২.৪ মুহাম্মদের মানবিকতা

দ্বিতীয় অধ্যায় । ইসলাম ধর্ম । মুহাম্মদের মানবিকতা

নিবিরা আর দশজনের মতোই সাধারণ মানুষ ছিলেন। তবে তাঁদের উপস্থিতির জন্য তোমার এলাকায় পরশমণি বর্ষিত হয়েছে।– জালালুদ্দিন রুমি (১২০৭-১২৭৩ খ্রিস্টাব্দ)(৩৫)

 

প্রাথমিক যুগের অধিকাংশ ইসলাম-বিশেষজ্ঞ স্বীকার করেছেন আধ্যাতিক স্বতন্ত্রতা ব্যতীত নবি মুহাম্মদ আসলেই একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন। এই সত্যটি কোরানের সুরা কাহাফে রয়েছে : ‘বলো, আমি তোমাদের মতোই একজন মানুষ; আমার ওপর প্রত্যাদেশ হয় যে আল্লাহই তোমাদের একমাত্র উপাস্য।’ (১৮:১১০)। সুন্নি বিশেষজ্ঞদের অনেকে মুহাম্মদকে পরিপূর্ণ জ্ঞান এবং দোষক্রটির উর্ধ্বে বিবেচনা করেননি। তারা নবির নবুওতিকে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বিশেষ উপহার হিসেবে দেখতেন। তাঁরা মনে করতেন আল্লাহ নবির দায়িত্ব পালনের জন্য এমন একজন মানুষকে নির্বাচন করেন যার জ্ঞান, দূরদৃষ্টি এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ের মানবীয় গুণাবলী রয়েছে কিংবা যাকে মানুষের দিক-নির্দেশের দায়িত্ব অর্পণকালে এসব অনন্য গুণাবলী উপহার দেয়া হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, আমরা একজন মানুষের ওপর তখনই নবুওতির বিশ্বাস করি যখন আমরা তাঁকে স্রষ্টার বার্তাবাহক হিসেবে মনে করি। ওই বিশেষজ্ঞরা এমন কোনো যুক্তি দেখাননি যাতে মনে হয়, আমরা একজন মানুষকে বিশ্বাস করি কারণ স্রষ্টা তাঁকে আমাদের থেকে অধিকতর জ্ঞান এবং নৈতিক গুণাবলী দিয়ে পাঠিয়েছেন। তাদের এই মতামত কোরানের বিভিন্ন আয়াতের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যেমন সুরা শুরার এই আয়াত : ‘এভাবে আমি আমার আদেশক্রমে তোমার কাছে এক আত্মা (ফেরেশতা) প্রেরণ করেছি যখন তুমি জানতে না কিতাব কী, বিশ্বাস কী। কিন্তু আমি একে করেছি আলো যা দিয়ে আমি আমার দাসদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা পথনির্দেশ করি; তুমি তো কেবল সরল পথই প্রদর্শন কর।’ (৪২:৫২)। এই একই বিষয় পূর্ববর্তী আয়াতেও আলোচিত হয়েছে। এবং সবচেয়ে পরিষ্কারভাবে এবং সুস্পষ্টরূপে আলোচিত হয়েছে সুরা আন’আমে, যেখানে মুহাম্মদকে অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য লোকেদের জবাব দেওয়া হয়েছে ; বলো, আমি তোমাদেরকে বলি না যে আমার কাছে আল্লাহর ধনভাণ্ডার আছে। অদৃশ্য সম্পর্কেও আমি জানি না। তোমাদের এ-ও বলি না যে আমি ফেরেশতা। আমার প্রতি যা প্রত্যাদেশ হয় আমি শুধু তা-ই অনুসরণ করি। বলো, “অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান? তোমরা কি চিন্তাভাবনা কর না? (৬:৫০)। সুরা আ’রাফে মুহাম্মদকে এই বলে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে : ‘বলো, আল্লাহর ইচ্ছা আমার নিজের ভালোমন্দের ওপরও আমার কোনো অধিকার নেই। আমি যদি অদৃশ্যের খবর জানতাম তবে তো আমার অনেক ভালো হতো আর মন্দ কোনোকিছু আমাকে স্পর্শ করত না। আমি তো বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা মাত্র। (৭:১৮৮)। সুরা আ’রাফের আয়াতটি হেজাজের পৌত্তলিকদের প্রশ্নের জবাবে বলা হয়েছে। তাঁরা প্রশ্ন করেছিল, মুহাম্মদ যদি সত্যই অলৌকিক জগতের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন, তাহলে তিনি কেন ব্যবসায় নিয়োজিত হয়ে বিশাল মুনাফা অর্জন করছেন না।

এ-বিষয়ে কোরানের আয়াত সুস্পষ্ট এবং পরিষ্কার। হাদিস ও অন্যান্য নির্ভরযোগ্য নবির জীবনবৃত্তান্ত প্রমাণ করে মুহাম্মদ কখনোই নিজেকে দোষত্রটির উর্ধ্বে এবং গায়েবি বিষয় নিয়ে জ্ঞান আছে, এমন দাবি করেননি। একটি নির্ভরযোগ্য হাদিস অনুযায়ী, ‘তিনি একবার পৌত্তলিকদের অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নবাণে বিব্রত হয়ে বলেছিলেন, তারা আমার কাছে কি চায়? আমি আল্লাহর এক বান্দা। আল্লাহ আমাকে যা শেখান তাই আমি জানি।’ মুহাম্মদের সত্যবাদিতা এবং সততাকে প্রশংসা করা হয়েছে সুরা আবাসার ১-১১ নম্বর আয়াতে যেখানে তার প্রতি সুস্পষ্ট একটি দৈব-তিরস্কার রয়েছে :

সে (মুহাম্মদ) ব্ৰুকুচকে মুখ ফিরিয়ে নিল
কারণ তার কাছে এক অন্ধ এসেছিল।
তুমি ওর সম্বন্ধে কী জান?
সে হয়তো পরিশুদ্ধ হ’ ত
ব? উপদেশ নিত ও উপদেশ থেকে উপকার পেত?
য়ে নিজেকে বড় ভাবে
বরং তার প্রতি তোমার মনোয়োগ!
যদি সে নিজেকে পরিশুদ্ধ না করে, তবে তাতে তোমার কোনো দোষ হতো না!
অথচ যে কিনা তোমার কাছে ছুটে এল
আর এাল ভয়ে-ভয়ে
তাকে তুমি অবজ্ঞা করলে!
কক্ষনে (তুমি এমন করবে না, এ এক উপদেশবাণী (৮০:১-১১)।

নবি মুহামদ কিছু ধনী এবং প্রভাবশালী লোককে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে সৎপন্থা অবলম্বন করেছিলেন। এটা সমর্থনযোগ্য একটি উদ্যোগ। কারণ পৌত্তলিকরা প্রশ্ন তুলেছিল ; দু-দলের মধ্যে কোনটি মর্যাদায় শ্রেয় আর সমাজ হিসেবে কোনটা উত্তম। (১৯৭৩)। যে কোনো অবস্থাতে গণ্যমান্যদের সমর্থন অর্জন করা মুহাম্মদের জন্য খুবই স্বাভাবিক। একদিন তিনি যখন হেজাজের একজন প্রভাবশালী লোকের সাথে কথা বলছিলেন এবং তাঁকে ইসলামে বিশ্বাস করানোর জন্য একাগ্রতায় নিমজ্জিত ছিলেন, তখন আব্দুল্লাহ বিন ওম মাকতুম নামের একজন সদ্য ইসলাম-গ্রহণকারী অন্ধব্যক্তি মুহামদকে জিজ্ঞেস করলেন : ‘আল্লাহ আপনাকে যা কিছু শিখিয়েছেন তার কিছুটা আমাকেও শেখান। নবি ওই অন্ধব্যক্তির কথায় কর্ণপাত না করে বাড়ি চলে গেলেন। এরপরই এই মহৎ সুরা আবাসার আয়াতগুলো নাজিল হয়, যেখানে নবিকে পরিষ্কারভাবেই তিরষ্কার করা হয়েছে। পরবর্তীতে যখনই আব্দুল্লাহ বিন ওম মাকতুমের সাথে নবির দেখা হত, তিনি তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতেন। সুরা মুমিনের একটি আয়াতে নবিকে ধৈর্যশীল হতে বলা হয়েছে ; অতএব তুমি ধৈর্য ধরো, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। তুমি তোমার পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা ও সকাল-সন্ধ্যায় তোমার প্রতিপালকের পবিত্র মহিমা ঘোষণা করো। (৪০:৫৫)। এই আয়াতে নবির চরিত্রে দোষ দেখিয়ে তাঁকে নিজের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে। সুতরাং মুহাম্মদের কোনো দোষত্রুটি নেই বলে পরবর্তীকালের মুসলমানদের মনে যে গভীর অন্ধবিশ্বাস জন্ম নিয়েছে তা কোরানের এই ভায্যের বিরোধী।

