২.৫ বাথানের প্রত্যাবর্তন

০৮১.

বাথানের প্রত্যাবর্তন

বাঘারু এখন তার পুরো বাথান নিয়ে ফরেস্টের চড়াই ছেড়ে নদীর বুকে নেমে আসছে অতি দ্রুত। বুড়িয়ালের পিঠে সে বাথানের প্রায় শেষে। হাঁটু মুড়ে বসে সে একবার ডাইনে, একবার বায়ে, আর-একবার সামনে; শুধু জিভ আর টাকরায় আওয়াজ করে যাচ্ছে–টররর-অ, টররর-অ, টর বর-অ। আর সেই আওয়াজের সঙ্গতিতে সমস্ত বাথান যেন একটা সৈন্যদলের মত সোজা চলে যাচ্ছে বনবাদাড় গাছগাছড়া ভেঙে, ঢাল বেয়ে। ওরা উঠেছিল পাহাড়ের ডান দিক বেয়ে। নামছে পাহাড়ের বা ঢাল দিয়ে। বুড়িয়াল বুঝে যায়, বাথানকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যেতে হবে। সে মাঝে-মাঝে গলাটা সোজা তুলে আকাশে আওয়াজ ছাড়ে-আঁ আঁ আঁ ক, আঁ আঁ আঁ ক! ভোখা, বুড়িয়ালের পাশে পাশে দুলে-দুলে ছুটে-ছুটে চলেছে। বাছুর চারটে মাঝে-মাঝে পেছিয়ে পড়ছে। প্রায় সব সময়ই আছে বাঘারু আর বুড়িয়ালের সামনে। আর, বাঘারু দুই হাত দুই দিকে তুলে বুড়িয়ালের পিঠের ওপর থেকে পুরো বাথানকে তাড়া দিচ্ছে, টররর-অ, টরর-অ।

ঝটত করি চল, ঝটত করি, গিরহন আসিছে, গিরহন, আকাশখান অন্ধকার হয়া যাবে, পাখির দল সঝা হইবার আগত ঘরত ফিরিবেন। বাঘা, হাতি, গণ্ডার আতির (রাত্রির) আগত বাহির হইবার ধরিবে, দিন ফুরিবার আগত বনত আতি নামি আসিবে, টররর-অ, টররর-অ।

বুড়িয়াল এগতে পারে না। সামনের মোষগুলো দাঁড়িয়ে গেছে। গলা উঁচু করে বুড়িয়াল দেখে, কী ব্যাপার। তার শিং ধরে বাঘারু উঠে দাঁড়ায়। দাঁড়াতে হল বলে ভোখা ঘেউ-ঘেউ করে ডেকে ওঠে। কিন্তু তার পরই আবার পায়ে-পায়ে চলা শুরু হয়। গতিটা কমে যায়। বাঘারু বুড়িয়ালের পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে বাথানের মুখের দিকে দৌড়ায়। ভোখা সঙ্গে সঙ্গে তার পিছে ছোটে। বাথান একজোট হয়ে যাওয়ায় ভেতর দিয়ে চলার পথ বন্ধ। বাঘারুকে পাশ দিয়ে ছুটতে হয়।

বাথানের মুখ গিয়ে দেখে ঢালের যে-পাকটা দিয়ে বাথান ডাইনে ঘুরে এই ফরেস্ট আর তলায় নদীর বুকের মাঝখানের জঙ্গলটাতে ঢুকবে, সেখানে একটা বড় গর্ত হয়ে আছে। কিন্তু তাতে কোনো মোষ থেমে নেই। তারা পাশের সরু জায়গাটা দিয়ে সাবধানে পা ফেলে বায়ের মাটি পাথরের দেয়ালে গা ঘষে পেরিয়ে যাচ্ছে। সেই জন্যেই, যত জোরে নামছিল, তত জোরে আর নামতে পারে না। অনেকগুলো মোষ পার হয়ে গেছে। বাঘারু পেছন ফিরে একবার দেখে নেয় কতগুলো বাকি। কিন্তু যেগুলো পার হয়ে গেছে, সেগুলো যদি আলগা হয়ে যায়। আর এর মধ্যে গ্রহণের অন্ধকার শুরু হয়ে গেলে ওগুলো, ভয়ের চোটে এদিক-ওদিক হয়ে যাবে। গিরহনের ভয়, বড় ভয়। বাঘারু লোখাকে সামনের রাস্তাটায় আঙুল দেখিয়ে চেঁচায়, সিও সিও। ভোখা লাফিয়ে সেই গর্ত পেরিয়ে সামনে চলে যায়। ভোখাকে দেখিলে জানিবে বাঘারু আছে। বাঘারু গর্তটার দুদিকে পা দিয়ে দাঁড়ায়। তার পর যে মোষ পার হচ্ছে তার গা-টা একটু ঠেলে রাখে। তাতেই মোষগুলোর ভয় কেটে যায়–হয় বাঘারুর স্পর্শেই, আর নয়ত, ঐ গর্তের পাশে সামান্যতম সাহায্যেই ওদের পেরনোটা সহজ হয়ে যায়। ফলে, তাড়াতাড়িই পার হতে শুরু করে দেয়। পেছনে বুড়িয়ালের হকার শোনা যায়, আঁ আঁ আঁ ক। বাঘারু ঘাড় ঘুরিয়ে আওয়াজ দেয়, এই রো, অ-অ।

সেই পাড়া-টাকে বাঘারু আটকে দেয়। বাথানের মধ্যে থেকে এখন যদি কোনো গোলমাল পাকায়, সরু রাস্তায়? বরং ওটাকে তার সামনা-সামনি রাখা ভাল।

কিন্তু সেই পাড়া আর তার পরে বুড়িয়ালকে পার করাটা কঠিন হয়ে পড়ে। পাড়াটা তাও যদিবা হেঁচড়ে চলে যেতে পারে–বাঘারু তাকে অন্য দিকের চড়াইটার সঙ্গে ঠেলে ধরে রাখলে, বুড়িয়াল পারে না। তার পেটটা দুদিকেই এত বড় যে ঐ গর্তের পাশ-ঘেঁষা তার পক্ষে অসম্ভব। বাঘারু একবার চেষ্টা করে দুই হাতে সে বুড়িয়ালের একটা দিক তুলে দিতে পারে কি না। কিন্তু বুড়িয়ালের ওজন পাহাড়ের চাইতেও বেশি।

সবগুলো মোষ পেরিয়ে গেছে। সেই বাকের গর্তের সামনে শুধু বুড়িয়াল আর বাঘারু। বুড়িয়াল তার এতদিনের অভিজ্ঞতায় বুঝে যায়–পেছনে একটা কোনো বিপদের তাড়া আছে। বাঘারুর মনে একটা হিশেব খেলে যায়–বুড়িয়ালের ত বাথানে এমনি কোনো কাজ নেই। আর সে একা এখানে থাকলে বাথানের কোনো ক্ষতি নেই। কাল সকালে এসে বুড়িয়ালকে খুঁজে নিলেই হবে। বাঘারু বুড়িয়ালের পিঠে এমন ঠাণ্ডা হাত রাখে যেন সে হিশেব জানা হয়ে যায়। বুড়িয়াল আকাশে মুখ তুলে–আ-আ-আঁক রবে তার সেই ডাক ছাড়ে। বুড়িয়াল আকাশে মুখ তুললে মনে হয়, আকাশই ভেঙে পড়বে।

এদিকে বাথান নীচে নেমে যাচ্ছে। বাঘারু আকাশের দিকে তাকায়, গ্রহণ কি শুরু হয়ে গেল। সে লাফিয়ে ওপরে উঠে ছোটে-মোটা ডাল কয়েকটা পাওয়া যায় কি না। বুড়িয়াল অস্থির পায়ে আকাশে মুখ তুলে বাঘারুর দিকে ঘোরে।

বাঘারু হাতের নাগালে যেকটা ডাল পায়, নিয়ে দৌড়ে এসে গর্তটার ওপর ছড়িয়ে দিয়ে প্রায় শুয়ে পড়ে, দুই হাতে সেই ডালগুলোকে চেপে ধরে ক্যালভার্টের মত করে টাকায় আওয়াজ তোলে, টর–অ, টর–অ।

বুড়িয়াল তার সামনের ডান পাটা আগে দেয়। দিয়ে একটু অপেক্ষা করে। তার পর ডান পাটাকে আরো একটু এগিয়ে নেয়। নিয়ে আবার একটু অপেক্ষা করে। তার পেছনের ডান পাটা তখন গর্তের কাছাকাছি, আর সামনের বা পা মাটিতে শক্ত, পেছনের বা পা, শূন্যে, আর একটু আগে। বুড়িয়াল যেন বাঘারুকে আর-একটু সময় দেয়। ডালগুলোকে আরো জোরে সেঁটে রেখে বাঘারু এবার তার শেষ সঙ্কেত দেয়, টররর-অ, টররর-অ। সঙ্কেত শেষ হতে না-হতেই বুড়িয়ালের সামনে ডান পা-টা যেন পিছলে পেরিয়ে যায় আর পেছনের ডান পাটা ডালগুলোকে ছুঁয়ে কি না ছুঁয়ে চলে যায়।

বাঘারু লাফিয়ে উঠে আসে। বুড়িয়াল দাঁড়িয়েছিল। তার পিঠের ওপর দুই হাত দিয়ে বাঘারু শরীরটাকে ঝোলাতেই সে চলতে শুরু করে দেয়। বাঘারু তার পর বসতে পারে। বুড়িয়াল যতটা সম্ভব ছুটতে শুরু করে। বাথানের বেশি দূর যাওয়ার কথা নয়। বাঘারু একবার তারস্বরে চিৎকার করে ওঠে, হে-এ-এ লোখা। তার চিৎকার শেষ হওয়ার আগেই বুড়িয়াল তার গলা আকাশে তুলে হকার দেয়-আ-আ-আঁক। জবাবে ভোতার ডাক শোনা যায়, কাছেই, বোধহয় বাক দুই নীচে। এখন ত জঙ্গলে নেমে গেছে। ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে নদীর বুকটাও মাঝে-মধ্যে দেখা যাচ্ছে। বাঘারু আকাশে তাকিয়ে দেখে, তার সামনে পশ্চিমের পাহাড়ের ওপরে সূর্যটা আর গোল নেই, চাঁদের নাখান খাওয়া গিরহন নাগি গেইল, গিরহন নাগি গেইল, টর বর-অ, টর বর-অ, বুড়িয়াল তার গতি বাড়ায়, যতটা সম্ভব।

সূর্যের দিকে তাকানোর ফলে বাঘারু চোখে অন্ধকার দেখে, কিছু দেখতে পায় না। চোখ বন্ধ করে ফেলে, আন্দাজে বুড়িয়ালের শিং দুটো খোঁজে, ধরতে। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গেই মনে হয় এই সময় শিং ধরলে বুড়িয়ালের নামার অসুবিধে হবে। বুড়িয়াল কানের ঝাঁপট মেরে বাঘারুকে আশ্বাস দিতে থাকে, আর তার দুলুনি বাড়ে।

চোখ বন্ধ রেখেই বাঘারু আ-আ-আঁ– ডাক শুনতে পায়। সে চোখ খুলে ফেলে। একটু অস্পষ্ট, কিন্তু দেখা যাচ্ছে। একটা মোষ ডাকছে। একটা? নাকি পর পর? লোখা? ভোখার ডাক নেই। তা হলে কি ওরাও সূর্যের গ্রহণ দেখে ফেলেছে? বাঘারু জানে সেটা অসম্ভব। আবার সেই আ-আ-আ ডাক। একার। ঐকিয়া (একা) কুন মহিষ ডাকিবার ধইচছে এ্যালায়? পড়ি গেইসে? বাঘারু সামনে দেখতে পায় তোখা দাঁড়িয়ে, গলা উঁচু করে খাড়া, কিন্তু লেজ নাড়ছে। ভয় পায় নি। কিন্তু, কিছু একটা ঘটিছে, ভোখা বোবা বনি গেইছে, তয়? তয়? হঠাৎ বাঘারুর সন্দেহ জায়ে, পোয়াতিটার বাচ্চা হওয়া ধরিল, নাকি? এ্যালায়?

.

০৮২.

বাথানে জন্ম

বকটা ঘুরেই বাঘারু দেখে যা ভেবেছে, তাই। সেই ভর-পোয়াতি মইষানি পেছনের দুই পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে আর তাকে মাঝখানে রেখে দুই পাশে অন্য মোষগুলো সারি দিয়ে। কয়েকটা মোষ হয়ত আগে নেমে গেছে। এখান থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে নদীর বুক, ব্রিজ, বাঘারুর সেই পাথর। আর দু-একটা বাক নামলেই তারা নদীতে নেমে যেতে পারত।

বুড়িয়ালের পিঠ থেকে লাফিয়ে নামতে-নামতে বাঘারু একবার দেখে নেয় বাইরে আলোর রঙ মরে এল কিনা। সূর্যে যে গ্রহণ লাগতে শুরু করেছে তা বাঘারু দেখেইছে। আলো মরে আসবে আরো পরে। ছায়া লম্বা হতে-হতে একেবারে কোথায় মিশে যাবে। কিন্তু এখনও শেয়াল বা মোরগ ডেকে ওঠে নি। কোনো রকমে কি ওটাকে আর-দুটো বাক ঠেলেঠুলে নেয়া যায় না? অন্তত নদী পর্যন্ত?

বাঘারু দৌড়ে মইষানিটার কাছে ছুটে যায়। সেটা ঘাড় ঘুরিয়ে আবার সেই একা-ডাক ডাকে। বাঘারু ওর গায়ে, গলায়, মুখে হাত বুলিয়ে পেছনে এসে দেখে, আ-আ-আ, খাইসে, খাইসে, বাছুরের মাথাখান দেখা যাছে, চাদিখান দেখা যাছে। বাঘারু দৌড়ে গিয়ে কিছু গাছগাছড়া ছিঁড়ে এনে তলায় ছড়িয়ে দেয়। বুড়িয়াল এগিয়ে এসে উঁচু থেকে তার সেই মস্ত গলাটা পশ্চিমের পাহাড়ের মাথার দিকে বাড়িয়ে থাকে–যেন পাথরের তৈরি। তার নীচে সেই মইষানি মাটিতে পেছনের পা দুটো ঠুকে আ-আ-আঁ করে আকাশজোড়া ডাক তোলে। বাঘারু তার সেই দুই হাতে মইষানির পা দুটো আরো ফাঁক করে দিয়ে, তার পেছনটা দুই হাতে দুই দিকে ঠেলে ধরে। সেই ফাঁকটা সম্পূর্ণ জুড়ে যায় বাছুরের ছোট গোল মাথায়। মইষানি আবার একটা ডাক দেয়; আঁ-আঁ-আঁ, আর তার সামনের পা দুটোতে ভর দিলে ঘুরে যেতে চায়। বাঘারুর জন্যে পারে না। ফাঁকটাকে আরো একটু বড় করে দিয়ে বাছুরের মাথাটা আরো একটু বেরোয়। কিন্তু এখন বাঘারু ছেড়ে দিলে মাথাটা আবার ভেতরে চলে যাবে। বাঘারু তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিলে বাছুরের বেরুবার পথটা আরো একটু ফাঁক করে দিতে চায়, যাতে, বাছুরের মাথাটা অন্তত এইটুকু বেরিয়ে আসে যে সে দুই হাতে সেটা ধরতে পারে। একবার ধরতে পারলে বাঘারু টেনে বের করে আনবে।

ততক্ষণে মইষানির দুই পা বেয়ে রক্ত, জল, আর শ্লেষ্ম গলে-গলে পড়ছে। বাঘারুর দুই হাতের কব্জি থেকে সেই তরল পদার্থ হাত গলে কনুই পর্যন্ত গিয়ে টপ টপ মাটিতে পড়ছে। বাঘারু তার দুই হাতের জোর রাখার জন্যে নিজের দুই পা ফাঁক করে মাটিতে দাঁড়ায় আর সামনে তাকিয়ে দেখে, নদী ও ফরেস্টের ওপর এখনো ছড়ানো আলোতে ছায়া লেগে গেল কি না। চকিতে একবার ভেবে নেয় বাঘারু, বাথানটাকে ঠেলেঠুলে নীচে পাঠিয়ে দেবে কি না, দেখাই ত যাচ্ছে এখান থেকে, সঙ্গে ভোখা যাক, কায়কায় ত চলিও গেইছে। দুই হাতে মইষানির পেছনটা ফাঁক করে ধরে রেখে বাঘারু দুই পাশে তাকায়–তোখা পর্যন্ত চুপচাপ লেজ নাড়ায়, বুড়িয়াল পর্যন্ত খাড়া, সারাটা বাথান সিধা গলা খাড়া করি আছে, ঘাসেও মুখ দেয় না, হকারও তোলে না। এ্যালায় ত বাথানখান বাথান হওয়া ধরিছে। একটা পোয়াতি মইষানি বাছুর দিবা ধইচছে। এইখান ত একোটা কেনা বাথান। গয়ানাথ কিনিছে। এই হাট ঐ  হাট ঘুরিঘুরি কিনিছে। বুড়িয়ালখান কেনা। বুড়া বঁড় কেনা। ওয়ালিখান কেনা। তার বাদে ত বাথানও বাছুর হওয়া ধরি। বাছুর হওয়া ধরিলে বাথান বাড়িবে। বাথান চালু থাকিবে। বাছুর হবা ধরিছে। বাছুর। বাথানত বাছুর।

ততক্ষণে মইষানির পেছনের ফাঁকটা বাছুরের মাথায় সম্পূর্ণ ভরে গেছে। এখন বাঘারু ছেড়ে দিলেও, মাথাটা আর ভেতরে ঢুকে যেতে পারবে না। বাঘারু তার বা পা দিয়ে মইষানির তলপেটে একটা ছোট্ট গুলো দেয়, কোথন দে, কোঁথন দে, দে।

সেই গুঁতোতে মইষানি আঁ-আঁ-আঁ-আঁ আর্তনাদ করে ওঠে। সামনের পা দুটো দাপায়। এই মইষানিটা যত চেঁচায় তার গলাটা তত লম্বা হতে থাকে। অন্য মোষগুলো চেঁচায় না, কিন্তু তাদের গলাও ক্রমেই লম্বা হয়। এখন এই জঙ্গলের ভেতর বাঘারুর বা দিকে বুড়িয়ালের বিরাট লম্বা বাড়ানো গলা আর ডাইনে সারি দেয়া মোষের দলের বাড়ানো গলার সারি, আর সামনে তলার সেই নদীর বুক–বাঘারুর মনে হয়, এ্যালায় নাগি যাবে গিরহন, এ্যালায় নাগি যাবে। গেলে যাবে, সেটা আর তত বিপদের নয়। কারণ ফরেস্টের ভেতর থেকে ত সে বেরিয়ে আসতে পেরেছে–কিন্তু এমন জায়গায় মোষের পালটা যদি এলোমেলো হয়ে যায়।

বাছুরের মাথা আরো খানিকটা ঠেলে এসেছে, কিন্তু এখনো বাঘারু দুই হাতে মাথাটা ধরতে পারবে না। বাঘারু তার ডান হাতের তর্জনী দিয়ে মইষনির ফাঁকের চামড়াটা একটু টেনে দেখে। তারপর দুই হাতের তর্জনী আর মধ্যমা মইষানির ফাঁকের ভেতর ঢুকিয়ে দিতে চেষ্টা করে। চামড়ার তলার দিকটা দিয়ে আঙুলগুলো ঢুকিয়ে চাপে বেঁকিয়ে দিতে হয়। মইষানির চামড়া ছিঁড়ে যেতে পারে। গেলে যাবে। এখন সেসব টের পাবে না। দুই হাতের চারটে আঙুল একবার ভেতরে ঢুকে গেলে বাইরের দুই বুড়ো আঙুল বাছুরের মাথায় লাগিয়ে বাঘারু মাথাটা সাড়াশির মত চেপে ধরে।

চেপে ধরেই থাকে। টানে না। একবার পিছলে আঙুল বেরিয়ে এলে আবার ঢোকানো মুশকিল। সেই আন্দাজ বাঘারুকে ধীরেসুস্থে নিতে হয়, ধরা ঠিক হয়েছে কি না, পিছলে যাবে কি না।

নিশ্চিন্ত হয়ে বাঘারু এবার ধীরে-ধীরে টানতে শুরু করে। ধীরে ধীরে টানের জোর বাড়ায়। ধীরে-ধীরে। এখন বাঘারু হাতের দুই তালুর ভেতর মাথাটাকে পেয়ে যায়। তাই তাকে আবার ঠাহর করতে হয় হাত পিছলে যাবে কি না। এখন হাত একবার পিছলে গেলে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে হবে–যখন বেরবার বাছুরই বেরবে। বাঘারু যখন নিশ্চিন্ত হয় যে তার দুই হাতের মুঠোর ভেতর বাছুরের ঐ একটুখানি মাথা পুরো সেঁটে আছে সে তখন ধীরে ধীরে শরীরের সবুটুকু জোর দিয়ে বাছুরটাকে টানে। বাঘারুর যেন হিশেব আছে, কখন, কত ধীরে, আর কখন, কত তাড়াতাড়ি, টানলে, পেটের ভেতরের আস্ত একখান বাছুর জলেরক্তে ভিজি বাহির হয়্যা আসি দুই ঠ্যাঙত খাড়া হবার পারে। সেই মুহূর্তে আকাশে, লক্ষ-লক্ষ গ্রহনক্ষত্রের অসংখ্য আকর্ষণ-বিকর্ষণে তৈরি অগণন কক্ষপথের সাপেক্ষতায় সূর্যের যে আঁধারপাত ঘটে যাচ্ছিল সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশের নির্ভুল মাপে, বাঘারুর হাতের মাপ ছিল তার চাইতেও নির্ভুল।

মাথার অনেকখানিই বেরিয়েই এসেছিল। বাঘারু এখন কপাল পেয়ে যেতে পারে দুই হাতের মুঠোয়। বাছুরের শরীরের আর এই মইষানির পেটের প্রত্যেকটা খুঁজ বাঘারুর এমনই জানা যে সে বা হাতটাতে বাছুরের ঘাড়টা ধরে একটু কোনাচে করে নেয় আর ডান হাত দিয়ে মাথাটাকে একটু বায়ে ঘোরাতেই কপাল পেয়ে যায়। মাথা মানেই ত ঘাড় আর কপাল। বাঘারু বা হাতে ঘাড়টা চেপে রেখে, ডান হাতে কপালটা ধরে একবার তলার দিকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে, পরের ঝাঁকুনিতেই ওপরে ঠেললে কপালের হাড়টা.আরো খানিকটা বেরিয়ে আসে। বাঘারুর ঝাঁকুনিতে মইষানি পেছনের একটা পা হড়কে যেতে চায়। কিন্তু সে গেলে যাক, বাঘারু ত এখন তার মুঠো আলগা করবে না। সে মাটির ওপর দুই গোড়ালির চাপ দিয়ে তার শরীরটার ঝোঁক পেছনে ফেলে দুই হাতে ঘাড় আর কপাল ধরে বাছুরের মাথাটা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে চোখের ওপরের হাড়, চোখের পাশের হাড়টা বের করে আনতেই–এটাই মুখের শেষ বাধা-সড়াৎ করে বাকি সরু মুখটা গলা পর্যন্ত বেরিয়ে আসে আর মইষানির পেছনে বাছুরের মাথা ঝুলে থাকে। মইষানি একটু হাল্কা বোধ করে ফেলে হয়ত, সে তার পেছনের একটা পা সরাতে যায়–আর ফাঁক করে থাকতে পারে না। বাঘারু মুহূর্তের সময়ও দেয় না। বা হাতে বাছুরের মাথাটা ধরে রেখে ডান হাতটা তার গলার ফাঁক দিয়ে মইষানির ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। আঙুল নেড়ে দেখে নেয়, মইষানির ভেতরে বাছুরের সামনের পায়ের ভাঁজ ঠিক আছে কি না। তার পর ডান হাতটা দিয়ে পা দুটোকে ভেতরে চেপে দুই হাতে আবার সেই টান দেয়, ধীরে-ধীরে, কিন্তু নিশ্চিত, বাঘারু পুরো শরীরের ওজন ঝুলিয়ে যেন বাছুরটাকে টেনে বের করে আনবে।

আড়িয়া (ওঁড়ে) বাছুর হলে এই সামনের পা আর কাঁধের জায়গাটাই সব চেয়ে চওড়া আর গাই বাছুর হলে পেছনের পা আর কোমর। বাঘারু বাছুরের মাথাটা ছেড়ে বা হাতটাও ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়, কিন্তু বেশি ভেতরে না, একটু ঢোকাতেই সে ঘাড়টা পেয়ে যায়। বাছুরের মাথাটা বাইরে ঝুল ঝুল করে। আর বাঘারু ডান হাতে মইষানির পেটের ভেতরে সামনের পা দুটো-লেগে-থাকা বুক আর বাইরে বা হাতে, ঘাড় ধরে, মাটিতে দুই গোড়ালির ঠেকনো দিয়ে, ঝুলে পড়ে। মইষানির গলা দিয়ে কেমন একটা গো গো আওয়াজ বেরয়। বাঘারুর বা হাতের আঙুলের গিঠটা মইষানির ফাঁকটাতে ঠেকে যেতেই সে প্রায় একই সঙ্গে বা হাতটা ঘাড় থেকে খুলে আঙুলগুলো সোজা করে টেনে বের করে আনে আর ডান হাতে পুরো টান দেয়। সড়াৎ করে ঘাড়টা বেরিয়ে আসে আর বাছুরের মাথাটা আরো ঝুলে যায়। সড়সড় করে বাছুরের ঘাড়বুক-পা নেমে আসতে থাকে, প্রায় মইষানির হাঁটু পর্যন্ত ঝুলে পড়ে। কিন্তু সামনের পা দুটো সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসার আগেই বাঘারু বা হাতে ঘাড়টা ধরে আটকে দেয়–যেভাবে গড়িয়ে নামছে, পেছনের পা যদি আটকে যায়। বাঘারু ডান হাতটা আবার ভেতরে ঢোকায়। তখন বাছুরের শরীরটাই নীচে নামার টান পেয়ে গিয়েছে। হড়-হড় করে নীচে নেমে যাচ্ছে। বা হাতে সেটাকে একটু ঠেকিয়ে বাঘারুর ডান হাতে বাছুরের পেছনের পা দুটো একবারেই মুঠো করে ধরতে পারে। তার পর সেই দুই পা ধরে হিড়হিড় করে টেনে নামাতে থাকে। কোমরের হাড়টায় ঠেকে যায়। কিন্তু ততক্ষণে পেছনের পা দুটোর পাতা বেরিয়ে গেছে। একটা ঝাঁকি দিতেই বাছুরের পুরো পেছনটা বেরিয়ে সেই থলির মধ্যে ঝুলতে ঝুলতে নীচে ঘাসের ওপর। বাঘারু হাত দিয়ে বাছুরটাকে শুইয়ে দেয়। মইষানির পেটের ভেতর থেকে ঝিল্লির থলি, জল, রক্ত বেরিয়ে আসতে থাকে।

.

০৮৩.

 বাথানে আরো একজন

মইষানি তখন থরথর করে কাঁপছে আর বারবার মুখটা পেছনে নিয়ে আসতে চায়। কিন্তু কেন যেন আনে না। বাঘারু এবার সামনের দিকে তাকায়–রোদে কি ছায়া লেগেছে? বাঘারু পশ্চিম পাহাড়ের দিকে তাকায়। পাহাড়ের ছায়াটা কেমন অদ্ভুত ঠেকে, যেমন বাঘারু কখনো দেখে নি। বাথানও তেমনি কিছু বুঝে ফেলে কি না, কে জানে। হঠাৎ অনেকগুলো মোষ একসঙ্গে ডেকে ওঠে। মাটিতে পা ঠোকার আওয়াজ তোলে। ভোখা এতক্ষণ পরে আকাশে মাথা তুলে একটা লম্বা টানা ডাক শুরু করে, বুড়িয়াল তার বিরাট কান দুটো দিয়ে একবার ডান, আর-একবার বা পিঠ ঝাড়ে। গিরহন নাগি গেইল রে, মোর বাথানঠে গিরহন নাগি গেইল।

বাঘারু আর মুহূর্ত দেরি করে না। সে দুই হাতে মইষানির পেটের ভেতর থেকে ঐ রক্ত জলময় লম্বা থলির বাকি অংশ টেনে বের করে। ফুল পড়িল? না, না পড়িল? তার পর নাড়ীটা ছিঁড়ে একটা গিট দিয়ে বাঘারু বাছুরটাকে আলাদা করে ফেলে। ততক্ষণে বাছুর তার পা চারটে মেলে ঘাড়টা তুলছে আর ফেলছে। বাঘারু টাকরায়  টর, টর-অ দিয়ে দেয়। সামনের মোষগুলো চলতে শুরু করে দেয়। কিন্তু ওদের শিংগুলো তোলা, লেজটা শক্ত। ডর খাছে? ডর? মোর বাথানত গিরহন আসি গেইল রে, আসি গেইল। বাঘারু টাকরায় আবার আওয়াজ তোলে, টরররর-অ, টরররর-অ, মুখে আওয়াজ দেয়, ঝট কর, ঝট কর, হেঁট হেঁট, টর–অ।

এইসব করতে করতে বাঘারু বুড়িয়ালের গলাটা শুধু একবার ছুঁয়ে দিতে পেরেছে। তাতেই বুড়িয়াল বোঝে তার কিছু করণীয় আছে। সে কয়েক পা এগিয়ে আসে। বিয়ানি মইষানি বাছুর দেখতে না পেয়ে। আঁ আঁ আঁ করে কেঁদে ওঠে।র কেনে। কান্দিবার ধরিস বাদে। বাঘারু দুই হাতে কিছু ঘাসপাতা ছিঁড়ে এনে বাছুরের শরীর থেকে ক্লেদটা মুছে দেয়, মাত্র একবারে যতটা পারে। তার বাথান রওনা দিয়ে দিয়েছে। বাঘারু দুই হাতে বাছুরটাকে কোলে তুলে নেয়। তখনো ত বাছুরটা গর্ভের ভেতরে যেমন ছিল, সেই ভঙ্গিতেই চার পা এক করে ঘাড় নুইয়ে গোল পাকিয়ে আছে। সবে দু-একবার ঘাড়টা তুলেছে মাত্র। এখন বাঘারুর দুই হাতে বাঘারুর বুকের ভেতরে সে সেভাবেই থাকে। যেন বাঘারুর বুক তার দ্বিতীয় গর্ভ। বাঘারু কোলে করে, বুকে করে, দুই হাতে উঁচু করে, বাছুরটাকে তুলে নেয়। নিয়েই বুড়িয়ালকে পায়ের ধাক্কায়,  টর-অ দেয়। বুড়িয়াল চলতে শুরু করে। বাঘারু বাছুরটাকে বুকে করে বুড়িয়ালের পাশে-পাশে ছুটতে শুরু করে। ততক্ষণে বিয়ানি মইষানিটাকে ছাড়িয়ে বুড়িয়াল এগিয়ে গেছে। আর বিয়ানি মইষানি বুড়িয়ালের পাশে-পাশে পিছে-পিছে ছুটতে-ছুটতে জিভ বের করে বাঘারুর কোলে বাছুরটার গায়ের যেটুকু পাচ্ছে সেটুকুই চাটছে। তাতে বাঘারুর হাতের অনেকটা চাটা হয়ে যায়।

টর-অ, টররর-অ করে বাঘারু বুড়িয়ালের ডান পাশ দিয়ে ছুটতে থাকে। পুরা বাথান নামি যাছে এ্যালায়, চল, চল, গিরহন নাগিছে, গিরহন নাগি গিসে। চি-ই-রো চি-ই-রো আওয়াজে এক ঝাক পাখি বনের ভেতর থেকে উড়ে এসে, সামনে কোনো অনির্দিষ্ট আশ্রয়ের দিকে ছুটে যেতে গিয়ে, এই দলটাকে দেখে, আচমকা পাক খেয়ে বাঘারুর কোলে সেই নতুন বাছুরের দিকে নেমে, আবার উঠে, বুড়িয়ালের ওপরে একটু নিচু হয়ে, নদীর ওপরে চলে যায়।

গিরহন, গিরহন, পাখিরা বাহির হয়্যা যাছে। ঠুকরিবার পারে, বাছুরক ভোখা, ভোখা। ভোখা পেছন থেকে বাঘারুর ছুটন্ত দুই পায়ের ভেতর মুখ ঢুকিয়ে দেয়। বাঘারু ছুটতে-ছুটতে বুড়িয়ালের পিঠের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে ভোখাকে বলে, উঠ, উঠ। বলতে বলতে একটু নিচু হয়, হাঁটুটা ভাজ করে। ছুটতে-ছুটতেই ভোখা বাঘারুর নোয়ানো পিঠের ওপর সামনের দুই পায়ের ভর দিয়ে ওঠে, আর বাঘারু সোজা হতে-হতে লোখা টক করে বুড়িয়ালের পিঠের ওপর উঠে যায়। নিজের পেছনের পা দুটোর ওপর টান-টান বসে পড়ে আকাশে মুখ তুলে ঘেউ-ঘেউ করে পাখি তাড়াতে শুরু করে দেয়।  ট র-অ-অ-অ, টর–অ-অ-অ বাথানের একেবারে শেষে বাঘারু, গিরহন নাগি গেইসে, গিরহন নাগি গেইসে, নামি চলল, নামি চললা, ট–অ-অ-অ, ট র-অ-অ-অ।

বাঘারু প্রায় যেন পৌঁছে যায়। সোজা নেমে গেলে ত আর কয়েক পা। তার পর নদীর ভেতর দিয়ে হেঁটে সেই তাদের বাথানের জায়গাটায় পৌঁছতে পারে। কিন্তু বাঘারুদের আর নদীর মাঝখানে এখন সেই খোপ (ঘন ঘাসের জঙ্গল), এ্যালায় তাড়াহুড়ায়, বাথান নিয়া নামা না যায়, হয়ত ভেতরে কোথাও কোনো পাথর আলগা হয়ে আছে, পা দিলেই পিছলে যাবে, বা, ঘাসে ঢাকা গর্তে পা আটকে যাবে। তার চাইতে সোজা যাওয়া ভাল, কে বাঁক ঘুরে। টর–অ-অ-অ, টর–অ-অ-অ।

আলোতে কতটা গ্রহণ লাগল মাপতে বাঘারু ছুটতে-ছুটতে তাকায়। অকাল-গোধূলিতে পশ্চিম পাহাড়ের এক অচেনা ছায়া ডায়না নদীর চরটাকে কোনাকুনি অন্ধকার করছে। সেই দুধের গাড়ি আসে দক্ষিণ-পচ্চিম পাকের যে-জঙ্গল দিয়া, এই একটু উঁচু থেকে দেখা যায়, সেই জঙ্গলের মাথাখান জুড়ি হে-ই মাইল-মাইল ছায়া ছড়ি যাছে হে, ছড়ি যাছে। আলোত কালি নাগি গেইসে, নাগি গেইসে, আন্ধার, আন্ধার, গিরহন, গিরহন–

বাঘারু শেষ বাক নেয়।

পাশে বুড়িয়াল! বাঘারুর কোলে নতুন বাছুর–জলে রক্তে-শ্লেষ্ময় জড়ানো। একবার ঘাসটাস দিয়ে বাঘারু মুছিয়েছিল বলে ঘাস-লতা-পাতা শরীরে সেঁটে আছে, যেন সে-সব জন্মচিহ্ন, ছিটোয়াল মহিষ। বুড়িয়ালের পিঠে খাড়া বসে ভোখা টানা ঘেউ-ঘেউ ডেকে যাচ্ছে। বুড়িয়ালের ধায়ে সেই বিয়ানি-মইষানি–যার বাছুর। বুড়িয়ালের একটু পেছনে, গা ঘেঁষে ছুটতে ছুটতে চলেছে, তার গলাটা লম্বা বাড়িয়ে বাছুরটাকে যতটুকু পারে চাটছে। মইষানির পেছন, পেছনের দুই পায়ের ভেতর দিক, রক্তেজলে থকথক করছে। বুড়িয়ালের ডাইনে বাঘারু। ছুটতে-ছুটতে কখনোও বুড়িয়ালের গায়ে, ধাক্কা লাগে। বুড়িয়াল যেন নতুন বাছুরসহ বাঘারুকে চলমান ঢাকা দিয়ে রেখেছে। ওপর থেকে কিছু, পা থেকে কিছু নতুন বাছুরের ওপর চাপ পড়ে। বাঘারুর থুতনি গলা-বুক-পেট, আর বগল থেকে আঙু পর্যন্ত দুই হাত রক্তেজলে ল্যাদল্যাদ করছে। এই রকম করে ছুটতে ছুটতে ওরা নদীর পাথুরে বুকে ঢুবে যায়।

.

০৮৪.

পাখোয়াল পর্ব : আর-এক বৃত্তান্তের শুরু

সূর্যের আলো ধীরে ধীরে কমে আসে। জঙ্গল, পাহাড়, পাথরের ছায়াগুলি বদলে যেতে থাকে। আলোতে নরম রঙ লাগে। ডায়নার বুকে অসংখ্য নুড়ি-পাথরের অজস্র রঙের ছায়া লম্বা থেকে লম্বা ছড়িয়ে যায়। কোনো সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তে রঙের এমন কৌণিক প্রপাত ঘটে না। ডায়নার বুকে নুড়ি-পাথরের এইসব রঙিন ছায়ার ওপর বিরাট ছায়াবান পাথরের কালো ছায়া পড়ে।

বাথান এখন বাথানের জায়গায়। কিন্তু কোনো মোষই বসে নি। গায়ে গা লাগিয়ে, গলায় গলা বাড়িয়ে সবগুলো মোষই থমথমে দাঁড়িয়ে যেন নিশ্চিন্ত নয়, তারা ফিরেছে কি না। যেন, তখনই তাদের আবার এখান থেকে সরে যেতে হতে পারে।

বাছুরটা ঐ বাথানের মধ্যে নড়বড়ে পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে আর পা ভেঙে ভেঙে পড়ে যাচ্ছে।

আলো আরো কমে, প্রায় অন্ধকার হয়ে এল। বড় বড় গাছের পাতা কোনাচে। আবছায়া গাছগুলো হঠাৎ লম্বা হয়ে যেতে থাকে। সূর্যের আলোর অভাবে বাঘারুর ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করে। সূর্যের দিকে তাকিয়ে দেখে, প্রায় পুরো সূর্যটাই অন্ধকার হয়ে আছে, সুতোর মত এক ফালি বাকি। গিরহন, গিরহন।

পূর্ণ গ্রহণের মুখে মোষগুলো গলা তুলে আঁ আঁ আঁ ডাকতে শুরু করে। লেজ-মাথা দুইই মাটির দিকে নামিয়ে লোখা কান্নার টানা সুর তোলে।

শুধু সেই নতুন বিষয়ানি মইষানি তার বাছুরের গা চেটেই যায়। আর বাছুরটা ঘাড় নড়বড় করতে করতে উঠে দাঁড়ায়। তারপর পা ঘাড় দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে পড়ে। আবার সোজা হতে শুরু করে। এই, এখনই ঘাড় তুলে কয়েক পা ছুটে যেতে না-পারলে যেন ওর জন্ম সম্পূর্ণ হয় না।

বনের ভেতরে ডাল থেকে পাখিদের ওড়ার পাখসাট। ঘাসবনে এক সার জোনাকি জ্বলে জলের মত ঘুরপাক খেয়ে যায়। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হরিণের মত কিছু একপাল ছুটে যায়। গ্রহণের আকাশের অন্ধকার থেকে ঝুপঝুপ নেমে আসে বাদুড়, উড়ে চলে যায়। শেয়াল আর বনমোরগ একসঙ্গে প্রহর ঘোষণা করে দেয়। তাতে, ভোখা মাটির দিকে মুখ নামিয়ে আবার কান্না শুরু করে। আওয়াজটা যেন মাটি খুঁড়ে ভেতরে চলে যাবে। গিরহন, গিরহন, গিরহন পুরা হয়্যা গেইল, পুরা হয়্যা গেইল–তারই পাথরের নীচে, বাথানের মাঝখানে বাঘারু তাকিয়ে আছে, দ্বিতীয় সূর্যোদয় শুরু হয় কখন তার অপেক্ষায়।

প্রথম বার বাঘারু খেয়াল করে না। দ্বিতীয় বারও, অত আওয়াজে যেন পরিষ্কার হয় না। কিন্তু তার পরের বার একেবারে স্পষ্ট, যেন বাঘারুর শোনার জন্যেই, তীক্ষ্ণও। সারাটা শরীর দিয়ে পাখিটা ডাকে, ক-অ-অক, ক-অ-অক। শেষেরটুকু শোনাই যায় না। গলা বুজে আসে। পাখোয়ালখান জঙ্গলের অনেক ভিতরত আছি। এ্যালায় গিরহনের আন্ধার দেখি ছুটি-ছুটি আসিবার ধইচছে। গাওখান ধোকপোকাছেবাঘারু তার না-দেখা পাখির শরীরের সেই বেপথু দেখতে পায়। পাখিটা আবার গাঢ় ও স্পন্দিত স্বরে কুহর দিয়ে ওঠে, ক-অ-অক।

বাঘারুর শ্বাস তখনো স্বাভাবিক হয় নি, ঘাম তখনো মরে নি। হাতপায়ের রক্তক্লেদ তার বোয়া হয় নি। দুটো রক্তমাখা হাত মুখের কাছে তুলে বাঘারু খুব চাপা স্বরে, গলা না তুলে পাখিটার ডাকে সাড়া দেয়। একবার।

পাখিটা আর সাড়া দেয় না। এ্যালায় চুপ করি গেইসে। চুপ করি বসি থাকিবে। বাঘারু আরো একবার ডেকে ওঠে, চাপা, তার ক্লান্ত শ্বাসটায় সেই চাপা খাদের স্বরটা কেঁপে-কেঁপে ওঠে। গলা দিয়ে নয়, বাঘারু শরীর দিয়েই ডাকছে, শরীরের স্বেদ আর শ্বাস দিয়ে। পাখিটা এবার চুপ করে যাবে।

বাঘারু প্রথমে শুনতে পায় না, কিন্তু তার পরই শোনে, চার দিকে গ্রহণের সেই আওয়াজের ভেতর। পাখিটার আরো নরম জবাবি ডাক উঠেছে–ক-অ-অ-অক, ক-অ-অক্। এখন যেন আর পুরোটাও ডাকতে পারে না। ডাকটা তুলতেই গলাটা খাদে নেমে যাচ্ছে। বাঘারু যেন দেখতে পায়, পাখিটা সেই ডালের ওপর দুই পায়ের ভেতর শরীরটা ডুবিয়ে আর ঘাড়ের ভেতর গলাটা টেনে নিয়ে তার দোসরের জন্যে, অপেক্ষায়। কোথায় সে আছে তার সঙ্কেতটুকু জানতে গলা দিয়ে শুধু আওয়াজটা বের করে যাচ্ছে। একবার সে সঙ্কেত জেনে এই অন্ধকারে উড়ে চলে আসবে।

বাঘারুর দুই হাত মুখের কাছে এনে চাপা স্বরে, খাদে, আবার সেই আওয়াজটা তোলে, বুদ্বুদ তোলার মত। বাঘারু আবার ডেকে ওঠে। বাঘারু আবারও ডেকে ওঠে।

দুই হাত মুখের কাছে ধরে ডাকতে-ডাকতে বাঘারু একটু এগিয়ে যায় ডায়নার দিকে। গ্রহণের অন্ধকারে ডায়নার ফেনা পাথর থেকে ছিটকে ছিটকে উঠছে বাঘারু জলে পা দিয়ে ডাকতে-ডাকতে একটু এগয়।

যে বাঁকে নদী ফরেস্টের অন্ধকারের ভেতরে সেঁদিয়ে গেছে-~-উজানে, সেইখানে, বাঘারু দাঁড়ায়। ডায়নার জলের সঙ্গে মিশে, ডায়নার ওপর দিয়ে সেই পাখির কুহর চলে আসতে থাকে। পাখির পুরো শরীরটাই যেন ডাকছে এমন গহন সেই কুহর। বাঘারু তার শুকনো রক্ত-লাগা দুই হাত ঠোঁটের কাছে এনে ডেকে ওঠে গভীর খাদে। সেই ডাকের ভেতর হাপ এসে যায়। বাঘারুও যেন, পাখিটার মতই, পুরো ডাকটা ডেকে উঠতে পারে না। পাখি আর বাঘারুর ডাকাডাকি ঘিরে গ্রহণের অকাল-আঁধার বনজঙ্গলের আওয়াজে ভরে-ভরে ওঠে। এখনই গ্রহণ শেষ হয়ে আবার সূর্যোদয় ঘটবে।

.

০৮৫.

বনপর্বের শেষ অধ্যায়

সেই সকালে বাঘারু তার বাথান নিয়ে পাহাড়ে উঠেছিল পশ্চিমের চড়াই দিয়ে। এখন বিকেল, বা সন্ধ্যায়, পুবের ঢাল দিয়ে নেমে এল। সূর্যে হঠাৎ গ্রহণ লেগে যাওয়ায় বিকেল বা সন্ধ্যেটা একটু দুবার ঘটে যাচ্ছে, এই যা। নদীর বুক থেকে বাথান নিয়ে বেরিয়ে বাঘারু আবার নদীর বুকেই ফিরে আসে–মাঝখানে তার বাথানে মোষ বাড়ে একটা। এই মিলে বেশ একটা সম্পূর্ণতার ভাব আসে।

এমন কোনো ঘটনাও ত বাঘারুর নেই, যা একটা কোথাও আরম্ভ হয়ে একটা কোথাও শেষ হয়। প্রাকৃতিক কোনো কিছুই ত তেমন হয় না।

বাঘারুর সব ঘটনাই তার আগে থাকতে ঘটে আসছে, আর তার পরেও ঘটে যেতে থাকে। মানবিক সব ঘটনা ত এমুনই ব্যক্তিনিরপেক্ষ।

বাঘারুর সব দিনই ত হুবহু এক। সে ত আর দিন কাটায় না যে একটার পর একটা দিন মিলে তার জীবন তৈরি হবে। বাঘারু জীবন কাটায়, পুরো আস্ত একটা জীবন। একটা দিন ত সে জীবনের অতি তুচ্ছ একটা মাপ মাত্র।

বাঘারুর প্রতিটি দিনই এক-একটা পুরো জীবন। প্রতিটি ভঙ্গিই ত বীরত্বের ভঙ্গি–সে নদী সঁতরানোই হোক আর পাথরে শুয়ে থাকাই হোক, ভোখার সঙ্গে খেলাই হোক আর বুড়িয়ালের পিঠে দাঁড়ানোই হোক। সে মোষের বাচ্চা বের করাই হোক, আর পাখির ডাক ডাকাই হোক।

ভাষা মানেই ত অর্থ। বাঘারুর ত কোনো অর্থ নেই। বাঘারু ত শুধু বাঁচা আর বাঁচা, সে ত শুধু জীবন আর জীবন।

ভাষা মানেই ত কিছু-না-কিছু অলঙ্কার। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত বাঘারুর সারা গায়ে, মাঝখানে একটা নেংটি ছাড়া, সামান্যতম ঢাকা নেই। বাঘারুর তুল্য এমন নগ্ন ভাষা পাওয়া যাবে কোথায়?

ভাষা মানেই ত নাম। বাঘারুর ত কোনো নাম নেই। সে ত শুধু কাজে কাজে বদলে বদলে যায়কুনিয়া, বাঘারু, পাথরিয়া, মইষাল, তার এই হয়ে ওঠার ত আর শেষ নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *