২.৪ মানুষ ও শয়তানের লড়াই

মানুষ ও শয়তানের লড়াই

নগরকোট মন্দিরের মূর্তি ও হিন্দু আখড়া জয় করে সেখানে ইসলামী শাসন প্রবর্তনের পর সুলতান মাহমূদ গৌড়দের বিদ্রোহ দমনে গজনী ফিরে যাচ্ছিলেন। কারণ, গৌড়ি সম্প্রদায় তার রাজধানী সুরক্ষার প্রশ্নে ঝুঁকি ও হুমকি সৃষ্টি করেছিলো। এটা ছিলো সুলতান মাহমূদের জন্য চরম দুর্ভাগ্যের বিষয়। তিনি যতোবার হিন্দুস্তানে এসে বিজয় নিশান উড়িয়ে এখানে ইসলামী শাসনের ভিত মজবুত করতে চেয়েছেন, ততোবারই সুলতানের অবর্তমানে কোনো না কোনো মুসলিম বেঈমান গজনী আক্রমণে প্রলুব্ধ হয়েছে। ফলে সংবাদ পেয়েই সুলতানকে রাজধানী রক্ষার জন্য গজনী ফিরে যেতে হচ্ছিলো। তিনি হিন্দুস্তানে তার প্রশাসনিক ভিত মজবুত করার অবকাশ পেলেন না।

হিংসাপরায়ণ অমুসলিম ঐতিহাসিকরা তার এই অগত্যা ফিরে যাওয়ার বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ ও প্রকৃত সত্য উদঘাটন না করে সুলতান মাহমূদের নামে কলংক লেপন করেছে। তারা বলেছে, সুলতান মাহমূদ ধন-সম্পদ লুটতরাজের জন্য মন্দিরে আক্রমণ করতো, মূর্তি ভেঙ্গে দিতো, মন্দিরে স্বর্ণ-মণিমুক্তা যা থাকতো তা সংগ্রহ করতো। তাই লুটতরাজ শেষ হলেই সে পুনরায় গজনী ফিরে যেতো। হিন্দুস্তানে ইসলামী শাসন প্রবর্তনে এবং মুসলমানদের শাসন প্রক্রিয়া শক্তিশালীকরণে সুলতান মাহমূদ আন্তরিক ছিলো না।

দু’হাজার হিন্দু বন্দীকে সাথে করে গজনী ফিরে যাচ্ছিলেন সুলতান। প্রকৃতপক্ষে এরা বন্দী ছিলো না, তখনকার রীতি অনুযায়ী এরা ছিলো দাস। মহারাজা আনন্দ পাল যুদ্ধে পরাজয়ের পর উপঢৌকন হিসেবে দু’হাজার দাস দিয়েছিলো। তাছাড়া কিছু সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হাতি সুলতান হিন্দু বাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন আর কিছু হাতি হিন্দু রাজা-মহারাজারা পরাজয়ের পর বশ্যতা স্বীকার করে তাকে উপহার দিয়েছিলো।

যে পরিমাণ সৈন্য নিয়ে তিনি গজনী ত্যাগ করেছিলেন, ফেরার সময় সংখ্যা তার চেয়ে অনেক কম ছিলো। বিজিত এলাকার প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা রক্ষার প্রয়োজনে কিছু সৈন্যকে ওখানে রেখে আসতে হলো। এছাড়া তার কোনো সৈন্য শত্রুর হাতে বন্দী না হলেও একটা উল্লেখযোগ্য অংশ যুদ্ধে শাহাদাতাবরণ করেছিলো।

এই কঠিন সময়ে তার অন্যতম দু’কমান্ডারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। এরা প্রতিপক্ষের হাতে মারাও যায়নি। আবার সুলতান মাহমূদ নগরকোটের প্রশাসনিক কাজেও এ দুজনকে রেখে আসেননি।

এদের একজন কমান্ডার বুগরা খান আর অপরজন কমান্ডার উলস্তগীন। উভয়েই ছিলো আকর্ষণীয় দেহ-সৌষ্ঠবের অধিকারী টগবগে যুবক। বুগরাখান ছিলো পেশোয়ার অঞ্চলের অধিবাসী। সে গজনী থেকে মাঝে মধ্যে পেশোয়ার যাতায়াত করতো বলে হিন্দুস্তানের স্থানীয় ভাষা বুঝততা এবং অল্প বিস্তর বলতেও পারতো। সুলতান মাহমূদের সৈন্যরা যখন নগরকোট দুর্গ জয় করে, তখন বুগরা খান পার্শ্ববর্তী একটি পাহাড়ের চূড়ায় তার ইউনিট নিয়ে মোতায়েন ছিলো। বুগরা খানের সৈন্যরা যখন দেখলো মুসলমানরা দুর্গের প্রধান ফটক ভেঙ্গে ফেলেছে। তখন তার ইউনিটের সৈন্যরা ঊর্ধ্বশ্বাসে দুর্গের দিকে ঘোড়া ছুটায়। বুগরা খান তার ঘোড়াকে সবার আগে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাড়া দেয়। হঠাৎ ঘোড়া এমনভাবে লক্ষ দিয়ে ছুটতে লাগলো যে বুগরা খান নিজে তাল সামলাতে না পেরে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেলেন। তার ঘোড়াটিও বুগরা খানের এভাবে পড়ে যাওয়ায় ভয় পেয়ে তাকে ফেলে দৌড়ে চলে যায়। পাহাড়ের উপর থেকে পড়ে গিয়ে গড়াতে গড়াতে বুগরা খান নীচে চলে যায়। তার উভয় পা মচকে যায়। শরীরে কয়েক স্থানে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। তার পক্ষে সোজা হয়ে দাঁড়ানো সম্ভব হচ্ছিলো না। এমতাবস্থায় হিন্দু সৈন্যরা প্রাণ বাঁচানোর জন্য এদিক-ওদিক পালাচ্ছিলো। হিন্দুদের পালাতে দেখে বুগরা খান ঝোঁপ-ঝাড়ের আড়ালে নিজেকে লুকাতে চেষ্টা করছিলো। কারণ, হিন্দু সৈন্যদের সামনে পড়লে আর তাকে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখতো না।

প্রচণ্ড আঘাত ও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে চেতনাবোধ প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলো বুগরা খান। অর্ধচেতন অবস্থায় প্রাণ বাঁচানোর জন্য সে কোন্ দিক থেকে কোন্ দিকে পালাতে শুরু করেছিলো কিছুই জানা ছিলো না। কখনো বেহুঁশ হয়ে পড়ে যেতো আবার যখনই হুশ ফিরে পেতে উঠে একদিকে চলতে শুরু করতো। বারবার চেতনা হারিয়ে ফেলতো। অবচেতন দেহে পড়ে থাকা অবস্থায় কারো হুংকারে চেতনা ফিরে পেলো বুগরা খান। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তরবারীর বাটে তার হাত চলে গেলো। কোষমুক্ত করে ফেললো তরবারী। তরবারী মুষ্টিবদ্ধ করে যেই না উঠে দাঁড়াতে চাইলো অমনি ব্যথায় মোচর দিয়ে উঠলো পা। প্রায় ভেঙ্গে গেছে তার একটি পা। তদুপরি ক্ষতস্থান থেকে অনবরত রক্তক্ষরণ ও টানা কয়েক দিনের অনাহার-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে গেছে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেও ক্ষণিকের মধ্যেই লুটিয়ে পড়ে বুগরা খান।

“আরে বুগরা খান! মাথা ঠিক করো । কি হয়েছে? আমি আলসতুগীন।” বুগরা খানের নিজের ভাষায় কথা বললো লোকটি। “তুমি এখানে কি করে এলে?”

বুগরা খান কথা বলার চেষ্টা করলো কিন্তু তার মুখে কোনো শব্দই উচ্চারিত হলো না। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় তার কণ্ঠ শুকিয়ে গেছে। জিহ্বা লেপ্টে গেছে। বুগরা খানের মুখ দেখেই আলাসতুগীন বুঝে নিলো সে খুবই তৃষ্ণার্ত। আলাসতুগীন তার কোমরে বাঁধা পানির পাত্র খুলে তার মুখে ধরলো। কয়েক ঢোক পানি পান করলো বুগরা খান। কিছুক্ষণ পর পুরোপুরি চেতনা ফিরে পেলো। অবস্থার উন্নতি দেখে তার মুখে কিছু খাবার তুলে দিলো আলাসতুগীন।

আলাসতুগীনও বুগরা খানের মতোই একজন সেনা কমান্ডার। সেই সুবাদে বুগরা ও আলাসতুর মধ্যে ছিলো গভীর হৃদ্যতা। সুলতান যখন মন্দির ও দুর্গ অবরোধ করেন, তখন বুগরা খানের যেমন দায়িত্ব ছিলো ইউনিটসহ পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের উপর থেকে যুদ্ধের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা এবং প্রয়োজনে ভেতরে ও বাইরের আক্রমণ প্রতিরোধ করা। অনুরূপ আলাসতুগীনের দায়িত্বও ছিলো নগরকোট থেকে কিছুটা দূরে হিন্দু সৈন্যদের রসদ সামগ্রী আসার পথ রোধ করা এবং পথিমধ্যেই সাহায্যকারী দলকে আটকে রাখা। আলাসতুগীনের অধীনে ছিলো ছোট একটি তীরন্দাজ ইউনিট। এরা ধাবমান ঘোড়ায় চড়েও লক্ষ্যভেদী তীরন্দাজে পারদর্শী ছিলো এবং ছিলো কুশলী যোদ্ধা। একদিন আলাসতুগীন ইউনিটের চোখে পড়লো একটি হিন্দু বাহিনী। তবে এরা নগরকোটের দিকে যাচ্ছিলো না, যাচ্ছিলো নগরকোটের বিপরীত দিকে। আলাসতুগীনের তীরন্দাজ ইউনিট হিন্দু সেনাদের প্রতি তীর নিক্ষেপ শুরু করলে ইত্যবসরে এর পাশ দিয়েই অগ্রসরমান একটি পদাতিক সেনাদল দেখা গেলো। ওদের চোখে পড়লো, মুসলিম তীরন্দাজ ইউনিট হিন্দুদের তাড়া করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পলায়নপর হিন্দু অশ্বারোহী আর পদাতিক সৈন্যরা একাকার হয়ে গেলো। অশ্বারোহী আশ্রয় নিলো পলায়নপর পদাতিক সৈন্যদের মাঝে আর পদাতিক সৈন্যরা অশ্বারোহীদের আশ্রয় ভেবে মুসলিম তীরন্দাজদের মোকাবেলায় প্রবৃত্ত হলো। আলাসতুগীনের জনবল ছিলো হাতেগোনা কয়েকজন। অপরদিকে পলায়নপর হিন্দুরা সংখ্যায় ছিলো অনেক। এরা সবাই জীবন বাঁচানোর তাকিদেই মুসলিম তীরন্দাজদের ঘিরে ফেলে এবং কাবু করে ফেলে। মাত্র কয়েকজন তীরন্দাজ ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে চতুর্দিকের আঘাতে বেসামাল হয়ে পড়লো। অধিকাংশই মারা পড়লো আর অল্প ক’জন জীবন নিয়ে পালাতে সক্ষম হলো। এই পালিয়ে বাঁচাঁদের একজন ইউনিট কমান্ডার আলাসতুগীন। টানা কয়েক দিন সে সাথীদের খুঁজে ফিরছিলো। কিন্তু অচেনা হিন্দুস্তানের বিশাল জঙ্গলে কোন্ দিকে হারিয়ে গেছে কোনো কুল-কিনারা করতে পারলো না। সেই গহীন জঙ্গলে সে অবচেতন অবস্থায় দেখতে পেলো বুগরা খানকে। আর এই বুগরা খান তারই ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং তার মতোই সেনা কমান্ডার।

পানি ও খাবার গ্রহণ করার পর স্বাভাবিক জীবনবোধ ফিরে পায় বুগরা খান। কিন্তু তার চলার শক্তি ছিলো না। ততোক্ষণে দিন পেরিয়ে রাত হয়ে গেছে।

রাত পোহালে কমান্ডার আলাসতুগীন বুগরা খানকে নেয়ার জন্য এবং নগরকোটের রাস্তা দেখিয়ে দেয়ার জন্য কোনো লোক পাওয়া যায় কিনা এ জন্য ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। রাতেই বুগরা খান তাকে জানিয়ে দিয়েছিলো নগরকোট দুর্গ মুসলমানরা জয় করে নিয়েছে। তাদের অবস্থান থেকে কিছুদূর অগ্রসর হলেই আলাসতুগীন একটি বসতি দেখতে পায়। তাকে লোকালয়ের দিকে অগ্রসর হতে দেখে কিছু লোক তার উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসে। ওরা ছিলো গ্রামীণ দরিদ্র হিন্দু। মুসলমান সেনা অফিসার দেখে গ্রামের লোকজন তাকে নমস্কার জানাতে থাকে। আলাসতুগীন ইশারা-ইঙ্গিতে ওদের সাথে কথা বলে চারজন যুবককে তার সাথে নিয়ে বুগরা খানের নিকট ফিরে আসে। ততোক্ষণে বুগরা খানের অবস্থার আরো অবনতি ঘটেছে। খানের অবস্থার অবনতি দেখে আলাসতুগীন দুচারটা শব্দ ব্যবহার করে ওদের কাছে জানতে চাইলো, নগরকোট এখান থেকে কত দূর? হিন্দুরা ইশারা ইঙ্গিতে বুঝালো নগরকোট এখান থেকে বহুদূর এবং অসমতল পাহাড়ী পথ।

চার যুবকের একজন তাদের বললো, এমতাবস্থায় এই আহত ব্যক্তির পক্ষে নগরকোট যাওয়া সম্ভব নয় বরং একে গ্রামে নিয়ে যাই। কিছুটা সুস্থ হলে আমরা তাকে নগরকোট পৌঁছে দেবো। বুগরা খান সাহেবের সোক। সে ওদের কথা পুরোপুরিই বুঝতে পারলো এবং বন্ধু আলাসতুগীনকে ওদের প্রস্তাবের কথা তার ভাষায় বুঝিয়ে দিলো।

হিন্দু যুবকরা এ কথাও বললো, আমাদের গ্রামে এ ধরনের হাড়ভাঙ্গা ও ক্ষতের চিকিৎসা হয় এবং এখানে প্রচুর দুধ ও মধু পাওয়া যায়, যা আহত ও দুর্বল লোককে দ্রুত সারিয়ে তুলে।

মনের দিক থেকে আলাসতুগীন গ্রামে অবস্থানের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। কারণ, এসব গ্রামের মানুষেরা তাদের বশ্যতা স্বীকার করলেও দুশমন সম্প্রদায়ের। এদের বিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু বুগরা খানের অবস্থা ছিলো খুবই নাজুক। এ অবস্থায় তাকে নগরকোট পর্যন্ত নিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। ফলে বাধ্য হয়েই সে বুগরা খানকে বললো, আপাতত এখানে থেকে যাই।

আলাসতুগীন ছিলো খুবই সতর্ক কমান্ডার। সে হিন্দুদের স্বভাব সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞাত ছিলো। বুগরা খান তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বন্ধুর জীবন-মরণ পরিস্থিতিতে অনেকটা আবেগপ্রবণ হয়ে গেলো আলাসতুগীন। পরিশেষে অগ্র-পশ্চাৎ এতো কিছু না ভেবে চার যুবককে নির্দেশ দিলে আহত বুগরা খানকে সবাই মিলে কাঁধে তুলে নিলো।

আলাসতুগীন যখন চার হিন্দু যুবককে গ্রাম থেকে নিয়ে গিয়েছিলো, তখন রাস্তার পাশে তিনজন লোক একটি গাছের নীচে দাঁড়িয়ে উসখুস করছিলো। এদের একজন ছিলো নগরকোট মন্দিরের পুরোহিত আর অপর দু’জন নগরকোট দুর্গের শীর্ষস্থানীয় আমলা। মন্দির পতনের ক’দিন আগেই পুরোহিত পাশের এক গ্রামে এসে আশ্রয় নেয়। আর সামরিক আমলা দু’জন এসেছে একদিন আগে। এদের তিনজনকেই গ্রামের হিন্দুরা লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছিলো। পুরোহিত ও দু’কর্মকর্তা সুলতানের বাহিনীর হাতে সম্মিলিত বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় আর মন্দির দখল করে মূর্তি ভাঙ্গার জন্য মুসলিম সেনাদের বিরুদ্ধে মনের প্রচণ্ড বিদ্বেষে অগ্নিশর্মা রূপ ধারণ করছিলো। এই গ্রামে মুসলিম সেনার উপস্থিতি দেখে এরা আশংকা করছিলো, এখান থেকেও হয়তো তাদের পালাতে হবে। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যে মুসলিম সেনাকে ফিরে যেতে দেখে দু’কর্মকর্তার উদ্দেশে পুরোহিত বললো, আমি যদি তোমাদের মতো সৈনিক হতাম তাহলে কাপুরুষের মতো এখানে এসে লুকিয়ে থাকতাম না। মনে হয় না যে তোমাদের শরীরে রাজপুত ধারার রক্ত আছে। তোমরা কি দেখেছিলে ম্লেচ্ছদের ঘোড়াগুলো আমদের মন্দিরের প্রধান ফটক ভেঙ্গে কিভাবে প্রবেশ করেছিলো? তোমরা কি দেখেছিলে, দুশমন সৈন্যরা আমাদের কৃষ্ণদেবীর মূর্তিগুলোকে কিভাবে পাহাড়ের উপর থেকে নীচে ফেলে ঘোড়ার পায়ে পিষে টুকরো টুকরো করেছে। আমি নিজ চোখে দেখেছি, ম্লেচ্ছ সৈন্যরা আমাদের সরস্বতী ও ভগবতী মূর্তিকে পায়ের নীচে পিষ্ট করেছে। এক মুসলমান সৈন্য আমাদের মন্দির চূড়ায় উঠে আযান দিয়েছিলো, তা কি তোমরা শুনেছিলে? হয়তো শুনে থাকবে। হয়তো পবিত্র গীতা ও মূর্তি মুসলমানদের পদপিষ্ট হতেও দেখে থাকবে। তোমরা রাজপুত হলে শত্রুদের হাতে জীবন বিসর্জন দিতে কিন্তু জীবন নিয়ে পালিয়ে আসতে না। আসলে তোমাদের কাছে ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার চেয়ে জীবনই বেশি প্রিয়।

“না না মহারাজ!” এক কর্মকর্তা পণ্ডিতের পায়ের দিকে হাত প্রসারিত করে বললো। “আমরা কাপুরুষ নই পণ্ডিত মহারাজ।”

“হাত সরিয়ে নাও।” ঘৃণাভরে বললো পুরোহিত। “তোমরাও ম্লেচ্ছ। যে সৈনিক নিজ ধর্মের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে পারে না, তার স্বজাতির কোনো পল্লীতে থাকার অধিকার নেই। তোমাদের উচিত জঙ্গলের জীব-জন্তুদের সাথে বসবাস করা। তোমরা কি ধারণা করতে পারো, আমি এই তিন কুমারীকে কিভাবে শত্রু বাহিনীর বেষ্টনীর মধ্য থেকে বের করে নিয়ে এসেছি। আমি ওদের চেহারায় কালি মাখিয়ে পুরুষের কাপড় পরিয়ে বের করে নিয়ে আসি। আর যারা মন্দিরে রয়ে গেছে তারা কী কঠিন অবস্থার শিকার হয়েছে, তা কি তোমরা জানো!”

“আমরা এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবো মহারাজ।” বললো অপর কর্মকর্তা।

“হু, তোমরা যদি সত্যিই আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন হতে, তাহলে মন্দির থেকে তোমরা পালিয়ে আসতে না, মন্দির থেকে তোমাদের লাশ বের হতো। তোমাদের আত্মা থাকতো আকাশে। আসলে তোমরাও ম্লেচ্ছ, আত্মপরিচয় লুকিয়ে তোমরা হিন্দু সমাজে বসবাস করছে। দেখো, গজনীর এই সুলতান দেশের অন্য মন্দিরগুলোরও একই অবস্থা করবে। আজ নগরকোট ধ্বংস হয়েছে, আগামীকাল থানেশ্বরের পালা। তোমরা কি জানো, থানেশ্বর আমাদের কাছে এতোটাই পবিত্র মুসলমানদের কাছে মক্কা-মদীনা যেমন পবিত্র। হায়, আজ যদি আমার এই বৃদ্ধ শরীরে শক্তির সঞ্চার হতো, আমি যদি গজনীর মুসলতানকে নিজ হাতে হত্যা করতে পারতাম!”

“এ কাজটি করার জন্যই আমরা এখানে অবস্থান নিয়েছি মহারাজ।” বললো এক কর্মকর্তা। “আমরা পেছনে পড়িনি, ইচ্ছা করেই এখানে থেকে গেছি। আমি সৈনিক নই, আমলা। আমরা যা চিন্তা করি, সৈনিকদের দেমাগে তা কখনো আসবে না। আমরা যতোটুকু আত্মমর্যাদাবোধ লালন করি, তা কোনো রাজা-মহারাজও লালন করে না। জানো, রাজা-মহারাজাদের আত্মমর্যাদাবোধ কম কেন? কারণ, তারা ক্ষমতার পূজারী। মন্দিরের সাথে শাসকদের ভালোবাসা এতোটুকু গভীর নয় মহলের প্রতি তাদের আগ্রহ যতোটুকু তীব্র। রাজমহল যার কাছে বেশি প্রিয় হয়ে ওঠে, মন্দির তার কাছে গুরুত্বহীন হয়ে যায়। দেখো, সুলতান মাহমূদ কোনো অবতার নয়, একজন মানুষ মাত্র। অথচ নগণ্য একজন মানুষ হয়ে এতোগুলো হিন্দু রাজ্যকে সে পায়ের তলায় পিষ্ট করলো! আমি মনে করি, এই একটি মাত্র মানুষকে যদি শেষ করে দেয়া যায়, তাহলে গোটা গজনী বাহিনী আমাদের পায়ে লুটিয়ে পড়ে প্রাণ ভিক্ষা চাইবে।

“সুলতান মাহমূদ মানুষ হলেও তাকে হত্যা করা সহজ ব্যাপার নয়।” বললো একজন কর্মকর্তা। “আপনার হয়তো জানা নেই আমি দরবেশের বেশ ধারণ করে দুর্গের ভেতরে প্রবেশ করেছিলাম, কিন্তু মধ্যে কয়েক জায়গায় আমার পথরোধ করা হয়েছে। আমাকে ঘাটে ঘাটে যাচাই করা হয়েছে। প্রত্যেকবার আমি ওদের বলেছি, ভাই! আমি একজন দরবেশ মানুষ, দুনিয়া ত্যাগী। সুলতানকে মোবারকবাদ জানাতে এসেছি। অনেক অনুরোধের পর সিপাহীরা আমাকে তাদের কমান্ডারের কাছে নিয়ে গেলো। কমান্ডার আমাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের পর আমার শরীর তল্লাশি করে চোগার ভেতর লুকিয়ে রাখা খঞ্জর বের করে এনে বললো, দরবেশের পরিচয় দিচ্ছে, তাহলে সাথে অস্ত্র কেন? আমি বললাম, যে ধর্মের একজন সুলতান দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে একের পর এক রাজ্য দখল করে এতোদূর পর্যন্ত মূর্তিপূজা বন্ধ করতে এসেছেন, সেই ধর্মের একজন অনুসারীর কাছে কি এই অস্ত্রটুকুও থাকবে না, তা কি করে হয়? আমি একজন খাঁটি মুসলমান। আর প্রত্যেক মুসলমানের কাছে আত্মরক্ষামূলক হাতিয়ার থাকা অলংকার। এতো কৌশলে কথা বলার পরও সে আমাকে এক দারোয়ানের হাতে তুলে দিলো। আমি তখন অনুভব করলাম, গজনীর সুলতানের কাছে পৌঁছা মোটই সহজ কাজ নয়, তাকে হত্যা করা তো দূরের কথা। ব্যর্থ হয়ে অবশেষে আমাকে ফিরে আসতে হয়েছে।”

“আমরা এখন এখানেই থাকবো।” বললো অপর কর্মকর্তা। এখানে থেকে আমরা অপেক্ষা করবো। সুলতান অবশ্যই বিজিত এলাকা দেখার জন্য বের হয়ে এখানে আসবেন। তখন হয় দূর থেকে তীর মেরে হত্যা করবো, নয়তো কাছে গিয়ে খঞ্জর দিয়ে তাকে হত্যা করবো। আমরা নিজেদের জীবনের মায়া করি না মহারাজ। যদি আমাদের দুজনের জীবনের বিনিময়েও হয়…।”

‘এটা করতে পারলে তোমরা পরজনমে এদেশের মহারাজা হবে।” বললো পুরোহিত। “ব্রাহ্মণ ও রাজপুতরাও তোমাদের পায়ে মাথা ঠেকাবে।” পণ্ডিত একটু গম্ভীর হয়ে ভেদকথা বলার মতো করে বললো, “আমিও এ কথাই ভাবছিলাম, কিভাবে ওই একটি মাত্র লোককে হত্যা করা যায়। আমার সাথে যে তিন তরুণী এসেছে তোমরা কি তাদের সৌন্দর্য দেখেছে? আমি ভাবছি, কি করে ওদেরকে উপঢৌকন হিসেবে সুলতানের কাছে পৌঁছানো যায়। ওরা সেখানে পৌঁছতে পারলে তার খাবারে বিষ প্রয়োগ করতে পারতো।”

 “অসম্ভব।” বললো এক কর্মকর্তা। “আমাদের বলা হয়েছে, এই সুলতান নাকি পাথরের মতো কঠিন। মদ ও নারীর প্রতি তার মোটেও আসক্তি নেই। এ জন্য তার সৈন্যরা কোনো অঞ্চল জয় করলেও সেখানকার কোনো নারীর ইজ্জতের উপর কোনো আঘাত হানে না। কোনো নারীর সমহানির ঘটনা ঘটে না। সুলতান মাহমূদকে নারীর ফাঁদে ফেলা সম্ভব নয়। অন্য কোনো পথ ভাবতে পারেন।”

“অথচ নারী আর মদই আমাদের মহারাজাদের ডুবিয়েছে।” বললো পুরোহিত। “আর মুসলমানদের বিজয়ের মূল কারণ হলো তারা মদ ও পরনারী ভোগকে ঘৃণা করে। তদুপরি আমাদের কিছু একটা করতেই হবে। আমাদের আরো ভাবতে হবে। আমি রাতে ঘুমাতে পারি না। জীবনভর যে কৃষ্ণমূর্তির পূজা করে কাটিয়েছি, নিজের চোখের সামনে তাদের অমর্যাদা হতে দেখেছি। এ জন্য এদেশের উপর ভগবানের অভিশাপ পড়বে, আমার উপর পড়বে, তোমাদের উপরও পড়বে।”

নগরকোট মন্দির সুলতানের বাহিনী পদানত করেছে প্রায় ৮/১০ দিন হয়েছে। কদিন ধরে এই হিন্দু কর্মকর্তা ও পুরোহিত পাহাড়ের পাদদেশের এই পল্লীতে আত্মগোপন করে আছে। হিন্দু দু’কর্মকর্তা তাদের বেশ বদল করে দু’-দু’বার পাহাড়ের উপরে অবস্থিত দুর্গে গিয়েছিলো সুলতান মাহমূদকে হত্যা করার জন্য। কিন্তু সুলতানকে হত্যা করার কোনো সুযোগ তারা পায়নি। এরপরও তারা হতোদ্যম হয়নি। পণ্ডিতের কথাও তাদের হতাশাগ্রস্ত করেনি। সুলতান বিজিত এলাকা পর্যবেক্ষণে বের হলে দূর থেকে বিষাক্ত তীর নিক্ষেপ করে তাকে হত্যা করার মানসে দুকর্মকর্তা দুটি ধনুক, প্রয়োজনীয় সংখ্যক তীর সংগ্রহ করেছে। এলাকাটি ছিলো জঙ্গলাকীর্ণ এবং উঁচু-নীচু অসংখ্য পাহাড়ে বেষ্টিত। আড়াল থেকে তীর নিক্ষেপ করে লুকিয়ে পড়া কোনো কঠিন ব্যাপার নয়।

ইত্যবসরে আলাসতুগীন পল্লী থেকে চার যুবককে নিয়ে ফিরে আসে। দূর থেকে পুরোহিত ও দু’কর্মকর্তা ভেবেছিলো, গজনীর এই সেনা হয়তো চার যুবককে বেগার খাটানোর জন্য নিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর এই তিন হিন্দু দেখতে পেলো, পল্পীর চার যুবক এক ব্যক্তিকে কাঁধে করে নিয়ে আসছে। হিন্দু কর্মকর্তারা আলাসতুগীনকে এবার চিনে ফেলে। তাই নিরাপত্তার স্বার্থে তারা

লুকিয়ে পড়লো । আলাসতুগীন যখন গ্রামে পৌঁছলো তখন গ্রামের অন্যান্য লোকজনও এসে জড়ো হলো। বুগরা খানকে একটি চৌকিতে শুইয়ে দেয়া হলো। গ্রামের দু’বৃদ্ধা তার আঘাত ও ক্ষতস্থান দেখতে লাগলো। একটু পরীক্ষা করে তারা ক্ষতস্থানের চিকিৎসা শুরু করে দিলো।

আলাসতুগীনের বলে দেয়া কথায় বুগরা খান দুই বৃদ্ধকে তাদের ভাষায় বললো, গ্রামের লোকজন যদি তাদের সাথে কোনো ধরনের দুরভিসন্ধিমূলক কিছু করে, তাহলে সারা গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হবে এবং গ্রামের ছেলে-বুড়ো সবাইকে পাইকারী হারে হত্যা করা হবে।

“আপনারা আমাদের শাসক-প্রভু। গোটা গ্রামের মানুষ আপনাদের সেবায় একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। উল্টো-সিধা করার দুঃসাহস কে করবে। আমরা এর চেয়েও বেশি আঘাতের সুচিকিৎসায় দক্ষ। কোনো চিন্তা করবেন না। ৪/৫ দিনের মধ্যে আপনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবেন।”

আলাসতুগীন ও বুগরা খানের জন্য একটি ঝুপড়ির মতো ঘর খালি করে সেটিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হলো। গ্রামের লোকজনের কাছে সবচেয়ে উন্নত যে বিছানা ছিলো, তাই তাদের জন্য বিছিয়ে দেয়া হলো। রাতে শুয়ে শুয়ে আলাসতুগীন বুগরা খানকে বললো, প্রত্যূষে সে সেনা ক্যাম্পে গিয়ে বুগরা খানকে এখানে থেকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবে। কিন্তু বুগরা খান তাতে আপত্তি করে বললো, তাকে একাকী ফেলে যাওয়া ঠিক হবে না। একাকীত্বের সুযোগে গ্রামের লোকজন তাকে গায়েব করেও দিতে পারে, নয়তো ক্ষতস্থানে বিষ প্রয়োগ করে ক্ষতি করতে পারে।

দীর্ঘ ক্লান্তি, ক্ষুধা, পিপাসায় কাতরতার কারণে দু’কমান্ডার কিছুক্ষণ পরই গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। কিন্তু তাদের ঘর থেকে কিছুটা দূরেই অপর একটি ঘরে হিন্দু পুরোহিত, কর্মকর্তা ও চিকিৎসক ক্ষীণ আওয়াজে সলাপরামর্শ করছিলো। পুরোহিত অন্যদের বললো, এই দু’সেনা অফিসারকে আমরা নিজেদের কাজে ব্যবহার করতে পারি। সেই কৌশল আমাদের জানা আছে। যার দ্বারা কোনো কাপুরুষকেও বাহাদুর আর বাহাদুরকে কাপুরুষে পরিণত করা যায়। সুলতানকে যদি তার নিজের লোকজনের দ্বারা হত্যা করানোর ব্যবস্থা করা যায়, তবে সেটিই হবে সবচেয়ে উত্তম। বললো এক কর্মকর্তা। কারণ, আমরা অনেক চেষ্টা করে দেখেছি, সুলতানের কাছে যাওয়া অপরিচিতের জন্য খুবই কঠিন।

“তোমরা দু’জন শোন!” বৃদ্ধ দু’চিকিৎসককে বললো পুরোহিত। “এ দু’কমান্ডারকে তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে দেয়া যাবে না। আমাকে একটি ঘোড়া দাও, আমাকে এখনই থানেশ্বর যেতে হবে। ঘোড়াটা এমন সামর্থবান হতে হবে, যেনো দ্রুত আমি সেখানে যেতে পারি এবং দ্রুত ফিরে আসতে পারি।” দুকর্মকর্তাকে পুরোহিত বললো, “তিন কুমারীকে আমি তোমাদের কাছে রেখে যাচ্ছি। এদের করণীয় সম্পর্কে আমি ওদের বুঝিয়ে বলে যাবো। তোমরা অন্যান্য দিকে খেয়াল রেখো।”

গ্রামের এক লোককে ইশারা করলে তিন তরুণীকে কমান্ডারদের ঘরে নিয়ে আসা হলো। পণ্ডিত তরুণীদের করণীয় কর্তব্য বুঝিয়ে দিলো। এরই মধ্যে ঘোড়া প্রস্তুত করে নিয়ে আসা হলো। পুরোহিত অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করে দ্রুত চলে গেলো।

ভোরবেলায় আলাসতুগীন ঘুম থেকে ওঠে দেখলে বুগরা খান ব্যথায় কোকরাচ্ছে। আলাসতুগীন বৃদ্ধ চিকিৎসকদের ডাকার জন্য ঘর থেকে বের হতে যাবে, তখনই দরজার পাশে দেখলো দু’তরুণী দাঁড়ানো। আলাসতুগীনকে দেখে ওরা সলজ্জ হাসলো। সুন্দরী তরুণীদের দেখে আলাসতুগীনের চোখ ছানাবড়া। এক তরুণী তার উদ্দেশে কিছু বললেও সে পূর্ববৎ দাঁড়িয়ে রইলো। তার চেহারা দেখেই মনে হলো সে কিছুই বুঝেনি। অপর তরুণী মাথা ঝুঁকিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলো এবং উভয়েই ভেতরে প্রবেশ করে বুগরা খানের পাশে গিয়ে বসলো।

এক তরুণী বুগরা খানের মাথা হাতে নিয়ে বললো, খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝি? অপরজন তার হাত নিজের হাতে নিয়ে নিলো। বুগরা খান ঘটনার আকস্মিকতায় নির্বাক হয়ে গেলো। তার মুখ থেকে কোনো কথাই বের হলো না। ব্যথায় সে যে কুঁকাচ্ছিলো, তাও ভুলে গেলো।

“এদের কেউই আমাদের ভাষা বুঝে না।” তরুণী অপর সঙ্গীকে বললো।

“না না, আমি তোমাদের ভাষা বুঝি। কিন্তু আমি তামাদের মতো এমন সুন্দরী তরুণীদের দেখে ভেবে পাচ্ছিলাম না এই জঙ্গলে তোমাদের মতো রূপসী কোত্থেকে এলো? মনে হয় তোমরা এই গ্রামের বাসিন্দা নও।”

“এ জঙ্গলেই আমাদের জন্ম। বললো এক তরুণী। এই জঙ্গলে কেউ বিপদে পড়লে, কেউ কোনো আঘাতপ্রাপ্ত হলে আমরা তার সেবা-শুশ্রূষা করে থাকি। আচ্ছা, আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করছিলাম, আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে

‘ব্যথা খুব বেশি।” জবাব দিলো বুগরা খান এবং তরুণীর হাত তার হাতে তালুবদ্ধ করে নিলো।

“খুব তাড়াতাড়ি সেরে উঠবেন। ঠিক আছে, আমরা আপনার খাবার নিয়ে আসছি।” এই বলে উভয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

তরুণীরা যখন খাবার নিয়ে প্রবেশ করলো, তখন ওরা তিনজন। একজনের হাতে হাত-মুখ ধোয়ার পানি, অপর দু’জনের হাতে পানাহার সামগ্রী। খাবারের মধ্যে অন্যতম ছিলো মধু মেশানো দুধ।

এক তরুণী বুগরা খান ও আলাসতুগীনের হাত-মুখ ধুইয়ে দিলো। উভয়েই দুধপান করলো এবং খাবার ও ফলফলাদি আহার করলো। তরুণীরা খাবারের শূনপাত্র তুলে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই বুগরা খানকে উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠতে শোনা গেলো। আলাসতুগীন বুগরা খানের হাসি শুনে গভীরভাবে তার চেহারার দিকে তাকিয়ে নিজেও হেসে ফেললো। দীর্ঘদিন পর দু’বন্ধু এভাবে প্রাণখোলা হাসলো। কারণ, হাজারো রণাঙ্গনে তাদের পরাজয় যখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিলো তখন গজনী বাহিনীর কারো বেঁচে থাকার আশা ছিলো না। কিন্তু রাজা আনন্দপালের হাতির চোখে তীরবিদ্ধ হলে সেটি যখন বিকট আর্তচিৎকার দিয়ে ওদের বাহিনীকেই পদপিষ্ট করতে শুরু করলো আর রাজার ঝাণ্ডা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো; তখন হিন্দু বাহিনী বিশৃঙ্খল হয়ে পালাতে শুরু করে।

আলাসতুগীন ও বুগরা খানের প্রতি শত্রু বাহিনীকে তাড়া করার নির্দেশ হলে তারা নিজ নিজ ইউনিটকে নিয়ে শত্রু বাহিনীর পিছু ধাওয়া করে। সেই যুদ্ধে তাদের বহু সহযোদ্ধা শাহাদাতবরণ করেছে। ফলে তাদের হৃদয় থেকে হাসি উধাও হয়ে গিয়েছিলো। সেই যুদ্ধে কোনো বিরতি না দিয়ে সকলকে নগরকোটের দিকে অগ্রাভিযানের নির্দেশ হলো। সেখানে পৌঁছেও কঠিন যুদ্ধ করতে হলো। মৃত্যু যখন চোখের সামনে থাকে, তখন মানুষ কাঁদে। কিন্তু এই দু’কমান্ডার কাদার লোক ছিলো না। তারা গজনী থেকে পাহাড়, নদী, জঙ্গল, সমতল ভূমি এবং শত্রু বাহিনীর বাধা ডিঙ্গিয়ে বিজয়ের বেশে নগরকোট পর্যন্ত পৌঁছেছে। এখন বিজিত এলাকার এই ঝুপড়িতে বসে বুগরা খান যখন অট্টহাসিতে মেতে উঠলো, তখন বন্ধুর তাৎপর্যপূর্ণ হাসি দেখে আলাসতুগীনও হেসে ওঠে । আলাসতুগীন বুগরা খানের উচ্ছাসিত হাসিতে আন্দাজ করে, দীর্ঘ ক্লান্তিকর যুদ্ধ তাদের হৃদয় থেকে হাসি কেড়ে নিয়েছিলো, চাপা দিয়ে রেখেছিলো তাদের প্রাণোঙ্গল আবেগ। যুদ্ধ আর খুনাখুনিই নয়, এখন তাদের ইচ্ছে করে আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠতে, জীবনকে উপভোগ করতে।

বুগরা খান বন্ধু আলাসতুগীনকে জানালো, তার ব্যথা অনেকটাই কমেছে। আলাসতুগীন দরজার দিকে তাকিয়ে ছিলো। বুগরা খানের বুঝতে বাকি রইলো না বন্ধু কিসের জন্য দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তরুণীর বদলে ঘরে প্রবেশ করলো তাদের চিকিৎসক দুই বৃদ্ধ। এদের দু’জনকে গ্রাম্য অশিক্ষিত মনে হলেও হাবভাব দেখে মনে হলো পেশাগত কাজে তারা খুবই দক্ষ। তারা ঘরে প্রবেশ করে বুগরা খানের ক্ষতস্থান থেকে পট্টি খুললো, ভাঙ্গা পা দেখলো এবং শেষে দু’জন রায় দিলো, সম্পূর্ণ সেরে উঠতে আরো দিন দশেক লাগবে।

তাদের থেকে কিছুটা দূরে আরেকটি ঝুপড়ি ঘরে দুহিন্দু কর্মকর্তার সামনে তিন তরুণী উপবিষ্ট। এক কর্মকর্তা তরুণীদের উদ্দেশে বললো, “তোমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে। দু’তিন দিন ওদের কাছে বেশিক্ষণ থাকবে না। তাহলে ওদের সন্দেহ হতে পারে। দুধ নিজেরা পান করে পরীক্ষা করে নিও। স্বাদে কোনো তারতম্য ঘটলে তাতে আরো দুধ দিয়ে বেশি করে মধু মিশিয়ে নিও।”

“নেশা ধরানোর ব্যাপারে তোমরাই তো যথেষ্ট। দুধে নেশা মেশানো ছাড়া তোমরাই ওদের নেশাগ্রস্ত করার জন্য যথেষ্ট।” বললো অপর কর্মকর্তা।

খেয়াল রেখো, তোমরা যেনো আবার নেশায় আক্রান্ত না হয়ে যাও।” বললো অপর কর্মকর্তা। কারণ উভয়েই কিন্তু তাগড়া যুবক।”

“হয়তো এর চেয়েও আরো কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে তোমাদের।” বললো এক কর্মকর্তা। নিজের দেশ ও জাতির প্রয়োজনে তোমাদের এই ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। এখন তোমাদের কর্তব্য হলো, পণ্ডিত মহারাজের আসা পর্যন্ত ওদেরকে এখানে আটকে রাখা। পণ্ডিতজী একজন দক্ষ ঋষিকে সাথে নিয়ে আসবেন। তিনি এসে এদেরকে ভক্তে পরিণত করবেন। এরপর দেখো, এদের হাতেই আমরা সুলতানকে হত্যা করাবো।”

সুলতান মাহমুদের দুই খ্যাতিমান কমান্ডার হিন্দুদের চক্রান্তের ফাঁদে আটকে গেলো। দু’তিন দিনের মধ্যেই এরা তাদের কর্তব্য, দায়িত্ব ও অভিষ্ট লক্ষ্যের কথা বিস্তৃত হয়ে গেলো। তারা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি, দুধ ও মধুর সাথে মিশিয়ে তাদেরকে প্রতিদিন নেশাজাতীয় দ্রব্য পান করানো হচ্ছে। এরা যেহেতু শরাব পানে অভ্যস্ত ছিলো না, তাই দুধ ও মধুর সাথে মেশানো সামান্য শরাবেই ওরা আবেগপ্রবণ হয়ে উঠতো। সেই সাথে রূপসী তিন তরুণীও ওদের মধ্যে সৃষ্টি করে প্রচণ্ড কামনার নেশা।

এভাবে যখন প্রায় সপ্তাহ চলে গেলো। একদিন এক তরুণী বুগরা খান এবং আরেক তরুণী আলাসতুগীনের গায়ে গা মিশিয়ে আবেগ ও বিনয়ী কণ্ঠে নিবেদন করলো, তাদেরকে যেনো সাথে করে গজনী নিয়ে যাওয়া হয়। দু’কমান্ডার এ কথাও ভাবতে পারেনি যে, এই এলাকার মানুষই তো সব কালো। এর মধ্যে সুন্দরী তরুণী আসলো কিভাবে। ওদের জন্মদাতাই বা কে?

দুই বৃদ্ধ বুগরা খানের সেবা-শুশ্রূষা করছিলো আর চিকিৎসা অব্যাহত রাখছিলো। এরই মধ্যে বুগরা খান অনেকটাই সুস্থ হয়ে ওঠে। সে এখন নিজে নিজে হাঁটা-চলাফেরা করতে পারে। তবুও এ গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার কথা একবারও ভাবনায় আসেনি। কমান্ডার আলাসতুগীনের মনও ঝুপড়ির বেড়াজালে বন্দী হয়ে গেছে। একদিন উভয় বন্ধু তরুণীদের বললো, রাতের বেলায় তারা যেনো এ ঘরে একবার আসে। তরুণীরা বললো, রাতের বেলায় এদিকে পা বাড়ালে মা-বাবা তাদের প্রাণে রাখবে না। তাদের পিতা-মাতা তাদেরকে শুধু সেবা-শুশ্রূষা করতেই দিনের বেলা আসতে দেয়।

আসলে প্রশিক্ষিত এই তরুণীরা গজনী বাহিনীর দুই কমান্ডারের সুপ্ত কামনাকে উস্কে দেয়ার চেষ্টা করছিলো। যুদ্ধক্লান্ত দুই কমান্ডারের জন্য তরুণীরা মরিচীকা হয়ে দেখা দিলো। তারা যেভাবে উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে দু’কমান্ডারের প্রতি ভালোভাসা ও মমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতো, তাতে কমান্ডারদের মধ্যে প্রেমের দুর্বিনীত আকর্ষণ সৃষ্টি করে। যৌবনে উদ্দীপ্ত দুই যুবক কমান্ডার যখন রূপসী-তরুণীদের নাঙ্গা কাঁধের উপর বিক্ষিপ্ত রেশমী চুলগুলো নিয়ে খেলা করতো, তখন ভেতরে ভেতরে তাদের মধ্যে কামনার দানব তর্জন-গর্জন শুরু করে দিতো। তারা আবেগে কাঁপতো। আন্দোলিত হতো তাদের দেহ-মন।

এদিকে এদের অবস্থান থেকে কিছুটা দূরে একটি বিশাল মন্দির মূর্তিশূন্য করে সেখানে আযান চালু করেছিলেন সুলতান মাহমূদ। আর এখানে তারই দুই কমান্ডার হিন্দুদের চক্রান্তে পড়ে জ্যান্ত-মূর্তির পূজায় লিপ্ত হয়ে পড়েছে।

একদিন বুগরা খান তার সেবারত তরুণীকে বললো, “তোমরা আমাকে লাশের দুর্গন্ধ আর রক্তের হোলিখেলা থেকে তুলে এমন পরিবেশে নিয়ে এসেছে, এখানকার ঝুপড়িটাও আমার কাছে রাজমহলের মতো সুখ দিচ্ছে।”

“আপনি চাইলে আমরা আপনাকে সত্যিকার মহলেই নিয়ে যেতে পারব।” তরুণী বললো। “কিন্তু আমরা যা-ই করি তাতে আপনি আপত্তি করবেন না।” এ কথা বলেই তরুণী চলে যায়। পুনরায় একটি পেয়ালা হাতে নিয়ে এলো এবং বুগরা খানের সামনে রেখে বললো, “পান করুন। এটি এই মাটির বুনো ফলের রস। এই এলাকা ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না।”

বুগরা খান পেয়ালা হাতে নিয়ে কয়েক ঢোক পান করতেই তরুণী পেয়ালা ছিনিয়ে নিয়ে বললো, “এই রস এক সাথে বেশি পান করা ঠিক নয়।”

জীবনে এমন স্বাদের কোনো জিনিস বুগরা খান পান করেনি। কিছুক্ষণ পরই তার মধ্যে একটা ফুরফুরে আনন্দ দোল খেয়ে যায়। হঠাৎ সে তরুণীকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে বলে, “এখন আমি চলাফেরা করতে পারি কিন্তু তোমাদের ছেড়ে যাবো না। সুলতান যদি আমাকে তোমাদের ছেড়ে চলে যেতে নির্দেশ দেয়, তাও আমি মানবো না।”

“আপনি কি কখনো শরাব পান করেছেন? শুনেছি মুসলমানরা শরাব পান করে না।”

“হু, শরাবকে অভিশম্পাত করি আমি। তোমরা থাকতে আমার শরাবের কোনো প্রয়োজন নেই।” বললো বুগরা খান।

“আমি আপনাকে শরাবই তো পান করিয়েছি। বলুন তো এমন শরাবকে কেনো আপনারা হারাম মনে করেন?

বুগরা খান শরাব পানের কথা শুনে গম্ভীর হয়ে যায় এবং ভাবনায় পড়ে গেলো। তরুণী বুগরা খানের আরো ঘনিষ্ঠ হতে থাকলো এবং বুগরা খানের চোখের সামনে নিজেকে মেলে ধরলো। খানের চোখে চোখ রাখতেই বুগরা খান ভুলে গেলো হালাল-হারামের বিধি-বিধান।

“আলাসতুগীন!” বন্ধুকে ডাকলো বুগরা খান।

আলাসতুগীন ছিলো ঝুপড়ির অপর কক্ষে। সে বন্ধুর ডাকে চলে এলো। বুগরা খান তাকে পেয়ালা দেখিয়ে বললো, “দেখো! সুন্দরীরা কী চমৎকার পানীয়কে শরাব বলছে। নাও, আমি পান করেছি, তুমিও পান করো। ভারী মজার জিনিস।”

আলাসতুগীন বন্ধুর কথায় পেয়ালা হাতে তুলে নিলো এবং পেয়ালার অবশিষ্টটুকু গলাধঃকরণ করলো। কিছুক্ষণ পর বুগরা খানের মতো সেও স্বপ্নীল জগতের বাসিন্দা হয়ে গেলো।

গজনী বাহিনীর দু’কমান্ডার নিজেদের জন্য শরাব হালাল করে নিলো। তারা এটিকে শরাব বলতেই নারাজ। পরদিন দু’তরুণী তাদের ঘরে প্রবেশ করে দু’জনকে তাদের মুখোমুখি বসিয়ে বলতে লাগলো, “আমরা এ গ্রামের অধিবাসী নই। আমাদের অভিভাবকরা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। আপনাদের সৈন্যরা যখন নগরকোট মন্দির অবরোধ করে তখন আমরা মন্দিরে পূজা দিতে যাচ্ছিলাম। অবরোধের কথা শুনে আমাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে এবং নিজ বাড়িতে না গিয়ে এই পল্লীতে নিয়ে আসে। গ্রামের লোকজনকে বলে, গজনী বাহিনী নগরকোট দুর্গ অবরোধ করে এমতাবস্থায় তরুণী মেয়েদের নিয়ে যাতায়াত করা ঝুঁকিপূর্ণ। আপনারা আমাদের মেয়েদেরকে হেফাজত করুন। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে আমরা মেয়েদের নিয়ে যাবো। আমাদের সাথে অপর যে মেয়েটিকে দেখছেন, ও আমাদের প্রতিবেশী। আমাদের অভিভাবক আমাদের নিতে এসেছেন। আপনারা দু’জন আমাদের সাথে চলুন। আমরা বললে আপনাদেরকে নিতেও রাজি হয়ে যাবে।”

বুগরা খানকে তরুণীদ্বয় বললো, আপনি আপনার বন্ধুকেও ব্যাপারটি বুঝিয়ে বলুন।

বুগরা খান তরুণীদের প্রস্তাবের কথা আলাসতুগীনকে নিজের ভাষায় জানালে সে বললো, “আমরা সেনাবাহিনীর লোক। ওদের সাথে আমাদের যেতে দেখা অবস্থায় আমরা ধরা পড়লে আমরা গাদ্দার ও পক্ষত্যাগী সৈনিক হিসেবে চিহ্নিত হবো। সেনা আইনে আমাদের মৃত্যুদণ্ড হবে। এই তরুণীরা যদি আমাদের সাথে থাকতে চায় তাহলে ওদের এখানেই থাকতে বলল। এদেরকে আমাদের সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য অন্য কোনো ব্যবস্থার কথা চিন্তা করবো। ওদের উচিত আমাদের সাথে থাকা।”

তরুণীদ্বয় হতাশ হয়ে চলে গেলো। একটু পর তাদের ঝুপড়িতে প্রবেশ করলো দুই প্রবীণ। তারা বললো, “আমরা দুজন এ মেয়েগুলোর অভিভাবক। ওরা হয়তো আমাদের পরিচয় দিয়েছে। এই যুবতী মেয়েদেরকে নিয়ে রাস্তায় বের হওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই আপনারা যদি আমাদের সাথে থাকেন তাহলে রাস্তায় মেয়েদের কেউ অপহরণ করার চিন্তাও করবে না। আপনারা এর বিনিময়ে যা চান তাই দেয়া হবে।”

“আমরা তোমাদের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারি কিন্তু পুরস্কার হিসেবে এই মেয়ে দুটোকে চাই। এ প্রস্তাব যদি তোমাদের পছন্দ না হয় তাহলে একাই চলে যেতে পারো।” বললো বুগরা খান।

“এদের জন্যই তো আমরা এতটা ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি হয়েছি আর এতটা ঝুঁকি নিতে চাচ্ছি।” বললো একজন। “আমরা মেয়েদেরকে তোমাদের হাতে তুলে দেবে কোন্ যুক্তিতে!”

“রাখো তোমাদের যুক্তি। তোমরা মেয়েদেরকে এখান থেকে নিতেই পারবে না।” ক্ষুব্ধকণ্ঠে বললো বুগরা খান।

***

সেদিন রাতের ঘটনা। উভয় তরুণী বুগরা খান ও আলাসতুগীনের পাশে বসে তাদেরকে শরাব পান করাচ্ছিলো। শরাবের নেশায় উভয়েই ছিলো নেশাগ্রস্ত। ঝুপড়ির দরজা ছিলো খোলা। রাতের প্রথম প্রহরের পর ঝুপড়িতে সন্ন্যাসীর মতো এক লোক প্রবেশ করে। লম্বা চুল ও চোয়াল ভরা দাড়ি। লোকটি চোগা পরিহিত। হাতে লম্বা লাঠি। লাঠির মাথায় কাঠের তৈরি সাপের প্রতিকৃতি। তরুণীদ্বয় সন্ন্যাসীকে দেখেই চকিতে ওঠে এসে তার পায়ে হাত রেখে প্রণাম করে এবং বুগরা খান ও আলাসতুগীনকে জানায়, “ইনি একজন সন্ন্যাসী। এপথে হঠাৎ করে আসেন। কেউ তার ঠিকানা জানে না এবং তার ধর্মের কথাও বলতে পারে না। এই সন্ন্যাসী ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারেন। জঙ্গলের সাপও তার কথা শুনে। রাজা-মহারাজা তার পায়ে লুটিয়ে পড়ে কিন্তু তিনি দুনিয়ার কোনো সুখ-আহ্লাদ ভোগ করেন না। জঙ্গলেই থাকেন।”

“তোমার তো জীবিত থাকার কথা ছিলো না। এতোটাই উপর থেকে তুমি পড়েছিলে যে মৃত্যুর আশংকা এখনো পুরোপুরি কেটে যায়নি। এসো, আমার কাছে এসো।” বললো সন্ন্যাসীরূপী লোকটি।

সন্ন্যাসী বুগরা খানকে তার সামনে বসিয়ে প্রদীপটি কাছে টেনে নিলো। সে পকেট থেকে একটা হীরার মতো কিছু বের করে বুগরা খান ও তার মাঝখানে এমনভাবে প্রলো যে, প্রদীপের আলো পড়তেই সেটি থেকে বিভিন্ন রঙ বিচ্ছুরিত হতে থাকে। রঙের এই খেলা ছিলো খুবই মনোহরি।

সন্ন্যাসী বুগরা খানকে বললো, “এদিকে তাকাও এবং হীরাটি দেখতে থাকো। লক্ষ্য করো, এর মধ্যে তুমি জীবন-মৃত্যুকে নিজের চোখে দেখতে পাবে। আমি পরীক্ষা করে দেখবো, কোন্ ঘরে আছে তোমার আত্মা- মৃত্যুর ঘরে না জীবনের ঘরে।”

হীরের টুকরো থেকে বিচ্ছুরিত রঙ আর সন্ন্যাসীর কথার মধ্যে এমন জাদু ছিলো যে বুগরা খান আত্মহারা হয়ে যেতে লাগলো। অর্ধ অবচেতন তো সে শরাব পান করেই হয়েছিলো। এবার সন্ন্যাসীর কথা ও জাদুকরী হীরের ঝিলিকে সে সম্পূর্ণ আত্মহারা হয়ে গেলো। সে মোটেও আন্দাজ করতে পারেনি যে, সন্ন্যাসী নিষ্পলক তার চোখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সন্ন্যাসী হীরের টুকরোটিকে উপরের দিকে তুলে তার চোখের সামনে রাখলো। বুগরা খান হীরার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো। একসময় সন্ন্যাসী হীরের টুকরোটিকে চোখের সামনে থেকে সরিয়ে ফেললো। কিন্তু বুগরা খান তা মোটেও টের পেলো না। এবার বুগরা খান এক পলকে সন্ন্যাসীর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। সন্ন্যাসী এখন যা বলছে, চোখের দৃষ্টির মাধ্যমে তা বুগরা খানের ভেতরে প্রবেশ করছে। তার মধ্যে সৃষ্টি করছে স্বপ্নালুতা। সন্ন্যাসীর বলার ধরনও ছিলো মোহনীয়। সন্ন্যাসী এভাবে কথা বলছিলো যে, সে কোনো স্বপ্নিল জগতে বিচরণ করছে।

এক পর্যায়ে বুগরা খান বলতে শুরু করলো, “হ্যাঁ হ্যাঁ, এইতো আমি জান্নাত পেয়ে গেছি। আমার কাছ থেকে এ জান্নাত কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না। হ্যাঁ, আমিই গজনীর বাদশাহ। আমি খুন করে ফেলবো। আমার তরবারী অনেক দিন কাউকে হত্যা করে না…।”

পাশে বসে আলাসতুগীন দেখছিলো সন্ন্যাসীর কর্মকাণ্ড। কিন্তু সে এসবের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছিলো না। শুধুই অবাক হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে ছিলো।

এবার বুগরা খানকে ছেড়ে দিয়ে আলাসতুগীনকেও অনুরূপ পরীক্ষার নামে জাদুকরী প্রভাবে স্বপ্নিল জগতে বিচরণ করালো সন্ন্যাসী। কিছুক্ষণ পর সেও বুগরা খানের মতোই স্বপ্নিল জগতে বিচরণ করতে লাগলো।

মানুষ যখন অপরাধ ও পাপের মাধ্যমে নিজের কর্তব্যকে চেপে রাখে তখন ভোগবাদিতার স্বপ্নিল জগতে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে মোটেও কুণ্ঠাবোধ করে না। পাপাচার ও মদের বিস্ময়কর কার্যকারিতা হলো এসব মানুষের আত্মশক্তিকে নিঃশেষ করে দেয়। অমুসলিমরা শত শত বছর আগে মুসলমানদের বিভ্রান্ত করতে যে স্বপ্নময় পাপাচারের দ্বারা আকৃষ্ট করতো, কৌশলের ধরন পরিবর্তন হলেও আজও সেই প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।

ইসলাম একটি আদর্শ, সৎ চরিত্রের ভিত্তিতে রচিত হয়েছে ইসলামের ভিত্তি। কিন্তু ইসলামের শত্রুরা মুসলমানদের পদানত করার জন্য পাপাচারের মনোহরি দিকটাকেই ব্যবহার করে। পাপাচারের মধ্যে এমন দুর্বিনীত আকর্ষণ রয়েছে যে, তা মানুষের দুর্বলতাগুলো উস্কে দেয় এবং আত্মশক্তিকে দুর্বল করে ফেলে। মুসলমানদের দুর্বলতা ও মূল শক্তির উৎসকে অগ্নিপূজারী পৌত্তলিক ও ইহুদীবাদীরা চিহ্নিত করে এগুলো নিঃশেষ করার নব নব কৌশল উদ্ভাবন করছে।

ইহুদীরা মুসলিম মেধা ও শক্তিগুলোকে ধ্বংস করার জন্য তাদের সুন্দরী ললনাদের ব্যবহার করেছে। খৃস্টানরা মুসলিম তরুণদের বিভ্রান্ত করতে আজও তাদের সুন্দরী কন্যা-জায়াদের ব্যবহার করে। মুসলিম তরুণদেরকে আজও চক্রান্তকারী ইহুদী-খৃস্টান-পৌত্তলিকরা মদের নেশা, নারী আর ধন-সম্পদের টোপ দিয়ে আদর্শচ্যুত করছে। ওদের মনোলাভা ফাঁদে পড়ে মুসলিম মিল্লাতের বহু বাঘা বাঘা সমাজপতিও ধ্বংস হয়ে গেছে।

বুগরা খান ও আলাসতুগীনের দেমাগ দুই রূপসী শরাব খাইয়ে আগেই কজা করে নিয়েছিলো। ওরা আক্ষরিক অর্থেই নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলো। উভয়েই আত্মশক্তি ও বোধ হারিয়ে ফেলেছিলো। যোগী সন্ন্যাসীদের জাদুকরী তৎপরতা আজও বহাল রয়েছে। জাদুকরী প্রভাব প্রয়োগ করে এরা লাঠিকেও সাপে পরিণত করতে পারে। সমবেত বহুজনকে জাদু করে এরা বিভ্রান্ত করতে পারে। এখন তো জাদু একটি শিল্প হিসেবে সারা দুনিয়া জুড়ে আদৃত।

এই জাদুকরদের নিয়ে আসার জন্য দু’আমলাকে এখানে রেখে তারা অজ্ঞাত স্থানে চলে গিয়েছিলো। শুরুতে পুরোহিত তরুণীদের অভিভাবক হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করে। তরুণী দুজন বুগরা খান ও আলাসতুগীনকে তাদের সাথে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলে উভয়েই তা প্রত্যাখ্যান করলো। এরপরই এদেরকে জাদু করে অন্ধভক্তে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নেয় পুরোহিত। মদ ও নারীর প্রভাব আগেই তাদেরকে আদর্শচ্যুত করে ফেলেছিল, বাকিটা যোগী এসে জাদু প্রয়োগ করে পূর্ণ করলো।

ভোরের আলো বিকশিত হওয়ার আগেই রওয়ানা হয়ে যাওয়া এই কাফেলা নগরকোট থেকে বহু দূরে চলে গিয়েছিলো। বুগরা খান ও আলাসতুগীন ঘোড়ার পিঠে আর অন্যরা উটের পিঠে আরোহণ করেছে। হিন্দু পুরোহিত ও তার দুই আমলা সঙ্গীসহ জাদুকরও কাফেলার সহযাত্রী। বুগরা খান ও আলাসতুগীন রাজপুত্রের মতো মাথা উঁচু করে রাজকীয় চালে অশ্বের উপর উপবিষ্ট। ওরা তো

আনন্দে আত্মহারা আর যারা ওদেরকে জাদুকরী প্রভাবে গোলামে পরিণত করেছে, ওদের মুখে হাসি নেই; ওরা কার্য সিদ্ধি চূড়ান্ত করণের চিন্তায় মগ্ন।

কাফেলা চলতে চলতে মাঝে-মধ্যে পথে থামতে, আবার চলতো। আর বিশ্রামের সুযোগে বুগরা খান ও আলাসতুগীনকে পানীয় ও খাবারে নেশাদ্রব্য খাওয়ানো অব্যাহত রাখলো। ধীরে ধীরে এরা নিজেদের ধর্ম-দেশ ও আদর্শ ভুলে অন্ধকারে তলিয়ে যেতে লাগলো।

এক সময় কাফেলা থানেশ্বর পৌঁছলো। সেই যুগে থানেশ্বর মন্দির ছিলো ভারতের বিখ্যাত মন্দিরগুলোর শীর্ষ দুটির একটি। হিন্দুরা থানেশ্বর মন্দিরকে মুসলমানদের কাবার মতোই সম্মান করতো। থানেশ্বর মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের জানা ছিলো, গজনী বাহিনীর দু’কমান্ডারকে নেশাগ্রস্ত করে থানেশ্বর নিয়ে আসা হচ্ছে। এদের হাতে মাহমূদ গযনবীকে হত্যা করানো হবে। কেননা, নিজ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি ছাড়া কারো পক্ষে সুলতান মাহমূদের ধারে-কাছে যাওয়া সম্ভব নয়।

বুগরা খান ও আলাসতুগীনের জন্য মন্দিরের পাতালপুরীতে দুটি কক্ষ সাজানো হলো। কক্ষ দুটিকে রাজমহলের আদলে খুশবো ও বাহারী আসবাবপত্রে সাজানো হলো। তুলতুলে নরম বিছানার উপর গেলাফ বিছানো হলো। ছাদে ঝুলিয়ে দেয়া হলো রঙিন ফানুস। দুই কমান্ডার সেখানে পৌঁছলে তাদেরকে রাজকীয় অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করা হলো। অভ্যর্থনাকারীরা তাদের গমন পথে মাথা অবনত করে কুর্নিশ করলো। তাদের সাজানো কক্ষে পৌঁছে দেয়ার সাথে সাথেই কিছু মহিলা সেবার জন্য এসে উপস্থিত হলো। কিন্তু এরা তরুণী নয়, বয়স্ক মহিলা।

কাফেলা থানেশ্বর পৌঁছার পরই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত হিন্দুদের আলাদা করে তাদের জানালো, সুলতান মাহমুদ গজনী চলে গেছে। সামান্য কিছু সংখ্যক সৈন্য নগরকোট রেখে গেছে। এটা জানা সম্ভব হয়নি, তাড়াতাড়ি সে ফিরে আসবে নাকি দীর্ঘ সময় সেখানে থাকবে। এমতাবস্থায় এদেরকে এখানে রাখার মধ্যে কোন লাভ আছে বলে মনে হয় না।

“সুলতান অবশ্যই আসবে পণ্ডিত মহারাজ!” বললো দুই আমলা। “এই দুই লোক আমাদের হাতে এসে গেছে। এদেরকে আমরা নিজেদের মতো করে তৈরি করতে পারবো। এরা আমাদের উপকারে আসবে। এদের দিয়েই আমরা মাহমূদকে খুন করাতে পারবো।”

দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর হিন্দু পুরোহিত ও সন্ন্যাসী জাদুকর ও আমলাদ্বয় এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, বুগরাখান ও আলাসতুগীনকে থানেশ্বর মন্দিরেই রাখা হবে এবং এদের দিয়ে সুলতান মাহমুদকে হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।

সুলতান মাহমূদ জরুরী খবর পেয়ে গজনী চলে এলেন। গজনীর পশ্চিমে গৌড় নামের একটি পাহাড়ী এলাকা শাসন করতো মুহাম্মদ বিন সূরী। মুহাম্মদ বিন সূরী সুলতান মাহমূদকে হিন্দুস্তানে ব্যস্ত দেখে দশ হাজার সদস্যের এক সৈন্য বাহিনী নিয়ে গজনীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এসে তাঁবু গাড়লেন। তাঁবুর চারপাশে পরিখাও খনন করলেন তিনি। তাছাড়া তার তাবুর তিনদিকেই ছিলো উঁচু পাহাড়। শুধু একদিকে পরিখা ও পাহাড় ছিলো না। চতুর্দিকে প্রাকৃতিক পাহাড়ী প্রতিরক্ষার কারণে মুহাম্মদ সূরীর তাবুটি দুর্গের মতো সুরক্ষিত প্রমাণিত হলো। ফলে তাবু থেকে কিছু সংখ্যক সৈন্য বেরিয়ে গজনী বাহিনীর উপর ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে দ্রুতগতিতে তাঁবুতে ফিরে যেতো। এভাবে তারা গজনী বাহিনীর চৌকিগুলোতে একের পর এক আক্রমণ করে বিপর্যস্ত করে তুলে।

দুদিন গজনী সেনাদের দুটি দল আক্রমণকারীদের তাড়া করে তাঁবু পর্যন্ত নিয়ে গেল কিন্তু তাঁবুর চতুর্দিকে পরিখা থাকায় আর সামনে অগ্রসর হতে পারলো না। যে পথটা ছিলো সেদিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করতেই সেখানে থাকা তীরন্দাজরা তাদের উপর তীরবৃষ্টি বর্ষণ করলো। কিছুক্ষণ তীর নিক্ষেপের জবাবে তীর নিক্ষেপ করে ফিরে আসা ছাড়া কোন উপায় ছিলো না। গজনীর সৈন্যরা পেরেশান হয়ে গেলো সূরীদের আক্রমণে। সূরী বাহিনী গজনী বাহিনীর শক্তি ক্ষয় করে দুর্বল করার পর এক সময় আক্রমণ করে গজনী দখল করার চিন্তা করছিলো। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে গজনীর নিরাপত্তায় নিয়োজিত সেনাপতি সুলতানকে বিষয়টি অবহিত করা জরুরী মনে করলেন।

সূরীদের গজনী আক্রমণের সংবাদ সুলতান মাহমুদের কাছে যখন পৌঁছল, তখন তিনি নগরকোট মন্দির ও সেনা শিবির অবরোধ করেছেন মাত্র। গজনী আক্রান্তের খবর শুনে সুলতানের মাথায় বাজ পড়লো। তিনি নগরকোটে আক্রমণের নির্দেশ দিলেন। প্রচণ্ড আক্রমণের কারণে নগরকোট দুর্গবাসীরা প্রতিরোধে টিকতে না পেরে হাতিয়ার ফেলে আত্মসমর্পণ করলো। দ্রুত মন্দির থেকে সব মূর্তি ফেলে দিয়ে দুর্গ দখল শেষে সেনাবাহিনীকে দু’ভাগে ভাগ করে একটি অংশ নিজের সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য আলাদা করলেন আর একটি অংশ নগরকোট দুর্গের প্রশাসন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নিয়োগ করলেন।

এমনিতেই সুলতান মাহমূদের যাত্রা হতো অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে। কিন্তু সে দিনের মতো আর কখনো সুলতান মাহমূদকে এতোটা ক্ষুব্ধ দেখা যায়নি। অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে অস্বাভাবিক দ্রুততার সাথে সুলতান মাহমুদ গজনীতে পৌঁছে গেলেন। রাস্তায় তিনি সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন, আমাদের সফর হবে খুবই দ্রুত। তাই তোমরা চলাবস্থায়ই সওয়ারীগুলোকে ফসলের ক্ষেতের মধ্যদিয়ে ছেড়ে দিও। উট, ঘোড়া, হাতিগুলো যাতে চলতে চলতে কিছুটা খেয়ে নিতে পারে। আর পদাতিক সৈন্যদেরকে তিনি বলে দিয়েছিলেন, তোমরা পথিমধ্যে কোন বসতি পেলে তাদেরকে খাবার দিতে নির্দেশ দিবে।

সুলতান মাহমূদ যুদ্ধ করতেন প্রতিপক্ষের সৈন্যদের সাথে। শাসকরাই হতে তার প্রতিপক্ষ। সাধারণ নাগরিকদের জন্য তিনি কখনো কষ্টের কারণ হননি। বরং তার সৈন্যরা বেসামরিক নাগরিকদের জান-মালের নিরাপত্তা দিয়েছে। কিন্তু এবার তিনি গজনী আক্রান্তের কথা শুনে স্বজাতি গাদ্দার ও পরাজিত আনন্দ পালের মৈত্রী চুক্তিবিরোধী তৎপরতায় চরম ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছিলেন। দ্রুত গজনী পৌঁছানোর জন্য তার সৈন্য ও সওয়ারদের এর বিকল্প ছিলো না।

