একটা সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে এলো শাজাহান। গেটের সামনে অনেক লোকের ভিড়, সেই ভিড় এড়িয়ে সহজে আসতে পারছে না কামাল। নানাজনের সঙ্গে কথা বলতে হচ্ছে তাকে। শাজাহান খানিকটা এগিয়ে একটি সিগারেটের দোকানের সামনে প্রতীক্ষা করতে লাগলো। সিনেমা হলটির দেয়াল জুড়ে ক্যাটকেটে রঙের বিরাট পোস্টার, তাতে দুটি পুরুষের দ্বন্দ্ব যুদ্ধ, একটি নারীর কান্নামাখা মুখ, দু হাত তোলা এক অন্ধ ফকির, পালতোলা নৌকো ও আকাশে দ্বিতীয়ার চাঁদ ইত্যাদি অনেক কিছু রয়েছে। কামালের নিজস্ব পরিচালনায় প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র ‘স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’ বেশ কিছুদিন ডিস্ট্রিবিউটারদের টালবাহানার পর সদ্য মুক্তি পেয়েছে, প্রথম দু দিন দর্শকের সংখ্যা বেশ ভালোই।
কামাল যথেষ্ট শিক্ষিত মানুষ, কিছুদিন সে একটা কলেজে পলিটিক্যাল সায়েন্সের অধ্যাপকের কাজ করেছিল, এক সময় গল্প-কবিতা লিখতো। কিন্তু তার এই বাংলা সিনেমাটির কাহিনীতে, ট্রিটমেন্টে, সংলাপে সামান্য একটুও বুদ্ধির ছাপ নেই, আগাগোড়া সব অবাস্তব দৃশ্য। অকারণ নাচ ও গান, একটি মেয়ে এতবার কেঁদেছে যে অন্তত সেরখানেক চোখের জল ফেলতে হয়েছে তাকে। আড়াই ঘণ্টা ধরে বসে থেকে এই সিনেমা দেখতে দেখতে প্রায় শারীরিক কষ্ট হয়েছে শাজাহানের, এক একবার তার বমি পেয়েছে। শাজাহান শেক্সপীয়ারের ভক্ত, বিশুদ্ধ শিল্প-সাহিত্য ছাড়া অন্য কিছুতেই তার রুচি নেই। তাকে জোর করে এরকম একটি সিনেমা দেখানো সত্যিই প্রায় অত্যাচারের পর্যায়ে পড়ে।
সিনেমা হলে বসে থাকতে থাকতেই শাহাজান একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।
হালকা বাদামী রঙের সুট পরে আছে শাজাহান। চোখে সানগ্লাস, তার মাথার একটা চুল এদিক ওদিক হয় না। একটুক্ষণ একা থাকলেই তার মুখে একটা বিষণ্ণতার ছাপ পড়ে। সুলেখার মৃত্যুর পর থেকে অনেক চেষ্টা করেও এই বিষণ্ণতাটা সে মুছে ফেলতে পারছে না। সুলেখা…রক্তমাংসের পবিত্রতা…তার সঙ্গে কি শাজাহান কোনোদিন একটুও অসমীচীন ব্যবহার করেছে…সুলেখার মৃত্যুর জন্য সে কি কোনোক্রমে দায়ী? সুলেখার সঙ্গে তার শুধু বন্ধুত্ব ছিল। আর তো কিছু না। মাঝখানে ঐ ক্রিকেট খেলোয়াড় স্কাউন্ড্রেলটা এসে…। শাজাহান চোখ বুজলো, দিল্লিতে সেই একটি সকালের দৃশ্য মনে পড়লেই তার শরীর জ্বালা করে।
কামাল তার পিঠে হাত দিয়ে বললো, চলো শাজাহানভাই…আমার ছবিটা তোমার কেমন লেগেছে তা জিজ্ঞেস করবো না।
শাজাহান অতি-ভদ্রতার ধার ধারে না। করুকে খুশী করার জন্য মিথ্যে কথা বলতে পারে না, সে শুকনোভাবে বললো, ইউ বেটার নট!
কামাল অন্য উৎসাহে এখন টগবগ করছে। সে এখন সমালোচনার ধার ধারে না। এ দেশে সমালোচকদের মতামতের ওপর টিকিট বিক্রি নির্ভর করে না। ছবিটা রিলিজ করার ব্যাপারে সে বেশ কয়েক মাস দুশ্চিন্তায় ভুগেছে। সে বললো, মনে তো হয় বক্স অফিস হিট করবে। সেইটাই বড় কথা! আমি তো আর্ট করতে যাই নাই, আমি সাধারণ মানুষের জন্য পিওর অ্যাণ্ড, সিম্পল এন্টারটেইনমেন্ট-এর, ছবি বানিয়েছি। তোমারে যে জন্য নিয়ে এসেছি, আমার নায়িকা
সেলিমার অভিনয় তোমার কেমন লাগলো?
–থরোলি ডিসগাসটিং!
–যাঃ, এটা তুমি কী কইলা শাজাহানভাই? সেলিমা রিয়েলি ট্যালেন্টেড অ্যাকট্রেস। বোম্বাইয়ের ওয়াহিদা রহমানের থিকা কোনো অংশে কম না।
–আমি ওয়াহিদা রহমানের কোনো ফিল্ম দেখিনি। কিন্তু তোমার ঐ সেলিমা। ওর মুখখানা খোসা ছাড়ানো পেঁয়াজের মতন। শী হ্যাঁজ নো বিজনেস টু অ্যাক্ট! শী শুড বী। ব্যানিল্ড ফ্রম দা ফিল্ম ওয়ার্ল্ড!
গাড়ির দরজার হাতল খুলতে গিয়ে একটুখানি আহতভাবে থমকে গেল কামাল। মৃদু আপত্তির সুরে বললো, এটা তুমি ঠিক বলছে না। সেলিমার অভিনয়ের অনেকেই প্রশংসা করেছে। আমার এই ছবি মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যাচ্ছে। অনেকেরই ধারণা সেলিমা একটা কিছু অ্যাওয়ার্ড পাবেই!
–যদি পায়, তা হলে বুঝতে হবে, সেটা শিল্পের প্রতি রাশিয়ানদের নবতম তাচ্ছিল্য!
গাড়িটা শাজাহানের, ইদানীং কামাল সেটা প্রায়ই ব্যবহার করে। স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’ ছবির প্রেডিউসারের সঙ্গে বিবাদ হওয়ায় কামাল যখন ফ্যাঁসাদে পড়েছিল, তখন শাজাহানই এগিয়ে এসেছিল তার সাহায্যের জন্য। প্রিন্ট-পাবলিসিটির খরচ বাবদ সে দেড় লক্ষ টাকা। দিয়েছে, তার আগে সে নিজে ছবির রাসেজ-ও দেখতে চায়নি। শাজাহান তো ব্যবসায়ী, ছবি যদি বক্স অফিসে সাকসেসফুল হয় তাতে তার খুশী হওয়ার কথা। তার লগ্নী করা টাকা সে সুদ সমেত ফেরৎ পাবে। অথচ ছবিটা চলা না-চলার ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহই নেই। আশ্চর্য মানুষ এই শাজাহান। সে কামালের আত্মীয় হলেও কামাল ওর কোনো কথার জোরালো প্রতিবাদ করতে ভয় পায়।
গাড়িতে উঠে বসে কামাল খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে ড্রাইভারকে বললো, তুমি…ইসে…এখন সোজা চলো…নিউ এস্কাটনে যাবা।
তারপর শাজাহানের দিকে ফিরে বললো, সেলিমার বাসায় আমাদের যাবার কথা, তুমি ওখানে যেয়ে যেন ওরে বকাবকি করো না!
শাজাহান এবার সামান্য হেসে বললো, তুমি ওখানে যাবে? তোমার বউ তোমাকে কোনো অ্যাকট্রেসের বাড়িতে যেতে নিষেধ করেছে না?
কামাল মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, বাদ দাও তো হামিদার কথা! নাচতে নামলে ঘোমটা দিয়ে থাকলে চলে? ফিলিম করবো, অথচ কোনো হিরোইনের সাথে সেটের বাইরে দেখা করবো না। এটা একটা পাগলের মতন কথা না? সেলিমার বাড়িতে আজ পার্টি, আজ আমার একটা স্পেশাল ডে।
–কত লোক আসবে সেখানে? তুমি তো জানো কামাল, আমার বেশি মানুষের ভিড় সহ্য হয় না, আমি তোমাকে ওখানে নামিয়ে দিয়ে চলে যাবো!
–আরে না, না। তেমন কিছু নয়। খুব প্রাইভেট পার্টি। পাঁচ সাত জন, তুমি সবাইরে চেনো। সাজাহানভাই, আমার নেস্ট ভেঞ্চারে তুমি আমার পার্টনার হবে তো? এবারে একটা জব্বর স্টোরি ভেবেছি। ইয়োর মানি রিটার্ন ইজ গ্যারান্টিড। বাংলা ও উর্দু ডাল ভাসান হবে…
–আই অ্যাম অ্যাফ্রেড, আই ওন্ট বী এবল টু ডু দ্যাট। আমি হয়তো আর পূর্ব পাকিস্তানে থাকবো না।
–থাকবে না? তাইলে কোথায় যাবে। পশ্চিম পাকিস্তানে? ইণ্ডিয়ায় ফিরে যাবে?
–জানি না। এখনও ঠিক করিনি। তবে এখানে আর থাকবো না।
–কেন। কী হইলো তোমার?
একথার সরাসরি উত্তর না দিয়ে শাজাহান কয়েক পলক তাকিয়ে রইলো কামালের মুখের দিকে। যদিও তার ওষ্ঠে সামান্য হাসি। তবু শাজাহানের মুখমণ্ডলে একটা গাঢ় বিষাদের ছাপ। যেন সে তার বেঁচে থাকার উৎসবের আলোগুলি ইচ্ছে করে নিবিয়ে রেখেছে।
একটু পরে সে বললো, কামাল, একটা ঘটনা শুনবে? তুমি জানো, আমাদের আদি বাড়ি ছিল লখনৌতে। কলকাতায় আমাদের বেশ কয়েক পুরুষের বাস। তবু আমাদের ফ্যামিলির অনেকেরই ধারণা, আমরা খানদানি মুসলমান, আমরা বাঙালী নই, আমরা আপকারি। আমাদের পরিবারের মুরুব্বিরা এখনো বাড়িতে উর্দু জবান চালু রেখেছে। আমি একবার আমার রুটস খুঁজতে লখনৌ গিয়েছিলাম। কোনো কারণে কলকাতায় আমার মন টেকেনি, ভেবেছিলাম লখনৌতে সেটল করবো। অসুবিধা কিছু ছিল না। সেখানে আমাদের চেনাজানা বেশ কয়েকজন আছে। বিজনেস কানেকশান আছে। আমি উর্দু জানি। বিরিয়ানি-মুরগ মসল্লম খেতে ভালোবাসি, লখনৌ কালচারের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতেও পারতাম। মাসখানেক থাকা হলো, নানান লোকজনের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হবার পর একদিন আমি রিয়েলাইজ করলাম, মাই গড, আমি এখানে টোটালি মিসফিট! যাদের সাথে মেলামেশা করতে যাই, তাদের সাথে আমার মনের একটুও মিল নেই! আমিও মুসলমান আর তারাও মুসলমান। আমিও উর্দু বলি, তারাও উর্দু বলে। তবু কোনো কমুনিকেশান হয় না। আমি কলকাতার মতন একটা বড় শহরে মানুষ হয়েছি। আমি মুসলমান হলেও কসমোপলিটান, ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার কোনো কমন গ্রাউণ্ড খুঁজে পাই না। ওরা গান বাজনার কথা উঠলে পুরোনো আমলের গানবাজনার কথাই শুধু বলে। সেখানেই থেমে আছে। বাখ-মোৎসার্টের কথা তুললে ওরা ফ্যালফেলিয়ে চেয়ে থাকে। ওরা সুরের হারমোনাইজ করায় বিশ্বাস করে না। কনসার্টের রস ওরা বুঝতে চায় না। ওরা কোনো নতুন এক্সপেরিমেন্টই মানতে চায় না। এমনকি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কোনো ঠাটের সামান্য সরগমের অদল বদলকেই মনে করে বেওকুফি! কোরান-হাদিস আমিও কম পড়িনি, কিন্তু ওদের ব্যাখ্যার সাথে আমার ব্যাখ্যা মেলে না। ওরা স্ত্রীলোকদের যে চক্ষে দেখে, তা শুনে আমি শিউরে উঠি। ওদের ভ্যালুজ আর আমার ভ্যালুজ সম্পূর্ণ আলাদা! এই উপলব্ধি যখন হলো, সেদিন কী দুঃখ যে হয়েছিল, কামাল!
কামাল বললো, দ্যাখো, সিয়া আর সুন্নিদের মধ্যে এই পার্থক্য…
তাকে বাধা দিয়ে শাজাহান প্রায় আর্তস্বরে বলে উঠলো, না, না, না, এটা সিয়া-সুন্নির পার্থক্য নয়, এটা সম্পূর্ণ আলাদা মূল্যবোধের ব্যাপার। আমি অনেক ভেবেচিন্তেই এই কথা বলছি। পশ্চিম পাকিস্তানীদের সঙ্গে তোমরা মিলতে পারছে না, তার কারণ, ভাষার তফাৎ। তাছাড়া, পশ্চিমীরা তোমাদের ঠিক খাঁটি মুসলমান মনে করে না। এই ঐস্লামিক রাষ্ট্রে ওরা নিজেদের বেশি মুসলমান মনে করে বলেই তোমাদের ওপর সদারি করতে চায়, বাঙালী মুসলমানরা হিন্দু-ঘেঁষা, এই কথা ভেবে ওরা তোমাদের সেকেণ্ড ক্লাস সিটিজেন করে রাখতে চায়। কিন্তু আমার কেসটা সম্পূর্ণ আলাদা। আমি ওদের মতন সমান উর্দু বলতে পারি। ওদের মতনই আমার খানাপিনা, পোশাক-আশাক, ওদের চেয়ে আমি কোনো অংশে কম মুসলমান নই। লখনৌতে আমার শিকড় আছে, কিন্তু টাইম হ্যাঁজ চেইঞ্জড, নাউ আই বিলং টু আ ডিফরেন্ট কালচার? যে লোক শেক্সপীয়ার, রবি ঠাকুর, ওমর খৈয়াম, ইকবাল, কাহলিল জিবরান, টি এস এলিয়ট, জীবনানন্দ দাশ পড়ে আনন্দ পায়, সে তো শুধু মুসলমান নয়।সে ওয়ার্ল্ড সিটিজেন! কিন্তু তার আশ্রয় কোথায়? এক হিসেবে সে হতভাগ্য!
–শাজাহানভাই, তবে তো কলকাতাই তোমার পক্ষে সব চেয়ে ভালো জায়গা ছিল। বড় শহর, অনেক রকম মানুষ, ইচ্ছা করলে নিজস্ব একটা বন্ধুগোষ্ঠী বেছে নেওয়া যায় শুনেছি। তাহলে কলকাতায় তোমার মন টিকলো না কেন?
–সেটা খুব প্রাইভেট ব্যাপার। সেটা খুলে বলার মতন আমার মনের অবস্থা এখনও হয়নি। তোমাকে আমি আরও বলি, গত বছর ইণ্ডো-পাকিস্তান ওয়ারের আগে আমি করাচি রাওয়ালপিণ্ডিতে অন্তত তিনবার গেছি। ইচ্ছা করলে আমি সেখানেও সেটল করতে পারতাম। কিন্তু ঐ একই গণ্ডগোল। সেখানে বুদ্ধিমান, ভোলা মনের মানুষ নিশ্চয় বেশ কিছু আছে, কিন্তু তারা কোথায় যে লুকিয়ে থাকে, খুঁজে পাওয়া শক্ত। প্রকাশ্যে কেউ কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করে না। বা, করতে সাহস পায় না। সেখানে অধিকাংশ মানুষই যেন এক রূপকথায় বুঁদ হয়ে আছে!
–শাজাহানভাই, তুমি উর্দু যতই ভালো জানো, আসলে তো তুমি এখন বাঙালী মুসলমান। পূর্ব পাকিস্তানে এসেও কি তুমি বন্ধুত্ব করার মতন মানুষ পাওনি? তুমি এখান থেকেও চলে যাবে বলছো। হঠাৎ তোমার এই মত পরিবর্তন কেন হলো?
–সত্য কথা বললে আশা করি, তুমি মনে দুঃখ পাবে না, কামাল? আমার মনের পরিবর্তন হলো আজই। তোমার তোলা সিনেমাটা দেখে। তুমি বললে না, সাধারণ লোকের এন্টারটেইনমেন্টের জন্য তুমি এই রদ্দি ছবি করেছে। তবে কি এই দেশের সাধারণ মানুষ একেবারে গরু-ছাগল? না, তারা গরু-ছাগল নয়। সেকথা বোঝা যায় তাদের ফোক সঙ শুনে। তাদের যাত্রা, কবির লড়াই দেখে। কিন্তু তোমরা তাদের মনে করো গরু-ছাগল, তাই তাদের এইসব ভুষিমাল গেলাতে চাও! তোমরা তাদের এই রকম গরু-ছাগল মনে করো বলেই তাদের মুক্তির জন্য তোমরা কোনোদিন সত্যিকারের লড়াই করবে না। তোমাদের লড়াইয়ের বুলি সব শখের বুলি। অন্ধকার ঘুপচি ঘরে বসে লম্বা লম্বা বাৎ ঝাড়বে, তারপর পুলিস বা মিলিটারির একটু কোঁতকা খেলেই সব চুপ করে যাবে! গত বছর যখন এখানে আসি, তখন। তোমাদের কথা শুনে মনে হয়েছিল, কত কী-ই যেন করতে যাচ্ছো! তোমার সেই সব বন্ধুরা এখন গেল কোথায়? লণ্ডন থেকে আলম বলে যে ছেলেটি এসেছিল, সে লণ্ডনে ফিরে গিয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্চ করেছে? নিশ্চয়ই নিজের কেরিয়ার গোছাচ্ছে! লাহোরে মুজিব সাহেব ছয় দফা প্রস্তাবে স্বায়ত্তশাসনের কথা উচ্চারণ করতেই আইয়ুব খান খুব হুড়কো দিয়েছে, কয়েক হাজার লোককে ভরে দিয়েছে জেলে। ব্যাস তারপরেই ভয় পেয়ে সব চুপচাপ। আর কেউ কোনো কথা বলে না। তোমাদের পূর্ব পাকিস্তানে সব আন্দোলন বন্ধ। পত্র-পত্রিকায় এখন খুব আইয়ুব খানের প্রশংসা দেখতে পাই। আইয়ুব খাঁর দাক্ষিণ্যে এখন কলেজের সাধারণ প্রফেসাররাও জাপানী গাড়ি কিনছে। কামাল, আমি নিজে কখনো পলিটিকস করিনি, কিন্তু যারা পলিটিকস করতে নেমেও ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায় কিংবা কমপ্রোমাইজ করে, তাদের আমি কিছুতেই শ্রদ্ধা করতে পারি না। কামাল, তুমি নাকি এককালে বিপ্লবী ছিলে? এখন এই যে। ট্র্যাস বাংলা ছবি তুলছো, এটা কি তোমার আত্মগোপন?
–শাজাহানভাই, এবার আমি একটা কথা বলি? ইণ্ডিয়া থেকে যারাই আসে, তারা মুসলমান হলেও বেশ একটা হামবড়াই ভাব দেখায়। যেন ইণ্ডিয়াতে তারা খুব সুখে আছে!
–আমার ট্র্যাজেডি কী জানো? আমি ইণ্ডিয়ান সিটিজেন, আমার ইণ্ডিয়ান পাসপোর্ট, ইণ্ডিয়াতেই জন্ম-কর্ম সব কিছু, তবু শুধু মুসলমান বলেই, আমার নামে কেউ লাগিয়েছিল, লাস্ট ওয়ারের সময় আমাকে পাকিস্তানের স্পাই বলে অ্যারেস্ট করেছিল ওখানে। এবার এই ইস্ট পাকিস্তানেও বোধ হয় আমাকে ইণ্ডিয়ার স্পাই বলে ধরা হবে। চতুর্দিকে অ্যান্টি ইণ্ডিয়া ক্যামপেন চলছে। এই সময় আমার মতন দু’দশজনকে অ্যারেস্ট করলে গভর্নমেন্টের মর্যাদা বাড়বে! এর মধ্যেই আমার পেছনে পুলিস লেগেছে, আমি টের পেয়েছি। অর্থাৎ, আমার কোনো দেশ নেই। আমি না ইণ্ডিয়ার, না পাকিস্তানের! আমি রিফিউজি না, কিন্তু রুটলেস। এখন পশ্চিমী কোনো দেশে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমার কোনো গতি নেই। আমি এখান থেকে কলকাতায় ফিরতে চাইলেও তা পারবো না। ঢাকা থেকে কলকাতার দূরত্ব কত তা নিশ্চয়ই জানো? সোওয়া দুশো মাইলের বেশি নয়। কিন্তু ঢাকা থেকে কলকাতায় একটা চিঠি পাঠাতে হলে, প্রথমে সেটা পাঠাতে হয় লণ্ডনে কোনো চেনা লোকের কাছে। সে আবার সেটা অন্য খামে পুরে কলকাতায় পাঠায়। দিস ইজ দা গ্রেটেস্ট জোক অফ হিস্ট্রি ইন দিস সেঞ্চুরি!
গাড়ি এসে থামলো নিউ এক্সাটনের একটি নতুন তিনতলা বাড়ির সামনে। বাড়িটি এমনই নতুন যে গায়ে এখনও বাঁশের ভারা বাঁধা আছে। বাইরের দেয়ালের রঙ সম্পূর্ণ হয়নি। কাছাকাছি আর কয়েকখানা বাড়িরও কনস্ট্রাকশান চলছে। ঢাকা শহরের অনেক জায়গাতেই এখন নতুন বাড়ি তৈরির চুন-সিমেন্টের গন্ধ। এক হাজার কোটি টাকা খরচ করে ইসলামাবাদে তৈরি হয়েছে পাকিস্তানের নতুন রাজধানী, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বদান্যতা দেখিয়ে ঢাকাতেও দ্বিতীয় রাজধানী বানাবার জন্য বরাদ্দ করেছেন, কুড়ি কোটি টাকা। এখন জমিবাড়ির কন্ট্রাকটরদের বেশ সুসময়।
সেলিমার দ্বিতীয় স্বামী ইউসুফও একটি কনস্ট্রাকশান ফার্মের মালিক। এমনই লম্বা-চওড়া চেহারা যে হঠাৎ দেখলে পাঠান বলে ভ্রম হয়, কণ্ঠস্বরটিও গমগমে। পায়জামার ওপর সে একটি সবুজ রঙের সিল্কের কুতা পরে আছে। তার মাথার চুল এলোমেলো। দোতলার সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে সে বললো, আসেন, আসেন, এত দেরি হইলো, সেলিমা তো অধৈর্য হয়ে গেছে। আপনাদের জন্য।
সেলিমার অঙ্গে সি-থ্র কাপড়ের তৈরি শালোয়ার কামিজ। যেন মসলিনের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। থিয়েটারি কায়দায় মাথা ঝুঁকিয়ে কপালে হাত ছুঁইয়ে সে শাজাহানকে বললো, আসলাম আলাইকুম! আসালাম আলাইকুম। এ গরিবের বাসায় আপনি দয়া করে এসেছেন…
শাজাহান বললো, আলাইকুম আসোলাম। আপনি আমাকে দাওয়াত দিয়েছেন, সেজন্য ধন্য হয়েছি।
–ছবি দেখে এলেন। কেমন লাগলো বলেন, আমি কী রকম করেছি?
প্রথমেই এই প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে গেল শাজাহান। কামাল কিছু একটা বলে কথা ঘোরাতে এলেও সেলিমা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শাজাহানের দিকে।
নিজের মুখে মিথ্যে কথাটা উচ্চারণ করতে পারবে না বলে শাজাহান কামালের দিকে ইঙ্গিত করে বললো, ওকে সব বলেছি। ওকে জিজ্ঞেস করুন।
ইঙ্গিতটা বুঝে গেল কামাল। সেলিমার কাঁধ জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বসিত গলায় সে বললো, দারুণ, মার্ভেলাস! শাজাহানভাই বললো, তুমি ওয়াহিদা রহমানের থেকেও অনেক ভালো, সুপার্ব! এ ছবির জন্য তুমি একখান ইন্টার ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পাবেই। আমি আজ শুনেছি, তোমার অ্যাপিয়ারেন্সের সময় দর্শকরা চারবার সিটি দিয়েছে, আর লাস্ট সিনে, তোমার সেই ভেঙে পড়া কান্নার সিকোয়েন্সে গোটা হল জুড়ে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ শব্দ। সবাই কাতে লেগেছিল!
সেলিমা কামালের দুই গালে ফটাফট করে চুমো খেয়ে প্রায় লাফাতে লাফাতে বলতে লাগলো, কামাল তুমনে কামাল কিয়া কামাল তুম নে কামাল কিয়া! আমি বলে দিচ্ছি, এ বই সুপারহিট হবেই।
ইউসুফ একটু দূরে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখতে দেখতে মিটিমিটি হাসছে। লম্বা ঘরটির মধ্যে আরও সাত-আটজন নারী পুরুষ, তাদের মধ্যে শুধু পল্টনকে চেনে শাজাহান। কামালের ফিমের নায়ককে এখানে দেখা যাচ্ছে না।
কামাল ও সেলিমার উচ্ছাস বিনিময় এক সময় থামিয়ে দিয়ে ইউসুফ বললো, রুবি। মেহমানদের গেলাস দাও!
ঘরের এককোণে একটি গোল টেবিলের ওপর নানা রকম মদের বোতল ও গেলাস। কোনো বেয়ারা নেই, সেলিমা নিজে গেলাসে পানীয় ঢেলে নিয়ে এসে প্রথমে দিল শাজাহানের হাতে। কৌতুকের সুরে বললো, বন্দেগী জাঁহাপানা শাহজাহান, আপনি এর সাথে পানি নিবেন,
সোড়া? শাজাহান আগেই দেখে নিয়েছে যে দ্রব্যটি প্রিমিয়াম স্কচ। সে মাথা নেড়ে বললো, থ্যাঙ্ক ইউ, কিছুই লাগবে না।
ইউসুফ আবার বললো, রুবি, কাবাবের প্লেটটা নিয়া আসো। দ্যাখো গরম গরম আছে কি না!
শাজাহান ইউসুফের দিকে তাকাল। এটাই তা হলে ইউসুফের সুখ। লোকজনের সামনে জনপ্রিয় নায়িকা সেলিমা আখতারকে হুকুম করে সে আত্মপ্রসাদ অনুভব করে। সেলিমা তার কাছে একটা দাসীর সমান। এই বিয়ে বেশিদিন টেকার নয়। সেলিমার জনপ্রিয়তা ও রোজগার আর একটু বাড়লেই সে ইউসুফকে ঝেড়ে ফেলে দেবে। ওদের দাম্পত্য জীবনে ফাটলের কথা সে এর মধ্যেই কামালের মুখে শুনেছে। শাজাহান এটাও লক্ষ্য করেছে যে সেলিমা যেন তার সঙ্গে একটু বেশি খাতির করে কথা বলে। দেখা হলেই গা ঘেঁষে দাঁড়াতে চায়।
সেলিমার মুখের দিকে তাকিয়ে সে মনে মনে বললো, খোসা ছাড়ানো পেঁয়াজের মতন, কোমল, মসৃণ, ভাবলেশ শূন্য। …হার ব্রেইন অ্যালাউজ ওয়ান হাফ-ফর্মর্ড থট টু পাস : “ওয়েল নাও দ্যাটস ডান : অ্যাণ্ড আই’ম গ্ল্যাড ইটস ওভার”। এর বেশি কিছু আর চিন্তা করা কি ওর পক্ষে সম্ভব?
এর আগে কামাল বেশ কয়েকবার ইঙ্গিত করেছে যে শাজাহান ইচ্ছে করলেই সেলিমাকে নিয়ে নিতে পারে। ধানমণ্ডিতে শাজাহান একলা বাড়ি ভাড়া করে রয়েছে, ইণ্ডিয়া থেকে সে হুণ্ডি মারফত টাকা পেয়েছে অজস্র, এখন সেলিমার মতন একটি সুন্দরী রমণীকে বিয়ে করলেই তাকে মানায়। ঢাকার উঁচু সমাজ তাকে এক নিমেষে চিনে যাবে।
কোনো একটি নারীকে সঙ্গিনী হিসেবে পাবার কথা আজকাল চিন্তা করে শাজাহান। কিন্তু কোন নারী? সেলিমার মতন মেয়েদের প্রতি তার কিছুতেই আকর্ষণ জন্মায় না। বরং রিপালশান হয়। তা হলে? শাজাহান জানে, সে সুলেখার স্মৃতি চিরকাল বুকে ধরে রাখবে না, সেটা মবিডিটি, সুলেখার স্মৃতি আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে যাবেই। কিন্তু এখনও যাচ্ছে না কেন? কেন অন্য কোনো মেয়েকে দেখলেই সুলেখার সঙ্গে তুলনা করতে ইচ্ছে হয়? এটাও বোধ হয় এক ধরনের অসুখ। আচ্ছা, সুলেখার স্মৃতির প্রতি অপমান করলে কেমন হয়? কোনো একটা ব্রেইনলেস মোমের পুতুলের মতন মেয়ের সঙ্গে চুটিয়ে লাম্পট্য করা যায়, তা হলে সুলেখার স্মৃতি নিশ্চয়ই লজ্জায় কুঁকড়ে মিলিয়ে যাবে!
কিন্তু এই পার্টিতেও শাজাহান কারুর সঙ্গে ভাব জমাতে পারলো না। সেলিমা তার কাছাকাছি আসছে, ইউসুফ একটা না একটা হুকুম করে তাকে সরিয়ে দিচ্ছে। শাজাহান আবার ইউসুফের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো, তোমার এই খোসা ছাড়ানো পেঁয়াজটি নিয়ে নেবার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই। এটিকে তোমার মাথার ওপরে চাপিয়ে রাখতে পারলেই আমি খুশী হবো।
ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই প্রায় সবাই মাতাল হয়ে গেল। এরা দ্রুত গেলাস শেষ করে। শাজাহান সেই প্রথম থেকে এক গেলাস নিয়েই নাড়াচাড়া করছে। এরা সবাই কথা বলছে কামালের সিনেমা বিষয়ে, এখনকার সিনেমা ইণ্ডাষ্ট্রি বিষয়ে। শাজাহান এ আলোচনায় যোগ দিতে পারছে না। সে দাঁড়ালো গিয়ে একটা জানলার ধারে।
এই ঘরে আজ যে আনন্দ-ফুর্তির ফোয়ারা, তা সব কিছুই হচ্ছে দরিদ্র ও চাষা, খেত মজুর, আর কারখানার শ্রমিকদের গাঁট কাটা টাকায়। এন্টারটেইনমেন্টের নাম করে তাদের দেখানো হচ্ছে রুপালি পর্দায় ভোজবাজি। বড়ঘরের সুন্দরী মেয়ের নাচ, তার স্তনের দোলানি ও নাভির প্রদর্শনী, এসব তো তারা চর্মচক্ষে বাস্তবে কোনোদিন দেখতে পাবে না। সেইজন্য অতি কষ্টের রোজগার করা পয়সা খরচ করে দেখতে আসবে। তাদের সেই ঘামে ভেজা টাকায় তৈরি হবে সেলিমা ও কামালদের মতন মানুষদের বড় বড় বাড়ি, কেনা হবে বিদেশী গাড়ি, স্কচ হুইস্কি, ফরাসী পারফিউম…।
এখান থেকে চলে যেতে হবে শাহাজানকে। কোথায় যাবে সে? পশ্চিম বাংলায় সে থাকতে পারলো না। পূর্ব বাংলাতেও তার মন টিকলো না। তবে কি আরও পশ্চিমে?
এখানে কামালই সব চেয়ে বেশি মাতাল হয়ে গেছে। আজ সে আনন্দ সামলাতে পারছে না, এক হাতে মদের গেলাস মাথার ওপর রেখে, অন্য হাতে কোমর ধরে সে নাচতে শুরু করেছে অশ্লীল ভঙ্গিতে, অন্যরা হাততালি ও শিস দিচ্ছে।
শাজাহান ভাবলো, এবার সে চুপি চুপি সরে পড়বে। তখনই পল্টন এসে দাঁড়ালো তার পাশে। পল্টন বিশেষ নেশা করেনি। সে-ও অন্যদের সঙ্গে তেমন মিশতে পারছে না মনে হয়।
পল্টন নিম্নস্বরে বললো, শাজাহানভাই, আজ আপনি নাকি গাড়িতে আসতে আসতে কামালকে খুব অ্যাটাক করেছেন? ও একটু আগে দুঃখ করছিল। আপনি বুদ্ধিমান মানুষ, এটা বুঝতে পারলেন না, এই সবই কামালের ছদ্মবেশ। ও একবার জেলখাটা মানুষ, খাঁটি দেশপ্রেমিক, ওর মধ্যে কোনো খাদ নেই।
শাজাহান আঙুল তুলে ধেই ধেই করে নৃত্যরত কামালকে দেখিয়ে শ্লেষের সঙ্গে বললো, এটা ছদ্মবেশ? এই বেলেল্লাপনা?
পল্টন বললো, নিশ্চয়! ছদ্মবেশ ধরতে গেলে নিখুঁতভাবে সাজাই তো ভালো। এখন যতদূর সম্ভব বোকা সাজতে হবে। কিংবা সুবিধাবাদীর ভূমিকা নিতে হবে। পুলিসের খাতায় আমাদের নাম আছে, একটু ওদিক হলেই আমাদের জেলে ভরে দেবে। এখন আমরা জেলে যেতে চাই না। বাইরে অনেক কাজ আছে।
–আপনারা বাইরে এখনও কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন? তার কোনো প্রমাণ তো দেখতে পাই। সবাই তো নেশা-ফুর্তিতে গা ঢেলে দিয়েছে দেখি।
–প্রমাণ আপনার চোখে পড়লে পুলিসের চোখেও ধরা পড়ে যাবে। এখন এইখানে, এই ঘরের মধ্যেও মোনেম খানের কোনো চর আছে কিনা তাও কি বলা যায়? ঐ ইউসুফকে সন্দেহ করার তো খুবই কারণ আছে। শাজাহানভাই, বাঙালী মুসলমান একবার যখন জাগতে শুরু করেছে, তখন আর থামবে না। এবারে একটা হেস্তনেস্ত হবেই।
হাতের গেলাসটা উঁচু করে শাজাহান বললো, আমি হয়তো এখানে তখন থাকবো না, তবু, আই উইস ইউ গুড লাক।