বছরের প্রথম দিনটি ভালো মন্দ খাওয়ার কথা, কিন্তু আজ দুপুরে ভাতের বদলে রুটি। বাড়িতে এক দানা চাল নেই, বাজারেও কোথাও চাল নেই। রেশানের দোকানে সপ্তাহে মাথা পিছু মাত্র তিন শো গ্রাম চাল বরাদ্দ, ভবানীপুর কালীঘাট অঞ্চলে কোনো রেশানের দোকান দু’সপ্তাহ ধরে সেই চালটুকুও দিতে পারছে না। তাদের স্টক আসেনি। তারা চালের বদলে গম দিচ্ছে।
প্রতাপ নিজে সকালে চাল খুঁজতে গিয়েছিলেন, জগুবাবুর বাজারের কথা আগেই জানা ছিল, আজ গেলেন লেক মার্কেটে, সব মুদি দোকানের মালিকই চালের কথা শুনলে গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়ে। অথচ প্রতাপ খবরের কাগজে পড়েছেন, কালোবাজারে চালের দাম এখন দু’টাকা কিলো। কোথায় সেই কালোবাজার, কী ভাবে সেখানে ঢুকতে হয়? দু’টাকা দরে সেই চাল কিনে কারা খায়?
দুটাকা কিলো দাম শুনলেই মাথাটা গরম হয়ে যায়! এই কলকাতা শহরেই সাত-আট টাকা মন দরে চাল কেনার স্মৃতি এখনও অনেকের মন থেকে মুছে যায় নি। এখন একজন কেরানি বা ইস্কুল মাস্টারের মাস মাইনে দেড় শো টাকা, তার যদি চার পাঁচ জনের সংসার হয় তা হলে দু’টাকা কিলো দরে চাল কিনে তারপর সে বাড়িভাড়া, জামা-কাপড়, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া এসবের খরচ জোগাবে কী করে? সাতচল্লিশ থেকে সাতষট্টি, স্বাধীনতা এবার কুড়ি বছরে পা দিল, আজও এই স্বাধীনতা দেশের মানুষকে শুধু দুবেলা দুমুঠো ভাতের ব্যবস্থা করে দিতে পারলো না? স্বাধীনতার জন্য দেশের মানুষ সব রকম কষ্ট স্বীকার করতে পারে। কিন্তু সে কষ্ট স্বীকারের মধ্যে একটা গৌরব বোধ থাকা চাই। কিন্তু এখন কিসের গৌরব, কিসের জন্য কষ্ট স্বীকার? অপদার্থ সরকার চালাচ্ছে এই দেশ, সব কিছুরই এখন কালোবাজার, এক শ্রেণীর মানুষের হাতে প্রচুর পয়সা, আর দরিদ্ররা হচ্ছে দরিদ্রতর। সরকার লোককে সপ্তাহে তিন শো গ্রাম. চাল খেয়ে সন্তুষ্ট থাকতে বলছে, তাও প্রতিশ্রুতি মতো রেশানের দোকান থেকে সে চালটুকুও দিতে পারছে না। কিন্তু যার পয়সার গরম আছে সে পার্ক স্ট্রিট চৌরঙ্গির হোটেল রেস্তোরাঁয় প্রতিদিন দু’বেলাই ফ্রায়েড রাইস-বিরিয়ানি-পোলাউ খেতে পারে। দু’টাকা কিলো দরেও তো কালোবাজার থেকে চাল কেনার লোক আসছে!
বাজারের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে প্রতাপের মনে পড়লো, কয়েকদিন আগে তিনি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইণ্ডিয়ার একটি বুলেটিন দেখেছিলেন। তাতে স্বীকার করা হয়েছে যে এ দেশের সাড়ে বারো কোটি মানুষ একদিন অন্তর একদিন খেতে পায়, আর দু’কোটি চল্লিশ লক্ষ লোক শুধু একবেলার খাবার টুকু কোনোক্রমে জোটাতে পারে। এই লোকগুলো একদিন অন্তর একদিন বা রোজ একবেলা ভাত-রুটি খায় না বজরার দানা খায়, তা অবশ্য বলা হয়নি।
বাজারে ঘুরতে গেলেও মেজাজ ঠিক রাখা শক্ত। সব কিছুরই আগুন দাম। মাছের বাজারে তো ঢোকারই উপায় নেই।
বেশ কিছুদিন ধরেই প্রতাপ একবেলা রুটি খেতে বাধ্য হয়েছেন। গত দু’সপ্তাহ ধরে দু’বেলাই রুটি। আজ ছুটির দিন, আজও দুপুরে একটু তৃপ্তি করে ভাত খাওয়া যাবে না? ছুটির দিনে ছেলে মেয়েদের সঙ্গে একসঙ্গে বসে খাওয়া হয়, প্রতাপ নিজেও যেমন রুটি পছন্দ করেন না, ছেলেমেয়েরাও রুটি ভালোবাসে না।
প্রতাপ শুধু বাজারে চক্কর দিচ্ছেন, কিছুই কেনা হচ্ছে না। তাঁর দু’চোখে ঝলসাচ্ছে রাগ, কার ওপর এই রাগ? আদালতে প্রতাপ যখন বিচারকের আসনে বসেন, তখন আসামীর চোখে তিনি বিচ্ছুরিত ক্রোধ দেখেছেন, যেন বিনাদোষে তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। আদালতের বাইরে, আজকাল প্রতাপ প্রায়ই অনুভব করেন, তিনি নিজেই যেন ঐ রকম একজন আসামী।
কাটাপোনা, ভেটকি মাছের দাম লাফিয়ে উঠেছে, সাত টাকায়। অথচ মাছের বাজারে ভিড় তো কম নয়, এই দামেও মাছ কেনার লোক আছে। প্রতাপ ওদিকে গেলেন না। এক জোড়া মুর্গীর ডিম চাইছে ছাপ্পান্ন পয়সা। লোকটার কি চোখের চামড়া নেই? এই সেদিনও চার আনায় এক জোড়া পাওয়া যেত। শীতের সময় কড়াইশুটি, ফুলকপি শস্তা হবার কথা, তাও ডবল দাম, কড়াই শুটি তো এ বছর দেড় টাকায় চড়ে বসে আছে! চালের দাম বাড়লে সব কিছুরই দাম বাড়ে।
প্রতাপ আবার ফিরে গেলেন মাছের বাজারে। তিনি কিছুতেই বেশি পয়সা খরচ করবেন না। আজকাল এক রকম নতুন মাছ উঠেছে, তার নাম তেলাপিয়া, কেউ কেউ বলে আমেরিকান কই। আমেরিকানরা জাহাজ ভর্তি করে গম পাঠাচ্ছে, সেই সঙ্গে তারা মাছও এ পাঠাচ্ছে নাকি? খাঁটি কলকাতার লোকেরা মাছের ব্যাপারে খুঁতখুঁতে, বাঙালরাও সমুদ্রের মাছ, কিংবা অচেনা মাছ চট করে ঢোকাতে চায় না রান্না ঘরে, সেইজন্যই এই তেলাপিয়া বা আমেরিকান কইয়ের দাম এখনও বেশ শস্তা। কয়েকদিন আগে ছিল দেড় টাকা কিলো, আজ চাইছে এক টাকা পঁচাত্তর পয়সা। প্রতাপ এই মাছ দু’একবার খেয়ে দেখেছেন, একটু কাদা কাদা গন্ধ, তাও চলে যায়। মাছটার প্রধান গুণ, কই মাছের মতনই জ্যান্ত থাকে। রুটিই যদি খেতে হয়, তা হলে এই শস্তার মাছই যথেষ্ট।
বাজার থেকে বাড়ি ফিরে প্রতাপ দেখলেন তাঁর মামাতো ভাই অনিরুদ্ধ আর তার বউ জয়ন্তী বসে আছে তাঁর জন্য। সেই একবার ভন্তু মামার অসুখের খবর পেয়ে প্রতাপ একবার তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন টালিগঞ্জে, তারপর আর যোগাযোগ নেই। ওঁদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতেও আগ্রহী নন প্রতাপ। তবে অনিরুদ্ধর স্ত্রী জয়ন্তীকে তাঁর বেশ ভালো লেগেছিল, সে এককালে পিকলুর ছাত্রী ছিল! এর হৃদয়ের কোনো একটা জায়গায় পিকলুর স্মৃতি আছে।
মমতা ওদের চা-মিষ্টি দিয়েছেন। মমতা কি জানে, এই যে জয়ন্তী, এই আর একজন, যে পিকলুকে মনে রেখেছে? মমতা বেশ হেসে হেসে গল্প করছেন ওদের সঙ্গে, ওদের বাড়ির খবরাখবর নিচ্ছেন, এই সময় প্রতাপ আর পিকলুর কথা তুলতে চাইলেন না।
ওদের দেখে প্রতাপের আরও একটা কথা মনে পড়লো। ওদের বাড়ির ছাদ থেকে বুলাদের বাড়ি দেখা যায়। প্রতাপের আর যাওয়া হয়নি ওদিকে, কেমন আছে বুলা কে জানে। খবরের কাগজে মাঝে মাঝে সত্যেন রায়ের নাম চোখে পড়ে।
অনিরুদ্ধ বললো, খোকনদা, আমার ছোট বোনের বিয়ে, বড় কাকা বিশেষ করে বলে দিয়েছেন, আপনাকে অবশ্যই যেতে হবে। বড়কাকা নিজে আসতে পারলেন না…বৌদি কথা দিয়েছেন যে উনি যাবেন, বৌদি আমাদের নতুন বাসায় একবারও আসেন নি…
মমতার দিকে এক পলক তাকিয়ে প্রতাপ হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিলেন, পড়তে লাগলেন। …‘কুমিল্লার ব্রাহ্মণবাড়িয়া গ্রাম নিবাসী, অধুনা কলিকাতার উপকণ্ঠে টালিগঞ্জের অধিবাসী মমাগ্রজ স্বর্গীয় নকুলেশ্বর ঘোষের কন্যা শ্রীযুক্তা সুচরিতার সহিত ফরিদপুরের মাদারিপুর মহকুমার ধূয়াসার গ্রামের রায় বংশের সুযোগ্য সন্তান শ্ৰীমান নিরঞ্জনের…’
হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলেন প্রতাপ, অন্য সবাই সচকিত হয়ে তাকালো।
প্রতাপ অনিরুদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন, তোর ছোট বোনের বয়েস কত? সে কখনন ব্রাহ্মণবাড়িয়া চোখে দেখেছে? সে পূর্ববঙ্গে গেছে কখনো? তোরা তো ফরটি সেভেনেই দেশ ছেড়ে এসেছিস।
অনিরুদ্ধ বললো না, ফর্টি নাইনে, আমার ছোট বোন এখানে আসার পরেই জন্মায়, ওর ঠিক আঠেরো বছর হলো।
–আঠেরো বছর কি কম সময়? তোর বড় কাকা লিখেছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিবাসী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সেই বাড়ি তোদর আছে এখনও?
–তা নেই অবশ্য!
তা হলে? এখনও ব্রাহ্মণবাড়িয়া আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে? তোদের টালিগঞ্জের বাড়িটাকে তুই বললি, ‘আমাদের বাসা’, যেন ওটা টেমপোরারি অ্যাবোড, ব্রাহ্মণবাড়িয়াই আসল।
–চিঠিতে তো এই রকমই বয়ান লেখে সবাই।
–পাত্র পক্ষও তো দেখছি ফরিদপুরের! যত সব গাঁজাখুরি ব্যাপার। কবে চুকে বুকে গেছে ওসব সম্পর্ক, এখন খবরের কাগজে পুর্ব বাংলার কোনো খবরই থাকে না দিনের পর দিন, এতদিনে ওরা আর আমরা সত্যিকারের আলাদা হয়ে গেছি, মুখ দেখাদেখি বন্ধ! আমাদের ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে, তাদের কাছে মাদারিপুর ব্রাহ্মণবাড়িয়া এইসব নামের কী মর্ম আছে?
জয়ন্তী বললো, নস্টালজিয়া! আমাদের বাড়িতে তো প্রায় প্রত্যেকদিনই দেশের বাড়ির গল্প হয়। আমার শাশুড়িতে প্রায় সব কিছুর সঙ্গেই, এমনকি লাউ-কুমড়ো-বেগুনের সঙ্গেও তুলনা দিয়ে বলেন, ওখানে এইসব জিনিসই বেশি ভালো ছিল।
মমতা প্রতাপকে একটু খোঁচা দিয়ে বললেন, তোমার মুখ দিয়েও তো মাঝে মাঝেই এ রকম কথা বেরিয়ে পড়ে। কালকেই না তুমি একবার বললে, ঢাকার মরণচাঁদের দোকানের দই-এর স্বাদ এখানকার চেয়ে অনেক ভালো?
প্রতাপ বললেন, তা বলে আমি আমার ছেলেমেয়ের বিয়ের সময় চিঠিতে মালখানগর নিবাসী লিখবো না!
–আহা, ওরা চিঠিতে লিখেছে লিখেছে, তা নিয়ে তুমি অত রাগারাগি করছো কেন?
–না, না, রাগারাগি করছি না, এমনিই বললাম। এ রকম লেখা খানিকটা ইলিগ্যালও বটে, ইণ্ডিয়ার সিটিজেন হয়ে তুমি যদি বলো পাকিস্তান নিবাসী…যাক গে, ওটা টেকনিক্যাল ব্যাপার, ঐ নিয়ে অবশ্য কেউ মাথা ঘামাতে আসবে না…হ্যাঁরে তোরা কত লোক নেমন্তন্ন করেছিস? এই দুর্দিনের বাজারে বেশি লোককে খাওয়ানো…চিনি পাওয়া যায় না, চাল পাওয়া যায় না।
অনিরুদ্ধ উঠে দাঁড়িয়ে বললল, ওসব ম্যানেজ হয়ে গেছে, তিন মন খুব ফাইন রাইস স্টক করে রেখেছি, চিনিরও ব্যবস্থা হয়ে গেছে…আমরা চলি খোকনদা, আরও অনেক জায়গায় যেতে হবে…আপনারা সেদিন সকালেই যাবেন কিন্তু, গাড়ি দেবো…গাড়ি পাঠিয়ে দেবো…
ওদের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসে প্রতাপ মমতাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এই বিয়েতে যেতে রাজি হয়েছে?
–ওরা এমন ভাবে বললো।
–তিন মন চাল স্টক করেছে।
–সবাই কি আর তোমার মতন হাকিমী বুদ্ধি নিয়ে সূক্ষ্ম আইনের চুল চেরা বিচার করে, না মাথা ঘামায়। এই বাজারে অনেকেই চাল জমায়। পাশের বাড়ির মিসেস মুখার্জি দুটো বড় বড় মাটির জালা কিনেছেন, প্রত্যেক সপ্তাহে বর্ধমানে গিয়ে চাল কিনে আনেন।
–আমাদের জন্য গাড়ি পাঠাবে বললো। যেন আমরা ট্রামে। বাসে যেতে পারি না। ওদের যে গাড়ি আছে, সেটা জানানোই আসল উদ্দেশ্য। জানো তো, এই যে নন্তু মামা, ভন্তু মামা, এরা আমার মায়ের আপন ভাই নয়, ওদের অবস্থা বিশেষ ভালো ছিল না। আমার বাবার কাছে এসে কাচুমাচু হয়ে বসে থাকতো, ওদের ছেলেমেয়েরা কেউ বিশেষ লেখাপড়া শেখেনি, কী সব কন্ট্রাক্টারি করে বড়লোক হয়েছে। আমরা এখন ওদের গরিব আত্মীয়। তবু আমাদের ডাকাডাকি করে কেন জানোনা, নিজেরা যে বাড়ি গাড়ি করেছে, সে সব গরিব আত্মীয়দের না দেখাতে পারলে ঠিক সুখ হয় না। ভন্তু মামা আমার সঙ্গে পিঠ চাপড়ানির সুরে কথা বলে। একদিন বলেছিলেন, কি রে, খোকন, তুই কলকাতায় এক টুকরো জমি নিজে রাখতে পারলি না? আমি কি টাকা পয়সা চুরি করি যে জমি কিনবো, বাড়ি বানাবো?
–আহা, এ কথার কোন মানে হয় না। যারা মাথা গোঁজবার জন্য একটা বাড়ি বানাচ্ছে, তারা সবাই চোর?
–যারা বাঁধা মাইনের চাকরি করে, চুরি জোচ্চুরি না করলে তাদের পক্ষে এই বাজারে বাড়ি বানানো সম্ভব? আর পাঁচ ছ’বছরের ব্যবসাতেই বা কী করে এত লাভ হয় যাতে তিনতলা বাড়ি, গাড়ি…হুঁ, একে ব্যবসা বলে না! বাড়িতে তিন মন চাল স্টক করেছে।
মমতা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, ঐ চালের ব্যাপারটাই তোমার খুব মনে লেগেছে না? নিজে চেষ্টা চরিত্র করবে না আমার বাবা রুটি খেতে এমন কিছু কষ্ট হয়ে না…তোমরা এখনো ভেতো বাঙালী রয়ে গেলে।
–ঐ বিয়েতে আমি যাবো না। তোমার ইচ্ছে হলে যেতে পারো! আবার উপহার কেনার জন্য একগাদা টাকা খরচ!
একটুবাদেই এলেন বিমানবিহারী। গাড়ি থেকে নেমেই হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকে বললেন, বাবলু কোথায়? সে কি খেলা দেখতে গেছে?
বাবলু বেরিয়ে গেছে সকালেই, সে খেলা দেখতে গেছে কি না তা বলে যায়নি। প্রতাপ জিজ্ঞেস করলেন, কেন, কী হয়েছে?
রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বিমানবিহারী বললেন, আজ ক্রিকেট খেলার মাঠে সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড হয়েছে। আমাকে আমার ভায়রা একটা টিকিট পাঠিয়ে দিয়েছিল, এই খেলায় টিকিটের জন্য এত হাহাকার, তাই ভাবলুম টিকিটটা নষ্ট করি কেন, দেখেই আসি। আরে ভাই, খেলা দেখতে গিয়ে প্রাণটা যাবার জোগাড়।
–হাঙ্গামা হয়েছে বুঝি।
–হাঙ্গামা মানে, এ রকম কেউ কখনো দেখেইনি! ওয়েস্ট ইণ্ডিজের সঙ্গে খেলা, সে খেলা তো ঠিক মতন শুরু হতেই পারলো না, একদল লোক জোর করে হুড়হুড়িয়ে ঢুকে পড়লো মাঠে, পুলিশ তাদের ওপরে লাঠি চালাতেই বেঁধে গেল ধুন্ধুমার কাণ্ড। দর্শকরাও ইঁট মারতে লাগলো পুলিশের দিকে, মাথার ওপরে যে চাঁদোয়াগুলো ছিল, তাতে আগুন ধরিয়ে দিল, পুলিশ তখন ছুঁড়তে লাগলো টিয়ার গ্যাস, তারপর যে হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেল, বুঝলে আমি ভাবলুম সেই কুম্ভমেলার স্ট্যামপিডের ঘটনা না ঘটে যায়। ভেবে দ্যাখো তুমি, হাজার হাজার লোক বসে আছে, সেদিকে কখনো টিয়ার গ্যাস ছোঁড়ে? আমি তো একবার ভাবলুম, মরেই যাব বুঝি। আমার চেনা এক ভদ্রলোক, সীতেশ রায়, তিনি নিজে রিস্ক নিয়ে দৌড়ে পুলিশের সামনে গিয়ে হাত জোড় করে বললেন, টিয়ার গ্যাস ছোঁড়া থামাতে, আমাদের সবার চোখের সামনে পুলিশ তাকে লাঠি পেটা করে শুইয়ে দিল। তাঁর কী অবস্থা এখন কে জানে! এ কি পুলিশ না নাৎসী বাহিনী?
প্রতাপ বললেন, বাবলুটা যায়নি তো খেলার মাঠে? মমতাকে জিজ্ঞেস করছি।
মমতা এসেও কিছু বলতে পারলেন না। খেলা দেখতে যাওয়ার কথা বাবলু কিছু জানায়নি, তবে দু’একদিন আগে ওয়েস্ট ইণ্ডিজের সঙ্গে এই টেস্ট খেলার টিকিট বিষয়ে আলোচনা করছিল।
বিমানবিহারী বিললেন, কী কেলেঙ্কারি ব্যাপার জানো, সোবার্স, কানহাই, ক্লাইভ লয়েডের মতন বিশ্ববিখ্যাত খেলোয়াড়, তাদেরও দেখলাম ভয় পেয়ে ময়দান দিয়ে ছুটতে। ইণ্ডিয়ার ক্যাপ্টেন পতৌদিও নাকি কিছুটা ইঞ্জিওর হয়েছেন। কী লজ্জার কথা। স্টেডিয়ামের চারদিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল।
প্রতাপ জিজ্ঞেস করলেন, গণ্ডগোলটা শুরু হলো কী ভাবে?
–আসল ব্যাপার যা মনে হচ্ছে, ঐ ইনকমপ্লিট স্টেডিয়ামে ষাট হাজার সীট, টিকিট বিক্রি করেছে অনেক বেশি…যে সব দর্শক জোর করে ঢুকেছে, তাদের অনেকেরই হাতে নাকি টিকিট ছিল…কতটা দুর্নীতি ভেবে দ্যাখো, কয়েক হাজার একস্ট্রা টিকিট বিক্রি করে বসে আছে…আর দর্শকদেরও দেখলুম পুলিশকে একটুও ভয় পায় না, সবাই ক্ষেপে আছে যেন, এ রকম আগে দেখিনি কখনো, শেষ পর্যন্ত মাঠে আর্মি নামাতে হয়েছে।
মমতার মুখে একটা কালো ছায়া পড়েছে। তিনি আস্তে আস্তে বললেন, বাবলুটা…কখন কোথায় যায়, কিছু বলে না।
বিমানবিহারী বললেন, চিন্তা করবেন না, দুপুরে ফিরবে নিশ্চয়ই। বছরের প্রথম দিনটাই এই ভাবে শুরু হলো। এমনিতেই তো গণ্ডগোল লেগেই আছে। প্রেসিডেন্সি কলেজে স্ট্রাইক চলছে কয়েক মাস ধরে, ট্রাম স্ট্রাইক, প্রায় কুড়ি বাইশ দিন ট্রাম চলছে না, কাল বিকেলে আমাদের বাড়ির সামনে হঠাৎ একটা মারামারি শুরু হয়ে গেল…লোকজন একেবারে ক্ষেপে আছে যেন।
প্রতাপ বললেন, আসল কারণটা হলো চাল। লোকে ভাত খেতে পাচ্ছে না, তাই সব সময় মনে মনে গজরাচ্ছে, যে-কোনো একটা উপলক্ষ পেলেই ফেটে পড়ছে।
বিমানবিহারী খানিকটা অবাক হয়ে বললেন, চাল? চাল, পাওয়া যাচ্ছে না বুঝি?
প্রতাপ বললেন, তুমি তো বাড়ির কোনো খবরই রাখো না। তোমার গিন্নীই সব দিক সামলান, দু’বেলা ভাত খেতে পাচ্ছো?
–আমি বরাবরই রাত্তিরে পরোটা খাই। চাল-হ্যাঁ, আমাদের চাল তো কৃষ্ণনগর থেকে আসে, নিজেদের জমির চাল।
–বাইরে থেকে কলকাতায় চাল আনা বে-আইনী নয়? করডনিং সিস্টেম যখন চালু আছে।
–বে-আইনী নাকি? কোনোদিন তো কেউ কিছু বলেনি? কতটা বে-আইনী জেলে টেলে যেতে হবে নাকি?
বিমানবিহারী হাসতে লাগলেন। মমতা ভুভঙ্গি করলেন প্রতাপের দিকে তাকিয়ে। চালের
অভাব থাকলেও তাঁদের চেনাশুনো সকলেই এখনো ভাত খায়। কোর্টে যেন আর কেউ চাকরি করে না, তারা সকলেই কি আইন মেনে ভাতের বদলে রুটি খাচ্ছে?
প্রতাপও হাসলেন। আজ সকালে বাজারে ঘোরার সময় তাঁর নিজেরও একবার কালোবাজার থেকে চাল কেনার ইচ্ছে হয়েছিল। অন্তত শুধু এই ফাস্ট জানুয়ারি দিনটায়…কিন্তু কোথায় সেই কালোবাজারের চাল, তার সন্ধানই তিনি পাননি।
বিমানবিহারী বললেন, এরা দেশটা চালাতে পারছে না। রোজই রাস্তায় রাস্তায় মিছিল…একটা বিদেশী টিম খেলতে এসেছে, সেটা যাতে ঠিক ঠাক হয় সেটুকু দেখারও যোগ্যতা নেই।
প্রতাপ বললেন, অপদার্থ! অপদার্থ! সামনেই আবার ইলেকশন, এরা ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে : কথা বলে ভোট চাইবে। খেলার মাঠে মিলিটারি নামাতে হয় যাদের…
–কাকেই বা ভোট দেবে। অপোজিশান পার্টি বলে তো কিছু নেই। দুটো স্ট্রং প্যারালাল পার্টি না থাকলে ডেমোক্রেসি কখনো ফাংশান করতে পারে? ইংল্যান্ডে লেবার পার্টি আছে, আর আমাদের এখানে কম্যুনিস্ট পার্টি যাও বা ছিল, এখন দু’ভাগ হয়ে গিয়ে ঝগড়া করছে নিজেদের মধ্যে, তার ওপরে আছে বলশেভিক পার্টি, আর সি পি আই, আর এস পি, এস ইউ সি, এরা সবাই নাকি মার্কসিস্ট, অথচ আলাদা আলাদা। আর ঐ অজয় মুখার্জির বাংলা কংগ্রেস, আমি বলে রাখছি তোমাকে, ইলেকশনের পর বাংলা কংগ্রেস আবার কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আমে-দুধে মিশে যাবে। জ্যোতি বসুকে সারা জীবন ঐ বিরোধী দলের নেতা হয়েই থাকতে হবে, দেখো!
–অতুল্য ঘোষ থাকতে আর কারুর ইলেকশানে জেতার আশা নেই, তা জানি। এই ইলেকশনের ওপর আমার ঘেন্না ধরে গেছে।
বিমানবিহারী মুখ তুলে মমতার দিকে তাকিয়ে বললেন, বৌদি, কী রান্না করেছেন? আজ আপনার বাড়িতে খেয়ে যাবো। নিজের বাড়িতে আমার খাওয়া নেই, ওরা তো জানে আমি খেলা দেখে বিকেলে ফিরবো!
প্রতাপের হঠাৎ যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। বিমানবিহারী এ বাড়িতে আসেন কদাচিৎ। বন্ধু হলেও তিনি এ বাড়িতে বিশিষ্ট অতিথি। তিনি নিজের মুখে খেতে চেয়েছেন। অথচ আজই বাড়িতে তেলাপিয়া মাছ! অন্য অনেক ছুটির দিনে মাংস রান্না হয়, আজ প্রতাপ রাগ করে…এখনও মাংস কিনে এনে চাপালে…না, তা সম্ভব নয়, কালীঘাট থেকে পাঞ্জাবী দোকানের কষা মাংস যদি আনানো যায়।
মমতারও মুখখানা লাল হয়ে গেছে। তাঁর স্বামীর কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই, ছুটির দিনে দু’একজন লোক তো এসে পড়তেই পারে, মাংসের বদলে তবু যদি একটা ভালো মাছ থাকতো।
জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে মমতা বললেন, আপনি খাবেন…আজ কিন্তু আমাদের ভাত হয়নি, আমরা সরকারের সব নিয়ম কানুন মেনে চলি তো, তাই আমরা রুটি খাই!
বিমানবিহারী বললেন, রুটি খেতে আমার একটুও আপত্তি নেই। আপনার হাতের রান্না-আপনি যা দেবেন, তাই-ই খাবো!
মমতা স্বামীর দিকে একটা দুঃখের দৃষ্টি ছুঁড়ে দিলেন।
প্রতাপ তখন দ্রুত চিন্তা করে যাচ্ছেন, পাঞ্জাবী দোকানের কষা মাংস কাকে দিয়ে আনানো যায়। বাবলুটাকে তো দরকারের সময় কিছুতেই পাওয়া যাবে না, বাড়িতে কোনো চাকরবাকর নেই, বিমানবিহারীকে বসিয়ে রেখে এখন প্রতাপ বেরিয়ে যেতে পারবেন না, একমাত্র মুন্নিকে যদি পাঠানো যায়…
বাথরুমে যাবার নাম করে প্রতাপ একবার ভেতরে গেলেন। মুন্নি বাড়িতে নেই। সে তো আজ বোটানিক্যাল গার্ডেনসে বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিকে গেছে, আগে থেকেই ঠিক ছিল। টুনটুনি আছে, কিন্তু সে এখনও একা একা বাইরে বেরুতে শেখেনি, সে পারবে না। প্রতাপের নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছে হলো।
রান্না ঘরে উঁকি দিয়ে তিনি গম্ভীর ভাবে মমতাকে বললেন, যা আছে, তাই-ই দাও! এক কাজ করো, বিমানরা এমনি রুটি খায় না, তুমি রুটি সেঁকবার সময় একটু ঘি মাখিয়ে দাও ওপরে।
মুখ না ফিরিয়েই মমতা বললেন, ঘি ফুরিয়ে গেছে!
ভবদেব মজুমদারের ছেলে প্রতাপ মজুমদার বাড়িতে একজন অতিথি খাওয়ানোর ব্যাপারে জীবনে এত লজ্জা পাননি। তাঁদের বাড়িতে বারো মাস দীয়তাং ভুজ্যতাং লেগে থাকতো। ভবদেব মজুমদার প্রায় প্রতিদিনই দুএকজন আত্মীয় বা বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে খেতে বসতেন।
বিমানবিহারী হাত ধুয়ে বসলেন খেতে। প্রথমে রুটির সঙ্গে ছোলার ডাল আর আল বাঁধাকপির তরকারি। তাই খেয়েই আহা-হা করতে লাগলেন বিমানবিহারী, মমতার রান্নার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। প্রতাপ আড়ষ্টভাবে তাকিয়ে আছেন, তাঁর গলা দিয়ে রুটি নামতে চাইছে না। তেলাপিয়া মাছ…বিমানবিহারী নিশ্চিত ঐ মাছ খান না, কোনো সচ্ছল পরিবারে ঐ মাছ ঢোকে না, ছুটির দিনের দুপুরে এ বাড়িতে আর কোনো মাছ নেই, মাংস নেই…
মমতা মাছের বাটিটা আনতে যেতেই প্রতাপ ঠিক করলেন বিমানকে তেলাপিয়া মাছের উপকারিতা বুঝিয়ে বলবেন। সব সময় জ্যান্ত পাওয়া যায়, কই মাছের সাবসটিটিউট, প্রোটিনে ভর্তি, অ্যামেরিকানরা দু’তিনরকম মাছের ক্রস ব্ৰীড় করিয়ে এই মাছ…
হঠাৎ অন্য একটা উপলব্ধিতে প্রতাপের মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি হেরে যাচ্ছেন। দারিদ্র্য লুকোবার চেষ্টাটাই আসল মানসিক দারিদ্র্যের লক্ষণ। তিনি নিজে বাড়িতে যা খান, সেই খাবার একজন বন্ধুকে খাওয়ানোতে লজ্জা কিসের।
মমতা মাছের বাটিটা টেবিলের ওপর রাখতেই প্রতাপ বললেন, বিমান, তুমি তেলাপিয়া মাছ কখনো খাওনি বোধ হয়? দ্যাখো একটু টেস্ট করে খেতে পারো কি না। আমাদের বাড়িতে এখন কিছুদিন অস্টারিটি চলছে, তুতুল চলে গেল তো, অনেক খরচপত্র হয়েছে, তাই আমরা এখন শস্তার মাছ খাই।
বিমানবিহারী খুব আগ্রহ দেখিয়ে বললেন, তেলাপিয়া? নামটাই শুনেছি, আমাদের বাড়িতে কখনো আনে না কেন কে জানে! দেখি, দেখি তো…
একটা মাছ ভেঙে খানিকটা মুখে দিয়ে তিনি বললেন, বাঃ, স্বাদ তো বেশ ভালোই, সর্ষেবাটা দিয়ে রান্নাও ভালো হয়েছে, এই মাছ শস্তা বুঝি?
বন্ধুকে চেনেন প্রতাপ, খারাপ লাগলেও ঐ মাছ খেয়ে যাবেন বিমানবিহারী, অন্তত বমি না পেলে ফেলবেন না। বিমানবিহারীরর ভদ্রতা অতি সূক্ষ্ম ধরনের।
বিমানবিহারী বললেন, বৌঠান, আপনিও আমাদের সঙ্গে বসে গেলে পারতেন। এবারে বসে পড়ুন। বেলা অনেক হলো।
মমতা বললেন, বাবলু এখনও এলো না, খেলা দেখতে গেলেও খেলা তো ভেঙে গেছে, তা হলে বাড়িতে আসবে না কেন?
প্রতাপ জিজ্ঞেস করলেন, দুপুরে কি খেতে আসবে বলেছিল? মমতা বললেন, খেতে আসবে না, সে রকম তো কিছু বলে যায়নি! সকালে বেরুলে দুপুরে তো খেতে আসে।
বিমানবিহারী বললেন, খেলার মাঠে গেলে একটু চিন্তারই ব্যাপার আছে। পুলিশ এমন পিটিয়েছে, কতজনের যে হাত-পা ভেঙেছে ঠিক নেই।
মমতা বললেন, বাবলুর একটু খোঁজ নেবে না?
প্রতাপ বললেন, কোথায় খোঁজ নেবো? আজ তো সব ছুটি, কোথায় সে টো-টো করে ঘুরছে।
মমতা বললেন, ওর বন্ধু কৌশিক, দু’জনে সব সময় এক সঙ্গে থাকে, কৌশিকের বাড়িতে একবার খোঁজ নিলে জানা যেত।
ছেলের বন্ধুর বাড়িতে খোঁজ নিতে যাওয়ার প্রস্তাবটা প্রতাপের মনঃপূত হলো না। তিনি ভুরু কুঁচকে বললেন, দ্যাখো, একটু বাদে আসবে নিশ্চয়ই।
হঠাৎ নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সুপ্রীতি। তাঁর চোখে মুখে দারুণ উৎকণ্ঠার ছাপ। সুপ্রীতি শুয়ে শুয়ে রেডিও শুনছিলেন, এই মাত্র রেডিওতে খেলার মাঠের দুর্ঘটনার খবর শোনালো।
সুপ্রীতি বললেন,ও থোকন, তুই একবার বাবলুর খবর নিয়ে আয়। ইডেন গার্ডেনে গিয়ে দ্যাখ, আমার ভালো লাগছে না…
সুপ্রীতি যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন একটা দৃশ্য। গঙ্গার ঘাটে গোল করে দাঁড়ানো মানুষের ভিড়, তার মাঝখানে শাওয়ানো রয়েছে দুটি কিশোরের শরীর…
বিমানবিহারী পাত্র ত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো প্রতাপ আমার সঙ্গে তো গাড়ি আছে, একবার দেখে আসা যাক!