সূরীদের ধারণার চেয়ে অনেক আগে সুলতান মাহমুদ গজনী পৌঁছে গেলেন। গজনী পৌঁছেই তিনি মুহাম্মদ বিন সূরীকে দূতের মাধ্যমে এই বলে পয়গাম পাঠালেন যে, “জাতির গাদ্দারদের পরিণতি কখনো ভালো হয় না। ইসলামী সালতানাতকে টুকরো টুকরো করে শাসনকারী ক্ষমতালিন্দুদের পায়ের তলা থেকে শুধু ক্ষমতার মসনুদই দূরে সরে যায় না, মাটিও থাকে না। জাতিকে প্রতারিত করে স্বজাতির মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে লিপ্তকারীদের শাস্তি দুনিয়াতেই ভোগ করতে হয়। সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে হাতে কুরআন নিয়ে অঙ্গীকারকারী শাসকদের রাজমহলই এক সময় জাহান্নামে পরিণত হয়।… নিজের আখেরাত ও জাগতিক মঙ্গল চাইলে শক্রতা না করে আমাকে সহযোগিতা করো। চলো আমার সাথে হিন্দুস্তানে। সেখানে মুহাম্মদ বিন কাসিমের আযাদ করা মুসলিম বসতিগুলো এখন মূর্তি পূজারীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। চলো সেখানে গিয়ে পরিত্যক্ত বিরান মসজিদগুলোকে আবাদ করি এবং বিভ্রান্ত মুসলমান ও হিন্দুদেরকে সিরাতে মুস্তাকিমের পথ দেখাই।… আমি তোমাদের কাছে আবেদন করছি না। বেঈমানী ও ঈমানের সওদাগরী তোমাকে যেদিকে ঠেলে দিচ্ছে, আমি এর অশুভ পরিণতি দেখতে পেয়ে তোমাকে সতর্ক করছি। ক্ষমতার মোহ তোমাদের এমন আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করবে যে, কেয়ামত পর্যন্ত মানুষ তোমাদের নামে অভিশাপ বর্ষণ করবে। আমি তোমাকে দুদিনের অবকাশ দিচ্ছি। আমার সহযোগী হতে চাইলে এসো। নয়তো সৈন্যদের নিয়ে গজনী ছেড়ে চলে যাও।”

সুলতানের দূত যখন মুহাম্মদ বিন সূরীর কাছে পয়গাম নিয়ে গেলো, সূরী রাজকীয় ভঙ্গীতে দূতের কাছ থেকে পয়গাম নিয়ে বললেন, “মৈত্রী চুক্তির জন্য পয়গাম নিয়ে এসেছো?” সূরীর প্রশ্নে দূত নীরব রইলো।

এক নিঃশ্বাসে মুহাম্মদ বিন সূরী সুলতানের পয়গাম পড়ে অট্টহাসিতে ভেঙ্গে পড়ে বললো, “তোমাদের সুলতান কি আমাকেও আনন্দপ লি আর বিজি রায় মনে করেছে! যাও, ওই ভূতটাকে বলো, মুহাম্মদ বিন সূরী তোমার কথায় রাজি নয়। যদি সাহস থাকে তাহলে তুমি এসো। আমরা ফিরে যাওয়ার জন্য এখানে আসিনি।”

মুহাম্মদ বিন সূরী এক পর্যায়ে হুংকার দিয়ে দূতকে বললো, “যাও! ওই গোলামের পুত্র গোলামকে বলল, সে যেনো তাড়াতাড়ি এখানে এসে আমার সাথে দেখা করে এবং আসার সময় গজনী সালতানাতকেও যেন একটি পাত্রে করে নিয়ে আসে।”

সূরীদের কাছ থেকে সুলতান মাহমূদ এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করেননি। যুদ্ধ জয়ের চেয়ে এরা বেশি পারদর্শী ছিলো লুটতরাজে। সুলতান মাহমূদের পিতা সুলতান সুবক্তগীনের শাসনামলেও গোরীরা গজনীর আশপাশের এলাকায় লুটতরাজ করতো। এ পর্যায়ে সুলতান মাহমূদ এদেরকে চূড়ান্ত শিক্ষা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এর আগে কোনদিন গোরীরা গজনীর আশপাশে এসে সৈন্য সমাবেশ করার সাহস করেনি। এবারই প্রথম মুহাম্মদ বিন সূরী দশ হাজার গোরী সৈন্য নিয়ে গজনীর পার্শ্ববর্তী ময়দানে তাবু গাড়লো । সুলতান মাহমূদ তার দুই সেনাপতি জেনারেল আলতুনতাস ও জেনারেল আরসালান জাযেবকে বললেন, আমি গোরী শাসকদেরকে চূড়ান্ত শিক্ষা দিতে চাই। আপনারা এ জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি নিন।

সুলতান মাহমূদ বেশভূষা বদল করে সূরীদের ক্যাম্প পর্যবেক্ষণ করার জন্য বেরিয়ে পড়লেন। তিনি সূরীদের ক্যাম্প নির্মাণের কৌশল ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেখে মনে মনে ওদের প্রশংসা করলেন। সেই সাথে ওদের শিবিরকে কবরস্তানে পরিণত করার বিষয়টিও ভাবতে লাগলেন। কিন্তু সূরীদের শিবির উজাড় করার বিষয়টি তার দৃষ্টিতে মোটেও সহজসাধ্য মনে হচ্ছিলো না।

অনুরূপ একটা শিবির সুলতান খিদরী নামক স্থানে স্থাপন করেছিলেন। সে সময় শত্রুবাহিনী তাদের উপর আক্রমণ করে বটে কিন্তু তাদের কিছুই ক্ষতি করতে পারেনি বরং শত্রুবাহিনীই নাস্তানাবুদ হয়। সূরীদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ এবং শিবির স্থাপন কৌশল দেখে সুলতান চিন্তান্বিত হলেন। তিনি পর্যবেক্ষণ শেষে শিবিরে পৌঁছে সেনাধ্যক্ষদের বললেন, শত্রুবাহিনী মজবুত প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে শিবির স্থাপন করেছে, ওদেরকে শিবির থেকে বের করে আনা সহজ হবে না।

সারারাত চললো সামরিক কৌশল নিয়ে চিন্তা-ভাবনা। অবশেষে শেষরাতের মধ্যেই সৈন্যদের যাত্রা শুরুর নির্দেশ দিলেন তিনি। সৈন্যদেরকে শত্রু শিবির থেকে কিছুটা দূরে পূর্ণ রণপ্রস্তুতিতে থাকার নির্দেশ দিলেন। সকাল বেলা তিনিও গিয়ে সৈন্যদের সাথে যোগ দিলেন। সেখানে পৌঁছার সাথে সাথেই আক্রমণের হুকুম দিনে সুলতান। কিন্তু সূরী সৈন্যরা সুলতানের বাহিনীকে ওদের ক্যাম্পের ধারে কাছে যেতেও দিলো না। শেষ পর্যন্ত যে অংশে পরিখা নেই সেই অংশে একযোগে হামলে পড়ার নির্দেশ দিলেন। সূরীর সৈন্যরা ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হলো। তারা সুলতান মাহমূদের সৈন্যদের নাজেহাল করতে লাগলো।

সূরীরা ছিলো সুবিধা মতো স্থানে। তারা শিবির থেকে বেরিয়ে এসে সংঘর্ষে লিপ্ত হতো। কঠোর আক্রমণের মুখে পিছু চলে যেতো। মুখোমুখি ছাড়া আর কোন দিক থেকে তাদের উপর আক্রমণ করা সম্ভব ছিলো না। কারণ, তাদের শিবিরটি ছিলো তিনদিকে পাহাড় বেষ্টিত, সেই সাথে তাদের শিবিরগুলো পরিখা দিয়ে সুরক্ষিত।

দিনের প্রথম প্রহরে সহযোদ্ধা দুই জেনারেলকে নতুন একটি চালের কথা বললেন সুলতান। সেই কৌশল মতো যুদ্ধের কায়া বদলে ফেললেন। সুলতান নিজেও সেনাদলের মধ্যভাগে আক্রমণে শরীক হলেন। মুহাম্মদ বিন সূরী সুলতানকে এগিয়ে আসতে দেখে তার আক্রমণ প্রতিহত করতে আরো দুটি ইউনিটকে শিবিরের বাইরে গিয়ে আক্রমণ করতে নির্দেশ দিলো। তখন পর্যন্ত সূরীরা প্রাধান্য বজায় রেখেছিলো আর সুলতানের বাহিনী ছিলো অনেকটা চাপের সম্মুখীন।

তুমুল সংঘর্ষ বেঁধে গেলো গজনী ও সূরী বাহিনীর মধ্যে। এক পর্যায়ে সুলতান ধীরে ধীরে পিছু হটতে লাগলেন। হঠাৎ তিনি এমন নির্দেশ দিলেন যে, তার সৈন্যদেরকেও এ নির্দেশ হতবাক করলো। হঠাৎ তিনি নিজেই চিৎকার দিয়ে বললেন, “বন্ধুরা সবাই পালাও, সূরীরা নয়তো কাউকে জীবিত রাখবে না।” এ কথা বলে তিনি নিজেও ঘোড়া ঘুরিয়ে পিছু ছুটলেন। তার সারি থেকে আরো কয়েকজনের কণ্ঠে এ ধরনের আহ্বান শোনা গেলো।

সূরীদের কানেও গেলো এই আওয়াজ। মুহাম্মদ বিন সূরী সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিলো। অবস্থাদৃষ্টে সে গজনী বাহিনীর পশ্চাদ্ধাবন করার নির্দেশ দিলো । বললো, ওদের কাউকেই গজনী ফিরে যেতে দিও না। মাহমূদকে আমার সামনে জীবিত ধরে আনন, আর গজনীর প্রতিটি ইট খুলে ফেলো।

বিজয়ের আতিশয্যে সকল সূরী সৈন্য শিবির থেকে বেরিয়ে পড়লো। শিবির হয়ে পড়লো সৈন্যশূন্য। প্রায় মাইল তিনেক দূরে গিয়ে সুলতান মাহমূদ পিছুহটা মুলতবী করে পূর্ব নির্দেশ মতো পলায়নপর সৈন্যদেরকে পশ্চাদপসরণ না করে ঘুরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিলেন। সুলতানের সকল কমান্ডারের জানা ছিলো, এই পশ্চাদপসারণ সুলতানের একটা রণচাল। সুলতান ঘুরে দাঁড়িয়েই তাকে ধাওয়াকারী সূরী সৈন্যদের উপর বজ্র আক্রোশে হামলে পড়লেন। শুরু হলো তুমুল মোকাবেলা। এদিকে জেনারেল আরসালান এই সুযোগের অপেক্ষায়ই ছিলেন। তিনি পেছন ঘুরে সূরীদের একপাশে আক্রমণ করলেন, আর অপরজন সূরীদের শিবিরে প্রবেশের পথ বন্ধ করে দিলেন। ঐতিহাসিকগণ লিখেন, রণকৌশলে অনভিজ্ঞ সূরী বাহিনী সুলতানের দূরদর্শী ফাঁদে আটকে যায়। বস্তুত এবার গজনী বাহিনীর হাতে সূরী বাহিনী কচুকাটা হতে লাগলো।

সেদিনের সূর্য ডোবার আগেই সূরীদের সূর্য চিরদিনের জন্য ডুবে গেলো। মুহাম্মদ বিন সূরী পালানোর অবকাশ পেলো না। একটি খাদের আড়াল থেকে দু’জন অনুচরসহ মুহাম্মদ বিন সূরীকে পাকড়াও করে সুলতানের সামনে হাজির করা হলো।

মুহাম্মদ! মাত্র একদিন আগে আমি তোমাকে যা লিখেছিলাম, তা আজ বাস্তবে প্রতিফলিত হয়েছে। তোমাকে পরাজিত করে আমি মোটেও উফুল্ল নই। এই লড়াইয়ে যে রক্তক্ষয় হয়েছে সেই রক্ত অন্য কাজে ব্যবহার করা উচিত ছিলো। আল্লাহর এই বিষয়টা আমি বুঝতে পারি না, শাসকের পাপের প্রায়শ্চিত্ত নিরপরাধ নাগরিকদের কেন ভোগ করতে হয়!

সুলতান মাহমূদ বলছিলেন আর এদিকে মুহাম্মদ বিন সূরীর শরীর নীচের দিকে ঝুঁকে পড়ছিলো। প্রথমে তার মাথা হাঁটুর ফাঁকে ঝুঁকে পড়লো। এরপর গড়িয়ে পড়লো মেঝেতে এবং একটা কাঁপুনী দিয়ে শরীরটা নিথর হয়ে গেলো। প্রহরীরা তাকে ধরে উঠাতে গেলো। দেখা গেলো, তার চোখ উল্টে গেছে এবং তার শরীর থেকে প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে।

মুহাম্মদ বিন সূরীর সাথে তার যে দু’জন অনুচর ছিলো তারা জানালো, সূরীর হাতের আংটিতে একটি বিষাক্ত হীরা ছিলো। পরাজয় ও পাকড়াও অনিবার্য হয়ে পড়ায় সে আংটির হীরাটি খুলে গিলে ফেলে। ঠিক সেই সময়ই সৈন্যরা আমাদের পাকড়াও করে এখানে নিয়ে আসে।

১০১০ খৃস্টাব্দ মোতাবেক ৮০১ হিজরী সনের গ্রীষ্মকালে সংঘটিত হয়েছিলো এই যুদ্ধ।

হিন্দুস্তান থেকে গজনী ফিরে আসার মধ্যে ছয়-সাত মাস কেটে গেছে। এর মধ্যে সুলতান মাহমূদের কাছে খবর আসতে লাগলো, দিল্লী থেকে ত্রিশ-চল্লিশ মাইল দূরে থানেশ্বরে একটি বিশাল মন্দির রয়েছে। সেখানে নানা ধরনের মূর্তি রয়েছে। বিশেষ করে বিষ্ণু দেবতার মূর্তিকে মানুষ আদমের চেয়েও বেশি পুরনো মনে করে। সেটির বেদীতে পূজা দেয়ার জন্য বহু দূর থেকে পূজারীরা আসে এবং বিষ্ণুকে পূজা দিতে পারলে হিন্দুরা মুসলমানদের কাবা জিয়ারতের মতো পুণ্যলাভ করে বলে সুখানুভব করে।

পৌত্তলিকতা বিরোধী আকীদা ও বিশ্বাসের কারণেই সুলতান মাহমূদ সকল মূর্তি ধ্বংসের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেই সাথে তার গোয়েন্দারা তার কাছে রীতিমতো খবর পাঠাচ্ছিলো যে, নগরকোট ও খিদরের যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের পর হিন্দুরা হতোদ্যম হয়ে পড়েছে। চোখের সামনে তাদের দেব-দেবীদের এহেন দুর্গতি ও ধ্বংসের পরও মুসলমানদের কোন ক্ষতি না হওয়ায় অনেকেই হতাশ। সেই সাথে মুসলিম সৈন্যরা তাদের সামনে অসংখ্য গরুকে জবাই করে খেয়ে ফেলে। যে গরুকে হিন্দুরা গো-মাতা বা গো-দেবতা হিসেবে পূজা করে এবং তারা গরুর গোশত খাওয়া হারাম মনে করে।

সুলতানের সৈন্যরা তার কাছে খবর পাঠাতে লাগলো, গোটা হিন্দুস্তানের সৈন্যবাহিনীর মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। গোটা জাতিই ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থা এমনই ভয়াবহ যে, আকাশের গর্জন শুনেও এরা মূর্তির সামনে হাত জোড় করে কান্নাকাটি শুরু করে দেয় নিরাপত্তা কামনা করে। এই পরিস্থিতিটা সুলতান মাহমূদের সহায়ক ছিলো। সূরীকে চিরদিনের জন্য নিঃশেষ করে দীর্ঘ বিশ্রাম না নিয়েই তিনি পেশোয়ারের দিকে অভিযানের নির্দেশ দিলেন। পেশোয়ার পৌঁছেই তিনি বেরা ও নগরকোটে দু’জন পয়গাম বাহক আর দূতকে পাঠালেন। নগরকোটের সৈন্যদের বলা হলো সম্পূর্ণ রণপ্রস্তুতি নিয়ে রাখতে। কারণ, সুলতান থানেশ্বর অভিযান চালাতে আসছেন।

বিশেষ দূতকে রাজা আনন্দ পালের রাজধানী পাঞ্জাবে পাঠানো হলো এই সংবাদ দিয়ে যে, সুলতানের বাহিনী পাঞ্জাবের মধ্যদিয়ে অতিক্রম করবে। চুক্তি অনুযায়ী রাজা আনন্দ পালের কর্তব্য হলো, সুলতানের বাহিনীর নিরাপদে পথ অতিক্রম করার ব্যবস্থা করা। তাদের গমন পথে যেনো কেউ বাধা বিপত্তি সৃষ্টি না করে। সেই সাথে আনন্দ পাল অন্যান্য হিন্দুরাজ্যের সৈন্য একত্রিত করে যেনো মৈত্রী বাহিনী গঠনের চেষ্টা না করে। আনন্দ পাল এ ধরনের কিছু করলে বোঝা যাবে রাজা চুক্তি ভেঙ্গে দিয়েছেন। তাহলে সুলতানের কর্তব্য হয়ে পড়বে বাটান্ডা ও পাঞ্জাবে অভিযান চালিয়ে লাহোর ও পাঞ্জাবের দ্বিতীয় রাজধানী বাটান্ডার প্রতিটি ইট খুলে ফেলা।

রাজা আনন্দ পাল তার এক ভাইয়ের নেতৃত্বে দু’হাজার অশ্বারোহী সৈন্য সজ্জিত একটি বাহিনীকে পাঠায় সুলতান মাহমূদকে অভ্যর্থনার জন্য। সেই সাথে দলনেতার কাছে এই পয়গাম লিখে পাঠালো যে, এ আমার ভাই এবং দূত। একে আপনার কাছে এই অনুরোধসহ পাঠাচ্ছি যে, “থানেশ্বর আমাদের একটি পবিত্র মন্দির ও বড় পুণ্যস্থান। আপনার ধর্ম যদি আপনাকে অন্যদের ধর্মালয় ধ্বংসের নির্দেশ দিয়ে থাকে, তবে নগরকোট ধ্বংস করে আপনি সেই দায়িত্ব পালন করেছেন। আমি আপনাকে অনুরোধ করছি, থানেশ্বরের ব্যাপারে আপনার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করুন। এর পরিবর্তে আপনাকে আমি প্রতি বছর খাজনা দেবো। তাছাড়া আপনার বাহিনীর থানেশ্বর আসা-যাওয়ায় যতো খরচ হতো সবই আমি অগ্রিম দিয়ে দেবো। এর বাইরেও আমি আপনাকে পঞ্চাশটি হাতি ও মূল্যবান মণিমুক্তা উপঢৌকন দেব।”

ঐতিহাসিক ফারিতা লিখেন, সুলতান মাহমূদ আনন্দ পালের প্রস্তাবে লিখেন- “আল্লাহ ও রাসূলের পক্ষ থেকে আমার প্রতি নির্দেশ হলো, যেখানেই মূর্তিপূজা হয় সেখানে যাও এবং মূর্তি ধ্বংস করে দাও। এক্ষেত্রে আমার রাসূলের দৃষ্টিভঙ্গী হলো, মূর্তি ভাঙ্গার প্রতিদান আখেরাতে আল্লাহ দেবেন। মূর্তি না ভাঙ্গার অঙ্গীকার করে আপনার কাছ থেকে আমার পক্ষে কোন উপঢৌকন নেয়া সম্ভব নয়। থানেশ্বর মন্দিরের মূর্তিগুলো ধ্বংস না করার পক্ষে আমার কাছে কোন যৌক্তিক কারণ নেই।”

রাজা আনন্দ পাল যখন মণি-মুক্তা ও খিরাজের লোভ দেখিয়েও থানেশ্বর আক্রমণ থেকে সুলতান মাহমূদকে নিবৃত করতে পারলো না, তখন দিল্লী, আজমীর, কনৌজেও রাজা-মহারাজাদের কাছে এই বলে দূত পাঠালো যে, গজনীর সুলতান বিনা উস্কানিতে থানেশ্বর মন্দির আক্রমণের জন্য ভারতের সীমানায় প্রবেশ করেছে। বানেশ্বরের বিষ্ণু মন্দির ধ্বংস করাই তার এবারের আক্রমণের উদ্দেশ্য।

***

এদিকে থানেশ্বরে সুলতান মাহমূদ গযনবীকে হত্যার সব ব্যবস্থা পাকাঁপোক্ত হয়ে গেছে। ১০১১ খৃস্টাব্দ মোতাবেক ৮০৬ হিজরী সন। সুলতান নগরকোট থেকে গজনী ফিরে যাওয়ার এখনও বছর পূর্ণ হয়নি। এতো দিনের মধ্যে তার দু’কমান্ডার বুগরা খান ও আলাসতুগীন রাজধানীতে ফিরে না আসায় তাদের পরিবারে সংবাদ দেয়া হলো, তাদের নিহত হওয়ার কোন প্রমাণ সেনাবাহিনীর হাতে নেই। সম্ভবত তারা হিন্দুদের হাতে বন্দী রয়েছে।

ওরা তো আসলে হিন্দুদের বন্দী ছিলো না। ছিলো শাহজাদা হিসেবে। জাদুটোনা ও নেশাগ্রস্ত করে এদেরকে থানেশ্বর মন্দিরে এনে দুটি রাজকীয় আসবাবপত্রে সাজানো কক্ষে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের সেবার জন্য দেয়া হয়েছে উদ্ভিন্ন যৌবনা সেবিকা।

বুগরা খানের পায়ের যখম ঠিক হয়ে গিয়েছিলো। সে এখন রীতিমতো হাঁটা-চলা ও সওয়ার হতে পারছে। বুগরা খান স্থানীয় হিন্দুদের ভাষা জানতো। এ জন্য সে-ই তাদের মেজবানের সাথে কথাবার্তা বলতো। দুই বন্ধু মিলে আড্ডা দিয়ে গল্পগুজব করে আর মদ ও নারীর মদির নেশায় সময় কাটিয়ে দিতো।

যে দুই তরুণী ওদের দুজনকে পথ ভুলিয়ে প্রেমের ছলনা ও নেশাদ্রব্য খাইয়ে থানেশ্বর মন্দিরে নিয়ে আসে, ওদের থানেশ্বর পৌঁছে দিয়ে এই তরুণীদ্বয় ওদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলো। কয়েকদিন ওদের জায়গায় নতুন তরুণীদের দেখে অবশেষে বুগরা খানকে তার বন্ধু আলাসতুগীন বললো, ওদের জিজ্ঞেস করো, আগের সেই তরুণীরা কোথায়। ওদের না পেলে আমি এখানে থাকবো না, আমাদের সেনাবাহিনীতে ফিরে যাবো।

যে জাদুকর দরবেশের বেশ ধারণ করে বুগরা খান ও আলাসতুগীনকে বিভ্রান্ত করে থানেশ্বর নিয়ে এসেছিলো, একদিন বুগরা খান তাকে জিজ্ঞেস করলো, আমাদেরকে যে দুটি মেয়ে আগে সেবাযত্ন করতো তারা কোথায়?

“তোমরা কি দেবীদেরকে তোমাদের মনোরঞ্জনের জন্য পেতে চাও। তারা তো মানুষ ছিলো না। তোমরা যেহেতু নগরকোট মন্দিরের মূর্তি ভাঙ্গায় শরীক ছিলে না, এ জন্য দেবীরা তোমাদের অসহায়ত্বের সময় মানুষের রূপ ধারণ করে তোমাদের সেবা করেছেন।

মানুষের মতোই তোমাদের সাথে ব্যবহার করেছেন।… তোমরা যখন তাদের ভালোবাসা চেয়েছে, তারা তোমাদেরকে প্রেম দিয়েছেন। কিন্তু তোমাদেরকে অসৎ উদ্দেশ্য থেকে বিরত রেখেছেন। তোমরা যখন তাদের কাছে অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার কথা বলেছে, তখন তারা হাসি-তামাশা করে তা এড়িয়ে গেছেন। তারাই আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, তোমাদেরকে যেমন সেনাবাহিনী থেকে বের করে এনে হত্যা, খুনাখুনি ও যুদ্ধবিগ্রহ থেকে আলাদা করে রাজকীয়ভাবে সেবাযত্ন করা হয়।”

“আরে না, তোমার কথা ঠিক নয়। ওরা ঠিকই মানুষ ছিলো” দৃঢ়তার সাথে বললো বুগরা খান।

বুগরা খানের চোখে চোখ রেখে জাদুকর সন্ন্যাসী বললো, “না, তারা মানুষ ছিলেন না। তোমরা তাদের ভক্ত। তোমাদের হৃদয় তাদের প্রেমে পাগল।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি তাদের ভক্ত। তাদের পূজারী।… আমার হৃদয় তাদের হৃদয়ের পিঞ্জিরায় আটকানো।” উচ্ছ্বসিতকণ্ঠে বলতে লাগলো বুগরা খান।

ততদিনে বুগরা খানের দেমাগ সন্ন্যাসী জাদুকর সম্পূর্ণই বদলে দিয়েছে। বুগরা খানের স্বাভাবিক বিবেকবোধ চাপা পড়ে গিয়েছিলো। এখন জাদুকর যা বলতো এবং যা ভাবতো, বুগরা খান তাই সত্য ভাবতো। শুধু বুগরা খান নয়, আলাসতুগীনও বুগরা খানের মতোই জাদুকরী প্রভাব ও মদের ক্রিয়ায় সম্পূর্ণ অন্য মানুষে রূপান্তরিত হয়েছিলো।

বুগরা খান ও আলাসতুগীনকে মন্দিরে রাজার হালে প্রতিপালন করা হচ্ছিলো। তারা যখন বাইরে বের হতো, তখন সাধারণ হিন্দুরা তাদের দেখে মাথা নীচু করে তাদের কুর্নিশ করতো। এতে এরা নিজেদেরকে রাজা রাজা ভাবতো। টানা দু’তিন মাস এদের উপর চললো জাদুকর ও সন্ন্যাসীদের কারসাজি। এক পর্যায়ে যখন সন্ন্যাসীরা বুঝলো যে, এদের নিজস্ব বিবেক বোধ আর অবশিষ্ট নেই, নিজেদের মতো করে কোনকিছু ভাবার মতো বুদ্ধি এদের লোপ পেয়েছে, তখন তাদেরকে একদিন বলা হলো, দেবীরা তাদেরকে ডেকেছে। দেবীর ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য এদেরকে থানেশ্বর মন্দির সংলগ্ন বাগানে নিয়ে গেলো পুরোহিতরা। রাতের অন্ধকারে বাগানের দৃশ্য ছিলো মনোরম। তাদেরকে একটি রাজকীয় মসনদে বসানো হলো। তাদের আসনের চারপাশে জ্বালানো হলো রঙ-বেরঙের ঝাড় বাতি। তাদের বসার জায়গা থেকে পনের-বিশ হাত দূরে দু’টি কাপড়ের গালিচা বিছিয়ে দেয়া হলো। রঙিন বাতির আলোয় গালিচাগুলো তারার মতো ঝলমল করছিলো।

এদিকে ধীরে ধীরে সেতারের বাজনা শুরু হলো। সেই সাথে ভেসে এলো বাঁশির সুর। বাঁশি ও সেতারের মিলিত আওয়াজে রাতের পরিবেশটা হয়ে উঠলো স্বপ্নিল। স্বপ্নিল সুরের মূর্ঘনার মধ্যে হঠাৎ সামনে চলে এলো সেই দুই তরুণী। কেউ বলতেই পারলো না এরা কী ফুলেল কাপড়ের আড়াল থেকে বের হয়েছে, না ফুলের ভেতর থেকেই প্রকাশ পেয়েছে। এদের পরনে এমন পাতলা সূক্ষ্ম কাপড় যে ওদের দেহবল্লরী উত্তেজনা সৃষ্টি করছে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিলো। তাদের মাথায় কোন ধরনের নিকাব ছিলো না। তাদের রেশমী চুলগুলো আলুথালুভাবে ঘাড়ের উপর ও বুকের উপর ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে ছিলো। রাতের স্নিগ্ধ সমীরণে উড়ন্ত রেমশী চুলগুলো গুদের রূপ-সৌন্দর্যকে আরো শতগুণে বাড়িয়ে দিয়েছিলো।

এরা দৃষ্টিগোচর হতেই সমবেত সকল হিন্দু দু’হাত জোড় করে প্রণাম করলো। বুগরা খান ও আলাসতুগীন হাত প্রসারিতও করেনি, প্রণামও করেনি। তারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওদের দিকে তাকিয়ে আত্মহারা হয়ে গেলো। তরুণীদ্বয় ধীরে ধীরে পায়চারি করতে লাগলো, তাদের পা যেনো মাটি থেকে উপরেই উঠছিলো না। সব মানুষ ওদের প্রণাম শেষে মাথা সোজা করে ওদের দিকে হাত প্রসারিত করে করজোড় নিবেদনের ভঙ্গিতে বসে রইলো। তরুণীরা ধীরে ধীরে রঙিন কাপড়ের আসন দুটিতে বসতেই তাদের অর্ধেক কাপড়ের আড়ালে চলে গেলো। দেখতে দেখতে তরুণীদ্বয় সেই আসনের মধ্যেই গায়েব হয়ে গেলো।

মন্দিরের প্রধান পুরোহিত তাদের উদ্দেশ্যে বললো, “যাও, কাপড়ের আসনে তাদের দেখো।”

বুগরা খান ও আলাসতুগীন আসনের দিকে অগ্রসর হয়ে চার-পাঁচ কদম থাকতেই দুটি কবুতর সেখান থেকে উড়ে চলে গেলো। তারা কাছে গিয়ে শূন্য গালিচা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলো না।

“এরা তো দেবী। শুধু তোমাদের জন্যই মানুষের রূপ ধারণ করে এসেছিলো।” বললো এক পুরোহিত। “তারা তোমাদের আশীর্বাদ দিয়েছে। আজ থেকে তোমরা আমাদের রাজা আর আমরা তোমাদের দাস মাত্র। তোমাদের আগের জীবনের কথা স্মরণ করো, কোথায় ছিলে তোমরা, কি ছিলো তোমাদের মর্যাদা ও সম্মান! আর আজ কোথায় এসেছে তোমরা। দেবীরা বলে গেছেন, তোমাদের সেবার জন্য তাদের মতোই দুই রূপসী সুন্দরী মানুষ তোমাদের কাছে পাঠাবেন।”

“এরা কি আমাদের সামনে দেখা দেবে?” জানতে চাইলো বুগরা খান।

“দেব-দেবীরা তো আর আমাদের ইচ্ছাধীন নন।” বললো প্রধান পুরোহিত। “তোমরা নগরকোট মন্দিরের মূর্তি ভাঙ্গনে শরীক ছিলে না বলেই দেবীরা তোমাদের উপর খুশি। মূর্তির অবমাননাকারী সুলতান থেকে তোমরা দূরে ছিলে।… এই দেবীরাও মূর্তির মতোই সুন্দরী। এদেরকেই পাথরের মতো মনে ৪ হবে। আমি তোমাদেরকে তাদের আসল রূপও দেখাবো।”

দেবীর প্রদর্শনী দেখে বুগরা খান ও আলাসতুগীন যখন তাদের কক্ষে এলো, তখন আলাসতুগীন বুগরা খানের উদ্দেশ্যে বললো, “আমরা জানতাম হিন্দুরা ভূত ওঁ পূজা করে, ওদের ধর্ম বাতিল ধর্ম। কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে এরা ইলমে গায়েব জানে।… আচ্ছা আমরা কিসের ইবাদত করি।”

যোগী-সন্ন্যাসী ও জাদুর প্রভাবে ইসলামের তাওহীদ সম্পর্কেই ওদের মনে সংশয় সৃষ্টি হয়। এরা হিন্দুদের দেব-দেবীকেই সত্য বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে। মানুষ তখনই পথভ্রষ্ট হয় যখন মনোদৈহিক সম্পর্ক ছিন্ন করে শুধুই দৈহিক তৃপ্তির মধ্যে ডুবে যায়। তখন শারীরিক প্রয়োজন পূরণের জিনিসকেই মানুষ মহা সত্য বলে বিশ্বাস করতে থাকে। এমন পর্যায়ে মানুষ জাদুটোনাকেই মুজিযা ভাবতে থাকে এবং ধোকা, প্রতারণা ও ফাঁকিবাজিকেই সত্যের মাপকাঠি বলে বিশ্বাস করে। মানুষ যে পরিমাণ প্রবৃত্তিপূজারী হয়, সেই পরিমাণে তার জ্ঞানবুদ্ধি লোপ পেতে থাকে এবং ভ্রান্তির মধ্যেই আত্মতৃপ্তি লাভ করে।

* * *

“অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, ওদের দেশে জাদুটোনা নেই।” সঙ্গীদের বললো থানেশ্বর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। নয়তো এরা এই কাজ দেখে এতোটা বিস্মিত হতো না। আমাদের দেশে কাউকে এভাবে গায়েব করে ফেলা খুবই সাধারণ ঘটনা।… এদেরকে আরো কিছু বিস্ময় দেখাও। আমার মনে হচ্ছে, এদেরকে এখন আমরা নিজেদের কাজে ব্যবহার করতে পারবো। এদের হাতে সুলতান মাহমূদকে খুন করাতে না পারলেও নগরকোটে অবস্থানকারী সেনাপতি ও অন্যান্যদের ঠিকই হত্যা করানো সম্ভব হবে।”

“জাদুর সাথে আমাদের ওষুধপত্রও কার্যকর ভূমিকা রাখবে”- বললো নেশাদ্রব্যের অভিজ্ঞ কবিরাজ। “ওদের এখন মেয়েদেরকে প্রেতাত্মারূপে দেখাবো।”

মন্দিরের বেদীতে দুটি চৌবাচ্চা ছিলো। এগুলোতে ফুলের নকশা করা কাপড় বিছিয়ে দেয়া হলো। চৌবাচ্চার পাশে লোবানের বাতি জ্বলছে। জ্বলন্ত লোবানের ধোয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে একেবেঁকে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে আর মূর্তিগুলোকে আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে। বাতিগুলো রাখা ছিলো মূর্তির নীচে ও পেছনে। তাতে মূর্তিগুলো আরো ঝকমকে মনোহরী দেখাচ্ছিলো।

সেই দুই তরুণী সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় চৌবাচ্চার মধ্যে দাঁড়ানো ছিলো। ওদের চোখ বন্ধ। কোন নড়াচড়া নেই। ঠিক মূর্তির মতোই ঠায় স্থির হয়ে দাঁড়ানো। লোবানের ধোয়ার কুণ্ডলী অপসারিত হয়ে ওদের চেহারা পরিষ্কার হয়ে উঠলে পুরোহিত সবাইকে মাথা নিচু করে মূর্তিকে সিজদা করার নির্দেশ দিলো। অন্যদের সাথে বুগরা খান ও আলসতুগীনও সিজদায় লুটিয়ে পড়লো।

সেই মূর্তি দর্শনের পর কুগরা খান ও আলাসতুগীনের ঈমানের শেষ চিহ্নটিও বিলীন হয়ে গেলো। তাদেরকে মদ-নারী ও নেশায় ডুবিয়ে রাখার সকল ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। জাদুটোনা আর শারীরিক আমোদ-ফুর্তির মধ্যে ওদের মাতিয়ে রাখা হলো। সন্ন্যাসী ও জাদুকররা যখন নিশ্চিত হলো, হিন্দুদের এসব ছলচাতুরীর রহস্য ভেদ করে ওদের পক্ষে তাওহীদের বিশ্বাসে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, তখন মন্দিরের পুরোহিতরা তাদের মনে সুলতান মাহমূদ সম্পর্কে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়াতে লাগলো।

“সুলতান মাহমূদ একটা ডাকাত, ধুনী, সন্ত্রাসী। সে হিন্দুস্থানে সুন্দরী নারী আর ধন-রত্ন লুট করতে আসে।” বলতে শুরু করলো পুরোহিত। বুগরা খান ও আলাসতুগীনের উদ্দেশ্যে বললো, “তোমরাই বলল, যে দেবীদের তোমরা দেখেছো, তোমরা কি তাদের অসম্মান করতে পারবে? যে দেবীরা তোমাদেরকে খুনাখুনি ও কঠিন জীবন থেকে উদ্ধার করে এমন শাহী জীবন দান করেছে, তাদের মূর্তিকে কি তোমরা নিজ হাতে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে পারবে? এখন তোমাদের জন্য এ আনন্দময় জীবনের সবচেয়ে বড় বাধা হলো সেই পাষণ্ড ডাকাত। সে যদি এখানে এসে মূর্তি ভাংতে শুরু করে, তাহলে তোমাদের শরীরে আগুন ধরে যাবে। যদি দেবদেবীর একটি অঙ্গ ভেঙ্গে যায়, তাহলে তোমাদের শরীরেরও অঙ্গ ভেঙ্গে যাবে। দেবদেবীদের কোন মৃত্যু নেই, তাই তোমাদেরও মরণ হবে না। কিন্তু তোমরা সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাবে। আর সেই দিনের মতো জঙ্গলে পড়ে পড়ে যন্ত্রণায় ধুঁকতে থাকবে, যেখান থেকে এ দেবীরা তোমাদের তুলে এনে সেবা-শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তুলেছিলো।”

“এখানেও কি সুলতান মাহমূদ আসবে?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো বুগরা খান।

“যদি এসেই পড়ে!” বললো পুরোহিত।

“ওকে আসতে দাও। এখানে এলে সে জীবন নিয়ে ফিরে যেতে পারবে না।” বললো বুগরা খান।

টানা চার-পাঁচ মাসে ওদের মধ্যে এমন পরিবর্তন ঘটলো, এরা নেশার যোরে কিংবা জাদুর প্রভাবে অবচেতন মনে হিন্দুদের অনুসারী হয়ে গেছে এমন ছিলো না। ওরা এখন স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের মতোই মন্দিরের বাইরেও ঘুরে বেড়াতো। তাদের মধ্যে কোন নেশাগ্রস্তের বাতিক ছিলো না। স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের মতোই ওরা হিন্দুত্ববাদে দীক্ষিত হয়ে গেলো।

একদিন বিকেল বেলায় একটি বাগানে পায়চারি করছিলো দু’জন। এমন সময় দূর থেকে আওয়াজ ভেসে এলো, “আলাসতুগীন…!”

নাম ধরে ডাক শোেনার কারণে উভয়েই চারপাশ তাকিয়ে দেখলো। এক সন্ন্যাসীরূপী সোককে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখলো। তার কালে সিঁদুর দিয়ে ওম’ লেখা। সন্ন্যাসীর মাথায় হিন্দু সন্ন্যাসীদের মতোই জটা আর সিঁদুরের আপনা আঁকা। সন্ন্যাসী কাছে এসে বললো, “আরে, তোমাদের ব্যাপারে তো আমাদের কিছুই বলা হয়নি। তোমরা এখানে কখন এলে, কোথায় থাকছে?”

“ওহ!” কিছুটা বিস্ময়মাখা কণ্ঠে বললো আলাসতুগীন। “তুমি উবায়দ না?”

এক সময় উবায়দ ও আলাসতুগীন একই সেনা ইউনিটে কর্মরত ছিলো। সেই সুবাদে একজন অপরজনকে চিনতো। উবায়দ ছিলো অভিজ্ঞ গেরিলা যোদ্ধা। সেই সাথে খুবই মেধাবী ও দুঃসাহসী। উবায়দ বুগরা খানকে চিনতে না। আলাসতুগীন বুগরা খানকে উবায়েদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। কিন্তু একথা বললো না, তারা এখানে কিভাবে এসেছে, কি করছে এবং কোথায় আছে। উবায়দকে পরবর্তীতে গোয়েন্দা বিভাগে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়। এদের দেখেও উবায়দ মনে করলো এদেরকেও হয়তো গোয়েন্দা কাজে পাঠানো হয়েছে।

“সুলতান কাছেই এসে গেছেন।” বললো উবায়দ। “তোমরা কি তার কাছে কোনো সংবাদ পাঠিয়েছে।”

“তুমি কি খবর পাঠিয়েছে?” জবাব এড়িয়ে গিয়ে পাল্টা উবায়দকে জিজ্ঞেস করলো আলাসতুগীন।

“আমাদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হলো, আগের মতো এই মন্দির রক্ষার জন্যও হিন্দুস্তানের অন্যান্য রাজা-মহারাজারা এখানে সৈন্য সমাবেশ ঘটাবে। কিন্তু যতোটুকু দেখতে পাচ্ছি এখনো অন্য জায়গা থেকে এখানে কোনো সৈন্য আসেনি। এখানে আগে থেকে যে সেনাবাহিনী ছিলো তাই রয়েছে।” বললো উবায়দ।

আলাসতুগীন আর উবায়দ গজনীর স্থানীয় ভাষায় কথা বলছিলো। সে উবায়দকে জানালো, বুগরা খানের সাথে সে মন্দিরের ভেতর পর্যন্ত ঢুকে গেছে এবং আপাদত মন্দিরের ভেতরেই অবস্থান করছে। ওরা যে সম্পূর্ণ বদলে গেছে এ ব্যাপারটি উবায়দকে মোটেও টের পেতে দিলো না। উবায়দকে তাদের ব্যাপারে অন্ধকারে রেখেই তারা জায়গা ত্যাগ করে মন্দিরের দিকে রওয়ানা হলো। আলাসতুগীন আরো জানালো, তারা উভয়েই হিন্দু সেজে মন্দিরের পুরোহিতদেরও ভক্ত বানিয়ে ফেলেছে।

উবায়দ যখন বাগান থেকে বেরিয়ে ফিরে যেতে লাগলো, তখন এক লোক তার মুখোমুখি হয়ে জানতে চাইলে, তুমি কো কোত্থেকে এসেছে? উবায়দ লোকটিকে একটি হিন্দুয়ানা নাম বলে দিলো এবং জানালো, আমরা কয়েকজন সন্ন্যাসী লাহোর থেকে এসেছি। জঙ্গলের মধ্যে আমরা তাঁবু টেনেছি, ওখানেই থাকি।

কিন্তু লোকটি উবায়দের কথা বিশ্বাস করতে পারলো না। তাকে সন্দেহ করতে লাগলো। সে ছিলো হিন্দুদের গোয়েন্দা বিভাগের লোক। বুগরাখান ও আলাসতুগীনকে দূর থেকে পাহারা দিতে এই গোয়েন্দা। গোয়েন্দা যখন দূর থেকে উবায়দকে আলাসতুগীনের সাথে কথা বলতে দেখলো, তখনই তার সন্দেহ হলো। তাই ওকে জানার জন্য তারা বাগান ছেড়ে যেতেই উবায়দের দিকে এগিয়ে এলো গোয়েন্দা।

উবায়দ যখন বললো, আমরা জঙ্গলে তাঁবু ফেলেছি, তখন লোকটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাদের তাঁবু দেখার জন্য প্রস্তাব করলো। উবায়দ তাকে সাথে নিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করলো। জঙ্গলের ভেতরে ঠিকই চার-পাঁচজন যোগী-সন্ন্যাসীরূপী লোক একটা তাবুতে অবস্থান করছিলো। কিন্তু উবায়দ এই গোয়েন্দাকে দেখাতে নিয়ে গিয়ে আর ফিরে আসতে দিলো না। তাঁবুতে পৌঁছা মাত্রই অন্যান্য সন্ন্যাসীরূপী লোকেরা উবায়দের ইঙ্গিতে লোকটিতে হাত-পা বেঁধে ফেললো। এরপর খঞ্জর বুকে ধরে উবায়দ জিজ্ঞেস করলো, কি কারণে আমার প্রতি তোর সন্দেহ হয়েছিলো, বল?

হিন্দু গোয়েন্দা কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানালো। এরপর ওর পায়ে দড়ি বেঁধে একটি গাছের সাথে ঝুলিয়ে নীচে আগুন ধরিয়ে দিলো। আগুনের তাপ গায়ে লাগতেই চিৎকার শুরু করলো হিন্দু গোয়েন্দা। সবকিছু বলবে বলে স্বীকার করলো। দড়ি খুলে নীচে নামালো ওকে। ধীরে ধীরে ওর সন্দেহ, গোয়েন্দাবৃত্তি এবং বুগরা খান ও আলাসতুগীন সম্পর্কেও সব কাহিনী বলে দিলো। গোয়েন্দা আরো জানালো, যেহেতু ওরা দু’জন গজনী বাহিনীর কমান্ডার এ জন্য তাদের পক্ষে সহজেই সুলতানের ধারে-কাছে যাওয়া সম্ভব। তারা হঠাৎ একদিন সুলতানের কাছে গিয়ে বলবে, তারা হিন্দুদের বন্দিদশা থেকে পালিয়ে এসেছে, তাই সুলতানের সাথে তাদের একান্ত জরুরী কথা আছে। এভাবে সুলতানের একান্ত সান্নিধ্যে গিয়ে তাকে হত্যা করবে।

হিন্দু গোয়েন্দার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদ্ধারের পর ওকে বেঁধে রাখলো উবায়দের গোয়েন্দা দল। তারা জঙ্গলের আরো ভেতরের দিকে চলে গেলো।

***

এদিকে বাগানে উবায়দের সাথে কথা বলে বুগরা খান ও আলাসতুগীন যখন মন্দিরে ফিরে গেলো, তখন দেখতে গেলো মন্দিরের লোকজন ব্যস্ত ও ভীতিকর পরিস্থিতি। জিজ্ঞেস করলে তাদের জানানো হলো, গজনীর সৈন্যরা থানেশ্বর মন্দির আক্রমণের জন্য আসছে। মন্দিরের পুরোহিত ও অন্যান্য লোকেরা মহারাজা আনন্দ পাল ও অন্যান্য হিন্দু রাজাদের সেনা দলের আগমনের অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলো। কিন্তু কোন হিন্দুরাজের সৈন্যদের এদিকে আসতে দেখা যাচ্ছে না।

থানেশ্বর মন্দিরের পুরোহিতদের জানা ছিলো না যে, সব রাজাদের কাছেই খবর পৌঁছে গেছে, সুলতান মাহমূদ থানেশ্বর মন্দির আক্রমণের জন্য আসছে। মুসলিম বাহিনী এ জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু সুলতানের অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে পৌঁছে যাওয়ার কথা তারা ভাবতেই পারেনি।

সুলতান ঝড়ের গতিতে সফর করছিলেন। থানেশ্বর মন্দির সাধারণ কোন পূজাশ্রম ছিলো না। এটি বেষ্টিত ছিলো বিশাল দুর্গ ও সেনা ছাউনী দ্বারা। সেনা শিবিরটিতে পরিপূর্ণ একটি সুসজ্জিত বাহিনী অবস্থান ছিলো। সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ করতে মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। থানেশ্বর মন্দিরের পৃথক গোয়েন্দা বিভাগ ছিলো। গোয়েন্দারা প্রধান পুরোহিতকে খবর দিলো, সুলতান মাহমূদ চলমান গতিতে অগ্রসর হলে আগামী একদিন এক রাতের মধ্যে থানেশ্বর পৌঁছে যাবে।

বুগরা খান ও আলাসতুগীন মন্দিরে গিয়ে জানালো, সুলতান মাহমুদের এক গোয়েন্দার সাথে তাদের সাক্ষাৎ হয়েছে। ওর সাথে আরো কয়েকজন রয়েছে। আগামীকাল আবার এদের একজন তাদের সাথে বাগানে দেখা করতে আসবে।

মন্দিরের সেনাপতি তাদেরকে বললো, তোমরা আগামীকাল সেই গোয়েন্দার সাথে দেখা করবে এবং ওদের সাথে গিয়ে ঠিকানা দেখে আসবে। যাতে ওদের ধরে শেষ করে দেয়া যায়। বুগরা খান ও আলাসতুগীনকে এ কথাও বলা হলো যে, তোমরা গোয়েন্দাদের ঠিকানা জেনে মুসলিম বাহিনীর দিকে চলে যাবে এবং নিজেদেরকে গোয়েন্দা পরিচয় দিয়ে বলবে, আমরা হিন্দুদের কয়েদখানা থেকে পালিয়ে এসেছি, সুলতানের সাথে একান্ত সাক্ষাতে আমাদের কথা আছে।

প্রায় এক বছর সময়কালে বুগরা খান ও আলাসতুগীন মুসলিম সালতানাতের সুরক্ষায় জিহাদী চেতনা লালনকারীর অবস্থান থেকে সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ হয়ে গিয়েছিলো। এই বিচ্যুতি ছিলো হিন্দুয়ানী চেতনার উপযোগী। এরা প্রশিক্ষিত জন্তুর মতোই অনুগত হয়ে গিয়েছিলো। হিন্দু পুরোহিতদের পাশবিক ভোগবাদিতা, মদ, নেশা, জাদুর প্রভাবে এরা মানবিকতার মর্যাদা থেকেও বিদ্যুৎ হয়েছিলো। তাদেরকে সেই দু’সুন্দরী তরুণীর মূর্তি দেখিয়ে ওদেরকে দেবীতে রূপান্তরিত করে মূর্তিপূজারীতে পরিণত করেছিলো। এরা কল্পনাও করতে পারেনি যে, সেই দু’তরুণীকেই চৌবাচ্চার মধ্যে মূর্তিরূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। চৌবাচ্চার চারপাশে ধূপ লোবান ও আগরবাতি এমনভাবে জ্বালানো হয়েছিলো যে, এসবের ধোঁয়ার কুণ্ডলীর কারণে তারা বুঝতেই পারেনি যে এরা ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছে।

এ পর্যায়ে তাদেরকে যখন বলা হলো, সুলতান মাহমূদ থানেশ্বর মন্দির লুট করতে ও ভাঙ্গতে আসছে। তখন বুগরা খান ও আলাসতুগীন ক্ষোভে অগ্নিরূপ ধারণ করলো।

এদিকে থানেশ্বর মন্দির সংলগ্ন সেনা শিবিরে হৈচৈ পড়ে যায়। তারা বিভিন্ন প্রতিরক্ষা মোর্চা ঠিক করতে শুরু করে। মন্দিরের ভেতরে-বাইরে সেনাদের দৌড়-ঝাঁপ শুরু হয়ে গেছে। শহরের মানুষের মধ্যে ভীতি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং শহরের সাধারণ লোকজনও তরবারী ও বর্শা নিয়ে মন্দির রক্ষার জন্য মন্দিরের প্রধান ফটকে জমায়েত হতে থাকে। সেনাবাহিনীর লোকেরা তাদের করণীয় সম্পর্কে দিক-নির্দেশনা দিচ্ছে এবং তাদেরকে বিভিন্ন দলে ভাগ করে দেয়।

এ দুর্যোগ মুহূর্তেও পরদিন বুগরা খান ও আলাসতুগীন উবায়দের সাথে সাক্ষাৎ করতে বাগানে চলে গেলো। তারা উভয়েই উবায়দকে মিথ্যা কাহিনী এবং অসত্য কার্যক্রমের গল্প শোনালো এবং প্রস্তাব করলো, আমাদেরকে তোমাদের আস্তানায় নিয়ে চলো। অবশ্য উবায়দ আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো যে, ওদেরকে ফুসলিয়ে হলেও আস্তানায় নিয়ে আসবে। কিন্তু এখন তারা নিজেরাই উবায়দের ইচ্ছা পূরণে আগ্রহী হয়ে উঠলো। তাতে উবায়দের লক্ষ্য অর্জন সহজ হয়ে গেলো। সে তাদের নিয়ে জঙ্গলের দিকে চলে গেলো।

উবায়দ আগেই সহকর্মীদের দিক-নির্দেশনা দিয়ে রেখেছিলো, বুগরা খান ও আলাসতুগীনকে এখানে নিয়ে এলে তাদের আটকে ফেলতে হবে। পূর্ব সিদ্ধান্ত মতো উবায়দ তাদের নিয়ে আস্তানায় পৌঁছা মাত্রই কয়েকজন তাদের ঝাঁপটে ধরে রশি দিয়ে হাত-পা বেধে ফেললো।

উবায়দ আশংকা করছিলো, গতকালের মতো আজও হয়তো ওদের অনুসরণকারী থাকতে পারে। তাই দ্রুত তারা সেই আস্তানা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়াটাকেই নিরাপদ মনে করলো। স্থান ছেড়ে আসার জন্য উবায়দের দল কমান্ডার বুগরা খান ও আলাসতুগীনের হাত বেঁধে পা খুলে দিলো এবং উভয়কে একই রশিতে বেঁধে একজন ধরে রাখলো যাতে পালাতে না পারে। আর হিন্দু গোয়েন্দাকে জঙ্গলের মধ্যে মেরে ফেললো।

খুব বেশি দূরে তাদের যেতে হয়নি। কয়েক মাইল পথ অগ্রসর হলেই গজনী বাহিনীর অগ্রবর্তী দলের দেখা পেলো। উবায়দ অগ্রবর্তী দলের কমান্ডারকে তাদের অপারেশনের কথা এবং সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করলে কমান্ডার উবায়দকে জানালো, তোমাদের আর অগ্রসর হওয়ার দরকার নেই। সুলতান কিছুক্ষণের মধ্যেই এখানে পৌঁছে যাবেন। উবায়দ আর অগ্রসর না হয়ে সেই স্থানেই অপেক্ষা করলো।

সুলতান মাহমুদ তার একান্ত নিরাপত্তা রক্ষীদের নিয়ে ঝড়ের বেগে থানেশ্বরের দিকে আসছিলেন। সুলতানের নিরাপত্তা রক্ষী দলের কমান্ডার পথিমধ্যে কয়েকজন সন্ন্যাসীরূপী লোককে দাঁড়ানো দেখে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তারা কেন পথিমধ্যে দাঁড়িয়ে আছে? কাছে এসে কমান্ডার দেখতে পেলো, এই সন্ন্যাসীরা আর কেউ নয়, তাদেরই গোয়েন্দা কমান্ডার উবায়দের দল। ইতিমধ্যে সুলতান সেই জায়গায় পৌঁছে গেলেন।

উবায়দ প্রথমেই সুলতানকে জানালো, থানেশ্বরে বাইরে থেকে কোন সেনাবাহিনী আসেনি এবং থানেশ্বর সেনা শিবিরের সৈন্যরা ছাড়াও শহরের বসিন্দারাও তাদের সাথে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। সেই সাথে জানালো, আমাদের সাবেক এই দুই কমান্ডারকে সুলতানকে হত্যার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিলো। সুলতানকে এদের আদিঅন্ত পুরো কাহিনী শোনালো উবায়দ।

“এদেরকে যেভাবে রেখেছে সেভাবেই রাখো। তবে কোন অবস্থাতেই ওদের কোন কিছু পানাহার করতে দিও না।ক্ষুধায় চেতনা হারালেও খেতে দিও না। তাহলে ওদের নেশা দূর হয়ে যাবে। তারপর ওদেরকে আমি সঠিক বাস্তবতা দেখাবো।” বললেন সুলতান।

সাবেক কমান্ডার দু’জন চোখ বড় বড় করে হতবাক হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। সুলতান উবায়দের কাছ থেকে সার্বিক পরিস্থিতির রিপোর্ট নিয়ে সৈন্যদের নিয়ে এগিয়ে চললেন।

গতির প্রতিযোগিতায় সুলতান বিজয়ী হলেন। থানেশ্বর মন্দিরের সেনা কমান্ডাররা দেখলো রাজা-মহারাজাদের বাহিনী পৌঁছার আগেই সুলতান তার সৈন্যদের নিয়ে থানেশ্বর পৌঁছে গেছেন। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, সুলতান মাহমূদের ক্ষিপ্র গতিময়তায় থানেশ্বরের সকল হিন্দু বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো । আসলে গতিময়তা ছিলো সুলতান মাহমুদের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। এ ক্ষেত্রেও তিনি হিন্দু সৈন্যদের আগে পৌঁছার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সুলতান থানেশ্বর পৌঁছে আগে হিন্দুদের প্রতিরোধ কৌশল পর্যবেক্ষণ করে অবরোধ না করে সরাসরি আঘাত হানার নির্দেশ দিলেন। সুলতানের নির্দেশে গজনী বাহিনীর তীরন্দাজ ইউনিট শহর প্রাচীরের উপর এমন তীব্র তীরবৃষ্টি বর্ষণ করলো যে, প্রতিরোধকারী সৈন্যরা আর মাথা তোলার সুযোগ পেলো না। শহর প্রাচীরের প্রধান ফটক ভেঙ্গে ফেললো গজনী বাহিনীর দুঃসাহসী বীর সৈন্যরা। হিন্দু বাহিনীর মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সুলতান শহরে ত্রাস সৃষ্টির নির্দেশ দিলেন। মুসলিম সৈন্যরা শহরে প্রবেশ করেই ব্যাপক ভাংচুর করে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করলো। হিন্দু নাগরিক তো দূরের কথা, সৈন্যরা জীবন বাঁচানোর জন্য দিকবিদিক ছুটাছুটি করতে শুরু করলো।

সুলতান মাহমূদ মন্দিরের সকল মূর্তি বাইরে বের করে প্রকাশ্য রাস্তার উপর ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু থানেশ্বর মন্দিরের সবচেয়ে বড় মূর্তি ও বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী বিষ্ণু মূর্তিকে না ভেঙ্গে অক্ষত রাখার নির্দেশ দিলেন সুলতান। এই বিষ্ণু মূর্তির জন্যই সারা হিন্দুস্তানে থানেশ্বর মন্দির বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলো। সুলতান বিষ্ণু মূর্তিকে অক্ষত অবস্থায় গজনী নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। থানেশ্বর বিজয়ের পর গজনী ফেরার সময় বিষ্ণু মূর্তিকে গজনীর সৈন্যরা বহন করে নিয়ে গেলো। সমকালীন একজন ঐতিহাসিকের বর্ণনা থেকে জানা যায়, গজনীর রেসকোর্স ময়দানে থানেশ্বর মন্দিরের অহংকার বিষ্ণু মূর্তিকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়। আর ঘোড়ার পায়ের আঘাতে আঘাতে তা গজনীর ধূলো-বালির সাথে মিশে যায়।

থানেশ্বর মন্দির ও শহরের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেয়ার পর সুলতান গোয়েন্দা কমান্ডার উবায়দকে নির্দেশ দিলেন ধৃত বুগরা খান ও আলাসতুগীনকে তার কাছে নিয়ে আসতে।

বুগরা খান ও আলাসতুগীনসহ সকল যুদ্ধবন্দীকে সুলতানের সামনে এনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হলো। বন্দীদের প্রথম সারিতে ছিলো ধৃত দুই সাবেক কমান্ডার, মন্দিরের পুরোহিত দল ও সন্নাসী-জাদুকরদের শীর্ষ ব্যক্তিসহ সেই তরুণীদ্বয় এবং মন্দিরের নর্তকী-সেবিকারা।

সুলতান বন্দী বুগরা খান ও আলাসতুগীনকে নির্দেশ দিলেন, তোমাদের পূজনীয় এই দুই তরুণীকে দেখো। আর ওদের থেকে তোমাদের দেবীদের আলাদা করে ফেলল। উভয়েই হতবাক হয়ে দেখলো। তারা যে দুই তরুণীর প্রেমে পড়ে ওদেরকে স্বর্গের অপ্সরা ভেবে পূজা করতে শুরু করছিলো, এরা দিব্যি সশরীরে তাদের সামনে বন্দী অবস্থায় দণ্ডায়মান। সুলতান জাদুকরকে নির্দেশ দিলেন, এই তরুণীদ্বয়কে তোমার জাদু দিয়ে চৌবাচ্চার মধ্যে গায়েব করে দাও। এরপর গায়েব থেকে এদেরকে আবার বাস্তবে হাজির করো।

দু’টি চৌবাচ্চা নিয়ে আসা হলো। এক জাদুকর এগিয়ে এসে তরুণীদ্বয়কে ধরে এনে চৌবাচ্চার মধ্যে বসিয়ে দিলো এবং একটু পর সবাই দেখলো চৌবাচ্চা সম্পূর্ণ খালি, সেখানে কিছু নেই। একটু পর সেই জাদুকর খালি চৌবাচ্চা থেকেই আবার তরুণীদ্বয়কে বের করে আনলো।

“এটা হিন্দুস্তানের হাজারো জাদুর মধ্যে খুবই সাধারণ একটা জাদু।” বললেন সুলতান। “হিন্দুদের ধর্ম টিকেই আছে জাদু ও রহস্যময়তার অন্ধকারে। আসলে এই পৌত্তলিক ধর্মটার মূল জিনিসই শরীর কেন্দ্রিক। আত্মার সাথে পৌত্তলিকতার কোন সম্পর্ক নেই। ভোগবাদিতা ও রমণলীলা হিন্দু ধর্মের প্রধান উস।”

সন্ন্যাসী, জাদুকর ও পুরোহিতদের উদ্দেশ্যে সুলতান বললেন, “আমি তোমাদের দেবদেবীদের মূর্তি ভেঙ্গে ফেলেছি। ওদেরকে বলো না, আমার উপর তাদের অভিশাপের মুসীবত চাপিয়ে দিতে।”

বিস্ময় ও হতবাক হয়ে বুগরা খান ও আলাসতুগীন সবকিছু দেখছিলো। ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় তখন তাদের দেমাগ থেকে নেশার প্রভাব অনেকটাই বিলীন হয়ে গেছে। সুলতান আবেগময় সম্মোহনী ভাষায় বক্তৃতা করছিলেন। ঠিকই সেই সময়ে মন্দির চূড়া থেকে ভেসে এলো আযানের সুমধুর মনোমুগ্ধকর ধ্বনি ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার’। সুলতান থেমে গেলেন। বুগরা খান ও আলাসতুগীনের শরীর ততোক্ষণে পাপের অনুভূতিতে নিঝরে কাঁপতে শুরু করেছে, আর তাদের দু’চোখে গড়িয়ে পড়ছে অনুশোচনার পাপানল।

আযান শেষ হলে সুলতান সাবেক দুই সেনা কমান্ডারকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তোমাদের আজ আমি কোন শাস্তি দেবো না। তোমরা জীবন নিয়ে স্বাধীনভাবেই বেঁচে থাকো। সকল মুসলমানকে জানিয়ে দাও যে, আমাদের শক্ররা তোমাদের মতো তুখোড় যোদ্ধাদেরকে শুধু তলোয়ার দিয়েই আঘাত করে না, ওদের হাতে এমন ধারালো অস্ত্র রয়েছে যা দিয়ে তারা কোন মুসলিম সেনাপতির অন্তর কেটে দিতে পারে, ঈমান নষ্ট করে দিতে পারে, ইসলাম-মুসলিম জাতীয়তা ও ঐতিহ্য ভুলিয়ে দিয়ে বাতিলের সেবাদাসে পরিণত করতে পারে।“

* * *

সাপ স্বর্ণ ও মানুষ

ঐতিহাসিক ফারিশতা লিখেন, ৮০২ হিজরী মোতাবেক ১০১১ খৃস্টাব্দে সুলতান মাহমূদ থানেশ্বর মন্দির জয় করে যখন গজনী ফিরে এলেন, তখন গজনীকে দেখে হিন্দুস্তানের কোন শহর মনে হতো। কারণ, গজনীর অধিবাসী ও সৈন্য সংখ্যা খুব বেশি ছিলো না। কিন্তু প্রতিবারই অভিযান শেষে হিন্দু যুদ্ধবন্দীদের গজনী নিয়ে আসতেন সুলতান। কিন্তু থানেশ্বর যুদ্ধে হিন্দু যুদ্ধবন্দির সংখ্যা দাঁড়ায় দুই লাখের উপরে। সে সময় যুদ্ধবন্দিদেরকে দাস-দাসীতে পরিণত করা হতো এবং সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধলব্ধ সম্পদের (গনীমতের) মতোই পদ অনুযায়ী তাদের বন্টন করে দেয়া হতো।

গজনী ফিরে সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধলব্ধ মালে গনীমত বণ্টনসহ যুদ্ধবন্দিদের বণ্টন করে দেয়ার পর সুলতান সকল সেনা সদস্যের উদ্দেশ্যে বললেন, যুদ্ধবন্দি গোলামদের সাথে কেউ এমন ব্যবহার করো না যে, এরা বাকি জীবন নিজেদেরকে জন্তু-জানোয়ারের মতোই কাটাতে বাধ্য হয়। ওদেরকে ইসলামী রীতি-নীতি সম্পর্কে অবহিত করো। ওদের ভাগ্যকে তোমরা সদোত্তর দিয়ে এভাবে বদলে দাও যাতে তারা শুধু আপনজন ও জাতি-ধর্মকেই ভুলে যায় না, সাগ্রহে ইসলামে দীক্ষা নেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। সব মিলিয়ে তখন যুদ্ধবন্দির সংখ্যা দুলাখ ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। ফলে এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে গোলামে পরিণত করে না রেখে ওদেরকে মুসলিম সমাজের মূল ধারায় লীন করে দেয়ার জন্য কঠোর নির্দেশ জারি করলেন। এর ফলে অবস্থা এই দাঁড়ালো যে, অল্প দিনের মধ্যেই বিপুলসংখ্যক হিন্দু গোলাম ইসলাম গ্রহণ করে স্বাধীনতা লাভ করলো।

ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, সুলতানের দূরদর্শী এই সিদ্ধান্তের ফলে গোলামী থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত হিন্দুদেরকে নওমুসলিম হিসেবে সমাজের মূল ধারায় মিশে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হলো। এক পর্যায়ে সুলতান নওমুসলিমদের সমন্বয়ে সেনাবাহিনীর আলাদা একটি রেজিমেন্ট গঠন করেন। তাছাড়া সুলতানের অধীনে একটি হিন্দু রেজিমেন্টও ছিলো। যার কমান্ডারও ছিলো হিন্দু। সুলতান মাহমূদের প্রশাসনিক কাজেও হিন্দুদেরকে অফিসার পদে নিযুক্ত করেছিলেন এবং মুসলমানদের তুলনায় হিন্দু আমলাদের বেশি সুযোগ-সুবিধা দিতেন। হিন্দু সেনাদেরকে তিনি কখনো ভারত অভিযানে ব্যবহার করতেন না। পার্শ্ববর্তী মুসলিম শাসকদের মোকাবেলায় হিন্দু রেজিমেন্টকে ব্যবহার করতেন সুলতান।

থানেশ্বর বিজয়ের পর বিপুল সংখ্যক বন্দী নিয়ে রাজধানীতে ফিরে আসার পর সেই রাতে গজনীতে প্রথম রাতের বেলায় সৈন্য ও সাধারণ নাগরিকরা আনন্দে মেতে উঠলো। রাতে গজনীর রেসকোর্স ময়দানে সমবেত সৈন্য ও শহরবাসী আতশবাজি পোড়ালো। মানুষ পরম বিজয় উৎসবে মেতে নাচতে লাগলো। শহরের অলিগলি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লো আনন্দের বন্যা। অবস্থা এমন হলো যে, গজনীতে যেনো রাত নামেনি। চতুর্দিকে আলোকসজ্জা ও আতশবাজিতে রাতের গজনী কোলাহলে মুখরিত হয়ে উঠলো।

থানেশ্বর মন্দিরের সবচেয়ে বড় বিষ্ণু মূর্তিকে ঘোড়ার টানা গাড়িতে তুলে শহরময় প্রদর্শনী করা হলো। লোকজন মূর্তিতে থু থু ছিটিয়ে দিলো আর খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মূর্তির সুন্দর গায়ে ক্ষত সৃষ্টি করছিলো। এরপর বিশালাকার বিষ্ণু মূর্তিকে রেসকোর্স ময়দানে নিয়ে আসা হলো। সেখানে সমবেত হাজার হাজার সৈনিক-জনতার সামনে সেটিকে ভেঙ্গে ফেলা হলো। সে সময় সকল হিন্দু বন্দিকেও ময়দানে নিয়ে আসা হলো, যাতে দর্শকদের সাথে তারাও তাদের দেবতার করুণ পরিণতি স্বচোখে দেখতে পারে। বন্দিদের উদ্দেশ্যে এক ঘোষক বললো, দেখো, এটা নিছক একটা পাথরের তৈরি বিগ্রহ মাত্র। এটা কোন মতেই দেবতা হতে পারে না। এটা তোমাদের ধর্মের পুরোহিতদের তৈরি প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়। এসব মূর্তির মধ্যে যদি কোন দেবতার শক্তি থাকতো তাহলে এতোক্ষণে আমাদের সবাইকে ধ্বংস করে দিতো।

‘আল্লাহু আকবার, ইসলাম জিন্দাবাদ, পৌত্তলিকতা মুরদাবাদ’ শ্লোগানে শ্লোগানে রাতের আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠলো আর হিন্দু কয়েদীরা মর্মজ্বালা নিয়ে নীরবে তাদের দেবতার করুণ পরিণতি প্রত্যক্ষ করলো। সেই রাতে গজনী শহরে যে আনন্দ-উল্লাস ও হৈ-হুঁল্লোড়ে বিজয় উৎসব অনুষ্ঠিত হলো, গজনী শহরে এমনটি আর কখনো ঘটেনি। মুসলমানদের বাড়িঘরও ছিলো উল্লাসমুখর। কিন্তু এতোসব আনন্দ উৎসব সত্ত্বেও একটি মহল ছিলো সম্পূর্ণ নিস্তরঙ্গ। সেই মহলে যিনি অবস্থান করছিলেন, এতো আনন্দ-উৎসবেও তিনি ছিলেন চিন্তাৰিত। আনন্দ-উৎসবে যোগ না দিয়ে তিনি নিজের একান্ত কক্ষে একাকী বসে ছিলেন। দুর্ভাবনা ও দুশ্চিন্তায় তার চেহারা ছিলো মলিন। এমন সময় তার কক্ষে উপস্থিত হলো দুই লোক। তারা তাকে যথাবিহিত সম্মান প্রদর্শন করে পাশে উপবেশন করলো। এরা ছিলো গজনী বাহিনীর দুই গোয়েন্দা প্রধান আর মহলে অবস্থানকারী ব্যক্তিটি ছিলেন বিজয়ের প্রধান নায়ক সুলতান মাহমুদ। তিনি বিজয় উৎসবে যোগ না দিয়ে তার দুই গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে ডেকে গজনীর প্রতিবেশী মুসলিম শাসকদের কর্মতৎপরতার খোঁজ-খবর নিচ্ছিলেন।

দ্বিতীয় খণ্ড সমাপ্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *