করতে গিয়ে ছোট্ট পাহাড়টার উপরে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থেকে সেনাবাহিনীর এগিয়ে যাওয়া সহ যুদ্ধের গতি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে নিকোলাস। মাঝে মাঝে কুণ্ডুলি পাকানো ধোঁয়া এসে দৃষ্টিপথে বাধা দিচ্ছে, বুঝতে কষ্ট হচ্ছে যে কতটা এগোল যুদ্ধ।

ডান দিকে রাজা রাম সিং রাঠোরের কমলা আর কেশর রঙা পোশাক পরিহিত অশ্বারোহী সৈন্যরা বাকিদেরকে ছেড়ে এগিয়ে গেল দ্রুত শত্রুপক্ষের একেবারে মাঝখানে গিয়ে আঘাত হানল।

আরো একবার ধোঁয়া এসে বাধা দেয়ার পর তাকাতেই নিকোলাস অনুমান করতে পারল এর কারণ। সৈন্যসারির পাশাপাশি হাওদাসহ দুটি বিশাল হাতি চলতে শুরু করেছে, চারপাশে ব্যানার বাহকদের। নিজের সৈন্যদেরকে দৃঢ় হতে উৎসাহ দিচ্ছে আওরঙ্গজেব আর মুরাদ। রাজা রাম সিং রাঠোর নির্ঘাৎ বিজয়ীর খেতাব নিতে চাইছে নিজের মাথায়, যেন রাজপুত সৈন্যদের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে ওঠে সবাই। আবার বিদ্রোহী দুই ভাইকে হত্যা অথবা বন্দি করার মাধ্যমে প্রতিশোধ নেয়া হবে ধর্মতের যুদ্ধে চাচাত ভাই যশয়ন্ত সিংয়ের পরাজয়ের। কিন্তু পরিষ্কারভাবে দেখা গেল এই বেপরোয়া মনোভাবের কারণে মূল্য দিতে হচ্ছে তার সৈন্যদের, শত্রু সারির মাঝখান থেকে গর্জে ওঠা কামান বা বন্দুকের গুলিতে পড়ে যেতে লাগল একের পর এক সৈন্য।

শ্বেত-শুভ্র তেজী ঘোড়র উপর থাকা রাজা রাম সিং রাঠোর আর তার দুই পাশের ব্যানার বাহকেরা অলৌকিকভাবে রয়ে গেল একেবারে অক্ষত আর তাই সবার আগে পৌঁছে গেল বিদ্রোহী দুই ভাইয়ের চারপাশ ঘিরে থাকা সৈন্যদের মাঝে, ঠিক পেছনেই আছে প্রায় নিঃশেষ হয়ে আসা রাজপুত বাহিনী।

এতদূর থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে সবকিছু দেখা বেশ কষ্টকর হলেও নিকোলাসের চোখে পড়ল, একজন রাজপুত সৈন্য গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল একটা হাতির উপর। বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত আর রণসাজে সজ্জিত আরো কয়েকটি অশ্বের মত এ ঘোড়ার মুখে মুখোশ লাগান, হাতির মাহুতের উপর আঘাত করল রাজপুত সৈন্য। কিন্তু হাওদার একজন দেহরক্ষী উঠে দাঁড়িয়ে দুবার চালাল তার হাতের বর্শা। চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে গেল ঘোড়া আর তার রাজপুত আরোহী।

রাজা রাম সিং রাঠোরের একজন ব্যানার বাহক পড়ে গেল। কিন্তু অন্যান্যরা রয়ে গেল নেতার কাছাকাছি। অন্য আরেক রাজকীয় হাতির দিকে ছুটে গেল রাজা। প্রতিপক্ষ হয় তার কাছ থেকে সরে গেল নয়ত কেঁপে উঠল আঘাতের চোটে। হঠাৎ করেই বাকি ব্যানার বাহক সামনের দিকে পড়ে গেল ঘোড়া থেকে আর মাটির উপর নিজের কমলা রঙা ব্যানার নিয়েই জড়িয়ে গেল। এরপর গর্জে উঠল রাজার নিজের সাদা ঘোড়া। সেও কি হাতির মাহুতকে আঘাত করার কথা ভাবছিল? কিন্তু পেছন দিকে সরে এলো ঘোড়া, আর যেই মুহূর্তে পেছনে হেলে গেল জটা, সাথে সাথে নেমে উদ্যত তলোয়ার বাগিয়ে ধরে আর নিচু হয়ে হাতির দিকে ছুটে গেল রাজা। লেবুরঙা পাগড়ি আর কমলা সাদা জোব্বা পরিহিত রাজাকে চিনতে একটুও কষ্ট হল না। সাহসের সাথে চেষ্টা করল হাতির পেটের নিচে ঢুকে যেতে; সম্ভবত হাওদার জায়গায় পেটের নাড়ী কেটে দেয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু উদ্দেশ্য যাই থাকুক না কেন সফল হতে পারল না রাজা; পড়ে গিয়ে আহত হল আর উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই চ্যাপ্টা হয়ে গেল হাতির পায়ের নিচে পড়ে।

রাজার অকুতোভয় সৈন্যরা তারপরেও যুদ্ধ করতে লাগল। দ্রুত বাড়তে থাকা ধোয়ার মাঝে দিয়েও নিকোলাসের চোখে পড়ল রাজপুতদের সাথে আরো যোগ দিতে শুরু করেছে দারার মধ্যভাগের অশ্বারোহী সৈন্যরা–অযোধ্যা, কাশ্মির আর অন্যান্য জায়গা থেকে আগত বহু যুদ্ধের অভিজ্ঞ যোদ্ধারা। আওরঙ্গজেব আর মুরাদের হাতিদ্বয় ইতিমধ্যে ঘুরে গিয়ে অশ্বারোহী রক্ষীবাহিনী সহ নিজেদের সৈন্যগণের মাঝে ঢুকে গেল নিরাপত্তা বলয়ের ভেতরে। তলোয়ার দিয়ে কচুকাটা করতে করতে তাদের পিছু নিল দারার অশ্বারোহী বাহিনী। দারার বাহিনী অল্প একটু এগিয়ে গেলেও যুদ্ধ যে কঠিন আর সমানে সমান হচ্ছে তা পরিষ্কারভাবেই বোঝা গেল। দারার সুউচ্চ হাওদা ধীরে ধীরে একেবারে যুদ্ধের মাঝখানে এগিয়ে যাচ্ছে দেখতে পেল নিকোলাস। এমনকি দারা মাত্র আধা ঘণ্টারও কম সময় আগে নিজের সত্যিকারের যাত্রা শুরু করলেও নিকোলাসের কাছে মনে হল যুদ্ধের গতি বড় বেশি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। বুঝতে পারল এখনই নিজের সৈন্যদের নিয়ে তারও উচিত যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া, কিন্তু কোথায়? আবারো ময়দানের প্রতিটি অংশ ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখল নিকোলাস, খেয়াল করল বাম পাশে খলিল উল্লাহ খান আর তার সৈন্যরা যেন পিছিয়ে পড়ছে। ফলে বেশ খানিকটা জায়গা ফাঁকা হয়ে পড়েছে।

নিকোলাস বুঝতে পারল না এর কারণ। উত্তরের যুদ্ধে কখনো পিছু হটতে দেখেনি খলিল উল্লাহ খানকে। আবারো তাকিয়ে শূন্যস্থানটাকে ক্রমশ বেড়ে যেতে দেখল নিকোলাস। আতঙ্কিত হয়ে দেখতে পেল যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে, দারার পক্ষ ত্যাগ করে চলে আসছে খলিল উল্লাহ খান আর তার উজবেক সৈন্যরা। এটা নিশ্চয়ই পূর্ব-পরিকল্পিত। সমরকন্দের বিরুদ্ধে অভিযানে আওরঙ্গজেবের বেশ কাছাকাছি ছিল খলিল উল্লাহ খান। আর দারার বাহিনীতে তাকে দেখতে পেয়ে একটু বিস্মিতই হয়েছিল নিকোলাস। কিন্তু কথা বলার সময় সহজ সুরে সংক্ষিপ্তভাবে খলিল উল্লাহ খান শুধু এটুকুই জানিয়েছিল যে একমাত্র মুকুটধারী সম্রাটের প্রতিই বিশ্বস্ত সে, অতীতে আওরঙ্গজেবের দক্ষতার প্রতি শ্রদ্ধা যাই থাকুক না কেন তাতে কিছু যায় আসে না। এখন বোঝা যাচ্ছে পরিষ্কারভাবে ভণিতা করেছে খলিল উল্লাহ খান; অপেক্ষা করেছে কখন মোক্ষম আঘাত হানতে পারবে।

যেন নিকোলাসের সন্দেহকে সত্যি প্রমাণ করতেই দারার সামনে সৃষ্টি হওয়া শূন্যস্থানের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে এলো একদল বিদ্রোহী বাহিনীর অশ্বারোহী সৈন্য। খলিল উল্লাহ খানের প্রস্থানগামী সৈন্যদের পাশ দিয়ে এগিয়ে এলো, যেন নিশ্চিতভাবেই জানে যে কোন ধরণের সাবধানতার প্রয়োজন নেই। খলিল উল্লাহ খানের কীর্তি দারাও দেখতে পেয়েছে নির্ঘাৎ, কেননা ঘুরে গিয়ে তার হাতিও হন্তদন্ত হয়ে ফিরে আসতে চাইল, পেছনে দেহরক্ষীর দল। ইশারা করে নিজের সৈন্যদের ঘোড়ায় উঠে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দিল নিকোলাস। জানে এখন তাদের দায়িত্ব কী–দারার দিকে এগিয়ে গিয়ে ফাটলটাকে মেরামত করতে সাহায্য করা।

দুই কি তিন মিনিটের মাথায় যুদ্ধের ময়দানের ঘন ধোঁয়ার ভেতরে ঢুকে গিয়ে জ্বালা করে উঠল নিকোলাসের চোখ আর নাক। একটু ফাঁক পেতেই দেখতে পেল তিন থেকে চারশ গজ দূরে থেমে আছে দারার হাতি। হাত আর পা দিয়ে সমানে তাগাদা দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে কাছাকাছি যেতেই দেখতে পেল এর কারণ। হাওদা থেকে নিচে নেমে আসছে দারা। আরেকটু কাছে এগিয়ে যেতেই যুদ্ধের চিৎকার-চেঁচামেচি আর অস্ত্রের গর্জন ছাপিয়ে দারার দেহরক্ষীদের প্রধানের কাছে জানতে চাইল, কী ব্যাপার? শাহজাদা কেন নেমে যাচ্ছে? হাতি আহত হয়েছে?

না, হাতি ঠিকই আছে। শাহজাদা ঘোড়ায় চেপে আরো দ্রুত যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে যেতে চাইছে খলিল উল্লাহ খান থেকে পাওয়া অপ্রত্যাশিত ষড়যন্ত্রের জবাব দিতে।

এক কি দুই মিনিটের মাথায় কপালে সাদা রঙের উজ্জ্বল দাগঅলা একটা কালো তেজী ঘোড়ার উপর উঠে বসল দারা। এগিয়ে গেল বাম দিকের যুদ্ধের মাঝে, পেছনে গেল দেহরক্ষীদের দল, নিকোলাস আর তার সৈন্যরা। মাহুতকে রেখে গেল রাজকীয় হাতিকে শূন্য হাওদা সহ দারার শিবিরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।

একটু পরেই দারা, নিকোলাস আর তাদের অনুসরণকারীরা এগিয়ে গেল রণ-সাজে সজ্জিত বিদ্রোহী সৈন্যদের দিকে। তীরের মত করে আশেপাশের সৈন্যদেরকে কচুকাটা করতে করতে এগিয়ে আসছে দারাদের দিকে। নিজের লম্বা দ্বি-ফলা তলোয়ার বের করে পাশ দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে যাবার সময় এক বিদ্রোহী সৈন্যের দিকে আঘাত করল নিকোলাস। নিজের তলোয়ার দিয়ে নিকোলাসের আঘাত ঠেকিয়ে দিল সৈন্যটা আর একই সাথে নিজের ভোজালি দিয়ে আঘাত করতে চাইল নিকোলাসকে। ঘোড়ার পিঠে বসে ঘুরে গেল নিকোলাস, নাকের সামনে দিয়ে বাতাস কেটে বের হয়ে গেল বিদ্রোহী সেনার খঙ্গ। প্রায় সাথে সাথে নিজের চঞ্চল দ্রুত ঘোড়াকেও ঘুরিয়ে নিল বিদ্রোহী লোকটা টাটু ঘোড়ার চেয়ে একটু বড়। আরো একবার আঘাত করতে এগিয়ে এলো নিকোলাসের দিকে প্রথম বার আঘাতের ধাক্কায় এখনো বেসামাল হয়ে আছে দারার ইংরেজ সেনাপ্রধান।

নিকোলাসের এই অবস্থা দেখে আর প্রতিপক্ষকে খতম করে দেয়ার আশায় বিদ্রোহী সৈন্যটা সাবধানে হাত মাথার পিছনে নিয়ে চাইল সর্বশক্তি দিয়ে খড় তুলে নিকোলাসের উপর চূড়ান্ত আঘাত হানতে। এই ফাঁকে নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে নিজ তলোয়ারের অসম্ভব লম্বা দৈর্ঘ্যকে কাজে লাগিয়ে নিকোলাস অস্ত্রটা ছুঁড়ে দিল বিদ্রোহী সেনার অরক্ষিত বগলে। চিৎকার করে উঠে একপাশে সরে গিয়ে হাতের খঙ্গ মাটিতে ফেলে দিল লোকটা। দ্বিতীয় আরেক বিদ্রোহী সেনা বর্শা বাগিয়ে ধরে এগিয়ে এলো নিকোলাসের দিকে। কিন্তু নিকোলাসের শক্ত ইস্পাতের দেহবর্মে লেগে পিছলে গেল বর্শার ফলা আর তড়িঘড়ি করে লোকটার হাতের উপরের দিকে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করল নিকোলাস। চিৎকার করে কেঁপে উঠল দ্বিতীয় বিদ্রোহী সেনা, ছুঁড়ে ফেলে দিল অকম বর্শাটা, ক্ষত থেকে হাত বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল রক্ত।

চারপাশে তাকিয়ে নিকোলাসের চোখে পড়ল দারার দেহরক্ষীরা আর তার নিজের ভাড়াটে সৈন্যটা শক্তভাবে প্রতিহত করছে আওরঙ্গজেব আর মুরাদের সৈন্যদের, যাদের বেশির ভাগই পড়ে রইল আহত বা মৃত হয়ে। কিন্তু নিকোলাসের সৈন্যদের মাঝেও ক্ষয়ক্ষতি কম হয়নি। বহু বছর ধরে তার সাথে কাজ করা একজন বুন্ডিয়ান নিজের রক্তের পুকুরে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে আছে মাটিতে, আদারঙা চুলে জড়িয়ে আছে ছিন্নভিন্ন মগজ আর খুলি ফেটে বেরিয়ে আসছে তরল।

আবারো যুদ্ধে এগিয়ে যেতে উদ্যত হল নিকোলাস। সহযোদ্ধার হয়ে প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর এখন সে, বিদ্রোহী সেনাদের কারণে যাকে প্রাণ দিতে হল। যুদ্ধের সমস্ত শোরগোল ছাপিয়েও শুনতে পেল পেছনে এগিয়ে আসছে অসংখ্য খুরের শব্দ। ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেল, সবুজ ব্যানার উড়িয়ে বন্য উন্মত্তে ছুটতে ছুটতে আসছে একদল অশ্বারোহী। নিঃসন্দেহে দারার সৈন্য।– একেবারে সামনের জনের উদ্দেশে চিৎকার করে উঠল নিকোলাস, কেন পিছু হটছো তোমরা? প্রথম কয়েকজন নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে এতটাই বিচলিত যে উত্তর দেবারও সময় হলনা তাদের; কিন্তু কিশোর অবস্থার থেকে একটু বড় হবে বয়সে এমন একজন অশ্বারোহী এক মুহূর্তের জন্য টেনে ধরল ঘোড়ার লাগাম। শাহজাদা দারা পালিয়ে যাচ্ছে, তাই আমরাও। নিজের জীবনের মায়া থাকলে তুমিও তাই কর।

কিন্তু শাহজাদা তো পালিয়ে যায়নি। পাল্টা চিৎকার করে উত্তর দিল নিকোলাস।

ভুল করছ তুমি। রাজকীয় হাতিকে পেছন দিকে চলে যেতে দেখেছি। কিন্তু হাওদা যে খালি তা দেখোনি?

না। কিন্তু তার মানে তো শাহজাদা নিশ্চয় মৃত।এই কথা বলে নিকোলাসকে আর একটিও শব্দ করার সুযোগ না দিয়ে ঘোড়র পেটে পা দিয়ে গুতো মেরে নিজের সঙ্গীদের পিছু নিল তরুণ। চারপাশে তাকিয়ে দারাকে খুঁজল নিকোলাস। কিন্তু ভিড়ের চাপে নিজের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না সে। এমনকি সামনের দিকে চোখ মেলেও কিছু না পেয়ে পেছনে ছুটন্ত ঘোড়ার শব্দ শুনতে পেল। আরো একবার ঘুরে তাকিয়ে দেখতে পেল তার নিজের পাশ থেকে সৈন্যরা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালাচ্ছে সামনে দিকে।

শাহজাদা দারা নিরাপদ আছে! আমরা যুদ্ধ জিততে চলেছি! চিৎকার করে আশেপাশের যোদ্ধাদেরকে জানাতে চাইল নিকোলাস, কিন্তু জানে যে যদি সেও এ অবস্থায় পড়ত, মন দিয়ে শোনার পর্যায়ে থাকত না।

ঠিকই ভেবেছে সে। পুরো দলটা পার হয়ে গেল তার দিকে একবারও না তাকিয়ে, শুধুমাত্র একজন সবুজ পোশাক পরিহিত অশ্বারোহী ঘোড়া সহ হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল মৃত বিদ্রোহী সৈন্যের গায়ের উপর। দুমড়ে মুচড়ে ঘোড়ার পিঠের উপর থেকে বস্তার মত মাটিতে পড়ে গেল সৈন্যটা। আবারো উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই পেছন থেকে এগিয়ে আসা সৈন্যরা পায়ের চাপে পিষ্ট করে ফেলল তাকে, এতটাই ভীত তারা যে সঙ্গীকে পাশ কাটানোর চিন্তাও মাথায় রইল না!

দারার উচিত এখনি এসে সবার সামনে দেখা দেয়া, নয়ত অনেক দেরি হয়ে যাবে। শোধরানোর অযোগ্যভাবে পরাজয় ঘটবে যুদ্ধে আর আগ্রার রাস্তা খুলে যাবে আওরঙ্গজেব আর মুরাদের জন্য।

ভালোভাবে যুদ্ধের মতিগতির দিকে তাকাতেই প্রায় দুইশ গজ দূরে হট্টগোলের মাঝে সাদা উজ্জ্বল চিহ্নঅলা কালো ঘোড়া দেখতে পেল নিকোলাস। প্রায় খোঁড়াতে লাগল ঘোড়াটা আর নিতম্বের কাছ থেকে গড়িয়ে পড়ছে উষ্ণ তরল রক্ত, কিন্তু পিঠের উপরে থাকা আরোহীর কোন দেখা নেই। দারা নিশ্চয়ই আঘাত পেয়ে পড়ে আছে কোথাও। তাড়াতাড়ি করে ঘোড়া ছুটিয়ে সেই তেজী ঘোড়াটাকে প্রথম যেখানে দেখতে পেয়েছে সেদিকে ছুটে গেল নিকোলাস। কাছাকাছি যেতেই দেখতে পেল সবুজ আর সোনালি পোশাক পরিহিত দারার তিনজন দেহরক্ষী ঘোড়ায় চেপেই আপ্রাণ চেষ্টা করছে সোনার দেহবর্ম পরে মাটিতে শুয়ে থাকা স্থবির দেহটাকে নিরাপত্তা দিয়ে ঢেকে রাখতে।

প্রায় সাথে সাথে কালো পোশাকের এক বিদ্রোহী অশ্বারোহী এসে ঘোড়ার উপর থেকে আঘাত করে ফেলে দিল দারার একজন দেহরক্ষীকে। এর মুহূর্তখানেকের মাঝে দ্বিতীয় দেহরক্ষী মুখ থুবড়ে পড়ল ঘোড়ার গলা জড়িয়ে ধরে, নির্ঘাৎ আহত হয়েছে। তৃতীয় জন একা লড়ে চলেছে চারজন বিদ্রোহী আক্রমণকারীর সাথে।

যত জোরে সম্ভব নিজের সব সৈন্যকে তার পিছু নিতে বলে খণ্ডযুদ্ধের দিকে এগোতে শুরু করল নিকোলাস। ভয় হচ্ছে পাছে দেরি না হয়ে যায়। হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেল নিজের পিস্তল দুটোর কথা। ভারী দস্তানা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কোমরের কাছ থেকে টেনে নিল একটি পিস্তল। ঘর্মাক্ত হাত বারবার পিছলে যাচ্ছে গোলাকার হাতলের উপরে, কিন্তু দ্রুতই নিজেকে সামলে বজ্রমুষ্টিতে আঁকড়ে ধরল পিস্তলের হাতল, নিশানা ঠিক করে গুলি ছুঁড়ে বসল, উপরের দিকে হাত তুলে ঘোড়া থেকে পড়ে গেল এক বিদ্রোহী। কিন্তু নিকোলাস জানে যে এত দূর থেকে এ শট লাগাটাকে সৌভাগ্য ছাড়া আর কিছু বলা যাবে না। অন্য আরেকটা পিস্তলে হাত দিতেই তলোয়ারের আঘাতে আরেকজন বিদ্রোহীকে ঘোড়া থেকে ফেলে দিল দারার দেহরক্ষী।

দ্বিতীয় পিস্তলের নিশানা ঠিক করে বাকি দুজন বিদ্রোহী যোদ্ধার একজনের দিকে গুলি ছুড়ল নিকোলাস। কিন্তু গুলি করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল নিজের ঘোড়ার, ফলে আরোহীর গায়ে না লেগে গুলি গিয়ে লাগল ঘোড়ার নিতম্বে। ভীত হয়ে আহত ঘোড়াটা ডাক ছেড়ে দাপাদাপি শুরু করতেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল বিদ্রোহী লোকটা। এলোমেলো দৌড়াতে শুরু করল ঘোড়া, কিন্তু খানিক দূর যেতেই আরোহীকে পেটের নিচে নিয়ে ভেঙেচুড়ে মাটিতে পড়ে গেল ঘোড়া, বাকি আছে আর একজন কিন্তু নিকোলাস তার কাছে এগিয়ে যেতেই বেঁচে থাকা তৃতীয় দেহরক্ষীকে তলোয়ারের আঘাতে মাটিতে ফেলে দিল বিদ্রোহী সেনা।

ততক্ষণে পৌঁছে গেল নিকোলাস। এবার তার দিকে উন্মত্তের মত আঘাত হানল বিদ্রোহী। কিন্তু নিকোলাসের হাতে এখনো পিস্তল, অস্ত্রটাকে ঘুরিয়ে ধরে কাকৃতি হাতল দিয়ে জোরে আঘাত করল বিদ্রোহী সৈন্যের মুখমণ্ডলের উপর। ফেনিল রক্ত আর দাঁতের ভাঙ্গা কণা এসে মিশে গেল লোকটার কালো দাড়িতে। ধাতস্থ হবার আগেই পিস্তল এক পাশে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তলোয়ার হাতে নিল নিকোলাস, আঘাত করল শত্রুর ঘাড়ের উপর, শিরস্ত্রাণের ঠিক নিচে, ডোডো হয়ে গেল হাড় আর শ্বাসনালী। পড়ে গেল বিদ্রোহী সেনা।

এরই মাঝে নিকোলাসের নিজের সৈন্যরা আর দারার দেহরীক্ষরা এসে পৌঁছতেই ঘোড়র উপর থেকে লাফিয়ে নেমে দারার কাছে এগিয়ে গেল নিকোলাস। শাহজাদাকে উপুড় করে শুইয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি শরীর পরখ করে দেখল। কপালের কাছে ভেজা কাটা দাগ ছাড়া আর কোন বড় ক্ষতের দেখা মিলল না। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানালো যেন শুধুমাত্র সংজ্ঞা হারানোই হয় এটা। কোমরের কাছ থেকে পানির বোতল বের করে দারার চোখেমুখে কয়েক ফোঁটা ফেলতেই মনে হল নড়ে উঠল শাহজাদা। এরপর সাবধানে দারার মুখে মাঝেও খানিকটা পানি ঢালতেই কাশতে শুরু করল শাহজাদা।

বেঁচে আছে। চারপাশে ঘিরে থাকা সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল নিকোলাস। যার কাছে আছে সবচেয়ে সেরা ঘোড়াটা, নেমে এসো, শাহজাদাকে চড়তে দাও। অন্য কারো ঘোড়ায় উঠে যাও। বাকি তিনজন দেহরক্ষীকে পরীক্ষা করে দেখো জীবনের আশা আছে কিনা। যদি থাকে তাদেরকেও ঘোড়র উপর তুলে নাও, যদি নিজেদের আসনের সাথে বেঁধে নিতে হয়, তাই নাও।

ছুঁড়ে ফেলে দেয়া পিস্তলটাকে তুলে নিয়ে কোমরের কাছে প্রথমটার সাথে রেখে দিয়ে চারপাশে তাকাল নিকোলাস। ধোঁয়ার আস্তরণ ভেদ করে যেদিকেই তাকাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছে পিছু হটছে দারার সৈন্যরা। দ্রভাবে বলতে গেলে এটাই সমাপ্তি। বেশিরভাগই ছুটছে আপন প্রাণ বাঁচাতে। নিকোলাস ভালো করেই জানে যে এরকম অর্ধ-অচেতন দারাকে নিয়ে তাদেরকে ফিরিয়ে আনার কোন সম্ভাবনাই নেই। শাহজাদার এখন একমাত্র আশা আগ্রাতে পৌঁছে হাকিমদের কাছে যাওয়া যেন বেঁচে থাকতে পারে আরেকটা যুদ্ধের জন্য।

ঘোড়ায় উঠে পড় সকলে। চিৎকার করে নির্দেশ দিল নিকোলাস। যত দ্রুত সম্ভব আগ্রায় পৌঁছাতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *