উন্নয়নের তত্ত্ব ও ভবিষ্যৎ
আর্থিক উন্নয়ন বিষয়ে আঠারো শতকের শেষভাগের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিক্ষক ও ব্যাখ্যা ছিলেন এডাম স্মিথ। বৃটেনে শিল্পবিপ্লবের সেটা জন্মলগ্ন। স্মিথের তত্ত্বের একই সঙ্গে ধারক ও সমালোচক ডেভিড রিকাডো। তাঁর পর উনিশ শতকের মধ্য ও শেষভাগে যাঁরা এ বিষয়ে চিন্তার ক্ষেত্রে আলোড়ন তুলেছিলেন তাঁদের ভিতর কার্ল মার্ক্স ও জন স্টুয়ার্ট মিল বিশেষভাবে স্মরণীয়। সেই সময়ে আরো কিছু দেশে, যেমন জামানীতে, দ্রুত শিল্পোন্নয়ন শুরু হয়েছে। আর বৃটেনে ততদিনে শিল্পবিপ্লব শৈশব অতিক্রম করে গেছে। স্মিথের প্রসিদ্ধ গ্রন্থের টীকাভাষ্য তখন আর যথেষ্ট রইল না। উনিশ শতকের অভিজ্ঞতার আলোতে উন্নয়নতত্ত্বকে নতুনভাবে সাজানো সম্ভব ও প্রয়োজন হল। মিল ও মার্ক্সের পর আরো এক শতাব্দীর অধিক কাল কেটে গেছে। অনিবার্যভাবে উদঘাটিত হয়েছে আরো নতুন তথ্য ও অভিজ্ঞতা, উনিশ শতকের পরিধির ভিতর যাদের খোঁজ পাওয়া কঠিন হবে। পূর্বসূরীদের চিন্তা এখনও মূল্যবান। তবু সময় এসেছে নতুন চিন্তার। পুরনো চিন্তার ব্যাখ্যাই যথেষ্ট নয়।
(ক)
১৭৭৬ সালে এডাম স্মিথের সেই বিখ্যাত গ্রন্থ প্রকাশিত হল, An Inquiry into the Nature and the Causes of the Wealth of Nations, অর্থাৎ জাতিসমূহের ধনদৌলতের প্রকৃতি ও কারণ অনুসন্ধান। স্মিথ একদিকে ছিলেন তাত্ত্বিক ও দার্শনিক, অন্যদিকে আর্থনীতিক ইতিহাসের সঙ্গে তাঁর ভালো রকম পরিচয় ছিল।
আর্থিক উন্নয়নের মূল কারণগুলি কী? স্মিথের অনুসন্ধান এই নিয়ে। এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্যের খানিকটা পরিচয় দেওয়া যাবে। তার আগে পরিভাষা সংক্রান্ত একটা প্রশ্ন আছে। বাংলায় ‘অর্থ শব্দের দৃটি ভিন্ন ব্যবহার দেখি। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘money’ বাংলায় তাকে অনেক সময় অর্থ বলি। যেমন ধরুন এই বাক্যটি, ‘জিনিস বিনিময়ের অসুবিধা দূর করতে গিয়ে অর্থের আবিষ্কার হল’ (ধনবিজ্ঞান)। এখানে ঐ। শব্দটির মানে হল money অর্থাৎ মুদ্রা। আবার ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘economic development’ তাকে বাংলায় তর্জমা করে আমরা বলি আর্থিক উন্নয়ন। এখানে অর্থ শব্দটির অন্য এক মানে পাচ্ছি।
অনেকে হয়তো ভাববেন, এই দুই অর্থের ভিতর পার্থক্য তেমন বড় নয়। আর্থিক অবস্থার উন্নতি মানেই হল টাকাপয়সার বৃদ্ধি। অথবা কথাটা উলটে বলা যায় টাকাপয়সা বাড়লেই আর্থিক উন্নতি হয়। ব্যক্তির ক্ষেত্রে এইরকম মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু জাতীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রেও কি এ কথা বলা যায়? এইখানেই এডাম স্মিথের সঙ্গে তাঁর। পূর্ববর্তী কিছু অর্থশাস্ত্রীর মতের মৌল পার্থক্য দেখা যায়। স্মিথের আগের যুগে অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রতিপত্তি ছিল, ম্যার্কেন্ট্যালিস্ট’ মতবাদের। এই মতবাদের লেখকেরা বিশ্বাস করতেন, দেশের ভাণ্ডারে সোনারুপো যত জমবে ততই আর্থিক উন্নয়ন এগিয়ে যাবে। অবশ্য তাঁদের কথাটা এখানে অতিরিক্ত সরল আকারে বলা হল। যাই হোক, এডাম স্মিথ ম্যার্কেন্টালিস্ট মতবাদের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। তিনি এই কথাটা জোরের সঙ্গে বলতে চেয়েছিলেন যে, সোনারুপো অথবা মুদ্রার পরিমাণ বাড়ানোটা আর্থিক উন্নয়নের মূল কথা নয়। উন্নয়নের একটা বাস্তব ভিত্তি চাই। যেমন শ্রমের দক্ষতা অথবা কার্যক্ষমতা আর্থিক উন্নয়নের বাস্তব নির্ধারক। আমাদের জানতে হবে, কার্যক্ষমতা কীভাবে বাড়ে? ইতিহাস ও তত্ত্ব মিলিয়ে এই প্রশ্নটার উত্তর আমাদের বুঝে নিতে হবে।
এডাম স্মিথ বললেন, বাজারের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পে শ্রম বিভাগ বেড়ে চলেছে, আর তার সঙ্গে বাড়ছে শ্রমে দক্ষতা। একই মানুষকে যদি সব কাজই করতে হয় তবে কোনো কাজেই তার বিশেষ দক্ষতা আশা করা যায় না! জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত সবই যদি একই ব্যক্তিকে করতে হয় তবে জুতো সেলাইয়ের কাজে তাঁর বিশেষ পারদর্শী হবার সম্ভাবনা কম, শাস্ত্রেও বিশেষ পণ্ডিত হওয়া তাঁর পক্ষে কঠিন। এডাম স্মিথ অবশ্য অন্য এক ধরনের কর্মবিভাগের কথা বিশেষ করে ভাবছিলেন। শিল্পের আয়তন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন প্রক্রিয়ার সবটা আর কোনো একজনের হাতে থাকে না, প্রক্রিয়াটা ছোটো ছোটো অংশে বিভক্ত হয়ে যায়, আর প্রতিটি অংশে নিযুক্ত হয় এক বা একাধিক কর্মী। একই সঙ্গে যন্ত্রের ব্যবহারও বেড়ে যায়, বহুবিভক্ত প্রক্রিয়াগুলি যখন যান্ত্রিক হয়ে পড়ে। এসবই ঘটতে পারে তখনই বেশি পরিমাণে শিল্পোৎপাদন যখন প্রয়োজন, আর বাজারের বিস্তার ঘটলে তবেই এটা সম্ভব। কৃষককন্যা যদি ঘরে বসে নিজের কাপড় নিজে বোনে তবে সেখানে শ্রমবিভাগের সুযোগ কম। কিন্তু বাজারের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে গড়ে ওঠে কাপড়ের কল কাজের প্রক্রিয়াটা সেখানে খণ্ড খণ্ড হয়ে যায়; সেই সঙ্গে বাড়ে যন্ত্রের ব্যবহারও। শ্রম বিভাগের ফলে কেউই আর নিজের প্রয়োজনীয় অধিকাংশ জিনিস নিজে উৎপাদন করে না, নির্ভর করতে হয় বাজারের ওপর। মিলের মালিক উৎপন্নদ্রব্য বাজারে বিক্রী করবার আগেই শ্রমিককে তার মজুরী মিটিয়ে দিতে হয়, যাতে দিনের শেষে তার গ্রাসাচ্ছদন জোটে। কিন্তু মজুরী অগ্রিম দিতে গেলেই প্রয়োজন মূলধন। কাজেই শ্রমবিভাগ ও বাজারভিত্তিক উৎপাদনের জন্য মূলধন অত্যাবশ্যক। মূলধন আসে সঞ্চয় থেকে। এডাম স্মিথ তাই সঞ্চয়ের ওপর জোর। দিয়েছিলেন। এমনিভাবে স্মিথের চিন্তায় শ্রমবিভাগ, বাজারের বিস্তার, সঞ্চয় আর মূলধন পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত। এই সবের ভিত্তিতে বৃদ্ধি পায় কার্যদক্ষতা। আর্থিক উন্নয়নের এটাই বাস্তব ভিত্তি। এই বাস্তব ভিত্তি যদি অনুপস্থিত থাকে তবে দেশে শুধু মুদ্রার পরিমাণ বাড়িয়ে জাতীয় শ্রীবৃদ্ধি সম্ভব নয়। এই যে বাস্তব বিশ্লেষণের ওপর জোর দেওয়া এটা পাশ্চাত্য ধ্রুপদী অর্থবিজ্ঞানের একটা বৈশিষ্ট্য। টাকার মুখোশ পরে আর্থিক ক্রিয়াকাণ্ড আমাদের সামনে দেখা দেয়। সেই মুখোশের পশ্চাতে আছে ‘বাস্তব অর্থনীতি। শ্রম। ভূমি। মূলধন, অর্থাৎ যন্ত্রপাতি আর শ্রমিকের জীবনধারণের অন্ন। এইসব উপাদানের সংযুক্ত সুদক্ষ প্রয়োগে উৎপাদন হয় পণ্যদ্রব্য। পণ্যদ্রব্যের বিনিময়ের জন্য বাজার। টাকা এই বিনিময়ের সহায়ক। তেল যেমন চাকা ঘোরাতে সাহায্য করে, কিন্তু তেলটা চাকা নয়। অর্থনীতির চাকাটা দৃষ্টির ভিতর আনতে হবে। বাস্তব বিশ্লেষণের প্রতি মনোযোগ, ধ্রুপদী অর্থবিজ্ঞানের জোর এইখানে। পরবর্তী কোনো কোনো। অর্থনীতিবিদদের মতে তার দুর্বলতার একটা কারণও নিহিত এইখানে।
আগেই দেখেছি, উন্নয়নতত্ত্বে সঞ্চয়কে একটা বিশেষ স্থান দিয়েছিলেন এডাম স্মিথ। এটাকে ধ্রুপদী অর্থনীতির আরেক বৈশিষ্ট্য বলা যেতে পারে। জমিদার আর শিল্পপতি এই দুই শ্রেণীর লোকের প্রতি এডাম স্মিথের মনোভাবের পার্থক্য লক্ষ করবার মতো। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের প্রতি তাঁর মনের এক কোণে একটা গভীর সন্ধিগ্ধ ছিল। এই শ্রেণীর মানুষ সুযোগ পেলেই জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে জনসাধারণকে বিপাকে ফেলে, এই ধরনের উক্তি আছে তাঁর লেখায়। কিন্তু আর্থিক উন্নয়নের কাজে, দেশের ধনদৌলত বাড়াবার ব্যাপারে, তবু জমিদার বা অভিজাত শ্রেণীর ওপরে তিনি স্থান দিয়েছেন ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি শ্রেণীকে। অভিজাত শ্রেণীর মানুষ সঞ্চয়ী নয়, শিল্পপতি সঞ্চয়ী। সঞ্চয় আর সঞ্চয়ের বিনিয়োগ, উন্নয়নের জন্য এটাই জরুরী। কৃষিতে উন্নতির জন্যও এটা প্রয়োজন। ব্যবসায়িক দৃষ্টি নিয়ে কৃষিতে মনোযোগ দিলে তারও উন্নতি ঘটে।
আর্থিক ক্রিয়াকাণ্ডে রাষ্ট্রের স্থান কী হবে? অনেকে বলেন, বাজারের হাতেই এডাম স্মিথ সব ছেড়ে দিয়েছিলেন, রাষ্ট্রের জন্য আর্থিক ক্রিয়াকর্মে বিশেষ কোনো ভূমিকা তিনি অবশিষ্ট রাখেননি। স্মিথ সম্বন্ধে এটা ভুল ধারণা। অবশ্য আর্থিক ক্রিয়াকাণ্ডে বাজারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তাঁর চিন্তায় স্বীকৃত। কিন্তু এ কথাও তিনি বুঝেছিলেন যে, ব্যবসায়ীদের হাতে সব ছেড়ে দিলে ঝোঁক চলে যায় একচেটিয়া ব্যবসায়ের দিকে। কাজেই রাষ্ট্রের। একটা সদাসতর্ক ভূমিকা ছাড়া ব্যবসায় নিবাধ থাকে না। তা ছাড়া এমন অনেক ক্রিয়াকর্ম আছে যাতে জাতীয় জীবন সামগ্রিকভাবে উন্নত কিংবা উপকৃত হয়, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে কোনো ব্যবসায়ীর পক্ষে সেই সব কাজ তেমন লাভজনক নয়। স্মিথের প্রিয় উদাহরণ, জনসাধারণের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা। এইসব ক্ষেত্রে তিনি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা চেয়েছিলেন।
এডাম স্মিথের পর ধ্রুপদী অর্থবিজ্ঞানের প্রধান নায়ক ডেভিড রিকার্ডো। জমিদার আর। শিল্পপতির ভিতর স্বার্থের দ্বন্দ্বের একটা পরিষ্কার বিশ্লেষণ পাওয়া যায় রিকাডোর লেখায়। স্মিথ জোর দিয়েছিলেন এই কথাটার ওপর যে, জমিদারশ্রেণী সঞ্চয় ও বিনিয়োগের কাজে বড় আগ্রহী হয় না, আগ্রহী হয় বিলাসব্যসনে, কাজেই আর্থিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এই শ্রেণীর ভূমিকা দুর্বল। রিকার্ডো দেখালেন যে, আর্থিক নীতির ক্ষেত্রে এই দুই শ্রেণীর স্বার্থ এবং দৃষ্টিভঙ্গী বিপরীত। তকালীন একটা রাজনীতির বিতর্কের ভিতর দিয়ে প্রশ্নটা। জরুরী হয়ে উঠেছিল। নেপোলিয়নের আমলে ফ্রান্সের সঙ্গে বৃটেনের বৈরসম্পর্কের। কারণে ফরাসী দেশের গম এক সময়ে ইংলণ্ডে আসতে পারেনি। নেপোলিয়ন বিগত হবার পর বেশ কিছুকাল ফরাসী গমের আমদানির ওপর একটা শুল্ক থেকে গেল ইংরেজ কৃষকের স্বার্থে। ঐ শুল্কটা থাকবে, না তুলে দেওয়া হবে, এই নিয়ে তর্ক শুরু হল। তুলে দিলে অপেক্ষাকৃত সস্তা গম ইংলন্ডের জনসাধারণের হাতে আসবে। গমের দাম কমে গেলে কিন্তু জমিদারের প্রাপ্য খাজনা কমে যাবে। গমের দাম বেশি হলে জমিদারের লাভ। কিন্তু খাদ্যমূল্য বাড়লে মজুরীও বাড়ে, তাতে শিল্পপতির ক্ষতি। রিকার্ডো ছিলেন আমদানী শুল্ক তুলে দেবার পক্ষে। জমিদার ও শিল্পপতির স্বার্থের দ্বন্দ্বটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল সেই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে। রিকার্ডো সেটাকে তত্ত্ব হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। স্মিথের মতো তিনিও অবাধ বাণিজ্যের পক্ষে ছিলেন।
যেমন জমিদার ও শিল্পপতির ভিতর স্বার্থের দ্বন্দ্ব আছে, বিশেষত হ্রস্বমেয়াদী দৃষ্টিতে, তেমনি দ্বন্দ্ব আছে শ্রমিক ও শিল্পপতির ভিতরও। এডাম স্মিথ ও রিকার্ডো সেটা লক্ষ করেননি এমন নয়। শ্রমিকেরা সংগঠিত নয় বলে শিল্পপতিদের সঙ্গে দর কষাকষিতে তারা সুবিধা করতে পারে না, স্মিথের লেখায় এই ধরনের মন্তব্য আছে। কিন্তু এই দ্বন্দ্বটার ওপর স্মিথ অথবা রিকার্ডো ততটা জোর দেননি। তাঁদের দৃষ্টিতে সঞ্চয় ও বিনিয়োগটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ জাতির স্বার্থে। এইখানে এসে পড়ে দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টির একটা বিচার। আর্থিক উন্নয়নের ফলে দীর্ঘমেয়াদে কি শ্রমিকেরও অবস্থার উন্নতি ঘটে? ধ্রুপদী অর্থবিজ্ঞানীদের মতে সেটা নির্ভর করছে অন্য কিছু অবস্থার ওপর, যার ভিতর প্রধান জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ।
দেশে পুঁজি সঞ্চয়ের সঙ্গে সঙ্গে যেমন শিল্পের বৃদ্ধি ঘটে তেমনি শ্রমের জন্য চাহিদাও বাড়ে। জনসংখ্যা যদি একই হারে বেড়ে চলে তবে মজুরি বাড়বে না। অনিয়ন্ত্রিত সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটলে শ্রমিকের দারিদ্র্য দূর করা যাবে না। ম্যালথাস এ কথাটা বিশেষ জোরের সঙ্গে বলেছিলেন। তবে সংখ্যানিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনার বিষয়ে তিনি সচেতন ছিলেন। স্মিথ থেকে জন স্টুয়ার্ট মিল পর্যন্ত সবাই সেটা মানতেন। একদিকে প্রয়োজন পুঁজিসঞ্চয় অব্যাহত রাখা আর অন্যদিকে জন্মনিয়ন্ত্রণ। তবেই শ্রমিকশ্রেণীর অবস্থার উন্নতি হবে, ধ্রুপদী অর্থবিজ্ঞানীদের এই ছিল অভিমত। একটা প্রশ্ন এখানে তোলা যেতে পারে। পুঁজিসঞ্চয়। করা হলেই কি যথেষ্ট? তার বিনিয়োগের সুযোগ থাকছে কি না সেটাও তো দেখা। দরকার। যদি সঞ্চিত পুঁজির বিনিযোগের সুযোগ কমে যায়, তবে তা থেকেই কি আর্থিক সঙ্কট দেখা দিতে পারে না? এ বিষয়ে ধ্রুপদী অর্থবিজ্ঞানীদের ভিতর মতামতের কিছু পার্থক্য ছিল। তবে অধিকাংশের মতটা সংক্ষেপে এই রকম। ধরা যাক উৎপাদনের জন্য বিনিয়োগের ক্ষেত্র আছে শুধু দুটি, খাদ্যশস্যের চাষ আর কাপড়ের কল। যারা কৃষিতে নিযুক্ত তাদেরও কাপড়ের প্রয়োজন আছে, আবার যারা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত তাদেরও খাদ্যের। চাহিদা আছে। দুটো ক্ষেত্রেই যদি অনুপাত রক্ষা করে মূলধন বিনিয়োগ করা যায় তা হলে। চাহিদার অভাবে উৎপাদন আটকে যাবে না। এমন অবশ্য হতে পারে যে, কাপড়ের কলে। অত্যধিক টাকা ঢালা হল আর কৃষিকাজ অবহেলিত থেকে গেল। তা হলে বাড়তি কাপড় কিনবার মতো যথেষ্ট চাহিদা হয়তো বাজারে থাকবে না, কারণ চাষীদের আয় যথেষ্ট নয়।
অর্থাৎ বিভিন্ন ক্ষেত্রের ভিতর পুঁজির বিনিয়োগে অনুপাত রক্ষা না করলে বাজারে সঙ্কট দেখা দিতে পারে। ভুলটা শোধরাতে সময় লাগে কিন্তু বাজারের সংকেত বুঝে নিয়ে ঠিক পথে ফিরে আসা সম্ভব। এইরকম ভুল সংশোধন করতে করতেই অর্থনীতি এগিয়ে চলে। যোগান বাড়াতে গিয়ে বাড়তি পুঁজি বিনিয়োগ করতে হয়, আর তা থেকেই বাড়তি আয় এবং চাহিদাও সৃষ্টি হয়। খাদ্যশস্য ও বস্ত্রশিল্পের সঙ্গে আমাদের তাত্ত্বিক ছকের মধ্যে যদি আমরা যন্ত্রশিল্প যোগ করে দিই তা হলেও মূল যুক্তিটা ভেঙে পড়বে না। বাজারে সংকট যদিও মাঝে মাঝে দেখা দেয় তবু পুঁজির বিনিয়োগ ও আর্থিক উন্নয়ন সাময়িক হেরফের অতিক্রম করে এগিয়ে চলে। ইতিহাসের পথ মসৃণ নয়, এ কথা স্বীকার করে নিয়েও সাময়িক উত্থানপতন অথবা সুবিধা-অসুবিধার চেয়ে আর্থিক উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদী নির্ধারকগুলির প্রতি অধিক মনোযোগী হতে শিখিয়েছে ধ্রুপদী অর্থবিজ্ঞান। বাস্তব বিশ্লেষণের মতোই এটাও তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। দীর্ঘ দৃষ্টিতে উন্নয়নের পথে একটি মূল বাধাই ধ্রুপদী আর্থিক তত্ত্বে স্বীকৃত। ভূমির উৎপাদিকা শক্তির একটা সীমা আছে। ফলে উন্নয়নের গতি একসময়ে ক্রমবর্ধমান বাধার সম্মুখীন হতেই পারে। কিন্তু সেটা বাজারের সঙ্কট নয়। উন্নয়নের দীর্ঘকালীন সীমা নির্ধারিত হচ্ছে চাহিদার অভাব থেকে নয়, জমির উৎপাদিকা শক্তির সীমাবদ্ধতা থেকে। জমি বলতে এখানে বোঝাচ্ছে না শুধু কৃষিযোগ্য ভূমি। আরো ব্যাপক অর্থে তেল কয়লা সহ সর্বপ্রকার প্রাকৃতিক সম্পদের কথাই ধরতে হবে।
ধ্রুপদী অর্থবিজ্ঞানীরা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিলেন এইরকম বলা হয়ে থাকে। কথাটা একেবারে ভুল নয়। তবে সম্পূর্ণ ঠিকও নয়। ধ্রুপদী অর্থবিজ্ঞানের মূল সিদ্ধান্তগুলি মেনে নিলেই যে কাউকে ধনতন্ত্রের সমর্থক হতেই হবে এমন নয়। যেমন ধরা যাক জন স্টুয়ার্ট মিলের কথা। তিনি অর্থবিজ্ঞানের ঐ সিদ্ধান্তসমূহ মোটামুটি মানতেন। কিন্তু সমাজতন্ত্র ও সমবায়ের প্রতি ছিল তাঁর গভীর সহানুভূতি। ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও সমাজবাদের ভিতর সমন্বয়ে তিনি আস্থা স্থাপন করেছিলেন। শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সমাজ অগ্রসর হবে সমবায়ের পথে, এই তাঁর আশা ছিল। জন স্টুয়ার্ট মিলের সমম্বয়ী চিন্তা যুক্তিগ্রাহ্য কি না সেই আলোচনা আপাতত মুলতুবী থাক।
উনিশ শতকের গোড়ায় ধ্রুপদী অথবিজ্ঞানের প্রভাব প্রবল হলেও সমালোচকের অভাব ছিল না। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে লিস্ট অথবা সিসদির নাম। তবে অন্যান্য সবাইকে প্রসিদ্ধিতে ছাড়িয়ে গেছেন মহাপণ্ডিত কার্ল মার্ক্স। তাঁর চিন্তার সামগ্রিক পরিচয় দেওয়া এখানে অসম্ভব। তবু সংক্ষেপে কয়েকটি কথা বলা দরকার।
মার্ক্সের নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাঁর শোষণতত্ত্ব বহু লোকের মুখে-মুখে শোনা যায়। মানুষ তার শ্রমের দ্বারা পণ্যদ্রব্য উৎপাদন করে। শ্রমের পরিমাণ দিয়েই দ্রব্যের মূল্য নিধারিত হয়। আবার ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রম নিজেই একটি পণ্যদ্রব্য, কারণ বাজারে তার ক্রয়-বিক্রয় চলে। শ্রমিক যে-পরিমাণ মূল্য সৃষ্টি করে আর শ্রমের পরিবর্তে যে-মূল্য লাভ করে, এই দুয়ের ভিতর পার্থক্য আছে। যে-মূল্য শ্রমিক সৃষ্টি করেছে অথচ লাভ করেনি তাকে বলা হয়েছে উদ্বৃত্ত মূল্য। শ্রম ক্রয় করে পুঁজিপতি ও উদ্বৃত্ত মূল্য তারই হস্তগত হয়। এরই নাম শোষণ। উদবৃত্ত মূল্য দিয়েই শোষণের পরিমাপ হয়। উদবৃত্ত মূল্যের দ্বারা পুষ্ট হয় শোষকশ্রেণী।
শ্রমের মূল্য, অর্থাৎ শ্রমিকের মজুরি, নির্ধারিত হয় কী ভাবে? ধনিকেরই স্বার্থে শ্রমিক লাভ করে সেই নিম্নতম মজুরি যাতে সে কষ্টে-সৃষ্টে বেঁচে-বর্তে থাকে আর প্রতিদিন ফিরে আসে আবারও উৎপাদনের কাজে উৎসর্গিত হবার জন্য। উদবৃত্ত মূল্য থেকে পুঁজি সঞ্চয় হয়, তাই দিয়েই নতুন করে শ্রমিক নিযুক্ত হয়, আর ক্রয় করা হয় সেই যন্ত্রপাতি যার সৃষ্টির মূলেও আছে শ্রম। পুঁজির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকের জন্য পুঁজিপতির চাহিদাও স্বাভাবিকভাবে বাড়বার কথা আর তাই ঊর্ধ্বমুখী চাপে বাজারের সাধারণ নিয়মে মজুরি বৃদ্ধি পাবার কথা। কিন্তু ধনিকশ্রেণী মজুরি বৃদ্ধি রোধ করতে বদ্ধপরিকর। একে তো শ্রমের ক্রেতা হিসেবে পুঁজিপতিদের ভিতর একটা সমঝোতা বা অলিখিত চুক্তির মতো আছে। তা ছাড়া মজুরি-বৃদ্ধির উপক্রম দেখা দিলে শ্রমিকের নিয়োগ কমিয়ে দিয়ে যন্ত্রের নিয়োগ বাড়াবার পথে অগ্রসর হয় শিল্পের মালিক। যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে শ্রমিকদের ভিতর বেকারের সংখ্যা বেড়ে যায়। এই বেকারবাহিনীর চাপে মজুরি সর্বনিম্ন স্তরেই থেকে যায়। এইসঙ্গে ধনতন্ত্রের আরো একটা ঝোঁকের কথা মার্ক্সীয় অর্থতত্ত্বে বলা হয়েছে। শিল্পে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃহৎ শিল্পের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ছোটো ছোটো শিল্প হয় বড় শিল্পের লেজুড় হয়ে যায়, নয়তো প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেরে বিদায় নেয়। পুঁজি ক্রমশ অল্পসংখ্যক পুঁজিপতির হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। এইভাবে সমাজে দুই বিপরীত মেরু সৃষ্টি হয়। এক মেরুতে অবস্থিত অল্পসংখ্যক ধনিক যাদের হাতে পুঁজি পুঞ্জীভূত। আর অন্য মেরুতে আছে বঞ্চিত জনসাধারণ, যাদের শ্রমশক্তি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এইভাবে ধনিক ও শ্রমিকের দুই শিবিরে সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ে, মধ্যবিত্তের স্থান ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে।
ধনতন্ত্রের ভিতর স্ববিরোধ এবার স্পষ্ট ও তীব্র হয়ে ওঠে। একদিকে মূলধন ও যন্ত্রের অগ্রগতির ফলে সমাজের উৎপাদিকা শক্তি অসামান্যভাবে বেড়ে যায়। অন্য দিকে অধিকাংশ মানুষের দারিদ্র্যের ফলে ক্রয়ক্ষমতা অত্যন্ত সীমাবদ্ধ থেকে যায়। দেশের ভিতর পণ্যদ্রব্য বিক্রি করার পথে কঠিন বাধা সৃষ্টি হয়। পুঁজিপতিরা তখন বিদেশে। বাজার খুঁজতে বাধ্য হয়। বিদেশের বাজার নিয়ে আরম্ভ হয় বিভিন্ন ধনতান্ত্রিক দেশের ভিতর বিরোধ ও সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ। দেশের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট এইভাবে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। মার্ক্সবাদের শিক্ষা এই যে, ধনতন্ত্র স্থির হয়ে থাকে না, তার অন্তর্নিহিত স্ববিরোধ ক্রমেই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। বিপ্লবের ক্ষেত্র এইভাবে প্রস্তুত হয়। এই বিপ্লবে নেতৃত্বের ভূমিকা নেয় শ্রমিকশ্রেণী। আধুনিক শ্রমিকশ্রেণী একদিকে ধনতন্ত্রেরই সৃষ্টি। অন্য দিকে এই শ্রমিকশ্রেণীই ধনতন্ত্রের সংহারক। মার্ক্সীয় তত্ত্ব অনুযায়ী বিপ্লবের পর প্রতিষ্ঠিত হবে শোষণমুক্ত সমাজ। যে-রাষ্ট্রযন্ত্র একদিন ছিল ধনিকের হাতে শোষণের ও অত্যাচারের যন্ত্র, সেটা এবার হবে শ্রমিকশ্রেণীর নিয়ন্ত্রণাধীন। বিপ্লবোত্তর সমাজেরও বিবর্তনে একাধিক ধাপ আছে, যার প্রথম ধাপকে বলা হয়েছে সমাজতান্ত্রিক আর উচ্চতর ধাপকে সাম্যবাদী। রাষ্ট্র যেহেতু মূলত শ্রেণী-আধিপত্য রক্ষার নিপীড়ক যন্ত্রবিশেষ, অতএব শোষণমুক্ত সমাজে তার প্রয়োজন ক্রমে ফুরিয়ে যাবারই কথা। সেটাই মার্ক্স আশা করেছিলেন। সেইখানে পৌঁছর পথে শ্রমিকশ্রেণীর ডিক্টেটরশিপ একটা ঐতিহাসিক পযায়। মানুষের সার্বিক মুক্তিই শেষ লক্ষ্য।
একথা সাধারণভাবে স্বীকৃত যে, মার্ক্সীয় আর্থিক তত্ত্বের মূল ছিল ধ্রুপদী, বিশেষত রিকাডোর, চিন্তাভাবনায়। তবু এই দুই দৃষ্টিভঙ্গীর ভিতর কিছু গুরুতর বৈসাদৃশ্য সহজেই চোখে পড়ে। আর্থিক জীবনে মাঝে মাঝে অস্থিরতা দেখা দেয় একথা রিকার্ডো, মিল সহ সবাই জানতেন। কিন্তু মার্ক্স বিশ্বাস করতেন, ধ্রুপদী অর্থবিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন না যে, ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার ভিতর সংকট অনিবার্যভাবে ক্রমেই বেড়ে চলবে। ধনতন্ত্রের আশ্রয়ে শিল্পের উৎপাদিকা শক্তির অভূতপূর্ব বৃদ্ধি ঘটে, একথা স্মিথ এবং মার্ক্স উভয়েই মানতেন। শ্রেণীবিরোধের কথাও এঁদের কারোই অজানা ছিল না তবে মার্ক্স তাত্ত্বিকভাবে স্বীকার করতেন না, ধ্রুপদী চিন্তানায়কেরা করতেন, যে, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিতরও শ্রমিকশ্রেণীর জীবনযাত্রার উন্নতি সম্ভব। বলা বাহুল্য, আর্থিক ধ্যানধারণার এই পার্থক্যের সঙ্গে যোগ ছিল রাজনীতির, আরো ব্যাপক অর্থে সমাজনীতির। অবশ্য বিশ শতকের শেষ প্রান্তে পৌঁছেও আমাদের ঐ দুই বিরোধী তত্ত্বের ভিতরই একটিকে বেছে নিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। বরং সম্ভব আরো নতুন দৃষ্টিভঙ্গী।
(খ)
থিওরী অথবা তত্ত্বের সঙ্গে তথ্য সব সময়ে মেলে না। অথচ তত্ত্বের উদ্দেশ্য তথ্যকে বুঝতে সাহায্য করা। তত্ত্বের ভিত্তিতে যেসব প্রত্যাশা যুক্তিসঙ্গত মনে হয়, তথ্যের সঙ্গে তাদের মিলিয়ে দেখবেন সমাজবিজ্ঞানী। প্রয়োজন হলে সংশোধন করবেন পূর্বকল্পনা। বৈজ্ঞানিকের কাছে কোনো গৃহীত তত্ত্বই শেষ কথা নয়।
মোটা ধরনের কিছু তথ্যের প্রতি এবার দৃষ্টিপাত করা যাক। পাশ্চাত্য ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে ধন-বণ্টনে অসাম্য এখনও আছে বড় আকারেই। তবে শতাব্দীর পরিপ্রেক্ষিতে এ-কথা বলা যাবে না যে, সেই অসাম্য ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। বেকার সমস্যার সমাধান পৃথিবীর উন্নত ও অনুন্নত অধিকাংশ দেশে এখনও নাগালের বাইরে। দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিতে দেখতে গেলে এ-কথাই বলতে হয় যে, ব্যবসায়িক অস্থিরতা এবং উত্থান-পতনের ভিতর দিয়ে উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে জাতীয় আয় ও মাথাপিছু আয় মোটের ওপর বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি হয়েছে, যদিও তাদের অভাববোধ বোধকরি কিছুমাত্র কমেনি। জাপানে, পশ্চিম ইয়োরোপে অথবা আমেরিকায় আজকের শ্রমিক এক অথবা কয়েক প্রজন্ম আগের শ্রমিকের তুলনায় উন্নততর জীবনযাত্রার অধিকারী। এটা সম্ভব হয়েছে শিক্ষার প্রসার, শ্রমিক সংগঠনের শক্তিবৃদ্ধি এবং প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে। ধনতন্ত্রের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকের মজুরি বাড়েনি এ-কথাটা সাধারণভাবে সত্য নয়। অবশ্য এইসব কথারই সমালোচনা সম্ভব। মার্ক্সবাদী। মহলে যে-সমালোচনাটি প্রায় শোনা যায় তা হল এই যে, উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশে জনসাধারণের জীবনযাত্রার উন্নতি সম্ভব হয়েছে অনুন্নত দেশের শ্রমিকদের শোষণ করে। পশ্চিমের ধনপতি স্বদেশে শ্রমিকদের কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিতে পেরেছে বিদেশে দারিদ্র্য চালান দিয়ে। অর্থাৎ, উন্নত ধনতন্ত্রের শ্রমিকশ্রেণী সাম্রাজ্যবাদের প্রসাদপুষ্ট, এর বেশি কিছু নয়। পিছিয়ে-পড়া দেশগুলিতে অনেকেরই এইরকম বিশ্বাস। এ-বিষয়ে পরে কিছু আলোচনা করা যাবে।
এই শতকের আরেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা, নতুন মধ্যবিত্তের উৎপত্তি ও বৃদ্ধি। এই মধ্যবিত্ত শুধু ছোটো ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের নিয়েই নয়। আরো অন্য ধরনের মানুষ এর ভিতরে আছে। শিষ্কোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষক গবেষক যন্ত্রবিদ ও নানা রকমের বিশেষজ্ঞদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এরা নতুন মধ্যবিত্তের পঙক্তিভুক্ত। পুঁজিপতি নয় এরা, কিন্তু অনেকেই উচ্চপ্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। পুঁজি বিনেয়োগ করা হয়েছে এদের শিক্ষায়, যার ফলে এদের আয়ের ক্ষমতা বেড়ে গেছে। উল্লেখ করা সঙ্গত হবে যে, এডাম স্মিথের চিন্তায় এ-বিষয়ে আলোচনার ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায়। স্মিথ বলেছিলেন, মূলধন বাস্তব রূপগ্রহণ করে শুধু যন্ত্রে নয়, যন্ত্রীর প্রশিক্ষিত কলাকৌশলেও। যন্ত্রকুশলীদের আয়ের উৎস নয় অশিক্ষিত শ্রম। বরং শিক্ষা, ব্যয়বহুল শিক্ষাই, এদের প্রধান পুঁজি। এদের অন্য শ্রমিকদের সঙ্গে এক করে দেখা চলবে না। শিল্পোন্নত দেশগুলিতে এদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এই নতুন মধ্যবিত্ত আধুনিক শিল্পের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না, বরং তার আশ্রয়ে বেড়ে চলে। নতুন মধ্যবিত্তের আর এক অবলম্বন আমলাতন্ত্র। আধুনিক রাষ্ট্রে, কি ধনতন্ত্রে কি সমাজতন্ত্রে, আমলাদের শক্তি ও সংখ্যা বেড়ে চলেছে। আমাদের মতো দেশেও এরা বর্তমান ও বর্ধমান। উচ্চপর্যায়ের আমলাদের কোনো প্রকারেই শ্রমিকশ্রেণীর সঙ্গে একাকার করে দেখা যায় না। এরা নতুন মধ্যবিত্তেরই অংশবিশেষ। যন্ত্রবিদ বিশেষজ্ঞ ও আমলাবাহিনী নিয়ে গঠিত এই যে বিশেষ শ্রেণী, এরা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তেমনি স্বচ্ছন্দে বিরাজ করে যেমন করে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। এই নব মধ্যমশ্রেণীর অবস্থান ও ভূমিকা সম্বন্ধে সঠিক ধারণা ছাড়া আজকের দিনে কোনো সঠিক সমাজতত্ত্ব হয় না। অন্তত শিল্পোন্নত দেশগুলিতে শ্রমিকশ্রেণীর একটা অতুচ্ছ অংশ মধ্যবিত্তের অংশ হয়ে যাচ্ছে। আজকের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এ বিষয়ে সচেতন যে, সমাজ চলমান প্রতিদ্বন্দ্বিতার নিষ্ঠুর পরিবেশে মধ্যবিত্তের ___ ____ ক্ষোভ ও নৈরাশ্যের কারণও কম নেই। এটা আশ্চর্য নয় যে, নব মধ্যবিত্তের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ তাত্ত্বিকভাবে বিপ্লবী। এটাও আশ্চর্য নয় যে, এরা কার্যত স্থিতিশীলতা অথবা সুশৃঙ্খল পরিবর্তনের পক্ষপাতী। ঘোষিত তত্ত্ব আর আচরিত জীবনচর্যার ভিতর এই অসামঞ্জস্য মধ্যবিত্তের জীবন নাটকের মৌল বৈশিষ্ট্য। নতুন প্রজন্ম এই কাপটে মর্মাহত, যদিও অতি দ্রুত তাদেরও জীবনের এটা অঙ্গ হয়ে ওঠে।
রুশ বিপ্লবের পর সমাজতন্ত্রবিরোধী মহলে অনেকের ধারণা হয়েছিল যে, নতুন সোভিয়েত ব্যবস্থা বেশি দিন টিকবে না। সে-ধারণা অদ্যাবধি সত্য প্রমাণিত হয় নি। সোভিয়েত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভালো-মন্দ দু দিকই আছে। সেখানে ধনের বণ্টনে। অসাম্য অপেক্ষাকৃত কম। তবে সাংগঠনিক ও সামরিক ব্যবস্থায় স্তরভেদ, ক্ষমতার অসাম্য ও বিশেষ সুবিধাভোগীদের উপস্থিতি অস্বীকার করা যায় না। বেকার সমস্যার নগ্ন রূপ সেখানে নেই। অপর পক্ষে ভোগ্যবস্তুর গুণগত মান রক্ষা করা যাচ্ছে না। অতিকেন্দ্রিকতার ফলে, তলাকার প্রতিষ্ঠানের হাতে ক্ষমতার অভাবে, আর্থিক ব্যবস্থাপনায় নানা অসুবিধা দেখা দিয়েছে। কিন্তু প্রধান কথা, এই নতুন ব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে পরিবর্তন ও সংশোধনের পথে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে, ব্যবস্থাটা ভেঙে পড়ছে না। সোভিয়েত সমাজ আত্মরক্ষায় ও দ্রুত শিল্পায়নে সফল হয়েছে। বিদেশী সমালোচকদের নৈরাশ্যবাদী ভবিষ্যদ্বাণী ব্যর্থ হয়েছে। সোভিয়েত সমাজে যে নতুন মধ্যবিত্ত গড়ে উঠেছে তারা এই ব্যবস্থাকে ভাঙবার পক্ষপাতী নয়, সংশোধনের পথে একে চালু রাখতেই আগ্রহী। দেশের ভিতরই কিছু যুবক অবশ্য আছে, কিছু লেখক শিল্পী চিন্তাবিদ, যারা ঐ-দেশের বর্তমান ব্যবস্থার ঘোরতর সমালোচক, যাদের লেখা সরকারের চোখের আড়ালে প্রচারিত হচ্ছে। তবু এটাই ধরে নেওয়া ভালো যে, ও-দেশের বর্তমান আর্থনীতিক ও রাজনীতিক ব্যবস্থার কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন সহসা ঘটবে না। ভবিষ্যৎ আপাতত অনিশ্চিত।
অন্তত শিল্পোন্নত দেশে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্বন্ধেও একই কথা বলতে হয়। মার্ক্স ভেবেছিলেন, ধনতন্ত্রের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে তার আত্মবিরোধ। যে-কোনো। ধনতান্ত্রিক দেশে পুঁজির পরিমাণ যত বৃদ্ধি পাবে ততই পুঁজিপতি আর শ্রমিকশ্রেণী দুই বিপরীত মেরুতে আরো বেশি করে সংবদ্ধ হবে, দুই বিরোধী শিবিরের সংঘর্ষ আরো তীব্র হয়ে উঠবে, বৈপ্লবিক পরিস্থিতি পক্ক হবে আর শ্রমিকশ্রেণী তখনই খুঁড়বে ধনতন্ত্রের কবর। অর্থাৎ, মার্ক্সের তত্ত্ব মেনে নিলে, প্রাগ্রসর ধনতান্ত্রিক দেশেই সমাজের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব সবচেয়ে ভীষণ, সেখানেই সঙ্কট সবচেয়ে গভীর। কিন্তু ১৯১৭ সালে বিপ্লব ঘটল অনুন্নত রুশ দেশে, ধনতন্ত্র যেখানে বেশি দূর বিকশিত হতে পারেনি। লেনিন প্রমুখ নেতারা অবশ্য এর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ধনতন্ত্র ছডিড়য়ে পড়েছে বিশ্বময়, তৈরি হয়েছে বহু দেশ নিয়ে একটি দীর্ঘ শৃঙ্খল, এই শিকলের যেটা দুর্বলতম গ্রন্থি, টান পড়লে সেটাই ভাঙবে আগে। তবু স্বীকার করা ভালো যে, রুশ দেশে বৈপ্লবিক ঘটনার পরও আশা করা হয়েছিল যে, মার্ক্সীয় তত্ত্ব অনুযায়ী বিপ্লব ছড়িয়ে পড়বে এক অথবা একাধিক উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশে। কিন্তু ঘটনা অন্য প্রকার। রুশ বিপ্লবের পর প্রায় সত্তর বছর পূর্ণ। হতে চলেছে। কোনো প্রাগ্রসর ধনতান্ত্রিক দেশেই বৈপ্লবিক প্রত্যাশা পূর্ণ হয়নি।
ব্যাপারটা বিশেষ করে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে গত দশ পনের বছরে, ১৯৭৩ সালের পরবর্তী বছরগুলিতে। এ সময়ে ধনতান্ত্রিক জগতে আবারও বড় আকারে আর্থিক দুর্যোগ দেখা দেয়। আশা করা অসঙ্গত হত না যে, এই সময়ে ঐ দেশগুলিতে জনমত প্রবলভাবে বামপন্থী হয়ে উঠবে, ধনতান্ত্রিক জগতে একটা বৈপ্লবিক পরিবেশ অপ্রতিরোধ্য হবে। কিন্তু তা হয়নি। ইংলণ্ড ও আমেরিকার মতো প্রাগ্রসর ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে এই সময়ে ভোট পড়ল রক্ষণশীল দলগুলির পক্ষে। আরো উল্লেখযোগ্য, ফরাসী দেশে কম্যুনিস্ট দলের জনসমর্থন এই সময়ে কমে গেল প্রশ্নাতীতভাবে। সন্দেহ নেই যে, পশ্চিমী দুনিয়ায় সংগঠিত শ্রমিক তার বৈপ্লবিক উৎসাহ অনেক পরিমাণে হারিয়ে ফেলেছে। এইসব দেশে নব মধ্যবিত্তের চেতনায় আকস্মিক বিপর্যয়ের চেয়ে সামাজিক স্থায়িত্বের আকাঙ্ক্ষাই প্রবল। সাম্রাজ্যবাদী শোষণকে এসবের কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। একেই অবলম্বন করে প্রাগ্রসর ধনতান্ত্রিক জগৎ বিপ্লব ঠেকিয়ে রেখেছে। এই ব্যাখ্যা কতটা ভার গ্রহণ করতে পারে ভেবে দেখা দরকার। রুশ বিপ্লবের পর পশ্চিমী দেশগুলিতে যখন ধনতন্ত্রের পতন ঘটল না তখন বলা হয়েছিল, পিকিং (বা বেইজিং) আর কলকাতার পথে বিপ্লব এসে পৌঁছবে ইয়োরোপে আমেরিকায়। অর্থাৎ চীন আর ভারত সাম্রাজ্যবাদের বড় খুঁটি, ঐ দুটো দেশ হাতছাড়া হলেই শিল্পোন্নত পশ্চিমী ভূখণ্ডে ধনতন্ত্রের পতন ঘটবে। ভারত স্বাধীন হয়েছে, চীন কম্যুনিস্ট হয়েছে। কিন্তু এর ফলে পাশ্চাত্য ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর জাপান জার্মানী ফরাসী দেশ হল্যাণ্ড বেলজিয়াম প্রমুখ আরো বহু দেশ উপনিবেশ হারিয়েছে। অথচ এর পরও ঐ-সব দেশে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রয়োজনীয় কিছু কিছু পরিবর্তন সাধন করে আপাতদৃষ্টিতে আরো উন্নত জীবনযাত্রার দিকেই এগিয়ে চলেছে। স্পেনের উদাহরণও উল্লেখযোগ্য! ফ্রাংকোর একনায়কতন্ত্র পিছনে ফেলে, উপনিবেশের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে, স্পেন এগিয়ে চলেছে গতানুগতিক পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের পথ ধরে। ধনতন্ত্র। সেখানেও সংশোধিত হয়েছে, ভেঙে পড়েনি। কেউ হয় তো বলবেন, ঐ-সব দেশকেই ধারণ করে আছে সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন দেশ। এতে মার্কিন দেশের ধারণশক্তিকে অত্যন্ত বড় করে দেখানো হয়। ভিয়েতনামে যখন নির্দয় যুদ্ধ চলছিল তখন অনেকে ভেবেছিলেন যে, ভিয়েতনামের উপর দখল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির পক্ষে একান্ত প্রয়োজন। ভিয়েতনাম হাতছাড়া হয়েছে, যুদ্ধে মার্কিন দেশ হেরে গেছে, মার্কিন অর্থনীতি ভেঙে পড়েনি। কেবল ঔপনিবেশিক কারণে নয়, সমসাময়িক কালে আরো নানা অসামঞ্জস্যের ফলে, ধনতান্ত্রিক দেশগুলি বড় ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে। এ-কথা স্বীকার্য। ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি, বিশেষত প্রাগ্রসর দেশগুলিতে, বহুবিস্তৃত বাজারের উপর নির্ভরশীল। মাঝে-মাঝে অবস্থার আকস্মিক পরিবর্তনে এই অর্থনীতি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, যার পর নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যে ফিরে আসা সময়সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য। ধ্রুপদী যুগের অর্থবিজ্ঞানীরাও এই রকম বিপর্যয়ের সঙ্গে অপরিচিত ছিলেন না। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন সাংগঠনিক পরিবর্তন ও তজ্জনিত জটিলতা, যেমন বৃহৎ শ্রমিক সংগঠন কিংবা অতিকায় শিল্প প্রতিষ্ঠানে একাধিকারের দিকে ঝোঁক, যার ফলে মূল্যস্ফীতি প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে ওঠে। এইসব সমস্যার ভিতর দিয়ে অনিবার্য হয়ে উঠেছে। ধনতন্ত্রের পরিবর্তন, কিন্তু আকস্মিক ধ্বংস নয়। অর্থাৎ, পাশ্চাত্য ধনতন্ত্র অথবা সোভিয়েত সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে আমাদের ব্যক্তিগত মনোভাব যাই হোক না কেন, এই দুই ব্যবস্থাকে সঙ্গে নিয়েই পৃথিবী আরো অনেকদিন চলবে এটা মেনে নেওয়াই বাস্তব বুদ্ধিসম্মত। তৃতী শ্বির কোনো কোনো দেশে প ইতর টপালট ঘটা অসম্ভব নয়।
যেসব প্রাগ্রসর ধনতান্ত্রিক দেশ তৃতীয় বিশ্বে পুঁজি বিনিয়োগ করেছে তাদের ভিতর নানা কারণে মার্কিন দেশ আজ সবাগ্রগণ্য। তৃতীয় বিশ্বের উঠতি মধ্যবিত্তের একাংশ বিদেশী পুঁজির বিরুদ্ধে সংগ্রামে সক্রিয়। স্বভাবতই এই সংগ্রাম জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের লক্ষণে চিহ্নিত। দেশের ভিতর পুরনো প্রতিষ্ঠিত সামন্ততন্ত্রী ও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ তার স্রোতও এই আন্দোলনে এসে মিশেছে। জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মিশ্রণ ঘটেছে নানা রকমের সমাজতান্ত্রিক চিন্তার। এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকার বহু দেশে আন্দোলনের নেতাদের হাতে ক্ষমতা এসেছে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে। ফলস্বরূপ যে-সব শাসনতন্ত্র গড়ে উঠেছে তাদের বৈচিত্র্য উল্লেখযোগ্য। অস্থিরতাও উল্লেখযোগ্য। নতুন শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে বিদেশী বৃহৎ শক্তির নতুন করে চুক্তি হয়েছে। বাংলাদেশে দেখি এরই নাটকীয় দৃষ্টান্ত। তবে বাংলাদেশই একমাত্র উদাহরণ নয়। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই বিদেশী সহায়তা নতুনভাবে প্রবেশলাভ করেছে। কোনো দেশে মার্কিন সহায়তা প্রধান, কোনো দেশে সোভিয়েত সহায়তা। ইরান, ইরাক, ইজিপ্ট, ইথিওপিয়া, কাছাকাছি এই দেশগুলির ভিতরও কত প্রকার ভেদ। মোটের ওপর মার্কিন পুঁজির প্রশ্নাতীত প্রাধান্য। তবে এটাও এতোদিনে স্পষ্ট যে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি কোনো সরলরেখায় কিংবা স্থায়ীভাবে মার্কিন অথবা সোভিয়েত পথে যাচ্ছে না। তাদের স্বাভাবিক গতি অন্য পথে। এমন কি আমেরিকা অথবা সোভিয়েত দেশের সামনেও কোনো পরীক্ষিত সরল পথ আজ নেই। আমরা যখন এক-বিশ্বের কথা বলি, বিশ্ব-শান্তির কথা বলি, তখন এ-কথাটা মনে রাখা ভালো। সারা বিশ্ব কোনো এক ধর্মের নেতৃত্বে। ঐক্যবদ্ধ হবে অতীতের এই চিন্তা যেমন অবাস্তব তেমনি কোনো এক অদ্বিতীয় তন্ত্র কিংবা মতবাদ পৃথিবীকে ঐক্যবদ্ধ করবে এই চিন্তাও বাস্তববুদ্ধিগ্রাহ্য নয়। এতে শুধু বিদ্বেষ বাড়ে। কিছু আদর্শ, কিছু মূল্যবোধ প্রয়োজন। প্রয়োজন সহাবস্থানের স্বীকৃতি, মনুষ্যত্বের ঐক্যের অভিলাষ। কিন্তু মানুষকে অগ্রসর হতে হবে নানা বিচিত্র পথে।
সহাবস্থানের স্বীকৃতি মানে অবশ্য এই নয় যে, আজকের দিনের বিভেদ ব্যবস্থাই চিরস্থায়ী হবে। ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র বলে যে দুটি ব্যবস্থাকে আমরা চিহ্নিত করেছি। উভয়েই পরিবর্তিত হয়ে চলেছে, এ কথা আমরা আগেই লক্ষ করেছি। এখন প্রশ্ন, এদের গতি কোন দিকে? এদের ভিতর ব্যবধান কি ক্রমে বাড়ছে না কমছে? পরিবর্তনের গতিতে এই দুই ব্যবস্থা ভবিষ্যতে এক অভিন্ন পরিণতিতে এসে স্থিতি লাভ করবে এমন মনে করবার যথেষ্ট কারণ নেই। তবে কোনো কোনো দিক থেকে এদের পার্থক্য কমে আসছে। রাজনীতির উচ্চকণ্ঠ কলহ ও কোলাহলের দাপটে এটা আমরা অনেক সময় লক্ষ করি না। অথচ এটা লক্ষ করবার যোগ্য বস্তু। যে-সব তত্ত্বের মধ্যে আমরা এতোদিন চূড়ান্ত বিরোধ ধরে নিয়েছিলাম, ক্রমে দেখা যাচ্ছে সেই দ্বন্দ্বের অনেকটাই দুই আংশিক সত্যের বিরোধ! সাম্প্রতিক ইতিহাসে তার ইঙ্গিত আছে। সেদিকে দৃষ্টি ফেরাবার আগে আজকের দিনের, বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের, কিছু সমস্যার কথা বলে নেওয়া দরকার।
(গ)
পৃথিবীর যাবতীয় দুঃখ-দুর্দশার ব্যাখ্যা করা হয়েছে শোষণতত্ত্ব দিয়ে। উৎপাদনের যন্ত্রপাতির মালিকানা নেই শ্রমিকের হাতে। শ্রমিক মূল্যসৃষ্টি করে, অথচ সে লাভ করে মজুরী, জীবনধারণের মতো মজুরী, উদ্বৃত্ত মূল্যের ওপর তার অধিকার নেই। দেশের অধিকাংশ মানুষের দুর্দশার মূলে আছে এই শোষণ। এই ব্যাখ্যায় কিছু নির্মম সত্য আছে। তবে এটা অসম্পূর্ণ। সারা বিশ্বের সংকটের এমন কি তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র্যেরও এমন অনেক কারণ আছে যাকে সঠিকভাবে ধরা যায় না ঐ তত্ত্বের ভিতর। শোষণতত্ত্ব কাজে লাগে, কিন্তু তার উপর একান্ত নির্ভর যুক্তিসঙ্গত নয়।
কোনো দেশেই আজকের জগতে শ্রমিকশ্রেণী উৎপন্ন মূল্যের সবটা লাভ করে না। উদবৃত্ত মূল্যের উপর নির্ভর করে আছে আমলাতন্ত্র ও সামরিক বাহিনী। সব দেশেই তাই, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তেমনি সোভিয়েত যুক্তরাজ্যে। উদ্বৃত্ত মূল্যের উপর নির্ভর করেই আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনী লড়ছে। কেউ হয় তোত পার্থক্য করবেন এইভাবে, আমলাতন্ত্র ও সামরিকবাহিনী কাজ করছে মার্কিন দেশে ধনিকের স্বার্থে আর সোভিয়েত দেশে শ্রমিকের স্বার্থে। চীন কিন্তু মনে করে না যে সোভিয়েত আমলাতন্ত্র ও সামরিকবাহিনী শ্রমিকের স্বার্থেই কাজ করে যাচ্ছে। এ তর্কের শেষ নেই। মোট কথা, উদবৃত্ত মূল্য কোনো দেশেই শ্রমিকশ্রেণী সর্বাংশে লাভ করে না।
তৃতীয় বিশ্ব তথা ঔপনিবেশিক দেশগুলির দুর্দশার কয়েকটি বিশেষ কারণ নিয়ে এবার আলোচনা করা যাক। মার্কিন দেশ এক সময় ইংলণ্ডের উপনিবেশ ছিল। মার্কিন দেশের কাঁচা মাল, যেমন তুলল, গম, তামাক, ব্রিটেনে রপ্তানি হত আর ও দেশ থেকে শিল্পজাত দ্রব্য ও মূলধন আসত মার্কিন দেশে। আমেরিকা স্বাধীনতালাভ করবার পরও অনেকদিন পর্যন্ত দু’দেশের ভিতর বাণিজ্যে এই বৈশিষ্ট্য ছিল। ভারতও ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ। এ দেশ থেকেও কাঁচা মাল ও দেশে যেত, ও দেশ থেকে শিল্পজাত দ্রব্য এ-দেশে আসত। কিন্তু ঔপনিবেশিকতার এই যে দু’টি উদাহরণ দেওয়া গেল এ দুয়ের ভিতর একটা বড় পার্থক্য আছে। এটা ভালোভাবে ধরতে হলে সোজাসুজি চোখ ঘোরাতে হয় সমাজ ও সংস্কৃতির প্রশ্নের দিকে। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের প্রভাবে এ দেশে যে নব মধ্যবিত্তের সৃষ্টি হল এ দেশের প্রাচীন সমাজ ও নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল সেই শ্রেণী। ঠিক এইরকম একটা বিচ্ছেদের আশঙ্কা ছিল না মার্কিন দেশে। বাঙালী নবশিক্ষত মধ্যবিত্ত পশ্চিমের কাছ থেকে যে সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হল তাতে কিছু ভাব ও আদর্শ ছিল যাকে মূল্যবান বলা চলে। সে যুগের অনেক গুণী মানুষই তাকে মূল্যবান বলে সমাদর করেছেন। কিন্তু নব্য শিক্ষিত সম্প্রদায় এতে করে দেশের মানুষের সঙ্গে যোগ হারিয়ে ফেলল। যারা গ্রাম-বাংলায় নেতৃত্ব দিতে পারত তারা ইংরেজি শিখে নগরবাসী হল। এ দেশের সমাজের একটা বড় ভাঙনের আরম্ভ এইখানে। শুধু যে মিলের কাপড়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় গ্রামের শিল্প মার খেল তাই নয়। সব মিলে অর্থনীতি ও সংস্কৃতিকে ব্যাপ্ত করে এ দেশের জনসমাজে একটা বড় দুর্দশা নেমে এলো। এ থেকে ইংরেজ কতটা পেল তা দিয়ে আমাদের ক্ষতির পরিমাপ হয় না। এটা সেইরকমের খেলা নয় যাতে একপক্ষের ক্ষতি আর অন্য পক্ষের লাভের মধ্যে সাম্য থাকবেই। ম্যানচেস্টারের বস্ত্ৰ-শিল্পকে শেষ অবধি ভালোভাবে রক্ষা করা যায়নি। এ দেশে কাপড়ের কল হয়েছে। কিন্তু ভারতের গ্রামীণ সমাজ তার ভারসাম্য ফিরে পায়নি।
উনিশ শতকের শেষভাগে জাপান পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। দলে দলে জাপানী যুবক বিদেশ পরিক্রমায় বেরিয়ে পড়ে, স্বদেশেই উন্নতিসাধনের ইচ্ছায়। পশ্চিমের প্রযুক্তি নিয়ে জাপান দ্রুত এগিয়ে যায়। সেটা অন্ধ মুগ্ধ অনুকরণ হয়ে ওঠেনি। বিশেষত স্বদেশের সংস্কৃতি সম্বন্ধে জাপান সতর্ক ছিল। এর সুফল ও কুফল দুই-ই লক্ষ করা যায়। কিন্তু এ দেশের সমাজে যে ধরনের ভাঙন দেখা দিয়েছে জাপান তা থেকে রক্ষা পেয়েছে।
এইরকম নানা তথ্য থেকে একটা সাধারণ সিদ্ধান্তে আসা যায়। কোনো বিশেষ শ্রেণী উদবৃত্তমূল্যের ওপর কতোটা নির্ভর করছে সে-কথা বললেই সবটা বলা হয় না। দেশের সমাজের সঙ্গে তার যোগ কী-ধরনের সেটা আরো গভীরভাবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। শোষণের সঙ্গে একদিকে আর্থিক উন্নয়ন অন্যদিকে শ্রেণীদ্বন্দ্বের সম্পর্ক আছে। কিন্তু এই সম্পর্কটা খুব সরল নয়। আধুনিক কালে জাপানের দ্রুত আর্থিক বৃদ্ধি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। শোষণ’ ছাড়া মূলধন গঠন হয় না। জাপানেও শোষণ অবশ্যই আছে। কিন্তু সেখানে শ্রমিকের সঙ্গে মালিক ও পরিচালকের বিচ্ছেদ গম্ভীর হয়নি, পাশ্চাত্য দেশে যেমন হয়েছে। বরং শ্রমিক মালিক পরিচালক মিলে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের প্রতি একটা আনুগত্য সেখানে এখনও প্রধান, যেটা পারিবারিক সম্বন্ধেরই মতো। জাপানের আর্থিক উন্নতির একটা মূল কারণ বলে এটাকে গণ্য করা হয়েছে। ভারতে এটা সম্ভব হয়নি। আরো তলিয়ে ভাবতে গেলে পুরনো জাতিভেদ আর ব্রিটিশ আমলের সাদা-কালোর বিভেদ এইসব নানা কথা এসে যায়।
পিছিয়ে-পড়া দেশগুলিতে আর্থিক সমস্যাকে আরো জটিল করে তুলেছে, জনসংখ্যাবৃদ্ধি। সমস্যাটা নানা সংস্কার দিয়ে আচ্ছন্ন, ক্রমশঃ বুঝবার চেষ্টা করা যাক। পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের প্রসিদ্ধ অর্থনীতিবিদ আথার লুইস। শ্বেতাঙ্গদের বাইরে ইনিই প্রথম এবং অদ্যাবধি একমাত্র যিনি অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এঁর একটি সহজ মডেল ছিল, এই আলোচনার শুরুতে যার উল্লেখ করা যেতে পারে। অনুন্নত দেশগুলিতে যে শিল্পে শ্রমিকদের অল্প মজুরিতেই পাওয়া যায় তার কারণ এই সব দেশে অপর্যাপ্ত সংখ্যায় মজুর আছে দুঃস্থ গ্রামাঞ্চলে। গ্রামাঞ্চলের এই মজুরদের আধা-বেকার অবস্থা। পুঁজিপতিরা পরিকল্পিতভাবে এই বেকারবাহিনী সৃষ্টি করেনি, বরং অনুন্নত চাষের সঙ্গে এই অর্ধবেকারেরা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। শিল্পের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এই অধবেকারেরা আকৃষ্ট হয় কৃষি থেকে শিল্পাঞ্চলে। ক্রমে চাষের ক্ষেত্রে বেকার ও অধবেকারের সংখ্যা কমে আসে, তখন মজুরি বৃদ্ধি পায় কৃষিতে ও শিল্পে। ভারতের মতো দেশে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় থেকে, বিশেষত গত তিরিশ বছরে, শিল্পের বেশ খানিকটা উন্নতি ও প্রসার হয়েছে। অথচ দেশে বেকার ও অর্ধবেকারের সংখ্যাও এই সময়ে বেড়েছে। এর একটা ব্যাখ্যা দরকার।
পাশ্চাত্য ধনতান্ত্রিক দেশগুলির শিল্পোন্নয়নের প্রথম যুগের অভিজ্ঞতার সঙ্গে লুইসের মডেল যতটা মিলছে আমাদের সঙ্গে ততটা মিলছে না। এর কারণ আছে। জন্মহার ও শিশু মৃত্যুহার দুটোই কমাবার উপায় বিজ্ঞান আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে সাম্প্রতিক কালে। উনিশ শতকে এই সব উপায় ও পদ্ধতি, এতোটা জানা ছিল না। আজকের উন্নতিশীল দেশগুলি এই সব পদ্ধতি অবলম্বন করতে শুরু করেছে। কিন্তু মৃত্যুহার যত তাড়াতাড়ি কমছে, জন্মহার অনুন্নত দেশে তত তাড়াতাড়ি কমছে না। গত শতকে ইউরোপের উন্নতিশীল দেশগুলিতে জনসংখ্যা বাড়ছিল বছরে শতকরা দেড় ভাগ অথবা আরো কম। আজকের উন্নতিশীল দেশগুলিতে সংখ্যাবৃদ্ধির হার শতকরা আড়াই ভাগ, কোথাও কোথাও আরো বেশি। এই সব দেশে শিল্পের প্রসার ঘটছে, শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিক সংখ্যা বাড়ছে; কিন্তু একই সঙ্গে বেকার ও অর্ধবেকারের সংখ্যাও বাড়ছে জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধির ফলে। আরো মনে রাখা দরকার যে, আজকের উন্নতিকামী দেশের বৃহৎ শিল্পে শ্রমসংকোচক প্রযুক্তি নিয়োগ করবার সুযোগসম্ভাবনা যতখানি ততটা ছিল না উনিশ শতকে। এই সব কারণে আমাদের মতো দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের দিকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া আবশ্যক হয়ে পড়েছে। প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর, সঠিক প্রচার ও সংগঠনের। ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে অনেকে জন্ম-নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করেছে। আবার শোষণতত্ত্বের সঙ্গে মিলিয়ে ভাবতে গিয়ে মার্ক্সবাদীরা বলেছে যে, জনসংখ্যার সমস্যাটা ধনতন্ত্রের সৃষ্টি, সমাজতন্ত্রে এর প্রয়োজন থাকে না। গত কয়েক দশকে প্রথমে ধনতান্ত্রিক জাপান এবং তারপর সমাজতান্ত্রিক চীন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে অসাধারণ তৎপরতা দেখিয়েছে। ১৯৬৫ থেকে ৭৫ সালের মধ্যে চীন ও ভারত দুই দেশেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির বাৎসরিক হার ছিল মোটামুটি শতকরা আড়াই ভাগ। তারপর চীনে সেই হার দ্রুত নামিয়ে আনা হয়েছে শতকরা দেড় ভাগেরও নীচে, ভারতে কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি এখনও। গোঁড়ামি-ত্যাগ করে ব্যাপারটা বুঝবার সময় নিশ্চয়ই এসে গেছে। নয় তো একটা কঠিন সমস্যাকে অকারণে কঠিনতর করে তোলা হবে।
আধুনিক প্রযুক্তি সম্বন্ধীয় কিছু জটিলতা আছে, যা থেকে সৃষ্টি হয়েছে পিছিয়ে-পড়া দেশগুলিতে আরো বাধা-বিঘ্ন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যদিও পরস্পর সংযুক্ত তবু এ দুয়ের ভিতর পার্থক্যটাও মনে রাখা দরকার। বিশুদ্ধ বিজ্ঞান বিশ্বজনীন। পৃথিবীময় বৈজ্ঞানিকদের সহযোগিতায় এর ভিত্তি, এই সহযোগিতা যত দৃঢ় হয় ততই ভালো। প্রযুক্তির সম্পর্ক প্রয়োগের সঙ্গে। দেশে কালে এই প্রায়োগিক সমস্যাগুলি ভিন্ন। আধুনিক প্রযুক্তি বলতে যা বোঝায় তার উদ্ভব প্রধানত শিল্পোন্নত দেশের প্রায়োগিক প্রয়োজন থেকে। অনুন্নত বা অপ্পোন্নত দেশগুলিতে উন্নত দেশের প্রযুক্তি ব্যবহার করবার সময় সেটা ভেবেচিন্তে করা দরকার। উনিশ শতকে উন্নত ও অপ্পোন্নত দেশের ভিতর প্রযুক্তির পার্থক্য ততটা ছিল না আজ যতটা। পিছিয়ে-পড়া দেশগুলি প্রাগ্রসর দেশের কাছ থেকে প্রযুক্তি ধার করতে পারে, এটাকে প্রথমোক্ত দেশের পক্ষে একটা বড় সুবিধা বলে মনে করা হয়। কোনো কোনো দিক থেকে এটা যে একটা সুবিধা এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু অল্পোন্নত দেশের নব্য মধ্যবিত্তের চোখে আধুনিক প্রযুক্তির এমন একটা আকর্ষণও আছে দেশের মঙ্গলের সঙ্গে যার যোগ দুর্বল। তাই এ বিষয়ে সতর্কতা প্রয়োজন। যন্ত্রবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা এই সবে প্রয়োগের অতএব প্রযুক্তির দিকটা প্রধান। যে-সমস্যাটার কথা এই মাত্র বলেছি তার উদাহরণ এইবার দেওয়া যেতে পারে। চাষের ক্ষেত্রে শ্রমসংকোচক নানা যন্ত্রের উদ্ভাবন হয়েছে। আমেরিকা ক্যানাডা বা সাইবেরিয়ার মতো অঞ্চলে জমির আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা কম। সেখানে শ্রমসংকোচক যন্ত্রের ব্যবহারে বিশেষ সুবিধা আছে। কিন্তু ভারতে বা চীনে অবস্থা অন্যরকম। কৃষিযন্ত্রের সীমাবদ্ধ প্রয়োগই এখানে সঙ্গত। নয় তো শ্রমের ব্যবহার অত্যধিক সংকুচিত হবে, বেকারের সংখ্যা বাড়বে। মাটি কাটবার জন্যও অনেক বৃহৎ যন্ত্র আছে, তাতে অল্প মানুষ। নিয়েই অনেক বেশি পরিমাণ মাটি কেটে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু যে সব দরিদ্র দেশে শ্রমশক্তির প্রাচুর্য, সেখানে এসব যন্ত্র কতটা ব্যবহার করা সামাজিক দৃষ্টিতে যুক্তিযুক্ত, সেটা ভেবে দেখা দরকার।
চিকিৎসাবিদ্যা নিয়েও এই প্রসঙ্গে চিন্তা করা দরকার। কলকাতার মতো শহরে হাসপাতালের কী দুরবস্থা সেটা ভুক্তভোগী সবাই জানে। এই অবস্থার নানা কারণ আছে। প্রশাসনিক দুর্বলতা তো আছেই। কিন্তু একটা মূল সমস্যা হল হাসপাতালে অত্যধিক ভিড়! বহু লোক ফিরে যায় যাদের ফিরিয়ে দেওয়া অন্যায়, আবার যাদের রাখা হয় তাদের জন্যও উপযুক্ত স্থান নেই। কলকাতার হাসপাতালে এই অতিরিক্ত ভিড়ের প্রধান কারণ গ্রামবাংলায় চিকিৎসার ব্যবস্থার অভাব।
আমাদের মেডিক্যাল কলেজে যাঁরা পড়ান পৃথিবীর প্রাগ্রসর চিকিৎসা শাস্ত্রের সঙ্গে তাঁরা অল্পবেশি পরিচিত। তাঁদের কাছে শিক্ষা পেয়ে আমাদের অনেক ছাত্র উন্নত দেশগুলিতে চিকিৎসার কাজে গৌরবের সঙ্গে নিযুক্ত আছেন। কিন্তু আধুনিক চিকিৎসার সঙ্গে পরিচিত আমাদের ডাক্তারবাবুরা এ-দেশের গ্রামাঞ্চলে তেমন সুবিধা করতে পারেন না। তাঁদের বিদ্যা প্রয়োগ করতে হলে যে ধরনের যন্ত্রপাতি ও ঔষধ প্রয়োজন এ-দেশের গ্রামে গ্রামে সে সব পাওয়া যায় না। পুরনো চিকিৎসাপদ্ধতি হয় তো এতোটা বৈজ্ঞানিক ছিল না, প্রযুক্তির দিক থেকে এতোটা অগ্রসর ছিল না। কিন্তু এ দেশের হাকিম কবিরাজ হাতের কাছে যে সব গাছ-গাছড়া এবং অন্যান্য উপকরণ পাওয়া যায় যথাসম্ভব তারই ব্যবহারে রোগীর চিকিৎসা করতেন। তাঁদের চিন্তা ও উদভাবনী শক্তি এই দিকে চালিত হয়েছিল। সমস্ত বিশ্বকে বাজার ধরে নিয়ে আমরা যে আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। সেটা আমাদের গ্রামে ঢুকবার পথ পায় না, এমন কি শহরেও সকলের পক্ষে সেটা বড় সহায়ক নয়। অতি উন্নত প্রযুক্তির এইরকম অসুবিধা আছে। এতে নগরের ধনী মানুষের হয় তো উপকার হয়। কিন্তু দেশের মঙ্গলের সঙ্গে এর যোগাযোগ দুর্বল। উন্নত প্রযুক্তি মাত্রই উপযুক্ত প্রযুক্তি নয়। অবশ্য উন্নত প্রযুক্তির পক্ষে আছে প্রচারের যন্ত্র। কিন্তু সে জন্যই সতর্ক আরো বেশি প্রয়োজন। উপযুক্ত প্রযুক্তি নিয়ে আরো গভীরভাবে চিন্তা করা প্রয়োজন। বহুজাতিক ব্যবসায়ী সংস্থা মাত্রই উন্নতিশীল দেশের পক্ষে অপকারী এমন বলা যাবে না। আজকাল তো সমাজতান্ত্রিক দেশ সহ সর্বত্র এই সব সংস্থাকে ডাকা হচ্ছে। তবে অত্যুন্নত দেশের প্রযুক্তি অনেক সময় সে সব দেশে বর্জিত কিছু যন্ত্রপাতি সহ সেই প্রযুক্তি–আর অল্পোন্নত দেশের শ্রমকে একত্র করবার চেষ্টায় বিপত্তি ঘটা সম্ভব। আর্থিক ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই সব প্রকল্প পরীক্ষা করে দেখা দরকার। উন্নতির জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজন উপেক্ষা করা যায় না। কিন্তু স্বনির্ভরতাকে একটা বিশেষ মূল্য দিতেই হবে। সে জন্য চেষ্টার ত্রুটি থাকলেই বিপদের সম্ভাবনা।
আধুনিক সমাজকে বলা হয়েছে ‘consumer sxiety’ অর্থাৎ এর ঝোঁক ভোক্তার দিকে, ভোগ সুখের দিকে। সুখের সঙ্গে আনন্দের একটা পার্থক্য প্রচলিত আছে। ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তির ভিতর দিয়ে আমরা যা পাই তাকে বলা যায় সুখ; আত্মার তৃপ্তিতে আনন্দ। আত্মা বলতে এখানে প্রকৃতির বাইরে কিছু বোঝাচ্ছে না। অপরের সঙ্গে যোগের ভিতর আত্মার আনন্দ। আধুনিক সমাজে ব্যক্তির আকর্ষণ ভোগ্যবস্তুর প্রতি। এমন কি উপভোগের প্রতি ততটা নয়, ভোগ্যবস্তুর ওপর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবার প্রতি যতটা। প্রতিদ্বন্দ্বিতাময় সমাজের স্বাভাবিক ঝোঁক এইদিকে। যে সব ভোগ্যবস্তুর ওপর আমার প্রতিবেশীর অধিকার আছে আমারও সেই সবের ওপর অধিকার থাকা দরকার, নয় তো আমি তুলনায় হীন হয়ে পড়ি। প্রতিযোগী সমাজের এই ধর্ম। আধুনিক মানুষের অনেক দুঃখ অনেক সমস্যার মূল খুঁজে পাওয়া যাবে এইখানে। কয়েকটি সমস্যার কথা সংক্ষেপে বলা যাক।
পৃথিবীটা এখন অনেক ছোট হয়ে গেছে। সিনেমা দূরদর্শনের দৌলতে উন্নত দেশের জীবনযাত্রার ছবিও অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশের মানুষের সামনে ভেসে ওঠে পাশের বাড়ীর দৃশ্যের মতো। উন্নতিশীল দেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের আকাঙ্ক্ষার পরিধির ভিতর এসে পড়ে সেই জীবনযাত্রা। যাদের সাধ্যে কুলোয় তারা কলেজ পেরিয়েই চলে যায় বিদেশে, বিশেষত মার্কিন দেশে। যারা সেটা পারে না, তারা দেশে বসেই বিদেশের জীবনযাত্রার। অনুকরণ করে। এই নিয়ে চলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এর কয়েকটি ফলাফল বিবেচনা করা যেতে পারে। এক, আমাদের মনোযোগর কেন্দ্রে থাকে না দেশের সমস্যা। দুই, মান-ইজ্জতের প্রতীক হয়ে ওঠে যে সব ভোগ্যবস্তু, পারিবারিক আয়ের অনেকটাই খরচ। হয়ে যায় তাতে। যে সব প্রয়োজন আরো মৌল, সে সবের জন্য আয়ের সামান্যই। অবশিষ্ট থাকে। এই সমস্যাটা দেখা দেয় যেমন মধ্যবিত্ত পরিবারে তেমনি শ্রমিকের পরিবারেও। ফলে আয়বৃদ্ধি হলেও অভাব মেটে না। এরই সঙ্গে যোগ দুর্নীতির সমস্যার। ভালোমন্দ যে-কোনো উপায়ে ‘উপরি’ আয়ের প্রতি প্রলুব্ধ হয়ে পড়ে মানুষ। তৃতীয় বিশ্বে এই ব্যাধির প্রকোপ দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে সাম্প্রতিক কালে। দুর্নীতিতে দুর্বল হচ্ছে উন্নয়নের বাস্তব ভিত্তি। একই সঙ্গে বাড়ছে অর্থ আর অনর্থ।
এশিয়া আফ্রিকায় নব্য মধ্যবিত্তের আয় দেশের সাধারণ মানুষের আয়ের তুলনায় অনেক বেশি। এর একটা সহজ কারণ আছে। এ সব দেশের মাথা পিছু গড়পড়তা আয় পশ্চিমের উন্নত দেশের তুলনায় অনেক কম। সাধারণ মানুষের রোজগার দেশের গড়পড়তা আয়ের উর্ধ্বে উঠতে পারে না। কিন্তু শহরের নব্য মধ্যবিত্তের আয় সেই হিসেবে নির্ধারিত হয় না। তাদের চোখ পড়ে আছে নিজের দেশের গ্রামের দিকে নয়, শিল্পোন্নত দেশের শহরের দিকে, যেখানে গড়পড়তা আয় হয় তো পঞ্চাশগুণ বেশি। আজকের ঘানা স্বাধীন হবার আগে সে দেশে একবার গিয়েছিলাম। সেখানে তখন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। দেশে উচ্চশিক্ষিত লোকের অভাব, বিলেত থেকে অধ্যাপক আমদানি হয়েছে পড়াবার জন্য। তাদের মাইনে ঠিক হয়েছে স্বাভাবিক কারণেই বিলেতের মাইনের মান অনুযায়ী, এমন কি তার চেয়ে খানিকটা ওপরে। দেশ স্বাধীন হবার পর দেশী অধ্যাপকদেরও মাইনে ঠিক হল সেই বিদেশীদের অনুকরণে, তা নইলে সমাজে ইজ্জত থাকে না। তখনকার রোডেসিয়ার খনিতে বিদেশী যন্ত্রবিদেরা নিযুক্ত ছিল। সেখানেও একই ঘটনা। নব্য মধ্যবিত্তের কলাকৌশলের বাজারটা আন্তর্জাতিক। কাজেই তার দৃষ্টি বাইরের দিকে। এয়ার ইন্ডিয়ার পাইলট উড়োজাহাজ চালিয়ে যায় আমেরিকার বন্দরে। সে চাইবে সেখানকার পাইলটের সঙ্গে তুলনীয় মাইনে, তা নইলে তার সম্মান থাকে না। এয়ার ইন্ডিয়ার সঙ্গে ইণ্ডিয়ান এয়ার লাইনসের বেশি বিভেদ করা যায় না, কারণ দুয়ের ভিতর কলাকৌশলের তেমন মৌলিক পার্থক্য নেই। বিভিন্ন সরকারী সংস্থার উচ্চ পদের কর্মচারীদের ভিতর আবার মাইনের তুলনীয়তার প্রত্যাশা থাকে। এইভাবে একদিকে যেমন নব্য মধ্যবিত্ত গোষ্ঠীর আকার বেড়ে চলে অন্যদিকে তেমনি তার আয়ের মান দেশের দারিদ্র্যের সঙ্গে সম্পর্ক হারিয়ে ফেলে। এদের আয় যতই দেশের গড়পড়তাকে অনেক দূর ছাড়িয়ে ওঠে ততই সাধারণ মানুষের আয় নেমে যায় দেশের সামান্য গড়পড়তার চেয়েও আরো নীচে। উন্নতিশীল অনেক দেশে সামন্ততন্ত্রের ধ্বংসাবশেষের ওপর গড়ে উঠছে অসাম্যের এই নতুন বনিয়াদ। এতে যে শুধু নিধনের অসুখ বেড়েছে তাই নয়, ধনবানদের ভিতরও একদিকে বিচ্ছিন্নতাবোধ অন্যদিকে মাৎসর্য ছড়িয়ে পড়েছে গুপ্ত ব্যাধির মতো।
(ঘ)
সমস্যা থেকে অবশেষে আসতে হয় সমাধানের চিন্তায়। এ-কথা প্রথমেই স্বীকার করে। নেওয়া ভালো যে, সামাজিক ব্যাধির নিদানতত্ত্বের তুলনায় নিরাময়পদ্ধতি অনেক বেশি জটিল ও দুঃসাধ্য। অর্থাৎ, রোগের কারণ যদি বোঝা যায় রোগ দূর করা কঠিন হয়। কখনো বা একটা রোগ সারাতে গিয়ে অন্য রোগ তৈরি হয়ে যায়। উন্নয়নের ব্যাপারেও এই সাবধানী বাক্য প্রযোজ্য। আসলে সমাজের ব্যাধি একটি নয়, অনেক। ধাপে ধাপে এগুনো ছাড়া উপায় নেই।
আমাদের দেশে এবং তৃতীয় বিশ্বের আরো অনেক দেশে আর্থিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র একটা বড় ভূমিকা পালন করছে। এই ভূমিকা শুধু পরিকল্পনা প্রণয়নে সীমাবদ্ধ নেই। প্রধান প্রধান অনেক শিল্পে ও ব্যবসায়ে সরকারী উদ্যোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বেসরকারী উদ্যোগেও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ব্যাপক আকারে উপস্থিত। এইসব দেশে অনেক সময় দেখা। যায় যে, পরিকল্পনায় ও পরিকল্পনার রূপায়ণে শিল্পের প্রতি রাষ্ট্র যতোটা মনোযোগী কৃষি অথবা পল্লী-উন্নয়নে ততোটা নয়। ভারী শিল্প বিশেষভাবে রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে গুরুত্ব পেয়ে। থাকে। এর একাধিক কারণ আছে। একে তো ভারী শিল্পের সঙ্গে প্রতিরক্ষার একটা বিশেষ সম্পর্ক আছে। তা ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে বহুসংখ্যক ছোটো উদ্যোগের দেখাশোনা করা কঠিন, অল্প সংখ্যক বড় উদ্যোগের তত্ত্বাবধানের কাজ অপেক্ষাকৃত সহজ।
আরো কিছু যুক্তি আছে। উন্নতিশীল দেশগুলিতে দারিদ্র্যের কারণে পণ্যদ্রব্যের জন্য চাহিদা যথেষ্ট নয়। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা সীমাবদ্ধ। বিদেশের বাজারে প্রবেশলাভ সহজ নয়। এ অবস্থায় একটা সহজ পথ হল, যেসব জিনিস এতকাল। আমদানি করা হত সেসব যথাসম্ভব দেশেই উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেওয়া। এইসব জিনিস অনেক সময় বৃহৎ ও ভারী শিল্পে প্রস্তুত হয়। উন্নয়নের বিশেষভাবে ভিত্তি শক্ত করবার জন্য যন্ত্রশিল্পকে অগ্রাধিকার দেবার কথা ভাবা হয়েছে। স্বনির্ভরতার জন্য ভারী শিল্পের প্রয়োজন আছে।
একই যুক্তিতে কৃষিকেও সমানভাবে অগ্রাধিকার না দেবার কোনো কারণ নেই। খাদ্যশস্য আমদানি করতে আমাদের কম টাকা খরচ হত না। অর্থনীতির ভিত্তি শক্ত করবার জন্য কৃষির প্রতিও মনোযোগ দেওয়া আবশ্যক। এতদিনে আমরা অবশ্য এমন জায়গাতে এসে পৌঁছেছি যেখানে খাদ্যাভাব যদিও দূর হয়নি তবু খাদ্যশস্য আমদানির ওপর আমাদের আর নির্ভর করতে হয় না সাধারণ অবস্থায়। অন্যান্য কৃষিজ দ্রব্যের অনটন এখনও আছে, যেমন তেল, ডাল, চিনি। দুধ মাছের অপ্রতুলতাও উল্লেখযোগ্য। অর্থাৎ, শিল্পের বেলায় যেমন উৎপাদনবৈচিত্র্য চাই, আজ কৃষির ক্ষেত্রেও সেটা প্রয়োজন।
এই সবই সাধারণভাবে স্বীকার্য। তর্ক এসে যায় সরকারী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিয়ে। বাজারের হাতে কতটা ছেড়ে দেওয়া সমীচীন, এটাই একটা প্রধান প্রশ্ন। প্রশ্নটা আরো গুরুত্ব পেয়েছে এই জন্য যে, যে-সব দেশে এতদিন বাজারের ওপর নির্ভরতার নীতি স্বীকৃত ছিল না, সেখানেও এখন ঐদিকে ঝোঁক দেখা দিয়েছে। চীন ও পূর্ব ইউরোপের নানা দেশের অর্থনীতিতে এই ঝোঁকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আসলে অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে ক্রমে উদঘাটিত হচ্ছে একটা নতুন সত্য। এতোদিন তর্কের তোড়ে যেসব জিনিসকে পরস্পরবিরোধী বলে মনে করা হত, যেমন পরিকল্পনা ও বাজারব্যবস্থা, সমবায় ও পারিবারিক কৃষি, দেখা যাচ্ছে তাদের মধ্যে সমন্বয় সম্ভব এবং সেটাই আবশ্যক। দুই শিবিরবদ্ধ গোঁড়ামিতে অর্থতত্ত্বের মুক্তি নেই; এতে শুধু অনর্থ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তত্ত্বের দিক থেকে এটা দেখানো কঠিন নয় যে, বাজারের নির্ণয় সামাজিক হিতের দিক থেকে আদর্শ নির্ণয় নয়। সরকার জনসাধারণের প্রতিনিধি, অন্তত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এরকমই ধরে নেওয়া হয়। ব্যবসায়ী চলে নিজের স্বার্থে; সরকার চলে জনসাধারণের স্বার্থে। এইভাবে দেখতে গেলে সরকারী নিয়ন্ত্রণই সর্বাবস্থায় ভালো। একাধিক কারণে তর্কটার এভাবে নিষ্পত্তি হতে পারে না। এডাম স্মিথ দেখিয়েছিলেন যে, আমরা যখন নিজের স্বার্থে কাজ করি তখনই যে সামাজিক স্বার্থের বিপরীত কাজ করি এটা মোটেই ধরে নেওয়া যায় না। চাষী নিজের স্বার্থেই চাষ করে, শাকসবজি ডিম বাজারে নিয়ে বিক্রি করে। এটা সে ব্যক্তিগত স্বার্থে করে বটে, কিন্তু এতেই সমাজের স্বার্থও পূর্ণ হয়। কাজেই স্মিথের অনুমান এই যে, বাজারের গঠনটা যদি একচেটিয়া ব্যবসায়ের দিকে অতিরিক্ত ঝুঁকে না পড়ে, সরকার যদি কতগুলি ব্যাপারে তার দায়িত্ব পালন করে, তবে ব্যবসায়ীর স্বার্থের সঙ্গে সমাজের স্বার্থের সাধারণভাবে সামঞ্জস্য আশা করা যায়। আবার সরকার জনসাধারণের নামে কাজ করে বলেই যে, তার সিদ্ধান্ত সব সময়েই কার্যত জনসাধারণের অনুকূল হবে, এটাও ধরে নেওয়া যায় না। সরকারকে কাজ করতে হয় আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে দলীয় রাজনীতির চাপের ভিতর। বাজার যেমন বাস্তবে আদর্শ গঠন লাভ করে না, আমলাতন্ত্র ও দলীয় রাজনীতির বেলায়ও তেমনি কোনো আদর্শ। অবস্থা কল্পনা করে নেওয়া অবাস্তব। এসব ব্যাপারে বিশুদ্ধ তত্ত্ব দিয়ে চালিত হতে গেলেই মুশকিল।
বাস্তবে যে সমস্যা দাঁড়িয়েছে সেটা আমরা চোখের সামনে দেখছি। সরকারী নিয়ন্ত্রণের উপায় হিসেবে এসেছে লাইসেন্স, পারমিট, ইত্যাদি। পদে পদে আমলাতন্ত্রের কাছ থেকে ছাড়পত্র অনুমতিপত্র, এইসব যোগাড় করতে হয়। এতে পদে পদে কাজ আটকে যাচ্ছে, প্রথমে সময় নষ্ট, তারপর ঘুষ দিয়ে কাজটা করিয়ে নেওয়া, এটাই রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজ আটকে দেওয়াই অর্থকর হয়ে উঠেছে। এতে করে অভ্যাস নষ্ট এবং স্বভাব নষ্ট। এটাই চলছে সর্বস্তরে। এদেশের দুর্নীতির এই চেহারার সঙ্গে আমরা পরিচিত। অন্যান্য দেশেও এটা অনুপস্থিত নয়।
এই অবস্থায় সরকারী নিয়ন্ত্রণের জটিলতা কমাবার পক্ষে যুক্তি আছে। বাজার হৃদয়হীন; কিন্তু আমলাতন্ত্রও তাই। আমলাদের বিশেষভাবে দোষ দিয়েও লাভ নেই। সরকারী নিয়ন্ত্রণ বেশি জটিল হলে এই রকমই ঘটে। এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই যে অনেক দেশই, এমনকি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও, ক্রমে বাজারের উপর নির্ভরতার পথে ফিরে এসেছে। তবে এই প্রত্যাবর্তনও শর্তহীন হতে পারে না। মানুষের সব প্রয়োজন একসঙ্গে মেটানো যায় না। সমাজের বহু প্রতিদ্বন্দ্বী প্রয়োজনের ভিতর কোনটাকে কতটা অগ্রাধিকার দিতে হবে তার নির্ধারণে রাষ্ট্রের কিছু সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা থাকা চাই, সেই পরিকল্পনার-কাঠামের ভিতরই সরকারী ও বেসরকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি কাজ করবে।
যে যুগে অর্থবিজ্ঞানের মূল ধারায় ছিল বাজারব্যবস্থার ওপর প্রায় নিঃশর্ত আস্থা, সে যুগকে। আমরা পিছনে ফেলে এসেছি। অধিকাংশ অর্থবিজ্ঞানীর ভিতর সেই আস্থার ভিত্তি দুর্বল হয়েছিল কেইনস্-এর চিন্তাধারার প্রভাবে। দেশের ভিতর মোট পুঁজিবিনিয়োগের পরিমাণ নির্ধারণের কাজটা বাজারব্যবস্থার হাতে ছেড়ে দিলে যে বিপদ আছে, এ-বিষয়ে তিনিই। সবাইকে স্মরণীয়ভাবে সতর্ক করে দিয়েছিলেন কিন্তু সেখানেও আমরা আর দাঁড়িয়ে নেই। কেইন-এর উদ্বেগ ছিল পুঁজিবিনিয়োগের মোট পরিমাণ নিয়ে, তার বন্টন নিয়ে নয়। বাস্তবে সমস্যাটা শুধু তাই নিয়েই নয়। আরো অন্য সমস্যা আছে, কেইনস্-এর চিন্তার কেন্দ্রে যা কখনো স্থান পায় নি।
আঞ্চলিক উন্নয়নে অসামঞ্জস্য এইরকম একটা সমস্যা। এর উদাহরণ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। এই উপমহাদেশেও এটা বর্তমান। উন্নত অঞ্চল উন্নততর হয়; অনুন্নত অঞ্চলের সঙ্গে তার ব্যবধান বেড়ে চলে। নগর হয়ে ওঠে মহানগর। চতুস্পার্শ্ব থেকে রস টেনে নিয়ে সে বেড়ে ওঠে। বাজারব্যবস্থা এই ঝোঁক ঠেকাতে পারে না। সচেতন কেন্দ্রীয় নীতি দিয়ে একে ঠেকাবার প্রয়োজন হয়। সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং প্রয়োগ করতে হয়। তা নইলে আমরা এমন একটা দুষ্ট বৃত্তের ভিতর আবদ্ধ হয়ে পড়ি যাকে ভাঙবার সাধ্য নেই বাজারের। এই কলকাতা মহানগরীই সেই দুষ্ট বৃত্তের এক সুস্পষ্ট উদাহরণ। অতিস্ফীত এই মহানগরীতে সমস্যার অন্ত নেই। একে উদ্ধার করবার জন্য, এর পরিবহণ বাসস্থান ও জল সরবরাহকে সহনীয় করে তুলবার উদ্দেশ্যে এবং পরিবেশের উন্নতি ও রূপসজ্জার জন্য, হাজার হাজার কোটি টাকার নানা প্রকল্পের কথা ভাবা হচ্ছে। সারা বাংলার গ্রামে গ্রামে যখন শিক্ষা স্বাস্থ্য অন্নের ন্যনতম ব্যবস্থা নেই তখন কলকাতায় এই পরিমাণ টাকা ঢালা যাবে কি না আর তাতেও কলকাতার সমস্যার সমাধান হবে কি না, এটাও চিন্তার বিষয়। কলকাতায় অবস্থা আরো একটু সহনীয় হলেই পরিপার্শ্বের দুঃস্থ অঞ্চল থেকে আরো বেশি মানুষ মহানগরীর প্রতি আকৃষ্ট হবে এবং তার ফলে পরিবহণাদির বাড়তি সমস্ত ব্যবস্থাই আবারও প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রচুর হয়ে পড়বে। এই সম্ভাবনার কথা কি আমরা ভেবে দেখেছি? এই সেই উভয় সংকট কলকাতাকে তার নির্ধারিত কাজের উপযোগী স্থান করে তুলতে হলে বাকী বাংলাকে। উপবাসী রেখে এখানে অজস্র টাকা ঢালতে হয়। যদি সেটা সম্ভব হয়, যদি কলকাতাকে কাজকর্মের উপযোগী করে তোলা যায়, তবে উপবাসী বাংলার আরো অগণিত মানুষ সম্ভবত এখানেই উপচে পড়বে এবং এখানকার পথঘাট আবারও অবরুদ্ধ হয়ে কাজের অযোগ্য হয়ে পড়বে।
এই উভয়সংকট থেকে বেরোবার একটাই পথ ভাবা যায়, সেটা বিকেন্দ্রীকরণ। কলকাতা পশ্চিমবাংলার প্রধান ব্যবসায়কেন্দ্র, পূর্ব ভারতের একমাত্র বন্দর; কলকতা এই রাজ্যের রাজধানী ও প্রশাসনের কেন্দ্র; কলকাতা পূর্ব ভারতের বৃহত্তম শিক্ষাকেন্দ্র। কিন্তু এই হস্পর্শের ফল ভালো হয়নি; এটা প্রয়োজনও নয়। পাকিস্তানের ভাগ্য ভালো লাহোর, করাচী আর ইসলামাবাদকে একস্থানে এনে ফেলতে হয়নি। নুইয়র্ক ব্যবসায়ের কেন্দ্র, ওয়াশিংটন রাজধানী, শিক্ষার কেন্দ্র অন্য এক রাজ্যে। পশ্চিমবাংলায় মহাকরণ ও শিক্ষাকেন্দ্র অন্যত্র হতে পারে। এই সেই পথ যাতে কলকাতা এবং সেইসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ খানিকটা ভারসাম্য ফিরে পাবে। এটা নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রশ্ন সুস্পষ্ট নীতি ছাড়া এটা সম্ভব নয়। কলকাতার নব্য মধ্যবিত্তের অভ্যস্ত ছকে বাঁধা জীবনে এতে অসুবিধা দেখা দেবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যতের জন্য এটাই সুপথ।
কলকাতা উদাহরণ মাত্র। মোট কথা, পরিকল্পিত বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজন আছে। কয়েকটি গ্রামের কেন্দ্রে একটি স্থানীয় বাজার ও ছোট শহর; কয়েকটি ছোট শহরের কেন্দ্রে একটি মাঝারি শহর এইভাবে পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রাম ও শহরের বিন্যাস ও উন্নয়ন সম্ভব। পথঘাট স্বাস্থ্য ও শিক্ষার কেন্দ্র সবই এইভাবে সাজানো দরকার। এটাই স্বাভাবিক বিবর্তনের পথ। কিন্তু নানা কারণে এই পথ থেকে বিচ্যুতি ঘটে। একবার বিচ্যুতি ঘটলে ঠিক পথে ফিরে আসা সহজ নয়। সেজন্য প্রয়োজন পরিকল্পিত প্রচেষ্টা।
বিকেন্দ্রীকরণের সঙ্গে যুক্ত আছে মালিকানার প্রশ্ন। মালিকানা বা স্বামিত্ব বলতে কার্যত বোঝায় বিশেষ ধরনের অধিকারপুঞ্জ। ধনতন্ত্রে এ-জাতীয় অধিকার ধনিকগোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রতন্ত্রে রাষ্ট্রের হাতে। রবীন্দ্রনাথ সমাজতন্ত্রের সঙ্গে রাষ্ট্রতন্ত্রের একটা ভেদ দেখিয়েছিলেন। আমরা এ বিষয়ে শব্দের ব্যবহার নিয়ে ততোটা সাবধানী নই। সেখানেই একটা দ্ব্যর্থতা থেকে যায়। সমাজের হাতে সব অধিকার ন্যস্ত এ কথা বললেও স্পষ্ট হয় না যে, সেইসব অধিকার বস্তুত প্রয়োগ হচ্ছে কী ভাবে। সমাজতন্ত্র নামে পরিচিত কোনো কোনো ব্যবস্থা কার্যত রাষ্ট্রতন্ত্রেরই ভিন্ন নাম, অতিকেন্দ্রিকতার এই ফল। বিকেন্দ্রিত সমাজব্যবস্থার চিত্র ভিন্ন রূপ। সেখানে মালিকানা-সংক্রান্ত সমস্ত অধিকার কোথাও কেন্দ্রীভূত নয়, বরং কর্তব্য ও দায়দায়িত্বর সঙ্গে যুক্ত হয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরে ও বিভিন্ন বিন্যাসে বিন্যস্ত। গান্ধীজী বলেছিলেন পরিকল্পনা শুরু করতে হবে গ্রাম থেকে। গ্রামসমাজকে সংগঠিত করতে পারলে আমাদের মতো দেশে অনেক কাজ সহজ হয়ে ওঠে, তা নইলে অনেক চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। যেমন ধরা যাক, জনশিক্ষা। জনশিক্ষার প্রসারে আমাদের সাফল্য এযাবৎ উৎসাহব্যঞ্জক নয়। এ কাজের সঙ্গে একটি বা কয়েকটি গ্রাম নিয়ে সংগঠিত সমিতিকে যুক্ত করতে পারলে ভালো হয়। তা নইলে অব্যবস্থা ও প্রতারণা দূর করা কঠিন। বয়স্কশিক্ষার নামে যে-টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে সেটা সেই কাজে খরচ হচ্ছে কি না, শিক্ষক নিয়মিত তাঁর কাজ করছেন কি না, ছাত্রদের কী কী অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে, এসব কে দেখবে? এসব কাজ সরকারী কর্মচারী বা পরিদর্শক দিয়ে ঠিকভাবে করা যায় না। টাকার অপব্যবহার হয়, ব্যর্থতা ঢাকা পড়ে ভুল রিপোর্টে।
জনসংখ্যানিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব নিয়ে আগেই আলোচনা করেছি। এখানেও আমরা যথেষ্ট সাফল্য দেখাতে পারিনি। এদেশে স্ত্রীশিক্ষা এখনও যথেষ্ট প্রসার লাভ করেনি, বিশেষত। গ্রামাঞ্চলে। স্ত্রীশিক্ষার সঙ্গে জন্মনিয়ন্ত্রণের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, এটা সমীক্ষায় লক্ষ করা গেছে। স্ত্রীশিক্ষা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ এই দুটি ব্যাপারেই আমরা পিছিয়ে থাকব যতদিন পর্যন্ত না গ্রামাঞ্চলে এদের যথেষ্ট প্রবেশ ঘটে। আবারও গ্রামসমিতির কথা তুলতে হয়। গ্রামাঞ্চলে যেখানে সবাই সবাইকে চেনে সেখানে এইসব ব্যাপারে গ্রামসমিতিকে সঙ্গে নিতে পারলে কাজ সহজে এগিয়ে যায়।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের দরিদ্রতম মানুষদের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যক খাদ্যবস্তু সুলভে বা ন্যায্য দামে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হয়। বাজারব্যবস্থার একটা ত্রুটি এই যে, যাদের ক্রয়ক্ষমতা নেই তাদের সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হয় না। দরিদ্র গ্রামবাসীর অম্নের ব্যবস্থা না থাকলে শিক্ষার ব্যবস্থাও করা যাবে না। এ ব্যাপারে চীন অথবা শ্রীলংকার তুলনায় ভারত পিছিয়ে আছে। শ্রীলংকার সুবিধা, সেটা ছোট দেশ। গ্রামে গ্রামে এই জাতীয় সেবার ব্যবস্থা করা প্রশাসনিক দিক থেকে সেখানে অপেক্ষাকৃত সহজ। চীনের সংগঠনশক্তি এইসব কাজের পক্ষে সহায়ক হয়েছে। ভারতে এজন্য প্রয়োজন সংগঠিত গ্রামসমিতি। এই কাজটা আবশ্যক, কিন্তু সহজ নয় জমিদারি উচ্ছেদ নিয়ে অশ্রুবিসর্জন করবার মতো লোক। অবশ্য বেশি অবশিষ্ট নেই। জমির পুনর্বণ্টনের পক্ষে একটা বড় যুক্তি এই যে, এতে করে গ্রামসমাজে গণতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় হবে। দলীয় জবরদস্তি কিন্তু গ্রামস্বরাজের ধারণার বিরোধী। রাজনৈতিক দল প্রায়শ ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের যন্ত্রবিশেষ হয়ে দাঁড়ায়। এ বিষয়ে জয়প্রকাশ নারায়ণ ও বিনোবা ভাবে সাবধানী বাণী উচ্চারণ করে গেছেন। আমাদের মতো দেশে কৃষির জন্য ভূমিবণ্টন ও সংগঠন কেমন হওয়া দরকার এ নিয়ে অনেক বাদবিসংবাদ হয়েছে। প্রশ্নটা একাধিক কারণে জটিল। সমাধানের যে-পথই। আমরা বেছে নিই না কেন, কয়েকটি মূল কথা, কিছু সতর্ক বাণী, মনে রাখা আবশ্যক।
এ-দেশে ভূমির ওপর জনসংখ্যার চাপ অত্যধিক। চাষের জমির জন্য পরিবারপিছু একটা যুক্তিসংগত সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেবার পর উদ্বৃত্ত জমি যদি ভূমিহীনদের ভিতর ভাগ করে দেওয়া হয় তবে প্রত্যেক ভূমিহীন পরিবারের হাতে যে-পরিমাণ জমি আসে তাতে সেই সব পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদন সম্ভব নয়। অর্থাৎ জমি লাভের পরও তাদের। অন্যের জমিতে চাষ করতে হবে অথবা অন্য কাজ খুঁজতে হবে। এই অবস্থায় নিজের জমি ধরে রাখাও তাদের পক্ষে কঠিন হয়। সব জমি যৌথখামারে পরিণত করলেও সমস্যা দূর হবে না। যৌথখামারের ভিতরও জমির উপর জনসংখ্যার চাপ থেকেই যাবে। এই পরিবর্তনের ফলে শস্যের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে এই প্রত্যাশার কোনো দৃঢ় ভিত্তি নেই। গত তিরিশ বছরে চীন ও ভারতে শস্যোৎপাদন মোটামুটি একই হারে বেড়েছে। এ ব্যাপারে সোভিয়েত দেশের রেকর্ডও সন্তোষজনক নয়।
সমবায়ের সপক্ষে কিছু ভালো যুক্তি আছে; তবে বড় বড় কমুনে কৃষিকাজ ভালো হয় না। এ বিষয়ে চীনের অভিজ্ঞতা শিক্ষাপ্রদ। ১৯৫৮ সালে সেখানে কমুনব্যবস্থার প্রবর্তন। হয়। কিছু কাল পরীক্ষানিরীক্ষার পর সেই ব্যবস্থা পরিত্যাগ করা হয়েছে। কমুন এখনো আছে, কিন্তু চাষবাসের কাজ সোজাসুজি কমুনের হাতে নেই। অতিকায় কমন ঐ কাজের পক্ষে উপযোগী নয়। পরিবার অথবা অপেক্ষাকৃত ছোট সমবায়েই চাষবাস ভালো। হয়। কিছু সমন্বয় সহযোজনের দায়িত্ব এবং বড় আকারের মূলধন বিনিয়োগের কাজই বৃহত্তর সংগঠন বা কমুনের হাতে দেওয়া যায়। বৃহৎ খামারের অতিকেন্দ্রিকতা ভেঙে চীনের চাষব্যবস্থা বেরিয়ে এসেছে। সেখানে বাজারের ভূমিকাও বাড়ছে। আসলে বাজার ও সমবায় দুইই চাই। আর বিভিন্ন রকমের কর্ম ও দায়িত্বের জন্য বিভিন্ন আকারের সমবায় চাই। পল্লীর অর্থনীতিতে পারিবারিক উদ্যোগেরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আবশ্যক। ১৯৮০ সালের পর চীনদেশে পারিবারিক চাষবাসের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটে। এর ভাল মন্দ নিয়ে বিতর্ক আছে। এসব ব্যাপারে বিভিন্ন দেশকে নিজ নিজ পরিস্থিতিতে সতর্ক পরীক্ষানিরীক্ষার ভিতর দিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে।
কোনো একদিন আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতিতে কৃষি এবং অন্য বৃত্তি ও উদ্যোগের ভিতর একটা ভারসাম্য ছিল। তার নীরব সাক্ষ্য ছড়িয়ে আছে এ-দেশের বৃত্তিভিত্তিক বিভিন্ন জাতের আকারে ও বৈচিত্র্যে। সেই ভারসাম্য একদিন ভেঙে পড়ল। সমস্যা আরো বেড়ে উঠল জনসংখ্যার বৃদ্ধির ফলে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিক প্রযুক্তিকে। অবহেলা করাও যায় না আবার তাকে নির্বিচারে গ্রহণও করা যায় না। এইখানে এসে যায় বিকেন্দ্রিত শিল্পায়নের কথা। কৃষিতে নিযুক্ত মানুষদের একটা বড় অংশকে গ্রামীণ শিল্পে অথবা কৃষির বাইরে অন্য কোনো উৎপাদক কাজে নিয়ে আসতে হবে, তা নইলে গ্রামের আর্থিক সমস্যা ঘুচবে না। যাকে এইমাত্র গ্রামীণ শিল্প বলা হল তার অবস্থান যে গ্রামেই হতে হবে এমন নয়। কয়েকটি গ্রামের কেন্দ্রে যে ছোট শহর সেখানেও তার স্থান হতে পারে। বিকেন্দ্রিত শিল্পায়নের জন্য ব্যাঙ্কের ঋণনীতি ও পদ্ধতির যেমন পরিবর্তন চাই তেমনি গবেষণার সংগঠনে ও সমস্যা নিবার্চনে নতুন উদ্দেশ্যের প্রতিফলন থাকা প্রয়োজন। পরিকল্পনার এক একটি বৃত্ত তৈরি হতে পারে কিছু গ্রাম ও বাজারসহ ছোট শহর নিয়ে। এক বৃত্তের সঙ্গে বৃহত্তর বৃত্তের যোগ ঘটিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে পারি জাতীয় অর্থনীতির দিকে। আর্থিক ও সামাজিক ক্রিয়াকর্মের এইরকম একটা রূপরেখার ইঙ্গিত ছিল গান্ধীর চিন্তায় ও রচনায়।
গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ উভয়েই পল্লীকে ভিত্তি হিসেবে মেনে নিয়ে তাঁদের আদর্শ সমাজের সংগঠনের চিত্রটি দেশের সামনে তুলে ধরেছিলেন। এরই সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এঁরা শিক্ষারও রূপায়ণ করেছিলেন। দেশের সঙ্গে নব মধ্যবিত্তের বিচ্ছিন্নতা থেকে উত্তরণের পথ এই। তবে গ্রামের সীমার মধ্যেই আবদ্ধ থাকা এঁদের লক্ষ্য ছিল না। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “একটা কথা বিশেষ করে বলা দরকার। আমি যখন ইচ্ছা করি যে আমাদের দেশের গ্রামগুলি বেঁচে উঠুক, তখন কখনও ইচ্ছে করি নে যে, গ্রাম্যতা ফিরে আসুক। গ্রাম্যতা হচ্ছে সেইরকম সংস্কার, বিদ্যাবুদ্ধি বিশ্বাস ও কর্ম, যা গ্রামসীমার বাইরের সঙ্গে বিযুক্ত-বর্তমান যুগের বিদ্যা ও বুদ্ধির ভূমিকা বিশ্বব্যাপী..গ্রামের মধ্যে সেই প্রাণ আনতে হবে, যে প্রাণের উপাদান তুচ্ছ ও সংকীর্ণ নয়, যার দ্বারা মানবপ্রকৃতিকে কোনদিকে খর্ব ও তিমিরাবৃত না রাখা হয়।” (পল্লীপ্রকৃতি)। বিশ্ববিজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তিকে অবহেলা করা ভুল। তবে সমাজের যে রূপ ও বিন্যাস আমাদের অভীষ্ট তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই মানুষের জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রয়োগ কাম্য। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের সঙ্গে যোগ চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন গান্ধীও। সেই চিন্তার সঙ্গে এঁরা বিরোধ দেখেননি পল্লীসংগঠনের। পল্লীতেই আছে আত্মীয়বুদ্ধির ও প্রতিবেশীচেতনার মূল ও মৃত্তিকা, যাকে বাদ দিয়ে বিশ্বের সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে না।
এইখানে এসে যায় একটা জীবনদর্শনের কথা, যা থেকে অর্থনীতিকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে গেলে পরিণামে বিপত্তি ঠেকানো যায় না। আধুনিক অর্থবিজ্ঞানের ভিত্তিতে আছে উপযোগবাদ বা সুখবাদ। এর বিরুদ্ধে নানা সমালোচনা শোনা গেছে। উপযোগবাদের প্রধান দুর্বলতা বোধ করি এই যে, সুখ জিনিসটাকে সে খণ্ড খণ্ড করে দেখে। তাতে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সুখের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বড় হয়ে ওঠে, মানুষে মানুষে আনন্দের। পরিপূরকতা তেমন স্বীকৃতি পায় না। অবশেষে সমাজের সংহতি বিপন্ন হয়। তাই আমরা বিস্মিত হই না যখন দেখি জন স্টুয়ার্ট মিলের মতো চিন্তা___ উপযোগবাদ নিয়ে যাত্রা শুরু করেও তার সীমানার মধ্যে স্বস্তি বোধ করেন। __ভোগবাদী জীবনদর্শনের কথা আমরা আগে আলোচনা করেছি, উপযোগবাদে উপস্থিত তার দার্শনিক ও ব্যবহারিক ভিত্তি। একটা স্তর আছে যেখানে সুখ এইরকম খণ্ডিত ব্যক্তিকেন্দ্রিক রূপ নিয়েই আসে। একেও একেবারে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু একে শেষ সত্য বলে স্বীকার করে নিয়ে এ যুগের সমস্যার সমাধানে পৌঁছবার পথ নেই।
ব্যক্তির ও সমাজের চেতনার মহত্তর দিকটাকে কী করে জাগ্রত করা যায় সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া কঠিন। মানুষ অনেক কিছু ধীরে ধীরে শেখে সংকটের ভিতর দিয়ে। পরিবেশদূষণ আমাদের শেখায় প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গী। প্রতিদ্বন্দ্বী সমাজের ভূপীকৃত ব্যর্থতা অলিনির্দেশ করে প্রতিবেশীকে নিয়ে পল্লীসংগঠনের দিকে। যুদ্ধের ভয়াবহতা বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় আন্তর্জাতিক শান্তি সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা। আবার সংগঠনের ব্যর্থতা এই শিক্ষা রেখে যায় যে, সংগঠনই সব নয়। চেতনার একটা নিজস্ব ভূমিকাও আছে যার কোনো সাংগঠনিক বিকল্প নেই। প্রয়োজন নবচেতনা ও নবসংগঠনের একটি শুভবৃত্ত। কোনো আকস্মিকতায় এর আরম্ভ নয়, শেষও নয়। আপ্তচিন্তার শেকল ভেঁড়া সহজ নয়। তবু শুরু হয়ে গেছে নতুন পথে পরীক্ষানিরীক্ষা।
সমাজের এক নব কল্পচিত্র পৃথিবীর কিছু আদর্শবাদী মানুষের চিত্তে আজ স্বপ্নের মতো। বিচরণ করছে। সেই আদর্শ আর শুধুই নিরবয়ব কল্পনা নয়। মাঝে মাঝে যেন। অবয়বপ্রাপ্ত হয়ে সে ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে উঁকিঝুঁকি মেরে অন্তর্হিত হচ্ছে। এই নব আদর্শের ভিত্তিতে অধুনা স্থান পেয়েছে সৈন্যবাহিনীর সংগঠনসংক্রান্ত এক যুগান্তকারী। ধারণা।
উচ্চনীচ ভেদসম্পন্ন আমাদের এই পরিচিত সমাজের একই সঙ্গে প্রতিরূপ ও আশ্রয়, জাতীয় সেনাবাহিনী। ক্ষত্ৰতন্ত্র ও আমলাতন্ত্র, আজকের অসাম্যচিহ্নিত সমাজের এই দুই প্রধান স্তম্ভ। মনে রাখতে হবে যে, সেনাবাহিনীর সংগঠনের সঙ্গে শিল্পবিপ্লবের একটা ঘনিষ্ঠ যোগ আছে। এ যুগের সামরিক ব্যবস্থা ও সাজসরঞ্জাম ভারী শিল্প ও আধুনিক পরিবহণকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে। ফরাসী বিপ্লবের যুগে সেনাবাহিনী আর সাধারণ মানুষের ভিতর এতো বড় পার্থক্য ছিল না। উনিশ শতকের শেষভাগে বিসমার্কের যুগে ব্যবধান প্রকাণ্ড হয়ে উঠলো। এঙ্গেলস শেষ জীবনে এটা লক্ষ করেছিলেন। সেই ধারা তারপর আরো বহু দূর এগিয়ে গেছে। এরই সঙ্গে তাল রেখে অতিকেন্দ্রিক সমাজের অপর এক স্তম্ভ, আমলাতন্ত্র, বেড়ে উঠেছে। ধনতন্ত্রে তো বটেই, আজকের সমাজতন্ত্রেও এই দৃশ্য। বৃহৎ শক্তি বলে পরিচিত প্রতিটি দেশেই আধুনিক সামরিক সংগঠন ও ভারী শিল্প, অতিকেন্দ্রিক সমাজ ও আর্থিক পরিকল্পনা, এই সবই পরস্পর সংবদ্ধ।
মার্কস সমাজেকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করে দেখেছিলেন, সম্পত্তিবান ও সম্পত্তিহীন। এদের ভিতর আপসহীন লড়াই। সম্পত্তিবান সম্পত্তি রক্ষার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করবেই, কারণ তার সমস্ত স্বার্থ নিহিত সেইখানে। আজকের বাস্তবে কিন্তু অন্য একটি মাত্রা এসে যোগ হয়েছে, একে বাদ দিলে কোনো গণনাই আর নির্ভুল থাকে না। ধনতন্ত্র পথ নয়, একথা ঠিক। তবু একথা বলাই আজ যথেষ্ট নয়। নব মধ্যবিত্তের বিশেষ সুবিধার ভিত্তি নয় মামুলী সম্পত্তি ব্যবস্থা। নব মধ্যবিত্ত বাধ্য নয় এই সম্পত্তিব্যবস্থার জন্য। আমরণ লড়াই চালিয়ে যেতে। ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে কায়েমী সুবিধার বিকল্পভিত্তি। আজকের সমাজতন্ত্রে নব মধ্যবিত্ত ফিরে এসেছে, স্থিতি খুঁজে পেয়েছে, আমলা আর সামরিকবাহিনী এই দুই পরম্পরসংবদ্ধ সমাজবৰ্গকে আশ্রয় করে। সাম্প্রতিক ইতিহাসের এই শিক্ষাকে উপেক্ষা করা যায় না।
একে ভাঙতে হলে ভাঙতে হয় আমলাতন্ত্র তথা সামরিকবাহিনীর সংগঠনকে। চীনের নেতা মাও নতুন সংগঠনের পথে পা বাড়িয়েছিলেন। মার্কসের প্রোলেতারিয়েত ছিল শিল্পবিপ্লবের সন্তান, প্রাগ্রসর নাগরিক সভ্যতার সঙ্গে তার যোগ। মাও-এর নেতৃত্বে চীনের বিপ্লবী সৈনিক হয়েছিল কৃষকের সহচর, গ্রাম থেকে অচ্ছেদ্য। সেই চিন্তা তারপর। দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সেখানেও অদ্ভুত কিছু মানুষের কাছে এই নতুন আদর্শ এসে পৌঁছেছিল।
চীন আজ যে পথে চলেছে মাও-এর পথ থেকে সেটা বেঁকে গেছে অনেক দূরে। বাংলাদেশে সামরিকবাহিনী ও আমলাতন্ত্র জাঁকিয়ে বসেছে। আবারও এক সশস্ত্র গণ-অভুত্থানের ভাবনা ভাবছে বাংলাদেশে কিছু বিপ্লবী, হয়তো ভাবছে চীনেও এবং অন্যদেশে। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থান ঘটানোটাই প্রধান কথা নয়, সমস্যা সেইখানে নয়। ভস্ম থেকে বারবার গড়ে ওঠে অসাম্যের সৌধ। সমস্যা এইখানে।
নতুন আদর্শের স্থায়ী রূপায়ণে কে পথ দেখাবে? জাতীয়তাবাদের সঙ্গে এর মিল কম। ক্ষমতালিপ্সার সঙ্গে একে মেলানো অসম্ভব। কোনো বৃহৎ শক্তির কাছ থেকে বিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্ব আশা করা যায় না। হয়তো পথ দেখাবে কোনো ছোট দেশ। আর। তার বিস্তৃতির জন্য ক্ষেত্র তৈরি হবে ধীরে, পৃথিবীজোড়া মানুষের হৃদয়ে। এ পথের। পরিণতি সংগঠিত অহিংসায়। অথবা মেনে নিতে হবে সংগঠিত অসাম্যকে। হিংসার। ওপর সাম্য গড়ে তোলা যাবে না। দুই বিকল্পের ভিতর ভবিষ্যৎ দোদুল্যমান। অহিংসা কি সম্ভব? অসাম্য কি সহনীয়? আমরা কোন দিকে চলেছি সেটাই প্রধান প্রশ্ন। এযুগের চেতনায় অসাম্য ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠছে। একে রোধ করতে না পারলে এর অস্তে আছে মানুষের আত্মহনন। আজকের সমাজে তার ইঙ্গিতের অভাব নেই।
সমাজের গভীরতর মূল্যাশ্রয়ী পরিবর্তনের নির্দেশ প্রচলিত উন্নয়নতত্ত্বের ভেতর খুঁজতে যাওয়া নিরর্থক। পৃথিবীতে একদিকে ব্যাপক দারিদ্র অন্যদিকে জাতিসমূহের আয়ের সিংহভাগ সামরিক খাতে খরচ হচ্ছে, শুধু এই তথ্যের জোরেই সামরিক ব্যয় কমানো যাবে না। সেই সঙ্গে প্রয়োজন ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে নতুন কল্পনা ও দূরদৃষ্টি, প্রত্যয় ও সংঘবদ্ধ। প্রয়াস। উন্নয়নতত্ত্বকে অবশেষে যুক্ত হতে হবে বৃহত্তর সমাজ দর্শনের সঙ্গে। আঠার উনিশ শতকের চিন্তকদের কাছে আমরা ঋণী। কিন্তু আমাদের দায়িত্ব ভবিষ্যতের কাছে। সেই ভবিষ্যৎ মানুষকে ডাক দিয়েছে নতুন চিন্তার পথে।
উন্নয়নের তত্ত্ব ও ভবিষ্যৎ (১৯৮৭)
৮ ও ৯ অক্টোবর ১৯৮৬ বিধান শিশু উদ্যানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রদত্ত অশোককুমার সরকার। স্মৃতি বক্তৃতামালা।
.
উল্লেখপঞ্জী
১। আঠার শতকের শেষভাগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীরা নির্লজ্জভাবে বাংলা লুঠ করে। এই লুণ্ঠনে কিন্তু বাংলার যতটা ক্ষতি হয় ইংল্যাণ্ডের ততটা লাভ হয়নি। এ বিষয়ে জন স্ট্রেচির ‘The End of Empire’ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।
২। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা আবশ্যক যে, উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে রুশ দেশেরও দ্রুত আর্থিক উন্নতি শুরু হয়ে যায়। প্রথম মহাযুদ্ধের পূর্ববর্তী ত্রিশ বৎসরে রুশ দেশের শিল্পোৎপাদন জর্মানীর মতই উল্লেখযোগ্য গতিতে বাড়তে থাকে। এতে বিদেশী পুঁজির একটা ভূমিকা ছিল; কিন্তু শুধু বিদেশী পুঁজি নিয়োগে কোনো দেশের দ্রুত উন্নতির ব্যাখ্যা হয় না।
৩। সমাজতান্ত্রিক দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানেও মুনাফা বা লাভের একটা ভূমিকা আছে। কিন্তু সে আলোচনায় এখন যেতে চাই না।
৪। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার এই সমস্যা নিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ আলোচনা চলেছে। সাম্যবাদী দেশেও মূলধনের অপচয় পূর্ব ইয়োরোপের অর্থনীতিজ্ঞদের ভিতর আজ প্রধান আলোচ্য বিষয়।
৫। এটাকে শুধু ধনতন্ত্রের সমস্যা বললে অবশ্য একটু ভুল হয়। আধুনিক সমাজে উৎপাদন প্রক্রিয়া এমন দীর্ঘসূত্রে বাঁধা, পণ্যবিনিময়ের ব্যবস্থা এমন জটিল এবং পরিবর্তন এতো দ্রুত যে, আজ যা মানুষের হাতছাড়া হয় ও কাল যা হাতে আসে তা এক বস্তু নয় এবং এ দুয়ের মধ্যে তুলনাও কোনো শিল্পোন্নত দেশেই আজকের বীজধান ও কালকের নবান্নের সম্পর্কের মতো সরল নয়।