২.৫
এয়ারপোর্টে এসে কবির দেখলেন, সেই একই ফ্লাইটে ফিরছেন বিনায়ক।
সিকিউরিটি চেকের পর বিমানে ওঠার অপেক্ষায় পাশাপাশি বসলেন দুজনে। বিনায়ক জিগ্যেস করলেন, কী, দিল্লি জয় করা হল?
কবির ঘাড় নাড়লেন।
বিনায়ক বললেন, তাই তোমাকে খুশি-খুশি দেখাচ্ছে। তোমরা পুলিশরা শুধু জয় করেই খুশি হও। পরাজয়েও যে অনেক সময় সুখ থাকে, তা তোমরা বুঝবে না। অনেকটা দুর্যোধনের মতন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, সুখ চাহি নাই মহারাজ, জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ। পড়েছ?
কবির বললেন, না পড়িনি, তবে আবৃত্তি শুনেছি। কর্ণ-কুন্তী সংবাদ, তাই না?
ধ্যাৎ! এর মধ্যে কর্ণ এল কোথা থেকে! সে তো হারা পার্টি। এটার নাম গান্ধারীর আবেদন! একদিন আমি পড়ে শোনাব তোমায়।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, এটাও আমি শুনেছি। নামটা মনে ছিল না। তবু, তুমি একদিন পড়ে শুনিয়ো।
তুমি আমাকে কী একটা গল্প শোনাবে বলছিলে?
সেই গল্পের শেষটা ঠিক করার জন্যই আমি এবার দিল্লিতে এসেছিলাম। আমরা সাধারণত কোনও অপরাধীকে গ্রেফতার করতে পারলেই খুশি হই। এবার এসেছিলাম, যাতে একজনকে গ্রেফতার করতে না হয়। এটাকে তুমি জয় বলবে, পরাজয় বলবে?
হেঁয়ালি করো না। পুরো ব্যাপারটা খুলে বলো।
ও হ্যাঁ হ্যাঁ। তুমি বলছিলে বটে, আবার তাকে নিয়ে কী গণ্ডগোল শুরু হয়েছে? তোমরা কি একটা নিরীহ মেয়েকে নিজের মতন করে বাঁচতে দেবে না?
শোনো বিনায়ক। তাকে বাঁচাবার জন্যই তো এত সব চেষ্টা। তবু ঘটনাটা আমাদের সাধ্যের বাইরে চলে যেতে পারত। এর মধ্যে যা হয়েছে, তা তোমাকেও জানাইনি। বাচ্চা মেয়েদের স্কুলে চাকরি, একটু জানাজানি হলেই তার চাকরি নিয়ে টানাটানি হত। কিন্তু সেই খুনের মামলাটা আবার উঠেছিল। তাতে লক্ষ্মীমণি একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী। দিল্লি পুলিশ তাকে আনতে চাইলে আমরা বাধা দেব কী করে? আইন হচ্ছে আইন। কিন্তু…।
কবির এরপর বিনায়ককে বাকি ঘটনা খুলে বললেন।
সব শুনে বিনায়ক বললেন, আমি কুকুরদের ভালোবাসি। কেউ যদি কোনও কুকুরের অযত্ন করে, তা হলে আমার খুব রাগ হয়। কিন্তু একটা কুকুর যদি পাগল হয়ে যায়, তাকে মেরে ফেলা ছাড়া আর তো কোনও উপায় থাকে না। এই সহদেব লোকটাও তো পাগলা কুকুরের মতন হয়ে গিয়েছিল। ওকে মারা হয়েছে, বেশ হয়েছে। তার জন্য সমাজ ওই বাহাদুর নামের দারোয়ানটিকে কোনও শাস্তি দিতে পারে না। বরং তাকে পুরস্কার দেওয়া উচিত।
কবির বললেন, আইনে যে সেরকম কোনও ব্যবস্থা নেই। যাই হোক, এ কেস নিয়ে আর আমাদের কিছু করার নেই। আমরা হাত ধুয়ে ফেলেছি। লক্ষ্মীমণিকে নিয়ে যে আবার এত কাণ্ড হয়েছে, তাও ওকে জানাবার দরকার নেই।
কলকাতায় পৌঁছে দুই বন্ধু তক্ষুনি বাড়ি না ফিরে সোজা চলে এলেন একটা ক্লাবে। আজ সেলিব্রেট করতেই হবে।
সেখান থেকেই ফোন করা হল বর্ধনকে। মোবাইল ফোন নিঃশব্দ। পাওয়া গেল বাড়ির ফোনে।
তিনি প্রথমেই বললেন, আমার মোবাইলটা চুরি হয়ে গেছে আজ বিকেলে। এত চোর বেড়েছে! হ্যাঁ, কী বলবে, বলো! তুমি কোথায়, দিল্লিতে?
কবির বললেন, না স্যার, একটু আগে ফিরেছি।
খুনি ধরা পড়েছে?
না, তবে
ধরতে পারলে না। তা হলে আর শুধু তবে শুনে কী হবে? তবু বলো–
সবটা শোনার পর বর্ধন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আমাদের লাইনে কাজ হচ্ছে চোর, খুনি ডাকাতদের ধরে ধরে শান্তি দেওয়া। এরকম একজন-দুজনকে যদি সুস্থ জীবন ফিরিয়ে দেওয়া যায় তার চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে! তবে এসব ঘটনা ঢাকঢোল পিটিয়ে তো কাউকে জানানোও যায় না।
জানাবার দরকারও নেই।
ঠিক। মেয়েটি শান্তিতে থাকুক। কবির, তোমার কবে কী প্রমোশন হবে আমি জানি না। আমার একটা সোনার রিস্ট ওয়াচ আছে, একবার পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছিলাম বলে আমার বাবা দিয়েছিলেন। ঘড়ি তো আমি এখন পার না। ওই ঘড়িটা তোমায় নিতে হবে।
স্যার, আমি আর ঘড়ি নিয়ে কী করব। আমার তো দুটো ঘড়ি আছেই। আপনি যে বললেন, সেইটি আমার কাছে অনেকখানি পাওনা।
চোপ! আমি বলছি, নিতেই হবে। তুমি না পরো, তোমার ছেলেকে দিও!
.
এই কাহিনির এমন মধুর সমাপ্তি হলে সবাই খুশি হত। কিন্তু জীবন মসৃণ গতিতে চলে না সব সময়।
লক্ষ্মীমণির জীবনে আবার একটা খাঁড়া নেমে এল।
বাচ্চাদের স্কুল থেকে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ গুরুতর।
রাত্তিরবেলা লক্ষ্মীমণি একা থাকে নীচের তলায়। আর থাকে স্কুলের দারোয়ান রামদয়াল। সে লোকটা গাঁজাখোর। মাঝে-মাঝেই লক্ষ্মমণির রান্নায় ভাগ বসাতে চায়। এক রাত্তিরে সে জোর করে লক্ষ্মীমণির ঘরে ঢুকে পড়ে তাকে বলাৎকার করতে গিয়েছিল। লক্ষ্মীমণি ভয় পেয়ে চ্যাঁচামেচি করতেই ওপরতলায় বাড়ির মালিক বুড়ো-বুড়ির ঘুম ভেঙে যায়।
তারা দাবি করেছেন, লক্ষ্মীমণি আর দারোয়ান, দুজনকেই বিদায় করে দিতে হবে। একদিনও আর রাখা চলবে না। সে ব্যবস্থা না নিলে তারা ইস্কুলই বন্ধ করে দেবেন।
লক্ষ্মীমণির চাকরি গেছে, দারোয়ান পলাতক।
এখন কোথায় যাবে লক্ষ্মীমণি? আপাতত বিনায়কের স্ত্রী তাকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ সেটাও ভালো নজরে দেখছে না। বিনায়কের কাছ থেকে ফোনে এই খবর শুনে কবির কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন।
আবার কোনও বেশ্যালয়েই যেতে হবে লক্ষ্মীমণিকে। এ দেশের মেয়েরা একবার যদি ঘর ছাড়ে কিংবা নিজের ঘর থেকে জোর করে বাইরে বার করে দেওয়া হয়, তারা আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে না। তাদের শেষ পর্যন্ত গতি হয় মাংসের বাজারে।
একটু পরে একটা বিশেষ কাজে বর্ধন এলেন কবিরের অফিসে।
কাজের কথা শুরু করার আগে কবির তাঁকে শোনালেন ঘটনাটা।
বর্ধন বললেন, হু। এখন সে যাবে কোথায়?
কবির বললেন, আমার বন্ধু বিনায়কের বাড়িতে দুজন কাজের লোক আছে। আর একজনকে রাখবে কী করে? লেখক মানুষ, কতই বা রোজগার। তা ছাড়া ওঁর স্ত্রীর ইস্কুল থেকেও আপত্তি করছে। এরপর আমাদের তো আর কিছু করার নেই, স্যার।
বর্ধন কয়েকবার মাথা দোলালেন।
তারপর বললেন, কবির, আমার বাড়িতে যেদিন মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়া হয়, সেদিন একটা কাচের জার আমি ভেঙে ফেলেছিলাম মনে আছে? ওই মেয়েটা যেমন নিখুঁত ভাবে কাঁচ পরিষ্কার করে জলটল মুছে ফেলল, কোনও কাজের মেয়েই তা করে না। তার মানে, ওর। কাজে মন আছে। আমার বাড়িতে যে হাউজকিপার, তার বয়েস হয়েছে, সব কাজ আর পারে না। ওই মেয়েটা, কী যেন নাম বললে, সরস্বতী না দুর্গা, ওকে আমার বাড়িতে রাখতে পারি। কী, সেটা ঠিক হবে না?
এ তো খুবই ভালো কথা স্যার।
ওকে আজই নিয়ে আসার ব্যবস্থা করো। ওর দুটো ছেলেমেয়ে আছে না? তাদেরও আনাও। ওরাও থাকবে, লেখাপড়া শেখার ব্যবস্থা করব। আমি শিগগির রিটায়ার করব, ওদের নিয়েই আমার দিন কাটবে।
এরপর একটা সিগারেট ধরাতে গিয়ে তিনি আবার বললেন, তবে হ্যাঁ, ওর স্বামীটা যেন আমার বাড়ির ধারে কাছেও না আসে, বলে দিও। যদি আসে, তাকে আমি জুতোপেটা করব।
কবির ঝুঁকে পড়ে বর্ধনের হাঁটু স্পর্শ করলেন।