আমাদের আবার নতুন করে জীবনযাত্রা শুরু হল। দিদিমণির ওখানে আমরা একেবারে ঘরের লোক হয়ে গিয়েছিলুম। সকাল থেকে সন্ধে অবধি হাজার কাজের ভার আমাদের ওপরে চাপানো ছিল। সমস্ত কাজ শেষ করে রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর বিশুদার ঘরে আমি, পরিতোষ, দিদিমণি, বিশুদা ও আহিয়া মিলে ভারি মিষ্টি একটা আড্ডা জমাতুম। এখানে প্রতি সন্ধ্যায় সেই স্মৃতির পীড়ন চলতে লাগল আমার মনের ওপর দিয়ে মর্মান্তিকভাবে। এখানে খাওয়া-দাওয়া, থাকা-শোওয়া ওখানকার চেয়ে অনেক ভালো, কিন্তু সেই পাতাঝরা গাছের শ্রেণী, সেই সারাদিন ধরে শোঁ-শোঁ হাওয়ার হুঙ্কার, মৃত্যুপথযাত্রী বিশুদার হাসিভরা মুখ ও রসিকতা, সবার ওপরে কল্যাণময়ী দিদিমণি, কোথায় পাব এখানে!
সে-জগতে ছিল নারীমূর্তি দুর্লভ। ব্রহ্মচারীদের আশ্রম হলেও না-হয় কথা ছিল। কিন্তু নবাবসাহেবের ঘর ছাড়া বাড়ির এখানে সেখানে, বিশেষ করে পিয়ারাসাহেবের বৈঠকখানায় বড় বড় নগ্ন ও অর্ধনগ্ন নারীর তৈলচিত্র টাঙানো। পিয়ারাসাহেবের সান্ধ্য আসরে বিস্তর লোক যাওয়া আসা করে। তার মধ্যে জনকয়েক খুবই বকে, কেউ কেউ বেশি কথা বলে না, কেউ কেউ একেবারে চুপ করে বসে থাকে, আসা-যাওয়ার সম্ভাষণটুকু বাদে তাদের মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না। কিন্তু লক্ষ করেছি, নারীর প্রসঙ্গ উঠলে আর রক্ষে নেই, সবাই একেবারে পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে।
অথচ নারীর মূর্তি সেখানে দেখাই যায় না। মেয়েদের থাকবার মহল, সে যে কোথায় তা জানি না। সেখানে পিয়ারাসাহেব, নবাবসাহেব ও হকিম ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের প্রবেশের অধিকার নেই। সে-মহলে নবাব-বাড়ির অনেক মহিলা ও নিরাশ্রয়া আত্মীয়া বাস করেন। একপাল দাসী আছে সেখানে, কিন্তু সকলের হারেম ছেড়ে বাইরে যাবার হুকুম নেই–
দিনকতক যেতে-না-যেতেই এই নারীহীন রাজ্যে নিজেকে বড়ই নিঃসঙ্গ বলে মনে হতে লাগল। পরিতোষকে জিজ্ঞাসা করলুম, কি রে, কেমন লাগছে এখানে?
সে বেশ খুশি মনেই বললে, বেড়ে লাগছে!
রাণুমার সঙ্গে পরিচয় হবার পরদিন সকালে ইস্টিশান থেকে বেরুবার সময় সেই যে স্নান করেছিলুম, তার পরে মাথায় আর জল ঠেকানো হয়নি। অবিশ্যি এখানে আসার পরের দিন সকালেই খাবার আগে চাকর এসে বলেছিল, চলুন, স্নান করবেন।
স্নান করব না–শুনে সে জানিয়েছিল যে, গরম জলের যদি প্রয়োজন হয় তাও আছে। আমরা ‘আজকে নয়’ বলে চাকরকে বিদায় দিলেও প্রতিদিনই ‘আজকে নয়’ চলতে লাগল। শীতকাতর হলেও আমাদের প্রতিদিন স্নান করার অভ্যেস ছিল। শীতকালেও একদিনের জন্য স্নান বাদ দিলে শরীর রুক্ষ হয়ে উঠত। তথাপি স্নানের প্রতি এমত বিরাগের কারণ হচ্ছে–আমাদের বস্ত্রহীনতা। ধুতি ও জামা অত্যন্ত মলিন ও এমনভাবে ছিন্ন হয়েছিল যে, সদাসর্বদাই সর্বাঙ্গে র্যাপার জড়িয়ে থাকতে হত। উত্তরার্ধের সৌজন্য রক্ষা করতে গিয়ে অপরার্ধের শ্লীলতা বাঁচাবার জন্যে তখুনি থেবড়ে বসে পড়তে হত। কিছুদিন এইরকম চললে উভয়কে অচিরেই যে নগ্নানন্দ ও দিগম্বরানন্দ মহারাজ হয়ে বদরিনারায়ণাভিমুখে প্রয়াণ করতে হবে, সে-বিষয়ে ক্রমেই নিঃসন্দেহ হয়ে উঠছিলুম। এমন সময় দেবতা একটু নেকনজর করলেন।
চাকরেরা রোজই আসে স্নানের কথা বলতে, আর আমরা বলি ‘আজ নয়’, চাকরেরা চলে যায়। সেদিন দ্বিপ্রহরে কবুতরখানা থেকে ফিরে নবাবসাহেবের সঙ্গে আমরা গল্প করছি, এমন সময় চাকর এসে জিজ্ঞাসা করলে, হুজুর, স্নান করবেন?
না।–বলতেই নবাবসাহেব বললেন, কেন, স্নান করবে না কেন?
তার পরে চাকরকে হুকুম দিলেন, এঁদের নিয়ে গিয়ে ভালো করে তেল মালিশ করে গরম জলে স্নান করিয়ে দাও।
আর আপত্তি করা চলে না, উঠতেই হল। গোসলখানার সামনে দুজন লোক তেল মাখাবার উপক্রম করতেই আমরা দুজনে একসঙ্গে স্নানের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলুম,–যদিও বেশ ভালো করেই জানা ছিল যে দুজন ভদ্রব্যক্তি এক সঙ্গে এক ঘরে স্নান করতে ঢোকাটা এখানকার চাকরদের চোখেও বিসদৃশ ঠেকবে। কিন্তু সদৃশ-বিজ্ঞানের সব ফর্মুলা মেনে চলবার মতন অবস্থা আমাদের ছিল না।
যা হোক, সেই ছেঁড়া ধুতি পরে স্নান করে র্যাপারকে লুঙ্গি করে পরা গেল। আমার র্যাপারখানার রঙ ছিল গ্যাডগ্যাডে সবুজ জমির ওপরে লাল সরু চেক, আর পরিতোষের র্যাপারখানার ছিল ছাই রঙের জমি ও তার ওপরে চওড়া কালো চেক।
ঘরের মধ্যে একটা বড় আয়না ছিল, যাতে আপাদমস্তক প্রতিফলিত হয়। লুঙ্গি পরে গায়ে সেই ছেঁড়া টুইলশার্ট চড়িয়ে, আস্তিন গুটিয়ে, আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে মনে হল, বহু কৃচ্ছ্রসাধনের ফলে এতদিনে সত্যিই আমার আমিত্ব লোপ পেয়েছে, সেই মোহনমূর্তি দেখে হাস্যসংবরণ করা দুরূহ হয়ে দাঁড়াল। পরিতোষ বললে, তোকে ঠিক গ্যাঁটকাটার মতন দেখাচ্ছে।
আমি বললুম, তোকে দেখাচ্ছে ঠিক গরুচোরের মতন।
ঘরের মধ্যকার সেই ঝাপসা আলোয় পরিতোষ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে নিজেকে দেখতে লাগল সেই আয়নায়। তার পরে হঠাৎ ফিরে আমার চোখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললে, ঠিক বলেছিস তুই। আমাদের দুজনের চোখেই কিরকম একটা চোর চোর ভাব এসেছে, দেখেছিস?
হবে না! সেদিন যা চোরের মার খাওয়া গেছে!
নিজেরাই শুকোতে দেব মনে করে ছেঁড়া কাপড় দুখানা নিংড়ে হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়া গেল। ঘরের বাইরেই একপাল চাকর দাঁড়িয়ে ছিল, তারা আমাদের সেই মনোহর সজ্জা দেখে প্রথমটা গেল অবাক হয়ে, তার পরে হাসি চাপবার প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল।
আমরা সেদিকে গ্রাহ্য না করে কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই একজন চাকর ছুটে এসে আমাদের হাত থেকে ধুতিখানা একরকম কেড়ে নিয়ে একদিকে চলে গেল।
সত্যি কথা বলতে কি, ধুতি বেহাত হওয়াতে শঙ্কিতই হয়ে পড়লুম। কারণ ব্যবহারের অযোগ্য মনে করে সেগুলো যদি তারা আর ফিরিয়ে না দেয়, তা হলে তো গেছি আর কি!
যুগলমূর্তি সেই চমকপ্রদ বেশে ঘরের মধ্যে ঢুকতেই নবাবসাহেব অবাক হয়ে খোলা চোখে আমাদের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন, তার পরে আড়চোখে দেখতে লাগলেন। লজ্জায় মনে হতে লাগল, স্নানের ঘর থেকেই হিমালয়ের দিকে রওনা হলেই হত ভালো। এমন সময় খাবার এসে পড়ায় সামলে গেলুম।
ইদানীং দুপুরবেলার ভোজনপর্বের পর আমরা পিয়ারাসাহেবের ঘরে গিয়ে আড্ডা জমাতুম। সেখানে বিড়ি-সিগারেটও বেশ উড়ত, আর আমরাও খুব বকতুম,–সহনশীল শ্রোতার অভাব ছিল না। সেদিন আড্ডায় বসে বেশ জমাট করে কলকাতার গল্প শুরু করেছি, এমন সময় ঘরের মধ্যে দুটো লোক এসে দাঁড়াল, একজনের কাঁধে গোটাকয়েক রঙিন ও সাদা কাপড়ের থানা আর একজনের গলায় ঝোলানো গজ-ফিতে।
তারা পিয়ারাসাহেবকে সেলাম করে দাঁড়াতেই সে আমাদের বললে, আপনাদের জামার মাপ নিতে এসেছে।
শুনে প্রথমটা আশ্চর্যই লাগল। কিন্তু-কিন্তু করছি দেখে আসরের এক বৃদ্ধ বললেন, যান যান, মাপটা দিয়ে এসে গল্প করবেন ‘খন।
দরজি আমাদের দুজনের মাপ নিয়ে কাপড় পছন্দ করতে বললে। দু-তিন রকমের ছিট পছন্দ করে দিতে দরজি কুর্নিশ করে চলে গেল। পিয়ারাসাহেবের ঘর থেকে ফিরে গিয়ে দেখি, সেখানে আমাদের জন্যে ধোয়া কোরা ধুতি ও শাড়িতে মিলিয়ে বারোখানি অপেক্ষা করছে।
সেই দিনই সন্ধ্যার একটু পরে দরজি এসে ছ’টা জামা দিয়ে গেল আর বলল, বাকি ছ’টা কাল এমন সময় এসে দিয়ে যাব।
হঠাৎ এতগুলো জামা কাপড় পেয়ে, ভিক্ষার সামগ্রী হলেও, খুবই খুশি হওয়া গেল।
রাত্রে আহারাদির পর আমাদের পয়মন্ত র্যাপার ছেড়ে নতুন ধুতি ও সেই রঙিন না-শার্ট না-পাঞ্জাবি না-পিরান জামা চড়িয়ে শুয়ে পড়লুম।
পরের দিন পিয়ারাসাহেব আমাদের আলাদা ডেকে দুজনকে পাঁচটা করে টাকা দিয়ে বললে, খরচ করুন, যখন যে জিনিসের দরকার পড়বে, আমি আপনাদের খাদিম রয়েছি আমাকে জানাবেন। এর পরদিনই পিয়ারাসাহেবের কাছ থেকে দোয়াত, কলম, চিঠি লেখবার কাগজ ও খাম চেয়ে নিয়ে দুজনে আলাদা করে দিদিমণিকে দুখানা দীর্ঘ পত্র লেখা গেল। তাতে বড়কর্তার কথা, টাকা কেড়ে নেওয়া, প্রহার ইত্যাদি সমস্ত বৃত্তান্ত তন্নতন্ন করে লিখে দিলুম। দুজনেই এ-কথা লিখে দিলুম যে, পত্রপাঠ মাত্র টাকা পাঠিয়ে দেবে, টাকা পেলেই আমরা ফিরে যাব।
সময়টা যে কী ভীষণ উৎকণ্ঠায় কাটতে লাগল, তা বোধ হয় আর লিখতে হবে না। চিঠির জবাব আসবার সময় উতরে যাওয়ার দু-তিন দিন পরে একদিন পিয়ারাসাহেবকে জিজ্ঞাসাই করে ফেললুম, আচ্ছা, সেদিন চিঠিটা ডাকে দেওয়া হয়েছিল তো?
পিয়ারাসাহেব চমকে উঠে বললে, সে কি! তা কখনও হতে পারে! আচ্ছা, আমি এখুনি তাকে ডাকাচ্ছি।
তখুনি সে-ব্যক্তির তলব পড়ল। সে বললে, হুজুরের হুকুম পাওয়া মাত্র আমি নিজে ডাকখানায় গিয়ে দু-পয়সার টিকিট লাগিয়ে বাক্সে ফেলে এসেছি।
কি আর করা যাবে! আবার চিঠি লেখবার সরঞ্জাম চেয়ে নিয়ে দিদিমণিকে দীর্ঘতর এক পত্ৰ লেখা গেল। সেদিনকার চিঠিতে যা গিয়েছিল তা তো লিখলুমই, তা ছাড়া আরও অনেক কথা লেখা হল। পিয়ারাসাহেব চিঠিখানা হাতে নিয়ে বললে, এটা তা হলে রেজেস্টারি করে পাঠানো যাক কি
বলেন?
বললুম, তা হলে তো ভালোই হয়।
তখুনি সেই লোকটাকে ডেকে পিয়ারাসাহেব জিজ্ঞাসা করলে, চিঠি রেজেস্টারি করতে পার?
লোকটার উজবুগের মতন চাউনি দেখে মনে হল যে, সে পারবে না।
পরিতোষ বললে, ডাকঘরটা আমাদের দেখিয়ে দাও, আমরাই রেজেস্টারি করে দেব’খন।
আমাদের উঠতে দেখে পিয়ারাসাহেব বললে, আচ্ছা, আমার একটা পরামর্শ শোনেন তো বলি। এ চিঠিখানা এমনি যাক, এর যদি জবাব না আসে, তখন রেজেস্টারি করা যাবে।
সভাস্থ একজন রসিকতা করে বললে, সে-চিঠিরও যদি জবাব না আসে?
পিয়ারাসাহেব তখুনি হেসে উত্তর দিলে, তা হলে ‘পিরিপেট’ তার করা হবে, উত্তর না দিয়ে আর উপায় থাকবে না।
কথাটা উচ্চারিত হওয়া মাত্র সভায় প্রশংসার উচ্চরোল উঠল। সভাস্থ সকলে উচ্ছ্বসিত হয়ে সাহেবজাদার বুদ্ধির তরফ করতে লাগল। সেই তারিফের তুফান উপেক্ষা করে লোকটা আমাদের চিঠিখানা হাতে নিয়ে ছুটল ডাকঘরের উদ্দেশে।
কিন্তু হায়! সেখানারও উত্তর পাবার দিন পেরিয়ে গেল, তবু দিদিমণির কোনো খবর পেলুম না। আমরা ঠিক করলুম, আর চিঠি লিখব না। কিন্তু পিয়ারাসাহেব একদিন নিজে থেকেই জিজ্ঞাসা করে, জবাব পাইনি শুনে বললে, দমে যাবেন না, এখনও দু-দুটো অস্ত্র আমাদের হাতে আছে। আপনারা আবার লিখুন।
এবারে শুধু পরিতোষ লিখলে, দিদিমণিকে ও বিশুদাকে একখানা, আমি আর লিখলুম না। কি জানি কেন, আমার মনের মধ্যে কয়েকদিন থেকেই কে যেন নিরন্তর বলে চলেছিল, রাজকুমারীর মতন দিদিমণির অধ্যায়ও শেষ হয়ে গেল। একটা ব্যথা-ভরা ঔদাস্যের পীড়নে নিষ্পেষিত হতে লাগলুম।
আবারও নির্দিষ্ট দিন অতীত হয়ে যাবার পর চিঠি এল না বটে, কিন্তু রেজিস্টারি চিঠির রসিদ ফিরে এল–মনোরমা দেবীর বদলে সই করে নিয়েছেন অমরনাথ বন্দ্যোউপাধ্যায় মহাশয়।
আর বাক্য-বিনিময়ের অবকাশ রইল না। উভয়েই মর্মে মর্মে বুঝতে পারলুম, দিদিমণির সঙ্গে চিরদিনের জন্যে বিচ্ছেদ হয়ে গেল।
দিদিমণির সঙ্গে চিরবিচ্ছেদের কথাটা আজ যত সহজে লিখে ফেলতে পারলুম, সেদিন কিন্তু তত সহজে সে-আঘাতকে স্বীকার করতে পারিনি। সৃষ্টিকর্তা আমার হৃদযন্ত্রটিকে ঘাতসহ করে তোলবার জন্যে তখন থেকেই যে বনেদ গাঁথতে শুরু করেছিলেন, সে-কথা কল্পনাও করতে পারিনি।
এতদিনে আমাদের এই নতুন কর্মক্ষেত্রকে অন্তরের সঙ্গে মেনে নেবার জন্যে মনের মধ্যে নতুন করে লড়াই শুরু হল। এখানে আমাদের কোনো কষ্টই নেই। এত খাতির যত্ন আদর, এমন উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ চোখের সামনে থাকলেও মানসলোকে জ্বলজ্বল করত দিদিমণি ও তাদের সংসার। কামলোকে নিয়ত গুঞ্জরিত হত একই তান–কবে সেখানে ফিরে যাব, কবে আবার জীবনের সেই সুখের দিনগুলি শুরু হবে, যে জীবনযাত্রায় অল্পদিন হলেও আমরা একান্তই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলুম, নিষ্ঠুর বিধাতা চোরের মার মেরে যে অভ্যেস ছুটিয়ে দিলেন।
রেজেস্টারি চিঠির রসিদে শ্রীমান বড়ে-ভাইয়ের দস্তখত দেখে নিমেষে আমাদের আশার প্রাসাদ ভূমিসাৎ হয়ে গেল। এখানে সেখানে ঘুরি,আমোদ আহ্লাদে ও আড্ডায় যোগ দিই; কিন্তু কোথায় যেন একটা অস্বস্তির খোঁচা স্মরণে বাজে, কিছুই ভালো লাগে না।
আমাদের হালচাল দেখে একদিন পিয়ারাসাহেব জিজ্ঞাসা করলে, ক’দিন থেকেই লক্ষ করছি আপনারা দুজনেই মনমরা হয়ে আছেন, কোনো কারণে আমাদের ওপর নারাজ হয়েছেন নাকি? বললুম, আপনাদের ওপর নারাজ হব–এত বড় অকৃতজ্ঞ আমাদের মনে করবেন না। এখানে আমরা খুবই সুখে আছি।
পিয়ারাসাহেব আবার বললে, কিন্তু মাপ করবেন, আপনাদের চেহারা দেখে আমার মনে হচ্ছে, নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে। আমি আপনাদের অধম ছাত্র, আমার দ্বারা যদি কিছু হয় তো বলুন।
পিয়ারাসাহেবের কথা শুনে পরিতোষ কি-একটা বলতে উদ্যত হয়ে থেমে গেল। ফিরে দেখলুম, তার চোখে মেঘ থমথম করছে। তার হালচাল দেখে থমকে গিয়ে পিয়ারাসাহেব কিছুক্ষণের জন্যে চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করলে, আচ্ছা, যেখানে তিন-তিনখানা চিঠি লিখলেন, সেখান থেকে কোনো উত্তর এসেছে কি?
পরিতোষের অশ্রু তখন গলায় ঠেকেছে। সে কি-একটা বললে, কিন্তু গলা দিয়ে স্পষ্ট বেরুল না। তার অবস্থা দেখে আমিই বললুম, উত্তর আসেনি বটে, কিন্তু সেখান থেকে আর কখনও যে উত্তর আসবে না তার সঙ্কেত এসেছে।
আমার কথাটা ভালো বুঝতে না পেরে পিয়ারাসাহেব জিজ্ঞাসা করলে, কি এসেছে?
এবার তাকে সমস্ত কথা খুলে বলা গেল। কিরকম করে আমরা দিদিমণিদের বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলুম, কেমন করে ক্রমে আমাদের বন্ধন দৃঢ় হয়ে উঠেছিল; বড়কর্তার প্রথম দিনের ব্যবহার, দিদিমণির আশ্বাস ও বড়কর্তাকে বাড়ি থেকে দূর করে দেওয়া; তার পর কাশীতে সেই অমানুষিক অত্যাচার, সবার ওপরে দিদিমণির চিঠিগুলো গাপ করা। প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে দিদিমণিদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ইতিহাস তন্ন তন্ন করে তাকে খুলে বললুম। আমাদের কথা শুনতে শুনতে পিয়ারাসাহেবের স্বভাব-রক্ত বর্ণ আরও লাল হয়ে উঠতে আরম্ভ করল।
কাহিনি শেষ করে চুপ করলুম। পিয়ারাসাহেবও কিছুক্ষণ কোনো কথা বললে না। সে সেইরকম লাল মুখ নিয়ে নীচের দিকে চেয়ে কি যেন ভাবতে লাগল গভীরভাবে। তার এ-মূর্তি এর আগে কখনও দেখিনি। সদাসর্বদাই তার মুখখানা ঘিরে ভারি একটা মিষ্টি হাসি জ্বলজ্বল করত। চাকরবাকরদের ধমক দেবার সময় তার-কণ্ঠস্বর কিছু উচ্চগ্রামে চড়লেও মুখে সেই হাসিটুকু কিন্তু লেগেই থাকত, তার এমন পুরুষ-মূর্তি এই প্রথম চোখে পড়ল।
কিছুক্ষণ সেই ভাবে থেকে আবার সেই পুরনো হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলে, আচ্ছা, সেই লোকগুলো আপনাদের দুখানা কলকাতার টিকিট দিলে মাত্র? পথের দু-দিনের, অর্থাৎ আপনাদের খাওয়াদাওয়ার জন্যে কিছু খরচপত্র দিলে না?
না।
পিয়ারাসাহেব বললে, ওই যে কি নাম লোকটার, অমরনাথ না কি, লোকটা আদমজাদ্ নয়, একেবারে হাওয়া অর্থাৎ হিংস্র জানোয়ার।
এবার পরিতোষ গর্জে উঠল, ঠিক বলেছেন আপনি, লোকটা মানুষরূপী জানোয়ার।
পিয়ারাসাহেব আবার সেইরকম ঘাড় নীচু করে বসল চিন্তা করতে। কিছুক্ষণ চিন্তা করে মুখ তুলে ভারি মিষ্টি করে বললে, দেখুন, বয়সে আমার চেয়ে ছোট হলেও আপনারা আমার শিক্ষক, আমি ছাত্র। বলুন, এ বান্দা কি ভাবে আপনাদের খিদমতে লাগতে পারে? কোনো দ্বিধা করবেন না, সম্ভব-অসম্ভবের কথা বিচার করবেন না। শুধু মনের ইচ্ছাটা প্রকাশ করুন, আপনাদের আশীর্বাদে তা কার্যে পরিণত করবার মতন হিম্মৎ এ-বান্দা রাখে।
কথাগুলোর বাচ্যার্থ ঠিক বুঝতে না পারলেও ব্যঙ্গার্থ হৃদয়ঙ্গম করতে দেরি হল না। অমরনাথ বন্দ্যোউপাধ্যায়কে কি করা হবে, কি সাজা দিলে সেই অত্যাচারের প্রতিশোধ হয়, সেই চিন্তায় মাথার মধ্যে গোলমাল বেধে যেতে লাগল, বাঁশবনে ডোমকানার অবস্থায় পড়ে গেলুম।
বোধ হয় আমাদের অবস্থা বুঝতে পেরে পিয়ারাসাহেব বললে, কয়েক রকমে তাকে জব্দ করা যেতে পারে। ধরুন আপনারা বলছেন যে, দিদিমণির হাতে যদি আপনাদের চিঠিগুলো পড়ত, তা হলে তিনি নিশ্চয় জবাব দিতেন।
আমরা দুজনেই বলে উঠলুম, নিশ্চয়ই।
পিয়ারাসাহেব বললে, তা হলে এ-কথা নিশ্চিত যে, এই লোকটাই তাঁর চিঠিগুলো গাপ করে, আর এ-কথাও ঠিক যে, চিঠি সে বাড়ি থেকে গাপ করে না, কারণ বাড়িতে ঢোকবার হুকুম তার নেই। আমার মনে হয়, ওইখানকার ডাকঘরের কোনো কর্মচারীর সঙ্গে তার যোগ আছে।
আমাদের তো তাই মনে হচ্ছে।
তা হলে ডাকঘরের সেই কর্মচারীকে খুঁজে বের করে তাকে টাকা দিয়ে হাত করে চিঠি মেরে দেওয়ার অপরাধের জন্যে আপনাদের অমরনাথের নামে নালিশ করা যেতে পারে। মামলার সময় ডাকঘরের লোকটা সাক্ষী দেবে যে, এই লোকটার হাতে চিঠিগুলো সে দিয়েছিলে এই বিশ্বাসে যে, সেগুলো যথাস্থানেই পৌঁছবে।
পিয়ারাসাহেব ঘাড় নেড়ে নেড়ে বলতে লাগল, এ-কথা যদি প্রমাণ করতে পারা যায় তো নিশ্চয় তার ভালোরকম সাজা হয়ে যেতে পারে।
ছাত্রের আইনজ্ঞান দেখে পুলকিত হয়ে বললুম, সেই ঠিক হবে, লোকটা যেরকম বদমাশ, তাতে তার বিশেষ শিক্ষা দেওয়া দরকার।
একটু কি ভেবে নিয়ে পিয়ারাসাহেব বললে, আচ্ছা ধরুন, ডাকঘরের কর্মচারীর সাক্ষ্যের পর আপনাদের দিদিমণি যদি তাঁর ভাইকে বাঁচাবার জন্যে বলেন, সব চিঠি তাঁর হস্তগত হয়েছিল; কিন্তু তিনি ইচ্ছে করেই কোনো জবাব দেননি। তা হলে? তা হলে তো ওই লোকটাই উল্টে নালিশ করে আমাদের সাজা দিইয়ে দিতে পারে।
জোর করে বললুম, সে কখনও হতে পারে না, সে হওয়া অসম্ভব। দিদিমণি তাকে দু’চক্ষে দেখতে পারে না। সে-ই ওকে বাড়ি থেকে দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে, আমাদের সামনে।
পিয়ারাসাহেব মৃদু হেসে বললে, আচ্ছা, না-হয় ধরেই নেওয়া গেল যে, পাতানো ভাইদের জন্যে তিনি নিজের ভাইয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবেন। কিন্তু তাঁর বাবা এখনও বেঁচে আছেন। আপনারাই বলছেন, বাপ এই ছেলেকে খুবই ভালোবাসেন, দিদিমণিও এ-কথা আপনাদের অনেকবার বলেছেন, কেমন কিনা?
বললুম, এ-কথা অস্বীকার করবার উপায় নেই।
পিয়ারাসাহবে বললে, তা হলে বুঝুন। বাপ যদি মেয়েকে অনুরোধ করেন যে ভাইয়ের বিরুদ্ধে তুমি সাক্ষী দিও না, তা হলে আপনাদের দিদিমণি কী করবেন? নিশ্চয় আপনারা এই ক’দিনে তাঁর বাপের চাইতে আপনার লোক হয়ে যাননি।
পিয়ারাসাহেবর কথাগুলো ভালো করে বিবেচনা করে বুঝতে পারলুম, সে ঠিকই বলেছে। কি আর বলব! চুপ করে রইলুম।
কিছুক্ষণ বাদে পিয়ারাসাহেব বললে, আরও একটা কাজ করা যেতে পারে-আমরা হলে তো তাই করতুম, কিন্তু আপনাদের মরজি হবে কি না বলতে পারি না।
দুজনেই উদ্গ্রীব হয়ে উঠলুম। জিজ্ঞাসা করলুম, কি কাজ?
পিয়ারাসাহেব বললে, যদি হুকুম করেন তো আপনাদের আসামিকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় আপনাদের পায়ের কাছে এনে ফেলে দিতে পারি। তার পর তার নাক কান ছেঁটে দিতে পারেন অথবা চোখ কানা বা হাত-পা নষ্ট অথবা যদি প্রাণদণ্ড দেন–সে হুকুমও তামিল হয়ে যেতে পারে। ভয় পাবেন না, আপনাদের গায়ে আঁচড়টি পর্যন্ত লাগবে না।
কথাটা শুনে আনন্দের চোটে চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলুম, মাথা ঘুরতে লাগল লাট্টুর মতন বনবন করে।
পরিতোষটা তড়াক করে হাঁটু গেড়ে উঠে যাত্রার ঢঙে বলতে আরম্ভ করে দিলে, অর্জুন! অর্জুন! An Arjun is come to judgement! হে পরন্তপ! আপনি ধন্য এবং আপনার মতন মহানুভবকে ছাত্ররূপে পেয়ে আমরাও ধন্য হলুম।
সে বলে চলল, আমাদের তারিখে লেখা আছে, দ্বাপর যুগে আপনারই মতন একজন ছাত্র তাঁর গুরুকে ঠিক এইভাবেই একদিন গুরুদক্ষিণা দিয়েছিলেন, আর আজ কলিযুগে দিলেন আপনি
সেই যাত্রার ঢঙেই বসে পড়ে পরিতোষ সাড়ম্বরে দ্রোণাচার্যের কাহিনি শুরু করতে যাচ্ছে, এমন সময় পিয়ারাসাহেব মিষ্টি হেসে বললে, সে কাহিনি আমার জানা আছে। দ্রোণ মহারাজ আর অর্জুনজীর কিস্সা তো?
একটু চুপ করে থেকে পিয়ারাসাহেব সেইরকম হেসে আমাকে বললে, কিন্তু দ্রোণ মহারাজ সেজন্য অর্জুনকে ভালো ভালো সব বাণ দিয়েছিলেন। আপনাদের শত্রু দমন করলে আমাকে কি দেবেন?
আমি বললুম, দ্বাপর যুগের সে-সব অস্ত্র এ-যুগে অচল হয়ে পড়েছে। আমরা আপনাকে এ-যুগের প্রধান অস্ত্র-বাক্যবাণ ছাড়বার কৌশল শিখিয়ে দেব। তাক্ বুঝে প্রয়োগ করতে পারলে ইতরবিশেষ সকলেই এতে ঘায়েল হয়, অথচ শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন থাকে না। আপনি বোধ হয় জানেন না, জাতিহিসাবে আমরা এই অস্ত্রে সিদ্ধিলাভ করেছি। অতএব মাভৈঃ!
আমার কথা শুনে পিয়ারাসাহেব উচ্চরবে হেসে উঠল। হাসি থামলে সেইরকম উচ্চকণ্ঠেই বলতে আরম্ভ করলে, বাহ্বা, বহোত খুব, খুব, খুব।
আরও বার ‘পাঁচ-সাত’ ‘খুব’ কথাটি অপেক্ষাকৃত নিম্নস্বরে উচ্চারণ করে বললে, ভারি খুশি করেছেন আপনারা, ভারি খুশি হয়েছি। আপনারা একটু বসুন, আমি এখুনি আসছি। যাবেন না যেন, আজ এক জায়গায় কুস্তির দঙ্গল দেখতে যাবার নিমন্ত্রণ আছে, সকলে মিলে যাওয়া যাবে।
কিছুক্ষণ বাদে পিয়ারাসাহেব দুটো চমৎকার, কিনারায় হাতের কাজ-করা সিল্কের চাদর এনে আমাদের দিয়ে বললেন, ওড়িয়ে।
এখানকার হালচালই আলাদা।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা কুস্তির দঙ্গল দেখে এসে পিয়ারাসাহেবের খাশ দরবারে বিরাট আড্ডা বসে গেছে। চার-পাঁচ জন লোক, তারা কুস্তি করে না বটে, কিন্তু কুস্তিবিদ্যা এবং কুস্তিগীরদের জীবনী সম্বন্ধে এক-একটি অথরিটি। তারা এক একজন করে অতীত ও বর্তমানের বড় বড় কুস্তিগীরদের জীবনী ও বড় বড় দঙ্গলের ইতিহাস বেশ জমাটি করে বলে যাচ্ছিল। বিচিত্র তাদের জীবন-কাহিনি আর অসম্ভব তাদের শক্তিমত্তা! বাস্তব মানুষের এমন রূপকথার মতন জীবন এর আগে শুনিনি। আর সেই লোকগুলির বর্ণনা করবার কায়দাও চমকপ্রদ। শুনতে যে ভালোই লাগছিল, তা অস্বীকার করব না; কিন্তু মাঝে মাঝে এ-কথাও মনে হচ্ছিল যে, আমরা পিয়ারাসাহেবের খার্শ দরবারে বসে আছি, না, কোনো গুলির আড্ডায় ঢুকে পড়েছি! সাদা চোখে মানুষ যে এমন সব অসম্ভব কাহিনি বলা যেতে পারে এবং লোকে তা বিশ্বাস করে, এই তার প্রথম অভিজ্ঞতা হল।
যা হোক, রাত হয়ে যাচ্ছে, হয়তো নবাবসাহেবের আহারের সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাবে, এই মনে করে ওঠবার উপক্রম করতেই পিয়ারাসাহেব বললে, বসুন, কোথায় যাচ্ছেন এরই মধ্যে?
বললুম, যাই, নবাবসাহেব হয়তো আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন।
পিয়ারাসাহেব রহস্য করে বললে, রোজই তো নবাবসাহেবের সঙ্গে খানা খান, আজ না-হয় এই গরিবের সঙ্গে খেলেন!
এর ওপর আর কথা চলে না। বসতেই হল।
ক্রমে আসরের অনেকেই উঠে গেল। আবার দু-একটি করে লোক এসে তাদের স্থান পূরণ করতে লাগল। এমনই চলেছে, এমন সময় একটি লোক ঘরের মধ্যে ঢুকতেই পিয়ারাসাহেব বললে, কি, নবাবসাহেবের আসতে আজ এত দেরি হল যে?
লোকটা সহাস্যে উত্তর দিলে, এখানে এলে আপনি না-খাইয়ে তো ছাড়বেন না। জানি, দেরি হবে, তাই কতকগুলো কাজ সেরে এলুম।
পিয়ারাসাহেব বললে, তা বেশ করেছ, তুমি একবার ছুটে হারোয়ার বাড়িতে গিয়ে বল যে, এক্ষুনি এসে সে যেন আমার সঙ্গে দেখা করে। যদি সে বাড়িতে না থাকে তা বলে এস, যত রাত্তিরই হোক আমার সঙ্গে দেখা করবে, সে না-আসা পর্যন্ত আমি তার জন্যে এখানে অপেক্ষা করব।
মিনিট পনেরোর মধ্যেই লোকটা ফিরে এসে বললে, হুজুর, হারোয়া বাড়িতে নেই, খবর দিয়ে এসেছি, ফিরলেই এখানে পাঠিয়ে দেবে।
কিছুক্ষণ পরেই প্রায় আসর-জোড়া দস্তরখান বিছানো হল। তাড়া তাড়া সানকি ও বাটি আসতে লাগল।
পিয়ারাসাহেবের আসরে এই প্রথম খানা খেতে বসলুম। সে এক বিরাট ব্যাপার! সে আবার একলা কিংবা বাড়ির দু-চার জন লোকের সঙ্গে বসে খেতে পারে না, বিশেষত রাত্রের আহারের সময়। সে-সময় রোজ দশ-পনেরো জন বাইরের লোক তার সঙ্গে বসে খাওয়া চাই, নইলে তার খেয়ে তৃপ্তি হয় না। কোনো কোনো দিন খাবার সময় লোক কম পড়লে সেই রাত্রে চাকরদের এখানে সেখানে ছুটোছুটি করতে হয় লোক ডাকবার জন্যে। চাকরেরাও সেয়ানা–আড্ডায় লোকসমাগম কম দেখলেই তারা সন্ধে থেকেই ছুটোছুটি করতে থাকে পিয়ারাসাহেবের মোসাহেবদের বাড়িতে বাড়িতে। তার এই সান্ধ্যবিলাসের জন্য আলাদা বাবুর্চি, বাবুর্চিখানা, আলাদা মশলাচি ইত্যাদি নিযুক্ত আছে, সেই সকাল থেকে এ-বেলার রন্ধনের আয়োজন শুরু হয়। এখানকার আহারাদির বাহুল্যও বেশি। কিন্তু বাহুল্য ও আড়ম্বরের তারতম্য যাই হোক না কেন, একটা বিষয়ে দু-জায়গাকার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ লক্ষ করলুম। নবাবসাহেবের সঙ্গে খানা খেতে খেতে মাঝে মাঝে মনে হত, বুঝি-বা ব্রহ্মোপসনার আসরে বসেছি। এখানে মনে হতে লাগল, যেন কাঙালি-ভোজনের পঙ্ক্তিতে বসেছি।
আহারপর্ব শেষ করে ঘরের ছেলেরা সব ঘরে ফিরে গেল। পিয়ারাসাহেব আমাদের ছাড়লে না। উঠি-উঠি করছি দেখে সে বললে, যাবেন না। আপনাদের জন্যেই হারোয়াকে ডেকে পাঠিয়েছি, আজ রাতেই পরামর্শ করে একটা যা হয় কিছু স্থির করে ফেলা যাবে।
জিজ্ঞাসা করলুম, তিনি হন কে?
আপনাদের দুশমনকে ধরে নিয়ে আসবার কথা বলেছি না! এই হল সেই লোক, এ-কাজ সে অনেকবার করেছে, এখনও করে। মোদ্দা কথা হল, এই হল তার পেশা।
এমন দুর্লভদর্শনকে দেখবার কৌতূহল হতে লাগল।
একটু পরেই ঘরের মধ্যে একজন লোক এসে পিয়ারাসাহেবকে কুর্নিশ করে দাঁড়াল। এই লোকটির চেহারার কিছু বিবরণ দেওয়া আবশ্যক বোধ করছি।
লোকটা অত্যন্ত ঢ্যাঙা আর অস্বাভাবিক রকমের রোগা। হাড়ের ওপরে স্রেফ চামড়াটুকু টান করে বসানো মাত্র, মধ্যে মেদ-মাংসের চিহ্নমাত্রও নেই। শিরাগুলো যেন দেহ ত্যাগ করে ঠিকরে বেরিয়ে পড়তে পারলে বাঁচে, এমনই ফুলে রয়েছে। সরু প্রায় আধ হাত লম্বা গলার উপরে ইয়া বড় একটা শুকনো মাথা, অর্থাৎ মাথায় একগাছিও চুল নেই, খুলির ওপরে চামড়াটা একেবারে সেঁটে বসে আছে, শিরাগুলো ঠেলে বেরিয়ে আসছে। তার চুড়োয় আবার একটা উঁচু-গোছের ছোট জরির টুপি চড়ানো–জরি অবশ্য মলিন হয়ে গিয়েছে। মুখের অবস্থাও তাই, দুই গালে অতলস্পর্শী খোঁদল। তার ওপরে বেশ ঘন একজোড়া গোঁফ, একটি চোখের অর্ধেকটা সাদা, সেটা ছানি কিংবা কোনো আঘাতের চিহ্ন কি না তা বোঝা গেল না। ফরসা কালো, মিশকালো, শ্যাম ও উজ্জ্বল-শ্যামবর্ণকে বেশ করে একত্রে মেশালে যে রঙ হয়, তাই হচ্ছে তার গায়ের রঙ।
ইনি আবার শৌখিন কম নন। গায়ে ফিনফিনে একটা ঢোলা পাঞ্জাবি, এমন ঢোলা যে তার মধ্যে তার মতন পাঁচ-সাতটা লোক অনায়াসে লুকোচুরি খেলতে পারে। পাঞ্জাবির ওপরে একটা গা-সাঁটা গরম ওয়েস্টকোট। এর ওপর সেই খ্যাংরাকাঠির মতন পায়ে চুড়িদার পাজামা। সেরকম একখানি মাল সচরাচর চোখে পড়ে না।
লোকটি কুর্নিশ করে দাঁড়াতেই পিয়ারাসাহেব তাঁকে অভ্যর্থনা করলে, এস এস, চুন্নি মিয়া, কি খবর? আজকাল তো বাবুসাহেবের দর্শন পাওয়াই ভার!
চুন্নি মিয়ার কঙ্কাল মৃদু হেসে বললে, হুজুর, রুটির ফিকিরে দিনরাত ব্যস্ত থাকি, তাই আপনার দরবারে রোজ হাজির হতে পারি নে, নইলে সময় পেলেই তো আসি।
অদ্ভুত কণ্ঠস্বর! সে কেমন একটা শাঁই-শাঁই আওয়াজের উচ্চ-নীচ সমষ্টি মাত্র। আমার মনে হল, চুন্নি মিয়া যেন জিভের বদলে আলজিভ দিয়ে কথা কইলে।
পিয়ারসাহেব বললে, কাল রাত্রে আমার সঙ্গে খানা খাবে, অনেকদিন একসঙ্গে বসে খাইনি।
চুন্নি মিয়া নীরবে অভিবাদন করে বললে, হুজুরের যা মরজি।
চুন্নি মিয়া এবারে জুতো ছেড়ে আমাদের কাছে এসে বসল। তাকে দেখিয়ে পিয়ারাসাহেব আমাদের বললে, এই যে আমাদের চুন্নি মিয়াকে দেখছেন, এঁকে সামান্য লোক মনে করবেন না, ইনি মানুষরূপী শের অর্থাৎ ব্যাঘ্র।
পরিতোষ বলে ফেললে, তাতে আর সন্দেহ কি!
দেখলুম চুন্নি মিয়ার মুখ-কঙ্কাল কিঞ্চিৎ প্রসন্ন ভাব ধারণ করলে।
পিয়ারাসাহেব বলতে লাগল, এর এখন যা চেহারা দেখছেন, তা চুন্নি মিয়ার ভূতের চেহারা, আমার দুটোর মতন চেহারা ছিল এর আগে। দেখলুম, চুন্নি মিয়ার মুখ-কঙ্কাল ক্রমেই অপ্রসন্ন হয়ে উঠতে লাগল। জিজ্ঞাসা করলুম, তা হলে এমন চেহারা হয়ে গেল কি করে?
পিয়ারাসাহেব মৃদু হেসে বললে, রোগে।
কি রোগে? হকিমসাহেবকে দেখালে হয় না?
পিয়ারাসাহেব ওপরদিকে আঙুল দেখিয়ে বললে, একমাত্র ওই হকিম ছাড়া এ-রোগ ওর কেউ সারাতে পারবে না, আমাদের চুন্নি মিয়া সাঙ্গিয়ার শৌখিন।
সে আবার কি জিনিস?
সে একরকম নেশার জিনিস। কেন, সাঙ্গিয়ার নাম শোনেন কি আপনারা?
পিয়ারাসাহেবে প্রশ্ন শুনে পরিতোষ হাসতে হাসতে বললে, সাহেবজাদা! আমরা নেশাসমুদ্রের কূলে বসে সবেমাত্র এই নুড়িখেলা আরম্ভ করেছি। উপযুক্ত গুরু পেলে ও-সমুদ্রে পাড়ি জমাতে পারব–এই আশা মাত্র রাখি। তবে ওই যে কি বললেন, ওর কথা শুধু আমরা কেন, আমাদের দেশেও বোধ হয় কেউ শোনেনি। আমরা গোটাকয়েক মামুলি নেশা, যেমন–মদ, গাঁজা, গুলি, চরস, ভাং, আফিম ইত্যাদির কথা জানি।
পরিতোষের কথা শুনে পিয়ারাসাহেব উচ্চ হেসে বললে, জী হাঁ। সাঙ্গিয়া নেহাত তুচ্ছ নয়। এর জন্যে চুন্নি মিয়াকে দৈনিক দেড় পো করে কাঁচা ঘি খেতে হয়।
কথাটা শুনে চমকে উঠলুম, বলেন কি!
পিয়ারাসাহেব বললে, জী হাঁ। নইলে শরীর বড় শুকিয়ে যায়।
এবারে চুন্নি মিয়া আমাদের বললে, হাঁ বাবুজী, সাঙ্গিয়া বড্ড ঘি খায়।
কথাটা বলেই পিয়ারাসাহেবের দিকে ফিরে বললে, আজকাল আর দেড়-পো’তে শানাচ্ছে না, প্রায় আধ সের করে টানতে হচ্ছে।
আমি আর থাকতে না পেরে বলে ফেললুম, চুন্নি মিয়া, আমার বেয়াদপি মাফ করবেন, রক্ত মাংস মজ্জা প্রভৃতি আসুরিক ভোজ্যের প্রতিও সাঙ্গিয়া মহারাজের বিশেষ অরুচি আছে বলে তো বোধ হচ্ছে না!
চুন্নি মিয়া আবার অপ্রসন্ন হলেন।
যা হোক, কিছুক্ষণ গালগল্প ওড়াবার পর পিয়ারাসাহেব তাকে জিজ্ঞাসা করলে, হারোয়ার কি খবর? তাকে ডেকে পাঠিয়েছি অনেকক্ষণ হল।
চুন্নি মিয়া বললে, হুজুর, সেইজন্যেই তো আমি এসেছি। বাড়িতে শুনলুম, আপনি হারোয়াকে তলব করেছেন। কিন্তু সে তো বিশেষ একটা কাজে বিদেশে গিয়েছে। আমার দ্বারা যদি কিছু হয়, তাই ছুটতে ছুটতে এলুম।
পিয়ারাসাহেব খুব আস্তে, একরকম ইশারাতে কি জিজ্ঞাসা করলে। তার জবাবে চুন্নি মিয়া তার সেই শাঁই-শাঁই স্বরকে যতদূর সম্ভব সংযত করে বললে, হ্যাঁ, মোটা রকমের কিছু পাবার উম্মিদ আছে।
পিয়ারাসাহেব চুন্নি মিয়াকে আমাদের কথা বলতে আরম্ভ করলে। দেখলুম, আমরা তাকে যা যা বলেছিলুম, তার একটি বর্ণও সে ভোলেনি। একটার পর একটা ঘটনা এমন অপূর্ব ভঙ্গিতে সে বর্ণনা করতে লাগল, সেগুলো যেন চোখের সামনে মূর্ত হয়ে উঠতে লাগল। কাশীতে সেদিন সেই সকালবেলাকার অত্যাচারের সময় আমাদের দৈহিক যন্ত্রণাই প্রবল হয়েছিল। তার মধ্যে যে মর্মান্তিক অপমান নিহিত ছিল, পিয়ারাসাহেবের বর্ণনাকৌশল মনের মধ্যে তার গভীর ছাপ ফেলতে লাগল ও সঙ্গে সঙ্গে সেই লোকটার ওপর প্রতিশোধ নেবার সংকল্পে মন বিষিয়ে উঠতে লাগল।
পিয়ারাসাহেবের কথাগুলো খুব গম্ভীর ভাবের সঙ্গে শুনে চুন্নি মিয়া বললে, এর আর কথা কি হুজুরের যখন মরজি হয়েছে, তখন দুশমন অচিরেই আপনার পায়ের তলায় এসে পড়বে। যদি হারোয়াকে এ-কাজের ভার দিতে চান তো তাকেই দেবেন, সে তো আমারই ছোট ভাই। আর যদি আমাকে হুকুম করেন, তাও তামিল হবে।
পিয়ারাসাহেব জিজ্ঞাসা করলে, হারোয়া কবে ফিরবে?
চট্ করে যদি কাজ মিটে যায় তো কয়েক দিনের মধ্যেই ফিরে আসবে।
পিয়ারাসাহেব বললে, দেখ, হারোয়াকে আমি সেখানে পাঠাতে চাই, আর তুমি,থাকবে এখানে। এখানেও তো কাজ আছে।
বলে চোখ মট্কে সে কি ইশারা করলে।
চুন্নি মিয়া বিজ্ঞের মতন বার-কয়েক নীরবে ঘাড় নেড়ে বললে, সে তো ঠিক কথা। তা বেশ, সব ঠিক হয়ে যাবে।
এবারে আমরা বললুম,’ লোকটা কেও-কেটা নয়। সেখানে তার বেশ সহায়সম্পদ আছে, মোট কথা, তাকে বড়লোক বলা যেতে পারে। আমাদের সাবধানবাক্য শুনে চুন্নি মিয়া সেই মুখে সুধাময় হাসি হেসে আশ্বাস দিলে, বাবুজী, বেফিকির থাকো।
তার পরে মুখের ওপর অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের ভাব এনে বললে, বাবুজী, নিজেদের গুমর করতে নেই, তার ওপরে সামনে মনিব বসে রয়েছে। আমরাও বড়লোক।
পরিতোষ বললে, তাতে আর সন্দেহ কি!
চুন্নি মিয়া পিয়ারাসাহেবকে বলতে লাগল, হারোয়ার ফিরতে তো এখনও দিনকতক দেরি আছে, ইতিমধ্যে আমরা এদিকের কাজগুলো সেরে ফেলি। কাশীতে চিঠি লিখতে হবে, সেখানে কিছু টাকা পাঠিয়ে দিতে হবে। চারিদিকে আটঘাট না বেঁধে তো কাজে হাত দেওয়া যাবে না, সেবারকার কথা মনে আছে তো? পরে যেন আফশোস না করতে হয়!
পিয়ারাসাহেব চঞ্চল হয়ে উঠল, ঠিক বলেছ। তার ওপরে এঁরা বলছেন, লোকটার টাকাকড়িও বেশ আছে, সহায়ও কিছু কম নেই।
চুন্নি মিয়া বললে, ওইজন্যেই তো বলি, হুজুর, কাজের শেষ করে দিতে। তা করেন না বলেই তো শেষে নানা রকমের বখেরা এসে জোটে, এ তো আর হুজুরের অজানা নেই!
পিয়ারাসাহেব গম্ভীরভাবে বললে, যা বলেছ।
এবারে চুন্নি মিয়া আমাদের বললে, দেখুন বাবুজী, যে লোকটা আপনাদের সঙ্গে এতখানি দুশমনি করেছে, চোর বদনাম দিয়ে রাস্তার লোক দিয়ে মার খাইয়েছে, আপনাদের আখের নষ্ট করে দিয়েছে, তাকে হাতে পেয়ে হাত-পা ভেঙে কিংবা নাক-কান কেটে দিয়ে ছেড়ে দেওয়া দয়ার কাজ হতে পারে, কিন্তু সুবিবেচনার কাজ হবে না। আমার মতে একেবারে শেষ করে দেওয়াই উচিত, ও শত্রুর শেষ রাখতে নেই।
শত্রু সম্বন্ধে এই বিধানটি দেখলুম সর্বশাস্ত্রসম্মত।
সেই রাত্রেই অমরনাথ বন্দ্যোউপাধ্যায়কে প্রাণদণ্ড দিয়ে ঘরে এসে দেখি, নবাব সাহেব্যথারীতি পশ্চিম দিকে মুখ করে হাঁটু গেড়ে বসে চোখ বুজে দুই হাত সামনে প্রসারিত করে কার কাছে কি ভিক্ষা চাইছেন, কে জানে!
.
নবাবসাহেবদের বাড়ির জীবনযাত্রা আমাদের কাছে অভিনব হলেও ক্রমে তাতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়তে লাগলুম। সকালবেলা উঠে হকিমসাহেবের সেই উলটে-পালটে নাড়ী-টেপা অভিনিবেশ সহকারে দর্শন করা, তার পরে সারাদিন ধরে কবুতর ওড়ানো, ঘুড়ি ওড়ানো, দিন-দুপুরে ও রাত-দুপুর অবধি পিয়ারাসাহেবের আসরে বসে গালগল্প ওড়ানো, মধ্যে মধ্যে কুস্তির দঙ্গল ও তারই ফাঁকে ফাঁকে ‘ডিরেক্ট মেথডে’ ছাত্রকে ইংরিজি ও বাংলা শেখাবার চেষ্টা চলতে লাগল।
পিয়ারাসাহেবের আড্ডাটি ছিল আমাদের কাছে মহাবিদ্যালয়-স্বরূপ। সেখানে বসে দেশের ও দশের কত অদ্ভুত ইতিহাসই যে শুনতে লাগলুম, তার আর ইয়ত্তা নেই,–সে-সব ইতিহাস কোনো কেতাবেই লেখা নেই, কখনও লেখা হবে কি না জানি না; শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তা লোকের মুখে-মুখেই চলে আসছে। বাঙালি ঘরের ছেলেরা এবং অধিকাংশ বুড়োরাও ভারতবর্ষের ইতিবৃত্তের কত প্রাইভেট কথাই যে জানে না, তাই নিয়ে দুই বন্ধুত্বে মাঝে মাঝে আলোচনা ও হাসাহাসি করি। এইভাবে আমাদের দিন কাটতে লাগল।
এরই ফাঁকে ফাঁকে কোনো দিন চুন্নি মিয়া আসে হারোয়ার খবর নিয়ে, বলে, সে এই এসে পড়ল বলে।
চুন্নি মিয়া খবর দিলে, কাশীতে চিঠি চলে গিয়েছে, লোকটাকে তারা চিনতেও পেরেছে।
একদিন রাতে চুন্নি মিয়া চিঠি নিয়ে এসে পড়ে শোনালে। তাদের ওখানকার এজেন্টরা বড়েভাইয়ের চেহারায় বর্ণনা করেছে, শুনে মনে হল, একেবারে হুবহু ঠিক।
দেখতে দেখতে প্রায় মাসখানেক কেটে গেল, তখনও হারোয়ার পাত্তা নেই। জিজ্ঞাসা করলে কিংবা তাড়া দিলে চুন্নি মিয়া মিনতি করতে থাকে, আর কটা দিন দেখুন। এতদিন যখন সবুর করেছেনই তখন আর কটা দিন অপেক্ষা করুন। হুজুরের কাজ পড়েছে জেনে সে তো সেখানকার কাজ ফেলেই চলে আসতে চায়, আমিই তাকে বারণ করেছি, কারণ ওখানে মোটা কিছু ‘রকম’ মেলবার আছে।
একদিন চুন্নি মিয়াকে জিজ্ঞাসাই করে ফেলা গেল, যে কাজে হারোয়া মিয়া গিয়েছে, তাতে কত পাবে আশা করছ?
চুন্নি মিয়া বললে, হুজুরের আশীর্বাদে কাজ যদি সুসারে সম্পন্ন হয়, তা হলে আর আমাদের খেটে খেতে হবে না। বছরে হাজার দশেক টাকা পাওয়া যেতে পারে এমন জমিজমা পেয়ে যাবে।
জিজ্ঞাসা করলুম, আর কার্যটি যদি অতিসারে পরিণত হয়, তা হলে?
তা হলেও অন্তত আট-দশ হাজার টাকা পাওয়া তো যাবেই, তা ছাড়া–
পিয়ারাসাহেব উচ্চ হেসে বললে, বেশি বকো না। এদের ছেলেমানুষ দেখছ বটে,কিন্তু এরা বাঙালির ছেলে। বাক্যি-সাক্যি শুনে বুঝতে পারছ না?
পিয়ারাসাহেব কথা শেষ হবার আগেই চুন্নি মিয়া খপ্ করে দুহাত দিয়ে তার একখানা পা চেপে ধরে বললে, আপনার দিব্যি।
তার পর নিজের ছানি-পড়া চোখটা দেখিয়েই আমাদের বললে, মিথ্যে কথা যদি বলে থাকি তা হলে আমার এই চোখটা যেন নষ্ট হয়ে যায়।
জিজ্ঞাসা করলুম, আচ্ছা ধরুন, কাজকর্ম করিয়ে নিয়ে শেষকালে যদি তারা কিছু না দেয়?
চুন্নি মিয়া বললে, আপনি ঠিকই বলেছেন, আপনার কথা খুবই সত্যি। এরকম যে একেবারেই না হয়, তাও নয়। কিন্তু এরা তা করবে না, কারণ এরা ভারি জমিদার, হামেশাই এদের এরকম কাজ করবার জন্যে লোকের দরকার হয়। এরা যদি কারুকে ফাঁকি দিয়ে অঙ্গীকৃত পুরস্কারের কমও দেয়, তা হলে দু-দিনের মধ্যেই চারিদিকে সেই বিশ্বাসঘাতকতার কথা রটে যাবে, তখন লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করলেও এ-কাজের জন্যে আর কোথাও লোক পাবে না। সাহেবজাদা বলুন, আমি সত্যি বলছি কি না!
পিয়ারাসাহেব বললে, হ্যাঁ, সত্যি কথা। বরঞ্চ এদের হাতের মুঠোর মধ্যে রাখবার জন্যে কিছু বেশিই দিতে হয়। চাঁদির জুতো না পড়লে এরা শায়েস্তা হয় না।
খুব একটা হাসি পড়ে গেল। রহস্যটা চুন্নি মিয়াও বেশ উপভোগ করলে।
ওদিকে ওদের কাজ অগ্রসর হতে লাগল, এদিকে আমরাও নিশ্চিন্ত ছিলুম না। আশা উৎকণ্ঠা ও ভয়–এই ত্রিবিধ রসের সাগরে নিশিদিন হাবুডুবু খেতে লাগলুম। কাছাকাছি কেউ না থাকলেই আমরা এ-বিষয়ে পরামর্শ করতে লেগে যেতুম। দিন পাঁচ-ছয়ের মধ্যেই মনে হল, সে-রাত্রে–
ঝাঁকের মাথায় লোকটাকে প্রাণদণ্ড দিয়ে ফেলা ঠিক হয়নি। একদিন পিয়ারাসাহেবের কাছে কথাটা প্রকাশ মাত্র সে বললে, ঠিক বলেছেন। কারুকে একেবারে প্রাণে মেরে ফেলার পক্ষপাতী আমিও নই। চোখ-দুটো অন্ধ করে ছেড়ে দেওয়া যাবে, তা হলে যতদিন বাঁচবে ততদিন তার পাপের ফল ভোগ করতে হবে।
সেইখানে বসেই পরামর্শ করে ঠিক করা গেল যে, দুটো চোখ নয়, একটা চোখ কানা করে দিলেই যথেষ্ট হবে ‘খন।
কয়েকদিন-যেতে-না-যেতে সে চোখটাও মাফ করে দেওয়া হল। এমনই করে প্রায় প্রতি রাত্রেই পিয়ারাসাহেবের আসরে বসে অমরনাথ বন্দ্যোউপাধ্যায়কে নাক কান হাত পা ছাঁটার দণ্ড দিয়ে নবাবসাহেবের ঘরে ঢুকেই গুরুদণ্ড দিয়ে ফেলার জন্যে অনুতাপ হতে লাগল। শেষকালে একদিন স্থির করে ফেলা গেল, লোকটাকে ধরে নিয়ে এসে শুধু বলব–তুমি আমাদের ওপর যা অত্যাচার করেছ, এখুনি আমরা তার সমুচিত প্রতিশোধ নিতে পারি; কিন্তু তোমার মতন ঘৃণ্য জানোয়ারকে হত্যা করে হস্ত কলঙ্কিত করব না। যাও–এই বলে দুজনে একটি করে ঠেসে লাথি মেরে বিছুয়াটি কেড়ে নিয়ে বিদেয় করে দেব।
এই বিধানটি আমাদের দুজনেরই বেড়ে লাগল। কিন্তু প্রতিদিনই দণ্ডাদেশ বদলাতে বদলাতে পিয়ারাসাহেবও একটু যেন কেমনধারা হয়ে পড়েছিল। সেইজন্যে তার কাছে কথাটা পাড়তে সঙ্কোচ হতে লাগল। সেই রাত্রি থেকে পিয়ারাসাহেবের সঙ্গেই আমাদের রাত্রির আহারের ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাতে নবাবসাহেবের বড় অসুবিধা হতে লাগল, কারণ জ্ঞান হওয়া অবধি বাইরের লোক নিয়ে খেতে বসা শুধু তাঁর অভ্যাস নয়, একেবারে সংস্কারে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তাই সকালবেলা আমরা তাঁর সঙ্গে খেতুম, আর রাতে বাড়ির দু-তিনজন অথবা কখনও কখনও তার চেয়েও বেশি চাকরের দল নিয়ে তিনি খেতে বসতেন।
একদিন রাত্রে আহারাদির পর পিয়ারাসাহেবের সঙ্গে গালগল্প চলেছে ও তারই মধ্যে তাকে ইংরেজি ও বাংলা শেখাবার চেষ্টা করছি, এমন সময় চুন্নি মিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললে হুজুর, বড় ভালো খবর আছে।
কি বৃত্তান্ত, কি খবর, তা না শুনেই দেখলুম, পিয়ারাসাহেব একেবারে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল।
একটি জিনিস আমরা এখানে এসেই লক্ষ করেছিলুম যে, এরা, ঠাকুরদা ও নাতি উভয়েই, অন্যের–সে পরিচিত ও অপরিচিত, আপনার বা পর যারই হোক না কেন–কিছু ভালো হয়েছে শুনলে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে এবং কেউ দুঃখ পেয়েছে শুনলে তেমনই দুঃখিত হয়ে পড়ে।
দুষ্ট লোক পরের সুখে হিংসা করে ও পরের দুঃখে আনন্দিত হয়। সাধারণ লোক পরের সুখে হিংসা করে এবং পরের দুঃখ সম্বন্ধে নিরপেক্ষ থাকে। অসাধারণ লোক পরের দুঃখে দুঃখী হয়, কিন্তু পরের সুখ সম্বন্ধে উদাসীন থাকে। ভালো লোক পরের দুঃখে দুঃখী এবং পরের সুখে সুখী হয়। কিন্তু পরের সুখ-দুঃখকে এমনভাবে ভোগ করা যে সম্ভব হতে পারে, তা এখানেই প্রথম দেখলুম। সত্যি কথা বলতে কি, এমন বিমৎসর লোক জীবনে কমই দেখেছি।
যা হোক, চুন্নি মিয়ার সুখবরটি এই যে, হারোয়ার চিঠি এসেছে–সে লিখেছে যে, সেখানকার কার্যটি পরিপাটিরূপে সম্পাদিত হয়েছে। মহারাজা এত খুশি হয়েছেন যে, জমিদারি ছাড়া তাদের বেশ মোটা টাকা দিয়ে পুরস্কৃত করবেন বলেছেন। টাকাটি হস্তগত হতেই এখন যা দু’এক দিন দেরি। টাকাটা পেলেই হারোয়া চলে আসবে।
চুন্নি মিয়া কিছুক্ষণ বকবক করে চলে গেল। দেখলুম, চুন্নি মিয়াদের এই ভাগ্যোদয়ে পিয়ারাসাহেব খুবই খুশি হয়ে উঠলেন। মেজাজ শরীফ দেখে–বড়ে-ভাইকে ধরে নিয়ে এসে অক্ষত অবস্থায় ছেড়ে দেওয়ার প্ল্যানটি তাকে বলে ফেললুম।
আমাদের প্রস্তাব শুনে দেখলুম, পিয়ারাসাহেব ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বললে দেখুন, সে-লোকটা যদিও আসলে আপনাদেরই দুশমন, কিন্তু আপনাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার জন্যে আমিও তাকে নিজের দুশমন বলেই মনে করি। আপনারা আমার চেয়ে বয়সে ছোট হলেও আমার গুরুজন। আপনাদের রায়ের ওপরে কথা বলা আমার শোভা পায় না–আমার কাজ তাকে ধরে নিয়ে.এসে আপনাদের পায়ের কাছে ফেলে দেওয়া। তার পরে আপনারা তাকে মারুন বা রাখুন, সে আপনাদের অভিরুচি।
যাক, একটা কষ্টকর বোঝা মনের ওপর থেকে নেমে গেল–যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম।
পিয়ারাসাহেব আবার তখুনি বললে, কিন্তু সে-লোকটা আমার ‘জানি দুশমন’ অর্থাৎ জীবনশত্রু হয়ে থাকবে চিরদিন। তা থাকুক, আমি তা গ্রাহ্য করি না।
পিয়ারাসাহেবের সঙ্গে রাত্রে আহারাদির ব্যবস্থা হলেও আমাদের শোবার ব্যবস্থা ছিল নবাবসাহেবের ঘরেই। একদিন সকালে হকিমসাহেব সেইরকম ঘণ্টাখানেক ধরে নবাবসাহেবের নাড়ী টেপাটেপি করে বললেন, নাড়ীটা তো ভালো ঠেকছে না।
নবাবসাহেব মৃদু হেসে বললেন, বোধ হয় ডাক এল!
হকিমসাহেব সে-কথা শুনে হাসতে হাসতে উঠে চলে গেলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে পিয়ারাসাহেবকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলেন। পিয়ারাসাহেব তার ঠাকুরদার কাছে গিয়ে বসে জিজ্ঞাসা করলে, কেমন আছেন?
নবাবসাহেব মৃদু হেসে বললেন, যেমন রোজ থাকি, সেইরকমই আছি। হকিমসাহেব বলছেন, আজকের নাড়ীটা নাকি সুবিধার নয়। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আর সুবিধার যদি নাই হয়, তাতেই-বা এমন কি এসে যাচ্ছে–একদিন তো যেতেই হবে, আমি সর্বদাই তৈরি হয়ে আছি।
নবাবসাহেবের কথা শুনে পিয়ারাসাহেবের চক্ষু সজল হয়ে উঠল। সে ধরা-ধরা গলায় বললে, না না, অমন কথা বলবেন না। আপনি ছাড়া আমি আর কারুকে জানি না। শৈশব থেকে আজ পর্যন্ত আমি আপনার কোলে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছি। আপনি চলে গেলে পৃথিবীতে আমরা কে থাকবে?–আমি বড় অসহায়।
পিয়ারাসাহেবের কণ্ঠের করুণ সুরে আমরা সকলেই অভিভূত হয়ে পড়লুম। নবাবসাহেবও কিছুক্ষণ ঘাড় নীচু করে নাতির দিকে মুখ তুলে উদাসভাবে বললেন, তবুও বেটা, যেতে তো হবেই একদিন!
এই ধরনের কথাবার্তা এইখানেই শেষ হয়ে গেল। হকিমসাহেব বললেন যে, বেলা তিনটের সময় এসে তিনি একবার পঁচিশ নাড়ী পরীক্ষা করে দেখে তবে শেষ রায় দেবেন।
সেদিন দুপুরবেলা নবাবসাহেব আমাদের সঙ্গে বসে রীতিমতো অর্থাৎ প্রত্যহ যতখানি আহার করেন, তা করলেন। নাড়ী-খারাপের খবর পেয়ে বাইরের অনেক লোক আসতে লাগল তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, যাদের এতদিন কখনও দেখিনি। তিনি সকলের সঙ্গেই আলাপ করলেন। তারা চলে যাবার পর প্রতিদিন যেমন কিছুক্ষণ ঘুমুতেন, তারও ব্যতিক্রম হল না। ঘুম থেকে উঠে ছাতে না যাওয়া পর্যন্ত রোজ যেমন মালা জপ করতেন, তেমনই জপ আরম্ভ করলেন। ইতিমধ্যে হকিমসাহেব ও পিয়ারাসাহেব এসে উপস্থিত হলেন। তাঁদের সঙ্গে ওইখানকারই চার-পাঁচজন মাননীয় কর্মচারী এসে নবাবসাহেবকে খুব নীচু হয়ে কুর্নিশ করলে। নবাবসাহেব তাদের প্রত্যেককে অভিবাদন করে বসতে অনুরোধ করলেন। হকিমসাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, আজ দিবানিদ্রা কেমন হয়েছিল?
নবাবসাহেব সে-প্রশ্নের উত্তরে মৃদু হাসলেন মাত্র, কোনো জবাব দিলেন না।
হকিমসাহেব বললেন, আপনার নাড়ী পরীক্ষা করব, অনুগ্রহ করে উঠে খাটে শয়ন করুন।
নবাবসাহেব তাঁর স্বভাবসুলভ মৃদু হাসি হেসে বললেন, সে কি হয়! এঁরা নীচে বসে রইলেন, আর আমি ওপরে শোব?
হকিমসাহেব বললেন, তাতে কি হয়েছে? আপনি আমাদের সকলেরই বজউগ অর্থাৎ শ্রদ্ধেয়। নবাবসাহেব কিছুতেই খাটে উঠে শুতে রাজি নন, শেষকালে ঘরসুদ্ধ লোকের আগ্রহাতিশয্যে তিনি খাটে উঠে চিত হয়ে শুয়ে পড়লেন। নাড়ী দেখা শুরু হল।
প্রথম হাতের কব্জি, তার পরে কনুই বগল কাঁধ ঘাড় কানের পেছন, তার পরে পেট থেকে আরম্ভ করে পায়ের বুড়ো আঙুলের ডগা পর্যন্ত–দেহের দুই অঙ্গের অন্ধি-সন্ধি ও গ্রন্থিতে বারে বারে হকিমসাহেব মৃত্যুদূতের সন্ধান করতে লাগলেন। সেই থেকে সন্ধে অবধি এইভাবে নাড়ী দেখে বললেন, নাঃ, বিশেষ কিছুই নয়। আমি কাল সকালে ওষুধ নিয়ে এসে নিজে খাইয়ে দেব।
নবাবসাহেবকে বললেন, আপনি কিন্তু আর জমিতে শুতে পাবেন না।
হকিমসাহেবের পেছনে পেছনে আমরা, ঘরসুদ্ধ সকলেই, পিয়ারাসাহেবের বৈঠকখানায় এসে উপস্থিত হলুম। মুখে কেউ কিছু না বললেও সকলেই উদ্গ্রীব–অর্থাৎ কিরকম দেখলেন?
কিন্তু কারুকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে হল না। হকিমসাহেব নিজে থেকেই ঘোষণা করলেন, ডাক এসে গিয়েছে, বড়-জোর মাসখানেক, কি মাস-দেড়েক।
সভাস্থ দু-একজন লোক মুখের ওপর জোর করে এমন বিস্ময়ের ভাব নিয়ে পিয়ারাসাহেবকে এমন সব সান্ত্বনার বাণী শোনাতে লাগল যে, তা শুনে আমাদের মনে হল, নবাবসাহেবের যে শেষকালে মৃত্যু ঘটবে এমন কথা তারা কোনোদিন কল্পনাই করতে পারেনি।
কিন্তু পিয়ারাসাহেব নিস্পন্দ হয়ে বসে রইল, কারুর কথার জবাব দিলে না। তার ভাবগতিক দেখে আগন্তুক সকলেই একে একে উঠে চলে গেল। আমাদেরও উঠে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু যাবার অন্য কোনো চুলো নেই বলেই সেখানে বসে রইলুম।
লোকগুলো চলে যাবার অনেকক্ষণ পরে পিয়ারাসাহেব হকিমসাহেবের একখানা হাত নিজের দু-হাত দিয়ে তুলে নিয়ে বললে, হকিমসাহেব, আপনি তো জানেন, কোন ছেলেবেলায় বাপ-মাকে হারিয়েছি, তাঁদের কথা ভুলেই গিয়েছি। সেই থেকে আজ পর্যন্ত ওঁর কোলেই আমার এতদিন কেটেছে। উনি চলে গেলে আমি কি করব?
হকিমসাহেব বললেন, এ তো বরদাস্ত করতেই হবে সাহেবজাদা, অন্য উপায় তো নেই, অত উতলা হলে চলবে কেন?
পিয়ারাসাহেব আরও কি যেন বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় হকিমসাহেব আবার শুরু করলেন, আমাকে দেখুন। কোন দূর অতীতে, তখন আমরা নওজোয়ান, সেই সময় আপনার ঠাকুরদার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল, সেই থেকে আজ পর্যন্ত আমরা কাছাকাছিই আছি। আমাদের মধ্যে কোনোদিন মনোমালিন্য হয়নি। সেই বন্ধু আমার চলে যাচ্ছে! কি করব? এ মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় তো নেই। তবে কিনা আমারও তো দিন ঘনিয়ে এসেছে, এই যা।
কিছুক্ষণ বাদে হকিমসাহেব চলে গেলেন। দেখতে-না-দেখতে নবাব সাহেবের আসন্ন মৃত্যুর কথা বিদ্যুদ্বেগে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তেই নবাব-বাড়ি একেবারে যেন নিঝুম হয়ে পড়ল। সেখানে বড় ছোট কর্মচারী থেকে আরম্ভ করে সামান্য ভৃত্যরাও চিৎকার করে গল্প, কথা বলা এবং ঝগড়া করত, কিন্তু কি জাদুমন্ত্রে হঠাৎ যেন সব চুপ হয়ে গেল। পিয়ারাসাহেবের আড্ডায় প্রতিদিন যাদের মুখে হাসি খোশগল্প ও বাত্তেল্লার ফোয়ারা ছুটত, সেদিন দেখলুম, তারা অত্যন্ত সংযত হয়ে অর্থাৎ জুতোর আওয়াজটি পর্যন্ত না হয় এমনভাবে আসরে এসে বসতে লাগল। অতি ধীরে সংক্ষেপে পিয়ারাসাহেবকে একটি কি দুটি প্রশ্ন করে বসে রইল।
সেদিন আর একটি আশ্চর্য অভিজ্ঞতা হয়েছিল, যে-কথাটা এখানে না বলে থাকতে পারছি না। এদিকে পুরুষেরা এই তুষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করামাত্রই ওদিকের ওঁরা যেন চাঙ্গা হয়ে উঠতে লাগলেন। এতদিন আছি, কিন্তু নারী-কণ্ঠস্বর কখনও কর্ণগোচর হয়নি। শুনেছিলুম, পরপুরুষের কর্ণে কণ্ঠস্বর যাতে না পৌঁছয়, এইভাবে স্বরগ্রাম সাধতে ছেলেবেলা থেকেই তাঁদের তালিম দেওয়া হয়ে থাকে। বাড়ির মহিলাদের তো দূরের কথা, দাসীদের ওপর পর্যন্ত সেই হুকুম ছিল। কিন্তু সেদিন হঠাৎ কি যে হল, তা বোঝবার তো উপায় নেই। তবে দূরে কাছে নারীদের কণ্ঠস্বর–কখনও ঝগড়া, কখনও অন্য সব কথা শুনতে পেতে লাগলুম। পিয়ারাসাহেবও যে শুনতে না পাচ্ছিল, তা নয়। মধ্যে মধ্যে তার মুখখানা বিরক্তিতে বিষিয়ে উঠলেও সে চুপ করে বসে রইল।
পুরুষ নিষ্ক্রিয় হলেই প্রকৃতি উদ্ধতা হন।
সেই রাত্রি থেকেই আমাদের অন্যত্র শোবার ব্যবস্থা হল। কারণ আমরা নীচে শোব আর নবাবসাহেব খাটের ওপরে শোবেন–এ ব্যবস্থায় তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না। পিয়ারাসাহেবের দরবার-ঘরের লাগা একটা ঘরে আমাদের থাকবার বন্দোবস্ত করে দেওয়া হল।
পরের দিন সকালে আমরা নবাবসাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেলুম; কিন্তু তাঁর ঘরের কাছে গিয়ে দেখলুম যে, সেখান থেকে আরম্ভ করে একেবারে সেই অন্তঃপুর পর্যন্ত কানাত পড়ে গিয়েছে। সেখান থেকে মেয়েরা হরদম নবাব সাহেবের ঘরে যাতায়াত করছেন। তাঁর এক পত্নী কাল রাত্রি থেকে সেই ঘরেই বাস করছেন। এক পিয়ারাসাহেব ও হকিমসাহেব ছাড়া সেখানে অপর লোকের প্রবেশ নিষেধ।
পরের দিন শুনলুম, নবাবসাহেবের অবস্থার কোনো ব্যতিক্রমই হয়নি, যথাপূর্বং সারারাত্রি জপ প্রার্থনা চলেছে, তবে গত রাত্রে আহার কিছু কম করেছেন।
পিয়ারাসাহেব এমন উতলা হয়ে পড়েছিল, তাতে আমাদের মনে হয়েছিল, ঠাকুরদাদা যাবার আগেই তার একটা ভালো-মন্দ কিছু হয়ে না যায়। কিন্তু দেখলুম, দিন-দুয়েকের মধ্যেই সে বেশ সামলে নিলে।
সমস্ত ব্যাপারটা আমাদের কাছে খুবই রহস্যজনক বলে বোধ হতে লাগল। ঠিক এইরকম না হলেও প্রায় এরই কাছাকাছি একটা গল্প আরব্য-উপন্যাসে পড়া গিয়েছিল বটে, কিন্তু আধুনিক যুগে চিকিৎসক বা জ্যোতিষীর কথার ওপরে বিশ্বাস করে এতখানি বাড়াবাড়িটা কি জানি আমরা বরদাস্ত করতে পারছিলুম না। সেই রাত্রে আড্ডা দেবার সময় পিয়ারাসাহেবকে বলে ফেললুম, হকিমসাহেবের কথায় এতখানি আস্থা স্থাপন করাটা যেন একটু বাড়াবাড়ি বলে বোধ হচ্ছে। উনি তো আর দেবতা নন যে, যা মুখ দিয়ে বেরুবে তাই ফলে যাবে!
পিয়ারাসাহেব জবাব দিলে, উনি একেবারে দেবতা। এ-বাড়ির অনেকের মৃত্যু সম্বন্ধে উনি আগেই বলে দিয়েছেন। আমি নিজে দু-তিনবার দেখেছি, একেবারে হুবহু মিলে গিয়েছে।
এর ওপরে আর কথা চলে না।
ঘটনাস্রোত খুবই দ্রুত অগ্রসর হতে আরম্ভ করলে। বোধ হয় দিন-তিনেক পরে একদিন সকালবেলা উঠে দেখি, চাকরদের মধ্যে সাজগোজ করবার খুব ধুম লেগে গিয়েছে। বেলা কিছু এগিয়ে যাবার পর পিয়ারাসাহেব আমাদের ডেকে বললে, আমাকে আজই বিশেষ কাজে একবার গাজিপুরে যেতে হচ্ছে। সেখান থেকে ফিরে যেতে হবে পাটনায়, সেখান থেকে কলকাতা হয়ে আবার ফিরতে হবে পাটনায়।–এখন এই চলল, ইংরিজি বাংলা শেখা সব মাথায় উঠল।
কতদিনে ফিরে এসে আবার শান্ত হয়ে বসতে পারবেন বলে মনে হয়?
পিয়ারাসাহেব ওপরদিকে একখানা হাত তুলে বললে, একমাত্র খোদাই জানেন। আমাদের এই যে সব বিষয়-আশয়, তারই একটা ব্যবস্থা করবার জন্যে ছুটোছুটি করে বেড়াতে হবে।
সে বলতে লাগল, আমাদের বিষয়ের ভাগ-বাঁটোয়ারা–সে এক মহা হাঙ্গামার ব্যাপার। তার ওপরে বিশেষ করে আমাদের পরিবারে এই হাঙ্গামা আরও প্যাঁচোয়া হয়ে পড়েছে। আমার ঠাকুরদার চারটি বিবাহ–ছোট পত্নী এখনও বর্তমান। আমার বাবার আরও তিন ভাই ছিল। বাবার চার বিয়ে, আমার মা ছাড়া আর তিনজনই বেঁচে আছেন। চাচাঁদের প্রত্যেকেরই দুটি-তিনটি করে বিয়ে, চাচারা সকলেই গত হয়েছেন বটে, কিন্তু শত্রুমুখে ছাই দিয়ে দু-একজন ছাড়া তাঁদের স্ত্রীরা সকলেই জীবিত। বাড়িতে ছেলের পাল ছিল, সব মরে মরে আমি একা দাঁড়িয়েছি। নিজের বোন ও খুড়তুতো বোন অগুনতি। দুটো খুড়তুতো বোন আমার কাঁধে পড়েছে আর বাকি সবার এখানে-সেখানে বিয়ে হয়েছে। ঠাকুরদা এদের কারুকেই বঞ্চিত করতে চান না, সকলকেই যার যা প্রাপ্য দিয়ে যাবেন, এবং এই কার্যটি তিনি বেঁচে থাকতে-থাকতেই করে যেতে চান, নইলে ভবিষ্যতে অনেক বাধা এসে উপস্থিত হতে পারে। আর এই বৃহৎ কাজের ভার বৃদ্ধ আমার ওপরে চাপিয়েছেন, ‘না’ বলি এমন সাধ্য আমার নেই।
কথায় কথায় প্রকাশ হয়ে পড়ল যে, পিয়ারাসাহেব এখন গাজিপুরে চলেছে বিবাহ করতে। অনেকদিন আগে সেখানকার এক মেয়ের সঙ্গে তার বিবাহের কথাবার্তা পাকা হয়েই ছিল। নবাবসাহেব ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, তিনি যাবার আগেই যেন এই বিবাহ-কার্যটি সমাধা হয়।
বলা বাহুল্য, পিয়ারাসাহেবের দুই পত্নী বর্তমান।
তাকে ঠাট্টা করে বললুম, দুটি পত্নী তো ঘরে রয়েইছে, আর কেন?
পিয়ারাসাহেব হেসে বললে, হ্যাঁ, তারা বিবাহিত পত্নী বটে, কিন্তু তারা তো আমাদের ঘরেরই মেয়ে,–ঘরকি মুরগি দাল বরাবর। অর্থাৎ ঘরের মুরগিতে মাংসের স্বাদ নেই, তা খেতে ডালের মতন।
সেদিন দ্বিপ্রাহরিক ভোজনের পর এ-কথা সে-কথার ভণিতা করে পিয়ারাসাহেব বললে, আমার তদির এমনই মন্দ যে, আপনাদের মতন গুণী লোককে পেয়েও কিছু শিখতে পারলাম না। তবে এ-কথা আপনারা নিশ্চয়ই মনে রাখবেন যে, সুবিধা হলেই আমি আপনাদের ডেকে পাঠাব।
আজও তার সে-সুবিধা হয়ে ওঠেনি, হয়তো মুরগির ঝাঁকে পড়ে আমাদের কথা সে স্রেফ ভুলেই গিয়েছে।
কিছুক্ষণ এ-কথা সে-কথার পর পিয়ারাসাহেব বললে, আজ রাতের গাড়িতেই আমাকে গাজিপুর রওনা হতে হবে। সেখানে তার করা হয়েছিল, তারা দিন ঠিক করে জবাব দিয়েছে। আপনারা আজই যেতে পারেন কিংবা কালও যেতে পারেন; ইচ্ছে করলে দু-দিন, দশদিন অথবা যতদিন ইচ্ছা থাকতে পারেন।
পিয়ারাসাহেব আমাদের এক-একজনকে কুড়িটা করে নগদ টাকা ও একটা করে সবজে রঙের ওপরে কালো ডোরা-কাটা টিনের ট্রাঙ্ক উপহার দিয়ে সেই রাত্রেই লোক-লস্কর ও জনাকয়েক সাময়িক অভিভাবককে সঙ্গে নিয়ে গাজিপুর যাত্রা করলেন।
আমাদের যাত্রার দিন স্থির না হলেও বিদায়ের পালা শুরু হয়ে গেল। মনে হতে লাগল, বৃথাই হল গৃহত্যাগ, বৃথাই হল এতদিনের দুঃখ-সুখ-যন্ত্রণা-ভোগ, বৃথাই হল অমরনাথ বন্দ্যোউপাধ্যায়কে ক্ষমা করা; লাভ হল এই কয়েকটি মাসের অভিজ্ঞতা–দুর্লভ সে অভিজ্ঞতা।
প্রতিদিন অতি ক্ষুণ্ণমনে সেই কয়েকখানা ধুতি ও জামা আর সেই পাড়ওয়ালা রেশমের চাদরখানা নানা রকমে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ট্রাঙ্কের এ-কোণে ও-কোণে গুছিয়ে রাখি, পরের দিন আবার অন্যভাবে সাজাই! অদৃষ্ট আমাদের সঙ্গে যা অভদ্র ব্যবহার করলে, অতি সংক্ষেপে মধ্যে মধ্যে তারই আলোচনা করি দুই বন্ধুতে। গৃহত্যাগের সময় আশা আকাঙ্ক্ষা ও কল্পনা দিয়ে মনের মধ্যে যে মনোহর প্রাসাদ তৈরি করেছিলুম, নিষ্ঠুর অদৃষ্ট অতি বর্বর আঘাতে তা চূর্ণ করে দিলে। তার কাছে এই অতি ‘অপমানকর আত্মসমর্পণ-জনিত অন্তর্দাহের মধ্যেও যে কয়েকটি মুখ সেদিন মনের মধ্যে ফুটে
উঠেছিল–ইহজন্মে তো বটেই, জন্মজন্মান্তরেও তারা আমার আত্মীয়সূত্রে বাঁধা হয়ে রইল।
আর, দিদিমণি! তার সঙ্গে আর কখনও দেখা হয়েছিল কি না–এমন একটা প্রশ্ন পাঠক-পাঠিকার মনে জাগা স্বাভাবিক।
হ্যাঁ, তার সঙ্গে আর একবার দেখা হয়েছিল, সেই কথাটি বলেই এবারের পর্ব শেষ করি!
.
ত্রিশ বছর পরে–তখন আমি মহা কাজের লোক। কাজের ঠেলায় তাঁতের মাকুর মতন ভারতের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত অবধি ঠিকরে-ঠিকরে বেড়াচ্ছি। দুর্ভাগ্যের ঘন তমিস্রা ভেদ করে ভাগ্যাচলের শিখরে সুখসূর্যের প্রথম রশ্মি পড়েছে মাত্র, এমন সময় কয়েক দিনের ব্যবধানে বাবা মা চলে গেলেন। কাজের তাড়ার মধ্যে থাকলে শোক তেমন লাগে না, –অগ্নিশিখার ভেতর দিয়ে খুব জোরে হাতখানা ঘুরিয়ে দিলে যেমন তাত লাগে, কিন্তু পোড়ে না, তেমনই আর কি!
ছুটোছুটির কাজ কমে গেলেও শুধু আগের দমেই ঘুরপাক খাচ্ছি, এমন সময় আমার ভেতরকার সেই লোকটা, যে আমায় কখনও কোথাও ঘর বাঁধতে দিলে না, সেই চির-উদাসী আবার একদিন মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠল। মনের মধ্যে ‘সব ঝুট হ্যায়’-এর কেত্তন শুরু হয়ে গেল। সাংসারিক দায়িত্বের ধামা চাপা দিয়ে সেই বৈরাগ্যের দম বন্ধ করে মারবার চেষ্টা করছি, এমন সময় চোখে পড়ে গেল উপনিষদের অমূল্য উপদেশ–যদহরের বিরজেত্তদহরের প্রব্রজেৎ; অর্থাৎ কিনা বৈরাগ্যটি উদয় হওয়ামাত্রই খসে পড়বে।
অতএব, খসে পড়া গেল। দিন-কয়েক এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ালুম, কিন্তু কিছুই ভালো লাগে না,–মনের মধ্যে দারুণ অশান্তির দাহন, অথচ তার প্রত্যক্ষ কোনো কারণ খুঁজে পাই না। সে এক অস্বস্তিকর অবস্থা! সেইরকম ঘুরতে ঘুরতে একদিন দ্বিপ্রহরে বৃন্দাবনে গিয়ে উপস্থিত হলুম।
আজ বৃন্দাবনের অনেক উন্নতি হয়েছে শহরের আঙ্গিকের দিক দিয়ে। কিন্তু বেশিদিনের কথা নয়, সেদিনেও বৃন্দাবনের অবস্থা ছিল অত্যন্ত খারাপ। যা হোক, বৃন্দাবন আমার অজানা স্থান নয়। বন্ধুবান্ধব সহ দু-তিনবার এর আগে সেখানে গিয়েছি, সারাদিন ঘুরে-ফিরে বিকেল নাগাদ মথুরায় ফিরে এসেছি, রাত কখনও কাটাইনি সেখানে। বোধ হয় তাই না-জানার একটা মোহ ছিল বৃন্দাবনের প্রতি।
দারুণ গ্রীষ্মকাল, বোধ হয় জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি। সেখানে পৌঁছেই মনে হল, যেন অদৃশ্য এক অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। গ্রীষ্ম অসহ্য মনে হতে লাগল। মন্দিরগুলো তেতে আগুন, রাস্তায় ধুলোর ঝড়, গাছের পাতাগুলো ঝুরি-ভাজা, যমুনার নমুনা মাত্র সার।
রান্না ও ফাইফরমাশ খাটবার জন্যে একজন লোক ছিল। তাকে একদিন জিজ্ঞাসা করলুম, এরকম সাংঘাতিক গরম আর কতদিন থাকবে?
সে বললে, আরও মাসখানেক তো বটেই, তার পরে আস্তে আস্তে গরমটা সহনীয় হবে।
এই লোকটাই একদিন কথায় কথায় বললে যে, সেখান থেকে কিছু দূরেই বড় বড় জঙ্গল আছে আর সে-জায়গাগুলো বেশ ঠান্ডা। অনেক লোক গরমের সময়টা সেইখানেই কাটায়, চারিদিকই বেশ ফাঁকা কিনা!
কথাটা শুনেই আমার সন্দেহ হল। জঙ্গল, অথচ চারিদিক ফাঁকা কিরকম? জিজ্ঞাসা করলুম, গাছ-টাছ আছে বাপু সে-জঙ্গলে?
সে ঘাড় নেড়ে বললে, অনেক–অনেক গাছ আছে দেখবেন সেখানে।
একদিন দ্বিপ্রাহরিক আহারাদারি পর ছাতি মাথায় দিয়ে বেরিয়ে পড়া গেল বনের উদ্দেশে, ঠান্ডা হবার আশায়। অত্যন্ত হতভাগা ছাড়া রাস্তায় অন্য লোকজন নেই। তাদেরই কারুকে কারুকে জিজ্ঞাসা করে শেষকালে জঙ্গলে গিয়ে তো উপস্থিত হওয়া গেল।
বৃন্দাবনের বাহাদুরি আছে বাবা! জঙ্গল মানে, ধু-ধু করছে বিরাট প্রান্তর, এক মাইলের মধ্যে এখানে-সেখানে গেঁটে-সেঁটে-বেঁটে তিন-চারটে গাছ দেখতে পাওয়া যায় কি না-যায়! থেকে থেকে আগুন-বাতাস হুঙ্কার ছেড়ে ছুটোছুটি করছে, এরই নাম জঙ্গল।
সেই লক্ষ গোপিনীর তপ্ত বিহরশ্বাসে প্রায় রোস্ট হয়ে বাসস্থানে ফিরে এসে তিন ঘটি বিনা বরফে গুড়ের শরবত পান করে কথঞ্চিৎ ঠান্ডা হওয়া গেল।
তার পরে বৃন্দাবনের ভিখারিনি! ভোর হতে-না-হতেই পালে পালে ভিখারিনি বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়, বিশেষ করে মন্দিরগুলোর আশেপাশেই তারা ওত পেতে থাকে আর দেবদর্শনাভিলাষী নরনারী, বিশেষ করে নতুন মুখ ও যাত্রী দেখলেই ছেঁকে ধরে। আক্রান্ত ব্যক্তি ছুটে গিয়ে গাড়িতে উঠলেও নিস্তার নেই, তারা গাড়ির পেছনে ছুটতে থাকে মাইলের পর মাইল। তারপর দম ফুরিয়ে গেলে থেমে যায় ম্লান মুখে চলন্ত গাড়ির দিকে চেয়ে থাকে, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দম ফিরে পেলে আবার অন্য যাত্রীর সন্ধানে ছোটে।
ভারতবর্ষের বহু তীর্থের ভিখারি ও ভিখারিনিদের অত্যাচারের অভিজ্ঞতা আমার আছে। তাদের অসৌজন্যের জন্যে অনেক ভালো জায়গা থেকে ধুলোপায়েই বিদায় নিতে হয়েছে। মনে পড়ে, একবার আমরা কয়েকটি বন্ধু মিলে ভুবনেশ্বরে মন্দির দেখতে যাওয়া হল। পথে পালে পালে ভিখারি আক্রমণ করল। দু-একটা ছোট ছেলে-মেয়েকে একটা করে পয়সা দেওয়া মাত্র কোথা থেকে পঙ্গপালের মতন ছোট ছেলে-মেয়ের দল চারদিক থেকে ছুটে আসতে লাগল আমাদের গাড়ি লক্ষ করে, আর সেই কয়েক মাইল পথ তারা আমাদের সঙ্গে গেল, আর সেইরকম চ্যাঁচাতে-চ্যাঁচাতে আমাদের সঙ্গেই ভুবনেশ্বরে ফিরে এল। পরে শুনলুম, সেখানে তখন দুর্ভিক্ষ চলছিল। যাই হোক, মানুষের সেই অবস্থা দেখে মনে-মনে সেই দেশের অভিভাবকদের দোষ দিয়েছি মাত্র, তাদের দুরবস্থার জন্য নিজেকে দায়ী মনে হয়নি। কিন্তু বৃন্দাবনের সেই দৃশ্য দেখে সেখানকার লোকদের মধ্যে সেদিন নিজেকে অত্যন্ত হীন বলে মনে হয়েছিল, তার কারণ, এই ভিখারিনিদের মধ্যে শতকরা একশোটিই হচ্ছে বাংলাদেশের নরনারী। সে এক বিস্ময়কর অবমাননায় প্রতিদিন অন্তর কলুষিত হতে লাগল। বাংলাদেশের প্রত্যেক নরনারীরই এ-বিষয়ে দায়িত্ব আছে।
রোজই সকালবেলা কিছু পয়সা নিয়ে গিয়ে এদের মধ্যে বিতরণ করতুম। একটা বিশেষ জায়গায় গিয়ে পৌঁছলেই চারদিক থেকে নারীকণ্ঠের কাতর চিৎকার উঠত, বাবা, দ্যাও, একটি পয়সা দ্যাও- বাপ রে! আজও যদি স্বপ্নে ঘুরতে-ঘুরতে কখনও বৃন্দাবন গিয়ে পড়ি তো তাদের চোখে পড়বার আগেই ঘুম ছুটে যায়।
বৃন্দাবন ক্রমে অসহ্য হয়ে উঠতে লাগল। ভারতবর্ষে যত তীর্থস্থান আছে, ভক্তিহীন লোকের বাস করবার পক্ষে বৃন্দাবন তার মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট স্থান। ভক্তিহীন ব্যক্তির মুক্তি নেই, বিশেষজ্ঞরা এমন একটা মন্তব্য মাঝে মাঝে প্রকাশ করে থাকেন বটে; কিন্তু আমি জোর করে বলতে পারি যে, ভক্তিহীন লোকও যদি বৃন্দাবনে বাস করেন তো কেবলমাত্র ওখানে বাস করার কৃচ্ছ্রসাধনেই তিনি মুক্তিলাভ করবেন।
কিছুদিন বৃন্দাবনে কাটিয়ে মথুরায় এসে ডেরা বাঁধলুম। হ্যাঁ, মথুরা একটা জায়গা বটে! বৃন্দাবনের সঙ্গে মথুরার আকাশ-পাতাল তফাৎ। ব্রজের দুলাল বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরায় এসে আর সেখানে ফিরে যাননি–এইটুকু জানলেই মথুরা-বৃন্দাবনের মধ্যে তফাৎটা বুঝতে পারা যাবে।
কিন্তু তথাপি বৃন্দাবন থেকে মধ্যে মধ্যে আমি একটা আশ্চর্য আকর্ষণ অনুভব করতে লাগলুম। এরকম অভিজ্ঞতা আমার জীবনে নতুন নয়। যদিও অনেকবার একে প্রত্যাখ্যান করেছি, কিন্তু যতবার সাড়া দিয়েছি ততবারই দেখেছি, এর মূলে আমার জন্যে নূতনতর শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়ে আছে। এবারেও এই আহ্বানকে উপেক্ষা না করে মধ্যে মধ্যে টাঙ্গা ভাড়া করে সকালবেলা বৃন্দাবনে গিয়ে মন্দির ইত্যাদি দর্শন করে দুপুরের মধ্যে ফিরে আসতে লাগলুম।
বোধ হয় বার-তিনেক এইভাবে যাতায়াত করবার পর সেদিন গোবিন্দজীর ভাঙা মন্দিরের কাছ অবধি গিয়েই বুঝতে পারলুম, কিসের একটা উৎসব লেগেছে। বৃন্দাবনে অবিশ্যি সপ্তাহে একটা-না-একটা উৎসব লেগেই আছে। কিন্তু সেদিনকার উৎসবের মধ্যে যেন একটু বিশেষত্ব ছিল। রাজ্যের লোক রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। টাঙ্গা তো দূরের কথা, অনভ্যস্ত লোকের পক্ষে সেই ভিড়ে পথ করে চলাও দুষ্কর। ভিড়ের মধ্যে ভিখিরি ও তথাকথিত সন্ন্যাসীই বেশি, ভিখিরিদের মধ্যে অধিকাংশই ভিখারিনি আর সন্ন্যাসীদের মধ্যে অধিকাংশই ভিখারি।
টাঙ্গা থেকে নেমে কয়েক পা চলতে-না-চলতে ভিখারিনির দল আমাকে একেবারে ছেঁকে ধরলে। তাদের মধ্যে অনেকেরই মুখ আমার চেনা, অনেকেই আমাকে চেনে, বিশেষ দিনে আমার মতন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে দেখতে পেয়ে তারা বিশেষরকম উৎসাহিত হয়ে সমস্বরে তান ধরলে, বাবা দ্যান, একটা পয়সা দ্যান, দয়া করে একটা পয়সা দ্যান–
ব্যাপার সুবিধের নয় বুঝে বেশি ঘোরাফেরা না করে একটা মন্দিরে কিছুক্ষণ কাটিয়েই কোনোরকমে চোখ কান বুজে ছুটে গিয়ে তো টাঙ্গায় উঠে বসলুম। কিন্তু পালাব কোথায়? ভালো করে চেপে বসবার আগেই ‘ভিখিরিপল্টন টাঙ্গাসমেত আমাকে ঘিরে ফেললে।
পকেটে হাত পড়ল। খুচরো পয়সা যা ছিল একটা একটা করে তাদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে টাঙ্গা চালিয়ে দিলুম।
আমার টাঙ্গার পেছনে এক পাল ভিখারিনি ছুটতে আরম্ভ করলে। টাঙ্গার ঘড়ঘড়ানি ও সেইসঙ্গে সমস্বরে নারীকণ্ঠের কাতর চিৎকার–বাবা, দ্যান দ্যান–একটা পয়সা ফেলে দ্যান। শেষকালে তিত-বিরক্ত হয়ে স্রেফ তাদের কবল থেকে রক্ষা পাবার জন্যে টাঙ্গাওয়ালাকে বললুম, এই, জোরসে চালাও।
আমার কথা শুনে টাঙ্গাওয়ালা অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে চাইলে। সে-দৃষ্টির অর্থ- সামান্য কারণে বিরক্ত হলে কি চলে? তার পরে অনিচ্ছাসত্ত্বেও মুখে ‘চকাস’ আওয়াজ করে রাশে সামান্য একটু টান দিলে।
টাঙ্গার ঘোড়া, বিশেষ করে বৃন্দাবনী টাঙ্গার ঘোড়া, তারা শাপভ্রষ্ট জীব, রাশটানের ওজন অনুভব করেই বুঝে নিলে। সোয়ারিকে খুশি করবার জন্যে কয়েক কদম একটু জোরে ছুটে আবার বিলম্বিত লয়ে নেমে এল। ইতিমধ্যে বিপরীত দিক থেকে যাত্রীপূর্ণ কয়েকটা টাঙ্গা এসে পড়তেই নতুন আসামি পেয়ে ভিক্ষার্থীর দল তাদের পেছনে লেগে গেল; শুধু একজন আমাকে ছাড়লে না, টাঙ্গার পেছনে সমানে ছুটতে লাগল। মুখে এক কথা–বাবা, দ্যান, একটা পয়সা ফেলে দ্যান–
ভিখারিনি স্থূলকায়া, রঙ রোদে ঘুরে-ঘুরে তামাটে হয়ে গিয়েছে, মাথা ন্যাড়াই ছিল, বিন্দু-বিন্দু খোঁচা-খোঁচা পাকা চুল, পেছনদিকে আধ-ইঞ্চি-টাক একটু চৈতন্য, মুখাকৃতি একেবারে চৈনিক।
তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকতে থাকতে মনে হতে লাগল, আমার কোনো এক আত্মীয়ার সঙ্গে যেন সে-মুখের সাদৃশ্য আছে। অথচ আশ্চর্য এই, কার মুখ যে সেটা তা কিছুতেই স্মরণ করতে পারছিলুম না। তার ভাষায় সেই পূর্ববঙ্গীয় সুরই সব ঘুলিয়ে দিতে লাগল। কার মুখ এ-কার মুখ? হঠাৎ বিস্মৃতির ঘন তমসার মধ্যে স্মৃতির বিদ্যুৎ ঝলকে উঠল–দিদিমণি!
চলতি গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ে ভিখারিনিকে ধরে বললুম, দিদিমণি, আমাকে চিনতে পারছ? আমি–
কয়েক মুহূর্ত মাত্র। অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে থেকে ধীরে ধীরে সে বললে, স্থ–অ–বি–র!
আশ্চর্য! সে কি আমায় আগেই চিনতে পেরেছিল?
দিদিমণিকে তখুনি টাঙ্গায় তুলে নিয়ে তার বাড়ি গেলুম। ছোট একতলা বাড়ি, তারই দুটো ঘর। এক ঘরে শোওয়া থাকা চলে, অন্য ঘরে একটা মাঝারি-গোছের তক্তপোশের ওপর কম করে গুটি পঁচিশ দেবতা–মানে একই দেবতা নানা রকমের পোজ মেরে শুয়ে, বসে ত্রিভঙ্গ হয়ে, হামাগুড়ি দিয়ে রয়েছেন-এটির নাম ঠাকুর ঘর। এঁদের প্রত্যেককেই আলাদাভাবে পরিচর্যা করতে হয়।
দিদিমণি তার শোবার ঘরে একটা মাদুর পেতে আমাকে বসিয়ে সামনে বসল। পাঁচ-সাত মিনিট চুপচাপ কাটবার পর সে বললে বস আমি এখুনি আসছি।
বোধ হয় ঘণ্টাখানেক বাদে ঠাকুর-ঘর থেকে বেরিয়ে সে আবার সামনে বসে ডাক দিলে, যমুনা!
তখুনি একটি বাঙালি বিধবা দরজায় এসে দাঁড়াল। দিদিমণি বলল, ঘরে অতিথ্ এসেছেন।
কথাটা শুনেই সে চলে গেল।
চুপ করে বসে আছি দিদিমণির দিকে চেয়ে, সেও আমার দিকে চেয়ে আছে। কারুর মুখে কথা নেই। আমার মনের মধ্যে লক্ষ প্রশ্নের ঝড় চলেছে। বলবার ইচ্ছে হতে লাগল, তোমার সেই বাজারের টাকা নিয়ে আমরা পালাইনি। ইচ্ছা হল, একবার জিজ্ঞাসা করি আমাদের অতগুলো চিঠির একটারও জবাব দিলে না কেন?
কিন্তু তখুনি মনে হল, এতদিন পরে সে প্রশ্ন তুলে লাভ কি? সেদিন জীবনের সমস্তটাই ছিল ভবিষ্যতের গর্ভে। সেই ভবিষ্যতের সকল সম্ভাবনাই নির্ভর করেছিল আমাদের সেই চিঠিগুলি উত্তরের মধ্যে। আজ জীবনের সমস্তটাই চলে গেছে অতীতের গর্ভে, সে-চিঠির কোনো মূল্যই আমার কাছে আজ আর নেই। কেন চিঠি লেখনি?–এ-প্রশ্নও নিষ্প্রয়োজন সুদ্ধমা কৌতূহল-নিবৃত্তি ছাড়া। সেরকম কুকুর-কৌতূহল আমার নেই।
দিদিমণির নিজের কথা জিজ্ঞাসা করবার ইচ্ছা করতে লাগল। –রাজারানী হয়ে কেমন করে সে আজ পথের ভিখারিনি হয়েছে? এই অবস্থায় নিশ্চয় সে একদিনের মধ্যেই এসে পৌঁছয় নি! কি করে ধাপে ধাপে, স্তরে স্তরে নামতে নামতে, কত বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে অদৃষ্ট তাকে টানতে টানতে এখানে এনে ফেলেছে? কি প্রশ্ন করব? কোন প্রশ্নটা আগে করব?
সেই ঝড়ের মধ্যে থেকে-থেকে আর একটা সুর মনের মধ্যে ঝঙ্কার দিতে লাগল, কতদিন ধরে কত অভাবনীয় আপদের মধ্য দিয়ে তার দিন কেটেছে, কত অশ্রু, কত ব্যথার কাহিনি–কি হবে সে সুদীর্ঘ ইতিহাস শুনে? শত জীবনের বিনিময়েও তো তার দাগ মোছা যাবে না! থাক, সে-কথা শুনে কাজ নেই, কৌতূহলের বিনিময়ে আর নতুন আঘাত অর্জন করতে চাই নে।
দিদিমণিকে দেখতে লাগলুম, মুখখানা ঘিরে একটা করুণ ভাব থমথম করছে; কিন্তু দেখতে দেখতে মনে হয়, যেন কারুণ্যের-আবরণ-দেওয়া রহস্যময় হাসি সেটা।
চুপ করে বসে আছি তার মুখের দিকে চেয়ে, একবার কয়েক মুহূর্তের জন্য সে আমার চোখের ওপর চোখ রাখলে। কি নিরন্বয় পরিবর্তন হয়েছে তার চোখের ও দৃষ্টির! যে চোখ মুহূর্মুহূ, ঘৃণা, আনন্দ, উদ্বেগ, ভয়, দয়া, করুণা, অনুনয় ও ঔদ্ধত্যে ঝলকে উঠত সে-চোখ একেবারে স্থির হয়ে গিয়েছে। অন্তর শান্ত, তাই চোখে কোনো ভাবই প্রতিফলিত হয় না। যে-চোখ শরৎপ্রভাতের সৌরকরোজ্জ্বল শিশির-বিন্দুর মতন ঝলমল করত, সে-চোখ যেন নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছে, যেন ঊর্মিমুখর সাগর একটা প্রাকৃতিক বিপ্লবে শান্ত হয়ে গিয়েছে।
চুপচাপ বসে আছি দুজনে মুখোমুখি। সময় বা ক্ষুধা-তৃষ্ণার জ্ঞান আমার ছিল না, এমনকি দেহের অস্তিত্ব পর্যন্ত মন থেকে মধ্যে মধ্যে লোপ পেয়ে যেতে লাগল। শুধু মনে হতে লাগল, আমি যেন একটা চিন্তার যন্ত্র মাত্র, আমার মধ্যে বসে কে যেন চিন্তার চক্র ঘুরিয়ে চলেছে।
এইরকম চলেছে হঠাৎ দিদিমণি দু-হাত দিয়ে আমার মাথাটা ধরে তার দিকে আমাকে আকর্ষণ করলে। আমি সেদিকে একটু এগিয়ে গিয়ে চোখ বুজে ফেললুম। মনে হল, এবার বুঝি তার গাম্ভীর্যের আবরণ খসে গেল, সেই আগেকার মতন আমার মাথাটা আদরে চেপে ধরবে। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে সে বললে, চুলগুলো সব পেকে গেছে যে!
খাবার ডাক পড়ল। উঠে গিয়ে বারান্দার মতন একটা জায়গায় খেতে বসলুম। কি খেলুম, খেলুম কি না-খেলুম তাও মনে নেই, উঠে এসে আবার সেই মাদুরে বসলুম।
কিছুক্ষণ বাদে দিদিমণি, বোধ হয় খাওয়া-দাওয়া সেরে, আমার কাছে এসে বসল।
বেলা পড়ে আসতে লাগল। টাঙ্গাওয়ালা এসে তাড়া দিয়ে বললে, তার কাছে বাতি নেই, অন্ধকার হয়ে গেলে রাস্তায় পুলিশে ধরবে।
দিদিমণি কিছুই বললে না। কোথায় যেতে হবে, কোথায় থাকি–কোনো প্রশ্নই নয়।
বিদায়ের আগে হাত দুখানা ধরে কাছে নিয়ে এলুম, দেখলুম, বাঁ-হাতের তর্জনীমূলে সেই ক্ষতচিহ্ন জ্বলজ্বল করছে।
আমার মূর্ছিত অতীত চমকে উঠে বিস্মিত বর্তমানের দিকে চেয়ে রইল। আস্তে আস্তে হাত-দু’খানা তার কোলের ওপরে নামিয়ে দিলুম।
উঠি-উঠি করছি, এমন সময় দিদিমণি জিজ্ঞাসা করলে, পরিতোষ কোথায়?
পরিতোষ নেই শুনে সে কোনো কথাই বললে না। আবার দেখলুম, সে-চোখে কোনো আলোড়নই নেই।
টাঙ্গাওয়ালা আর-একবার তাড়া দিতেই উঠে পড়লুম। দিদিমণিও আমার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল। বিদায়ের সময় বললুম, দিদিমণি, তোমার কি অর্থকষ্ট আছে? আমার কাছে কোনো সঙ্কোচ কোরো না। বলো, অর্থের প্রয়োজন থাকে তো আমি রয়েছি, তোমার কোনো ভাবনা নেই।
দিদিমণি বললে, গোবিন্দের ইচ্ছায় আমার কোনো অভাব নেই।
প্রণাম করে টাঙ্গায় গিয়ে উঠলুম।
।। দ্বিতীয় পৰ্ব সমাপ্ত।।
পরের দুই পর্ব চাই