কর্মসংস্থান ও আর্থিক পুনর্গঠন
বেকার সমস্যা এদেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আশার কথা এই যে, গ্রামে ও শহরে আগামী কয়েক বছরে কর্মসংস্থান বাড়াবার কিছু সুযোগও উপস্থিত। হরিৎ বিপ্লবের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে জমি থেকে বছরে একটির জায়গায় দুটি, এমন কি তিনটি ফসল তুলবার সম্ভাবনা ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে কৃষিতে শ্রমের নিয়োগ বৃদ্ধির পথে; অন্তত পশ্লী অঞ্চলে অধবেকারত্ব এতে কমবে বলে আশা করা যায়। গ্রামে গ্রামে সেচব্যবস্থা, পথঘাট ইত্যাদি বাড়াতে গেলে শ্রমিকের প্রয়োজন। প্রাথমিক শিক্ষার দ্রুত বিস্তারের জন্য যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে বলে শোনা যাচ্ছে, তাতেও কিছু শিক্ষিত মানুষের কর্মর্সংস্থান হবে। তা ছাড়া ছোট শিল্পের প্রসারের সম্ভাবনা তো আছেই। মহানগরীতে উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে; তাতেও লোকের দরকার। এইসব খণ্ড খণ্ড সম্ভাবনা। যখন আমাদের সামনে এসে পড়েছে তখন একটা সামগ্রিক দৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত করে তাদের বিচার প্রয়োজন। কারণ, সাময়িকভাবে কিছু কর্মের সংস্থান ___ যথেষ্ট নয়। ব্যাধির মূল কোথায়, কি করে তাকে দূর করা যায়, সেটাও বিবেচ্য।
এদেশে বেকারের সংখ্যা কত? এ প্রশ্নের কোনো পরিষ্কার উত্তর আমাদের জানা নেই। তবে কোরের সংখ্যা বাড়ছে একথা প্রায় সকলেই স্বীকার করবেন। দ্বিতীয় পঞ্চবর্ষ পরিকল্পনার গোড়ায় সারা ভারতবর্ষে এই সংখ্যা ছিল ৫৩ লক্ষ। অন্তত এই রকম একটা হিসেব কিছুদিন চালু ছিল। পরিকল্পনার পাঁচ বছরে কর্মপ্রত্যাশীর সংখ্যা বাড়বে এক কোটি, আর নতুন কর্মসংস্থানও হবে মোটামুটি ঐ একই সংখ্যায়, এইরকম একটা আশাও সেই সময় প্রকাশ করা হয়েছিল। ১৯৬১ সালে যখন দ্বিতীয় পঞ্চবর্ষ পরিকল্পনা তার অন্তে পৌঁছল তখন দেখা গেল যে, আদি হিসেবগুলো ভুল। প্রথম সংখ্যাটা হবে এক কোটির চেয়ে আরও সতের লক্ষ বেশী, দ্বিতীয়টা বিশ লক্ষ কম; অর্থাৎ দ্বিতীয় পরিকল্পনার পাঁচ বছরে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে ৩৭ লক্ষ। ৫৩ লক্ষের সঙ্গে ৩৭ লক্ষ যোগ করে তৃতীয় পঞ্চবর্ষ পরিকল্পনার গোড়ায় বেকারের মোট সংখ্যা দাঁড়াল ৯০ লক্ষ। কিছুদিন পর অবশ্য জানা গেল যে, এই সংখ্যাটাও ভুল। কিন্তু সে কথা এখন থাক। তৃতীয় পরিকল্পনার পাঁচ বছরে বেকারের সংখ্যা আরও বেড়েছে, বৃদ্ধির পরিমাণ নাকি পঁচিশ লক্ষ। যদি তাই হয় তো তৃতীয় পরিকল্পনার শেষে, অর্থাৎ ১৯৬৬ সালে, বেকারের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ কোটি ১৫ লক্ষ। তবে নতুন হিসেবে বলা হলো যে, ঐ সংখ্যাটা আসলে হবে ৯০ লক্ষ থেকে এক কোটির ভিতর। মোট কথা এদেশে বেকারের সংখ্যা আমরা সঠিক জানি না, কিন্তু সংখ্যাটা বাড়ছে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
সংখ্যা নিয়ে বিভ্রাটের কথা বলেছি। এজন্য কাউকে হাস্যাস্পদ প্রমাণ করা আমার উদ্দেশ্য নয়। এদেশের বেকারের সংখ্যাগণনা সহজ নয়। পূর্ণ বেকারের পাশে পাশে আছেন অর্ধ বেকার। এঁদের সনাক্ত করা জটিল ব্যাপার। কর্মসংস্থানের জন্য অনেকে খাতায় নাম লেখান। কিন্তু যাঁরা বেকার তাঁরা সবাই নাম লেখান না; যাঁরা নাম লেখান তাঁদের সবাই পুরোপুরি বেকার নন। এইরকম নানা জটিলতা আছে। কিন্তু সংখ্যা গণনার জটিলতা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। মূল বিষয়ে ফিরে আসা যাক।
বেকার সমস্যার কারণ কি? গান্ধীবাদীদের একটা ব্যাখ্যা ছিল। তাঁদের বিশ্লেষণ আরম্ভ হয় গ্রামীণ অর্থনীতি থেকে। গ্রামের এক সময়ে কৃষি ও কুটির শিল্পের ভিতর অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক ছিল। আধুনিক শিল্পবাণিজ্যের প্রভাবে কুটির শিল্প ভেঙ্গে পড়ে। এই থেকেই গ্রামের অর্থনীতিতে বিপর্যয়ের শুরু। আধুনিক শিল্পের কল্যাণে নগরের প্রসার হয়েছে, যন্ত্রপাতির ব্যবহার বেড়েছে। কিন্তু এইসব যান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতি ততটা শ্রমনির্ভর নয়, যতটা মূলধননির্ভর। গ্রামীণ অর্থনীতির বিপর্যয়ের ফলে দেশময় যে-পরিমাণ মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছে, নগরে অথবা আধুনিক শিল্পে সে-পরিমাণে নতুন কর্মের সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। বেকার সমস্যা সম্বন্ধে গান্ধীবাদী ব্যাখ্যা মোটামুটি এই রকমের।
এই পুরনো ব্যাখ্যাটির খানিকটা নবীকরণ সম্ভব। তার আগে অন্য একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা আবশ্যক। বিগত দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের ভিতর আর্থিক বৈষম্যের প্রশ্ন পরিকল্পনা কমিশনের আলোচনায় গুরুত্ব লাভ করে। পাকিস্তানের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় সমস্যাটির প্রতি আরও বিশেষভাবে দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। এ কথাটা স্পষ্ট হয়েছে যে, পরিকল্পনা অনুযায়ী উন্নয়নের জন্য জাতীয় সংহতি প্রয়োজন, আবার আঞ্চলিক বৈষম্য এই সংহতিকেই বিপন্ন করতে পারে। কাজেই বেকার সমস্যার পাশে পাশে এই বৈষম্যের প্রশ্নও একটি প্রধান জাতীয় সমস্যা হিসেবে আজ স্বীকার্য।
এদেশে আঞ্চলিক বৈষম্য কম নয়। ১৯৭২ সালের ২২শে মার্চ প্রধানমন্ত্রী লোকসভায় যে-সব তথ্য পেশ করেন তাতে জানা যায় যে, ৬৯-৭০ সালে পঞ্জাবে মাথাপিছু আয় ছিল ৯৪৫ টাকা, আর বিহারে ৪০২ টাকা। অর্থাৎ, পঞ্জাবের তুলনায় বিহারের মাথাপিছু আয় অর্ধেকেরও অনেকটা কম। আবার একই প্রদেশের ভিতরও উল্লেখযোগ্য আঞ্চলিক বৈষম্য দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গে কলকাতা-দুর্গাপুর-আসানসোল জুড়ে আছে ভারতের অন্যতম প্রধান শিল্পাঞ্চল। অথচ এই একই রাষ্ট্রে পল্লী অঞ্চলের শতকরা নব্বই ভাগ অংশে বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি আজও।
গান্ধীবাদীরা গ্রাম ও শহরের অসম সম্পর্কের কথা বলেছেন এবং সেই সূত্রে বেকার সমস্যার ব্যাখ্যা করেছেন। গ্রামকে অনগ্রসর অঞ্চলের এবং শহরকে অগ্রসর শিল্পাঞ্চলের প্রতীক বলে ধরে নিলে গান্ধীবাদী ব্যাখ্যাটি নতুনভাবে রাখা যায়। অনগ্রসর অঞ্চলে কুটির শিল্প ও বাণিজ্য গড়ে ওঠেনি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেখানে অর্ধবেকারের সংখ্যা। দ্রুত বেড়ে চলে। এদের একটি অংশ জীবিকার অন্বেষণে শহরে আসে। কিন্তু আধুনিক শিল্প মূলধনবির্ভর; দেশের দ্রুতবর্ধমান অর্থবেকারদের সবাইকে এখানে কাজের সুযোগ দেওয়া যায় না। কাজেই নগরেও বেকারের সংখ্যা বেড়ে চলে। এমনিভাবে গ্রাম অথবা অনগ্রসর অঞ্চলের দারিদ্র্য এবং নগর অথবা আধুনিক শিল্পাঞ্চলের বেকারত্ব ও সামাজিক অস্থিরতার ভিতর একটা কার্যকারণ সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত আঞ্চলিক অর্থনীতি আমাদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যবস্তুর অন্তর্ভুক্ত ছিল না বলা যায়। এখনও এ ব্যাপারে অবস্থার কোনো বড় পরিবর্তন হয়নি। আর্থিক কর্মকাণ্ডের যে-একটা আঞ্চলিক ভিত্তি আছে, এ কথা পাঠ্যপুস্তকে শুধু আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসঙ্গেই স্মরণ করা হয়। দেশের আভ্যন্তরীণ সমস্যার বিশ্লেষণে প্রচলিত অর্থবিজ্ঞান প্রায়ই স্থানবোধশূন্য। শ্রমের পূর্ণ নিয়োগ সংক্রান্ত তত্ত্বের বেলায়ও এর বড় ব্যতিক্রম দেখা যায় না। এইসব আলোচনায় জাতীয় আয়ের মোট কতটা অংশ মূলধন হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে সেটাই প্রধান কথা, দেশের কোন্ অংশে তার বিনিয়োগ হচ্ছে। সেটা প্রধান নয়।
অথচ বেকার সমস্যার পিছনে উন্নত ও অনুন্নত অঞ্চলের পারস্পরিক সম্পর্কে গঠিত একটি পটভূমিকা যে-মুহূর্তে আমাদের দৃষ্টির ভিতর আসে তখনই আঞ্চলিক প্রশ্নকে আর তুচ্ছ করা যায় না। অনগ্রসর অঞ্চল থেকে মানুষ জীবিকার সন্ধানে শিল্পাঞ্চলে আসে বটে। দেশের ভিতর এইরকম একটা সচলতা থাকা স্বাভাবিক ও বাঞ্ছনীয়। অধিকাংশ মানুষের জন্য তবু জীবিকার সংস্থান চাই তাদের নিজ নিজ অঞ্চলে। এ ছাড়া উপায় নেই। অনুন্নত অঞ্চলে যদি কর্মের সুযোগ না থাকে, স্থানীয় সম্পদের ভিত্তিতে যদি সেখামে শিল্পগঠনের উদ্যোগ না থাকে, তবে তাতে সেই অঞ্চল এবং সমগ্র দেশ উভয়েরই ক্ষতি।
প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব প্রায়ই অনুন্নত অঞ্চলের উন্নতির পথে প্রধান অন্তরায় হয়। বরং অনগ্রসরতাই অনগ্রসরতার মূল কারণ। অর্থাৎ সাফল্য যেমন সাফল্যকে ডেকে আনে এবং ব্যর্থতা ব্যর্থতাকে, অনগ্রসরতাও তেমনই এমন কিছু অবস্থার সৃষ্টি করে। যার ফলে এরপর অগ্রসর হওয়া কঠিন হয়ে ওঠে। আর্থিক উন্নয়ন ও শিল্পায়নের জন্য শুধু প্রাকৃতিক সম্পদই প্রয়োজন হয় না; সেই সঙ্গে চাই একটা অনুকূল পরিপার্শ্ব, পথঘাট, বিদ্যুৎ, শিক্ষা ইত্যাদি। যে-সব গ্রাম বাজার থেকে বেশী দূর, সেখানে উন্নতি ও ‘আধুনিকীকরণে’র শক্তিও দুর্বল। কাজেই গ্রাম ও শহরের ভিতর পারস্পরিক নির্ভরশীলতার একটা সম্পর্ক সূযতে গড়ে তোলা প্রয়োজন। কয়েকটি গ্রামের মাঝখানে একটি বাজার; বাজারের সঙ্গে যোগ একদিকে গ্রামের, অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত বড় শহরের; সেই শহরের সঙ্গে যোগাযোগ আবার কেন্দ্রীয় নগরের। পথঘাট এমনভাবে পরিকল্পিত যে, গ্রাম থেকে বাজারে অথবা নিকটবর্তী শহরে যাতায়াত সহজ। সেই সঙ্গে চাই শিক্ষার সুবন্দোবস্ত। এই হলো মোটামুটি ছক, যার ভিত্তিতে গ্রাম ও শহরের ভিতর ধীরে ধীরে নৈকট্য স্থাপন করা যায়।
সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের মোট শহরবাসীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের বাস বৃহত্তর কলকাতায়। লোকসংখ্যার হিসেবে বৃহত্তর কলকাতা এখানকার পরবর্তী বৃহত্তর শহরের তুলনায় ত্রিশগুণের চেয়েও বড়। অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গে আছে একটি বৃহৎ নগরীর একাধিপত্য। ফলে কলকাতার সঙ্গে পল্লী বাংলার বৃহদংশের আর্থিক ও সাংস্কৃতিক দূরত্ব এতই বেশী যে, এ-দুয়ের ভিতর পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সৃষ্টিশীল সম্পর্ক গড়ে ওঠা অত্যন্ত কঠিন। ভারতের অন্যান্য কোনো কোনো অঞ্চলেও তুলনীয় অবস্থা দেখা যায় তবে শিল্পাঞ্চল ও। গ্রামাঞ্চলের ভিতর বৈসাদৃশ্য সম্ভবত অন্য কোথাও এমন প্রকট নয়। এই নাগরিক। একাধিপত্যের পরিবর্তে চাই বিকেন্দ্রিক উন্নয়নের ভিন্ন রূপরেখা।
গান্ধীবাদীরা গ্রামীণ শিল্পের সাহায্যে বেকার সমস্যার সমাধান করতে চান। এই চিন্তাধারারও কিছু পরিবর্তন আবশ্যক। দ্বিতীয় পঞ্চবর্ষ পরিকল্পনার সময়ে কথা শোনা গিয়েছিল যে, আমরা ভারী শিল্পের সাহায্যে বেকার সমস্যার সুরাহা করব। সিংহলেও দু বছর আগে (১৯৭০ সালের অগাস্ট মাসে) কর্মসৃষ্টির বড় একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, তাতে গ্রামীণ শিল্পের জন্য বেশ কিছু টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু নানা রকম অসুবিধা অবিলম্বে দেখা দেয়। আমাদের দেশের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তার মিল আছে। শুধু সরকারী সহায়তায় গ্রামীণ শিল্পকে চিরকাল টিকিয়ে রাখা যাবে না। গান্ধীবাদীরা নিজেরাই স্বীকার করেন যে, এজন্য ছোট শিল্পের দক্ষতা বাড়ানো দরকার। কুটির শিল্পের যান্ত্রিক উন্নতিতে ওঁরাও আজ আগ্রহী।
এই চিন্তাধারাকে আরও একটু এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দরকার। ছোট শিল্পের দক্ষতা বাড়াবার জন্য যেমন যান্ত্রিক নতুনত্ব প্রয়োজন, তেমনই কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি কিনবার সমস্যা আছে, আবার উৎপন্ন দ্রব্য বিক্রী করবার প্রশ্নও আছে। এই সব নানা কারণে ছোট শিল্পকেও একটা সংগঠনের ভিতর আসতে হয়। কোনো কোনো শিল্পকে কৃষকের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু এমন অনেক ছোট শিল্প আছে যাদের বাজারের কাছে, অথবা ঐ রকম কোনো সুবিধাজনক জায়গায়, পরস্পরের সান্নিধ্যে স্থাপন করতে পারলে কাজের সুবিধা হয়। যাকে গ্রামীণ শিল্প বলা হয় তার উন্নতির প্রশ্ন আজ গ্রামের স্বয়ম্ভরতার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা সম্ভবত ঠিক হবে না। গ্রামীণ যে-অর্থনীতি শিল্পবিপ্লবের সংঘাতে ভেঙ্গে গেছে সেখানে প্রত্যাবর্তনের পথ আর খোলা নেই। বরং আমাদের দৃষ্টিকোণ আরও একটু বিস্তৃত করে আঞ্চলিক উন্নয়নের লক্ষ্য সামনে রেখে ছোট শিল্পের। কথা চিন্তা করা এখন ফলপ্রসূ হতে পারে। গ্রাম এবং ছোট ও মাঝারি শহরের সমন্বয়েই একটি অঞ্চল। এই কাঠামোর ভিতর স্থানীয় সম্পদের পূর্ণতর ব্যবহারের জন্য শিল্পের বিকেন্দ্রীকরণ বাঞ্ছনীয়।
জাতি গঠন ও আর্থিক পুনর্গঠনের কাজের ভিতর এইখানে মিল। গ্রাম ও জনপদ, আঞ্চলিক সমাজ ও বৃহত্তর সমাজ, এইসব নিয়েই জাতি। ব্যক্তি একই সঙ্গে ছোট, বড় এবং আরও বড় সমাজের অংশ। শিল্পবিপ্লবের একটা ঝোঁক আছে, স্বতন্ত্র ব্যক্তি ও বৃহৎ জাতির মাঝখানে আত্মীয়তা এবং সমাজবদ্ধতার অন্য যে-সব বৃত্ত আছে, তাদের সে। নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়। এই ঝোঁকটা যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তখন মানুষের স্বভাব তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। মানুষের আর্থিক ও আত্মিক কিছু অভাব সুষ্ঠুভাবে মেটানো যায় আঞ্চলিক সমাজের সীমানার ভিতর। আবার অন্য কোনো কোনো প্রয়োজনে তাকে যুক্ত হতে হয় আরও বৃহৎ সমাজ এবং অবশেষে সমগ্র মানবসমাজের সঙ্গে। একথা যেমন সত্য সমাজনীতিতে, তেমনই অর্থনীতিতে। এইসব ছোট এবং বড় সমাজের ভিতর তাই কর্মের সমম্বয় প্রয়োজন। এটা সহজ কথা হয়েও সহজ নয়, কারণ বাস্তব অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন সমম্বয়ে পৌঁছতে হয় নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে। গান্ধী বলেছিলেন, জনপদের জন্য গ্রাম, দেশের জন্য জনপদ, পৃথিবীর জন্য দেশ। সেকথা এখনও সত্য। কিন্তু এই পারস্পরিক নির্ভরতার প্যাটার্নের ভিতর ছোট বড় বিভিন্ন গোষ্ঠীর দায়দায়িত্বের ক্রমাগত পরিবর্তন হচ্ছে। আমদের আজকের প্রয়োজন অনুযায়ী কর্মবিভাগের রেখাগুলি নতুন করে এঁকে নেওয়াই প্রধান কাজ। এই পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামীণ অর্থনীতি, আঞ্চলিক অর্থনীতি ও জাতীয় অর্থনীতি নিয়ে নতুনভাবে। চিন্তা করার সময় এসেছে।
সমাজ সংগঠনের বৃহত্তর কাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই আর্থিক পুনর্গঠনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান খোঁজা আবশ্যক। একথা অর্থনীতিবিদদের ভুলে থাকার একটা অভ্যাস আছে। কিন্তু একটা কথা কিছুতেই আর উপেক্ষা করা যায় না; পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি নিয়েও সেটা বলা দরকার। আর্থিক উন্নয়নের জন্য ন্যূনতম একটা সামাজিক সংহতি প্রয়োজন। বেকার সমস্যা ও আঞ্চলিক অসাম্যের সমস্যা আজ এমন আকার ধারণ করেছে যে, এর সঙ্গ সেই ন্যূনতম সমাজ সংহতির প্রশ্নই জড়িয়ে পড়েছে। আর্থিক পরিকল্পনার যাঁরা। প্রণেতা, নগরের সমস্যা স্বভাবতই তাঁদের চেতনাকে একটু বেশী করে অধিকার করে থাকে। কারণ নাগরিক অসন্তোষ বেশী সরব। নগরের সমস্যাকে উপেক্ষা করা বিপজ্জনক। তবু ব্যাধির মূল খুঁজতে হলে আরও গভীরে যেতে হবে।
এদেশের যাঁরা নীতির নির্ধারক তাঁদের ভিতর কি সেই নতুন চিন্তা শুরু হয়েছে? পল্লী অঞ্চলে আরও কিছু পথঘাট, স্কুল অথবা বিদ্যুতের ব্যবস্থা করাই যথেষ্ট নয়, যদিও এ সবই প্রয়োজন। পল্লী ও নগরের সম্পর্কের প্রশ্নটা নিয়েই নতুন করে ভাবতে হবে। এ ব্যাপারে আমাদের আর্থিক চিন্তায় এখনও স্বচ্ছতা আসেনি। নতুন পরিকল্পনামন্ত্রী দায়িত্ব। গ্রহণের পর বলেছেন যে, বেকার সমস্যা সমাধানের চেষ্টা জোরদার করতে হবে। পল্লী অঞ্চলে যেটুকু না করলেই নয় তাই হবে। আর শহরে, ব্যবসাবাণিজ্যে, ক্ষুদ্র শিল্পে ও সেবাকর্মে যথাসম্ভব বেশী কর্মের সংস্থান করা হবে (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২৮ জুলাই)। একটি বহু প্রচারিত সংবাদপত্রে পরিবেশিত এই খবরটি কি নির্ভুল? পিছিয়ে-পড়া দেশগুলিতে স্বাভাবিকভাবে যা ঘটছে, তারই প্রায় একটি হুবহু চিত্র এখানে পাওয়া যাচ্ছে। এসব দেশের পল্লী অঞ্চলে নতুন কাজের সুযোগ বাড়ছে না; আর শহরের অতিস্ফীত ব্যবসাবাণিজ্যে ও তথাকথিত সেবাকর্মে অর্ধবেকারদের সংখ্যা ক্রমশ অস্বাস্থ্যকরভাবে বেড়ে চলেছে। এই প্রতিক্রিয়াটিকে সরকারী সহায়তায় আরও একটু সুচারুভাবে সম্পন্ন করাই কি যথেষ্ট? তবে কি ‘নয়া অর্থনীতির চাকা ঘুরেও ঘুরছে না? আশা রাখতেই হয় যে, পরিকল্পনামন্ত্রীর আরও কিছু বক্তব্য আছে, যা তিনি এখনও বলেননি। দেশের অর্থনীতি নিয়ে নতুন একটা সামগ্রিক চিন্তা পরিকল্পনায় প্রতিফলিত হওয়া চাই। গ্রামকে উপেক্ষা করে দেশময় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা পারে না।
পল্লী ও নগর (১৯৭৩)