একই বিষয়টি সুরা ইনশিরাহ এর প্রথম তিন আয়াতে ভিন্নভাবে ফুটে ওঠেছে ; আমি কি তোমার বক্ষ উন্মুক্ত করিনি? আমি হালকা করেছি তোমার ভার, যা ছিল তোমার জন্য খুব কষ্টকর।’ (৯৪:১-৩)। আরবি কোরানে ব্যবহৃত ‘ওয়েজরশব্দটি (বাংলা অর্থ ‘ভার বা বোঝা) সূরা ফাতহ এর প্রথম দুটি আয়াতে ধানব শব্দ (বাংলা অর্থ ‘পাপ) দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে : আল্লাহ তোমার জন্য সুস্পষ্ট বিজয় অবধারিত করেছেন। এ এজন্য যে, তিনি তোমার অতীত ও ভবিষ্যতের ক্রটিগুলো মাফ করবেন, তোমার প্রতি তাঁর অনুগ্রহ পূর্ণ করবেন এবং তোমাকে সরল পথে পরিচালিত করবেন।(৪৮:১-২)। অতএব কোরানের এই স্পষ্টভাবে বর্ণিত এবং অপরিবর্তনযোগ্য আয়াতগুলো প্রমাণ করে, নবি মুহাম্মদ যাকে পরবর্তীতে মুসলমানরা সকল দোষক্রটির উর্ধ্বে এবং অলৌকিক ব্যক্তিত্বের মর্যাদা দিয়েছিলেন, তিনি কিন্তু নিজেকে মোটেও সেরকম মনে করতেন না এবং কোরানেও সেভাবে ফুটে ওঠেনি। যৌক্তিক চিন্তা এবং জ্ঞানচর্চায় আগ্রহী যে কারো কাছে মুহাম্মদের এই আধ্যাত্মিক উৎকৃষ্টতা এবং সততা আরও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়।

ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশ্বাস, সামাজিক প্রথাসমূহ যেগুলো গণিতশাস্ত্রের নিশ্চয়তা এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রায়োগিক প্রমাণের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়, সে-সব বিষয়ে মানুষ নিজের যুক্তির কর্মদক্ষতা দেখাতে সবসময়ই অনিচ্ছা পোষণ করে এসেছে। পক্ষান্তরে তারা প্রথমেই বিশ্বাস অর্জন করেছে এবং নিজেদের বিশ্বাসের পক্ষের বক্তব্য দিয়ে মস্তিষ্ক পূর্ণ করেছে। স্বীকার করতে হবে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মতো ইসলামের ওলামারাও এই বৈশিষ্ট্যের বাইরে নন। নবি মুহাম্মদ সকল দোষত্রটির উর্ধ্বে-নিজেদের এই বিশ্বাসের প্রতি অন্ধ হয়ে এবং তা প্রমাণের আশায় তারা কোরানের স্পষ্ট আয়াতগুলো পর্যন্ত ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন।

নবি মুহাম্মদের মানবীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনায় এ-প্রসঙ্গে একটি গল্পের কথা মনে পড়ে যায়। ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমের রাজ্য খোজেস্তানের সুস্তান শহরে একজন খ্যাতিমান সুফি সাধক ছিলেন, তাঁর নাম শাহ আল-তুস্তারি (৮১৮-৮৯৬ খ্রিস্টাব্দ)। একদিন এই সাধকের কাছে তাঁর অনুসারীগণ গিয়ে বললেন, লোকজন বলাবলি করছে, আপনি নাকি পানির উপর দিয়ে হাঁটতে পারেন। আল-তুস্তারি বললেন, ‘মুয়াজ্জিনকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো, তিনি একজন সৎ ব্যক্তি। অনুসারীগণ মুয়াজ্জিনকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে জবাব দিলেন : ‘আমি এ-বিষয়ে কিছু জানি না। তাঁকে কখনো আমি পানির উপর দিয়ে হাঁটতে দেখিনি। তবে আমার মনে আছে তিনি একদিন পুণ্যস্নানের জন্য সাঁকোর উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি পা পিছলে পানিতে পড়ে যান। ডুবেও যেতেন, যদি না আমি তাঁকে টেনে তুলতাম। এ-ঘটনার একটি দিক যা কোনো নিরপেক্ষ সত্যসন্ধানী অস্বীকার করতে পারবেন না তা হলো, প্রমাণের প্রাচুর্য।

হাঙ্গেরীয় বংশোদ্ভূত ইসলাম-বিশেষজ্ঞ ইজহাক গোল্ডজিহার” মনে করেন হাদিসের সংকলন এবং মুহাম্মদের প্রথম দিককার জীবনীকারকগণ ইসলামের প্রতিষ্ঠাতাকে যেভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে এবং স্বচ্ছতার সাথে চিত্রায়িত করেছেন তা বিশ্বের অন্যান্য ধর্মের ঐতিহাসিক নথিপত্রে খুঁজে পাওয়া যায় না; এবং কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই এগুলো মুহাম্মদকে মানবীয় নৈতিক, ভালোমন্দ, দোষ-গুণের অধিকারী হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছে।

এই তথ্যগুলো উপস্থাপনের মাধ্যমে নবি মুহাম্মদকে অলৌকিক ক্ষমতাধর অতিমানব বানাবার কোনো চেষ্টা করা হয়নি। বরং দেখানো হয়েছে তিনি তাঁর সাহাবি এবং সহযোগীদের নিয়ে একটি সমতাস্থলে অবস্থান করতেন। তাৎক্ষণিক উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ৫ম হিজরিতে (৬২৭ খ্রিস্টাব্দ) মদিনায় পরিখার যুদ্ধে মুসলমানদের পক্ষের আর সবার মতো নবিও একইভাবে খননকাজ করেন। প্রচলিত আছে জীবনের প্রশান্তি সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, “আমি পৃথিবীতে তিনটি জিনিস পছন্দ করি: সুগন্ধি, নারী এবং সবার উপরে নামাজ। মুহাম্মদের জীবনাচরণে কঠোর এবং বিশ্বজনীন নয় এমন বিষয়াবলী খুব কমই খুঁজে পাওয়া যায়। নবিকে মানবীয় সীমাবদ্ধতার বাইরে রাখার চেষ্টা কোরান, হাদিস এবং নবির জীবন চরিতের সাথে মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। নবি মারা যাবার পর থেকে এই প্রচেষ্টা শুরু হয়। তাঁর মৃত্যুর একদিন পর হজরত ওমর (অথবা অন্য কোনো শীর্ষস্থানীয় সাহাবি) খোলা তরবারি নিয়ে হুমকি দিলেন, মুহাম্মদের মৃত্যুখবর যে প্রচার করবে, তিনি তার গলা কেটে ফেলবেন। তখন হজরত আবু বকর কোরানের আয়াত উদ্ধৃত করে প্রতিবাদ করলেন: তোমার মৃত্যু হবে, এবং তাদেরও। (সুরা জুমার ; আয়াত ৩০)। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য ওমর নয়, আবু বকরই সঠিক ছিলেন। হিজরি ১১ সালে (৬৩২ খ্রিস্টাব্দ) মুহাম্মদের মৃত্যুর পর মদিনা থেকে যত সময় এবং স্থানের দূরত্ব বাড়তে থাকল মুসলমানরাও তাদের কল্পনাগুলোকে ততটাই প্রসারিত করতে লাগলেন।

মুসলমানরা অতিরঞ্জন আর কাব্যিকতাকে এতোটাই প্রসারিত করলেন যে দুটি প্রধান ভিত্তিমূল, যেগুলো প্রতিদিনের পাঁচবার নামাজের সময় বলা হয় এবং কোরানের বিভিন্ন আয়াতেও উদ্ধৃত আছে, সেগুলো তাঁরা ভুলে গেলেন : মুহাম্মদ আল্লাহর বান্দা এবং বার্তাবাহক। তাঁরা মুহামদকে সৃষ্টির আদি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করলেন এই বলে যে : আপনি না থাকলে এই মহাবিশ্ব তৈরি হতো না। পারস্যের সুফিবাদী শায়েখ নজম আল-দিন দায়া রাজি (মৃত্যু হিজরি ৬৫৪ বা ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দ) নামের গভীর বিশ্বাসী লেখক তাঁর “মেরসাদ আল-ইবাদ’ বইয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছেন: ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা, যিনি শুধুমাত্র হওউচ্চারণ করেই সবকিছু সৃষ্টি করতে পারতেন, সেই আল্লাহই সর্বপ্রথম মুহাম্মদকে আলো হিসেবে তৈরি করেছিলেন এবং মুহাম্মদ যখন আলোর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন তখন সেই আলো লজ্জায় ঘামতে শুরু করল এবং সেই ঘামের ফোঁটা দিয়ে আল্লাহতায়ালা অন্য নবি ও ফেরেশতাদের আত্মা তৈরি করলেন।’

মুহাম্মদের আধুনিক জীবনীকারক মিশরীয় বংশোদ্ভুত মুহাম্মদ আবদুল্লাহ ওস-সামান লিখেছেন : মুহাম্মদ আসলেই অন্যান্য নবির মতোই মানুষ ছিলেন। তাঁর জন্ম, মৃত্যু আর সকল মানুষের মতোই হয়েছিল। মুহাম্মদের নবুওতি তাঁর মানুষ পরিচয়ের জন্য কখনো কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। আর সকলের মতোই তিনিও রাগতেন, সন্তুষ্ট, বিমর্ষ এবং উল্লসিত হতেন। তিনি একবার আসওয়াদ ইবনে আব্দুল মোতালেব ইবনে আসাদের প্রতি এতোটাই ক্রোধান্বিত হয়েছিলেন যে, তাঁকে অভিশাপ দেন এই বলে‘আল্লাহ যেন তাঁকে অন্ধ করে দেন এবং তাঁর পুত্রকে পিতৃহারা করেন।

মুহাম্মদ ইজ্জত দারওয়াজা (১৮৮৮-১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দ) ফিলিস্তিনি রাজনীতিবিদ-ইতিহাসবিদ, তিনি নবি মুহাম্মদের ওপর একটি জীবনীগ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর বইয়ে কোরানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন কোনো নিজস্ব বক্তব্য প্রদানে বিরত থেকেছেন। মুহাম্মদ এবং ইসলামের প্রতি তাঁর একনিষ্ঠতা এবং ভক্তির উজ্জ্বল প্রমাণ পাওয়া যায় দুই খণ্ডে রচিত এই বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠায়। তিনি পরিতাপের সাথে শেষ পর্যন্ত উপসংহারে পৌছেছেন যে, মধ্যযুগের বিশিষ্ট হাদিস-ভাষ্যকারক আল-কাসতালিনি” (জন্ম হিজরি ৮৫১ বা ১৪৪৮ খ্রিস্টাব্দ-মৃত্যু হিজরি ৯২৩ বা ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দ) ইসলামি গ্রন্থ রচনায় সম্পূর্ণ উচ্ছন্নে গিয়েছিলেন এবং নিজের মনগড়া কাহিনী একের পর এক আরোপণ করেছিলেন তাঁর গ্রন্থে যেগুলোর কোনো ভিত্তি দারওয়াজা নিজে কোরান এবং বিশ্বাসযোগ্য হাদিস ও অন্যান্য তথ্যবিবরণে খুঁজে পাননি। কাসতালিনির মতো অন্ধবিশ্বাসীরা কোনো প্রমাণ ছাড়াই বিশ্বাস করতেন, আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন কারণ নবি মুহামদ যেন মানবজাতিতে জন্মগ্রহণ করতে পারেন; এবং এই কারণে মুহাম্মদ হলেন মানবজাতি সৃষ্টির প্রাধন কারণ। কাসতালিনি আরও মনে করতেন লওহ, কলম, আরশ বা সিংহাসন, কুরসি বা চেয়ার থেকে শুরু করে আকাশ, পৃথিবী, জিন, মানুষ, বেহেশত, দোজখ সবকিছুই নবি মুহাম্মদের নুর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। তাঁরা সুরা আন’আমের এই আয়াতের বক্তব্য ভুলে গেলেন : রিসালাতের দায়িত্ব আল্লাহ কার ওপর অর্পণ করবেন তা তিনিই ভালো জানেন।’(৬:১২৪)। একই সাথে তাঁরা ইসলামের মৌলিক মূলনীতিও ভুলে গেলেন, যেখানে বলা হয়েছে কেবল আল্লাহই অস্তিত্বশীল জগতের চূড়ান্ত কারণ।

ফিলিস্তিনি লেখক দারওয়াজা আরও লিখেছেন যে, কোরানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে সকল নবিকে মরণশীল হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যাদেরকে আল্লাহ মানবজাতিকে দিক-নির্দেশনা দেবার জন্য পাঠিয়েছেন। সুরা আম্বিয়ার ৭-৮ আয়াতদ্বয়ে বলা হয়েছে : তোমার পূর্বে আমি প্রত্যাদেশ দিয়ে মানুষই পাঠিয়েছিলাম; তোমরা যদি না জান তবে উপদেশপ্রাপ্ত সম্প্রদায়দেরকে জিজ্ঞাসা করো। আর তাদেরকে এমন দেহবিশিষ্ট করিনি যে তাদের খাবার খেতে হতো না; তারা চিরস্থায়ীও ছিল না। ( ২১:৭-৮)। অর্থাৎ আল্লাহর বাণী প্রচারের জন্য নির্বাচিত হওয়া ছাড়া মুহাম্মদ আর কোনো ক্ষেত্রেই মানবজাতির বাইরের কেউ নন। কোরানে এই বক্তব্য বারবার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে যেগুলো ফিলিস্তিনি লেখক ইজ্জত দারওয়াজা তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন। প্রাসঙ্গিক আরও আয়াত আমরা এখানে উল্লেখ করতে পারি : বলো, আমার প্রতিপালকের পবিত্র মহিমা! আমি এক সুসংবাদদাতা রসুল ছাড়া আর কী? আল্লাহ কি মানুষকে রসুল করে পাঠিয়েছেন? ওদের এই কথাই লোকদেরকে বিশ্বাস করতে বাধা দেয় যখন ওদের কাছে পথের নির্দেশ।(১৭:৯৩-৯৪)। ওরা বলে, এ কেমন রসুল যে খাবার খায় হাটে-বাজারে চলাফেরা করে! তার কাছে ফেরেশতা পাঠানো হয় না যে তার সঙ্গে থাকবে ও ভয় দেখাবে।’ (২৫৭)। প্রত্যাদেশের মাধ্যমে তোমার কাছে এ-কোরান প্রেরণ করে আমি তোমার কাছে সবচেয়ে ভালো কাহিনী বর্ণনা করেছি, যদিও এর পূর্বে তুমি ছিলে অসতর্কদের অন্তর্ভুক্ত।’(১২:৩)। আমি তোমার পূর্বেও কোনো মানুষকে অমরত্ব দান করিনি। সুতরাং তোমার মৃত্যু হলে ওরা কি চিরকাল বেঁচে থাকবে? ( ২১:৩৪)। মুহাম্মদ রসুল ছাড়া আর কিছুই নয়, তার পূর্বে বহু রসুল গত হয়েছে। (৩:১৪৪)। যখন তুমি জানতে না কিতাব কী, বিশ্বাস কী। (৪২:৫২)। বলো, আমি তো রসুলদের মধ্যে এমন নতুন কিছু নই। আর আমাকে ও তোমাদেরকে নিয়ে কী করা হবে আমি তা জানি না। আমার প্রতি যা প্রত্যাদেশ হয় আমি তা-ই অনুসরণ করি। আমি এক স্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র। (৪৬:৯)।

নবি মুহাম্মদের মনুষ্যত্ব, তাঁর মানবীয় গুণাবলী এবং ক্রটির ইঙ্গিত ইসলামের ইতিহাসের অনেকগুলো সমর্থিত সূত্র থেকে পাওয়া যায়। হিজরি ৪ সালে মাওনার বানু আমির ও বানু সেলিম গোত্রের সাথে লড়াইয়ে নবির পক্ষের প্রায় ৭০জন সাহাবি নিহত হন। এ-ঘটনায় নবি অসম্ভব বেদনাত হয়ে পড়েন। তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন, “হে আল্লাহ! মোদারদেরকে (উত্তর-আরবীয় গোত্রসমূহ) পদদলিত করুন। ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত ওহুদের যুদ্ধে নবি পরাজিত হন এবং সেই যুদ্ধে নবির চাচা হামজা বিন আব্দুল মোতালেব মারা যান। আবিসিনিয়া থেকে আগত এক ক্রীতদাস ওয়াশি ইবনে হার্ব কুরাইশদের পক্ষ হয়ে লড়াইয়ে হামজার নাক-কান কেটে ফেলেন এবং তরবারি দিয়ে পেট ফুটো করে দেন। কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবা বদর যুদ্ধে নিহত তাঁর পিতা উতবা ইবনে রাবিয়া হত্যার প্রতিশোধ নিতে হামজার পাকস্থলি চিরে ফেলেন এবং মুখ দিয়ে রক্তমাখা যকৃত চুষেন। হামজার ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন দেহ দেখে নবি এতোটা রাগান্বিত হন যে, তিনি চিৎকার করে বলেন, আল্লাহর নামে শপথ নিয়ে বলছি, পঞ্চাশ জন কুরাইশকে আমি ছিন্নভিন্ন করে দেব। এ-রকম আরও অসংখ্য ঘটনাবলীর মাধ্যমে তৎকালীন আরবদের মনের নির্দয়তা ও প্রতিহিংসার পরিচয় মেলে। তৎকালীন সামাজিক পরিবেশ এমনই ছিল যে একজন অভিজাতবংশীয় নারী যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে মৃতব্যক্তির পাকস্থলী চিরে ফেলত এবং যকৃত চুষে ছুড়ে ফেলত। যুদ্ধের সময় হিন্দ বিনতে উতবাসহ আরও অনেক সন্ত্রান্ত কুরাইশ নারী মক্কার যোদ্ধাদের মাঝে গিয়ে মেয়েলি আকর্ষণ এবং বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদেরকে উৎসাহিত করতেন।

ইবনে হিশামের নবি মুহাম্মদের জীবনচরিত” থেকে জানা যায়, বাজিলা গোত্রের কিছু লোক মদিনায় এসে অসুস্থ হয়ে পড়লে মুহাম্মদের কাছে গিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করেন। মুহামদ তাঁদেরকে বললেন, উটের দুধ পান করলে তাঁরা সুস্থ হয়ে যাবে। তিনি তাঁদেরকে মদিনার বাইরে অবস্থিত তাঁর পশুপাল রক্ষণাবেক্ষণকারীর নিকট পাঠালেন। উটের দুধ খাওয়ার পর তাঁরা সুস্থ হয়ে ওঠে কিন্তু কোনো কারণে তাঁরা নবির সেই পশু রক্ষণাবেক্ষণকারীকে হত্যা করে। তাঁরা ওই ব্যক্তির চোখে ফলক ঢুকিয়ে উটের সাথে বেঁধে ছেড়ে দেয়। মর্মান্তিক এই খবরটি শোনার পর নবি খুবই উত্তেজিত হয়ে উঠেন। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে কর্জ ইবনে জাবেরকে প্রেরণ করেন তাঁদেরকে ধরে নিয়ে আসার জন্য। এরা ধরা পড়ার পর নবির নিকট নিয়ে আসা হলো। নবি তাঁদের হাত-পা কাটার জন্য এবং চোখ উপড়ে ফেলার নির্দেশ দিলে তা বাস্তবায়িত হয়।

বুখারি হাদিসে উল্লেখ আছে নবি বলেছিলেন, “আমি একজন মানুষ, আমি রাগ, দুঃখ, কষ্ট অনুভব করি। ঠিক যেমনি অন্য সব মানুষ রেগে যায়। অন্যান্য সূত্র থেকে এই হাদিসের সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়। সাহাবি আবু রহম আল-গিফারি বলেছেন, একবার এক অভিযানে তিনি যখন নবির পাশে চলছিলেন, তখন তাঁর বাহক পশুটি আকস্মিকভাবে তাঁকে এমনভাবে নবির কাছাকাছি নিয়ে যায় যে, তাঁর প্রশস্ত পা নবির হাঁটুর নিচে আঘাত করে এবং নবি এতে মারাত্মক ব্যথা পান। নবি তখন রেগে গিয়ে আবু রহমকে নিজের চাবুক দিয়ে আঘাত করেন। আবু রহম খুবই বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন এই ঘটনায়, কারণ তিনি মনে করেছিলেন তাঁর এই অশোভন আচরণের জন্য তাঁর সম্পর্কে একটি আয়াত নাজিল হতে পারে। জীবনের শেষ দিনগুলোতে নবি সিরিয়া অভিযানকারী সৈন্যদলের নেতৃত্ব তরুণ বয়সী ওসামা বিন জায়েদকে প্রদান করেন। আবু বকরের মতো বয়োজ্যেষ্ঠ সাহাবি আছেন এমন একটি সৈন্যদলের দায়িত্ব একজন বিশ বছর বয়সী ব্যক্তিকে প্রদানের ফলে সৈন্যদলের মাঝে অসন্তোষ ও অসমতির ধ্বনি শোনা যেতে লাগল। অসন্তুষ্টির তালিকায় নবির কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সাহাবিও ছিলেন। অসন্তোষের কথা শুনে নবি প্রচণ্ড বিরক্ত হলেন, তিনি অসুস্থ অবস্থায় শয্যাত্যাগ করে মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করেন। তারপর ঘোষণামঞ্চে দাঁড়িয়ে রাগান্বিত অবস্থায় জিজ্ঞেস করলেন, “আমি ওসামাকে নিযুক্ত করায় কার কি অভিযোগ রয়েছে? নবির শেষ সময়ের অসুস্থতায় তাঁর একজন স্ত্রী মায়মুনা আবিসিনিয়ায় থাকাকালীন সময়ে শেখা জ্ঞান দিয়ে একটি ওষুধ তৈরি করেন। এ-ওষুধ অজ্ঞান থাকা অবস্থায় নবিকে খাওয়ানো হয়। তিনি হঠাৎ জেগে উঠেন এবং রাগান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘কে এই কাজটি করেছে? উপস্থিত সবাই জানালেন, মায়মুনা ওষুধটি তৈরি করেছেন এবং আপনার চাচা আব্বাসকে দিয়ে ওষুধটি খাওয়ানো হয়েছে? নবি তখন নির্দেশ দিলেন ওষুধটি আব্বাস ব্যতীত উপস্থিত সবাইকে খাওয়ানো হোক। রোজা রাখা সত্ত্বেও সে-সময় মায়মুনা ওষুধটি পান করেছিলেন।

নবুওতির ২৩ বছর ধরে মুহাম্মদের বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে মানসিক প্রতিক্রিয়া এবং মানবিক অনুভূতির প্রকাশ প্রচুর ঘটনার বিবরণ থেকে জানতে পারা যায়। বিশেষ করে মদিনায় ১০ বছর অবস্থানকালীন সময়ের ঘটনাবলী। আয়েশা সম্পর্কিত মিথ্যা কথা বলার ঘটনা, মারিয়াকে স্বীয় আরোপিত অবজ্ঞা, জয়নাবকে বিয়ে করার জন্য তাড়াহুড়ো করা এবং বিচ্ছেদের সময়সীমা অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে জয়নাবকে নিজের ঘরে নিয়ে আসা ইত্যাদি ঘটনার প্রেক্ষিতে মুহাম্মদের মানসিক অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়। এতোসব সাক্ষ্যপ্রমাণের উপস্থিতি এবং কোরানে অসংখ্যবার মুহাম্মদকে কোনো প্রকার অলৌকিক ক্ষমতা প্রদান করা হয়নি স্পষ্টভাবে বলার পরও তিনি মারা যাওয়ার সাথে সাথে অতিধাৰ্মিক এবং অলৌকিকতায় বিশ্বাসীরা বলতে শুরু করলেন, নবি সব-ধরনের অলৌকিক এবং বিস্ময়কর কাজ করে গিয়েছেন। সময় ও স্থান যতোই প্রসারিত হতে লাগল ততোই কল্পকথার পরিধি বৃদ্ধি পেতে লাগল।

যদিও অনেক ইসলামি পণ্ডিত এই ধরনের কল্পকাহিনীকে অসম্ভব ও অযোগ্য বলে মনে করতেন। তার কিছু উদাহরণ এখানে উল্লেখ করা যায়। কাজি আয়াদ ইবনে মুসা (১০৮৩-১১৪৯ খ্রিস্টাব্দ) একজন আন্দালুসীয় বিচারক, ধর্মতাত্ত্বিক। তিনি নবি মুহাম্মদকে প্রশংসা করে কিতাব আস-শিফা বি তারিফ হোকুক আল-মুস্তফা নামে একটি বই রচনা করেছেন। প্রত্যাশার বিপরীতে বইটি মুহাম্মদের আধ্যাত্মিক, নৈতিক এবং রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি নিয়ে রচিত নয়। বইটি পড়ে পাঠক আশ্চর্যন্বনিত হয়েছেন এই ভেবে যে, লেখকের মতো একজন শিক্ষিত, সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং সম্ভবত নির্বোধ নন, এমন ব্যক্তি কিভাবে নবি মুহাম্মদ সম্পর্কে এ-রকম লেখার কথা চিন্তা করতে পারেন। নবি মুহাম্মদের দাস এবং প্রসিদ্ধ হাদিস বর্ণনাকারী আনাস বিন মালেকেকে(৩৯) উদ্ধৃত করে, কাজি আয়াদ তাঁর বইয়ে নবি মুহাম্মদকে অলৌকিক যৌনক্ষমতার অধিকারী বলে মন্তব্য করেছেন। নবি নাকি প্রত্যহ নিজের এগারো জন স্ত্রী’র সাথে দৈহিক মিলন করতে পারতেন। নবির যৌনক্ষমতাকে কাজি আয়াদ ত্রিশজন সাধারণ পুরুষের যৌনক্ষমতার সমতুল্য বলে অ্যাখ্যায়িত করেছেন। এমন কী, আনাসকে সাক্ষী করে কাজি আয়াদ তাঁর বইয়ে নবি মুহাম্মদের একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করিয়েছেন: সাধারণ মানুষ থেকে চারটি ক্ষেত্রে আমি শ্রেষ্ঠ। এগুলো হচ্ছে উদারতা, সাহস, সঙ্গম এবং ঘন ঘন বালশ (আরবি এই শব্দের অর্থ শত্রু নিপাত করা)। এই বক্তব্যটি যদি আনাস বিন মালেকের মুখ থেকেও নিঃসৃত হয় তবু একজন কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি তা বিশ্বাস করতে পারেন না। সত্য ঘটনা হচ্ছে, ইসলাম ধর্মের নবি মুহাম্মদ কখনো আত্মপ্রচারে নিমগ্ন ছিলেন না। আর কোরানে কোথাও মুহাম্মদের দয়ালু মনোভাব এবং সাহসের উল্লেখ নেই। শুধু সুরা কলমে উল্লেখ আছে : ‘তুমি অবশ্যই সুমহান চরিত্রের সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছ। (৬৮:৪)।

যদি কাজি আয়াদ নিজের দানশীলতা এবং নিভীকতার জন্য আত্মপ্রচারণা করতেন তাহলেও তা বিচারযোগ্য ছিল। কিন্তু অপর ব্যক্তির মুখ দিয়ে এমন এক ব্যক্তিকে যৌন ক্ষমতা এবং মানুষ হত্যা নিয়ে গর্ব করানোর কোনো অধিকার কাজি সাহেবের নেই। বিশেষ করে এই ব্যক্তিটি নবি মুহাম্মদ, তিনি কখনো এ-ধরনের কথা বলেন নি। আসল কথা হচ্ছে, সত্যকে পাশ কাটিয়ে কাজি আয়াদ নিজস্ব যৌনবাসনার উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে চেয়েছেন। নবিকে মানুষের উর্ধ্বে স্থান দেয়ার অভিপ্রায় থেকে তিনি এতো দূর পর্যন্ত অগ্রসর হলেন যে, তিনি তাঁর বইয়ে নবির মলমূত্র ও থুথুকে দিয়েও কথা বলিয়েছেন। তিনি বইয়ে উল্লেখ করেছেন, কিছু ওলামার বক্তব্য অনুযায়ী, এগুলো নাকি সম্পূর্ণ পবিত্র। নিজস্ব কাণ্ডজ্ঞানহীনতাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে তিনি গল্প ফাঁদলেন, নবির ব্যক্তিগত এক দাসী উমে আয়মান একদা নবির মূত্র পান করে শোথরোগ (শরীরে পানি সঞ্চারের ফলে ফোলারোগ) থেকে আরোগ্য লাভ করেন। নবি নাকি ওই দাসীকে বলেছেন, তাঁর মূত্রপানের ফলে সে আর কোনোদিন পেটের পীড়ায় ভুগবে না। উদ্ভট আরেকটি বিষয় হচ্ছে কাজি আয়াদ তাঁর বইয়ে এও দাবি করেছেন, নবি যখন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ঘর থেকে বের হতেন তখন পাথর এবং গাছগাছালি তাঁর চারপাশে এসে বেড়া দিত, যাতে লোকচক্ষুর অন্তরালে গিয়ে প্রাকৃতিক কর্ম সারতে পারেন। একজন পাঠক এই ধরনের আজগুবি বক্তব্য পড়ে সহজেই বুঝতে পারবেন, মুহাম্মদকে মানুষের উপরে স্থান দিতে গিয়ে কাজি আয়াদ অন্ধবিশ্বাসে আপ্লুত হয়ে কতটুকু সীমা অতিক্রম করেছিলেন। কাজি সাহেবের এই ধরনের কষ্টকল্পনা রচনার চেয়ে তিনি বরং সহজে বলতেই পারতেন, নবি মুহাম্মদকে আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো খাওয়া-দাওয়া ও প্রাকৃতিক কর্ম করতে হতো না। তাহলে অন্তত তাঁকে হাঁটাচলা করা পাথর ও গাছগাছালির গল্প তৈরি করতে হতো না।

এ-ধরনের প্রলাপবাক্য শুধু কাজি আয়াদ একা উচ্চারণ করেননি। পূর্বে উল্লেখিত হাদিস-ভাষ্যকারক আল-কাসতালিনির মতো আরও ভজন খানেক লেখক রয়েছেন যারা শতাধিক অযৌক্তিক হাস্যকর কাহিনীর পুনরাবৃত্তি করেছেন, যার ফলে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে নবি মুহাম্মদকে অকারণেই স্বতন্ত্র সমালোচনা ও বিদ্রুপের সমুখীন হতে হয়। নবিকে দিয়ে এটাও বলানো হয়েছে যে, আদমকে সৃষ্টি করার সময় আল্লাহ আমাকে আদমের কোমরে স্থাপন করেছিলেন, পরবর্তীতে নুহ, ইব্রাহিমের কোমরেও আমাকে তিনি প্রতিস্থাপন করেন। মাতৃগর্ভ থেকে জন্মলাভের আগ পর্যন্ত আমি তাঁদের পবিত্র কোমর ও গর্ভে অবস্থান করেছি। তার মানে কি এই যে, প্রতিটি মানুষ ঝোপ ঝাড়ের ভেতর থেকে হঠাৎ করেই অস্তিত্বশীল হয়ে ওঠেছে। স্বাভাবিকভাবে মাতৃগর্ভ থেকে জন্মলাভের আগে যদি মানুষের অস্তিত্বশীল হবার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে এই ঝোপঝাড়ের যুক্তির মাঝেও কোনো অসংগতি থাকার কথা নয়।

কাজি আয়াদ আরও বলেছেন, নবি মুহাম্মদ যখন কোনো জায়গা দিয়ে অতিক্রম করে যেতেন, তখন সেখানকার পাথর, গাছগাছালি তাঁর কাছে হেঁটে চলে এসে বলত : হে আল্লাহর দূত আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। চলাচল করতে সক্ষম, কণ্ঠস্বর্যন্ত্র এবং জিহ্বাসম্পন্ন প্রাণীরাও যদি এসে একথা বলত তাহলেও একটা কথা ছিল। কিন্তু মস্তিক, স্নায়ু, দৃষ্টি ও ইচ্ছাশক্তিহীন অজৈব পদার্থ কিভাবে নবিকে চিনতে পারল! সম্ভাষণ জানানো তো দূরের কথা। কেউ কেউ বলবেন এটা সম্পূর্ণ অলৌকিক বিষয়। তাই যদি হয় তাহলে মুহাম্মদের বাণীকে বিশ্বাস করার শর্ত হিসেবে কুরাইশরা যখন অলৌকিক কার্যাবলী দেখানোর দাবি তুলেছিল, সে-সময় কেন তা প্রদর্শিত হয়নি? কুরাইশরা যে-ধরনের অলৌকিকতা দেখতে চেয়েছিল তা আহামরি কিছু নয়। তাঁরা দাবি করেছিল মুহাম্মদ যেন পাথর থেকে পানি নির্গত করেন কিংবা পাথরকে সোনায় পরিণত করেন। যদি পাথর মুহামদকে সম্ভাষণ জানাতে পারে তবে ওহুদের যুদ্ধে একটি পাথর কিভাবে মুহাম্মদের শরীরে আঘাত করে তাঁকে আহত করল? অলৌকিকতার-পূজারীরা এই পাথরকে নাস্তিক’ বলে চিহ্নিত করবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই!

সুন্নি এবং শিয়া লেখকদের অসংখ্য বইয়ে বলা হয়েছে নবি মুহাম্মদের কোনো প্রতিবিম্ব ছিল না। তিনি সামনে-পিছনে সমানভাবে দেখতে পেতেন। শাহরানি’ (মৃত্যু হিজরি ৯৭২ বা ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর বই কাশফ আল-ঘোমায় লিখেছেন : নবি মুহাম্মদ চতুর্দিকে সমানভাবে দেখতে পেতেন এবং রাতের বেলাতেও তিনি দিনের মতো পরিষ্কার দেখতে পেতেন। তিনি যখন একজন লম্বা মানুষের সাথে হাটতেন, তখন তাঁকে লম্বা দেখাত এবং তিনি যখন বসতেন তখন তাঁর কাঁধ অন্যদের চেয়ে উঁচু থাকত।

এই ধরনের বক্তব্যপ্রদানকারী মুসলমান লেখকেরা আসলে মুহাম্মদের মহানুভবতা, নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলী, দক্ষতা নির্ণয়ে একেবারেই অক্ষম। তাঁদের চিন্তাভাবনা পুরোপুরি সেকেলে। যে কারণে তাঁরা বাহ্যিক অবয়ব, শারীরিক সক্ষমতাকে কেবলমাত্র শ্ৰেষ্ঠত্বের প্রতীক হিসেবে মনে করেছেন। একজন মানুষকে অন্যদের তুলনায় শ্রেষ্ঠতর করতে যে আধ্যাত্মিক, বৌদ্ধিক এবং নৈতিক সক্ষমতাই বিচার্য, এগুলি তাঁদের স্কুলচিন্তাধারায় স্থান পায়নি। শুধু তাই নয় তাঁদের মনে কখনো এই প্রশ্ন আসেনি কোনো অলৌকিক ঘটনা কেন মুহাম্মদকে তাঁর উদ্দেশ্য সাধনে সাহায্য করেনি। তারা এও প্রশ্ন তুলেননি, মুহাম্মদ কেন কথিত দাবি অনুযায়ী লিখতে-পড়তে পারতেন না? নবিকে প্রতিবিম্বহীন এবং মাথা ও কাঁধের দিক দিয়ে অন্যদের তুলনায় উচ্চতর করার হাত দিয়ে কোরান লিখলেন না? সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই অলৌকিকতা-সন্ধানকারীরা নিজেরা মুসলিম ছিলেন, তাঁরা কোরান পড়েছেন এবং কোরানের অর্থ বোঝার জন্য যথেষ্ট আরবি জানতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁরা বিভ্রমের শিকার হয়ে সেগুলোকে ব্যাকুলভাবে “সত্য হিসেবে প্রচার করেছেন, যেগুলো কিনা সরাসরিভাবে কোরানের বক্তব্যের পরিপন্থী।

কোরানের যেসব আয়াত মুহাম্মদকে সকল মানবীয় গুণসম্পন্ন একজন মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করে সেইসব আয়াত নিখুঁতভাবে পরিষ্কার এবং এগুলোকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করার কোনো সুযোগ নেই। মক্কায় অবতীর্ণ সুরা তাহা এর ১৩১ নম্বর আয়াতে নবিকে বলা হয়েছে ; আমি অবিশ্বাসীদের কাউকে-কাউকে পরীক্ষা করার জন্য পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য হিসেবে ভোগবিলাসের যেউপকরণ দিয়েছি তার দিকে তুমি কখনও লক্ষ্য কোরো না। তোমার প্রতিপালকের দেয়া জীবনের উপকরণ আরও ভালো ও আরও স্থায়ী। ( ২০:১৩১)। একইভাবে মক্কায় অবতীর্ণ সুরা হিজরে বলা হয়েছে : “আমি তাদের (অবিশ্বাসীদের) কতককে ভোগবিলাসের যে-উপকরণ দিয়েছি তার দিকে তুমি কখনও চোখ দিয়ো না। আর (ওরা বিশ্বাসী না হওয়ার জন্য) তুমি দুঃখ করো না। তুমি বিশ্বাসীদের প্রতি বিনয়ী হও। (১৫:৮৮)। এই আয়াতগুলোর বক্তব্য থেকে এটা স্বাভাবিকভাবে বোঝা যায়, নবি মুহাম্মদের মনে কোনো ধরনের উচ্চাশা ভর করেছিল। হয়তো তিনি আশা করছিলেন কুরাইশ নেতাদের মতো তিনিও বিপুল ধনসম্পদ এবং পুত্রসন্তানের অধিকারী হবেন।

মুহাম্মদের বেশিরভাগ প্রতিপক্ষ ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। ফলে স্বাভাবিকভাবে তাঁরা পরিবর্তনের বিরোধী ছিলেন এবং তাঁদের অবস্থানকে টলাতে সক্ষম যে কোনো ধরনের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে দাবিয়ে রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। একইভাবে বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর মুহাম্মদের অনুগামী হওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তাঁদের মধ্যেও দাবি আদায় ও বৈষম্য দূরীকরণের জন্য আকাঙ্ক্ষা ছিল। এই পরিস্থিতিতে নবি বিমর্যবোধ করলেন এবং কিছু ধনাঢ্য ব্যক্তিকে পক্ষে টানার আশা করলেন। তাঁদের উপরেই ইসলামের ভবিষ্যত নির্ভর করছে বলে তিনি স্থির করেছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তাঁকে এই পথে যেতে নিষেধ করলেন। সুরা সাবায় এই বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে : “যখনই আমি কোনো জনপদে সতর্ককারী প্রেরণ করেছি সেখানকার বিত্তশালী অধিবাসীরা বলেছে, “তুমি যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছ আমরা তা অবিশ্বাস করি। আর ওরা আরও বলত, আমাদের ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততি বেশি, সুতরাং আমাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে না। (৩৪:৩৪-৩৫)।

সুরা আন’আমের ৫২ নম্বর আয়াতে নবিকে যেভাবে সম্বোধন করার হয়েছে তাতে একজন চিন্তাশীল পাঠক চমকিত না হয়ে পারেন না : যারা তাদের প্রতিপালককে সকালে ও সন্ধ্যায় তাঁর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ডাকে তাদেরকে তুমি তাড়িয়ে দিয়ো না। তাদের কর্মের জবাবদিহির দায়িত্ব তোমার নয়, আর তোমার কোনো কর্মের জবাবদিহির দায়িত্বও তাদের নয় যে তুমি তাদের তাড়িয়ে দেবে, তাড়িয়ে দিলে তুমি সীমালঙ্ঘনকারীদের শামিল হবে।’ (৬:৫২)। এই আয়াতে পরোক্ষভাবে তিরষ্কারমূলক মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে যা মুহাম্মদের মানবিক চরিত্র ও আচরণের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রমাণ। পৌত্তলিকরা বলে আসছিল যে তাঁরা মুহাম্মদের দলে যোগ দিবেন না। কারণ তাঁর অনুসারীদের কোনো গুরুত্ব নেই। এ-কারণে সম্ভবত তিনি সমাজের প্রভাবশালী ও ধনীদের দলে টানতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন এবং নিজের হতদরিদ্র অনুসারীদের দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন। এই অনুমানটি সুরা কাহাফের ২৭-২৮ আয়াতদ্বয় দ্বারা সমর্থিত হয়েছে : “তুমি তোমার কাছে তোমার প্রতিপালক যে-কিতাব পাঠিয়েছেন তার থেকে আবৃত্তি করো। তাঁর বাণী পরিবর্তন করার কেউ নেই। তুমি কখনোই তাঁকে ছাড়া অন্য কোনো আশ্রয় পাবে না। তুমি তাদের সঙ্গে থাকবে যারা সকালসন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালককে ডাকে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের আশায়, আর তাদের ওপর থেকে মুখ চোখ ফিরিয়ে নিয়ো না পার্থিব জীবনের শোভা কামনা করে। আর যার হৃদয়কে আমি অমনোযোগী করেছি আমাকে সরণ করার ব্যাপারে, যে তার খেয়ালখুশির অনুসরণ করে আর যার কাজকর্ম সীমা ছাড়িয়ে যায় তাকে তুমি অনুসরণ করো না। (১৮:২৭-২৮)।

তফসির আল-জালালাইনের মতে এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছিল সেই মুহুর্তে যখন ওয়ানা বিন হোসেন নামের একজন উপজাতীয় নেতা এবং তাঁর অনুসারীরা ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল -যতক্ষণ পর্যন্ত না মুহাম্মদ তাঁর সহায়-সম্বলহীন দরিদ্র অনুসারীদের ত্যাগ করছেন। নবির ভ্রান্তি এবং সর্বোপরি একজন স্বাভাবিক মানুষের মতো তাঁর আচরণের পরিচয় পাওয়া যায় সুরা বনি-ইসরাইলের ৭৩-৭৫ নম্বর আয়াতত্ৰয়ে। যদিও আয়াতগুলো ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে নাজিল হয়েছিল, তথাপি এগুলোর প্রত্যেকটির অর্থ একই: ‘আমি তোমার কাছে যে-প্রত্যাদেশ পাঠিয়েছি তার থেকে তোমার বিচ্যুতি ঘটানোর জন্য ওরা চেষ্টা করবে যাতে তুমি আমার সম্বন্ধে কিছু মিথ্যা কথা বানাও, তা হলে, ওরা অবশ্যই বন্ধু হিসেবে তোমাকে গ্রহণ করবে। আমি তোমাকে অবিচলিত না রাখলে তুমি ওদের দিকে প্রায় কিছুটা ঝুঁকেই পড়তে। তুমি ঝুঁকে পড়লে অবশ্যই আমি তোমাকে ইহজীবন ও পরবীজনে দ্বিগুণ শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করাতাম, তখন আমার বিপক্ষে তোমাকে কেউ সাহায্য করত না।’ (১৭:৭৩-৭৫)। কিছু তফসিরকারকের মতে এই আয়াতগুলো নাজিল হয়েছিল যখন মুহাম্মদ কয়েকজন কুরাইশ নেতার সাথে (প্রথম অধ্যায়ের নবুওতি অর্জনের পর অনুচ্ছেদ দ্রষ্টব্য) আলোচনা করেছিলেন। সে সময় তিনি সুরা নজম উচ্চারণ করেছিলেন এবং স্বীয় বক্তব্যের জন্য পরবর্তীতে নিজে অনুশোচনা করেছিলেন : ‘এরাই হচ্ছে সেই উড়ন্ত সারস। তাই এদের মধ্যস্থতা আশা করা যেতে পারে। (স্যাটানিক ভার্সেস বা শয়তানের আয়াত নামে পরবর্তীতে প্রচারিত)।

আবু হুরায়রা(৪২) এবং কাতাদার(৪২) বক্তব্য অনুযায়ী এই তিনটি আয়াত মুহাম্মদ ও কুরাইশ নেতাদের মধ্যে আলোচনার পর নাজিল হয়েছিল যেখানে কুরাইশ নেতারা মুহামদকে তাঁদের উপাস্য দেবতাদের সমান করতে কিংবা অন্তত অসমান না করার দাবি জানিয়েছিলেন। বিনিময়ে তাঁরা মুহাম্মদকে শান্তিতে বসবাসের আশ্বাস দিয়েছিলেন এবং তাঁর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনেও আগ্রহ জ্ঞাপন করেছিলেন। এছাড়া তাঁরা গরীব, গৃহহীন মুসলমানদেরকে নির্যাতন, প্রহার ও রৌদ্রতপ্ত পাথর নিক্ষেপ বন্ধেরও আশ্বাস দিয়েছিলেন। নবি স্বাভাবিকভাবে প্রথমে এই প্রস্তাবের প্রতি নমনীয়ভাব প্রদর্শন করেছিলেন। যদিও তা প্রয়োগের সময়ে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন। তিনি চিন্তা করে দেখলেন, পৌত্তলিকতা এবং মূর্তিপূজা বিলোপের কুরাইশদের প্রস্তাবিত মীমাংসায় পৌছালে তাঁর এতোদিনের ধর্মপ্রচারের ফলাফল বিলোপ হয়ে যাবে। হয়তো তাঁকে ওমরের মতো নিষ্ঠাপ্রাণ, মাথা নত না করা অসীম সাহসী আলি এবং হামজার মতো বিশ্বাসী যোদ্ধারা বুঝিয়েছেন, যেকোনো প্রকার আপোস গুরুতর ভুল কিংবা পরাজয়ে রূপ নেবে। যেকোনো পরিস্থিতিতেই হোক, এই তিনটি আয়াত প্রমাণ করে নবি মুহাম্মদের চরিত্রে আবেগময়তা এবং প্রলুব্ধ হবার মতো মানবীয় গুণাবলী বিদ্যমান ছিল।

কোরানের অন্য আয়াত থেকেও এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়। সুরা ইউনুসের ৯৪-৯৫ আয়াতদ্বয়ে বলা হয়েছে : ‘আমি তোমার কাছে যা অবতীর্ণ করেছি তাতে যদি সন্দেহ হয় তবে তোমার আগের কিতাব যারা পড়ে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করো। তোমার প্রতিপালকের নিকট থেকে তোমার কাছে সত্য এসেছে। তুমি কখনও সন্দিহানদের শামিল হয়ো না। আর যারা আল্লাহর নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করেছে তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না; হলে, তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের একজন হবে।(১০:৯৪-৯৫)। একইভাবে সুরা মায়িদাতে বলা হয়েছে : হে রসুল! তোমার প্রতিপালকের কাছ থেকে তোমার ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তা প্রচার করো, যদি না কর তবে তো তুমি তাঁর বার্তা প্রচার করলে না। আল্লাহ তোমাকে মানুষ থেকে রক্ষা করবেন। আল্লাহ অবিশ্বাসী সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না। (৫৬৭)। একজন বিশ্বাসী মুসলমান, যিনি কোরানকে আল্লাহর বাণী হিসেবেই গ্রহণ করেছেন, তিনি এই আয়াতগুলো কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন? নবিকে এভাবে ভৎসনা করার মানে কি?

নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এর একমাত্র ব্যাখ্যা হচ্ছে মানবিক দুর্বলতা এবং নৈতিক ক্রটি নবির শুভসত্তাকে গ্রাস করতে শুরু করেছিল। তিনি মানুষকে ভয় করতে শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে আল্লাহ তাঁকে অভয় দিলেন -যেকোনো প্রকার নিষ্পেষণ থেকে তিনি তাকে রক্ষা করবেন। কুরাইশ নেতা ওয়ালিদ বিন আল-মুগিরা, আলাস বিন ওয়ায়েল, আদি বিন কায়েস, আসওয়াদ বিন আব্দুল মোতালেব এবং আসওয়াদ বিন আবদে ইয়াগুস প্রমুখ মুহাম্মদের চরিত্র ও ধর্মপ্রচারকে ব্যঙ্গ করে গভীর কষ্ট দিয়েছিলেন। হয়তো তিনি বিরক্ত হয়ে ধর্মপ্রচার নিয়ে অনুতপ্ত হতে শুরু করেছিলেন কিংবা হয়তো মানুষকে তাদের মতো চলতে দিয়ে নিজের ধর্মপ্রচারকার্য পরিত্যাগ করার চিন্তাভাবনাও শুরু করেছিলেন। তা না-হলে সুরা হিজরের ৯৪-৯৫ নম্বর আয়াতদ্বয় তাঁর প্রতি অবতীর্ণ হতো না ; অতএব তোমাকে যে বিষয়ে আদেশ করা হয়েছে তা প্রকাশ্যে প্রচার করো আর অংশীবাদীদেরকে উপেক্ষা করো। যারা বিদ্রুপ করে তাদের বিরুদ্ধে তোমার জন্য আমিই যথেষ্ট।’ ( ১৫:৯৪-৯৫)। এই সুরার পরবর্তী তিন আয়াতও প্রস্তাবিত ব্যাখ্যা সমর্থন করে ; আমি তো জানি ওরা যা বলে তাতে তোমার মন ছোট হয়ে যায়। তুমি তোমার প্রতিপালকের প্রশংসা করে তাঁর মহিমাকীর্তন করো আর সিজদাকারীদের শামিল হও। তোমার কাছে নিশ্চিত বিশ্বাস (মৃত্যু) আসা পর্যন্ত তুমি তোমার প্রতিপালকের উপাসনা করো। (১৫৯৭-৯৯)। কোরানের কয়েকজন তফসিরকারক সুরা হিজরের ৯৯ নম্বর আয়াতে ব্যবহৃত ইয়াকিন শব্দটি মৃত্যুর অনিবার্যতাকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে বলে ধরে নিয়েছেন। মুহাম্মদকে নৈতিক ক্রটির উর্ধ্বে বিবেচনা করার কারণে তাঁরা নবির দুর্বলতাকে স্বীকার করতে কুষ্ঠাবোধ করেছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে কোরানের ভাষ্যের বিপরীত ব্যাখ্যা প্রণয়ন করেছেন। সুরা হিজরের তিনটি আয়াতের অর্থ সুস্পষ্ট। মুহাম্মদ ব্যাপকভাবে নিরাশায় ভুগছিলেন। যে-কারণে তাঁর মাঝে দ্বিধাবোধ তৈরি হয়েছিল। এমন কী নিজের যোগ্যতা নিয়েও তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল। যদিও আল্লাহকে প্রার্থনা ও প্রশংসার মাধ্যমে শেষপর্যন্ত তাঁর মনে নিশ্চয়তা ফিরে এসেছিল, তিনি তাঁর গন্তব্যে পৌছাতে পারবেন। সুরা আহজাবের প্রথম আয়াতে মুহামদকে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে : হে নবি! তুমি আল্লাহকে ভয় করো। এবং তুমি অবিশ্বাসী ও মুনাফিকদের আনুগত্য করো না। আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ, তত্ত্বজ্ঞানী। (৩৩:১)। তফসির আল-জালালাইন গ্রন্থে এই আয়াতের প্রথম ক্রিয়াপদকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ভয় করতে থাক’হিসেবে। আরেকটি তফসির অনুযায়ী যদিও উভয় আদেশই মুহাম্মদের উদ্দেশ্যে নাজিল হয়েছে, তারপরও তা মূলত সমগ্র মুসলিম জাতির জন্যই অবতীর্ণ হয়েছিল। এই তফসিরকারকদের মোহগ্ৰস্ততা তাদের সত্যতা থেকে অনেক বেশি। কারণ এই সুরার পরের আয়াতেই আল্লাহ মুহামদকে বলেছেন ; তোমার প্রতিপালকের কাছ থেকে তোমার ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তুমি তার অনুসরণ করো।’(৩৩:২)।

উপরোক্ত আয়াতগুলো সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করে নবি স্বাভাবিক ও মানবিকভাবে তাঁর হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন এবং প্রতিপক্ষের দাবি মেনে নিবেন কিনা ভেবে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলেন। আল্লাহ তাঁকে এ-কাজে কঠোরভাবে নিষেধ করেন। বিজ্ঞানসম্মতভাবে বলা যায়: বিরোধী পক্ষের তীব্র আপত্তি, প্রতিবাদ, প্রতিরোধের মুখে নবি যখন নিঃশেষিত হতোদ্যম হয়ে গিয়েছিলেন, তখন নিজেকে পুনরায় আল্লাহর প্রতি সমর্পণের মাধ্যমে ও নিজের অভ্যন্তরীণ ইচ্ছাশক্তিতে বলীয়ান হয়ে পুনরায় নিজ কক্ষপথে ফিরে আসেন।

এই ব্যাখ্যাকে যদি অস্বীকার করাও হয় তাহলে অবশিষ্ট একমাত্র ব্যাখ্যা থাকতে পারে তা হলো, নবি মক্কার প্রতিকূল পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য প্রতিপক্ষের দাবির সাথে আপোষ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আল্লাহ তাঁকে এ কাজে নিষেধ করেন। মুহাম্মদের রাজনৈতিক বিচক্ষণতার কথা বিবেচনায় নিলে এই ধারণা বিতর্কযুক্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু আমরা যদি নবির সত্যনিষ্ঠতা, একাগ্রতা এবং নৈতিক শক্তির কথা বিবেচনা করি তাহলে তা আদৌ সম্ভব নয়। মুহাম্মদ যা বলতেন তিনি তা বিশ্বাস করেই বলতেন এবং তিনি নিজেকে আল্লাহর প্রেরিত দূত বলেই বিশ্বাস করতেন।

এই অধ্যায়ের শেষে প্রাসঙ্গিক হওয়ায় ক্যামব্রিজ তফসির(৪৩) (কোরানের একটি প্রাচীন ফার্সি ভাষ্য) থেকে একটি গল্প উল্লেখ করা যেতে পারে। এখান থেকে কোরান নাজিল হওয়ার ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে ইসলামের প্রথম কয়েকশ বছরে মুসলমানদের চিন্তাভাবনার একটি বিশদ চিত্র পাওয়া যাবে। এই গল্পটি ওই তফসিরের (পৃষ্ঠা ২৯৫, ভলিউম ২, তেহরান সংস্করণ) রয়েছে এভাবে ; সুরা নজম শুরু হয়েছে, শপথ অস্তমিত নক্ষত্রের শব্দগুলো দ্বারা। সুরা নজম পাঠ করার পর চাচা আবু লাহাবের ছেলে ওতাইবা নবিকে বললেন, তিনি কোরানে বর্ণিত নক্ষত্রে বিশ্বাস করেন না। নবি বিরক্ত বোধ করে তাকে অভিশাপ দিলেন। আল্লাহর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করে বললেন: “হে আল্লাহ! তোমার শিকারী কোনো পশু দ্বারা যেন সে পরাজিত হয়। ওতাইবা এ-কথা শোনার পর ভয় পেয়ে গেলেন। কিছুদিন পর ওতাইবা একটি মরুযাত্রীদলের সাথে ভ্রমণ করছিলেন। ওই দলটি হারানে পৌছে যাত্রাবিরতি করে। ওতাইবা নিজের বন্ধুদের মাঝে শুয়ে পড়েন। আল্লাহ একটি সিংহ পাঠালেন, ওতাইবাকে তাঁর বন্ধুদের মধ্য থেকে তুলে নিয়ে গেল এবং তাঁর দেহ ছিন্নভিন্ন করে দিলেও অভিশপ্ত দেহাবশেষ ভক্ষণ করল না। ফলে সকল মানুষ জেনে গেল সিংহটি তাঁকে আহারের জন্য ধরে নিয়ে যায়নি, বরং নবির প্রার্থনা পূর্ণ করতে গিয়েছে। এই গল্পের রচয়িতাদের মনে এই কথা একবারো আসেনি, ওতাইবাকে অভিশাপ দেবার পরিবর্তে নবি বরং তাঁকে ক্ষমা করে দেবার জন্য এবং তাঁকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে পারতেন। এতে বরং ইসলামের মহানুভবতা অনেক বেশি প্রচারিত হতো। ইসলাম কী পরম করুণাময়, দয়াময়, জগতের কর্তার প্রতি বিশ্বাস নয়?

হিজরতের পর মদিনাতে ইসলাম শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় বিশ্বাস হিসেবে সীমাবদ্ধ ছিল না। একটি নতুন আইনি কাঠামো এবং আরব রাষ্ট্রের ভিত্তিতে পরিণত হয়। নবুওতির শেষ দশ বছরে মুহাম্মদ যখন মদিনায় অবস্থান করছিলেন তখন ইসলামের সকল আদেশ এবং বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। প্রথম পদক্ষেপটি ছিল প্রার্থনা বা কিবলার দিক জেরুজালেম থেকে মক্কার দিকে পরিবর্তন করা। এই ঘটনার ফল দাঁড়াল মুসলমানদের চেয়ে ইহুদিদের থেকে আলাদাভাবে কর আদায় করা হতে লাগল। আরেকটি ঘটনা ঘটল মদিনার আরবরা তাদের দীর্ঘদিনের হীনমন্যতা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয় এবং আরব বেদুইনদের মধ্যে জাতীয়তাবোধেরও উন্মেষ ঘটে। কাবা ঘরকে যেসব গোত্র তাঁদের উপাস্য-দেবতার মন্দির হিসেবে ব্যবহার করত তা সকল আরবদের পূর্বপুরুষ ইব্রাহিম ও ইসমাইলের গৃহ হিসেবে পরিগণিত হয়। একইভাবে উপবাসের ক্ষেত্রেও ইহুদিদের অনুকরণ করা বর্জিত হল। ইহুদিরা মহরম মাসের দশম দিন উপবাস পালন করত, যা আরও কয়েকদিন বর্ধিত করা হলো। পরবর্তীতে পুরো রমজান মাসকেই উপবাসের জন্য বরাদ্দ দেয়া হলো।

তবে বিবাহ, বিচ্ছেদ, রজঃস্রাব, উত্তরাধিকার, বহুগামিতা, অবৈধ যৌনসংগম, পরকীয়া ও চুরির ক্ষেত্রে জরিমানা, প্রতিশোধ, রক্তের দামও অন্যান্য অপরাধ সম্পর্কিত বিষয়ে এবং নাগরিক বিষয়াদি যেমন অপরিচ্ছন্নতা, খাদ্যাভাসে নিষেধাজ্ঞা, খৎনার ক্ষেত্রে প্রধানত ইহুদি আইনগুলো ও বৃহত্তর আরব-ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে তা মদিনায় বাস্তবায়ন করা হয়েছে। নাগরিক ও অন্যান্য ব্যক্তিগত বিষয়ক ইহুদি ও পৌত্তলিক আরবীয় চিন্তাধারা, রীতিনীতি প্রভাবিত আইনসমূহ সামাজিকঅর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে বিনা-প্রশ্নে ব্যবহার করা হয়েছে।

 

————————–

পাদটীকা

২৬. ইরানের অনেক স্থানে ইমামজাদাদের মাজার পাওয়া যায়। ভক্তরা এখানে এসে মৌখিকভাবে অথবা কাগজে বা দাখিল নামক এক টুকরা কাপড়ে লিখে সাহায্যের আকুতি জানায়। কবরগুলোর অনেকগুলোর উপর গম্বুজ বানিয়ে রাখা হয়েছে যার কতগুলো আবার অনেক পুরনো। এদের মধ্যে কতগুলো কবর হল স্থানীয় সাধকদের। এদের বেশিভাগেরই জীবনী সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি। তারপরও এদেরকে ইমামদের বংশধর হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে আসছে।

২৭. আলি দস্তি এই অনুবাদটিকে গ্রহণ করেছেন। আরেকটি অনুবাদে পাওয়া যায় and a guide to every nation ব্যাকরণগতভাবে উভয়ই সঠিক।

২৮. জালালউদ্দিন আল-সুয়তি মিশরীয় বংশোদ্ভূত কোরানের তফসিরকারক। কোরানের তফসির আল-জালালাইনের সহলেখক।

২৯. ইব্রাহিম আন-নাজ্জাম নেতৃস্থানীয় মুতাজিলা দার্শনিক। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের স্বাধীন চিন্তার ফলেই কোরান রচিত হয়েছে। যদিও তাঁর বেশ কিছু লেখা ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে কালের পরিক্রমায়, তবে তাঁর কিছু উদ্ধৃতি অন্যান্য মুতাজিলা দার্শনিকদের (যেমন আল-জাহেজ) লেখায় পাওয়া যায়।

৩০. নবম শতাব্দীর দিককার আবু আল-হাসান আহমেদ ইবনে ইয়াহিয়া ইবনে ইশহাক আল-রাওয়ানদি সংশয়বাদী মুতাজিলা দার্শনিক হিসেবে প্রখ্যাত। তাঁর অনেক লেখনী সমসাময়িক গোঁড়া মুসলমান ধর্মতাত্ত্বিক দ্বারা ধর্মদ্রোহী হিসেবে সমালোচিত

হয়েছে।

৩১. আবু মুহাম্মদ আলি বিন আহমেদ বিন হাজম (জন্ম হিজরি ৩৮৪ বা ৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দ-মৃত্যু হিজরি ৪৫৬ বা ১০৬৪ খ্রিস্টাব্দ) প্রভাবশালী মুরীয় ধর্মতাত্ত্বিক এবং ইতিহাসবিদ। ধর্ম ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ইতিহাস নিয়ে তাঁর বই আল-মেলাল ওয়াননিহাল মুসলিম দর্শন ও ধর্মের ইতিহাসের শিক্ষার্থীদের কাছে পরিচিত।

৩২. আবুল হোসেন আব্দুর রহিম বিন মুহাম্মদ আল-খাইয়াত (৮৩৫-৯১৩ খ্রিস্টাব্দ) বাগদাদ নিবাসী খ্যাতিমান মুতাজিলা দার্শনিক। তাঁর অনেক লেখা হারিয়ে গেলেও অবশিষ্ট এখনো কিছু বিচ্ছিন্নভাবে পাওয়া যায়।

৩৩. আলি দস্তি তাঁর বইয়ের মূল ফার্সি সংস্করণে ফেরেশতা শব্দ ব্যবহার করলেও সাধারণভাবে জিব্রাইল ফেরেশতার কথা প্রচলিত আছে।

৩৪. শামসুদ্দিন মুহাম্মদ হাফিজ (১৩২৫-১৩৯০ খ্রিস্টাব্দ) পারস্যের খ্যাতিমান কবি।

৩৫. জালালউদ্দিন রুমি পারস্যের সুফিবাদি মৌলভি হিসেবে পরিচিত হলেও তাঁর আরেকটি পরিচয় হচ্ছে তিনি একই সাথে প্রখ্যাত কবি। এশিয়া মাইনর অঞ্চলের কনিয়া অঞ্চলে তিনি বাস করতেন। কাব্যচর্চা ছাড়াও আলকেমির প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল।

৩৬. ইজহাক গোল্ডজিহার (খ্রিস্টাব্দ ১৯২১-১৮৫০)বুদাপেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক। ইসলামের ইতিহাস,

মুহাম্মদের জীবনী নিয়ে তাঁর অনেকগুলো ?ITTST2S TTTTTI (FTTF Muhammadanische Studien, 2 vols, Halle 188990, 1E. by C. R. Barber and S. M. Stern, Muslim Studies, 2 vols, London 1967-71; Vorlesungen aber den Islam, Heidelberg 1910, 2nd ed. 1923,1 €. by Felix Arin, Le dogme et la loi de l’Islam, Paris 1920, 2nd ed. 1958, and by A. and R. Hamori, Introduction to Islamic theolegy and law, Princeton 1981; and Die Richtungen der Islamischen Koranauslegung, Leiden 1920.

৩৭. আবুল আব্বাস আহমেদ বিন মুহাম্মদ আল-কাসতালিনি মিশরের কায়রো নিবাসী লেখক। তিনি মুহাম্মদের জীবনী ও হাদিসের ভাষ্য নিয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন।

৩৮. দ্রষ্টব্য : পাদটীকা ১৫। আলফ্রেড গিয়োমের অনুবাদের ৬৭৭-৬৭৮ পৃষ্ঠায় সংযোজিত।

৩৯. হিজরতের কিছু পরে নবি মুহাম্মদ আনাস বিন মালেককে দাস হিসেবে গ্রহণ করেন। নবির মৃত্যু পর্যন্ত সাথেই ছিলেন। উমাইয়াদের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ করেছেন। ৯১ বছর বয়সে তিনি বসরাতে মৃত্যুবরণ করেন।

৪০. আব্দুল ওয়াহাব আস-শাহরানি মিশরের একজন প্রসিদ্ধ ধর্মীয় নেতা এবং লেখক।

৪১. আবু হুরায়রা (মৃত্যু হিজরি ৫৮ বা ৬৭৮ খ্রিস্টাব্দ) ইয়েমেন থেকে মদিনায় এসে বসবাস করেন। মুহাম্মদের মৃত্যুর প্রায় চার বছর আগে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। হাদিস ভাষ্যকার হিসেবে পরিচিত।

৪২, কাতাদা ইরাকের বসরাতে বসবাসকারী একজন অন্ধ বেদুইন। হাদিস-ভাষ্যকার হিসেবে পরিচিত।

৪৩. কোরানের দুর্লভ ফার্সি ভাষার একটি তফসির প্রকাশ করেছে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি। এক হাজার খ্রিস্টাব্দের দিকে রচিত ফার্সি তফসিরটির মূল লেখক কে জানা যায় না। ধারণা করা হয় ১২৩১ খ্রিস্টাব্দের দিকে এর প্রতিলিপিকরণ করা হয়েছে। ক্যামব্রিজ তফসির- এ কোরানের ১৯ নম্বর সুরা মরিয়ম থেকে ১১৪ নম্বর সুরা নাস-এর তফসির পাওয়া গেলেও আগের

সুরাগুলোর তফসির পাওয়া যায় নাই। ফার্সি ভাষায় এই তফসিরকে সবচেয়ে প্রাচীন দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৭০ সালের দিকে পুনরায় তেহরান থেকে দুই খণ্ডে তফসিরটি প্রকাশিত হয়েছে।

1 Comment
Collapse Comments

Do not write such a thing so that confusion arises to the general people.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *