তুতুল যে সার্জারিতে কাজ করে, তার কাছেই মার্ক অ্যাণ্ড স্পেনসারের একটি বড় দোকান। সেখানে একদিন দেখা হয়ে গেল শিরিনের সঙ্গে। শিরিন জানালো যে কয়েকদিন আগে ঢাকা থেকে ফিরে আলম হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আলম বহ্নিশিখার খোঁজখবর নিচ্ছিল, সে তার নতুন বাসার ঠিকানা জানে না।
আলম তুতুলের জন্য অনেক কিছু করেছে। রঞ্জনের সূত্রেই আলমের সঙ্গে পরিচয়, কিন্তু দু’ জনের চরিত্র একেবারে আলাদা। প্রথম প্রথম আলমের পরামর্শ ও সাহচর্য না পেলে তুতুল আরও বিপদে পড়তো। আলমই এই চাকরিটা জোগাড় করে দিয়েছে তুতুলকে, তার মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সেজন্য আলম কোনো প্রতিদান চায় না। তাকে ধন্যবাদ দিতে গেলেও সে এমনভাবে হেসে উড়িয়ে দেয় যেন এটা কোনো আলোচনার ব্যাপারই না। আলম কখনো তুতুলের শরীর ছোঁওয়ার চেষ্টা করেনি, বরং সে একটা সসম্ভ্রম দূরত্ব বজায় রাখে। আলমের কাছে তুতুল সত্যিই কৃতজ্ঞ। যদিও ইদানীং আলমের সঙ্গে বেশি দেখা হয় না। সে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির সঙ্গে অনেকটা জড়িয়ে পড়েছে, বছরে দু তিনবার ঢাকা যায়।
আলম অসুস্থ, তাকে একবার দেখতে যাওয়া উচিত। তুতুল শিরিনকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি দু’ একদিনের মধ্যে যাবে ওর বাড়ি? তা হলে আমি তোমার সঙ্গে যেতে পারি।
শিরিন একটু ভেবে-চিন্তে পরদিন সন্ধে সাতটায় সময় দিল। সে একটা নির্দিষ্ট টিউব স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে, সেখান থেকে আলমের বাড়ি দু তিন মিনিট।
যথা সময়ে গিয়ে তুতুল সেখানে দাঁড়িয়ে রইলা, কিন্তু শিরিনের দেখা নেই। তুতুল অপেক্ষা করলো আধঘণ্টা। এই সময় ট্রেনের সংখ্যা অনেক, একটা ধরতে না পারলে পাঁচ-সাত মিনিট পরেই আর একটা পাওয়া যায়, এত দেরি হবার তো কোনো কারণ নেই। নিশ্চয়ই শিরিন কোনো কারণে আটকে গেছে। বিশেষ কিছু না ঘটলে কেউ অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফেইল করে না। প্রত্যেকবার ট্রেন থামার পর যাত্রীরা হুড় হুড় করে বেরিয়ে আসে। তুতুল উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকে।
চল্লিশ মিনিট পরে তুতুল অস্থির হয়ে উঠলো। আর আশা নেই। ভিড়ের মধ্যে খুঁজে পায়নি। এমনকি হতে পারে? তুতুল তো নিউজ স্ট্যাণ্ডের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে, সব পত্র-পত্রিকার হেড লাইন তার মুখস্থ হয়ে গেছে। এখন তুতুল কি করবে? আলমের বাড়িতে একা যাওয়া যায়? আলম অতি ভদ্র, তাতে কখনো অসুবিধে নেই। তাছাড়া, আলম যেমন আড্ডাবাজ, নিশ্চয়ই ওর আরও বন্ধু-টন্ধু আছে। শিরিন তাকে খুঁজে না পেয়ে হয়তো ওখানেই চলে গেছে। অনেক বলে-কয়ে তুতুল আজ সাজারি থেকে ছুটি নিয়ে এসেছে, এরপর আর সময় পাবে না। এত দূর এসেও সে ফিরে যাবে?
আলমের সঙ্গে তুতুলের দেখা করতে ইচ্ছে করছে। ফিরে যেতে একেবারেই মন চাইছে না।
হাঁটতে হাঁটতে তুতুল ভাবতে লাগলো, শিরিনের সঙ্গে আলমের কী সম্পর্ক? ঠিক বোঝা যায় না। আলম বলেছিল শিরিন তার কাজিন। এক এক সময় মনে হয়, শিরিন তার বান্ধবী। শিরিনের একবার ডিভোর্স হয়ে গেছে, কিন্তু দেখলে মনে হয় কুমারী, ফুটফুটে বাচ্চা বাচ্চা চেহারা। শিরিন কি আলমকে ভালোবাসে? ওদের মধ্যে তো কাজিনের সঙ্গেও বিয়ে হয়।–
দোতলার ফ্ল্যাটটির দরজা খুললো আলম, সে সম্পূর্ণ একা। সে একটা পাজামা ও গেঞ্জি পরে আছে। বাইরে সাত ডিগ্রি টেম্পারেচার। বাড়ির মধ্যে গরম। আলমের চোখ দুটি লালচে, চুল উস্কোখুস্কো, মুখখানা কিছুটা শীর্ণ। তুতুলকে দেখে হৈ হৈ করে উঠলো।
ঘরের মধ্যে ঢুকে, ওভারকোট খুলে তুতুল জিজ্ঞেস করলো, আপনার অসুখ হয়েছে শুনলাম?
আলম সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিয়ে বললো, আরে ধুৎ, কিছু না, কিছু না! সামান্যই ব্যাপার। কে তোমারে খবর দিল? শিরিন? বাঃ, শিরিন তো একখান বেশ ভালো কাম করছে। সে নিজে আসলো না ক্যান?
তুতুল নিজের ঠাণ্ডা হাতখানা আলমের কপালে ছোঁয়ালো। আলমের বেশ জ্বর, অন্তত চার সাড়ে চার তো হবেই!
আলম হেসে বললো, এক ডাক্তার আসছে আর এক ডাক্তারের চিকিৎসা করতে! হোঃ! আমার একটা বিশ্রি ঠাণ্ডা লাগার ধাত আছে। এ দ্যাশে বরফের মধ্যে হাঁটলেও ঠাণ্ডা লাগে না। কিন্তু নিজের দ্যাশে গ্যালে গরমে-ঠাণ্ডায় সর্দি বসে যায়। কী মুশকিলের কথা! ঠিক হয়ে যাবে, দু’ দিনে ঠিক হয়ে যাবে।
তুতুল আলমের নাড়ি টিপে বললো, পালস্ রেট বেশ হাই। কী ওষুধ খাচ্ছেন?
–তোমারে সদারি করতে হবে না। বসো তো! কী খাবে? তুমি তো ওয়াইন-টোয়াইন খাও না, বীয়ারও চলে না, একটু কফি করে দেবো?
–কিছু করতে হবে না, আপনাকে বেশ দুর্বল দেখাচ্ছে। আপনি বসুন। শিরিন কি ফোন করেছিল এখানে?
–না তো। বাদ দাও এখন শিরিনের কথা। তুমি এসেছো, সেটাই বড় কথা। এবারে ঢাকায় গিয়ে কী হলো জানো? আমার যাওয়াটা বিশেষ প্রয়োজন ছিল। কী সাঙ্ঘাতিক খারাপ অবস্থা পূর্ব পাকিস্তানের। আয়ুবের কোঁতকা খেয়ে সব পলিটিশিয়ান চুপ মেরে গেছে। অধিকাংশই জেলে। যারা বাইরে আছে, তারাও ভয়ে বাড়িতে বসে থাকে। শেখ মুজিবের নামে কী বদনাম দিয়েছে জানো? শেখ মুজিব নাকি ইণ্ডিয়ার স্পাই। ইণ্ডিয়ার সাথে ষড়যন্ত্র করে শেখ সাহেব নাকি পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্রোহ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন।
–এখানকার কাগজেও একটা খবর বেরিয়েছিল।
–মিথ্যা কথা! সব মিথ্যা কথা! মোনেম খাঁ’র উর্বর মস্তিষ্কের ফসল। আইয়ুবও এমন একটা ডাহা মিথ্যার সুযোগ নিয়ে শেখ মুজিবকে শেষ করে দিতে চায়। ক্যান্টনমেন্টে বন্দী করে রেখেছে। কিন্তু তার থেকেও খারাপ কথা কী জানো, ঢাকার কোনো উকিল ব্যারিস্টার শেখ সাহেবের পক্ষ নিয়ে মামলাও লড়তে চায় না। শেখ সাহেবের এত ফলোয়ার, এখন তারা সবাই মুখ সেলাই করে রেখেছে। যেন শেখ সাহেব খতম। পূর্ব পাকিস্তানের সব আন্দোলন খতম! আমি আমার বন্ধু মওদুদ আমেদ ও আর কয়েকজনের সাথে এক সন্ধ্যাবেলা গ্যালাম বেগম মুজিবের সাথে দেখা করতে। ধানমণ্ডির সেই বাড়ি একেবারে অন্ধকার, আগে সব সময় সেখানে পাটির লোকজন থাকতো, আজ একজনও নাই। বেগম আমাদের দেখে কেন্দে ফেলান। তিনি কইলেন, আত্মীয় বন্ধুরা কেউ আর এই রাস্তা দিয়েও হাঁটে না, একটা কাউয়াও এই বাড়ির উপর দিয়া উইড়া যায় না, তোমরা ক্যান আসছো? আমাগো তিনি বিশ্বাস করতে পারতেছিলেন না। আমরা প্রস্তাব দিলাম, শেখ মুজিবের পক্ষে লড়ার জন্য আমরা ব্রিটিশ ব্যারিস্টার নিয়া যাবো। দুই তিনদিন আলোচনার পর শেষ পর্যন্ত মানিক মিঞার মধ্যস্থতায় তিনি রাজি হইলেন। ওকালতনামা, মানে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দিয়েছেন আমাদের নামে। বহ্নিশিখা, তুমি দেখবে সেই কাগজ? এবার তুলকালাম হবে। ব্রিটিশ ব্যারিস্টার নিয়া গেলে ওয়ার্ল্ড প্রেসের নজর পড়বে…
এক একজনের সঙ্গে গল্প করার জন্য কোনো বিষয় খুঁজতে হয় না, শব্দ ভাবতে হয় না। সাবলীলভাবে এক প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে চলে যাওয়া যায়। আলমের নানান ব্যাপারে কথা বলার খুব উৎসাহ, তুতুল মুগ্ধ শ্রোতা। কখন যে সময় কেটে যায়, হিসেব থাকে না তার।
এক সময় তুতুল ঘড়ি দেখে বললো, ইস, সাড়ে নটা বাজে! আমাকে এক্ষুনি উঠতে হবে, কত দূরে যাবো!
আলম উঠে জানলার পর্দা সরিয়ে দেখে বললো, বাইরের শব্দ তো শোনা যায় না। দ্যাখো, এসো, কী রকম কুকুর-বিড়ালে বৃষ্টি হচ্ছে, সেই রকম ঝড়ো হাওয়া। এর মধ্যে যাবে কী করে?
তুতুল পরমাশ্চর্য হয়ে বললো, ঝড়বৃষ্টি? আজ সকাল থেকে চমৎকার সানি ওয়েদার। একফোঁটা মেঘ দেখিনি আকাশে। আজই আমি রেইন কোট নিয়ে বেরুইনি।
আলম বললো, এই হচ্ছে লণ্ডন ওয়েদার। নারীর চরিত্রের মতন দুৰ্জ্জেয়। এই বৃষ্টি মাথায় পড়লে জ্বর হবে নির্ঘাৎ। বসো, বসে যাও!
–আপনার রেইন কোট কিংবা ছাতা যদি ধার নিই। এরপর টিউবে উঠতেও ভয় করবে।
–আগে ঝড়টা তো থামুক। তুমি কি ডিনার করে এসেছো? একটু সুপ আছে, গরম করে দিতে পারি।
জানলার কাছে গিয়ে ঝড় দেখতে দেখতে তুতুল মিথ্যে করে বললো, আমি খেয়ে এসেছি। এখন কিছু লাগবে না।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে আলম একটি সিগারেট ধরালো। তারপর আস্তে আস্তে বললো, এবার ঢাকায় গিয়ে আর একটা সমস্যা হয়েছিল। এতরকম ঝঞ্ঝাট, তার মধ্যেও বন্ধুরা জিজ্ঞেস করছিল, তুই এত অন্যমনস্ক কেন রে? তাদের কী করে বলি যে বহ্নিশিখা নামে একটি হিন্দু মেয়ের মুখ আমার মাথায় ঘুরে ফিরে আসছে, সে কেমন আছে, তার কোনো অসুবিধা হলো কি না, থাকার জায়গা নিয়ে যে গণ্ডগোল চলছিল
তুতুল মুখ ফেরালো। এখন আলমের কণ্ঠস্বরে এমন একটা কিছু ফুটে উঠেছে, যা হৃদয়ের কোনো একটা জায়গায় লাগে। তুতুল কোনোক্রমেই আর কারুর বাড়িতে এত বেশি সময় বসে থাকতো না। আলমের এখানে তার ঘড়ি দেখার কথা খেয়াল হয়নি কেন?
তুতুল বললো, আপনি আমার কথা এত ভাবতে যাবেন কেন, আমি কি ছেলেমানুষ? এখন, সব চিনে গেছি।
–মনকে তো বোঝানো যায় না। যখন তখন তুমি আমার মনের মধ্যে চলে আসো। তোমার মনে আছে, প্রথম দিন তুমি লণ্ডনে পৌঁছালে, এয়ারপোর্টে দু কদম হাঁটতে গিয়ে তুমি হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে, আমি তোমার হাত ধরলাম? সেইদিন থেকেই আমার মনে হয়, তুমি কোনো বিপদে পড়লে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দেবে। তোমার হাত ধরতে পারলে আমি ধন্য হয়ে যাবো। একথা এতদিন বলি নাই।
–আমি এবার যাই!
–যাবে? বৃষ্টি থামে নাই এখনো, বেশ জোর। ঠিক আছে, একটা ট্যাক্সি ডাকি, তাতে চলে যাও!
তুতুল আঁতকে উঠে বললো, ট্যাক্সি? সে তো অনেক ভাড়া হবে, আমার বাড়ি কি এখান। থেকে কম দূরে? অসম্ভব!
আলম বললো, তবে আমি তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবো। টিউবে, একেবারে বাড়ি পর্যন্ত। আমার ফেরার কোনো অসুবিধা নাই। আমার নিজের গাড়িটাও সারাইতে গেছে। নইলে তাতেই তোমারে পৌঁছাইয়া দিয়া আসতে পারতাম।
গাড়ি থাকলেও আপনাকে যেতে দিতাম না। আপনার এত জ্বর, টিউব স্টেশনেও যেতে হবে না, আমি একাই যেতে পারবো। একটা শুধু ছাতা।
–এত রাত্তিরে তোমার একা টিউবে যাওয়া সেইফ না। আমাদের এই লাইনটায় প্রায়ই মাগিং হয়। একটা বাজে গ্রুপ আছে। একা কোনো মেয়ে এই সময় যায় না…আর একটা অলটারনেটিভ আছে, আমার আর একটা ছোটঘর আছে, একটা সোফা আছে। সেখানে আমি সচ্ছন্দে শুয়ে থাকতে পারি, তুমি যদি এই ঘরে থাকো।
তুতুল মুখ নিচু করে বললো, না, তা সম্ভব নয়।
–কেউ তো তোমার অপেক্ষায় বসে থাকবে না? তোমার রুমমেটকে টেলিফোন করে বলেও দিতে পারো।
–তার দরকার নেই, আমি ঠিক চলে যেতে পারবো। আমার পক্ষে এখানে থাকা সম্ভব নয়, মানে, কাল খুব সকালেই
–সম্ভব নয়, ও আচ্ছা! আমি তবে তোমার সঙ্গে যাবোই।
–নাঃ, প্লীজ, এই জ্বর গায়ে গেলে…আমার রাত্তিরে ঘুম হবে না!
–বহ্নিশিখা, আমি তোমার কাছে কিছু চাই না। বাট আই ডু কেয়ার ফর ইউ! তোমাকে আমি ভালোবাসি, শুধু সেই কথাটা জানিয়ে রাখতে চাই।
তুতুল দেয়ালের দিকে মুখ করে উদাসীন গলায় বললো, আমাকে ভালোবাসলে আপনি ভুল করবেন। আমি অপয়া।
–তার মানে?
–আমাকে যারা ভালোবাসে, তারা কেউ বাঁচে না।
আলম এবার সকৌতুকে হেসে উঠে বললো, মরণ আমারে তিনবার দেখা দিয়ে গেছে। এখনও তালে তালে আছে। আমি যদি বাঁচি তবে অন্য কারুর আয়ুর জোরে। ভালোবাসার জোরেই বাঁচবো। হয়তো তুমিই আমাকে বাঁচাতে পারো।
তুতুল অনেকটা যেন নিজেকে শোনাবার জন্যই বললো, আমার এতক্ষণ এখান থেকে জোর করে চলে যাওয়া উচিত ছিল। তবু আমি যেতে পারছি না।
–কেন পারছো না?
–বোধহয় আমার মনের জোর কমে যাচ্ছে। আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলছি।
–সেজন্য কি তোমার অনুতাপ হচ্ছে? তুমি কিছু ভুল করছো?
–না, তা বোধহয় বলা যায় না। ঠিক জানি না।
–বহ্নিশিখা, তুমি এ ঘরে এসেই টিপিক্যাল ডাক্তারের মতন অটোমেটিক্যালি আমার কপালে হাত রাখলে, আমার পাস দেখলে। এখন একবার, এমনিই, অকারণে, আমার হাতটা একটু ধরবে?
আলমের দিকে ফিরে তুতুল চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।
আলম আবার অনুনয় করে বললো, আমি কি তোমার হাতটা একটু ছোঁবার অনুমতি পেতে পারি?
তুতুল বাড়িয়ে দিল নিজের হাত।
শেষ পর্যন্ত ট্যাক্সিতেই ফিরতে হলো তুতুলকে। আলম কিছুতেই শুনলো না, টেলিফোনে একটা ট্যাক্সি ডেকে, সেই ট্যাক্সি ড্রাইভারের হাতেই খুঁজে দিল দশটা পাউণ্ড। সেই ট্যাক্সি থেকে নেমে, বাড়ির সদর দরজা চাবি দিয়ে খুলতে খুলতেই তুতুল ভিজে গেল অনেকটা।
ভাবনা ঘুমিয়ে পড়েছে, তবু শাড়ী বদলাবার জন্য তুতুল গেল বারান্দার বাথরুমে। ভিজে শাড়ী, ব্লাউজ, ব্রা, শায়া খুলে সে দাঁড়ালো আয়নার সামনে। দেয়াল জোড়া আয়না, এভাবে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তুতুল কখনো আশিরপদনখ নিজেকে দেখেনি। তার মুখে একটা তীব্র অনুভূতির ছাপ। তার জীবনের একটা দিকবদল আসন্ন, সে টের পাচ্ছে যে এতদিনে তার শরীর জেগে উঠেছে।
আয়নার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তুতুল। তার মনে পড়লো পিকলুর কথা। আলমের ঘরে থাকতে থাকতেই পিকলুদার কথা মনে পড়ছিল। পিকলুদা একদিন দুপুরে দেখতে চেয়েছিল এই শরীর, এইভাবে। তুতুল রাজি হয়নি। পিকলুদার সেই আহত দৃষ্টি…
কোথায় হারিয়ে গেছে পিকলুদা। জয়দীপও হারিয়ে গেল। আলমকেও কি সে হারিয়ে যেতে দেবে? এমন সম্মান দিয়ে কেউ তো তার শুধু হাত ধরতে চায়নি।
তুতুল অনেকক্ষণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদলো। যেন একটা বহুদিন জমে থাকা বরফ গলে যাচ্ছে। জন্ম হচ্ছে একটি নতুন ঝনার, প্রবল তার তোড়, কাঁপিয়ে দিচ্ছে তুতুলের সর্বাঙ্গ।
এর পর প্রায় প্রতিদিন দেখা হতে লাগলো আলমের সঙ্গে। আলম নিজের কাজ নষ্ট করে তুতুলের কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। রাত্রে তাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়, দরজা পর্যন্ত, তুতুলদের বাড়ির মধ্যে ঢোকে না। নিজের অ্যাপার্টমেন্টেও তুতুলকে ডাকে না। সে শুধু তুতুলের সঙ্গে থাকতে চায়। তার রাগ-অভিমান নেই, হাসি-ঠাট্টায় মশগুল রাখতে চায় তুতুলকে। তুতুলই একদিন দুপুরে আলমকে বললো, তুমি বড্ড রোগা হয়ে যাচ্ছে, কিছু খাওনা বুঝি? এসো, আজ আমার বাড়িতে এসো, আমি তোমায় ভাত বেঁধে খাওয়াবো।
সেই রাতে তুতুল তার মাকে চিঠি লিখতে বসলো। এতদিন সে শুধু কাজের কথা, পারিপার্শ্বিকের কথা, অন্য মানুষজনের কথা লিখেছে। আজ লিখলো নিজের মনের কথা।
সেই চিঠি কলকাতায় পৌঁছোলো পাঁচ দিন বাদে। সকালের ডাকের চিঠি। প্রতাপ তখন আদালতে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছেন। পোস্টম্যানের হাত থেকেই খামটা নিয়ে মুন্নি চেঁচিয়ে বললো, পিসিমণি, তোমার চিঠি! ফুলদি নতুন স্ট্যাম্প পাঠিয়েছে, খামটা আমি নেবো।
জপ করতে বসেছিলেন সুপ্রীতি, মেয়ের চিঠির কথা শুনে তিনি দ্রুত মন্ত্র শেষ করলেন। এবারে তুতুলের চিঠি একটু দেরিতে এসেছে। মাত্র সাত আট লাইন পড়েই তিনি দারুণ এক আর্তনাদ করে উঠলেন, ও খোকন, সর্বনাশ হয়ে গেছে। ও মমতা…
সে রকম চিৎকার শুনলেই সাঙ্ঘাতিক কোনো দুঃসংবাদের আশঙ্কা হয়। প্রতাপ ও মমতা ছুটে এলেন এক সঙ্গে। উৎকণ্ঠায় ছাই বর্ণ মুখে প্রতাপ জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে দিদি? দেখি চিঠিটা!
সুপ্রীতির নাভিমণ্ডল থেকে হাহাকার উঠে এলো। সর্বনাশ হয়েছে! আমি বিষ খাবো। তুতুল মুসলমান বিয়ে করতে চায়!
প্রতাপ দ্রুত চিঠিখানা পড়তে লাগলেন। সুপ্রীতি সত্যিই যেন বিষের জ্বালায় ছটফট করছেন। বেশ কিছুদিন ধরে সুপ্রীতি একেবারে নির্জীব হয়ে গিয়েছিলেন, বাড়িতে তাঁর গলার আওয়াজ শোনাই যেত না। আজ এক প্রচণ্ড আঘাতে যেন তিনি আবার জেগে উঠেছেন। কণ্ঠে ফুটে উঠছে রাগ ও দুঃখের তীব্রতা। তিনি বারবার বলতে লাগলেন, বিষ দে। ও থোকন, বিষ দে আমাকে। নিমক হারাম, অকৃতজ্ঞ মেয়ে, এত কষ্ট করে তাকে মানুষ করেছি, তোদের কত কষ্ট হয়েছে। এ বাড়িতে কেউ একটু দুধ খায় না, মাছ খায় না, সেই মেয়ে বিলেতে গিয়ে মুসলমান বিয়ে করবে, একথা শোনার জন্য আমাকে বেঁচে থাকতে হলো?
সুপ্রীতির এতখানি তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখে প্রতাপ খানিকটা ঘাবড়ে গেলেন। তুতুল ডাক্তারি পাস করে বিদেশে গেছে, সে তো তার নিজস্ব ইচ্ছে অনিচ্ছে অনুসারেই জীবনটা ঠিক করবে। দিদিকে কী করে সান্ত্বনা দেবেন প্রতাপ? চিঠিটা মমতার হাতে দিয়ে তিনি বললেন, দিদি, তুমি মুসলমান বলে এত আপত্তি করছো কেন? তুতুল বুদ্ধিমতী মেয়ে। সে যাকে পছন্দ করবে, সে নিশ্চয়ই ভালো ছেলেই হবে। সে ছেলে যদি মুসলমানও হয়…
সুপ্রীতি চোটপাট করে বললেন, তার মানে? মুসলমান জামাই আমি মেনে নেবো? কক্ষনো না? ওদের জন্য আমাদের দেশ ছাড়তে হয়নি? আমাদের সর্বস্ব গেছে! দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে, কত মানুষকে মেরে ফেলেছে! লক্ষ লক্ষ রিফিউজি এখনো ভিখিরি, সেই রিফিউজিদের হাতে খুন হয়েছে আমার স্বামী, তার জন্যও তো মুসলমানরাই দায়ী! কত লাঞ্ছনা, কত অপমান সহ্য করেছি, সেসব আজ ভুলে যাবো? তুই এত কষ্ট করে সংসার চালাচ্ছিস, সবই তো ওদেরই জন্য…আমার মেয়ে, সে এ কী করলো খোকন, বংশের মুখে চুনকালি দিল, ওরে খোকন।
প্রতাপ বললেন, দিদি, আস্তে, আস্তে, পাড়ার লোকে শুনলে ভাববে আমাদের বাড়িতে বুঝি কেউ…
সুপ্রীতি বললেন, তার থেকে কম কী হয়েছে? ও মেয়ে মরে গেলেও আমি এত কষ্ট পেতাম না রে, ওঃ ওঃ, খোকন, আমার বুক ধড়ফড় করছে। এত কষ্ট, নিজের পেটের মেয়ে এত কষ্ট দিতে পারে মাকে…
মমতা বললেন দিদি, আগেই এত উতলা হচ্ছেন কেন? বিয়ে তো এখনও হয়নি। তুতুল লিখেছে, আলম নামে একটি ছেলেকে তার পছন্দ হয়েছে, ছেলেটি ডাক্তার, খুব ব্রিলিয়ান্ট, ভালো বংশের ছেলে।
–সে মুসলমান!
–হ্যাঁ, আলম নাম যখন, মুসলমান তো হবেই। তবে, বিয়ের তারিখস্টারিখ এখনো কিছু ঠিক হয়নি, তুতুল লিখেছে সে আপনার আশীর্বাদ চায়…।
মমতার দিকে কটমট করে তাকিয়ে সুপ্রীতি বললেন, আশীর্বাদ? তাকে লিখে দাও, সে যেন পত্রপাঠ ফিরে আসে। দরকার নেই তার বড় ডাক্তার হওয়ার। ওদেশে ছেলেরা গিয়ে মেম বিয়ে করে, আর আমার মেয়ে গিয়ে বিয়ে করতে চাইলো…খোকন, তুই আরও লিখে দে, সে যদি আসতে না চায়, কোনোদিন সে আর আমার মুখ দেখতে পাবে না…আমার আশীর্বাদ চায়, এত নির্লজ্জ বেহায়া হয়েছে সে! লণ্ডন শহরে বিষ পাওয়া যায় না? আমার অভিশাপ, সে বিশ খেয়ে মরুক! মুসলমানের বউ হওয়ার চেয়ে ও মেয়ের মৃত্যুর খবর পেলেও আমি চোখের জল ফেলবো না!