২.৫১
তামাকহাটা মরিচহাটা আনাজহাটা পেছনে রেখে বড় বড় পা ফেলে বিষহরিতলার কাছে এসে পড়ল বিনুরা।
আশ্চর্য, লারমোর চেয়ার টেবিল পেতে যথারীতি রোগী দেখতে বসেছেন। এক পাশে ওষুধের মস্ত বাক্স। আরেক পাশে সুজনগঞ্জ হাটের অনেকগুলো অসুস্থ রুগণ মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। সামনের বিশাল মাঠ জুড়ে যে অত বড় একটা মিটিং চলছে, অসংখ্য হাটুরে মানুষ যে ভিড় জমিয়েছে, সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই লারমোরের। নিজের কাজের মধ্যে তিনি ধ্যানস্থ হয়ে আছেন। সমস্ত পৃথিবী জুড়ে যে এত অস্থিরতা, এত উত্তেজনা, কলকাতা-বিহার-নোনায়াখালি রক্তের নদী হয়ে যে দুলছে– লারমোরের দিকে তাকালে সে কথা কে বিশ্বাস করবে!
পেট টিপে টিপে একটা রোগীকে পরীক্ষা করছিলেন লারমোর। হেমনাথ ডাকলেন, লালমোহন—
লারমোর মুখ তুললেন। খুশি গলায় বললেন, আরে হেম যে, কখন এলে হাটে?
এই সবে। নৌকো থেকে নেমে সোজা আসছি।
বসবে তো? না হাট টাট সেরে আসবে?
বসবও না, হাটও সারব না–
তবে কী করবে?
সামনের বিশাল জনতার দিকে আঙুল বাড়িয়ে হেমনাথ বললেন, ওখানে মিটিং হচ্ছে, দেখতে পাচ্ছ?
হ্যাঁ। লারমোর ঈষৎ মাথা হেলিয়ে বললেন, অনেকক্ষণ থেকেই দেখছি। শুনলাম ঢাকা থেকে কারা এসে বক্তৃতা দিচ্ছে।
আমিও তাই শুনলাম। আর শুনেই এদিকে এলাম–
মিটিংয়ে যাবে নাকি?
হ্যাঁ। তুমিও চল–
আমার যাবার সময় কোথায়? দেখছ না, ওরা বসে আছে। এখন উঠে গেলে ওরা আমাকে খেয়ে ফেলবে। লারমোর তার রোগীদের দেখিয়ে দিলেন।
হেমনাথ বললেন, তুমি তা হলে যাবে না?
না। ওসব কচকচি আমার খুব খারাপ লাগে। নিজের কাজ আর এই সব রোগা, অসুস্থ মানুষ ছাড়া অন্য কিছু ভাল লাগে না। ঢাকার লোকেরা এসে কী-ই বা বলবে! তাতে এখানকার মানুষের উপকার কিছু হবে?
হেমনাথ হাসতে লাগলেন, তার মানে এদের ছেড়ে কোথাও যেতে চাও না তুমি?
না।
তবে তুমি এদের নিয়েই থাকো। আমরা মিটিংয়ে যাই যাও—
মিটিং শুনে এখানে আসবে তো?
আসব।
হঠাৎ কী মনে পড়ে যেতে লারমোর বললেন, হাট থেকে তুমি কখন বাড়ি ফিরবে হেম?
হেমনাথ বললেন, বিকেল নাগাদ—
আমিও তোমার সঙ্গে যাব।
সে কি, আজ এত তাড়াতাড়ি? তুমি তো হাট ভাঙবার পর সেই রাত্রিবেলা রাজদিয়ায় ফের।
আজ শরীরটা খুব ভাল লাগছে না।
হেমনাথকে উদ্বিগ্ন দেখাল, কী হয়েছে?
তেমন কিছু না। লারমোর হাসলেন, এই একটু জ্বর জ্বর মতো। আচ্ছা তোমরা মিটিংয়ে যাও। এরপর গেলে হয়তো কিছুই শুনতে পাবে না।
শেষ পর্যন্ত সামনের ওই বিশাল মাঠে, বিপুল জনতা যেখানে উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, হেমনাথদের যাওয়া হল না। লারমোরের অস্থায়ী হাসপাতাল থেকে সবে দু’পা এগিয়েছেন, মিটিং ভেঙে গেল। তারপরেই জলোচ্ছ্বাসের দিশেহারা ঢলের মতো জনতা ছুটল হাটের দিকে।
মিটিং থেকে যারা ফিরছে তারা সবাই প্রচন্ড উত্তেজিত। সমানে তারা চিৎকার করছিল, মার কাফেরগো–
মার সুমুন্দির পুতেগো—
মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছিল, লড়কে লেঙ্গে—
পাকিস্থান–
হেমনাথ আর বিনু দাঁড়িয়ে পড়েছিল।
আগে ওই মাঠে অনেক বার হাটুরে মানুষদের ভিড় করতে দেখেছে বিনু। হরিন্দ যখন দেশ দেশান্তরের খবর এনে ওখানে কেঁড়া দিত, একটা মানুষও আর হাটের চালার তলায় থাকত না। যুদ্ধের সময় সেনাদলে রিকুমেন্টের জন্য এস.ডি.ও কি ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব কিংবা মিলিটারি অফিসাররা যখন আসতেন তখনও মরিচহাটা, তামাকহাটা ফাঁকা করে সবাই ওখানে ছুটে যেত। কিন্তু এমন উত্তেজনা নিয়ে উদভ্রান্তের মতো কেউ ফিরত না।
জনতা উন্মত্তের মতো ছুটে যাচ্ছে। ঢাকার লোকগুলো তাদের কী বলেছে, কে জানে। বিনুরা বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকল।
কিছুক্ষণের ভেতর দেখা গেল, হাটের একটা চালাও আর আস্ত নেই। বাঁশের খুঁটিগুলো জনতার হাতে হাতে মারণাস্ত্র হয়ে ঘুরছে।
দেখতে দেখতে দাঙ্গা শুরু হয়ে গেল। সমস্ত সুজনগঞ্জের হাট জুড়ে কয়েক হাজার লাঠি আকাশের দিকে উঠেই নেমে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে উঠছে চিৎকার, আর্তনাদ। লোকের পায়ে পায়ে হাটের ধুলো মাথার ওপর উঠে মেঘের মতো জমতে শুরু করেছে।
অনেকক্ষণ পর আপন মনে হেমনাথ বললেন, কী সর্বনাশ!
বিনু খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। নিজের চোখে আগে আর কখনও দাঙ্গা দেখে নি সে। ভীরু গলায় ডাকল, দাদু–
কী বলছিস? অন্যমনস্কের মতো সাড়া দিলেন হেমনাথ।
আমরা কেমন করে বাড়ি যাব?
হেমনাথ বুঝিবা তার কথা শুনতে পেলেন না। বলতে লাগলেন, অন্য অন্য জায়গায় দাঙ্গা হয়েছে। কিন্তু এ পাপ তো এখানে ছিল না–
বিনু কী বলতে যাচ্ছিল, পেছন থেকে লারমোরের গলা ভেসে এল, হেম–হেম—
হেমনাথ ঘুরে দাঁড়ালেন, বিনুও ঘুরল। চোখাচোখি হতেই লারমোর বললেন, এখানে এস—
হেমনাথরা লারমোরের কাছে চলে এলেন।
উদ্বিগ্ন সুরে লারমোর বললেন, কান্ডটা দেখেছ!
হুঁ–গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন হেমনাথ।
এই সময় হাটের দিক থেকে ছুটতে ছুটতে মজিদ মিঞা এসে হাজির। তাকে পাগলের মতো দেখাচ্ছে। অস্থির গলায় সে বলতে লাগল, এ কী হইল ঠাউরভাই, এ কী হইল!
হেমনাথ কী বলবেন, ঠিক করে উঠতে পারলেন না। অত্যন্ত বিচলিত আর চঞ্চল হয়ে উঠেছেন। তিনি।
মজিদ মিঞা আবার বলল, এট্টা কিছু বিহিত করেন ঠাউরভাই। আপনের চৌখের সামনে অ্যামন খাওয়াখাওয়ি মারামারি হইব। কুনখানে কার দুষে (দোষে) দাঙ্গা হইছে হেয়াতে আমাগো কী? আমরা চিরকাল য্যামন একলগে আছি, ত্যামনই থাকতে চাই। আপনে অগো থামান ঠাউরভাই। তমস্ত জীবন। যা দেখি নাই, এই শ্যাষ বস্যে (বয়সে) হেই খুনাখুনি দেখতে হইব? তার থিকা আমার মরণ ভাল।
হেমনাথ কিছু বলবার আগেই লারমোর চেঁচিয়ে উঠলেন, এ দাঙ্গা চলতে পারে না। যেভাবেই হোক থামাতে হবে। চল’ বলেই হাটের মাঝখানে যেখানে তান্ডব চলছে, সেদিকে ছুটলেন।
মজিদ মিঞা বিনু এবং হেমনাথ লারমোর পিছু পিছু ছুটলেন। সব চাইতে প্রথমে পড়ে আনাজহাটা। সেখানে এসে দেখা গেল, অনেকগুলো লোকের হাত-পা ভেঙে গেছে, মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে। রাশি রাশি ঝিঙে-পটল-বেগুন চারধারে ছত্রখান হয়ে আছে। আহত লোবগুলো যন্ত্রণায় ক্ষতস্থান চেপে ধরে কাঁদছিল, ককাচ্ছিল, গোঙানির মতো শব্দ করে চিৎকার করছিল।
ডান দিকে মরিচহাটা, বাঁ ধারে মাছের বাজার। দু’জায়গাতইে সমানে লাঠি চলছে আর বৃষ্টি ধারার মতো ঢিল পড়ছে। সেই সঙ্গে ক্রুদ্ধ, হিংস্র, মারমুখী জনতা চেঁচাচ্ছিল?
