সেই সময়ে, গঙ্গার ওপারে, খেয়াঘাটের ভেজা মাটি স্বপ্নাতুর হয়ে উঠল নারীকণ্ঠের চাপা হাসিতে। লীলা আর তিলি এসেছিল নদী পার হয়ে সিনেমা দেখতে। একপারের ছবিগুলি দেখা হয়ে গেছে আগেই। এবার আর একপারের সিনেমা দেখে, ছুটে আসতে আসতেও খেয়া নৌকাটি গেছে ছেড়ে। তাই হাঁপ-ধরা গলায় দু বোনের এত হাসি। এত বিব্রত এলোমেলো ভাব।
তিলি আজ আসতে চায়নি। লীলা তাকে চুল ধরে টেনে এনেছে প্রায়। যাবিনে কি লো মুখপুড়ি। আজ তার প্রাণে তীব্র স্রোত। আজ সে বেরুবেই, ঘুরবেই, ছুটবেই, হাসবেই। প্রাণ না চাইলেও, না এসে তিলির উপায় কী। বাদলাপোকার বোবা উল্লাস লেগেছে মনে। মহামরণের আলেয়া জ্বলছে দিকে দিকে দপদপ করে।
হাঁপাতে হাঁপাতে হাসতে হাসতে এল দুই বোন। তিলি বলল, মুখপোড়া মাঝি একটু দেখতেও পেলে না আমাদের!
লীলা বলল, সে চোখ কই ব্যাটার !
হেসে উঠতে গিয়ে থামল দু জনেই। একটা নৌকা নোঙর তুলছে। ঘাটে বাঁধা কিন্তু খেয়াপারানি নৌকা নয়। লোকে বলে এগুলিকে প্রাইভেট নয়তো রিজার্ভ। খেয়াঘাটে পয়সা দিতে হয়, আবার এদেরও দিতে হয় অনেক বেশি। নৌকার যাত্রী দেখা যায় না।
দুই বোন কিছু বলবার আগেই, নৌকাটা একটি পাক খেল। তারপর হঠাৎ স্থির হয়ে গেল। পশ্চিমা মাঝি যেন কার সঙ্গে কথা বলল। নৌকা একেবারে কিনারে নিয়ে এসে বলল দুই বোনকে, আইয়ে মাইজি।
দুই বোন চোখাচোখি করল। তিলি জিজ্ঞেস করল, কত বেশি নেবে?
মাঝি ফিরে তাকাল ছইয়ের ভিতর। ছইয়ের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল এক জন পুরুষ। ধুতি পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোক। ঘাটের ওপরের আলোয় চট করে চেনা যায় না। বেরিয়ে এসে বলল, ওপারে যাওয়া হবে তো? আমি রিজার্ভ করেছি, পয়সা কেন? আমিই তো রয়েছি।
দুজনেই চমকে উঠে দেখল বিনচৌ। সঙ্গে সঙ্গে মুখোমুখি তাকাল তিলি আর লীলা। লীলার চোখে বিস্ময় ও চাপা হাসি। তিলির বিস্ময় ও তীব্র অনুসন্ধিৎসা। চাপা অসহায় ও ভয়। হঠাৎ মনে হল, সবটাই যেন সাজানো, পূর্বপরিকল্পিত। কিন্তু লীলার হঠাৎ বিস্ময়ে, ষড়যন্ত্রের কোনও চিহ্ন নেই। মানুষের মুখ দেখে তো বোঝা যায়।
দু জনকেই নীরব দেখে বিনয় বলে উঠল, ভুল করিনি নিশ্চয়ই। আমাদের বিজয়ের বোন তুমি তো তুমি।
ওমা ! নামও জানে দেখছি। না জানবে কেন। রাজীবের কাছে শুনেছে নিশ্চয়। তা বলে ডাক নামটা-ই! তিলির ইচ্ছে হল, বলে, ঠুমি নয়, তিলকরাণী সাহা। আজকাল নাকি দাসী বলা উঠে গেছে।
জবাব দিল, হ্যাঁ।
বিনয় বলল, তবে এসো, আর দেরি কোরো না।
লীলা বলল, চ’না।
তিলি দেখল দিদির চোখে, ছেড়া নোঙরের টান। সে উঠবেই, ভাসবেই ওই নৌকায়। তবু বড় ভয় করে। তবু উঠতে হল।
বিনয় বলল, তোমরা ছইয়ের ভেতরে বসতে পারো ঠুমি, আমি বাইরেই আছি।
ছইয়ের ভিতরটা অন্ধকার। বিনচৌ অচেনা নয়। তবু তিলি আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল পাটাতনের উপর। তবে শক্ত করে ধরে লীলার আঁচল। যেন লীলা ঝাঁপ দিতে না পারে জলে।
বিনয় বলল, যদি ভেতরে না বসো, তবে ছইয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াও। নয়তো পড়ে যাবে।
তাই দাঁড়াল দু জনে। বিনয় দাঁড়াল একটু সরে। নৌকা ছেড়ে দিল মাঝি। ডাঙায় বাতাস তেমন টের পাওয়া যায় না। কিন্তু গঙ্গার বুকে বাতাস আছে। পাল তুলে দিল মাঝি।
মধ্যঋতুর শেষ টানে ঢলো ঢলো গঙ্গা। ছোট ছোট ঢেউ ছপাৎ ছপাৎ করে লাগছে নৌকার গায়ে।
তিলি দেখল, লীলার বাঁকা ঠোঁটে হাসি। বিনচৌ তাকিয়ে আছে সকালের মতোই। চাউনির অর্থটা অস্পষ্ট নয়। কিন্তু কোনও নগ্ন কদর্যতা নেই। বিনচৌ-এর চোখে আরও কিছু ছিল। তার চোখের বিষণ্ণ ব্যাকুলতা।
হঠাৎ বিনয় বলল, কোথায় গেছলে?
কাকে বলল। দু বোনই ফিরে তাকাল। বিনয় আবার বলল, ঠুমি?
তিলি বলল, সিনেমায়।
বিনয় বলল, ও। তারপরে বলল তার ভদ্রভাষায়, ইনি বুঝি তোমার দিদি?
তিলির রাগ হল। কিন্তু, প্রতিপত্তিশালী ভদ্রলোক বিনচৌ। তাকে তো যা তা বলা যায় না।
বলল, হ্যাঁ।
জানে বিনয়। তবু, এতক্ষণে আইনত ফিরে তাকাবার অধিকার পেল যেন। লীলার কাছ থেকে হাতখানেক দূরে সে। আঁচল এসে উড়ে লাগল প্রায়। বিজয় মিস্তিরির বাড়ির কাউকে আপনি করে। বলা বিনয়ের পক্ষে শক্ত। কিন্তু লীলা মেঘনাদের স্ত্রী। বলল, ও, আপনি তা হলে মেঘনাদবাবুর স্ত্রী।
লীলা ভ্রূ তুলে, একটু যেন বিদ্রূপভরে তাকাল। ভাবখানা, সে কথা বুঝি এখনও জানে না?
আর জ্ঞানী গুণী বিত্তশালী বিনয় চৌধুরীকে বলল, আপনি তো বিনচৌ।
তিলির সর্বাঙ্গ আড়ষ্ট হয়ে গেল ভয়ে। বিনয় এক মুহূর্ত থেমে হেসে উঠল হা হা করে। বলল, শোনা হয়ে গেছে দেখছি এর মধ্যেই। কে বলল?
আরও ভয় পেল তিলি, সর্বনাশী নাম করবে নাকি! কিন্তু লীলা বলল, অনেকেই।
হাসির রেশটা যায়নি তখনও বিনয়ের। বলল, ও।
তিলির মুখের দিকে আড়চোখে দেখে লীলা আবার ঠোঁট উলটে বলল, খুব রাগ করলেন নাকি?
: কেন?
: ওই নামটা বললাম বলে?
