হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় বাঁশবনের অন্ধকার রাজ্যময় ভিতরে বাইরে চারিদিকে ছড়িয়ে আছে– বাঁশবনের গোড়ায়, আদিমকাল থেকে ঝরে পড়া পচা বাঁশপাতার নিচে, ঝোপঝাড়ের ঘন আবরণের মধ্যে, বটগাছের কাণ্ডের গহ্বরে, কাহারপাড়া আটপৌরে-পাড়ার ঘরের কোণ-কানাচ থেকে মানুষগুলির মনের কোণে পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে।
আটপৌরেদের ঘেটুগানের জোর সত্যিই এবার খুব বেশি। লহর ছুটিয়েছে। বনওয়ারী দাঁড়িয়ে শুনলে।
“হায় কলিকালে, কতই দেখালে—
দেবতার বাহন পুড়ে ম’ল অকালে, তাও মারলে রাখালে।
ও তার বিচার হল না বাবা, তুমি বিচার করা।
অতি বাড় বাড়িল যারা তাদের ভে-ঙে পড়ো।”
ছাঁৎ করে উঠল বনওয়ারীর বুকটা। সেই সাপ নিয়ে ঘেটুগান বেঁধেছে আটপৌরেরা। অভিসম্পাতটা অবশ্যই করালীকে, কিন্তু তবু তার খানিকটা অংশ বনওয়ারীর উপরেও এসে পড়েছে বলে তার নিজেরই মনে হল। ছমছম করে উঠল চারিদিক, মনটা কেঁপে উঠল।
“বিচার নাহিক বাবা পুরিল পাপের ভারা
সাজের পিদিম বলো ফু দিয়ে নিলে কারা
ও বটতলাতে বাবা বটতলাতে
সাধু জনের এ কি লীলা সন্জেবেলাতে।
মিহি গলাতে মোটা গলাতে হায় হায় কি গলাগলি
কত হাসিখুশি কত বলাবলি কত ঢলালি!
সেই কাপড়ে বাবা তোমায় সন্জে দেখালে
হায় কলিকালে—”
বনওয়ারীর হাত-পা যেন অসাড় হয়ে গেল।
কালোশশীর সঙ্গে তার এই বটতলাতে দেখা হওয়ার কথা না হলে কেউ নিশ্চয় দেখেছে। যেই দেখুক, কিন্তু সত্যই তো এটা তার অপরাধ। কাপড় সে ছেড়েছিল। বাড়ি ফিরে প্রদীপ জ্বেলে ধূপ নিয়ে আসবার সময় কথাটা তার মনে হয়েছিল, কিন্তু স্নান তো করে নাই! স্নান করা তার উচিত ছিল। তা ছাড়া আজ মনে হচ্ছে, বাবার বাহনকে মেরেছে যে কালী, তাকে শাস্তি না দিয়ে এমনভাবে সমাদর করা তার অপরাধ হয়েছে—একশোবার অপরাধ হয়েছে। কিন্তু দেখলে কে? পরম নিশ্চয় নয়। পরম দেখলে কখনই চুপ করে থাকত না। কালোশশীর মতিগতি সবাই জানে; মধ্যে মধ্যে ভূপ সিংহ মহাশয় এখনও আসেন, চন্ননপুরে গেলে কালোশশী এখনও অনেক জনের সঙ্গে ঢলে পড়ে কথা বলে, সেসব কথার মানে দু রকম হয়। জাঙলেও সদ্গোপ মহাশয়দের মধ্যে আধাবয়সী যারা, তাদের দিকেও বাঁকা চোখে তাকিয়ে কালোশশী মুচকে হাসে। সবই সত্যি, সবই জানা কথা, তার সঙ্গেও এককালে মনে মনে ‘অঙ’ ধরেছিল এও জানে লোকে; কিন্তু এমন ঘটনা পরম চোখে দেখে কখনও সহ্য করতে পারত না। তখনই ‘হকার’ মেরে সে লাফিয়ে এসে পড়ত। বনওয়ারীর সঙ্গে একহাত হয়ে যেত। হয়ত দুজনের একজন শেষ হয়ে যেত সেই দিনই তখনই। কাহারপাড়া এবং আটপৌরে-পাড়ায় রেষারেষি আছে। একটা—চিরদিন ‘পিতিপুরুষ’ ধরে। আটপৌরেরা বলে, আমরা পালকি বহন করি না, আমাদের ঘোড়া ‘গোত্ত’ নয়। তাদের ক্ষেেত্র ঘোড়া গোত্র নয়, ‘বাহন গোত্র’, ওরা ঠাট্টা করে বলে, ঘোড়া গোত্র। ঘোড়া গোত্র হোক আর বাহন গোত্রই হোক, সে করেছেন ভগবানওই বাবাঠাকুর। আটপৌরেরা কি? লাঠি কাধে দিয়ে ভগবান পাঠিয়েছেন, ঠেঙাড়ে ডাকাত গোত্র যে তাদের। দূত গোও যা, ও ডাকাত-ঠেঙাড়ে ক্ষেেত্তও তাই। এখনও পর্যন্ত বেটারা থানার খাতায় দাগী, হাজ্বরে দিতে হয়, চৌকিদার রাত্রে ঘুম ভাঙিয়ে ডাকে। কোনো বেটা আটপৌরের ঘরের চালে খড় নাই ভাল করে, হড়িতে অর্ধেকের বেশি চাল নাই। এই নিয়ে ওদের সঙ্গে কাহারদের ঝগড়া চিরকালের। এককালে অবিশ্যি ওদেরই প্রতাপ ছিল বেশি। সে আমলটা হাঁসুলী বাঁকের চুরি ডাকাতির আমল। এখন সকলে চুরি ছেড়ে চাষবাস করছে, এখন কাহারদের চলতির কাল। আগে আটপৌরেরা কাহারদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত, আজ হিংসে করে। এ গান কোন বেটা হিংসুটে আটপৌরের বাধা। ব্যাপারটা জানতে হবে বনওয়ারীকে।
বলতে পারে একমাত্র কালোশশী। কালোশশীর সঙ্গে একবার দেখা করতে হবে তাকে। কিন্তু ভয় হয়। কালোশশীর মধ্যে নেশা আছে, সে নেশার ঘোর কাটিয়ে ওঠা সহজ নয়। ক্ষিদের সময় মুখের অন্ন ছেড়ে উঠে আসা যায়, কিন্তু কালোশশীর কাছে গিয়ে মাতাল না হয়ে ফিরে আসা যায় না। এ মদ তার খাওয়ার উপায় নাই। তার সে দিন ফুরিয়ে গিয়েছে। কাহারপাড়ার। সে মাতব্বর। মাতব্বরের নিন্দে হলে মাতব্বরি থাকে না, লোকে মুখ টিপে হাসে–শাসন মানে না। তার পাপে জাতজ্ঞাতের অকল্যাণ হয়। যে পাপ সে করেছে, তার প্রায়শ্চিত্তই তাকে করতে হবে।
গাছতলা থেকে আবার সে বেরিয়ে সন্তৰ্পণে চলল আখের শালের দিকে। শালে হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে। সম্ভবত মণ্ডল মহাশয় এসে গিয়ে থাকবেন। বনওয়ারীকে গরহাজির দেখে হয়ত গা-গাঁ শব্দে চিৎকার করতে আরম্ভ করেছেন। বনওয়ারী একটু দ্রুতপদেই চলল। কতকগুলি গালিগালাজ শুনতে হবে আর কি। বনওয়ারী না হয়ে অন্য কেউ হলে তার অদেষ্টে নিৰ্ঘাত ‘পেহার’ জুটত। বনওয়ারীর গায়ে হাত তুলতে কেউ সাহস করে না। সাহস করে হাত তুললে বনওয়ারীও তার হাত ধরে ফেলবার সাহস রাখে। অবিশ্যি এক চন্ননপুরের মুখুজ্জেবাবুরা ছাড়া। বাপ রে বাপ রে, কি ধনদৌলত চারিদিকে! যাকে বলে, মা-রাজলক্ষ্মী অষ্টাঙ্গে অলঙ্কার পরে ‘বানারসী’ কাপড় পরে বিয়ের কনেটির মত গয়নার ঝুমঝুমঝুমঝুম ঠিন-ঠিন শব্দ করে বানারসী কাপড়ের খসখস শব্দ তুলে অহরহ বেড়াচ্ছেন। কাহার বনওয়ারী পালকি বয়ে বুড়ো হল, এ অঞ্চলে কত বড় বড় বাড়ির বিয়ের কনেকে পালকি বয়ে শ্বশুরবাড়ি এনেছে, বনওয়ারী বলে—‘নক্ষ্মীকে এনেছি নারায়ণের বৈকুণ্ঠে। গয়না কাপড় সে অনেক দেখেছে, অনেক সুবাস এঁকেছে, অনেক গয়নার বাজনা শুনেছে। কিন্তু চন্দনপুরের বাবুদের মতন বর্জরের গয়না কাপড়ের ‘বন্ধ এ আর সে দেখে নি।
খুব ত্বরিত গমনে চলতে চলতে হঠাৎ বনওয়ারী যেন আপনিই থেমে গেল। পা যেন। আটকে গেল। পশ্চিম দিকে বা পাশেই বাবাঠাকুরের থান। ডান দিকে দূরে দোয়েম জমির মাঠে আখ কাটছে কাহাররা, ঝাপঝাপ খসখস শব্দ উঠছে। কথাবার্তার সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। সামনে জাঙলের আমবাগানে শাল চলছে, আলোর ছটা আসছে। কিন্তু সমস্ত কি ভুলে গেল বনওয়ারী? সে ধীরে ধীরে চলল বাবাঠাকুরের থানের দিকে। অপরাধ-অপরাধ হয়েছে বনওয়ারীর। হে। বাবাঠাকুর, ক্ষমা কর, মার্জনা কর। আঃ, কি মতিভ্ৰমই হল করালীর! হায়, হায় হায়! ধৰ্মনাশা করালী। বাবার বাহনটিকে হত্যা করলে পুড়িয়ে? কি ‘বিচিত্ত বন্ন’, কি বাহার, কি শিস, কি ‘পেকাণ্ড’ বড়। তা ছাড়া কালোবউকে নিয়ে তার কি মতিভ্ৰম হল এই ‘পবীণ’ বয়সে! হে বাবা, হে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, তুমি এ দোষটি নিয়ে না বনওয়ারীর করালীকেও ক্ষমা কোরো বাবা। আর বনওয়ারীর একটি দোষ ক্ষমা কোরো, ওই কালোশশীকে নিয়ে দোষটি তুমি ধোরো না। কালোবউয়ের সঙ্গে তার ছেলেবয়সের ‘অঙ’। এই বয়সে এতকাল পরে সে ‘অঙ’ মনের বারুদের সঙ্গে মিশে তুবড়িবাজির ‘অঙিন’ ফুলঝুরি হয়ে বেরিয়ে আসছে। আগুন লেগেছে, আর তাকে চাপা দেবার উপায় নেই। কালোবউ-কালোশশী যদি আটপৌরে-পাড়ার মাতব্বর পরমের বউ না হত, তবে হয়ত বনওয়ারীর ‘হিয়ের’ তাপ এতখানি হত না, আগুন লাগত না মনের বারুদে।
বাবার থানের প্রান্তভাগে বনওয়ারী দাঁড়াল। ওখানটিতে এই ‘সনসনে’ ‘আত্তিকালে হঠাৎ গিয়ে ঢুকতে নাই। বাবা খেলা করেন এখন, কখনও তপজপ করেন, কখনও খড়ম পরে খটখট করে বেড়ান, কখনও বেলগাছের ডালটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন ‘কালারুদ্’ বাবার দরবারের দিকে চেয়ে।
হাততালি দিয়ে বাবাকে নিজের আগমনের কথা জানিয়ে সে আরও খানিকটা অগ্রসর হল। কিছুদিন আগেই বাবার থান পুজো দেবার জন্য তারা পরিষ্কার করেছিল। হাঁসুলী বাঁকের পাষাণ মাটিতে এখন শীতের টান পড়েছে, আস্তে আস্তে তার উপর খরার অর্থাৎ গ্রীষ্মের রোদের আমেজ লাগছে। জল নাই; পরিষ্কার বাবার থানটি তাই এখনও পরিষ্কারই আছে। বনওয়ারী সেইখানে শুয়ে পড়ল উপুড় হয়ে। মনে মনে মানসিক করলেবাবা, ক্ষমা কর তুমি, তোমার বেলতলাটি আমি বাধিয়ে দেব।
ঠিক সেই ক্ষণটিতেই একটা গোলমাল উঠল কাহারপাড়ায়।