মার শালারে—
মার বউয়ার ভাইরে–
মাইরা মাইরা কাফেরের পুতেরে শ্যাষ কইরা দে—
লড়কে লেঙ্গে—
পাকিস্থান—
কালী মাঈকি জয়–
হঠাৎ গলায় সবটুকু শক্তি ঢেলে সুজনগঞ্জের হাটটাকে চমকে দিয়ে চিৎকার করে উঠলেন লারমোর, থামা, থামা–তোরা মারামারি থামা–
মজিদ মিঞাও চেঁচাচ্ছিল, আহাম্মকের ছাওরা, অ্যামন খুনাখুনি করিস না তরা। আল্লার কিরা।
চিৎকার করতে করতে একবার মরিচহাটা, একবার মাছের বাজার, একবার গো-হাটার দিকে ছুটছিলেন লারমোর। তার পেছনে ছিল বিরা।
উন্মত্ত জনতা মজিদ মিঞা বা লারমোরের কথা কানেই তুলছিল না। হিংস্র এক ডাকিনী তাদের যেন মন্ত্র পড়ে ছেড়ে দিয়েছে। সমানে লাঠি চালিয়ে যাচ্ছিল, ঝক ঝক ঢিল ছুঁড়ছিল। তাদের চোখে হত্যা যেন ঝিলিক দিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
ছোটাছুটি করতে করতে তামাকহাটায় এসে হঠাৎ লারমারের চোখে পড়ল, একটা রুগ্ণ লোকের মাথার ওপর তিন চারটে লাঠি উদ্যত হয়ে আছে, পলক পড়বার আগেই নেমে আসবে।
লারমোর লাফ দিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। বললেন, মারিস না ওকে, মারিস না। ওই লাঠির একটা বাড়ি পড়লে ও মরে যাবে।
যারা মারবার জন্য লাঠি তুলেছিল তাদের ভেতর থেকে একজন খ্যাল খ্যাল করে হেসে উঠল, ভালাই তো, বেশি কষ্ট করতে হইব না। এক বাড়িতে যমের দুয়ারে পাঠাইয়া দিতে পারুম। তুমি যাও সাহেব
না, কিছুতেই না–মা-পাখি যেমন করে তার বাচ্চাকে ডানা দিয়ে ঘিরে রাখে তেমনি করে দু’হাত দিয়ে রুণ লোকটাকে আগলে রাখলেন লারমোর।
সেই লোকটা আবার বলল, সর সাহেব, শালারে নিকাশ কইরা দেই—
না। কদিন আগে কালাজ্বরে ও মরতে বসেছিল। কত কষ্ট করে ওকে মরার হাত থেকে ফিরিয়েছি। আমার চোখের সামনে ওকে কিছুতেই মারতে দেব না।
ভালো চাও তো সইরা যাও সাহেব—
না। লারমোর অনড় হয়ে রইলেন। তাঁর চোখে কঠিন প্রতিজ্ঞা জ্বলছে যেন।
সেই লোকটা উগ্র গলায় আবার বলল, শালা বিদ্যাশি, এইখানে আইসা মাদবরী (মাতব্বরী) ফলাও–
লারমোর চমকে উঠলেন, আমি বিদেশি!
নিয্যস।
কথাটা যেন বিশ্বাস করতে পারলেন না লারমোর। আবার প্রতিধ্বনি করলেন, আমি বিদেশি, আমি বিদেশি–
তয় কি তুমি এই দ্যাশের নাতিন জামাই? দেখছ নিজের গায়ের রংখান?
সেই লোকটার সঙ্গীগুলো অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিল। তাদের একজন বলল, প্যাচাল না পাইড়া সইরা যাও সাহেব
স্থির অগ্নিশিখার মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন লারমোর। বললেন, না–
তয় মর শালা—
কেউ কিছু বুঝবার আগেই একটা লাঠি এসে পড়ল লারমোরের মাথায়। চড়াৎ করে শব্দ হল একটা। তারপরেই রক্তের ফোয়ারা ছুটল। মাথায় হাত দিয়ে পলকে লুটিয়ে পড়লেন লারমোর।
বিনু চিৎকার করে উঠল, লালমোহন দাদুকে মেরে ফেলল, মেরে ফেলল–
মজিদ মিঞা কপালে চাপড় মারতে মারতে আর্ত, আকুল গলায় বলতে লাগল, হায় হায়, এই কি সর্বনাশ করলি ডাকাইতরা!
হেমনাথ কিছুই বললেন না। ধীরে ধীরে বসে লারমোরের বোগা, দুর্বল দেহখানা কোলে তুলে নিলেন। হেমনাথের শরীর আশ্চর্য কঠিন, শুধু ঠোঁট দুটো থর থর করছে।
এই সময় ওদিক থেকে কারা যেন সন্ত্রস্ত গলায় চেঁচিয়ে উঠল, পুলিশ আসছে, পুলিশ আসছে—
নিমেষে সামনের সেই হিংস্র, উত্তজিত হত্যাকারীর দল অদৃশ্য হয়ে গেল। শুধু তারাই না, যারা দাঙ্গা করছিল, সুজনগঞ্জ হাটের সীমানার ভেতর তাদের কারোকেই আর দেখা গেল না।
আঘাত লাগার ফলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন লারমার। দিনের আলো থাকতে থাকতেই অজ্ঞান অবস্থায় তাকে নিয়ে হেমনাথরা রাজদিয়ায় ফিরলেন। একেবারে সোজা গির্জায় নিয়ে তুললেন।
লরমোর আজকের দাঙ্গায় শিকার হয়েছেন, এই খবরটা কেমন করে যেন দিগ্বিদিকে রটে গিয়েছিল। রাজদিয়ার কুমোরপাড়া কামারপাড়া যুগীপাড়া মৃধাপাড়া নিকারীপাড়া সর্দারপাড়া–শুধু কি রাজদিয়া, চারপাশের গ্রামগঞ্জগুলো শূন্য করে কত মানুষ যে লারমোরকে দেখতে এল! বিষণ্ণ করুণ মুখে তারা আজকের এই নিদারুণ ঘটনাকে ধিক্কার দিতে লাগল, আ রে সব্বনাইশারা, তরা মারণের লেইগা মানুষ বিচরাইয়া (খুঁজে) পালি না? লালমোহন সাহেব যে আমাগো বাপের লাখান ভালবাসছে। হে যে আমাগো বাপ–
কাদের আর বিধবা পরানের মা (দু’জনেই লারমোরের আশ্রিত) অবোধ শিশুর মতো কাঁদছে। কাঁদছে আর ভাঙা গলায় বলছে, সাহেবের যদিন ভালমোন্দ কিছু হয়, আমরা কই যামু? আমাগো কী হইব? কে দেখব আমাগো? চোখের জলে তাদের বুক ভেসে যাচ্ছিল।
খবর পেয়ে স্নেহলতাও ছুটে এসেছেন। শিবানী আসতে চেয়েছিলেন। বাড়ি একেবারে ফাঁকা থাকবে বলে আসেন নি। এসেই লারমোরের শিয়রের কাছে বিষণ্ণ প্রতিমার মতো বসেছেন স্নেহলতা।
এদিকে এই বিপদের সময় হেমনাথ কিন্তু একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েন নি। রাজদিয়ায় ফিরেই ডাক্তার আনতে মজিদ মিঞাকে কমলাঘাটে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কমলাঘাটের বন্দরে বড় ডাক্তার আছে।
সন্ধের পর ডাক্তার নিয়ে তখনও মজিদ মিঞা ফেরে নি, লারমোরের জ্ঞান ফিরল। চোখ মেলে ক্ষীণ দুর্বল স্বরে তিনি ডাকতে লাগলেন, হেম–হেম কোথায়?
হেমনাথ লারমোরের পায়ের দিকে বসে ছিলেন। তাড়াতাড়ি উঠে এসে বললেন, এই যে ভাই, এই তো আমি–
আমি আর বাঁচব না—
ছি, ও কথা বলতে নেই। তোমার অনেক কাজ, বাঁচতে তোমাকে হবেই। হেমনাথের কণ্ঠস্বর অসহ্য আবেগে কাঁপছিল।
লারমোর বিচিত্র হাসলেন, তারপর অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে উঠলেন, বাঁচতে আমি চাই না হেম, চাই। ওরা আমাকে বিদেশি বলল! আমি বিদেশি! আমি বিদেশি!
হেমনাথ বললেন, কে বললে তুমি বিদেশি?
তাঁর কথা বোধ হয় শুনতে পেলেন না লারমোর। আপন মনে বলে যেতে লাগলেন, কবে এ দেশে এসেছিলাম, মনেও পড়েও না। জীবনের সবটুকুই এখানে কাটিয়ে দিলাম। এখানকার অন্ন-বস্ত্র ভাষা সমস্ত মাথায় তুলে নিয়েছি। এখানকার মানুষকে বুকে জায়গা দিয়েছি। তবু আমি বিদেশি, আমি বিদেশি–
হেমনাথ তার বুকে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগলেন, কেন তুমি কষ্ট পাচ্ছ লালমোহন? একটা উন্মাদ কী বলেছে, মনে করে রেখো না। তুমি যদি বিদেশিই হবে, এত লোক তোমাকে দেখতে এসেছে! ওই দিকে তাকাও’লারমোরের খবর পেয়ে যারা ছুটে এসেছিল, উদ্বিগ্ন মুখে এখনও তারা গির্জায় ভিড় করে আছে। হেমনাথ তাদের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিলেন।
লারমোরের দুরন্ত অভিমান একটুও শান্ত হল না। ক্লান্ত সুরে তিনি বলতে লাগলেন, একজন বললেও তো বিদেশি বলেছে-বলতে বলতে শিশুর মতো ফুঁপিয়ে উঠলেন। তার চোখের কোল বেয়ে মুক্তোর দানার মতো ফোঁটায় ফোঁটায় জল ঝরতে লাগল।
বিনু কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। লারমোরের দিকে তাকিয়ে অপার বিস্ময়ে তার মন ভরে যাচ্ছিল। এমনিতে এই মানুষটি ধীর, স্থির, সংযত। জগতে ঈশ্বরের দূত হয়েই তিনি যেন নেমে এসেছেন। কিন্তু বিদেশি, এই একটি মাত্র কথায় কী নিদারুণ অস্থিরই না হয়ে উঠেছেন। মানুষের হৃদয়ে কোথায় যে দুর্বল আবেগ নিহিত থাকে!