: না। বরং ভালই লাগল। বলে ঘাড় কাত করে তাকাল বিনয়। যেন বলতে চাইল, অন্তত তোমার মুখে ভালই লাগে। তারপর বিষাদ অথচ খুশি মাখানো চোখে তাকিয়ে রইল এক মুহূর্ত। আবার বলল, ওই নামে ডাকে আমাকে সবাই। তবে আড়ালে। যদি ভাল লাগে, ডাকুক। আপনার যদি ভাল লাগে ।
তা হলে ওই নামে ডাকব? বলে খিলখিল করে হেসে উঠল লীলা। হাসতে হাসতেই বলল, তা আমার বেশ লাগে ওই নামটি। বড়মানুষি বড়মানুষি গন্ধ থাকে না। বরং
চোখের কোণ দিয়ে বিদ্যুৎ হানল লীলা। মধ্যগঙ্গার তরঙ্গে তরঙ্গে দুলছে তার শরীর। বিনয় বলল, বরং
লীলা বলল, কাছের মানুষ মনে হয়।
: সত্যি! বিনয় হেসে হেলে পড়ল যেন আরও। আর লীলা হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম করে, তিলির গায়ে পড়ল। তিলির আর সহ্য হয়নি। সে লীলার আঁচল ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়েছে। লীলা সামলাতে পারেনি। বলল, কী লো মুখপুড়ি, এখুনি যে পড়ে মরতাম।
তিলির কথা পর্যন্ত ফোটে না মুখে। মনে মনে দাঁত পিষে বলল, বাঁচা যেত তা হলে।
আর কী বিচিত্র বিনয় চৌধুরী। লোকে দেখলে হয়তো বিশ্বাস করতে পারত না, সে এমনি করে কথা বলছে সদ্যপরিচিতা বিজয় মিস্তিরির দিদির সঙ্গে। এমনি হেসে হেসে, প্রেম নয়, এমনি পিরিতে গদগদ হয়ে। যারা তাকে বিনচৌ বলে, তারাও ভাবতে পারে না বোধ হয়। পশ্চিমা মাঝিটা অনেক দিনের মানুষ। অনেকদিন পার করেছে বিনয়কে। সেও কোনওদিন বাবুর এমনতরো জোয়ার ঢালা গঙ্গার কলকলানি দেখেনি। ভাবছে, কে হবে এই জেনানা দুটো !
ইতিমধ্যে বিনয়ের উদাস চোখ চলে গেছে দূর গঙ্গায়। ঈষৎ ফিরে বলল, মেঘনাদবাবু আসেননি যে আপনাদের সঙ্গে।
লীলা বলল ঠোঁট উলটে, নাদবাবুর এ সব স্বাদ ভাল লাগে না। রুটির কারখানা করবে কে তবে?
তিলির ক্রোধ চড়তে লাগল। বিনয়ের চোখে অন্ধকার গঙ্গার তরঙ্গের ঝিকিমিকি। সহৃদয় গলায় বলল, সত্যি, ভদ্রলোকের এতবড় একটা আশা ! জমজমাটি কারবার ফেলে চলে এসেছেন। দেখা যাক, মনে হয় ওঁর কারবার ভালই চলবে।
সত্যি নাকি? তা হতে পারে। বিনচৌ যখন আছে বলে বিদ্রূপভরে হেসে উঠল।
এক মুহূর্ত দিশেহারা মনে হল বিনয়কে। বিদ্রুপের পাল্লাটা ঝুঁকছে কোন দিকে, ঠিক ধরতে পারছে । বলল, আপনারা স্বামী-স্ত্রীতে খুবই মনঃকষ্টে আছেন, বুঝতে পারি।
লীলা মনে মনে বলল, মাইরি! তাম্বুলরঞ্জিত ঠোঁট রেখায়িত করে বলল তীব্র গলায়, সত্যি, বুঝতে পারেন? তবে মনঃকষ্ট দূর হবে নিশ্চয় !
পর মুহূর্তেই সে উঃ বলে আর্তনাদ করে উঠল। তিলি প্রাণপণ জোরে চিমটি কেটেছে ডানায়। রাগে তার কান্না পাচ্ছে এবার।
লীলা বলে উঠল, রাককুসি , খুন করবি নাকি?
চাপা গলায় বলল তিলি, হ্যাঁ।
লীলা হেসে উঠল। আর বিনয়ের মন, তার চাউনি দুলতে লাগল দূরগঙ্গার অন্ধকার ও হঠাৎ আলোর ঝিকিমিকির মতো। ঘাট এসে গেছে সামনে। সে অল্প ঝুঁকে উদাস মেলায়েম গলায় বলল, মনঃকষ্ট দূর করতে পারব কি না জানি নে, চেষ্টা করব।
গলায় তার অদ্ভুত গাম্ভীর্য ও গভীরতা। লীলা ফিরে তাকাল। চোখাচোখি তাকিয়ে রইল এক মুহূর্ত। তারপর বিনয় সরে গেল অনেকখানি। ঘাটের আলো এসে পড়েছে নৌকায়।
নৌকা লাগতেই ছুটে এল দুটি রিকশাওয়ালা। বিনচৌ বাবুকে নিয়ে যাবে তারা। বিনয় বলল, রিকশায় যাবেন তো?
তিলি বলল, লীলাকে, না, পায়ে হেঁটে যাব। বেশি দূরে তো নয়।
আর একবার চোখাচোখি করে বিনয় চলে গেল রিকশায়। অস্ফুটে বলে গেল, চলি, দেখা হবে পরে।
তিলি নীরব। হনহন করে চলেছে লীলাকে পেছনে ফেলে। লীলা পা চালিয়ে কাছে এল। তিলি হিসিয়ে উঠল চাপা ঝাঁঝালো গলায়, বিনচৌ-এর বুকে পড়তে ইচ্ছে করছিল বুঝি?
লীলা বলল, তা যা-ই বল, মানুষটি বেশ।
: তুই তো বেশ বলবিই। বড় ভাল লেগেছে কি না।
: মন্দ লাগার কী আছে। তোদের এখানে মস্ত মানুষ। প্রাণে রসও আছে। কেমন করে তাকাচ্ছিল।
: যেন তোর সঙ্গে পিরিত করছিল।
লীলা হেসে বলল, মাইরি, সেইরকমই মনে হচ্ছিল।
রাস্তাটি মিলের পাঁচিলের পাশ দিয়ে গেছে, আর এক দিকে মাঠ। বড় বড় গাছ ধারে ধারে। কৃষ্ণচূড়া, পিপুল পিটুলি, তেঁতুল ঢেকে দিয়েছে রাস্তাটার মাথা। খেয়াঘাটের যাত্রী ছাড়া মানুষ থাকে না। এখন একেবারে ফাঁকা।
তিলির রাগ সপ্তমে উঠেছে। বলল, লজ্জা করে না?
: কীসের লজ্জা!
: লজ্জা যাক, ভয়ও কি নেই?
: কেন, কীসের ভয়?
: হ্যাঁ, তোর বড় বুকের পাটা। ভয়ও নেই। তা বলে কি একটু মায়া-মমতাও নেই?
বলতে বলতে লীলার হাত ধরে ফুঁপিয়ে উঠল সে, তোর পায়ে পড়ি লো দিদি, পায়ে পড়ি, এমন করিসনে।
বিষয়টিকে ভয়ের কিংবা লজ্জার মনে হয়নি একটুও লীলার কাছে ! তা হলে এ জীবনে অনেক আগেই লজ্জায় মরতে হত ! মায়া মমতা ! তার কী দাম আছে এ সংসারে। সকলেই আছে নিজ নিজ পথে। আপন আপন স্বার্থসিদ্ধির আশায়। কে কবে কার প্রাণের দিকে তাকিয়েছে। একটি চাবিকাঠি পেয়েছে সে একজনের। যৌবনের চাবিকাঠি। ভাবে, আজ দেখি পুরুষের ওইটিই। সবচেয়ে শস্তা। পথে ঘাটে বেড়ায় ফেলে ছড়িয়ে। কী দাম তার। বুকভরা আগুন নিয়ে সে। ছুটেছে দিকে দিকে।
তিলির ব্যাকুল ফোঁপানিতে একটুও মন ভিজল না তার। তীব্র গলায় বলল, ন্যাকামো রাখ তুমি, এ সব আমার ভাল লাগে না। যা পাইনি তার জন্য আমার লজ্জা ভয় মায়া-মমতা নেই।
তারপর তীব্র বিদ্রূপ করে বলল, চব্বিশ বছর পার করতে চললি, বলিস বুকে তোর আঁচড় লাগেনি একটুও। বুক ভরে, মন ভরে কিছু চাসনি, তুই কি বুঝবি? কাঁদছিস তুমি, তোর কে আছে? কী আছে?…
অসহ্য যন্ত্রণায় চাপা গলায় ফিসফিস করে উঠল তিলি, চুপ কর চুপ কর দিদি। ঘাট হয়েছে, আর বলব না, কখনও না ।
আর কোনও কথা না বলে, হেঁটে চলল তারা। গলির মোড়ে এসে তিলি হঠাৎ তরল গলায় বলল,দেখো। আবার বাড়ি গিয়ে যেন মুখ হাঁড়ি করে থেকো না। সবাই ভাববে, আমি আবার কিছু বলেছি।
লীলা হেসেই বলল, বলেছিস তো মুখপুড়ি।
বিজয় আর মেঘনাদ তখনও বাড়ি ফেরেনি। নকুড় জড়িয়ে জড়িয়ে নামগান করছে। সুকুমারী ভাড়াটেদের ঘরে কথা বলছে। শুধু পথ চেয়ে বসে আছে ষোড়শী। ঘরের মাঝখানে কাপড় টাঙানো, পার্টিশন খাড়া করা হয়ে গেছে। অতন্দ্র দুই চোখ অন্ধকার ঘরে। কোলের কাছে ছেলে ঘুমন্ত। মানুষের সাড়া পেয়ে উঠে দাঁড়াল। দেখল দুই ননদ।
জিজ্ঞেস করল তিলিকে, কী দেখলে আজ ঠাকুরঝি?
সিনেমায় যাওয়ার সময় তিলি তাকে ডেকেছিল। সে যায়নি। ভয় করে কেন যেন। বোধ হয় বিজয় সঙ্গে থাকে না বলে। তিলি বলল, তখন বললাম, গেলিনে কেন। আমি বলতে পারব না।
তারপরে বলল, আচ্ছা, বলবখনি।
কিন্তু বলা আর হল না। খাওয়াদাওয়া হল। একে একে শুয়ে পড়ল সবাই।
লীলা ঘুমোল, নকুড়, সুকুমারী, ষোড়শী, সবাই। বিজয় মেঘনাদ ফিরে আসেনি। জেগে বসে আছে তিলি। কেন যেন মেঘনাদের উপর তার প্রচণ্ড রাগ হয়েছে : মেঘনাদ তার বউকে সামলাতে পারে না। কয়েকটি কড়া কথা বলবে তাকে।
শুক্লপক্ষের তৃতীয়ার চাঁদ ডুবে গেল। নিকষ অন্ধকারে গাছপালা জেগে রইল একটি ছমছমে ভূতুড়ে বড় সত্তায়। ঝিঁঝির একটানা ডাক আর শিউলির গন্ধ বাতাসে।
বেশ একটু দেরিতেই ফিরে এল দুজনে। হাত মুখ ধুল। খেতে বসবার আগে হঠাৎ বলল তিলিকে, কী তুমি ঠাকরুন! অমন করে বারবার তাকাচ্ছ যে? কী হয়েছে? ১৩৪
তিলি বলল, তোমার উপর বড় রাগ হয়েছে।
: কেন বলো তো?
তিলি হঠাৎ হেসে উঠে চাপা দিল মুখের ভাব। বলল, কেন আবার। এত দেরি করলে কেন?
: ও, এই কথা !
মেঘনাদ ফিরিস্তি দিতে লাগল তাদের ঘুরে বেড়াবার।
বিজয় খালি বলল, কাল ভোরে আর উঠতে পারব না।
আর তিলি ভাবতে লাগল, বিশ্বসংসারে বুঝি সবই মিথ্যে, সত্য শুধু, তার কিছু নেই, কিছু না।
পরদিন সকালে রাজীব এল। মেঘনাদ তৈরি হয়েছিল যাওয়ার জন্য, বলল, আসেন। আপনার জন্য বসে আছি। বিজয় চলে গেল কারখানায়। সে সঙ্গে গেলে বড় ভাল হত।
রাজীব বলল, কেন, বিজয়কে আপনার কী দরকার জামাইবাবু।
মেঘনাদ একটু সঙ্কুচিত হয়ে বলল, মেশিনপত্রের ব্যাপার তো ঠিক বুঝি না। বিজয় সঙ্গে গেলে একটু দেখেশুনে নিতে পারত। বিনয়বাবুকে আমার অবিশ্বাস নেই তা বলে। তবে আমার একটা কর্তব্য তো আছে।
রাজীবের ঘূর্ণায়মান দৃষ্টি এক মুহূর্ত স্থির হয়ে রইল। ব্যস্ত চিন্তিতভাবে, আঙুল দিয়ে চিবুকে ঠুকল একটু। তারপর হঠাৎ বলল, বাইরে চলুন। রাস্তায় যেতে যেতে আপনাকে কয়েকটি কথা বলব।
মেঘনাদের মুখে একটু অস্বস্তি দেখা দিল। কী আবার বলবে রাজীব। দুঃসংবাদ যদি কিছু থাকে, এখানেই বলুক
রাজীব হেসে বলল, কী হল, ঘাবড়াচ্ছেন নাকি? খারাপ কিছু বলব না। বলতে বলতে রাজীবের চোখ ব্যস্ত চিলের মতো ঘুরতে লাগল আশেপাশে। কাকে যেন খুঁজছে। ভাবছে, আর কেউ কি নেই এ বাড়িতে। নকুড় হয়তো কোথাও গেছে। কিন্তু তিলি কিংবা তার দিদি এরা সব। কোথায়?
তিলি ছিল বারান্দাতেই। ইচ্ছে করেই নিজেকে আড়াল করে রেখেছিল।
লীলা ভাড়াটেদের কারও ঘরে আলাপে ব্যস্ত।
মেঘনাদের সঙ্গে বেরিয়ে এল রাজীব। মেঘনাদ পাটভাঙা বাগেরহাটের ময়ূরকণ্ঠী রঙের পাঞ্জাবি পরেছে আজ। ধুতি পরেছে ধোপদুরস্ত। যদিও দশহাতে কাপড় তার খাটো হয়। পায়ে পরেছে। পাশু। কেবল মাথার চুলগুলি তার বাগ মানেনি। শুধু জলে কিছু হয় না। ভাল করে তেল জল। মাখলে তবে আঁচড়ানো যায়। নইলে, পাকিয়ে পাকিয়ে পাঁশুটে কোঁকড়ানো চুল সাপের ফণার মতো ফোঁস ফোঁস করতে থাকে। তার চেহারা দেখলে এমনিতেই একটু ভয় ভয় করে। আজ পোশাকের পারিপাট্যে খানিকটা সম্ভ্রমের উদয় হচ্ছে।
বিজয় কাল বলে রেখেছিল, বোনাই একটু ফরসা জামাকাপড় পরে যেয়ো। হাজার হোক তোমার একটা ইজ্জত আছে।
জামাকাপড়ে ইজ্জত কতখানি বাড়ে, সে জানে না। কিন্তু তাকে অনেকবার তাকিয়ে তাকিয়ে তিলি দেখেছে। তারপর ঠাট্টা করে বলেছে, যা-ই বল বোনাই, তোমার চেহারাটা-ই এমনি, মনে হয় না যে বিজয় মিস্তিরির বাড়ি থেকে বেরুচ্ছ।
মেঘনাদ বলেছে, সকালবেলাই এ সব কী বলছ। তা হলে আমি আর বেরুতে পারব না কিন্তু।
: না, সত্যি বেশ দেখাচ্ছে তোমাকে
মেঘনাদ গোঁফ পাকিয়ে বলেছে, পছন্দ হয় তা হলে?
তিলি বলেছে, ইস!
কিন্তু বলতে গিয়ে বুকটা খচ করে উঠেছে। মেঘনাদের কথার জন্য নয়। গতকাল লীলার কথাগুলি মনে পড়ে গেছে।
রাস্তায় বেরুতে প্রথম দর্শন হল অমৃতর সঙ্গে। অমৃত চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কোথায় চললেন জামাইদা?
নিশ্চয় পারিপাট্যের জন্যই এ প্রশ্ন। লজ্জিতভাবে জবাব দিল মেঘনাদ, বিনয়বাবুর কারখানায়।
অমৃতর বৈষ্ণব হাসি বাঘের দাঁত খিচানোর মতো দেখাল।
বড় রাস্তা পার হয়ে, পাড়ার ভিতর দিয়ে পুবদিকে চলল তারা। যুদ্ধের সময় পুবদিকের মাঠে ছোটখাটো দু-একটা কারখানা হয়েছে। কিন্তু পাড়াগুলির গ্রাম্যতা কাটেনি একটুও।
পানাভরা পুকুর আর শেওলাপড়া ভাঙা ঘাট। বাসনমাজা কাপড়কাঁচার ভিড় সেখানে, চালকুমড়োর মাচা নয় তো পুঁই লাউডগা ফোঁস ফোঁস করে করে উঠেছে ছাদে কিংবা চালায়। গাছগাছালির ভিড়, শরতের রৌদ্রছায়ায় এক বিচিত্র বর্ণবাহার। কান পাতলে পাখিরও ডাক শোনা যায়। এখনও বাগদিপাড়া, দৃলেপাড়া, বামুনপাড়ার নাম ঘোচেনি, রূপও ঘোচেনি।
রাজীব বলল, আপনাকে বলেছিলাম, দেখুন সে যা-ই হোক, বিজয় আমার অনেক আপন। আপনাকে সেই জন্য আমি জামাইবাবু বলেছি। আমি যখন সঙ্গে আছি, তখন আপনি আমার উপর। ভরসা করতে পারেন।
মেঘনাদ খুশি হয়ে ফিরে তাকাল রাজীবের দিকে। রাজীব আবার বলল, বিনয়বাবু তোক খুব। ভাল। দেখুন, মানুষ একটু বড়লোক হলে, তার বিরুদ্ধে লোকে অনেক কথা বলে। বলবেই, নইলে। দুনিয়াটা সুদ্ধ একদিনেই সবাই ভগবান হয়ে যেত। কিন্তু ধরুন, বিনয়বাবু যদি আপনাকে ঠকাতেই। চান, আমরা কি সব মরে গেছি?
মেঘনাদ শশব্যস্ত হয়ে বলল, না না, আমি কিন্তু বিনয়বাবুকে মোটেই খারাপ মনে করিনে। উনি বিদ্বান বুদ্ধিমান মানুষ
বাধা দিয়ে রাজীব বলে উঠল, না আমি বলছি, আপনি ভাবলেও কিছুমাত্র অন্যায় করেননি জামাইবাবু। টাকাপয়সার ব্যাপার। বিদ্বান বুদ্ধিমান হলেই তাকে যে একেবারে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে হবে, তার কি মানে।
রাজীব একটু থামল। কিন্তু কোনও সমর্থনসূচক কথা-ই বেরুল না মেঘনাদের মুখ দিয়ে। মানুষকে কেন সে খারাপ ভাববে, কেন অবিশ্বাস করবে অকারণে।
রাজীব কী বলতে চাইছে। এ যে দু রকমের কথা হয়ে গেল। অবিশ্বাস করবে না আবার বিশ্বাসও করবে না পুরোপুরি। এ সংশয় মনে নিয়ে কাজ আরম্ভ করবে কী করে সে। তার মুখের দিকে চকিত দৃষ্টি হেনে রাজীব বলল, আমি কী বলছি জামাইবাবু জানেন। বলছি, বিনয়বাবু যা-ই করুন, সেটুকু দেখাশোনার ভার আপনি আমার উপর দিতে পারেন। আমার এইটুকু অনুরোধ যখন। যা-ই করুন, আমাকে একটু জানাবেন আগে। বিনয়বাবুকে আপনার কাছে আমিই ডেকে নিয়ে এসেছি। পান থেকে চুন খসলে, বিজয়ের কাছে আমার আর মুখ থাকবে না। আপনি সবই করুন, আমার কথাটা ভুলবেন না। আপনার সব কাজে আমাকে একবার স্মরণ করবেন।
রাজীবের কথায় মনের অস্বস্তিটুকু দূর হল মেঘনাদের। সে বুঝল, রাজীব যে তার ভরসা, এ কথাটি বলবার জন্য সে উন্মুখ হয়েছিল। সকলের আড়ালে মেঘনাদের কাছে সে তার প্রাণটা খুলে দিয়েছে। যদি কিছু হয়, সেই ভয়ে, আত্মসম্মানের জন্য আগেই সে নিজের কর্তব্যটুকু করে রাখল। সে বলল, আপনারা ছাড়া, আর কার কাছে যাব। আপনি বলবেন, তবে যাব? আমি নিজে বুঝি আপনার উপর ভরসা করিনি।
রাজীব বলল, জানি, তবু বললাম। জানেন আমাদের বংশ চিরকাল ব্যবসায়ী। একমাত্র আমি ছিটকে চলে এসেছি অন্যদিকে। না এসে পারিনি। স্বাধীন হয়েছি কিন্তু এখনও অনেক কাজ বাকি।
তারপর হঠাৎ হেসে তার চিল-চোখে তাকিয়ে বলল, তা না হয় ঘরের ব্যবসা দেখিনি। দেশের কাজ করতে করতেও না হয় আর একজনের ব্যবসাই একটু দেখব। গায়ের রক্তটা তো ব্যবসায়ীর।
হেসে উঠল সে। মেঘনাদের চোখ পড়েছে ততক্ষণে একটি বিরাট ঢিবির উপরে। উইঢিবি এত বড় হয় না। যেন পাঁশুটে বর্ণের একটি টিলাপাহাড়। জিজ্ঞেস করল, ওটা কী?
রাজীব বলল, ওই তো বিনয়দার কারখানা। ওটা দেখছেন ঝাড়াই ফেঁসোর ময়লা।
কারখানার বেড়া বেষ্টনীর মধ্যে এসে ঢুকল তারা। কম্পাউণ্ডটি বেশ বড়। একদিকে চালাঘরে ফেঁসো ঝাড়াই হচ্ছে। আর একটি বড় ঘর গুদামঘরের মতো লম্বা। পাশেই আর একটি ছোট কোঠাঘর। বিনয়ের অফিস। অফিসের দরজার সামনে একটি লোক বসে রয়েছে টুলে। সে চাকর। কাজ করছে অধিকাংশই মেয়েমানুষ। ছোট ছোট ছেলেমেয়েও আছে কয়েকটি। কোলের ছেলে নিয়েই কাজে এসেছে কয়েকজন মেয়ে মজুর। ছেলেগুলি গাছতলায় কাঁদছে, খেলছে, কেউ কেউ ঘুমোচ্ছ।
বিনয়ের অফিসে আসতে সে হেসে অভ্যর্থনা করল মেঘনাদকে। চেয়ার দিল বসতে। সিগারেটের টিন দিল বাড়িয়ে।
মেঘনাদ জোড় হাতে সঙ্কোচভরে বলল, আরে না না, কী করছেন?
এরকম অভ্যর্থনায় সে কোনও দিনই অভ্যস্ত নয়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বিনয়ের অফিস দেখতে লাগল। দেওয়ালে খানকয়েক ছবি। কয়েকটি যন্ত্র আর মোটা কম্বলের মতো কাপড়ের ছবি। টেবিল, চেয়ার, টেলিফোন, সবই ঝকঝকে তকতকে।
মেঘনাদ বুঝল, কারখানার চেহারা যা-ই হোক, বিনয় বড় কারবারি। বিনয় তাকে কারখানা দেখাল ঘুরিয়ে। মেঘনাদের বুকের মধ্যে হু হু করে উঠল। হিংসায় নয়। তার কর্মহীনতা, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের বেদনায়।
বিনয়ের ঝাড়াই মেশিন নেই। লোহার মিহি জালের উপর উপুড় হয়ে মেয়েরা ফেঁসে চটকাচ্ছে। বিনয়ের চেয়েও বেশি দেখছে সবাই মেঘনাদকে। তাকে ভেবেছে একজন অবাঙালি। বাবুসাহেব। কিন্তু আশ্চর্য ! সেলাম করছে রাজীবকে। এই ঝাড়াই কারখানার ইউনিয়নেরও নেতা রাজীব।
তারপর বড় গুদামঘর খোলা হল। অন্ধকার ঘর। দরজাগুলি সব খুলে দেওয়ার পর আলো দেখা দিল। একদিকে ডাঁই করা রয়েছে ফেঁসোর বস্তা। আর একদিকে নানানশ্রেণীর মেশিন। জংধরা সেলাই মেশিন থেকে পেপার প্রেসার কাটার পর্যন্ত আছে, কিছু কিছু চটকলের তাঁত আর স্পিনিং-এর পার্টও আছে। গত বছরে, কারখানার দাঙ্গার সময় একদল গুণ্ডা এগুলি লুঠ করে এনে তাকে সের দরে বিক্রি করেছিল। দোষ পড়েছিল শ্রমিকদের উপর।
দরজার কাছেই তুলে এনে রাখা হয়েছে ডাইস মেশিনটি। মেশিনটি মানে, একটি মেশিন নয়। খণ্ড খণ্ড, টুকরো টুকরো রয়েছে। কাজের সময় জোড়া লাগিয়ে নিতে হবে। বোঝা যাচ্ছে, মেশিন সদ্য ঝাড়াপোঁছা করা হয়েছে। মাইলখানেক দূরে ছিল রহমতের বেকারি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর তার বেকারি উঠে যায়। মেশিনটি সে কিনেছিল, ভবিষ্যতের জন্য। ব্যবহার করা হয়নি আজও। তার কাছ থেকে কিনে নিয়েছিল বিনয়। কত দামে কিনেছিল, সেটা রহমত ছাড়া বোধ হয় আর কেউ জানে না।
আজ সেই মেশিনের খরিদ্দার হয়ে এসেছে মেঘনাদ।
বিনয় তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখাতে লাগল মেশিনটি। এইটি মিক্সিং, এইটি মিক্সিং-এর চাকা, মশলা মেখে ময়দার ড্যালা এর মধ্যেই ঢেলে দিতে হবে। এইটি প্রেসার, এর তলা দিয়ে, কাচির ধুতির মতো মিহি ময়দার পাত বেরিয়ে আসবে এই পথে। সারাদিন ধরে খালি ডলবার কোনও দরকারই হবে না। ছাঁচের যন্ত্রটি আছে আলাদা। যে চওড়া রেলিংটার উপর দিয়ে যাবে ময়দার পাত, তার উপর প্রেসার দিয়ে নিমেষে নিমেষে শত শত ছাঁচ কেটে দেবে কাটার। এ মেশিন ইলেকট্রিকে চলবে। ডিজেলেও চালানো যায়। ইলেকট্রিক হিটার থাকলে, তন্দুরের দরকারই নেই ।
বিস্মিত খুশির হাসি ছড়িয়ে পড়েছে, মেঘনাদের সারা মুখে। একটা বোবা বন্য খুশি তার গোঁফের ফাঁকে, গালের ভাঁজে। যেন দূর বনপাহাড়ের কোনও ট্রাইবেল পুরুষ দেখছে সভ্যজগতের জাদুকরি কারসাজি। মেশিনের সবচেয়ে বড় চাকাটা, যেন বড় স্টিমারের সারেঙ্গের হাতের হুইল। তার সর্বাঙ্গ ছটফট করছে, একটু হাতের স্পর্শের জন্য। কী আশ্চর্য! কী সুন্দর ! হাত দিলে যেন সারা গায়ে তড়িৎপ্রবাহ খেলে যাবে। কিন্তু লজ্জা করছে, হয়তো এরা কিছু ভাববে।
তবু বড় চাকাটার গায়ে হাত দিল সে। ঠাণ্ডা, শক্ত, তবু একটি বিচিত্র শিহরণ খেলে গেল মেঘনাদের গায়ে।
বিনয়ের সেই একই ক্লান্ত উদাস গলা। বলল, পারিবারিক ব্যাপারে একটু ব্যস্ত আছি আমি। কেনাকাটার ব্যাপারটা কয়েকদিন বাদেই হবে, কী বলেন।
মেঘনাদ যন্ত্রের ঘোরে আচ্ছন্ন। বলল, কিন্তু জমিটা
বিনয় বলল, দেখাব! আমার স্ত্রী-পুত্র সব পুরী যাবে দু-একদিনের মধ্যে। আমি একটু ব্যস্ত থাকব। তারপরেই হবে। আজকে শুক্রবার। আগামী মঙ্গলবার জমি দেখাব আপনাকে। সে আমি সব ঠিক করেই রেখেছি, আপনাকে ভাবতে হবে না। এখন রাজমিস্তিরিদের সঙ্গে কথা বলতে হয়। আর পারমিটের জন্য এক দিন যেতে হয় র্যাশন অফিসে। কবে যেতে চান?
মেঘনাদ বলল, আমি তো পা বাড়িয়েই আছি। যখনি বলবেন।
রাজীব বলে উঠল, মঙ্গলবারের পর।
বিনয় তাকাল রাজীবের দিকে। রাজীব বলল, একসঙ্গে তো সব হবে না।
তারপরে আবার বলল যেন বিনয়ের চাউনির জবাবে, একটার পর একটা করতে হবে।
বিনয় বলল, সেই ভাল।
বিদায় নিয়ে ফিরে চলল রাজীব আর মেঘনাদ। খানিকটা গিয়ে হঠাৎ রাজীব বলল, এক মিনিট জামাইবাবু, আসছি।
বলে সে ছুটে গেল বিনয়ের কাছে। বলল, আপনার স্ত্রী পুরী যাবেন, তাতে কি আপনি সত্যি ব্যস্ত থাকবেন বিনয়দা?
বিনয়ের বিষণ্ণ-উদাস চোখে হঠাৎ রক্তাভা দেখা দিল। বলল, সেটাও তোমাকে বলতে হবে নাকি?
রাজীবের ঠোঁটের পাশে সামান্য একটু বাঁকা হাসির আভাস। বলল, না, উনি মানে আপনার স্ত্রীর যাওয়ার জন্যে যে আপনি ব্যস্ত থাকবেন, আমি বুঝতে পারিনি। এদিকে আবার দেরি হবে তো।
বিরক্ত হয়ে বিনয় বলল, ওই করে তুমি অনেক ক্ষতি করেছ। বাড়ির ছেলে বউ বাইরে যাবে, আর আমি এ সব নিয়ে মশগুল হয়ে আছি, সে সব কি তোমার নতুন জামাইবাবুর চোখে ভাল ঠেকবে?
নতুন জামাইবাবু অর্থে মেঘনাদ। এক মুহূর্ত চুপ থেকে রাজীব বলে উঠল, সত্যি, ঠিক, ভুল হয়ে গেছে। সন্ধ্যাবেলা বাড়ি থাকবেন তো?
: থাকব।
: কিংস্ মিলের ইউনিয়নের সেক্রেটারি রতন সিং আসবে আজ আপনার কাছে। বোধ হয় একটা কিছু গণ্ডগোলে পড়েছে।
চলে গেল সে। বিনয় বিষণ্ণ বঙ্কিম ঠোঁটে হাসল।
.
পুজো এল, পুজো গেল। এর মধ্যে এক দিন সবাই দেখল, বিনচৌ-এর গাড়িটাতে কিছু লটবহর চাপল।
এই সময়ে বিনয় দাঁড়িয়েছিল নীচের ঘরে সিঁড়ির কাছে। পাশে দাঁড়িয়েছিল গোপাল, বিনয়ের বিশ্বস্ত চাকর। সে যাবে বিনয়ের স্ত্রী, সুলতার সঙ্গে।
দিল্লী থেকে এখানে আসার পর এই প্রথম সুলতা বাংলাদেশের বাইরে যাচ্ছে। এই প্রথম অনুমতি পাওয়া গেছে বিনয়ের কাছ থেকে। সঙ্গে যাবে গোপাল, বিনয়ের প্রতিনিধি।
প্রথমে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল দুই ছেলে। সিঁড়ির মাঝপথেই থেমে গেল বিনয়কে দেখে। বিনয়ের মতোই প্রায় দেখতে। একটি ন বছরের আর একটি সাত বছরের। হঠাৎ যেন লজ্জায় ও অস্বস্তিতে দু জনেই জড়োসড়ো হয়ে পড়ল। আর একটু খোশামোদের হাসি কাঁপছে ঠোঁটের কোণে।
শান্তিনিকেতনের নিরীহ সৌম্য আবহাওয়ায় তারা মানুষ। তা ছাড়া ছোটকাল থেকে তারা দেখেছে, মায়ের সঙ্গে বাবার কোথায় যেন একটা মস্ত ব্যবধান। সেই ব্যবধানের মধ্যে এক অজানা বিস্ময় ও ভয় ছিল মিশে। আরও ছিল, দারুণ অস্বস্তিকর স্তব্ধতা। বাবার কাজ ও কথাকে তারা চিনত না। এক বাড়িতে দু রকমের দুটি মানুষ। মা আর বাবা। তাদের টান গেছে মায়ের দিকে বেশি। ভয় ধরানো থমথমানির মধ্যেও মা তাদের নিয়ে হেসেছে, গান করেছে গুনগুন করে। আর দেখেছে, মায়ের চোখে কী এক চাপা ব্যথা। মাকে তারা চেনে, ভালবাসে। শান্তিনিকেতনের আবহাওয়া পুষ্ট করেছে তাদের মাতৃ-প্রেম। আর এক দুর্বোধ্য ভয় বিদ্বেষ দূরে সরিয়ে দিয়েছে বিনয়ের কাছ থেকে।
এবার নেমে এল সুলতা। এক মুহূর্ত সেও থমকাল। তারপর ছেলেদের হাত ধরে নেমে এল তরতর করে। খসা ঘোমটা দিল টেনে। বড় ছেলেটির হাত টিপতেই সে কলের পুতুলের মতো বলে উঠল, বাবা, আমরা যাচ্ছি।
বিনয় ঘাড় নাড়ল।
সুলতা ফরসা, দোহারা। চোখে-মুখে বুদ্ধির দীপ্তি কিন্তু বিষণ্ণ। কপালে সিঁদুর নেই। সিঁথিতে আভাসমাত্র। হঠাৎ নজরে পড়ে না। বলল, যাচ্ছি।
বিনয় বলল, ফিরে আসার দিনটা মনে আছে নিশ্চয়ই।
বিষণ্ণতার মধ্যেও একটু খুশির আমেজ ছিল সুলতার মুখে। সে আমেজটুকু কেটে গিয়ে গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, আছে।
বিনয় বলল, গোপাল সব সময় সঙ্গে থাকবে।
ঠোঁটের পাশ দুটি কঠিন হয়ে উঠল সুলতার। কিছু বলল না।
বিনয় আবার বলল, ছেলেরা যদি চায়, তবে ওদের বোলপুর পৌঁছে দিয়ে আসতে পারো। বলে উদাস চোখ ফিরিয়ে নিল সে। সবাই চলে গেল। হঠাৎ খেউ খেউ শব্দে বিনয় বুঝল, গাড়িটা ছেড়ে দিয়েছে।
দিল্লির কথা মনে পড়ল তার। মনে পড়ল, ব্রাহ্ম পরিবারের সেই অঙ্কশাস্ত্রের অধ্যাপকের বাড়ির কথা। অধ্যাপক নগেন্দ্রনাথ নিজে একদিন নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গেলেন, নতুন ইতিহাসের অধ্যাপক বিনয়কে। পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, মেয়ে সুলতার সঙ্গে। সুলতা তখন ইংরেজি পড়ত। বিনয়ের বাংলাটাও পাশ করা ছিল। সুলতার ঝোঁক গেল বাংলাকাব্যের দিকে।
দূর প্রবাসে, সুলতার কাছে বাংলা ছিল অমৃতের মতো। দূর প্রবাসের প্রেমিকের মতো সেই ভাষা। শৈশবে হেসেছে খেলেছে হিন্দি ভাষায়। বড় হয়ে ইংরেজি হিন্দি বাংলার জগাখিচুড়ি দিয়ে ঝগড়া করেছে চাকরের সঙ্গে, কথা বলেছে বাপের সঙ্গে। বিনয় যখন গিয়েছিল তখন, মাতৃহীন সংসারের সে ছিল সর্বময়ী কত্রী।
সুলতাদের একটা সমাজ ছিল। তার সঙ্গে বিনয়ের চাক্ষুষ দূরের কথা, দুর-পরিচয়ও ছিল না একরকম। সে জানত, পবিত্রতার নামগন্ধহীন, রং মাখা এ এক কুৎসিত সমাজ। না হিন্দুর গরু, না মুসলমানের শুয়োর।
সুলতা যখন ঘরে থাকত, মুখে রং মাখত তখনও। ঠোঁটের রং বাসি হত না। জর্জেটের বাঁধুনি শিথিল হত না এক মুহূর্ত। চাকরকে ডাকত বোয় বলে, ঝিকে আয়া। বাড়িতে দিবানিশি নানান লোকের আসাযাওয়া। অধিকাংশই সুলতার মেয়ে আর ছেলে বন্ধু। অল্প স্বল্প নগেন্দ্রনাথের প্রবীণ বান্ধব। ছেলে মেয়ের দলে বাঙালি ছাড়াও দিল্লি, মারাঠি, পঞ্জাবি, মাদ্রাজি সবরকমই ছিল। নানান প্রদেশের তীর্থক্ষেত্র বিশেষ।
বাপের ঘরে শাহাজাদির মতো সুলতা। তার ঠোঁটের রং, চোখের কাজল আর জর্জেটের ঢেউয়ের একটা নেশা ছিল বিনয়ের। মনের এই নেশাটা সে করত চোরের মতো লুকিয়ে। যে পরিবারে সে মানুষ, সেখানে প্রেমের চোখে চাওয়াটাই নোংরামি ! তা ছাড়া ছিল ভীরুতা। এই আভিজাত্যকে সমীহ না করুক, ভয় ছিল। সুলতাকে প্রেম নিবেদনের সাহস তার ছিল না। প্রেম করাটা তার মাথায়ও আসেনি। তাই তার ব্যবহার ছিল শান্ত, মিষ্টি আর খানিকটা নির্বিকার। সুলতার কাছ থেকে যেটুকু পেত, সেটুকু যেন কোনও স্বৈরিণীর কাছে লুকিয়ে পাওয়া অনাচারগ্রস্ত পাকানো রসের মতো। সে রস প্রেম না। সুলতাদের দেহ ও প্রেম বলে কিছু নেই, এটাই তার বিশ্বাস ছিল।
ইউনিভার্সিটিতে মেয়েদের কাছাকাছি এসেছে সে। কোনও মেয়েকেই সে কোনওদিন ভাল চোখে দেখেনি। ভাল হয় না, এইটাই তার জানা ছিল, রক্তে ছিল অবিশ্বাস। তার মা, জ্যাঠাইমা, তার বোন, বউদিরা অন্য মানুষ। তারা ভিন্ন জগতের। তারা হিন্দুনারীর দোষে গুণে মহৎ। সুলতাদের ঠাঁই নেই সেখানে।
সে যে ঘর ছেড়ে গেছল, তার কারণ তার বাবা। লোকটি জ্যাঠামশায়ের কাছে মার খেয়ে খেয়ে, বিরাগ ও অশ্রদ্ধা জাগিয়ে দিয়েছিল বিনয়ের মনে। জ্যাঠামশায়ের অদ্ভুত ক্ষমতাটাই তাকে উদ্দীপ্ত ও কৌতূহলী করেছে। লজ্জায় ও ভয়ে জিজ্ঞেস করতে পারেনি, জেঠু, তুমি বাবাকে কী করে ঠকাচ্ছ? জ্যাঠামশাই এদিকে দিনরাত্রি ব্লাডপ্রেসারে আর পেটের ব্যারামে কাতরাত। লোকের সঙ্গে মিষ্টি হেসে। কথা বলত। সেই লোকটাই কী করে বাবাকে পাগল করছিল !
বড় হয়ে বাবার জন্য তার কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু জ্যাঠামশায়কে সে উপযুক্ত নায়ক মনে। করেছিল। বুঝেছিল, এরকম না হলে মানুষ কিছু করতে পারে না বোধহয়। বাবা ভুল করেছে, সে । নিজে অন্তত আর এভাবে বোকা হবে না।
এই রকম মন নিয়ে দুবার পাশ করেছে সে। আশ্চর্য? পাশ করাটা তার কাছে কোনও সমস্যাই নয়। সারাজীবন পড়লে, সারাজীবনই পাশ করতে পারত।
কিন্তু অর্থের প্রয়োজনে ঘর ছেড়েছিল সে। বাইরে এসেছিল পূর্ণ অভিজ্ঞতার সজাগ মন নিয়ে, পা টিপে টিপে। পা টিপে টিপে এসেছিল সহৃদয় নগেন্দ্রনাথের বাড়িতে। তার প্রবাস জীবনকে স্নেহ-সিক্ত করতে চেয়েছিলেন নগেন্দ্রনাথ। সুলতাও চেয়েছিল।
সেই প্রথম বিনয়ের একটি মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা জন্মেছিল। দুপাচ্য খাবার, কিন্তু খেতে ভাল। সুলতার ঠোঁটের রং কদর্য সমাজ-চরিত্রের লক্ষণ, কিন্তু দেখতে ভাল লাগে। নেশাটা রক্তের মধ্যে ধরে গেছল। সোঁদা মাটির টানে কেঁচোর মতো বুকে হেঁটে হেঁটে এগুচ্ছিল সে।
সুলতারা দেখছিল এক স্বল্পবাক, শিক্ষিত স্বাস্থ্যবান বাঙালি যুবক। চোখে তার স্বপ্ন, প্রবাসের বিষণ্ণতা। সুলতা বাংলা শিখতে চেয়েছিল আর তার একলা জীবনে দিতে চেয়েছিল মিষ্টি সাহচর্য।
সত্যি, অনেকে ঘিরেছিল সুলতাকে। তার মধ্যে প্রথম হয়ে উঠেছিল বিনয়। শেষ পর্যন্ত, বিনয়ের রাত্রে খাওয়াটাও সারতে হত সুলতাদের বাড়িতেই। বাংলা রান্না খাওয়ার জন্য, সব সময়েই সুলতার কোনও না কোনও ভিন্নদেশের বন্ধুরও থাকত নিমন্ত্রণ।
বিনয় জানত, এ খাওয়ানো মানে সুলতার রঙের আসর জমিয়ে রাখার কারুমিতি। যখন যাকে ভাল লাগে, তাকেই খাওয়ায়। সুলতার ছেলেবন্ধুদের নেশাটার আরও গুঢ় কারণ বুঝেছিল সে। বুঝেছিল, ওরা সুলতার সব রকমেরই সঙ্গী।
কিন্তু আশ্চর্য ! হিংসে হত তার। তার একলা ঘরের অন্ধকারে ছটফট করত। যে দিন রাত্রে সুলতা অন্য কোনও বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে বিনয়কে পৌঁছে দিয়ে যেত, তার বুকের মধ্যে একটি অসহায় ক্রুদ্ধ সত্তা নিঃশব্দে চিৎকার করত। আর ভাবত, যে বন্ধুর সঙ্গে সুলতা ফিরে গেছে, হয়তো এতক্ষণ বক্ষলগ্ন হয়েছে তার। কেন না ওদের সমাজে যে সবই চলে। ভাবতে ভাবতে অসহ্য যন্ত্রণায় তাকে মাথায় জল ঢালতে হত।
শুধু জানত না, ফিরে যাওয়ার পথে দিল্লির ঘুমন্ত প্রাসাদের আনাচেকানাচে আটকা পড়ে থাকত সুলতার দীর্ঘশ্বাস। সুলতা নির্বাক উদাস বিষণ্ণ স্বভাব বিনয়কে ততদিনে ভালবেসেছিল।
সুলতা ভাবে ভঙ্গিতে সম্মতি দিয়েইছিল। প্রস্তাব করেছিলেন নগেন্দ্র। কেন না, বিনয়ের পক্ষে প্রস্তাব করা সম্ভব নয়, এইটাই অনুমান করেছিলেন। হঠাৎ পাংশু মুখে চুপ করে গেছল বিনয়। বিয়ে ! সুলতাকে ! কয়েকদিন সময় নিয়ে শুধু ভেবেছিল। ভাবার কোনও দরকার ছিল না। জীবনে সেই প্রথম আগুন লেগেছিল তার রক্তে। প্রতিটি শাণিতবিন্দু সুলতাকে কামনা করছিল।
তা ছাড়া, সেই প্রথম মনে হয়েছিল, সে তার জেঠুর মতো একটা কাজ করতে যাচ্ছে। অঙ্কশাস্ত্রের হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট নগেন্দ্রনাথের সারাজীবনের সঞ্চিত টাকাটা তো পাবে সে-ই।
সুলতাদের সমাজ সংসার মানুষ, সবই পাপ। বিনয় জানত, সে পাপের দুর্নিবার আকর্ষণ রোধ করতে পারছে না। বাড়ির ঠিকানা, পিতৃ-পরিচয়, সবই দিয়েছিল সে নগেন্দ্রনাথের কাছে। দিয়ে বলেছিল, ওই বাড়ির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক সে ভবিষ্যতে রাখবে না। আর, তারাও দেবে না সম্মতি এ বিয়েতে।
সেদিক থেকে সংস্কারমুক্ত ছিলেন নগেন্দ্রনাথ। বিশ্বাসও করতেন বিনয়কে।
বিয়ের পর আলাদা বাসা করেছিল বিনয় সুলতাকে নিয়ে। গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো দ্বিগুণ জ্বালা চেপেছিল বিনয়ের মনে। সে দেখছিল, সুলতার বিয়ে হয়েছে বটে, সঙ্গীরা তাকে ছাড়েনি। সেও ছাড়েনি সঙ্গীদের। তাদের যাওয়া আসা একই রকম চলছিল। খাওয়াদাওয়া, আচ্ছা, সবই ঠিক ছিল। বদল হয়েছিল শুধু বাড়িটা।
সুলতার তখন প্রথম সন্তান হয়েছে। বিনয়ের বিষণ্ণ উদাস চোখের দিকে তাকিয়ে একদিন সে অদ্ভুতভাবে আবিষ্কার করেছিল, তার বন্ধুদের, বিনয়েরই ছাত্রদের এ বাড়িতে আসা সে পছন্দ করে না।
মনে মনে কষ্ট পেয়েছিল সুলতা। এরা সকলেই প্রায় তার শৈশবের সঙ্গী। বলেছিল, কেন বলো তো?
বিনয় বলেছিল, এখন তো আমিই আছি।
সেই জীবনে প্রথম সুলতার রং মাখা ঠোঁট ফ্যাকাসে হয়ে গেছল। বিনয়ের কথার আসল অর্থ বুঝতে তার একটুও অসুবিধা হয়নি।
তারপর দিনে দিনে বিনয়ের রূপটা খুলেছিল আস্তে আস্তে। ঠিক বিনয়ের মতো করেই। সুলতার প্রতি তার আসল ধারণা, আসল বাসনা ফুটেছিল তার একই বিষণ্ণ চোখে, অল্প শান্ত কথায়।
তখন দ্বিতীয় দফায় আসন্নপ্রসবা সুলতা।
কিন্তু সুলতা, চোখের জল না ফেলে, বিনয়ের এ বিশ্রী গোঁড়ামিটা ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছিল তার প্রেমের উচ্ছ্বাসে হেসে। ভেবেছিল, ওর পারিপার্শ্বিকের ঠুলিটা দেবে ফুটো করে। বাইরে যেত, ডেকে আনত বন্ধুবান্ধবীদের, বেশি করে আলাপ করিয়ে দিত বিনয়ের সঙ্গে।
বিনয় বুঝেছিল বিপরীত। ভেবেছিল, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। একই কথা ভেবেছিল সুলতাও।
সে নির্বাক হয়ে, বিমর্ষ চোখে আরও কঠিন হয়ে উঠেছিল। বেরুতে না-দেওয়া আর কাউকে না আসতে দেওয়ার (কাউকে অবশ্য বিনয় নিজের মুখে আসতে বারণ করেনি, সে-সবই সুলতার দায়।) অপমানকর ঘটনা ঘটতে আরম্ভ করেছিল অনেক। সেই সঙ্গে, নিরালায় পেয়েও কম অপমান করেনি সুলতাকে।
সুলতা চমকে চমকে উঠেছিল বিস্ময়ে, ব্যথায়। তারপরে ভয়ে ও ঘৃণায়। কিছুদিন পরেই তার দ্বিতীয় সন্তান হয়েছিল।
কথাটা চাপা থাকেনি। ফলে, আস্তে আস্তে, বন্ধুবান্ধবদের কান থেকে কথাটা গিয়ে পৌঁছেছিল কলেজের ছেলেদেরও কানে। বিনয় যে শুধু তরুণদের কাছে অপ্রিয় হয়ে উঠেছিল তা নয়, কলেজে ছেলেরা লেগে গেছল বিনয়ের পেছনে। পেছনে লাগার ব্যাপারটা এমনই হল, কলেজের গভর্নিং বডি বিনয়কে কাজে ইস্তফা দিতে বললেন। নগেন্দ্রনাথ অসহ্য ব্যথায় চুপ করে ছিলেন একেবারে।
বিনয় বুঝেছিল, এটা একটা প্যাঁচ। সারা দিল্লিটাই সুলতার ঠোঁটের আশায় ছিল। আর বুড়ো বেহ্মজ্ঞানী নগেন্দ্রনাথ খেলছিল নিশ্চয়ই কড়া অঙ্কের প্যাঁচ।
সুলতা বিনয় ও বাবাকে ছাড়া সবাইকে অভিসম্পাত দিয়েছিল তখন। সে জানত, সবাই মিলে বিষিয়ে তুলেছে তার জীবনটা।
অধ্যাপনায় ইস্তফা দিয়েছিল বিনয়। তার সমস্ত রাগ ও ঘৃণা এসে জড়ো হয়েছিল সুলতার উপর। বড় বড় দুটি আরক্ত চোখে, আশ্চর্য শান্ত গলায় কোনও অপমান করতে সে বাকি রাখেনি সুলতাকে।
সুলতাদের সমাজে, আচারে বিচারে ও শিক্ষায়, এর প্রতিকারের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সুলতা ধৈর্য ধরে ছিল, বিনয়কে সে ভালবেসেছিল।
সেই সময়টা যুদ্ধের ঘটা পেকে উঠেছে। তেতাল্লিশের উপোসী বাংলার উপর সারা ভারতের ব্যবসায়ীদের নজর । একদিকে ক্ষুধা, আর একদিকে বোমার ভয়ে জুজুবুড়ি কলকাতা। বেকার বিনয় একটু বেকায়দা বোধ করছিল। সেই সময় জুটেছিল এসে উধম সিং। বাড়ি আগ্রায়। কলেজে। চাকরি করত লাইব্রেরিয়ানের। আসলে সে ছিল ইনটেলিজেন্ট ব্রাঞ্চের লোক। কাজ ছিল ছাত্রদের উপর নজর রাখা আর রিপোর্ট করা। তার সমবেদনা এসে পড়েছিল বিনয়ের উপর।
সে প্রথমেই খোঁজ করেছিল, বিনয়ের টাকা আছে কী পরিমাণ। কিছু ছিল। একলা মানুষ, বাড়িতে টাকা পাঠাবার দায়িত্ব সে মনেও রাখেনি। বাপের মৃত্যু সংবাদে, কোনওরকমে হবিষ্যটা করেছিল থান পরে। ছাত্র অবস্থায় পয়সার জন্য কোনও ব্যাকুলতা ছিল না। কর্মজীবনে পয়সাটা চিনে ফেলেছিল আশ্চর্যরকমভাবে। সুতরাং কিছু হাতে ছিল।
উধম এসে বলেছিল, এক ওয়াগন মাল এসেছে কানপুর থেকে। যার নামে এসেছে, সে টাকাটা দিতে পারছে না। হাজার তিনেক টাকা লাগবে। যদি বিনয় নিতে পারে সেটা, কাজ হবে।
মালটা কী? নতুন পুরনোয় মেশানো কিছু যন্ত্রপাতি আর নাটু এবং বোল্টস আছে। লাভ? সেটা উধম পরে বুঝিয়ে দিয়েছিল।
মালটা নিয়ে খালাস করে পাঠানো হয়েছিল বাংলাদেশে। এক সপ্তাহের মধ্যেই বিনয় দেখেছিল, পুঁজি তার দ্বিগুণের বেশি হয়ে গেছে।
উধম বুঝিয়েছিল, যে মালগুলি আসছে, ওগুলি কারখানারই পুরনো মাল। যে পাঠায়, সে কিছু নতুনও পুরে দেয় এবং যে দরে দেয়, সেটা দিল্লির দর। আবার বাংলাদেশে ফিরে গেলেই দরটা যায় চড়ে। চড়েও সাংঘাতিক রকম। বিশেষ করে কলকাতার বাজারে তখন লোহালক্কড় সোনা হয়ে গেছে।
এ ঘটনার পর অধ্যাপক জীবনের প্রতি করুণ অবহেলাভরে তাকিয়েছিল। সে স্বাদ পেয়েছিল অনেক বড় জিনিসের। তার বাবা শুধু কেঁদেই মরেছিল। জ্যাঠামশাই ছাড়া সে দিন বুঝি আর কেউ ছিল না তাকে বাহবা দেওয়ার। উধম সিংকে পারেনি সে ছাড়তে। বেচে তাকে দিয়েছিল টাকা।
উধম তাকে মাত্র আঙুল দিয়ে রাস্তা দেখিয়েছিল। তারপরে চিনিয়ে দিয়েছিল অলিগলি। জমে উঠেছিল ব্যবসা।
ওদিকে টের পাচ্ছিল, সুলতা সংযোগ রেখে চলেছে নগেন্দ্রনাথের সঙ্গে। চাকরগুলিকে বিশ্বাস করা যাচ্ছিল না।
প্রতিমুহূর্তে দেখছিল পাপের কারসাজি চলেছে যেন বাড়িটার দেওয়ালে দেওয়ালে। এমনকী, বিনয় একথাও ভাবত, সুলতার ছেলে কার ! ভাবে-ভঙ্গিতে সেটা জিজ্ঞেসও করত সুলতাকে।
অল্পদিনের মধ্যেই, উধমের সাহায্যে পাড়ি দিয়েছিল সে বাংলায়। সুলতা আশা করেছিল দিল্লির পাপ থেকে বিনয় নিজে মুক্ত হয়েছে। এবার ভোলা মনে তার সঙ্গে সংসার পাতবে।
কিন্তু আশ্চর্য ! কোনও নড়চড়ই হয়নি। আজন্মের দিল্লি ছেড়ে সে এসে বন্দিনী হয়েছিল চব্বিশ পরগনার দূর উত্তরের ধোঁয়া ধূসরিত মফস্বল শহরে। বিনয় তার একটি কথা রেখেছিল। ছেলে দুটিকে সরিয়ে দিয়েছিল এ বাড়ি থেকে শান্তিনিকেতনে।
রং? সে শুধু ঠোঁটে কেন। মন থেকেই তো তার দাগ উঠে গেছল কবে। বিনয় এখনও ভাবে, সুলতার রং মেখে রং করা ঘুচিয়ে দিয়েছে সে চিরদিনের জন্য।
অনেক দিন বাদে দিল্লির কথা ভাবতে ভাবতে ডুবে গেল বিনয়। আজও তার সেই উদাস চোখ। কিন্তু ঠোঁটের কোণে একটি তৃপ্তির হাসি চমকাচ্ছে।
রাঁধুনি ঠাকুরটি একটু গিন্নি গিন্নি ভাবের। সে ভাবল, বাবুর আজ মন কাঁদছে বউ-ছেলে ছেড়ে। তাই অত ভাবনা। তাই এক সময়ে এসে বলল, বাবু অত ভেবে আর মন খারাপ করে কী হবে। নেয়ে খেয়ে নেবেন চলুন।
বিনয় এক মুহূর্ত অবাক হয়ে হেসে বলল, ঠিক বলেছিস চল।
উপরে এসে, হঠাৎ কী মনে করে সুলতার ঘরে গেল। এ ঘরে সে মাসে একবারও ঢোকে কিনা সন্দেহ।
মনে পড়ল, এখানে এসে সুলতার সঙ্গে তার সব সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটে গেছে।
সুলতা তাকে ঢুকতে দেয়নি এ ঘরে। সুলতার সেই মূর্তি অদ্ভুত ! লোক জানাজানি অনর্থ করতেও পেছপা ছিল না।
বিনয় বুঝেছিল, সব রং হারিয়ে আজ সুলতা ক্ষিপ্ত। ঠিক আছে। হঠাৎ ঘন ঘন, সপরিবারে নিমন্ত্রণ করে পাঠাতে লাগল সে ললিত মজুমদার কম্পাউন্ডারকে। কম্পাউন্ডারের বড় মেয়েটা জেনে নিল বিনয়ের কাছে, তাদের স্বামী-স্ত্রীতে নিদারুণ বিচ্ছেদ। দরিদ্র মেয়েটা, বিনয়কে করুণা করতে গিয়ে ডুবল। দিনে দিনে ডুবল সুলতারই চোখের সামনে। বিনয় ভাবছিল, দিল্লির শোধ নিচ্ছে কষে।
তারপর ডা. সীতানাথের স্ত্রী। একই ব্যাপার। সুলতার উপর শোধ নিতে গিয়ে একটা যুক্তিও খাড়া করেছিল সে। নতুন নতুন প্রেমের লোভটাও দুর্নিবার হয়ে উঠেছিল। ডাক্তারের স্ত্রী তার উদাস ক্লান্ত জীবনে বন্ধুর মতো এসেছিল। দাম্পত্য জীবনের কোথায় তার কিছু ফাঁক ছিল। সেই ফাঁকের মাঝখান দিয়ে বিনয় দাঁড়িয়েছিল সামনে। তারপর পালিয়েছে।
বালবিধবা উগ্রক্ষত্রিয়দের মেয়ে মুক্ত এসেছিল অন্যভাবে। বেচারির বন্ধকি জমিটুকু হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে টাকা চেয়েছিল বিনয়ের কাছে। বন্ধক ছিল চারু স্যাকরার কাছে। বিনয় টাকা। দিয়েছিল। মুক্ত নিজেই সামলাতে পারেনি। ভাল মানুষ ভাল মানুষ করে এলিয়ে পড়ল এমন, দেখল, শেষে জমিটাই বিনয়ের দখলে। ওই জমিটা চারু স্যাকরার কাছে পাঁচ বছর আগে বাঁধা দিয়ে মুক্ত তার স্বামীকে রোগমুক্ত করতে চেয়েছিল।
বিনয়ও অবাক হয়েছিল। ব্যাপারটা সে মোটেই ভেবে করেনি। বরং পড়ে পাওয়া চৌদ্দআনা জমিটা যতদিন সে নেয়নি, তার অস্বস্তি হচ্ছিল। তার নানান কাজে কর্মে মনে পড়ত সব সময়। তারপর যখন নিয়ে নিল, তখন সব অস্বস্তির অবসান হয়ে গেল।
বিনয় জানালা দিয়ে তাকাল দক্ষিণের আকাশে। রাস্তায় ভিড় লেগেছে। মিষ্টি মিষ্টি রোদে ভরে গেছে দিনটা। বাড়িটা একেবারে নিঝুম। অবশ্য নিঝুমই ছিল চিরদিন।
চোখের সামনে ভাসতে লাগল মেঘনাদের স্ত্রী লীলাকে। কম্পাউন্ডারের মেয়ে। ডাক্তারের স্ত্রী সুধা, মুক্ত এমনকী সুলতা, কাউকে দিয়ে হঠাৎ তুলনা করা যায় না লীলার। কালোরূপের এত আগুন আর দেখেনি সে। যে আগুন লেলিহান শিখার মতো হাসির ছটায় পুড়িয়ে দিতে চায়। কী সাহস! প্রাণ চাইলে হয়তো মাঝ গঙ্গায় নৌকা ডুবিয়ে বিনয়কে মেরে মরতেও পারত।
দীর্ঘশ্বাসের শব্দে চমকে ফিরল সে খাটের দিকে। শূন্য বিছানা, সাজানো গোছানো। দরজার দিকে ফিরে দেখল রাঁধুনি ঠাকুর দাঁড়িয়ে আছে।
বেচারি ! গিন্নিমন্ত ঠাকুর। সে ভাবছে, আহা। বাবু বেচারির কী ব্যথা ! থাকতে যাকে মনে লাগেনি, আজ তার জন্য এ খালি ঘরে মনটা হু-হুঁ করছে। এ কথা আজ সে কাকে বলবে। ভোলা রইল, মা এলে বলবে। সে তো পরের কথা। উলটে নিজের বামনির কথাটাই মনে পড়ে যাচ্ছে।