বাড়িতে কোনো বন্ধুটন্ধু এসে পড়লে তুতুলের খুব অস্বস্তি হয়। জায়গার খুব টানাটানি, তুতুলের এখনও একটা নিজস্ব ঘর নেই, তার ওপর আবার টুনটুনি এসেছে। টুনটুনির শোওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে সুপ্রীতির ঘরে, কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই সে মুন্নি আর তুতুলের ঘরে কাটায়। ছোট্ট একটা বসবার ঘর, সেখানে ছুটির দিন সকাল-বিকেল প্রতাপ বসেন, অন্যান্য দিনে সেটা থাকে বাবলু ও তার বন্ধুদের দখলে। বাবলু আবার তার বন্ধুরা এলে দরজা বন্ধ করে দেয়। এর মধ্যে তুতুলের বন্ধুরা এসে পড়লে তাদের সে বসতে দেবে কোথায়? অথচ সব বন্ধু ও সহকর্মীদের তো বলে দেওয়া যায় না যে তোমরা কেউ আমার বাড়িতে দেখা করতে এসো না।
রবিবার বিকেল চারটের সময় হাজির হলো শিখা আর হেমকান্তি। প্রতাপ ভেতরে ঘুমোচ্ছেন। বসবার ঘরে বাবলু ও তার একজন মাত্র বন্ধু। তুতুল বাধ্য হয়ে বললে, এই বাবলু, তুই তোর বন্ধুকে নিয়ে নিজের ঘরে যা না প্লীজ, আমরা এখানে একটু বসবো।
বাবলু আপত্তি করলো না, ভেতরেও গেল না, বেরিয়ে পড়লো তার বন্ধুর সঙ্গে। এরপর কখন যে সে ফিরবে, তার কোনো ঠিক নেই।
শিখা এম ডি করবে ঠিক করেছে। হেমকান্তি বর্ধমানে তার নিজের দেশে ফিরে গিয়ে প্র্যাকটিস শুরু করতে চায়। অথচ ওরা কেউ কারুকে ছেড়ে থাকতে পারবে না। শিখার বাড়ির অবস্থা সচ্ছল, আর হেমকান্তি ইস্কুল মাস্টারের ছেলে। দু’জনের মনের মিল হয়েছে বটে, কিন্তু বাস্তব অবস্থার অনেক গরমিল। প্রেমের দেবতা এইরকম গরমিলের মধ্যেও দু’জনের মনকে
জুড়ে দিয়ে কৌতুক করেন বোধহয়।
হেমকান্তি ভালো রেজাল্ট করেছে। শুধু একটা এম বি বি এস ডিগ্রি নিয়ে গ্রাম্য ডাক্তার হয়ে জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া তার পক্ষে মানায় না, কিন্তু হেমকান্তির এক কথা, বুড়ো বাপ যথাসর্বস্ব খরচ করে আমায় ডাক্তারি পড়িয়েছে, আর আমি তাঁর ঘাড় ভাঙতে পারবো না, আমায় এখন টাকা রোজগার করতে হবে। শিখা আবার চিরকালই কলকাতা শহরে মানুষ,সে গ্রামে থাকবার চিন্তাতেই শিউরে ওঠে।
এইসব বিষয়ে টুকিটাকি কথাবার্তা চলছে, এমন সময় সদর দরজার সামনে একটি গাড়ি থেকে নামলেন একজন সুসজ্জিতা পৌঢ়া মহিলা। তাকে দেখেই তুতুলের বুকটা ধক করে উঠলো। জয়দীপের মা!
হেমকান্তি উঠে দাঁড়িয়ে বললো, মাসিমা, আমি আর শিখা কিন্তু ঠিক চারটের সময় এসেছি।
জয়দীপের মা চিন্ময়ী রীতিমতন বিদুষী মহিলা, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপিকা হিসাবে রিটায়ার করেছেন মাত্র কিছুদিন আগে, মৌর্য-কুষাণ যুগ সম্পর্কে তাঁর ইংরিজিতে লেখা দু’তিনটি বই আছে। তাঁর স্বামী ধনী ব্যবসায়ী, তবু কলেজে পড়ানোর কাজ ছাড়েননি। এককালে সুন্দরী ছিলেন বেশ, হঠাৎ খুব রোগা হয়ে গেছেন দু’তিন মাসে, ব্লাউজটা কাঁধের কাছে ঢলঢলে দেখাচ্ছে। তিনি পরে এসেছেন একটা নীল পাড় সাদা সিল্কের শাড়ী। চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা।
ঘড়ি দেখে তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমার দেরি হলো, হঠাৎ দুপুরবেলা ভাবলুম, আমার এখানে আসাটা ঠিক হবে কি না। বহ্নিশিখা যদি রাগ করে…
তুতুলের মুখখানা অস্বাভাবিক ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সে যেন আটকা পড়েছে একটা ফাঁদে। শিখা-হেমকান্তিরা আজ ষড়যন্ত্র করে এখানে এসেছে। গত দেড়-দু’মাস ধরে সে একটা কথা অতি সাবধানে গোপন করে এসেছে বাড়ির সবার কাছ থেকে, এমনকি নিজের কাছেও অস্বীকার করেছে। জয়দীপের কাছ থেকে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই আসছে একটা করে চিঠি, সে চিঠি একটাও সে বাড়িতে রাখেনি। মেডিক্যাল কলেজে তাঁর খুব প্রিয় অধ্যাপক ডঃ ব্যানার্জি মাঝে মাঝে ডেকে বলছেন ঐ একই কথা, তুতুল শুধু না না বলেছে। আজ যেন হঠাৎ একটা বিস্ফোরণ ঘটবে।
তুতুল এখন পর্যন্ত চিন্ময়ীকে বসতে পর্যন্ত বলেনি, একটা সম্বোধনও করেনি। চিন্ময়ী জিজ্ঞেস করলেন,শঙ্করকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিলুম, তুমি একবারও কেন আমার সঙ্গে দেখা করলে না, বহ্নিশিখা?
তুতুল কোনো উত্তর দিল না।
চিন্ময়ী আবার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মা’র সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই, তাতে। তোমার আপত্তি আছে? তার আগে, তোমাকেই একটা কথা জিজ্ঞেস করি, সেটাই খুব ইম্পটন্টি, তুমি কি জয়দীপের কাছে কিছু প্রতিজ্ঞা করেছিলে, মানে, কিছু কথা দিয়েছিলে? সে বারবার আমাকে লিখছে…।
তুতুল এবারেও কিছু উত্তর দিতে পারলো না। সে কি বলবে? না, সে জয়দীপের কাছে কোন প্রতিজ্ঞা করেনি! জয়দীপ তার বুকের ওপর তুতুলের একটা হাত রেখে জোর করে তাকে দিয়ে একটা প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু তুতুল কিছুই উচ্চারণ করেনি নিজের মুখে।
কিন্তু জয়দীপের মাকে সে কথা সে কী করে বলবে?
হেমকান্তি বললো, হ্যাঁ, বহ্নিশিখা সেই সময় জয়দীপকে কথা দিয়েছিল, আমরা জানি। জয়দীপ সে কথা আমাদেরও বলে গেছে।
তুতুল এবারে অস্ফুটভাবে বললো, মাসিমা, আপনি বসুন।
শিখা জিজ্ঞেস করলো, আমি ভেতরে গিয়ে তোর মাকে ডেকে আনবো? সঙ্গে সঙ্গে অন্দরের দরজার কাছ থেকে টুনটুনি বললো, আমি ডেকে আনছি।
অনেক আগে থেকেই দরজার ওদিকে দাঁড়িয়ে ছিল টুনটুনি। কলকাতা এখনও তার কাছে নতুন, বাইরের মানুষজন সম্পর্কে তার খুব কৌতূহল। বাবলুর বন্ধুদের আড্ডায় দরজা খোলা থাকলেই সে এক একবার ভেতরে ঢুকে পড়ে। বাবলু তাকে ধমকে ভেতরে পাঠিয়ে দেয়। সে। আড়াল থেকে ওদের কথাবার্তা শোনে।
সুপ্রীতি দুপুরে ঘুমোন না। একটা সেলাই নিয়ে বসেছিলেন, টুনটুনির কথা শুনে আঁচলটা ভালো করে জড়িয়ে বাইরে এলেন। সুপ্রীতির শাড়ীটি আজ বড় মলিন। নাকের ওপর একটু একটু মেছেতার দাগ, পাতলা হয়ে এসেছে কপালের চুল। বাইরের ঘরে এসে এক ব্যক্তিত্বময়ী রমণীকে দেখে তিনি খানিকটা জড়োসড়ো হয়ে গেলেন।
সুপ্রীতিও এক সময় এক বনেদী বাড়ির বধূ ছিলেন, বড়লোকদের দেখে মোটেই তাঁর মধ্যে হীনমন্যতা জাগতো না। শুধু বরানগরের সরকার বাড়ির বধূ নয়, তিনি মালখানগরের ভবদেব মজুমদারের কন্যা। কিন্তু আগেকার সেই ঘাড় সোজা করে তাকানোর অভ্যেস তাঁর চলে। গেছে। অনেকগুলি বছর ধরে তিনি তাঁর ছোট ভাইয়ের সংসারে আশ্রিতা, তাঁর স্বামী তাঁকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে যেতে পারেননি, নিজের মেয়েকে নিয়ে নানা সময়ে নিদারুণ দুশ্চিন্তায় ভুগেছেন, অর্থচিন্তা তাঁকে গোপনে গোপনে কুরে কুরে খেয়েছে। আত্মসম্মান বজায় রাখার জন্য মনের সঙ্গে লড়াই করতে করতে কখন যে তিনি হার স্বীকার করে বসে আছেন, তা তিনি নিজেও জানেন না। এখন তাঁর শরীর ও মনে যেন সূর্যাস্তের পালা।
চিন্ময়ী হাত জোর করে নমস্কার জানিয়ে বললেন, আমি জয়দীপের মা। যেচে আপনার। বাড়িতে এসেছি।
শিখা নিজের জায়গাটা ছেড়ে দিয়ে বললো, মাসিমা, আপনি এখানে এসে বসুন!
বসবার আগে সুপ্রীতি বললেন, একটু চা করতে বলি? এই টুনটুনি কেটলিতে জল বসা তো!
হেমকান্তি বললো, মাসিমা, জয়দীপ আমাদের বন্ধু, ক্লাসফ্রেণ্ড, আপনি তার কথা শুনেছেন। নিশ্চয়ই বহ্নিশিখার মুখে?
সুপ্রীতি বললেন, হ্যাঁ, সে তো বিলেতে চলে গেছে, তাই নয়?
তুতুল চমকে তাকালো মায়ের দিকে। মা কী করে জানলো? সে তো মাকে জয়দীপ সম্পর্কে কোনো কথাই বলেনি! মুন্নি কিছু বলেছে? কিংবা বাবলু?
চিন্ময়ী বললেন, হ্যাঁ আমার ছেলে…
হঠাৎ তিনি থেমে গেলেন। তার চোখ শুকনো। লোকজনের সামনে অশুবর্ষণ করা তাঁর স্বভাব নয়, কিন্তু তাঁর অন্তঃকরণে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তিনি কথা বলতে পারছেন না। তাঁর মনীষা ও যুক্তিবোধ দিয়েও তিনি তাঁর অপত্যবন্ধনকে ভুলতে পারছেন না এক মুহূর্তের জন্যও। তিনি জানেন, আজ এ বাড়িতে তিনি যে-প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন তা যুক্তিহীন।
হেমকান্তি চিন্ময়ীর অসুবিধেটা বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি কথা ঘোরাবার জন্য সুপ্রীতিকে বললো, মাসিমা আমাদের প্রফেসর ডক্টর ব্যানার্জি আপনার মেয়ের সবসময় এমন প্রশংসা করেন যে আমাদের হিংসে হয়। এমন ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী উনি নাকি কখনো দেখেননি। অথচ ওর থেকে শিখার রেজাল্টও এমন কিছু খারাপ নয়।
শিখা বললো, মোটেই না, বহ্নিশিখা অনেক বেশী নম্বর পেয়েছে।
চিন্ময়ী এর মধ্যে অনেকটা সামলে নিয়েছেন। হ্যাণ্ডব্যাগ থেকে তিনি বার করেছেন রুমাল, কিন্তু রুমাল দিয়ে ভেতরের রক্তক্ষরণ মোছা যায় না।
সুপ্রীতি কোনো কথা বলছেন না নিজে থেকে। বাইরের লোকজনের সামনে সঙ্কুচিত ভাবটা কাটছে না তাঁর। অথচ এমন একদিন ছিল, যখন যে-কোনো ঘরোয়া আসরে তিনিই থাকতেন মধ্যমণি হয়ে।
চিন্ময়ী বললেন, আমার এ বাড়িতে আসার কথা ছিল অন্যভাবে। আমার ছেলেসে আপনার মেয়েকে খুব পছন্দ করে…ওরা দু’জনেই ডাক্তারি পাস করেছে, ওরা যদি চাইতো, আমি নিজে এসে আপনাকে অনুরোধ জানাতুম…
সুপ্রীতি বললেন, ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে গেলে, তাদের ইচ্ছে-অনিচ্ছেটাই বড় কথা।
ধানাই-পানাই করার বদলে সোজাসুজি কথা বলাই চিন্ময়ীর স্বভাব। তিনি সুপ্রীতির চোখের দিকে কোমল ভাবে তাকিয়ে বললেন, কিন্তু তা হবার নয়। আমার ছেলে অসুস্থ, সে আর কতদিন বাঁচে তার ঠিক নেই, এ অবস্থায় ওরকম কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
সুপ্রীতি একটু কেঁপে উঠলেন, জয়দীপের কী অসুখ হয়েছে, তুতুল তা না বললেও তিনি জানেন। তবু তিনি ধরেই রেখেছিলেন, এই সিল্কের শাড়ীপরা মহিলা তাঁর রুগ্ন ছেলের সঙ্গে তুতুলের বিয়ে দিতে চাইলে তাতে না বলার ক্ষমতা তাঁর নেই।
তিনি তুতুলের দিকে তাকালেন। তুতুল মুখ নিচু করে আছে। একটা সময় আসে, যখন ছেলে মেয়েরা পর হয়ে যায়। তুতুল এখন হয়তো এই মহিলার কথাই বেশি করে শুনবে।
চিন্ময়ী বললেন, আপনার কাছে আমি শুধু একটি অনুরোধ নিয়ে এসেছি। আমি ইংলণ্ডে যাচ্ছি আগামী মাসে, লন্ডন শহরে আমার দাদা আছেন অনেক দিন ধরে, আমার দাদাও ডাক্তার, বেলসাইজ পার্কে বেশ বড় বাড়ি, ওখানে থাকা-টাকার কোনো অসুবিধে নেই। আপনার মেয়েকে কি আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি? যদি শেষ কটা দিনে আমার ছেলেটা একটু শান্তি পায়, সে খুব করে চাইছে…অবশ্য আপনি অমত করলে…
সুপ্রীতি ফাঁকাভাবে তাকিয়ে রইলেন চিন্ময়ীর দিকে। এই মহিলার কথার অর্থ তিনি ঠিক বুঝতে পারলেন না। এর ছেলের অসুখ, লন্ডনে আছে, সেখানে তুতুল যাবে তার সেবা করতে? ঐ ছেলেটিকে বিয়ে করে, না না করে? সে আর বেশিদিন বাঁচবে না জেনেও তুতুলকে তার সঙ্গে…।
চিন্ময়ী বললেন, আপনার মেয়ের কেরিয়ার নষ্ট করে তাকে আমি নিয়ে যেতে চাই না। বহ্নিশিখার হাউস স্টাফ থাকার পীরিয়ড এখনো শেষ হয়নি আমি জানি। ওখানে গিয়েও সেটা কমপ্লিট করা যায়। তারপর ওখানে যাতে এফ আর সি এস করে আসতে পারে সে ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। ওখানে থেকে আসবে কয়েক বছর…
হেমকান্তি বললো, ডক্টর ব্যানার্জি বলেছেন, উনিই সব ব্যবস্থা করে দেবেন। মাসিমা, জয়দীপ ওখান থেকে বহ্নিশিখার নামে টিকিট পাঠিয়েছে, সব রেডি, আপনি আপত্তি করবেন না।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে সুপ্রীতি আবেগশূন্য গলায় বললেন, আমার তো আপত্তি নেই। তবে আমার ভাই, ভাইয়ের বউ, ওদের মতামত নেওয়া দরকার, ওদের একটু ডাকি?
দরজার কাছ থেকে টুনটুনি বললো, আমি ডাকছি, আমি ডাকছি।
তুতুল সবাঙ্গ দিয়ে চিৎকার করে বলতে চাইলো, না না! আমি বিলেত যেতে চাই না। সবাই মিলে আমাকে ফাঁদে ফেলছে! আমার বিলেত যাবার একটুও ইচ্ছে নেই। আমি জয়দীপের কাছে কোনো প্রতিজ্ঞা করিনি। জয়দীপের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল, তার বেশি কিছু তো নয়। জয়দীপ এখন পাগলামি করছে! হেমকান্তি যে কারণে বর্ধমানে তার গ্রামে চলে যেতে চায়, সেই কারণেই তো তুতুল তার মায়ের কাছে থাকতে চাইছে। না, না শুধু সেই কারণে নয়, মাকে ছেড়ে সে থাকতে পারবে না, সে চলে গেলে তার মা একটা অবলম্বনশূন্য লতার মতন নেতিয়ে পড়ে যাবেন, তা সে ভালো করেই জানে।
কিন্তু তুতুল মুখ দিয়ে কোনো কথাই উচ্চারণ করতে পারলো না।
প্রথমে প্রতাপ এলেন না, শুধু মমতা। তিনি বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা করলেন। সুপ্রীতির তুলনায় মমতা অনেক সপ্রতিভ। তুতুলের বিলেত যাওয়ার ব্যাপারে তাঁর পূর্ণ সম্মতি আছে.। আজকাল ডাক্তারি করতে গেলে বিলিতি ডিগ্রি না হলে চলে না। তুতুলের যখন যোগ্যতা আছে। তখন যাওয়াই তো উচিত।
প্রতাপ এসেও সেই মতই দিলেন। তবে তিনি বারংবার সুপ্রীতিকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, দিদি, তোমার কোনো অসুবিধে হবে না তো? কয়েকটা বছরের তো মাত্র ব্যাপার…
সুপ্রীতি প্রত্যেকবার জানালেন, তাঁর কোনো আপত্তি নেই।
আর তুতুলের মুখ নিচু করা মৌনই সম্মতির লক্ষণ হিসাবে ধরে নেওয়া হলো।
শেষ কথা হিসেবে প্রতাপ চিন্ময়ীকে বললেন, ঠিক আছে, আমি কালই ওর পাসপোর্টের ব্যবস্থা করছি। তবে, আপনি আপনার ছেলের পাঠানো টিকিটটা ফেরৎ দিয়ে দিন। তুতুলের টিকিটের ব্যবস্থা আমরাই করবো। ওর কিছু ফরেন এক্সচেঞ্জেরও ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমার শালা ত্রিদিব আছে গ্লাসগো শহরে, তাকে আমি লিখে দিচ্ছি।
এরকম একটা সার্থক ব্যবস্থাপনার পরেও ফেরার পথে গাড়িতে একা একা কাঁদতে লাগলেন চিন্ময়ী। শিখা আর হেমকান্তি তুতুলকে নিয়ে গেল বাইরে।
এত বড় একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, মমতা, প্রতাপ আর সুপ্রীতি অনেকক্ষণ ধরে আলোচনা করতে লাগলেন এই বিষয়ে। চিন্ময়ীর সামনে সুপ্রীতি যে কথাটা বলতে পারেননি, এবারে সেই আশঙ্কাটাই ব্যক্ত করলেন। জয়দীপকে বিয়ে করে এত অল্প বয়সে বিধবা হয়ে যাবে তুতুল? তারপর বাকি জীবন সে কী করবে? শুধু ডাক্তার হয়ে থাকবে?
সুপ্রীতির তুলনায় মমতা অনেক আধুনিক। তিনি বললেন, প্রথম দিকে ধরা পড়লে এই রোগ সেরেও যেতে পারে। তবে, পুরোপুরি সেরে না ওঠা পর্যন্ত জয়দীপের সঙ্গে তুতুলের বিয়ে হবার তো কোনো দরকার নেই! জয়দীপকে সঙ্গ দেবে তুতুল, সে জন্যে বিয়ে করতে হবে কেন?
হঠাৎ মনে-পড়া ভঙ্গিতে সুপ্রীতি প্রতাপকে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁরে থোকন, তুই যে বললি ভাড়ার টাকা আমরা দেবো…সে যে অনেক টাকা! এরোপ্লেনের টিকিট ওরা যখন কেটেই ফেলেছিল…।
প্রতাপ খানিকটা বিরক্ত ভাবে বললেন, দিদি, আমরা কী মরে গেছি? আমাদের বাড়ির একটা মেয়ে বিলেত যাবে, সেজন্য অন্য লোকের দয়ার দান নিতে হবে?
প্রতাপ তাকালেন মমতার দিকে। মমতা জানেন যে প্রতাপ এখন তাঁর কাছ থেকে কী শুনতে চান। তিনি হেসে বললেন, তুমি ঠিকই বলেছো। তবে, তোমাকেও চিন্তা করতে হবে না। পাঁচ সাত হাজার টাকা তোমাকে আমিই দিতে পারবো।
সুপ্রীতি বললেন, তোমরা তো অনেক দিয়েছো! আমার এক জোড়া মকর মুখো বালা, একটা টিকলি। সব মিলিয়ে ভরি পাঁচেক সোনা এখনও আছে, আর তো কোনো কাজে লাগবে না…
দু’দিন পরে বাবলুর সঙ্গে তুতুলের একটা ঘোরতর সংঘর্ষ হলো।
বাবলু বাড়ি ফিরেছে রাত এগারোটার পর। মমতা তার খাবার গরম করে দেবার পর মৃদু বকুনির সুরে বললেন, শোনো তোমার রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে বলেই যে তুমি সাপের পাঁচ পা দেখেছো, তা ভেবো না। তোমার বাবা বলেছেন, বাবলু এত রাত পর্যন্ত কোথায় থাকে, কী করে তা তিনি বাবলুর মুখেই শুনতে চান। যেদিন তোমাকে ধরবেন সেদিন বুঝবে ঠ্যালা।
মায়ের বকুনি গায়েই মাখলো না বাবলু। সে হেসে বললো ওলড ম্যানকে বলো, বেশি মাথা গরম করলে ব্লাড প্রেসার বেড়ে যাবে! পৌনে এগারোটায় ফিরেছি, এটা কি বেশি রাত্তির নাকি? নাইট ইজ কোয়ায়েট ইয়াং!
ছেলের মাথায় এক চাঁটি মেরে মমতা বললেন, এই তুই তোর বাবাকে ওলড ম্যান বলছিস যে? তোর বাবা মোটেই বুড়ো হয়নি।
–মা, তুমি কি ইংরেজিটা ভুলে গেছো একদম? একবার সেই যে মেম কাকীমা এসেছিল একজন, তখন তো তুমি তার সঙ্গে খুব ইংরেজি বলেছিলে? নিজের বাবাকে ওল্ড ম্যান বললে মোটেই বুড়ো বলা হয় না… মা, তোমরা নাকি ফুলদিকে প্যাসেজ মানি দিয়ে বিলেত পাঠাচ্ছো?
–হ্যাঁ, কেন? তোর আপত্তি আছে নাকি? তুই যদি পি-এইচ ডি করার জন্য বিদেশে যেতে চাস, তোর প্যাসেজ মানিও আমরা দিতে পারবো।
–আমি? তোমরা কী ভাবো আমাকে? বাপ-মা’র টাকা নিয়ে বিদেশে যাবো? কেন, আমি কি ভিখিরির ছেলে যে বিদেশ যেতে হবে? এদেশে পি-এইচ ডি করা যায় না? পি-এইচ ডি করেই বা আমার কী ল্যাজ গজাবে? আর আমি পড়াশুনো করতে পারবো না। এবারে চাকরি খুঁজবো?
–চুপ, বাবলু, আস্তে আস্তে। তোর বাবা ঘুমিয়েছেন এই সবে মাত্র।
এ বাড়িতে অনেক রাত্তিরের দিকেও কিছু কিছু ঘটনা ঘটে।
এগারোটা সাড়ে এগারোটার মধ্যে মমতা তাঁদের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেন। সুপ্রীতিও ঘুমিয়ে পড়েন বেশ আগে আগে। এই দুই ঘরের আলো নেবানো। তুতুল অনেক রাত জেগে পড়াশুনো করেছে গোটা ছাত্রী জীবন, এখনও তার সে অভ্যেস যায়নি। বাবলুও ইদানীং খুব রাত জাগে। পরীক্ষার সময় তো কথাই নেই। এখন তার কোনো অ্যাকাডেমিক পড়াশুনোর চাপ না থাকলেও সে দুটো-তিনটের আগে ঘুমোতে যায় না।
একদিন বাবলু রাত দুটো আন্দাজ বাথরুমে ঢুকে হঠাৎ ভূতের ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠেছিল। তারপর তার কী লজ্জা! সে ভূতে বিশ্বাস করে না, তবু তার ভূতের ভয়! আসলে সে দেখেছিল টুনটুনিকে। এ বাড়িতে যে একজন নতুন মানুষ এসে আছে, তা অনেক সময় তার মনেই থাকে না। ভাগ্যিস বাবলুর চিৎকারটা তুতুল ছাড়া আর কেউ শুনতে পায়নি।
টুনটুনি সুপ্রীতির সঙ্গে শুয়ে পড়লেও প্রায় দিনই আবার একটু পরে চুপিচুপি বেরিয়ে আসে। সে যেন রাত্তিরের পাখি। হঠাৎ সে উঁকি মারে বাবলুর ঘরে কিংবা তুতুলের ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। তুতুল, মুন্নি, বাবলু এরা দিনে অনেকটা সময় বাড়ির বাইরে কাটায়, সীজন শুরু হয়নি বলে টুনটুনিকে এখনো কোনো কলেজে ভর্তি করা যায়নি, তাই সে বাইরে বেরুতে পারে না। মামাতো, মাসতুতো ভাইবোনেরাই তার বাইরের জানালা।
বাবলুর সঙ্গে কথা বলার সময় সে একেবারে বাবলুর গা ঘেষে দাঁড়ায়। দেওঘরে তাদের বাড়ির একতলার ভাড়াটে ছেলেদের সঙ্গে সে এইভাবেই মিশতো। এইভাবেই দাঁড়িয়ে সে বাবলুকে নানান প্রশ্ন করে।
দুতিনদিন পর বাবলু হঠাৎ টের পেল, টুনটুনির স্পর্শে তার শরীরটা গরম হয়ে উঠছে। সে বেশ অবাক হলো। এ পর্যন্ত অলি ছাড়া আর কোনো মেয়ে সম্পর্কে সে কোনো শারীরিক বা মানসিক আকর্ষণ বোধ করেনি। তা হলে এটা কী হচ্ছে? এই মেয়েটা তার মাসতুতো বোন, কিন্তু দীর্ঘ অপরিচয়ের জন্য একে ঠিক আত্মীয় মনে হয় না, একটা মেয়ে মেয়েই মনে হয়।
টুনটুনি দু’মাস আগে যখন এ বাড়িতে আসে, তখন সে ছিল তার মায়েরই মতন রোগা পাতলা। কিন্তু তার শীর্ণতা ছিল অপুষ্টির জন্য, এই দু’মাসেই বর্ষার চারাগাছের মতন সে ফনফনিয়ে বেড়ে উঠেছে, মাংস লেগেছে তার গালে, বুক দুটি সুস্পষ্ট, হাঁটা চলার সময় তার উরুতে খেলা করে একটা ছন্দ।
বাবলু টুনটুনির কাছ থেকে সরে গিয়ে অন্য জায়গায় বসলেও টুনটুনি আবার ঘন হয়ে এসে বাবলুর শরীরে শরীর ছোঁয়ায়। বন্ধু বান্ধবদের মাঝখানে টুনটুনি এসে পড়লে বাবলু তাকে রাইরে যাবার জন্য হুকুম করতে পারে, কিন্তু এই সময়, সে কিছু বলতে পারে না। তার দু’কানের পাশে আগুনের আঁচ। ইচ্ছে করে একটা হাত তুলে টুনটুনির কোমর জড়াতে, কিন্তু সে হাত তোলে না।
কৌশিকের সঙ্গে বাবলু সব রকম বিষয়ে আলোচনা করে। শুধু সায়েন্স নয়, অন্য অনেক বিষয়েও পড়াশুনো করেছে কৌশিক, তার মতামতের দাম আছে বাবলুর কাছে। একদিন বাবলু তাঁকে জিজ্ঞেস করলো আচ্ছা কৌশিক, প্রাপ্তবয়স্ক দুটি ছেলে মেয়ের শরীর যদি কাছাকাছি আসে, তাহলে তাদের মধ্যে ফিজিক্যাল আর্জ জেগে ওঠা তো স্বাভাবিক ব্যাপার?– কৌশিক মুচকি হেসে বললো, তুই বুঝি অলিকে বিয়ে করার কথা ভাবছিস? এই সময় তুই বিয়ে টিয়ের কথা চিন্তা করলে তোকে আমরা রেনিগেড বলবো।
অলির নামটা উচ্চারিত হওয়ায় বিরক্ত হয়ে বাবলু বললো, ধ্যাৎ! বিয়ে টিয়ের কথা আসছে কী করে! আমি তোকে একটা থিয়োরিটিক্যাল প্রশ্ন করছি। এই যে আর্জ, এটা স্বাভাবিক কি না।
–যদি পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা থাকে, তাহলে এই আর্জটা স্বাভাবিক। আর না হলে…
–ভালোবাসারও কোনো প্রশ্ন নেই। আমি বলছি, পিওরলি ফিজিক্যাল অ্যাঙ্গেল থেকে, যদি দুটি শরীর কাছাকাছি আসে, তাহলে দুটি শরীরই রেসপণ্ড করবে না? সেক্স সিগন্যাল টের পাওয়া যাবে।
–ট্রামে বাসে আমরা তো কত মেয়ের পাশাপাশি যাই, ভিড়ের মধ্যে অনেকের গায়ের সঙ্গে গা ঠেকে যায়, তাতেই কি সেক্স সিগন্যাল শুরু হয়ে যায় নাকি?
–অনেক সময় হয়, সত্যি করে বল?
–হলেও সেটাকে দমন করাই সভ্যতা। অতি বদ লোকেরাই ট্রামে বাসে মেয়েদের সঙ্গে অসভ্যতা করে।
–পাবলিকলি এরকম কিছু করলে সেটা অসভ্যতা নিশ্চয়ই। কিন্তু যদি প্রাইভেসি থাকে–একটা ফাঁকা ঘরে যদি দু’জন কাছাকাছি আসে, মনে কর, তাদের মধ্যে প্রেম নেই, কোনো রকম মানসিক যোগাযোগ নেই, তবু শরীর সাড়া দিতে পারে না?
–কী আজেবাজে কথা বলছিস, অতীন? তোর মাথার মধ্যে সেক্স ঢুকেছে নাকি? আমি প্রেমের সম্পর্কের মানে বুঝি, কিন্তু শুধু অ্যানিমাল সেক্স, এটা কোনো আলোচনার বিষয়ই নয়।
–মাথায় যদি ঢুকেও থাকে, সেটাকে তাড়াতে হলে তো যুক্তি দিয়ে তাড়ানো দরকার! টু বি ফ্র্যাঙ্ক ইউথ-ইউ, সিনেমায় এলিজাবেথ টেলরকে দেখলে এক এক সময় আমি উত্তেজনা বোধ করি। অথচ তার সঙ্গে কি আমার প্রেম আছে? না কোনো মানসিক যোগাযোগ? কথার কথা বলছি, এলিজাবেথ টেলর যদি হঠাৎ রক্তমাংসের শরীরে আমার খুব কাছাকাছি আসে।
–ডিসগাস্টিং! তুই যা বলছিস, তা হলো সেক্সয়াল অ্যাবারেশন! সভ্য শিক্ষিত মানুষ এইসবের উপরে উঠতে চেষ্টা করে সব সময়। দু’জন নারী পুরুষ যদি পরস্পরকে সত্যিকারের ভালবাসে, তখন তাদের শারীরিক মিলন একটা পবিত্র, সুন্দর ব্যাপার। অবশ্য কিছু সামাজিক রীতিনীতি মেনে নিতেও হয়, ফর দা বেনিফিট অফ ফিউচার জেনারেশন। এছাড়া শারীরিক মিলনের কথা যারা ভাবে, তারা বদলোক, ক্রিমিন্যাল অথবা মহাপুরুষ। শুনেছি, বড় বড় কবি আর শিল্পীরা…
বাবলু হাসতে হাসতে বললো, ইন দিস কেস, আই অ্যাম টেমপটেড টু ডিক্লেয়ার মাইসেলফ এ মহাপুরুষ!
কৌশিকের কাছ থেকে কোনো সমাধান পেল না বাবলু। অলিকে সে ভালোবাসে অথচ টুনটুনি তার গা ঘেঁষে দাঁড়ালে সে শারীরিক উত্তেজনা বোধ করে কেন? ওকে তো ঠেলে সরিয়ে দিত ইচ্ছে করে না, বরং নিজের ওপর একটু একটু রাগ হয়। দিনেরবেলা তবু অতটা মনে হয় না, কিন্তু রাত্তিরে, নিস্তব্ধতার ঝিমঝিমের মধ্যে শরীর যেন আরও স্পর্শকাতর হয়ে থাকে। রাত্রির মাদকতা অগ্রাহ্য করা খুব শক্ত।
আজ রাতে টুনটুনি আবার আসতেই বাবলু ভাবলো, আজ পরীক্ষা করে দেখাই যাক না।
টুনটুনি পরে আছে সেমিজের মতো একটা ঢলঢলে পোশাক, এটা পরে সে শোয়, ঐ ভাবেই সে উঠে এসেছে। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তার স্তনের উেলি, ঊরুর বিভঙ্গ। বাবলু তার দিকে চেয়ে চোখ ফেরাতে পারছে না, এই মেয়েটা তার আত্মীয় হয়, এর সঙ্গে শারীরিকভাবে কিছু করা অন্যায়, তা বাবলু জানে। তবু ড্যাম ইট, কেন তার ফিজিক্যাল রি-অ্যাকশন হচ্ছে? শরীরের কি আলাদা ইচ্ছে অনিচ্ছে আছে? কৌশিক সেই কথাটাই বোঝাতে পারল না।
চেয়ারে বসে আছে বাবলু, টুনটুনি তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তার পিঠে লেগেছে টুনটুনির উরু, তার মাথার খুব কাছে ওর বুক। সে কিন্তু কথা বলছে খুব নিরীহ ভাবে, সে শুনতে চাইছে কফি হাউসের গল্প।
বাবলু আজই প্রথম টুনটুনির কোমর জড়িয়ে ধরলো, তার মনে কি অপরাধবোধ জাগছে? কই না তো? অলির প্রতি সে অন্যায় করছে? তবু সে হাতটা সরিয়ে নিতে পারছে না কেন? তার গা কাঁপছে। সে হাতটা নামিয়ে এনে টুনটুনির নিতম্বে বোলাতে লাগলো, কোমর জড়িয়ে ধরাটাও দোষের নয়, কিন্তু এখন সে যা করছে, এটা যৌন খেলা, নিষিদ্ধ সম্পর্কের প্রথম ধাপ, এখনো বাবলু হাত সরাতে পারছে না, তার ভালো লাগছে। কী মসৃণ, কোমল অথচ শক্ত…
টুনটুনির কোনো লজ্জা বা বিকার নেই। দেওঘরের ভাড়াটে ছেলেরাও তার সঙ্গে ঠিক এইরকমই খেলা খেলতো। সে আরও ঘন হয়ে এল।
এবার কি বাবলু টুনটুনির বুকে হাত দেবে? না দেবার কী কারণ থাকতে পারে? মনের মধ্যে একটা দুর্দান্ত ইচ্ছে শিকল-ছেঁড়া সিংহের মতন লাফিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সারা বাড়িতে কোনো শব্দ নেই, রাস্তাও এখন নিঝুম, বাবলুর নিঃশ্বাসে ড্রাগনের মতন হালকা।
সে টুনটুনির বুকে অন্য হাতটা রাখলো। এভাবে সে অলিকেও কখনো ছোঁয়নি। হঠাৎ জড়িয়ে ধরে সে অলিকে চুমু খেয়েছে কয়েকবার, কিন্তু সব সময়ই অলি ছটফট করে ছাড়িয়ে নিয়েছে নিজেকে। টনটুনি বাধা দিচ্ছে না, সে হাসছে মৃদু মৃদু। বাবলু আস্তে আস্তে হাত বোলাতে লাগলো তার দুই স্তনে, শুধুই তো দুটি মাংসের ডেলা, তবু কী অসম্ভব ভালোলাগা, চুম্বকের মতন বাবলুর হাত আটকে গেছে, এবার কি সে অন্য হাতে টুনটুনির মুখটা নিচু করে এনে তার ঠোঁটটা কামড়ে ধরবে?
–বাবলু?
মা কিংবা পিসিমণি নয়, দরজার দামনে দাঁড়িয়ে ফুলদি। বাবলু লজ্জা পেল না। নিজেকে অপরাধী বোধ করল না, তার মাথায় অসম্ভব রাগ চড়ে গেল ফুলদিকে দেখে। টুনটুনি সামান্য একটু সরে গিয়ে দাঁড়ালো বাবলুর চেয়ারের পেছন দিকে।
তুতুল অবশ্য বাবলুকে শাসন করতে আসেনি, টুনটুনির সঙ্গে তার অতখানি শারীরিক ঘনিষ্ঠতাও সে লক্ষ করেনি পেছন দিক থেকে, তার ও সব দিকে মন নেই এখন। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ায় সে বাবলুকে বলতে এসেছে। তার হাতে একটা পুরনো খাতা।
যে কথা সে বলবে তা টুনটুনির সামনে বলা যায় না। তুতুল তাই বললো, টুনটুনি তুই এখন শুতে যাতো, ওর সঙ্গে আমার দু’একটা কথা আছে।
বাবলু জেদের সঙ্গে বললো, না, টুনটুনি থাকবে, ওকে আমি কফি হাউসের গল্প শোনাচ্ছিলাম।
তুতুল কাতরভাবে বললো, তা হলে একটু পরে আবার আসিস। আমার মিনিট দশেক লাগবে।
টুনটুনি বেরিয়ে যেতেই বাবলু কড়া গলায় বললো, ফুলদি, তোমার সম্পর্কে আমার যা ভক্তিশ্রদ্ধা ছিল, সব চলে গেছে। তুমি বিলেত যাবার জন্যে ক্ষেপে উঠেছো! তোমাকে আমি অন্যরকম ভাবতাম। একজন ডাক্তারকে তৈরি করতে গভর্নমেন্ট এক্সচেকারের কত টাকা খরচ হয় জানো না? গরিব দেশের টাকায় ডাক্তারি পাশ করে এখন সাহেব মেমদের পদসেবা করবে!
–তুই জানিস না বাবলু, আমি ইচ্ছে করে যাচ্ছি না?
–তোমায় কেউ জোর করে পাঠাচ্ছে? তুমি কি কচি খুকী? জয়দীপের ক্যানসার হয়েছে বলে কি কেউ তোমাকে ব্ল্যাকমেল করছে? তার ক্যানসার হয়েছে, সে এ দেশে না মরে ও দেশে গিয়ে মরতে চায়, তা বলে তোমাকেও ছুটতে হবে সেখানে? আসলে তুমি তোমার কেরিয়ার গোছাতে চাও, বিলিতি ডিগ্রির মোহ!
তুতুলের কান্না এসে গিয়েছিল, সে চোখের জল মুছে সংযত গলায় বললো, তুই আমাকে বকছিস, বাবলু, কেন বিলিতি ডিগ্রি নিতে গেলেই বা সেটা দোষের কেন হবে? অনেকেই তো যায়, আবার ফিরে আসে।
–অর্ধেকের বেশিই ফেরে না। এখন আমেরিকাতেও ডাক্তারদের খুব ডিম্যাণ্ড, স্টার্লিং ডলারের ঝুমঝুমি–যারা একবার মুগ্ধ হয়, তারা আর এই পোড়া দেশে ফিরবে কেন?
–তোদের ছেড়ে আমি বিদেশে থাকবো, তুই একথা ভাবতে পারলি?
–তোমাদের এই লোভটা দেখলেই আমার গা-টা রি রি করে ফুলদি। এ দেশে লেখাপড়া করে পুরোপুরি ডাক্তার হওয়া যায় না? ওয়েস্টার্ন কান্ট্রিগুলো তোমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকলেই তোমরা তু তু করে ছুটে যাবে।
ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে এরকম কড়া কড়া কথা শোনার অভ্যেস নেই তুতুলের, এর উত্তরে সে ধমক দিতেও পারবে না। এমনিতেই তার মনটা এখন আরও দুর্বল হয়ে আছে। একদিকে তার প্রস্তুতির তাড়াহুড়ো, এরই মধ্যে সব সময় তার কান্না পায়। মা তাকে সত্যি সত্যি মন খুলে যেতে দিতে রাজি হয়েছে কি না, তা সে এখনও বুঝতে পারে নি।
ধরা গলায় সে বললো, তোর সঙ্গে এই নিয়ে আমি তর্ক করতে আসিনি, বাবলু! যাওয়া আমার ঠিক হয়ে গেছে। কারুর মুখের ওপর আমি জোর দিয়ে না বলতে পারি না। হয়তো সেটাই আমার দোষ। তোকে আমি একটা জিনিস দিতে এসেছি। এটা আমার কাছে এতদিন রাখা ছিল, আমি সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই না, যদি হারিয়ে যায়।
–কী এটা?
–পিকলুদার কবিতার খাতা।
–দাদার কবিতার খাতা? কয়েকদিন আগেই আমি খুঁজেছি…
–তুই তো আমাকে জিজ্ঞেস করিসনি, আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছিলুম, মাঝে মাঝে পড়তাম, তুই যদি লেখাগুলো কোথাও ছাপাতে পারিস…
প্রায় কেড়ে নেবার ভঙ্গিতে বাবলু রুক্ষ গলায় বললো, দাও, ওটা আমাকে দাও!
বাবলুকে তো দিতেই এসেছিল তুতুল, তবু যেন একটা অমূল্য সম্পদ তার হাত থেকে চলে যাচ্ছে, এইভাবে সে শেষ মুহূর্তেও খাতাটা আবার ফিরিয়ে নিতে চাইলো, পারলো না। শূন্য হাতে সে একটা দেওয়ালের ওপর আছড়ে পড়ে কাঁদেতে লাগলো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।
বাবলুর শরীরময় অতৃপ্তি, তার থেকে ক্রোধ, সেই ক্রোধের সবটা ঝাঁঝ সে তুতুলের উপর ছড়িয়ে দিয়েও এখনও মনে মনে গজরাচ্ছে।