হেমনাথ বলতে লাগলেন, কেঁদো না–শান্ত হও—
একটুক্ষণ চুপ করে থাকার পর খুব ক্লান্ত সুরে লারমোর বললেন, আমার বড় ঘুম পাচ্ছে হেম–
বেশ তো, ঘুমোও না—
একটা কাজ করবে হেম?
কী?
হল-ঘরে যেশাসের পায়ের কাছে আমাকে নিয়ে যাবে? ওখানে গেলে আমি একটু শান্তি পেতাম। ধরাধরি করে হেমনাথরা খাটসুদ্ধ লারমোরকে হল-ঘরে নিয়ে এলেন। পূর্ব দিকের দেওয়ালে যেখানে জোতির্ময় মানবপুত্রের বিশাল ছবিটা টাঙানো রয়েছে, তার তলায় তাকে রাখলেন।
লারমোর বললেন, এবার একটু ঘুমোই হেম। ধীরে ধীরে তাঁর চোখ এবং কণ্ঠস্বর বুজে এল।
অনেক রাত্রে কমলাঘাট থেকে বড় ডাক্তার নিয়ে ফিরল মজিদ মিঞা। ডাক্তার লারমোরের গায়ে হাত দিয়েই চমকে উঠলেন। ভাল করে পরীক্ষা করে গম্ভীর গলায় জানালেন, লারমোরের চোখে চিরনিদ্রা নেমে এসেছে। মানুষের সাধ্য নেই এ ঘুম ভাঙায়।
একধারে দাঁড়িয়ে বিনু দেখল, ক্রুশবিদ্ধ যিশুমূর্তির তলায় এ কালের লাঞ্ছিত রক্তাক্ত অপমানিত আরেক ক্রাইস্ট।
খুব অল্পদিনের ভেতর পর পর দু’টো মৃত্যু দেখল বিনু। সুরমার এবং লারমোরের। সুরমার মৃত্যু বিনুর ব্যাক্তিগত ক্ষতি। কিন্তু এ মানুষটি কোত্থেকে এসে জল-বাংলার প্রতিটি বৃক্ষলতা, পশুপাখি, তৃণদল এবং মানুষের হৃদয়ে নিজের সিংহাসন পেতেছিলেন। সমস্ত শূন্য করে তিনি আজ চলে গেলেন।
গির্জার একধারে লারমোরের সমাধি দেওয়া হল। সেই জায়গাটায় একটি বেদি তৈরি করে দিয়েছেন হেমনাথ। সেটার গায়ে শ্বেত পাথরের ফলক রয়েছে। তাতে লেখা?
ডেভিড লারমোর,
জন্ম–১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৯ শে মে।
মহাপ্রয়াণ–১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ, ২২ শে ডিসেম্বর।
মানবতার প্রতীক, আর্তজনের বন্ধু, মহাপ্রাণ এই মানুষটি এখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
.
২.৫২
লারমোরের মৃত্যুর পর আশা করা গিয়েছিল, মানুষের মনে শুভবোধ জাগবে। কিন্তু কিছুই হল না। উত্তেজনা, অশান্তি, আতঙ্ক বেড়েই চলল। প্রায় রোজই খবর আসে মুসলিম লিগ এ গ্রামে ও গ্রামে এ গঞ্জে সে গঞ্জে এবং নদীর চরগুলোতে মিটিং করে বেড়াচ্ছে। চারদিকে দাঙ্গাও চলছে। হত্যা আর্তনাদ হল্লা আগুন, ইত্যাদি ছাপিয়ে বহুকণ্ঠের চিৎকার শোনা যায়, লড়কে লেঙ্গে
পাকিস্থান পালটা উত্তরও ভেসে আসে, বন্দে মাতরম–
তারপর ক’মাস আর। ভারতবর্ষের ভাগ্য একদিন স্থির হয়ে গেল। কত কালের সুপ্রাচীন এই দেশ। সাতচল্লিশের পনেরই আগস্ট তাকে কেটে দু’টুকরো করে ফেলা হবে। এক ভাগ হবে পাকিস্তান। আরেক ভাগ আবহমান কালের পুরনো নামটাই ধরে রাখবেভারত।
খবর পেয়ে মোতাহার হোসেন ছুটে এলেন। রাস্তা থেকে বাগানে পা দিয়েই চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলেন, হেমদাদা—হেমদাদা–
হেমনাথ বাড়িতেই ছিলেন। দেশভাগ নিয়ে বিনুর সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। চমকে বাইরের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, কে, মোতাহার?
হ্যাঁ।
আয়, আয়–
মোতাহার সাহেব ঘরে এসে তক্তপোষে বসলেন। তাকে খুবই বিমর্ষ দেখাচ্ছে। বললেন, খবর শুনেছেন?
কোন খবরের কথা তিনি বলছেন, হেমনাথ বুঝতে পারলেন। বললেন, শুনেছি। তোর ছাত্রের সঙ্গে তাই নিয়েই আলোচনা করছিলাম।
মোতাহার সাহেব বললেন, শেষ পর্যন্ত মুসলিম লিগ আর জিন্নারই তা হলে জয় হল!
আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন হেমনাথ, তাই তো দেখছি।
কিন্তু—
জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন হেমনাথ, কী?
প্রথমটা উত্তর দিলেন না মোতাহার সাহেব, অন্যমনস্কের মতো জানালার বাইরে ধু ধু ধানখেতের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর মুখ ফিরিয়ে হঠাৎ অত্যন্ত উত্তেজিত সুরে বলতে লাগলেন, এত মানুষ জেল খাটল, হাজার হাজার সোনার ছেলে প্রাণ দিল! না হেমা, এ আমরা চাই নি, এ আমরা চাই নি।
মোতাহার সাহেবের উত্তেজনা, অস্থিরতা ক্রমশ বাড়তেই লাগল। তিনি বলতে লাগলেন, কোন থিওরির ওপর দেশটা ভাগ হতে চলেছে, ভাবলে মাথা খারাপ হয়ে যায়।
বুঝতে না পেরে হেমনাথ শুধোলেন, কোন থিওরির কথা বলছিস মোতাহার?
জিন্নার টু নেশন থিওরি। প্রবল আক্ষেপের গলায় মোতাহার সাহেব বলতে লাগলেন, সারা জীবন একতার কথা বলে শেষে কিনা দ্বি-জাতি তত্ত্বের বিষ গিলতে হল!
হেমনাথ চুপ।
মোতাহার সাহেব থামেন নি, দেশভাগই যদি মেনে নেওয়া হল, আগে মানলেই হত। এত রক্তারক্তি, এত দাঙ্গা, এত হত্যা-ধর্ষণ-আগুন, কোনওটাই ঘটত না।
তা ঠিক।
নেতারা খেয়ালের বশে যা করলেন তার পরিণাম ভাল হবে না। দেশভাগের পেছনে কী আছে, লক্ষ করেছেন হেমদাদা?
কী আছে?
ঘৃণা বিদ্বেষ অবিশ্বাস আর শত্রুতা।
আস্তে করে মাথা নাড়লেন হেমনাথ।
মোতাহার সাহেব বলতে লাগলেন, দেশ যদি সত্যি সত্যিই ভাগ হয়, হিন্দু-মুসলমানকে চিরকাল ওই তিনটে জিনিসের জের টেনে চলতে হবে। আর সব চাইতে ক্ষতি হবে বাঙালি জাতির। এ জাতি আর কোনও দিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।
কিছুক্ষণ নীরবতা।
তারপর মোতাহার সাহেবই আবার শুরু করলেন, আপনার কী মনে হয় হেমদাদা?
কী ব্যাপারে?
দেশভাগ কি শেষ পর্যন্ত হবে?
তার মানে–হেমনাথ অবাক, সব স্থির হয়ে গেছে। একটা সেটেলড় ফ্যাক্টকে আনসেটেলড্ করা যাবে কী করে?
হেমনাথের কথা বুঝিবা শুনতে পেলেন না মোতাহার সাহেব। তার বুকের ভেতর এই মুহূর্তে কোন হাওয়া বইছে, কে জানে। দুরমনস্কের মতো তিনি বললেন, আমার কি মনে হয় জানেন হেমদাদা?
কী?
পার্টিশান আটকে যাবে।
কে আটকাবে?
দেশের মানুষ। নেতাদের এই হঠকারিতা তারা কিছুতেই, কোনও মতেই মেনে নেবে না। আপনি দেখে নেবেন। মোতাহার সাহেবের চোখ জ্বলতে লাগল। হাত মুষ্টিবদ্ধ, চোয়াল কঠিন।
এমনিতেই মোতাহার সাহেব মানুষটি বেশ গম্ভীর। তাঁর চোখ এত উজ্জ্বল আর তীক্ষ্ণ যে, সেদিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। দেখলেই ত্ম লাগে, আবার ভক্তিও হয়।
কিন্তু খুব কাছাকাছি এলে টের পাওয়া যায়, গাম্ভীর্যটা তার ছদ্মবেশ। কঠিন মাটির ঠিক তলাতেই সুশীতল জল রয়েছে, সামান্য খুঁড়লেই ফিনকি দিয়ে ফোয়ারা বেরিয়ে আসবে।
বাইরে কঠিন ভেতরে সরস, এই মানুষটি আজ কিন্তু বড়ই অস্থির, উদভ্রান্ত, চঞ্চল। মাটি খুঁড়লে আজ আর ফোয়ারা বেরুবে না, পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আগুনের হলকা হয়ে বেরিয়ে আসবে।
.
শেষ পর্যন্ত দেশজোড়া রক্তাক্ত সুতিকাগারে সেই দিনটি ভুমিষ্ঠ হল। পনেরই আগস্ট, উনিশ শ’ সাতচল্লিশ। খন্ডিত দেশের ওপর দিয়ে স্বাধীনতার রথ এল ঘর্ঘরিয়ে।
মোতাহার সাহেব দেশবাসীর ওপর ভরসা রেখেছিলেন, তারা দেশভাগ বন্ধ করবে। জননীর মতো গরীয়সী এই জন্মভূমির দেহে ছুরি বসাতে দেবে না। কিন্তু সব বৃথা। হায় রে দুরাশা!
এই মুহূর্তে দেশের সব মানুষই প্রায় অন্ধ, আচ্ছন্ন। দু’হাত দুরের জিনিস দেখবার মতো দৃষ্টিটুকু পর্যন্ত তাদের নেই। জননীদেহ কেটে কুটে ভাগাভাগি করে নেওয়া ছাড়া তারা আর কিছু ভাবতেই পারছে না।
মোতাহার সাহেবের মতো যে দু চারজন আছেন, যাঁদের দৃষ্টি আপন সময়ের সমস্ত অন্ধকার এবং কুয়াশা সরিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছয়, তারাই শুধু অসীম দুঃখে দুরন্ত অভিমানে মূক হয়ে গেছেন। এ তাঁরা চান নি।
.
২.৫৩
পনেরই আগস্ট ভোর হবার কয়েক ঘন্টা আগে পাকিস্তান ডে’ ঘোষণা করা হয়েছিল।
চোদ্দই আগস্টের মাঝরাত থেকেই রাজদিয়ার চোখে আর ঘুম নেই। ঢাকা থেকে কত ব্যান্ড পার্টি যে আনা হয়েছে। এই নগণ্য শহরের সব রাস্তা ঘুরে ঘুরে তারা বাজিয়ে চলেছে।
রাজদিয়ার চোখ থেকে ঘুম তো গেছেই, ঘরে আর কেউ নেই। বাজনার শব্দে সবাই বেরিয়ে এসেছে। ঝিনুক আর বিনুকে নিয়ে হেমনাথও বাগান পেরিয়ে ক’বার যে রাস্তায় এলেন তার হিসেব নেই।
এক সময় ভোর হল।
এবার ব্যান্ড পার্টির সঙ্গে বেরুল মিছিল। মিছিল কি দু’চারটে? ধবধবে পোশাক-পরা ছোট ছোট শিশুদের মিছিল, কিশোর-কিশোরীদের মিছিল, যুবক-যুবতীদের মিছিল। প্রতিটি মিছিল চাঁদ-তারা আঁকা সবুজ পতাকা আর জিন্নার ছবি দিয়ে সুসজ্জিত।
মিছিলগুলো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ধ্বনি দিচ্ছে:
কায়েদে আজম—
জিন্দাবাদ—
পাকিস্থান—
জিন্দাবাদ–
যেভাবে আর যে মূল্যেই হোক, স্বাধীনতা এসেছে। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরীদের কণ্ঠস্বর আর ব্যান্ড পার্টির বাজনা আকাশে বাতাসে বিচিত্র উন্মাদনা ছড়িয়ে দিচ্ছিল। হেমনাথ আর বাড়ি বসে থাকতে পারলেন না। বিনুকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেন।
মিছিলের পর মিছিল পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে এবং শোভাযাত্রা দেখতে দেখতে এক সময় সারি সারি মিষ্টির দোকান, স্টিমারঘাট, বরফ কল পেরিয়ে হেমনাথরা স্কুলবাড়ির কাছে চলে এলেন।
মিষ্টির দোকান, স্টিমারঘাট, বরফ কল কিংবা রাজদিয়ার যত বাড়িঘর– সব কিছুর মাথায় সবুজ পতাকা উড়ছে। স্টিমারঘাটটাকে ফুল-পাতা আর রঙিন কাগজ দিয়ে চমৎকার করে সাজানো হয়েছে। তা ছাড়া, রাস্তায় কুড়ি পঁচিশ হাত দুরে দূরে একটা করে তোরণ চোখে পড়ে। মাঝে মাঝে উঁচু উঁচু মঞ্চ বানিয়ে নহবত বসানো হয়েছে। সেখানে সানাই বাজছে।
আজকের এই দিনটা যে আর সব দিনের চাইতে আলাদা, রাস্তায় পা দিয়েই তা টের পাওয়া যায়। এই রাজদিয়ার ওপর দিয়ে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ দিন এসেছে, গেছে। কিন্তু এমন দিন আর কখনও আসেনি। উদাসীনভাবে অন্যমনস্কের মতো একে যেন হাত পেতে নেওয়া যায় না, বিপুল সমারোহে একে বরণ করে নিতে হয়।
স্কুলবাড়ির কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ কে যেন ডেকে উঠল, হেমদাদা—হেমদাদা–
বিনুরা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। এদিক ওদিক তাকাতেই ডান ধারে তারা মোতাহার হোসেন সাহেবকে দেখতে পেল।
স্কুলবাড়ির ঠিক গায়েই কংগ্রেস অফিস। তার দরজায় মোতাহার সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। চোখাচোখি হতেই হাতছানি দিলেন। মোতাহার সাহেব এবং তার দু’একজন সঙ্গী ছাড়া কংগ্রেস অফিস এখন একেবারে ফাঁকা।
বিনুরা পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল।
মোতাহার সাহেব বললেন, আজ এত সকালে বেরিয়ে পড়েছেন হেমদাদা?
হেমনাথ হাসলেন, ব্যান্ড পার্টির আওয়াজে আর মিছিলের চিৎকারে ঘরে থাকা গেল না যে।
আপনাকে যেন ভারি খুশি দেখাচ্ছে—
উত্তরটা এড়িয়ে গিয়ে হেমনাথ বললেন, রাজদিয়ার সব লোক বেরিয়ে পড়েছে। আমি আর কী করে ঘরে বসে থাকি বল?
অত্যন্ত ক্ষুব্ধ গলায় মোতাহার সাহেব বলতে লাগলেন, এত বড় একটা ট্র্যাজেডি ঘটে গেল, যার পরিণাম কী হবে কেউ বলতে পারে না, আর আপনি মিছিল দেখবার জন্যে, আনন্দ করবার জন্যে বেরিয়ে পড়েছেন। আপনার কাছে এ কিন্তু আশা করিনি হেমদাদা–
একটু চুপ করে থেকে হেমনাথ বললেন, যা হবার তো হয়েই গেছে। তার জন্যে মনে দুঃখ রেখে কী লাভ? হয়তো এতে ভালই হবে। দেশ জুড়ে যে রক্তারক্তি আর হত্যা চলছিল তা চিরদিনের মতো বন্ধ হয়ে যাবে। যা এসেছে তাকে প্রসন্ন মনেই গ্রহণ কর মোতাহার।
মোতাহার সাহেব খুব একটা সান্ত্বনা পেয়েছেন, এমন মনে হল না। ক্ষোভ বিষাদ দুঃখ, সব একাকার হয়ে তার মুখখানাকে মলিন করে রাখল।
বিনু অবাক হয়ে হেমনাথকে দেখছিল। আজই শুধু না, রাজদিয়ায় আসার পর থেকেই দাদুকে দেখছে সে। ভালমন্দ শুভাশুভ, যা-ই সামনে এসে দাঁড়াক তাকে তিনি সানন্দে, পরম উদারতার সঙ্গে বুকে তুলে নিতে পারেন। তার চরিত্রের মূলমন্ত্র এখানেই।
হেমনাথ বললেন, এখন চলি রে মোতাহার—
মোতাহার হোসেন উত্তর দিলেন না।
হেমনাথ আবার বললেন, আমাদের সঙ্গে তুই যাবি?
নীরস সুরে মোতাহার সাহেব জানালেন, যাবেন না।
আবার বড় রাস্তায় এসে পড়ল বিনুরা। পুব দিকে খানিকটা গেলেই সেটেলমেন্ট অফিসের পাশে মুসলিম লিগের অফিস। লিগের অফিসটাকে আজ আর চেনাই যায় না। ফুলে-পাতায়, রঙিন কাগজে আর অসংখ্য সবুজ পতাকায় তার চেহারা বদলে গেছে। কত মানুষ যে সেখানে ভিড় জমিয়েছে, লেখাজোখা নেই। লিগের অফিসটা ঘিরে এই মুহূর্তে বিরাট উৎসব চলছে।
হঠাৎ কংগ্রেস অফিসটার কথা মনে পড়ে গেল বিনুর। একটু আগেই সেখান থেকে তারা এসেছে। মুসলিম লিগের এই উৎসবমুখর জমকালো বাড়িটার তুলনায় সেটার দৃশ্য বড় করুণ এবং নিষ্প্রভ। অথচ কদিন আগেও কংগ্রেস অফিসে ভিড় লেগে থাকত। রাতারাতি সব বদলে গেছে।
লিগ অফিসের কাছে আসতেই রজবালি শিকদার ছুটে এল। তার দেখাদেখি আরও অনেকে। ইদানীং রজবালি এ অঞ্চলে লিগের বড় নেতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসেই রজবালি হেমনাথকে বুকে জড়িয়ে ধরে। সে বলল, আপনে আইছেন হ্যামকত্তা! দেখেও সে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।
সহজ গলায় হেমনাথ বললেন, হ্যাঁ, এলাম। পাটিশানের পর এ দেশ যদি পাকিস্তান হয়ে থাকে, আমরা তা হলে পাকিস্তানী। এমন দিনে আমরা আসব না?
অভিভূত স্বরে রজবালি শিকদার বলল, নিয্যস নিয্যস—
কে একজন চেঁচিয়ে উঠল, আরে কেউগা আছস, গুলাপ জল লইয়া আয়, হ্যামকত্তারে দে–
একজন ছুটে গিয়ে রুপোর পিচকিরিতে গোলাপ জল এনে বিনুদের মাথায় ছিটিয়ে দিল। শুধু বিনুরাই নয়, হিন্দু-মুসলমান যারাই লিগ অফিসের কাছে আসছে তাদেরই বুকে জড়িয়ে ধরা হচ্ছে, গোলাপ জলে সিক্ত করে দেওয়া হচ্ছে।
লিগ অফিসের একজন বলল, পাকিস্থান হইয়া গ্যাছে। যা চাইছিলাম তা পাইছি। আইজ থিকা আপনাগো লগে আমাগো কাইজা বন্ধ।
হেমনাথ হাসতে হাসতে বললেন, আমার সঙ্গে কিন্তু কখনও কারোর ঝগড়া নেই।
তাড়াতাড়ি জিভ কেটে লোকটা বলল, আপনের কথা কই না হ্যামকত্তা–
তবে?
হিন্দুগো কথা কই।
আমি বুঝি হিন্দু না?
রজবালি বলল, আপনের লগে কার তুলুনা! আপনে হিন্দুও না, মুসলমানও না। আপনে হগলের হ্যামকা–তার কণ্ঠস্বর আবেগে কাঁপতে লাগল।
আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর হেমনাথ বললেন, এখন যাই রে রজবালি।
অহনই যাইবেন?
সুর্য উঠে গিয়েছিল। সকালের নরম সোনালি রোদ নদীর ঢেউয়ে টলমল করছে। ঝাঁকে ঝাঁকে শঙ্খচিল উড়ছিল। মাসটা যদিও শ্রাবণ, আজকের আকাশ আশ্চর্য উজ্জ্বল, পালিশ-করা নীল আয়নার মতো তার গা থেকে দীপ্তি বেরুচ্ছে। আর আছে ভারহীন ভবঘুরে মেঘ। উলটোপালটা পুবের বাতাস তাদের তাড়িয়ে তাড়িয়ে একবার এদিকে, আবার ওদিকে নিয়ে যাচ্ছে।
হেমনাথ বললেন, সেই কখন বেরিয়েছি! কত বেলা হয়ে গেল।
রজবালি বলল, অ্যামন দিনে হুদা মুখে যাইতে পারবেন না। আইজ ইট্টু মেঠাই মুখে দিতে হইব।
এখন মিষ্টিটিষ্টি খেতে পারব না বাপু।
তয় বাইন্দা দেই, বাড়ি নিয়া যাইবেন।
হেমনাথ হাসতে হাসতে বললেন, ছাড়বি না যখন, তখন দে। বাড়িই নিয়ে যাই।
দেখা গেল, হেমনাথদের শুধু নয়, যারাই লিগ অফিসের কাছে আসছে মিষ্টিমুখ না করে কেউ ছাড়া পাচ্ছে না।
রজবালি নিজের হাতে মিষ্টির একটা হাঁড়ি এনে হেমনাথকে দিল। তারপর বলল, বিকালবেলা কোটের (কোর্টের) মাঠে আইসেন।
রাজদিয়ায় ফৌজদারি আর দেওয়ানি আদালত দুটো পাশাপাশি। তার সামনে মস্ত মাঠ। হেমনাথ শুধোলেন, সেখানে কী?
মিটিন হইব। ঢাকার থিকা বড় ন্যাতারা আইসা বতিতা করব। আইসেন কিলাম।
আসব।
বাড়ি আসতেই স্নেহলতা জানালেন, মীরপাড়া-মৃধাপাড়া সর্দারপাড়া, রাজদিয়ায় যত মুসলমান বাড়ি আছে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে সব জায়গা থেকে মিষ্টি পাঠিয়েছে।
.
বিকেলবেলা আদালত পাড়ার মাঠে এসে দেখা গেল, লোকে লোকারণ্য। রাজদিয়ারই শুধু না, চারদিকের গ্রামগঞ্জ থেকে মানুষ ভেঙে পড়েছে।
রজবালি কোথায় ছিল, ছুটে এল। যেখানে শহরের গণ্যমান্য শ্রদ্ধেয় মানুষরা বসে আছেন, তাঁদের পাশে দুটো চেয়ারে হেমনাথ আর বিনুকে নিয়ে বসাল।
ঢাকা থেকে নেতারা এসেছিলেন। তারা পাকিস্তান দিবসের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করলেন। তারপর স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যাক্তিদের কিছু বলতে অনুরোধ করা হল।
যদিও মুসলিম লিগ এই সভা আয়োজন করেছে, তবু হঠাৎ রজবালি শিকদার বক্তা হিসেবে। হেমনাথের নাম প্রস্তাব করে বসল। অগত্যা হেমনাথকে পাকিস্তান সম্বন্ধে দু’চার কথা বলতে হল।
সভা শেষ হতে সন্ধে হয় গেল। তারপর শুরু হল আতসবাজির খেলা। কতরকম যে বাজি আনা হয়েছে হিসেব নেই। কোনওটা আকাশে গিয়ে আলোর ময়ূর হয়ে যাচ্ছে, কোনওটা চিল, কোনওটা বাঘ, কোনওটা আবার সিংহ। একেকটা হাউই উড়ে গিয়ে আগুনের ফুলকি দিয়ে লিখে দিচ্ছে পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ কিংবা কায়েদে আজম, জিন্দাবাদ। তলায় হাজার কন্ঠে উল্লসিত জয়ধ্বনি উঠছে?
পাকিস্তান—
জিন্দাবাদ।
কায়েদে আজম—
জিন্দাবাদ।
বাজি পোড়ানো দেখে হেমনাথরা যখন বাড়ি ফিরলেন, মাঝ রাত পার হয়ে গেছে।
.
২.৫৪
সাতচল্লিশে দেশভাগ হল। তারপর দেখতে দেখতে আরও তিনটে বছর কেটে গেল।
এর মধ্যে বি. এ পাস করেছে বিনু। ঝিনুক ম্যাট্রিক পাস করে রাজদিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে গেছে।
ওদিকে যুদ্ধের সময় ঝোঁকের বশে যে অবনীমোহন কন্ট্রাক্টরি নিয়ে আসাম চলে গিয়েছিলেন, সেখানেও বেশিদিন থাকেন নি। যুদ্ধ থামবার সঙ্গে সঙ্গে তার শখ মিটে গিয়েছিল। আসলে যুদ্ধ শেষ। ঠিকাদারিরও প্রয়োজন মিটে গেছে। কন্ট্রাক্টরি ছেড়েছুঁড়ে অবনীমোহন কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন, সেখানে ব্যবসা শুরু করেছেন।
কলকাতায় গিয়েই বিনুকে পাঠিয়ে দেবার জন্য হেমনাথকে চিঠি দিয়েছিলেন অবনীমোহন। বিনু যায় নি। তারপর ছেচল্লিশের দাঙ্গার সময় কিংবা দেশভাগের সময়ও যাবার কথা লিখেছিলেন। তখনও বিনু যায় নি। দেশভাগের সময় অবশ্য জমিজমা বিক্রি করে হেমনাথকেও চলে যেতে লিখেছিলেন অবনীমোহন। সুধা সুনীতি কলকাতাতেই আছে। তারাও ওই একই কথা লিখত। এখনও নিয়মিত লিখে যাচ্ছে।
পাকিস্তান দিবসকে ঘিরে রাজদিয়ায় যে উদ্দীপনা দেখা দিয়েছিল, ভাটার টানের মতো ধীরে ধীরে তা স্তিমিত হয়ে গেছে। এখানকার জীবন আবার পুরনো ঢিমে তালে বাজতে শুরু করেছে।
তিন বছর আগের মতোই চৈত্র বৈশাখের রোদে মাটি ফেটে চৌচির হয়েছে, দিগন্তে আগুনের হলকা নেচে নেচে গেছে। গ্রীষ্মের পর শ্যামল বেশে এসেছে বর্ষা। মাঠ ভাসিয়ে, ধানখেত পাটখেত ডুবিয়ে চারদিক একাকার করে দিয়েছে। তারপর আকাশে মাটিতে পরিচিত ছবি এঁকে একে একে দেখা দিয়েছে শরৎ-হেমন্ত-শীত-বসন্ত। রাজদিয়ার মানুষ তিন বছর আগের মতো পাট বুনেছে, ধান কেটেছে, খেতে নিড়ান দিয়েছে, নৌকো বেয়েছে। মটর কলাইর খেতে ছেই’ সেদ্ধ করে খেয়েছে,গলুয়ায় (মেলায়) গিয়ে বউর জন্য আলতা কিনেছে, ফুলেল তেল কিনেছে। মাঠ পাড়ি দিয়ে গেছে সুজনগঞ্জের হাটে, কিংবা ম্যালেরিয়ায় ভুগে ভুগে অস্থির হয়ে উঠেছে। তিন বছর আগের মতোই তারা ভাসান গান গেয়েছে, সারি জারি আর রয়ানিতে চারদিক মুখর করে তুলেছে।
তিন বছর আগের মতোই ভেসালের বাঁশে শঙ্খচিল বসেছে। ধানখেতের আলে আলে জলসেঁচি শাকের অরণ্য উদ্দাম হয়ে উঠেছে। বিলগুলো পানকলস আর জলসিঙাড়ায় ছেয়ে গেছে। পৌষ মাঘ মাসে শীতের দেশ থেকে এসেছে যাযাবর পাখিরা, গরম পড়তে না পড়তেই তারা ফিরে গেছে। কাঁচের মতো স্বচ্ছ জলের তলায় টাটকিনি আর ভাগনা, গজার আর বজুরা, কাঁচকি আর বাজালি মাছেরা ডিম পেড়ে রুপোলি ফসলে জল-বাংলাকে পরিপূর্ণ করে তুলেছে।
তিন বছর আগের মতো কাউফলের গাছগুলোতে ফুল ধরেছে, বউনাগাছের শরীর ফুলে ভরে গেছে। কালো কালো মসৃণ মুত্রার মাথায় অসংখ্য সাদা ফুলের সুগন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। যেখানেই চোখ ফেরানো যাক-ধানের খেতে, শাপলাবনে, বেতঝোপে কি খাল-বিল-নদীতেসব দিকেই জল বাংলার এই অপরূপ বসুন্ধরা আগের মতোই রমণীয়। র্যাডক্লিফ রোয়েদাদের ছুরি ভারতবর্ষকে দু’খানা করে কেটে ফেলার পরও রাজদিয়ার কিন্তু তেমন কোনও পরিবর্তন নেই। তার আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতি প্রায় একই নিয়মে চলেছে।
তবে দূর-দূরান্ত থেকে খবর আসছিল, পাকিস্তান হবার পরই এদেশে ভাঙন শুরু হয়ে গেছে। সাতপুরুষের ঘর-ভদ্রাসন ছেড়ে দলে দলে মানুষ আসাম আর আগরতলায় চলে যাচ্ছে। বেশির ভাগ যাচ্ছে কলকাতার দিকে। নোয়াখালি বরিশাল ফরিদপুর কুমিল্লা, এমনকি ঢাকা জেলার নানা গ্রাম গঞ্জ থেকেও ওই একই খবর আসছিল।
মোতাহার হোসেন সাহেব মাঝে মাঝে আসেন। বিষণ্ণ সুরে বলেন, খবর পাচ্ছেন হেমনাথ দাদা?
আস্তে আস্তে মাথা নাড়েন হেমনাথ। ঝাঁপসা গলায় বলেন, পাচ্ছি।
আপনি তো বলেছিলেন, পাকিস্তান হয়ে গেলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু এ কী হচ্ছে?
হেমনাথ উত্তর দেন না, বিমর্ষ মুখে চুপচাপ বসে থাকেন।
উত্তেজিতভাবে এবার মোতাহার সাহেব বলতে থাকেন, সমাধানই যদি হয়ে যাবে, হাজার হাজার মানুষ ইস্ট পাকিস্তান ছেড়ে চলে যাচ্ছে কেন?
এবারও হেমনাথ নীরব।
.
এর ভেতর একটা ব্যাপার ঘটে গেল।
একদিন দুপুরবেলা বিনুরা সবে খেয়ে উঠেছে, বাগানের দিক থেকে খুব চেনা একটা গলা ভেসে এল বড়কত্তা, বড়কত্তা–
হেমনাথ চেঁচিয়ে বললেন, কে রে?
আমি যুগইলা–বলতে বলতে সত্যিসত্যিই যুগল সামনে এসে দাঁড়াল।
যুগলের গলা পেয়ে স্নেহলতা আর শিবানীও বেরিয়ে এসেছিলেন।
দশ বছর আগে নতুন বৌকে নিয়ে সেই যে ভাটির দেশে দ্বিরাগমনে গিয়েছিল যুগল, তারপর এই প্রথম তাকে দেখা গেল।
প্রায় তেমনই আছে যুগল, তেমনি হিলহিলে বেতের মতো পাতলা চেহারা, তেমনি খাড়া খাড়া চুল। তবে এই মুহূর্তে তাকে অত্যন্ত উদভ্রান্ত আর অস্থির দেখাচ্ছে। রীতিমতো আতঙ্কগ্রস্ত সে।
এতকাল পর যুগলকে দেখে সবাই ভারি খুশি। স্নেহলতা শিবানী তো চেঁচামেচিই জুড়ে দিলেন, বোস যুগল, বোস–
যুগল বসল না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা বলতে লাগল, অহন বসুম না ঠাউরমা। আপনেগো লগে দেখা কইরাই যামু গা।
যাবি যাবি। কতকাল তোকে দেখি না। সেই যে শ্বশুরবাড়ি চলে গেলি, ভুলেও আর এদিক মাড়াস না। শ্বশুর-শাশুড়ি পেয়ে আমাদের একেবারে ভুলেই গেছিস। সে যাক গে, এখন এলি কোত্থেকে?
ভাটির দ্যাশ থিকা।
শ্বশুরবাড়ি থেকে?
হ।
ছেলেপুলে হয়েছে?
হ।
ক’টা?
দুই পোলা।
একা একা এলি যে, বউ ছেলেদের সঙ্গে আনলি না কেন?
একটু চুপ করে থেকে আবছা গলায় যুগল বলল, অরা আসছে—
স্নেহলতা শিবানী হেমনাথ, তিনজনেই একসঙ্গে বলে উঠলেন, কোথায় রে, কোথায়?
ইস্টিমারঘাটায়—
স্টিমারঘাটে বসিয়ে এসেছিস যে, তোরা আস্পর্ধা তো কম নয়! ঘরের বৌকে রাজদিয়া পর্যন্ত এনে বাড়িতে তুললি না!
মুখখানা কাঁচুমাচু করে যুগল বলতে লাগল, গুসা কইরেন না। তাগো আননের সোময় আছিল না, আনলেই দেরি হইয়া যাইত। আইজের ইস্টিমার ধরতে পারতাম না। দ্যাশ ছাইড়া জম্মের মতো যাওনের আগে আপনেগো লগে দেখা কইরা গ্যালাম।
হেমনাথ উৎকণ্ঠিত হলেন, কোথায় চলছিস দেশ ছেড়ে?
কইলকাতা।
কলকাতায় কেন?
ভাটির দ্যাশে আর থাকন গেল না বড়কত্তা। আগুন দিয়া গেরামকে গেরাম পোড়াইয়া দিছে, চৌখের সুমুখ থিকা ফসল কাইটা লইয়া যায়। অ্যাত অত্যাচার সইয়া থাকন যায় না। হেইর লেইগা যাইতে আছি গো।
একটু চুপ। পলকে সমস্ত আবহাওয়াটা বদলে গেল। চারদিক থেকে বিচিত্র এক বিষণ্ণতা সবাইকে ঘিরে ধরতে লাগল।
একসময় হেমনাথ বলে উঠলেন, কলকাতায় কোনও দিন যাস নি। অচেনা জায়গায় গিয়ে কী করবি, কোথায় থাকবি, কী খাবি–তার কি কিছু ঠিক আছে! বরং এক কাজ কর, বৌ ছেলেদের নিয়ে এখানেই চলে আয়। রাজদিয়াতে কোনও গোলমাল নেই।
খানিক ভেবে যুগল বলল, না বড়কত্তা, কইলকাতাতেই যামু। রাইজদাতে গন্ডগোল নাই বুঝলাম, কিন্তুক হইতে কতক্ষণ? কতখানে যে খুন জখম আরম্ভ হইয়া গ্যাছে! হেয়া ছাড়া
কী?
আমার হউর (শ্বশুর), তিন খুড়া হউর, দুই পিসাত ভায়রা আর তাগো গুষ্টি আমার লগে যাইতে আছে। তাগো ফেলাইয়া আমি ক্যামনে আসি? এত মাইনষের জাগা দ্যাওন তো সোজা না বড়কত্তা–
মনে মনে হেমনাথ ভেবে দেখলেন, কথাটা ঠিকই বলেছে যুগল। শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় স্বজনদের ফেলে একা একা সে এখানে আসতে পারে না। আবার সবাই এলে এতগুলো মানুষকে আশ্রয় দেওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব।
হেমনাথ এবার অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন, ভাটির দেশ থেকে কি অনেক লোক চলে যাচ্ছে?
মেলা বড়কত্তা, মেলা। যা দশ বিশ ঘর আছে, হেরাও থাকব না। দুই চাইর দিনের ভিতরে সাফ হইয়া যাইব। একটু থেমে যুগল আবার বলল, যদিন পারেন আপনেরাও যাইয়েন গা।
হেমনাথ উত্তর দিলেন না।
যুগল এবার বলল, আর খাড়ইতে পারুম না। ইস্টিমার ছাড়নের সোময় হইয়া আইল। যাই গা ঠাউরমা, যাই বড়কত্তা, চলোম ছুটোবাবু- হেমনাথ শিবানী আর স্নেহলতাকে প্রণাম করে একটু পর চলে গেল যুগল।
যুগল চলে যাবার পর পুবের ঘরের তক্তপোষে শুয়ে শুয়ে তার কথাই ভাবছিল বিনু। ওরা কলকাতায় যাচ্ছে।
আট ন’বছর আগে বিনুরা যেদিন প্রথম রাজদিয়া এল সেদিনই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কলকাতার কত খবর নিয়েছিল যুগল। কলকাতা তখন তার কাছে স্বপ্ন, তার কল্পনায় কলকাতা রমণীয় স্বর্গ হয়ে ছিল।
কিন্তু চল্লিশের কলকাতা আর এখনকার কলকাতা কি এক? প্রতিদিন ডাকে যে খবরের কাগজ আসে তাতে কলকাতার ভয়াবহ ছবি থাকে। সুবিশাল ওই মহানগর নাকি উদ্বাস্তুতে ছেয়ে গেছে। কোথাও থাকবার জায়গা নেই। তাই ছিন্নমূল নরনারীর দল রেল স্টেশনে, ফুটপাতে, রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছে।
আজকের কলকাতা যুগলকে কোন স্বর্গে পৌঁছে দেবে, কে জানে।
.
২.৫৫
যুগল যা ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিল, অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল। একটা মাসও তারপর কাটে নি, রাজদিয়ার মাটি তেতে উঠল।
ঢাকা থেকে এসে কারা যেন সুজনগঞ্জে, মীরকাদিমে, ওদিকে আউটশাহী বেতকা আবদুলাপুরে প্রায় মিটিং করে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের চালে আগুন লাগছে, মাঠের পর মাঠ পাকা ধান কারা রাতের অন্ধকারে কেটে নিয়ে যাচ্ছে। শুধু কি তাই, সন্ধে হলেই ঘরের চালে চালে ঢিল পড়ে, দেশ ছেড়ে চলে যাবার জন্য বেনামা চিঠি আসে। এমন চিঠি খানকতক হেমনাথও পেয়েছেন।
ব্যাপারটা এতেই থেমে থাকল না। সুজনগঞ্জের হাট থেকে ফিরবার পথে সেদিন বারুইপাড়ার রাখাল আর যুগীপাড়ার রাধাবল্লভ সড়কির ঘা খেয়ে এল। তারপর যেদিন গণকপাড়ার কাঁপাসীকে খুঁজে পাওয়া গেল না সেদিন থেকে এই রাজদিয়াতেও ভাঙন শুরু হয়ে গেল। গণকপাড়া তো বটেই, কুমোরপাড়া কামারপাড়া বারুইপাড়া নাহাপাড়া, সব জায়গা থেকেই দলে দলে মানুষ ভিটেমাটি ফেলে স্টিমারে করে কলকাতার দিকে চলে যেতে লাগল। হেমনাথ আর মোতাহার সাহেব পিস কমিটি করেও ভাঙন ঠেকাতে পারলেন না।
ইদানীং সব চাইতে আশ্চর্য ব্যবহার হয়েছে মজিদ মিঞার। আগে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই হেমনাথের বাড়ি আসত সে, আজকাল হাজার ডাকাডাকি করলেও আসে না। দেখা হলে এড়িয়ে যায়। তার সম্বন্ধে নানারকম কথা কানে আসছে। লোকটা অদ্ভুতভাবে বদলে গেছে।
শোনা যায়, মজিদ মিঞা নাকি কেতুগঞ্জের দিকে লিগের পান্ডা হয়ে উঠেছে। আশ্চর্য, এই মানুষই দশ বছর আগে, বিনুরা প্রথম যেদিন রাজদিয়ায় এল, পনৈর মাইল জল ঠেলে তাদের দেখতে এসেছিল। এই মানুষই সিগারেট খাবার জন্য তাকে মেরেছিল, মারের চোটে জ্বর এলে সারারাত তার শিয়রে বসে কেঁদেছিল। সুজনগঞ্জের হাটে দাঙ্গা বাধলে এই মানুষই পাগলের মতো ছোটাছুটি করেছিল। রক্তাক্ত, আহত অবস্থায় লারমোরকে রাজদিয়ায় নিয়ে আসার পর সে কমলাঘাটে ছুটেছিল ডাক্তার আনতে। তার হৃদয়ের উত্তাপ, তার আত্মীয়তাবোধ, তার মমতা, মহত্ত্ব বিনুকে এতকাল মুগ্ধ করেছে। আশ্চর্য, সেই মানুষটা বদলে গেল!
রাজদিয়ায় ততটা না হলেও আশেপাশের গ্রামগঞ্জগুলো থেকে প্রায়ই খুন-জখম-আগুনের খবর আসছিল। রাত হলেই উন্মত্ত চিৎকার শোনা যায়, অন্ধকার চিরে চিরে মশালের আলো দপদপ করে জুলতে থাকে।
একদিন আরও নিদারুণ খবর এল। রাজদিয়া থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত যে স্টিমার সারভিস ছিল তা বন্ধ হয়ে গেছে। সমস্ত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাজদিয়া যেন অজানা দ্বীপের মতো জলবাংলার এই প্রান্তে পড়ে রইল।
শুধু রাজদিয়া বা চারধারের গ্রামগুলোতেই নয়, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-মানিকগঞ্জ থেকেও গোলমালের খবর আসছিল।
যত শুনছিলেন, যত দেখছিলেন, ততই যেন স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছিলেন হেমনাথ। সমস্ত জগৎ থেকে কিছুদিনের জন্য নিজেকে গুটিয়ে এনে চুপচাপ বসে রইলেন। ঠিক বসে রইলেন না, সেই বড় বড় লোহার বাক্সগুলো খুলে সারা জীবনের সঞ্চয় অসংখ্য ভাল ভাল জিনিস– ময়ূরের পালক, সুন্দর হস্তাক্ষর, চকচকে পাথর, চমৎকার ছবি দেখে দেখে কাটালেন। মন খারাপ হলেই তিনি এগুলো নিয়ে বসেন। সারাদিন এসব দেখবার পর সন্ধেবেলা গির্জায় লারমোরের সমাধিতে বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে আসতে লাগলেন।
দিনকয়েক পর হঠাৎ বুঝিবা হেমনাথের মনে হল, এভাবে নিজেকে গুটিয়ে এনে ঘরে বসে থাকা ঠিক হয়নি। আবার আগের মতো তিনি গ্রাম গ্রাম ঘুরতে লাগলেন। এই দুঃসময়ে তিনি পাশে থাকলে সবাই ভরসা পাবে।
.
চারদিক জুড়ে যখন আগুন জ্বলছে সেইসময় একদিন দুপুরবেলা ভবতোষ এলেন। চুল এলোমেলো, চোখের কোলে শ্যাওলার মতো কালচে দাগ, মুখময় তিন চার দিনের দাড়ি, চোখ আরক্ত। সমস্ত শরীর ঘিরে সীমাহীন বিষণ্ণতা।
দশ বছর ধরে ভবতোষের এই এক চেহারাই দেখে আসছে বিনু।
এসেই ভবতোষ বললেন, খুব খারাপ খবর কাকাবাবু—
হেমনাথ বাড়িতেই ছিলেন। উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, কী ব্যাপার?
ঝিনুকের মা মৃত্যুশয্যায়। শেষ সময়ে ঝিনুক আর আমাকে একবার দেখতে চেয়েছে।
কে বললে?
সেই খবর পাঠিয়েছে।
একটু ভেবে হেমনাথ বললেন, ঝিনুকের মা এখন কোথায়?
ঢাকায়।
তোর শ্বশুরবাড়ি?
না।
তবে?
যার সঙ্গে চলে গিয়েছিল তার কাছেই আছে।
কিন্তু–
কী? জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন ভবতোষ।
হেমনাথ বললেন, স্টিমার বন্ধ। চারদিকে গোলমাল চলছে। এর ভেতরে ঢাকায় যাবি কী করে?
আমি একটা বিশ্বাসী মাঝি ঠিক করে রেখেছি, সেই নৌকোয় করে নিয়ে যাবে। ভয়ের কিছু নেই।
এ সময় পাঠানো উচিত না। ঝিনুক বড় হয়েছে। তবু ওর মায়ের কথা ভেবে না পাঠিয়ে পারছি না। খুব সাবধানে যাবি কিন্তু–
ভবতোষ মাথা নাড়লেন।
হেমনাথ আবার বললেন, কবে ফিরবি?
তিন চারদিনের মধ্যে।
ঝিনুককে সঙ্গে নিয়ে ভবতোষ চলে গেলেন।
.
২.৫৬
তিন চারদিনের জায়গায় ষোল সতের দিন কেটে গেল। তবু ঝিনুকরা ফিরছে না। তাদের কোনও বিপদ ঘটল কিনা, বোঝা যাচ্ছে না। স্নেহলতা শিবানী এবং হেমনাথ অস্থির হয়ে উঠলেন। আর বিনু?
কৈশোর আর যৌবনের প্রায় দশটা বছর ঝিনুকের সঙ্গে একই বাড়িতে কাটিয়ে দিয়েছে সে। মাঝে মাঝে ভবতোষ ঝিনুককে নিয়ে গেছেন ঠিকই। কিন্তু দু’একদিন পরেই সে ফিরে এসেছে। একসঙ্গে ষোল সতের দিন তাকে ছেড়ে কখনও থাকে নি বিনু।
ঝিনুক যেন শ্বাসবায়ুর মতো সহজ। কাছে থাকলে টের পাওয়া যায় না। এই দশ বছরে ধীরে ধীরে জীবনের কতখানি জায়গা জুড়ে সে ব্যাপ্ত হয়ে আছে, এই প্রথম বুঝতে পারল বিনু। ঝিনুকের জন্য প্রতি মুহূর্তে তার শ্বাস যেন রুদ্ধ হয়ে আসতে লাগল।
শেষ পর্যন্ত ঠিক হল, হেমনাথ ভবতোষদের খোঁজে ঢাকায় যাবেন। বিনুও সঙ্গে যেতে চেয়েছিল, হেমনাথ নেন নি। বললেন, দু’জনে গেলে কী করে চলবে? বাড়িতে একজন পুরুষমানুষ থাকা দরকার।
দিনতিনেক পর ঝিনুককে নিয়ে ঢাকা থেকে ফিরলেন হেমনাথ। কিন্তু এ কোন ঝিনুক? চুল আলুথালু। চোখের দৃষ্টি স্থির, উদ্ভ্রান্ত। গালে-ঠোঁটে-হাতে, সমস্ত শরীরে কত জায়গায় যে মাংস উঠে উঠে রক্তারক্তি হয়ে আছে! পরনের জামাটা, শাড়িটা নানা জায়গায় ছেঁড়া। কোনও রাক্ষস যেন তার শরীরের সার শুষে নিয়েছে।
ঝিনুককে দেখেই শিবানী স্নেহলতা কেঁদে ফেললেন, কী হয়েছে ঝিনুকের? কী হয়েছে? ভব কোথায়?
হেমনাথকেও চেনা যাচ্ছিল না। শক্তিমান, ঋজু মানুষটা একেবারে ভেঙেচুরে গেছেন যেন। তাঁকে একটা ধ্বংসস্তূপ বলে মনে হচ্ছে।
আড়ষ্ট, ভাঙা গলায় হেমনাথ বললেন, ভব নেই।
স্নেহলতা চিৎকার করে উঠলেন, কী হয়েছে ভব’র? বল–বল–
হেমনাথ যা বললেন, সংক্ষেপে এই রকম। এখান থেকে ঢাকা পৌঁছবার পর ভবতোষ দাঙ্গার ভেতর পড়েছিলেন। ঘাতকের দল ভবতোষকে মেরে ফেলেছে। তারপর ঝিনুককে নিয়ে চলে গিয়েছিল। হেমনাথ ঢাকায় গিয়ে পুলিশ দিয়ে ঝিনুককে উদ্ধার করেছেন। কিন্তু ভাবতোষের মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া যায় নি।
শ্বাপদেরা ষোল সতের দিন একটা বাড়িতে ঝিনুককে আটকে রেখেছিল। যে অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয়েছে, তার চাইতে সে যদি মরে যেত!
স্নেহলতা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, কেন মরবে, কেন? কী দোষ ওর?
হেমনাথ ঝাঁপসা গলায় বলতে লাগলেন, কেন যে ওদের আমি ঢাকায় যেতে দিলাম। আমি যদি তখন শক্ত হতাম, কিছুতেই ওরা যেতে পারত না। ভবতোষ মরল। আর এই সোনার প্রতিমা নিজের হাতে বিসর্জন দিলাম।
একধারে দাঁড়িয়ে পলকহীন ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে ছিল বিনু। একটা কথাও বলতে পারছিল না। বার বার তার মনে হচ্ছিল, তীক্ষ্ণমুখ অগণিত তীর তার হৃৎপিন্ড বিদ্ধ করে যাচ্ছে।
ঢাকা থেকে আসবার পর দুটো দিন কিছু খেল না ঝিনুক, ঘুমলো না, এমনকি একটা কথাও পর্যন্ত বলল না। দিনরাত শূন্য চোখে দূর ধানখেতের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে বসে থাকল।
পুরো দুদিন পর ঝিনুক ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, আমাকে তোমরা মেরে ফেল, আমাকে মেরে ফেল।
স্নেহলতা সান্ত্বনা দেবেন কি, নিজেই কাঁদতে লাগলেন। ঝিনুকের পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, কাঁদে না দিদি, কাঁদে না–
আমার যে আর কিছুই নেই দিদা! আমার বেঁচে থেকে আর কী লাভ?
ও সব ভুলে যা দিদিভাই—
ভুলতে যে পারছি না।
উত্তর না দিয়ে স্নেহলতা তার পিঠে হাত বুলিয়ে যেতে লাগলেন।
ঝিনুক বলতে লাগল, আমি এখানে থাকব না দিদা, আমাকে আর কোথাও পাঠিয়ে দাও।
কোথায় যাবি দিদি?
যেখানে খুশি পাঠাও। আমার এখানে বড্ড ভয় করছে।
কিসের ভয়, আমরা তো আছি।
না না, তোমরা কিছু করতে পারবে না। ওরা আমাকে আবার ধরে নিয়ে যাবে।
যত দিন যাচ্ছে, ঝিনুকের ভয় ততই বাড়তে লাগল। রাত্রিবেলা চারধারের গ্রামগুলো থেকে যখন বর্বর চিৎকার ভেসে আসে কিংবা মশালগুলো দপ দপ করে জ্বলতে থাকে, সেই সময় ঝিনুক অস্থির হয়ে ওঠে। স্নেহলতা শিবানী হেমনাথ বা বিনু–যে-ই কাছে থাকে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে কাঁপতে বলে, আমি আর বাঁচব না, এখানে থাকলে নিশ্চয়ই মরে যাব।
দেখেশুনে একদিন হেমনাথ বললেন, ওর মনের ভেতর ভয় বাসা বেঁধে ফেলেছে। এখানে রাখা আর ঠিক হবে না।
স্নেহলতা বললেন, এখানে তো রাখবে না বলছ। কোথায় রাখবে তা হলে?
ভাবছি কলকাতায় অবনীমোহন কি সুধা সুনীতির কাছে পাঠিয়ে দেব।
কলকাতায়?
হ্যাঁ।
নিয়ে যাবে কে?
বিনু। এ ছাড়া সত্যিই ওকে বাঁচানো যাবে না।
বিনু কাছেই ছিল। বলল, এক কাজ করা যাক বরং—
হেমনাথ শুধোলেন, কী কাজ?
বাড়িঘর জমিজমা বেচে চল সবাই চলে যাই।
দৃঢ় স্বরে হেমনাথ বললেন, না, কিছুতেই না। কোনও অন্যায় আমি করিনি। বিনা দোষে জন্মভূমি ছেড়ে কেন চলে যাব? দুর্দিন দেখে সবাই যদি পালিয়ে যাই সুদিন আনবে কে? মনে রেখো সব মানুষই পশু হয়ে যায়নি, যেতে পারে না। আগের মতো দিন আবার আসবেই। তা ছাড়া
তা ছাড়া?
এখনও যারা রাজদিয়ায় আর আশপাশের গ্রামগুলোতে আছে, আমি চলে গেলে তারাও থাকবে না। তাদের জন্যও আমাকে রাজদিয়ায় থাকতে হবে।
কিন্তু–
হেমনাথ হেসে ফেললেন, তুই কি বলতে চাস, বুঝতে পেরেছি। এর জন্যে যদি মরতেও হয়, আমি রাজি।
শেষ পর্যন্ত স্থির হল, বিনু একলাই ঝিনুককে নিয়ে কলকাতায় চলে যাবে।
হঠাৎ একটা কথা মনে পড়তে স্নেহলতা বলে উঠলেন, কিন্তু—
কী?
স্টিমার তো বন্ধ, যাবে কী করে?
হেমনাথ বললেন, তারপাশা থেকে দিনে একটা কি দুটো করে স্টিমার যাচ্ছে গোয়ালন্দে। এখান থেকে নৌকোয় ওরা তারপাশা যাবে। আমি রাজেক আর তমিজ মাঝিকে ঠিক করে রেখেছি। সে ই বিনুদের তারপশায় নিয়ে স্টিমারে তুলে দিয়ে আসবে।
কিন্তু—
আবার কী?
ঢাকায় গিয়ে ঝিনুকের যা হাল হয়েছে, তারপাশা যাবার পথে আবার কিছু হবে না তো?
ওদিকে কোনও গোলমাল হয় নি। তা ছাড়া রাজেকরা খুব বিশ্বাসী। তারপর অদৃষ্ট।
.
দিন দুই পর সন্ধেবেলা পুকুরঘাট থেকেই রাজেক মাঝির নৌকোয় উঠল বিনুরা। বিনুরা বলতে বিনু আর ঝিনুক। সারারাত বাইলে ভোরবেলা তারা তারপাশা পৌঁছে যাবে। ঝিনুক বিনুর কোলের কাছে চিত্রার্পিতের মতো বসে আছে।
সবে কার্তিকের শুরু। এখনও মাঠে প্রচুর জল। ধানখেত আর শাপলাবন ঠেলে অনায়াসেই নৌকো নিয়ে বড় নদীতে চলে যাওয়া যাবে।
স্নেহলতা শিবানী আর হেমনাথ পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। শিবানী স্নেহলতা খুব কাঁদছিলেন। হেমনাথ রাজেক মাঝিকে সাবধান করে দিচ্ছেন। পাখি পড়ানোর মতো বার বার বলছেন, কিভাবে কেমন করে তারপাশায় নিয়ে যাবে।
রাজেক সমানে মাথা নাড়ছে আর বলছে, আপনে নিচ্চিন্ত থাকেন বড়কত্তা, জান থাকতে ছুটোবাবুগো গায়ে কেও হাত দিতে পারব না। আল্লার কিরা–
বিনু একদৃষ্টে হেমনাথের দিকে তাকিয়ে ছিল। স্নেহলতা শিবানী–কাউকেই দেখতে পাচ্ছিল না সে। তার চোখের সামনের সব কিছু ঘিরে, সমস্ত চরাচর জুড়ে প্রসন্ন পুরুষটি যেন দাঁড়িয়ে আছেন।
হেমনাথকে দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক হয়ে গেল বিনু। হঠাৎ ক’বছর আগের সেই দিনটির কথা মনে পড়ে গেল তার। জল-বাংলার এই অখ্যাত নগণ্য জনপদে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে সারা রাজদিয়ায় যেন উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছিল। আর আজ? রাতের অন্ধকারে, নিঃশব্দে, সবার চোখের আড়ালে চলে যেতে হচ্ছে। নিরানন্দ, নিরুৎসব এই বিদায় বিনুর বুক অসীম বিষাদে ভরে দিতে লাগল।
এই মুহূর্তে কত কথাই মনে পড়ছে তার। লারমোর, মজিদ মিঞা, রামকেশব, মনা ঘোষ, গয়জদ্দি ব্যাপারি, রজবালি শিকদার, পতিতপাবন, মোতাহার হোসেন সাহেব, ফসলকাটা মাঠে যে লোকটা ইঁদুরের গর্ত থেকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ধান বার করত সেই তালেব, চরের সেই ভূমিহীন কৃষাণের দল, এমনকি ধানের খেতে গা দুলিয়ে দুলিয়ে যে বুড়ো সোনালি গোসাপটা আলের ওপর দিয়ে বুকে হেঁটে যেত–সবাই চোখের সামনে ভিড় করে এল। আর মনে পড়ছে শরতের উজ্জ্বল নীলাকাশকে, সাদা সাদা ভবঘুরে মেঘদলকে, কার্তিকের ধূসর হিমকে। জলসেচি শাকের নিবিড় লাবণ্য, বেতঝোঁপ, মুত্রাবন, বড় বড় পদ্মপাতা, জলসিঙাড়া, কাউ আর হিজলবন, কইওকড়া আর হেলেঞ্চা লতার দাম, শঙ্খচিলের ঝক, গোবক, কানিবক, পানিকাউ, শালিক, বুলবুলি, বাঁচা-ট্যাঙরাবাজালি-বজুরি মাছেরা–কত কথা যে মনে পড়তে লাগল! এরাই তো তার হাত ধরে কৈশোর থেকে যৌবনে পৌঁছে দিয়েছে। হায়, কৈশোরের এই রম্যভূমি, যৌবনের এই স্বর্গে আর কোনও দিন ফেরা হবে কিনা, কে জানে।
জল-বাংলার মনোহর দৃশ্য, পশুপাখি, বৃক্ষলতা খুব বেশিক্ষণ বিনুকে বিভোর করে রাখতে পারল। এবার তার চোখ এসে পড়ল খুব সামনে, একেবারে কোলের কাছে, ঝিনুকের ওপর। মেয়েটাকে দেখতে দেখতে অপার স্নেহে, অসীম করুণায় তার বুক ভরে যেতে লাগল। এই সময় হঠাৎ মনে পড়ল, তার বাবা অবনীমোহন পশ্চিম বাংলার মানুষ, মা পূর্ব বাংলার মেয়ে। তার বুকের একধারে পুর্ব বাংলা, আরেক ধারে পশ্চিম বাংলা। তার রক্তের এক স্রোত পদ্ম, আরেক স্রোত গঙ্গা। আর কোলের কাছে। এই মেয়েটা–এই ঝিনুক? সে তো পুর্ব বাংলার লাঞ্ছিত, অপমানিত আত্মা। তাকে নিয়েই সে কলকাতায় চলেছে।
হঠাৎ প্রাণের ভেতর কী হয়ে গেল, কে বলবে। বড় মায়ায় ঝিনুককে সে বুকের কাছে নিবিড় করে টেনে আনল।
পুকুর পাড় থেকে একসময় হেমনাথের গলা ভেসে এল, আর দেরি করিস না রাজেক, নৌকো ছেড়ে দে–
মাঝি বলল, এই ছাড়ি—
একটু পর জলে বৈঠা পড়ল, একটানা বাজনার মতো ছপছপ শব্দ কানে আসতে লাগল।
নৌকো অকূলে ভাসল।
॥ দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত ॥