২.৫১ Thirty spokes will converge

Thirty spokes will converge
In the hub of a wheel
But the use of the cart
Will depend on the part
Of the hub that is void.

রাত শেষ হয়ে এলে কেন আমার দুঃখ হয়! কেন হায় হায় করে ওঠে আমার ভেতরটা! হরিশঙ্কর, জয়নারায়ণ আমাকে এই উত্তরাধিকার দিয়েছেন। আমার মায়ের শরীরে যে-রক্ত ছিল, জয়নারায়ণের শরীরেও সেই রক্ত। তার সঙ্গে মিশেছে হরিশঙ্করের ধারা! হরিশঙ্করে মিলেছে। ছোটদাদুর বংশের বীজ। এঁরা সবাই নিশাচর। যত রাত বাড়ে, তত এঁদের আনন্দ বাড়ে, কর্মোদ্দীপনা বাড়ে। সবাই জেগে ওঠেন ভিন্ন এক জগতে। সে জগতে রহস্য, সে জগতের অন্য মাত্রা, অন্য বায়ু চলাচল। আকাশের ছায়াপথ নক্ষত্রপুঞ্জ নিয়ে নেমে আসে, ভেসে আসে পরলোকের কণ্ঠস্বর, বিশাল বিশাল ভাব অতিথি হয়ে আসে, মনের ঝিনুক খুলে গড়িয়ে পড়ে চিন্তার মুক্তো। আমি যে এঁদেরই শরিক।

ছোটদাদু হঠাৎ সচেতন হলেন। নিজেকে গোটাতে চাইলেন একটি শ্লোকে,

কিমন্যৈরসদালাপেরায়ুষো যদ অসদ্ব্যয়ঃ।
মন্দস্য মন্দপ্রজ্ঞস্য বয়ো মন্দায়ুষশ্চ বৈ।
নিদ্রয়া হ্রিয়তে নক্তং দিবা চ ব্যর্থকর্মভিঃ ॥

শ্রীমদ্ভাগবত থেকে বললেন ছোটদাদু। এই বংশের সমস্ত মানুষের অসাধারণ স্মৃতি। ছোটদাদু শৌনকের উপলব্ধিই ব্যক্ত করলেন, কী লাভ অযথা গালগল্পে। আয়ুক্ষয় ছাড়া তো অন্য কোনও ফল। হবে না। যারা অলস, যারা নির্বোধ, তাদের পরমায়ু এইভাবেই ক্ষয় হয়, রাতে ঘুম, দিনে বৃথা কর্ম।

ছোটদাদু কাঁচের টুকরোর মতো হাসলেন। হেসে বললেন, পিন্টু। জীবনে এমন কিছু আশা কোরো না যা তোমার আয়ত্তের বাইরে। সাধনজগতের একটা সত্য তোমাকে বলে যাই, এখানে জোর করে লড়াই করে কিছু পাওয়া যায় না। আপনি এসে ধরা দেয়। There is a treasure in the deep mountains; He who has no desire for it finds it. এ জগতে এক হাতে তালি বাজে, এক ডানাতে পাখি ওড়ে, এক পায়ে মানুষ চলে, একটা চোখে মানুষ দেখে। এ তোমার সোনার খনি দেখে এগোনো নয়, এগিয়ে সোনার খনি পাওয়া। এক কাঠুরে মাথায় এক বোঝা ডালপালা নিয়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসছে। এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা। তিনি বললেন, জঙ্গলের মধ্যে এগিয়ে যাও। পরের দিন সে সন্ন্যাসীর কথায় এগিয়ে গেল। দেখলে মোটা মোটা কাঠের জঙ্গল। সেদিন যতদূর পারলে কেটে এনে বাজারে বেচে অন্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি পয়সা পেলে। পরের দিন আবার সে মনে মনে ভাবতে লাগল, তিনি আমায় এগিয়ে যেতে বলেছেন, ভাল, আজ আর একটু এগিয়ে দেখি না কেন? সে এগিয়ে গিয়ে চন্দনকাঠের বন দেখতে পেলে। সে সেই চন্দনকাঠ মাথায় করে নিয়ে বাজারে বেচে অনেক বেশি টাকা পেলে। পরদিন আবার মনে করলে, আমায় এগিয়ে যেতে বলেছেন। সে সেদিন আরও খানিক দূর এগিয়ে গিয়ে তামার খনি দেখতে পেলে। সে তাতেও না ভুলে দিন দিন আরও যত এগিয়ে যেতে লাগলক্রমে ক্রমে রুপো, সোনা, হিরের খনি পেয়ে মহা ধনী হয় পড়ল। এই হল ধর্মের পথ। ভ্রমণকাহিনি পড়লে হবে না। সংকল্প নিয়ে, নির্দেশ মেনে এগোতে হবে। একটু-আধটু রূপ জ্যোতি দেখে বা সিদ্ধাই লাভ করে যে মনে করে আমার সব হয়ে গেছে, সে মরেছে।

ছোটদাদু শব্দ করে হাসলেন। আমরা বসে আছি স্তব্ধ হয়ে। গলাটা একটু ধরাধরা লাগছে।

হরিশঙ্কর বললেন, ধর্ম ছাড়া কি পৃথিবীতে আর কিছু নেই?

ছোটদাদু বললেন, অবশ্যই আছে। ভোগ আছে, দুর্ভোগ আছে। সাফল্য-অসাফল্য আছে। রোগ শোক জরা ব্যাধি আছে। ধর্ম হল বিচার। ধর্ম হল গণিত। ধর্ম হল হিসেব। ধর্ম হল ইনসেক্টিসাইড, পেস্টিসাইড। ধর্ম হল বুদ্ধি। লেজেগোবরে না হওয়ার কায়দা। বাঁচব, মরার সময় মরব। রোজ একবার করে মরব না। ধর্ম মানুষকে ঝকঝকে একটা জীবন দান করে। ধর্ম হল অলৌকিক এক টুথপেস্ট। মনের দাঁতকে ঝকঝকে করে। জীবনের দুর্গন্ধ দূর করে। ধর্ম নিয়ে ন্যাকামি চলে না,কাব্য চলে না। রোমান্টিকতা চলে না, ধর্ম হল কোদাল। মনের কৃষিকাজ ধর্মের কোদাল ছাড়া চলে না। হয় না।

হরিশঙ্কর বললেন, একটা জিনিস আমার মাথায় আসছে না, তোমার যদি মনেই হয় ক্যান্সার হয়েছে, তা হলে ভাগ্যের হাতে নিজেকে সমর্পণ না করে, বিজ্ঞানের হাতে নিজেকে সমর্পণ করছ। না কেন! এটা কি একটা ন্যাকামি, একটা রোমান্টিকতা নয়?

ছোটদাদু হেসে বললেন, এটা আমার মনে হওয়া নয়, এটা ডাক্তারদের ডায়াগনোসিস। ক্যান্সার সারে না। চিকিৎসা মানে শরীরের ওপর অকারণ অত্যাচার আর টাকার শ্রাদ্ধ। বুদ্ধিমানের কাজ হল, চুপ করে বসে দেখো কী হয়! প্রেমিক হয়ে যাও। মৃত্যু-প্রেমিক। ধীরে ধীরে তাকে আসতে দাও। আমি ন্যাকা নই, রোমান্টিক ফুল নই, আমি বুদ্ধিমান। এ বিট ইনটেলিজেন্ট। ভাগ্যের কাছে আত্মসমর্পণ নয়, এ হল দুরারোগ্য ব্যাধির কাছে সারেন্ডার। ছোট জীবন সুখের, দীর্ঘজীবন দুঃখের। আমার কোথাও কোনও বন্ধন নেই। তোমাদের একটা হেঁয়ালি শোনাই। একটু। বোঝার চেষ্টা করো।

মনে করো একটা সাপ। এই মেঝেতেই শুয়ে আছে। সাপটা কপাত করে একটা ব্যাং গিলেছে। গেলার পর অলৌকিক কারণে সাপটা স্রেফ উবে গেল। সাপটার পেট যে জায়গায় ছিল মেঝেতে, দেখা গেল সেই জায়গায় ব্যাংটা বসে আছে হতভম্ব হয়ে, ব্যাংটা মরেনি। এইবার ওই ব্যাংটাকে বোঝার চেষ্টা করো। ব্যাং কী ভাবছে, তার মনের অবস্থাটা কী?

হরিশঙ্কর হা হা করে হেসে বললেন, আরে এ তো চরম বেদান্তের গল্প। সুন্দর একটা অ্যালিগরি, অথরবাবা। সাপ আছে ব্যাংটার মনে, ব্যাংটার সংস্কারে। যুগ যুগ ধরে সাপ ব্যাং খায়। যেমন যুগ যুগ ধরে সংসার নামক ময়াল সাপ মানব নামক জীবকে গিলে বসে আছে। সংসার বলে কিছু নেই। কিন্তু আমাদের গিলে বসে আছে, এই অনুভূতি আমাদের সংস্কারে চলে গেছে। নড়তেও পারি না, চড়তেও পারি না, পড়ে আছি জবুথবু হয়ে। কী ঠিক বলেছি কি না!

ছোটদাদু বললেন, এই তো চাই হরিশঙ্কর! এমন একটা পরিষ্কার মাথা না হলে ধর্মের অধিকারী হওয়া যায় না। পিন্টু, আজ তোমাকে একটা কথা বলে যাই, সন্ন্যাসী আর গৃহীতে তফাত বিশেষ নেই। সন্ন্যাসীর মন যদি গৃহীর মন হয় তা হলে বাইরের গেরুয়া হল সাজমাত্র। মন না রাঙিয়ে কাপড় রাঙালে কী হবে যোগী! গৃহীও মন রাঙিয়ে যোগী হতে পারে। তোমার মাতামহ, মাতুল, তোমার পিতা সকলেই মহাসাধক। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। যে-কোনও ভেকধারী সন্ন্যাসীর কান কেটে দিতে পারে। কৌশলটা কী জানো, আরোপ করো। সেটা কী? একটা প্রতীকে তোমার মন স্থাপন করে। যেমন বৃক্ষ। সবসময় মনে করবে তুমি একটা বিশাল গাছ। সেই গাছে অসংখ্য পাতা। একটা দিন মানে অসংখ্য মুহূর্ত। কয়েক কোটি মুহূর্ত নিয়ে একটা দিন। একটা দিন মানে ষড়ঋতু। তোমার সকাল হল বসন্ত। মুকুলিত মুহূর্তের পত্রসম্ভার নিয়ে বৃক্ষরূপী তুমি দিন শুরু করলে। দ্বিপ্রহর হল গ্রীষ্ম। মধ্যাহ্নের দিন ঢলে যাওয়ার বিষণ্ণতায় বর্ষার অনুভূতি। অপরাজ্ঞের শরতে তুমি দিবসের ফসল তুলবে গোলায়। সন্ধ্যার হেমন্তে নামবে নির্জনতা। দিনের চোখ বুজে এল। যাত্রা করো, যাত্রা করো যাত্রীদল, পাখি ফিরে চলো কুলায়, ব্যস্ত জনপদ শান্তির কর্মবিরতির আচ্ছাদনে। রাত আসছে, আসছে শীত, আসছে জৈব-নিদ্রা। একে একে ঝরে গেল একটি দিনের সব মুহূর্তের পাতা। প্রতিটি মুহূর্ত যেন কারণে ঝরে। অকারণে নয়। কর্মের যজ্ঞাগ্নিতে আহুতি দাও তোমার ওই বিম্ববৃক্ষের এক-একটি ত্রিপত্র। ত্রিপত্র মানে, স্মরণ, মনন, নিদিধ্যাসন। বৃক্ষ অচল, বৃক্ষ অটল, সে শুধু ঊর্ধ্বে ওঠে, সসীম থেকে অসীমে যেতে চায়। আকাশে ডালপালা বিস্তার করে নৃত্য করে। পাখি হল রমতা সাধু। বৃক্ষকে সঙ্গ দেয়, ঈশ্বরের নাম শোনায়। আর বৃক্ষের ভূমি কী? সংস্কার। আর প্রাণরস কী? বিশ্বাস। এই বিশ্বাসে তুমি আসবে কীভাবে? ধ্যানের মাধ্যমে। পুজোর চেয়ে জপ বড়, জপের চেয়ে ধ্যান বড়। নিক্তির ওপরের কাঁটা, নীচের কাঁটা। ওপরের কাঁটা হল ঈশ্বর-শক্তিতে বিশ্বাস আর নীচের কাঁটা হল মন। মাঝে মাঝে দেখে নাও, ওপরের কাঁটার সঙ্গে নীচের কাঁটা মিলেছে কিনা। যদি এদিক ওদিক হয়ে গিয়ে থাকে, বুঝতে হবে স্মরণে চলেছ, অবিশ্বাসে হেলেছ। সঙ্গে সঙ্গে স্থির হও। চোখ বোজাও। বিচারে বোসো। ঝুঠা সোহাগ জগৎ কী রী সজনী, হোয় হোয় মিট জাসি/ মাতা পিতা সুত কুটুম কবীলা, টুটু গয়া জঁ তাগা। প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা, সোহাগ, পিতা, মাতা, আত্মীয়-কুটুম্ব সব দু’দিনের। ইন দেহকা গরব ন করনা, মাটিমে মিল জাসি/ এ সংসার চহরকি বাজি সাঁঝ পর্ভা উঠ জাসি। জগতের এই বিচিত্র রং-ঢং, কড়াক্রান্তি, গাড়ি-বাড়ি, সাজসজ্জা, যা কিছু দেখছ, এ সবই জাদুকরের জাদুখেলা। জীবনসন্ধ্যায় দেখবে সব ভোঁ-ভাঁ। জো দিন গয়ে সো ফির নহি আবৈ, অন্ত সময় কোই কামন আবৈ, জব জম লেহি বোলায়। জয়নারায়ণ, তোমার সেই বিখ্যাত গান :

আমার দিন তো চলে যায় মা,
আর কবে দেখা দিবি, ধুলা ঝেড়ে কোলে নিবি,
বড় দেরি হয়ে গেল, তাড়াতাড়ি আয় মা ॥

জো দিন গয়ে সো ফির নহি আবৈ। আর শেষে যখন যম এসে ধরবে তখন কেউ আসবে না সাহায্য করতে। ইন দেহকা গরব ন করনা, মাটিমে মিল জাসি। এই হল বিচার। গানের চর্চা তো করো, তা এই গানটা গাইতে পারো? ভবে আসা খেলতে পাশা, বড় আশা করেছিলাম। জয়, ধরো না। শেষ গানটা গেয়ে যাই। ধরো, গলা মেলাও।

জয়নারায়ণ বললেন, তা হলে হারমোনিয়মটাও আসুক। সুরে সুর লেগে যাক।

আমি উঠতে যাচ্ছিলুম, মুকু বললে, তুমি বোসো, আমি আনছি।

হারমোনিয়ম এসে গেল। শুরু হল গান। ছোটদাদু যেন ভাবসাগরে ভাসছেন। ক্ষীরের মতো চেহারা। পদ্মের মতো প্রস্ফুটিত বসে থাকা। জয়নারায়ণ সুর ভাসালেন,

ভবে আসা খেলতে পাশা, বড় আশা করেছিলাম।
আশার আশা ভাঙা দশা, প্রথমে পঞ্জুড়ি পেলাম।
প’বারো আঠারো যোলো, যুগে যুগে এলাম ভাল,
(শেষে) কচে বারো পেয়ে মাগো, পঞ্জা ছক্কায় বদ্ধ হলাম।
ছ-দুই-আট, ছ-চার-দশ কেউ নয় মা আমার বশ;
খেলাতে না পেলাম যশ, এবার বাজী ভোর হইল।

ছোটদাদু বললেন, জয়, রামপ্রসাদী তুমি এত ভাল গাও! চেহারা পালটে দিয়েছ। পঞ্জুড়ি মানে কী? পঞ্চভূত। পঞ্জা-ছক্কায় বন্দি হওয়া অর্থাৎ পঞ্চভূত ও ছয় রিপুর বশ হওয়া। ছ-তিননয়ে কঁকি দিব। ছয়কে ফাঁকি দেওয়া অর্থাৎ ছয় রিপুর বশ না হওয়া। তিনকে ফাঁকি দেওয়া অর্থাৎ তিন গুণের অতীত হওয়া। সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ– এই তিন গুণেতেই মানুষকে বশ করেছে। তিন ভাই, সত্ত্ব থাকলে রজকে ডাকতে পারে, রজ থাকলে তমকে ডাকতে পারে। তিন গুণই চোর। তমোগুণে বিনাশ করে, রজোগুণে বদ্ধ করে, সত্ত্বগুণে বন্ধন খোলে বটে; কিন্তু ঈশ্বরের কাছ পর্যন্ত যেতে পারে না। কিন্তু পথ দেখিয়ে দেয়।

ভোরের প্রথম পাখিটি কোথাও চিক করে উঠল, যেন দিনের কপাট অল্প একটু ফাঁক হল। ছোটদাদু মহানন্দে মশগুল। আমি ভাবছি, আর একটু পরেই এই আসর ভেঙে যাবে। এই মুহূর্তের সমন্বয় আর জীবনে ঘটবে না। সময় আর নদী একই ধারা। এক জল একই জায়গা দিয়ে দু’বার বহে যাবে না। অলওয়েজ নিউ, এভার চেঞ্জিং। ভাল লেগেছে বলে দৃশ্য ঘটনাকে আবার ইচ্ছামতো। সাজানো যাবে না। মালা হতে ফুলগুলি ছিঁড়ে ঝরে যায়।

হরিশঙ্কর বসে আছেন স্তব্ধ আকাশের মতো। ঘটনাকে মেনে নেওয়ার অসীম ক্ষমতা তার। তিনি বলেন, মানুষ হল আইসক্রিম। খোলের ভেতর সময় ভরা। টসটস করে ঝরে যাচ্ছে মুহূর্ত। জীবন হল মোমবাতি জ্বলবে আর গলবে, নিঃশেষ একদিন। হরিশঙ্করের দর্শন হল, No one throws a stone at a barren tree. ফল ধরে আছে যে-গাছে, সেই গাছেই লোক ঢিল ছোড়ে। সফল জীবনই মানুষের আক্রমণের লক্ষ্য।

ছোটদাদু নড়েচড়ে বসে বললেন, এইবার তোমাদের অনুমতি ছাড়াই আমি একটা কাজ করব?

হরিশঙ্কর প্রশ্ন করলেন, কী কাজ! তুমি আবার অনুমতি নেবে কী, আমরাই তোমার অনুমতি নোব। বলো কী কাজ তুমি করতে চাও?

আমি একটা ব্রিজ তৈরি করব। ছোটদাদু হাসছেন।

সকলেই একটু অবাক। ব্রিজ তৈরি করবেন মানে? কোন নদীর ওপর?

হরিশঙ্কর বললেন, রহস্য কিঞ্চিৎ পরিষ্কার হওয়া দরকার।

ছোটদাদু বললেন, পিন্টু, তোমার রাজবেশ পরে এসো। সিল্কের পাঞ্জাবি, গরদের ধুতি। পাঞ্জাবিতে সোনার বোম লাগাবে।

কেন ছোটদাদু?

আমি যে প্রশ্ন পছন্দ করি না পিন্টু।

আমার যে ওর কোনওটাই নেই।

তা হলে সাদা ধুতি আদ্দির পাঞ্জাবি পরে এসো।

জয়নারায়ণ বললেন, তোর না থাকে আমার আছে। যা পরে আয়, তোর দীক্ষা হবে। হালকা পালকের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম। দীক্ষা মানে ত্রিজন্ম। উপনয়নে দ্বিজন্ম হয়ে গেছে। সেজেগুজে ঘরে ঢুকতেই ছোটদাদু বললেন, মুকু, তুমি একটা টকটকে লাল শাড়ি পরে এসো। লাল শাড়ি তোমার আছে, আমি দেখেছি।

জয়নারায়ণ বললেন, আমরাই বা কেন বাকি থাকি?

ছোটদাদু বললেন, ঠিকই তো। হরিকে নিয়ে যাও। বেশ ধোপদুরস্ত হয়ে এসো। মুকু, তুমি দু’খানা পুজোর আসন, গঙ্গাজলের ঘটি, কোষা-কোষী, তাম্রকুণ্ড, ধূপ, ধূপদানি, দেশলাই, প্রদীপ নিয়ে আসবে।

একটা কিছু হবে, এই আনন্দে সব হয়ে গেল। পরিপাটি আয়োজন। ছোটদাদু আমাকে আর মুকুকে পাশাপাশি আসনে বসালেন। আমার বাঁ পাশে মুকু। প্রদীপ জ্বলছে। ধূপের ধোঁয়া পাক খাচ্ছে ঊষার ফিকে গোলাপি আলোয়। আমাদের সামনে কোষা-কোষী, তাম্রকুণ্ড। ছোটদাদু বসেছেন সামনে পদ্মাসনে।

ছোটদাদু বললেন, জয়, তোমার আঙুলে দুটো আংটি। ও দুটো কি গ্রহশান্তির জন্যে?

আজ্ঞে না। শখের আংটি।

যে-কোনও একটার মায়া ছাড়তে পারবে?

কেন পারব না!

তা হলে মুকুর অনামিকায় একটা পরিয়ে দাও। পিন্টুর হাতে একটা রয়েছে দেখছি।

মাতুল মহা উৎসাহে মুকুর আঙুলে আংটি পরিয়ে দিলেন। বাইরে কলকল করে পাখি ডাকছে।

ছোটদাদু বললেন, ব্যাপারটা কী হতে চলেছে বলে তোমাদের অনুমান?

জয়নারায়ণ বললেন, দীক্ষা।

ছোটদাদু বললেন, না, দীক্ষা নয়, বিবাহ।

হরিশঙ্কর, জয়নারায়ণ দুজনে একসঙ্গে বললেন, বিয়ে!

আমার বুকের ভেতরটা গুড়গুড় করে উঠল। বিয়ে! এইভাবে কি বিয়ে হয়? বিয়ের তো কিছু নিয়ম আছে। তা ছাড়া মুকুর মতামত। হরিশঙ্করের ইচ্ছা অনিচ্ছা।

হরিশঙ্কর বললেন, পাত্রীর মত নিবি না? মুকুর বাবা?

ছোটদাদু বললেন, আমার মত, আমার ইচ্ছা। এর ওপর কারও কথা তো চলবে না।

হরিশঙ্কর বললেন, বিবাহের একটা অনুষ্ঠান আছে।

ছোটদাদু বললেন, সে দায়িত্ব আমার।

হরিশঙ্কর বললেন, বেশ, কিন্তু ছেলেটাকে এরই মধ্যে সংসারে ঢোকাবি! সংসার যে বড় কদর্য জায়গা। আমি চেয়েছিলুম ও হবে বৈদান্তিক সন্ন্যাসী। এক মুক্তপুরুষ।

ছোটদাদু একটা আঙুল তুলে বললেন, সন্ন্যাসী হওয়া কি ডাক্তার হওয়া, না ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। হব বললেই হওয়া যায়। সংস্কার চাই, দৈব কৃপা চাই। তুমি তো সব ছেড়ে চলে গিয়েছিলে। ফিরে এলে ঘোর সংসারী হয়ে। কবে মুক্তি পাবে? আশার ছেলের মানুষ হতে পনেরো কুড়ি বছরের। ধাক্কা। এই পনেরোটা বছর তোমার কোনও মুক্তি নেই। সংসার! আমরা কে সংসারের বাইরে আছি হরিশঙ্কর? সংসার ঢুকে বসে আছে আমাদের মনে। পক্ষহীন শোনো বিহঙ্গম, এ যে নহে পথ। পালাবার। জেনে রাখো, যৌবনের সকালেই তুমি তোমার স্ত্রীকে হারিয়েছ। এই বয়সে তোমার পুত্রবধূর প্রয়োজন, যাকে তুমি মা বলে ডাকবে। সেই ডাকাটাই তোমার সাধনা। পিন্টু আর মুকু, দু’জনের দুই গ্রহ। দু’জনের রাশিচক্রের মিলনে এই সংসার হেসে উঠবে। এর কিছু আছে, কিছু নেই, এর যা নেই ওর তা আছে, ওর যা নেই এর তা আছে। কীরকম জানো, একটা ছবি ছিঁড়ে দু’টুকরো। হয়ে আছে, এখন শুধু সাবধানে জুড়ে দেওয়া। কোনও পক্ষের কোনও প্রতিবাদ আছে?

কারও মুখে কোনও কথা নেই। নীরবতায় পেরেক ঠুকছে ঘরের দেয়ালঘড়ি। যেন কোনও স্বর্ণকার সময়ের অলংকারে মিছরি কাটছে।

ছোটদাদু বললেন, নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ। একটা প্রশ্ন কেবল মুকুকে, তোমার মন থেকে। পুলিশ অফিসারের সেই ছেলেটি ঝরে গেছে কি? সুরঞ্জনার দাদা?

মুকু চমকে উঠল।

ছোটদাদু বললেন, বিপজ্জনক জীবনসঙ্গী হত। ওদের পরিবারে তোমার সুখ হত না। ওদের আদর্শের সংজ্ঞা আলাদা। তুমি এই পরিবারের জন্যেই তৈরি।

মুকু বললে, আমার রাগ আর অভিমান দুটোই হয়েছিল।

এখন?

এখন আর কিছু নেই।

আমি যা চাইছি তোমার মত আছে?

আছে।

তোমার বাবার মত?

কে বাবা? কার বাবা? আমার বাবা আমার সামনে বসে আছেন।

হরিশঙ্কর স্নিগ্ধ চোখে মুকুর দিকে তাকালেন। ভোরের নীল আকাশ অনেক সময় মানুষের দিকে এইভাবে তাকায়। ফাঁদে-পড়া ধেড়ে ইঁদুরের মতো আমার মনের অবস্থা।

ছোটদাদু বললেন, পিন্টু, এইবার তোমাকে প্রশ্ন, দেখলে তো অনেক, একই মশলার রকমভেদ, মুকুকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত আছ?

আমার মাথা অবনত। মুকু কি আমাকে মানুষ ভাবে! ওর চরিত্রের বলিষ্ঠতা আমার আছে কি? আমার সুরঞ্জনা, আমার জবা। আমার দুর্বলতার পরিধি তো কম নয়। আমি একটা ফড়িং। লাফ মেরে একবার এই ঝোপে, একবার ওই ঝোপে।

ছোটদাদু বললেন, উত্তর দাও।

আমি সব দিক থেকে ওর অযোগ্য।

আমি এই জ্ঞানোদয়টুকুই চেয়েছিলাম। যোগ্যের জন্যেই অযোগ্য। আচ্ছা শুরু করা যাক অনুষ্ঠান। একই মন্ত্রে দু’জনের দীক্ষা। মন্ত্রের জীবনবন্ধন।

অনুষ্ঠান শুরু হল। ছোটদাদু আচমন করে প্রত্যেকের হাতে একটু একটু গঙ্গাজল দিলেন। মন্ত্রটি ভারী সুন্দর,

হংস ঋষিঃ। অব্যক্তাং গায়ত্রী ছন্দ।
পরমহংস দেবতা। অহমিতি বীজম্‌।
স ইতি শক্তিঃ। সোহহমিতি কীলকম ॥

হরিশঙ্করের হাতে আমার ডান হাত, জয়নারায়ণের হাতে মুকুর ডান হাত। দু’জনে আমাদের হাত মেলালেন। ছোটদাদু লাল সুতোর সাতটা পাক মেরে বন্ধন দিলেন। সেই মিলিত হাতের ওপর শুরু হল তাঁর জপ। সময় চলে যায়। ধ্যান গভীর থেকে গভীরতর। একটা তরঙ্গ বহে চলেছে। শরীরে। একটা ঘোর। অদ্ভুত একটা ভালবাসার ভাব। একটা স্নিগ্ধতা। মুকুর আংটি চলে এল আমার আঙুলে, আমারটা মুকুর আঙুলে। ছোটদাদু কখন যে শাঁখা সিঁদুর জোগাড় করেছিলেন, তাও জানি না। আমাকে বললেন, শাঁখা পরাও, সিঁদুর দাও। ছোটদাদু বিশুদ্ধ উচ্চারণে বলছেন,

শক্তয়োহস্য জগৎ কৃৎস্ন শক্তিমাংস্তু মহেশ্বরঃ।
শক্তিস্ত শক্তিমনাদ ব্যতিরেকং ন গচ্ছতি।
তাদাত্ম মনয়োনিত্যং বহ্নি দাহি কয়োরিব ॥

ছোটদাদু বললেন, এইবার তোমরা দু’জনে আমাদের সাতবার প্রদক্ষিণ করে আসনে বোসো।

গোটা একটা মেয়ে আমার হাত ধরে গোল হয়ে ঘুরছে। মাথায় লাল ঘোমটা, হাতে শাখা, কপালে সিঁদুর। ধূপের ধোঁয়া, প্রদীপের শিখা। মন্ত্রের ওঙ্কার। ক্ষণিকের জন্যে মনে হল, এই ঘরের বাইরে তাঁবুর মতো বিশাল এক মশারির ভেতর একটি অসহায় পরিবারের অনিশ্চিত কাহিনি তৈরি হচ্ছে।

আসনে বসলুম দু’জনে। ছোটদাদু আমাদের কানে বীজমন্ত্র দিলেন। দিয়ে বললেন, কয়েকটি কথা স্মরণে রেখো। জীবনের পথে কাজে লাগবে। সুখে, দুঃখে, শান্তিতে, অশান্তিতে, সত্যকে হারিয়ে ফেলো না। উদার দৃষ্টিতে দেখবে। কখনও উৎকণ্ঠিত হবে না। বিপদে হারিয়ে ফেলো না নিজেকে। মনকে ধরে রাখবে কেন্দ্রবিন্দুতে, প্রদীপের স্থির শিখার মতো। মনকে শান্ত রাখবে, এক সেকেন্ডের জন্যেও দৃঢ়তা হারাবে না। মন হবে টলটলে তরল, নমনীয়, উদার, উন্মুক্ত, স্বাধীন। শরীর যখন বিশ্রামে তখনও মন যেন একাগ্রতা না হারায়। প্রচণ্ড ব্যস্ততা ও বিক্ষিপ্ততাতেও মাথা যেন ঠান্ডা ও স্থির থাকে। শরীর যেন মনের দ্বারা প্রভাবিত না হয়, মনও যেন শরীর নিরপেক্ষ থাকে। মনকে ধরে থাকবে, শরীরটাকে ভোলার চেষ্টা করবে। মনকে সবকিছু জানাবে, কিন্তু বাজে ব্যাপারে মাথা ঘামাবে না। বাইরের ব্যাপারে মাথা ঘামাবে না, নিজের ভেতরের শক্তিকে জাগাবার চেষ্টা করবে। ক্ষুদ্রকে বৃহতের ধারণা করতে হবে, বৃহৎকে ক্ষুদ্রের। সততাই একমাত্র মন্ত্র। জ্ঞানের পরিধি বাড়াও। জগতের সবকিছু জানো, বিচার, অবিচার সৎ, অসৎ। সমস্ত শিল্প ও দক্ষতা আয়ত্ত করো। পৃথিবী তোমাকে যেন ঠকাতে না পারে, যেন বোকা না বানাতে পারে।

ছোটদাদু হেসে বললেন, এইবার তোমরা গুরুজনদের একসঙ্গে প্রণাম করো।

প্রণাম শেষ হতেই বললেন, পুবের জানলার দিকে মুখ করে দু’জনে পাশাপাশি বোসো, মুকু বসবে তোমার বামে। তোমার বাঁ হাতের ওপর থাকবে মুকুর ডান হাত। ওই অবস্থায় একশো আটবার বীজমন্ত্র জপ করবে ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে, একসঙ্গে। মনে মনে চিন্তা করবে, মন থেকে মনে চলে গেছে মন্ত্রের উজ্জ্বল একটি সেতু। একশো আট হয়ে যাওয়ার পর, মুকু বসবে তোমার কোলে। ওইভাবে একশো আট। তারপর তোমরা মিলিত হবে। শরীরে শরীর। ঊর্ধ্বে অধে, অধে ঊর্ধ্বে। কিন্তু, সঙ্গমের হি কর্তব্যং কর্তব্যং ন তু মৈথুন। আশা করি বুঝতে পারলে। আমরা চলে যাচ্ছি। দরজা বন্ধ হচ্ছে বাইরে থেকে।

বন্ধ দুয়ার জীবের উপমা। বাইরেটা বন্ধ না হলে আত্মপ্রকাশ কী অসম্ভব! ওই দুয়ার যখন জগতের দিকে খুলে গেল আবার, তখন আর আমি নয়, আমরা দেখলুম, এক শান্ত সমাহিত সাধক, সাদা শার্ট, সাদা ধুতি পরে পথ ধরে হেঁটে চলেছেন, দূর থেকে দূরে। একবারও পেছন ফিরে তাকালেন না। যা ঘটে গেল, গেল। সম্পূর্ণ নিরাসক্ত। কৃষক যেভাবে জমিতে বীজ ছড়াতে ছড়াতে চলে যান দিগন্তের কোনও এক মহাবৃক্ষের আড়ালে। তারপর রাত আসে, মৃত্তিকার স্নেহে সময় খেলা করে যায়, দিবসের সূর্য শাসন করে, আরোপ করে তিতিক্ষা, আনন্দে উপ্ত হয় প্রাণ। চিতা জ্বলবে একের পর এক, সময়ের ব্যবধানে। সাক্ষী মহাকাল লিখবে জীবের কাহিনি, বাতাস উলটে যাবে পাণ্ডুলিপির পাতা।

আমাদের জাফরি-ঘেরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে হরিশঙ্কর নায়কের মতো হেসে বললেন, তুমিও সংসারী, আমিও সংসারী। বউমা, এইবার চা চাপাও। জীবনের লিকার যত গাঢ় হবে, আদর্শের দুধ তত বেশি ঢালবে, স্থৈর্যের চিনি।

লালমতো একটা কী চলে গেল! মুকু। জয়নারায়ণ অকৃত্রিম ছেলেমানুষের মতো বললেন, ওই দেখ তোর বউ! বউমা ডাকে নড়ছে চড়ছে। নিউ চ্যাপ্টার অফ ইয়োর লাইফ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *