২.৫ বুড়োবুড়ি বসে আছে মুখোমুখি

বুড়োবুড়ি বসে আছে মুখোমুখি। দুপুরে ঘুমোচ্ছ সবাই। মুখোমুখি বসে আছে নকুড় আর সুকুমারী।

সুকুমারী জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে ভেংচে উঠল, তুমি কিছুই পারবে না।

নকুড় খেঁকিয়ে উঠল, কী করে পারব। তোমার ছেলেই তো সোহাগ করে রাজীবদাকে ডেকে নিয়ে এল। সেখানে আমি কী কথা বলব? কিছু বললে ভাববে যে, বুড়ো আবার মুখ খুলছে কেন?

সুকুমারী ঘরের ঘুমন্ত মানুষগুলির দিকে তাকিয়ে, প্রায় ফিসফিস করে বলতে লাগল, মেঘুর আসল কারবারে নাক গলাতে না পারো, অন্য কিছু করো। মেজাজ বুঝে এক সময় বলল না, একটা মুদি দোকান যদি করে দেয়।

: হ্যাঁ, টাকার থলি খুলে রেখেছে। বললেই ঝেড়ে দেবে।

কিন্তু সুকুমারীর চোখ সরে না ঝুমি ঠুমি ষোড়শীর উপর থেকে। যেন ওদের দিকে তাকিয়ে আপন মনে বিড়বিড় করছে, রাজীবকেই বা এত বিশ্বাসের কী আছে। কার মনে কী আছে, কিছু বলা যায়?

নকুড়ের ঘষা ঘষা চোখ দুটো লাল হয়ে উঠল। বলল, সে জানে বিজা শুয়োরের বাচ্চা।

: বিজা শুয়োরের বাচ্চা কেন?

: সে বানচোত-ই তো আমাকে কিছু বলতে দিচ্ছে না।

দু জনেই চুপচাপ। বাইরে বাতাস বইছে। কাঁচা নর্দমার ধারে জঙ্গলগুলি মাথা দোলাচ্ছে। পিপুলের ডালে ডালে সাঁই সাঁই শব্দ। তার ছায়াতলে এক রাশ চড়াই দুর্বোধ্য আলাপে ব্যস্ত। যেন একদল কৌশল আঁটছে, আর একদল নাকচ করে দিচ্ছে। নইলে এত ব্যস্ত ডাকাডাকির সভা কীসের।

আকাশে মেঘ ও রৌদ্রের খেলা। শরতের ঘন নীল আকাশে, মেঘের দৌড়ের চলেছে প্রতিযোগিতা। কোথায়, কোন দূরে, কোন দেশে তার মুখ, কেউ জানে না।

উঃ শব্দে একটি নিশ্বাস ফেলল নকুড়। বলল, আমার কিছু হবে না। আরও খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি যদি একবার মেয়েটাকে

সুকুমারীর চোখে ভয় দেখা দিল। বলল, যা মেয়ে।

ঘণ্টাখানেক পরেই সবাই উঠল। সুকুমারী তাড়াতাড়ি চিরুনি হাতে এগিয়ে এল লীলার কাছে। বলল, বোস ঝুমি, আমি চুল বেঁধে দিই তোর।

লীলা ভ্রূ কুঁচকে একবার মাকে দেখল। ধ্বক করে উঠল সুকুমারীর বুকে। কিন্তু লীলা বসে পড়ল প্রতিবাদ না করে।

নকুড় বেরিয়ে পড়ল টুকটুক করে। তিলি গেল উঠোনে। ষোড়শী ছেলে নিয়ে বসে রইল অদূরে। আজ ছুটির দিন। কিন্তু বিজয় বাড়ি নেই। খেয়েছে, খেয়েই আবার বেরিয়ে গেছে। কোথায় নাকি মিটিং আছে।

সুকুমারী পাশ দিয়ে লীলার মুখ দেখতে চেষ্টা করল। চোখ বুজে আছে লীলা। কী চুল! হিমশিম খাচ্ছে সুকুমারী। এতবড় চুলে আজ এক যুগ হাত দেয়নি সে। বিরক্ত লাগে, রাগ হয়। মনে হয়, ধরে ক্যাঁচ করে কেটে দেয়।

কিন্তু বলল, এমন চুল, বড় অযত্ন করিস তুই ঝুমি।

সত্যি! মনে মনে বলে উঠল ষোড়শী। কী সুন্দর চুল ! তার নিজেরও যে বড় বড়।

চুল অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সে কথাটি একবারও মনে থাকে না। ননদের চুল দেখে তার। আপসোস হয়।

লীলা বলল, কে অত করে, বলো?

সুকুমারীর মুখে এল, কেন, এত সাবান কাপড় গহনার বাড়াবাড়ি। চুলগুলি রোজ বাঁধা যায় না। কিন্তু বলল, বেশ তো, ঠুমি বউ আমি রয়েছি, বসলেই তো পারিস। একটা ভাল তেল আনিয়ে নিস।

লীলা নির্বাক। সুকুমারী আবার বলল, কত বেঁধে দিয়েছি তোর চুল। যা মেয়ে ছিলি । থির হয়ে দু দণ্ড বসতিস না। ধরে ধরে এনে বিনুনি বাঁধতুম, সে জন্যেই আজ এত চুল।

তারপরেই হঠাৎ গলাটা ধরে আসতে থাকে তার। ঠোঁট কাঁপে। কান্নায় ঠিক নয়, ভয়ে ও উৎকণ্ঠায়। থেমে থেমে বলতে থাকে, তবু মা তোকে ভাল ঘরে দিতে পেরেছিলাম। পাশ দিয়ে তাকাল সুকুমারী। চোখ খুলেছে লীলা ! ঠোঁট দুটি যেন বেঁকে উঠছে। আর পান খেলে মেয়েটার ঠোঁট যে কী লাল হয়। ভয় ধরে যায়।

হঠাৎ সুকুমারী ফুঁপিয়ে ওঠে। ফুঁপিয়ে উঠে, লীলার পিঠের জামাটা খুলে ফেলে। পিঠের সেই ক্ষত। একদিন নকুড় কাটারি মেরেছিল। সেই ক্ষতে হাত দিয়ে ফুপিয়ে বলে উঠল, আহা, এমন সোনার অঙ্গে ।

বিদ্যুম্পৃষ্টের মতো ফিরল লীলা। আবাঁধা চুল ছড়িয়ে পড়ল বুকে। ধ্বক করে জ্বলে উঠল চোখ। চকিতে ঠাস করে সুকুমারীর গালে এক চড় বসিয়ে দিয়ে হিসিয়ে উঠল, সোহাগ দেখাচ্ছ আজকে?

বলেই ফণা তোলার মতো উঠে দুরদুর করে বাইরে চলে গেল।

সুকুমারী গালে হাত দিয়ে ফিসফিস করে উঠল, মারলি, মারলি আমাকে?

দুই বিন্দু রক্ত দেখা দিল তার চোপসানো ঠোঁটের কশে। কাঁপতে লাগল থরথর করে। ষোড়শীর গলা দিয়ে শুধু একটি চাপা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ বেরোল। ভয়ে আতঙ্কে শক্ত হয়ে বসে রইল। কী করা উচিত ভেবে পাচ্ছে না। কেবল, তার কোলের ছেলেটা কী ভাবল কে জানে। সুকুমারীর দিকে তাকিয়ে, হেড়ে গলায় হেসে উঠল খলখল করে।

বেলা গেছে। পিপুলের তলা দিয়ে, রাস্তায় ওপাশের খোলার চালার উপর দিয়ে এক চিমটি আকাশ দেখা যায়। রক্তাকাশের গায়ে একটা পুচ্ছ বাঁকানো হাঙ্গরের মতো কালো মেঘ। পিপুলের বাসায় ফিরে-আসা বাসিন্দা বিহঙ্গদের জটলা

ভয়ে উঠতে পারছিল না ষোড়শী। কিন্তু জল কলে ভাজা লাগাতে যেতে হবে। সে ভয়ে ভয়ে উঠল। পুরুষের মতো মোটা গলায় বলল সুকুমারী, এ কথা কাউকে বললে গলায় পা দেব বউ।

লীলা সেজেছে এমন বিচিত্র সাজ ! পান খেয়ে, চুল বেঁধে, গহনা পরে, পায়ে স্যান্ডেল দিয়ে কেমন একটা কুৎসিত সাজ তার সর্বাঙ্গে প্রকট হয়ে উঠেছে। শহুরে সাজ সাজতে জানে না সে। সাধারণ সাজে সে কালো রূপসী হয়ে ওঠে।

মেঘনাদের বেরোবার মুখে বলল সে, আমাকে নিয়ে টকিতে চলল।

অবাক হল মেঘু। যেতে বাধা দেয় না। নিজে যায় না। তিলিকে নিয়ে, নয়তো লীলা একলাই যায়। দেখল, লীলার চোখেমুখে উত্তেজনা। সাজগোজ দিয়ে সেটুকু ঢাকা যায়নি। নাকের নাকছাবিটি পর্যন্ত কাঁপছে। হয়তো কোনও দুঃখে, কোনও রাগে, কিন্তু সেটুকু জিজ্ঞেস করতেও বাধে মেঘনাদের। তবু বুকে বড় বাজে। রাজীবের সঙ্গে কথা বলে মন তার উল্লসিত হয়ে ওঠেনি। বিজয় নেই। মন খুলতে চলেছিল সে ইদ্রিসের কাছে। কিন্তু সে এক কথাতেই রাজি হল। বলল, বেশ, চলো। তবে, তিলি আর শালাজকেও নিয়ে চলো।

শালাজ ষোড়শী। লীলা তীব্র চাপা গলায়, ভু বাঁকিয়ে বলল, কেন, আমাকে একলা নিয়ে যাওয়া যায় না?

এক কথাতেই বিরূপ হয়ে উঠছিল মেঘনাদের মন। তবু বলল, টকি দেখার ব্যাপার তাই বলছি। ভাল, একলা যেতে চাও, চলো।

বাড়িটা থমথম করতে লাগল। সোড়শী বাঁচল জলের কলের ভাজায় গিয়ে। কেবল তিলি অবাক হয়ে রইল সমস্ত ব্যাপারটি দেখে।

.

রাত্রে ঘুম ভেঙে গেল তিলির। ফোঁস ফোঁস করে কে কাঁদছে। পাশে হাতিয়ে দেখল, মা নেই। শিয়রের দিকে দেখল, একটি ছায়ার বুকে আর একটি। নকুড়ের বৃদ্ধ বুকে পড়ে সুকুমারী কাঁদছে। শুধু বলছে, তোমারি জন্যে, শুধু তোমারি জন্যে !…

নকুড়ের চোখে জল ছিল কিনা কে জানে। সে ভাঙা-গলা টিকটিকির মতো বলছে, সত্যি, সত্যি, সত্যি ।

তারপর নকুড় বলল, আমার মরণ-ই ভাল।

সুকুমারী বলল, ছি ! ওকথা বলো না। আমি কী নিয়ে থাকব গো।

বুঝি যৌবনে সুকুমারী যে কান্না কাঁদেনি, নকুড় করেনি সোহাগ, আজ এই বয়সে সেই রাত এসেছে তাদের।

তিলি বুকে হাত দিয়ে পড়ে রইল। কিছুই জানে না। কিন্তু বুকটার মধ্যে কেমন করছে।

আর একজন জেগে ছিল। ষোড়শী। সে কিছুই বলতে পারেনি বিজয়কে। শাশুড়ির গলায় পায়ের ভয়ে নয়। বিজয়ের মনে কী হবে সেই ভয়ে। সে আড়ষ্ট হয়ে পড়ে ছিল। তারও বুকে কান্না থমকে রয়েছে কেন যেন।

জেগেছিল আর একজন। মেঘনাদ। পাশে শুয়ে তার লীলা। অন্ধকারেও চোখে ভাসে তার ঘুমন্ত লীলাকে। বিস্ত, অর্ধ উন্মুক্ত শিথিল তনু। ঘুমন্ত চোখের পাতা পুরো বোজে না। কেমন। অসহায় আর শান্ত। জাগলে কী দুর্নিবার ! তার যা দরকার সবটুকু দিয়েও সে যাকে পায়নি। কেন। তা সে জানে না। স্ত্রী অতৃপ্ত, স্বামীর এই লজ্জা নিয়ে নিয়ে সে ঘুরছে সর্বত্র।

আজ কেন লীলা তাকে ডেকে নিয়ে গেছে, সে জানে না। কেন বা এসে পাশ ফিরে শুয়েই একেবারে আঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে, তাও জানে না। আজ এ বাড়িতে শুধু তারই ঘুমোবার পালা। এই এক ক্ষত তার বুকে।

আজ তার সামনে অনেক আশা ও সংশয়। নয়াপাড়ির আশা। কোথায় মেঘ দেখা দেবে, কে জানে। ঝড় উঠলে এ ঢেউ সামলানো দায়। ডুবলে ভরা ডুবি। বিপিনের চিঠির কোনও জবাব। আসেনি। সামনে সপ্তসিন্ধু। সেই সপ্তসিন্ধুতে ডাইস মেশিন, বিরাট হিটারের পাতে থরে থরে সাজানো নানান আকারের পিষ্ট ময়দা। আকাশে উড়ছে বিশাল চিমনির ধোঁয়া। বিরাট ফ্যাক্টরি। ওইটুকু সওদাগরের স্বপ্ন।

.

বিনয় এল পরদিন। নিয়ে এল রাজীব। এ অঞ্চলে বিনয় চৌধুরী নামে তাকে সবাই চেনে। বয়স খুব বেশি নয়। পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ হবে। দোহারা গঠন, গোঁফ কামানো মুখ। দেখলে মনে হয় অতি সাদাসিধে মানুষ। অল্প দামের পাঞ্জাবি আর সাধারণ ধুতি কোঁচা দিয়ে পরা। পায়ে মোটা সোলের স্যান্ডেল। আঙুলে নীলা আর পলার দুটি আংটি।

কথা বলে ক্লান্ত গলায়। শুধু চোখ দুটি অপলক। কোনও কোনও সময় হঠাৎ বিমর্ষ মনে হয়। করুণ হয়ে উঠে চোখ দুটি। মনে হয় যেন জীবনে অনেক দুঃখ আছে। মাঝে মাঝে তা চেপে তো আসবেই। যতটা পারো, তারই মধ্যে হেসে নাও। স্বভাবতই তাকে খানিকটা প্রাণখোলা নিরহঙ্কার বলে মনে হয়।

তার সম্পর্কে এখানকার লোক, জানা অজানার মাঝামাঝি। মফস্বলের এই শহরের এমন এক বাড়ির ছেলে সে, যে বাড়ির পুরুষদের কেউ কখনও চাকরি কিংবা ব্যবসা করতে দেখেনি। এই শহরেই কিছু জমিজমা আর পুবের গাঁয়ে অল্পবিস্তর ধানজমি নেড়েচেড়েই চালিয়ে দিয়েছে নাকি। আর বিবাদ করেছে পরস্পরের মধ্যে। বড় রাস্তার উপরে নিজের মস্ত বড় বাড়ি। যৌবনের প্রারম্ভে সে এ অঞ্চলের রত্নতুল্য ছিল। রাস্তা দিয়ে গেলে আঙুল দিয়ে দেখাত তাকে লোকে। বাংলায় আর ইতিহাসে সে দুবার এম. এ. পাশ করেছে। ভাল ভাবেই পাশ করেছে। পাশ করে সে বাইরে চলে গিয়েছিল প্রফেসারি নিয়ে। ফিরে এসেছিল হঠাৎ যুদ্ধের সময়। বাইরে থেকেই বিয়ে করে ফিরেছিল।

প্রথমে কী কাজ সে করত, কেউ জানত না। হঠাৎ তার নিজের নতুন বাড়ি উঠতে আরম্ভ করেছিল। এমন কী, বাইরে থেকে ফিরে এসেও সে তার ভাইদের বাড়িতে ওঠেনি। ভাড়া বাড়িতে উঠেছিল প্রথম। তারপর হঠাৎ তার বাড়ি উঠতে দেখে, সবাই অবাক হয়েছিল।

বনের মধ্যে নতুন জানোয়ার এলে যেমন অন্যান্য জানোয়ারদের মধ্যে একটা সাড়া পড়ে যায়, এখানেও হল তাই। এ কোন বনের কোন জীবটি এসেছে, আসার উদ্দেশ্য কী, একদলের এই অনুসন্ধান চলল কলকাতা ও মফস্বলের কেন্দ্রীয় বনবিভাগে। সাধারণ মানুষের শুধু বিস্ময় আর সংশয় সম্বল।

রটনা হয়ে গেল, একটা বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক সে। এখন যুদ্ধের জন্য পুরোপুরি সরকারি কাজে লাগছে। প্রচুর টাকার কারবার।

বিনয় নিজে বাইরের লোকের সঙ্গে মিশত। কেবল তার কাজের কথা ছাড়া। যুদ্ধের পরে সে কয়েকটা চটকলের সঙ্গে চুক্তি করে, বেপরোয়া চটের ফেঁসো কিনতে আরম্ভ করেছিল। দেখা গেছে স্থানীয় বহু লোকের খালি জমিতে ওই ফেঁসোর পাহাড়। এমনকী রাস্তার ধারেও। ফলে অনেক লোক আর মিউনিসিপ্যালিটির সঙ্গে তার মামলা হয়েছিল। অনেকগুলি জায়গা সে আটক করেছিল। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল অধিকাংশ জমি তার দখলেই এসেছে। কেবল মিউনিসিপ্যালিটির জমিগুলি ছাড়া। অবশ্য জমিগুলির কিছু মূল্য সে দিয়েছিল। তা ছাড়া অনেকগুলি, পুরনো মর্টগেজ দেওয়া জমি সে কিনেছিল শস্তা দামে।

এই ফেঁসো ঝাড়াই করে যে কুঁচো পাওয়া যায়, সেটাই চালান যায় তার বিদেশে। এই কুঁচো চটের দাম অনেক। এদেশে যাকে বলে বিলাতি পশমের কম্বল, তারই মিক্সচার হিসাবে এগুলি চলে। এ ছাড়া, এ অঞ্চলে তার আর কোনও স্থানীয় ব্যবসা আছে বলে কেউ জানে না। কিন্তু লোকের ধারণা, বাইরে তার আরও ব্যবসা আছে।

পুরনো যন্ত্রপাতি কেনাটা তার অন্যতম কারবার। ফেঁসো ঝাড়াইয়ের কারখানায় একটা চালাঘরে শুধু পুরনো যন্ত্রপাতি ঠাসা। সে জন্য, ছোটখাটো কারখানার লোকের যাতায়াত আছে তার কাছে।

একটি সেকেন্ডহ্যান্ড মোটর গাড়ি আছে তার। গাড়িটা তার ঝরঝরে হয়ে গেছে বটে, বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। সে নাকি এর চেয়ে ভাল এবং দামি গাড়ি কিনতে পারে। কেনে না, কারণ সে নাকি ভয়ঙ্কর কৃপণ, এরকম দুনাম আছে তার। গাড়িটা স্টার্ট দিলে, বাচ্চা কুকুরের ঘেউ ঘেউ করার মতো একটা শব্দ হয় ! সাধারণ লোকে বলে, চৌধুরীর গাড়ি আসছে। যারা তার উপর বিরূপ, বিশেষ যুবকেরা, তারা বলে, বিনচৌ-এর গ্রে হাউন্ড আসছে। বিনচৌ, বিনয় চৌধুরী। তার এই সংক্ষিপ্ত বিচিত্র নামটা বিনয় নিজেও জানে। শুধু যে ঠাট্টা তা-ই নয়। অনেকে, বিশেষ অবাঙালিরা জানে, বিনচৌ-টাই আসল নাম ! বলে বিনচৌবাবু। কিন্তু জেনেও ঝগড়া করার কোনও বাসনা নেই। যে সব ছেলেরা তার এ-নাম বলে,তারা অনেকেই আশেপাশের কলকারখানায় কাজ করে। ইচ্ছে করলে বিনয় তাদের ক্ষতি করতে পারে। কলকারখানার কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে তার রীতিমতো ওঠাবসা আছে, কিন্তু ক্ষতি করেনি। ধৈর্যটা বিনয়ের মস্ত বড় গুণ। তাকে কেউ কোনওদিন ক্ষিপ্ত হতে দেখিনি। দেখেনি ব্যস্ত হয়ে চলতে। চেঁচিয়ে কথা বলতে কিংবা গলা চড়িয়ে কাউকে ডাকতে শোনেনি কেউ। তার শিক্ষার জন্য তাকে ধারালো মনে হয় না। ভারী মনে হয়। ভারী আর অমায়িক ! আর আশ্চর্য শান্ত ব্যথিত চোখ-দুটি বিনয়ের। করুণ আর অসহায়। এটা তার হৃদয়ের প্রতিবিম্ব কিনা, বোঝা মুশকিল। আপাতদৃষ্টিতে তার জীবনেও কাজেকর্মের সঙ্গে ওই চোখের কোনও মিল নেই।

সে ঠিক খোলাখুলি রাজনীতি করে না। কিন্তু এখানকার রাজনীতিতে নাকি তার হাত আছে। পুরোপুরি। এখানকার অনেকগুলি শ্রমিক ইউনিয়নের সে উপদেষ্টা। কয়েকজন প্রতিষ্ঠাবান রাজনৈতিক নেতার রীতিমতো যাতায়াত আছে তার বাড়িতে। সেই সব নেতাদের উপর এখানকার গরিব জনসাধারণ খগহস্ত। হয়তো সেইজন্যই বিনয়ের উপরে অনেকে বিরূপ। বিরূপতার চেয়ে বলা ভাল, একটা অপরিচয়ের সংশয়। সে নিজে এখানকার লোকের সঙ্গে মেশে, মিশতে দেয় না।

তার বাড়ির সংবাদ কেউ জানে না। বিনয়ের স্ত্রীকে দেখা যায় কম। বাইরের লোকে জানে, স্ত্রী তার অসুস্থ। বাড়ি থেকে বড় একটা বেরোয় না। যারা দেখেছে তারাও খুব কম দেখেছে। কোনও সন্ধ্যায় হয়তো, কুকুর বাচ্চার ঘেউ ঘেউ করা গাড়িটাতে করে বেরুতে দেখেছে তাকে কেউ। বলেছে, কে, বিনচৌ-এর বিবি না? আচ্ছা, দেখতে ঠিক কেমন? ফরসা, বেশ ফরসা। মাথায় খুব চুল। আর বেশ বড়সড় মানুষ। কিন্তু যেন পুতুলের মতো। চোখের পাতা পড়ে না, ভু কাঁপায় না, নির্বিকার বিষণ্ণ। অনেক সেজেগুঁজেও বিধবার মতো দুঃখী যেন।

দুটি ছেলে আছে বিনয়ের। তারা এখানে থাকে না। শান্তিনিকেতনে আছে। ছুটিতে তারা আসে। তখন বিনয়ের স্ত্রীকে একটু বেশি দেখা যায়। মা বলে মনে হয় তখন তাকে। মনে হয় না, বিনয় চৌধুরীর সেই অপরিচিতা অন্তরালবর্তিনী বিষাদ মূর্তি বউটি। শুধু মা ; স্নেহময়ী পাগলিনী। তখন সে বৈধব্য বেশে বিষণ্ন সধবা নয়। হাসিখুশি মা

বিনয়ের সঙ্গে যারা মেশে ; দু দিন বাদে দেখা যায়, তারাও কেমন অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিজয়দের মিলের হাসপাতালের কম্পাউন্ডারের সঙ্গে কিছু দিন বিনয়ের মেলামেশা হয়েছিল। কম্পাউন্ডারের চারটি মেয়ে আর স্ত্রী, প্রায়ই যাওয়া আসা করত। হঠাৎ যাওয়া আসা, আবার হঠাৎ বন্ধ। একেবারে বন্ধ। কেন কেউ জানে না কম্পাউন্ডারও কোনওদিন কিছু বলে না।

এখানকার ডাক্তার সীতানাথ প্রায়ই আসেন। তাঁর স্ত্রী শ্রীমতী সুধা হঠাৎ কিছু দিন খুব যাওয়া আসা করেছিলেন। এমনকী, বিনয়ের সঙ্গে একলাও তাকে বেরোতে দেখা গেছে। কিছু দিন পরে আর দেখা যায়নি। মনে হয় না, এ বাড়িতে সুধা কোনওদিন এসেছিলেন।

আগুরিপাড়ার বুড়ি অবলা মেয়ে মুক্তকে নিয়ে হঠাৎ কিছু দিন যাওয়া আসা করেছিল। তারপরে হঠাৎ বন্ধ। একমাত্র এরাই বিনয়ের নামে কিছু খারাপ কথা রটিয়েছিল। কিন্তু সত্য মিথ্যা প্রমাণসাপেক্ষ। প্রমাণ একটিমাত্র আছে। বুড়ির মেয়ে মুক্ত যে ভিটে জমিটুকু বাঁধা রেখেছিল, সেটুকু ছ মাসের মধ্যেই বিনয়ের দখলে এসে পড়েছে।

গঙ্গার ওপার থেকে জনাকয়েক অধ্যাপক প্রায়ই তার বাড়িতে আসেন। অধ্যাপকেরা বিনয়ের সহপাঠী। তা ছাড়া ছোট কারখানার ব্যবসায়ীদের আনাগোনা আছে।

এখানে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছিল সে, জমি কেনা ও দখলের ব্যাপারে। মনে হয়েছিল সে এখানে এসেছে শুধু নানা উপায়ে কতগুলি জমি দখল করতে।

সব মিলিয়ে এমন একটি অস্পষ্টতা, যে বিস্মিত সংশয় সকলের। সংশয়ের শেষ নেই বলে, অবিশ্বাস বিদ্বেষে পৌঁছেছে। ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে শ্রমিক সকলেরই এক ভাব। সকলেরই যেন একটু সন্ত্রস্ত ভাব ।

গতকাল শুনেই বিজয় বলেছিল রাজীবকে, বিনচৌকে জোটাচ্ছেন রাজীবদা? 

রাজীব জানত, বিজয় এ কথা বলবে। এ বিষয়ে রাজীবের রাগ ছিল। কোনওদিন প্রকাশ করেনি। সে জবাব দিয়েছিল হেসে, এ তো আর তোমার মজুর ইউনিয়ন নয়, ব্যবসা। যাকে দিয়ে যেদিকে উপকার হবে, সেটাতে আপত্তি করব কেন?

বিজয় আপত্তি করেনি। অবিশ্বাস আছে তার। কিন্তু সে নীরব হয়েছিল। রাজীব যদি ভাল বোঝে, জোটাক। বোনায়ের যদি উন্নতি হয়, ক্ষতি কী? তবে বিনচৌ-এর বুদ্ধি, সেটুকু দুর্বুদ্ধি, নাহলেই বাঁচোয়া। বিনয় চৌধুরী আজ পর্যন্ত কারও উপকার করেছে, এ কথা শোনা যায় না।

.

বিনয় এল। আসবার পথে, প্রথম গুজব উঠল অমৃতর দোকানে। অমর্তের মুদিখানায়। দু চার জন আড্ডাবাজ ছিল, খদ্দের নয়। অমর্ত নিজে বসেছিল পরনের কাপড়টি আলগা করে।আঙুল বুলিয়ে আরাম করছিল। রাজীবের সঙ্গে বিনয়কে দেখেই, আবডালে লুকনো দুর্বল নেড়ি কুত্তার মতো সচকিত হয়ে উঠল সে। বলল, চৌধুরী না?

বিষ্টু ছিল, বেকার মিস্তিরি। বলল, হ্যাঁ, বিনচৌ।

: বিজার বাড়ি যাচ্ছে?

: হ্যাঁ, বিজয়ের বোনাইয়ের কাছে।

: কার কাছে, সে আর আমি জানি নে? বিজয়ের বাড়িতে এখন সব ঐশিয্যিই আছে।

ঝাঁঝালো তিক্ত গলায় বলল অমর্ত। কপালে কুঁচকে, ঢেউ খেলে গেল রসকলি। তার মনের ঘা দগদগিয়ে উঠল যেন কোমরে

বিষ্টু বাঁকা চোখে উদাস গলায় বলল, তোমার রসের কেড়েটি শালা ফাটাব মাঝখানে থেকে। সমস্ত কোমরটা এবার একেবারে খুলে গেল। রাধা কেষ্টর নাম নেই, সকাল বেলা মারাত্মক কটুক্তি করে বলে উঠল, আমার রসের কেড়ে কোনও শালি নয়। খতেনের হিসেব আমার ওসব রস বোঝে । সত্তর টাকার উপর পাওয়ানা হয়েছে। বিজা মিস্তিরির বোনকে পাই পয়সাটি শুধতে হবে।

বিষ্টু বলল, বোন কেন? মিস্তিরির বোনকে দেখে কি দিয়েছ?

: তবে কি, এতগুলান টাকার মাল বিজা মিস্তিরির মুখ চেয়ে দিয়েছি? অত কাঁচা ছেলে অমর্ত কুণ্ডু নয়।

বিষ্টু বলল, তা তো বটেই। কিন্তু মেয়েমানুষ অতগুলো টাকা দেবে কোত্থেকে।

অমৃত কুদ্ধ চোখে তাকাল রাস্তার বিজয়ের বাড়ির দিকে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, মেয়েমানুষ হয়ে নিতে পারলে, আর দিতে পারবে না? কিছু দিতে হবে বইকী! মেয়েমানুষের মতোই দিতে হবে।

বিষ্টু বলল, তাও তো বটে।

বলে মুখ টিপে হাসল। অমৃত বার বার দেখতে লাগল রাস্তার দিকে, আর বিড়বিড় করতে লাগল। দেশে আছে বউ, গুটি ছয়েক ছেলেমেয়ে। তাদের সে কোনওদিন এখানে আনেনি। তিলিকে দেখে অবধি মনে আশা জেগেছে। আর একটি সংসার যদি এখানে পাতা যায়। যদি নয়, পাতা যাবে না কেন। নকুড় সা’র অনুমতি পেতে কতক্ষণ! একবার বললে হয়, বুড়ো মা হুমড়ি খেয়ে পড়বে। ভাবেভঙ্গিতে মনের কথাটি তিলির কাছে সে ব্যক্ত করেছে অনেকবার। করলে কী হবে। বয়স হয়েছে, হুঁড়ি তো এখন পাড়ার মাথা কিনে বসেছে। ধমকে যায় অমৃতকে। একবার সাত পাক হয়ে যাক, হাতে হাত পড়ক। পাড়া-জমানো ছেনালি দু দিনে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। সম্প্রতি দেশ ভাগাভাগির ব্যাপারে সে একটু অস্থির হয়ে উঠেছে। যশোর থেকেই বউ ছেলেমেয়ে যদি চলে আসে, তা হলেই গণ্ডগোল। শোনা এক কথা, চোখের সামনে অতগুলি ছেলেমেয়ে দেখলে কি আর নকুড় সাই তখন ভিড়বে। সেই জন্য সে একটু ব্যস্ত হয়ে উঠেছে মনে মনে।

তার উপর বিনয় চৌধুরী। একে তো রাজীবকে যেতে দেখলেই কোমরের চেয়ে বুকের ঘা দগদগিয়ে ওঠে বেশি। সরষের তেল মাপতে মাপতে সে মানস-চক্ষে দেখতে পায় রাজীবের বক্ষলগ্ন হয়ে তিলি হেসে লুটোপুটি হচ্ছে। তখন মনের জ্বালায় খদ্দরের মালের ওজনটা শুধু কম পড়ে যায়। আবার বিনয় চৌধুরী। একা রামে রক্ষে নেই, সুগ্রীব দোসর। ছুঁড়ির কি এখন আর অমর্ত মুদির কথা মনে থাকবে ! না, মনে থাকবে দোকানের দেনার কথা ! তার থেকে রাজীব আর বিনয়ের ভার অনেক বেশি। কিন্তু যত ভারই হোক পাল্লার ভার কমাতে অমৃতর হাতও অপটু নয়।

সারা বাড়িটিময় সাড়া পড়ে গেল যেন। বিনচৌ এসেছে ! এই বস্তিতে তিন ঘরের বাস বটে। তবু বস্তি-ই। এ বাড়ির মেয়েরা বিনয়কে বিনচৌ বলে। পুরুষদের কাছ থেকে যে রকম শোনে, সে রকমই বলে। ছোট ছেলেটি বলে, জানিস। বিনচৌয়ের বাড়ির সামনে দুটো কুকুর লড়ছিল খুব। বক্তব্য কুকুরের লড়াই। স্থানের উল্লেখ এই ভাবেই হয়। বিনচৌয়ের ফেঁসোর কারখানা রাস্তায়, বিনচৌয়ের বালিপুকুরে, বিনয়ের নামটি এমনিভাবেই বলে তারা।

কালকের থমথমে ভাবটি আজও কাটেনি। নকুড় নীরব। কাল সারা রাত তার বুকে পড়ে সুকুমারী কেঁদেছে। তার এই ভাঙা নড়বড়ে বুকে। যে আশাটুকু মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল বুকে, একটি আঘাতে সে মাথা ডুবে গেছে, ভেঙে পড়ছে সমস্ত আশা। 

সুকুমারীর রেখাঙ্কিত চোখের কোণ দুটি ফুলে উঠেছে। এ সংসার তার সংসার। তবু সে শোকে ও অপমানে বেড়াচ্ছে মুখ ঢেকে। আজ সে রান্নার খোঁজ করেনি। উনুনের কাছে যায়নি। এমনকী, ষোড়শীকে পর্যন্ত দেয়নি মুখঝামটা। ষোড়শীকে সে শাসিয়ে রেখেছে বটে। কিন্তু শাশুড়ির দাবড়ানি দেওয়ার তীব্র মুখটি তার লীলা ভেঙে দিয়েছে সোড়শীর সামনেই। সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। জলকলে ভাজা লাগাতে যাচ্ছে। পিপুলতলায় গিয়ে বসছে নয়তো অন্য বাড়িতে, আর কারও ঘরে দূরে দূরে সরে যাচ্ছে। পাশাপাশি ঘর। কান পাতলে কথা শোনা যায়। ভাড়াটে মেয়ে বউরাও লক্ষ করেছে সুকুমারীর ভাবান্তর। তারা বিস্মিত, কৌতূহলী। জিজ্ঞেস করেছে তিলিকে, তোমার মায়ের কী হয়েছে। ষোড়শীকে বলেছে, শাউড়ির কী হল গো?

কেউ কিছু বলতে পারে না। এক জন জানে না। আর এক জনের করুদ্ধ ভয়ে। ছটফট করছে তিলি। কী হয়েছে? লীলা ঘর ছেড়ে বেরুচ্ছে না। বেরুলেও, কথা নেই মুখে। হাসি তো। দূরের কথা। তিলির দিকেও তাকাচ্ছে না চোখ তুলে। খালি কাল রাতের কথা মনে পড়ে যায়। মায়ের সেই কান্না, বাবার গোঙানি। জিজ্ঞেস করে, তুই জানিস বউদি? জানিসনে? কী যে হল। সে নিজেই রান্নার দিকে এসে পড়েছে।

ষোড়শীর ভয়চকিত চোখ। এদিক ওদিক দেখে, ঘর ঝাঁট দেয়। এদিক ওদিক দেখে, বাটনা বাটে। গলার কাছে পাক দিয়ে উঠেছে কীসের আবর্ত। ঠেলে ফুলে উঠে আসতে চাইছে। তিলির সামনে যেতে চায় না। যদি বলে ফেলে। বেরিয়ে যায় যদি। সারাটি রাত কেটেছে এমনি করে। যদি বলে ফেলে বিজয়কে। দিনের বেলাও তাই। তার শুধু ভয়। কী যে ভয়! সবচেয়ে বেশি ভয় যেন লীলাকে। কালসাপিনীর মতো ননদের সেই দপদপে চোখ, সেই চাপা গর্জন। সে যেন নিজেরই গাল বাঁচিয়ে বেড়াচ্ছে, কখন বুঝি তার উপরেই ঝাঁপিয়ে পড়বে লীলা। কাজ করে, ছেলে সামলায় আর কান পাতে। কলের বাঁশি বাজবে কখন। কখন আসবে সেই লোকটি, তার সর্বভয়হর। কখন শোনা যাবে মুক্ত কণ্ঠের সেই হাঁকডাক। যখন চারপাশের এই ভিড় করা অদৃশ্য ভয়গুলি মুখ ঢেকে পালাবে। হাওয়া খেলবে ঘরে। সেই মানুষটি আসবে কখন, তার ভয়ভঞ্জন। বিপদভঞ্জন। বিজয় নয়, শ্রীমধুসুদন!

লীলা কুঁসছে নিঃশব্দে। পিঠের সেই ক্ষতচিহ্ন দগদগে হয়ে উঠেছে হঠাৎ। জ্বালা করছে। অনেকদিন কোনও জ্বালা ছিল না। টের পাওয়া যেত না। আদরের ছলে, সেটুকু খুচিয়ে দিয়েছে সুকুমারী। সে তো বেশ ছিল, ভাল ছিল। এত কথা থাকতে ওইখানটিতেই সোহাগ উথলে উঠল তার মায়ের। যেখানে তার জীবনের আগুন ছাইচাপা হয়ে পড়েছিল। তার নিষ্পাপ জীবনের কলঙ্ক, অপমান, ব্যথা যেখান থেকে তাকে আজও বার বার ঠেলে ঠেলে দিচ্ছে পাপের মধ্যে। তাকে উসকে দিল মা। উসকে দিল সেই স্মৃতিকে, যে স্মৃতি ক্ষয় করছিল শুধু তলে তলে। ধন, মন, জন নিয়ে সোহাগ ভাল লাগে। জীবনের সবার বড় ঘৃণা নিয়ে সোহাগ সহ্য হয় কার ।

চুল তার এলানো। জামা নেই গায়ে, কাপড় জড়ানো। দপদপে চোখে আড়ে আড়ে দেখছে মেঘনাদকে। মেঘনাদ চিন্তিত। খাতা কলম নিয়ে হিসাবে ব্যস্ত। নতুন কাজের শুরুতে হিসাব করতে বসেছে সে। লোকজন, কী কী মাল তৈরি হবে, প্রথম কত ময়দা দিয়ে শুরু করা যাবে, এই সব। কেন না, রাজীব যাকে নিয়ে আসবে, তার সঙ্গে আলোচনা করতে হবে তো!

তার ফাঁকে অনেকবার দেখেছে লীলাকে। কাল রাত থেকেই দেখেছে। আজ সকালে কয়েকবার ডেকেছে। কিন্তু সাড়া পায়নি।

তার কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। বড় আশা ছিল প্রাণে, এখানে মা ভাই বোনের কাছে এসে লীলা নতুন হয়ে দেখা দেবে।

কিন্তু কী হয়েছে কে জানে? সে এখানে এসেও মানিয়ে নিতে পারল না।

সে তিলিকে জিজ্ঞেস করেছে, তিলি, তোমার দিদি কি ঝগড়া করেছে কারও সঙ্গে?

তিলি বলেছে, কী জানি, আমি তো কিছুই জানিনে। তোমার সঙ্গে হয়নি তো?

অসহায় বিস্ময়ে বলেছে মেঘনাদ, না, আমি তো কিছু বলিনি।

দুঃখেও হাসি পেয়েছে তিলির। কী বিপদ! বউ কেন রাগ করেছে, তাও জানে না লোকটি। বলেছে, তালে বোধহয় মার সঙ্গে কিছু হয়েছে। একটু তোয়াজ-টোয়াজ করে দেখো না।

তোয়াজ! অদ্ভুত তিক্ত ব্যথিত হাসি ফুটেছে মেঘনাদের ঠোঁটে। বলেছে, ঠুমি, রাগ হলে। সামলানো যায়। তোমার দিদির যে সব কিছুতে বড় ঘেন্না।

সাদাসিধে লোকটি এরকমভাবে কথা বললে অদ্ভুত মনে হয়। সে বলে উঠেছে, না না । হ্যাঁ গো হ্যাঁ বলে মেঘনাদ অদ্ভুতভাবে হেসে উঠেছে, আমি জানি, শুধু বুঝিনে। খালি জানি, আমার কাজকে তার বড় ঘেন্না। কিন্তু এই কাজের জন্য, কী যে করেছি, তা তোমার দিদি জানে না। আরও যে কী আছে কপালে, তা জানিনে। কিন্তু তোমার দিদিকে তো আমি কিছু না দিয়ে রাখিনি।

কিছু বলবে না ভেবেছিল তিলি। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। তবু না বলে পারেনি, হয়তো কিছু একটা দেওনি বলে ফেলেও লজ্জায় কুঁকড়ে উঠেছে তিলি। ভীত হয়েছে। এরকমভাবে মেঘনাদের সঙ্গে কথা বলতে সাহস হয় না তার।

মেঘনাদ বলেছে, তোমার দিদি মিছে বলে না। এই একটা কাজেই হাত পাকালাম চিরদিন। তাও আবার ঠেকে গেছি। ঝুমির সেই একটা কিছু যে কী, তা কোনওদিন আর জানতে পারলাম না বলে সে ঘরে চলে গেছে। নির্বাক বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে তিলি। সংশয় ছিল তার বোনাইয়ের সম্পর্কে একটু অবুঝ ভালমানুষ বলে। কিন্তু, এ তো সবটুকু অবুঝের কথা নয়।

এমন সময় এল রাজীব। একেবারে তিলির কাছে এসে বলল, তুমি, একটা চেয়ারটেয়ার কিছু আছে?

তিলি চমকে ফিরে তাকাল। দেখল, পিপুলতলায় বিনচৌ। বলল, এ কী বিনচৌকে নিয়ে এসেছেন?

রাজীব বলল, হ্যাঁ। ভয়ের কিছু নেই।

বাড়ির সবাই কানাকানি করতে লাগল, বিনচৌ এসেছে বিজয় মিস্তিরির ঘরে।

তিলি গেল মহেন্দ্রর বউয়ের কাছে। ওদের একটা চেয়ার আছে। কতকালের চেয়ার কেউ জানে না। কেউ বসেও না। বারোমাস এইটার উপর মালপত্র থাকে। তাড়াতাড়ি পরিষ্কার করে ঘরে এনে পেতে দিল তিলি ।

নকুড় হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে উঠেছে। বিনয়কে আপ্যায়ন করতে গিয়েও কথা ফুটল না তার মুখে। তার বুড়ো বুক টনটন করছে। এই সমস্ত লোক আসছে আজকে ওর বাড়িতে। তবু তার কোনও আশা নেই।

জামধরা বুকটাকে ঠেলে তবু খ্যাঁকারি দিয়ে উঠল নকুড়। সবই দেখছে সে। কিন্তু একদিনও তো মেঘুর সঙ্গে কথা বলেনি। সবার চেয়ে বড় আশা যে, সে তত দূরে সরিয়ে দেয়নি তাকে এখনও ! শোনা যাক কী কথা হয়। যদি কাজ আরম্ভ হয়, তার মাঝে কি নকুড়ের একটু ঠাঁই হবে না। বিনয়কে বলে উঠল সে, কী ভাগ্য আমার ! বসেন বসেন। বিনয় হেসে উঠল। বলল, থাক না, বুড়ো মানুষ, আবার উঠে দাঁড়াবার কী আছে? বসলেই তো হয়।

রাজীব বলল, বিজয়ের বাবা।

নকুড় আপ্যায়িত হয়ে স্বীকার করল, আজ্ঞে ।

বিনয় বলল, ও!

মেঘনাদ এসে দাঁড়াল। এক মুহূর্ত অপলক চোখে তাকিয়ে রইল বিনয়। একটু যেন অবাক হয়েছে। বোধ হয়, মেঘনাদের চেহারাটা অকল্পিত মূর্তি ধরে দেখা দিয়েছে তার চোখে।

সত্যি, মেঘনাদের চেহারাটা সম্প্রতি একটু নতুন হয়েছে। তার মস্ত বড় স্থূল মুখটি এখানে এসে সামান্য রোগা হয়েছে। সেইজন্য মুখটি তীব্র হয়েছে আগের তুলনায়। তার পোড়া গৌরবর্ণ তামাটে ছিল। তামাটে রঙের মধ্যে এখন একটু কাঁচা সোনার চাপা আভাস। চুল তার ঈষৎ পিঙ্গল। তখন ছোট ছিল। এখন বড় হয়ে তার মস্ত মুখটির সঙ্গে মানানসই দেখাচ্ছে।

মেঘনাদের চেহারা দেখে এক মুহূর্ত থমকে গেল বিনয়।

তারপর হাত তুলে নমস্কার করল। বলল, আসুন।

মেঘনাদ অনেকখানি নত হয়ে কপালে হাত ঠেকাল। ঠিক সিরাজদিঘার পাকা ব্যাপারির মতো। বিনয়ের অবতার। শুধু কপালে নেই হরিনামের ছাপ, গলায় নেই তুলসীমালা। কিন্তু মেঘনাদের নেই বৈষ্ণববাচিত বিনয় । মাথা নুয়েছে তার বিনয়ের বিদ্যার কাছে। সে শুনেছে, বিনয় বল এম. এ. পাশ। সেটা যে কত বড় পাশ, সবটুকু সে জানে না। বাজারদরটা জানে। বল এম.এর নগদমূল্য, রাস্তায় বেরুলেই অনেক ভক্তি শ্রদ্ধা সম্মান আর বিস্ময় ঝাঁপ দিয়ে পড়ে তার সর্বাঙ্গে। এখানে অর্থমূল্য গৌণ। বিধিমতে বিদ্যাকে ভক্তি করাই মেঘনাদের ধর্ম। অজানাকে ভয় ভক্তি, সে যে মানুষের চিরকালের ধর্ম। ওইটুকু দিয়ে সে ধন্য। তা ছাড়া, অনেক সংশয় পার হয়ে এসেছে। মেঘনাদ। বিনয়ের মতো শিক্ষিত মানুষ এগিয়ে এসেছে তাকে বুদ্ধি দিয়ে সাহায্য করতে। ধানমণ্ডাইয়ের সাহেবের কথাই মনে পড়ছে তার ভিন্নবেশে, সেই সাহেবের মতোই যেন আজ তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বিনয়। ধানমণ্ডাইয়ের সাহেবের প্রতিও তার কিছু সংশয় ছিল মনে। আবার কেটে গিয়েছিল। আজও সংশয় কিছু আছে বইকী! কেটে যাবে তাও। সে তো সংশয়বাদী নয়। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। জীবনের অভিজ্ঞতাটুকু যাবে কোথায়? মেঘ কেটে যাবে সেটুকুনি তো ভরসা।

বিনয় বলল, বসেন।

অনাড়ম্বর বেশ, বয়সের পাল্লা ও শিক্ষা সব মিলিয়ে রাজীবের তুলনায় বিনয় তাকে আশ্বস্ত করেছে বেশি, বিনয় বড় অমায়িক, অত্যন্ত ভদ্রলোক। বলল, আপনি গৃহকতা, বসা উচিত তা-ই আমারই। কিন্তু, আলোচনার আসল কতা তো আপনি। আপনিই বসুন।

মেঘনাদ আন্দাজে বুঝে নিল, বিনয় পরিহাস রসিক। নইলে, তাকে কখনও বসতে বলে। তা ছাড়া, চেয়ারে কবার বসেছে সে এ জীবন। লক্ষ্মণ সা’র গদিতে একটা চেয়ার ছিল। কেউ না থাকলে মাঝে মাঝে সেটায় বসে পা দোলাত । সেটা ছিল চেয়ারে বসে খেলা। টকি দেখতে গিয়ে, কিংবা এখানে সেখানে এক আধবার জড়োসডো হয়ে বসেছে, শেষের দিকে বসেছে গদিতে। তাও চৌকির উপর বিছানো মাদুর। চেয়ার নয়। সে হেসে উঠল ; হাসলে তার চোখ দুটি ছোট হয়ে যায়। বলল, এখন আপনি কতা। আপনি বলবেন, আমি শুনব। আপনি এতবড় মানুষ, আপনার সামনে কখনও আমি বসতে পারি?

বিনয় হেসে উঠল। ক্লান্ত মানুষের হাসি। চোখের চাউনি তেমনি করুণ বিষাদমাখা। যেন এই হাসি, এই মানুষটি সব নয়। আড়ালে আছে আর একজন। সেই বিষাদভরা চোখ দিয়ে মেঘনাদকে দেখছে বিনয়। কোনও অনুসন্ধিৎসা নেই, তীব্রতাও নেই। তারপর তার সারা মুখটিও ভরে উঠল যেন বিষাদে। কিন্তু বিষাদ নয়, বিনয়ের গম্ভীর মুখোনিই এ রকম দেখায়। চেয়ারে বসল না সে। একখানি পা তুলে দিয়ে, মুখটি আরও ভার করে বলল, আচ্ছা, আপনি কী ভাবে আরম্ভ করবেন মনে করছেন?

মেঘনাদ তার লেখা কাগজটি আনেনি। লজ্জা করছিল আনতে। লেখবার মতো ব্যাপার কিছু নয়। মনের মধ্যেই আছে সব কিছু। তবু লিখেছিল, বিষয়টি অনুভব করার জন্য, একলা একলা ভাববার জন্য। সে ছোট করে আরম্ভ করতে চায়। ছোট থেকে শুরু করে ছড়িয়ে পড়তে চায় ধীরে ধীরে। যেমন করে সে একদিন আরম্ভ করেছিল সিরাজদিঘায়। কেয়োর মতো ক্ষুদ্র ও ধীরগতিতে, সন্তর্পণে, আশপাশ দেখে, প্রায় পা টিপে টিপে চলতে হবে। চোরাবালিতে না আটকায়। এদিক ওদিক হলে ভরাডুবি হতে কতক্ষণ। যদি হয়, তবে অল্পের উপর দিয়ে যাবে, ঘা লাগবে, প্রাণে মরবে না। অবশ্য সিরাজদিঘায় সে তার সর্বস্ব দিয়েছিল। কিন্তু সেখানে ছিল লালমিঞা।

সে বলল, ভাবছি, ছোটখাটো করেই আরম্ভ করব। নতুন জায়গা, জানিনে শুনিনে কিছু।

বলতে বলতে সঙ্কোচটা কেটে গেল মেঘনাদের। বলল, বাজার আমি অবশ্য দেখেছি। মাল কাটবে কিছু এখানে।

বিনয় অপলক চোখে তাকিয়েছিল মেঘনাদের দিকে। কথাগুলি শুনেছে কিন্তু ভাবান্তর হয়নি তার কিছুই। বলল, কারখানার কী করবেন ঠিক করেছেন?

মেঘনাদ বলল, একটা ঘর ভাড়া নিয়ে

মনে হল বিনয় একটু হাসল, ঘর ভাড়া পাওয়া যাবে কিন্তু কারখানা করতে দেবে কেন আপনাকে?

কারখানা আর কী, একটা তো তন্দুর হবে।

যাই হোক, আগুন তো জ্বালাতে হবে। ঘর নষ্ট হবে। মালিক তার ঘর আপনাকে নষ্ট করতে দেবে কেন? তা ছাড়া ছাদ ফুটো করে চিমনি করতে হবে।

মেঘনাদ হঠাৎ জবাব দিতে পারল না। বিনয় হাসল, বুদ্ধিদীপ্ত অলস হাসি। চেয়ার থেকে পাটা নামিয়ে সে চিন্তান্বিত মুখটা ফেরাল ভেতরের দরজার দিকে। তিলি দাঁড়িয়েছিল। সরে গেল চকিতে।

মেঘনাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বিনয় বলল, আপনি ছোট ছোট করছেন কেন? বড় করতে আপনার আপত্তি কী?

মেঘনাদ কিন্তু আগের কথার জের টানল। বলল, আমি ছাতওয়ালা ঘরের কথা বলছি না। কারখানা তো টিনের চালাঘরেই হবে। টিন সরিয়েও চিমনি করা যাবে।

একমুহূর্ত চুপ হয়ে গেল বিনয়। ঠিক। কারখানার সঙ্গে পাকা ঘরের তো কোনও প্রশ্ন নেই। তার চোখের তারা দুটি চিন্তিতভাবে এদিক ওদিক করল কয়েকবার। যেন ভেবে নিল বিষয়টি। তারপরে হঠাৎ বলল হেসে উঠে, বেশ, তো, টিনের চালাঘরেই করবেন, কিন্তু কাজটা তো আগুনের। ঘরের মালিক মানবে কেন? আপনার দেশে যেটা ছিল, সেটা কী রকম ছিল? ভাড়া নিয়েছিলেন, না নিজেরই ছিল?

মেঘনাদ হাসতে গেল, পারল না। হঠাৎ কোনও কথাও জোগাল না তার মুখে। প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গেই চোখের সামনে ভেসে উঠেছে সেই ঘর। করোগেটে টিনের বেড়া, টিনের চাল। সে কি ভাড়া, না তার নিজের? সে ভাড়াও নয়, নিজেরও নয়। সে দান। লালমিঞা দান করেছিল তাকে। বলল, ওটা কিছু নয়। আমাকে একজন দান করেছিল ওটা।

বিনয় বলল, সে যা-ই হোক, ছিল আপনার নিজেরই। ব্যবসায়ী মানুষ আপনি, নিজেই বুঝতে পারেন, যা হয় তা নিজের হওয়াই ভাল। পরের ঘরে লক্ষ্মী পাতা, আমি ও সব ভাল বুঝিনে মশাই। কী বলেন?

ঢুলুঢুলু করুণ চোখ দুটি তুলে ধরল বিনয়।

কী বলবে মেঘনাদ। খাঁটি কথা, সত্য কথা। পরের ঠাঁইয়ে লক্ষ্মী পাততে চায় কে? প্রাণের কথা বলেছে বিজয়। কিন্তু মনটা ততখানি চনমন করে ওঠে না। সাধ্য থাকা চাই। মেঘনাদ পূর্ববাংলার মানুষ। এখানে এসে, জমির দাম সে শুনেছে। শুনে ভয় হয়েছে তার। সিরাজদিঘায় যে জমি হাজার টাকায় পাওয়া যায়, এখানে তার দাম দশহাজার। সাহা ঘরের সন্তান হলেও, টিপে চলার মতো খাটো প্রাণ নয় তার। কিন্তু যেটুকু আছে, যা আছে, আবেগের স্রোতে তাকে নয় ছয় করে দিতে পারবে না। কথায় বলে, উনো ভাতে দুনো বল। সে উনো দেবে, দুনো নেবে। দিতে গিয়ে, দুনো দিলে যে সব ফকিকার। বলল, আজ্ঞে, বলেছেন ঠিকই। আর এই নতুন দেশের। জমিজায়গার বড় দাম। ভাবছি প্রথমে শুরু করি হোক করে। সময় এলে আমাকে রুখবে কে। 

বিনয় হাসল অভিজ্ঞ উজ্জ্বল শান্ত হাসি। রাজীবের দিকে একবার তাকাল! রাজীব তাকিয়েছিল ভিতরের দরজার দিকে। বিনয়ও একবার দেখল সেদিকে। কেউ দাঁড়িয়ে নেই সেখানে। বোঝ যায় চলাফেরা করছে অনেকে। পর মুহূর্তেই বিনয়ের হাসি হয়ে উঠল গম্ভীর বিষণ্ণ। বলল, দেখুন মশাই, সময় কখনও আসে না। আপনি করতে পারেন সে রকম করে। তবে সময় কোনওদিন বসে থাকে না। যে আজ আছে সে কাল নেই। আপনাকে আমি ব্যবসার নামে, টাকা নিয়ে জুয়া খেলতে বলছি না। তবে সাহস করে, প্রাণ ধরে এগুতে হবে। আপনাকে আর আমি কী শেখাব? লোকে জুয়া খেলে কোন ভগবানের নাম নিয়ে, তা জানিনে। কিন্তু সিদ্ধিদাতা গণেশের ইজ্জতকে খাটো করব কেন? যাকে প্রাণমনে চেয়েছি, তাকে সব দিতে ভয় কীসের? যিনি আজ হাত বাড়িয়ে আছেন, কাল তিনি হাত গুটিয়ে নিলে যে আমারো সব গুটিয়ে গেল।

মেঘনাদ তাকিয়েছিল দরজার বাইরে দুর্বা ছাওয়া আঙ্গিনায়। পিপুলের ছায়ায় শালিকেরা খেলা করছে। কিন্তু চোখে তার এক ফেলে-আসা দিনের স্বপ্নের ঝিকিমিকি। যৌবনের প্রথম পাড়ির সেই দিনটি। কে হাত বাড়িয়ে নেবে মেঘনাদের নৈবেদ্য, কে নেবে না হাত গুটিয়ে অসময়ে সে কথা ভাবছে না সে। তবু, এ ব্যবসা তো তার কাছে শুধু ছাপানো নোট ও মালের লেনদেন নয়। কোথায় যেন আছে এর একটি জীবন্ত সত্তা ; তাকে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না। সে দেবতা নয়, বন্ধু। মেঘনাদের মনে হয়, মেঘু যেন মনে মনে কত দিন কথা বলেছে তার সঙ্গে। সে যেন কে, কে একজন আছে। সে গণেশ নয়। পিতৃ-পুরুষের আরাধ্য দেবতা শ্রীহরি নয়। এ সে-ই, যে তার সঙ্গে সঙ্গে ফিরেছে আশৈশব। তার দুর্দিনে সুদিনে। রাত্রের অন্ধকারে, খালে বিলে বিজনে বনে। গদির আসনে, কর্মময় তৃপ্তিদায়ক সান্নিধ্যে। এমনকী, তার ঘরোয়া জীবনের যন্ত্রণায়, হৃদয়ের বেদনায়।

মেঘনাদের হৃদয় যেখানে সায় দেয়, বুদ্ধি সেখানে বড় রকমের ঠাঁই পায় না। বিনয়ের কথার মধ্যে এক গৃঢ় সত্যের সন্ধান পেল সে। তার কিশোর কাঁচা রক্তের বিনিময়ে যা সঞ্চয় করেছিল, একদিন সব সে ধরে দিয়েছিল লালমিঞার হাতে। কোন প্রাণে সে দিয়েছিল? দিয়েছিল কোন সাহসে? আজ কেন ভয়? সঙ্কোচ কীসের? যাকে দিতে হবে, তাকে রয়ে সয়ে দিয়ে লাভ কী। এ তো জুয়া নয়।

তবু এত দিনের ব্যবসায়ী মন তার সহজে চিড় খেতে চায় না। বিনয়ের প্রস্তাব তাকে ভেবে দেখতে হবে আর একটু।

কিন্তু চুপ করে নেই বিনয়। তার বিষণ্ণ চোখের ভিতরে খেলছে একটা চাপা ঝিলিক। বলল, দেখুন মেঘনাদবাবু। সামান্য যা করেছি, অনেক দিয়ে পেয়েছি। যা হোক আপনাকে অর্ধেক দামে আমি নিজে জমি দেব। যত ভাল, আর যত দামেরই হোক। যে দামে আপনাকে সবাই দেবে, আমি দেব তার অর্ধেক। আর দেখুন, সব কিছু কেবলি পুতুপুতু করে ধরে রাখার কোনও মানে হয় না। বিলাতি কোম্পানিগুলো কোথায় উঠেছে আজ? আর আপনারা চিরকাল কাঠ জ্বালিয়ে ময়দার ড্যালা সেঁকে দেবেন, এ চলতে পারে না। কম্পিটিশনে আপনাকে নামতেই হবে। বেকারি-ই করুন আর আলু পটল-ই বেচুন। যুগটা-ই তাই। চিরকাল মশাই আপনিই কি এরকম থাকবেন না, থাকা চলে? ব্যবসা করতে হলে, আপনাকেও আস্তে আস্তে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করতেই হবে। সেই ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে আপনি কাজ আরম্ভ করুন। এই হচ্ছে আমার কথা।

মেঘনাদ বলে উঠল, ঠিক কথা বলেছেন।

নকুড় কম্পিত ঘাড় তুলে, অবাক ব্যাকুল চোখে তাকাল মেঘনাদের দিকে। মেঘনাদের মস্তবড় মুখটি উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছে। খুশি মাখানো হাসিতে হঠাৎ অনেকখানি অন্তরঙ্গ হয়ে উঠল বিনয়ের। চোখে তার দূর দিগন্তের স্বপ্নের ছায়া। বলল, আমিও তাই চাই, জানেন। এ আমার অনেক দিনের আশা। আমি নিজের চোখে দেখেছি সে সব যন্ত্রপাতি। সত্যি, কী না হয় যন্ত্রে। মানুষগুলো আগুনে খেটে খেটে পুড়ে মরে। মাল তৈরি হতে দেরি লাগে। আর মেশিনে কত সুন্দর, কত তাড়াতাড়ি ভাল মাল করা যায়। আপনি অনেক কথা বললেন, তাই বলছি, একটু যদি কোনওক্রমে গুছিয়ে নিতে পারি, তবে একবার চেষ্টা করব-ই।

নকুড় নিজেরই অজান্তে বার বার মনে আওড়াচ্ছিল, মেশিন ! মেশিন কিনতে চায় মেঘু। তবে? তবে, যা ভেবেছিল নকুড় তাই ! জামাই তার অনেক ভারী হয়েই এসেছে তা হলে। কিন্তু সে যে একবারও মুখ খুলতে পারছে না। একবারও যোগ দিতে পারছে না তাদের কথায়। যেন নিজেকে কোনওরকমে গুঁজে দিতে চাইছে সে তাদের মধ্যে, তাদের বিচ্ছিন্ন ব্যুহের মধ্যে। তার বৃদ্ধ বুকটা ছেলেমানুষের মতো কেঁদে উঠতে চাইছে।

রাজীব এবার একটু পাশ নিয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায় তিলিকে। যেখানে তিলি আঁচল লুটিয়ে, চুল এলিয়ে খুন্তি নাড়ছে, বাটনা বাটছে। ভাঙা পাখাঁটি নিয়ে খচখচ করে হাওয়া দিচ্ছে উনুনে। যেখানে ষোড়শী উদাস অঙ্গে স্তন পান করাচ্ছে ছেলেটিকে।

বিস্মিত চোখে আলোছায়ার খেলা। ঠোঁটের পাশে, কপালে কয়েকটি ছোটখাটো চিন্তার রেখা। ছোট অথচ গম্ভীর। কিন্তু উপর থেকে তা বোঝা যায় না। বলল, চেষ্টা কেন? ওই ভেবেই আপনি করুন। আপনার পারমিটের ব্যবস্থা আমি করে দেব, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। সত্যি যদি কেউ কিছু করে আমি তার পক্ষে আছি। আপনি প্রথম থেকেই ছোট ছোট করছেন। স্বাভাবিক, খুবই। স্বাভাবিক। না এগুলে কি আগের কিছু দেখা যায়? এ আর আপনাকে আমি কী বলব।

মেঘনাদ বিনীত হয়ে উঠল, বিনীত হলে তাকে বোকা মনে হয়। বলল, বলবেন বইকী, নিশ্চয়ই বলবেন। তারপর হঠাৎ তার গলাটা মোটা আর গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, জানেন, জীবনকে ভয় কখনও করিনি। খাটব খাব, সেটুকু তো কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। ছোটকাল থেকে আছি এর পেছনে, জীবনে অনেক করেছি, এই ভেবে দুঃখ করে আমার কী হবে? আরও কত কী করতে হবে। সেইটুকু ভাবনা।

বিনয় যেন মিশে গেছে মেঘনাদের সঙ্গে। সে যে বিনয় চৌধুরী বুঝি সেটাও মুছে ফেলতে চাইছে সে। বলল, বাঙালি ব্যবসায়ীদের আমি ওই জন্য দু চক্ষে দেখতে পারিনি। দুপয়সা পেলে তো, সে আর ঘরের দরজা ছেড়ে নড়ছে না। সেই জন্যই মুদিখানা করা ছাড়া তার কপালে আর কিছু ঘটে উঠে না। আর বাঙালি সওদাগরেরা আগে বাণিজ্য করত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে। এখন। মুদিখানা নয় তো শুধু সওদাগরি দপ্তরের কেরানিগিরি।

সওদাগর ! মদন সা’র বেটা শিশু মেঘু জেগে উঠল মেঘনাদের মধ্যে। দূর দূর সমুদ্র ! শতেক মাল্লার বৈঠা পড়ে। বাতাসে পাল পড়ে ছিঁড়ে। নৌকা ডুবুডুবু। দেবীর কোপ হয়েছে। এদিকে দ্বিতীয় পক্ষের বউ ঘরে, প্রথম সতীনের ছেলেমেয়েগুলিকে দূর দূর করে। নিজের বেটা বেটি নিয়ে পিঠা পায়েসে চাকুম-চুকুম, সোনা গহনার ঝকরমকর, চুবচুবে তেলে নাকন-চিকন…নাটাই চণ্ডীর ব্রত কথা মনে পড়ছে তার।

হাসির কথা। তবু ব্যথা লাগে। বিচিত্র ব্যথা ও হাসিতে মেঘনাদের তামাটে মুখটায় আগুন লেগে গেল। সিংহের কেশরের মতো চুলগুলি তার সেই আগুনের শিখা যেন। গোঁফ জোড়া খাড়া হয়ে উঠল পশুরাজের মতোই।

স্বপ্ন দেখল সে চোখ চেয়ে দাঁড়িয়ে, মস্তবড় কারখানা ঘরে তার মেশিন চলছে ঝম ঝম করে। লোক খাটছে, শত শত। মিঠে বিস্কুটের গন্ধে ভরে গেছে আকাশ বাতাস।

বিনয়কে অবাক করে দিয়ে, চাপা গলায় ফিসফিস করে বলল সে, আজকাল তো আর তেমন সওদাগরি চলে না। কিন্তু ব্যবসায় আমি ভয় করব না। চুপ করে পড়ে থাকব না। ঝাঁপ দেবই, জানেন। দেশে থাকতেই ভারী সাধ ছিল, বড় কারখানা করব। সময় পেলাম না। তারপর এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে পরিষ্কার গলায় বলল, বেশ আপনার কাছ থেকেই জমি নেব আমি, ঘর তুলব নিজেই। আমি আমার বুক দিয়ে আগলাব। তবু মন গুমরে আর পড়ে থাকব না।

গায়ের থেকে তার ধুতির জড়ানো অংশ খুলে গেছে। তার শক্ত চওড়া পেশীল বুকটা দেখাচ্ছে লাল টকটকে। সত্য বুঝি এই বুক দিয়ে বিশ্ব আগলানো যায়। পিছনে পড়ে সব ভয় সংশয়। শত আঘাতেও ভাঙবার নয় তামার পাতের মতো বুকটা।

এক মুহূর্ত বিনয় সেই বিশাল মূর্তির দিকে চাপা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। রাজীবও। তাদের মনে হল, বুকটা জগদ্দল পাথরের মতো তাদের মুখ থেতলে দিতে আসছে। লোকটিকে চিনতে দেরি হয় না। এত সাধারণ, আর এত সহজ মানুষ মেঘনাদ। অথচ লোকটার মুখের দিকে তাকালে মনটা শিউরে শিউরে উঠে।

তবু এক স্পর্শহীন বাতাসে কুটোস কাটির মতো বিনয়ের মুখের রেখাগুলি কোথায় উড়ে গেল। বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে তার মুখে। আর তার পাশে, রাজীবকে মনে হচ্ছিল সপ্রতিভ শিশু। একটি মতলববাজ দুষ্টু ছেলে। এতক্ষণে সে হেসে বলল, তা হলে শুভস্য শীঘ্রম্। লেগে পড়ুন।

কিন্তু অসহ্য হল নকুড়ের। বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করছে। সময় চলে যায়। সুযোগ চলে যায়, সে তত কিছুই বলতে পারছে না। পরামর্শ, আলোচনা। তার শরিকানা তো রইল না একেবারেই। সে কি তবে হেরে গেল। জিতে গেল ওই লোক দুটো। সে যে শ্বশুর। সবাইকে অবাক করে দিয়ে গলা থেকে একটা তীব্র শব্দ বেরিয়ে এল তার। যেন কেঁদে কঁকিয়ে উঠল ভাঙা জেদি গলায়।

সবাই চমকে ফিরল তার দিকে। ছুটে এল তিলি। মুখে তার ঘাম, চুল তার খোলা। হাতে মাখামাখি হলুদ। হুতোশে গলায় জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে বাবা, ওরকম করছ কেন?

হাঁপাতে লাগল নকুড়। হাঁপাতে হাঁপাতে চোখ পিটপিট করে বিস্মিত শান্ত গলায় টেনে টেনে বলল, অ্যা? কই, কী রকম করছি? কিছু করিনি তো। গলায় কেমন একটা কাশির দলা আটকে গেছে, তা-ই

মেঘনাদ এসে দাঁড়িয়েছে শ্বশুরের সামনে। তিলি বলল, তোমার তো এরকম কখনও হয় না।

না তো ! হঠাৎ কী রকম হয়ে গেল!

বিনয় বলে উঠল, বয়স হয়েছে তো।

তিলি নকুড়ের বুকে হাত দিয়ে বলল, একটু হাত বুলিয়ে দেব বুকে?

নকুড় বলে উঠল, না না। সামলে উঠেছি। তুই যা, রাঁধগে। বিজাটার আসবার সময় হল।

কথাটা মিথ্যে নয়। কাঁচের চুড়ির শব্দ করে চলে গেল তিলি। তার পেছনে পেছনে গেল রাজীব। এ বাড়িতে তার অবাধগতি।

তারপর, যেন কিছুই হয়নি, এমনিভাবে মেঘনাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল নকুড়, তা হলে, কী ঠিক হল বাবা?

মেঘনাদ বলল, আরম্ভ করে দেওয়াই ঠিক করলাম। কারবার যখন করবই তখন বসে থেকে লাভ কী। ওনারা আছেন, আপনি আছেন, নেমে পড়ি ভরসা করে। ঘড়ঘড়ে গলায় নকুড় বলল, আমি আছি? আমি আর কী করব। বুড়ো মানুষ..

নকুড় যেন ছেলেমানুষ। মেঘনাদ সস্নেহ গলায় বলল, বুড়ো মানুষ বলেই তো দরকার। আপনি কাছে থাকলেই যে অনেকখানি।

নকুড়ের একবার চোখ ফেটে জল এসে পড়ল। তবু সে যে বুড়োমানুষ। কান্নাটাকে রূপান্তরিত করল শারীরিক কষ্টের মধ্যে। আরও দুবার কেশে, শান্ত গলায় বলল, নাঃ, শরীরটার কী যে হল। যাক। তারপর, তোমাদের আর কী কথা হল?

যেন সে এতক্ষণ শোনেনি কিছুই। মেঘনাদ বোঝাতে লাগল তাকে। এতক্ষণে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল লীলা। সে দেখতে আসছিল, কে এসেছে আজ তার স্বামীর সঙ্গে ব্যবসার কথা বলতে। এতক্ষণ তাও বেরুতে ইচ্ছে করেনি তার। সবাই যে ছুটে এল নকুড়ের জন্য, তখনও কোনও চাঞ্চল্য বোধ করেনি সে। ঘরের বাইরে এসে দেখল, রাজীব কথা বলছে তিলির সঙ্গে। তিলি কাজ করছে আপন মনে। ঠোঁটের কোণে টেপা টেপা হাসি। মুখ ফেরানো অন্যদিকে।

ষোড়শী বসে আছে ঘোমটা টেনে। আর রাজীব বোঝাচ্ছে সমিতির কথা। কথাটা নারী সমিতির বর্তমান কার্যাবলীর বিষয়।

অগোছাল বেশ লীলার। জামাকাপড় চটকানো । শুয়েছিল সে। চোখগুলি ফোলা ফোলা। চোখে তার চাপা হিংস্রতা, ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপ। নাকের পাটা ঈষৎ ফোলানো। এই একই মূর্তি তার গতকাল থেকে।

ঘরে এসে ঢুকল সে। লজ্জা দূরের কথা, বরং বিদ্বেষের উদ্ধত ভঙ্গিতে সে ঢুকল। মেঘনাদ কথা বলছে নকুড়ের সঙ্গে। বিনয় ফিরে তাকাতেই চোখাচোখি হল তাদের। চমকে উঠল বিনয়। মনে হল, তাকে যেন কেউ চোরাগুপ্তি নিয়ে নিঃশব্দে এসেছে তাড়া করে। তবু সে চোখ নামাতে পারল না। ফিরে তাকাল আবার। তাকাবার মতো চোখ ছিল তার। তার বিনচৌ-এর নির্ভয় হৃদয় আর মেঘমেদুর বিষণ্ণ অসহায় চোখ। ওই চোখে কখনও কোনও প্রতিবাদ নেই, রাগ নেই, বিদ্বেষ নেই। শুধু তুমি এবার মোরে লহ হে নাথ গানের সুরে যেন ভরা। এক বিচিত্র ব্যথিত আকুতি ও ভিক্ষা সব পাওয়া রিক্ত সন্ন্যাসীর মতো। ঠোঁটের হাসি যেন ব্যথিত বুদ্ধের।

বিতৃষ্ণা ও বিদ্বেষে জ্বালাভরা চোখ লীলার। নির্লজ্জ অপলক চোখে দেখে নিতে চাইল বিনয়ের মর্মস্থল পর্যন্ত। মেঘনাদের সহকর্মী, বিপিনের দিকে তাকায় সে এমনি করেই। কয়েক মুহূর্ত নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে হঠাৎ চোখ ফিরিয়ে নিল সে। তাকাল নকুড়ের দিকে। যেন নকুড়ের কাছেই এসেছে। তবু ফিরে তাকাল আবার।

বিনয় তাকিয়েছিল তখনও, বিষণ্ণ করুণ চোখে মিশেছে মুগ্ধ বিস্ময়, কিছু ব্যাকুলতা। যেটুকু ঢেকে দিয়েছে তার পুরুষ চোখের নির্লজ্জতা।

কল নেড়ে হ্যারিকেনের শিস্ কমিয়ে দেওয়ার মতো নিবে এল লীলার চোখের আগুন। হঠাৎ থিতিয়ে এল জ্বালা। ভাবল, লোকটার নাম যেন কী? বিনচৌ, হ্যাঁ বিনচৌ, বলেছিল তিলি। কিন্তু এ তো বিপিনের চোখ নয়। ব্যবসার এত পরামর্শ, এত আলোচনার মধ্যেও ওই চোখ তাকে যেন বলছে, সবার উপরে তুমি। শুধু তুমি! এত কথার মধ্যেও যেন ওই চোখ অপেক্ষা করেছিল, তাকে দেখবে বলে।

লীলার অতৃপ্ত হৃদয় পূজা-প্রত্যাশিনী। দর্পিতা চ্যাংমুড়ি কানীর বিষপ্রাণে হঠাৎ ভেসে উঠল অমৃত। কী চায় লোকটা ! কেন, তাকায় অমন করে? রাধা নামের সাধা বাঁশিটি এক হাতে, অন্য হাতে ভিক্ষার ঝুলি ধরা দীন বোষ্টম লোকটা। চাওয়ার রকমফেরে ভরা দুটি চোখ। মার নেই। কোনওটিরই।

ভয় নেই, চমকায় না একটুও লীলার প্রাণ। ভাবল, কিছু চায় লোকটা। যে বস্তু অশ্রদ্ধা ও অরুচির ভাতের মতো সে ছড়িয়ে ছড়িয়ে দিতে চায় লুব্ধ কাকের মুখে। কিন্তু দেয় না। খেলাটুকু জমে। যে বস্তু নিয়ে সে প্রশ্রয়ের হাসি হাসে খেলা করে, লোভ দেখায় ঘরে বাইরে, ঘাটে বাটে। কিন্তু সেখানে সর্বত্রই তার ঘৃণা ও অবিশ্বাস। সব তো হ্যাংলা কাক। যে বস্তু বাসরশয্যা থেকে আজ পর্যন্ত, তার অনিচ্ছায় কেড়েছে দলেছে মেঘনাদ। তা-ই তার বিশ্বাস। তাই তার ঘৃণা, অপমান ও বিদ্বেষ। তাই সে বস্তু হয়েছে বিষ। সে বস্তু তার বিষের প্রাণের ভালবাসা ও দেহ। আজ সবই বিষ শুধু বিষ।

বিনয়ের চোখে কিছু ছিল। তার চোখের দিকে তাকিয়ে লীলার ঘৃণা ও অবিশ্বাস হল না। পথঘাটের লোকগুলির সঙ্গে এক করে ফেলতে পারল না বিনচৌকে। তার মুখের দুদিনের রোষ, থমকানি কাটিয়ে নিঃশব্দে হাসিতে বেঁকে উঠল ঠোঁটে। প্রশ্রয়ের হাসি। একটু বা বিদ্রুপের আভাস তাতে, কর্দমাক্ত কালো মাটিতে চলকে পড়া রোদের মতো চকচকিয়ে উঠল মুখ। নাকছাবির পাথরে ঝিকিমিকি। পিঠে এলানো রুক্ষ চুলের গোছা টেনে আনল ঘাড় পেরিয়ে বুকে। ঘোমটার ফাঁকে, খর চোখের তারা দুটি, ছিটিয়ে দিল আগুন। তারপর তরতর করে এগিয়ে গেল নকুড়ের কাছে। মেঘনাদের ব্যবসার পরামর্শদাতাকে আর চোখের ঘৃণায় পুড়িয়ে মারা হল না। জিজ্ঞেস করল, বাবা, তোমার কী হয়েছে?

নকুড়, মেঘনাদ, কেউ টের পায়নি তার ঘরে আসা। নকুড় চমকায়নি। চমকাল মেঘনাদ। অবাক হয়ে তাকাল লীলার মুখের দিকে। কাল বিকেল থেকে কথা ছিল না লীলার মুখে। হাসি ছিল না এক ফোঁটা। অবাক হয়ে ভাবল, কী হল আবার? কেমন করে কাটল অমন সর্বনেশে মেঘ !

লীলা এসে বসে পড়ল বাপের কাছে। পান না খেলেও আগুন লেগেছে ঠোঁটে। চোখ দুটি হাসছে আপন মনে।

দেখে শুনে খুশি হয়ে উঠল মেঘনাদ। বাপের কাছে এসে লীলার বলা, জিজ্ঞেস করা, এইটুকুতেই তার মনের সব সংশয় যেন বেরিয়ে গেল বুকের আর একটি দরজা দিয়ে। বড় দুঃসময়ে লীলা এসেছে এই বিচিত্র রূপ ধরে। হেসে তাকাল সে লীলার দিকে। সে হাসির মধ্যে স্নেহের আভাস। আরও আভাস, একটু প্রেমের।

লীলা কয়েকবার চকিত দীপ্ত চোখে ফিরে তাকাল তার দিকে। তারপর জিজ্ঞেস করল আবার নকুড়কে, কী হয়েছে তোমার বলো তো?

সিঁটিয়ে গেল নকুড়ের হৃৎপিণ্ড। ঘৃণায় ভয়ে ও ব্যথায় এক মুহূর্ত কথা বলতে পারল না সে।

গত রাত্রের কথা সে ভোলেনি। এখনও সুকুমারীর কান্না বাজছে তার বুকে। তবু বললে ঘড়ঘড়ে গলায়, অ্যাঁ? না, কিছু তো নয়। একটা কাশির বেগ

মেঘনাদ ফিরে তাকাল বিনয়ের দিকে। বিনয় তাকিয়েছিল এদিকেই। মেঘনাদ ফিরতেই বলল, তা হলে আমি আজ চলি। কথা আবার পরে হবে।

মেঘনাদ উঠে এল তাড়াতাড়ি। বলল, আপনি বসলেন না একদণ্ড। আসা ইস্তক দাঁড়িয়ে রইলেন।

লীলার দিকে না চেয়েও, বিনয়ের চোখ পড়ে আছে ওই দিকেই। বলল, তাতে কী? আবার আসব, অনেকবার বসব, সে জন্য ভাববেন না। এখন আপনার কাজটা ভালয় ভালয় আরম্ভ করে দিতে পারলেই হয়।

মেঘনাদের মনের কোথায় লেগেছে নতুন জোয়ার। বলল, আরম্ভ করতে দেরি করব না আর। আপনি জমি দেখাবেন কবে?

একটু অন্যমনস্ক ভাব বিনয়ের। বিষণ্ণ উদাস চোখে বিচিত্র ঝিকিমিকি। বলল, চলুন না যেদিন খুশি। কালকেই চলুন। তবে একটা কথা আপনাকে কিন্তু বলা হয়নি।

বোঝা গেল, চোখে অন্যমনস্ক বিনয়। মনে নয়। মেঘনাদ বলল, বলেন।

বিনয়, বিনয় করে হেসে বলল, যখন আরম্ভ করি, তখন আমি একেবারেই ছোট করে ভাবতে পারিনে। ময়দার পারমিটটা যাতে সেন্ট্রালের হয় সেইটাই আমি চাই।

চট্র করে সেন্ট্রাল শব্দটা উচ্চারণ করতে পারল না মেঘনাদ। জিজ্ঞেস করল, কোথাকার?

চোখের দৃষ্টি বিনয়ের বড় বড় ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে পড়তে লাগল দূরে। দূরে ; যেখানে উন্মুখ পাড় হাসছে সূর্যালোকে। বলল, সেন্ট্রালের মানে দিল্লির, আমাদের কেন্দ্রীয় সরকারের। বাংলা দেশের গভর্নমেন্ট যে পারমিট দেবে, তাতে খুব বেশি ময়দা তো পাওয়া যাবে না। যদি আপনার ব্যবসা ভাল হয়, পরে আবার ছুটতে হবে দিল্লিতে। তার চেয়ে গোড়া বেঁধেই আরম্ভ করা যাক না।

এক সময়ে মেঘনাদ পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল লালমিঞার উপর। আজও কোন ফাঁক দিয়ে কখন একটু নির্ভরতা এসে পড়েছে তার বিনয়ের প্রতি। বলল, বেশ তো। তা কী করতে হবে বলেন।

উদাস চোখ আশ্বাসের হাসি ফুটিয়ে বলল, এমন কিছু নয় সেটা। গভর্নমেন্টের ব্যাপার তো বোঝেন। দিল্লি পারমিট দেওয়ার আগে দেখে নেয়, মালিকের যন্ত্রপাতি আছে কি না। দেশি : বেকারি হলে দিল্লি পারমিট দেয় না। হাতের কাজ তো। দেশি কায়দায় কত আর মাল হবে। সে জন্যে, বড় বড় মেশিনওয়ালা কারখানাগুলিকেই দিল্লি পারমিট দেয়। পারমিটের ওজনটা অনেক বেশি কিনা। প্রথম চোটেই ষাট মনের পারমিট পাওয়া যাবে প্রতি সপ্তাহে।

ষাট মন একেবারে? চমকে উঠল মেঘনাদ। এত ময়দা নিয়ে সে কী করবে? আর প্রথমেই যন্ত্রপাতি দিয়ে কারখানা তো সে চালাতে পারবে না।

সে বলল, কিন্তু অত যন্ত্রপাতি…

বিনয় বলল, অত কীসের? আপনাকে তা বলে আমি মেশিন দিয়ে কারখানা করতে বলছিনে। আপনি একটা থিন বিস্কুটের ডাইস-মেশিনই কিনুন না। সেইটে দেখিয়েই আমি এখন কাজ আদায় করে নেব।

ডাইস-মেশিনের নামটা অনেকবার শুনেছে মেঘনাদ। তবু, প্রথমেই মেশিন ! মনটা তার একটু খচখচ করতে লাগল।

বিনয় বলল, ভাবছেন অনেক টাকা লাগবে। আমি আপনাকে একটা সেকেন্ডহ্যান্ড ডাইমেশিন দেব। নতুনের দাম ধরুন তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। পুরনো হলেও সেটা একেবারে নতুনের মতো আছে। দু হাজার টাকায় পাবেন আপনি সেটা। সেটা দিয়ে যে আপনাকে কাজ আরম্ভ করতেই হবে তার কোনও মানে নেই। ফেলে রাখবেন ঘরে। লোহার যন্ত্র, পোকায় কাটবে না, উইয়েও ধরবে না। মাঝে মাঝে একটু তেলটেল দেওয়া। কিন্তু একটা জিনিস তো হয়ে থাকল। ওদিকেও কাজটা মিটে যায়। আর না হয় বেচেই দেবেন আবার।

ভয় সংশয় সবই ছিল মেঘনাদের। কিন্তু মেশিনের জন্য মন তার প্রস্তুত হয়েই ছিল তলে তলে। আজ আর না বলবে না সে। শুরু তার আজ থেকেই সব। আজ তার সূত্রপাত তোক এমনি করেই। বলল, কিনব।

নকুড় সবই শুনছিল। শুনতে শুনতেও, পিটপিট করে দেখছিল লীলাকে। তারই পাশে বসে লীলা কার দিকে চেয়ে চেয়ে হাসছে, দাঁতে ঠোঁট কেটে। মেঘনাদের দিকে?

ওদিকে তিলি, অন্যমনস্কভাবে হেসে কথা শুনছে রাজীবের। চোখ রয়েছে দিদির দিকে। অবাক বিস্ময়ে দেখছে দিদির কাণ্ডকারখানা। এত রাগ, কিন্তু কোথায় কী হল। দিব্যি চোখে-মুখে টিপে টিপে হেসে মরছে বিনচৌ-এর দিকে চেয়ে। বিনচৌ-এর ভাবখানা দেখেও বড় হাসি পাচ্ছিল। রাগও হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ মনটা ব্যথায় ও ভয়ে ভরে উঠল তার। এ কী খেলা তার দিদির! ঘরে জামাইবাবু রয়েছে। এত সামনে, এত কাছে স্বামী, তবুও কি একটু ভয় নেই প্রাণে। মায়াদয়া নেই। কি একটুও মনে। এ কী খেলা আগুন নিয়ে ! যেন দিদি আগুন লাগাতে চায় সবখানে। কিংবা এ শুধুই খেলা হয়তো। সে জানে কতটুকু লীলার। মেঘনাদ তাকে নিশ্চয়ই চেনে অনেক বেশি।

চিনুক। তবু মনটা মানে না তিলির। সংসার, স্বামী-পুত্র-কন্যা নিয়ে, ভাজা ভাজা হয়ে পাকা গিন্নি সে হয়নি। তবু, এ সংসারের অনূঢ়া জীবনে যে অভিজ্ঞতাটুকু জমেছে তার, সেটুকু কম নয়। সে নকুড়ের মতো ভাবেনি, সুকুমারীর মতো ভাবেনি। মেঘনাদ ও লীলার আসা, সব মিলিয়ে সংসারে একটু হাসি, একটু শান্তি আশা করেছিল। কিন্তু এর মধ্যে কোথায় যেন সর্বনাশ পা টিপে টিপে ঘুরছে ছায়ার মতো। বুকের ভয় ব্যথা তার গেল না।

রাজীব তখন বলছে, নারী সমিতির আমরা আলাদা আলাদা ডিপার্টমেন্ট খুলব ভাবছি। সেক্রেটারিরও তা-ই ইচ্ছা। আর নারী সমিতির তৈরি জিনিসপত্র কিনবে স্বয়ং গভর্নমেন্ট।

বড় অসহ্য লাগল রাজীবের বকবকানি। যেন নেই-আঁকড়ে ছেলেটা ঘ্যানঘ্যান করছে খাবারের সামনে বসে। দু হাত বাড়িয়ে কী খেতে দেবে ওকে তিলি। বিরক্ত হয়, হাসিও পায়। পুরো বিরক্ত হওয়া যায় না। এ বয়সের ওইটিই রীতি। শত হলেও রাজীব একটা ছেলে কিনা।

তবু বড় বিরক্ত লাগে তিলির। ঠোঁট টিপে সোজা তাকাল রাজীবের চোখের দিকে। বলল, বুঝেছি।

রাজীব বলল, অ্যাাঁ?

তিলি বলল, চা খাবেন?

পরমুহূর্তেই সজাগ হল রাজীব। বলল, এতক্ষণে মনে পড়ল বুঝি সে কথা। ঘড়ি দেখে, ফিরে তাকাল ঘরের দিকে। জিজ্ঞেস করল এখান থেকেই, কী হল বিনয়দা !

বিনয় বলল, তোমার জন্যেই বসে আছি।

রাজীব এদিকে ফিরে বলল, সময় নেই, আর এক দিন এসে খাব।

বলে চলে গেল। ঘরে আসতেই বিনয় বলল, কাল সকালে এসে তুমি মেঘনাদবাবুকে নিয়ে যেয়ো আমার ওখানে। আজ তা হলে চলি।

বলে সে ফিরে তাকাল মেঘনাদের দিকে। কিন্তু মেঘনাদকে টপকে সে দৃষ্টি বাতাসের মতো গিয়ে লাগল লীলার গায়ে।

লীলাও উঠে দাঁড়াল।

মেঘনাদ বলল তার গ্রাম্য বিনয়ে, কী আর বলব। আপনি বসলেন না। একটু কিছু খাওয়ানো হল না আপনাকে। বলবই বা কী। আপনি এত বড় মানুষ, বিদ্বান মানুষ…।

রাজীব দেখল অবাক হয়ে, বিনয় চৌধুরী এদের সঙ্গেও মিশতে কী রকম পটু। হেসে বলল বিনয়, ছি ছি, ও সব বলবেন না মশাই। বিদ্বানের মতো বিদ্যা আমার নেই। আর খাওয়া? খাওয়াতে তো আপনাকে হবেই। দাঁড়ান, খাওয়াটা বেশি করে পাওনা হোক, তখন খাব।

মেঘনাদ জোড় হাতে মাথা নত করল। এ মূর্তি সেই, সিরাজদিঘার গদির মালিক মেঘু সা’র। বলল, আমার ভাগ্যি।

লীলা তখন চোখের বিদ্যুতে, বুঝি বিদায় জানাচ্ছে তাকে। কী পেল সে বিনচৌ-এর চোখে, সে-ই জানে। রাজীবের সঙ্গেও চোখ ঠোঁট দিয়ে খেলা খেলেছে সে। আজ একটু অন্য রকম।

বারান্দা থেকে ডেকে উঠল তিলি, দিদি শোন।

লীলা ফিরল। চলে গেল বিনয় আর রাজীব।

.

বাড়ির অন্যান্য ভাড়াটে বউদের তখন চোখে চোখে, ঠোঁটে ঠোঁটে অনেক কথা হয়ে গেছে। কে বলে উঠল, কত রঙ্গ দেখালি, দাঁতের মধ্যে আটালি। দেখে দেখে শালা চোখ পচে গেল।

তিলি বোঝে, এ সব বলছে তাকে। এতক্ষণ যে রাজীব তার সঙ্গে কথা বলছিল। ওদের স্বামীরা সকলেই রাজীবের মজুর ইউনিয়নের মেম্বার। তবু, তিলিকে তারা ছেড়ে কথা বলবে কেন। কিন্তু ও সবে কান দেয় না তিলি।

লীলা এসে দাঁড়াতেই, বিদ্রূপ করে বলল সে, ওমা! এত যে হাসছিস্? কোথায় গেল তোর অত রাগ?

এক মুহূর্ত তিলির চোখে চোখ রেখে লীলা হেসে উঠল। বলল, রাগ কোথায় দেখলি?

তিলি বলল, ভ্রু কুঁচকে কেন? তোর রাগ দেখে তো সারা বাড়ি ভয়ে মুখ লুকিয়ে আছে সকাল থেকে। 

পেছন থেকে মেঘনাদ বলে উঠল, রাগ কোথায় দেখলে গো ঠুমি ঠাকরুন। এই তো দিব্যি হাসছে তোমার দিদি।

দু জনেই অবাক হয়ে মেঘনাদকে দেখল। তারপর হাসল চোখাচোখি করে। মেঘনাদ কেবলই ফিরে ফিরে দেখছে লীলাকে।

তিলি বলল, তাই তো বলছি। এতক্ষণ তো পেত্নির মতো মুখ করেছিল।

মেঘনাদ আড়চোখে লীলার দিকে দেখে বলল, সে তো ভাই আমার কপালগুণে।

লীলাও আড়চোখে দেখে নিঃশব্দে শুধু ঠোঁট ওলটাল। তিলি দেখছে দুজনকেই। মনের তলে চাপা অস্বস্তিটুকু গেল না তবু। হেসে বলল মেঘনাদকে, উঃ, ভারী যে বউয়ের সোহাগ হচ্ছে।

মেঘনাদ মনটা আজ খুলে দিয়েছে। মুখটাও খুলে দিল এবার। বলল, যদি হিংসে হয়, সোহাগ হয় তোমাকেও করব গো !

তিলি বলল, ইস্!

মেঘনাদের ঠাট্টায় এবার লীলাও ঠোঁট ফুলিয়ে হেসে বলল, মরণ !

এমনকী ষোড়শীর ঘোমটা ঢাকা ময়লা শাড়িতেও হাসির আভাস দেখা গেল।

মেঘনাদ বলল, দেখি, একবার ডাকঘরে যেতে হয়। পোস্টকার্ড এনে বিপিনদাকে একটা চিঠি লিখে দিই। এবার তাকে আসতেই হবে। সে জামা গায়ে দিতে গেল। বিপিনের নাম শুনে লীলার ভু দুটো কুঁচকে উঠল একবার। তেরছা চোখে মেঘনাদকে দেখে তিলিকে বলল, হ্যাঁ রে, মুখপুড়ি, একটু হেসেছি বলে এত তোর গায়ে লেগেছে কেন?

হাসতে হাসতে তীক্ষ্ণ চোখে একবার লীলার চোখের দিকে তাকাল তিলি ; বলল, তা হাস না তোর যত খুশি। তবে দেখিস দিদি, হেসে হেসে যেন মরিস নে।

লীলাও তৎক্ষণাৎ জবাব দিল স্পষ্ট গলায়, মরলে যদি জ্বালা জুড়োয়, না হয় মরব।

দুই বোনের তীক্ষ্ণ দু জোড়া চোখের চাউনি যেন শাণিত দুটি ইস্পাতের ফলা পরস্পর ঠোকাঠুকি করল। তবু কেউ হাসিটুকু ছাড়ে না।

তিলি বলল, দ্যাখ দিদি, মরলে যদি জ্বালা জুড়োত, সবাই তবে মরত।

লীলা : তবে মরেই দ্যাখ।

তিলি : সত্যি প্রাণ চায় বড়।

বলে দু জনেই হেসে উঠল হঠাৎ খিলখিল করে। লীলা বলল, বড় পেকেছিস।

তিলি আর হাসতে পারছে না। মনে হল, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠবে বুঝি এখুনি। তবে হাসি বজায় রেখেই বলল, সত্যি কাঁচা থাকতে আর দিলে না।

এমন সময় বাঁশি বেজে উঠল কারখানার। ষোড়শী উঠল ধড়ফড়িয়ে। সে দুই ননদের কথা শুনছিল এক মনে।

তাকে লাফ দিয়ে উঠতে দেখে লীলা বলে উঠল, দ্যাখ মাগির কাণ্ড। চোখেমুখে আর পথ দেখতে পাচ্ছে না।

তিলি বলল, তাই না বটে। কলের জল এনে রেখেছিস বউদি?

ষোড়শী বলল সভয়ে, না তো।

শিগগির যা রাককুসি। নইলে দাদা এসে হাত পা ছুঁড়বেখনি তেল কালির হাত ধোবার জল না পেলে।

মনে মনে বলল ষোড়শী, ছুঁড়ক। বলার সাহস তার আছে। তবু ঘুমন্ত ছেলেকে শুইয়ে, বালতি হাতে ছুটে গেল কলে।

মহেন্দ্র মিস্তিরির বেকার ভাইটা এতক্ষণ বসে বসে সব দেখেছে। এবার হঠাৎ গেয়ে উঠল,

তোমার সবার কাছে আনাগোনা।
শুধু আমায় চেয়ে দেখ না ॥

বলে চোখের কোণ দিয়ে, বারান্দার দিকে দেখে বেরিয়ে গেল। এ সময়ে তাকে বেরোতেই হবে। মহেন্দ্র এ সময়ে তাকে এসে বাড়িতে দেখলেই খেপে যাবে। কাজের খোঁজ না করে বসে থাকা সহ্য হয় না।

লীলা তিলি চোখাচোখি করল।

তারপর বিজয় এল। সঙ্গে সঙ্গে বউও ঢুকল জল নিয়ে। জমে উঠল বাড়ি আর পাড়া।

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোডে সাড়া পড়ল। ছিনে জোঁকের মতো ঘিরে এল সবাই জলকলে।

নকুড় চোখ পিটপিট করে দেখল এদিক ওদিক। সুকুমারীকে খুঁজছে। বুড়ো মনটা বড় আনচান করছে। বুড়ি গেল কোথায়।…এল না দেখে, টুকটুক করে গেল জংলাপুকুরে চান করতে।

বিজয় এল, খেল, চেঁচাল, ছেলে জাগাল, কাঁদাল। মা কোথায়, জিজ্ঞেস করল কয়েকবার। মেঘনাদ আসতে বিনচৌ-এর বিষয় কথা হল। বিজয়ের মনটা একটু খচখচ করতে লাগল তবু হঠাৎ কিছু বলা ঠিক নয় ভেবে বলল না কিছু। চলে গেল কাজে। যাওয়ার আগে, এক ফাঁকে গাল দুটি টিপে দিয়ে গেল ষোড়শীর। ষোড়শীও বোধ করি সেইজন্যই এতক্ষণ চান করতে যেতে পারছিল না।

অনেক বেলা অবধি মেঘনাদ একখানি চিঠি লিখল বিপিনকে, বিপিনদাদা, তামাকের আড়তদার রমজান মিঞার কাছে সব দেখাশোনার ভার দিয়া চলিয়া আইস। তুমি না আসিলে আমার আর চলে না।

তারপর সকলের খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকে গেল।

সকলের সব পাট চুকে গেল। সুকুমারী বাড়ি আসেনি তখনও। নকুড় ঘুমোতে পারছে না। ছটফট করছে।

রোদ মাথা থেকে গেছে কখন। বেঁকে পড়েছে। পিপুলের ছায়াটা হেলে পড়ে দরজার সিঁড়িতে এসে পড়েছে। আশ্বিনের শেষ। রোদ এখনও বেশ চনচনে। আর বড় চনমনে হয়ে উঠেছে। এর মধ্যেই তরতর করে আসে, যায়ও তেমনি। বর্ষা গেছে নাবিতে। পেছনে পড়া মেঘের ছুটকো দল চলেছে সারাদিন। রং আর তার জলভারে কালো নয়, তুলোধোনা হয়ে গেছে।

গাছগাছালি ডাঁটোসাঁটো ঘোর সবুজ। পিপুল ঝাড়ালো হয়েছে। ঘাস বড় হয়ে উঠেছে উঠোনের। চারপাশে বেড়েছে বন। বুক চিতিয়ে উঠেছে মান। আগুন ছিটানো বিছুটিও কেমন সবুজের ঝাড় বেঁধেছে। অল্প অল্প হাওয়া আছে।

হাওয়ার শব্দে, শালিকের ডাকে চমকে চমকে নকুড় বাইরে তাকায়। সুকুমারী আসে না। চোখ দুটো টনটনিয়ে উঠছে। রাগে দুঃখে বুকের মধ্যে গুমরে গুমরে উঠছে। কারও খেয়াল নেই। বারান্দায় বসে আছে সবাই। তিলি, লীলা, ষোড়শী, আরও কয়েকজন। বাড়ির বুড়িটার কথা কারও মনেও নেই।

আছে, মনে আছে। তিলির মনটা আর মানছে না। রাগ করলে অবশ্য সুকুমারী এরকম দেরি করে মাঝে মাঝে। বসে থাকে গিয়ে পাড়া প্রতিবেশীর ঘরে। কিন্তু আজ যেন বড় বেশি হচ্ছে। বড় ছটফট করছে মনটা। ঘরে বাইরে, কাজে আড্ডায় ঘোরে সে সারাদিন। জানে, মা আছে কাছে কাছে। এখন তিলির মনটা বড় খারাপ হয়ে উঠল। উঠে পড়ে সে।

লীলা বলল, চললি কোথায় ঠুমি।

তিলি বলল, একটু দেখে আসি, মা কোথায় গেল।

কী ভেবে লীলা বলল, চল তবে আমিও যাই।

ষোড়শীর মনটা ছটফট করছিল। সে পথ চেয়ে রইল বসে।

বেরোল দু জনে। রাস্তায় এসে, এদিক ওদিক দেখে এগুল পশ্চিমে। খানিকটা গিয়ে নগার বাড়ি। নগার বাড়ির উত্তরে ফটিক কেওরার বাড়ি। নগার বউ টেপি গোবর কুড়োয় এখানে সেখানে। তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল তিলি, টেপিদি, মা এসেছে তোমাদের এখেনে?

টেপি ঘর থেকে বেরিয়ে বলল, না তো।

কোথাও যেতে দেখেছ?

টেপি এদিক ওদিক চেয়ে বলল, হ্যাঁ, তোমার মাকে রেল লাইনের দিকে, পুবে যেতে দেখেছি।

রেললাইনের দিকে? হঠাৎ আতঙ্কে চোখ দুটি বড় হয়ে উঠল তার। বলল, কখন গো?

তা হবে, বেলা পেরায় এগারোটা লাগাত।

অ্যা?

কান্নায় কথা আটকে গেল তিলির গলায়। লীলা বলল, ওরকম করছিস কেন ঠুমি?

তিলি বলল, মা যে রাগ করে গেছে। রাগ করে এপাড়া থেকে মেয়েরা রেল লাইনে গেলে আর ফিরে আসে না কেউ।

কাঁটা দিয়ে উঠল লীলার সারা গায়ে। কালো চকচকে মুখ ফ্যাকাসে ছাই ছাই হয়ে উঠল। এ যেন সেই লীলাই নয়। সে যেন কী পাপ করেছে।

তিলি বলল, চল দিদি যাই।

দু জনে ছুটল হনহন করে।

ঘরে গিয়ে কেশো গলায় হিহি করে হেসে উঠল টেপি। শুকনো মুখে, সুকুমারীও হাসছে। কয়েকটা দাঁতে। টেপিকে সে ওই কথা শিখিয়ে রেখেছিল। বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখেছে সবই। নিজের মনেই বলে উঠল, কেন, এখন কেন? মা মলে তো সবাই বাঁচিস। তবে আবার অমন ছোটা কেন? ছোট, ছোট হারামজাদিরা।

টেপি তো হেসে বাঁচে না। হাসে আর বলে, ও মা গো ! খুব শোধ নিয়েছ খুড়ি। তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, ভর দুপুরে মেয়ে দুটো গেল। তা তোমায় না পেয়ে যদি ডবকা চুড়ি দুটোই রেলে মাথা গলিয়ে দেয়?

কী বললি? শিউরে উঠে সুকুমারী চেঁচিয়ে বলল, ডাক ডাক ওদের, চেঁচিয়ে ডাক।

দ্যাকো কাণ্ডো! বলে রাস্তায় এসে টেপি চড়া গলায় চিৎকার করে উঠল, তুমি। এই ইমি …।

দু বোন তখন গলি পেরিয়ে প্রায় বড় রাস্তায় পড়ো পড়ো। থমকে দাঁড়াল। টেপি হাতছানি দিল। বলল, ফিরে আয়, ফটিকদের বাড়িতে নাকি বসেছিল।

নিজের ঘাড়ে দোষটা নিল না সে।

কিন্তু টেপির গলায় ঠুমি চিৎকার শুনে চমকে উঠল নকুড়। ঝিমুনো মাথাটা তুলে ধরল হঠাৎ। সন্ত্রস্ত গোসাপের মতো। মনটা কু গাইছিল। হঠাৎ তুমি চিৎকারে, ভয়ে অবশ হয়ে গেল। খালি ভাঙা গলায় বলতে লাগল, কী হল? কী খবর? চেঁচায় কেন?

দরজার কাছে এসে জবাব দিল সুকুমারী, কিছু নয়, এমনি। ঘুমোওনি?

নকুড় উদগ্রীব হয়ে বলল, কে, বিজার মা? এলে?

পরমুহূর্তেই দারুণ অভিমানে গলাটা বুজে এল তার। খালি বলল, বিজার মা, আমার আর বাঁচতে সাধ নেই। একটুও না।

ভেউক, ভেউক–পোঁ-পোঁ—

বিজয় বলল, সরে এসো বোনাই। বিনচৌ-এর গাড়ি আসছে।

সন্ধ্যাবেলা বেরিয়েছে শালা ভগ্নীপতি। মেঘনাদ সরে গেল ধারে। গাড়িটা চাপা স্বরে খেউ খেউ করতে করতে, আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল। বিজয় দেখল বিনয়ের বউ আর দুটি ছেলে রয়েছে। গাড়ির মধ্যে।

নিজের মনেই বলে উঠল সে, ও, পুজোর ছুটিতে ছেলেরা এসে পড়েছে।

মেঘনাদ বলল, কার ছেলে?

বিজয় বলল,  বিনচৌ-এর। ওই যে, গাড়িতে গেল বউ ছেলেরা।

এক মুহূর্ত থেমে বলল, শালা আশ্চর্য মাইরি, জানো বোনাই বিনচৌ-এর বউকে কোনওদিন সোয়ামির সঙ্গে কেউ বেরোতে দেখেনি! ছেলেগুলোও ছুটিছাটাতে বাড়ি এলে, বাপের সঙ্গে বেরোয় না।

মেঘনাদ বলল, কেন?

কী জানি ! ওদের মাগ-ভাতারকে কেউ কোনওদিন কথাই বলতে দেখেনি। বউটাকে দেখতে কিন্তু মাইরি খুব ভাল মানুষ মনে হয়। শুনেছি দিল্লির মেয়ে। খুব লেখাপড়াও জানে।

সন্ধ্যা হয়েছে। বাতি জ্বলে উঠছে দোকানে। ভিড় হচ্ছে চা-খানায়, খাবারের দোকান আর হোটেলে। অল্প বাতাস, মন্থরগতি। শহরের ধোঁয়া ধুলো সহজে নড়ছে না।

মেঘনাদ দূরের দিকে তাকিয়ে বলল, দেখো বিজয়, তোমার বিনচৌ-ই বলল আর ভগবানই বলো, বউ-সোয়ামির মনের সুখে জমজমাট সংসার বড় ভাগ্যির কথা। এ সংসারে মন পাওয়া বড় দায়। মনের মিল কী চাষ্টিখানি কথা।

কথাটা কেমন করে যেন বেরিয়ে গেল মেঘনাদের মুখ দিয়ে। আর কথাটি শুধু কথা নয়। কথাটির মধ্যে কোথায় যেন বোনাইয়ের মনঃকষ্টের ব্যাপার ছিল। লীলাকে দেখে সেটা একটু আঁচ করতে পারে বিজয়। কিন্তু বুঝতে পারে না।

কথাটি বলেও মেঘনাদের দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে না। বুকের ফানুসটা আরও ফুলে ফেঁপে, তার চেহারাটিকেই শুধু মস্ত করে তোলে।

বিজয় বলল, ঠিকই বলেছ বোনাই। মনের মানুষ ক-জনা পায়?

তারপর বলল,  বিনচৌ আর তার বউয়ের মধ্যে কী যেন একটা আছে, জানো ! ভেতরে না-ই গেলে। সোয়ামি ইস্তিরি একটা বাড়িতে থাকে, সেটা বাইরে থেকে আঁচ করা যায় না?

বলে হঠাৎ দাঁড়াল। এখানটায় দোকানপাট একটু কম। সামনেই, পুবদিকে একটা মস্তবড় বাড়ি। যেন ভুতুড়ে বাড়ি। এত বড় বাড়ি কোনও সাড়া শব্দ নেই। দরজা জানালা বন্ধ অন্ধকার। ইলেকট্রিক কানেকশন্ নেই। একটি ঘরের জানালায় সামান্য হারিকেনের আলো দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ভেতর থেকে অনেক মানুষের চাপা গুলতানি শোনা যাচ্ছে। বাড়িটা দেখিয়ে বিজয় বলল, বোনাই, এইটে বিনচৌদের আসল ভিটে। ভেতরে অনেক বড়। বিনচৌ-এর আর আর ভাইয়েরা থাকে এখানে। কিন্তু শালা, বিনচৌ দূরের কথা, এদ্দিন এসেছি, এই বাড়িটার ভাব কিছু। বুঝলাম না মাইরি !

আবার এগুল দু জনে। বিজয় বলল, আমরা যখন এখানে এসেছি, তখনও বিনচৌ কলকাতায় পড়তে যায়। এই বাড়িটাতে থেকে বিনচৌ-এর জ্যাঠা বিনচৌ-এর বাপকে জ দিয়ে দিলে, জানো।

মেঘনাদ বলল, কী করে?

কী জানি কী করে। পূবে, রেললাইনের ওপারে ওদের অনেক জমি ছিল। কী যে করলে শালা ওর জ্যাঠা, ওর বাপ মাথায় হাত দিয়ে বসল। এক আধবার না, অনেকবার। বছরে একটা করে কাণ্ড ঘটত ওদের বাড়িতে। বিনচৌ-এর ভাইয়েরা তো জ্যাঠাকে ঠ্যাঙা নিয়ে খুন করতে চেয়েছিল।

বিনচৌ চায়নি?

না, এইটেই শালা অবাক ব্যাপার মাইরি। বিনচৌ সেরে লেখাপড়া নিয়ে থাকত, আর পাড়ার লোকে ওকে বড় ছেদ্দা করত। তখন কিন্তু কেউ ওকে বিনচৌ বলত না। সবাই বলত, এই ছেলেই বাপের সব দুঃখু ঘোচাবে।

ঘোচায়নি?

কোথায়? কলকাতায় দুটো ডবল পাশ করে চলে গেল বাড়ি ছেড়ে। জ্যাঠা বাড়ি ছেড়েছিল অনেক আগে। বাপ মল কিছুদিনের মধ্যে। তারপর বাকি তিনটে ভাই শালা রোজই দাঙ্গা করত। তারপর অনেকদিন বাদে বিনচৌ এল ফিরে। সঙ্গে বউ আর দুই ছেলে। এখন শুনি, এ বড় বাড়িটাও কিনে নিয়েছে বিনচৌ। কোনও ভাইয়ের আর শরিকানা নেই। থাকবে কী করে? ট্যাক্স খাজনা দেবে না। কেউ তো কিছু করত না। একে তাকে জগ দিয়ে চালিয়ে দিল চিরটাকাল। বিনচৌ এসে ট্যাক্স খাজনা মেটালে, সব ভাইয়েদের কিছু কিছু টাকা দিলে। টাকার তোয় লিখে দিলে সকলে।

ভালই তো হয়েছে। নইলে ওরা আর কাউকে বাড়িটা বিক্রি করে দিত।

হ্যাঁ, এখন বিনচৌ-এর ফেঁসো কারখানার দরোয়ান আসে বাড়িভাড়া আদায় করতে।

হঠাৎ যেন কিছু মনে পড়েছে, এমনিভাবে ডাকল মেঘনাদ, বিজয়।

বলো। 

বিনচৌকে তোমার ভাল লাগে না, অনেকবার বলেছ। সে যে আমার কারবারে একটু দেখাশোনা করতে চায়, সে কি তোমার ভাল লাগছে না?

বিজয় বলল, কথাটা যদি তুললেই বোনাই, তবে বলি, বড় ভয় করে, জানো ! ওর বড় দুর্নাম। নিজের চোখেই দেখেছি, কত লোকের জমি মেরে দিলে। ওর ফেঁসো কারখানায় তিরিশটা মেয়ে কাজ করে। শালা, কেউ ওকে ভাল বলে না। জান, ও আমাদের চটকলের কেউ নয়, তবু আমাদের বিষয় নিয়ে মালিকের সঙ্গে কথা বলে। জানি রাজীবদাই ওকে গুরু মেনেছে। কিন্তু ও আমাদের কোনওদিন ভাল করেনি। এই নিয়ে রাজীবদার সঙ্গে কতবার আমাদের ঝগড়া হয়েছে। আমরা ইউনিয়ন তুলে দিতে চেয়েছি। বিনচৌ ইউনিয়নের কেউ নয়, কিন্তু শালা আমাদের লিডাররা ওর কথা ছাড়া চলে না, আমরা জানি। সবটাতেই এমনি, বিনচৌ-এর হাত আছে।

এক মুহূর্ত থেমে আবার বলল, তবে বোনাই, তুমি পুরনো কারবারি। টাকার স্বাদ পেয়েছ তুমি, মর্যাদা তুমিই জানো। আমার শালা হপ্তার টাকা ডাইনে আনতে বাঁয়ে কুলোয় না। অথচ দেখেছি আমার মতো মিস্তিরি আবার মুদি কারবার করে। একটার বদলে দুটো বউ পোষে। কোত্থেকে করে শালারা, ভগবান জানে। তাই বলছি, এ সব কারবারে আমার চেয়ে বিনচৌকে তুমি বুঝবে ভাল। 

তাদের খেয়াল নেই, কোথায় এসেছে তারা। দুজনেই মগ্ন নিজেদের কথায়। মেঘনাদের ভারী মুখে চিন্তার ছায়া।

চিন্তা নয়, অস্বস্তি। মনের কথাটি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারছে না বিজয়কে। থেমে থেমে খাপছাড়া ভাবে বলল, আজ আর আমি শুধু ব্যবসাই করতে যাচ্ছিনে বিজয়। টাকার স্বাদ কে না পেতে চায়। টাকা চায় সবাই। তুমি চাও, আমিও চাই : বাটপাড়ি করে তো চাইনে।

তারপর কী বলতে গিয়ে তার সারা মুখ বিচিত্র আলোয় ভরে উঠল। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, বিজয় লোকে ভক্তি করে মন্দির গড়ে। সেখানে ঠাকুর পিতিষ্ঠে করে। করে না?

বিজয় অবাক চোখে বলল, তা করে।

মেঘনাদ চাপা আবেগভরা গলায় বলল, আমিও মন্দির গড়তে চাই।

আরও অবাক হল বিজয়। মেঘনাদকে বোকা আর পাগল মনে হতে লাগল। বলল, কীসের মন্দির বোনাই।

মেঘনাদ বিজয়ের ঘাড়ে তার ভারী হাত রেখে বলল, কারখানা হে কারখানা, বড় কারখানা, তাতে আমি মেশিন পিতিষ্ঠে করব। আমার মাল অল্প, কিন্তু একটু একটু করে খাড়া করব। সেই মন্দিরে আমার টাকার পুণ্যি কবে হবে জানি না। কিন্তু এ না হলে আজ আর সিদ্ধিলাভ হবে না। এখন নতুন করে কাজ শিখতে হবে। নতুন কাজের মিস্তিরি হব আমি। পেছিয়ে কেন থাকি? আজকে সময় পড়েছে অন্যরকম, সেইরকম করতে হবে। হাতে কলমে হেঁকে পুড়ে যা শুরু করেছি, যন্তরেই যদি তার শেষ হয়, তা হলে সেই শেষ দেখব না? বড় সাধ। সেই দেখে যেন আমি মরি। আমি সোনার পালঙ্ক আর হাওয়ার গাড়ি চাইনে। আমি যেন নতুন কিছু করে যেতে পারি এই কারবারে।

সে যেন দিব্যচোখে দেখতে পেল তার সেই যন্ত্র-মন্দির। ঘরঘর করে মেশিন চলছে। ময়দা ডলছে, তাতছে, ছাঁচ কাটছে, ঝাঁজরি মুখে দুধ পড়ছে ফিনকি দিয়ে। মেশিনে হবে না মেঘার মালপো? কিংবা ঝুমির ঝুরি!

আরও ঘন হয়ে, সে প্রায় বিজয়ের কানে ফিসফিস করে বলল, বিজয়, আস্তে আস্তে আমি সেই মন্দির গড়তে যাচ্ছি। আমি হরিসেবায় কোনওদিন দশটা টাকা খরচ করিনি। কিন্তু আমার যা আছে সব দিয়ে আমি ওইটে করতে পারব না? তবে আস্তে, খুব আস্তে। ডান হাতে নিয়ে বাঁ হাতে ঢেলে দেব ওইদিকে। 

নির্বোধের মতো তাকিয়ে রইল বিজয়। কখন তারা ঘুরে ফিরে সেই গঙ্গার ধারে এসেছে, টের পায়নি। দূরে খেয়াঘাটের আলোয়, মেঘনাদকে অচেনা লাগল বিজয়ের। একটা অতিকায় বিরাট অমানুষিক মূর্তি। চাপা উল্লাসের লক্ষণ তার সর্বাঙ্গে। বিজয় এ মানুষটাকে চেনে না। মানুষটার কথাও বুঝল না। একটুও অনুভব করতে পারল না তার উল্লাস।

মেঘনাদ বলল, কিন্তু এখুনি নয়। এ তো আমার সারা জীবনের কথা হে। কিন্তু বলল, এ বিষয়ে আমাকে কে দুটো কথা বলে একটু সাহায্য করবে। কে একটু পরামর্শ দেবে, একটু দেখবে শুনবে? যার কথা বলল, আমি তার কাছেই যাব।

কী বুঝলে বিজয়, জানিনে। সে হঠাৎ দৃঢ় গলায় বলল,  বিনচৌ ছাড়া এখানে আর কারও কথা তো আমার মনে হচ্ছে না বোনাই। সে যদি সত্যি সত্যি তোমাকে দেখে, তা হলে তোমার ভাল বই মন্দ হবে না।

মেঘনাদ বলল, লোকটাকে তো তাই আমার তেমন খারাপ মনে হল না। একটু বেশি বড় বড় বাই আছে লোকটার। বোধ হয় খেটে ব্যবসা করতে হয়নি তাকে তা-ই

বিজয় তখন অন্য কথা ভাবছে। গঙ্গার ধার থেকে তাদের কারখানাটা দেখা যায়। কারখানার চিমনির মাথায় দুটো লালবাতি জ্বলছে। একপাল শুয়োর ছড়িয়ে পড়েছে গঙ্গাধারে, আলো-আঁধারি আনাচে কানাচে।

মেঘনাদের মন্দির গড়ার কথা শোনার পর থেকে তার চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে, ওই চটকল কারখানা। বোনাইয়ের যন্ত্র কারখানা যদি মন্দির, তবে ওইটাও মন্দির। তারও বিরাট যন্ত্র। ওইটা যদি মন্দির, তবে তার সেবাইত নিশ্চয় কোম্পানি। আর পূজারী হল ওই ম্যানেজার, সেলসাহেব, কেরানিসাহেব আর লেবার অফিসার। তবে আমরা কী?

মুহূর্তে তার মুখ কঠিন হয়ে উঠল। দু চোখে জ্বলে উঠল ঘৃণার আগুন। ওই মন্দির তাদের দিবানিশি শুষছে। ফাঁক পেলেই ঠকাচ্ছে। কাজ নয়, যেন চোরাবালিতে চলেছে তারা পা টিপে টিপে, কখন ভরাডুবি হবে, সেই ভয়ে।

চকিত আলোয় সব অন্ধকার দূর হয়ে গেল তার চোখ থেকে। মনে মনে বলল, বুঝেছি, বোনাইয়ের এত খুশির কারণ বুঝেছি। বোনাইয়ের লোভ বেড়েছে। সে আজ আর অল্প তুষ্ট নয়। সে ওই কারখানার মতো মন্দির গড়ে, নতুন সেবাইত হতে চায়।

সে ডাকল, বোনাই।

মেঘনাদ তন্ময় ছিল নিজের ভাবনায়। তন্ময় ছিল, আপনার বেগে চলা ওই গঙ্গার মতো।

বলল, বলো।

: তা হলে আমাদের কারখানাটাও মন্দির।

হঠাৎ আন্দাজ করতে পারল না মেঘনাদ তার কথা। বলল, হ্যাঁ, তা তো বটেই।

বিজয় বলল, বুঝেছি বোনাই। আমরা শালা হাজারগণ্ডা ওই মন্দিরে পেষাই হই। তুমিও শয়তানের মন্দির গড়তে চাও।

হৃৎপিণ্ডে তীরবিদ্ধ পশুর মতো অস্ফুটে আর্তনাদ করে উঠল মেঘনাদ, না না।

বিজয় : তা-ই বোনাই, তা-ই। তোমাদের জাত আলাদা। বড় বড় কথা বলছ, পুজো, মন্দির। ছেলের সাবিত্রী ব্রত। তোমাদের মতো ধর্মিষ্টিরা কেন ওই মন্দির গড়ে, তা আমরা হাড়ে হাড়ে জানি। শালা, সেরে টাকার নেশা আর লোভ।

ব্যথা ও বিস্ময়ে দলা পাকিয়ে গেল মেঘনাদের মুখ। গোঁফজোড়া কাঁপতে লাগল। সে ডাকল, বিজয়।

বিজয় তবু বলে গেল, আমার মতো অনেক লোকেরা তোমার কারখানার একদিন মিস্তিরি হবে। তুমি আমার বোনাই, বোনের বর, তোমার যন্ত্রের কারখানা হবে। আমার শালা কত সুখ। কিন্তু বোনাই দোহাই মাইরি মন্দির বোলো না ওটাকে। বলির পাঁঠার মতো আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

বিজয়কে ভালবাসে মেঘনাদ। তার আর সহ্য হল না। বলে উঠল, শালা, তুই কী বলছিস।

ঠিক বলছি বোনাই। তুমি বলো, কারখানা হবে, তোক হবে। এক দিন তোমার কারখানার মজুরেরা ইউনিয়ন করবে, লড়বে। হায়রে শালা মন্দির। ঠিক বলেছ বোনাই। অমন খাসা মন্দির আর হয় না, সংসারে। মেঘনাদ চুপ। দু জনেই চুপ। আগে, মেঘনাদের কথা বুঝতে পারছিল না বিজয়। এখন বিজয়ের কথা বুঝতে পারল না মেঘনাদ। বুকভরা একটা দুরন্ত চিৎকার পথ না পেয়ে ফুলে ফুলে উঠতে লাগল। বিজয়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে তাকিয়ে রইল মধ্য গঙ্গার স্রোতের ঝিকিমিকিতে। চোখে তার বোবা বিস্ময় ও ব্যথা। টাকার নেশা, ইউনিয়ন, লড়াই…। বুঝল না কিছু।

আকাশে মিটি মিটি তারা, ধোয় আকাশে জ্বলছে সোনার বিন্দুর মতো। যেন টোকা দিলে বেজে উঠবে টিং টিং করে, ঘোঁৎ ঘোঁৎ করছে শুয়োরগুলি, দূরের খেয়াঘাট থেকে আসছে চাপা গুলতানি।

হৃদয়াবেগে দুজনেই সমান। মেঘনাদ ভাবল, সর্বস্ব পণ করে আমি যাত্রা করছি। কিন্তু এ কীসের তুলনা দিচ্ছে বিজয়। শয়তানের মন্দির। কেন, কেন? আমি পড়ে থাকব পেছিয়ে, মান্ধাতার আমলে। যা শুরু করেছিলাম, তার শেষ দেখব না ! এ কী আমার পাপের আশা। আমার এত সাধ, এত বাসনা। আমি কাউকে মারতে চাইনে, ডোবাতে চাইনে, ঠকাতে চাইনে। কিন্তু যন্ত্র দিয়ে। কারখানা গড়ব এক দিন পুরোমাত্রায়, আমার সেই সৌভাগ্য অপরাধ ! কেন, কেন?

যদি স্টিমার পাই, তবে কেন বৈঠা ধরে হাল টানি। সে না ফিরেই দৃঢ় গলায় বলল, বিজয়, তোমার কথা আমি সব বুঝলাম না। কিন্তু যা-ই বলো, ওই আমার চাই। যতদিন বাঁচব, খাটব, শুধু ওই জন্য। ঘরছাড়া হয়েছি, সর্বস্ব নিয়ে এসেছি। লোভ বলল, নেশা বলল, যা বলল, পলে পলে খেটে খেটে ওইখানেই যেতে চাই। মরবার আগেও। সে-ই আমার সুখ। আমার চিরকালের আশা।

বিজয় কী দেখল মেঘনাদের মুখে, কথা বলতে পারল না। পাপ লোভ নেশা, কিছুই দেখতে পেল না তার মুখে। বরং সেই সুদূর দিনের আশার আবেগটাই আবার এসেছে ফিরে। মুখ ভরে উঠেছে স্বপ্নে।

সে কী বুঝল কে জানে। নিজের সংশয় ও জ্বালাকেই চাপা দিল সে। বলল, বোনাই, খুব রাগ করেছ?

: না। তুমি এত কথা বললে, আমি আমার দোষ ধরতে পারলাম না।

মেঘনাদের অস্পষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত আবার চুপ করে রইল বিজয়। তার কথা কি বোনাই একেবারেই বোঝেনি। আশ্চর্য ! বলল, বোনাই, কী কথা যে বলেছি, তা বোধ হয় নিজেই শালা ভাল বুঝিনে। ঘর পোড়া গরু কিনা তাই অমন ফোঁস ফোঁস করে উঠেছি। তোমার সে দিনের তো দেরি আছে এখনও।

: হ্যাঁ, বুঝি অনেক দেরি।

: আসুক সেদিন। সেদিন যদি মাইরি তোমার প্রাণটা এমনি থাকে, তবে বেঁচে যাই। তারপর এক মুহূর্ত নীরবতার ফাঁকে, সে দিনের ছবিটা ভেসে উঠতে লাগল। তারই সঙ্গে, বাপ মা ভাই বোন, এমনকী লীলা, যাকে নিয়ে বোনাইয়ের প্রাণে হয়তো কিছু ব্যথাও আছে, সকলের একটা পালটা ছবি দেখা দিল। হঠাৎ বলল হেসে, দেখো বোনাই, সেদিন যেন আমার দিদি, তোমার কালো বউটাকেও ভুলে যেয়ো না।

মেঘনাদ হেসে উঠল। হাসতে হাসতে, হঠাৎ ব্রেক কষার মতো চাপা শব্দে থেমে, দাঁত খিচানো যন্ত্রের মতো বিকৃতমুখে বলল, ভাই তোমার দিদির কালো মুখ কোনওদিন পাইনি। যদি কালো পায়ে একটু ঠাঁই পাই, মেঘু সা’র তা-ই অনেক ভাগ্য।

বলে আবার হেসে উঠল। তীব্রস্বরে চিৎকার করে উঠল একটা শূকরী। পর মুহূর্তেই একটি বিচিত্র জাদু মাখানো সুর ভেসে এল, হা-হুঁত্ ! হা-হুঁত্ !..সেই শব্দে উত্তীর্ণ হয়ে উঠল জানোয়ারগুলি। জান্তব সোহাগে নাক দিয়ে কোঁৎ কোঁৎ শব্দ করে সেই স্বরের দিকে এগুতে লাগল। ডাক পড়েছে ওদের পালকের !

গঙ্গা ছলছল করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *