এক সপ্তাহ ধরে ইকবালকে তাঁর সেলে নিঃসঙ্গ অবস্থায় রাখা হয়েছিল। তাঁর একমাত্র সঙ্গী ছিল স্তুপীকৃত খবরের কাগজ ও ম্যাগাজিন। তাঁর সেলে আলোর ব্যবস্থা ছিল না, তাঁকে কোন বাতিও সরবরাহ করা হয়নি। অসহ্য গরমের মধ্যে তাঁকে শুয়ে রাতের শব্দ শুনতে হয়-নাক ডাকা, মাঝে মাঝে গুলির আওয়াজ এবং গভীর রাতে প্ৰচণ্ড নাক ডাকার শব্দ। বৃষ্টি শুরু হলে থানাকে মনে হয় আগের চেয়ে আরও বেশি নীরব। ক্রমাগত বৃষ্টি পতন ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। মাঝে মাঝে দেখা যায় রিপোর্টিং রুম ও ব্যারাকের মধ্যে একজন কনস্টেবলকে দৌড়ে যেতে। একঘেয়েমিপূর্ণ বৃষ্টির ফোঁটার শব্দ ও মেঘের ডাক ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। পাশের সেলে আছে জুগ্গা। কিন্তু তার দেখা পাওয়া যায় কদাচিৎ। প্রথম ঘণ্টাখানেক পরেই তারা তাকে ফিরিয়ে আনে। জুগ্গাকে নিয়ে কনস্টেবলরা কি করে তা ইকবাল জানতে পারেন নি। তিনিও জিজ্ঞাসা করেন নি। আর জুড়াও তাঁকে কিছু বলেনি। তবে পুলিশের সাথে তার রসিকতা আরও কদৰ্য এবং তাদের সাথে তার যোগাযোগ আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে।
একদিন সকালে পাঁচজন লোককে পুলিশ হাতকড়া পরিয়ে থানায় নিয়ে এলো। তাদের দেখামাত্রই জুগ্গার মেজাজ বিগড়ে গেল। সে তাদের গালি-গালাজ করল। জুল্লার আচরণের প্রতিবাদ করে তারা রিপোর্টিং রুমের বারান্দা ত্যাগ করতে অস্বীকার করল। নতুন এই বন্দী কারা, তা নিয়ে ইকবালের বিস্ময়ের সীমা রইল না। তাদের কথাবার্তা শুনে ইকবালের মনে হলো, তারা সবাই মাতলামি, হত্যা ও লুণ্ঠনের অপরাধে গ্রেফতার হয়েছে। থানার কয়েক গজ দূরেই চন্দননগর। সেখানেও মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। ইকবাল আগুনের লেলিহান শিখা দেখেছে, শুনেছে মানুষের আর্ত চিৎকার। কিন্তু পুলিশ সেখানে কাউকে গ্রেফতার করেনি। বন্দীরা নিশ্চয়ই সাধারণের চেয়ে ব্যতিক্রম। নতুন বন্দীদের তিনি যখন চেনার চেষ্টা করছিলেন, সেই সময় তাঁর সেলের তালা খুলে দেয়া হলো। জুয়া ও একজন কনস্টেবল তাঁর সেলে প্রবেশ করল। জুগ্গার মেজাজ বেশ ভালই দেখা গেল।
সুপ্ৰভাত বাবুজি, সে বলল, আমি আপনার ভৃত্য হতে চলেছি। আমি আপনার কাছ থেকে শিখতে পারব।
ইকবাল সাহেব কনস্টেবলটি জুগ্গার কথার জের টেনে তালা বন্ধ করতে করতে বলল, সোজা ও সরল পথে কিভাবে চলতে হয় তা এই বদমায়েশটাকে শিখিয়ে দিন।
ওর কথা ছেড়ে দিন, জুগ্গা বলল, বাবুজি জানে যে, তোমার সরকারই আমাকে বদমায়েশ বানিয়েছে। তাই নয়। কি, বাবুজি?
ইকবাল ওর কথার উত্তর দিলেন না। তিনি বাড়তি একটা চেয়ারের ওপর পা রেখে কাগজের স্তুপের দিকে তাকিয়ে রইলেন। জুগ্গা চেয়ার থেকে তাঁর পা দু’টো সরিয়ে তার বড় দু’টো হাত দিয়ে টিপতে শুরু করল।
বাবুজি, অবশেষে আমার কিসমত খুলে গেছে। আপনি যদি আমাকে কিছুটা ইংরেজী শিখিয়ে দেন, তাহলে আমি আপনার সেবা করব। মাত্র কয়েকটা বাক্য শিখিয়ে দিন, ঐ দিয়েই আমি গিট মিট করতে পারব।
পাশের সেলে কার জায়গা হলো?
জুগ্গা ইকবাল সাহেবের পা টিপতে টিপতে বলল, আমি জানিনে। ওরা বলল, ওরা রামলালের খুনীদের গ্রেফতার করেছে।
আমার ধারণা ছিল, ঐ খুনের জন্য। ওরা তোমাকেই ধরেছে, ইকবাল বললেন।
আমাকেও ধরেছে, জুগ্গা হাসলো। তার সাদা সমান্তরাল দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ল। সোনা দিয়ে বাঁধানো একটা দাঁতের অংশও দেখা গেল। মানো মাজরায় কোন অঘটন ঘটলে ওরা আমাকেই ধরে। আপনি তো জানেন আমি একটা বদমায়েশ।
তুমি কি রাম লালকে খুন করনি?
জুগ্গা পা টেপা বন্ধ করল। দু’হাত দিয়ে সে নিজের কান দু’টো ধরে জিহবায় কামড় দিল। তৌবা; তৌবা! নিজের গ্রামের মহাজনকে খুন? যে মুরগি ডিম দেয় তাকে কে মারে বাবুজি? তাছাড়া আমার পিতা যখন জেলে ছিল তখন রামলাল উকিলকে টাকা দিয়েছিল। আমি জারজ ছেলের মতো কাজ করিনে।
আমার মনে হয় ওরা এখন তোমাকে ছেড়ে দেবে।
পুলিশ হলো দেশের রাজা। দয়া হলে তারা আমাকে ছেড়ে দেবে। আবার যদি আটকে রাখতে চায় তাহলে লাইসেন্স ছাড়া বর্শা রাখার দায়ে বা অনুমতি ছাড়া গ্রামের বাইরে যাওয়ার কারণে অথবা শুধু কিছুর কারণে ওরা আমাকে আটকে রাখবে।
কিন্তু তুমি তো ঐ রাতে গ্রামের বাইরে ছিলো। ছিলে না?
জুগ্গা মেঝের ওপর বসল। ইকবালের পা দু’টো নিজের কোলের ওপর টেনে নিয়ে পায়ের পাতার নিচের অংশে হাত বুলাতে লাগল।
আমি গ্রামের বাইরে ছিলাম, সে উত্তর দিল। তার চোখে দুষ্টমিভরা চাহনি খেলে গেল। আমি কাউকে খুন করতে যাইনি। আমি নিজেই খুন হয়েছি।
ইকবাল তার ঐ বক্তব্যের সাথে পরিচিত। ফলে তিনি ঐ বিষয়ে বিস্তারিত বলার জন্য জুগ্গাকে উৎসাহিত করলেন না। কিন্তু আলোচনা যখন একবার শুরু হয়েছে তখন জুগ্গাকে আর ফেরানো সম্ভব বলে মনে হলো না। আরও আগ্রহভরে জুগ্গা তাঁর পা টিপতে শুরু করল।
আপনি তো অনেক বছর বিলেতে কাটিয়েছেন, জুগ্ন আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করল।
হ্যাঁ, অনেক বছর, ইকবাল বললেন। যা ঘটতে যাচ্ছে এমন একটা অবশ্যম্ভাবী। বক্তব্য এড়াতে তিনি বৃথাই চেষ্টা করলেন।
তাহলে বাবুজি, জুগ্গা আরও আস্তে জিজ্ঞাসা করল, আপনি অনেক মেম সাহেবের সাথে রাত কাটিয়েছেন। তাই না?
ইকবাল অস্বস্তি বোধ করলেন। যৌন বিষয়ক আলোচনা থেকে ভারতীয়দের বেশি সময় সরিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এটা তাদের মনের সাথে পুরোপুরি মিশে আছে। এটা তাদের কলা, সাহিত্য ও ধর্মে প্রকাশমান। সাইনবোর্ডগুলোতে কামোদ্দীপক বস্তু ও হস্তমৈথুনজনিত কুফল থেকে রক্ষার উপায় সম্বলিত বিজ্ঞাপন দৃশ্যমান। আদালত ও বাজার এলাকায় দেখা যায় হকাররা বিক্রি করছে নির্জীব পুরুষাঙ্গকে সতেজ, মোটা ও লম্বা করার জন্য গিরগিটির চামড়া থেকে নিঃসৃত তেল। নিঃসন্তান মহিলাকে সন্তান ধারণের এবং ছেলে হওয়ার জন্য ওষুধের আবিষ্কারক হাতুড়ে চিকিৎসকের দাবি সম্বলিত বিজ্ঞাপনও দেখা যায়। প্রায় সব সময়ই মানুষ এসব শোনে। যৌনাচার বিকৃতি ভারতীয়দের কাছে যতটা স্বাভাবিক অন্যদের কাছে ততটা নয়। শালা (স্ত্রীর ভাই) [আমি তোমার বোনের সাথে ঘুমাতে চাই] এবং শ্বশুর (আমি তোমার মেয়ের সাথে ঘুমাতে চাই) কথাগুলো আত্মীয়-বন্ধুদের সাথে বলা হলে যেমন আদরের হয়, তেমনি শক্রদের উদ্দেশ করে বলা হলে তা হয় রাগের প্রকাশ। রাজনীতি, দর্শন খেলাধুলা নিয়ে যতই আলোচনা হোক না কেন, ঐ আলোচনা যৌন আলোচনায় এসে থামবে। চাপা হাসি ও হাততালির মাধ্যমে সবাই উপভোগ করে শেষোক্ত এই আলোচনা।
হ্যাঁ কাটিয়েছি, সাধারণভাবে ইকবাল বললেন, বহু মেম সাহেবের সাথে।
বাঃ বাঃ, জুগ্গা যেন চিৎকার করে উঠল। ইকবালের পা টেপায় তার উৎসাহ ও উদ্দীপনা বেড়ে গেল। বাঃ বাবুজি, বাঃ।। আপনি নিশ্চয়ই দারুণ আনন্দ উপভোগ করেছেন। মেম সাহেবরা হলো বেহেশতের হুরির মতো। সাদা, নরম, একদম সিল্কের মতো। আমাদের এখানে যারা আছে তারা হলো কালো মোষ।
মহিলা মহিলাই, এদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সত্যি কথা বলতে কি, সাদা চামড়ার মহিলাদের উত্তেজনা কম। তুমি কি বিয়ে করেছ?
না বাবুজি। একটা বদমায়েশের কাছে কে তার মেয়েকে দেবে? যেখানে পাই সেখানেই আমি যৌন ক্ষুধা মেটাই।
সব সময় পাও নাকি?
মাঝে মাঝে …। মামলার শুনানির দিন পিরোজপুর গিয়ে যদি উকিল ও তার কেরানিদের কাছ থেকে টাকা বাঁচাতে পারি। তাহলে আমার সময় কাটে খুব আনন্দে। সারা রাতের মতো আমি আগে ভাগেই ওদের সাথে কথা বলে নেই। অন্য লোকের মতো। ওরা আমাকেও সমান চোখে দেখে। ওদের ধারণা, দুবার বা সবচেয়ে বেশি হলে তিনবার। জুগ্গা তার মোচে তা দিয়ে বলল, কিন্তু জুগ্গাত্ সিং যখন ওদের কাছে যায় ওরা হায় হায় করে চিৎকার করে, নিজের কান ধরে বলে, তৌবা তৌবা। ভগবানের নামে দোহাই দিয়ে ওদের ছেড়ে আসার কথা বলে এবং টাকাও ফেরত দিয়ে দেয়।
ইকবাল জানে এটা মিথ্যা কথা। প্রায় সব যুবক ঐ ধরনের কথা বলে।
বিয়ে করলে তুমি তোমার বউকে তোমার প্রতিযোগী হিসাবে পাবে, ইকবাল বললেন, সে সময় তুমি তোমার কান ধরে তৌবা তৌবা বলবে।
বিয়েতে কোন মজা নেই বাবুজি। মজা করার সময় বা জায়গা কোথায়? গরমের দিনে সবাই বাইরে খোলা জায়গায় ঘুমায়। চুপি চুপি সামান্য সময়ের জন্য বউয়ের কাছে যাওয়া যায়। কেউ দেখে ফেলে এই আশঙ্কা সব সময় থাকে। শীতকালে পুরুষ ও মহিলারা আলাদাভাবে ঘুমায়। রাতে স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই একই সময় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার ভান করে বাইরে এসে মিলতে হয়।
বিয়ে না করেও তুমি এ সম্পর্কে অনেক কিছু জানো দেখছি।
জুগ্গা হাসল। আমি আমার চোখ বন্ধ করে থাকি না। তাছাড়া বিয়ে না করলেও আমাকে একজন বিবাহিত লোকের মতোই কাজ করতে হয়।
তুমিও আয়োজন করে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দাও?
জুগ্গা বেশ জোরে হাসল। হ্যাঁ বাবুজি। এ কাজ আমি করি। ঐ কারণেই আজ আমি হাজতে। কিন্তু আমি মনে মনে বলি; ঐ রাতে যদি আমি বাইরে না যেতাম, তাহলে আপনার সাথে সাক্ষাতের সুযোগ আমার হতো না বাবুজি। আপনার কাছ থেকে আমার ইংরেজী শেখার সুযোগও হতো না। গুড মর্নিং-এর মতো কিছু গিট-মিট আমাকে শিখিয়ে দিন। দেবেন না বাবুজি?
ইংরেজী শিখে তুমি কি করবে? ইকবাল জিজ্ঞাসা করলেন। সাহেবরা দেশ থেকে চলে গেছে। তোমার উচিত মাতৃভাষা শেখা।
এই উপদেশে জুগ্গা খুশি হলো না। তার কাছে শিক্ষা মানে ইংরেজী শেখা। যেসব কেরানী ও পত্ৰলেখক উর্দু বা শুরুমুখী ভাষায় লেখে তারা লেখাপড়া জানে, কিন্তু শিক্ষিত নয়।
ওটা আমি যে কোন লোকের কাছ থেকে শিখতে পারব। ভাই মিত সিং আমাকে গুরুমুখী শিখিয়ে দেবেন বলে কথা দিয়েছেন। কিন্তু আমি এখনও ওটা শুরু করিনি। বাবুজি, আপনি কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছেন? আপনি নিশ্চয়ই দশ ক্লাস পাস করেছেন?
হ্যাঁ, দশ ক্লাস আমি পাস করেছি। আমি আসলে পাস করেছি। ষোল ক্লাস।
ষোল! বাহ বাহ। ষোল ক্লাস পাস করা কোন লোকের দেখা আমি পাইনি। আমাদের গ্রামে শুধু রামলালই পাস করেছিলেন চার ক্লাস। এখন সে মৃত। এখন একমাত্র মিত সিং-ই কেবল পড়তে পারে। প্রতিবেশী কয়েকটি গ্রামে কোন ভাই নেই। আমাদের ইন্সপেক্টর সাহেব সাত আর ডেপুটি সাহেব দশ ক্লাস পর্যন্ত পড়েছেন। ষোল! বাপরে। আপনার নিশ্চয়ই খুব বুদ্ধি।
অতি প্ৰশংসায় ইকবাল অস্বস্তিবোধ করলেন।
তুমি কিছু লিখতে বা পড়তে পার, তিনি জিজ্ঞাসা করলেন।
আমি? না, আমার চাচার ছেলে স্কুলে সামান্য যা কিছু শিখেছিল, সে আমাকে তাই শেখায়। ওটা ছিল আধা ইংরেজী, আধা হিন্দুস্থানী:
পিজন মানে – কবুতর
ফ্লাই মানে – উড়ান
লুক মানে – দেখো
স্কাই মানে – আসমান।
আপনি এসব জানেন?
না। সে তোমাকে কোন অক্ষর শেখায় নি?
এবিসি? সে নিজেই এটা জানত না। আমি যা জানি, সে তাই-ই জানত:
এ বি সি তুমি কোথায়?
এডওয়ার্ড মারা গেছে,
আমি দুঃখ করতে চাই।
আপনি নিশ্চয়ই এটা জানেন?
না, আমি এটাও জানিনে।
ভাল কথা, আপনি আমাকে ইংরেজীতে কিছু বলুন।
ইকবাল খুশি হলেন। গুড মর্নিং, গুড নাইট কিভাবে বলতে হয় ইকবাল তাকে শিখালেন। মানুষের জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় কয়েকটি মূল কাজের ইংরেজী জুগ্গা জানতে চাইলে ইকবাল ধৈর্যহীন হয়ে পড়লেন। ঠিক ঐ সময় নতুন গ্রেফতারকৃত পাঁচজন লোককে পাশের সেলে আনা হলো। এ দৃশ্য দেখে জুগ্গার হাস্যোজুল মুখটা আকস্মিকভাবে অন্তৰ্হিত হলো।