২.০৫ প্রবাস খণ্ড

তারা ঝুড়িভরা আবির আনিয়াছে। গামলাভরা রঙ্ গুলিয়াছে। চৌকোণা চার-থাকের একটা মাটির সিঁড়ির উপর দুই পাশে পোঁতা দুইখানা বাঁশের সঙ্গে দড়ি বাঁধিয়া একখণ্ড সালু কাপড়ে একটি ছোট গোপাল ঝুলাইয়াছে। নিতান্তই নাড়ুগোপাল। পাশে রাধা নাই। হামা দিয়া হাত বাড়াইয়া লাল কাপড়ের বাঁধনে লটকাইয়া একা একাই ঝুলিতেছে। এক-একজন আসিয়া তার গায়ে মাথায় আবির মাখাইয়া একটা করিয়া দোলা দিয়া যায়। তারই দোলনে সে অনবরত দুলিয়া চলিতেছে।

এ-পক্ষ প্রস্তুত। শুকদেবপুরের দল এখনো আসিয়া পৌঁছায় নাই। আপ্যায়নকারীদের একজন তিলকদিগকে ঠাকুরের কাছে নিয়া ঝুড়ি হইতে কয়েক মুঠা আবির একখানা ছোট পিতলের থালিতে দিয়া বলিল, ‘ঠাকুরের চরণে আবির দেও।’

প্রেমের দেবতা কোথায় কার জন্য ফাঁদ পাতিয়া রাখে কেউ কি বলিতে পারে? উজানীনগরের খলাতে কিশোর এমনি একটা ফাদে পড়িল। কার সঙ্গে কার জোড়বাঁধা হইয়া থাকে তাও কেউ বলিতে পারে না। যাকে জীবনে কখনো দেখি নাই হঠাৎ একদিন তাকে দেখিয়া মনে হয় সে যেন চিরজনমের আপন। প্রেমের দেবতা অলক্ষে কার সঙ্গে কখন কার গাঁটছড়া বাঁধিয়াছেন কেউ জানে না।

তারাত তিন জনে গোপালকে আবিরে রঞ্জিত করিল। তারপর কয়েকজন পুরুষ মানুষ তাহাদের গালে মাথায় আবির দিয়া রাঙাইবার পর তিন চারজন স্ত্রীলোক আবিরের থালা লইয়া আগাইয়া আসিল। কয়েকজন, কিশোরের কাছে মাতৃসমা। তারা কিশোরের কপাল রাঙাইল। আশীর্বাদের মত সে-আবির গ্রহণ করিয়া কিশোর নিজে তাদের পায়ে আবির মাখাইয়া কপালে পায়ের ধূলা ঠেকাইল।

কয়েকজন তরুণী। বোন বৌদিদের বয়সী। তারা আবির লাগাইল গালে আর কপালে। কিশোর নীরবে গ্রহণ করিল। গোলমালে ফেলিল আর একজন।

অবিবাহিতা মেয়ে। দেহে যৌবনের সব চিহ্ন ফুটিয়াছে। সে-সব ছাপাইয়া বহিয়াছে রূপের বান। বসন্তের এই উদাত্ত দিবসে মনে লাগিয়াছে বাসন্তী রঙ্। প্রাণে জাগিয়াছে অজানা উন্মাদনা। পঞ্চদশী। বড়ই সাংঘাতিক বয়স এইটা। মনের চঞ্চলতা শরীরে ফুটিয়া বাহির হয়। হইবেই। মালোর মেয়েরা বিবাহের আগে অত বড় থাকে না। অতখানি বড় হয় বিবাহের দুই তিন বছর পর। কোথা হইতে কেমন করিয়া এই অনিয়ম এখানে আসিয়া পড়িয়াছে।

কিশোরের গালে আবির দিতে মেয়েটার হাত কাঁপিল; বুক দুরু দুরু করিতে লাগিল। তার ছন্দময় হাতখানার কোমল স্পর্শ কিশোরের মনের এক রহস্যলোকের পদ্মরাজের ঘোমটা-ঢাকা দলগুলিকে একটি একটি করিয়া মেলিয়া দিল। সেই অজানা-স্পর্শের শিহরণে কাঁপিয়া উঠিয়া সে তাকাইল মেয়েটির চোখের দিকে। সে-চোখে মিনতি। সে-মিনতি বুঝি কিশোরকে ডাকিয়া বলিতেচেঃ বহুজনমের এই আবিরের থালা সাজাইয়া রাখিয়াছি। তোমারই জন্যে। তুমি লও। আমার আবিরের সঙ্গে তুমি আমাকেও লও।

থালা সুদ্ধ তার অবাদ্ধ হাত দুইটি কাঁপিতেছে। লজ্জায় লাল হইয়া সে চোখ নত করিল। তাকে বাঁচাইল তার মা। মাথার কাপড় একটু টানিয়া সলজ্জভাবে তার মেয়েকে নিজের বুকে আশ্রয় দিল।

কিশোরের ধ্যান ভাঙ্গিল সুবল। হাতে একটা ঝাঁকুনি দিয়া বলিল, ‘অ দাদা, গানের আসরে চল।’

 

শুকদেবপুরের অর্ধেক পুরুষ মাছধরায় গিয়াছে। মোড়ল গিয়াছে একটা শুকনা বিল লইয়া বাসুদেবপুরের লোকদের সঙ্গে পুরানো একটা বিবাদ মিটাইতে। শুকদেবপুরের নারীরা আসিয়া খলার নারীদের সহিত মিশিল। পুরুষেরাও আসিল ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া।

পুরুষেরা কতক্ষণ রঙ-মাখামাখি করিয়া শ্রান্তদেহে চাটাইয়ের উপর বসিয়াছে। ওদিকে মেয়েদের রঙ-মাখামাখির পালা চলিতেছে, এদিকে পুরুষদের হোলি-গান শুরু হইয়াছে। একজনকে সাজাইয়াছে হোলির রাজা। তার গলায় কলা-গাছের খোলের মালা, মাথায় কলাপাতার টোপর, পরণে ছেঁড়া ধুতি, গায়ে ছেঁড়া ফতুয়া। মাঝে মাঝে উঠিয়া কোমর বাঁকাইয়া নাচে, আবার বসিয়া বিরাম নেয়। বুড়া মানুষ।

বহুদিন পরে আনন্দের আমেজ পাইয়া তিলকের এইরূপ হোলির রাজা হইবার ইচ্ছা করিতেছিল। কিশোরের কানে কানে বলাতে উত্তর পাইল, ‘আমরা বিদেশী মানুষ। সভ্য হইয়া বইসা থাকাই ভাল। নাচানাচি করলে তারা পাগলা মনে করব।’ কিন্তু তিলক দমিবার লোক নয়। সে প্রতীক্ষা করিয়া থাকিল। গানের সম যখন চড়িবে, ঝুমুরের তাল উঠিবে, তখন সে কোনোদিকে না চাহিয়া আসরের মাঝখানে দাঁড়াইয়া নাচিবে। একবার কোনোরকমে উঠিয়া কয়েক পাক নাচিতে পারিলে, লজ্জা ভাঙ্গিয়া যায়, কোনো অসুবিধা হয় না।

গায়কেরা দুই দলে পৃথক হইয়া গান জুড়িল। রাধার দল আর কৃষ্ণের দল।

 

রাধার দল ভদ্রভাবে গান তুলিলঃ

সুখ-বসন্তকালে, ডেকোনারে
অরে কোকিল বলি তুমারে।।
বিরহিনীর বিনে কান্ত হৃদাগ্নি হয় জ্বলন্ত,
জলে গেলে দিগুণ জ্বলে হয়নারে শান্ত।
সে-যে ত্যজে’ অলি কুসুম-কলি রইল কি ভুলে।।

কৃষ্ণের দল সুর চড়াইলঃ

বসন্তকালে এলরে মদন-
ঘরে রয় না আমার মন।।
বিদেশে যাহার পতি,
সেই নারীর কিবা গতি,
কতকাল থাকিবে নারী বুকে দিয়া বসন।।

রাধার দল তখনও ধৈর্য ঠিক রাখিয়া গাহিলঃ

বনে বনে পুষ্প ফুটে,
মধুর লোভে অলি জুটে,
কতই কথা মনে মনে উঠে সই –
ব্যথা কার বা কাছে কই।।
দারুণ বসন্তকাল গো,
নানা বৃক্ষে মেলে ডাল গো,
প্রবাস করে চিরকাল সে এল কই।।
বসিয়া তরুর শাখে কুহু কুহু কোকিল দাকে,
অরে সখিরে এ-এ-এ-

কৃষ্ণের দল এবার অসভ্য হইয়া উথিলঃ

আজু শুন্ ব্রজনারী,
রাজোকুমারী, তোমার যৌবনে করব আইন-জারি।
হস্তে ধরে নিয়ে যাব,
হৃদকমলে বসাইব – রঙ্গিনী আয় লো –
হস্তে ধরে নিয়ে যাব, হৃদকমলে বসাইব।
বসন তুলিয়া মারব ঐ লাল-পিচোকারী –

 

রাধার দল এই গানের কি উত্তর দিবে ভাবিতেছে, এমন সময় মেয়েদের তরফ হইতে আপত্তি আসিল, পুরুষদের গান এখানেই শেষ হোক। দুপুর গড়াইয়া গিয়াছে। এখন মেয়েদের গান আরম্ভ করিতে হইবে।

রসাল প্রসঙ্গ পাইয়া তিলক মনে মনে উল্লসিত হইয়া উঠিয়াছিল। ভাবিয়াছিল রাধার দল কৃষ্ণপক্ষকে কড়া একটা উত্তর দিয়া আরও চেতাইবে, তারপর কৃষ্ণপক্ষের মুখ দিয়া যাহা বাহির হইবে, তাহার সঙ্গে সঙ্গে সে নাচিতে উঠিবে। তার আশাভঙ্গ হইল।

 

দোল-মণ্ডলের চারিদিকে খলার ও শুকদেবপুরের মেয়েরা সেদিন একাকার হইয়া গিয়াছে। কারো হাতে একজোড়া রাম-করতাল। কারো বা শুধু-হাত।

একসঙ্গে অনেকগুলি করতাল বাজিয়া উঠিল। ঝা ঝা ঝম্ ঝম্ ঝা ঝা ঝম্ ঝম্ শব্দে আকাশ ফাটাইয়া দিল। তার সঙ্গে অনেকগুলি কাঁকনপরা হাতের মিলিত করতালি। তারপর অনেকগুলি মেয়ের পা একসঙ্গে নাচিয়া উঠিল। অনেকগুলি মেয়ের কণ্ঠ একসুরে গাহিয়া উঠিল। কিশোরের মন এক অজানা আনন্দ-সাগরে ডুবিয়া গেল।

দলের ভিতর সেই মেয়েটিকেও দেখা গেল। মার পায়ের দিকে তাকাইয়া সেও তালে তালে পা ফেলিতেছিল। কিশোরের সহিত চোখাচোখি হইয়া সে তাল-কাটা পড়িল। পা আর উঠিতে চাহিল না। মা সস্নেহে মুখ ঘুরাইয়া চাহিয়া দেখে, মণ্ডলের মধ্যে থাকিয়া মেয়ের পা দুটি স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে। আর ঘনঘন লাজে রাঙা হইয়া উঠিতেছে। কারণ কি, না, অদূরে দাঁড়াইয়া কিশোর তাহাকেই দুই চোখের দৃষ্টি দিয়া যেন গ্রাস করিতেছে।

মণ্ডলের তাল্ভঙ্গ হইতেছে দেখিয়া মা তাহাকে ঠেলিয়া বাহির করিয়া দিল। মণ্ডল-ছাড়া হইয়া সে আরও বিপন্ন বোধ করিল। এইবার সে কি করিবে ভাবিতেছে এমন সময় এক ভয়ানক কাণ্ড ঘটিল। দমকা হাওয়ার মত একটা আকস্মিক শব্দে মেয়েদের কণ্ঠপদ স্তব্ধ হইয়া গেল। মৃদু তরঙ্গায়িত তরাগে যেন সহসা জাগিল ঝঞ্ঝার বিক্ষোভ। শুকদেবপুরের পুরুষ যারা উপস্থিত ছিল, চক্ষুর পলকে উঠিয়া মালকোঁচা মারিয়া রুখিয়া দাঁড়াইল। যে-ঘরে লাঠিসোঁটা থাকে সে ঘরে ঢুকিয়া কয়েকজন বিদ্যুতের গতিতে লাঠির তাড়া বাহির করিয়া আনিল। সাজ সাজ রবে খলা তোলপাড় হইয়া উঠিল।

ততক্ষণে বাসুদেবপুরের ওরা ঢুকিয়া পড়িয়াছে।

মেয়েদের মধ্যে হুলস্থূল পড়িয়া গেল। আক্রমণকারীদের কয়েকজন লাঠি হাতে মেয়েদের দলে পড়িয়া লাফালাফি করিতেছে। একজন সেই বিমূঢ়া মেয়েটার দিকে আগাইয়া আসিতেছে যেন। এইবার কিশোরের চৈতন্য হইল। সে লাফাইয়া মেয়েটার সামনে পড়িয়া দুর্বৃত্তের গতিরোধ করিল। তার লাঠি তখন আকাশে আস্ফালন করিয়া কিশোরের মাথায় পড়ে আর কি। ঠিক সেই মুহূর্তে শুকদেবপুরের একজনের বিপুল এক লাঠির ক্ষিপ্ত আঘাত আক্রমণকারীকে ধরাশায়ী করিল। তার হাতের লাঠি লক্ষ্যচ্যুত হইয়া কিশোরের মাথায় না পড়িয়া হাতে পড়িল। মুহূর্ত মধ্যে মুমূর্ষুর হাত হইতে সেই লাঠি ছিনাইয়া লইয়া সে আগাইয়া যাইতেছিল, পিছন হইতে টান পড়ায় ফিরিয়া দেখে তার ধুতির খুঁট দুই হাতে মুঠা করিয়া ধরিয়া মেয়েটা মূর্ছা যাইতেছে।

তারপর শত শত কণ্ঠের সোরগোলের মধ্যে শত শত লাঠির ঠকাঠক্ ঠকাঠক্ শব্দ হইতে লাগিল। কারো হাত ভাঙ্গিল, পা ভাঙ্গিল, কারো মাথা ফাটিল। আক্রমণকারীদের অনেকেই আর ফিরিয়া গেল না। রক্তাক্ত দেহে এখানেই পড়িয়া রহিল। অন্যেরা লাঠি ঘুরাইয়া পিছু হটিতে হটিতে খোলা মাঠে নামিয়া দৌড় দিল।

ইহারই পটভুমিকায় কিশোর মূর্ছিতা মেয়েটাকে পাঁজা-কোলা করিয়া তুলিয়া ঘন ঘন হাঁকিতে লাগিল, ‘এর মা কই, এর মা কই! ডরে অজ্ঞান হইয়া গেছে। জল আন, পাংখা আন।’

মেয়েটার চুলগুলি আলগা হইয়া মাটিতে লুটাইয়া পড়িয়াছে। গলা টান হইয়া মাথাটা এলাইয়া পড়িয়াছে। বুকটা চিতাইয়া এতখানি উঁচু হইয়াছে যে, কিশোরের নিঃশ্বাস লাগিয়া বুঝিবা আবরণটুকু খসিয়া যায়।

মা এক জায়গায় দাঁড়াইয়া তখন কাঁপিতেছিল। কিশোরের ডাকে সম্বিৎ পাইয়া ভাঁড়ারঘর হইতে তেলজল পাখা আনিয়া দিল। কিশোর তেলে-জলে এক করিয়া গায়ের জোরে ঘুঁটিয়া দিয়া হাতের তালুতে চাপিয়া চাপিয়া মাথায় দিতে দিতে মেয়েটা চোখ মেলিয়া চাহিল।

‘আপনের মাইয়া আপনে নেন’, বলিয়া কিশোর ত্যাগ দেখাইল।

কথা কয়টি ঠিক জামাইর মুখের কথার মত হইয়া মেয়ের মার কানে গিয়া ঝঙ্কার তুলিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *