২.৫ পিঙলা বলে যাচ্ছিল তার কাহিনী

পিঙলা বলে যাচ্ছিল তার কাহিনী। হিজল বিলের বিষহরির ঘাটের উপর বসে ছিল দুজনে পিঙলা আর শিবরাম। মাথার উপর ঝড় উঠেছে, হুহু করে বয়ে চলেছে, মেঘ উড়ে চলেছে। মধ্যে মধ্যে নীল বিদ্যুতের আঁকাবাকা সর্পিলরেখায় চিড় খাচ্ছে কালো মেঘের আবর্তিত পুঞ্জ। কড়কড় করে বাজ ডেকে উঠছে।

পিঙলার ভ্রূক্ষেপ নাই। তার বিশ্বাস, হিজলের আশপাশে বজ্ৰাঘাত হয় না। তার বিশ্বাস, সে যখন মায়ের চরণে প্রার্থনা জানিয়ে মন্ত্ৰ পড়ে হিজল বিলের সীমানার শান্তি ভঙ্গ না করে দূরান্তরে চলে যেতে মেঘকে ঝড়কে আদেশ করেছে, তখন তাই যেতে সে বাধ্য এবং তাই যাবে।

শিবরাম বলেন-ভাল করে কি ঝড় লক্ষ্য করেছ তোমরা বাবা? হয়ত কেতবে পড়েছ, কিন্তু আমরা সেকালের মানুষ-এ সব পাঠ গ্রহণ করেছি প্রকৃতির লীলা থেকে। ঝড়টা সেদিনের ছিল শুকনো ঝড় এবং উপর-আকাশের ঝড়। অনেক উপরে ঊনপঞ্চাশ পবনের, তাণ্ডব চলছিল, নিচে তার কেবল অ্যাঁচটা লাগছিল। এমন ঝড় হয়। সেদিনের ঝড়টা ছিল সেই ঝড়। সেদিনের ঝড়টা যদি পৃথিবীর বুকে নেমে বয়ে যেত, তবে হিজলের চরের ঝাউবন বাবলাবন শুয়ে পড়ত মাটিতে, হিজল বিলের জল চলকে পড়ত চরের উপর, গঙ্গার বুকের নৌকা যেত উড়ে। সাঁতালী বেদেদের কাশে-ছাওয়া খড়ের চাল ঝড়ের নদীতে নোঙর-ঘেঁড়া পানসির মত ঘুরতে ঘুরতে চলে যেত উধাও হয়ে, পিঙলা আর আমি নাগিনী কন্যা আর ধন্বন্তরিভাই চলে যেতাম শূন্যলোকে ভেসে।

হেসে শিবরাম বললেন—তাই যদি যেতাম বা, তা হলে উড়ে যেতে যেতে পিঙলা নিশ্চয় খিলখিল করে হেসে উঠত, বলত—ধন্বন্তরিভাই, মনে কর, মা-মনসার ব্ৰতর কথা; নাগলোকের ভাইয়েরা বেনে কন্যাকে বলেছিল—বহিন, দেহকে বঁটুলের মত গুটিয়ে নাও, তুলোর চেয়ে হালকা হও, আমার স্কন্ধে ভর কর, চক্ষু দুটি বন্ধ কর। দেখবে শের্শে করে নিয়ে গিয়ে তুলব নাগলোকে। তেমনি করে ধন্বন্তরি আজ ভাই, আমার কাঁধের উপর ভর কর, ভয় কোরো না।

পিঙলার তখন বাস্তববোধ বোধহয় একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। মস্তিষ্কের বায়ু সেটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে, আর বায়ুকে আশ্রয় করে মেঘের মত পুঞ্জিত হচ্ছে আবর্তিত হচ্ছে ওই। অলৌকিক বিশ্বাস। ঊন্মাদ রোগের ওই লক্ষণ। একটা মনোবেদনা বা অন্ধ বিশ্বাস নিরন্তর মানুষের মন এবং দেহের মধ্যে সৃষ্টি করে গুমোটের, যে ভাবনা প্রকাশ করতে পারে না মানুষ, সেই নিরুদ্ধ অপ্রকাশিত ভাবনা বায়ুকে কুপিত করে তোলে। তারপর প্রকৃতির নিয়মে কুপিত বায়ু ঝড়ের মত প্রবাহিত হয়। তখন এই বেদনা বা বিশ্বাস মেঘের মস্তিষ্ককে আচ্ছন করে দুর্যোগের সৃষ্টি করে।

পিঙলা সে দিনও আকাশের উৰ্ব্বলোকে প্রবাহিত ঝড়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে হেসে বললে—দেখিছ ধন্বন্তরিভাই, অনুনীর মহিমা!

শিবরাম বলেন—একটা গভীর মমতা আমার ছিল—গোড়া থেকেই ছিল। এমনই যারা বন্য যাদের প্রকৃতির মধ্যে মানব-প্রকৃতির শৈশব-মাধুর্যের অবিমিশ্র আস্বাদ মেলে, রূপ ও গন্ধের পরিচয় মেলে, তাদের উপর এই মমতা স্বাভাবিক, তোমরা এদের সংসর্গে আস নাই–তাই এই আকর্ষণের গাঢ়তা জান না। আমার ভাগ্য, আমি পেয়েছি। সেই আকর্ষণের উপরে সে দিন আর এক আকর্ষণ সংযুক্ত হয়ে সবলতর প্রবলতর করে তুলেছিল আমার আকর্ষণকে। সে হল—রোগীর প্রতি চিকিৎসকের আকর্ষণ। আমি পিঙলার আচরণের মধ্যে রোগের উপসর্গের প্রকাশ-বৈচিত্র্য দেখছিলাম। ভাবছিলাম, রোগেরও অন্তরালে লুক্কায়িত রয়েছেন যে বিচিত্র রহস্যময়ী, তিনি কিভাবে পিঙলাকে গ্রাস করবেন? রোগের অন্তরালে কোন রহস্যময়ী থাকেন, বোঝ তো?-মৃত্যু। তা ছাড়া, পিঙলার কাহিনী ভালও লাগছিল।

পিঙলা ওই পর্যন্ত বলে খানিকটা চুপ করেছিল। নাগু ঠাকুর বুকের উপর অতর্কিত প্রচণ্ড আঘাত খেয়ে পড়ে গেল—সে ছবি শিবরামের চোখের উপর ভাসতে লাগল। এতগুলি কৃষ্ণকায় মানুষের মধ্যে গৌরবর্ণ রক্তাম্বর-পরা ওই বিশালদেহ অসমসাহসী মানুষটা টলতে টলতে পড়ে গেল। পিঙলা বলে চুপ করলে। উদাস দৃষ্টিতে আকাশের ঘন আবর্তিত মেঘের দিকে চেয়ে রইল। তারপর দূরে একটা বজ্ৰপাতে সচেতন হয়ে আকাশের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললে—দেখেছ ধন্বন্তরিভাই, জনুনীর মহিমা!

–ঠাকুর আসিবে। সে-ই আনিবে আমার ছাড়পত্তর-বিধেতার দরবারে হিসাবনিকাশে কন্যের ফারখতের হুকুম। বেদেকুলের বন্দন থেক্যা মুক্তির আদেশ আনিতে গেছে ঠাকুর। আমিই তারে সেদিন হাতপায়ের বাঁধন খুল্যা ছেড়া দিলম; না-হলি ওই পাপী শিরবেদেটা তারে জ্যান্ত রাখিত না। খুন কর্যা ভাসায় দিত হাঙরমুখীর খালে। হাঙরে কুম্ভীরে খেয়ে ফেলাত ঠাকুরের গোরা দাঁতাল-হাতির পারা দেহখানা।

শিউরে ওঠে পিঙলা।

–ভাগ্য ভাল, ভাদু মামারে সেইদিন থেকা সুমতি দিলে মা-বিষহরি। সে-ই এস্যা আমাকে কইলেকন্যে তুমি কও, মায়ের চরণে মতি রেখ্যা বেয়ান কর্যা বল, বেরাহ্মণের লোহু সাঁতালীর মাটিতে পড়িবে কি না-পড়িবে। গঙ্গারাম বলিছে—উকে খুন কর্যা ফেলে দিবে, হাঙরমুখীর খালে। বলিছে—ছো যদি দিস তবে উ ঠাকুর সব্বনাশ করা দিবে।

সেই যে চেতনা হারিয়ে মূৰ্ছিত হয়ে পড়েছিল পিঙলা, অনেকক্ষণই তার জ্ঞান হয় নাই। তারপর জ্ঞান ফিরল যখন, তখন সে তার দাওয়ায় শুয়ে, আর তার মাথার কাছে বসে ভাদুর মেয়ে তার মামাতো বোন চিতি। বাড়ির সামনে যেখানে সে দেখেছিল নাপ্ত ঠাকুরকে আর সাঁতালীর বেদেদের—সেখানটা শূন্য। দূরে বিয়েবাড়িতে লোকজন বসে রয়েছে। জটলা করছে। বাজনদারেরা ছুটে পালিয়েছে। নাগু ঠাকুরকে বুকে কিল মেরেছে—নাগু ঠাকুর যখন উঠবে, তখন সাঁতালীতে বিপর্যয় ঘটবে। মৌমাছি বোলতা ভিমরুলে ভরে যাবে সাঁতালীর আকাশ। কিংবা জ্বলে উঠবে সাঁতালীর কাশে-ছাওয়া ঘরবাড়ি। কিংবা প্রচণ্ড ঝড়ই আসবে—যা হোক একটা ভীষণ বিপর্যয় ঘটবে।

পিঙলাকে সমস্ত বিবরণ বললে চিতি।

বললে—আহা, দিদি গ, মানুষ তো নয়, সাক্ষাৎ মহাদেব গ। পাথরের কপাটের মতন বুকের পাটা, গোরা রঙ, বীর মানুষ, পড়ল ধড়াস করে।

ভাদু ছুটে এল এই সময়ে। ওই প্রশ্ন করলে—বেরাহ্মণের লোহু সাঁতালীর মাটিতে পড়িবে কি না-পড়িবে।

পিঙলা বললে—কি হল আমার, সে কথা তুমাকে বলতে পারব ধন্বন্তরিভাই। হা ঠিক যেমন হছিল—সেই বাবুদের বাড়িতে, ওই নাগু ঠাকুরের হাঁক শুন্যা, বেদেকুলের মান্য যায়যায় দেখ্যা যেমনি হছিল, ঠিক তেমুনি হল। পরানটা আকুলি হয়ে উঠল। মনে মনে পরানটা ফাটায়ে ডাকিলম মা-বিষহরিকে। বলিব কি ভাই, চোখে দেখিলম যেন মায়ের রূপ। ওই আকাশের ম্যাঘে যেমন চিকুর হেন্যা মিলায়ে যেতিছে বিদ্যুতের চমক, তেমুনি চকিতে দেখিলম—চকিতে মিলায়ে গেল। পিথিমীটা যেন দুল্যা উঠল, ছামুতে হেই হিজল বিল উথলায়ে উঠল। গাছ দুলিলপাতা দুলিল।

 

পিঙলা আবার মূৰ্ছিত হয়ে পড়েছিল। এবার কিন্তু গতবারের মত নয়। এবার তার উপর হল বিষহরির ভর। মূৰ্ছার মধ্যেই মাথা তার দুলতে লাগল, মাথার সে আন্দোলনে রুখু চুলের রাশ চারিপাশে ছড়িয়ে পড়ল। বিড়বিড় করে সে বললে—ছেড়া দে, সিদ্ধ পুরুষকে তোরা ছেড়া দে, বীরপুরুষকে তোরা ছেড়া দে। কন্যে থাকিবে না, কন্যে থাকিবে না। মা কহিছে, কন্যে থাকিবে না।

 

পিঙলা বলে—সেই বিচিত্র বিস্ময়কর ক্ষণে বিষহরি মাকে (খে দেখেছিল। ওই চকিতে দেখা দিয়ে মা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন যেন কি। পিঙা দেখলে ধরাশায়ী মদমত্ত শ্বেতহস্তীর মত নাগু ঠাকুরকে। বুকে তার রুদ্রাক্ষের মালা নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে দুলছে, হাত-পা বাধা, কিন্তু চোখে তার নির্ভয় দৃষ্টি। নাগু ঠাকুরের শিঙার মত কণ্ঠস্বর কানের কাছে বেজে উঠল—কন্যা থাকিবে না। বিষহরির হুকুম আমি শুনেছি। আমি ওই কন্যেকে নিতে এসেছি।

এদিকে কন্যার ভর দেখে ভাদু চিৎকার করে উঠেছিলমা জাগিছেন, কন্যের ভর হইছে। ভর হইছে। ধূপ-ধুনা-বিষমটকি! নিয়ে আয়, নিয়ে আয়।

ধূপধুনার গন্ধে, ধোঁয়ায়, বিষমটাকির বাদ্যে সে যেন নূতন পর্বদিন এসেছিল সাঁতালী গাঁয়ে।

—কি আদেশ কও মা!

পিঙলার সেই এক কথা।—সিদ্ধপুরুষ ছেড়ে দে, ছেড়ে দে। কন্যা থাকিবে না। কন্যা থাকিবে না।

বলতে বলতে নির্জীব হয়ে পড়েছিল পিঙলা। যেন নিথর হয়ে গিয়েছিল। সে জেগেছিল দীর্ঘক্ষণ পর। তখন তার সামনে দাঁড়িয়ে গঙ্গারাম, চোখে তার ক্রূর দৃষ্টি। ডোমন-করেতের দৃষ্টি মেলে তার দিকে চেয়ে ছিল।

কিছুক্ষণ পর পিঙলা টলতে টলতে উঠল, ডাকলে–ভাদুমামা গ!

—জনুনী!

–ধর আমাকে।

–কোথা যাবে গ, ই দেহ নিয়া?

—যাব। ঠাকুর কোথাকে আছে, নিয়া চল আমাকে। বিষহরির আদেশে কইছি মুই। নিয়া চল।

আশ্চর্য আদেশের সুর ফুটে উঠেছিল পিঙলার কণ্ঠস্বরে। সে সুর লঙ্ঘনের সাহস বেদেদের কোনোকালে নাই।

হাতে পায়ে বেঁধে ফেলে রেখেছিল নাগু ঠাকুরকে।

আশ্চর্য, নাগু ঠাকুর চুপ করে শুয়ে ছিল—যেন আরাম শয্যায় শুয়ে আছে। পিঙলার ধ্যানকল্পনার দেখা ছবির সঙ্গে আশ্চর্য মিল।

পিঙলা প্রথমেই তাকে প্রণাম করলে, তারপর নিজের হাতে তার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে হাত জোড় করে বললে—বেদেকুলের অপরাধ মাৰ্জ্জনা করি যাও ঠাকুর। তুমি ঘর যাও।

নাগু ঠাকুর উঠে দাঁড়িয়ে একবার গম্ভীরকণ্ঠে ডাকলে পরমেশ্বরী মা! তারপর বললে–প্রমাণ চেয়েছিস তোরা? ভাল, প্রমাণ আমি আনব। এনে, শোন, কন্যে, প্রমাণ দিয়েই তোকে আমি নিয়ে যাব। তোকে নইলে আমার জীবনটাই মিছে।

–ছি ঠাকুর, তুমি বেরাহ্মণ-–

–জাত আমি মানি না কন্যে, এ সাধনপথে জাত নাই। থাকলেও তোর জন্যে সে জাত আমি দিতে পারতাম। তোর জন্যে রাজসিংহাসনে থাকলে তাও দিতে পারতাম। নাগু ঠাকুরের লজ্জা নাই, মিছে কথা সে বলে না।

কথা বলতে বলতে নাগু ঠাকুর যেন আর একজন হয়ে গেল। ধন্বন্তরি, শিঙা যেন শানাই হল, তাতে যেন সুরে এক মধুর গান বেজে উঠল। মুখে চোখে গোরা রঙে যেন আবীরের ছটা ফুটল।

—সর্‌, সরে যা। দুটারে, দুটারেই খুন করব মুই।

বেদেদের ঠেলে এগিয়ে এল গঙ্গারাম।

হা-হা করে হেসে উঠল নাগু ঠাকুর। এবার আর সে অপ্রস্তুত নয়। হাতের লোহার ত্রিশূলটা তুলে বললে—আয়। শুধু হাতে যদি চাস তো তাই আয়। হয়ে যাক, আজই হয়ে যাক।

তীক্ষ্মস্বরে চিকার করে উঠল পিঙলাখবরদার! ঠাকুর যা বলিছে সে আপন কথা বলিছে! মুই যাই নাই। যতক্ষণ মায়ের আদেশ না মিলবে মুই যাব না। বেরাহ্মণকে পথ দে।

গঙ্গারাম নাণ্ড ঠাকুরের হাতে ত্রিশূল দেখে, অথবা পিঙলার আদেশে, কে জানে, থমকে দাঁড়াল।

নাগু ঠাকুর বেরিয়ে গেল বেদেপাড়া থেকে। যাবার সময় গঙ্গারামের সামনে দাঁড়িয়ে বললে প্রমাণ যেদিন আনব, সেদিন এই কিলের শোধ আমি নোব। বুকটাকে লোহাতে বাঁধিয়ে রাখিস, এক কিল সেদিন আমি মারব তোর বুকে। না, দু কিল—এক কিল আসল, এক কিল সুদ। হা-হা করে হেসে উঠল নাগু ঠাকুর।

ওই হাসি হাসতে হাসতেই চলে গেল সে।

গোটা বেদেপাড়াটা স্তম্ভিত হয়ে রইল।

 

পিঙলা বললে—ধন্বন্তরিভাই, তুমার কাছে মুই কিছু গোপন করব না, পরানের কথাগুলান বুকের ভিতরে গুমুরা গুমুর্যা কেঁদ্যা সারা হল। দুঃখের ভাগী আপন জনার কাছে না-বলা শান্তি নাই। তুমারে সকল কথাই কই, শুন। হও তুমি মরদ মানুষ তবু তুমি আমার ধরম-ভাই। মনে লাগে, যেন কত জনমের আপন থেক্যাও আপনজনা। বলি শুন ভাই। মানুষটা চল্যা গেল, এ হতভাগীর নয়ন দুটা আপনা থেক্যাই ফিরল তার পানে। সে চলে গেল, কিন্তু পথ থেকে নয়ন। দুটা আর ফিরল না। লোকে পাঁচ কথা কইলে। কিন্তু কি করব কও? ধন্বন্তরিভাই, সুয্যমুখী পুষ্প সূরযঠাকুরের পানে তাকায়ে থাকে, দেবতার রথ চলে, পুব থেকা পচি মুখে-নয়নে তার পলক পড়ে না, নয়ন তার ফেরে না। নাগু ঠাকুর আমার সূরযঠাকুর। তেমুনি বরন তেমুনি ছটা–ঠাকুর আমার বন্ধন-মোচনের আদেশ নিয়া আসিল, কইল-ওই কন্যের লইলে পরানটা মিছা, পিথিমীটা মিছা, বিদ্যা মিছা, সিদ্ধি মিছা; তার লাগি সে জাত মানে না, কুল মানে না, স্বগ্‌গ মানে না। এই কালো কন্যে-কালনাগিনী—এরে নিয়া ঘর বাঁধিবে, বুকে ধরিবে, হেন পুরুষ ই পিথিমীতে কে? কোথায় আছে? আছে ওই নাগবিদ্যায় সিদ্ধ নাগু ঠাকুর। নাগলোকে নর গেলে পরে পরান নিয়া ফেরে না। নাগলোকের বাতাসে বিষ মানুষ ঢল্যা পড়ে যায়, নাগলোকের দংশনে পরান যায়। কিন্তু বীরপুরুষের যায় না। পাণ্ডব অর্জুন নাগরাজার কন্যেকে দেখেছিলমা-গঙ্গার জলে, কনেকে পাবার তরে হাত বাড়ালে, কন্যে হেসে ড়ুব দিলে জলে। বীরপুরুষও ড়ুবল। এস্যা উঠল নাগলোকে। বিষ-বাতাসে সে ঢল্যা পড়ল না, সে বাতাসে তার পরানে মধুর মদের নেশা ধরায়ে দিলে। নাগলোক এল হাঁ-হাঁ করে, বীরপুরুষ যুদ্ধ করে। কন্যেকে জয় করে লিলে। নাগু ঠাকুর আমার তাই। সে চলে গেল, আমার নয়ন দুটি তার পথের পানে নাফির্যা থাকে কি করে কও? তাকায়ে ছিলম তার পথের পানে। রাঢ়ের পথ, মা-গঙ্গার কূল থেকে চল্যা গিয়াছে পচি মুখে। দুই ধারে তালগাছের সারিও চলা গিয়াছে—আঁকাবঁকা পথের দুই ধারে এঁকেবেঁক। সুযিঠাকুর তখুন পাটে বসেছে, তার লাল ছটা সেই তালগাছের সারির মাথায় মাথায় রঙের ছোপ বুলায়ে দিয়েছে; চিকন পাতায় পাতায় সে পিছলে পিছলে। পড়িছে। মাটির ধুলোতে তার আভা পড়িছে। ওদিকে মাঠে তিল ফুলের বেগুনে রঙের উপর পড়িছে লাল আলোর রঙ। নাগু ঠাকুর সেই পথ ধরা চল্যা গেল। মুই অভাগিনী রইলম খালি পথের পানে তাকায়ে। বাঁশ আমার ছিল না। শ হল, কে যেন ঘাড়ে ধরে দিলেক ঝকি!

ঝুঁকি দিলে গঙ্গারাম।

কুৎসিত হাসি হেসে সে বললে–চাঁপার ফুল ফুটল লাগিছে! অ্যাঁ!

চাঁপার ফুলের অর্থ, ধন্বন্তরিভাই জানে কি না প্রশ্ন করলে পিঙলা। শিবরাম হাসলেন। মৃদুস্বরে বললেন–-জানি।

শিবরাম জানবেন বৈকি। তিনি যে আচার্য ধূর্জটি কবিরাজের শিষ্য। তিনি গ্রামের মানুষ, শুধু গ্রামের মানুষ নন, গ্রামের যে মানুষ ভূমিকে জানে, নদীকে জানে, বৃক্ষকে জানে, লতাকে জানে, ফল ফুল ফসলকে জানে, কীট-পতঙ্গ জীব-জীবনকে জানে—সেই মানুষ। তিনি জানেন, নাগমিলন-তৃষাতুরা নাগিনীর অঙ্গসৌরভ ওই চাপার গন্ধ। প্রকৃতির নিয়মে অভিসারিকা নাগিনীর অঙ্গখানি সৌরভে ভরে উঠবে, চম্পকগন্ধা তার প্রেমের আমন্ত্রণ পাঠিয়ে দেবে-অন্ধকার লোকের দিকে দিকে।

পিঙলা বলেনা না। হল না। তুমি জান না ধন্বন্তরিভাই। সে বলে—অভিসারিকা নাগিনী চম্পকগন্ধা বটে, এ কথাটা ঠিক। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম না কি বললে না? ও কথাটার অর্থ কি সে তা জানে না, তবে মূল তথ্যটা তা নয়। কালো কানাই গো, কালো কানাই, কালিন্দীর কূলে ব্ৰজধাম, সেখানের মাটিতে উদয় হয়েছিল—কালোর্চাদের। সেই কানাইয়ের কারণ। শোন, গান শোন।

বিচিত্র বেদের মেয়ে, মাথার উপরে ঝড়ো আকাশ, বাতাসের একটানা শেশো শব্দ, তারই সঙ্গে যেন সুর মিলিয়েই গান ধরে দিলে—

কালীদহের কূলে বসে, সাজে ও কার ঝিয়ারী?
ও তো লয় কো গৌরবরনী রাধা বধূ শ্যামপিয়ারী।
ও কার ঝিয়ারী?

সাজছে যে তার দেহের বর্ণ কালো। কালো কানাইয়ের বর্ণের আলো আছে, কানাই কালোভুবন আলো করে; এ মেয়ের কালো রঙে আলো নাই কিন্তু চিকন বটে! ও হল কালীয়নাগনন্দিনী, কালীদহের কূলে মনোহর সজ্জায় সেজে কালো কানাইয়ের আশায় বসে আছে। অঙ্গে তার চম্পকসজ্জা।

খোঁপায় পরেছে চাঁপা ফুল, গলায় পরেছে চাপার মালা। বাহুতে চপার বাজুবন্ধ, হাতে চাপার বালা, কোমরে চাপার সাতনরী! কালীদহের কূলে বসে কদম্বতলার দিকে চেয়ে গুনগুন করে সে গান গাইছে–

ওরে ও নিচুর কালিয়া,
কি অগ্নি জ্বালালি বুকে–কি বিষমো জ্বালা!
সে জ্বালায় মোর বুকের বিষ–জ্বলা জ্বলা জ্বলা হইল মধু!
আমার মুখের বিষের পাত্রে, মধু আমার খাইয়া যাও রে বঁধু!

ধূর্জটি কবিরাজের শ্ৰীমদ্ভাগবতে মহাভারতে হরিবংশে আছে শ্রীকৃষ্ণের কালীয়নাগ দমনের কথা। পিঙলার সাঁতালী গাঁয়ের বেদেদের আছে আরও খানিকটা। ওরা বলে—আরও আছে। বলে—যুদ্ধে নাগ হার মানেন নাই। বিষম যুদ্ধের পর নাগ বললেন–আমি মরব, তবু হার মানব না। হার মানতে পারি এক শর্তে। সে শর্ত হল, তোমাকে আমার জামাই হতে হবে। আমার কন্যাকে বিয়ে করতে হবে। বল, তা হলে হার মানব। কুটিল কানাই তাতেই রাজি হলেন। কালীদহের জলের তলায় বেজে উঠল বিয়ের বাদ্যি। কালীয়নাগ হার মেনে মাথা নোয়াল, অস্ত্র সমর্পণ করলে। কালীয়নাগের বিষ-মাখানো অস্ত্রগুলি নিয়ে, মাথার মণি নিয়ে কানাই এই আসি বলে চলে গেলেন—আর এলেন না। চলে গেলেন মথুরা। সেখান থেকে দ্বারকা। ওরা বলে–সেই অবধি সন্ধ্যাকালে কালীদহের কূলে দেখা যেত এক কালো মেয়েকে। পরনে তার রাঙা শাড়ি, চোখে তার নিষ্পলক দৃষ্টি, দেহে তার লতার মত কমনীয় গঠন-লাবণ্য, সর্বাঙ্গে চম্পাভরণ। সে কাঁদত। নিত্য কাঁদত। আর ওই গান গাইত—ওরে ও নিঠুর কালিয়া!

এই কাহিনী ওদের গানে আছে, মুখে মুখে গল্পে আছে।

সন্ধ্যাবেলা এই কাহিনী শুনে, স্মরণ করে সাঁতালীর নাগিনী কন্যেরা চিরকাল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। বিরলে বসে গুনগুন করে অথবা নির্জন প্রান্তরপথে উচ্চকণ্ঠে সকরুণ সুরে ওই গান চিরকাল গেয়ে আসছে–

আমার বুকের বিষ জ্বল্যা জ্বল্যা জ্বল্যা হইল মধু।

কালীদহের কূলে কৃষ্ণাভিলাষিনী ব্যর্থ-অভিসারিকা কালীয়নাগনন্দিনীর চম্পকসজ্জার সৌরভ একদা বিচিত্র রহস্যে তার দেহসৌরভে পরিণত হয়েছিল। সেই চম্পকগন্ধযুক্তা বেদনাতুরা কুমারীকে দেখে নাকি অন্য সব পতিগরবিনী সোহাগিনী নাগকন্যারা হেসে ব্যঙ্গ করেছিল। সেই ব্যঙ্গে বেদনার উপর বেদনা পেয়ে কৃষ্ণাভিলাষিনী চম্পকগন্ধা কুমারী অভিশাপ দিয়েছিল, বলেছিল—এ কামনা কার না আছে সৃষ্টিতে? আমার সে কামনা দেহগন্ধে প্রকাশ পেয়েছে বলে যেমন ব্যঙ্গ করলি তোরা, তেমনি আমার অভিশাপে নাগিনী কুলে যার অন্তরে যখন এই কামনা জাগবে, তখনই তার অঙ্গ থেকে নির্গত হবে এই গন্ধ। আমি কৃষ্ণাভিলাষিনী, আমার তো লজ্জা নাই, কিন্তু তোরা লজ্জা পাবিশাশুড়ি-নন্দ-শ্বশুর-ভাসুরের সংসারে, সংসারের বাইরে নাগপ্রধানদের সমাজে।

শিবরাম বলেন-ওদের পুরাণকথা ওরাই সৃষ্টি করেছে। আমাদের পুরাণ সত্য হলেও ওদের পুরাণকথাও সত্য; কিন্তু থাক্ সে কথা। পিঙলার কথাই বলি শোন।

 

পিঙলা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। বোধহয় কালীয়নাগকুমারীর বেদনার কথা স্মরণ করে। বেদনা অনুভব করছিল। বোধহয় নিজের বেদনার সঙ্গে মিলিয়ে নিচ্ছিল।

শিবরাম বলেন–পিঙলার চোখে সেইদিন প্রথম জল দেখলাম। পিঙলার শীর্ণ কালো গাল দুটি বেয়ে নেমে এল দুটি জলের ধারা। তিনি বললেন—আজ থাক্ রে বহিন। আজ তুই স্নান করে বাড়ি যা। এইবার বৃষ্টি আসবে।

পিঙলা আকাশের দিকে তাকালে।

মোটা মোটা ফোটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু হল। মোটা ফোটা কিন্তু ধারাতে ঘন নয়, একটু দূরে দূরে পড়ছে, যেমন বৃষ্টি নামার শুরুতে অনেক সময় হয়। হিজলের জলে মোটা ফোঁটাগুলি সশব্দে আছড়ে পড়ে ঠিক যেন খই ফোটাচ্ছে, যেন পালিশ-করা কালো পাথরের মেঝের উপর অনেকগুলো ছেনি-হাতুড়ির ঘা পড়ছে। পিঙলা কথার উত্তর না দিয়ে মুখ উচু করে সেই বৃষ্টি মুখে নিতে লাগল।

শিবরাম উঠেছিলেন। পিঙলা মুখ নামালে, বললে–নাগ ভাই, বস। ই জল হবে না। উড়ে চলেছে মেঘ, দু ফোঁটা দিয়া ধরম রেখ্যা গেল নিজের, আর আমার চোখের জল ধুয়্যা দিয়া গেল। বস, শুন। আমার কথা শুন্যা যাও।

—জান ভাই ধন্বন্তরি, একনার অমৃতি, অন্যজনের বিষ। গরল পান করা শিব মৃত্যুঞ্জয়, দেবতারা অমর হন সুধা পান করা। রাম-সীতের কথায় আছে, রামের বাবা দশরথকে অন্ধক মুনি শাপ দিলে, কি, পুত্যশোকে মরণ হবে। শাপ শুন্যা রাজা নাচতে লাগল। কেনে? নাচিস কেনে রাজা? রাজা কয়-ই যে আমার আশীর্বাদ, আমার পুত্তু নাই, আগে পুত্ত্ব হোক, তবে তো পুভুশোকে পরানটা যাবে! কালীনাগের জন্যে কানাইগরবিনী শাপ দিলেকসে শাপ নাগিনীদের লাজের কারণ হইল, কিন্তু তাতেই নাগিনী হইল মোহিনী। তাদের অঙ্গগন্ধে নাগে হইল পাগল। আর সাঁতালীর নাগিনী কন্যের ওই হইল সধ্বনাশের হেতু, পরানের ঘরের আগুন, সে আগুন ঘরে লাগলে ঘরের সাথে নিজে সমেত পুড়া ছারখার হয়া যায়। নাগিনী কন্যের অঙ্গে চাপার বাস ফুটলে হয় কন্যে আত্মঘাতী হয়, লয়তো কুলে কালি দিয়া বেদেকুলে পাপ চাপায়ে অকূলে ভাসে। জান তো শবলার কথা। নাগিনী কন্যের অঙ্গে চাপার বাস। অভিসম্পাত, এর চেয়ে বড় গাল আর হয় না। বেদেঘরের বউ কি কন্যের সকল পাপ জরিমানায় মাপ হয়, রাত কাটায়ে সকালে বেদের বউ কন্যে ঘরকে ফিরলে বেদের মরদ তার অঙ্গটা হেঁচা দেয় ঠেঙার বাড়ি দিয়া, কিন্তু ছাড়-বিড় নাই, জরিমানা দিয়া দিল্যাই সব মাজ্জনা; যদি গেরস্ত কেউ সাক্ষী। দেয়, কি, রাতে তার বাড়িতে তার আশ্চয়ে ছিল, তবে জরিমানাও লাগে না। কিন্তু লাগিনী কন্যের বেলা তা লয়। তার সাজাপরানটা দিতে হয়। তাই ওই পাপীটা, ওই শিরবেদেটা যখন কইল—কি, চাপার ফুল ফুটল লাগিছে! অ্যাঁ? তখুন আমার পায়ের নখ থেক্যা মাথার চুল পয্যন্ত বিদ্যুৎ খেলে গেল।

এর পর মুহূর্তে পিঙলার রূপ পালটে গিয়েছিল।

সে এক বিস্ময়কর পরিবর্তন! স্থির বিস্ফারিত দৃষ্টি নিষ্কম্প দেহ, এক মুহূর্তে কন্যা যেন সমাধিস্থ হয়ে গিয়েছে। বাইরের পৃথিবীর সব যেন হারিয়ে যাচ্ছে, মিলিয়ে যাচ্ছে, মুছে যাচ্ছে। হিজলবিল, সাঁতালীর ঘাসবন, সামনের বেদেরা—কেউ নাই, কিছু নাই।

বুকের ভিতর কোথায় ফুটন্ত চাপার ফুল! ফুটেছে চাপার ফুল! কই? কোথায়? কোথায়?

না। মিছে কথা। পিঙলা চিৎকার করে উঠেছিল। আপনার মন তনুতন্ন করে অনুসন্ধান করে দেখে সে কিছুতেই নিজেকে অপরাধিনী মনে করতে পারে নাই। কই? নাগু ঠাকুরের ওই গৌরবর্ণ বীরের মত দেহখান দেখে তার তো বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বার কামনা হয় নাই! ওই তো নাগু ঠাকুর চলে গেল—কই, তার তো ইচ্ছে হয় নাই সাঁতালীর আটন ছেড়ে, সাঁতালীর বেদেদের জাতিকুল ছেড়ে ঠাকুরের সঙ্গে ওই তালগাছ-ঘেরা পথ দিয়ে চলে যায় নিরুদ্দেশে! তার চলে যাওয়া পথের পানে তাকিয়ে সে ছিল, এ কথা সত্য; কিন্তু এমন যে বীরপুরুষতার পথের পানে কে না তাকায়? সীতা সতীর স্বয়ম্বরে ধনুকভাঙার পণ ছিল। মহাদেবের ধনুক। রামচন্দ্র যখন ধনুক ভাঙবার জন্য সভায় ঢুকলেন, তখন সীতা সতী রাজবাড়ির ছাদের উপর। থেকে তাকে দেখে কি তার পানে তাকায়ে থাকে নাই? মনে মনে শিবঠাকুরকে ডেকে বলে নাই—হে শিব, তুমি দয়া করো, তোমার ধনুককে তুমি পাখির পালকের মত হালকা করে দিয়ে, কাশের কাঠির মত পলকা করে দিয়ো—যেন রামচন্দ্রের হাতে ধনুকখানা ভেঙে যায়! মনে মনে বলে নাই—মা মঙ্গলচণ্ডী, রামচন্দ্রের হাতে দিয়ে বাসুকী নাগের হাজার ফণার বল, যে বলে সে পৃথিবীকে ধরে থাকে মাথায়—সেই বল; আর বুকে দিয়ে অনন্ত নাগের সাহস, যে সাহসে প্রলয়ের অন্ধকারে সারা সৃষ্টি দিগ্বিদিক ড়ুবে গেলে মুছে গেলে একা ফণা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। কাল সমুদুরের মাঝখানে—সেই সাহস। তাতে কি অপরাধিনী হয়েছিলেন সীতা সতী? রামচন্দ্রকে চোখে পরানে ভাল লেগেছিল তাই কথাগুলি কয়েছিলেন-ভগবানও কান পেতে সে কথা শুনেছিলেন। ধনুক ভাঙার আগে তো সীতা ফুলের মালাগাছাটা রামের গলায় পরায়ে দেন। নাই! পিঙলাও দেয় নাই। সে শুধু তার পানে চেয়ে বলেছে—ভগবান, ঠাকুরের প্রতিজ্ঞা পূরণ কর, সে যেন এই অভাগিনী বন্দিনী কন্যার মুক্তির আদেশ নিয়ে ফিরে আসে। বিধাতার শিলমোহর করা মা-বিষহরির হাতের লেখা ছাড়পত্র সে যেন আনতে পারে।

চোখের ভাল লাগা, মনের ভাল লাগা—এর উপরে হাত নাই; কিন্তু সে ভাললাগাকে সে তো কুলধর্মের চেয়ে বড় করে নাই, তাকে সে লঙ্ন করে নাই! সে এক জিনিস, আর বুকের মধ্যে চাপা ফুল ফোটা আর এক জিনিস। সে ফুল যখন ফোটে, তখন বুকের গঙ্গায় বান ডাকে; সাদা ফটিকের মত জল-ঘোলা ঘোরালো হয়; ছলছল ডাক, কলকল রব তোলে, কুল মানে না, বাঁধ মানে না, সব ভেঙ্গেচুরে ভাসিয়ে চলে যায়। স্বর্গের কন্যে মর্ত্যে নেমে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সাত সমুদ্রের নোনা জলে।

তবে?

না, মিছে কথা। সে চিৎকার করে উঠেছিলনা না না।

শিবরাম বলেন-আমি মনশ্চক্ষে দেখলাম, সঙ্গে সঙ্গে পিঙলার সমস্ত দেহ পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল; কালবৈশাখীর ঝড়ে আন্দোলিত ঝাউগাছের মত প্রবল অস্বীকৃতির দোলায় দুলে উঠল। তারই ঝাপটায় তার মাথার চুলের রাশি খুলে এলিয়ে পড়ল। চোখ দুটো হয়ে উঠল প্রখরতার মধ্যে ফুটে উঠল উন্মাদ ক্রোধের ছটা।

উন্মাদ রোগ তখন পিঙলাকে আক্রমণ করেছে।

পিঙলা বললে—ধন্বন্তরিভাই, মুখে কইলম, মনে কইলম, ডাকলম বিষহরিকে। সেদিন তারে ডেক্যা কইলম-জননী, তুমার বিধান যদি মুই লঙ্ন কর্যা থাকি, বুকের চাপার গাছে জল ঢেল্যা যদি চাপার ফুল ফুটায়ে থাকি, তবে তুমি কও। তুমার বিচার তুমি কর। হোক সেই বিচার। সে পাগলের মত ছুটল। নাগু ঠাকুরকে যে-ঘরে বেঁধে রেখেছিল, সেই ঘরের দিকে।

নাগু ঠাকুরের বাঁধন সে-ই নিজের হাতে খুলে দিয়েছিল। তার চোখের সামনে দিয়ে নাগু ঠাকুর চলে গিয়েছে। কিন্তু তার সেই মহানাগের ঝাঁপি সে নিয়ে যায় নাই, সেটা পড়ে আছে। সেই ঘরে!

বেদের দল এ কথা বুঝতে পারে নাই; তারা বিস্মিত হয়ে ভাবছিল-ওদিকে কোথায় চলেছে কন্যা?

পিঙলা তুলে নিয়ে এল সেই কাঁপি। বিষহরির আটনের সামনে ঝাপিটা নামিয়ে চিৎকার করে উঠল—বিচার কর মা-বিষহরি অনুনী, তুমি বিচার কর।

সমস্ত সাঁতালী আতঙ্কে শিউরে উঠেছিল—কন্যা, এ কি করলে? কিন্তু উপায় নাই। আটনের সামনে এনে যখন নাগের ঝাঁপি পেতে বিচার চেয়েছে, তখন উপায় নাই। সমবেত মেয়েরা অস্ফুট শব্দ করে উঠেছিল—ও মা গ!

সুরধুনী চেঁচিয়ে উঠেছিল, কন্যে!

পুরুষেরা নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে এ ওর মুখের দিকে চেয়েছিল। গঙ্গারামও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখে কি যেন একটা খেলে যাচ্ছিল। যেন হিজল বিলের গভীর জলের তলায় কোনো জলচর নড়ে নড়ে উঠছে। ভাদু ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখে যেন আগুন লেগেছে। সমস্ত শরীর তার শক্ত হয়ে উঠেছে–হাতে কপালে শিরাগুলো মোটা হয়ে দাঁড়িয়ে উঠেছে।

পিঙলা হাঁপাচ্ছিল, চোখে তার পাগলের চাউনি। বার বার মাথার এলানো চুল মুখে এসে পড়ছিল। সে হাত দিয়ে সরায় নি সে চুল, মাথা ঝুঁকি দিয়ে সরিয়ে পিঠে ফেলছিল। খুলে দিয়েছিল ঊর্ধ্বাঙ্গের কাপড়, আঁচলখানা লুটিয়ে পড়েছিল মাটিতে। তারপর সে ক্ষিপ্ৰ হাতে খুলে দিলে সেই মহানাগের কাঁপি। কামাখ্যা-পাহাড়ের শঙ্খচূড়। বল হাঁটু গেড়ে তারই সামনে নগ্ন বক্ষ পেতে।

নাগিনী কন্যা যদি চম্পকগন্ধা হয়ে থাকে, যদি তার অঙ্গে নাগ-সাহচর্য-কামনা জেগে থাকে, তবে ওই নাগ তাকে সাদরে বেষ্টন করে ধরবে পাকে পাকে কন্যার অঙ্গ বেষ্টন করে মাথার পাশে তুলবে ফণা। না হলে নাগ তার স্বভাবধর্মে মারবে তাকে ছোবল; ওই অনাবৃত বক্ষে করবে তাকে দংশন।

নাগু ঠাকুরের নাগ—তার বিষ আছে কি গালা হয়েছে সে জানে নাগু ঠাকুর।

মুহূর্তে মাথা তুলে দাঁড়াল হিংস্ৰ শঙ্খচূড়।

সামনে পিঙলা বসেছে বুক পেতে। সাপটার ফণা তার মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে। সেটা পিছন দিকে হেলছে, জিভ দুটো লকলক করছে, স্থির কালো দুটো চোখ পিঙলার মুখের দিকে নিবদ্ধ। হেলছে পিছনের দিকে, বুকটা চিতিয়ে উঠছে, মারবে ছোবল। বেদেদের চোখ মুহূর্তে ধরে নিয়েছে। সাপের অভিপ্রায়। কন্যাকে জড়িয়ে ধরতে চায় না, দংশনই করতে চায়। পিঙলার চোখে। বিজয়িনীর দৃষ্টি—তাতে উন্মাদ আনন্দ ফুটে উঠেছে। সে চিৎকার করে উঠল—আয়। পড়ল নাগ। ছোবল দিয়ে। অসমসাহসিনীর দুই হাত মুহূর্তে উর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত হল নাগটার ফণা লক্ষ্য করে। অব্যর্থ লক্ষ্যে লুফে নেওয়ার মত গ্রহণ করবে। কিন্তু তার আগেই সাঁতালীর বিষবেদেদের অগ্রগণ্য। ওস্তাদ ভাদু তার হাতের লাঠিটা দিয়ে আঘাত করেছে সাপটার ঠিক গলার নিচে; সে আঘাত এমনি ক্ষিপ্র, এমনি নিপুণ, এমনি অব্যৰ্থ যে সাপটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়ল পিঙলার পাশে মাটির উপর। শুধু তাই নয়, ধরাশায়ী সাপটার গলার উপর কঠিন চাপে চেপে বসল ভাদুর সেই লাঠি।

বেদেরা জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল।

সুরধুনী পিঙলার স্থলিত আঁচলখানা তুলে তার অঙ্গ আবৃত করে দিয়ে বাঁকা দৃষ্টিতে গঙ্গারামের দিকে তাকিয়ে বললে-পাপী! পাপী কুথাকার।

গঙ্গারাম শিরবেদে, সাঁতালীর একচ্ছত্র মালিক, দণ্ডমুণ্ডের কর্তা; তার ভয় নাই। সে ঘাড়। নাড়তে নাড়তে চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *