১১. অপমানের তিক্ততা
তুষারপাতের প্রথম ঝাপটা সমরকন্দের ডিম্বাকৃতি গম্বুজ, সুদৃশ্য মিনার আর চিনামাটির টালিশোভিত তোরণের জটিল অবয়ব কেউ রূপার তবক দিয়ে ঢেকে দিয়েছে বলে মনে হতে থাকে। ফলের বাগানের পুত্রহীন ডালপালার ভিতর দিয়ে শনশন শব্দে বয়ে চলা শীতল বাতাস আর হুড়মুড় করে ভেঙে পড়া তুষারের স্তূপ। বাবরের কাছে শহরটাকে ঘোমটার আড়ালে নববধূর মত মনে হয়- যার সৌন্দর্য চোখের আড়াল হলেও পুরোপুরি ঢাকা পড়েনি।
তার প্রিয় বাদামী রঙের আজদাহাটা ফেস-ফোঁস করে নিঃশ্বাসের সাথে কুয়াশার মেঘ নির্গত করে এবং বুকের কাছে পা তুলে নরম তুষারের ভিতর থেকে খুর বের আনে। মাথায় নেকড়ের চামড়ার নরম টুপি। চামড়ার পরত দেয়া আলখাল্লা গায়ে শক্ত করে আটকে আর পায়ে মেষের চামড়ার বুট পরিহিত অবস্থায় বাবর শহর রক্ষাকারী দেয়ালের বাইরের দিকের অবস্থা পর্যবেক্ষণ শেষে ফিরে আসছে। দেহরক্ষী বাহিনী খুব কাছ থেকে তাকে অনুসরণ করছে। গত দুসপ্তাহ ধরে ওয়াজির খান জ্বরে ভুগছে। এই প্রথম সে তার সাথে নেই, অবশ্য বাবুরী সাথে রয়েছে। শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে একটা উজ্জ্বল সবুজ কাপড়ের ফালি দিয়ে তার মুখটা ঢাকা।
গলবস্ত্র দিয়ে মাথা ঢাকা থাকা সত্ত্বেও বাতাসের প্রবাহের মাঝে তারা পরস্পরের কথা শুনতে পারবে। কিন্তু ঠাণ্ডার কারণে তাদের কথাই বলতে ইচ্ছা করে না। বাবরের অবশ হয়ে থাকা ঠোঁটের কারণে একটা শব্দও উচ্চারণ করতে হলে তাকে যথেষ্ট কসরত করতে হবে। কিন্তু সবুজাভ-নীল তোরণদ্বারের ছাদের নিচে ঝুলে থাকা সুতীক্ষ বরফের শলাকার দিকে এগিয়ে যেতে, শীতের কথা সে বেমালুম ভুলে যায়। সাফল্যের উল্লাস, কড়া মাদকের উষ্ণ ধারার ন্যায় তার ভেতরটা চাঙ্গা করে তুলে।
তোরণদ্বারের নিচে দিয়ে বাবর তার লোকদের নিয়ে দুলকিচালে ভেতরে প্রবেশ করে পশ্চিম দিকে অবস্থিত নগরদূর্গের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে একটাই দুশ্চিন্তা তাকে ত করে। সমরকন্দ দখল করার পরে যে তিন মাস অতিক্রম করেছে। সেই পুরোটা সময় যা তাকে অনবরত খুঁচিয়ে আসছে। বর্তমানে শীতের কড়াল থাবা আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার বরাভয় দিচ্ছে কিন্তু বরফ গলতে শুরু করণে কি হবে? সাইবানি খান যদিও সাথে সাথে শহর অবরোধ না করে, উত্তরে নিজের দূর্গে ফিরে গিয়ে শীতকাল শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন বলে ঠিক করেছেন। আর বাবর খুব ভালো করেই জানে নিজের সীমিত সম্পদ দিয়ে সাইবানি খানের কাছ থেকে সমরকন্দ হয়তো দখল করা যায়, কিন্তু সেটা রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। শহর দখল করার প্রায় সাথে সাথে বাবর তার লোকদের এর নিরাপত্তা জোরদার করতে নিয়োগ করে। অতিরিক্ত পর্যবেক্ষণ গম্বুজ নির্মাণ করতে বলে এবং শহর রক্ষাকারী দেয়ালের উচ্চতা কয়েক স্থানে বৃদ্ধি করার আদেশ দেয়। তুষারপাতের কারণে কাজ বন্ধ হবার আগে পর্যন্ত তার লোকেরা সাধ্যমত কাজ করেছে।
কোক সরাইয়ের আঙ্গিনায় ঘোড়া নিয়ে প্রবেশ করে বাবর ভাবে, নানীজান, আম্মিজান আর খানজাদার বিলাসবহুল মহলে তাদের সাথে দেখা করতে যাবে কিনা। যেখানে বিজয় অর্জনের অব্যবহিত পরে সমরকন্দে আসা অব্দি তারা অবস্থান করছেন। সে ওয়াজির খানকে দেখতে যাবে বলে ঠিক করে। তার শারীরিক অবস্থার নিশ্চয়ই এতক্ষণে উন্নতি হয়েছে… ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে গা গরম করার অভিপ্রায়ে দুহাতে নিজের শরীরের দু’পাশে চাপড় দিতে দিতে পাথরের তৈরি নিচু কামরার দিকে এগিয়ে যায়, যেখানে ওয়াজির খান অবস্থান করছে। বাবরের তাকে। এখন বড় প্রয়োজন, আর সে তার আরোগ্য কামনায় অস্থির হয়ে উঠেছে।
পায়ের জুতো থেকে বরফ ঝাড়তে ঝাড়তে এবং মাথা থেকে নেকড়ের চামড়ার তৈরি টুপি খুলে- নেকড়ের লম্বা লোম বরফে শলাকার ন্যায় আকৃতি নিয়েছে সে। ভেতরে প্রবেশ করে। ওয়াজির খানের কক্ষের নিচু দরোজার নীচ দিয়ে ঝুঁকে প্রবেশ করে সে তার বৃদ্ধ বান্ধবকে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে। একটা হাত মুখের উপরে রাখা, যেনো ঘুমিয়ে রয়েছে। কাছে আসতে সে আঁতকে উঠে দেখে হাকিমের পরামর্শে ছাগলের চামড়ার তৈরি কম্বলের কয়েক পরত দিয়ে ঢেকে দিয়ে বিছানার পাশে একটা ঝুড়িতে জ্বলন্ত কয়লা রাখার পরেও ওয়াজির খান থরথর করে কাঁপছে। গতকালও তার কাঁপুনি এতো প্রবল ছিলো না।
“সে কেমন আছে?”
আগুনের কাছে দাঁড়ানো হাকিম তামার পাত্রে তৈরি একটা মিশ্রণ নাড়ছে। “সুলতান, তার অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। তার জ্বর প্রশমিত করতে আমি দ্রাক্ষারস, লতাগুল্ম আর দারুচিনি দিয়ে তৈরি একটা এলিক্সির আগুনে উত্তপ্ত করছি।” লোকটার কণ্ঠস্বর বিষণ্ণ এবং মুখের অভিব্যক্তিতে চিন্তার ছাপ- গতকালের সাক্ষাতের ভক্তিপূর্ণ আন্তরিকতা থেকে একেবারেই আলাদা।
ওয়াজির খান মারা যেতে পারে প্রথমবারের মতো এই সম্ভাবনার কথা তার মাঝে। উদয় হতে পেটের ভেতরে অস্বস্তির একটা গিঁট দানা বাঁধে। “তাকে আপনার বাঁচাতেই হবে।”
“সুলতান, আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করবো। কিন্তু প্রাণ দেয়া বা নেয়ার অধিকার কেবল সৃষ্টিকর্তার এক্তিয়ারে। আমি কেবল এটুকুই বলতে পারি শীঘ্রই যদি তার অবস্থার উন্নতি না হয়, তবে সে আমার সামর্থের বাইরে চলে যাবে…” হাকিম ঘুরে দাঁড়িয়ে পাত্রের মিশ্রণ আরো জোরে নাড়তে আরম্ভ করে।
বাবর ওয়াজির খানের কাছে যায় এবং আলতোভাবে তার হাত মুখের উপর থেকে সরিয়ে দেয় যা ঘামে ভিজে চপচপ করছে। ওয়াজির খান নড়ে উঠে এবং এক মুহূর্তের জন্য তার একটা চোখ খুলে তাকায়। “সুলতান…” তার চিরাচরিত মন্দ্র কণ্ঠস্বর এখন ক্ষীণ কষ্টসাধ্য কর্কশ আর্তনাদ।
“কথা বলার দরকার নেই। নিজেকে অনুগ্রহ করে কাহিল করবেন না।” বাবর সতর্কতার সাথে ওয়াজির খানের কাধ চেপে ধরে। তার কাঁপুনি থামাতে চেষ্টা করে। অসুস্থ বন্ধুর শরীরে নিজের শক্তির কিছুটা প্রবাহিত করতে চায়। ওয়াজির খানের পরণের মোটা আলখাল্লা ভেদ করে সে তার দেহের অস্বাভাবিক উষ্ণতা অনুভব করতে পারে।
একটা মাটির পেয়ালা নিয়ে হাকিম এগিয়ে আসে।
“আমাকে দিন।” বাবর পেয়ালাটা তার হাত থেকে নেয় এবং এক হাতে ওয়াজির খানের মাথাটা তুলে ধরে অন্য হাতে পেয়ালাটা তার ঠোঁটের কাছে ধরে। ওয়াজির খানের চেষ্টা সত্ত্বেও পেয়ালার বেশিরভাগ উষ্ণ লাল তরল তার চিবুকের খোঁচা খোঁচা। দাড়ি বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। নিজের অনাড়িপনাকে সে অভিসম্পাত করে। বাবর আবার চেষ্টা করে, তার মনে পড়ে কিভাবে একটা স্যাঁতসেতে গুহার অভ্যন্তরে জ্বরের সময়ে ওয়াজির খান একবার তার শুশ্রূষা করেছিলো। কাপড়ের ফালি পানিতে ভিজিয়ে ভক্তিভরে আর ধৈর্যসহকারে তার শুষ্ক মুখ পানির ফোঁটায় সিক্ত করে তুলেছিলো। সে ওয়াজির খানের মাথাটা আরেকটু উঁচু করে এবার কাজ হয়। হাকিমের তৈরি করা আরকের কিছুটা গলধঃকরণ করতে পারে ওয়াজির খান, তারপরে আরেকটু। পুরোটা শেষ হতে বাবর ওয়াজির খানের মাথা বালিশে নামিয়ে রাখে।
“সুলতান, তার অবস্থার উন্নতি হতেই আমি আপনাকে জানাবো।”
“আমি এখানেই থাকছি।” ওয়াজির খানের কোনো নিকটাত্মীয় নেই যে তার যত্ন নেবে। তার স্ত্রী আর একমাত্র পুত্রসন্তান বহুবছর আগে গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে এবং প্রায় দশ বছর আগে সন্তান জন্মদান করার সময়ে তার একমাত্র কন্যা মারা গিয়েছে। বাবর কয়েকটা জরির কারুকাজ করা তাকিয়া নিয়ে ওয়াজির খানের বিছানার পাশের দেয়ালে সেগুলো স্তূপ করে সেখানে আধশোয়া হয়। পৃথিবীর বুকে যদি ওয়াজির খানের অবস্থানের সময় শেষ হয়ে আসে, তবে অন্তিম মুহূর্তে সে তার পাশে থাকতে চায়।
রাত ক্রমশ গম্ভীর হয়। বাবর চুপচাপ তাকিয়ে থাকে এবং হাকিম ওয়াজির খানের চারপাশে পায়চারি করার ফাঁকে নাড়ি পরীক্ষা করতে, চোখের পাতা খুলে চোখের মণিতে উঁকি দিতে বা বুকে হাত রেখে জ্বরের মাত্রা পরিমাপ করতে বিছানার পাশে আসলে সে তাকে সাহায্য করে। যন্ত্রণায় ঝটফট আর কাঁপতে থাকলেও মাঝে মাঝে ওয়াজির খান কিছুটা শান্তভাবে শুয়ে থাকে। আবার কখনও প্রলাপ বকে। তার বেশিরভাগ কথাই বোঝা যায় না কিন্তু বিড়বিড় করে বলতে থাকা দুর্বোধ্য শব্দের ভিতরে বাবরের কানে কিছু আটকায়..
“কবুতর…কবুতর যাদের পালকে চুনির মতো লাল রক্ত লেগে রয়েছে…সুলতান দেখেন কিভাবে সেগুলো আছড়ে পড়ছে…”
আকশি দূর্গের ছাদ থেকে বাবরের আব্বাজান আর তার প্রিয় চবুতরা যেদিন বিস্মরণের অতলে ধ্বসে পড়েছিলো ওয়াজির খান বোধহয় সেদিনের কথা বলতে চাইছে। আজ এতদিন পরেও বাবর সেদিন গিরিখাতের কিনার, যার অতলে তার আব্বাজানের দেহ অষ্টবক্র হয়ে পড়ে ছিলো, থেকে তাকে সরিয়ে আনা ওয়াজির খানের হাতের শক্ত পাঞ্জার স্পর্শ আজও অনুভব করতে পারে… ওয়াজির খানের কাছে তার কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। তার আব্বাজানের অকাল মৃত্যুর পর থেকে লোকটা তাকে পিতার মতোই আগলে রেখেছে, কিন্তু তাকে বাঁচাবার জন্য সে কিছুই করতে পারছে না।
ওয়াজির খান আবার একটু শান্ত হতে বাবরের চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসে। ওয়াজির খানের ভালোমন্দ কিছু একটা হয়ে গেলে তার কি হবে?
***
“সুলতান…সুলতান… উঠুন!”
বাবর চমকে উঠে বসে। পুরো ঘরটা প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন। কেবল হাকিমের ডান হাতে উঁচু করে ধরা একটা তেলের প্রদীপের দপদপ করতে থাকা শিখা যতটুকু আলোকিত করতে পারে।
চোখ পিটপিট করে বাবর কোনোমতে উঠে দাঁড়ায়। বিছানার দিকে তার তাকাতে সাহস হয় না। কারণ জানেই তাকালে সে কি দেখতে পাবে। সে তার বদলে হাকিমের চোখের দিকে তাকায়। “কি হয়েছে?”
“সুলতান, আল্লাহতালা আমাদের প্রতি সদয় হয়েছেন। চিকিৎসক বিছানার কাছে এগিয়ে যায় এবং ওয়াজির খানের মুখ তার হাতের প্রদীপের ক্ষুদ্র আভায় আলোকিত হয়ে উঠে।
তাকিয়ায় ভর দিয়ে সে আধশোয়া হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। কাঁপুনি একেবারেই থেমে গেছে। টিকে থাকা এক চোখের দৃষ্টি উজ্জ্বল আর পরিষ্কার এবং ক্লান্ত মুখে বুঝি একটু হাসির আভাসও দেখা যায়। জ্বর ছেড়ে গেছে। বাবরের এক মুহূর্ত দেরি হয় চোখের সামনের দৃশ্যটার মর্ম অনুধাবন করতে। তারপরেই সে স্বস্তি আর শ্রদ্ধার বাণভাসি জোয়ারে আপ্লুত হয়ে বিছানার কাছে দৌড়ে গিয়ে ওয়াজির খানকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে।
“সুলতান, শান্ত হোন। আমার রোগী এখনও দুর্বল…” হাকিম প্রতিবাদের সুরে চেঁচিয়ে উঠে। তার কথা বাবর শুনতেই পায় না, সে কেবল প্রবল কতজ্ঞতায় ভারাক্রান্ত। ওয়াজির খানের জীবনের উপর থেকে বিপদ কেটে গিয়েছে…
তাকে বিশ্রাম করতে দিয়ে বাবর কক্ষ থেকে বাইরে আসে। শীতল বাতাস সুইয়ের মতো খোলা মুখে হামলে পড়ে কিন্তু সে পাত্তাই দেয় না। অসুস্থতা আর দুশ্চিন্তার মেঘ কেটে যেতে, সে নিজের ভেতরে আপন তারুণ্য আর শক্তির একটা জোয়ার অনুভব করে। আর সেই সাথে তরুণ এবং বেপরোয়া সঙ্গের জন্য সে উদগ্রীব হয়ে উঠে। পূর্ব দিগন্তে সকাল যদিও কেবল দিন শুরুর সব আয়োজন মাত্র আরম্ভ করেছে, সে তখনই বাবুরীকে ডেকে পাঠায়।
কয়েক মিনিট পরে, সদ্য ঘুমভাঙা চোখে ভেড়ার চামড়ার জারকিন বাঁধতে বাঁধতে সে এসে হাজির হয়। এত ভোরে ডেকে পাঠানোর কারণে স্পষ্টতই বিভ্রান্ত বাবর তার মুখ থেকে উষ্ণ নিঃশ্বাসের সাদা কুণ্ডলী নির্গত হতে দেখে। “এসো, অনেক ঘুমিয়েছো…আমরা একটু বাইরে যাচ্ছি।” বাবর তাকে ডেকে বলে।
“কি?…”
“আমার কথা তুমি ঠিকই শুনেছে- এবার চলো অলস কোথাকার…”
দশ মিনিট পরে, সবুজাভ-নীল তোরণদ্বারের নীচ দিয়ে তাদের ঘোড়া ছুটিয়ে বের হতে দেখা যায়। সূর্যের আলোয় রাতের তুষার গলতে শুরু করায় তাদের ঘোড়ার খুরের কারণে গুটি বসন্তের মত দাগ পড়ে মাটির বুকে। যা কিছুই হোক, বেঁচে থাকা আর তারুণ্যের চেয়ে মঙ্গলময় আর কিছুই হতে পারে না।
***
প্রথমে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না। বছরের এই সময়ে, ধুসর প্রায় নিপ্রভ আলো মানুষের চোখকে অনায়াসে প্রতারিত করতে পারে। কোলবা পাহাড়ের দিকে বাবর চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। তাকিয়ে থাকার মাঝেই সে ভাবে সে আরো লোক দেখতে পেয়েছে- হ্যাঁ: সে ঠিকই দেখেছে- দূরের কালো অবয়বগুলো ঘোড়সওয়ারের।
ওয়াজির খানও স্থির চোখে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
“উজবেক…?”
“আমারও তাই মনে হয়, সুলতান। সম্ভবত অগ্রগামী গুপ্তদূতের দল।”
বাবর ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নেয়। গত তিন সপ্তাহ ধরে সমরকন্দে গুজব- প্রথম প্রথম অস্পষ্ট, ভিত্তিহীন তারপরে অনেক বিশদ বর্ণনা- ছড়াতে শুরু করেছে। সবাই দেখা যায় দুটো বিষয়ে একমত যে, সাইবানি খান সমরকন্দের পশ্চিমে বোখারায় অবস্থান করে ভাড়াটে বাহিনী গড়ে তুলছে আর শীতকালটা নিজের লোকদের সাথে একত্রে অতিবাহিত করা সব উজবেক যোদ্ধাকে মোটা পুরষ্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছেন।
বাবরের আদেশে সমরকন্দের অস্ত্র নির্মাতারা, পুরো শীতকালটা যারা কঠোর পরিশ্রম করেছে, এখন তাদের প্রয়াস বৃদ্ধি করে দিন-রাত নাগাড়ে কাজ করছে। বাতাসে এখন কেবল ধাতুর সাথে ধাতুর আঘাত করার শব্দ ভাসছে। তারা চুল্লীতে তীক্ষ্ণ প্রান্ত বিশিষ্ট ফলা আর বর্শার আকৃতি তৈরি করে সেটা নেহাইয়ে রেখে সেটাতে পান দিচ্ছে। অস্ত্রের কোনো কমতি তার নেই এবং সাধ্যমত চেষ্টা করেছে শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে। কিন্তু মানুষ কোথায় পাবে?
সে ভ্রূকুটি করে। শেষবার গণনা করার সময়ে সংখ্যাটা ছিল সাত হাজার। যার ভিতরে মাঙ্গলিঘ তীরন্দাজ বাহিনীও রয়েছে যারা পুরোটা শীতকাল শহরেই অতিবাহিত করেছে। উজবেকরা আক্রমণের পাঁয়তারা করছে জানার পরেই সে এই অঞ্চলের অন্য সর্দারদের কাছে দূত পাঠিয়েছে- এমন কি তামবাল আর জাহাঙ্গীরের কাছেও সে লোক পাঠিয়েছে। সমরকন্দের পতনের পরে তাদের সেনাবাহিনী আকশি ফিরে গিয়েছে- সম্মিলিতভাবে সাধারণ শত্রুকে প্রতিহত করার আবেদন জানিয়ে। এখন পর্যন্ত কারো কাছ থেকে কোনো উত্তর আসেনি।
“ওয়াজির খান, আমি উজবেকদের ফিরে আসতে দেখে মোটেই অবাক হচ্ছি না। আমি জানতাম তাদের ফিরে আসাটা কেবল সময়ের ব্যাপার। আপনি যখন অসুস্থ ছিলেন তখন বাবুরী আর আমি প্রায়ই বিষয়টা নিয়ে আলাপ করতাম…”
“আর সেই বাজারের ছোকরা কি বলতো?”
ওয়াজির খানের কণ্ঠের অপ্রত্যাশিত রুক্ষতায় বাবর অবাক হয়। “হতে পারে সে বাজারের ছেলে, কিন্তু তারপরেও তার কথায় যুক্তি আছে…এবং সে সমরকন্দ আর এর লোকদের ভালো করেই চেনে…”।
“সুলতান, তার ভুলে গেলে চলবে না সে কে, এবং আপনার ক্ষেত্রেও সেটা প্রযোজ্য…আপনি হলেন আমাদের সরতাজ…তার মতো একজন ভুইফোড়ের সাথে আপনি পরামর্শ করছেন বয়োজ্যেষ্ঠ, বিজ্ঞ আর অভিজাত-বংশীয় কাউকে। বিবেচনায় না এনে সেটা ভালো দেখায় না…আল্লাহতালা যদি আপনার পিতার হায়াত দরাজ করতেন তাহলে এসব কথা তিনিই আপনাকে বলতেন…”
বাবর পারলে ওয়াজির খানকে দৃষ্টি দিয়ে ভস্ম করে দেয়। সম্ভবত এসব তার জানের শত্রু সেই বুড়ির কাজ বাবুরীর প্রতি এসান দৌলত তার বিতৃষ্ণা বা বাবুরীর সাথে তার মেলামেশার ব্যাপারে নিজের আপত্তির কথা কখনও গোপন করার চেষ্টা করেননি। বাবরের তারপরেই মনে পড়ে ওয়াজির খানের কাছে সে নানাভাবে ঋণী আর সম্প্রতি বুড়ো লোকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। “তৈমূরের রক্তের উত্তরাধিকারী আর একজন সুলতান এই দুটো বিষয় আমি কখনও ভুলবো না। বাবুরীর সঙ্গ আমার ভালো লাগে…কিন্তু তার পরামর্শ আমি গ্রহণ করি কারণ সেগুলো যুক্তিসঙ্গত। আপনার মতোই আমি যা শুনতে চাই বলে সে বিশ্বাস করে সেরকম মন রাখা কথা বলে না…বরং সে নিজে যা বিশ্বাস করে সেটাই কেবল বলে। তার মানে এই না যে সবসময়ে আমি তার সাথে একমত হই… আমি নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেই…”।
“আপনার বয়োজ্যেষ্ঠ মন্ত্রণাদাতা হিসাবে আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। হতে পারে বাবুরী বিচক্ষণ, কিন্তু একই সাথে সে বদরাগী আর একটা হামবড়া ভাব তার মধ্যে রয়েছে। আপনি যদি তার সাথে আপনার বন্ধুত্বের ব্যাপারে এখনই সতর্ক না হন, অন্যরা তাহলে নিজেদের অবহেলিত মনে করে ঈর্ষান্বিত আর ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতে পারে…আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই মাঝে মাঝে আমিও এর উর্ধ্বে উঠতে পারি না…”
ওয়াজির খানের চোখমুখের বিব্রতভাব লক্ষ্য করে বাবর আলতো করে তার কাঁধ স্পর্শ করে। “আপনি আমার সবচেয়ে বড় সহায় এবং অন্যসব ইচকিসের চেয়ে আমি আপনার পরামর্শ বেশি গুরুত্ব দেই। আমি সতর্ক থাকবো…এখন এসব নিয়ে আর শুধু শুধু বিব্রত হবেন না, মন্ত্রণা সভা আহ্বান করেন। তাদের জানা উচিত আমরা পাহাড়ের উপরে কি দেখেছি…”
পায়ের ব্যাথ্যা সত্ত্বেও ওয়াজির খান দ্রুত হেঁটে যায়। বাবর পুনরায় কোলবা পাহাড়ের দিকে তাকায়। কিন্তু কালো অবয়বগুলোকে আর দেখা যায় না। বাবুরীর ব্যাপারে তাকে সতর্ক করে ওয়াজির খানের বলা কথাগুলো কি যথার্থ, নাকি পুরোটাই কেবল তার যে নিজের বয়সী সঙ্গীর প্রয়োজন রয়েছে সেটা বুঝতে ওয়াজির খানের অপারগতা? ঘটনাপ্রবাহ ইতিমধ্যে তাকে দেখিয়েছে যে বাজারের ছেলের মতোই একজন সুলতানের জীবনও যথেষ্ট দৈবাধীন। তৈমূরের মতো সেও যদি সমৃদ্ধি আর সাফল্য অর্জন করতে চায়, তাহলে সবার সম্ভাব্য সাহায্য তার প্রয়োজন হবে। বর্তমানে, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা গুরুত্বপূর্ণ এবং সে ব্যাপারে বাবুরীর চেয়ে দক্ষ আর কেউ না…
বাবর দ্রুত তার দরবার কক্ষে প্রবেশ করে। সেখানে সে একটা নিচু টেবিলে তার আদেশে মাদার অব পার্ল দিয়ে সমরকন্দ আর তার আশেপাশের এলাকার মানচিত্র খোদাই করা দেখতে পায়। আধ ঘণ্টা পরে তার মন্ত্রণাদাতাদের সবাইকে টেবিলের চারপাশে বসে থাকতে দেখা যায়।
শহররক্ষা দেয়ালের ভিতরে আক্রমণের অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় না। আমাদের বর্তমান লোকবল দিয়ে সাইবানি খানের হামলা প্রতিহত করা সহজ হবে না, বা দীর্ঘস্থায়ী কোনো অবরোধ আমরা সামলে উঠতে পারবো না। বসন্তের শুরুতে আমরা যদি তাকে গিয়ে আক্রমণ করি নিজের বাহিনী পুরোপুরি গুছিয়ে নেবার আগে, তাহলে আমাদের সফল হবার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা যদিও সংখ্যায় তখনও অনেক কম থাকবো। সে যখন একেবারেই আক্রমণের প্রত্যাশা করছে না তখন আমরা তাকে দ্রুত আর প্রবলভাবে আক্রমণ করতে পারি। সে যদি আমি যা ভেবেছি তাই করে, বোখারা থেকে সে সরাসরি আমাদের আক্রমণ করতে এগিয়ে আসে, তাহলে পূর্বদিক থেকে সমরকন্দের দিকে বহমান এই নদী বরাবর এগিয়ে আসলে সেটাই হবে তার দ্রুততম রাস্তা।” বাবর তার সোনার বাঁটযুক্ত খঞ্জরের ডগাটা দিয়ে প্রায় সোজা একটা পথ এঁকে দেখায়। “কিন্তু সমরকন্দে পৌঁছাবার আগে, তার অন্য বাহিনীর সাথে মিলিত হয়ে সর্বশক্তি নিয়ে আমাদের দিকে আসতে হলে তাকে কোথায় যাত্রাবিরতি করতে হবে…আর আমরা সেই সময়েই তাকে আক্রমণ করবো।”
তার মন্ত্রণাদাতারা সবাই বিড়বিড় করে সম্মতি প্রকাশ করে কেবল বাইসানগারকে উদ্বিগ্ন দেখায়।
“বাইসানগার, কি ব্যাপার…?”
“সাইবানি খানের মতিগতি বোঝা মুশকিল। আমরা তার বিষয়ে যা কিছু জানি তার ভিতরে এটা অন্যতম- সে জন্য আমাদের উপযুক্ত মূল্য দিতে হয়েছে। আমার মনে আছে কিভাবে বর্বরটা তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ভোজবাজির মতো পাহাড় থেকে নেমে এসে আপনার চাচাকে হত্যা করে, আমাদের বাহিনীকে কচুকাটা করেছিলো…”
“আর এজন্যই আমি বোখারায় গুপ্তচর পাঠাচ্ছি। আমি সাইবানি খানকে যেভাবে টোপ দিয়ে সমরকন্দের দেয়ালের ভেতর থেকে টেনে বের করেছিলাম- সেরকম কোনো ফাঁদে আমি নিজে পড়তে চাই না। কিন্তু আমি যখনই নিশ্চিত হবো সে আমাদের আক্রমণ করতে অগ্রসর হচ্ছে, আমি আমার সর্বশক্তি নিয়ে পশ্চিমে এগিয়ে গিয়ে তাকে চমকে দেবো। সে যদি নদীর তীর বরাবর এগিয়ে আসে, তাহলে আমি প্রস্তাব করছি আমরা এখানে তার জন্য ওঁত পেতে থাকবো।” মানচিত্রে সমরকন্দ থেকে ঘোড়ায় তিন দিনের দূরত্বে অবস্থিত একটা স্থানের উপরে বাবর তার খঞ্জরের ডগা রাখে। যেখানে সংকীর্ণ নিচু, পাথুরে পর্বতের মাঝ দিয়ে নদীটা প্রবাহিত হচ্ছে।
***
দশদিন পরে বাবরকে তার লোকদের একেবারে সামনে ঘোড়ায় চড়ে, মন্ত্রণা সভায় সে ঠিক যে জায়গাটার কথা বলেছিলো সেদিকে এগিয়ে যেতে দেখা যায়। এক সপ্তাহ আগে তার গুপ্তদূতের দল খবর নিয়ে আসে যে সাইবানি খান তার দলবল নিয়ে এগিয়ে আসছে। সাথে বিশাল অশ্বারোহী বাহিনী, নদীর দিকে সে এগিয়ে চলেছে। বাবর সমরকন্দে অপ্রত্যাশিত আক্রমণ প্রতিরোধের উপযুক্ত একটা বাহিনী রেখে, তার সেনাবাহিনীকে আদেশ দেয় অগ্রসর হতে। বাবর তার বাহিনী নিয়ে নদী থেকে দূরে অবস্থান করে এবং গুপ্তদূতের দল নদীর তীর ধরে উজবেকদের এগিয়ে আসার খবর তাকে নিয়মিত অবহিত করতে থাকে। সেদিন সকালে তারা খবর নিয়ে আসে যে উজবেক ইতিমধ্যে তাদের রাতের অস্থায়ী ছাউনি গুটিয়ে নিয়েছে এবং তারা যদি তাদের স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে আসা অব্যাহত রাখে তবে আজ দুপুর নাগাদ তারা সংকীর্ণ স্থানটার কাছে পৌঁছাবে।
বাবর, ওয়াজির খান, বাইসানগার আর আলী ঘোসত, তার অশ্বারোহী বাহিনীর তিন অধিকর্তাকে আদেশ দেয়। বাবর আর তার অগ্রগামী বাহিনী, বর্শার আকৃতিতে বিন্যস্ত হয়ে বল্পিত বেগে ঘোড়া ছোটায়। তারা পাশ থেকে এসে উজবেকদের যাত্রা পথের কেন্দ্রে আঘাত করবে এবং দ্বিখণ্ডিত করে বের হয়ে যাবার আগে যতোটা সম্ভব ক্ষতি সাধন আর বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করবে। তারপরে আবার বিপরীত দিক থেকে একই ভঙ্গিতে পুনরায় হামলা করবে। উজবেক বাহিনীর মাঝ দিয়ে তাকে তেড়েফুড়ে অতিক্রম করতে দেখামাত্র ওয়াজির খান তার মূল বাহিনী নিয়ে দ্রুত এগিয়ে এসো সৈন্যবাহিনীর সামনের অংশে আক্রমণ করবে। যখন বাইসানগার আরেকটা বাহিনী নিয়ে বৃত্তাকারে ঘুরে এসে পেছন থেকে উজবেকদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আলী ঘোসতের অধীনে আরেকটা বাহিনী থাকবে অতিরিক্ত হিসাবে।
বাবর এখন তার সামনে অনুচ্চ ভূমিরেখা দেখতে পায় যেখান থেকে নদীটা দেখা। যায়। তার বাদামী আজদাহা ভূমিরেখার উপরে উঠে আসে এবং তার অগ্রগামী রক্ষীদলের সদস্যরা পাশে এসে দাঁড়াতে উজবেক অশ্বারোহী বাহিনীর লম্বা সারি সে দেখতে পায়। তার অবস্থান সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ দলটা নদীর তীর ধরে ধূলোর একটা মেঘ উড়িয়ে এগিয়ে চলেছে। এই ক্ষণটার জন্যই সে এতো প্রস্তুতি নিয়েছে। ঢাল বেয়ে প্রায় বারোশ গজ দূরে, শত্রুর দিকে ধেয়ে যাবার জন্য সে তার বাহিনীকে আদেশ দেয়। সে তার বাহনকে যখন সামনে এগোবার জন্য ইঙ্গিত করেছে ঠিক তখনই বাবর প্রথমবারের মতো এক নিঃসঙ্গ উজবেক অশ্বারোহী, মূল সারি থেকে সামান্য দূরে, সম্ভবত অনাহুত অতিথির উপস্থিতি সম্পর্কে আগেই সতর্ক করার জন্য নিয়োজিত প্রহরীকে দেখতে পায়। লোকটাও তাকে একই সাথে দেখে এবং সাথে সাথে নিরাপত্তার জন্য মূল বাহিনীর উদ্দেশ্যে ঘোড়া ছোটাবার আগে শিঙ্গায় ফুঁ দিয়ে বিপদ সঙ্কেত ঘোষণা করে।
শিঙ্গার আওয়াজ শোনার সাথে সাথে, উজবেক বাহিনীর গতি মন্থর হয়ে আসে, এবং অশ্বারোহী যোদ্ধারা ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নেয় বিপদের মোকাবেলা করতে। কেউ কেউ ধনুক নামিয়ে তীরের একটা ঝাপটা বইয়ে দেবার মতো সময় পায় এবং উজবেকদের কাছাকাছি পৌঁছাবার আগেই বাবরের অগ্রগামী রক্ষীদলের কয়েকজন যোদ্ধা মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে। বাবরের নেতৃত্বে বাকি যোদ্ধারা প্রচণ্ড বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে শত্রুর সারিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং চারপাশে এলোপাথাড়ি ঘাই দিতে শুরু করে। উজবেক যোদ্ধাদের সারি পিছু হটতে শুরু করে। মনে হয় যেন। প্রত্যাশিতভাবেই ভাঙছে আর বাবরের মনে হয় বিজয় নিশ্চিত।
কিন্তু তারপরেই উজবেকরা তার সামনে বিক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে ছিটকে সরে যাবার বদলে তাকে তার বাহিনীসহ ঘিরে ফেলতে শুরু করে। বাবর তার তরুণ নিশান বাহককে ঘোড়া থেকে সামনে ছিটকে পড়তে দেখে। বেচারার মাথা উজবেকদের নিজস্ব ধাতব পাতযুক্ত কস্তনীর আঘাতে ছাতু হয়ে গেছে। বাবর তার ঘোড়ার মাথা প্রচণ্ড শক্তি ঘুরিয়ে নিয়ে তরুণ নিশানবাহকের দেহটা এড়িয়ে যায় এবং হাতের বর্শা দিয়ে তার হত্যাকারীকে গেঁথে ফেলে। কিন্তু আরও উজবেক যোদ্ধা মারমুখী ভঙ্গিতে তার দিকে এগিয়ে আসে। বর্শা ফেলে দিয়ে বাবর এবার আলমগীর কোষমুক্ত করে। উজবেক যোদ্ধাদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা আর চাপ তাকে তার দেহরক্ষীদের কাছ থেকে ক্রমশ দূরে সরিয়ে নিয়ে যায় এবং বুঝতে পারে সে আটকা পড়তে চলেছে। প্রাণে বাঁচতে হলে তাকে এই ব্যুহ ভেদ করে বের হতে হবে। আলগমীর ধরা ডান। হাত সোজা রেখে সে ঘোড়ার গলার উপরে ঝুঁকে আসে এবং তার চারপাশের উজবেক যোদ্ধাদের মাঝে যে সামান্য ফাঁক দেখতে পায় সেদিকে ঘোড়া ছোটায়।
মুহূর্ত পরে, ফাঁকা জায়গায় বেরিয়ে এসে সে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। কপালের উপরের এক কাটা স্থান থেকে রক্ত তার ডান চোখের উপরে গড়িয়ে পড়ে। এক উজবেক যোদ্ধা আরেকটু হলে বর্শা দিয়ে তার মাথা গেথে ফেলেছিল। বাবরের ক্ষিপ্রতা আর আঘাত পাশ কাটাবার দক্ষতা তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে এবং যদিও বর্শার। তীক্ষ্ণ মুখ সে এড়াতে পারেনি। কপাল থেকে রক্ত মুছে ফেলার অবসরে চোখে। ঝাপসা দৃষ্টি নিয়ে সে বুঝতে চেষ্টা করে কোনো দিকে গেলে মূল বাহিনীর সাথে মিলিত হতে পারবে।
কয়েক মিনিট পরে তার দৃষ্টি পরিষ্কার হয়ে আসতে শুরু করে। যদিও ক্ষতস্থান থেকে রক্ত পড়া তখনও বন্ধ হয়নি। বাবর দ্রুত ঘোড়ার পর্যানের কাপড় থেকে একটা ফালি কেটে নেয় খঞ্জর দিয়ে এবং মাথায় সেটা দিয়ে শক্ত করে পট্টি বেঁধে নেয়। চারপাশে তাকিয়ে সে বুঝতে পারে তাদের চমকে দেবার অভিপ্রায়ে করা হামলা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে এবং আতঙ্কিত আজদাহা তাকে কোণাকুণি উজবেক আর তার সঙ্গের অবশিষ্ট যোদ্ধাদের মাঝে একটা খালি প্রান্তরে উড়িয়ে নিয়ে এসেছে। সে আবার একটা সম্ভাব্য বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি নিজেকে আবিষ্কার করে। তার বাদামী ঘোড়ার পেটে গুতো মেরে সে দ্রুত বল্পিত বেগে নিজের বাহিনীর দিকে এগিয়ে যায়। প্রতিটা মুহূর্ত পেছন থেকে তীর বা বর্শা এসে বিদ্ধ হবার আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে থাকে। কিন্তু তার আশঙ্কা অমূলক প্রতিপন্ন হয়।
আলি ঘোসত তার ধুসর ঘোড়ায় উপবিষ্ট হয়ে আদেশ অনুযায়ী নিজের অধিনস্ত অতিরিক্ত সৈন্যদের নিয়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলো। বাবর সেখানে এসে যোগ দেবার পরে তার সেনাপতিদের সাথে নতুন কোনো পরিকল্পনা আলোচনার করার আর সুযোগ বা সময় কোনোটাই পায় না। বাবর তার পর্যদস্ত ঘোড়ার লাগাম টেনে থামার সময়েও পেছন থেকে ঢালের উপরে তরবারির আঘাতের আওয়াজ আর বুনো চিৎকার শুনতে পায়। আর কয়েক মুহূর্ত উজবেকরা তার বাহিনীর দফারফা করে ফেলবে। আমি এখানের নেতৃত্ব গ্রহণ করছি।” সে চেঁচিয়ে উঠে আলি ঘোসতকে বলে। “উজবেক যোদ্ধার সারি বরাবর ওয়াজির খান আর বাইসানগারের কাছে অশ্বারোহী বার্তাবাহক পাঠান। পূর্বের সব আদেশ তাদের ভুলে যেতে বলেন। উজবেকরা আমাদের তীরন্দাজদের আওতার ভিতরে আসা মাত্র তাদের উপরে নরক নামিয়ে আনতে আদেশ দেন। তারপরে, আমার নেতৃত্বে আমাদের পুরো বাহিনী আক্রমণে যাবে।”
তরবারি উঁচু করে ধরে বাবর ঘামে জবজব করতে থাকা ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নেয় উজবেকদের মুখোমুখি হবার জন্য। আদতে তাদের সামনে অগ্রগামী হবার বেগ হ্রাস পেয়েছে এবং এখন রেচিত বেগে তারা সামনে বাড়ছে। তাদের ঠিক কেন্দ্রে লম্বা দুটো বেগুনী ঝাণ্ডার মাঝে সে একজন অশ্বারোহীকে সনাক্ত করে, যে কেবল সাইবানি খানই হতে পারে। অনেক দূরে অবস্থান করায় বাবর তার চেহারা ভালো করে বুঝতে পারে না। কিন্তু তার স্পর্ধিত আচরণ তার স্থিরতার ভিতরে কিছু একটা রয়েছে যা চোখে পড়ে। ছয় মাস আগে ঠিক যেমন সমরকন্দ থেকে অবরোধের আশঙ্কায় নিজের বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে আক্রমণের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যাবার সময়ে সে দৃষ্টি কেড়েছিল। বাবর তাকিয়ে থাকার মাঝেই সাইবানি খান ধীরে ধীরে অনেকটা অভিবাদনের ভঙ্গিতে বাম হাত উঁচু করে এবং তার যোদ্ধাদের ভিতর থেকে রণহুঙ্কারের একটা তরঙ্গ ভেসে উঠে- এমন একটা শব্দ যা রক্ত শীতল করে ফেলে।
বাবরের যোদ্ধারা প্রত্যুত্তরে চেঁচিয়ে উঠে নিজেদের অবজ্ঞা প্রকাশ করে। কিন্তু তাদের অবজ্ঞা হুমকির মাত্রা লাভ করার আগেই নিজের তরবারির এক ঝাপটায় সাইবানি খান আক্রমণের সঙ্কেত দেয় এবং উজবেক খুরের দাপটে তারা বল্পিত বেগে সামনে এগিয়ে আসতে বাকি সব শব্দ চাপা পড়ে যায়। বাবরের চারপাশে তার লোকেরা একহাতে লাগাম ধরে ঘোড়া শান্ত রাখার পাশাপাশি ঢাল উঠিয়ে আকাশ অন্ধকার করে নেমে আসা তীরের বৃষ্টি ঠেকাতে হিমশিম খেয়ে যায়। বাবরের তীরন্দাজ বাহিনীও চুপ করে বসে না থেকে পাল্টা তীর ছোড়ে। আর সেগুলো লক্ষ্যভেদও করে। কিন্তু উজবেকদের ধেয়ে আসা কালো তরঙ্গের ছন্দময়তায় বিন্দুমাত্র ছেদ পড়ে না। এমনকি তীরের আঘাতে জিন থেকে ছিটকে ধাবমান খুরের নিচে যোদ্ধারা পিষে যেতেও গতির কোনো হেরফের হয় না।
উজবেক বাহিনী আরো কাছে এগিয়ে আসে। “সমরকন্দের জন্য!” বাবর চিৎকার করে উঠে এবং পাল্টা আক্রমণের জন্য ধেয়ে যেতে তার লোকেরা তাকে অনুসরণ করে। নিমেষ পরে, দু’দল যোদ্ধা ধেয়ে আসা দুটো স্রোতের মতো পরস্পরের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ধাতুর উপরে ধাতুর আপতনের শব্দের সাথে ঘোড়ার চিহি রব আর মানুষের আর্তনাদ, হুঙ্কার মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সম্মুখ সমরের চাপ আর বিভ্রান্তির কারণে বলা কঠিন- যে আসলেই কি ঘটছে। কিন্তু কচুকাটার মতো করে ডানে বামে তরবারি চালাবার সময়ে বাবরের মনে হয় তার যোদ্ধারা বুঝি উজবেকদের চেপে ধরছে। ভাবনাটা তার ভিতরে নতুন উদ্যমের জন্ম দিতে সে লম্বা, বর্ম-ধারী এক উজবেকের দিকে ধেয়ে গেলে, তাকে মোকাবেলা করার বদলে সে ঘোড়া নিয়ে পিছু হটে। তার বাহিনীর চেয়ে উজবেক বাহিনীর সংখ্যা অনায়াসে বেশি হবে। কিন্তু চারপাশের পরিস্থিতি দেখে মনে হয় তারা পিছু হটছে। বাবর আর তার অমিত সাহসী যোদ্ধার দল স্থির সংকল্পে সামনে এগিয়ে যেতে উজবেক বাহিনী ডানে বামে ছিটকে যাচ্ছে।
কিন্তু তারপরেও তাকে দেখতে হবে আসল পরিস্থিতিটা কেমন। বাবর তার বাদামী আজদাহার পাঁজরে গুঁতো দিয়ে তার সামনে সহসা উন্মুক্ত হওয়া ফাঁকের ভিতর দিয়ে তাকে ছুটিয়ে নিয়ে যায়। তার আশেপাশের যোদ্ধাদের অনুসরণ করতে বলে সে একটা নিচু আগাছাপূর্ণ টিলার দিকে ঘোড়া হাঁকায়, যা সে যতোটা দেখতে পাচ্ছে- খালি রয়েছে এবং ভালো পর্যবেক্ষণ স্থান হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। সেখানে পৌঁছে সে নিচের যুদ্ধ পরিস্থিতির দিকে তাকায়। লড়াকু, পলায়নপর যোদ্ধাদের মাঝে একটা বিন্যাস তার সামনে আকৃতি লাভ করতে থাকে। সহসা সবকিছু স্পষ্ট হয়ে উঠে এবং বাবর নিজের উপরে ক্ষোভে কটুকাটব্য করে উঠে। সে বুঝতে পারে উজবেকরা আসলে কি চাইছে। মোঙ্গলদের একটা প্রাচীন যুদ্ধরীতি তুলুগামার উপরে তারা নির্ভর করছে। সে কেবল পুস্তকে এর কথা পড়েছে কখনও চোখে দেখেনি।
বাবরের লোকদের আক্রমণের মুখে পিছু হটে যাবার ভান করে সাইবানি খানের যোদ্ধারা আসলে ডানে আর বামে দুটো আলাদা দলে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের ভিতরে তারা ঘুরে দাঁড়িয়ে বাবরের সেনাবাহিনীর বাম আর ডান বাহু আক্রমণ করে কেন্দ্রের সেনাদলকে অরক্ষিত এবং বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। উজবেকরা এরপরে বাবরের বিচ্ছিন্ন দুই বাহিনী থেকে নিজেদের পৃথক করে নেবে কেন্দ্রে হামলা করার জন্য ব্যুহ তৈরি করতে। কেন্দ্র গুঁড়িয়ে দেয়ার পরে তারা তাদের সহযোদ্ধাদের সাথে পুনরায় যোগ দেবে, পূর্বে বিচ্ছিন্ন সেনাবাহিনীর ডান আর বাম বাহুকে নাশ করতে। ওয়াজির খানের অধীনস্ত যোদ্ধারা বাধ্য হবে নদীর দিকে এগিয়ে যেতে এবং তীরের ঢালু আর বালুময় ভূমিতে আটতে পড়বে। অন্যদিকে বাইসানগারের বাহিনী যদি এখনই পালাতে সক্ষম না হয় তবে তারা পুরোপুরি উজবেক বেষ্টনীর মাঝে আটকে যাবে।
বাবরের পেছন থেকে ভেসে আসা শিঙ্গা ধ্বনিতে যুদ্ধের ডামাডোল চাপা পড়ে যায়। সোয়া মাইল দূরে একটা পাহাড়ের পেছন থেকে উজবেক যোদ্ধাদের একটা বহর দুলকি চালে এগিয়ে আসছে। নেকড়ের পালটা সম্ভবত সেখানে লুকিয়ে অপেক্ষা করছিলো। দলটা নিকটবর্তী হতে কালো চামড়া মোড়া ঢালের উপরে রূপার গোলাকৃতি কারুকাজ দেখে বাবর চিনতে পারে তাদের: সাইবানি খানের দুর্ধর্ষ বাহিনী। তার নিজের গোত্রের, একই রক্ত বহন করা যোদ্ধার দল। বাইসানগারের অধীনস্ত বাহিনীর দিকে তারা এগিয়ে যায়। কোনো সন্দেহ নেই তাদের পালাবার শেষ সম্ভাবনাটুকুও তারা বন্ধ করে দিতে চায়।
বাবর সহসা উপলব্ধি করে ভূমির চড়াই উতরাইয়ের কারণে বাইসানগার শত্রু পক্ষের আগুয়ান বাহিনীকে দেখতে পাবে না। কিন্তু হামলাকারীদের চেয়ে সে নিজে বাইসানগারের নিকটে অবস্থান করছে। সে দ্রুত, ঘোড়া তাজা রয়েছে এমন এক যোদ্ধাকে নির্বাচিত করে। “বাইসানগারকে সতর্ক করে দাও- তাকে বল নিজের অবশিষ্ট বাহিনী নিয়ে সে যেনো সমরকন্দে ফিরে যাবার জন্য সর্বোচ্চ প্রয়াস নেয়। আমার কথা তুমি বুঝতে পেরেছো?”
তরুণ অশ্বারোহী ঢাল বেয়ে দ্রুত নেমে যায়। বার্তাবাহক আক্রমণরত উজবেক বাহিনীর নাগাল এড়িয়ে যেতে পারবে, এটা মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত বাবর সেখানে অপেক্ষা করে। তারপরে সে বাকিদের তার কাছাকাছি অবস্থান করতে বলে নদীর তীরের দিকে ধেয়ে যায় যেখানে ওয়াজির খানের বাহিনী নিজেদের প্রাণ বাঁচাবার মরণপণ লড়াইয়েরত।
আক্রমণকারী উজবেক যোদ্ধাদের সারি যেখানে দুর্বল, বাবর ঘুরে এসে সেখানে হামলা করে। তরবারির আঘাতে নিজের পথ করে নেয়। কিন্তু তার সাথে যে বিশজনের মতো যোদ্ধা ছিলো তাদের ভিতরে কেবল বারোজন ব্যুহ ভেদ করে বের হয়ে আসতে পারে। হতাশাব্যঞ্জক একটা পরিস্থিতি। ওয়াজির খানের বাহিনীকে আদতেই নদীর দিকে ঠেলে নিয়ে চলেছে উজবেকরা। তাদের কেউ ঘোড়ার পিঠে উপবিষ্ট অবস্থায় ক্রমাগত তীর নিক্ষেপ করছে, কেউ বালুময় নদী তীরে ঘোড়ার পায়ের নীচ থেকে সরে যাওয়া বালুর কারণে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেই হিমশিম খেতে থাকা মানুষ আর ঘোড়ার বিশৃঙ্খল টালমাটাল দঙ্গলের ভিতরে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাতের বাঁকানো তরবারির ধারের সদ্ব্যবহার করে। বাবর ওয়াজির খানকে ভীড়ের মাঝে সনাক্ত করতে পারে না।
বাবর সহসা অনুভব করে তার ঘোড়া থরথর করে কাঁপছে। বাদামী রঙের সুন্দর আজদাহা ব্যাথায় চিৎকার করে উঠে। দুটো তীর একইসাথে গলায় আর ঘাড়ে বিদ্ধ হতে এবং ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া শিরা থেকে তাজা লাল রক্ত ফিনকি দিয়ে বের হয়ে আসতে বেচারী ইতিমধ্যে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাতে শুরু করে সজোরে মাটিতে আছড়ে পড়ে। বাবর সময়মত জিন থেকে লাফিয়ে পড়ে বিশাল প্রাণীটার নিচে চাপা পড়ার হাত থেকে বেঁচে যায়। বাবর টলমল করতে করতে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হাতে তখনও আলমগীরের বাঁট ধরা। কিন্তু খঞ্জর আর ঢাল কোথায় যেনো ছিটকে পড়েছে। মাতালের মতো টলতে টলতে এবং বাতাসে ক্রমাগত ছোবল দিতে থাকা তরবারির ফলা আর কস্তনীর মতো ঘোড়ার খুরের থাবা এড়িয়ে সে আরেকটা ঘোড়ার আশায় চারপাশে তাকায়।
“সুলতান।” বাবুরী ভূতের মত উদয় হয়, তার মুখ রক্তে আবৃত। চোখে বেপরোয়া দৃষ্টি। পর্যানের উপরে সামনে ঝুঁকে এসে, সে বাবরকে তার বিশাল ধূসর ঘোড়ার পিঠের পেছনে তুলে নেয়।
“নদীর দিকে চলো!” বাবর চিৎকার করে বলে। যতোজন সম্ভব যোদ্ধাকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে আরেকদিন যুদ্ধের জন্য বেঁচে থাকাটাই এখন তাদের একমাত্র আশা। তরবারি মাথার উপরে আন্দোলিত করার ফাঁকে সে চারপাশে তার বাকি সেনাপতিদের দিকে তাকায় এবং চিৎকার করে নিজ নিজ বাহিনীসহ নদীর দিকে পিছিয়ে যেতে বলে। ওয়াজির খানকে সে এখনও দেখতে পায় না।
পাহাড়ের বরফ গলতে শুরু করায় নদী এখন কানায় কানায় পূর্ণ। ঘোড়া নিয়ে নদীর পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লে দেখা যায় পানি প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর স্রোতও বেশ তীব্র। বাবুরীর ঘোড়া তাদের দুজনের ওজনের কারণে বেশ কষ্ট করে সাঁতার কাটে। তাদের দুজনকে নিয়ে বেচারা কখনও তীরে পৌঁছাতে পারবে না। আলমগীর কোষবদ্ধ করে বাবুরী কিছু করার আগেই সে পিছলে পানিতে নেমে যায়। কিন্তু মাত্র বিশ গজ দূরে অবস্থিত অপর পাড়ের উদ্দেশ্যে সাঁতার কাটতে আরম্ভ করলে একটা শক্তিশালী স্রোতের কবলে পড়ে সে ভাটির দিকে ভেসে যায়।
“সুলতান…” বাবর ওয়াজির খানের কণ্ঠস্বর চিনতে পারে। কিন্তু কানের কাছ দিয়ে বয়ে চলা হিমশীতল পানির স্রোত তাকে নিজের মাঝে টেনে নেবার হুমকি ক্রমাগত দিতে থাকলে সে চারপাশে তাকিয়ে দেখার মতো সময় পায় না। তারপরে সে পানিতে একটা পাতলা শক্তমতো কিছু অনুভব করে। সহজাতপ্রবৃত্তির বশে সে সেটা আঁকড়ে ধরে। জিনিসটা বর্শার হাতলের মতো অনেকটা। নদীর স্রোত এবার তাকে ধারালো পাথরের একটা দৃশ্যমান শিলাস্তরের মাঝে নিক্ষিপ্ত করতে সে বর্শার হাতল পাথরের সংকীর্ণ খাঁজে আটকে দেয়। বাবর এবার হাতলের উপরে ভর দিয়ে। নিজেকে পাথরের কাছে টেনে নিয়ে আসে এবং ক্ষতবিক্ষত আর রক্তাক্ত হাতে সে হাঁপাতে হাঁপাতে নিজেকে পানির উপরে উঠিয়ে নিয়ে আসে।
তার চারপাশের পানিতে বৃষ্টির মতো তীর এসে পড়তে থাকে। নদীর অপর পাড়ে উজবেক তীরন্দাজের দল সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে, পলায়নরত প্রতিপক্ষকে ধুয়ো দেয়, কেউ কেউ আবার তীর ছোঁড়ার মাঝে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করতে থাকে। সে একটা পাথরের পেছনে আড়াল নিতে গিয়ে ওয়াজির খানকে দেখতে পায়। বেচারা তখনও পানিতে নাস্তানাবুদ হচ্ছে। তার কালো ঘোড়ার পাঁজরে আর পাছার দাবনায় কয়েকটা তীর বিদ্ধ হয়েছে এবং আতঙ্ক আর যন্ত্রণায় বেচারার চোখ বড় বড় হয়ে আছে। ওয়াজির খান আপ্রাণ চেষ্টা করে ঘোড়াটাকে তীরের কাছে নিয়ে আসতে। কিন্তু এখনও অর্ধেক পথ বাকি। বাবরের প্রাণ বাঁচিয়েছে যে বর্শা, সেটা কি তারই ছুঁড়ে দেয়া? নিজের বিপদের কথা বিস্মৃত হয়ে, বাবর পাথরের আড়াল থেকে উঠে দাঁড়ায় এবং ওয়াজির খানের নাম ধরে চিৎকার করে ডাকে। বুড়ো যোদ্ধা চোখ তুলে তাকায়।
তারপরেই বাবর দেখে অপর পাড়ে দাঁড়ানো এক তীরন্দাজ তার দিকে ধনুক তাক করে এবং ধনুকের ছিলা কানের পাশে টেনে নিয়ে আসে। শিকার লক্ষ্য করে উড়াল দেয়া বাজপাখির মতো কালো পালক শোভিত তীর ধনুক থেকে নিক্ষিপ্ত হয়ে বাতাস কেটে অমোঘ গতিতে এগিয়ে আসে। কোনো অজানা কারণে, ওয়াজির খান ঘুরে দাঁড়ায় এবং সেভাবে দাঁড়ানো অবস্থায়, তীরটা তার অরক্ষিত গলায় এমন জোরে এসে আঘাত করে যে তীরের ফলাটা তার ঘাড়ের পেছন দিয়ে বের হয়ে আসে। সে ঘোড়ার উপর থেকে ধীরে ধীরে কাত হয়ে প্রচণ্ড গর্জন করে বহমান খরস্রোতা পানিতে গড়িয়ে পড়ে। বাবরের বেপরোয়া, হতাশ চিৎকার তাকে অনুসরণ করে রক্তে লাল হয়ে উঠা পানিতে তার দেহ ধীরে বয়ে যায়।
আকশির দূর্গে তার আব্বাজানকে অতল খাদে আছড়ে পড়তে দেখে সে যেমন স্তম্ভিত, হতভম্ব হয়ে পড়েছিল আজও তার ঠিক সেই দশা হয়। সে মাটিতে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে চোখ বন্ধ করে।
“সুলতান, আমাদের এখান থেকে যেতে হবে…” বাবুরীর কণ্ঠস্বর তার কানে আসে। বাবর যখন কোনো উত্তর দেয় না, তখন সে রুক্ষভাবে তাকে ধরে দাঁড় করিয়ে দেয়। এভাবে বসে থাকলে চলবে না…সেটা মূর্খতার সামিল হবে…”
“ওয়াজির খান…ভাটিতে খুঁজে দেখার জন্য একটা অনুসন্ধানী দল আমি পাঠাতে চাই…সে হয়তো এখনও বেঁচে আছে।”
“তিনি মারা গিয়েছেন…এখন মৃতরাই তার দায়িত্ব নেবে। নিজেকে বাঁচানো ছাড়া আপনি এখন তার জন্য কিছুই করতে পারবেন না… বেঁচে থাকলে তিনিও তাই চাইতেন। আপনি সেটা জানেন…এখন চলুন…”
***
“সুলতান, শস্যভাণ্ডার প্রায় খালি হয়ে এসেছে।” বাবরের অভিজ্ঞ উজির অবরোধ আরম্ভ হবার পর থেকে সমরকন্দের শস্য পরিস্থিতি লিপিবদ্ধ করে এসেছে যে লাল রঙের চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা খেরো খাতায়, সেটার দিকে একবার তাকিয়ে তারপরে বলে।
“আর কতদিনের রসদ মজুদ রয়েছে?”
“পাঁচ দিনের মতো। খুব বেশি হলে এক সপ্তাহ চলবে।”
খাদ্যের পরিমাণ আরও কমাবার কোনো প্রশ্ন উঠে না। একজন সৈনিকের জন্য এখনই দৈনিক বরাদ্দ তিনকাপ শস্যদানা, পুরুষ নাগরিকের জন্য দুইকাপ এবং বাচ্চা আর মেয়েদের জন্য এক কাপ করে শস্য বরাদ্দ করা রয়েছে। শহরের অধিবাসীরা ইতিমধ্যে চোখের সামনে যা কিছু দেখছে তাই খেতে শুরু করেছে। গুলতি দিয়ে শিকার করা কাক থেকে আরম্ভ করে গাধা বা কুকুরের মাংস যেসব প্রাণী খাদ্যের অভাবে মারা গিয়েছে বা মাংসের জন্য তাদের জবাই করা হয়েছে। শাহী আস্তাবলের ভারবাহী প্রাণীদের অনেক আগেই সৈনিকদের মাংসের প্রয়োজনে হালাল করা হয়েছে। তার লোকেরা বাধ্য হয়ে এই সময়ের জন্য দারুণ মূল্যবান অশ্বারোহী বাহিনীর ঘোড়াগুলিকে গাছের পাতা আর কাঠের গুড়ো পানিতে গুলে খেতে দিচ্ছে ফলে প্রতিদিনই প্রাণীগুলোর অবস্থা আরও সঙ্গীন হয়ে উঠছে। শীঘ্রই এমন সময় আসবে যখন তারা বাধ্য হবে ঘোড়াগুলিকে হত্যা করতে। একবার ঘোড়ার পাল শেষ হয়ে গেলে তারা শহরের চারপাশের দেয়ালে উজবেক অবরোধ ছিন্ন করে ঝটিকা বাহিনী পাঠিয়ে রসদের অন্বেষণ করতে ব্যর্থ হবে।
গত তিন মাস ধরে প্রতিটা দিন বাবর কেবল একটা বিষয়ই চিন্তা করেছে সাইবানি খান কি আদৌ আক্রমণ করবে। কিন্তু সে কেন আক্রমণ করবে? বাবরের আত্মসমর্পন যখন সে জানে এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। নিদারুণ খাদ্যকষ্টে দিন অতিবাহিত করা শহরের লোকদের চোখের সামনে সে প্রতিদিন দেয়ালের কাছে নিজের লোকদের জন্য ভূড়িভোজের আয়োজন করে সে বোধহয় বিকৃত আনন্দ লাভ করছে এবং আশেপাশের গ্রাম থেকে লুট করে আনা খাদ্যশস্যের স্তূপ অবরুদ্ধ শহরবাসীর চোখের সামনে পুড়িয়ে দিয়ে সে যেনো তাদের বলতে চায়, “নষ্ট করার মতো যথেষ্ট খাবার আমার রয়েছে- তোমাদের অবশ্য কিছুই নেই।”
এসবের চেয়েও জঘন্য বিষয়, তিন সপ্তাহ আগে বাবরের সেনাবাহিনীর ছয়জন পক্ষত্যাগী সদস্য তার হাতে ধরা পড়েছিলো যারা শহরের দেয়াল টপকে পালাতে চেষ্টা করেছিলো এবং তার আদেশে শহর রক্ষাকারী দেয়ালের ঠিক সামনে তার আদেশে বেচারীদের বিশাল তামার পাত্রে তেলে সিদ্ধ করা হয়েছে। তাদের অন্তিম চিৎকারের একটা সুফল এসেছে আর কেউ এরপরে আর পালাবার চেষ্টা করেনি।
বাবর কাশিমকে বিদায় করে, সিঁড়ি দিয়ে আঙ্গিনায় নেমে এসে দেহরক্ষীসহ একটা ঘোড়া প্রস্তুত করতে বলে। ওয়াজির খানের মৃত্যুর শোক সে এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি- সে একজন বিশ্বস্ত বন্ধুর অভাবই কেবল অনুভব করে না, সেই সাথে এই হতাশাব্যঞ্জক বিষণ্ণ সময়ে সে তার মতো একজন অভিজ্ঞ পরামর্শদাতার শূন্যতা। আজকাল তার সাথে যারা ঘোড়া নিয়ে বের হয় তাদের ভিতরে বাবুরী প্রধান। গত কয়েক মাসের অভাবের ফলে তার চোখের নিচের হাড় আরও উঁচু হয়েছে। কি ঘটছে সে বিষয়ে সে ভালই মূল্যায়ন করতে পারে এবং খোলাখুলি কথা বলতেও সে প্রস্তুত।
রেজিস্তান চত্ত্বরে স্থাপিত, রেশমের চাদোয়ার নিচে পান্নাশোভিত হয়ে মঞ্চে উপবিষ্ট হয়েছিলো যখন বাবর- উৎসবমুখর সেসব দিন থেকে আজকের দিন কতো আলাদা। সমরকন্দের চিত্তাকর্ষক টাইলসেশোভিত চাকচিক্যময় ভবনগুলোকে সেদিন কেমন ম্লান মনে হয়েছিলো।
বাবর যে রাস্তা দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যায় সেখানে পূতিগন্ধময় জঞ্জাল আর আবর্জনা জমে স্তূপ হয়ে আছে যা সরাবার মতো লোক নেই। যদি না কেউ খাবারের সন্ধানে সেখানে হাতড়াতে না আসে। বাবুরি তাকে বলেছে ক্ষুধার জ্বালায় মরিয়া হয়ে কিছু নগরবাসী গোবর ঝাঁঝরিতে ফেলে চেলে দেখেছে সিদ্ধ করার মত শস্যদানা পাওয়া যায় কিনা। অন্যেরা হাতের কাছে লতা পাতা যা পাচ্ছে তাই পানিতে সিদ্ধ করছে। বাবর যেদিকেই তাকায় সে চুপসে যাওয়া মুখ আর কোটরাগত মলিন চোখ দেখতে পায়। যে লোকগুলো এক সময়ে তাকে দেখে উফুল্ল হয়ে উঠতো আজ তারা তাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়।”
“বাবুরি, লোকগুলো কি ভাবছে?”
“নিজের খিদে নিবারণ ছাড়া আর কিছুই তারা ভাবছে না। আর সামান্য যে কয়বার তারা অন্য কিছু ভাববার মতো ফুরসত পায় তখন সাইবানি খান শহর দখল করে কি করবে, সেটা ভেবে ভয় পায় যা তাদের ধারণা আসন্ন। উজবেকরা গতবার কোনো কারণ ছাড়াই হত্যা, ধর্ষণ আর ধবংসযজ্ঞে মেতেছিলো। সাইবানি খান এবার মনে রাখবে কিভাবে শহরের অধিবাসীরা আপনাকে স্বাগত জানিয়েছে, তার লোকদের উপর হামলা করেছে এবং সে নিশ্চিতভাবেই এর প্রতিশোধ নিতে চাইবে।”
“আমি তৈমূরের সমাধিতে যাবো…” বাবর সহসা ঘোষণা করে। বাবুরীকে বিস্মিত দেখায় কিন্তু সে কিছু বলা থেকে বিরত থাকে।
সমাধিপ্রাঙ্গণের প্রবেশ পথের সামনের আঙ্গিনায় ঘোড়ার চড়ে প্রবেশ করে বাবর। লাফিয়ে নেমে আসে এবং ইঙ্গিতে বাবুরীকে তার সাথে ভেতরে আসতে বলে। সমাধিপ্রাঙ্গণের খিদমতগারদের হাতের ইশারায় চলে যেতে বলে। সে দ্রুত ভেতরের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে এবং তৈমূরের মরদেহ যেখানে শায়িত রয়েছে সেই ভূগর্ভস্থ কক্ষে প্রবেশ করে।
বাবর শীতল পাথরের উপরে হাত রাখে। “এখানেই শায়িত আছেন মহাবীর তৈমূর। আমি প্রথমবার যখন এখানে এসেছিলাম, তখন শপথ নিয়েছিলাম যে তার যোগ্য উত্তরসূরী বলে নিজেকে প্রমাণ করবো। সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার সময় হয়েছে। শহরের দেয়ালের বাইরে আমি একটা শেষ যুদ্ধে আমার লোকদের নেতৃত্ব দেবো। ভবিষ্যত প্রজন্ম যাতে বলতে না পারে, তৈমূরের শহর আমি কোনো ধরণের প্রতিরোধ গড়ে না তুলে বর্বরদের হাতে সমর্পণ করেছি…”
“তিল তিল করে ধুকে মরার চেয়ে যখন আমাদের তরবারি চালাবার মতো শক্তিও আর অবশিষ্ট থাকবে না, তারচেয়ে এ ধরণের মৃত্যুই ভালো…”
বাবর সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ে এবং আগেও যেমন করেছে এবারও শীতল পাথরের শবাধার চুম্বন করার জন্য নত হয়।
কিন্তু তারা কোক সরাইয়ে ফিরে আসবার সময়ে পথে বাবর কিছু একটা পরিবর্তন আঁচ করতে পারে। রাস্তায় আগের চেয়ে অনেক বেশি লোক দেখা যায় এবং সবাই উৎসুক ভঙ্গিতে হাত পা নেড়ে কথা বলছে, ভাবটা এমন যেনো আলাপ করার মতো সংবাদ তারা জানতে পেরেছে। সে যেদিকে চলেছে অনেকেই সেদিকে এগিয়ে যায়, চারপাশে একটা জনসমুদ্রের সৃষ্টি হতে তার দেহরক্ষীর দল বাবরকে ঘিরে একটা বেষ্টনী গড়ে তুলে এবং তাকে নির্বিঘ্নে অতিক্রমের সুযোগ দিতে তারা হাতের বর্শার হাতল ব্যবহার করে লোকজনকে ঠেলে পেছনে সরিয়ে দেয়।
তার এক সৈন্য বর্শা উঁচিয়ে তার দিকে ধেয়ে আসে। “সুলতান।” প্রহরী কথা বলার মতো দূরত্বে এসে হাজির হতে চেঁচিয়ে উঠে। “সাইবানি খান একজন বার্তাবাহক পাঠিয়েছে।”
দশ মিনিটের ভিতরে বাবর কোক সরাইয়ে ফিরে এসে মন্ত্রণা কক্ষে, যেখানে সভাসদরা তার জন্য অপেক্ষা করছে, দর্শন দেয়।
উজবেক দূত কালো পাগড়ি আর গাঢ় বেগুনী রঙের জোব্বা পরিহিত বেশ মোটাসোটা দীর্ঘকায় এক ব্যক্তি। এক রণকুঠার লোকটার পিঠে ঝোলানো, কোমরে ঝুলছে খাঁটো, বাঁকা, একধারি তলোয়ার এবং কমলা রঙের পরিকরে গোঁজা রয়েছে রূপার বাঁটযুক্ত খঞ্জর। বাবর মন্ত্রণা কক্ষে প্রবেশ করতে সে হাত দিয়ে বুক স্পর্শ করে।
“আপনি কি সংবাদ নিয়ে এসেছেন?”
“আমার প্রভু আপনার বিড়ম্বনার একটা সমাধান প্রস্তাব করেছেন।”
“আর সেটা কি?”
“তিনি চোরের মতো আপনার শহর দখল করার ব্যাপারটা মার্জনা করতে প্রস্তুত আছেন। তার ন্যায়সঙ্গত সম্পত্তি তাকে ফিরিয়ে দিলে আপনাকে, আপনার পরিবার আর সেনাবাহিনীসহ শহর ত্যাগ করতে দেয়া হবে। তিনি আপনাকে ফারগানা বা পশ্চিমে কিংবা দক্ষিণে আপনার যেখানে পছন্দ সেখানে নিরাপদে গমন করতে দেবেন। পবিত্র কোরান শরীফের নামে তিনি শপথ করছেন যে তিনি আপনাকে আক্রমণ করবেন না।”
“আর এই শহর আর এর লোকদের ভাগ্যে কি ঘটবে? তিনি কি মানুষের চামড়া দিয়ে আরও ঢাক প্রস্তুত করতে চান, যেমনটা তিনি আমার ভাই শাহজাদা মাহমুদের চামড়া দিয়ে তৈরি করেছিলেন?”
“আমার প্রভু বলেছেন তাকে অপমাণিত করার জন্য শহরের বাসিন্দাদের অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু সেটা হবে কর আরোপের মাধ্যমে। যে কোনো ধরণের রক্তপাত পরিহার করা হবে। তিনি এ বিষয়েও কোরান শরীফ সাক্ষী রেখে ওয়াদা করছেন।”
“এর সাথে কি আর কোনো শর্ত আছে?”
“একেবারেই না। কেবল একটাই কথা আগামী পূর্ণিমার আগে তার মানে এখন থেকে দু’সপ্তাহকালের ভিতরে আপনি সমরকন্দ ত্যাগ করবেন।” বিশালদেহী দূত তার ততোধিক বিশাল উদরের উপরে হাত ভাঁজ করে দাঁড়ায়।
“সাইবানি খানকে গিয়ে বলবেন, আমি তার প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখবো। আর আগামীকাল দুপুর নাগাদ আমার উত্তর জানাবো।”
“আর সেই অবসরে আমার প্রভুর তরফ থেকে আমি আপনার জন্য সামান্য উপহার নিয়ে এসেছি।” বিশালদেহী উজবেক দূত আঙ্গুলে তুড়ি বাজাতে তার একজন পরিচারক, যে একপাশে নিরবে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো এবার একটা বিশাল ঝুড়ি নিয়ে সামনে এগিয়ে আসে। ঝুড়ির মুখের মোচাকৃতি ঢাকনা খুলে সে ভেতরে জিনিস মঞ্চের নিচে পাতা গালিচার উপরে ঢেলে দেয়- সমরকন্দের বাইরে অবস্থিত ফলবাগানের সুপ, মধুর মতো মিষ্টি এবং সোনালী রঙের তরমুজ গড়িয়ে বের হয়ে আসতে তাদের মুখে পানি নিয়ে আসা সুগন্ধে কক্ষটা মম করতে থাকে। “আমি দুটো গাধার পিঠে বোঝাই করে নিয়ে এসেছি। ফিরোজা দরোজায় গাধাগুলো দাঁড়িয়ে আছে। আমার প্রভুর বিশ্বাস ফলগুলো আপনার রসনা তৃপ্ত করবে।”
“আপনি আপনার প্রভুকে গিয়ে বলবেন আমাদের এসব প্রয়োজন নেই। সমরকন্দের দেয়ালের অভ্যন্তরে অবস্থিত বাগানের ফলের গাছ পাকা ফলে নুয়ে পড়ছে। আমরা এগুলো আমাদের গাধাকে খাওয়াবো…” বাবর উঠে দাঁড়ায় এবং দূতের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময়ে সে ইচ্ছাকৃতভাবে একটা তরমুজ লাথি দিয়ে সরিয়ে দেয়। কক্ষের মেঝেতে গড়িয়ে গিয়ে সেটা পাথরের চৌকাঠে আঘাত করতে ভেতরে নরম সোনালী আঁশ চুঁইয়ে বের হয়ে আসে।
***
“আমরা কি তাকে বিশ্বাস করতে পারি?” সেদিন রাতে, মোমবাতির আলোতে আলোকিত মন্ত্রণা কক্ষে তারা মিলিত হতে, বাবরের চোখ তার মন্ত্রণাদাতাদের মুখের অভিব্যক্তি পড়তে চেষ্টা করে। তাদের মতামত শোনার আগে পুরো বিষয়টা নিয়ে তাকে ভালো করে ভেবে দেখতে হবে।
“সে একটা বর্বর এবং আমাদের জানের দুশমন। কিন্তু সে কথা দিয়েছে।” বাইসানগার অভিমত প্রকাশ করে।
“গরু চোরের কথার মূল্য…” বাবর কঠোর ভঙ্গিতে প্রত্যুত্তর দেয়।
“কিন্তু পবিত্র কোরান শরীফের নামে এভাবে প্রকাশ্যে শপথ নিয়ে সেটা ভঙ্গ করলে তার বদনাম হবে।”
“কিন্তু তার এমন প্রস্তাব পাঠাবার কারণ কি? আমাদের চেয়ে তার সেনাবাহিনী সংখ্যায় বিশাল এবং যখন জানে সে শহরে তুমুল খাদ্যাভাব বিরাজ করছে। অপেক্ষা করতে চাইছে না কেন? সাইবানি খানের ধৈর্যের অভাব আছে বলে তো জানতাম না?”
“সুলতান, আমার মনে হয় আমি প্রস্তাব পাঠাবার আসল কারণ কি বুঝতে পেরেছি।” বাবুরী, বাবরের মঞ্চের একপাশে যেখানে সতর্কাবস্থায় দাঁড়িয়েছিলো সেখান থেকে সামনে এগিয়ে আসে।
‘কারণ বলো।” বাবর তার চারপাশে তাকে ঘিরে বসে থাকা লোকদের সাথে তাকে বসতে ইঙ্গিত করে। একজন সাধারণ সৈনিককে সুলতান তাদের মাঝে বসতে আহবান করেছেন এজন্য কেউ কেউ বিস্মিত হলেও সেটা সে অগ্রাহ্য করে।
“বাজারে জোর গুজব রটেছে- যারা আজ সাইবানি খানের দূতের পরিচারকের সাথে কথা বলেছে তারাই গুজবটা ছড়িয়েছে- সাইবানি খান উজবেক গোত্রের ভিতর থেকে তার নেতৃত্বে প্রতি হুমকি অনুভব করছেন। তারা বলেছে যে তৃণভূমির অনেক অভ্যন্তরে বসবাসরত তার এক ভাস্তে, তার বিরুদ্ধে একটা সামরিক বাহিনী গড়ে তুলছে। সাইবানি খান উত্তরে গিয়ে এই বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠবার আগেই একে অঙ্কুরে বিনষ্ট করতে চায়। সে যদি শীঘ্রই রওয়ানা না দেয়, তাহলে আবহাওয়া বৈরী হয়ে উঠবে এবং আগামী বসন্তের আগে সে আর কিছুই করতে পারবে না…”
বাবর ভাবে, কথাটা যদি সত্যি হয়, তাহলে অবরোধ করে সময় নষ্ট করাটা সাইবানি খানের কাছে এখন বিলাসিতার সামিল। সে এখন যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব শহরটা পুনরায় দখল নিয়ে এর নিরাপত্তায় একটা সেনাবাহিনী মোতায়েন করে নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধির নিমিত্তে রওয়ানা হতে চাইবে। সে এখন তার লোকবল আর রসদ সামগ্রীর যে কোনো ধরণের ক্ষয়ক্ষতি এড়িয়ে যাবে। বাবরের পশ্চাদপসরণকারী বাহিনীকে হেনস্থা করে-তৈমূর বংশীয় অন্যান্য গোত্রপতি আর সুলতানদের ঘাটাতে চাইবে না।
“আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।” বাবর উঠে দাঁড়ায়। “আমি উজবেকদের শর্ত মেনে নেব- যদি তারা আমার লোকদের পুরোপুরি অস্ত্র সজ্জিত অবস্থায় এখান থেকে যেতে দিতে রাজি হয়। তারপরে সে তার কণ্ঠে যতোটা সম্ভব নিশ্চয়তার ছোঁয়া যোগ করে বলে, “জনগণও রক্ষা পাবে এবং ইনশাআল্লা- আল্লাহতালা যদি চান আমরা আবার ফিরে আসবো।”
পরের দিন ভোরবেলা বাবর কোক সরাইয়ের ছাদ থেকে, কাশিম তার বার্তাবাহী দূতকে, সমরকন্দের সবুজ নিশানাবাহী দুইজন সৈন্যসহ ধীরে ধীরে ফিরোজা দয়োজা অতিক্রম করে সাইবানি খানের শিবিরের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে।
সে তার লোকদের যতোই বোঝাতে চেষ্টা করুক এটা আসলে আত্মসমর্পণ- এমন একটা ব্যাপার যার মুখোমুখি সে জীবনে আগে কখনও হয়নি বা কখনও করবে বলে বিশ্বাসও করতো না। আর এই ব্যাপারটা ভাবলেই তার বমি বমি পায়। অবশ্য সে এই অভিযানের শুরু থেকেই জানে যে এবার তাকে প্রবল প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হবে। আর শেষ পর্যন্ত সাইবানি খানের শর্তে রাজি না হওয়া ছাড়া তার সামনে আর কোনো বিকল্পও ছিলো না। সমরকন্দের জনগণের স্বার্থে এটাই ছিলো একমাত্র পথ। কিন্তু পশ্চাদপসরণের ভাবনা- চরম ঘৃণিত এক শত্রুর হাতে শহর তুলে দেয়া- খুবানি বহুদিন গাছে থাকলে যেমন তিতে স্বাদ হয়, তেমনি তিক্ত স্বাদ তার মুখে সে টের পায়। অবশ্য আরেকদিক দিয়ে ভাবতে গেলে, এর ফলে সে নিজেও মুক্ত হবে এবং সুযোগ পাবে নিজের আর নিজের পরিবারের সমৃদ্ধি পুনঃনির্মাণের। তার আত্মবিশ্বাস আর একাগ্রতা বজায় থাকে, সে জানে সেটা বজায় থাকবে। সে এখনও বয়সে তরুণ এবং বিরাট সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হবে এমন শিক্ষা তাকে দেয়া হয়নি। সে তার নিয়তির লিখন সার্থক করবেই।
***
বাবর তার ঘোড়ার পিঠে চেপে বসে উঁচু কোক সরাইয়ের দিকে একবারও ফিরে না তাকিয়ে বের হয়ে আসে। তার দেহরক্ষী বাহিনী, যাদের ভিতরে বাবুরীও রয়েছে, তার পেছনেই রয়েছে এবং সারির একেবারে শেষে, অশ্বারোহী বাহিনী দ্বারা সুরক্ষিত এবং চামড়ার পর্দা দিয়ে আড়াল করা একটা গরুর গাড়িতে পরিচারিকাদের নিয়ে তার আম্মিজান, নানীজান আর বোন আসছে।
তার স্ত্রী আর অন্যান্য মেয়েদের আরেকটা গাড়িকে মাঙ্গলিঘ তীরন্দাজ বাহিনী, যারা এখন জামমীন ফিরে যাবে পাহারা দিয়ে নিয়ে আসছে। আয়েশা তার বাবার সাথে দেখা করার জন্য তাদের সাথে যেতে চাইলে বাবর সানন্দে সম্মতি দিয়েছে। এখন পর্যন্ত তার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়ের এটাই একমাত্র উজ্জ্বল দিক বলে তার কাছে প্রতিপন্ন হয়েছে।
বাবরের অবশিষ্ট বাহিনী ইতিমধ্যে শহরের ভিতর দিয়ে উত্তরদিকে শেখজাদা দরোজার দিকে রওয়ানা দিয়েছে। সাইবানি খান আজ্ঞপ্তি জারি করেছে যে বাবরকে তার বাহিনী নিয়ে এই দরোজা দিয়ে শহর ত্যাগ করতে হবে। আর কয়েক ঘণ্টা পরে, সাইবানি খান তার গাঢ় আলখাল্লা সজ্জিত উজবেক যোদ্ধা পরিবেষ্টিত অবস্থায় মহিমান্বিত ফিরোজা তোরণদ্বার দিয়ে শহরে প্রবেশ করবেন।
পুরো শহরে একটা গুমোট আর স্থবির অবস্থা বিরাজ করে। বাবর আর তার বাহিনী এগিয়ে যেতে বেশিরভাগ বাড়ির দরোজা জানালার কপাট বন্ধ এবং হুড়কো দেয়া দেখা যায়। যদিও মাঝে মাঝে কাউকে উঁকি দিয়ে সশব্দে থুতু ফেলতে দেখা যায়। বাবর তাদের কোনো দোষ দেয় না। বাবর চাইলে ঘোষণা করতে পারে যে, এটা একটা সাময়িক ছন্দপতন, সে আবার ফিরে আসবে। যা কোনো রুচিহীন উজবেক অধীনে না, তৈমূর বংশীয় সুলতানের অধীনে সমরকন্দের জন্য একটা স্বর্ণালী যুগের সূচনা করবে। কিন্তু তার কথা শহরের লোকেরা কেন বিশ্বাস করবে? ঘোড়ায় বসে থাকার সময়ে বাবরের পিঠ যতোই সোজা হয়ে থাকুক, যতোই কঠোর হোক তার। মুখভাব, লোকদের চোখ তার দেহ ভেদ করতে পারে না এবং তার হৃদয়ে সাফল্যের ইস্পাত কঠিন প্রত্যয় দেখতে পায় না।
প্রায় দুপুর হয়ে এসেছে এবং সূর্য দোর্দণ্ডরূপ ধারণ করেছে। বাবর ভাবে আজকের দিনে তারা বেশিদূর যাবে না। তারা পূর্ব দিকে ঘুরে গিয়ে কোলবা পাহাড়ের দূরবর্তী প্রান্তে অস্থায়ী শিবির স্থাপন করবে। সেখান থেকে অন্তত সমরকন্দ তার চোখে পড়বে না। আগামীকাল সে তার মন্ত্রণাদাতাদের নিয়ে আলোচনায় বসবে, কোথায় গেলে ভাল হবে। এসান দৌলত ফারগানা ছাড়িয়ে পূর্বদিকে তার লোকদের কাছে যাবার জন্য তাকে অনুরোধ করেছে। বুড়ির কথাই সম্ভবত ঠিক। যদিও বাবরের সহজাত প্রবৃত্তি তাকে পাহাড়ের এখান থেকে বেশি দূরে না, এমন কোনো নির্জনস্থানে আত্মগোপন করে এবং সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করে…
সে এবার সামনে শেখজাদা তোরণের উঁচু বাঁকানো খিলান দেখতে পায়। সে তোরণদ্বারের দিকে রওয়ানা দিতে বাইসানগার তার দিকে এগিয়ে আসে। তাকে কঠোর আর যেতে অনিচ্ছুক দেখায়। সেটাই হবার কথা, কারণ এটা তার শহর সে যেখানে জন্ম গ্রহণ করেছে: সেই শহরটা উজবেকদের হাতে তুলে দিতে তার মোটেই ভালো লাগার কথা না। বাবরের চেয়ে কোনো অংশে কম না তার ক্ষতির মাত্রা।
“সুলতান, তোরণের পরে তৃণভূমিতে লোকদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করে রাখা হয়েছে এবং আরো ব্যাপার আছে। সাইবানি খানের দূত আপনার সাথে আরেকবার দেখা করতে চায়।”
“বেশ, ভালো। আমি আমার লোকদের সাথে যোগ দেয়ামাত্র তাকে আমার সামনে হাজির করবে।”
বাবরের বাহিনী- দু’হাজারের বেশি হবে না সংখ্যায়- যাদের নিয়ে সে সমরকন্দ জয় করেছিলো, তাদের তুলনায় নিতান্তই জরাজীর্ণ, শোচনীয় অবস্থা এখন। তাদের পেছন পেছন আসা মৃত্যু, ব্যাধি, পলায়ন আর খাদ্যাভাব তার দায় পুরো উসুল করে নিয়েছে। আজ আর কোনো উজ্জ্বল সবুজ বা হলুদ রঙের নিশান দেখা যায় না, যা দেখে তাদের সমরকন্দ বা ফারগানার সৈন্য বলে সনাক্ত করা যাবে। অবশ্য তাদের সে পরিচয়ও এখন ঘুচে গেছে।
বাবর তার লোকদের দিকে এগিয়ে যেতে তারা নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। শহরের বাইরে পৌঁছে যাবার পরে এদের ভেতরে কতোজন নিজের লোকদের কাছে ফিরে যাবে, বা তাদের আরো ভালভাবে পুরস্কৃত করতে পারবে এমন নৃপতির সন্ধান করবে?
রোদেপোড়া মাটির উপর দিয়ে ঘোড়া নিয়ে মোটাসোটা উজবেক দূতকে সে এগিয়ে আসতে দেখে। ব্যাটা আবার কি চায়? নিজের প্রভুর পক্ষে আত্মতৃপ্তি নিয়ে তাকিয়ে দেখতে?
“তো?”
“আপনার আর আমার প্রভুর মাঝে এই নতুন সমঝোতা স্মরণীয় করে রাখতে তিনি একটা দারুণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি আপনার বোন, মহামান্য শাহজাদীকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করবেন।”
“কি?” নিজের অজান্তে বাবরের হাত তরবারির বাঁট স্পর্শ করে। এক মুহূর্তের জন্য তার ইচ্ছে করে তরমুজে লাথি দিয়ে সে যেমন রস বের করে দিয়েছিলো তেমনিভাবে হোতকা ভাড়টার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন মাথা রক্ত ছিটাতে ছিটাতে গড়াতে থাকুক।
“আমি বলতে চাইছি আমার প্রভু সাইবানি খান ঠিক করেছেন আপনার বোন খানজাদাকে নিকাহ করবেন… তিনি এখন তাকে নিয়ে যাবেন…”
“সুলতান…” বাবর বাইসানগারের আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর শুনতে পায়।
বাবর মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে লোহার দরোজার দিক থেকে গাঢ় রঙের আলখাল্লা পরিহিত অশ্বারোহী বাহিনী ধনুক প্রস্তুত অবস্থায় ধেয়ে আসছে। নিমেষের ভেতরে বাবর আর তার লোকদের তারা তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। আরেকদিক আটকে রাখে শহরের পোক্ত দেয়াল। একটা ফাঁদ…
“এই তাহলে সাইবানি খানের কথা রাখার নমুনা…” বাবর ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে দূতকেও টেনে নামায় এবং লোকটার নধর গলায় খঞ্জর চেপে ধরে। উজবেক পাঠাটার গায়ে অসুরের মত শক্তি। সে তার বেষ্টনী থেকে ছুটতে চেষ্টা করে কিন্তু বাবরের হাতের খঞ্জরের ফলা তার চামড়া কেটে বসে। ঘন লাল রক্তের বিন্দু ক্ষতস্থানে দেখা দিতে তার লাফালাফি বন্ধ হয়।
“আমার প্রভু মোটেই ওয়াদার বরখেলাপ করেননি।” দূত ব্যাটা হাঁসফাস করে বলে। “তিনি আপনাকে নিরাপদে যেতে দেবেন বলে ওয়াদা করেছেন এবং আপনি। তাই যাবেন। তিনি কেবল নিজের জন্য একটা স্ত্রী খুঁজছেন।”
“কোন বর্বরের হাতে তুলে দেবার আগে আমি নিজ হাতে আমার বোনকে হত্যা করবো।” বাবর চিৎকার করে উঠে এবং দূতকে ছেড়ে দিলে সে হুড়মুড় করে। মাটিতে বসে পড়ে।
“আপনার বোনই তাহলে কেবল মারা যাবেন না।” দূত ব্যাটা পাগড়ির প্রান্ত দিয়ে গলার ক্ষতস্থান চেপে ধরে রাখে। “আপনি যদি আমার প্রভুর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, তিনি তাহলে এটাকে ব্যক্তিগত অপমান বলে মনে করবেন এবং আপনারা সবাই আপনি, আপনার পুরো পরিবার, এবং আপনার নিধিরাম সেনাবাহিনী, তাহলে বেঘোরে মারা পড়বে। আর তিনি পুরো শহর জ্বালিয়ে দিয়ে শহরের অধিবাসীদের কঙ্কালের উপরে সেটা পুনঃনির্মাণ করবেন। এখন আপনি ঠিক করেন কি করবেন…”
বাবর, নিজের আর তার লোকদের দিকে তাক করা উজবেক তীরগুলোর দিকে তাকায়। সে বাইসানগার আর বাবুরীর ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকায়। বাবর দূতকে আক্রমণ করার সাথে সাথে তরবারি কোষমুক্ত করে তারা সামনে এগিয়ে এসেছে। সে যে ক্রোধ আর অসহায়তা অনুভব করে তারই প্রতিচ্ছবি সে তাদের মুখেও দেখতে পায়। এবারও তার পছন্দের কোনো সুযোগ নেই। শত্ৰু পরিবেষ্টিত অবস্থায় আকস্মিক এক গৌরবময় যুদ্ধে নিজের লোকদের নেতৃত্ব দেয়া এক কথা, আর তাদের অর্থহীন নিষ্ঠুরতার সামনে, খেদাড়ে লোকজন বনজঙ্গল পিটিয়ে শিকারের পশু যেমন বৃত্তের মাঝে শিকারীর ইচ্ছায় মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, সেরকম পরিস্থিতির মধ্যে তাদের ফেলে দেয়া আরেক ব্যাপার।
উজবেক সারি পর্যবেক্ষণ করে বাবর সাইবানি খানের কর্তৃত্বপূর্ণ অবয়বটা খুঁজতে চেষ্টা করে। তাকে দ্বৈরথে আমন্ত্রণের এক বুনো ভাবনা তার মনে খেলা করতে থাকে। অবশ্য উজবেক নেতাকে সেখানে কোথাও দেখা যায় নাঃ তিনি এখন সমরকন্দে প্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সালতানাহীন কোনো সুলতানের সাথে সাক্ষাৎ করাটা তার জন্য এখন অসম্মানের ব্যাপার। দু’শো গজ দূরে দাঁড়িয়ে থাকা গরুর গাড়ির দিকে বাবর হেঁটে যায়। যেখানে এসব ঘটনা সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ তার আদরের আম্মিজান আর নানীজানের সাথে বসে রয়েছে। সে এক মুহূর্ত ইতস্তত করে তারপরে চামড়ার ঝালর সরায় যা তাদের আড়াল করে রেখেছে। আতঙ্কিত চোখে তিনজন তার দিকে তাকায়। তারপরে, সে যা বলতে এসেছে সেটা শোনার পরে অবিশ্বাসে তারা চিৎকার করে উঠে। চোখে টলটল করতে থাকা অশ্রু নিয়ে সে ঘুরে দাঁড়ায়। কিন্তু অসভ্য উজবেকের কামনার কাছে তাকে বলি না দেবার জন্য খানজাদার আকুতি আর মেয়েকে বখশ দেবার জন্য আম্মিজান খুতলাঘ নিগারের কান্না তাকে বেত্রাহত কুকুরের মতো তাড়িয়ে নিয়ে যায়। “খানজাদা, কথা দিচ্ছি আমি তোমাকে নিতে আসবো। আমি ওয়াদা করছি…আমি আসবোই…” বাবর কাঁদতে কাঁদতে চেঁচিয়ে উঠে বলে। কিন্তু এসব কিছুই খানজাদা শুনতে পায় না।