দিনের পর দিন কেটে যায়, মামুনের কাছে কোনো ভিজিটর আসে না। দুশ্চিন্তায় অস্থিরতায় তাঁর সারাটা বুক ব্যথা হয়ে গেছে, যেন অসংখ্য বোলতা কামড়েছে তাঁকে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, জোরে শ্বাস টানতে গেলে ঘড় ঘড় শব্দ হয়। একেবারেই খিদে নেই। কিছুই খেতে ইচ্ছে, করে না। খানিকটা হাই-প্রেসার ছাড়া মামুনের অন্য কোনো অসুখ ছিল না, জেলখানায় এসে এরকম শারীরিক যন্ত্রণায় তিনি বিমূঢ় বোধ করছেন। অন্যায়ের প্রতিরোধ শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন, এটাই তাঁর বেশি কষ্টের কারণ।
শুয়ে শুয়ে মামুনের মনে পড়ে সেই ভাষা আন্দোলনের সময় কারাবাসের দিনগুলির কথা। সেবারও এই বিশ নম্বরেই ছিলেন, তবে সলিটারি সেলে নয়, বড় হলঘরে অনেকে মিলে একসঙ্গে। সেবারে কোনো রকম ভয় ছিল না, কষ্টবোধ ছিল না। সারাদিন হৈ-হল্লা ও আচ্ছা, মুহুর্মুহু শ্লোগান। পালা করে রান্না, যেন একটা পিকনিক। তখন শরীর ভরা যৌবন ছিল, যৌবন অনেক কিছুই সহ্য করতে পারে, যৌবনের অনেক দুঃখ-যন্ত্রণাকেও মনে হয় বিলাসিতা। এবারে মামুন টের পাচ্ছেন যে তাঁর বয়েস হয়ে গেছে!
শুধু মৃত্যুর কথা নয়, নিজের সংসারের কথা ভেবেও প্রবল দুশ্চিন্তা হচ্ছে তাঁর। বাড়িতে আর পুরুষ মানুষ নেই, ফিরোজা বেগম মেয়েদুটিকে সামলে রাখতে পারবেন? ছোটমেয়েকে নিয়ে তেমন চিন্তা নেই, কিন্তু হেনার মতিগতি বোঝা শক্ত। গত কয়েকটা বছর কাজ নিয়ে এমন পাগলামি করেছেন মামুন যে নিজের পরিবারের দিকে তাকাতে পারেননি, তিনি যেন পিতা কিংবা স্বামী ছিলেন না, ছিলেন শুধু একজন ব্যস্ত সম্পাদক। জেলখানায় এসে মামুন আবার পিতা ও স্বামী হলেন।
এরা খবরের কাগজ পড়তে দেয় না। প্রতিদিন বন্দীর সংখ্যা বাড়ছে, সেল-এর মধ্যে আর তিল ধারণের জায়গা নেই, এরা কি সারা পূর্ব পাকিস্তানের সব শিক্ষিত লোককে জেলখানায় আটকে রাখবে? নতুন যারা আসছে, তাদের মুখে বাইরের খবর কিছু কিছু জানা যায়, সবই ধর-পাকড় আর অত্যাচারের কাহিনী, মামুনের প্রিয়জনদের কথা কেউ বলতে পারে না। তবে
কোনো কোনো বাড়িতে বারবার খানাতল্লাশের অজুহাতে স্ত্রীলোক ও শিশুদের ওপরেও নাকি নিপীড়ন চলেছে।
মামুনের খুব আশা ছিল, আলতাফ নিশ্চয়ই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসবে। বড় উকিল লাগিয়ে তাঁকে জামিনে খালাস করবার চেষ্টা করবে। আলতাফ করিকর্মা মানুষ, সরকারি উঁচুমহলে তার দহরম মহরম আছে। মামুনের ধারণা, আলতাফ তাঁকে এখনো ভালবাসে। রাজনৈতিক নির্বাসন থেকে আলতাফই তো মামুনকে টেনে এনেছিল নতুন কর্মক্ষেত্রে। হোসেন। সাহেবের সঙ্গে এর মধ্যে যতবারই ঝগড়া হয়েছে মামুনের, আলতাফই মধ্যস্থ হয়ে মিটিয়েছে। ইদানীং হোসেন সাহেবের সঙ্গে মামুনের সম্পর্কের আরও অবনতি হয়েছিল, তিনি আওয়ামী লীগ এবং সে দলের সভাপতি শেখ মুজিবর রহমানকে একেবারে সহ্য করতে পারেন না। পাক-ভারত যুদ্ধের সময় থেকেই তাঁর ভারত বিদ্বেষ একেবারে চরমে উঠে বসে আছে, তার ধারণা, শেখ মুজিবের ছয় দফা প্রস্তাব আসলে পাকিস্তানকে ধ্বংস করার জন্য ভারতের চক্রান্ত! ঐ লোকটা ভারতের দালাল। মামুন যত বোঝাবার চেষ্টা করছেন যে, আমাদের ভারত নিয়ে মাথা ঘামাবার এখন কোনো দরকার নেই, আমাদের লড়তে হবে পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য অধিকার আদায় করার জন্য। শেখ মুজিব এমন কিছু নতুন কথা বলেননি, তাঁর ঐ ছয় দফা অনেকদিন ধরেই আমাদের মনের কথা। হোসেন সাহেব তা মানবেন না, তিনি টেবিলে কিল মেরে বলবেন, পূর্ব পাকিস্তান আবার কী? পূর্ব পাকিস্তান কি একটা পৃথক দেশ? গোটা পাকিস্তানের মুসলমানদের স্বার্থের কথা যে চিন্তা করে না, সে হয় হিন্দু ভারতের এজেন্ট অথবা কমুনিস্ট?
মামুনের আপত্তি সত্ত্বেও পত্রিকার চীফ সাব সুধীর দাসকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে চেয়েছিলেন হোসেন সাহেব। তাঁর কাগজে তিনি কোনো মালাউনকে রাখবেন না। সেই ইস্যুতে মামুন নিজের পদত্যাগপত্র দিতে গিয়েছিলেন, কিন্তু ব্যাপারটা আঁচ পেয়ে সুধীর দাস নিজেই হঠাৎ চাকরি ছেড়ে চলে গেছে। লোকটা খানিকটা ফাঁকিবাজ হলেও কাজ জানতো, সে চলে যাওয়ায় মামুনের অসুবিধে হয়েছে যথেষ্ট।
যতই মালিকের সঙ্গে মতবিরোধ থাক, তবু মামুন এখানে দিনকাল পত্রিকার সম্পাদক। পত্রিকা অফিস থেকে সম্পাদকের জামিনের জন্য কোনো চেষ্টাই করা হবে না? আলতাফও চুপচাপ রয়ে গেল?
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একজন কেউ জিজ্ঞেস করলে, আরে মামুন মিঞা, সারাদিনই কি ঘুমাও নাকি?
লোকটার মাথার পেছনের দিকে আলো, সামনের দিকে অন্ধকার, তাই মামুন মুখখানা ঠিক দেখতে পেলেন না। একজন মোটাসোটা, গোলগাল ধরনের মানুষ। মামুন জিজ্ঞেস করলেন, কে?
পুরনো দোস্তরে একেবারে ভুইলা গ্যালা? আমার গতরখান না হয় খোদার খাসীর লাহান হইছে, কিন্তু গলার আওয়াজও কি পাল্টাইয়া গেছে?
–বদ্রু?
–হ, হ, আমি পটুখালির বদ্রু! মামুন মিঞা, মনে নাই, সেই বায়ান্ন সালে তুমি আর আমি। এক সাথে এই জেলে আছিলাম?
মামুন উঠে বসলেন। বদ্রু শেখ তাঁর পুরোনো বন্ধু হলেও মামুন এখন আর তাঁকে পছন্দ করেন না। বছর তিন চারেক দেখাও হয়েছে, কিন্তু মামুন তাঁর কীর্তিকলাপ সবই জানেন। আমদানি-রফতানির ব্যবসায় অনেক টাকা করেছে সে, তা করুক, কিন্তু বেশ কয়েকটি নারীঘটিত কেলেঙ্কারিও শোনা গেছে তার সম্পর্কে। ঢাকা ও চিটাগাঙে দুটি রক্ষিতা আছে। তার। সে আওয়ামী লীগকে মোটা চাঁদা দেয় আবার সরকারি কর্তাদের ঘুষঘাস দেবার সব রকম ফন্দিফিকিরই তার জানা। অথচ, এই বদ্রই ছিল একসময় এক ফায়ার ব্র্যাণ্ড পলিটিক্যাল ওয়াকার। রক্ত গরম করা বক্তৃতা দিতে পারতো সে।
মাস ছয়েক আগে মামুনের কাগজের এক তরুণ রিপোটার বদ্রর ব্যক্তিগত জীবনের নানা রসালো খবর ও কয়েকটি ফটোগ্রাফ জোগাড় করে এনেছিল, মামুন সে রিপোর্ট ছাপেননি। সাংবাদিকটিকে তিনি ধমক দিয়ে বলেছিলেন, এই সব কী? কারোর ব্যক্তিগত স্ক্যাণ্ডাল ছেপে আমি কাগজের বিক্রি বাড়াতে চাই না। আসলে পুরোনো বন্ধুর প্রতি মামুন সম্পূর্ণ আবেগশূন্য হতে পারেননি। কিন্তু মামুন না ছাপলেও সেই খবর এবং ছবি অন্য কাগজে ছাপা হয়ে গিয়েছিল এবং বদ্রু শেখ মানহানির মামলা এনেছিল সেই কাগজের বিরুদ্ধে। সে মামলার নিষ্পত্তি আজও হয়নি বোধহয়।
দিনের বেলা লোহার দরজাটা খোলাই থাকে, বদু সেটা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। পকেট থেকে একটা মার্কিনি সিগারেটের প্যাকেট বার করে বললো, নাও।
মামুনের বুকটা ধক করে উঠলো, বহুদিন পর যেন এক অতি প্রিয়জনের সঙ্গে সাক্ষাৎ! জেলে আসার সময় মামুনের কুতার জেবে একটি প্যাকেটে সাতখানি সিগারেট ছিল, পরবর্তী দু’দিন অতি কৃপণের মতন সেই সাতখানি সিগারেট উপভোগ করেছেন একটু একটু করে, তারপর আর সিগারেট পাওয়ার উপায় নেই। মামুন শুনেছেন বটে যে কারারক্ষীদের ঘুষ দিয়ে, সিগারেট আনানো যায়, কিন্তু সামান্য নেশার দাসত্ব করার জন্য ঘুষ দেবেন মামুন? মাঝে মাঝেই সিগারেট ছেড়ে দেবার চিন্তা তার মাথায় উদয় হয়েছে আগে, এবারে এই সুযোগে ধূমপানের নেশা একেবারে ত্যাগ করবেন ঠিক করেছিলেন।
বদ্রুর হাতের প্যাকেটটার দিকে তিনি মন্ত্রমুগ্ধের মতন চেয়ে রইলেন।
বদ্রু মৃদু হেসে প্যাকেটটা মামুনের কোলে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, এইটা তুমি রাখো! মামুন প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না, ফ্যাকাসে ভাবে বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ!
চারদিন পর প্রথম সিগারেটটি ধরাতে গিয়ে তাঁর হাত কাঁপতে লাগলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, বদ্রু, তোমারে অ্যারেস্ট করলো ক্যান? তুমি রাস্তার ডেমনস্ট্রেশানে গেছিলা নাকি?
বদ্রু মাটিতে বসে পড়ে বললো, নাঃ, আমারে বাসা থিকা অ্যারেস্ট করছে। বত্রিশ ধারায়। দ্যাশ রক্ষা আইনে, আমি দ্যাশের শত্তুর!
মামুন বদ্রুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আইয়ুবের আমলে পূর্ব পাকিস্তানের মাঝারি ব্যবসায়ীরা মোটামুটি খুশী আছে, আগের তুলনায় সুযোগ সুবিধে পাচ্ছে কিছু কিছু। অনেক বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক ও সাহিত্যিককেও নানা রকম উপঢৌকন দিয়ে হাত করেছে গভর্নর মোনেম খাঁ। তারা আর সরকার বিরোধিতা করে না।
বদ্রু বললো, আমারে ধরার একটাই কারণ থাকতে পারে। আমি মার্চ মাসে শেখ মুজিবের সাথে লাহোরে আছিলাম। আমি তার সাপোর্টার।
–আওয়ামী লীগের ডেলিগেশানের সাথে তুমি লাহোর গেছিলা? সে খবর তো শুনি নাই!
–আমি ডেলিগেশনের সাথে যাই নাই। আমি গেছিলাম অন মাই ওউন ব্যবসার কাজে, লাহোর এয়ারপোর্টে শেখ সাহেবরে রিসিভ করলাম; তারপর রইয়া গেলাম সাথে সাথে। মামুন মিঞা সেই মিটিং-এর থ্রিল-এর কথা তোমারে কী কমু! ব্যবসা ট্যাবসা কইরা এখন আমার চামড়া মোটা হইয়া গেছে, চর্বিও জমাইছি অনেক, তবু এই চর্বি-চামড়া ভেদ কইরা রোমাঞ্চ হইলো। আমরাই তো একসময় পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য জান কবুল কবছিলাম, সেই আমরাই আবার লাহোরে…
–লাহোরের মিটিং-এর কথা আমরা সবাই জানি।
–তবু তুমি আমার কাছে শোনো! সেই লাহোর, যেখানে চল্লিশ সালে ঐতিহাসিক পাকিস্তান প্রস্তাব নেওয়া হয়, যে-প্রস্তাবের বয়ান আমার এখনও মুখস্ত আছে; that the areas in which the Muslims are numerically in a majority as in the north-western and eastern zones of India, should be grouped to constitute units shall be autonomous and sovereign তোমার মনে আছে, মামুন, এই প্রস্তাব পাশ হবার খবর শুনে আমরা কলকাতায় সেদিন আমজাদিয়া হোটেলে বিরিয়ানি খেতে গেছিলাম, কত রাত পর্যন্ত আমোদ করেছি? ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট স্টেটস, ইণ্ডিপেন্টে স্টেটস! স্টেট না, সেই স্টেটসগুলি হবে অটোমাস অ্যাণ্ড সভারেন?
মামুন শুকনো গলায় বললেন, ফর্টি সিক্সে দিল্লি কনভেনশনে আবার লাহোর প্রস্তাব সংশোধন করে বলা হয়েছিল, স্টেটস-এর এসটা টাইপের ভুল, ওটা স্টেট-ই হবে।
–ঐ কনভেনশানের কোনো লিগ্যাল স্ট্যাণ্ডিং নাই! ছয় বছর ধরে যে প্রস্তাব অনুযায়ী পাকিস্তান আন্দোলন চালানো হইলো জনগণের মধ্যে তা হঠাৎ একটা অ্যাজেণ্ডা বিহীন কনভেনশানে বাতিল করে দিলেই হলো? এক পাকিস্তানের নামে পশ্চিমী শাসন?
–যাক, ওসব পুরনো কথা তুলে আর কী হবে?
লাহোরের কথাটা শোনো! সেই ঐতিহাসিক লাহোর, যেখানে পাকিস্তান প্রস্তাব পাস হয়েছিল, সেই লাহোরেই ছাব্বিশ বছর পর, অরিজিন্যাল প্রস্তাবের সেই সুপ্ত এসটা ফিরায়ে আনার দাবি তুললো বাঙ্গালী মুসলমান। পাকিস্তান একটা স্টেট থাকবে না, স্টেটস্ হবে। মুজিবের ছয় দফা তো সেই এস-এর পুনরুদ্ধার ছাড়া আর কী? এর মধ্যে তো পাকিস্তান ভাঙ্গার কথা নাই!
মামুন এবারে শীর্ণভাবে হাসলেন। ইংরেজি অ্যালফাবেট-এর একটি মাত্র অক্ষরের জন্য এত রক্তপাত, এত নির্যাতন, খুন, কারাবাস? বদ্রু শেখ অতি সরল করে দেখেছে ব্যাপারটা।
বদ্রু বললো, সেই কনফারেন্সে তুমি শেখ সাহেবের ব্যক্তিত্ব দ্যাখলে অবাক হয়ে যেতে, মামুন। জানি তুমি শেখ মুজিবকে এখনো পুরোপুরি সাপোর্ট করো না, আওয়ামী লীগ ভেঙ্গে যখন ন্যাপের জন্ম হয়, তখন তুমি মুজিবকেই সেজন্য দায়ী করেছিলে, আমার ওপরেও চটেছিলে, তাই না? আসলে আমরাই তো আওয়ামী লীগের ভাঙ্গন রোধ করতে চেয়েছিলাম! এখন দ্যাখো না, ন্যাপের কী ভূমিকা? কোনো ভূমিকাই নাই, আওয়ামী লীগই বাঙ্গালীর একমাত্র পার্টি, যাই হোক, শোনো এবারে লাহোর কনফারেন্সে শেখ মুজিব কী রকম ধীর স্থির ভাবে বোমাটি ফাটালেন, তা যদি তুমি দেখতে! ছয় দফা প্রস্তাবের দাবি নিয়ে বই ছাপিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সাথে, সেই বইয়ের উপর ল্যাখা, “আওয়ার রাইট টু লীভ”। প্রথমে সেই বই বিলি করে দিলেন সভার মধ্যে, তারপর নিজের বলার সময় উঠে দাঁড়িয়ে নির্ভীক ভাবে গম্ভীরগলায় বললেন, পাকিস্তানে ফেডারেশন গড়তে হবে, তা হবে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে, পূর্ব পশ্চিমের অধিকার হবে সমান সমান! পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা অনেক বেশি, কিন্তু সেই অনুপাতে আমরা বেশি চাই না, সমান সমান চাই, এতে পশ্চিম পাকিস্তানই লাভবান হবে।
এইসব খবরই আমার কাগজে ছাপা হয়েছে বদ্রু। যাই হোক, শেখ মুজিব এখন কোথায়? তারে কি এই জেলে রাখছে?
–না! তার খবর কেউ জানে না, যতদূর মনে হয়, ক্যান্টনমেন্টে তারে লুকায়ে রেখেছে। কোনদিন না গোপনে খতম করে দেয়।
–বাইরের খবর কিছু জানো?
ইত্তেফাক কাগজ বন্ধ হয়ে গেছে। দেশরক্ষা আইনে নিউ নেশান প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত হয়েছে।
–সে খবরও জানি। মানিক মিঞা আছেন পাশের ঘরে। একদিন মাঝরাত্রে তাঁর হাতে ঐ মর্মে সরকারি নোটিস ধরায়ে দিল।
–তোমার কাগজ কিন্তু বার হচ্ছে ডেইলি। পুরাপুরি সরকারের ধামাধরা হয়ে গেছে।
–সম্পাদক হিসাবে কার নাম ছাপা হচ্ছে?
–সেটা লক্ষ্য করি নাই।
–বদ্রু, আমাদের বউ-বাচ্চাদের সংবাদ পাবার কোনো উপায় নাই? এরা কি আমাদের আদালতেও নিয়া যাবে না।
–দেশরক্ষা আইনে জামিন নাই, আদালত নাই। কতদিন এই ভাবে রাখবে তারও ঠিক নাই। আইয়ুব খাঁ বলেছেন না, ছয় দফার কথা যারা উচ্চারণ করবে, তাদের বিরুদ্ধে তিনি ল্যাঙ্গোয়েজ অফ ওয়েপন ব্যবহার করবেন?
–তোমাকে সুখে থাকতে ভূতে কিলালো কেন, বদ্রু? আমি তো শুনেছিলাম পলিটিকসের সাথে তোমার এখন কোনো সম্পর্ক নাই!
–পলিটিকসের সাথে সম্পর্ক নাই, কিন্তু দেশপ্রেম কি কখনো ধুয়ে মুছে যেতে পারে? এক সময় এই পাকিস্তানের জন্য শরীরের রক্ত পানি করি নাই? ভাষা আন্দোলনের সময় আমার বুকে গুলি লাগতে পারতো না? সেইসব কি মিথ্যা হয়ে যেতে পারে। শোনো মামুন, জানি, তুমি আমার নামে অনেক কথা শুনেছো। তার কিছু সত্যি, কিছু মিথ্যা। দেশের জন্য সব কিছু ত্যাগ করে, খেটে খেটে শরীরটাকে উপোসী রেখে মরে যাবো, সে ফিলোসফি আমার নয়। বয়েসও তো হয়ে গেল অনেক! আমি ভোগেও আছি, ত্যাগেও আছি। বিশ্বাস করো আর নাই করো, দেশের জন্যে এখনো অনেক স্বার্থত্যাগ করি, গ্রামের গরিব-বেকারদের যথাসাধ্য সাহায্য করি, আবার অন্যদিকে, তুমি বোধহয় জানো না, আমার বিবি গত চার বছর ধরে সূতিকায় ভুগে ভুগে বিছানার সাথে মিশে আছে, আমি কাছে গ্যালেই ভয় পায়… পোলাপানদের মুখ চেয়ে দ্বিতীয় শাদী করি নাই, তা বলে বাকি, জীবনটা কি আমি নারীসঙ্গ বঞ্চিত থাকবো? মাঝে মাঝে শরীরে মাইয়ামানুষের কোমল হাতের ছোঁয়া না পাইলে কোনো কাজেই উৎসাহ আসে না!
এই সময় গেটের বাইরে একজন সেপাই মামুনকে ডাকলেন। বদ্রু মামুনকে চোখ দিয়ে ইঙ্গিত করলো সিগারেটের প্যাকেটটা বিছানার তলায় রেখে যেতে। তারপর মামুনের কাঁধ চাপড়ে বললো, গুডলাক। নিশ্চয় তোমার ভিজিটর এসেছে। তোমার কাগজের মালিক হোসেন সাহেব ইচ্ছা করলে অনেক অসাধ্য সাধন করতে পারে।
মামুনকে নিয়ে আসা হলো ডেপুটি জেলার (সিকিউরিটি)-এর ঘরে। সেখানে মামুনের চেনা কেউ নেই। ডেপুটি জেলার মন দিয়ে একটি ফাঁইল পড়ছে। টেবিলের উল্টোদিকে একটি খালি চেয়ার, অভ্যেসবশতঃ মামুন সেখানে বসতে গেলেন, সঙ্গে সঙ্গে একজন সেপাই সে চেয়ারটি সরিয়ে নিল তাঁর পেছন থেকে।
মামুন ধড়াস করে পড়ে গেলেন মাটিতে। ডেপুটি জেলার ও সেপাইটি হেসে উঠলো হা-হা করে। ব্যথার বোধের থেকেও মামুন অবাক হলেন বেশি। চাইডিশ প্র্যাংক! ইস্কুলের ছেলেরা এরকম করে। ডেপুটি জেলার একজন উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসার, আর তিনি একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক!
ডেপুটি জেলার হাসি থামিয়ে বললো, মোজাম্মেল হক সাহেব, বিনা অনুমতিতে কয়েদীদের চেয়ারে বসবার অধিকার নাই, আপনি জানেন না! ঠিক আছে, এবার উইঠ্যা বসেন। অনুমতি দিলাম।
মামুনের পশ্চাৎদেশে বেশ চোট লেগেছে, তবু তিনি মুখ অবিকৃত রাখলেন, উঠলেন না, শান্তভাবে বললেন, ঠিক আছে, আমি মাটিতেই বসছি আপনি কেন ডেকেছেন বলেন!
যে লোকটি কয়েক মুহূর্ত আগে কৌতুকে হাসছিল, সে হঠাৎ এবারে রক্তচক্ষে প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললেন, উঠে বসেন! বেয়াদপি করলে…
সেপাইটি মামুনের চুল ধরে টেনে তুললো। বিস্ময়ের ঘোর এক পলকে কেটে গেল মামুনের। তিনি তখনই বুঝতে পারলেন, সামনে কত দুর্দিন আসছে। সরকারি কর্মচারিরা আগে থেকে টের পায়, সেই অনুযায়ী এদের ব্যবহার বদলে যায়। তাঁকে যে রাত্রে গ্রেফতার করে আনা হয়েছিল, সে রাত্রেও এই ডেপুটি জেলারটি তাঁর সঙ্গে অনেক নরম-ভদ্র ব্যবহার করেছে। এর মধ্যে নতুন কোনো নির্দেশ এসেছে নিশ্চয়ই!
ফাইলটি খুলে রেখে ডেপুটি জেলার জিজ্ঞেস করলো, হক সাহেব, আপনার আব্বা-আম্মার নাম এখানে যা লেখা আছে, তাতে কিছু ভুল আছে মনে হয়। কী কী নাম ছিল বলেন তো?
মামুন নিজের বাবা ও মায়ের নাম বললেন।
ডেপুটি জেলার মাথা নেড়ে বললেন, উঁহু কিছু একটা ভুল আছে। কোনো হিন্দু খানকীর পেটে আপনার জন্ম হয় নাই? আপনার ফেমিলিতে কোনো হিন্দু কানেকশন নাই? তবে, আপনার এই ধুতি-পরা ছবি…
ফাইলটা মামুনের সামনে ঝপাৎ করে ফেলে দিল সে। মামুন দেখলেন তাতে রয়েছে প্রায় বিবর্ণ একটি খবরের কাগজের কাটিং, একটা গ্রুপ ফটো, ফজলুল হকের একপাশে মামুন, বোধহয় উনিশশো চল্লিশ-একচল্লিশ সালের। মামুনের রোগা পাতলা চেহারা, কলকাতায় থাকার সময় তিনি প্রায়ই ধুতি পাঞ্জাবি পরতেন!
–এই ছবিটা আপনের না? ডিনাই করতে পারবেন?
মামুন বুঝলেন, ভয় পেয়ে কোনো লাভ নেই। এদের কাছে কাকুতি-মিনতি করেও কোনো ফল হয় না। এদের ক্রোধ, হিংস্রতা, খারাপ ভাষা এসবই কৃত্রিম। প্রচণ্ড মাতালকে যেমন কিছুই বোঝানো যায় না।
তিনি শান্ত এবং দৃঢ় গলায় বললেন, ডিনাই করার প্রশ্ন নাই। ধুতি পরেছি আপনার বাবা জীবিত আছেন কি না জানি না, জীবিত থাকলে.তেনারে জিজ্ঞাসা করে দেখবেন, এক সময় অনেক মুসলমানই ধুতি পরতো, সেটা দোষের কিছু ছিল না!
–ইণ্ডিয়ার কাছ থেকে আপনি মান্থলি কতটাকা পান?
–ইণ্ডিয়ার কাছ থেকে… ইণ্ডিয়ায় আমার কোনো প্রপার্টি নাই, সেখান থেকে টাকা পাবার তো কোনো প্রশ্ন ওঠে না।
–ঘেটি সিধা করে কথা বলেন। ইণ্ডিয়া গভর্ণমেন্টের কাছ থেকে কত টাকা পান?
সেপাইটি চুলের মুঠি ধরে মামুনের মাথাটা সোজা করে ধরে রাখলো। মামুনের মাথাটি যেন কাটা মুণ্ডু, চোখ বিস্ফারিত, ঠোঁট দুটি নড়ছে। তিনি বললেন, ইণ্ডিয়া গভর্ণমেন্ট কোন্ সুবাদে আমাকে টাকা দেবে?
–দালালদের যে জন্য দ্যায়। আপনি ইণ্ডিয়ান হাই কমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি মিঃ ওঝার বাসায় কয়দিন ডিনার খেতে গেছেন?
–মিঃ ওঝা কে, তারে আমি চিনিই না।
–ঝুট বাৎ বললে দাঁতগুলো খুলে নেবো! আপনি শেখ মুজিবর রহমানের সাথে মিঃ ওঝার আলাপ করায়ে দ্যান নাই?
–আপনি যে-সব কথা বলছেন, তার বিন্দু বিসর্গ আমি বুঝতে পারছি না। আমি একজন ল ইয়ারের সাথে যোগাযোগ করতে পারি কি? একটি পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে আমার একটা রাইট আছে।
ডেপুটি জেলার হা-হা করে হেসে উঠলো থিয়েটারি কায়দায়। অকারণে টেবিলে জোরে একটা চাপড় দিয়ে বললো, ঠিক আছে, এখন যান! পরে আবার কথা হবে!
সেপাইটি মামুনকে সেল-এ ফিরিয়ে নিয়ে গেল না, এলো আর একটি ঘরে। বদ্রু শেখ ঠিকই আন্দাজ করেছে। মামুনের একজন ভিজিটর এসেছে। আলতাফ!
আলতাফ একটা চেয়ারে বসে ছিল, দ্রুত উঠে এসে মামুনের পা ছুঁয়ে কদমবুসি করলো। মামুন পা সরিয়ে নিতে ভুলে গেলেন। আলতাফের এত ভক্তি তিনি আগে কখনো দেখেননি।
খুব কাছেই দাঁড়িয়ে রয়েছে দু’জন সেপাই। তাদের দিকে চকিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আলতাফ বললো, সময় দিছে মোটে পাঁচ মিনিট। জরুরি কথাগুলি আগে বলে নেই, মামুন ভাই। আপনার ‘ বউ মেয়েরা ভালো আছে। চিন্তা করবেন না। ফিরোজাভাবী আপনার ছোট মেয়েকে নিয়ে মাদারিপুর চলে গেছে, আমি নিজে ওনাদের স্টিমারে তুলে দিয়ে এসেছি। তিন হাজার টাকাও দিয়েছি ভাবীর হাতে।
–আর আমার বড় মেয়ে হেনা?
–সে আছে আপনার আপার বাসায়। সরকারের কাছে অ্যাপ্লাই করা হয়েছে। পারমিশান পাওয়া গেলেই সে আপনার সাথে দেখা করতে আসবে। এবারে আর একটা ভালো খবর দেই মামুনভাই। হোসেনসাহেব ‘দিনকাল’-এর সম্পাদক পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন আপনাকে। বিশ তারিখ থেকে আপনার সারভিস টারমিনেটেড। সম্পাদক হিসাবে, এখন হোসেন সাহেবেরই নাম ছাপা হবে। এটা একটা টেকনিক্যাল ব্যাপার, কাগজ-কলমে আপনাকে বরখাস্ত করা হলো। আপনি ফুল তিন মাসের বেতন পেয়ে যাবেন, তারপর অবস্থা আবার নর্মাল হলে আবার আপনাকে সম্পাদক হিসাবে ফিরায়ে নেওয়া হবে নিশ্চয়। এটাই ভালো হল না? দিনকাল পত্রিকার সম্পাদক হিসাবেই আপনাকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে, এখন আপনি আর সম্পাদক না থাকলে আপনাকে ডিটেইনড় করার কোনো কারণই থাকলো না। আপনাকে ছেড়ে দেবে নির্ঘাৎ।
যেন সেপাইটি এখনও চুলের মুঠি ধরে আছে, এইরকম বিস্ফারিত ভাবে মামুন তাকিয়ে রইলেন আলতাফের দিকে। আলতাফ সুসংবাদ এনেছে! বিনা নোটিসে বরখাস্ত করা হয়েছে তাঁকে। যে-সময় তাঁর পেছনে একটা সংবাদপত্রের জোর থাকা বিশেষ প্রয়োজনীয় ছিল, সেই সময়েই তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হলো সম্পাদকের পদ থেকে। এখন তিনি একজন সাধারণ নাগরিক। সেইজন্যই ডেপুটি জেলারটি অমন ব্যবহার করতে সাহস পেয়েছে তাঁর সঙ্গে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, আলতাফ, ভালো থেকো তোমরা। আমি আল্লার কাছে দোয়া করবো, যেন তোমাদের কখনো বিপদ না হয়। মঞ্জুবাবুল ভালো আছে তো? আর সুখু মিঞা?