মুসলিম : যত দোষ নন্দ ঘোষ
ব্রিটিশ উপনিবেশের ফলে ধীরে ধীরে ভারতের সর্বত্র মুসলিম শাসনের অবসান বটে— কারোর যুদ্ধে মৃত্যু হল, কেউ-বা বশ্যতা স্বীকার ও আত্মসমর্পণ করে নিল। আবার অনেক মুসলিম শাসক ভারত ব্রিটিশ মুক্ত হওয়ার পরও তাঁদের শাসন অব্যাহত রাখতে পেরেছিলেন। যেমন –হায়দ্রাবাদ, জুনাগড় ইত্যাদি। তবে অনেক ক্ষেত্রেই মুসলিম শাসক শূন্য হলেও ভারত মুসলিম শূন্য হয়নি। সেই প্রশ্নও ওঠে না। এখন কথা হল মুসলিম শাসকরা তো মধ্যপ্রাচ্য বা বিভিন্ন দেশ থেকে ভারতে এসে শাসন করেছিল, তবে কোটি কোটি মুসলিম-সাধারণ ভারতে এলো কোথা থেকে? সাধারণ মুসলিমরা কোথা থেকেও আসেনি, কেউ মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসেনি– এঁরা প্রায় সকলেই ভারতেরই অধিবাসী। ভারত তো অ-মুসলিমদের দেশ ছিল অষ্টম শতকের (৭১২ সাল) আগে পর্যন্ত। পরবর্তীকালে অ-মুসলিমদের একটা অংশ মুসলিম হল কেন? কীভাবে? এখন ইসলাম ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের (পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মুসলিমরা একদা ভারতীয় মুসলিমই ছিলেন) দ্বিতীয় বহুল প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস। জনসংখ্যার বিচারে ভারতে মুসলিমদের স্থান হিন্দুদের ঠিক পরেই। দেশের মুসলিম জনসংখ্যা (২০২০, ৩১ মে পর্যন্ত হিসাবে) ১৯৮,০২২,২৮৬, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ১৪.২ শতাংশ। ভারতে মুসলমান জনসংখ্যা সমগ্র বিশ্বের নিরিখে তৃতীয় বৃহত্তম। ভারত বিশ্বের বৃহত্তম সংখ্যালঘু মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রও বটে। আজ হিন্দুস্তান তথা ভারত (বাংলাদেশ, ভারত, এবং পাকিস্তানে) বসবাসরত প্রায় ৫০ কোটি মুসলিম এই অঞ্চলকে বিশ্বের মুসলিম জনশক্তির অন্যতম একটি কেন্দ্রে পরিণত করেছে। ইসলাম সর্বপ্রথম এই অঞ্চলে আসার পর থেকেই এই অঞ্চলের মানুষদের মাঝে অনেক অবদান রেখেছে এবং এখনও রেখে যাচ্ছে। কীভাবে এই বিশাল অঞ্চলে ইসলাম এসেছে তা নিয়ে অনেক মতবাদ আছে। রাজনৈতিকভাবে, কেউ কেউ (যেমন বর্তমান ভারতের ‘হিন্দুত্ব’ আন্দোলন) ইসলামকে ‘বিদেশি’ বলে আখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে, তাঁদের ভাষ্যমতে, আরব ও পারস্যের মুসলিমদের বহিরাক্রমণের কারণেই এখানে ইসলামের প্রবেশ ঘটে ও বিস্তার লাভ করে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা এরকম নয়। আমি মনে করি এগুলি ধাপে ধাপেই হয়েছে নানা ধারায়। যেমন –(১) মুসলিম শাসকের প্রতি আনুগত্যের ফলে ধর্মান্তর, (২) বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ধর্মান্তর, (৩) ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ধর্মান্তর, (৪) বিবাহ সূত্রে ধর্মান্তর, (৫) ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতা করে ধর্মান্তর, (৬) সুফিদের প্রভাবে ধর্মান্তর।
(১) মুসলিম শাসকের প্রতি আনুগত্যের ফলে ধর্মান্তর : ভারতে যেখানে স্থানীয় অ-মুসলিম রাজারা অত্যন্ত অত্যাচারী ছিলেন, সেখানে অনেক মুসলিম শাসক তাঁদের ক্ষমতাচ্যুত করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সুশাসন দিয়েছিলেন। যেসব সুলতানরা ভারতের স্থানীয় রাজাদের মুণ্ডু কেটে তুরস্কে পাঠিয়েছিলেন, সেইসব রাজারাই আবার অ-মুসলিম সাধারণ মানুষদের কাছে ‘রবিনহুড’। এইসব অ-মুসলিম সাধারণের অনেকেই মনে করতেন শাসকের ধর্মই তাঁর ধর্মা।
(২) বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ধর্মান্তর : বলপ্রয়োগ তাঁরাই করেন যে বা যাঁরা পরধর্মে অসহিষ্ণু যে বা যাঁরা পরধর্মকে হেয় করে নিজধর্মকে একমাত্র ধর্ম ধারণা পোষণ করেন। এঁরা সংখ্যায় নগণ্য হলেও কতিপয় এই বলপ্রয়োগকারীরা মনে করেন তামাম দুনিয়ায় ইসলাম ধর্ম ছাড়া আর কোনো ধর্মের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। ভুল ধর্মশিক্ষার কারণে এঁরা মনে করে কাফেররা হত্যার যোগ্য— হয় মুসলিম হও, নয় মরো। তাঁরা মনে করে, মালাউন তথা মূর্তিপূজকরা পাপী –এদের অবস্থান দোজখে। অতীতে বলপ্রয়োগে কোথাও কোথাও ধর্মান্তর নিশ্চয় হয়েছে, তার মানে এই নয় যে সমস্ত অ-মুসলিমদের বলপ্রয়োগের মাধ্যমেই ধর্মান্তর করা হয়েছে। এটা বললে সত্যের অপলাপ হয়। যদি বলপ্রয়োগ করে ধর্মান্তর করা হত তাহলে ভারতে একটিও অমুসলিম থাকত না। আমি বলছি না, বলছেন যুক্তরাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবী ও ভাষাতাত্ত্বিক শেলডন পোলক। তিনি বলছেন –“মুসলিম শাসকরা জোর করে ধর্মান্তরিত করালে ভারতে একজনও হিন্দু থাকত না। পোলককে প্রশ্ন করা হয়, অনেকে বলেন ইসলামি আক্রমণের পর সংস্কৃতের পতন হল, শাসকের দাপটে সবাই উর্দু, ফারসি শিখতে ছুটল। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন –“বাজে কথা। বাংলার নবদ্বীপ বা মিথিলায় সংস্কৃত ন্যায়চর্চা হয়েছে সুলতানি আমলেই। দারাশিকো বেদান্ত পড়েছেন বারাণসীর পণ্ডিতদের কাছে। মুসলিম শাসকরা ভারতে প্রায় বারোশো বছর রাজত্ব করেছিলেন। তাঁদের উৎসাহ না-থাকলে সংস্কৃত টিকে থাকত না। ধর্মের সঙ্গে ভাষার উত্থান-পতন গুলিয়ে তাই লাভ নেই।” শেলডন পোলকের ধর্ম-পরিচয় ইহুদি ব্রাহ্মণ।
অনেক হিন্দুত্ববাদীদের বলতে শুনেছি– সেদিন পলাশির প্রান্তরে সিরাজকে খতম করতে না-পারলে সারা ভারত ‘দার-উল-ইসলাম (ইসলামি দেশ)-এ পরিণত হত। শতশত বছর ধরে দোর্দণ্ডপ্রতাপ সুলতান-বাদশা নবাব-সম্রাটরা যা পারেনি, তা সিরাজ বা পরবর্তী মুসলিম শাসকরা পারত! কোন্ অঙ্কে? আমি বলি –অত ক্ষমতা পৃথিবীর কোনো ধর্মের এখনও হয়নি, যে ধর্ম অন্য ধর্মগুলিকে পৃথিবী থেকে ভ্যানিশ করে দিতে পারে। এমন ক্ষমতা হয়নি যে পৃথিবীর সব ধর্মকে গিলে খেয়ে কোনো একটা ধর্মের ছাতার তলায় সমস্ত মানুষ আশ্রয় নিতে বাধ্য করবে। অতীতে যেমন হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। প্রতিটি ধর্মেরই নিজস্ব শক্তি থাকে, সেই শক্তিকে উপড়ে দিয়ে অন্য ধর্মে টানা নিয়ে যাওয়া না। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে কতিপয় মানুষের ধর্মান্তর সম্ভব। নিশ্চয়, সকল জাতিকে নয়। অন্য ধর্মের মানুষ নিজধর্মে আনাতে এক ধরনের সুখ অনুভব করে। এঁরা নগণ্য হলেও এরকম অত্যুৎসাহী মানুষ তো সব ধর্মেই থাকে।
(৩) ইসলাম ধর্মে আকৃষ্ট হয়ে ধর্মান্তর : যে-কোনো ধর্মের কিছু যেমন মন্দের দিক থাকে, তেমনই ভালো দিকও থাকে প্রচুর। ভালো দিকগুলোই মানুষের জীবনদর্শন হয়। আর মন্দ দিকগুলো শয়তানের জীবনদর্শন। যে যেমন সে তেমন দিকই দেখতে পায়। কোনো সৎ ধর্মগুরুই ধর্মের মন্দ দিকগুলি সাধারণত উন্মোচন করে না। বরং ভালো দিকগুলিই বারবার সামনে নিয়ে আসেন তাঁরা। তা ছাড়া কোনো মানুষের মানবিকতা ও ভালো কর্মও ধর্মচিন্তার প্রতিনিধিত্ব করে। তেমনই ইসলামের ভালো দিকগুলিতে আকৃষ্ট হয়ে স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হয়েছে মানুষ এমন উদাহরণ অনেক। আবার ধর্মান্তরের পরে মন্দ দিকগুলির মুখোমুখি হয়ে নিজের পূর্ব ধর্মে ফিরে আসাও কম ঘটেনি। সাধারণ মানুষ তো বটেই, বহু বিখ্যাত মানুষও স্বেচ্ছায় স্বধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্মে কনভার্ট হয়েছেন। যে রাস্তা খ্রিস্ট বা বৌদ্ধ বা ইসলাম ধর্মে আছে, সেই রাস্তা হিন্দুধর্মে নেই। যাঁরা ধর্ম গ্রহণ বা ত্যাগ করেছেন তাঁদেরকে তো বোকা বলা যায় না। কয়েকজনের নাম এখানে উল্লেখ করতে পারি। আফ্রিকা মহাদেশের উগান্ডার বিখ্যাত পণ্ডিত এবং খ্রিস্টানধর্ম প্রচারক রেভারেন্ড পল ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। মুর্শিদকুলি খাঁ পূর্বে হিন্দু ব্রাহ্মণ ছিলেন। মার্কিন মুষ্ঠিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলি, আমেরিকান হেভিওয়েট বক্সিং চ্যাম্পিয়ন মাইক টাইসন, আমেরিকান অবসরপ্রাপ্ত বাস্কেটবল প্লেয়ার, কোচ, অভিনেতা, এবং লেখক কারিম আব্দুল-জব্বার, এমি পুরস্কার প্রাপ্ত সাবেক আমেরিকান ফুটবলার আহমদ রুশদি, ফ্রান্সের সাবেক বাস্কেটবল প্লেয়ার তারিক আব্দুল ওয়াহিদ (অলিভিয়ের সেন্ট জাঁ), পাকিস্তানের ক্রিকেটার মোহম্মদ ইউসুফ (ইউসুফ ইউহানা), আমেরিকান বাস্কেটবল প্লেয়ার রাশিদ ওয়ালেস, ফ্রান্সের সম্রাট ও ইতালির রাজা নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, আফ্রিকান-মার্কিন মুসলিম রাজনীতিবিদ ও ধর্মীয় নেতা ম্যালকম এক্স, ইতালীয় রাষ্ট্রদূত এবং অবসরপ্রাপ্ত ইতালীয় কূটনীতিক মারিও স্কিয়ালোজা, মাইকেল জ্যাকসনের ছোট বোন জ্যানেট জ্যাকসন, ভারতীয় সুরকার-গায়ক-গীতিকার-সঙ্গীতপ্রযোজক-সঙ্গীতজ্ঞ এ আর রাহমান (ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার আগে তার নাম ছিল দিলীপ কুমার) প্রমুখ প্রখ্যাত ব্যক্তিরা ইসলাম ধর্মে কনভার্ট হয়েছেন (এ তথ্য-তালিকা অসম্পূর্ণ)। এইভাবে পৃথিবীতে গড়ে প্রতি বছর প্রায় ২৮৮৩,০১১ জন অমুসলিম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। তার মধ্যে অগণিত সংখ্যক বিখ্যাত মানুষ আছেন, যাঁরা তাঁদের কর্মের দ্বারা সুপরিচিত।
(৪) বিবাহ সূত্রে ধর্মান্তর : কোনো হিন্দু ছেলে কোনো মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করলে মুসলমান সমাজে যতটা তুলকালাম হয়, ততটা হয় না যদি কোনো মুসলিম ছেলে কোনো হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করে। এমন স্ববিরোধ কেন? কারণ ইসলাম মতে কোনো অ-মুসলমান মেয়ে কোনো মুসলিমকে ছেলেকে বিয়ে করে তাহলে মেয়েটিকে স্বধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে হবে। বিধর্মী হয়ে মুসলমান পরিবারে অবস্থান করা সম্ভব নয়। অপরদিকে কোনো মুসলিম মেয়ে যদি কোনো অমুসলিম ছেলেকে বিয়ে করে সেই মেয়েটি হিন্দু হয়ে যায়। অতএব নৈব নৈব চ। লেখিকা মিনা সাহা ফারাহ্ তাঁর কাঠগড়ায় ঈশ্বর’ গ্রন্থে লিখেছেন– “..সবক্ষেত্রেই দেখা যায় মেয়েদেরকেই ধর্মান্তরিত হতে হয়। হিন্দু এবং মুসলিমদের মিশ্র বিয়েটা একটু বেশি উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন কারণে। শতকরা একশত ভাগ ক্ষেত্রেই অপরপক্ষকে মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে হয়। সাধারণত বিয়ের আগে ঘটা করে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ, নামাজ পড়া এসব শেখানো হয়। এ ধরনের একটি বিয়েতে আমি গিয়েছিলাম। মেয়েটি ছিল আমার ক্লাসমেট। মনে আছে সে যখন মুসলিম ধর্মে রূপান্তরিত হতে গিয়ে সুরা পড়ছিল তখন তাঁর দু-চোখ বেয়ে গড়াচ্ছিল আবেগের অশ্রু। গোরুর মাংস মুখে পুড়ে দেওয়ামাত্র সে তা উগড়ে দিচ্ছিল। কিন্তু তাতেও কি দমেছিল সমাজের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষগুলো! মেয়েটির নাম ছিল কল্পনা চক্রবর্তী। ওরা স্বামীর নামের সঙ্গে মিলিয়ে ওর নাম দিয়েছিল কল্পনা রহমান। যা লক্ষ করেছি তা হল হিন্দু মেয়েরা খুব সহজেই ধর্মান্তরিত হয়ে যায়। সহজেই তাঁরা জন্মগতভাবে মুসলমানের চেয়েও অধিক মুসলমান হয়ে পড়ে। নামাজ, রোজা, ধর্মকর্মে অধিক মন দেয়।… ধর্মান্তরিত হিন্দু মেয়েদের সন্তানদের পরিচয় হয় পিতৃ পরিচয়ে। হারিয়ে যায় একটি ইতিহাস।” বিবাহ সূত্রে কম হিন্দু মেয়ে মুসলিম হয়ে যায়নি। বহু যুগ ধরে চলে আসছে। সাধারণত মেয়েরা ধর্ম-পরিচয়ের চেয়ে বেশি আকৃষ্ট হয় অন্য কিছু বিষয়ে। তাই শর্মিলা ঠাকুর মনসুর আলি পটৌদিকে বিয়ে করে, সৈফ আলিকে বিয়ে করে অমৃত সিং ও করিনা কাপুর, আজহারউদ্দিনকে বিয়ে করে সঙ্গীতা বিজলানি, রীনা রায় বিয়ে করে মহসিন খানকে ইত্যাদি। বিরল ঘটনা হলেও মুসলিম মেয়েরাও হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করে ধর্মান্তরিত হয়। হাতে গরম চলচ্চিত্রাভিনেত্রী নুসরত জাহান হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করে শাঁখা-সিন্দুর পরে হিন্দু হতে হয়েছে। হিন্দু ধর্মমতেই বিয়ে হয়েছে।
(৫) ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতা করে ধর্মান্তর : প্রাক-ইসলামিক যুগে ভারত উপমহাদেশের সমাজের কাঠামোর ভিত্তি ছিল বর্ণপ্রথা, যার মাধ্যমে সমাজ কয়েক অংশে বিভক্ত ছিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্ত্যজ বর্ণের ইসলাম গ্রহণ করে। এর পিছনে বিভিন্ন কারণও ছিল। বর্ণপ্রথার বৈষম্যের চেয়ে ইসলাম সমাজে যে সমতা এনেছিল তা মানুষের কাছে বেশি আকর্ষণীয় ছিল। বর্ণপ্রথায় মানুষের অবস্থান নির্ণয় হয় জন্মের মাধ্যমে। সমাজে সক্রিয় অবদান রাখা তো দূরের কথা, এমনকি পিতা-মাতার যতটুকু অর্জন করেছে তার চেয়ে বেশি অর্জন করাই সম্ভব ছিল না। ইসলাম এসে মানুষকে সমান করার সুযোগ করে দেয় (মুসলিম সমাজে তাঁরা কতটা সমাদৃত হয়েছে সেটা নিয়ে কেউ বিতর্ক করতেই পারেন, তবে তাঁরা যে হিন্দুসমাজে পূর্বের তুলনায় সবচেয়ে ঘৃণিত বা স্লেচ্ছ হল, এটা বলাই বাহুল্য), তবে ব্রাহ্মণবাদের অভিশাপ থেকে মুক্তি দেয়।
ভারতে ব্রাহ্মণ্যশক্তি বৌদ্ধদের উপর এত বেশি অত্যাচার করত, যা অত্যন্ত নৃশংস ও অমানবিক ছিল। বৌদ্ধরা মাথা মুণ্ডন করতেন বা নেড়া হতেন। অত্যাচারের সীমা ছাড়িয়ে বৌদ্ধরাও দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। বৌদ্ধরা নেড়া হতেন বলে তাঁদেরকে ব্যঙ্গ করে নেড়ে’ বা ‘লেড়ে’ বলা হত। তাই মুসলমানদেরও কোনো কোনো অশিক্ষিত হিন্দু ‘লেড়ে’ সম্বোধন করে থাকে। শুধু বৌদ্ধই নয়, জৈনরাও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অত্যাচারে মুসলিম হয়েছিলেন। বৌদ্ধদের মতো দক্ষিণ ভারতের জৈনরাও রক্ষণশীল শৈব হিন্দুদের হাতে চরমভাবে নিপীড়িত হয় এবং একবার একদিনে ৮০০০ (?) জৈনকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করার কথা তামিল পুরাণে পাওয়া যায়।
অতীতকে মুছে ফেলা যায় না। অতীতের অভিজ্ঞতা দিয়েই বর্তমান নির্মাণ হয়, বর্তমানের অভিজ্ঞতা দিয়েই ভবিষ্যত নির্মাণ হয়। যা কিছু ঘটেছে, যা কিছু ঘটছে, যা কিছু ঘটবে –তার কোনো কিছুই হঠাৎ আকাশ থেকে পড়ে না। সবই আমাদের অর্জিত। আসুন, একটু বিস্তারিত বলি। সাধারণ হিন্দুরা মনে করেন, কলি যুগে কল্কি পৃথিবীতে অবতীর্ণ হবেন এবং সকল অন্যায়, অনাচার দূর করার জন্য। কিন্তু তারা কি জানেন, কল্কিপুরাণ অনুসারে, কল্কির অবতার পৃথিবীতে অবতরণের একটি মুখ্য উদ্দেশ্য হল বৌদ্ধদের ধ্বংস করা? কল্কিপুরাণে কলিবংশের নানা পাপচারের বিবরণ দিতে গিয়ে বলা হচ্ছে, “এদের মধ্যে ব্রাহ্মণেরা শূদ্র সেবাপরায়ণ’, ‘তাঁরা ধর্ম নিন্দুক’, ‘এরা বেদ বর্জিত’ (১), এরা বর্ণ সঙ্করকারক’ (২), মঠ নিবাসী’, তারা সবসময় নীচদের সাথেই মেলামেশা করতে চায়’ (৩)। মঠ নিবাসী’ শব্দে এখানে বৌদ্ধদের কথাই বলা হচ্ছে। সে কথায় পরে আসছি। কলিযুগে কী কী হবে কল্কিপুরাণে উল্লিখিত ভবিষ্যত্বাণী থেকে জেনে নিই। কল্কিপুরাণ বলছে— এই সময় শূদ্রেরা প্রতিগ্ৰহপরায়ণ হবে অর্থাৎ অন্যের দান গ্রহণ করবে এবং পরস্বাপহারী হবে অর্থাৎ অন্যের ধন অপহরণ করবে। (৪) এই কালে বর-কনের পরস্পর স্বীকারমাত্রই বিবাহ সম্পন্ন হয়ে যাবে। (৪) ব্রাহ্মণেরা রান্নলোলুপ হবে। তাঁরা চণ্ডালের পুরোহিত হতেও অস্বীকার করবে না (৫) স্ত্রীলোক আর বিধবা হবে না। তাঁরা স্বেচ্ছাচারিণী হবে।(৫) কলির তৃতীয় পদে বর্ণ সঙ্কর হতে থাকবে। (৬) কলির চতুর্থ পাদে সকলে একবর্ণ হবে। (৭) কল্কিকে শিক্ষাদান শেষে তাঁর গুরু পরশুরাম তাঁকে বলেন— “তুমি দিগ্বিজয় করতে বের হয়ে ধর্ম বিবর্জিত কলিপ্রিয় রাজাদের পরাস্ত করে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সংহার করে দেবাপি ও মরু নামক দুই ধার্মিককে রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করবে”।(৮) কল্কির স্তব করতে গিয়ে রাজারা কল্কিকে বলেন— “এখন আপনি কলিকুল ধ্বংস করার জন্য এবং বৌদ্ধ,পাষণ্ড,ম্লেচ্ছ প্রভৃতিকে শাসনের জন্য কল্কি রূপে অবতীর্ণ হয়ে বৈদিক ধর্মরূপ সেতু রক্ষা করছেন।” (৯) সুতরাং কল্কি যে আসলে বৌদ্ধদের ধ্বংস করার জন্যই আসবেন, এটা একদম পরিষ্কার হয়ে গেল। বাস্তবেও বৌদ্ধরাও ভারত থেকে প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে।
যাই হোক, নির্দেশ শ্রবণ করে কল্কি তাঁর উদ্দেশ্য পূরণের জন্য অর্থাৎ বৌদ্ধদের ধ্বংস করার জন্য বেরিয়ে পড়লেন। গন্তব্য কীটপুর, যেখানে অসংখ্য বৌদ্ধদের বাস। কল্কিপুরাণ থেকে সরাসরি উদ্ধৃতি দেওয়া যাক— “পরে তিনি (কল্কি) সেনাসমূহে পরিবৃত্ত হয়ে প্রথমত কীটপুর (জয় করার জন্য) বহির্গত হলেন।(১০) এই কীটপুর অতীব বিস্তীর্ণ নগর। এটা বৌদ্ধদের প্রধান বাসস্থল। এই দেশে বৈদিক ধর্মের অনুষ্ঠান নেই। এখানকার লোকেরা পিতৃ অর্চনা বা দেব অর্চনা করে না এবং পরলোকের ভয়ও করে না। (১১) এই দেশের অনেকেই শরীরে আত্মাভিমান করে। তাঁরা দৃশ্যমান শরীর ছাড়া অন্য আত্মা স্বীকার করে না। তাঁদের কুলাভিমান বা জাত্যাভিমান কিছুমাত্র নেই। তাঁরা ধনবিষয়ে, স্ত্রীপরিগ্রহ বিষয়ে বা ভোজন বিষয়ে সকলকে সমান জ্ঞান করে, কাউকেও উঁচু-নীচু মনে করে না।”(১২) কল্কির সঙ্গে বৌদ্ধদের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বর্ণনা কল্কিপুরাণে আছে, যেখানে বৌদ্ধদের পরাজিত করে বৌদ্ধধর্মের ধ্বংস সাধন করা হবে। যুদ্ধের বিবরণে বৌদ্ধদের এক সেনাপতির নাম দেখা যায় ‘জিন’। জৈন তীর্থঙ্করেরাই কিন্তু ‘জিন’ নামে সমধিক পরিচিত। কীকটপুরে উপস্থিত হয়ে কল্কি বৌদ্ধদের আক্রমণ করেন। উল্লেখ্য পুরাণের ভাষায়— “… এরপর সিংহ যেমন হাতিকে আক্রমণ করে, তেমনি পাপাপহারী সর্ববিজয়ী বিষ্ণু কল্কি, সেই বৌদ্ধ সেনাকে আক্রমণ করলেন।”(১৩) কল্কির তীব্র আক্রমণে বৌদ্ধ সৈন্যেরা পলায়ণে উদ্যত হলে কল্কি বলে ওঠেন— “ওরে বৌদ্ধরা! তোমরা রণাঙ্গন হতে পলায়ণ করো না, নিবৃত্ত হও, যুদ্ধ করো, তোমাদের যতদূর ক্ষমতা আছে, তা দেখাতে ভুলে যেও না।”(১৪)
বৌদ্ধদের সঙ্গে ব্রাহ্মণ্যবাদী কল্কির যুদ্ধের বিবরণ— “মহাশক্তি কল্কি তুরঙ্গম ও শূলব্যথা পরিহার পূর্বক সংগ্রাম ভূমিতে অবতীর্ণ হয়ে লাফ দ্বারা, ভ্রমণ দ্বারা, পদাঘাত দ্বারা, দন্তাঘাত দ্বারা, কেশর বিক্ষেপ দ্বারা বৌদ্ধসেনাদের শত শত সহস্র সহস্র বিপক্ষকে ক্রোধভরে বিনাশ করলেন। কোনো কোনো যোদ্ধা (উক্ত ভীষণ তুরগের) নিঃশ্বাস বায়ু দ্বারা উড়তে উড়তে অন্য দ্বীপে পতিত হল, কেউ-বা ওই নিঃশ্বাসবায়ু দ্বারা প্রক্ষিপ্ত হওয়ামাত্র হাতি, ঘোড়া, রথ প্রভৃতিতে প্রতিহত হয়ে অন্য দ্বীপে গিয়ে পড়ল, কেউ-বা ওই নিঃশ্বাসবায়ু দ্বারা প্রক্ষিপ্ত হওয়ামাত্র হাতি, ঘোড়া, রথ প্রভৃতিতে প্রতিহত হয়ে রণভূমিতেই পতিত হতে লাগল। গর্গ ও তাঁর অনুচরেরা অল্প সময়ের মধ্যে ৬০০০ বৌদ্ধসেনা বিনাশ করলেন। সসৈন্য ভর্গও এক কোটি এক নিযুত সৈন্য সংহার করেন। বিশাল ও তাঁর সেনারা ২৫,০০০ বৌদ্ধসেনাকে পরাজিত করেন। কবি সংগ্রামে প্রবৃত্ত হয়ে দুই পুত্রের সাহায্যে দুই অযুত বিপক্ষসেনার সংহার করেন। এভাবে প্রাজ্ঞ ১০ লক্ষ ও সুমন্ত্রক ৫ লক্ষ সৈন্যকে পরাজিত করে রণশায়ী করেন। এরপর কলি হাসতে হাসতে জিনকে বলেন, ওরে দুর্মতি! পালিয়ে যেও না, সামনে এসো। সর্বত্র শুভাশুভ ফলদাতা অদৃষ্ট স্বরূপ আমাকে বিবেচনা করবে। তুমি এখনই আমার শরনিকরদ্বারা বিদীর্ণদেহ হয়ে পরলোকে গমন করবে, সেসময় কেউই তোমার সঙ্গে যাবে না। অতএব তুমি বন্ধু-বান্ধবদের সুন্দর মুখ দেখে নাও।” (১৫) এরপর যুদ্ধে কল্কি বৌদ্ধ সেনাপতি জিনকে হত্যা করেন— “এরপর পাগল হাতি যেমন তালগাছ ভঙ্গ করে, তেমনই মহাযোদ্ধা কল্কি পদাঘাত দ্বারা জিনের কটিদেশ ভঙ্গ করে তাঁকে মাটিতে ফেলেন। বৌদ্ধ সেনারা জিনকে (রণভূমিতে) পতিত দেখে হা! হা! শব্দে চিৎকার করতে লাগল। ব্রাহ্মণগণ! শত্রু নিপাত হওয়াতে কল্কির সেনাদের আর আত্মাদের পরিসীমা রইল না।”(১৬)
এরপর অবশিষ্ট বৌদ্ধ সৈন্যদেরও হত্যা করা হয়। বৌদ্ধদের পরাজয়ে দেবতারা প্রীত হন— “(ধর্ম নিন্দুক গণ পরাস্ত হওয়াতে) পুনরায় যজ্ঞের আগুনে আহুতি দেওয়া হবে ভেবে দেবতারা পরম প্রীত হলেন।” (১৭) বৌদ্ধসেনারা নিহত হলে, তাঁদের স্ত্রীরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করতে উপস্থিত হন। বৌদ্ধদের স্ত্রীদের দেখে কল্কি যে ভাষার প্রয়োগ করেন, তাতে তাঁকে লম্পট ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় না। কল্কি বলছেন— “অবলারা! আমি তোমাদের হিত ও উত্তম বাক্য বলছি, শ্রবণ করো। নারীদের সঙ্গে পুরুষদের যুদ্ধ করতে নেই। তোমাদের এই চাঁদের মতো মুখে অলকরাজি শোভা বিস্তার করছে। এটা দেখে সকলেরই মনে আনন্দ হয়। এখন কোনো পুরুষ এই মুখে প্রহার করবে? এই মুখচন্দ্রে দীর্ঘাপাঙ্গ বিশিষ্ট প্রফুল্ল কমল সদৃশ নয়নে তাঁরা রূপভ্রমর ভ্রমণ করছে। কোনো পুরুষ এমন মুখে প্রহার করবে? তোমাদের এই স্তন দুটির উপর থাকা হার শিবের গলায় থাকা সাপের মতো শোভা পাচ্ছে। এসব দেখে কামদেবের দর্পও চূর্ণ হয়, অতএব কোনো পুরুষ এমন স্থানে প্রহার করতে পারবে? চঞ্চল অলোকরূপ চকোর দ্বারা যাঁহার চন্দ্রিকা আক্রান্ত হইয়াছে, এমন কলঙ্ক হীন মুখচন্দ্রে কোন পুরুষ প্রহার করতে সমর্থ হবে? তোমাদের এই স্তনভারাক্রান্ত নিতান্ত ক্ষীণ সূক্ষ্ম-লোম-রাজি বিরাজিত এই মধ্যদেশে কোন্ পুরুষ প্রহার করতে সমর্থ হবে? তোমাদের এই নয়নানন্দদায়ক অংশুক সমাচ্ছাদিত দোষ-স্পর্শ পরিশূন্য পরম রমণীর সুঘন জঘনে কোন্ পুরুষ বাণাঘাত করতে সমর্থ হবে?”(১৮)
কল্কির বৌদ্ধ-স্লেচ্ছদের হত্যা ও পরাজিত করার পর কল্কি পুরাণে বলা হচ্ছে— “যাঁরা এই ম্লেচ্ছজয় ও বৌদ্ধবিনাশের বিষয় আদরপূর্বক কীর্তন বা শ্রবণ করবেন, তাঁদের সকল দুঃখ দূর হবে। তাঁরা সর্বদা কল্যাণভাজন হবেন। মাধবের প্রতি তাঁদের ভক্তি জন্মাবে। সুতরাং তাঁদের পুনরায় জন্ম বা মৃত্যু হবে না। এই বিষয় শ্রবণ দ্বারা সমুদায় সম্পত্তি লাভ হয়, মায়ামোহ নিরাকৃত হয়ে যায়, সংসারের তাপ আর সহ্য করতে হয় না।”(১৯) (কল্কি পুরাণ— জগন্মোহন তর্কালংকার কর্তৃক অনূদিত) ব্রাহ্মণ্যবাদী কর্তৃক বৌদ্ধনিধনের বীজ কোথায় লুকিয়ে ছিল এবার নিশ্চয় বুঝলেন। সেই বীজ ক্রমশ মহিরুহ হয়ে ভারত থেকে আজ বৌদ্ধ নিমূল। এমনি বৌদ্ধদের মন্দিরগুলো পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাদীরা কোনোটা ধ্বংস করেছে, আবার কোনোটা রূপান্তর করেছে –তিরুপতি থেকে পুরীর মন্দির এগুলো সবই বৌদ্ধদের ছিল, আজ হিন্দুদের দখলে। বৌদ্ধদের যদি কোনোদিন পুনরুত্থান হয়, তখন নিশ্চয় তাঁদের মন্দিরগুলি ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হবে। স্মর্তব্য, বৌদ্ধদের একজনও কিন্তু বিদেশি ছিলেন না, সকলেই ভারতীয়। বৌদ্ধধর্ম হিন্দুধর্মের চেয়েও প্রাচীন ধর্ম, বৈদিক যুগের ধর্ম। বৌদ্ধ কর্তৃক রচিত দশরথ জাতক’-ই আদি রামকথা, বাল্মীকির রামায়ণ নয়।
ভীমরাও রামজি আম্বেদকর হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। কেন? তাঁর বুকে কে তলোয়ার ধরেছিল? তিনি কেবল বৌদ্ধ ধর্মে ধর্মান্তরিত হননি এবং লাখো অস্পৃশ্যদের থেরবাদী বৌদ্ধধর্মে (Theravada Buddhism) স্ফুলিঙ্গের মতো রূপান্তরিত করে খ্যাত হয়েছিলেন। ১৯২৭ সালে আম্বেদকর অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি গণ-আন্দোলন শুরু করেন এবং সুপেয় জলের উৎস দানে সংগ্রাম চালিয়ে যান (উল্লেখ্য সে সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দিরে নিম্নবর্ণের প্রবেশের অধিকার ছিল না)। মহদে সত্যাগ্রহ নামের অস্পৃশ্যদের (অন্ত্যজ জাতির) জন্য সংগ্রাম করে সুপেয় জলের পানের অধিকার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৩৫ সালে ১৩ অক্টোবর নাসিকের কাছে ঈওলার বৈঠকে বক্তব্যে আম্বেদকর তার ভিন্ন ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার অভিপ্রায় ঘোষণা করেন এবং তার অনুগতদেরও হিন্দুধর্ম ত্যাগে প্রণোদিত করেন। সমগ্র ভারতের অনেকগুলো জনসভায় তিনি তার আহবান পুনর্ব্যক্ত করেন। শ্রীলঙ্কার জনৈক ভিক্ষু হামমালা সাদ্ধতিষ্যের সঙ্গে সাক্ষাতের পর, আম্বেদকর নিজের ও অনুসারীদের জন্য নাগপুরে ১৪ অক্টোবর ১৯৫৬ সালে একটি অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। ঐতিহ্যবাহী প্রথায় বৌদ্ধভিক্ষুর কাছ থেকে ত্রিশরণ (Three Refuges) ও পঞ্চশীল (Five Precepts) গ্রহণের মাধ্যমে তিনি তাঁর ধর্মান্তরিতের কাজ সম্পন্ন করেন। তারপর তিনি তাঁর সহযোগীদের (সংখ্যায় ৫ লাখের মতো) যাঁরা তাঁর পাশে ছিলেন, সবাইকে তিনি ধর্মান্তরিত করান। (In the 1950s’— Frances Pritchett) নিজেদের ধর্মাবলম্বীদের ধরে রাখতে না পারলে অন্যদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়ে নিজধর্ম রক্ষা পাবে? হিন্দুদের মতো এত পরিমাণে ধর্মান্তরিত বোধহয় আর কোনো ধর্মে হয় না। প্রশ্ন করুন, উত্তর খুঁজুন।
তুর্কিদের তুলনায় আরবরা অনেক বেশি সুসভ্য ও মানবিক ছিল বলে মনে করা হয়। মূর্তিভঙ্গের মাধ্যমে স্থানীয় অধিবাসীদের এটাই বোঝানো হত যে, বিদেশিরা অনেক বেশি পরাক্রান্ত। শুরুতে মুসলিম সম্প্রদায় দেশের সমগ্র জনসংখ্যার সামান্য ভগ্নাংশ মাত্র। উচ্চশ্রেণির মুসলিমরা নিজেদের খুব নিরাপদ মনে করত না। ধর্মান্তরিত মুসলিমরা ছিল প্রধানত নিন্মবর্ণের হিন্দু। নিন্মবর্ণের হিন্দুরা ভেবেছিলেন ইসলাম ধর্মে তাঁদের অবস্থার উন্নতি হবে। এঁরা অভিজাত মুসলিমদের বিশেষ সাহায্য বা ভরসা দিতে পারেনি। উচ্চবর্ণের যেসব হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল তাঁরা কদাচিৎ ধর্মবিশ্বাসে অনুপ্রাণিত হয়ে ধর্মান্তরিত হয়েছিল। এঁরা অধিকাংশই ছিলেন সুযোগসন্ধানী। রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার আশায় ধর্মান্তরিত হতেন। তুর্কিরা এঁদেরকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। গোঁড়া হিন্দু ও গোঁড়া মুসলিমরা একে অপরের ধর্মের প্রভাব বরদাস্ত করত না। মুসলিমরা হিন্দুদের শাসন করত বটে, কিন্তু হিন্দুরা মুসলমানদের ‘বর্বর’ বলে চিহ্নিত করত। নানা কারণে যেসব হিন্দুরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল তাঁদের অনেকেই পরে আবার হিন্দুধর্ম গ্রহণ করে। কিন্তু বজ্র আটুনি ফস্কা গেরো। ক্রমে ক্রমে হিন্দুধর্মে প্রত্যাবর্তনের পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। পক্ষান্তরে ইসলাম গ্রহণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেমন বলপূর্বক বাধ্য করা হয়েছিল, তেমনই ইসলাম দুই বাহু প্রসারিত করে ভারতীয় তথা অন্য ধর্মাবলম্বীদের আপন বক্ষে আমন্ত্রণও জানিয়েছিল।
উপমহাদেশের এককালের জনপ্রিয় ধর্ম ছিল বৌদ্ধধর্ম। মুসলিম শাসনামলে এসে ধর্মটি প্রায়-বিলুপ্ত হয়ে যেতে থাকে। উপমহাদেশের মানুষ সাধারণত বর্ণপ্রথা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য প্রথমদিকে কোনো বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করত। যখন ইসলাম তাঁদের কাছে আরও এক বিকল্প হিসাবে মনে হল। তাঁরা বৌদ্ধধর্মের পরিবর্তে ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ল। কিন্তু বর্ণপ্রথা ত্যাগের ব্যাপারটা যথারীতি চলছিলই। মুসলিম শাসকদের আগ্রাসনে উপমহাদেশে বৌদ্ধধর্ম ধ্বংস হয়ে গিয়েছে বলে যে জনশ্রুতি আছে, তা আংশিক মিথ্যে। মুসলিম শাসনামলে বৌদ্ধদের ধর্ম পালনে কোনো রকম বাধা দেওয়া হয়নি একথা বলা যায় না। বস্তুত ভারত উপমহাদেশ থেকে বৌদ্ধধর্ম নিশ্চিহ্ন হয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের সুচতুর কৌশল ও অত্যাচারের কারণে।
হিন্দু থেকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরণ ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদের ভাষা হিসাবে উদ্ভূত হয়েছিল একটা সময়। দেশের বিভিন্ন অংশে দলিতরা, কখনো ব্যক্তি হিসাবে, আবার কখনো গোষ্ঠী হিসাবে অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার ভিতর দিয়ে মুক্তির রাস্তা খুঁজেছেন। কখনো অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত ধর্ম, যেমন– খ্রিস্টধর্ম, ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছেন। ব্রাহ্মণ্যবাদ থেকে মুক্তি পেতে যেসব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম সবচেয়ে বেশি ধর্মান্তরণ ঘটেছে, সেগুলি হল– খ্রিস্টধর্ম, ইসলাম ধর্ম এবং বৌদ্ধধর্ম। তবে বৌদ্ধধর্ম থেকে অনেকেই পূর্ব ফিরে এসেছিল। বৌদ্ধরা ধর্মান্তরিতদের ধরে রাখতে পারেনি। ভারতে প্রথম স্টেট স্পসনৰ্ড রায়ট হয় অন্নপূর্ণা পুজোর দিন, ১৯০২ সালে। বরিশালে নবাব সলিমুল্লা ও লর্ড কার্জন উপস্থিত। পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকে এবং রায়ট করা হয়। তখন স্বামী বিবেকানন্দ বেঁচে আছেন। সে সময় বিবেকানন্দ বললেন –“এরা ধর্ম ছাড়ল বন্দুকের ভয়ে নয়, তলোয়ারের ভয়ে নয়, আমাদের ভালোবাসার অভাবে। ভালোবাসার অভাবে আমাদের এতগুলো মানুষ চলে গেল।”
কালপঞ্জী অনুযায়ী এই ধর্মান্তরণগুলির তিনটি পর্যায় আছে— (১) প্রাক-ব্রিটিশ কাল, (২) ব্রিটিশ রাজত্বের কাল এবং (৩) স্বাধীনতা-পরবর্তী কাল।
(১) প্রাক-ব্রিটিশ কাল : এ সময় ব্রাহ্মণ্যধর্ম থেকে জৈন ও বৌদ্ধধর্মে ধর্মান্তর ঘটেছে। তারপর ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান, সুফি মতবাদ ও রাজনৈতিক যোগসূত্রের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরণ ঘটেছে। এই সময়কালে দক্ষিণ ভারতের কেরলে ও গোয়ায় খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরণ হয়েছে। হ্যাঁভেল সাহেব ইসলামের প্রসারের কথা বলতে গিয়ে তিনি চমকপ্রদভাবে বলেছেন– “যাঁরাই ইসলামকে গ্রহণ করল আইনত তারাই পেল মুসলমান রাজার সবরকম অধিকার। আদালতে সব মামলার নিষ্পত্তি হত আর্য আইনকানুন দিয়ে নয়, কোরানের বিধি দিয়ে। এইভাবে ধর্মান্তরিত করার পদ্ধতি নিম্নশ্রেণির হিন্দুদের মধ্যে বিশেষত যেসব অস্পৃশ্যজাতি হিন্দুধর্মের নির্মম বিধানে নির্যাতিত হচ্ছিল, তাঁদের মধ্যে খুব কার্যকরী হল।”
(২) ব্রিটিশ রাজত্বের কাল : খ্রিস্টধর্ম, শিখধর্ম ও ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তকরণ হয়েছে। এই সময়কালে গ্রামাঞ্চলে উৎপাদন ও বিনিময়ের চিরাচরিত সম্পর্কগুলি ভেঙে যাচ্ছিল এবং বর্ণব্যবস্থার নিচে থাকা জাতিগুলির উপর চাপ বাড়ছিল। অপরদিকে নতুন পৃষ্ঠপোষক ও ধর্মীয় সংযুক্তির মাধ্যমে নতুন সুযোগ উন্মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছিল। তখন ধর্মান্তরণের মাধ্যমে নিচু জাতিগুলি জাতি-কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছিল এবং তাঁদের সামাজিক অবস্থান পুনঃনির্ধারণ করতে চাইছিল।
(৩) স্বাধীনতা-পরবর্তী কাল : ধর্মান্তরের গতিটা আরও স্পষ্ট হল। ধর্মান্তকরণ আন্দোলনগুলি রাজনৈতিক আন্দোলন, সামাজিক গতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের আকাক্ষার সঙ্গে যুক্ত ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দিল্লির এক অ্যাডভোকেট রসিদ সালিম আদিল দলিত থেকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। তিনি দলিত সমস্যা, সামাজিক মুক্তি ও ইসলাম সম্পর্কে বলতে গিয়ে যোগিন্দার সিকান্দকে বলেন– “ইসলামের মাধ্যমে আমি আত্মসম্মান পেয়েছি”। ২০০২ সালে ২৮ অক্টোবর মিলি গেজেটে এক রিপোর্টে দেখা যায় –“গত রবিবার ২৭ অক্টোবর শতাধিক দলিত পরিবার হিন্দুধর্মের অসাম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে বৌদ্ধধর্ম, ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে। কারণ হিন্দুধর্মে তাঁদের অবস্থান অব-মানবিক, গোরু-ছাগলেরও অধম।” বস্তুত হিন্দুধর্মের বিপরীতে ইসলামিক মতাদর্শ এক সমতাভিত্তিক সামাজিক কাঠামোর কথা বলে। কারণ সকলেই আল্লাহর সন্তান এবং তাঁরা সকলেই সমান। কোরান ও হাদিসের কোনো অংশে জাত, বর্ণ, শ্রেণি বিভাজনের কথা উল্লেখ করেনি। তাই বর্ণভেদে শাস্তির বিধি-ব্যবস্থাও নেই। কিন্তু মনুসংহিতা, গীতা, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে সেটা স্পষ্টভাবে করেছে। তবে কোরান ও হাদিসে গোটা পৃথিবীর মানুষকে স্পষ্টত আড়াআড়ি দুটি অংশে ভাগ করেছে– (১) মুসলিম এবং (২) অ-মুসলিম। অপমানিত, অবদমিত, ঘৃণিত হিন্দুদের কাছে ইসলামে ধর্মান্তকরণ ছিল একাধিক বিকল্পের মধ্যে একটি। প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় মুসলমানদের একটা বড়ো অংশই দলিত বা অন্যান্য নিম্নবর্ণ থেকে ধর্মান্তরিত। বাংলায় এটা বেশি বেশি হয়েছে। ফলে অবিভক্ত বঙ্গদেশে মুসলিমরাই হয়েছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়। বর্তমানে সবার অলক্ষ্যে এই দলিত, নিপীড়িত, পিছিয়ে পড়া দরিদ্র মানুষরাই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করছে। মাদার টেরিজা স্বয়ং কম হিন্দুদের আশ্রয় দিয়ে খ্রিস্টান করেননি! দরিদ্র দলিত আধিবাসীদের সাহায্য দিয়ে জিশুর প্রেমকথা শুনিয়ে ধর্মান্তরিত করিয়েছেন।
তবে ভারতীয় মুসলমান সমাজেও জাতি-সদৃশ অনেকগুলি বৈশিষ্ট্য আছে বা কতকগুলি জাতি-সদৃশ গোষ্ঠী দেখা যায়। আশরফ বা অভিজাতরা অ-আশরফদের মধ্যে তীব্র পার্থক্য আছে। আশরফরা দাবি করে যে তাঁরা বিদেশ থেকে আগত এবং উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন। বলা হয়, আশরফরা চারটি বহিরাগত গোষ্ঠী থেকে উদ্ভূত। প্রথম দুটির উৎস আরব এবং তাঁরা ‘সৈয়দ’ ও ‘শেখ’ উপাধি লেখে। অপর দুটি নাম জাতি-গোষ্ঠীগত– পাঠান বা আফগান এবং মোগল। সৈয়দরা হিন্দুসমাজের শিক্ষিত ব্রাহ্মণদের মতো। শেখরা সংখ্যায় অনেক বেশি এবং মনে করা হয় যে অন্যান্য বর্গের মানুষ এতে যোগ দিয়ে এই শ্রেণিটির সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটিয়েছে। যাঁরা অ-আশরফ তাঁদের মধ্যে তিনটি গোষ্ঠী দেখা যায় –(১) যাঁরা হিন্দু উচ্চবর্ণ থেকে বিশেষত রাজপুত থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছে। (২) যেসব হস্তশিল্পী জাতিগুলি থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছে। এবং (৩) অস্পৃশ্য জাতিগুলি থেকে যাঁরা ধর্মান্তরিত হয়েছে। হিন্দু থেকে যাঁরা ধর্মান্তরিত হয়েছে তাঁদের সবাইকেই ‘আজলফ’ বলা হয় এবং ধর্মান্তরিত অস্পৃশ্যদের ‘আরজল’ বলা হয়। তাই কোরান, হাদিসে কোনো নিষেধাজ্ঞা না-থাকলে মুসলিম সমাজ নিজেরাই নিজেদের বিভাজিত করে নিয়েছে।
সাচার কমিটি লক্ষ করেছে –ভারতে মুসলিম সমাজ নানা স্তরে বিভক্ত এবং সেইসব পেশায় নিযুক্ত জাতিগুলি যাঁদের মধ্যে হিন্দুরা তফসিলি জাতি হিসাবে চিহ্নিত। ধারণা যে, এঁরা হিন্দুদের মধ্যেকার ‘অস্পৃশ্য’ জাতিগুলি থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছে। ধর্মের পরিবর্তন এদের সামাজিক মর্যাদা বা অর্থনৈতিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটায়নি। তাঁরা যেসব পেশায় নিযুক্ত সেগুলি সামাজিকভাবে ঘৃণ্য বলেই বিবেচিত।
(৬) সুফিদের প্রভাব : এক শ্রেণির মুসলিম ব্যাবসাবাণিজ্যের উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আগমন করে ইসলামের বাণী প্রচার করেন। অনুরূপভাবে আসেন কিছু ফকির ও অলি-দরবেশ। তাঁরাও কেবলমাত্র ধর্মপ্রচারের কাজে জীবন অতিবাহিত করেন এবং এখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। নিজ নিজ চিন্তা ও কর্মপদ্ধতি অনুসারে ইসলাম প্রচারকারী এসব অলি-দরবেশদের অনেকেরই মাজার রয়েছে বাংলাদেশে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন— হজরত শাহ জালাল, হজরত শাহ পরান, হজরত মোহসেন আউলিয়া, হজরত শাহ ফাতেহ উল্লাহ, শাহ সুলতান রুমি, বাবা শহিদ, শাহ আব্দুল্লাহ কিরমানি, বাবা ফরিদউদ্দিন শাকরাগঞ্জ, আখি সিরাজউদ্দিন, শেখ জালালউদ্দন তাবরিজি, সাইয়েদ জালালউদ্দিন আহমেদ কবির ওরফে মুখদুম, হজরত শেখ ফরিদ, হজরত গরিব উল্লাহ শাহ, হজরত শাহ আলি বোগদাদি, শাহ আল্লাহ, মাওলানা শেখ হামিদ দানিশমন্দ, হজরত বায়েজিদ বোস্তামি সহ আরও অনেক অনেক অলি আউলিয়া। ভারতীয় উপমহাদেশের খুবই পরিচিত হজরত খাজা মইনউদ্দিন চিশতির মাজার আজমিরে এবং হজরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার মাজার দিল্লিতে অবস্থিত।
ধর্মান্ধ তথা গোঁড়া মুসলিমরা এইসব সুফিদের ইসলামি বলেন না, বরং বলেন বিপদগামী মুসলিম। ভারতে যে স্থানীয় অধিবাসীরা ইসলামকে গ্রহণ করেছিলেন, তাঁরা প্রধানত বেশিরভাগ গ্রামেই বসবাস করতেন। তাঁরা বিশেষ কোনো মুসলমান সম্প্রদায়ের পরিবর্তে বৃহত্তর সমাজেরই অংশ হিসাবে পরিচিত ছিলেন— যে সমাজে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ এবং বিভিন্ন আদিবাসীদের সহাবস্থান ছিল স্বতঃস্ফুর্ত ও স্বাভাবিক। যে ইসলাম ভারতের মুসলিমরা গ্রহণ করেছিল তা গোঁড়া মোল্লা ও মৌলবীদের ধর্মীয় আদেশ দ্বারা পরিচালিত হয়নি। সেই গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ইসলামের সুফি মতবাদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়েছিল। ভারতে, বিশেষ করে বাংলায় উদার সুফি মতবাদ মান্যতা পেয়েছিল। কারণ তার মেলবন্ধন ঘটেছিল প্রাক-মুসলিম ‘সহজিয়া’ মানবধর্মের। সঙ্গে, বিশেষত সমন্বয়ধর্মী ‘নির্গুণ বাউল সহজিয়াদের সঙ্গে লোকায়ত স্তরে। উভয়ই গোঁড়া হিন্দু পণ্ডিত এবং মুসলমান শাস্ত্রজ্ঞদের অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। সমাজজীবনে বিভিন্ন স্তরে প্রাক-মুসলিম সহজিয়া ঐতিহ্যের সঙ্গে সুফি দর্শনের মেলবন্ধনের প্রক্রিয়াটি তুর্ক-আফগান ও মোগল রাজত্বকালে। সেই মেলবন্ধনের প্রক্রিয়ার প্রেক্ষাপটেই পূর্ববঙ্গের জঙ্গল কাটায় উদ্যোগী গ্রামীণ নেতৃত্ব ও সহযোগী কৃষকরা ইসলামকে গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন লোকায়ত সমন্বয়ী দর্শনের আধারে।
ইসলাম ধর্মকে সর্বৈ বলপ্রয়োগ করে চাপানো হয়নি তুর্ক-আফগান ও মোগল রাজত্বের সময়। এই ধর্মের প্রসার ঘটেছিল সুফি সাধকদের সমন্বয়বাদী তৎপরতার ফলে দেশভাগের আগে পর্যন্ত অবিভক্ত এই বাংলায় মুসলিমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। ভারতে, বিশেষ করে বাংলায় গ্রামবাসীরা যখন ইসলাম ধর্মকে গ্রহণ। করেছিল, তখন তাঁরা নাটকীয়ভাবে অতীতের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেননি। কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে বাংলায় এই ধর্মান্তরকরণ প্রক্রিয়া সাধিত হয়নি। ইসলাম ধর্মকে গ্রহণ করেও বাংলার গ্রামবাসীরা তাঁদের সহজিয়া ঐতিহ্যের শিকড়কে গ্রামবাংলায় আরও গভীরভাবে প্রোথিত করেছিলেন। বাংলায় ইসলামকে এত বিভিন্ন ধরনের প্রাক-মুসলিম সহজিয়া ঐতিহ্যকে আত্মস্থ করতে হয়েছিল।
(৭) অন্যান্য : (১) রাষ্ট্রদ্রোহী অথচ মুসলমান নন এমন অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছেন। (২) বিশিষ্ট ব্যক্তির অনুরাগ আদায়ের জন্য ধর্মান্তর হয়েছে। অনুপাতে নগণ্য হলেও উল্লেখের দাবি রাখে। (৩) পদোন্নতির লোভেও ধর্মান্তর ইত্যাদি।
ইসলাম এত নিবিড়ভাবে বাংলার গ্রামীণ সমাজের কৃষিনির্ভর অর্থনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিল যে, স্থানীয় কৃষকরা ইসলামকে কখোনই ‘পরদেশি’ হিসাবে চিহ্নিত করেননি। পরিতাপের বিষয়, কিছু গোঁড়া মুসলমান, ভারতের হিন্দুত্ববাদী এবং কতিপয় পাশ্চাত্যের পর্যটক ইসলাম তথা মুসলমানদের ‘বিদেশি’ বলে গলা ফাটায়, তাই কথায় কথায় পাকিস্তান দেখায়।
উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা সাভারকর ও গোলওয়ালকরের আর্দশে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতীয় মুসলিমদের খাটো করার জন্য নানারকম অভিযোগ তোলে। তার মধ্যে অন্যতম হল –(১) মুসলিমরা বিদেশি, ইসলাম ধর্ম বিদেশি। (২) মুসলিমমাত্রেই সন্ত্রাসবাদী। (৩) মুসলিমরা গণ্ডায় গণ্ডায় বাচ্চা পয়দা করে জনবিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে। (৪) মুসলিমরা গণ্ডায় গণ্ডায় বিয়ে করে। আপাতত এই চারটি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। প্রথমেই আসি বিদেশি প্রসঙ্গে।
অভিযোগ : মুসলিমরা বিদেশি। তাই ভারতে এঁদের কোনো জায়গা নেই। সংবাদপত্র কিংবা সোসাল মিডিয়াগুলিতে কান পাতলেই শোনা যায় হুমকি আর হুংকার– মুসলমানদের সব পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। কেন? মুসলমানরা কি ভারতের বৈধ নাগরিক নয়? মুসলমানরা কি বিদেশি? সেই কারণে কি ভারত থেকে সমস্ত মুসলমানকে পাকিস্তানে তাড়িয়ে দেওয়া উচিত? পাকিস্তান কারা চেয়েছিল সেই প্রশ্নের উত্তর আগের অধ্যায়ে দিয়েছি। বিদেশি অভিযোগে ভারত থেকে যদি সমস্ত মুসলমান পাকিস্তান বা অন্য কোথাও ঝেটিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তো একই অভিযোগে বিদেশি’ প্রশ্নে ভারত জনশূন্য হয়ে যাবে। যে বা যাঁরা তাড়াবেন তাঁদেরকেও তো খুঁজে পাওয়া যাবে না!
গজনির মামুদ আর আহম্মদ শাহ আবদালির মতো মুসলিম হানাদারেরা ভারত থেকে ধনসম্পদ লুঠ করে পালিয়েছে ঠিকই, এরা অবশ্যই বিদেশি। তেমনই ব্রিটিশরা তথা ইংরেজরাও বিদেশি, কারণ এরাও এ দেশের সম্পদ নিয়ে নিজেদের দেশে পাচার করেছে। কিন্তু এক কাতারে সকলকে ‘বিদেশি’ বললে জাতির অবমাননা করা হবে। ব্রিটিশরা ইংল্যান্ডের কোম্পানি অথবা রাজা বা রানির নামে ভারত শাসন করেছে। অনেক বড়োলাট ভারত-শাসনের দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন, অনেকেই ভারত ছেড়ে দেশে ফিরে গেছেন। অপরদিকে কোনো মুসলমান শাসকই নিজের দেশে ধনসম্পদ পাচার করেনি, ভারত ছেড়ে নিজের দেশে চলেও যায়নি। দাস, খিলজি, তুঘলক, লোদি অবশ্যই মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভারতে এসেছেন, কিন্তু ভারতেই থেকেছেন, ভারতেই মরেছেন। মোগলরা এসেছেন মোঙ্গলিয়া থেকে, যাঁরা উত্তমহাদেশকে সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ করেছে, শীর্ষে তুলে দিয়েছে। আজ বহির্বিশ্বে ভারতের পরিচিতই মোগলদের কীর্তির জন্য। তাজমহল সেই অমর কীর্তির মধ্যে অন্যতম। এদের সন্তান-সন্ততিরা এদেশেই বড়ো হয়েছে, এদেশেই জীবন নির্বাহ করেছে। আর ধর্ম? ধর্মটা নিশ্চয়ই বিদেশি, যেমন মাক্সীয় মতবাদ বিদেশি –অসুবিধা কোথায়! আমাদের পোশাক-আশাক, খাদ্য-খাবার, সংস্কৃতি, ভাষাও বিদেশি। ত্যাগ করতে পারব?
আর্যরা তো বিদেশিই। যে-কোনো তত্ত্ব থেকেই বিদেশি। পাশ্চাত্যের প্রায় সমস্ত পণ্ডিতই আর্যদের ‘বহিরাগত বলে দাবি করেন। বহু ভারতীয় পণ্ডিতও একই মতের অনুরাগী। বস্তুত আর্যরা বাইরে থেকে ভারতে এসেছিলেন এই মতই এখন সমধিক আদৃত। এশিয়া মহাদেশের একটি অঞ্চল হল এশিয়া মাইনর। পশুপালনের জন্য ঘাসের খোঁজে এরা ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে পৃথিবীর চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। কেউ গেল পশ্চিমে, কেউ গেল দক্ষিণে, আবার কেউ গেল দক্ষিণ-পূর্বে কিংবা দক্ষিণ-পশ্চিমে। এইভাবে তাঁরা ছড়িয়ে পড়ল বিভিন্ন দেশে। সেখানকার অধিবাসীদের সঙ্গে মিশে গিয়ে অথবা তাঁদের ক্ষমতা ও অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে সেই দেশে বসবাস শুরু করেছিল।
এশিয়া মাইনরের যে পশুপালক দলটি তৃণভূমির খোঁজ করতে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এগিয়ে আসে। তাঁরা ভারতে সপ্তসিন্ধু নদীর তীরে ভালো তৃণভূমির সন্ধান পেয়ে সেখানেই বসবাস করতে শুরু করে দেয়। যদিও ভারতের আদি বাসিন্দারা এই বিদেশি জাতিদের মেনে নিতে পারেনি। ফলে উভয় পক্ষই যুযুধান পক্ষ হয়ে উঠল অচিরেই। উভয় পক্ষের মধ্যে নিয়তই সংঘর্ষ আর সংঘাত। এই সংঘাতের কাহিনিই বর্ণিত হয়েছে উপমহাদেশের পুরাণগুলিতে। বিদেশি এই জাতিকেই আর্য’ বলা হয় এবং ভারতের আদি বাসিন্দাদের ‘অনার্য’ (দাস, অসুর, দৈত্য, দানো ইত্যাদি) বলা হয়। নিজের অধিকার অটুট রাখতে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়েছে শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত। অবশেষে অসম যুদ্ধে আর্যরাই জয় হয়েছে। কারণ আর্যরা ছিলেন যুদ্ধবিদ্যায় পটু, বিচক্ষণ। লোহা ছাড়া অন্যান্য ধাতুর ব্যবহারও জানত। অপরদিকে অনার্যদের উন্নত অস্ত্র ছিল না। যুদ্ধবিদ্যাও ভালো জানত না।
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী যে ইরান থেকে ভারতে এসেছিল তার ভাষাগত ও শিলালৈখিক উভয় প্রমাণই আছে। ইরানীয়দের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ‘জেন্দ আবেস্তা’-র সঙ্গে ঋগ্বেদের ভাষায় বিশেষ সাদৃশ্য চোখে পড়ে। এই সূত্রটি আর্য ভাষাগোষ্ঠীর পশ্চিম এশিয়া থেকে ভারতবর্ষে আগমনের স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে। প্রাচীন আবেস্তীয় ভাষার সঙ্গে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায়ও মিল পাওয়া যায়। প্রারম্ভিক পর্বে আফগানিস্তান, পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, কাশ্মীর, সিন্ধু ও রাজপুতানার অংশবিশেষ এবং পূর্ব ভারতের সরযূ নদী পর্যন্ত আর্যরা বসতি স্থাপন করেছিল। প্রথমে গঙ্গা ও যমুনার অববাহিকায় অরণ্যাঞ্চল পরিষ্কার করে তাঁরা সেখানে বসবাস করতে থাকে। ঋক-বৈদিক যুগেই আর্যদের সম্প্রসারণ ঘটেছিল। এরপর বহুকাল ধরে ভারতবর্ষে পারসিক, গ্রিক, পার্থিয়, শক, হুন প্রভৃতি জাতি প্রবেশ করেছে এবং ধীরে ধীরে ভারতের মূলস্রোতে মিশে গেছে। তবে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত শক জাতিদের ভারত থেকে মেরে তাড়িয়েছেন। মধ্য এশিয়ার যাযাবর হুন জাতিকেও গুপ্তসম্রাট স্কন্দগুপ্ত পিটিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সাধারণভাবে ভারতবর্ষে তিন ধরনের জনগোষ্ঠী দেখতে পাওয়া যায় –ককেসীয় বা শ্বেতবর্ণ, মোঙ্গলীয় বা হলুদ বর্ণ এবং ইথিয়োপীয় বা কৃষ্ণবরণ। এগুলির মধ্যে আন্দামান অঞ্চলে ইথিয়োপীয়দের আবির্ভাব বেশি। নাগা, লুসাই আসাম ও হিমালয়ের তরাই অঞ্চলেই মূলত মোঙ্গলীয় জনগোষ্ঠী বাস করে। সাঁওতাল, কোল, ভিল, মুণ্ডা প্রভৃতি জাতিও ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে বাস করে। এই সমস্ত জনগোষ্ঠী ছাড়াও ভারতের পশ্চিম উপকূলে ইহুদিদের লক্ষ করা যায়। বোম্বাই উপকূলে জোরাস্ট্রীয় ধর্মের প্রতি আস্থাশীল ভারতীয় পারসিরা এখনও বসবাস করে। টাটা কোম্পানির কর্ণধার রতন টাটাও পারসি। ভারতে প্রচুর ব্রিটিশ, ফরাসি, পোর্তুগিজ, ডাচ, চিনারা বসবাস করে, তাঁদের কি তাঁদের দেশে তাড়িয়ে দেওয়া যাবে? যাবে না। কারণ তাঁরাও ভারতের নাগরিক।
হ্যাভেল সাহেব ভারতীয় ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির চরম সমর্থক ও প্রশংসক। এই সংস্কৃতিকে মানুষের সৃষ্টি প্রতিভার চূড়ান্ত মহত্তম নিদর্শন বলেই তিনি মনে করেন। অন্যদিকে মুসলমানদের প্রতি ঘৃণাও তেমনই তীব্র ছিল। হিন্দুদের বিরুদ্ধে যায় বলেই তাঁর মতকে এক ফুয়ে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বস্তুত হিন্দুদের দিকেই ছিল তাঁর সম্পূর্ণ পক্ষপাতিত্ব। সুতরাং তাঁর মতো ঐতিহাসিকও যদি অতীতে ভারতবর্ষে অপ্রীতিকর ও অস্বাস্থ্যকর ঘটনা ঘটে থাকতে দেখেন, তাহলে অবস্থা যে অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে উঠেছিল তা অবশ্যস্বীকার্য। হ্যাঁভেল সাহেব লিখেছেন– “ভারতবর্ষে ইসলামের বিজয়াভিযান বাইরের কারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর সমগ্র আর্যাবর্তে যে রাজনৈতিক অধঃপতন দেখা দেয় তা তাঁর জন্যই সম্ভব হয়েছিল। নবির সমাজব্যবস্থা প্রত্যেক মুসলমানকে দিয়েছে সমান আত্মিক মর্যাদা, ইসলামকে করেছে রাজনীতি ও সমাজনীতির মিলনভূমি, আর তাই দিয়েছে তাকে জগৎ শাসনের ভার। জগৎটাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে সাধারণ মানুষের পক্ষে সুখী হওয়ার বিধান হিসাবে ইসলাম যথেষ্ট। বৌদ্ধদর্শন ও ব্রাহ্মণ মতবাদের গোঁড়ামির সংঘর্ষ যখন উত্তর ভারতে একটা রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-বিক্ষোভকে সৃষ্টি করল, সেই সংকটকালেই ইসলাম সঞ্চয় করেছে তার চূড়ান্ত রাজনৈতিক শক্তি।”(Aryan Rule in India) ভারতের শেষ বৌদ্ধরাজা (আসলে হর্ষবর্ধন প্রথম জীবনে ব্রাহ্মণ্যধর্মের হলেও পরবর্তী জীবনে বৌদ্ধধর্ম অবলম্বন করেছিলেন। তাঁকে ভারতের রাজা বলা হলেও তিনি মূলত কৌনজের রাজা ছিলেন। কৌনজ ভারত উপমহাদেশের অন্তর্গত একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। পরে অবশ্য পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলি দখল করে নিজের সাম্রাজ্য অনেকটা বৃদ্ধি করেছিলেন) হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর ভারতবর্ষে রাজনৈতিক অসংযোগ ও বিচ্ছিন্নতার ধারা ইসলামের অভ্যুত্থানের পাশাপাশি চলেছে। এম. এন. রায় তাঁর “The Historical Role of islam’ গ্রন্থে বলেছেন –“একজন রাজার মৃত্যু তিনি যত বড়ড়াই হউন না-কেন, তা অবশ্য ইতিহাসের মোড় ফিরিয়ে দিতে পারে না; এই বিচ্ছিন্নতার কারণ ধূমায়িত হচ্ছিল শত শত বছর ধরে। বৌদ্ধ-বিপ্লবই একে রাখল কিছুদিনের জন্য থামিয়ে, কিন্তু সে বিপ্লবের পরাজয়ে অবস্থা আরও ক্ষিপ্র, বেগবান এবং সুতীব্র হয়ে ওঠে। খ্রিস্ট সন্ন্যাসাশ্রম যেমন অন্যান্য জায়গায় করেছিল, তেমনই বৌদ্ধমঠের অধঃপতন আর সমগ্র ভারতীয় সমাজের উপর তার এক বিচ্ছিন্নকর প্রভাব ভারতবর্ষে মুসলিম বিজয়ে যথাসাধ্য সহায়তা করল।”
যাই হোক, অষ্টম শতাব্দী থেকে ভারতবর্ষে যে মুসলমান সম্প্রদায়ের আগমন শুরু হয়েছে, তা ভারতীয় জনসংখ্যায় এক নতুন সংযোজন। পশ্চিম উপকূলে এখানকার দেশীয় মানুষ ও আরবের মুসলমানদের সমন্বয়ে উদ্ভব ঘটেছে মালাবারের মোপলা শ্রেণির। পঞ্চদশ শতাব্দীতে পোর্তুগিজ, ডাচ, ফরাসি ও ইংরেজদের আগমন ইন্দো-ইউরোপীয় সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটিয়েছিল। ভারতবর্ষের যে মানুষই হোক না-কেন, যাঁরা ভারতবর্ষের আদিমতম অধিবাসী তাঁরাও বাইরে থেকে এসেছে। ভারতবর্ষে মুসলিমরা যাঁরা আছেন তাঁদের বিদেশ থেকে আসা কতজন পূর্বপুরুষ? এদের মধ্যে বেশির ভাগই তো ধর্মান্তরিত হিন্দু। বেশিরভাগ মানে শতকরা ৯৯ ভাগই ধর্মান্তরিত। মানুষ তো একই, কেবল ধর্মটাই আলাদা। ভারতের কমিউনিস্টরা তো রাশিয়ান নয়, ১০০% প্রশ্নহীন ভারতীয়। ধর্ম বদলে কি কোনো ব্যক্তি বিদেশি হয়ে যায়? তাহলে কি থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, ভূটান, লাওস, মঙ্গোলিয়া, জাপান, চিনের বৌদ্ধদেরও বিদেশি বলবে সে দেশের আদি বাসিন্দারা? কারণ বৌদ্ধধর্মের জন্ম তো ভারতেই। যেমন ইসলামের জন্ম সৌদি আরবে। করিনা কাপুর, সঙ্গীতা বিজলানি, কবির সুমন, এ আর রহমানেরা বিদেশি? ভারতে এমন অনেক খ্রিস্টান আছেন, যাঁরা ধর্মান্তরিত হয়েছেন। ভারতে বসবাসকারী খ্রিস্টানরাও কি বিদেশি? ধর্ম আলাদা হলে দেশ আলাদা হয়ে যায় কোন্ আইনে? ভারতের হিন্দু বৌদ্ধ ও জৈনরা আছেন অনেক, যাঁরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। হিন্দু শব্দটাও তো ভারতীয় নয়, বিদেশি শব্দ। স্বামী বিবেকানন্দ বড়ো আক্ষেপ করে বলেছেন –“ভারতবর্ষের পাঁচ ভাগের এক ভাগ মানুষ মুসলিম হয়ে গেল উচ্চবর্ণের অত্যাচারে।”
অতএব মুসলমানরা বিদেশি হলে বৈদিক সভ্যতার ধারক ও বাহক আর্যরাও অবশ্যই বিদেশি। ১ লক্ষ ১৫ হাজার থেকে ১ লক্ষ ৩০ হাজার বছর আগে আধুনিক মানুষের আবির্ভাব হয়েছিল আফ্রিকাতে। এরা আফ্রিকা থেকেই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। ভারতে ওরা ঢুকেছিল ৬০ হাজার বছর আগে। দেখা গেছে যে, ভারতে যত পুরোনো মানুষ পাওয়া গেছে সেই পুরোনো মানুষ আফ্রিকাতে পাওয়া গেছে তারও কয়েক লক্ষ বছর আগে। এবং এই পরিযানটা অনবরত চলছে গোটা পৃথিবীতেই। ভারতের বাইরে থেকে অবিরত মানুষ এসেছে সেই আদিম যুগ থেকেই। এসেছে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে। আবার অস্ট্রেলিয়া, চিন ও বার্মা (মায়ানমার) হয়েও ঢুকেছে। হরপ্পা সভ্যতা ছিল আজ থেকে ৪৫০০ বছর আগে। হরপ্পা সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায়। ধ্বংসের কারণ নিয়ে ঐতিহাসিকদের নানাবিধ বিতর্ক আছে, কিন্তু বিতর্ক নেই হরপ্পার অধিবাসীরা ছিলেন বহিরাগত জনগোষ্ঠী। এই জনগোষ্ঠীর একটা হল অবেস্তান, এঁদের এটা ধর্মগ্রন্থও ছিল –অবেস্তা। অপরটি আর্য জনগোষ্ঠী। আর্যরা কিন্তু কোনো জাতি নয়, ভাষাগোষ্ঠী। আর্যদের ধর্মগ্রন্থের নাম ঋকবেদ। এরা ঢেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ বছর আগে। অর্থাৎ আজ থেকে ৩৫০০ বছর আগে। অবেস্তান সভ্যতার লোকেরা আর্যদের একটু আগেই এসেছিলেন।
লক্ষ্যণীর ব্যাপার হল –ভারতের এই ভৌগোলিক অংশেই সর্বপ্রথম বহির্বিশ্বের তিনটি সিমেটিক ধর্মমত এসে পৌঁছেছে।ঐতিহ্য অনুসারে সিমেটিক জাতি ইহুদিরা তাঁদের ধর্ম নিয়ে খ্রিস্ট্রীয় প্রথম শতকে এখানে আসে। এঁরা হল স্বদেশ থেকে বিতাড়িত ইহুদি। হড্রিয়ান কর্তৃক বিতাড়নের পর ১৩৫ সালে তাঁরা বিপুল সংখ্যায় ভারতে আসা শুরু করে এবং উপমহাদেশের কোডুঙ্গন্ধুর, পালায়ার-চৌঘাট, পানতালায়নি, এজহিমালা প্রভৃতি জায়গাতে বসবাস শুরু করে। দলে দলে আগত এইসব ইহুদিদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলটি দশম শতাব্দীতে জোসেফ রব্বনের নেতৃত্বে আসে। জোসেফ রব্বনের অনুগতরা সাধারণত ত্রিবাঙ্কুরের ইহুদি বলে পরিচিত। স্পেন ও পোর্তুগালে অ-খ্রিস্টান বিতাড়নের পর্বে ইহুদিদের একটা বড়ো দল কোচিনে এসে আশ্রয় নেয় এবং রাতারাতি কোচিন ভারত ভূখণ্ডে ইহুদিদের বৃহত্তম বাসস্থানে পরিণত হয়। জলদস্যু ভাস্কো-ডা-গামার নেতৃত্বে পোর্তুগিজ বাহিনী ভারতে অশান্তির বাতাবরণ তৈরি করে ফেলে। পোর্তুগিজরা ক্যাথলিক খ্রিস্টান। কিন্তু এই সশস্ত্র সহিংস খ্রিস্টীয় বাহিনী ভারতে আসার অনেক আগেই প্রেম ও সাহসিকতার ধর্ম হিসাবে এদেশে খ্রিস্টধর্মকে নিয়ে আসেন সেন্ট টমাস। ইনিই ভারতের প্রথম খ্রিস্টধর্ম প্রচারক। তবে কালিকটে ভাস্কো-ডা গামা জাহাজ ভেড়ানোর অনেক আগেই আসে খ্রিস্টীয় ধর্মপ্রচারকরা। আরব সৈনিকদের সশস্ত্র সিন্ধু অভিযানের অনেক আগেই আরব বণিকেরা আসে। ভারতীয় বাণিজ্য হলেও আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক ব্যাবসা নিয়ন্ত্রণ করত আরব বণিকরাই, বিশেষ করে দক্ষিণ আরবের বণিকরা। আরবরা তখন থেকেই ভারতে বাণিজ্য করছেন যখন পয়গম্বর মোহম্মদের আবির্ভাবই হয়নি। অর্থাৎ উল্লিখিত সেই আরব বণিকদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রশ্নই নেই। শুধু ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠার আগে থেকে নয়, খ্রিস্টান ধর্ম প্রতিষ্ঠার অনেক আগে থেকেই আরবরা ভারতে বাণিজ্য চালিয়ে আসছে এবং বাণিজ্যের সুবাদেই তাঁরা সেই আদিকাল থেকেই মালাবার উপকূল মায় ভারত উপমহাদেশে বসবাসও করছে।
ভারতে অ-মুসলিম আরবীয়ানদের যাতায়াত ও বসবাসের মূল কারণ অবশ্যই বাণিজ্যিক বা অর্থনৈতিক। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সম্ভবত কেরলের প্রাচীন শাসনব্যবস্থা– প্রাচীন শাসনব্যবস্থা মানে কেরলের মাতৃতান্ত্রিক সমাজ –যে সমাজে সবকিছুতেই নারীর অগ্রগামিতা, পারদর্শিতা ও স্বাধীনতা ওই আরব বণিকদের কাছে এদেশে বসবাসের অতিরিক্ত আকর্ষণ বলে প্রতিভাত হয়েছিল। মোহম্মদের আবির্ভাবের পরে যখন আরবীয়রা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে তখন আপনা থেকেই কেরলে ইসলাম ধর্ম মসৃণভাবে প্রবেশ করে। সেই নবম ও দশম শতাব্দীতেই দক্ষিণ ভারতের ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা যেমন সম্মানে তেমনই সংখ্যাতে একটা তাৎপর্যপূর্ণ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছিল। এরপর দক্ষিণ ভারত ছাপিয়ে পরবর্তী উত্থান-পতনের ইতিহাসে সারা ভারত জুড়ে বর্তমানে দ্বিতীয় জনসংখ্যার মুসলিম জনগোষ্ঠী।
নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন ২০০৩ সালে ৯ জানুয়ারি ‘Times of India’ পত্রিকায় বলেছেন– “..কিন্তু এই সংস্কৃত ভাষাও এসেছে বিদেশ থেকে, ইন্দো-ইউরোপীয়দের সঙ্গে। এই মহান ভাষা বিকশিত হয়েছিল এই দেশে। সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞানের চর্চা সংস্কৃত ভাষার মধ্য দিয়েই হয়েছিল। সংস্কৃত ভাষার শ্রেষ্ঠ বৈয়ারণ পাণিনি ছিলেন আফগানি। তাঁর আদি বাসস্থান ছিল কাবুল নদীর তীরে। কিছু নব্য-বুদ্ধিজীবীরা গোটা ইতিহাসকে বিকৃতি করে ছাত্রদের মাথায়, নতুন প্রজন্মের মাথায় ঢোকানোর চেষ্টা করছে যে আর্যরাই ছিল ভারতের প্রাচীন অধিবাসী, এই সমস্ত প্রাচীন সভ্যতা নাকি তাঁরাই তৈরি করেছে, তাঁরাই ভারতের বাইরে দেশে দেশে গিয়ে সভ্যতা সৃষ্টি করেছে। এরাই আসলে স্বদেশীয়, মুসলিমরা হল বিদেশি। তার মানে দাঁড়াল আর্য ছাড়া ভারতে যাঁরা পরে এসেছে তাঁরা সকলেই বিদেশি!!”
অভিযোগ : মুসলিমরা কি অপরাধীপ্রবণ? এমন একটা অভিযোগ শোনা যায় মুসলিম-বিদ্বেষীদের পক্ষ থেকে। স্পষ্টভাবে বলা যায়, মুসলিমরা অপরাধপ্রবণ’, এটা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া অভিযোগ। এমন অভিযোগ একটা জাতিকে দেশের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার ষড়যন্ত্র। কিছু চোর-ছ্যাঁচ্চোর, ছিনতাইবাজ, পকেটমার ছাড়া মুসলমান কোথায়! আর এইসব অপরাধীরা কোন্ ধর্মে নেই? হিন্দুধর্মেও কি কিছু কম আছে? ধর্ষক, খুনি কি হিন্দুধর্মে নেই? যেহেতু মুসলিমদের মধ্যে বেকারি বেশি, দারিদ্র বেশি তাই এই ধরনের অপরাধে তাঁদেরকেই বেশি পাওয়া যায় জনসংখ্যার অনুপাতে। এই অপরাধীরা অত্যন্ত গরিব, অভাবী ঘরের। এসবের জন্য কি ধর্মকে দায়ী করা যায়? বড়ো বড়ো সব কাজে তো অন্যদের নামই পাওয়া যায়। কিন্তু বিজয় মাল্য তো অভাবী নন, তিনি প্রায় দশ হাজার কোটি নিয়ে ভারত ছেড়ে পালিয়ে গেলেও কিছু বলা হয় না কেন ধর্ম তুলে? সম্প্রতি কয়েকটি ধর্ষণকাণ্ডে অবশ্য কয়েকজন মুসলমানদের নাম পাওয়া গেছে— পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণকাণ্ড, কামদুনি ধর্ষণকাণ্ড, দিল্লি ধর্ষণকাণ্ড ইত্যাদি। সেখানে তো হিন্দু ধর্ষকও আছে। উত্তরপ্রদেশের হাথরাসের ধর্ষকরা কোন্ ধর্মের? উন্নাও, আজমগড়, বুলন্দ শহরের ধর্ষকরা কোন্ ধর্মের? কাশ্মীরের আসিফার ধর্ষণকারীরা কোন্ ধর্মের? ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর ‘ক্রাইম ইন ইন্ডিয়া’ ২০১৯ সালের এক রিপোর্ট বলছে দেশে মেয়েদের প্রতি সংঘটিত অপরাধে উত্তরপ্রদেশের অবস্থান শীর্ষে। গড়ে দিনে ৮৭ টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। রাজ্যের পরিষদীয় মন্ত্রী সুরেশকুমার খন্না বলেন –“যোগী আদিত্যনাথের মুখ্যমন্ত্রীত্বের প্রথম ২ মাসে রাজ্যে ৮০৩ টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।” অখিলেশ যাদবের মুখ্যমন্ত্রীত্বের শেষ পর্বে ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত উত্তরপ্রদেশে ২,৯৪৩ টি ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছিল। যোগী জমানায় প্রথম ১০ মাসেই (২০১৭ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত) ২৬ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৩৭০৪ টি। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০০২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ১২টি শেয়ার কেলেঙ্কারি হয়েছে। কোনো কেলেঙ্কারিতে আছেন হর্ষত মেহতা, কোনোটাতে কেতন পারেখ– এরা কিন্তু কেউ মুসলিম নন। ইন্দিরা গান্ধির হত্যাকারী, মহাত্মা গান্ধির হত্যাকারী, রাজীব গান্ধির হত্যাকারীরা কিন্তু কেউ মুসলিম নন। বিজন সেতুর কাছে যাঁরা আনন্দমার্গী সন্ন্যাসীদের পুড়িয়ে মেরেছিলেন তাঁরা মুসলিম ছিলেন না। নিতাই গ্রামে গণহত্যাকাণ্ডে জড়িত কোনো ব্যক্তিই মুসলিম নন। তাপসী মালিকের হত্যাকারীরাও মুসলমান নন। এরকম প্রচুর প্রচুর অপরাধের তালিকা দেওয়া যেতে পারে যেখানে মুসলিমদের উপস্থিতি নেই। ধর্মভিত্তিক অপরাধীদের পরিসংখ্যানটা একটু দেখে বলবেন, কারা বেশি অপরাধপ্রবণ। অভিযোগ : মুসলিমরা অ-মুসলিমদের উপর পাশবিক অত্যাচার করে তাঁদের ধর্মগ্রন্থ কোরান ও হাদিসের নির্দেশ অনুসারে: এ ব্যাপারে কারা কার থেকে কম যায়? এ ব্যাপারে হিন্দু, ইহুদি, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ সকলকেই এক কাতারে রাখতে অসুবিধা নেই, পরিসংখ্যান সহ। নিশ্চয়ই মুসলমানদের বিরুদ্ধে পাশবিক অত্যাচারের অভিযোগ আনা যায়। মুসলমানের বিরুদ্ধে যদি আনা যায়, তাহলে অন্য ধর্মগুলির বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ আনা যায়। গুজরাট দাঙ্গায় পাশবিক অত্যাচারের বর্ণনা দিয়েছেন লেখক দিব্যেন্দু পালিত– “গুজরাটে পরিকল্পিতভাবে যে গণহত্যা ঘটেছে –ঘটে চলেছে এখনও, তার কোনো তুলনা স্বাধীন ভারতের পঞ্চান্ন বছরের ইতিহাসে নেই।..কিন্তু এই সরকারি হিসাবের বাইরে আরও কত পুরুষ, নারী, শিশু, এমনকি তরবারির আঘাতে গর্ভবতী নারীর পেট চিরে বের করে আনা ভ্রুণকে হত্যা করা হয়েছে তার সংখ্যা কেউ জানে না…কলম সতর্ক হও, ফ্যাসিজম আসছে।” এই গুজরাটীয় নোংরা রাজনীতি সারা ভারতে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব ও পূর্ব ভারতে। তাই পশ্চিমবঙ্গের রাস্তা-ঘাটে ট্রামে-বাসে উচ্চকিত ঘোষণা শুনতে পাই কাটাদের কেটে ফেলার নিদান। প্রাবন্ধিক সুমিতাভ ঘোষালের বক্তব্যও প্রণিধানযোগ্য –“বাসে। ট্রামে সব জায়গায় মানুষের মধ্যে এক জাতিগত বিদ্বেষ মাথাচাড়া দিচ্ছে। গো-বলয়ের কথা ছেড়েই দিলাম, এই পশ্চিমবঙ্গেও। ভুল তথ্য, অজ্ঞতা আর অন্ধ আক্রোশ গিজগিজ করছে এইসব মানুষের মাথায়।..আমরা যারা কবি, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মী –আমাদেরই সেই দায়িত্ব নিতে হবে। একটি মুসলিম ছেলেকে মারলে যে একটি হিন্দু ছেলে চাকরি পায় না– একথাও শেষপর্যন্ত বোঝাতে হবে আমাদেরই।” কিন্তু এই কবি, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মীদেরও আজকাল সাম্প্রদায়িক কথা বলতে শুনছি, মুসলিম-বিদ্বেষী কথা বলতে শুনছি। তাহলে বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? ‘সেকু’-মাকু’রা কী পারবে! পাশাপাশি এও বলতে হবে একটি হিন্দু ছেলেকে মারলে একটি মুসলমান ছেলে কিছুতেই বেহেস্ত এবং বেহেস্তের ৭২টি হুরপরি পেতে পারে না।
অভিযোগ ওঠে, ইসলাম মতানুসারে এরা মন্দির ও প্রতিমা ভাঙতেই হবে, অসহিষ্ণু হতে হবে, এক হাতে কোরান আর অন্য হাতে তরবারি নিতেই হবে। মুসলিমরা অবশ্যই হিন্দুদের মন্দির ভেঙেছে, প্রতিমাও ভাঙে– বুদ্ধমূর্তিও ভেঙেছে। ভারতে, বাংলাদেশে, পাকিস্তানে, আফগানিস্তানে এক শ্রেণির দুষ্কৃতি মুসলিম তো মন্দির মূর্তি ভাঙেই। সংবাদপত্রে উঠে আসে সে খবর। কিন্তু হিন্দুরাও যে মুসলমানদের মসজিদ ভেঙেছে, বৌদ্ধদের মন্দির আত্মস্যাৎ করেছে সেটাও মনে রাখা প্রয়োজন। না-হলে সুবিচার হয় কীভাবে? ভুলে যাবেন কেন ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে ৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়ার শেষতম সুনাম হিন্দুদের রয়েছে। আঙ্গুল একদিকে রাখলে ইতিহাস ক্ষমা করে না। এইসব ভাঙাভাঙি বন্ধ করতেই হবে, দুই পক্ষকেই থামা জরুরি। আল্লাহকে গালি দিলে যদি বেহেস্তের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে মূর্তি ভাঙলেও বেহেস্তে দরজা খোলা থাকতে পারে না। কারণ মুসলমানের নিরাকার আল্লাহ আর হিন্দুদের সাকার ভগবান একই। দুই রূপে– নিরাকার ও সাকার। আল্লাহ সত্য হলে ভগবানও সত্য, তা সে যে রূপেই থাকুক। নিরাকার সত্য হলে আকারও সত্য, সাকার মিথ্যা হলে নিরাকারও অবশ্যই মিথ্যা হবে। এর সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, যে দুষ্কৃতি মন্দির বা মসজিদ ভাঙে, তাঁরা কেউই সংশ্লিষ্ট ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে না। এসব ঘটনা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই ঘটে থাকে। রাজনৈতিক অঙ্গুলি হেলনেই ঘটে। এর সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। পুরোটাই রাজনৈতিক, ধর্ম কেবল অনুসঙ্গ।
অভিযোগ : মুসলিমরা চারটি করে বিয়ে করে। কোরান বলছে (সুরা নিসা : ৩) “বিয়ে করবে নারীদের মধ্যে যাদের ভালো লাগে, দুই, তিন, অথবা চার।” যে প্রেক্ষাপট এখন আর নেই। যে নিয়ম চালু হয়েছিল সেই নিয়মের এখন আর কোনো কার্যকারিতা নেই। সভ্যসমাজে এসব অচল হয়ে গেছে। অচল যে হয়েছে তা কোরান আর মুসলিম সমাজকে পাশাপাশি রেখে অনুসরণ করলেই উপলব্ধি করা যায়। আমি নিজে একাধিক মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে গিয়েছি, দেখেছি। বেশিরভাগ পুরুষ একটি স্ত্রীতেই খুশি এবং সন্তুষ্ট আমৃত্যুকাল। এক-আধটা মুসলিম একাধিক বিয়ে করে বইকি ধর্মের দোহাই দিয়ে। অমন এক-আধটা হিন্দুও তো একাধিক বিয়ে করে। এক ঘরে রাখতে পারে না বলে এখানে ওখানে রেখে দেয়। চরিত্রের দোষ থাকলে একাধিক বিয়ে তো করতেই হয়। হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট হওয়ার আগে হিন্দু পুরুষরাও একাধিক বিয়ে করত। একাধিক সতীনের ঘর করতে হত হিন্দু মহিলাদের। আর শরিয়ত আইন? শরিয়ত অক্ষরে অক্ষরে মানলে তো আরব সহ সমস্ত মুসলিম দেশে হাত কাটা মানুষে গিজগিজ করত, ব্যাংক-ব্যবস্থা চালু হত না। যে সমস্ত রাষ্ট্র তাঁদের রাষ্ট্রের ধর্ম ইসলাম বলে চিহ্নিত করেছে, তাঁরাও সবসময় শরিয়তি আইন দ্বারা চলছে, তা কিন্তু মোটেই নয়। শরিয়তকে দেশজ করে নিতে হয়েছে। কোরানে সমর্থন আছে জেনে মুসলমানরা সকলে যদি চারটি করে বিয়ে করত তাহলে একটা সময়ে এসে ব্যাচেলার মুসলিম ভরে যেত। বিয়ে করার জন্য একটি মেয়েও পাওয়া যেত না। সব মেয়েদের তো পূর্বপুরুষরাই বিয়ে করে নিত। মুসলিম পুরুষের চেয়ে পাঁচগুণ কন্যাসন্তান জন্ম নিলে তবেই প্রত্যেকে একটি করে মেয়ে পেতে পারে বিয়ের জন্য। বস্তুত বেশিরভাগ মুসলিম একটিই বিয়ে করে কোরান চারটি পর্যন্ত নারী বিয়ে করার অনুমতি দিলেও। সেসব মুসলিমরা জানেন কোন পরিস্থিতিতে কোরান সর্বাধিক চারটে বিয়ে করার অনুমতি দিয়েছে। একাধিক বিয়ে করা অন্য ধর্মের মানুষও তো কিছু কম দেখিনি। যদি ইসলাম ধর্মের মতো অন্য ধর্মেও চারটি বিয়ে করার দিত না জানি কী পরিণতি হত। একথা সত্য, শরিয়ত বিধানে একজন পুরুষ চারটে পর্যন্ত বিয়ে করতে পারে। কিন্তু সেটা ফুর্তি করার জন্য নয়। ১৪০০/১৫০০ বছর আগে মোহম্মদ একটা পিছিয়ে পড়া জনসমাজকে এইভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। উপর্যুপরি যুদ্ধের কারণে পুরুষদের মৃত্যু হওয়াতে নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। ঘনঘন যুদ্ধের কারণে অসংখ্য নারী স্বামীহীন, অভিভাবকহীন পড়েছিলেন। যাতে বাকি জীবিত পুরুষরা একাধিক নারীকে বিয়ে করে তাঁদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেয় তাহলে সমাজে যন্ত্রণার লাঘব হয়। সেইজন্যই তিনি তৎকালীন সামাজিক পরিবেশে সুনির্দিষ্ট নিয়ম করেন এবং সর্বাধিক চারটে পর্যন্ত বিয়ে করার অনুমতি দেন। যত খুশি তত নয়। একথা ভুলে গেলে হয় না ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু বিবাহ আইন বলবৎ হওয়ার আগে পর্যন্ত ভারতের হিন্দু পুরুষরাও একাধিক বিবাহ করত। রাজা বা শাসকদের যেমন একাধিক রানি ছিল, জমিদার ও সাধারণ মানুষদেরও একাধিক স্ত্রী ছিল। হিন্দু পুরাণ-মহাকাব্যে তো একটি পুরুষের একাধিক স্ত্রীর জোরদার সমর্থন আছে। ধ্রুপদ সাহিত্যে ঝুড়ি ঝুড়ি এক পুরুষের একাধিক স্ত্রীর কাহিনি আছে। প্রথম পক্ষের সন্তান, দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান, তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী এসব তো আকছার শোনা যেত –কিছুদিন আগেও। নয় বছরের মেয়ের সঙ্গে অশীতিপর বৃদ্ধের বিবাহের কাহিনিও পাওয়া যায়। কুলীন ব্রাহ্মণদের স্ত্রীর সংখ্যা এত ছিল যে, কোথায় কোথায় শ্বশুরবাড়ি তার রেকর্ড রাখার জন্য জাবেদা খাতা রাখতে হত। পরে এসব কুকীর্তি আজ আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একদা হিন্দু সমাজের কুলীন ব্রাহ্মণদের স্ত্রীর সংখ্যা জানলে চোখ কপালে উঠে যাবে। হিন্দুদের এই বহুবিবাহ ব্যবস্থা বিলুপ্ত করতে অসম লড়াই করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি ৮৩ টি গ্রাম ঘুরে দেখিয়েছিলেন ১৯৭ জন কুলীন ব্রাহ্মণ ১২৮৮ টি বিয়ে করেছেন। তাঁদের একটা তালিকাও বানিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। কয়েকজনের নাম ও স্ত্রীর সংখ্যা এখানে উল্লেখ করা যাক– ঈশ্বরচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রীর সংখ্যা ছিল ১০৭ জন, ভোলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রীর সংখ্যা ছিল ৮০ জন, ভগবান চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রীর সংখ্যা ৭২ জন, পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ৬২ জন, মধুসূদন মুখোপাধ্যায়ের ৫৬ জন, তিতুরাম গঙ্গোপাধ্যায়ের ৫৫, রামময় মুখোপাধ্যায়ের ৫২, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ৫০, শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ৫০, রামরত্ন মুখোপাধ্যায় নামে এক কিশোরের স্ত্রীর সংখ্যা ৪৮ জন, দুর্গা বন্দ্যোপাধ্যায় নামে ২০ বছরের তরুণের স্ত্রীর সংখ্যা ১৬ জন।
ঈশ্বরচন্দ্রের আদি শিক্ষক কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় ভঙ্গ কুলীন, বহুবিবাহে আলস্য নেই। কালীকান্ত বললেন, “কী করি বল, আবার একটি বিবাহের সম্বন্ধ এসেছে, না করলেই নয়।” ঈশ্বরচন্দ্র বিস্মিত হয়ে বললেন, “বিবাহের সম্বন্ধ? কার? আপনার?” কালীকান্ত বললেন, “আর বলিস কেন! না করলে নয়, ওরাও ছাড়ে না।” ঈশ্বরচন্দ্র বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন গুরুর দিকে। বাড়িতে কালীকান্তের একটিই স্ত্রী। অন্যান্য গ্রামে স্ত্রীদের কাছে বছরে একবার করে টাকা আদায় করতে যান। সেইসব স্ত্রীদের বছরে একবার তিনি সহবাস দিয়ে ধন্য করেন বলে তাঁদের পিতামাতাকে অর্থব্যয় করতে হয় প্রত্যেকবার। ঈশ্বরচন্দ্র বাকরুদ্ধ। এবার গুরুমশাই নিজেই বললেন, “কী করি বল, পাঠশালাটি এখন ভালো চলে না, আমার এ পক্ষেই ছয়টি ছেলেমেয়ে, এত বড়ো সংসার চালানো কি সহজ কথা! পুরানো শ্বশুরবাটিগুলান থেকেও আদায়পওর আজকাল আর ভালো হয় না, রোজগারের একটা ব্যবস্থা করতে হবে তো!”
তারপর থেকে সর্বক্ষণ ঈশ্বরচন্দ্রের মন চঞ্চল হয়ে উঠল। যাঁরা নমস্য, যাঁরা শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি, তাঁরাও এই প্রকার অন্যায় করে, তবে সাধারণ অশিক্ষিত বা কুশিক্ষিত ব্যক্তিরা তো এ রকম করবেই। অথচ এর প্রতিবিধান করার কোনো ক্ষমতা তাঁর নেই, এ কথা চিন্তা করেই গায়ে যেন জ্বালা ধরে। বিদ্যাসাগরের যুগে বিয়ের জন্য ৯ বছর বা তার চেয়েও কম বয়সই নাকি আদর্শ ছিল। ওই বয়সে কন্যার বিবাহ দেওয়া বাবাদের কাছে ‘গৌরী দান’-এর মতোই পবিত্র কম ছিল। মায়ের আদরের আত্মজার বিয়ের পাত্রটি বয়সে তার চেয়েও বড়ো কিংবা তাঁর স্বামীই সেই হবু জামাতার অনুজতুল্য। কুলীন ঘরে পাত্রস্থ করার সর্বনেশে অহংকার ধরে রাখতে এভাবেই কত মেয়েকে সম্প্রদান করা হত শ্মশানযাত্রীতুল্য বৃদ্ধদের হাতে। সেই বৃদ্ধ হয়তো জানেনই না মেয়েটি তাঁর কত নম্বর বউ হতে চলেছে। মনুর বিধান অনুসারে অনুপযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে কন্যার বিবাহ দেওয়া কখনো উচিত নয়। এই সাধারণ নিয়মকে এমন বিকৃত অর্থে প্রয়োগ করা হত যে, উচ্চবর্ণের উপযুক্ত পাত্র না পেলে পিতামাতারা যে-কোনো কুলীনের হাতে কন্যাদান করতেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বহু বিবাহের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এই বহুবিবাহ নিরোধক আন্দোলনের ফলে তাঁকে যথারীতি গালাগাল ও অপবাদ কুড়োতে হয়েছিল। এখনকার সময় হলে হয়তো তিনি লিঞ্চিং হতেন, হয়তো খুনও হয়ে যেতেন। যাই হোক, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি প্রাচীনপন্থী ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। অল্পবয়সি স্ত্রীদের রক্ষার জন্য ‘সহবাস সম্মতি বিল’ সম্বন্ধে তাঁর অভিমত উল্লেখ করার মতো। এই বিলটি প্রধানত পারসি সমাজ-সংস্কারক মালাবারির উদ্যোগে উত্থাপিত হয়। এই বিলের উদ্দেশ্য ছিল বাল্যবিবাহ নিয়ন্ত্রণ করা এবং বালিকাবধূর বয়স বারো বছর না-হওয়া পর্যন্ত সহবাস দ্বারা বিবাহ সম্পূর্ণ করার ব্যাপারটা রদ করা। বিদ্যাসাগর বললেন, “হিন্দুদের পক্ষে গর্ভাধান অনুষ্ঠান যখন আবশ্যিক ক্রিয়া এবং কবে বালিকাবধূ প্রথম রজঃস্বলা হবে জানা নেই, তখন সহবাস সম্মতির বয়স ইচ্ছামতো বারো বৎসর নির্দিষ্ট করার তিনি বিরোধী।” তিনি প্রস্তাব করলেন যে, “বিলটি এমনভাবে তৈরি করা হোক, যাতে কোনো স্বামী যদি তাঁর স্ত্রী প্রথম রজঃস্বলা হওয়ার আগে বিবাহ সম্পূর্ণ করে তবে তা আইনত অপরাধ বলে গণ্য করা হবে।” লোকমান্য তিলক এই বিলের প্রচণ্ড বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধতার প্রধান কারণ এই যে, এই বিলটির দ্বারা হিন্দুদের সামাজিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর বিদেশি হস্তক্ষেপ করা হবে।
বিদ্যাসাগর জীবনীকার চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি, তিনি সমাজসংস্কারের জন্য দশটি প্রস্তাব বিশিষ্ট এক অঙ্গীকারপত্র রচনা করেন। যাঁরা সেই অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষর করতেন ধর্মের নামে তাঁদের প্রতিজ্ঞা করতে হত যে, তাঁরা তাঁদের কন্যাদের ১১ বছর বয়সের আগে বিয়ে দেবেন না। কৌলিন্য প্রথার কথা চিন্তা না-করে স্বজাতির সৎপাত্রে কন্যাদান করবেন। এক স্ত্রী জীবিত থাকতে নিজেরা দ্বিতীয়বার বিয়ে করবেন না। যার এক স্ত্রী জীবিত আছে এমন পাত্রে কন্যাদান করবেন না। একবার অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষর করার পর তা পালনে পশ্চাদপদ হবেন না। তিনি মাত্র ১২৫ জন স্বাক্ষরকারী সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। বহুবিবাহ বিলুপ্ত করতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রথম আবেদনপত্র পাঠান ১৮৫৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর, রাজবিদ্রোহের কারণে তাঁর আবেদনপত্র টেবিলেই পড়ে থাকে। নিরাশ না-হয়ে তিনি আবার আবেদনপত্র পাঠান ১৮৫৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারিতে। বহুবিবাহ সম্পর্কে আরও তথ্য জানা যায়, তিনশো স্বাক্ষর বিশিষ্ট একটি আবেদনপত্র সরকারের কাছে ১৮৬৬ সালের ২৪ মে জমা পড়ে। বহুবিবাহ রোধ করতে আইন পাস করার দাবি নিয়ে বিদ্যাসাগর লেফটেন্যান্ট গভর্নর বিডন সাহেবের সঙ্গে দেখাও করেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে, তাঁর জীবদ্দশায় তিনি বহুবিবাহ রহিত আইন পাস করে যেতে পারেননি। বিদ্যাসাগর দেখে যেতে না-পারলেও ভারত সরকার ১৯৫৫ সালে হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টের এই অনুশাসন বলবৎ হয়। ততদিনে বিয়ের বয়সও বেড়ে গিয়েছে। মেয়েদের ক্ষেত্রে বিয়ের ন্যূনতম বয়স হয়েছে ১৮, ছেলেদের ২১।
কিন্তু শরিয়ত অধিকার থাকা সত্ত্বেও মুসলমানেরা চারটি তো দূরের কথা, দ্বিতীয় বিয়েও করেন না। অতএব মুসলিমরা চারটে বিয়ে করে, এ অভিযোগের কোনো সারবত্তা নেই। ২০০১ খ্রিস্টাব্দের সেনসাস রিপোর্টে বলছে ভারতে ১০০০ পুরুষ পিছু ৯৪৩ জন নারী। মুসলিমদের প্রতি হাজারে ৯৫১ জন মহিলা এবং হিন্দুদের প্রতি হাজারে ৯৩৯ জন মহিলা। মহিলারা কম কেন? হিন্দুসমাজে কন্যাভ্রণ হত্যার ঘটনা বেশি এটা ঘটতে পারছে। মুসলিম সমাজে এমন ঘটনা বিরল। অপপ্রচার হিসাবে যদি একজন মুসলমানকে চারটি বিয়ে করে তবে তো বাকি ৭৫ শতাংশ মুসলিম যুবককে অবিবাহিত হয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে হবে। অতএব বুঝতে হবে এটি একটি পরিকল্পিত প্রচার, একটা সম্প্রদায়কে হেয় করার জন্য প্রচার। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বহুবিবাহের অনুপাত মুসলিমদের মতোই সমান সমান। হিন্দুদের একটার বেশি বিয়ে করলে জেল হয়ে যেতে পারে মামলা দায়ের করলে। তাই বলে কি হিন্দু পুরুষরা একাধিক বিয়ে করে না? ক-জন স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বিয়ের অভিযোগ নিয়ে আদালত-থানা-পুলিশ করেন? মুসলিম সমাজে দু-একটা ব্যতিক্রম ছাড়া সকলে একটি বউ নিয়েই ঘরসংসার করে। শতকরা ৯৫ ভাগ মুসলিমই একটি স্ত্রীর স্বামী। বাংলাদেশেও মুসলমানদের ক্ষেত্রে প্রথমা স্ত্রী সম্মতি না দেন তাহলে স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারে না। সম্মতি না-নিয়ে দ্বিতীয়বার বিয়ে করলে তা বেআইনি। প্রথমা স্ত্রী সম্মতি দেবেন কেন? কিন্তু হিন্দুদের ক্ষেত্রে এই আইনটি প্রযোজ্য নয়। হিন্দুরা সে দেশে বহুবিবাহ করতে পারে। আইনি বাধা নেই। যদি দিলীপকুমার ওরফে ইউসুফ খাঁর দ্বিতীয় বিয়ে দেখান, তাহলে কিশোরকুমার-ধর্মেন্দ্র-বিশ্বজিৎদের একাধিক বিয়ের কথাও বলতে হয়। আবার দেখুন বলিউডের তিন খান। শাহরুখ খানের একটিই স্ত্রী (গৌরী চিব্বার), আমির খানের একটিই স্ত্রী (রীনা দত্তের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের পর কিরণ রাওকে বিয়ে করেন), সলমন খান তো বিয়েই করলেন না। তবে সলমন খানের দুই ভাই। দুই ভাইয়েরই একটি করে স্ত্রী। সোহাইল খানের স্ত্রী সীমা সচদেব ও আরবাজ খানের স্ত্রী মল্লিকা অরোরা।
অভিযোগ : মুসলিমরা গণ্ডায় গণ্ডায় বাচ্চা পয়দা দেয়। কেবল মুসলিমই নয়, অধিক সন্তান জন্ম দেওয়ার অভ্যেস সব ধর্মেই আছে। বস্তুত অধিক সন্তান জন্ম দেন নিন্মবিত্তের অশিক্ষিত মানুষরা। তবে অনেক শিক্ষিত সমাজেও একটি পুত্রসন্তানের আশায় একাধিক কন্যাসন্তানও জন্ম দিয়ে থাকেন। উলটোদিকে একটি কন্যাসন্তানের আশায় একাধিক পুত্রসন্তান জন্ম দিয়েছেন, এমন ঘটনাও সব ধর্মেই দেখা যায়। আর্থ-সামাজিক কারণেই হিন্দু-মুসলিমনির্বিশেষে সমস্ত নিন্মবিত্তের মানুষ অধিক সন্তান জন্ম দিয়ে থাকে। সচেতন মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমানরা একটি বা দুটির বেশি জন্ম দেন না। তবে জন্ম নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে দরিদ্র ও অশিক্ষিত হিন্দুদের কিছুটা সচেতন করা গেলেও, দরিদ্র ও অশিক্ষিত মুসলিমদের মধ্যে ততটা সাড়া ফেলতে পারেনি। তা সত্ত্বেও একথা বলা যায় না যে, মুসলিমরা পরিবার পরিকল্পনা করে না। বললে সে কথা হবে নির্জলা মিথ্যা। পরিবার পরিকল্পনাটা আর্থিক এবং সাংস্কৃতিক মানোন্নয়নের উপর নির্ভর করেই হয়। আমাদের দেশে যারা আর্থিক বা সাংস্কৃতিকভাবে পিছিয়ে-পড়া –তা সে হিন্দু হোক, মুসলিম হোক তাদের সন্তান কিছুটা বেশিই হয়। হিন্দু তথা অন্য অ-মুসলিমদের মধ্যে জনসংখ্যা সচেতনতাই-বা কতটুকু? জন্ম নিয়ন্ত্রণের সামগ্রীর একটা বড়ো অংশের ক্রেতা তো অবিবাহিতরা, বিবাহিতরা নগণ্যই।
একদা একাধিক সন্তানের জন্ম দিত সব স্তরে সব ধর্মের মানুষরাই। বছর বছর জন্ম দিতে গিয়ে কত মায়েদের মৃত্যু হয়েছে তার হিসাব কেউ রাখেনি। আমাদের আগের প্রজন্মের এক এক পরিবারে আটটি/নয়টির কমে সন্তান ছিল না। কৃষ্ণ, ভীষ্মরাই তো অষ্টম সন্তান। বহু বিখ্যাত মানুষের জীবনী পড়ে দেখুন, তাঁরা তাঁদের বাবা মায়ের কততম সন্তান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর পিতা-মাতার চোদ্দোতম সন্তান ছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পনেরোটি সন্তানের পিতা ছিলেন। আমার শ্বশুরমশাইয়ের পাঁচটি কন্যা একটি পুত্রসন্তান, আমার শ্বশুরমশাইয়ের বাবারও পাঁচটি কন্যাসন্তান একটি পুত্রসন্তান ছিল। সেদিক থেকে আমরা দুই ভাই এক বোন, বাবারা দুই ভাই। এক বোন। আমার মায়েরাও দুই বোন এক ভাই। একবার নিজেদের আঙুল ঘোরান, উৎপাদনের দিক থেকে কে বা কারা কম দেখে নিন!
“মুসলিমদের জন্মহার এত বেশি যে মুসলিমরা আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই ভারত দখল করে হিন্দুদের হত্যা করে ভারতকে মুসলিম রাষ্ট্র বানিয়ে ফেলবে এবং মুসলিম রাষ্ট্র বানিয়ে হিন্দু মা-বোনদের ধর্ষণ করবে। হিন্দু পুরুষদের আগা কেটে মুসলমান বানিয়ে দেবে। হিন্দুরা জাগো। ঐক্যবদ্ধ হও। হাতে তুলে নাও অস্ত্র”— উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের মুখে এইসব উত্তেজনাপূর্ণ ডায়লগ শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেল। উপর্যুপরি এসব কথা শুনতে শুনতে আমার মনেও সন্দেহের দানা বাঁধছিল। ভাবছিলাম, সত্যিই যদি এটা বাস্তব তথ্য হয়, তাহলে তো চিন্তার বিষয়। সত্য জানতে সেন্সাসটা একটু ঘাঁটাঘাঁটি করতেই হল।
২০১৫ সালের ২৫ আগস্ট কেন্দ্রের বিজেপি সরকার হঠাৎ ২০১১ সালের সেন্সর রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে ধর্মভিত্তিক জনসুমারির ফলাফল প্রকাশ করতেই ‘হিন্দুরা বিপন্ন’ রব তুলে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে শুরু করে দিল তথাকথিত হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো। এই রিপোর্টে ছিল মুসলমান জনসংখ্যা ২০০১ সালের পর দশ বছর বেড়েছে ০.৮ শতাংশ, হিন্দু জনসংখ্যা কমেছে ০.৭ শতাংশ। কিন্তু প্রকৃত তথ্য কী? সেন্সর রিপোর্ট অনুসারে দেশের মোট জনসংখ্যার (১২১.০৯ কোটি) ৭৯.৮ শতাংশ হিন্দু এবং ১৪.২ শতাংশ মুসলমান। অর্থাৎ অতীতের মতো হিন্দু ধর্মাবলম্বীর জনসংখ্যা ৮০ শতাংশই আছে। অন্যদিকে মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে ৪.৯ শতাংশ। যেখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বী জনসংখ্যা কমেছে ৩.৫ শতাংশ। অর্থাৎ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তুলনায় মুসলমান জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৫০ শতাংশ। গত ৫০ বছরে মুসলমান জনসংখ্যা এতটা কমেনি। সেন্সাস রিপোর্টই বলছে, মুসলমান জনগোষ্ঠীর গড় বয়স হিন্দু জনগোষ্ঠীর চেয়ে কম, অর্থাৎ প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির কথা। তাঁদের জনসংখ্যার হার হ্রাসের বিষয়টিকে সমাজবিজ্ঞানের গবেষকরা খুবই গুরুত্ব দিয়ে পর্যালোচনা করে বলেছেন যে, এই মুসলমানদের জনসংখ্যা এ দেশে কমলে ২০৫০ তাঁরা পৌঁছে যাবেন ‘রিপ্লেসমেন্ট ফার্টিলিটি রেটে’। অর্থাৎ জন্ম ও মৃত্যুর এমনভাবে সমতা আসবে যাতে নতুন প্রজন্মের ফলে জনসংখ্যা নতুন করে আর বাড়বে না। হিন্দু জনগোষ্ঠীও এই একই অবস্থায় পৌঁছোবে, যদিও তা মুসলমান জনগোষ্ঠীর চেয়ে কিছুটা দেরিতে।
গবেষকদের মতে, জনসংখ্যার বৃদ্ধি বা হ্রাস আদৌ ধর্মবিশ্বাসের উপর নির্ভর করে না। পপুলেশন ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়ার গবেষক আলোক বাজপেয়ী বলেছেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে হিন্দু ধর্মাবলম্বী নিম্ন আয়ের শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত পরিবারের সঙ্গে মুসলমান জনগোষ্ঠীর পরিবারগুলোর হবহু মিল আছে। উভয়ক্ষেত্রেই জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় একই হারে। আবার উচ্চবিত্ত কিছুটা শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত হিন্দু পরিবারগুলোর জনসংখ্যা হ্রাসের সঙ্গে মিল রয়েছে একই ধরনের মুসলমান পরিবারগুলোর। আলোক বাজপেয়ীর গবেষণা থেকে এটা পরিষ্কার যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নির্ভর করছে পরিবারের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ইত্যাদির উপর, ধর্মবিশ্বাসের উপর নয়। (সোনা ভট্টাচার্য) একটা সারণি রাখলাম —
দশ বছরের ব্যবধানে জনসংখ্যা বৃদ্ধি শতাংশ হার–
ধর্ম——১৯৯১—-২০০১—-২০১১
হিন্দু—–২৫.১—–২০.৩—–১৬.৮
মুসলিম–৩৪.৫—–২৯.৫—-২৪.৬
বৌদ্ধ—-৩৫.৫—–২৪.৫—–৬.১
খ্রিস্টান—২১.৫—–২২.৬—-১৫.৫
শিখ——২৪.৩—–১৮.২—-৮.৪
জৈন——৪.৬——২৬——৫.৪
প্রকৃত পরিসংখ্যান যাই হোক, ভুয়ো পরিসংখ্যান ছড়িয়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা হিন্দুদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে চলেছে, যা উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি নষ্ট করতে যথেষ্ট সহায়ক। আতঙ্ক এতটাই ছড়ানো হচ্ছে যে, একজাতীয় মহামানব’ ভারতের আকাশে উদয় হয়ে হিন্দু মায়েদের অসংখ্য বাচ্চা জন্ম দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন, যাতে মুসলিমদের জন্মহারের সংখ্যা প্রায় শূন্য হয়ে যায়। আসুন, সেইসব অমৃতলোকের মহামানবের অমৃতবাণীগুলি শুনি– বিজেপির সাংসদ সাক্ষী মহারাজ বলছেন, “প্রতিটি হিন্দু রমণীর অন্তত চারটি করে সন্তান প্রসব করা উচিত।” বিজেপির নেত্রী সাধ্বী প্রাচী’ও সহমত পোষণ করেন। তিনি উত্তর ভারতে সভা করে মঞ্চে ডেকে দশপ্রসবিনী মহিলাদের ডেকে পুরস্কৃতও করছেন। পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা শ্যামল গোস্বামীর মতে, “সংখ্যাটা হওয়া উচিত পাঁচ।” বদ্রিকাশ্রমের শংকরাচার্য বাসুদেবানন্দ সরস্বতীর নিদান –“চার পাঁচটায় থামলে হবে না, প্রত্যেক হিন্দু মহিলাকে অন্তত ১০টি করে সন্তান উৎপাদন করতে হবে। কারণ, তা না হলে দেশে হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রক্ষা করা যাবে না।” সংঘের সদর দফতর নাগপুর শহরে এক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে স্বামী বাসুদেবানন্দ সরস্বতী বলেন- “ভারতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে দুই সন্তান নীতি’ চালু করা হয়েছিল হিন্দুদের তা এবার প্রত্যাখ্যান করার সময় এসেছে।” প্রত্যেক হিন্দু মায়ের অন্তত ১০টি করে সন্তানের জন্ম দেওয়া উচিত বলে অভিমত প্রকাশ করে তিনি আরও জানান, “এতগুলি সন্তানের ভরণপোষণ নিয়েও বাবা-মার চিন্তা করার দরকার নেই। কারণ ‘ঈশ্বরই তাদের পালন করবেন।
হিন্দুত্ববাদীদের ধ্বজাধারীরা নানা দিক থেকে মায়েদের উপর্যুপরি সন্তান প্রজননের আহ্বান জানাচ্ছেন। যেন সন্তান ধারণ এবং জন্মদান খুবই সহজ ও সুললিত একটি প্রক্রিয়া। অথচ সন্তানের জন্ম দিতে মায়েদের মৃত্যুর হার ভারতে এখনও অত্যন্ত বেশি। রাষ্ট্রপুঞ্জের সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী বিশ্বে প্রতি বছর যে ২ লক্ষ ৯০ হাজার প্রসূতির মৃত্যু ঘটে, তার ১৭ শতাংশই ভারতে। শতাংশ থেকে সংখ্যায় অনুবাদ করলে যা দাঁড়ায় বছরে ৫০ হাজার, দৈনিক ১৩৭। সন্তানজন্ম দিতে গিয়ে ভারতীয় মায়েদের এই গণমৃত্যুর প্রধান কারণ তাঁদের অপুষ্টি। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ১৫ থেকে ৫৫ বছর বয়স্ক ভারতীয় মহিলাদের ৬০ শতাংশই রক্তাল্পতায় ভুগছেন। জন্মের পরেও দেশে ফি-বছর যে ১৩ লক্ষ শিশু মারা যাচ্ছে, তা-ও মায়েদের ওই অপুষ্টির কারণে। সাক্ষী মহারাজ বা শংকরাচার্যরা এই অপুষ্টিক্লিন্ন, রক্তাল্পতায় ভোগা মহিলাদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের কথা, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের কথা বলছেন না। বলছেন ৪ টি, ৫ টি বা ১০ টি করে সন্তান উৎপাদন করতে, যাতে সনাতন ধর্ম রক্ষা পায়! কন্যাভ্রণহত্যা নামক ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি মুসলিম সমাজে বিরল। হিন্দুরা, বিশেষ করে হিন্দুত্ববাদীদের প্রধান চারণভূমি উত্তর ভারতের হৃদয়পুরের বাসিন্দারা এ বিষয়ে মুসলমানদের অনুকরণ করতে পারেন, মেয়েগুলো বাঁচবে।
মুসলিম জনসংখ্যাবৃদ্ধি নিয়ে ভাববেন না মশাইরা। শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে তাল রেখে মুসলিম মহিলারা নিজেরাই জন্মনিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসছেন, আসবেন। ইতিমধ্যেই সেই অগ্রগতির চেহারা গ্রামদেশে মিলতে শুরু করেছে। স্বামীর অনুমতি নিয়েই, কখনো-বা এমনকী স্বামীকে লুকিয়েও মুসলিম ঘরের বধূরা উপর্যুপরি প্রজননের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হতে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভিড় জমাচ্ছেন। সঙ্ঘ পরিবারের নেতারা অতীতেও অনেকবার হিন্দুদের বেশি বেশি করে সন্তান জন্ম দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে তাতে যে সাড়া মিলেছে পরিসংখ্যান কিন্তু সে কথা বলে না। এখন এমন অবস্থা যে, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশের হিন্দুদের ডেকে আনছেন এনআরসির মাধ্যমে ভারতীয় নাগরিকত্ব দিয়ে হিন্দুদের সংখ্যা বৃদ্ধি করবেন বলে।
ভারতে জনসংখ্যায় মুসলিমরা ক্রমশ হিন্দুদের ছাপিয়ে যাবে, এটা কুৎসিত অপপ্রচার। হিন্দুদের মতো মুসলমান সমাজেও জন্ম ও বিয়ে সবই নিয়ন্ত্রিত। তবে হিন্দুরা যদি বিভিন্ন ধর্মে ক্রমশ ধর্মান্তরিত হতে থাকে, তাহলে কিন্তু ভারতে হিন্দুদের সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়াটা কেউ ঠেকাতে পারবে না। কী উদ্দেশ্যে সুমন চাটুজ্যে, অরুণপ্রকাশ চাটুজ্যেরা স্বধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলিম হয়েছেন তা নিয়ে বিস্তর বড়োচর্চা হয়েছে। কিন্তু সুমন চাটুজ্যের বুকে তরোয়াল খুঁজে কেউ কবীর সুমন বানিয়ে দিয়েছে, একথা একজন নিন্দুকও বলতে পারবেন না। সুমনদের মতো এরকম অনেক হিন্দু নানা উদ্দেশ্যে স্বধর্ম ত্যাগ করে কেউ বৌদ্ধ, কেউ খ্রিস্টান, কেউ মুসলমান হয়ে যাচ্ছেন। বি আর আম্বেদকর, মহামতি অশোক, অশ্বঘোষ, বালচন্দ্রন চুল্লিক্কডু, জগদীশ কাশ্যপ, লক্ষ্মণ মানে, উদিত রাজ, রাহুল সাংকৃত্যায়ন, আইওথি থাস, লেনিন রঘুবংশীর মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরাও হিন্দুধর্ম ত্যাগ বৌদ্ধধর্মে চলে গেছেন। সংবাদে শিরোনামে চলে আসা দলিত রোহিত ভেমুলার পরিবারের সকল সদস্যই হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ হলেন। দলিত রোহিত ভেমুলা ব্রাহ্মণ্যবাদী কর্তৃক অপমানে আত্মঘাতী হয়েছিলেন। এইভাবে হিন্দুরা যদি বিভিন্ন ধর্মে একে একে দল বেঁধে চলে যায়, তাহলে কি হিন্দুদের পক্ষে সংখ্যাগুরু থাকা সম্ভব? ২০১৬ সালে রাজ্য-রাজনীতির দিকে তাকিয়ে দেখুন বিরোধীরা কীভাবে সব সংখ্যালঘু হয়ে যাচ্ছেন। সব বিরোধীদের যে ভয় দেখিয়ে ফুসলিয়ে তৃণমূল নিজের দলে ভিড়াচ্ছে– একথা বললে ঘোড়ায় হাসব। মানস ভুঁইয়া, কনক দেবনাথ, সোহরাবদের তৃণমূল ফুসলেছে, একথা কোনো মূর্খই বলবে না। মুকুল রায়, শুভ্রাংশু রায়, অনুপম হাজরা, শোভন চ্যাটার্জি, সোনালি গুহ, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভেন্দু অধিকারীরা তৃণমূল দল ছেড়ে বিজেপিতে নাম লিখিয়েছে। সবাই কি ফুসলানোর ফল? ভিড়ছে যাঁর যাঁর ধান্ধায়। ঠিক তেমনি শতশত হিন্দুরা অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। অন্য কোনো ধর্ম থেকে কেউ হিন্দু আসে না বললেই চলে। কিন্তু হিন্দুরা কেন অন্য ধর্মে চলে যায়, তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। খুঁজে বের করার দায়িত্ব নেবেন তাঁরাই, যাঁরা নিজেদেরকে হিন্দুদের বাবা-মা-নেতা সর্বোপরি অভিভাবক মনে করেন, সেইসব আরএসএস-হিন্দুমহাসভা-বিজেপির হিন্দুত্ববাদী সদস্যরা। শুধুমাত্র ‘ভারতমাতা কি জয়’, ‘আমি গর্বিত, আমি হিন্দু ইত্যাদি সারাক্ষণ চিৎকার করলে, লোকের ফ্রিজে গোরু খুঁজে বেড়ালে কেবল সময় ও শ্রমই নষ্ট হবে, কাজের কাজ কিছু হবে না। ১৯৯০ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর আগ্রায় এক প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে দেড় লক্ষ দলিত হিন্দুধর্ম ছেড়ে বৌদ্ধধর্মে আশ্রয় নেন। ১৯৫৬-৫৭ সালে স্বয়ং বাবাসাহেবের নেতৃত্বে ২৫ লক্ষ হরিজন বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিল। শুধু বৌদ্ধধর্মেই নয়, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মেও লাগাতার আশ্রয় নিচ্ছেন হিন্দুরা। ভাবুন কেন হিন্দুরা স্বধর্ম ত্যাগ করে অন্য ধর্মে চলে যাচ্ছে? মুসলিমদের জন্মহার নিয়ে অসত্য ভাষণ না-দিয়ে নিজেদের ঘরের দিকে তাকান, ধর্মান্তর ঠেকান, যদি হিন্দুজাতিকে রক্ষা করতে চান। আবারও বলছি, ধর্মান্তর ঠেকাতে না-পারলে হিন্দুদের সংখ্যালঘু হতে বেশিদিন লাগবে না। শুধু যাওয়া আছে, আসা নেই –এমন চলতে থাকলে কলসির জল শেষ হতে বেশিদিন লাগবে না।
অভিযোগ : মুসলিমরা গোরু খায়। স্বভাবগতভাবেই মানুষের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে আমাদের ঘৃণা করার অভ্যেস আছে। এটা আমাদের মজ্জাগত। নাগাল্যান্ডবাসীরা কুকুর খায়, সেটা আমরা দেখতে পাই না। জঙ্গলমহলের মানুষরা ছুঁচো পুড়িয়ে খায়, সেটা আমরা দেখতে পাই না। এই ভারতেই কত মানুষের খাদ্যাভ্যাসে কত বিচিত্রতা। আমাদের অফিসে একজন মেদিনীপুরের কলিগ আছে সে গেঁড়ি-গুগলি খাওয়ার গল্প বলে। সেটা যে কত সুস্বাদু সেটাও বলে। তা শুনে অফিসের কেউ কেউ ওয়াক তুলে বাথরুমে ছুটে যায়। এটা অসভ্যতামি। ধনেপাতা, গন্ধভাদুলে পাতা কেউ খেলে অনেকে ঘৃণা প্রকাশ করে ওয়াক তোলেন। অন্যের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে টিটকিরি করা অভব্যতা। মানুষের খাদ্যাভ্যাস বিচিত্র। মানুষ খায় না এমন কোনো জিনিসই নেই– গোরু, ছাগল, মোষ, হরিণ, সাপ, কুকুর, ইঁদুর, আরশোলা, টিকটিকি ইত্যাদি কি না। কেউ কারোর রুচিতে খায় না। আপ রুচি খানা পর রুচি পরনা। অনুরূপ মুসলিমরা গোরু খেলে তা দোষের কেন? গোরু যদি দেবতা হয়, তবে তো মাছ বা মৎস, শূকর বা বরাহ, কচ্ছপ বা কূর্ম খাওয়া নিষিদ্ধ করা উচিত সারা ভারতেই। এসব প্রাণীরা তো সাক্ষাৎ বিষ্ণু! পাশাপাশি এটাও বলতে চাই মুসলিমদেরও খেয়াল রাখতে হবে যেহেতু হিন্দুরা গোরুকে দেবতা মানে সেহেতু হিন্দুদের সামনে গোরু খাওয়া বা গোরু খাওয়ার গল্প করা বা গোরু কাটা এড়িয়ে যাওয়া। কোরবানি করা গোরু সোস্যাল মিডিয়াতে পোস্ট না-দেওয়া। তবে আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি বেশির ভাগ মুসলমান এ ব্যাপারটা মাথায় রাখে। সংখ্যালঘু হিসাবে ভারতে তো রাখেই, সংখ্যাগুরু হিসাবে মুসলিমরা বাংলাদেশেও একথা মাথায় রাখেন। সোসাল মিডিয়ার মাধ্যমে তাঁরা জানিয়ে দেন কোনো মুসলিম যেন কোরবানি করা পশুর ছবি পোস্ট না-করে। তবে পাকিস্তান, বাংলাদেশে সর্বদা যে এ বিষয়ে খেয়াল রাখে বললে অত্যুক্তি করা হবে। বৌদ্ধ বা হিন্দুদের মন্দির বা অন্য কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সামনে কেউ কেউ গোরু কোরবানি দেয় এ খবর তো পাওয়া ছবিসহ। এমন ঘটনা বাঞ্ছিত নয়। অন্যের ধর্ম-ভাবনাকে সন্মান না-দিলে নিজের ধর্ম-ভাবনাও মূল্যহীন হয়ে পড়ে। এতে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়।
বাংলাদেশী গোহত্যা বিরোধী মঞ্চের জনৈক সদস্য সৈকত বিশ্বাস বলছেন— “ইতিহাস বলে, শুধুমাত্র হিন্দু অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার জন্য আর হিন্দুদের সঙ্গে পরিকল্পিতভাবে বিভেদ সৃষ্টির জন্য মুসলিমরা ঈদে গরু কোরবানি দেওয়ার রেওয়াজ চালু করে। মরুর দেশ আরবে কখনোই গোরু ছিল না। তাই আরবদেশে ইদ উল-আজহায় উট আর দুম্বা কোরবানি দেওয়াই রীতি। কোরানে কোথাও লেখা নেই যে ইদ-উল-আজহার সময় গোরু কোরবানি দিতে হবে। ইসলামের প্রচারক খোদ মোহাম্মদ গোরু কোরবানি দেওয়া তো দুরের কথা, সারাজীবনে গোরুর মাংস চোখে বা চেখেই দেখেননি। প্রথমদিকে যখন বাণিজ্যিক উদ্দ্যেশ্যে আরব বণিকরা এদেশে এসে ঘাঁটি বাঁধে তখন ইদ-উল-আজহার সময় তারা বকরি (ছাগল) কোরবানি দিত বলে ইদ-উল আজহার নামই হয়ে যায় বকরি ঈদ। পরবর্তীতে মুসলিমদের ভারত জয়ের পর তারা হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে ধর্মান্তরিতের মাধ্যম হিসাবে গোরু জবেহ দেওয়ার রীতি চালু করে। অনেকক্ষেত্রে গোরু কোরবানির পর গোরুর শিং আর ভুঁড়ি হিন্দু মন্দিরে ফেলে হিন্দু মন্দির অপবিত্র করত,… হিন্দুদের জোর করে গোরুর মাংস খেতে বাধ্য করত। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ‘পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে। যে বাগধারাটি মোগল শাসকদের কর্তৃক হিন্দু বামুন আর পণ্ডিতদের জোর করে গোমাংস খাইয়ে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করার ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়। গোরু কোরবানির মূল উদ্দেশ্য হিন্দুদের হেনস্তা আর হিন্দুদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়া। ছোটোবেলা গ্রামে থাকতে দেখতাম মুসলিম প্রতিবেশীরা কোরবানি দেওয়া পশুর শিং আর নাড়িভুঁড়ি হিন্দু বাড়ির উঠোনে ফেলত। আমি বাস্তব জীবনে তেমন ধার্মিক নই; গোরুর প্রতিও আমার কোনো ভক্তিশ্রদ্ধা নেই। কিন্তু আমি শুধুমাত্র এই কারণে গোরু কোরবানির বিপক্ষে যে বকরি ইদে এদেশের মুসলিমদের গোরু কোরবানির মূল উদ্দেশ্য ধর্মীয় নয়, বরং এর পিছনে আছে মুসলিমদের হিন্দুবিদ্বেষ আর হিন্দু নিপীড়নের সুদীর্ঘ ইতিহাস।” প্রেক্ষাপট যাই হোক, গোমাংস ভক্ষণ করা। মুসলিমদের খাদ্যাভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অতএব এসব প্রেক্ষাপট স্মরণ করানোর কোনো অর্থ হয় না।
পেশায় আইনজীবী ও নেশায় সমাজসেবী গোপাল মণ্ডলও বলছেন— “আমার এক পরিচিত ভারতীয় শিল্পী এই সময়ে ঢাকা শহরে রয়েছেন তিনি যা বর্ণনা দিচ্ছেন তা লোকের কাছে অবিশ্বাস্য। ইসলামিরা কেন গো ভক্ষণ করেন? আরব দুনিয়ায় তো এই প্রাণীটা প্রায় অমিল ছিল। তো এই দেশে গো ভক্ষণে এত উন্মাদনা কেন? একটাই কারণ, হিন্দুদের ধর্মীয় আবেগে আঘাত দেওয়া। ওরা গোরু কাটে যে উল্লাসে –“দেখ কাফের, তোরা যে প্রাণীকে দেবজ্ঞানে পুজো করিস, তাকে জবাই করছি! …জাতি, ধর্ম, বর্ণনির্বিশেষে সংবিধান সকল ভারতীয়দের কাছে এক আইন বিষয়ক এক পবিত্র গ্রন্থ, যা সকল ভারতীয়দের নাগরিক অধিকারকে এক সুরক্ষিত বলয় প্রদান করেছেন। গোহত্যা বিষয়টি ধর্মীয় দৃষ্টিতে না-দেখে আমি একজন আইনের ছাত্র হিসাবে আইনের পরিসরেই দেখব। ভারতীয় সংবিধানের ৪৮ তম অনুচ্ছেদে কী আছে, আসুন বন্ধুরা এক বার চোখ বুলিয়ে নেই। আমি স্পষ্টভাবে একটা কথা বলতে চাই— হয় সংবিধানকে মান্যতা দিয়ে গোহত্যা বন্ধ হোক, না হয় সংবিধানের ৪৮তম অনুচ্ছেদ বাতিল বা সংশোধন করে গোহত্যা হোক। অন্তত সংবিধানকে অমান্য করা বন্ধ হোক। সকল ভারতীয় নাগরিকের নাগরিক কর্তব্য সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা করা। পড়ন সংবিধানের ৪৮তম অনুচ্ছেদ টি : Article 48 in The Constitution of India 1949 “Organisation of agriculture and animal husbandry The State shall endeavour to organise agriculture and animal husbandry on modern and scientific lines and shall, in particular, take steps for preserving and improving the breeds, and prohibiting the slaughter, of cows and calves and other milch and draught cattle.” এক বন্ধু আপত্তি তুলেছেন সংবিধানের ৪৮-এ অনুচ্ছেদটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে নয়, এটি Directive Principle এর মধ্যে পড়ে বলে। সুপ্রিমকোর্ট ফ্রি লিগাল এইডের কথা বলার অনেক আগেই সংবিধানে equal justice ও free legal aid ছিল সুনির্দিষ্টভাবে ৩৯-এ অনুচ্ছেদে। আমি কথাগুলো বলছি এই কারণে যে, সংবিধানের মৌলিক অধিকার ব্যতীত বাকি অংশটুকু কি ঠাকুরমার ঝুলি, যা শ্রুতিনন্দন হলেও কার্যকারিতা শুন্য! তবে আর কি, ফান্ডামেন্টাল রাইটের অংশটুকু রেখে বাকি অংশটুকু কবরে পাঠানোর ব্যবস্থা থোক। আমার মতো অনেকেই আপত্তি করবেন না। কিন্তু ঘোর আপত্তি আসবে অ-হিন্দু ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলি থেকে। এই মহান ভারতের মৌলিক অধিকার এর সংবলিত অনুচ্ছেদগুলির মধ্যে ‘সেকুলার’ শব্দটি নেই। আমরা ভালোভাবেই জানি ১৯৭৬ সালে ৪২ তম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ‘সেকুলার’ শব্দটি সংবিধানের মুখবন্ধের মধ্যে স্থান দেওয়া হয়, Fundamental Rights-এর মধ্যে নয়। সারা দেশের পণ্ডিত সমাজের একাংশ সেকুলারিজম সুপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সামিল। তখন যদি আমার মত মূর্খ প্রশ্ন তোলে সেকুলারিজম মানব না, মানব না— ওটা তো মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে না, শুধুমাত্র সংবিধানের মুখবন্ধে মানে গৌরচন্দ্রিকা অংশে উল্লেখ আছে ‘সেকুলার’ শব্দটি। আমায় পাগল ছাড়া আর কিছু কি বলবেন সেই পণ্ডিত সমাজ? তাই বলছি সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদ (৪৮) ডাইরেক্টিভ প্রিন্সিপাল হলেও তা অবশ্যই মান্য। পরিশেষে বলি, মান্যতা দিন পুর্ণ সংবিধানকে মানে মুখবন্ধ থেকে তার সর্বশেষ ৩৯৪-এ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত।…হিন্দু-মুসলমানের মিলনের অন্যতম প্রধান অন্তরায় এই ‘গোহত্যা! রাজনৈতিক কারবারি ও আঁতেল সেকুলাররা এই দিকটা ভাবেন না। শুধু কিছু ভোটের জন্যে হিন্দু-মুসলিমকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেয়, নিজেদের শিক্ষিত আধুনিক উদার প্রমাণ করতে একটি বিশেষ ধর্মের মানুষের আস্থালাভের জন্য গোরু খাওয়াকে সমর্থন করে সচেতনতার সঙ্গে আঘাত করে আর-এক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আবেগকে। একজন মুসলমানের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দিয়ে শূকরের মাংস খাওরার কথা বললে যেমন একজন মুসলমানের কষ্ট হয়, ক্রোধের সঞ্চার হয় তেমনই একজন ধর্মবিশ্বাসী হিন্দুর কাছেও ‘গোহত্যা’ ‘গোমাংস’ বিষয়টা সমান কষ্টের, আঘাতের ও ক্রোধের। কারও মনে কষ্ট দিয়ে ত্যাগ অর্থাৎ কুরবানি হয় না। যদি বলা হয় আল্লাহর কাছে সব মানুষই সমান, তবে শুধু নিজের জিহাদি ইমান রক্ষা করাই ধর্ম নয়, অপরের ইমানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে সম্মান জানানোটাই প্রকৃত ইসলাম ধর্ম’ হওয়া উচিত।”
তবে আইনজীবী যাই বলুক, ৪৮ অনুচ্ছেদ নিশ্চয় সমগ্র ভারতবর্ষে গোহত্যার নিষেধাজ্ঞা নয়। বলা হয়েছে কৃষিকাজ ও পশুপালনের স্বার্থে রাজ্যগুলি গোহত্যা ও গোপ্রজনন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কোনো কোনো রাজ্যে গোহত্যা বা গোরু কাটা নিয়ন্ত্রণ করা হয় গোরুর বয়স, লিঙ্গ, আদৌ উৎপাদনক্ষম কি না প্রভৃতি দেখে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সার্টিফিকেট দিলে তবেই সেই গোরু কাটা যায়। বুঝতে কোনো অসুবিধা নেই যে, ভারতে ‘গগাহত্যা নিষিদ্ধ’ বলে কোনো নির্দিষ্ট আইন নেই। তাহলে এমন আইন দেশের এবং সংবিধানের ধর্মনিপেক্ষতা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ করবে। পরিস্থিতি অনুযায়ী রাজ্য সরকারগুলি এ ব্যাপারে আইন প্রণয়ন করতে পারে। দেশের ২৯ টি রাজ্যের মধ্যে ২৪ টি রাজ্যে গোরু কাটার উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যেমন কেরল, পশ্চিমবঙ্গ, মিজোরাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, সিকিমে নিয়ন্ত্রণ নেই। সিডিউল সাতের ১৫ নং রাজ্যতালিকাভুক্ত ক্ষমতায় গোহত্যা সংক্রান্ত আইনে রাজ্যের এক্তিয়ার বলা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে একটা কথা জোর দিয়ে বলা যায় –হিন্দুদের ধর্মীয়ভাবে আঘাত করার জন্য মুসলমানরা গোহত্যা বা গোমাংস ভক্ষণ করে একথা পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাহলে তো হিন্দুরাও সকলে শূকর হত্যা করে শূকর খেয়ে শূকর ছড়িয়ে মুসলমানদের ধর্মীয়ভাবে আঘাত হানতে পারত। পারত না কি? এমনও তো নয় যে হিন্দুরা ব্যাপক সহনশীল, পরধর্মসহিষ্ণু! সেসব কাহিনি ইতিহাসে লেখা আছে, এমনকি পাথর ফলকেও খোদিত আছে।
এখন প্রশ্ন ভারতীয় উপমহাদেশে এসে মুসলমানেরা কেন গোরু খাওয়া প্রচলন করল? তৎকালীন মুসলমান শাসকরা কি জানতেন না প্রাচীন ভারতে গোমাংস খাওয়ার চল থাকলেও হিন্দুদের বড়ো অংশই এখন আর গোমাংস ভক্ষণ করেন না, গোরুকে দেবতা জ্ঞানে ভক্তি করে কেউ কেউ। সংখ্যাগুরু হিন্দু-ভারতে কীভাবে সংখ্যালঘুদের গোমাংস খাওয়ার রীতি চালু হয়ে গেল! ভারতে তো মাংস খাওয়ার মতো প্রাণীর অভাব ছিল না।– ছাগল, ভেড়া, ঘোড়া, গাধা, খচ্চর, কুকুর, বিড়াল, মোষ, উট, বাঘ, সিংহ, কুমির– আরও কত প্রাণী। সব ছেড়ে গোরু কেন! এমন তো নয় ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা (শূকর বাদে) যে-কোনো প্রাণীর মাংস খাক বা না-খাক গোরু খেতেই হবে! এমন তো নয় মুসলমানরা গোরু না-খেলে মুসলমানিত্ব নষ্ট হয়ে যাবে, বেহেস্তের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে! আসলে তা হয়তো নয়। মুসলমানরা যখন ভারত উপমহাদেশে শাসন ও বাণিজ্য করতে এসেছিল তখনকার ভারতবাসী অবশ্যই কৃষি ও পশুনির্ভর ছিল। কৃষির জন্য গোরু ছিল অত্যন্ত সুলভ। প্রায় সকলের ঘরে ঘরেই গোধন থাকত, বিশেষ করে স্বচ্ছল পরিবারে (গোয়াল ভরা গোরু, পুকুর ভরা মাছ তো সেদিনও ছিল)। যাঁর গোশালায় যত গোরু সে তত ধনী। সম্ভবত প্রাচীন যুগ তথা মধ্যযুগের অনেকটা সময় পর্যন্ত গোরু খাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আসেনি। তখন পর্যন্ত ভারতের অনেকেই গোরুর মাংস খেত। ইসলামে কোথাও মুসলিমদের গোরুর মাংস খাওয়ার কথা লেখা নেই। থাকার কথাও নয়। কারণ আরবে গোরু মোটেই সুলভ ছিল না। সুলভ ছিল দুম্বা আর উট। কোরবানিতেও দুম্বা ও উটের প্রয়োজন হত। মুসলিমরা ভারতে এসে দেখল এখানে দুম্বা আর উট মোটেই সুলভ নয়। সুলভ গোরু আর ছাগল। এটাও দেখল যে ভারতে বহু মানুষ গোরুর মাংস খায়। সংখ্যায় কম হলেও এখনও হিন্দুরা গোমাংস ভক্ষণ করেন, প্রায় ১.৫ কোটি ভারতীয় গোরুর মাংস খান। এটাও বুঝতে হবে হিন্দুধর্মের ধারণা অনেক পরে স্থিতিশীল হয়েছে। মূলত ব্রাহ্মণ্যধর্মের উপর দাঁড়িয়ে ছিল ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতি। সংস্কৃতজ্ঞ, গবেষক, লেখক মাহবুব লীলেন মনে করেন– বৈদিক শাস্ত্রে যেখানে গোরু রন্ধনপ্রণালী পর্যন্ত বর্ণনা দিয়া তারে এক নম্বর খাদ্য-মাংস কওয়া হইছে, সেইখানে উৎসব ছাড়া নিষেধ কইরা দেয়া হইছে উটের মাংস খাওয়া। আবার যেই দেশে উট আছে কিন্তু গোরু নাই সেই আরবে জন্ম নেয়া ইসলাম ধর্মেও কেমনে জানি না উট পিছলাইয়া এক নম্বর মাংস তালিকায় পইড়া গেছে গোরু। হিন্দুদের রান্নাঘর থাইকা গোরুরে না-হয় রক্ষা করছে গৌতমবুদ্ধের অহিংসা আন্দোলন। কিন্তু উটরে আগাগোড়া কেডা রক্ষা করল সেই ইতিহাস তো পাই না কোথাও।… অস্ট্রেলিয়ান উটগুলা সুন্নতি পশু হইলেও জাতে কিন্তু ইন্ডিয়ান। ব্রিটিশরা অস্ট্রেলিয়ার ভূমি জরিপের কামে ইন্ডিয়া থাইকা নিয়া গেছিল ওইসব উটের পূর্বপুরুষ মাতাগো। তারপর জরিপের কাম শেষে চইরা খা কইয়া ছাইড়া দিছে। গোরু ছাড়া অন্য প্রাণী তো কোরবানি দেওয়াই যায়। অনেক গরিব মুসলিম তো ছাগল, মুরগি কোরবানি দিয়ে থাকে। অনেকে আবার উট করবানি দেয়।
আমি দেখছিলাম মুসলমানদের গোরু খাওয়াতে যত-না আপত্তি হিন্দুবাদীদের, তার চেয়ে বেশি আপত্তি গোরু কোরবানিতে। গোরু কোরবানি যখন হিন্দুদের ধর্মীয় আঘাত হানে, তখন মুসলমানরা এ ধরনের কোরবানি থেকে বিরত থাকতেই পারে বা আড়ালে কাজটি সারতে পারে। বিরত হওয়া তো দূরের কথা –কিছু কিছু দুষ্কৃতি মুসলমান কোরবানির পর গোরুর উচ্ছিষ্ট (শিং, খুর ইত্যাদি) হিন্দুদের মন্দিরে গিয়ে ফেলে আসে এবং তার ছবি তুলে সোসাল মিডিয়ার পোস্ট করে। এছাড়া উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জবাই করা গোরুর রক্তাক্ত বীভৎস ছবিও ছড়িয়ে পড়ে। এই বীভৎস ছবি পোস্ট করা যে হিন্দুদের আঘাত করা এটা খুবই স্পষ্ট। হিন্দু কেন, এমন বীভৎসতা কারই-বা দেখতে ভালো লাগে! কোমলমতি হৃদয়ের মানুষদের কি ট্রমাচ্ছন্ন করে না? সম্প্রীতির পক্ষেও খুব বিপজ্জনক এটা, হুমকিই বটে। কোরানে তো কোথাও গোরু কোরবানি দিতে আল্লাহ নির্দেশ দেয়নি। কোরবানি বিষয়ে দুটি ভিন্ন কাহিনি আমরা কোরানে পাই, কোথাও গোরু নেই— হজরত আদমের পুত্রদ্বয় হাবিল-কাবিলের কোরবানিতে কিংবা হজরত ইব্রাহিমের কোরবানিতেও গোরু ছিল না। হাবিল-কাবিলের কোরবানিতে ছিল গমের শীষ এবং দুম্বা। অপরদিকে ইব্রাহিমের কোরবানিতে ছিল তাঁর প্রিয় সন্তান। সেসময় ভেড়া, দুম্বা, শস্য বা গম ইত্যাদি কোরবানির জন্য আল্লাহর দরকারে পেশ করা হত। যার কোরবানি কবুল হত আল্লাহর হুকুমে আকাশ হতে আগুন এসে তা ভস্মীভূত করে দিত। আর যাঁরটা কবুল হত না তাঁরটা পড়ে থাকত। তবে ভারতের সুপ্রিমকোর্ট জানিয়েছেন, বকরিদে কোরবানি করা মুসলমানদের ধর্মীয় অধিকার, এটা নিষিদ্ধ করা যায় না। আমিও বলব খাদ্যরুচি আপনা আপনা। আপ রুচি খানা, পর রুচি পরনা। অর্থাৎ নিজের রুচিতে খাদ্যগ্রহণ করবে, পরের রুচিতে পোশাক পরিধান করবেন। কারোকে যেমন জোর করে তাঁর অপছন্দের খাবার খাওয়ানো যায় না, কাবোর পছন্দের খাবার কারো মুখ থেকে নেওয়া যায় না। এটা অধর্মের কাজ।
২০১৬ সালের ঈদে আমার এক বন্ধু জিম নওয়াজ সচেতনতার জন্য ফেসবুকে একটি পোস্ট দিলেন –“ঈদের নামাজের খুদবা’র পরে ঈদগাহ কমিটির পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হল— “পশু কোরবানির পরে রক্ত পরিষ্কার করে ব্লিচিং ছড়িয়ে দিন। পশুর অব্যবহৃত বস্তু যেমন শিং, খুর, কান ইত্যাদি মাটি খুড়ে পুঁতে দিন। এগুলি যেখানে-সেখানে ফেলবেন না, এতে যেমন পরিবেশ দূষিত হবে, তেমনই অন্য সম্প্রদায়ের মনেও আঘাত লাগতে পারে। অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ যাতে কোনোভাবে আঘাত না পান, সেদিকে খেয়াল রাখবেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রাখুন। তাকাব্বাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম।” এই স্ট্যাটাসের পরিপ্রেক্ষিতে জনৈক উল্লাহ গর্জে উঠে লিখলেন “অন্য ধর্মে আঘাত লাগবে বলে পশুর অব্যবহৃত বস্তু যেমন সিং, খুর, কান মাটিতে নীচে পুঁততে যাব কেন?” এই মন্তব্যের অপরাধে অন্যান্য মুসলমান বন্ধুরা তীব্র প্রতিবাদ জানায়, ধিক্কার সহ ওকে ব্লক করার অনুরোধ করে। তৎক্ষণাৎ উল্লাহকে ব্লক করা হয়। আমাদের। সমাজে যেমন জিম নওয়াজরা আছে, তেমনই উল্লাহরাও আছে। জিম নওয়াজের আরও একটি সোস্যাল স্ট্যাটাস উল্লেখ না-করলেই নয়। বকরি ইদের আগের দিন জিম সোসাল মিডিয়ায় ঘোষণা করলেন— “আগামীকাল যাঁরা ফেসবুকে জবাই করা পশুর রক্তাক্ত ছবি পোস্ট করবে এবং সেই ছবিকে যাঁরা সমর্থন করবে, তাঁদের প্রতি আগাম ঘৃণা রইল। আমায় ফ্রেন্ডলিস্টে এমন কেউ থাকলে আমি তাঁদের অবশ্যই আনফ্রেন্ড করব ইনশাআল্লাহ।” হ্যাঁ, জিম নওয়াজ পশ্চিমবাংলার মুসলমান। এই সচেতনতা ও সতর্কতা আশার আলো জাগায় বইকি।
পাশাপাশি তবে এটাও বলা দরকার কিছু দাঙ্গাবাজ অপদার্থ কুলাঙ্গার মুসলমান সোস্যাল মিডিয়ায় কোরবানি করা গোরুর ছবি যেমন পোস্ট দিচ্ছে, তেমনই তার সঙ্গে ক্যাপসন লিখে দিচ্ছেন— ‘এভাবেই মালাউনদের জবাই করা হবে ইনশাআল্লাহ’, ‘হিন্দুর মাকে জবাই করে দিয়েছি’, মাশা-আল্লাহ আমাদের বাংলাদেশের ভাইয়েরা কত সুন্দর হিন্দুদের মাতাকে জবাই করছেন’ ইত্যাদি। কোনো দেশের সংখ্যালঘুদের এইভাবে মানসিক নির্যাতন বোধহয় বিশ্বে বিরল। এই ধরনের অসংযত অসহিষ্ণু পোস্ট এবং মন্তব্য সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়ে চলেছে, রক্তপাত ঘটাচ্ছে। মনে রাখতে হবে এলাকায় আগুন লাগলে দেবালয়ও রক্ষা পায় না, এটা না ভুললে সকলের মঙ্গল। অথচ রাষ্ট্র নির্বাক। সুশীল সমাজও ভীত, সন্ত্রস্ত। উচিত কথা বললে বন্ধু বেজার। হজম হয় না। পেটরোগা জন্মান্ধরা চাপাতি শানাবে।
অভিযোগ : মুসলমানদের তোষণ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই যে সংখ্যালঘুদের তোষণ করা হয় একথা আংশিক হলেও সত্য। ইফতার পার্টিতে গিয়ে মুসলমানি কায়দায় হিন্দু নেতানেত্রীদের দোয়া করা, মাথায় কাপড় দেওয়া, টুপি (ফেজ) পরা, খোদা হাফিজ বলা, ইমামদের প্রতি মাসে ২০০০ টাকা মুয়াজ্জিনদের ১০০০ টাকা দেওয়ার ঘোষণা, ‘বন্দেমাতরম’কে জাতীয় সংগীতের মর্যাদা না-দিতে পারা, সারা ভারতে অভিন্ন আইন প্রয়োগ করতে না-পারা— সবই তোষণের মধ্যে পড়ে। কারা তোষামোদ করে না– কংগ্রেস, বামপন্থী, বিজেপি, তৃণমূল ইত্যাদি সমস্ত রাজনৈতিক দল। তবে নেতাদের এই তোষণ যে ভালোবেসে হয় তা নয়, বিষয়টি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। এই তোষণ সত্যিই যদি ভালোবাসার হত শ্রদ্ধার হত, তাহলে সংখ্যালঘুদের আর্থ-সামাজিক অবস্থাই বদলে যেত। বাস্তবে তা হয়নি। উল্টে এই ভুয়ো তোষণে মুসলিমরা যে অন্ধকারে ছিল সেই অন্ধকারেই আছে। মুসলিম সম্প্রদায় কী সামাজিক কী অর্থনৈতিক কী রাজনৈতিক উন্নতি সরকারই চায়নি। এটা লজ্জার।
মনে পড়ছে, দমদম বিমানবন্দর সম্প্রসারণের জন্য জমি প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। সেই জমি পেতে গেলে হিন্দুদের বেশ কিছু মন্দিরসহ একটি মসজিদও ভাঙা পড়ছিল। মুসলিম তোষণের ফলে মসজিদ অক্ষত থাকলেও মন্দির অক্ষত থাকেনি। মসজিদকে অক্ষত রাখা হয়েছিল রাস্তা ঘুরিয়ে দিয়ে। বেশ কয়েক বছর আগে। কল্যাণী রেলস্টেশন সংলগ্ন এলাকায় অবৈধ কিছু দোকানপাট সহ একটি মন্দির গড়ে উঠেছিল। রেলস্টেশন সংলগ্ন এলাকা সম্প্রসারণের জন্য সেই মন্দির বুলডোজার দিয়ে খুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বিনা বাধায়। মন্দিরের স্থলে যদি সেটা মসজিদ হত তাহলে সেদিন অবলীলায় ভাঙতে পারত না রেল-প্রশাসন। এমন আচরণ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না। এরকম আরও অনেক ঘটনাই উল্লেখ করা যায়। তবে এ দায় আমি মুসলমানদের ঘাড়ে চাপাব না। এ ত্রুটি রাজনীতিকদের, প্রশাসনের। তোষণের ফল, হয়তো অজান্তেই।
তবে এসব তোষণ বাহ্যিক, দেখনদারি। বৃহৎ মুসলিম সমাজে কোনো ফায়দা হয় না। কারা তোষিত হয়? রাজনীতির ৬৬ শতাংশ, চাকরির ৮৭ শতাংশ, ব্যাবসায় ৯৭ শতাংশ এবং জমির ৯২ শতাংশ দখলে আছে তাঁদের– যাঁরা ভারবর্ষের মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ১৫ শতাংশ এবং তাঁরা উচ্চবর্ণেরা মুসলিম সম্প্রদায়, ভারতবর্ষের মোট জনগোষ্ঠীর যারা ১৪.৫ শতাংশ, আইএএস অফিসারদের মধ্যে তাঁরা মাত্র ২ শতাংশ। সারা ভারতবর্ষে মাত্র ৮৮ জন আইপিএস অফিসার আছেন যাঁরা মুসলিম। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে মাত্র ২ শতাংশ। মুসলিম সম্প্রদায়ের কোনো শিল্পপতিই নেই। ভারতে মাথাপিছু জাতীয় আয় থেকে মুসলিম সম্প্রদায়ের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১০ শতাংশেরও কম। (সূত্র : The Caste and Dominance of the state Power)
মেকি তোষণ বা মেকি ভালোবাসা দিয়ে কারোর পেট ভরে না। জাতির উন্নতি করতে চাইলে জাতির শিক্ষা, কর্মসংস্থান, গৃহ নিয়ে গঠনমূলক কাজ করা দরকার। থুতু দিয়ে চিড়ে ভেজানো যায় না। এর ফলে সেই জাতির লাভের চেয়ে ক্ষতি হয় বেশি। সেদিক থেকে বলতে গেলে মুসলিম জাতি বহুদূর পিছিয়ে আছে। দারিদ্রতা ঘোচানো যাচ্ছে না। শিক্ষার প্রসার ঘটানো হয়নি। ধর্মীয় পরিচয় দিয়ে নয়, অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠী হিসাবে মুসলিমদেরও বিবেচনা করে তাঁদের উন্নয়নের জন্য অবিলম্বে নীতি নির্ধারণ জরুরি। কিন্তু তোষণের বদনাম ছাড়া মুসলিমদের ভাগ্যে কিছুই জোটেনি বিগত ৭৩ বছরে।
রাজ্যে মুসলিম তোষণ হচ্ছে বলে যে রাজনৈতিক বিষ প্রতি দিন ঢেলে দেওয়া হচ্ছে, তা কতখানি অসার উচ্চশিক্ষায় মুসলিমদের অংশগ্রহণ দেখেই বোঝা যায়। সম্প্রতি মানব উন্নয়ন মন্ত্রক উচ্চশিক্ষার সর্বভারতীয় সমীক্ষার (অল ইন্ডিয়া সার্ভে অন হায়ার এডুকেশন) ইউনিট স্তরে তথ্য প্রকাশ করছে। এই তথ্য অনুসারে উচ্চশিক্ষায় রাজ্যের গর্ব প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৫-১৬ সালে কোনো মুসলিম ছাত্রছাত্রীর নামও নথিভুক্তি হয়নি। রাজ্যে আর-এক খ্যাতনামা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যাচ্ছে ২০১৫-২০১৬ সালে সাকুল্যে ৫০ জন মুসলমান ছাত্রছাত্রীর নাম নথিভুক্তি হয়েছে। আর একটু ভেঙে দেখা যাক, মুসলমান ছাত্রছাত্রী যেহেতু এত কম, তা শতাংশের হিসাবে দেখানো সম্ভব নয়, ২০১৪-১৫ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ১০,৫২৬, এর মধ্যে মুসলমান মাত্র ৮৯ জন। গত দশ বছরে এ বিষয়ে তথ্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেছে, রাজ্যে উচ্চশিক্ষায় যে প্রতিষ্ঠানগুলি যত উৎকৃষ্ট, সেখানেই মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের আণুবীক্ষণিক উপস্থিতি। উচ্চশিক্ষায় মুসলিমদের আণুবীক্ষণিক অংশটাই সমাজে তাঁদের ক্ষমতার অবস্থানগত মান সম্পর্কে স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। শিক্ষার সঙ্গে সক্ষমতার যোগ শিক্ষার স্তরভেদে লক্ষ করা যায়, লিখতে ও পড়তে জানলে জীবনের গুণগত মানের প্রভূত উন্নতি ঘটে। শিক্ষার ও বিশেষ কাজে দক্ষতার সঙ্গে কর্মসংস্থানের সুযোগ জড়িত। ইউনেস্কো মনে করে শিক্ষা লাভের সঙ্গে সঙ্গে দারিদ্র বিমোচনের পথও সহজ হয়ে যায়। উচ্চশিক্ষা সুযোগের ব্যাপ্তি অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়, শিক্ষার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে নাগরিক নিজের মানবাধিকার সম্পর্কে জানতে পারে, আইনি অধিকারের বাস্তব রূপায়ণ করতে শেখে এবং নাগরিক রাজনৈতিক বক্তব্য পেশ করতে পারে। শ্রেণি ও জাতিবৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে এবং করেও থাকে। দার্শনিক মার্থা নুসবম সামাজিক প্রগতির জন্য উচ্চশিক্ষায় উপর জোর দিতে গিয়ে বলছেন, “আমরা খুব সহজেই দেখতে পাই যে, আমরা যখন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষায় দিকে যাই, তখন এই লক্ষ্যগুলো হারিয়ে যায় না। প্রকৃতপক্ষে সেগুলো আরও জরুরি হয়ে ওঠে, যেহেতু এ যাবৎ প্রান্তিক হয়ে থাকা গোষ্ঠীগুলোর সামাজিক ক্ষমতার উপরে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে যে শিক্ষা দেওয়া হয় তার শক্তিশালী প্রভাব পড়ে।” উচ্চশিক্ষার সর্বভারতীয় সমীক্ষায় উচ্চশিক্ষায় সামাজিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের ছবি দেখতে পাওয়া যায়। এই সমীক্ষা অনুসারে বিগত তিন বছরে রাজ্যের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে মোট নথিভুক্ত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মুসলিমদের অংশগ্রহণ ৮ শতাংশ, সারা দেশের ক্ষেত্রে এটা তিন শতাংশেরও নীচে। উচ্চশিক্ষায় রাজ্যে উৎকর্ষ কেন্দ্রগুলিতে মুসলিমদের অংশগ্রহণ কম হলেও মুসলিম অধ্যুষিত মালদায় গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে উল্লেখজনকভাবে মুসলমানদের অংশগ্রহণ দেখা যায়; বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ শতাংশ ছাত্র মুসলমান। এ ছাড়া রাজ্যের সংখ্যলঘু দপ্তর পরিচালিত আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম ছাত্রের আধিক্য দেখা দেয়। উচ্চশিক্ষায় মুসলিমদের লক্ষণীয় অনুপস্থিতির কারণ কী হতে পারে? এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে কয়েকটি কারণ তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। প্রথমত, সমাজ কাঠামোতে শহরের আধিপত্যের ফলে উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রগুলি বেশির ভাগ শহরকেন্দ্রিক। রাজ্যের মুসলিমদের বেশিরভাগই গ্রামে থাকে। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাতে জনসংখ্যার অনুপাতে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এটা আশা করা হয় কলকাতার ১৯ থেকে ২৯ বছর বয়সি ১১ হাজার ছেলেমেয়ের জন্য একটি কলেজ থাকবে। রাজ্যের ক্ষেত্রে উক্ত বয়সের প্রতি ৩৪ হাজারে একটি কলেজ। অন্য দিকে যেখানে মুসলিম অধ্যুষিত জেলাগুলিতে ওই বয়সি ৫৬ হাজার প্রতি একটা কলেজ। উত্তর দিনাজপুরের ক্ষেত্রে একটা কলেজ প্রতি এই সংখ্যা ৭৬ হাজার। পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা থাকলেও আর্থিক কারণে মেধাবী মুসলিম ছাত্রছাত্রী মাঝপথে পড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। প্রতীচী-অ্যাসোসিয়েশন স্ন্যাপের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, রাজ্যের মুসলিমদের ৮০ শতাংশ পরিবারের আয় ৫০০০ হাজার টাকার নীচে। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষায় ক্রমশ ফি বৃদ্ধি ও বেসরকারিকরণের ফলে আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের কাছে উচ্চশিক্ষা অধরা।
আর্থিকভাবে খানিক সচ্ছল হলেও শহরের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগের অভাবে গ্রাম থেকে আসা ছেলেমেয়ের বাসস্থানের জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয়, মুসলমান ছাত্রছাত্রীদের ঘর ভাড়া পেতে সমস্যা। কারণ কেবল কলকাতায় নয়, জেলা শহরেও একইভাবে তাঁদের সন্দেহের চোখে দেখা হয়। অচ্ছুৎ ভাবা হয়। ঘরভাড়া তো দূরের কথা, হোটেল থেকে পর্যন্ত ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয়। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ছাত্রাবাসগুলিতে সুযোগ পাওয়া খুবই দুর্লভ। প্রাক-স্বাধীনতা যুগে প্রতিষ্ঠিত কলকাতায় মুসলমান ছাত্রছাত্রীদের হোস্টেলে সাকুল্যে দেড় হাজার ছাত্রছাত্রী থাকতে পারেন। শিক্ষার অধিকার আইনের ফলে বিনামূল্যে ৬-১৪ বছর বয়সি শিশুদের বিনামূল্যে পড়াশুনোর সুযোগ তৈরিতে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত মুসলমান ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। তবে সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, মাধ্যমিক শিক্ষার পর থেকেই মুসলমান ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে স্কুলছুট হওয়ার একটা তীব্র ঝোঁক দেখা যাচ্ছে। সমাজব্যবস্থায় এখনও পুরুষকে অর্থ-উপার্জনকারী যন্ত্র হিসাবে ভাবা হয়, রাজ্যে মুসলিম ছেলেদের মধ্যে স্কুলছুট হওয়ার প্রবণতা বেশি করে দেখা হচ্ছে। এই কারণেই অন্যান্য সামাজিক গোষ্ঠীর তুলনায় মুসলিম ছাত্রদের বিদ্যালয়ে থাকার গড় বছর খানিক কম। আর্থিক কারণের সঙ্গে সঙ্গে উচ্চশিক্ষা যে ভবিষ্যতে রুটিরুজি জোগানোর ব্যাবস্থা করতে পারবে, এমন নিশ্চয়তা না-থাকার কারণে উচ্চশিক্ষায় প্রতি আগ্রহ কমছে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গত পাঁচ বছরের স্টাফ সেনসাসে দেখা যাচ্ছে, রাজ্যে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে গড়ে ৫ শতাংশ মুসলিম। বেসরকারি সংগঠিত ক্ষেত্রেও মুসলিমদের অংশগ্রহণ খুব একটা আশাপ্রদ নয়। শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলিমদের অংশগ্রহণ বাড়াতে, ওবিসি হিসাবে ১০ শতাংশ সংরক্ষণের সুযোগ থাকলেও, ভর্তির মরসুমে লক্ষ করা গেছে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কার্যত সংরক্ষণের নিয়ম নীতিকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে। এ বিষয়ে ভূড়ি ভূড়ি অভিযোগ উঠেছে। আশার কথা, উচ্চশিক্ষায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কারিগরি ও চিকিৎসাশাস্ত্রে মুসলিম ছেলেমেয়েদের অংশগ্রহণ গত এক দশকে লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা ধরা যাক, মোট ৮৯ মুসলমান ছাত্রের মধ্যে ৬৬ জন অর্থাৎ ৭৫ শতাংশই বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং শাখায় পড়াশোনা করেন। রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজ ও অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে খানিকটা একই চিত্র দেখা যায়। সামগ্রিকভাবে উচ্চশিক্ষায় মুসলিমদের আণুবীক্ষণিক উপস্থিতি নিয়ে কথা শুরু করলে, অনেকেই ধর্মীয় পরিচিতির বিচারে উচ্চশিক্ষায় অংশগ্রহণকে ব্যাখ্যা করার প্রবণতাকে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি বলে দাবি করেন। তাঁদের মতে উচ্চশিক্ষায় মেধাই শেষ কথা। মেধায় যে খামতি নেই, তা উপরের তথ্যই পরিষ্কার করে দেয়। বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং শাখায় পড়াশোনা করা মুসলিমদের সাফল্য তাঁদের নিজেদের চেষ্টায়। মুসলিমদের জন্য সরকারি ও সংগঠিত ক্ষেত্রে ক্রমশ কাজের সুযোগ সংকুচিত হওয়ায় এই সমাজে পেশাজীবী শিক্ষার প্রতি ঝোঁক লক্ষ করা যায়।
পেশাজীবী শিক্ষায় যাতে তাঁরা সুযোগ পায় তার জন্য আল-আমিন মিশন বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে। অন্যদিকে, সমাজবিজ্ঞানের উচ্চশিক্ষায় মুসলিমদের অংশগ্রহণের একটা বড়ো বাধা ইংরেজি না-জানা। পশ্চিমবঙ্গের উচ্চশিক্ষায় ইংরেজি ভাষার প্রচলন আজও জোরদার, এ ক্ষেত্রে ইংরেজি জানাও প্রয়োজনীয়। অথচ গ্রামে বসবাসকারী ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ-বঞ্চিত প্রজন্ম তার দরুন ভুগছে। সমাজবিজ্ঞান পাঠে নিজের বক্তব্য জাহির করতে ইংরেজি জরুরি হয়ে পড়ে। অন্যদিকে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কারিগরিশিক্ষায় অঙ্ক অনেকখানি এগিয়ে যেতে পারে। আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের অনেকেই প্রোফেশনাল কোর্সে পড়াশোনার জন্য সরকারি ও অসরকারি সংস্থা থেকে আর্থিক সাহায্য পাচ্ছেন; রাজ্যের সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগমের বৃত্তি ও শিক্ষাঋণের কারণে এবং শিল্পপতি মুস্তাক হোসেনের জি ডি একাডেমি ও স্ন্যাপ-এর মাধ্যমে দরিদ্র মুসলিম পরিবারের কিছু ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষায় সুযোগ পাচ্ছে। স্বাধীনতার সত্তর বছর, সাচার কমিটি রিপোর্টের দশ বছর পরেও উচ্চশিক্ষা প্রাঙ্গণে মুসলিমদের অকিঞ্চিৎকর উপস্থিতি গণতান্ত্রিক ভারতে সামাজিক ন্যায়ের পরাজয়। রাজ্যে মুসলিমদের ধর্মীয় পরিচিতির গণ্ডি ভেঙে আর্থ-সামাজিকভাবে পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠী হিসাবে বিবেচনা করে মুসলিমদের উন্নয়নের জন্য নীতি-নির্ধারকরা নতুন করে ভাববেন, যেন উচ্চশিক্ষায় উপযোগী মুসলিম ছেলেমেয়েরা আরও বেশি করে শিক্ষার সুযোগ পায়। (সাবির আহমেদ, এই সময়)
মুসলিমদের শিক্ষা নিয়ে মুসলিম তোষণকারী’ সরকার কতটা ভাবেন, মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে না ভাবাতেই অনুভব করা যায়। মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে যখন তীব্র আন্দোলন হচ্ছে, তখন আশ্বাসের বদলে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী বললেন –“ওরা পড়াশোনা করলে রাজমিস্ত্রীর কাজ করবে কে?” স্বাধীনতার ৭০ বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও মুর্শিদাবাদে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেনি। মুর্শিদাবাদে প্রায় ২৬ টি কলেজ থাকলেও উচ্চশিক্ষায় জন্য একটা পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় নেই। এর ফলে উচ্চশিক্ষায় দিক দিয়ে পিছনের সারিতে রয়েছে এই জেলা। শুধু উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রেই নয়, প্রাথমিক, মাধ্যমিক স্তরেও বিভিন্ন দুর্দশা পরিলক্ষিত হয়েছে। রাজ্যে কংগ্রেস, সিপিএম দীর্ঘদিন শাসন করলেও জেলায় কোনো বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার দীর্ঘ ৮ বছর অতিবাহিত হলেও বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে টনক না-নড়ায় জেলাজুড়ে আন্দোলনে নামেন ছাত্র সংগঠন, অরাজনৈতিক সংগঠনগুলো। পদযাত্রা থেকে শুরু করে জেলা শাসকের অফিস অভিযান সহ নানান ধরনের বিক্ষোভ কর্মসূচি ডেপুটেশন অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি নিয়ে বিধানসভা অভিযানও করেছিল ছাত্ররা। অবশেষে আন্দোলনের চাপে পড়ে পঞ্চায়েত ভোটের ঠিক আগের মুহূর্তে ফেব্রুয়ারি মাসে জেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোষণা করেছিল রাজ্য সরকার। মুর্শিদাবাদের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হল। শেষপর্যন্ত ২০১৮ সালে বিধানসভায় বিল পাশ হয় মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় নামে। কৃষ্ণনাথ কলেজকে সামনে রেখেই হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। ইতিমধ্যেই কলেজ কর্তৃপক্ষ কলেজের জমি রাজ্য শিক্ষা দপ্তরের হাতে দিয়েছেন। কিন্তু একটা বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে অনেক জমির দরকার। সে জমিও পাওয়া গেছে। শহর থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে পূর্ত দপ্তরের বিশাল জমি পাওয়া গেছে। জমি হস্তান্তরিতও হয়েছে। ৩৪ নং জাতীয় সড়কের পাশে ওই জমি। পিছনেই হাওড়া ডিভিশনের খাগড়াঘাট রেলস্টেশন। ফলে পড়ুয়াদের কোনো সমস্যা হবে না। এছাড়াও শহরের গোরাবাজারে ভাগীরথী নদীর পাড়ে কলেজের পুরনো ছাত্রাবাসের সামনে রয়েছে বিশাল মাঠ। এখানেই এক সময় থাকতেন মাস্টারদা সূর্য সেন। সেখানেও কাজ চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপিআর অর্থাৎ ডিটেল প্রোজেক্ট রিপোর্ট তৈরি হয়নি। বুধবার বহরমপুরে প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী ডিপিআর তৈরির জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। ৭ বছর আগে জেলার আর-এক স্বপ্নপূরণ করেছিলেন রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী, সেটি হল মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। মোয়াজ্জেন ভাতা নয়, তোষণ যদি করতেই এভাবেই হোক। গঠনমূলক কিছু হোক। দেশের কোনো জাতি বা সম্প্রদায় পিছিয়ে থাকা মানে দেশের পিছিয়ে থাকা। সেই সম্প্রদায় সংখ্যালঘুই হোক বা সংখ্যাগুরু। সব শ্রেণির মানুষ সমানভাবে উঠে আসুক। এতে সমগ্র জাতির লাভ বই লোকসান হবে না।
অভিযোগ : মুসলিম মানেই জঙ্গি। এই মতের প্রবক্তারা বলে থাকেন— “সব মুসলিমরা জঙ্গি নয়, কিন্তু সব জঙ্গিরাই মুসলিম”। কী আছে সারবত্তা এই বাণীর ভিতর? জঙ্গি মানেই মুসলিম? সন্ত্রাসবাদ মানেই ইসলাম? ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ? ইসলাম ধর্মের নামে সন্ত্রাসী জিহাদ? এই কথার মধ্যে আশার কথা বললেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ২০১৪ সালে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভারতের রাষ্ট্রপতি ‘ভারতরত্ন’ প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেন, “ভারতের মুসলিমরা জঙ্গি নয়।… ধর্ম থেকে সীমান্ত, কোনো কিছুকেই পরোয়া করে না সন্ত্রাসবাদ। তাঁদের একটাই মতাদর্শ ধ্বংস’। মানবতার কোনো মূল্য নেই তাঁদের কাছে। এখানে ভালো সন্ত্রাসবাদ, খারাপ সন্ত্রাসবাদ বলে কিছু হয় না। এই ধরনের শ্রেণি বিভাজন আমার কাছে অর্থহীন।”
ভারতের মুসলিমরা না-হয় জঙ্গি নয়, কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি হামলা এবং এসব হামলার সঙ্গে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের সংশ্লিষ্টতার কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে মুসলিম-বিদ্বেষী মনোভাব ক্রমেই প্রকট হচ্ছে যে! আসলে ইউরোপ-আমেরিকায় অনেকে মুসলিম ও জঙ্গিবাদ সমার্থক মনে করছেন। জঙ্গিবাদের উত্থানের পিছনে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে দায়ী করে পশ্চিমাদের এই মুসলিম-বিদ্বেষ বিশ্বজুড়ে এক নতুন সংকট সৃষ্টি করবে বলেই আশঙ্কা। সম্প্রতি ভ্যাটিকানের পোপ এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বলেন, “আমি মনে করি সহিংসতার সঙ্গে ইসলামকে একাত্ম করে দেখা ঠিক নয়। এটা ঠিক নয় এবং এটা সত্যও নয়।” পোপের এই বক্তব্য পশ্চিমাদের মনোভাব বদলাতে আদৌ কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে কী? আসলে ইউরোপ আমেরিকা ‘জঙ্গি-ভূত’ দেখতে শুরু করেছে। আর এই ভূতের ভয়ে আতঙ্কে কাঁপছে পশ্চিমা সভ্যতা! ওদের ভাষায়, ‘ইসলামিস্ট টেরোরিস্ট’ আতঙ্ক। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন, বেলজিয়াম, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র –সব দেশই জিহাদি হামলার আশঙ্কায় তটস্থ, সন্ত্রস্ত। রাজনৈতিক ইসলামের জঙ্গি, ওয়াহাবি-সালাফি জিহাদ বিপন্ন করে তুলেছে তার সামাজিক স্থিতি। আর এতে সম্প্রসারিত হচ্ছে ইউরোপের দেশে দেশে বসবাসকারী লাখ লাখ মুসলিমের বিরুদ্ধে সন্দেহ, বিদ্বেষ ও জাতি-ঘৃণা। এখন সবার কাছে যে প্রশ্নগুলি দেখা দিচ্ছে— মুসলিমরাই কি টুইন টাওয়ার ধ্বংস করেনি? মুসলিমরাই কি শার্লি এবদোর ঘটনা ঘটায়নি? মুসলিমরাই কি প্যারিস কিংবা নিসে হত্যালীলা চালায়নি? আর মুসলিমরাই কি আইএস তৈরি করেনি? করেছে তো! কিন্তু সে জন্য সব মুসলিম কি সন্ত্রাসবাদী?
আমেরিকা তৎসহ পশ্চিমের ধনতান্ত্রিক দেশগুলির ইহুদি ও খ্রিস্টানদের কাছে প্রধান প্রতিস্পর্ধী প্রতিদ্বন্দ্বী সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী হল ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা। কারণ ইসলাম ধর্মাবলম্বীরাই জনসংখ্যা ও সম্পদের দিক থেকে ইহুদি-খ্রিস্টানদের ঘাড়ে সর্বদা নিঃশ্বাস ফেলছে। ইহুদি-খ্রিস্টান ধনবানরা সবসময়ই ভীত হয়ে আছে, এই বোধহয় ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা গোটা বিশ্বে অর্থনৈতিক রাশ হাতে নিয়ে ফেলল! গোটা বিশ্বের ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের দরকার নেই। শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনৈতিক উত্থান হলেই পশ্চিমের ইহুদি-খ্রিস্টানদের ধনকুবেরদের অর্থনৈতিক দাদাগিরি খতম। এ লড়াইয়ের শুরু ক্রুসেডের যুগ থেকেই। নবি মোহাম্মদ তারও অনেক আগে (১৫০০ বছর আগে) বুঝেছিলেন এই ইহুদি-খ্রিস্টানরা ইসলামিদের পক্ষে কতটা হুমকিস্বরূপ।
সেই ক্রুসেডের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত এই ইহুদি-খ্রিস্টানরা মুসলিমদের পিছনে পড়ে আছে। তাঁদেরকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ ট্যাগ লাগিয়ে গোটা বিশ্বকে এককাট্টা করতে সক্ষম হয়েছে। মুসলিম-বিশ্ব এক আন্তর্জাতিক দলনের শিকার। ওসামা বিন লাদেন ও তাঁর আল কায়দা সংগঠন, আইসিসের জঙ্গিদের তৈরি করেছে পশ্চিমের ধনকুবেররাই। মুসলিম-বিশ্বকে কোনঠাসা করে দিতেই এইসব সৃষ্টি। আল কায়দা ও আইসিসের জঙ্গি সংগঠনগুলো মূলত ইসলামিক দেশগুলোকে ধ্বংস করতেই আসরে নেমেছে। ইসলামকে ভুল পথে চালিত করে চলেছ এঁরা, যাঁর শিকার হচ্ছে সাধারণ মুসলিমরা। এখন প্রশ্ন তুলতে পারেন, কেন বেছে বেছে মুসলিমদেরই আমেরিকারা জঙ্গি বানিয়ে দিচ্ছে? কেন হিন্দু, বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মের জঙ্গি বানাচ্ছে না? যথার্থ প্রশ্ন বটে। কেন হিন্দু, বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মের মানুষদের জঙ্গি বানাতে যাবে? কী আছে তাঁদের? কোন্ দিক থেকে ধনতান্ত্রিক দেশের ধনকুবেরদের টেক্কা দিতে পারে? যদিও হিন্দু জঙ্গি নেই একথা বলা যায় না। এঁদের একটা অংশ মুসলিম জঙ্গিদের সাহায্য করে, আর-একটা অংশ দেশের মধ্যে দলিত ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী করে। প্রমাণ? এক হিন্দু জঙ্গি স্বপন সরকারের বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত ধারায় মামলা রুজু করা হয়। জারি হয়। ইউএস ২০-বি আইপিসি, ১০(এ), ১৩(২)/১৮ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে কোচবিহার অ্যাডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট অ্যান্ড সেশন আদালত। (এখন খবর, ৩ অক্টোবর, ২০১৯)
তাহলে আপনি কি বলতে চাইছেন, মুসলিমরা সাধু? ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংস করল কারা? আল কায়দার ওসামা বিন লাদেন, সেকি হিন্দু? এখন প্রশ্ন হল ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংস কি মুসলিম সন্ত্রাসবাদীরাই করেছিল? ঘটনাক্রম কিন্তু সেকথা বলছে না। একটু গোড়া থেকে পর্যবেক্ষণ করা যাক– বস্তুত ঘটনাটি যখন ঘটানো হয়েছিল তখন, যখন আমেরিকার আর্থিকবাজার নিদারুণভাবে মন্দা চলছিল। আমেরিকায় এমন অবস্থা এলেই বিশ্বে কোথাও না কোথাও যুদ্ধ নামিয়ে আনে। এই যুদ্ধই আমেরিকাকে আর্থিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করে। টুইন টাওয়ার ধ্বংসের চিত্রনাট্য আফগানিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের পথ প্রশস্ত করে দেয়।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, আর দশটি স্বাভাবিক দিনের মতোই নিউ ইয়র্কের ব্যস্ত একটি দিনের শুরু হয়েছিল। মার্কিন বার্তা সংস্থা সিএনএন এক প্রতিবেদনে জানায়, সেদিন সকালে ১৯ জন মিলে জেট ফুয়েল ভর্তি স্থানীয় সেবাদানকারী ৪টি বাণিজ্যিক বিমান ছিনতাই করে। এই বিমানগুলো নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডিসি এবং পেনসিলভানিয়াতে বিধ্বস্ত হয় এবং তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আঘাত হানে। ঘটনার তিন মাস পর ১৩ ডিসেম্বর মার্কিন প্রশাসন একটি ভিডিও টেপ প্রকাশ করে, যেখানে আল-কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেন এই হামলার দায় স্বীকার করেছে।
বিমান ছিনতাই থেকেই শুরু করা যাক। ভার্জিনিয়ায় অবস্থিত মার্কিন জাতীয় ‘এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল রুমে তখন স্বাভাবিক ব্যস্ত সময় পার করছিলেন অপারেটররা। বিমানে ঠাসা মার্কিন আকাশে বোস্টন থেকে লসএঞ্জেলেসগামী ছোট্ট বাণিজ্যিক বিমান আমেরিকান এয়ারলাইনের ফ্লাইট ১১-এর ককপিট থেকে একটা অদ্ভুত আওয়াজ শুনতে পান এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের দায়িত্বরত এক কর্মকর্তা। বিমানটির সঙ্গে কিছুক্ষণ পরই যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেন ওই অপারেটর। স্থানীয় সময় সকাল ৮টার দিকে বিমানটির অবস্থান হারিয়ে যাওয়া এবং একটা সম্ভাব্য বিমান ছিনতাইয়ের তথ্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানান তিনি। তাঁরা বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখে আপডেট জানানোর নির্দেশ দেন অপারেটরকে। রাজ্যের এটিসিতে যখন ‘ফ্লাইট ১১’-এর তল্লাশি চলছিল, তখনই বোস্টন থেকে লসএঞ্জেলেসগামী আরও একটি বিমানের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল।
এটিসি কক্ষে গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি বুঝে ওঠার আগেই টেলিভিশনে ভেসে আসে বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রে বিস্ফোরণের ঘটনা। স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ৪৬ মিনিটে নিউ ইয়র্কের লোয়ার ম্যানহাটনে অবস্থিত ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ১১০ তলা উচ্চতার টুইন টাওয়ারের নর্থ ভবনে আঘাত হানে কিছু একটা। পরে জানা যায়, ৫ ছিনতাইকারীসহ ৮১ জনের আমেরিকান এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ১১’ সরাসরি ঢুকে যায় গগনচুম্বী ভবনটিতে। আচমকা এমন হামলার এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল যখন হতবাক, তখনই তাঁরা সরাসরি ইউনাইটেড এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ১৭৫’-এর হামলার সাক্ষী হন। প্রথমটির ঠিক ১৭ মিনিটের মাথায় ‘ফ্লাইট ১৭৫’ আঘাত হানে টুইন টাওয়ারের দক্ষিণ ভবনে। স্তম্ভিত হয়ে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরো বিশ্ব। ঘোর কাটতে না কাটতেই, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলতে খবর আসে ভার্জিনিয়া থেকে লসএঞ্জেলেসগামী আমেরিকান। এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ৭৭’ নিখোঁজের কথা। ততক্ষণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী দুটো এফ-১৬ যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে দিয়েছে নিখোঁজ বিমানের তল্লাশিতে। যোগাযোগহীন হয়ে পড়ায় বিমানটির অবস্থান জানতে পারছিল না এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল কর্তৃপক্ষ। সকাল ৯টা ৩৭ মিনিটে ওয়াশিংটনে অবস্থিত মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের সদর দপ্তর পেন্টাগনে আঘাত হানে ৫ ছিনতাইকারীসহ ৫৮ জনের ফ্লাইট ৭৭’। এদিকে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান দুটো আমেরিকার ব্যস্ততম আকাশে প্রবেশের কোনো সুযোগই পাচ্ছিল না।
ঘটনা এখানেই শেষ নয়, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের জন্য আরও আতঙ্ক অপেক্ষা করেছিল। ৪ জন মিলে ইউনাইটেড এয়ারলাইনসের আরও একটি বিমান ছিনতাই করেছে। ছিনতাইকারী, পাইলট, ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট ও যাত্রী মিলিয়ে ৩৭ জনকে নিয়ে পেনসিলভানিয়ার শাঙ্কসভিলের পাশের একটি মাঠে ১০টা ৩ মিনিটে বিধ্বস্ত হয় ইউনাইটেড এয়ারলাইনসের ওই বিমানটি (ফ্লাইট ৯৩)। যেখান থেকেও কেউ বাঁচতে পারেনি। পরে ধারণা করা হয়, এই বিমানটিও ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল, তবে বিমানের যাত্রীরা ছিনতাইকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হলে সেটা পথিমধ্যেই বিধ্বস্ত হয়। প্রথম হামলার ঠিক ১০২ মিনিট পর অর্থাৎ ১০টা ২৮ মিনিটে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ও দর্শনীয় স্থাপত্যের ১১০ তলার টুইন টাওয়ার ধসে যায়। কিছুক্ষণ পর বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের ৪৭ তলার আরও এক ভবন ৭’ মাটিতে ধসে পড়ে। মাত্র ১০-১২ সেকেন্ডের মধ্যে ধসে যায় টুইন টাওয়ার। যেন ডিনামাইট বা শক্তিশালী বিস্ফোরক দিয়ে ভবন দুটোকে ভেঙে ফেলা হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৯/১১ ঘটনা আজও এক অপার বিস্ময়। ছিনতাই করা বিমান নিয়ে টুইন টাওয়ারে আছড়ে পড়া এবং অতিঅল্প সময়ের মধ্যে টুইন টাওয়ার সম্পূর্ণ ধসে পড়া এখনও এক বিরাট রহস্য। যুক্তরাষ্ট্র এই ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার জন্য আল-কায়েদাকে দায়ী করেছে। এই হামলায় আল-কায়েদার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে মার্কিন সরকারের অনেক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। অনেকেই তা বিশ্বাসও করছেন। আবার কেউ কেউ আছেন যাঁরা এটা মেনে নিতে পারছেন না। তাঁদের মতে আমেরিকার তৎকালীন বুশ সরকার নিজেই এই ঘটনা ঘটিয়েছে। তাঁদের ভাষ্য হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী তাঁর নতুন ভূ-রাজনৈতিক কৌশল বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই এই ঘটনা ঘটিয়ে দায় আল-কায়েদার উপর চাপিয়েছে। মার্কিন সরকারের ভাষ্যের সঙ্গে যাঁরা ভিন্নমত পোষণ করেন তাঁদের অন্যতম ফিলিপ মার্শাল। মার্কিন সরকারের অনেক গোপন মিশনের সঙ্গে জড়িত বিমান চালনা বিশেষজ্ঞ ফিলিপ মার্শাল মনে করতেন আল কায়দা কিছুতেই এ ধরনের হামলা করতে পারে না। তাঁর ধারণা, নাইন ইলেভেন নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র হয়েছে। তাঁর এই ভিন্নমত অনেকের মাঝে নতুন চিন্তার খোরাক জোগাচ্ছে। টুইন টাওয়ার ধ্বংসের রহস্য কারো-কারো মধ্যে নতুন ধারণার সৃষ্টি করছে। সেই ঘটনার পর ভিন্নমত পোষণকারী ফিলিপ মার্শালের নিজেরও রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে। বিমানের প্রাক্তন অভিজ্ঞ পাইলট ও ৯/১১ ষড়যন্ত্রের লেখক ফিলিপ মার্শাল এবং তাঁর দুই সন্তানকে ক্যালিফোর্নিয়ায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। এই লেখকের গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ২০০৩ সালের উপন্যাস ‘Lakefront Airport’, ১৯০৮ সালে ‘False Flag Nine Eleven : How Bush, Cheney and the War in Terror’ এবং ২০১২ সালে প্রকাশিত “The Big Bamboozle : Nine Eleven and the War in Terror’। এই লেখায় মার্শাল বলেন, টুইন টাওয়ারে আল-কায়েদা হামলা চালায়নি। বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি সরকার মিলিতভাবে নাইন ইলেভেনের ঘটনাটা ঘটিয়েছে। এই তত্ত্বের প্রবক্তা ফিলিপ মার্শালকে তাঁর ক্যালিফোর্নিয়ার মার্কিস এলাকার বাসভবনে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। সঙ্গে তাঁর দুই সন্তানের লাশও পাওয়া যায়। খবরে উল্লেখ করা হয়, তিনজনই বন্দুকের গুলিতে মারা যায়। ক্যালাভেরাস কাউন্টির শেরিফের অফিস জানায়, দুই সন্তান অ্যালেক্স ফিলিপ (১৭) ও কন্যা ম্যাসাইলা ফিলিপ (১৪) সহ মার্শাল ও তাঁদের পারিবারিক কুকুরটিকে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করা হয়। মার্শালের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হওয়া স্ত্রী ও এই দুই সন্তানের মা ঘটনার সময় বিদেশে ছিলেন। গুলি করে হত্যা করার সম্ভাব্য মোটিভ জানা যায়নি। তবে পুলিশের ধারণা, এটা আত্মহত্যার একটি ঘটনা। ফিলিপ মার্শাল বিমানের একজন অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন এবং সাবেক সরকারি বিশেষ কার্যক্রমে চুক্তিভিত্তিক পাইলট ছিলেন। তিনি যে গ্রুপে কাজ করতেন সেই গ্রুপটি যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা কার্যক্রমে জড়িত। আমেরিকায় অতি গোপনীয়তার উপর তিনি তিনটি বই লিখেছেন। কলম্বিয়ার মাদক সম্রাট পাবলো এসকোবারের মাদক সাম্রাজ্য ধ্বংসে ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অভিযানের অংশ হিসেবে ১৯৮০ দশকে লার্জেন্ট ক্যাপ্টেন হিসেবে মার্শাল কাজ শুরু করেন। পরে রিগ্যান প্রশাসনের সময় নিকারাগুয়ার কন্ট্রা বিদ্রোহীদের অস্ত্র জোগানোর গোপন মিশনে কাজ করেন। তিনি ওয়াল স্ট্রিটের ফাটকাবাজি, রাজনীতিকদের পৃষ্ঠপোষকতা, মিডিয়া মোগল থেকে শুরু করে সরকারের ৩০ বছরের গোপনীয়তা বিশেষ তৎপরতার উপর গবেষণা করেন এবং এ সম্পর্কে লেখালেখি করেন। মার্শাল ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে টুইন টাওয়ার হামলার ঘটনা অনুসন্ধানে একজন নেতৃস্থানীয় বিমান চালনা বিশেষজ্ঞ হিসেবে অনুসন্ধান কাজ করেন। ২০০৮ সালে প্রকাশিত ‘False Flag Nine Eleven : How Bush, Cheney and the War in Terror’ এবং ২০১২ সালে প্রকাশিত “The Big Bamboozle : Nine Eleven and the War in Terror’ গ্রন্থে নাইন ইলেভেনের ছিনতাইকারীদের ফ্লাইট প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতির উপর আলোকপাত করেন। War in Terror’ বইটি লেখার সময় তিনি মনে করতেন, তিনি যে অভিযোগ উত্থাপন করছেন তাতে তাঁর জীবন বিপদের মুখে রয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, ছিনতাইকারীদের প্রশিক্ষণ প্রদানে বুশ প্রশাসন ও সৌদি গোয়েন্দারা জড়িত ছিলেন। টুইন টাওয়ারে হামলায় ব্যবহৃত বিমানগুলোতে এসব ছিনতাইকারীও নিহত হয়। টুইন টাওয়ার ধ্বংস চক্রান্তের উদ্ভব ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ার হামলার পর থেকে দেড় দশক অতিক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু চক্রান্ত তত্ত্বগুলো এখনও মিলিয়ে যায়নি। বিবিসিতে বিশিষ্ট সাংবাদিক মাইক রুডিন একথা বলেছেন।
প্রথম প্রশ্নটি হচ্ছে, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রর বিমান বাহিনী ছিনতাইকৃত চারটি বিমানের একটিকেও কেন বাধা দিতে পারেনি? এ ক্ষেত্রে চক্রান্ত তত্তটি হচ্ছে, তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি সামরিক বাহিনীকে কেবল দর্শকদের দাঁড়িয়ে থাকতে এবং বিমানগুলোতে বাধা না-দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে কেন টুইন টাওয়ার এতো দ্রুত ধসে পড়েছিল। কয়েকটি ফ্লোরে আগুন লাগার পর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে টুইন টাওয়ার পুরোপুরি ধসে পড়ার ঘটনা খুবই অস্বাভাবিক। চক্রান্ত তত্তটি হচ্ছে নিয়ন্ত্রিত গুঁড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে একে ধ্বংস করা হয়েছিল ভিতর থেকেই। বিভিন্ন খবরে বলা হয় ধসে পড়ার আগে বেশ কিছু বিস্ফোরণের আওয়াজ শোনা যায়। টুইন টাওয়ার ধ্বংস হওয়ায় সেখানে অবস্থানরত প্রায় সবারই করুণ মৃত্যু ঘটে। তৃতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে একজন অ্যামেচার পাইলট কীভাবে একটি বাণিজ্যিক বিমান নিয়ে বিনা বাধায় বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক দফতরে গিয়ে আছড়ে পড়ল। প্রথম সম্ভাব্য ছিনতাইয়ের রিপোর্ট পাওয়ার পর মাত্র ৭৮ মিনিটের মধ্যে মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগনে এটি বিধ্বস্ত হয়। ছিনতাইয়ের রিপোর্ট পাওয়ার পর কেন বিমানটিকে তাড়া করা বা বাধা দেওয়া হয়নি। এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। চক্রান্ত তত্তটি হল, কোনো বাণিজ্যিক বিমান পেন্টাগনে আঘাত হানেনি। বরং ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে বা ছোটো বিমান বা পাইলটবিহীন ড্রোন বিমান এই হামলায় ব্যবহার করা হয়েছে। তবে যেহেতু প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে, আমেরিকান এয়ারলাইন্স ফ্লাইট ৭৭ পেন্টগন ভবনে আঘাত হেনেছিল তাতে পেন্টাগনমুখী বিমান চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্পর্কে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ পেন্টাগনের উপর দিয়ে কোনো বিমান চলাচল করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে যুক্তি হচ্ছে সেই বিমানটি আল কায়েদার নিয়ন্ত্রণে ছিল না। বরং পেন্টাগনেরই নিয়ন্ত্রণে ছিল। চতুর্থ প্রশ্নটি হচ্ছে পেনসিলভেনিয়ার শ্যাঙ্কভিলে একটি ছিনতাইকৃত বিমানের বিধ্বস্ত হওয়া। বিধ্বস্তস্থলটি খুবই ছোটো এবং সেখানে বিমানের কোনো ধ্বংসাবশেষ কেন দেখা গেল না? চক্রান্ত তত্ত্বটি হচ্ছে ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটের বিমানটিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে আঘাত করা হলে মাঝ আকাশেই এটি ধ্বংস হয়ে যায় এবং ধ্বংসাবশেষ বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। (সূত্র : বিবিসি, ডেইলি মেইল, টপইনফো পোস্ট।
১৫ বছর পর ‘আকাশচুম্বী ভবন ধসে পদার্থবিজ্ঞান’ শিরোনামে ২০১৬ সালে ইউরোফিজিক্স নিউজ জার্নালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যেখানে, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এমিরেটাস অধ্যাপক এবং কানাডিয়ান সোসাইটি অফ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সহযোগী রবার্ট কোল, ব্রিংহাম ইয়ং ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞানের প্রাক্তন অধ্যাপক স্টিভেন জোন্স, অ্যারোস্পেস, যোগাযোগ শিল্প এবং টেড ওয়াল্টারের মেকানিক্যাল ডিজাইনের প্রকৌশলী অ্যান্টনি জামবোতি, ওয়াল্টার, ৯/১১ সত্য উন্মোচনে কাজ করা স্থপতি ও ইঞ্জিনিয়ারদের সমন্বয়ে প্রতিবেদনটি লেখা হয়। সত্য উন্মোচনে কাজ করা দলটির বক্তব্য, ৯/১১-এর অফিশিয়াল কাহিনি সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তাই এটি নিয়ে পুনরায় তদন্ত শুরু করা উচিত। বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র এবং ভবন-৭ ধসের কারণ হিসেবে বিস্ফোরকের সম্ভাব্য ব্যবহারের প্রকৃত কারণ উদঘাটনে একটি পূর্ণ অনুসন্ধান পরিচালনা করতে হবে। দলটি দীর্ঘদিন ধরে এমন সব যুক্তি উপস্থাপন করে যাচ্ছিল, যা বহু বিতর্ককে উসকে দিয়েছে। বিতর্ক নিয়ে করোল বলেন, “১১ সেপ্টেম্বর ২০০১ এর ঘটনা ঘটার পর থেকেই এটা আমার মাথাব্যথার কারণ হয়েছে। ভবনটা কীভাবে ধসে গেল তাই আমি বুঝতে পারছি না। এমন ঘটার কোনো যুক্তিই নেই।”
যদিও দুর্ভাগ্যজনক দিনটির প্রতীকী চিত্রগুলোতে দুটো যাত্রীবাহী বিমানের আঘাতে সৃষ্ট আগুন লেগে মুহূর্তের মধ্যেই ভবন দুটোকে বিধ্বস্ত হতে দেখা যায়, তবে তৃতীয় ভবনটিতে কোনো বিমান আঘাত না হানলেও তা ধসে যায়, যেটা বাকি দুটোর থেকে কিছুটা দূরেই ছিল। অধিকাংশ তত্ত্বেই যাকে পরিকল্পিত ধ্বংস’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। করোল, তার সহকারী লেখক এবং অন্যরা মনে করেন এই ভবনটি সিআইএ এবং সিক্রেট সার্ভিসের অফিস হিসেবে স্থাপিত ছিল, যার ফলে কোনো আঘাত ছাড়াই ভবনটিকে তাসের ঘরের মতো ধসিয়ে দেওয়া হয়। তাঁদের মতে, “প্রকৃতপক্ষে, ৯/১১ হামলার আগে বা পরে আগুনের কারণে কখনোই পুরোপুরি স্টিল-ফ্রেমযুক্ত আকাশচুম্বী কোনো ভবনের এমন অবস্থা হয়নি। এমনকি ১৯৮৫ সালের মেক্সিকো সিটির ভূমিকম্পে একটি ২১ তলা ভবনের ধসে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো প্রাকৃতিক ঘটনাতে তেমনটা দেখা যায়নি। এই জাতীয় ভবনগুলোকে পুরোপুরি ভেঙে ফেলতে একটি নিয়ন্ত্রিত ধ্বংসাত্বক পদ্ধতি পরিচালনা করতে হয়, যেখানে বিস্ফোরক বা অন্য ডিভাইসগুলোর মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো কাঠামো ধসিয়ে দিতে ব্যবহৃত হয়।”
বিমানের আঘাতের পর উপরের তলাগুলোতে আগুন লেগেছিল, অথচ স্টিলের মোটা কলামের ভিত ছিল একদম নিচে। সেখানে এত দ্রুত উত্তাপ পৌঁছে কলামগুলোকে ধ্বংস করতে পারার কথা না। ডেইলি কমার্শিয়াল নিউজকে করোল বলেন, “উপরের তলার আগুনে স্টিলের কলাম বা কানেক্টর কিংবা ফ্লোর বিমকে পর্যাপ্ত দুর্বল করার সুযোগ খুবই কম। এছাড়াও, এগুলোর সঙ্গে অগ্নিপ্রতিরোধকারী ব্যবস্থা ছিল। শক্তিশালী বিস্ফোরকের আঘাতে কংক্রিটটি উচ্চ গতিতে বিচূর্ণ করা হলেই কেবল কাঠামোটির ধ্বংস সম্ভব। যা প্রায় ৩৭০ মিটার দূরের একটি ধ্বংসাবশেষের মাঠে ছড়িয়ে পড়বে। স্টিলের কলামগুলো গলাতে ৬৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্রয়োজন যা কেবল ভবনের ভিত্তিতে বিস্ফোরণের মাধ্যমে সম্ভব।”
২০০১ সালে আগে ‘জঙ্গিবাদ’ শব্দটির ব্যবহার শোনা যায়নি। জঙ্গিবাদ’ আর ‘মৌলবাদ’ দুটি অস্ত্র— যেগুলি কায়েমি স্বার্থবাদীরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে থাকে। সর্বপ্রথম এই জঙ্গি শব্দটির ব্যবহার শুনেছি ২০০২ খ্রিস্টাব্দে শুরুর দিকে। ১১ সেপ্টেম্বর ২০০১ খ্রিস্টাব্দে যখন নাটকীয়ভাবে টুইন টাওয়ার হামলা (?) হয়, তখন নাটকের কেন্দ্রবিন্দু করা হয় সৌদি আরবের নাগরিক ওসামা বিন লাদেনকে। জঙ্গি দমনের ধুয়ো তুলে, লাদেনকে হত্যার নাম করে বিশ্বকে নিজের পক্ষে এককাট্টা করে আমেরিকা আফগানিস্তানের উপর চড়াও হয়, শুরু করে হত্যালীলা।
প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি যখন বলেছেন ভারতের মুসলিমরা জঙ্গি নয়’, তখন নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারেন ভারতবাসী। কিন্তু একজন ভারতীয় মুসলিম না-হলেও জঙ্গি অপবাদ ঘুচবে কেন মুসলিমদের! সিরিয়া, পাকিস্তান, আফগানিস্তান মায় বাংলাদেশ যেখানেই জঙ্গি হানা হবে জঙ্গি হিসাবে মুসলিমদের নামই উঠে আসবে। আর জঙ্গি মানেই যে মুসলিম, সেই কলঙ্ক লাগবে সমগ্র মুসলিমদের গায়ে। ভারতের মুসলমানও সেই কলঙ্ক তথা বদনামের ভাগিদার হয়। তা ছাড়া এইসব জঙ্গিহানায় এত মানুষের মৃত্যু হয়, এত রক্তপাত হয়, শিশুরা পর্যন্ত বাদ যায় না, মুসলিমরাও বাদ যায় না— মুসলমানদের মধ্যে থেকে খুব একটা যে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়, তা কিন্তু নয়। কিন্তু এইসব অশুভ শক্তির প্রতিবাদ করেই-বা লাভ কী? কে শুনছে? বাংলাদেশের রাজধানী। ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গিহানার পর জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বাক্যবাণ ছুঁড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশের মুসলিম সমাজ। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে।
সারা পৃথিবীতে এত ধর্ম এত জাতি থাকতে জঙ্গি হিসাবে কেবল মুসলিমদের নামই-বা উঠে আসে কেন? ওমর ফারুকের বয়ান– “আজ আমরা জন্ম নিই মুসলিম হয়ে, হিন্দু হয়ে, খ্রিস্টান হয়ে, বৌদ্ধ হয়ে কিংবা ইহুদি হয়ে। বাবা-মা, ধর্মগুরুরা আমাদের যা শেখান, যা পড়ি, সারাজীবন আমরা সেটাই বিশ্বাস করি। আমাদের মনে কোনো প্রশ্ন জাগে না। নবি রাসুলরাও কোনো-না-কোনো পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা পারিবারিক শিক্ষায় আবদ্ধ থাকেননি। সত্যের সন্ধান করেছিলেন, নিজের বিবেককে প্রশ্ন করে ছিলেন কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল, কী করা উচিত, কী করা উচিত নয়, কেন করা উচিত নয় ইত্যাদি? তাঁরা সত্যকে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন, তাই আল্লাহ (সঃ) তাঁদের পথ দেখিয়েছিলেন। তাঁদের হাত ধরে মানবতার মুক্তি এসেছিল। আর আমরা অন্ধের মতো বিশ্বাস করি.. তাই আমাদের ব্রেইন ওয়াশ করা সহজ হয় তাঁদের জন্য। কাদের জন্য? তাঁদের জন্য যাঁরা ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দেয়। কারা ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দেয়? যে-কোনো মানুষ ভুল ব্যাখ্যা দিতে পারে, সে যে-কোনো ধর্মেরই হতে পারে। কারণ আমাদের চোখে আমার ধর্ম সেরা। অন্যরা ভুল! আসলে সঠিক কে আমরা জানি না। আমরা আজ দলে দলে বিভক্ত। আমরা মানুষ নই! আমরা মানুষ হয়ে উঠার আগেই ছোটোবেলাতেই কেউ মুসলিম, কেউ হিন্দু, কেউ বৌদ্ধ, কেউ খ্রিস্টান কিংবা ইহুদি হয়ে যাই। তাই আমাদের জন্য মানুষ হওয়ার চেয়ে আইএস হওয়া সহজ, জঙ্গি হওয়া সহজ! এটা শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, পৃথিবীর যে-কোনো ধর্মের মানুষের জন্য একই ব্যাপার! কারণ সিরিয়া বা ইরাকের মতো কোথাও মুসলিমরা মারা গেলে অন্য মুসলিমদের যেমন কষ্ট লাগে, তাঁরা সেখানে যুদ্ধ করতে যেতে চায়; তেমনই অন্য ধর্মাবলম্বীদেরও হয়। তা না-হলে আফগানিস্তানে বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস হওয়ায় শেষের দিকে জাপান কোয়ালিশন বাহিনীতে যোগ দিত না। বাংলাদেশে হিন্দুরা মারা গেলে ইন্ডিয়া উদ্বেগ প্রকাশ করত না! ফিলিস্তিনিরা একজন ইহুদি মারলে জবাবে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি মারত না! এটা খুবই স্বাভাবিক।
যাঁরা কেবল মুসলমানদের ঘাড়েই জঙ্গিপনার দায় চাপিয়ে সহজেই হাত ধুয়ে ফেলতে চান, তাঁদের কাছে আমার প্রশ্ন একটা নয়, অনেকগুলি প্রশ্ন— (১) কারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নামে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছিল, মানুষকে গৃহহারা করেছিল? এই হত্যাকারীরা তো কেউ মুসলিম সন্ত্রাসবাদী ছিলেন না। এই যুদ্ধে প্রায় ১ কোটি সৈন্য এবং ২ কোটি ১০ লক্ষ মানুষ আহত হয়। ৯০ লক্ষ যোদ্ধা এবং ৫০ লক্ষ নিরীহ মানুষ মারা যায়। আমেরিকানরা তুরস্কে গণহত্যা চালায় এবং যুদ্ধের সাইড এফেক্ট হিসাবে ইনফ্লুয়েঞ্জায় বিশ্বব্যাপী ২৫ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়। (২) কারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নামে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছিল? এই যুদ্ধে মিত্রশক্তির নেতৃত্বে স্তালিন, রুজভেল্ট, চার্চিল, কাই-শেকের আশীর্বাদে সামরিক প্রাণহানি হয়েছিল ১,৬০,০০,০০০-এর বেশি। বেসামরিক প্রাণহানি হয়েছিল ৪,৫০,০০,০০০-এর বেশি। অপরদিকে অক্ষশক্তির নেতৃত্বে হিটলার, হিরোহিতো, মুসোলিনির আশীর্বাদে সামরিক প্রাণহানি হয়েছিল ৮০,০০,০০০-এর বেশি। বেসামরিক প্রাণহানি হয়েছিল ৪০,০০,০০০-এর বেশি। এই হত্যাকারীরা তো মুসলিম সন্ত্রাসবাদী ছিলেন না। (৩) অস্ট্রেলিয়াতে কারা ২০ মিলিয়ন আদিবাসী অ্যাবোরিজিন হত্যা করেছিল? এই হত্যাকারীরা তো কেউ মুসলিম সন্ত্রাসবাদী ছিলেন না। (৪) কারা হিরোশিমা-নাগাসাকিতে নিউক্লিয়ার বোমা ফেলেছিল? হিরোসিমার ধ্বংসকাণ্ডে প্রায় ৯০ ভাগ বাড়িঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে মারা গিয়েছিল সেখানকার ২০ ভাগ ৭০,০০০ মানুষ। ওই বছরের শেষদিকে ১,৪০,০০০ জন এবং ১৯৫০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা বেড়ে ২ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। এছাড়া বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে লক্ষাধিক মানুষ। পাঁচ বছরের মধ্যে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ৩০ হাজার। নাগাসাকিতে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। এই হত্যাকারীরা তো মুসলিম সন্ত্রাসবাদী ছিলেন না। (৫) উত্তর আমেরিকায় অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কারা ১০০ মিলিয়ন রেড ইন্ডিয়ান হত্যা করেছিল? এই হত্যাকারীরা তো কেউ মুসলিম সন্ত্রাসবাদী ছিলেন না। (৬) দক্ষিণ আমেরিকার পেরু ইত্যাদি দেশগুলিতে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কারা ইনকাসহ ৫০ মিলিয়ন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আদিবাসী মানুষকে হত্যা করেছিল? এই হত্যাকারীরা তো মুসলিম সন্ত্রাসবাদী ছিলেন না। (৭) কারা ১৮০ মিলিয়ন আফ্রিকানকে ক্রীতদাস বানিয়েছিল, যাঁদের ৮৮ শতাংশই মারা গিয়েছিল এবং কারা তাঁদেরকে আটলান্টিক মহাসাগরে ছুঁড়ে ফেলেছিল? এই হত্যাকারীরা তো কেউ মুসলিম সন্ত্রাসবাদী ছিলেন না। (৮) ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তো ১০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিল, মানুষগুলি কমিউনিস্ট ছিলেন। এর মধ্যে পূর্ব তিমোরেই ছিল ৭ লক্ষ, আরও ২ লক্ষ নাগরিককে হত্যা করা হয়েছিল। অবশ্য এই হত্যালীলর বিনিময়ে পূর্ব তিমোরে তথাকথিত স্বাধীনতা এসেছিল। এই হত্যাকারীরা তো মুসলিম সন্ত্রাসবাদী ছিলেন না। (৯) মার্কিনরা ৪০ লক্ষ মানুষকে খুন করেছিল ভিয়েতনামে। চরম মুসলিম-বিদ্বেষীও নিশ্চয়ই বলবেন না এসব ঘটনা ঘটিয়েছে মুসলমানরা, মুসলমান জঙ্গিরা। হ্যাঁ, এই সন্ত্রাস, গণহত্যা, মানবাধিকার লুণ্ঠনমূলক কর্মকাণ্ডগুলি করেছিল পশ্চিমা তথাকথিত সভ্য মানুষগুলিই। তবু তাঁরা কেন জঙ্গি নয়, কেন সন্ত্রাসী নয়। কেন এমন ডাবল স্ট্যান্ডার্ড হয় মানুষের? পার্থক্য তো সামান্যই –একপক্ষ ইসলামের নাম ভাঙিয়ে মানুষ মারে, অন্য পক্ষ অস্ত্র-ব্যাবসা আর দাদাগিরি দেখাতে মানুষ মারে।
কিন্তু হত্যালীলা সংঘটন করতে করতে কেন জঙ্গিরা ‘আল্লাহু আকবর ধ্বনি দেয়? এটা কি সমগ্র মুসলিমদের সমর্থন আদায় করতে? উত্তর : হ্যাঁ। এটা বোঝানো –“এই দেখো, আমরা যা করছি তা আল্লাহর নামে ইসলামের হেফাজতের জন্যেই করছি। তোমরা আমাদের পাশে থাকো।” এইসব জঙ্গিরা সমগ্র মুসলিম জাতিরই ক্ষতি করছে। মুসলিমদের সন্দেহের চোখে দেখছে বিশ্বের মানুষ। বিশ্বের কাছে সমগ্র মুসলিম জাতি খাটো হয়ে যাচ্ছে। অথচ এঁরা মুসলিমদেরও হত্যা করছে। সাধারণ মুসলিমদের উচিত এঁদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। কিন্তু বিস্মৃত হয়ে যাই, যখন দেখি ফেসবুক কোনো মুসলিমের প্রোফাইলের ডিপিতে লাদেনের ছবি থাকে। হয়তো এরকম এক-আধজন করে, কিন্তু তার দায় সমস্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের ঘাড়ে গিয়ে পড়ে।
পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরান, ইরাক, তুরস্ক –সর্বত্রই এইসব জঙ্গিহানায় মুসলিমদেরই মৃত্যু হচ্ছে। টার্গেট মুসলিম কেন? হানটিংটন বলছেন— এটা সভ্যতার দ্বন্দ্ব। পশ্চিমী সভ্যতা, চিনের সভ্যতা, জাপানি সভ্যতা, ইসলাম সভ্যতা, হিন্দু সভ্যতা ইত্যাদি। পশ্চিমী সভ্যতার ঘুম কেড়ে নিয়েছে অর্থনৈতিক দিক থেকে চিন এবং সভ্যতার দিক থেকে মুসলিম।” ইরাকের যুদ্ধের সময় আমেরিকান হানটিংটন বলেই ফেলেছিলেন যে, এটা হচ্ছে ইসলামি সভ্যতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। একটা নতুন দর্শন তৈরি করা হচ্ছে। সভ্যতার দিক থেকে ইসলাম হল প্রধান শত্রু, আর অর্থনৈতিক দিক থেকে চিন হল প্রধান শত্রু। আমি যে-কোনো রূপের জঙ্গিপনা বা সন্ত্রাসবাদের বিরোধী। তা সে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদই হোক কিংবা জঙ্গি সন্ত্রাসবাদ।”
মিথ্যা প্রচার করে কীভাবে গোটা বিশ্বের মানুষকে এককাট্টা করতে হয়, সেই কৌশল শিখতে হয় আমেরিকার কাছ থেকে। সেই কৌশল যথার্থভাবেই শিখেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি। যাই হোক, ২০০৩ সালে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ও কোয়ালিশন বাহিনী বিশ্বজুড়ে মসৃণভাবে প্রচার করে দিলেন ইরাক গণবিধ্বংসী অস্ত্র (পরমাণু) তৈরি করছে এবং এরকম প্রচুর অস্ত্র মজুত করে রেখেছে সাদ্দাম হোসেন। বুশ প্রচার করলেন –ইরাক ১৯৯১ সালের চুক্তি অমান্য করে পরমাণু অস্ত্র মজুত করে রেখেছে। এহেন মিথ্যা প্রচারে গোটা বিশ্ব আমেরিকাকে যুদ্ধের প্ররোচনা দিল ইরাকের বিরুদ্ধে। আমেরিকা ও জোটসঙ্গীরা ঝাঁপিয়ে পড়ল ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। সেই যুদ্ধে মৃত্যু হয় ১,৫০,০০০ থেকে ১০,০০,০০০ বেশি মানুষ। কোন্ জঙ্গি হামলায় এত মানুষের মৃত্যু হয়েছে? গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি ও মজুতের ব্যাপারে অনেক গোয়েন্দা তথ্য আছে, এই অজুহাতে আরব দেশটিতে আগ্রাসন চালানো হলেও যুদ্ধের পর এ ধরনের ‘নির্ভর গোয়েন্দা তথ্য মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এই যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বাগদাদে নিযুক্ত জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শক সংস্থা ‘আনমোভিক’-এর প্রধান হ্যাঁন্স ব্লিক্স আক্ষেপ করে প্রখ্যাত সংবাদ মাধ্যম সিএনএন নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন— “আগ্রাসন শুরুর তিন সপ্তাহ আগে সম্ভাব্য হামলার খবর পাই আমরা। কিন্তু এটা যে অনেক বড়ো ধরনের ভুল ছিল সেটা জেনেও কাউকে বোঝাতে পারিনি!” ঠুনকো অজুহাতে হাজারো মানুষকে হত্যার ঘটনা উল্লেখ করে হ্যাঁন্স ব্লিক্স বলেন— “কেন ওই ভয়ংকর ভুলটি করা হয়েছিল, তা এখন পর্যন্ত মাথায় আসে না আমার। জাতিসংঘের আইন লঙ্ঘন করা হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নীরবতা ছিল সত্যিই বিস্ময়কর।”
ইরাক যুদ্ধ শুরুর পিছনের সম্ভাব্য কারণ ব্যাখ্যা করে জাতিসংঘের এই কর্মকর্তা বলেন— “আমি মনে করি, ২০০১ এর ১১ সেপ্টেম্বরে টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর তালেবানদের মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে দমন খুব সম্ভবত শক্তি প্রদর্শনের ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন জর্জ ডব্লিউ বুশ।” ব্লিক্স বলেন— “এই কারণ না-হলে, নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনের পতন ছাড়া ইরাক যুদ্ধের কোনো অর্জনই তো চোখে পড়ছে না।”
বস্তুত আমেরিকারা সারা বিশ্বকে বোঝাতে চায় তাঁরা জঙ্গিহানা, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় কত একনিষ্ঠ। তাঁরা সন্ত্রাসবাদকে কড়া হাতে নির্মূল করতে বদ্ধপরিকর। অথচ যে রাষ্ট্রশক্তির কাছে তাঁরা সন্ত্রাস দমনের বাসনা প্রকাশ করছে, তাঁদের নীতিই সন্ত্রাসের ধাত্রীভূমি। একদিকে সারা বিশ্বের থেকে সন্ত্রাসবাদীদের ধরে ধরে নিকেশ করে দেওয়ার পরিকল্পনা নেব, আবার নিজেরা দেশে সন্ত্রাসবাদী রপ্তানি করার স্কুল চালাব– দুটো একসঙ্গে চালানো যায় নাকি! কটা জঙ্গি মেরেছেন আমেরিকার দাদারা? বরং জঙ্গি দমনের বাহানায় এ-দেশ ও-দেশে সশস্ত্র হামলা করে বেড়াচ্ছে। সাধারণ মানুষদের খুন করে তল্পিবাহক সরকার বসিয়ে আসছে। আমেরিকার ভূমিকা অনেকটা মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণের মতো –পাণ্ডবদের হয়ে কৌরবদের বিরুদ্ধে একের পর এক অন্যায় করেও ধর্মের নামে সেগুলিকে ‘ন্যায়’ বলে প্রতিষ্ঠা করেছে। কুরুক্ষেত্রের আঠেরো দিনের যুদ্ধে যথাক্রমে ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, কর্ণ, শল্য, অশ্বত্থামাদের মতো প্রকৃত দক্ষ যোদ্ধা তথা বীরদের অন্যায়ভাবে হত্যা না করলে পাণ্ডবদের জয় কোনোভাবে হতে পারত না। অপরদিকে পাণ্ডবদের দু-একটা চুনো পুঁটি ছাড়া একটি বীরকেও মরতে হয়নি। বস্তুত পাণ্ডবদের জয়ের পিছনে আর-একটি মোক্ষম কারণ হল কৌরব-সেনাপতিদের বিশ্বাসঘাতকতা। অষ্টাদশ শতকের মিরজাফরের কথা মনে পড়ে যায়। সেনাপতির দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে যেভাবে ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, কর্ণ, শল্য, অশ্বত্থামারা পাণ্ডবদের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। আমেরিকারাও সন্ত্রাসবাদী ওসামা বিন লাদেনকে পাকড়াও করতে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার সময় বিশ্বের অনেক দেশকে তাঁদের নিজের পক্ষে নিয়ে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন— যাঁরা আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে আমেরিকার অভিযান সমর্থন করবেন না, তাঁরা সন্ত্রাসবাদী অথবা সন্ত্রাসবাদীদের মদতদাতা।
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সন্ত্রাস তথা যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব তথা জঙ্গিহানা –এসবের পিছনেও আমেরিকার মতো অস্ত্র বিক্রেতাদের লম্বা হাত আছে। স্বার্থ প্রথমত অস্ত্র বিক্রি করা, দ্বিতীয়ত সুযোগে থাকা কখন কোন্ দেশ সংকটে পড়বে এবং সেই দেশের উপর হামলে পড়ে নিজেদের মনোনীত সরকার বসাবেন। ভারত এবং পাকিস্তান এ ব্যাপারে সতর্ক না-হলে ঘোরবিপদ খুব নিকটেই হায়নার মতো ওৎ পেতে আছে। সারা পৃথিবীতে যত অস্ত্র উৎপাদন হয় তার ৩৭ শতাংশই হয় আমেরিকায়। আমেরিকা এত অস্ত্র কীসের জন্য, কাদের জন্য তৈরি করে? যত যুদ্ধ হবে তত অস্ত্র বিক্রি হবে, যত জঙ্গি কার্যকলাপ চলবে তত অস্ত্র রপ্তানি হবে। জঙ্গিরা ভয়ংকর সব অস্ত্র কোথা থেকে পায়? জঙ্গিদের কাছে নিষিদ্ধ অস্ত্র কে বিক্রি করে? যে অস্ত্র কেবলমাত্র সেনাদের কাছে থাকার কথা, সেই অস্ত্র জঙ্গিদের হাতে আসে কীভাবে?
নিজেদের স্বার্থরক্ষা করতে আমেরিকা পৃথিবীর অনেক অনেক দেশেই সন্ত্রাসবাদীদের সাহায্য করে এসেছে। আটের দশকে আফগানিস্তান থেকে নাজিবুল্লা সরকারকে হটাতে তাঁরা ওসামা বিন লাদেন এবং ফিলিপাইন্সের আবু সইফ গোষ্ঠীকে অর্থ এবং অস্ত্র জুগিয়েছিল। মুসলিম মৌলবাদী মুজাহিদিন গোষ্ঠীগুলিকে এইভাবে মদত দেওয়া ঠিক হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে আমেরিকাতেই অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছে। এই মুজাহিদিনরাই পৃথিবীব্যাপী অনেকগুলি সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মের পাণ্ডা। মার্কিন সেনাবাহিনী শুধুমাত্র সন্ত্রাসবাদীদেরই মদত দেয়, যাঁরা মাদ্রাসার দিকে আঙ্গুল তোলেন তাঁরা জেনে রাখুন ট্রেনিং দিয়ে সন্ত্রাসবাদী তৈরি করার জন্য রীতিমতো স্কুল চালায় মার্কিন সেনাবাহিনীও। স্কুল অব আমেরিকা’ বা ‘সোয়া’ হল সেই স্কুল, যা পানামায় ১৯৪৬ সালে চালু করা হয়। শয়তান তৈরির সেই পাঠশালায় আজ পর্যন্ত ৬০ হাজারের বেশি রাক্ষস’ স্নাতক হয়েছে। হত্যা, ধর্ষণ, নানা ধরনের নৃশংস অত্যাচার— হেন কুকর্ম তাঁরা করেন না, যা অপরাধের অভিধানে নেই।এক কলম্বিয়াতেই ভয়ানক তাণ্ডব চালাচ্ছে ১০ হাজারের বেশি সোয়ার স্নাতক। ২০০০ সালে এই কুখ্যাত পাঠশালার নাম পালটে করা হয় ওয়েস্টান হেমিস্ফিয়ার ইনস্টিটিউট অব সিকিউরিটি কো-অপারেশন। ১১/৯ ঘটনার পর প্রেসিডেন্ট বুশ কাউন্টার টেররিজম সেন্টার ৫০০ থেকে দশগুণ বাড়িয়ে ৫০০০ করা হয়েছে। খোলা হয়েছে ‘ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড অ্যান্ড সিকিউরিটি’। এখানে কর্মী নিয়োগ করা হয়েছে ১ লক্ষ ৭০ হাজার, ব্যয় হচ্ছে বছরে ৩৭০০ কোটি ডলার।
এই অধ্যায়ের পরিশেষে বলি, ঊনবিংশ শতকে আমরা এমন কোনো সন্ত্রাসী হামলা খুঁজে পাব না, যেটা মুসলিমরা করেছে। আসলে সন্ত্রাসের সৃষ্টিই হয় অ-মুসলিমদের হাত ধরেই। ১৮৮১ সালের একটা ঘটনা বলি। রাশিয়ায় সেন্ট পিটার্সবার্গের রাস্তায় দ্বিতীয় আলেকজান্ডারকে হত্যা করা হয়। তিনি তখন বুলেট প্রুফ গাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। সেইসময় এক বোমা বিস্ফোরণে ২১ জন নিরীহ পথিকও মারা যায়। তাঁকে হত্যা করেছিল ইগনেসি নামে এক ব্যক্তি। ইগনেসি ধর্ম-পরিচয়ে মুসলিম নন, বুলবক্স থেকে আসা একজন অ-মুসলিম।
অক্সফোর্ড ডিকসনারি বলছে, “সন্ত্রাস হল কোনো হিংসাত্মক কাজের মধ্যে দিয়ে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সফল করা বা অর্জন করা বা কোনো সরকারকে কোনো পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করা।” এই সন্ত্রাস’ শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল ১৭৯০ দশকে ফরাসি বিপ্লবের সময়। আর এই ১৭৯০ সালেই এডমন্ডবার্ক নামে এক ব্রিটিশ কুটনীতিক এই শব্দটিকে দিয়ে বুঝিয়েছিলেন সেই সময়ের জ্যাকোবিন সরকারকে। ১৭৯৩ ও ১৭৯৪ সালকে বলা হয় সন্ত্রাসের সময়কাল। কারণ ম্যাক্সমিলিয়ন রোবসপিয়ের ছিলেন এই সরকারের প্রধান। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ৩০০০ মানুষকে হত্যা করেছিল গিলোটিনে ঢুকিয়ে। তবে ইতিহাস বলছে রোবসপিয়ের সেসময় ৫,০০,০০০ মানুষকে আটকে রেখেছিল। তার মধ্যে ৪০,০০০ হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল। ২,০০,০০০ মানুষকে নির্বাসন দেওয়া হয়। ২,০০,০০০ মানুষ জেলের ভিতর অনাহারে মরে। বোঝাই যাচ্ছে ‘সন্ত্রাস’ শব্দটি কেন প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল ফরাসি বিপ্লবের সময়? ১৯০১ সালে ৬ সেপ্টেম্বর তদানীন্তন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ম্যাকলিনকে লিয়ন নামে এক অ-মুসলিম দু-বার গুলি করে হত্যা করেছিল। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধিকে কোন্ ধর্মের সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছিল ১৯৮৪ সালে? ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধিকে কোন ধর্মের সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছিল ১৯৯১ সালে? ব্রিটিশ ভারতে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামী’-দের ব্রিটিশরা সন্ত্রাসবাদীই বলত। তাঁদের নথিতে ‘Terrorist’ হিসাবেই উল্লেখ আছে। ব্রিটিশরা হিন্দু-মুসলিম-শিখ নির্বিশেষে সমস্ত সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরই ‘Terrorist’ বলত। খালিস্তানি সংগ্রামের শিখ সম্প্রদায়দের তো ভারত সরকার সন্ত্রাসবাদী বা জঙ্গিই বলত। মাওবাদীদেরও জঙ্গি বলা হয়। মজার বিষয় হল, এঁরা কেউ মুসলিম নয়। আরএসএস, অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবককেও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অভিযোগে নিষিদ্ধ করছিল ভারত সরকার, ১৯৪৮-৪৯ খ্রিস্টাব্দে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা সারা বিশ্বের সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের তালিকা তৈরি করেছে, সেই তালিকায় ভারতের আরএসএসকেও অন্তর্ভুক্ত করেছে। এক রিপোর্টে বলছে— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতার কমিশন হুঁশিয়ারি দিয়েছিল যে, আরএসএসের এজেন্ডা “to alienate non-Hindus or lower-caste Hindus is a significant contributor to the rise of religious violence and persecution.”
আরএসএসের বিরুদ্ধে বারবার সহিংসতা প্ররোচিত করার অভিযোগ উঠেছে। এটি বেশ কয়েকবার নিষিদ্ধও করা হয়েছে, প্রথমবারের মতো আরএসএসের সদস্য নাথুরাম গডসে দ্বারা মহাত্মা গান্ধিকে করার পর। ২০০২ সালে হিউম্যান রাইটস আরএসএসকে চিহ্নিত করে। ২০১২ সালে পুরো সময়ের আরএসএস কর্মী স্বামী অসীমানা ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী বোমা হামলা চালানোর কথা স্বীকার করেছিলেন। বোমা হামলা, হত্যাকাণ্ড এবং প্রোগ্রামের আরও অনেক উদাহরণ আরএসএস রেখেছে। আরএসএস (তার সহায়ক সহ) সমগ্র ভারত জুড়ে সংখ্যালঘু-বিরোধী সহিংসতার আরও অনেক বড়ো ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। এর মধ্যে আছে ১৯৪৭ সালের জম্মু গণহত্যা (২০,০০০ + মুসলিম হত্যা) এবং ১৯৬৯ সালে গুজরাট দাঙ্গা (৪০০ + মুসলিম হত্যা)– দুটি ঘটনাই গোলওয়ালকারের সফরের পরেই ঘটেছিল। পরে মহারাষ্ট্রে ১৯৭০ সালে ভিওয়ান্দি দাঙ্গা (১৯০ + মুসলিম হত্যা), ১৯৮৩ সালে আসামের নেলি গণহত্যা (২,২০০+ বাঙালি মুসলিম হত্যা), দিল্লিতে ১৯৮৪ সালে শিখ গণহত্যা (সরকারি হিসাবে ৩,০০০ +, বেসরকারি হিসাবে ১০,০০০ শিখ হত্যা), ১৯৮৫ সালে গুজরাট দাঙ্গা (১০০ + মুসলিম হত্যা), ১৯৮৭ সালে উত্তরপ্রদেশের মিরাট দাঙ্গা (১০০ + মুসলিম হত্যা), ১৯৮৯ সালের বিহারের ভাগলপুর দাঙ্গায় (৯০০ + মুসলিম হত্যা), বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর (১৯০০ + মুসলিম হত্যা) ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে দেশব্যাপী দাঙ্গা, ২০০২ খ্রিস্টাব্দে গুজরাত দাঙ্গা (২,০০০ + মুসলিম হত্যা), ২০০৮ সালের ওড়িশা দাঙ্গায় (১০০+ খ্রিস্টান হত্যা), ২০২০ সালে দিল্লি দাঙ্গায় (৫০ + মুসলিম হত্যা) এবং আরও অনেক ঘটনা ঘটিয়েছে। (https://medium.com/@pieterjfriedrich/petition-to-declare-rss-a-terrorist-organization 3260f7b4f151) বৌদ্ধিস্ট সোসাইটির সর্বভারতীয় সভাপতি রাজরত্ন অশোক আম্বেদকরও বলেছে –“RSS is terrorist Organization in India.” উইকিপিডিয়াও আরএসএস সংগঠনকে ‘Saffron terror’ বা ‘গেরুয়া সন্ত্রাস’ বলেছে। বলছে –“Saffron terror is a neologism used to describe acts of violence motivated by Hindu nationalism, usually perpetrated by members, or alleged members, of Hindu nationalist organisations like Rashtriya Swayamsevak Sangh (RSS) or Abhinav Bharat. The term comes from the symbolic use of the saffron colour by many Hindu nationalist organisations. The first known use of the term ‘Saffron Terror’ is from a 2002 article in Frontline. However, it was in the aftermath of the 29 September 2008 bomb blast in the predominantly Muslim town of Malegaon in Maharashtra that it came to be used widely. In late 2008, Indian police arrested members of a Hindu cell allegedly involved in the Malegao blasts. Former Home Minister of India P. Chidambaram urged Indians to beware of ‘Saffron terror’ in August 2010 at a meeting of state police chiefs in New Delhi. Since making that remark, a Hindu swami in the Patan district has filed a defamation lawsuit against Chidambaram, saying that the saffron colour is a symbol of Hindu religion and that saints across the country wear attire of the same colour. The swami also said that saffron was a symbol of peace, sacrifice and God, and that Chidambaram has hurt the sentiments of Hindus by linking the symbol with terrorism. On 6 September 2010, a Gujarat court ordered a probe into the use of the term by Chidambaram. Chidambaram was also criticised by members of his own party (the Indian National Congress) for the use of the term, with Congress spokesman Janardhan Dwivedi claiming “terrorism does not have any colour other than black.” The saffron colour appears in the party flags of various national parties of India like the Indian National Congress and the Bharatiya Janata Party (BJP). A saffron coloured flag is commonly seen in most temples in India. Buddhist monks typically wear saffron robes as a symbol of wisdom. It has been claimed that the term “saffron terrorism” is a misnomer considering the historical descriptions of the saffron colour compared to the definitions of terrorism. Saffron is the colour of the upper band of the Indian national flag. Sarvepalli Radhakrishnan, who was India’s first Vice-President and second President, described the saffron colour as follows– “Bhagwa or the saffron colour denotes renunciation of disinterestedness. Our leaders must be indifferent to material gains and dedicate themselves to their work.”
অতএব সন্ত্রাসবাদ কোনো ধর্মভিত্তিক বিষয় নয়, কোনো বিশেষ ধর্মাবলম্বীদেরও একচেটিয়া বিষয় নয়। কোনো বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের সবসময় সন্ত্রাসবাদী’ বলে টার্গেট করা মানে বাকি সন্ত্রাসীদের আড়াল করার চেষ্টা, লঘু করে দেখা। কোনো সন্ত্রাসবাদ বা সন্ত্রাসীরাই লঘু নয়। সব সন্ত্রাসীই সভ্য ও সুস্থ সমাজের বিরুদ্ধে হুমকি। সারা বিশ্বের যে দীর্ঘ সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের তালিকা পাওয়া যায়, তাতে কিন্তু কোনো ধর্মই বাদ যায়নি। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, ইহুদি, খ্রিস্টান সমস্ত ধর্মাবলম্বীদের মধ্য থেকেই সন্ত্রাসী কাজকর্মের সঙ্গে লিপ্ত। সারা বছর এঁরা কোথাও না কোথাও হত্যালীলা সংঘটন করে। তাহলে কেন মাছরাঙার বিরুদ্ধে মাছ খাওয়ার অভিযোগ তোলা হবে, যখন সব পাখিই মাছ খায়? সন্ত্রাসবাদ ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলুন। সবরকম সন্ত্রাসী কাজকর্মের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলুন। যাঁরা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালাই বলে সন্ত্রাস করে, তাঁরা আরও বড় মাপের সন্ত্রাসী।